3 of 4

৪.৪০ দজ্জাল বিবির অত্যাচারে দেশত্যাগী মারুফ-মুচির ভাগ্য-বিবর্তন

কাইরো শহরে এক সময়ে এক নিষ্ঠাবান দরিদ্র মুচি বাস করতো। পুরোনো জুতো মেরামত করে কোনরকম কায়-ক্লেশে জীবিকা নির্বাহ করতো। তার পয়সা ছিলো না সত্যি, কিন্তু সততা ও সারল্যের জন্য বহু বিত্তবানরাও তাকে হিংসে করতো।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এ রকম এক নিরীহ মানুষের ভাগ্যে জুটেছিলো এক খাণ্ডারণী বৌ। তার মতো পরশ্রীকাতর কুচুটে মুখরা নীচ প্রকৃতির নারী বড় একটা দেখা যায় না। তার অমানুষিক অত্যাচারে অসহায় স্বামীটি সদাই ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো।

মুচির নাম মারুফ। তার বৌ ফতিমা।

একদিন ফতিমা এসে স্বামীকে বললো, শোনো, আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় আমার জন্যে। খানিকটা কুনাফা হালওয়া নিয়ে এস। হা, হালওয়াটা যেন মধু দিয়ে মাখিয়ে আনতে ভুলো না। আমি আবার চিনির রসফস পছন্দ করি না।

মারুফ বিনীতভাবে বলে, শোনো চাচার মেয়ে! হাতে এখনও একটা দিরহাম নাই। তবে আশা করছি আল্লাহ আজ দেবেন। যদি পাই তবে তোমাকে কুনাফা খাওয়াবো আজ।

ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ফতিমা, তোমার ঐ সব বুজরুকির বাক্যি আমি শুনতে চাই না। রোজগার করতে পারবে কি পারবে না, সে আমার দেখবার নয়। আমি তোমাকে যা হুকুম করলাম তা আমার চাই-ই। তা সে তুমি চুরি করে আন বা রোজগার করে আন আমার জানতে ইচ্ছে নাই। কিন্তু কুনাফা না নিয়ে যদি খালি হাতে ঘরে ফেরো তবে তোমার বরাত খুব খারাপ হবে, এই বলে দিলাম। তোমার ঐ আল্লাহ-ফাল্লাহর দোহাই আমি শুনবো না তখন।

মারুফ মৃদু প্রতিবাদ করতে যায়, আহা অমন করে বলো না বিবিজান, আমরা সবাই তো তারই করুণায় বেঁচে আছি। তিনি না জোটালে কার সাধ্য জোটাতে পারে।

–ও সব ফালতু কথা রাখ, অক্ষম অপদার্থরাই ও সব বলে। যাই হোক, আমার সাফ কথা, কুনাফা আমার চাই

এই বলে সে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। মারুফ বাজারে গিয়ে তার ছোট্ট দোকানটা খুলে খদ্দেরের প্রত্যাশায় বসে রইলো। কিন্তু এমনই পোড়া কপাল, সারাটা দিনে কেউ এলো না তার কাছে। একটা দিরহামও রোজগার হলো না।

ফতিমার লাঞ্ছনার ছবি মনে ভাসতেই আতঙ্কে আঁৎকে উঠলো সে। কুনাফা দূরে থাক রাতের রুটি-সজীই বা জোগাড় হবে কি করে?

বাড়ির পথে চলতে থাকে, কিন্তু পা আর চলে না। এক সময় সে বাজারের বড় মেঠাই-এর দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। হতাশ হয়ে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে দোকানের সাজানো মিঠাই মণ্ডার থালাগুলোর দিকে।

দোকানী বৃদ্ধ সদাশয় ব্যক্তি। মুচি মারুফকে সে বিলক্ষণ জানে। তার মতো সৎ এবং সত্যনিষ্ঠ মানুষ এ শহরে খুব বেশি নাই, সেকথা কেই বা না জানে? কাছে এগিয়ে এসে দোকানী মারুফকে জিজ্ঞেস করে, কি মারুফভাই, কিছু নেবে ভাবছো?

মারুফ আরও মুষড়ে পড়ে, হ্যাঁ বাড়ি থেকে বেরুবার সময় বিবি বলেছিলো কুনাফা নিয়ে যেতে। কিন্তু আল্লাহ আজ একটি আধলাও আমার জন্যে বরাদ্দ করেননি। তাই খালি হাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে।

দোকানী আরও কাছে এগিয়ে এসে বলে, সে কি কথা, না হয় নাই হয়েছে রোজগার, তা বলে ঘরের বিবি সাধ করে একটা জিনিস খেতে চেয়েছে তা সে খেতে পাবে না, তা কি হয়? আমি। যখন জেনেছি, তখন আর তোমার ও নিয়ে দুর্ভাবনা করার কারণ নাই, মারুফভাই।

তোমার বিবিজান কতটা খেতে পারবে কুনাফা নিয়ে যাও আমার দোকান থেকে। পয়সার জন্য খুঁতখুঁত করো না। সে তুমি যে দিন বাড়তি রোজগার করতে পারবে দিয়ে যেও। তোমার মতো মানুষকে একটু খুশি করতে পারাও তো সৌভাগ্যের কথা মারুফভাই।

একটা ভারি বোঝা মাথা থেকে নেমে গেলো, মারুফ দোকানের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালো।

আমাকে এক পোয়া কুনাফা দাও তাহলে। দোকানী হালওয়ার রেকাবীতে জমানো কুনাফার চাকে ছুরি বসিয়ে একটা চাই কেটে তুলে পাল্লায় চাপিয়ে দেয়।

মারুফ বলে, কুনাফাটুকু মধু মাখিয়ে দাও ভাইসাব।

দোকানী বলে, মধু আজ ফুরিয়ে গেছে, যাই হোক ঘন চিনির সিরায় ডুবিয়ে দিচ্ছি। খেতে মধুর চেয়ে খারাপ লাগবে না। আমার বেশির ভাগ খদ্দেরই তো মধু ছেড়ে চিনির সিরাই পছন্দ করে।

মারুফ আমতা আমতা করে বললো, বেশ তাই দাও। বাড়ির দরজায় পা রাখতেই ছুটে আসে জাঁহাবাজ ফতিমা।

—কই, কই আমার কুনাফা কই? হালওয়ার মোড়কটা বাড়িয়ে ধরতেই বাজের মতো ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে সে ঘরে ঢুকে যায়। এবং একটুক্ষণ পরে আবার সে গাঁক গাঁক করে তেড়ে আসে মারুফের দিকে।

-এই তোমার মধুর কুনাফা! আমি না তোমাকে বলেছিলাম মধু মাখিয়ে আনবে? কিন্তু তা এনে এই ছাইপাঁশ চিনির সিরায় চুবিয়ে এনেছ কেন? এ কি কোনও মানুষে মুখে দিতে পারে?

এই বলে সে কুনাফাসুদ্ধ রেকাবীখানা ছুঁড়ে মারে মারুফের মাথায়। এবং এতেও সে ক্ষান্ত হয়, বাঘিনীর মতো সে ঝাপিয়ে পড়ে স্বামীর ওপর। এক হাতে চুলের মুঠি ধরে আর এক হাতে কিল চড় ঘুষি চালাতে থাকে বেপরোয়াভাবে।

রেকাবীর আঘাতে মারুফের একটা দাঁত ভেঙ্গে যায়। ঠোঁট বেয়ে গল গল করে রক্ত পড়তে থাকে। স্বাভাবিক কারণেই সেও কিঞ্চিৎ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। স্ত্রীকে মুক্ত করার জন্য ঈষৎ বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয় মারুফ। এর ফল আরও মারাত্মক হয়। ফতিমা প্রতিহত হয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ে, ওগো কে কোথায় আছ গো, রক্ষা কর এই শয়তানটা আমাকে মেরে ফেললো—

নারী-কণ্ঠের আর্তনাদে পাড়া-পড়শীরা ছুটে এসে স্বামী-স্ত্রীর ইত্যাকার লড়াই দেখে লজ্জাহত হয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে।

মারুফ স্ত্রীর আঘাত সামলাবার জন্য ফতিমার হাত মুষড়ে ধরেছিলো। তার ফলে ওর হাতের একটা আঙ্গুল গেছে ভেঙ্গে। আর ফতিমার রেকাবীর আঘাতে মারুফ হারিয়েছে একট দাঁত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার মুখ ও বুক।

পাড়া-পড়শীরা এই রকম একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কিভাবে মোকাবিলা করবে ভেবে পায় না।

বিবাদের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রতিবেশীরা জানতে পারে মধুর বদলে চিনির রসের কুনাফা আনা হয়েছে বলেই এমন অঘটন ঘটেছে।

প্রতিবেশীরা ফতিমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, মধুর চেয়ে চিনির সিরা মাখানো কুনাফা খেতেই বেশী ভালো। এতে মারুফের কসুর কিছু হয়নি। আমরা তো সবাই চিনির রসের কুনাফাই খাই। এতে এতো ক্রোধের কি কারণ হতে পারে? আর কি জন্যে বা তুমি তার একটা দাঁত ভেঙ্গে দিলে, ভালো মানুষের মেয়ে? ছিঃ ছিঃ এ তোমার দারুণ অন্যায়–দারুণ অন্যায়!

এই বলতে বলতে পড়শীরা বিদায় নিলো।

আগন্তুকরা চলে যাওয়ার পর ঘরের দাওয়ার এক পাশে বসে গজরাতে থাকে ফতিমা, হুম, পাড়ার লোককে তুমি আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছো? ঠিক আছে, দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি!

হিংস্র বাঘিনীর মতো রক্তচক্ষু মেলে সে তম্বি করতে থাকে। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কুনাফার টুকরোগুলো কুড়িয়ে জলে ধুয়ে একটা রেকাবীতে সাজিয়ে আবার মারুফ স্ত্রীর সামনে ধরে সোহাগ জানিয়ে আস্তে আস্তে বলে, আহা, রাগ করে কি হবে, নাও খেয়ে নাও। কাল তোমাকে আমি আবার মধু মাখা কুনাফা এনে দেব।

কিন্তু ফতিমা এক লাথি মেরে মারুফকে নিচে ফেলে দেয়, দূর হও আমার সামনে থেকে। তুমি কি ভেবেছ তোমার এই অখাদ্য হালওয়াটা আমি বসে বসে গিলবো? আমার নাম ফতিমা, এই তোমায় আমি বলে রাখলাম, কালকের মধ্যেই তোমাকে আমি শেষ করবো।

মারুফ আর ঘাঁটাতে সাহস করলো না ফতিমাকে। নিজেই সে হালওয়ার টুকরোগুলো বেশ তৃপ্তি করে গলাধঃকরণ করলো।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মারুফ তৈরি হয়ে দোকান খুলতে চলে গেলো তাড়াতাড়ি। আল্লাহ আজ হয়তো তাকে বঞ্চিত করবেন না। সে মনে মনে ভাবলো, আজ যা পয়সা পাবে তার সবটা দিয়ে সে বিবির জন্য মধুর হালওয়া কিনে নিয়ে যাবে।

কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও কোন খদ্দের এলো না দোকানে। খদ্দের এলো না, কিন্তু দু’জন সিপাই এসে দাঁড়ালো যমদুতের মতো।

—চলো, কাজী সাহেবের এজলাসে যেতে হবে তোমাকে।

সিপাই দুটো মারুফকে হাতকড়া পরিয়ে টানতে টানতে কাজীর আদালতে নিয়ে গিয়ে হাজির করলো। মারুফ দেখতে পেলো পূর্বাহ্নেই তার বিবি ফতিমা হাজির হয়েছে সেখানে। তার একখানা হাত ন্যাকড়া জড়িয়ে বাঁধা। তাতে খানিকটা লাল লাল ছোপও দেখা যাচ্ছিল। ফতিমার অন্য হাতের আঙ্গুলে ধরা একটা ভাঙ্গা দাঁত।

ভীত চকিত মারুফকে দেখে গর্জে উঠলেন কাজী সাহেব, ওই বেশরম বেতমিজ এদিকে এসো, তোমার কি প্রাণে একটুও ডর নাই? এই অসহায় দুর্বল নারীর ওপর তুমি নির্মম নির্যাতন চালিয়েছ? তার হাত ও দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছ? এতো বড় স্পর্ধা তোমার?

অভিযোগ শুনে মারুফ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এমন ডাহা মিথ্যার সে কি জবাব দেবে? ঐ ভাঙ্গা দাঁতটা তো তারই নিজের! অথচ ফতিমা সেটাকে তার নিজের বলে চালিয়েছে কাজীর কাছে?

মারুফকে নিরুত্তর থাকতে দেখে কাজীসাহেব ভেবে নিলেন, অভিযোগ পুরোপুরি সত্য, স্বামীটারই এই সব কাণ্ড!

তৎক্ষণাৎ তিনি জাদকে হুকুম করলেন, লোকটা বদমাইশ, ওকে একশ, ঘা বেত লাগাও।

কাজীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে তালিম করা হলো তখুনি। এই নিষ্ঠুর বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়ে অসহায় আর্তনাদে লুটিয়ে পড়লো মারুফ। আর সেই দুষ্ট শয়তান মেয়েছেলেটার চোখ দুটো খুশিতে লকলক করে নাচতে থাকলো।

আদালত থেকে বেরিয়ে ব্যথা-বিষ-জর্জরিত নিজের দেহটাকে কোনও রকমে টানতে টানতে এক সময়ে সে নীল নদের উপকূলে এক পোড়োবাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে আশ্রয়। নিলো। দেহের ক্ষতগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখের জল আর রোধ করতে পারে না সে।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, না না, আর কখনও সে ঘরে ফিরে যাবে না ঐ জহাদ মেয়েছেলেটার কাছে। তার জন্যে যদি বেঘোরে পড়ে তাকে মরতেও হয় মরবে সে।

এই পোড়োবাড়িতেই সে দু’দিন পড়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে উঠে নদীর ঘাটে গিয়ে একটা চালানী নৌকোয় চেপে বসলো। এবং যথাসময়ে নৌকোখানা তাকে পৌঁছে দিলো দামিয়েত্তায়। সেইখানেই সে বন্দরের মুটের কাজ করে কোনও রকমে দিন গুজরান করতে থাকলো।

এরপর জাহাজের কাপ্তেনের সুনজরে পড়ে একদিন সে খালাসীর চাকরী পেলো। তখন থেকে শুরু হলো তার সমুদ্র-জীবন।

জাহাজের খালাসী হয়ে সে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। কত নতুন নতুন শহর বন্দর, কত না বিচিত্র মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে।

বড় সুখেই কাটছিলো দিন। কিন্তু একদিন সব বিপর্যস্ত হয়ে গেলো। ঘূণী ঝড় উঠলো সমুদ্রে। সেই ঝড়ের দাপটে কাঠের জাহাজখানা খান খান হয়ে গেলো পলকে। সমুদ্র তখন উত্তাল। সঙ্গী-সাথীরা কে যে কোথায় তলিয়ে গেলে কিছুই হদিশ করতে পারলো না মারুফ! অবশ্য তখন আত্মরক্ষা ছাড়া অন্যদিকে খেয়ালই বা কে রাখতে পারে?

মারুফের বরাতের জোর, সে প্রাণে রক্ষা পেয়ে গেলো কোনও ক্রমে। ঐ প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মধ্যেও সে ভাঙ্গা জাহাজের এক খণ্ড কাঠ ভাসতে দেখে আঁকড়ে ধরতে পারলো। এবং সেই কাঠের সাহায্যে ভাসতে ভাসতে অবশেষে একদিন এসে পৌঁছলো এক সমুদ্র উপকূলে।

যতক্ষণ তীরের সন্ধান মেলেনি ততক্ষণ মারুফ প্রাণপণে পা চালিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলেছিলো। আহার নিদ্রা নাই, অথচ অমিত শক্তি সাহস এবং সহনশীলতার কোনও ঘাটতি ঘটেনি এই কদি। কিন্তু কি আশ্চর্য! তীরে পৌঁছানোমাত্র কোনও রকমে নিজের দেহটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে সে তরীভূমিতে বালির বিছানায় ঢেলে দিতে পেরেছিলো মাত্র। তারপর আর তার কিছুই মনে নেই।

ঘুম ভাঙ্গলো মারুফের। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে এক জমকালো সাজ-পোশাকে সজ্জিত এক প্রিয়দর্শন যুবক।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো বাষট্টিতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

—খোদা মেহেরবান, আপনি কে মালিক, এইখানে এইভাবে পড়ে রয়েছেন? যুবকের প্রশ্নের উত্তরে মারুফ তার দুঃখের কাহিনী শোনায় তাকে। সে বলে, আপনি চলুন আমাদের শহরে। আমাদের বাড়িতে। সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম করে সুস্থ হতে পারবেন। আচ্ছা, আপনার দেশ কোথায় জনাব? দেখে মনে হচ্ছে আপনি মিশরের মানুষ।

-আপনি ঠিকই ধরেছেন, মালিক।

–কাইরো শহরে আমার বাড়ি।

—কাইরো? কাইরোর কোন মহল্লায়?

মারুফ বলে লাল পথ জানেন? ঐ লাল পথে আমার ঘর।

—আপনি কি করতেন সেখানে? ওখানকার কাকে কাকে চেনেন?

—আমার জাত-ব্যবসা জুতো তৈরি করা। অতি দরিদ্র সাধারণ মানুষ আমি। আমার যারা পরিচিত তারা সবাই সাধারণ মানুষ, কেউ-কেটা নয় কেউ। যদি জানতে চান তাদের অনেকের নামই আমি বলতে পারি আপনাকে।

এই বলে সে তার পাড়া-পড়শীদের অনেকের নামই গড়গড় করে বলে গেলো।

যুবক প্রশ্ন করলো, আচ্ছা শেখসাহেব, আপনি ওখানকার শেখ আহমেদকে জানেন? আতর বিক্রি করেন?

—খুব চিনি। তিনি তো আমারই প্রতিবেশী! একেবারেই পাশাপাশি বাড়ি। বলতে গেলে ওদের বাড়ি আমার বাড়ির মধ্যে একটা মাত্র দেওয়ালের ফারাক।

যুবক জানতে চায়, তিনি কি ভালো আছেন?

—খোদার কৃপায় ভালোই আছেন মালিক।

-এখন তার কটি ছেলেপুলে?

-এখন পর্যন্ত তিনটি, খোদা তাদের সুখে রাখুন।

যুবক এবার জানতে চায়, আচ্ছা, মুস্তফা মহম্মদ আর তার ভাই আলী কেমন আছে? যা

মারুফ বলে, বড় ভাই মুস্তফা সাহেব ওখানকার মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে সকলেই শ্রদ্ধাবান। আগাগোড়া কোরাণ তার কণ্ঠস্থ। নানা সুরে ছন্দেও নানা ভাবে তিনি তা লোককে শুনিয়ে মুগ্ধ করেন। ছোটজন আলীর একটা ডাক্তারখানা আছে। আতরের কারবারও করেন তিনি। ওদের বাবাও এই কারবার করতেন। তিনিই তার দোকানের পাশে ছোট ছেলের জন্য আর একটা দোকান করে দিয়েছেন। আলীর ছেলে মহম্মদ আমার বাল্যকালের বন্ধু। এক সঙ্গে খেলাধূলা করে আমরা বড় হয়েছি। আল্লাহ ওকে সুখে রাখুন। কিন্তু জানি না সে আজ কোথায়? বেঁচে আছে কি নাই, তাও কেউ বলতে পারে না।

ছোটবেলায় আমাদের খেলার সঙ্গী ছিলো একটি খ্রিস্টান ছেলে। ওর বাবা পয়সা এবং প্রতিপত্তিতে ডাকসাইটে ছিলো। একদিন মহম্মদ ঐ ছেলেটাকে নিয়ে মজা করতে গিয়ে ফ্যাসাদ বাধলো। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে তার বাবার কাছে নালিশ করলো। বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে কোতোয়ালের কাছে এজাহার দিয়ে এলো তখুনি। সিপাইরা মহম্মদকে পাকড়াও করার জন্যে মহম্মদের বাড়ি চড়াও হলো। কিন্তু ধরতে পারলো না। মহম্মদ খিড়কীর দরজা দিয়ে সেই যে পালালো আর ফিরলো না কোনও দিন। আজ বিশটা বছর পার হয়ে গেছে মহম্মদের কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারেনি।

মারুফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলো।

যুবক আকুল হয়ে মারুফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। মারুফ, মারুফ আমাকে চিনতে পারছো দোস্ত? আমিই সেই মহম্মদ!

এর পর মারুফকে সঙ্গে নিয়ে মহম্মদ তার প্রাসাদোপম ইমারতে এসে পৌঁছলোনফর চাকর খোজা’ নিগ্রো দারোয়ান পাহারাদারে সরগরম হয়ে আছে সারা প্রাসাদ। দামী দামী আসবাব গালিচায় জমকালো সব ঘর-দোর! মহম্মদ বললো, এই আমার গরীবখানা।

পুরোনো বন্ধুকে কাছে পেয়ে মহম্মদ সব কাজকর্ম ভুলে মারুফকে নিয়ে মেতে রইলো কয়েকটা দিন।

মহম্মদ জানালো, এই শহরটায় এসে ইকতিয়ান অল খাতানের দাক্ষিণ্যে সে আজ বহু ধনদৌলতের মালিক হতে পেরেছে। এখন সে এই শহরের সবচেয়ে সেরা ধনী ব্যক্তি।

মহম্মদ বললো, মারুফ, আল্লাহর কৃপায় আমি অনেক পেয়েছি। এতো অর্থের আমার প্রয়োজন নাই। যদি তুমি আপত্তি না কর তবে আমার সম্পদের কিছু তোমাকে দিয়ে ধন্য হতে চাই আমি।

সে একটা থলেয় এক হাজার সোনার দিনার ভরে মারুফের হাতে তুলে দিলো, বন্ধুকে বন্ধুর উপহার, নাও বন্ধু। কাল সকালে তুমি আমার সবচেয়ে সেরা খচ্চরে চেপে আমার দোকানে যাবে। ঐ সময় বাজারের অনেক গণ্যমান্য সওদাগররা আমার পাশে থাকবে। তোমাকে দেখামাত্র আমি ছুটে যাবো তোমার কাছে। খচ্চরের লাগাম ধরে তোমাকে নামতে সাহায্য করবে। এবং এমন স্বাগত সম্ভাষণ জানাবো যাতে তোমার মর্যাদা বেড়ে যাবে সওদাগর-মহলে। তারা বুঝবে, তুমি যে-সে ব্যক্তি নও। তারাও তোমাকে খাতির অভ্যর্থনা জানাবে। এর পর বাজারে একটা সেরা দোকান কিনে দেব তোমাকে। তুমি মালিক হয়ে বসবে সেখানে। খুব শিগিরই দেখবে দারুণ পয়সা জমে যাবে তোমার ব্যবসায়। কত গণমান্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে তোমার। অচিরে তুমিও আমার মতোই এই শহরের সম্ভ্রান্ত এক সওদাগর হয়ে অতীতের সব দুঃখ তাপ ভুলে যেতে পারবে। তোমার খাণ্ডারণী স্ত্রীর দুর্ব্যবহার নিয়ত তোমাকে দহন করছে জানি। কিন্তু হাতে পয়সা হলে সে সব আঘাত তুমি ভুলে যেতে পারবে, বন্ধু।

এ মহত্ত্বের তুলনা কোথায়, মারুফ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।

পরদিন সকালে মারুফ সাজগোজ করে খচ্চরে চেপে বাজারে এসে উপস্থিত হয়। মহম্মদ তখন তার সওদাগর সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে খোশ-গল্পে মেতেছিলো, মারুফকে দেখামাত্র সে ছুটে গিয়ে স্বাগতম জানায়। খচ্চরের লাগামটা চেপে ধরে বলে, মেহেরবানী করে আমার দোকানে পায়ের ধুলো দাও দোস্ত। আমার কী সৌভাগ্য, আজ তুমি আমার দোকানে এলে।

এর পর পূর্ব-নির্দিষ্ট নাটকটি যথাযথভাবে অভিনীত হয়ে গেলো।

উপস্থিত সওদাগররা পরদেশী এক সওদাগরকে যথাবিহিত মর্যাদা সহকারে আদর আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলো না। মারুফ গম্ভীর চালে মাথা হেলিয়ে সকলকে শুভেচ্ছা জানালো।

সওদাগররা পরস্পরে ফিস ফিস করে আলোচনা করতে থাকলো। ইনি নিশ্চয়ই কোনও বিশাল ধনী সওদাগর। তা না হলে মহম্মদ সাহেব স্বয়ং অত খাতির সম্মান করেন?

মহম্মদ একবার গলা খাটো করে তার সওদাগর বন্ধুদের উদ্দেশ করে বলে, জান তো ইনি কে? তামাম দুনিয়ার সেরা ধনী সওদাগর। টাকার কুমীর! কেউ জানে না। ওঁর কত টাকা। উনি নিজেও বোধ হয় মাপ করতে পারবেন না ওঁর ধন-দৌলতের পরিমাণ। সারা পৃথিবী জুড়ে ওঁর কারবার। সব দেশে ওঁর। দোকানপাট আছে। এখানে আসার উদ্দেশ্যই তাই—একটা জমকালো দোকান খোলা। এতো যে বিত্ত, কিন্তু মানুষ হিসেবে ওঁর তুলনা বিরল।। একেবারে মাটির মানুষ বলতে যাকে বলে, তাই। ধীরে ধীরে ওঁর আরও অনেক গুণের পরিচয় পাবেন আপনারা। তবে নিজের ঢাক তো নিজে পেটান না কখনও, তাই জানতে একটু সময় লাগবে।

সওদাগররা মারুফের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। প্রত্যেকে তার বাড়িতে খানাপিনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে থাকলো। মারুফ মধুর হাসি হেসে সবারই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলো মাথা পেতে। কিন্তু আপাতত কিছুদিন তা রক্ষা করার অক্ষমতা জানিয়ে বললো, আপনারা আমার গোস্তাকি মাফ করবেন মালিক। আমি আপনাদের এদেশে এসেছি আমার দোস্ত মহম্মদের অতিথি হয়ে। তিনি যতদিন না আমাকে ছাড়বেন ততদিন আমি এঁর সঙ্গেই খানাপিনা করবো। তারপর ছাড়া পেলে অবশ্যই মিলিত হবো আপনাদের সঙ্গে।

এইভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মারুফের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো তার ঐশ্বর্যের কথা। স্বয়ং মহম্মদ লোককে বলতে লাগলো, ওরে বাবা, মারুফসে তো ধনকুবের, তার কাছে আমি নস্যি।

একদিন এ সংবাদ সেখানকার সুলতানের কানেও পৌঁছলো। উজিরকে ডেকে সুলতান বললেন, দেখতো উজির, আমার শহরে কে এক জগৎবিখ্যাত ধনী সওদাগর নাকি এসেছে, তার এত ধন-দৌলত, কোন সুলতান বাদশাহরও নাই! সে নাকি অনেক মূল্যবান সওদাপত্র সঙ্গে এনেছে। এবং পরে নাকি আরও কোটি কোটি দিনারের অমূল্য সব হীরে জহরত নিয়ে আসছে। তার সহচররা। আমার বিশ্বাস এই শহরের অর্থগৃধু শকুনী সওদাগররা ওকে চুষে খাওয়ার জন্য ওৎ পেতে আছে। তুমি একবার খোঁজ নাও তো, কে সেই লোক? তাকে নিয়ে এসো আমার সামনে। অমন একজন বিত্তবান মানুষ আমার মুলুকে এসে যাতে প্রতারিত না হতে পারে সেটা তো দেখা দরকার আমার। হয়তো এমনও হতে পারে তার দ্বারা আমার বা আমার বাচ্চাদেরও কিছু উপকার হতে পারবে!

উজির বিচক্ষণ ব্যক্তি, সব শুনে সুলতানকে বোঝাবার চেষ্টা করে, আপনি একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন, জাঁহাপনা। সবুরে মেওয়া ফলে। ধনপতি সওদাগর সাহেবের হীরে জহরতের লটবহরগুলো এসে পৌঁছাক, তারপর না হয় তাকে আমন্ত্রণ জানানো যাবে।

একথায় সুলতান রুষ্ট হলেন, তোমার কি মাথায় গোবর পোরা আছে উজির? সোজা সরল কথাটা বুঝতে পারছ না? তুমি ভাবছো, ওর মালপত্র এসে পৌঁছানর পর ঐ শকুনীরা তাকে আস্ত রাখবে? না না, তোমার বুদ্ধিতে চললে আমি সব হারাববা, তুমি আর দেরি না করে আজই এক্ষুণি তাকে সসম্মানে নিয়ে এসো আমার প্রাসাদে।

মুচি মারুফ এসে যথাবিহিত কুর্নিশাদি করে সুলতানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলো।

মারুফের নম্র বিনয়ী আদব-কায়দায় প্রীত হলেন সুলতান।

-শুনেছি আপনি শ্রেষ্ঠ ধনী সওদাগর। জগৎ জোড়া আপনার ব্যবসা বাণিজ্যের খ্যাতি। তা আমার মুলুকে কি অভিপ্রায়ে এসেছেন, বণিক।

-ব্যবসাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য জাঁহাপনা। আপনার শহরেও এসেছি ব্যবসা করবো বলে! তা আমার লটবহর এখনও এসে পৌঁছয়নি। না হলে দেখাতে পারতাম, কি কি ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য আমি করবো এখানে। আসেনি, তবে দু-একদিনেই পৌঁছে যাবে মালপত্র। অনেক মূল্যবান হীরে জহরৎ আছে তার মধ্যে। আপনার কন্যা বা বেগমের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।

তখন সুলতান তার সঞ্চিত সব মণি-রত্নাদি বের করে একটা বিরাট মুক্তো মারুফের হাতে তুলে দিয়ে বললো, দেখুন তো এটা কেমন জিনিস?

মুক্তো হতে নিয়ে একবার পরীক্ষা করার ভান করেই মেঝেতে ফেলে দিয়ে জুতোর গোড়ালী ঠুকে গুঁড়িয়ে দিলো।

সুলতান শিউরে উঠলেন, সর্বনাশ এ কি করলেন আপনি? ও যে মহামূল্য রত্ন! প্রায় হাজার মোহর দাম হবে?

মারুফ বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বললো, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন আপনি, হাজারখানেকই দাম হবে। কিন্তু আমার লটবহরের মধ্যে এক বস্তা মুক্তো আছে তার একটাও এতো ছোট এতো কম দামী নয়, জাঁহাপনা। সেগুলোর প্রত্যেকটি দেখতে যেমন বাহারী তেমনি দামেও অনেক বেশি মূল্যবান।

এতে সুলতানের লোভ শতগুণ হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, মনে মনে স্থির করে ফেললো, এমন ধনকুবেরকে তো হাত ছাড়া করা যায় না, আমার কন্যার সঙ্গে শাদী দিয়ে সম্পর্কের জালে জড়িয়ে ফেলতে হবে একে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো তেষট্টিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

সুলতান মারুফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনার সঙ্গে কথা বলে প্রীত হলাম, বণিকসাহেব। এখন আমার অভিলাষ, আপনি আমার কন্যাকে শাদী করুন। আপনি আমার দেশের মাটিতে পা রেখে আমাকে ধন্য করেছেন। আমার কন্যাকে আপনার বাঁদী করে দিয়ে আমি আমার অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছা করি। আপনি যদি অমত না করেন তবে শাদীর আয়োজন করি। আমার পুত্র-সন্তান নাই। তাই আমার মৃত্যুর পর আপনিই আমার মসনদে বসার অধিকারী হবেন।

মারুফ ক্ষণকাল নিরাসক্তভাবে মৌন হয়ে কি যেন ভাববার ভান করলো। তারপর বললো, জাঁহাপনার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস আমার নাই। কিন্তু এতো তাড়াহুড়োর কি দরকার? আমার লটবহর পৌঁছতে দিন, তারপর না হয় শাদীর দিনক্ষণ ধার্য করা যাবে। তাছাড়া, শাদী বলে কথা, অনেক? খরচপত্রের ব্যাপার রয়েছে। আমার ধনরত্ন এসে না পৌঁছলে কি করে এখনি সম্ভব, জাঁহাপনা? আমার যিনি বেগম হবেন তাকে তো হাজার মোহর করে দু’লক্ষ তোড়া উপহার দিতে হবে আমাকে! এসব তো আর সঙ্গে করে আনা যায় না। আমার লোকজনরাই তা নিয়ে আসছে। এছাড়া গরীবদের মধ্যে দান ধ্যানও তো করতে হবে। তাতে হাজার টাকা করে হাজারটা তোড়া অন্তত দরকার। শাদীর রাতে এটা আমাদের বংশের অবশ্য করণীয় কর্তব্য। এ না হলে আমি বাসরঘরেই ঢুকবো না। এছাড়া যারা আমার শাদীতে উপঢৌকন দেবেন তাদের জন্যও ঐ রকম আরও হাজারটা তোড়া চাই। আর খানা-পিনার জন্যও বরাদ্দ রাখতে হবে এক হাজার তোড়া। এরপর হারেমের অন্য সব বাদী বেগমদের জন্য উপহার আছে। প্রত্যেক বাঁদী-বেগমকে হাজারটা মুক্তো বসানো সাতনরী জড়োয়ার হার অবশ্যই দেব আমি। এইসব যথাযথভাবে করতে গেলে আমার লোক-লস্কর এসে না পৌঁছান পর্যন্ত কী করে এ শাদী সম্ভব হতে পারে জাঁহাপনা?

এইসব শুনে সুলতানের বুকের স্পন্দন দ্রুততর হতে থাকে। ওরে বাপ, এ যে দেখছি বিরাট ব্যাপার! এমন পাত্র তো হাতছাড়া করা সম্ভব নয়।

-সে জন্য আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না, মারুফ সাহেব। জাঁকজমকের একটু ত্রুটি রাখবো না আমি। যেমনটি আপনি বলবেন, বর্ণে বর্ণে মিলিয়ে নেবেন, ঠিক ঠিক তেমন হবে সব। আপনার লটবহর যখন এসে পৌঁছবে তখন না হয় আপনি আমার মেয়ের দৈনমোহর দেবেন। এখন শুভ কাজ সম্পন্ন হতে দিন। এ নিয়ে দুর্ভাবনা করবেন না। আপনার নগদ যা দরকার বলুন, আমি আমার ধনভাণ্ডার থেকে দিয়ে দিচ্ছি। তাছাড়া শাদীর উৎসবের জন্য যা খরচ হবে সব আমি করবো। তবে শুভ কাজে আমি বিলম্ব করতে চাই না। যত শীঘ্র সম্ভব শাদী হয়ে যাক, এটাই আমার ইচ্ছা। আপনি আর দ্বিধা সঙ্কোচ করবেন না। আমার যা সবই তো আপনার হবে একদিন।

সুলতান তখনই উজিরকে ডেকে পাঠালেন।

–শোনো উজির, আমীর মারুফের সঙ্গে শাহজাদীর শাদী পাকা করে ফেলেছি। এখন তুমি শেখ অল ইসলামকে একবার খবর দাও, আমি তার সঙ্গে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।

সুলতানের সিদ্ধান্ত শুনে উজির গম্ভীর হয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।

সুলতান অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? কিছু বলবে কী?

—জাঁহাপনা, উজির করজোড়ে মিনতি জানায়, আপনি আর কটা-দিন অপেক্ষা করুন। শাহজাদীর শাদী, এ তো চাট্টিখানি কথা নয়! ভালো করে কুলশীল না জেনে যে-কোনও লোকের হাতে তো তুলে দেওয়া যায় না তাকে।

সওদাগরটির কথাবার্তা শুনে আমি বিশেষ প্রীত হতে পারিনি, তার কারণ তার আদব-কায়দার মধ্যে কোথায় যেন একটা খানদানী মেজাজের খামতি আছে। আপনি আর কটা-দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন, জাঁহাপনা। ওর লটবহর পৌঁছতে দিন এখানে।

সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইলেন, তুমি একটা বিশ্বাসঘাতক। আমার সর্বনাশ করতে আছ এখানে, এ আমি বেশ বুঝতে পারছি। তুমি ভেবেছ তোমার মতলব আমি টের পাইনি? আমার কন্যাকে শাদী করে তুমিই আমার মসনদে চেপে বসতে চাও। কিন্ত সে আমি হতে দেব না কিছুতেই। শোনও উজির, আর যদি কোনও ভাবে আমার কাজে বাগড়া দেবার কোশিস কর তবে তোমাকে খতম করে ফেলবো আমি। এ পর্যন্ত যত পাত্ৰই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, তারা কেউ শাহাজাদীর যোগ্য নয় এই অজুহাতে তুমি তাদের বাতিল করে দিয়েছ। তখন আমি তোমার ফিকির বুঝতাম না, তাই বাধা দিইনি। কিন্তু এখন দেখছি, এইভাবে তুমি আমার কন্যাকে বুড়িয়ে দিতে চাইছে। যাতে আর কেউ না তার দিকে হাত বাড়ায়। পরে তার যোগ্য পাত্র যখন আমি সংগ্রহ করতে পারবো না, তখন তুমিই তার পাণি প্রার্থনা করবে, এই তোমার ফন্দী! সে গুড়ে বালি, তা আমি হতে দেব না। মারুফকে হাতছাড়া করলে তার মতো যোগ্য পাত্র কোথায় পাব আর? তাছাড়া, সে আমার জামাই হলে তার ধন-সম্পদ সবই তো আমার ভাণ্ডারে জমা হবে। তখন আমিই হবো তামাম আরব দুনিয়ার সেরা ধনবান বাদশাহ। আর আমি ঐশ্বর্যবান হলে তোমাদেরও লাভ হবে। যাক ওসব কথা, এখন আর দেরি না করে তুমি শেখ অল ইসলামকে খবর দিয়ে এসো।

কাজী শেখ অল ইসলাম এসে শাদীনামা তৈরি করে দিয়ে গেলো। সুলতানের আদেশে সারা শহর প্রাসাদে সাজসাজ রব ছড়িয়ে পড়লো তখুনি। আলোর মালায় সাজানো হলো প্রতিটি গৃহ ইমারত প্রাসাদ। নৃত্য গানে মুখর হয়ে উঠলো পূরবাসীরা।

মারুফ প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের তখতে বসে চোখে সর্ষের ফুল দেখতে থাকলো। এ কি কাণ্ড সে করে বসলো? এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তো সে জানে-মৃত্যু! কিন্তু এখন পালাবারও তো পথ নাই। সে চেষ্টা করতে গেলেও মৃত্যু!

দল বেঁধে দলে দলে মেয়েরা এসে ভরে ফেলেছে প্রাসাদ-আঙ্গিনা। একদল গাইছে, একদল বাজনা বাজাচ্ছে, আর একদল সুললিত ছন্দে নেচে চলেছে।

এসব কিন্তু মারুফের বিষবৎ মনে হতে লাগলো তখন। শুধু ভাবতে লাগলো, কি করে এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

এইভাবে তিন দিন কেটে গেলো।

এরপর শাহজাদীকে অপূর্ব সাজে সাজিয়ে বাসরঘরে এনে হাজির করলো সখী বাঁদীরা। মারুফের বুক কাপতে লাগলো। এখন সে কী করবে? হায় আল্লাহ! নিয়তি তাকে কোথায় ঠেলে দিলো?

শাহজাদীকে বাসরঘরে রেখে সবাই চলে গেলো। পালঙ্কের এক পাশে বসে মারুফ ভেজা-বেড়ালের মতো কাঁপতে লাগলো। শাহজাদী এসে পাশে বসে তার একখানা হাত নিজের কোলে তুলে নিলো।

—তুমি অমন মুখ গোমড়া করে জবুথবু হয়ে বসে আছ কেন প্রাণনাথ? এইসময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো চৌষট্টিতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে—

মারুফ কোনও রকমে উচ্চারণ করতে পারলো, একমাত্র খোদা ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না আমাকে।

—এ কথা কেন বলছো গো? আমাকে দেখে কি তোমার পছন্দ হয়নি। আমি কি এতই কুৎসিত?

মারুফ বলে, না না, তোমার কী দোষ? এর জন্য দায়ী একমাত্র তোমার বাবা।

—কেন, কি করেছেন তিনি? মারুফ বললো, আমি তখনই বার বার বলেছিলাম, আপনি এতো তাড়াহুড়ো করবেন না, আগে আমার সব লটবহর পৌঁছতে দিন। কিন্তু তিনি সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। আমাদের শাদীর প্রথম রাত, তোমাকে প্রাণভরে সাজাবো। সাতনরী মুক্তোর মালা পরাবো নিজের হাতে। কিন্তু সে সাধ আমার পূর্ণ হলো না। আমার ইচ্ছে ছিলো, হারেমের সব বাঁদী-বেগমকে মূল্যবান উপহার পাঠাবো। কিন্তু তাও পারলাম না। এ দুঃখ আমি রাখবো কোথায়?

শাহজাদী আশ্বস্ত হয়ে বললো, ও, ওই কথা। ছাড়তো ওসব, ভেবো না। এখন সাজ-পোশাক খুলে কাছে এসো। এ মধুযামিনী ঐ সব ছুটো চিন্তায় নষ্ট করো না, সোনা। আমি তোমার সোনাদানা বিষয়-সম্পদ কিছুই চাই না। তোমার মতো স্বামী পেয়েছি, এই আমার পরম সৌভাগ্য। তোমার। লটবহর আসুক না আসুক, তার জন্যে আদৌ আমি লালায়িত নই। তুমি যদি একান্তভাবে আমার হও তার চেয়ে বেশি এ আর কি প্রয়োজন? আমার ধনদৌলতের কোনও বাসনা নাই। ওতে কি মন ভরে? আমি বাদশাহজাদী, ঐশ্বর্যের অভাব কিছু নাই, কিন্তু বিশ্বাস কর, এক চিরকাল ধন-দৌলতকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করে এসেছি। এতে আমার কোনও আসক্তি নাই। থাক ওসব কথা, আজকের এই মধুর রাত্রি তোমার আমার দেহ মন প্রাণ এক সঙ্গে মিশে যাক, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে! এসো সাজ-পোশাক খোলো, আর দেরি করো না। আমার সারা দেহ মন কামনায় জরজর হয়ে উঠছে, এসোসোনা, দেরি আর আমি সইতে পারছি না।

-তা হলে তাই হোক, মারুফ ক্ষিপ্র হস্তে সাজ-পোশাক খুলে খুলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো মেঝের ওপর।

পরদিন সকালে উঠে হামামে গিয়ে বেশ ভালো করে গোসল করলো মারুফ। তারপর দারুন সাজে সেজে-গুজে গিয়ে বসলো দরবারে। উজিরকে বললো যারা উপস্থিত আছে তাদের সবাইকে যথাযথ মর্যাদার সাজ-পোশাক উপহার দিন।

সকলে নতুন জামাই-এর বদান্যতায় ধন্য ধন্য করতে লাগলো।

এইভাবে কুড়িটা দিন পার হয়ে গেলো। শাহজাদী স্বামীসুখে গর্বিতা হয়ে উঠলো। মারুফের কথা আর কী বলবো?

এদিকে উজির চিন্তিত হলো, এলাহী খরচের ধাক্কায় ধনভাণ্ডার শূন্য হয়ে পড়েছে। অথচ জামাই-এর লটবহরও এসে পৌঁছলো না। সুলতানের কাছে গিয়ে সে করজোড়ে বললো, জাঁহাপনা কোষে আর কোনও অর্থ নাই। এদিকে জামাতার লটবহরও এসে পৌঁছায়নি। এখন কী হবে আমি বুঝতে পারছি না!

সুলতান ঈষৎ বিচলিত বোধ করলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়ে বললেন, পৌঁছতে হয়তো কিছু বিলম্ব ঘটছে। কিন্তু তা নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নাই, সবুর কর, ঠিকই এসে পৌঁছবে।

উজির তিক্ত হাসি হেসে বলল, আপনার কথাই যেন সত্য হয় জাঁহাপনা। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে আমি চিন্তিত না হয়ে পারছি না। ভাড়ার শূন্য হয়ে পড়েছে। অথচ শাহাজাদীর শাদী হয়ে গেছে এক অজ্ঞাতকুলশীলের সঙ্গে। জানি না নসীবে কি আছে।

তোমার কথায় আমিও চিন্তিত হচ্ছি, উজির! তবে শুধু দোষারোপ না করে আমাকে কিছু উপায় বাতলাও। যদি প্রমাণ করতে পার আমার জামাতা একজন ঠগ প্রতারক মিথ্যাবাদী তবে তারও আমি উপযুক্ত ব্যবস্থা করবো। কিন্তু তার আগে তো আমি কিছু করতে পারি না।

উজির বলে, আপনি যথার্থই বলেছেন জাঁহাপনা, বিনা প্রমাণে কারো সাজা হওয়া উচিত নয়। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আর কেউ নয়, শুধু মাত্র আপনার কন্যাই আপনাকে আলোকপাত করতে পারেন। আমার কথা শুনুন, তাকে একবার আপনি ডাকুন এখানে। আমি নিজে তাকে দু’একটা প্রশ্ন করতে চাই। অবশ্য শাহজাদীর কোনও রকম অমর্যাদা না ঘটে সেদিকে আমি সজাগ থাকবো।

–ঠিক আছে, তাই হোক, গর্জে উঠলেন সুলতান, যদি প্রমাণ হয় মারুফ জালিয়াত, সে আমাদের প্রতারণা করেছে, তবে জামাতা হয়েও সে মউ এড়াতে পারবে না।

সে সময় মারুফ প্রাসাদে ছিলো না। সুলতানের নির্দেশে শাহজাদী দরবারে এসে পর্দার আড়ালে বসলো। সুলতান-কন্যাকে উদ্দেশ করে বললেন, দরবারে এখন শুধু আমরা তিনজন, আর কেউ উপস্থিত নাই উজির তোমাকে দু-একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চায়, তুমি তার জবাব দিলে আমি খুশি হবো।

শাহজাদী খুঁসে উঠলো, কী তোমার মতলব, উজির? বলো, কী জানতে চাও?

উজির নম্র কণ্ঠে বললো, মালকিন, ধনভাণ্ডার প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। আমীর মারুফের লটবহর এখনও এসে পৌঁছয়নি। এবং কবে পৌঁছবে তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। সেই কারণে আপনার পিতা আমাদের মহামান্য জাঁহাপনা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার অধিকার দিয়েছেন। এখন বলুন, এই পরদেশী সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? এই কুড়ি দিন ব্যাপী আপনি তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, আপনার মনে কী কোনও সন্দেহ দানা বেঁধেছে?

আল্লাহ মারুফকে দীর্ঘায়ু করুন, আল্লাহ আমার স্বামীর প্রতি সহায় থাকুন, আপনি জানতে চান তার সম্বন্ধে আমার কী ধারণা? তবে শুনুন, একটুও খারাপ নয় বরং অত্যন্ত ভালো। অমন মানুষ হয় না। তার সঙ্গেশাদী হওয়ার পর থেকে রূপে রসে আনন্দে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার জীবন-যৌবন। আমার স্বামীর মধ্যে যে সব সৎগুণ আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তা খুব কম মানুষেরই থাকে। এক কথায় সে আমার সুধাপাত্র, এবং আমিও তার কাছে তাই।

সুলতান উজিরকে উদ্দেশ করে বললেন, কী শুনলে তো? ঘুচলো তোমার সন্দেহ? আমার জামাতার মতো মানুষ সত্যিই আমি দেখিনি কখনও।

উজির কিন্তু সে কথায় সন্তুষ্ট হতে পারে না। আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা ঐ লটবহরে কি কি সামানপত্র আছে তিনি বলেছেন?

-ওসব দিয়ে আমার কী দরকার? আমাদের ভালোবাসার মধ্যে বিষয় সম্পদের কথা উঠবেই বা কি করে? আর তুচ্ছ ঐ হীরে জহরতের বাক্স-পাটরা এলো কি এলো না, তাতেই বা আমার কী? ওসবে আমার কোনও দিন কোনও রকম আসক্তি ছিলো না, আজও নাই।

উজির বলে, তথাপি যদি আদৌ সেগুলো কখনও এসে না পৌঁছয় তাহলে আমাদের খানাপিনা চলবে কি করে মালকিন? আপনি তো শুনলেন ভাড়ার খালি হয়ে গেছে।

খোদা মেহেরবান, তার ওপর ভরসা রাখুন, তিনিই সব চালিয়ে দেবেন।

উজির কি যেন বলতে যাচ্ছিল, সুলতান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো শাহজাদী যা বলেছে এর পরে আর কথা চলে না, উজির। তুমি থামো। আমার কন্যা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক কথা বলেছে।

তারপর তিনি শাহজাদীকে উদ্দেশ করে বললেন, শোনেনা বেটি, তুমি কথায় কথায় তার কাছ থেকে জেনে নেবার চেষ্টা করো, কবে নাগাদ তার মালপত্র সব এসে পৌঁছবার সম্ভাবনা আছে। কারণ বুঝতে তো পারছো, শাদীর জন্যে প্রচুর খরচ হয়ে গেছে। ভাড়ার শূন্য হয়ে গেছে, অথচ পাওনাদারের অনেকের দেনাই মেটানো হয়নি। তারা তাগাদা দেবে, সে তো সহ্য হবে না। আমি যদি বুঝতে পারি কোন সময় নাগাদ এসে পৌঁছবে সেই মতো তাদের তারিখ দেব, পাওনা নিয়ে যাওয়ার জন্য। তা না হলে দেনা মেটাবার জন্য অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য আমাকে কোনও নতুন কর ধার্য করতে হবে।

শাহজাদী পর্দার আড়াল থেকে কুর্নিশ জানিয়ে বলে, জো হুকুম জাঁহাপনা! আজ রাতেই আমি ওকে জিজ্ঞেস করবো। তারপর কাল সকালে আপনাকে জানাবো।

সেইদিন রাতে দু’জনে পাশাপাশি শুয়েছিলো, শাহজাদী তার একখানা হাত রাখলো মারুফের কাঁধে, কাছে টেনে নিয়ে এলো তাকে। অধরে অধর রাখলো। গভীর আবেশে চুম্বন করলো দু’জনে। তারপর শাহজাদী স্বামীকে সোহাগ করতে করতে কথাটা পাড়লো, তুমি আমার বুকের কলিজা, চোখের মণি, তোমাকে ছাড়া একটি এ দিনও আমি বাঁচবো না সোনা, তোমার উদ্দাম ভালোবাসার জোয়ারে আমি হালভাঙ্গা পালছেড়া দিশাহারা নাবিকের মতো ভেসে চলেছি। কোথায়? কতদূরে কোন নিরুদ্দেশের অজানা ঠিকানায় তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমি জানি না, জানতে চাইও না। তবে একথা ঠিক, এক সূত্রে বেঁধেছি জীবন, তোমার যা হবে আমারও তাই হবে। আমাদের দুজনের একই নিয়তি। কেউ তা বদলাতে পারবে না।

তাই তোমার কাছে আমার যেমন লুকাবার কিছু নাই, আমি বিশ্বাস করি আমার কাছেও গোপন করার মতো কিছুই থাকতে পারে না তোমার। আচ্ছা বলতো সোনা, তোমার লোক ঐ সব লটবহর নিয়ে কবে নাগাদ এসে পৌঁছবে এখানে? আমার বাবা এবং উজির বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন এই ব্যাপারে। অবশ্য তার কারণও আছে। শাদীর জন্যে অত্যধিক ব্যয়ের চাপে ভাড়ার প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছে। তোমার কিন্তু কিন্তু করার কোনও কারণ নাই, সোনা। যদি আশঙ্কা কর, তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে, এখানে আসতে হয়তো আরও অনেক দেরি হতে পারে, তবে অসঙ্কোচে আমাকে সব বলো। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, আমি সব দিক বজায় রেখে সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

নয়শো পঁয়ষট্টিতম রজনী :

 

আবার সে বলতে থাকে—

এই বলে সে মারুফকে আরও বুকের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে বলতে লাগলো।

হো হো করে হেসে উঠে মারুফ শাহজাদীকে আদর জানিয়ে বললো, এই একটা সহজ সরল প্রশ্ন করতে ভূমিকা করতে হলো কেন, সোনা?

মূহূর্তের জন্য চুপ করে গেলো মারুফ। তারপর খাঁকারী দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো, শোনো সোনা, আসলে আমি কোনও সওদাগর নই। আমার কোনও ধন-দৌলত কিছু নাই। স্বদেশে আমি এক অতি সাধারণ দরিদ্র চর্মকার ছিলাম। লোকের পায়ের জুতো সারিয়ে দিয়ে আমার জীবিকা চলতো। ফতিমা নামে এক দজ্জাল খণ্ডারণী মেয়েকে শাদী করেছিলাম সেখানে। সে আমার জীবনে চরম অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালো।তার অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে একদিন ঘর ছেড়ে পথে নামতে হলো আমাকে। তারপর নানা দেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে তোমাদের এই শহরে এসে পৌঁছলাম ভাগ্যচক্রে।

এইভাবে মারুফ তার জীবনের সব খুঁটিনাটি কাহিনী তুলে ধরলো শাহজাদীর সামনে।

সব শুনে শাহজাদী হেসে লুটিয়ে পড়ে মারুফের বুকে, ওঃ, তুমি কী সুন্দর! তোমার বৌটা অমন দজ্জাল ছিলো বলেইনা আজ তোমাকে আমি আমার বুকের কলিজা করে পেয়েছি। সত্যিই তোমার মতো মজার মানুষ আমি দেখিনি কখনও। এমন করে তুমি ভালোবাসতে জান, অথচ তোমার বোকা বৌটা তোমাকে বুঝতে পারলো না? যা পারেনি সে আমার সৌভাগ্য। কিন্তু এখন মুশকিল হলো, বাবা এবং উজিরকে কি বলা যাবে। তারা যদি আসল ব্যাপার শোনেন তবে তো তোমার নির্ঘাৎ গর্দান যাবে। ও, না না, সে আমি সইতে পারবো না সোনা। তোমার এক মুহূর্তের অদর্শন আমাকে অধীর করে তোলে। তোমাকে যদি ওরা ফাঁসী দেয় তবে আমিও আত্মঘাতী হবো।

তারপর একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে আবার বলতে থাকে, শোনো আর দেরির কাজ নাই। আজ ভোরেই তুমি প্রাসাদ থেকে এ শহর মুলুক ছেড়ে অন্য কোনও দূর দেশে রওনা হয়ে যাও। আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার মোহর আর আমার কিছু গহনাপত্র দিচ্ছি। আমার একান্ত বিশ্বস্ত এক নফরকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। তুমি যেখানে অবস্থান করবে সে ঐ ঠিকানাটা জেনে এসে জানাবে আমাকে। আমি তোমাকে মাঝে দূত পাঠিয়ে এখানকার হালচাল জানাবো। তার পরে যা করার, দরকার হবে তাই করবো। আমার আশা, বাবাকে আমি এমনভাবে বোঝাতে পারবো যাতে তোমার কোনও মান ইজ্জত একটুও খোয়া না যায় তাদের কাছে।

মারুফ কৃতজ্ঞ হয়ে বললো, আমি যদি বাঁচি তোমার কল্যাণেই বাঁচবো সোনা। এ ছাড়া আর কোনও পথ নাই।

এরপর সে রাতে আর কোনও কথা হলো না ওদের। প্রাত্যহিক রতিরঙ্গ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো দুজনে।

শেষ রাতে শাহজাদীর ঘুম ভাঙ্গতেই মারুফকে জাগিয়ে তুললো সে। নিজে হাতে সাজিয়ে গুজিয়ে দিলো এক বান্দার সাজ-পোশাকে। বললো, সাবধানে থেকো। তোমার জন্যে আমি বড় চিন্তায় থাকলাম। মাঝে মাঝে আমার লোক যাবে তোমার কাছে। তার মারফত সব জানতে পারবে।

সকালে দরবারে বসে সুলতান শাহজাদীকে ডেকে পাঠালেন, পাতলা পর্দার আড়ালে এসে বসলো সে। সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাতে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, বেটী?

শাহজাদী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, আপনার ঐ বুড়ো উজিরের মনস্কামনাই পূর্ণ হয়েছে বাবা। সুলতান উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন, কী হয়েছে?

শাহজাদী কান্না-বিজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, কাল রাতে খানা-পিনা সেরে আমরা শোবার আয়োজন করছি, এমন সময় এক প্রহরী এসে দরজায় করাঘাত করলো। দরজা খুলতেই সে বললো, প্রাসাদের বাইরে এক দূত এসেছে। সে জামাতা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। আমি বললাম, নিয়ে এসো তাকে এখানে।

দূত এসেছিলো আমার স্বামীর দলের লোকজনদের কাছ থেকে। একখানা চিঠি সে বাড়িয়ে দিলো আমার স্বামীর দিকে। আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চিঠিখানা পড়া শেষ করে সে একটু হেসে বললো, ও কিছু নয়, পথের মধ্যে বাদাবী ডাকাতরা আক্রমণ করে আমার পাঁচশো সিপাই বরকন্দাজের চারশোকে ঘায়েল করে হীরে জহরতের প্রায় চল্লিশটা বস্তা এবং কয়েক শো গাঁট কাপড়-চোপড় লুট করে নিয়ে গেছে।

—আমি আঁৎকে উঠলাম, সর্বনাশ!

তিনি কিন্তু মৃদু হেসে চিঠিখানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়ে বললেন, সর্বনাশ কেন হতে যাবে, সোনা? যা গেছে তার পরিমাণ সাকুল্যে নয় দশ লাখের বেশি হবে না। তার জন্য আমাদের এই মধুরাত্রি বিষাদ করে তুলতে চাই না। তোমার মুখের এক কণা হাসির দাম তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি। ও নিয়ে তুমি ভাবনা করো না। এসো আমরা শুয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। কাল ভোরে আমাকে একটু সকাল সকাল ডেকে দিও। আমি দূতের সঙ্গে রওনা হয়ে যাব। আমাকে না দেখলে, আমার মুখ থেকে ভরসার কথা না শুনলে আমার লোজনরা স্বস্তি পাবে না।

তারপর দূতকে বললেন তিনি, তুমি প্রাসাদের ফটকে অপেক্ষা কর। কাল ভোরে তোমার সঙ্গে যাব আমি।

খুব সকালেই তিনি রওনা হয়ে গেছেন। জানি না নসীবে কি আছে। কবে তিনি ফিরতে

পারবেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার উজির প্রতিনিয়ত আমার স্বামীর অমঙ্গল কামনা করে এসেছে। আমার বিশ্বাস এ বিপর্যয় তারই অভিশাপে ঘটেছে।

এই বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না শাহজাদী। দরবার ছেড়ে হারেমে চলে গেলো কাঁদতে কাঁদতে।

সুলতান গর্জে উঠলেন উজিরের ওপর, যত নষ্টের গোড়া তুমি। তোমার অমঙ্গল কামনার জন্যেই এমন বিপদ ঘটতে পারলো, ছিঃ ছিঃ, একি তোমার নীচ প্রকৃতি উজির, অন্যের ভালো একটুও দেখতে পার না তুমি?

মারুফকে পিঠে নিয়ে সুলতানের তাজি ঘোড়া বায়ুবেগে ছুটে চলতে থাকে। মুচির ছেলে মারুফ, জীবনে কখনও ঘোড়ায় চাপেনি। সে কেন তাজির উদ্দামতা সহ্য করতে পারবে? ধীরে ধীরে শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। অনুতাপ করতে থাকলো, কেনই-বা শাহজাদীকে সে আসল কথা সব খুলে বলতে গেলো? তা না হলে তো প্রাসাদের সুখ-বিলাস ছেড়ে আজ আবার তাকে পথে নামতে হতো না।

এই সব কথা চিন্তা করতে করতে এক সময় সে এক গ্রামের মধ্যে এসে প্রবেশ করলো। তখন সূর্য উঠে গেছে। খিদেও বেশ পেয়েছে। কিন্তু খেয়াল হলো তাড়াহুড়োর মধ্যে আসার সময় সে খানাপিনা কিছু সঙ্গে নিতে বেমালুম ভুলে গেছে।

একটা বাড়ির আঙ্গিনায় দু’টো গরু বাঁধা ছিলো। আর ঘরের দাওয়ায় বসে গৃহস্থ জাবনা তৈরি করছিলো। মারুফ এগিয়ে গিয়ে ডাকলো, এই যে শেখ সাহেব

গৃহস্থ এগিয়ে এসে সালাম জানিয়ে বললে, খোদা হাফেজ। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে। আপনি সুলতানের বরকন্দাজ!

মারুফ বললো, হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছেন আপনি।

-আমার গরীবখানায় আপনার পায়ের ধুলো দিতে আজ্ঞা হোক! মারুফ বললো, না শেখসাহেব, খুব তাড়া আছে। সুলতানের জরুরী কাজ নিয়ে বেরিয়েছি। কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। একটু কিছু খাবার দিতে পারেন আমাকে?

শেখ বিশেষ লজ্জিত হয়ে বললো, গোস্তাকি মাফ করবেন মালিক, ঘরে খানা বাড়ন্ত,- আপনি যদি মেহেরবানী করে নেমে ঘরে একটু বিশ্রাম করেন তবে আমি ছুটে গিয়ে পাশের গ্রামের হাট থেকে এক্ষুণি কিছু নিয়ে আসতে পারি। ততক্ষণে আপনার ঘোড়াটাও কিছু দানাপানি খেয়ে জিরিয়ে নিতে পারবে।

মারুফ ঘোড়া থেকে নেমে দাওয়ায় গিয়ে বসলো। গৃহস্থ ছুটলো পাশের গ্রামে হাটে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই খানাপিনা কিনে নিয়ে এলো সে। অতিথিকে আদর আপ্যায়ন করে খাওয়ালো। মারুফ খুব খুশি হয়ে তাকে একটা দিনার উপহার দিয়ে আবার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো।

চলতে চলতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। এক মাঠের মধ্যে এসে এক চাষীকে মাঠে হাল চালাতে দেখে তার কাছে এসে বললো, আমি বড় তৃষ্ণার্ত, একটু পানি খাওয়াতে পারো ভাইসাব।

সুলতানের পাইককে দেখে চাষী সসম্রমে তাকে স্বাগত জানিয়ে বললো, আপনি মেহেরবানী করে এই গাছতলায় একটু বিশ্রাম করুন মালিক, কাছেই আমার ঘর, যাবো আর আসবো, এই ভর দুপুরবেলায় আপনি এলেন, শুধু পানি তো আর আপনাকে দিতে পারি না, একটু কিছু মুখে দিলে আমি খুব খুশি হবো।

মারুফ বলতে যায়, না না, তার কী দরকার, শুধু একটু পানি পেলেই আমার যথেষ্ট হবে।

চাষী বলে, আপনার যথেষ্ট মনে হলেও আমার তো হবে না জনাব। আপনি একটু বসুন, আমি যাবো আর আসবো।

চাষী হাল রেখে গ্রামের দিকে চলে যায়। মারুফ ভাবে এরা কত ভালো, অতিথি এদের কাছে পীরের মতো। আহা, লোকটা তার চাষের কাজ কামাই করে আমার আহারের জন্য ছুটলো।

মনটা বড় খুঁত খুঁত করতে লাগলো মারুফের। ভাবলো লোকটা যতক্ষণ না ফিরে আসে ততক্ষণ সে একটু চাষ করে দেবে ওর জমি।

হালের কাছে গিয়ে বলদ জোড়াকে চালিয়ে সে লাঙল চালাতে থাকলো। এক পাক ঘুরতে না ঘুরতে এক। জায়গায় এসে লাঙ্গলের ফলাটা আটকে গেলো। অনেক লাঠি পেটা করেও গরু দুটোকে এক পা এগোনো গেলো না।

মারুফ বুঝলো মাটির তলায় কোনও পাথরের চাই-এ আটকে গেছে লাঙ্গলের ফলাটা। জমির আলে কোদাল রাখা ছিলো। মারুফ সেই কোদাল দিয়ে মাটি কেটে লাঙ্গলের ফলাটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে একটা তামার মোটা পাত্র টেনে তুললো। কৌতূহলী হয়ে আরও দু’চার কোদাল মাটি কেটে তুলতে গিয়ে খন্ খন্ করে একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে অবাক হলো।

একটা শ্বেত পাথরের চাঙ্গড়। অনেক কসরৎ করে পাথরটাকে সরাতেই দেখতে পেলো একটা সুড়ঙ্গ। উঁকি দিয়ে বুঝতে পারলো, একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।

সভয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে সুড়ঙ্গের নিচে নামতে থাকলো। বিস্ময়ে মারুফের চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। একি অসম্ভব কাণ্ড! সুড়ঙ্গের নিচে প্রকাণ্ড একটা কক্ষ। তার চারপাশে থরে থরে সাজানো অনেকগুলো জালা! সবগুলো সোনার মহরে ভর্তি।

মারুফ একটা দরজা দিয়ে পাশের আর একটা ঘরে প্রবেশ করে। সে ঘরেও অনেকগুলো জালা। সেগুলো কিন্তু সব মুক্তোয় ভরা।

পাশের আর একখানা ঘরে সে দেখতে পেলোলা জালা জালা ভর্তি সব হীরে চুনী পান্না এবং বহু মূল্যবান সব মণি-মাণিক্য।

পাশে আর একখানা ঘর। সে ঘরে কিছু নাই। একেবারে শূন্য ফাঁকা। শুধু একটি ছোট টুলের ওপর রাখা আছে অতি ক্ষুদ্র পাতিলেবু আকারের একটি স্ফটিকের কৌটো।

এক অজানা আশায় দুলে উঠলো মারুফের বুক। সে অনেক গল্প কাহিনী শুনেছে। এই ধরনের ছোট্ট কৌটোর মধ্যেই নাকি এমন দৈব বস্তু থাকে যার দ্বারা সারা দুনিয়ার ধনরত্ন পলকে হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে।

কৌটোর ঢাকনাটা খুলে সে একটা আংটি পেলো। মীনায় কাজ করা। দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন সব লেখা আছে তার ওপর। কিছুই পড়তে বা বুঝতে পারলো না মারুফ। বাঁ হাতের কনিষ্ঠাতে আংটিটা পরে নিলো সে। তারপর হাতের তালু দিয়ে ঘষে মসৃণ করতে চাইলো।

তৎক্ষণাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো মারুফের কানে, আমি এখানেই আছি। দোহাই আপনার, অত জোরে জোরে আর ঘষবেন না আংটিটা। আমার বড় ব্যথা লাগছে। আপনার যা প্রয়োজন মেহেরবানী করে হুকুম করুন, বান্দা তামিল করার জন্য সদাই প্রস্তুত আছে মালিক। যদি বলেন, কোনও বাদশার সারা মুলুক ছারখার করে জ্বালিয়ে দিতে হবে তাও যেমন পারি আবার যদিহুকুম করেন, এক রাতে সাতমহলা প্রাসাদ বানিয়ে দিতে, তাও করে দিতে পারি।

আমার অসাধ্য কিছুইনাই, শুধু আপনি একবার হুকুম করে দেখুন। আমি আপনার দাসানুদাস, এই বিশ্ব-সংসারে যত জিন দৈত্য আছে আমি তাদের সম্রাট। আপনি যা ইচ্ছা করেন আমি তা পলকে পূরণ করে দেব। কিন্তু আপনার কাছে বহুৎ মিনতি অত জোরে ঘষবেন না। বড় ব্যথা লাগে।

মারুফ বুঝতে পারলো তার আঙ্গুলের আংটির ভেতর থেকেই ঐ আওয়াজটা বের হচ্ছে।

—আল্লাহ তুমি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, কিন্তু কে তুমি?

মারুফের প্রশ্নের উত্তরে সে বললো, আমি ভাগ্যবিধাতা। এই আংটির ক্রীতদাস। এই আংটি যার কাছে থাকে আমি তারই আজ্ঞাবহ হই। এখন আপনিই আমার একমাত্র প্রভু। আমার অসাধ্য বলে কিছুই নাই। আমি জিন সম্রাট, আমার অধীনে বাহাত্তর জন সেনাধ্যক্ষ, তাদের এক একজনের সেনাবাহিনীতে এককোটি বিশ লক্ষ করে জিন সৈন্য আছে। তারা প্রত্যেকে সহস্র হাতির শক্তি ধরে। এখন আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন কী অসাধারণ আমার ক্ষমতা। তবে বলতে পারেন, তা হলে কেন আমি আপনার কাছ এমন দাসত্ব স্বীকার করছি কাতর ভাবে। তার উত্তর—আপনার হাতেই আমার জীবন। এই আংটি আমার হৃৎপিণ্ড। এটাকে যদি আপনি নষ্ট করে ফেলেন, আমার মৃত্যু ঘটবে। সেই কারণে এখন যে আপনিই আমার একমাত্র রক্ষাকর্তা। আপনাকে প্রসন্ন রাখাই আমার একমাত্র কাজ। আপনি আজ্ঞা করুন, প্রভু আমি আপনাকে সন্তুষ্ট রাখতে চাই। তবে একটা কথা, আপনি কিছুতেই দ্বিতীয়বার ঘর্ষণ করবেন না এই আংটির মীনা। তাতে আমার দেহে আগুন ধরে যাবে এবং চিরকালের মতো আপনি আমাকে হারাবেন। আমি দেহত্যাগ করবো তৎক্ষণাৎ।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো সাতষট্টিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

মারুফ বলে, শোনও ভাগ্যবিধাতা, তোমার সব কথাগুলো আমি মন দিয়ে শুনেছি। মগজে তা গাঁথা হয়ে থাকবে। আচ্ছা একটা কথা বলতে পার, কে তোমাকে এই পাতালপুরীতে এই কৌটোর মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিলো?

আংটি-দৈত্য বললো, এখন আমরা যেখানে আছি এটা সাদ্দাত ইবন আদেবের সেই বিখ্যাত রত্নাগার। তার আমি পেয়ারের বান্দা ছিলাম। এই আংটিটা তিনি হাতে ধারণ করতেন সব সময়।

মারুফ বললে, আচ্ছা বান্দা, তুমি কি এই সুড়ঙ্গের সমস্ত ধনরত্ন আমার নির্দেশমতো এখান থেকে অনত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে পার?

-কেন পারবো না মালিক? আপনি হুকুম করুন।

—তা হলে তাই কর। এখুনি এখানকার সব ধনরত্ন উপরে নিয়ে চলো। এককণাও কিছু রেখে যাবে না। আমার পরে যারা আশায় আশায় আসবে তারা যেন কিছুই না পেতে পারে।

মারুফ দেখলো বারটি তাগড়াই জোয়ান ছেলে এসে দাঁড়ালো তার সামনে তাদের প্রত্যেকের মাথায় বিরাট বিরাট বাক্স। তিনটি ঘরের জালা থেকে ঢেলে সমুদয় হীরে চুনি পান্না মুক্তো মোহর মণিমাণিক্য বোঝাই করলো ঐ বাক্সগুলোয়। তারপর মারুফকে অভিবাদন জানিয়ে পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

আংটিকে উদ্দেশ করে মারুফ বললো, চমৎকার! এবার আমার অনেকগুলো গাধা খচ্চর উট চাই। আর চাই পাইক বরকন্দাজ, নফর চাকর এবং সহিস। এই সব সামানপত্র ইকতিয়ান অস খতানে নিয়ে যেতে হবে।

আংটির দৈত্য একটা হাঁক ছাড়তে এক পাল উট খচ্চর ও নফর চাকর পাইক বরকন্দাজ সহিসরা এসে হাজির হলো সেখানে।

মারুফের নির্দেশে বাক্সগুলো উটের পিঠে চাপানো হলো। তারপর তারা যাত্রা করলো ইকতিয়ানের পথে।

মারুফ বললো, শোনও বান্দা, এবার আমার আরও হাজারখানেক জানোয়ার চাই। তাদের পিঠে বোঝাই থাকবে দামী দামী রেশমী কাপড়ের গাঁট। সে সব কাপড় সংগ্রহ করতে হবে সিরিয়া, মিশর, গ্রীস, পারস্য, হিন্দুস্তান এবং চাইনা থেকে। সেখানকার সবচেয়ে সেরা সেরা জিনিস ছাড়া চলবে না।

মারুফের মুখের কথা শেষ হতে না হতে হাজার খানেক উট গাধা খচ্চরের একটা পাল আবির্ভূত হলো সেখানে। তাদের পিঠে ভারি ভারি কাপড়ের গাঁট।

মারুফ এই বিশাল লটবহর নিয়ে ইকতিয়ানের পথে রওনা হয়ে যাবে, এমন সময় ঐ চাষী দুখানা রুটি একটু নুন লঙ্কা পেঁয়াজ নিয়ে উপস্থিত হলো সেখানে। এই অতি অল্প সময়ের মধ্যে

এলাহী ব্যাপার কি করে সংঘটিত হতে পারলো, কিছুতেই সে আন্দাজ করতে পারলো না।

মারুফ হাসতে হাসতে চাষীকে বললো, কী খুব অবাক হয়ে গেছ না? তা অবাক হওয়ার মতোই তো ব্যাপার।

চাষী কুণ্ঠিত হয়ে বললো, আপনি যে স্বয়ং সুলতান, তা তো আমি বুঝতে পারিনি জাঁহাপনা। তা হলে এই আধপোড়া রুটি আর পেঁয়াজ আপনার জন্য না এনে আমার ঘরের দুটো পোষা মুরগী মেরে খানা পাকিয়ে এনে দিতাম।

মারুফ বলে, তাতে কি হয়েছে। তোমার এই শুকনো রুটি পেঁয়াজই আমি বড় তৃপ্তি করে খাবো ভাইসাব। কই দাও আমার হাতে।

মারুফ দু’খানা রুটি আর একটা পেঁয়াজ নিয়ে মুখে পুরে দিলো।

-তোমাদের এই আন্তরিকতা কোনও পয়সা দিয়ে কেনা যায় না, দোস্ত! পোলাও মাংস তো রোজই খাই, কিন্তু আজ যা খেলাম তা অমৃত; মনে থাকবে অনেক কাল।

মারুফ বিদায় নেবার সময় বললো, আচ্ছা চলি ভাইসাব। আমি নিজে সুলতান নই এখনও, তবে সুলতানের জামাতা বটে। ভবিষ্যতে তার অবর্তমানে হয়তো আমিই সুলতান হয়ে মসনদে বসবো একদিন। তখনও তোমার এই আতিথ্যের কথা মনে থাকবে আমার। আমি সুলতান বা সুলতানের জামাতা সে কথা তো তুমি জানতে না। তা সত্ত্বেও তো এক অচেনা অজানা পরদেশী পথচারীকে আপ্যায়ন করার জন্য তোমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো, হাতের কাজ ফেলে তার সেবার জন্য ছুটে গিয়েছিলে ঘরে! এমনটা ক’জনে করে আজকাল? মানুষ হিসেবে তুমি অনেক অনেক বড়। তোমার মতো দাতার প্রাণ ক’জনের হয়?

-এবার তোমাকে আমি ভালোবেসে কিছু উপহার দিয়ে যেতে চাই চাষীভাই। এই যে যত লটবহর দেখছো সামনে—সব আমার। আমিই তার একচ্ছত্র মালিক। এখন বলো, কী তোমার চাই? এক জোড়া উট, এক জোড়া গাধা আর এক জোড়া খচ্চর তুমি নাও। তোমার জমি-খামারের কাজে লাগবে! আর এদের পিঠে যে সব গাঁট দেখছে তার মধ্যে আছে মূল্যবান সব রেশমী কাপড়। এগুলোও তোমাকে দিয়ে গেলাম। এ দ্বারা তুমি তোমার জমিজমা কিছু বাড়াতে পারবে। চাই কি ব্যবসা বাণিজ্য করেও মুনাফা করতে পারবে।

এরপর যাত্রা শুরু হলো ইকতিয়ানের পথে।

যথাসময়ে শহর সীমান্তে এসে পৌঁছলো মারুফ। দূত খবর বয়ে নিয়ে গেলো সুলতানের দরবারে। মারুফ সেখানে দল-বল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো।

দূত যখন দরবারে প্রবেশ করলো তখন উজির আর সুলতানের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা চলছিলো?

উজির বলছিলো, জাঁহাপনা আর কতকাল অলীক চিন্তায় বসে বৃথা কালক্ষয় করবেন? আপনার জামাতা মহামান্য আমীর প্রাণভয়ে পলায়ন করেছে। আগাগোড়াই সে আপনাকে ধাপ্পা দিয়ে গেছে। লোক-লস্কর লটবহর কিছুই তার নেই—কিছুই এসে পৌঁছবে না। আমরা তাকে সন্দেহ করেছি এটা বুঝতে পেরেই সে প্রাসাদ থেকে কৌশলে কেটে পড়েছে।

উজিরের কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেন না সুলতান। বলেন, হুম, আমাকে এমনভাবে ধোকা দিয়েছে সে? কিন্তু কোথায় পালাবে? কোথায় গিয়ে বাঁচতে পারবে? এখুনি দিকে দিকে সৈন্য পাঠাও। যেখানেই সে পালিয়ে যাক ধরে নিয়ে আসতে বললা!

এই সময় মারুফের দূত যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে সুলতানকে উদ্দেশ করে বললো, আমি আমীর মারুফের বান্দা! তার বার্তা বহন করে এনেছি আপনার কাছে। তিনি লোক-লস্কর ও লটবহর নিয়ে আমার পিছনে পিছনে আসছেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই শহর সীমান্তে এসে পৌঁছবেন। আপনাকে এই সংবাদ জানাবার জন্য তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।

সুলতান আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন উজিরের ওপর।

—এই তুমি—তুমিই যত নষ্টের গোড়া! তোমার বুদ্ধিতেই আমি বিভ্রান্ত হয়ে তাকে ধরে আনবার জন্য সৈন্য পাঠাতে যাচ্ছিলাম। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জার কথা!

হারেমে কন্যার মহলে এলেন সুলতান।

-মা জননী, সুখবর আছে। মারুফ তার দলবল নিয়ে এসে পৌচচ্ছে একটু পরেই। আমি জানতাম সে আসবেই। তার মতো সৎ মানুষ সত্যিই আমি দেখিনি। যাই তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি গে।

এই বলে সুলতান দ্রুতপায়ে মহল ছেড়ে চলে গেলেন। শাহজাদীর মুখে চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এলো। এ আবার কী হলো? মুচির ছেলের মাথায় আবার কি নতুন ফন্দি গজালো? কিন্তু যত নতুন চালই সে দিক তাতে তো কোন কাজ হবে না। ঐ শয়তান উজিরের জেরার মুখে পড়ে তার সব ফিকিরই ফাঁস হয়ে যাবে। উফ, তারপর যে কী ঘটবে তা আর ভাবতে চায় না শাহাজাদী। লোকটা আসলে অত্যন্ত ভালো মানুষ, সহজ সরল। কিন্তু তার নিজের ধারণা, তার মতো চালাক আর কেউ নয়।

শাহজাদী ভেবে পায় না, তাকে বার বার বারণ করা সত্ত্বেও কেন সে আবার আসছে। শাহজাদী তো তাকে বলেছিলো সবদিক ব্যবস্থা করে সে-ই তাকে খবর পাঠাবে। সেই সময় পর্যন্ত সে ধৈর্য ধরে থাকতে পারলো না।

আবার সে ভাবে, ধৈর্য্য ধরে সে থাকবেই বা কী করে? সে নিজেও তো পাগলিনী-প্রায় হয়ে উঠেছে। ভালোবাসা এমন বস্তু যা কোনও বাধাকেই বাধা মনে করে না, কোনও বিপদকেই বিপদ জ্ঞান করে না। সেও এখন বোধ হয় উদভ্রান্ত প্রেমিক হয়ে দিশাহারা হয়ে ছুটে আসছে এখানে।

কিন্তু এখানে এলে তো তার মৃত্যু অবধারিত। না, সে কি ভেবেছে, বাবার কাছে সে অকপটে সব কথা খুলে বলে নিজের দৈন্য তুলে ধরে প্রাণ ভিক্ষা করবে? তা যদি করতে যায় সে, তবে তার চেয়ে আহম্মকীর আর কিছুই হবে না। সরল সত্যকথা বলে সুলতানের ক্রোধ প্রশমিত করা যাবে না। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কী যে ঘটতে পারে তা বোধহয় ঐ বোকাটা আন্দাজ করতে পারেনি, তাই ছুটে এসেছে আবার।

সুলতানের নির্দেশে প্রাসাদ এবং সারা শহর আলোর মালায় সাজানো হলো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তোরণ-দ্বার স্থাপন করা হতে লাগলো। শহরের সবাই উন্মুখ হয়ে রইলো আমীর মারুফকে দেখবার প্রত্যাশায়।

মারুফের বন্ধু মহম্মদ আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। সর্বনাশ, এ তো আত্মঘাতী ব্যাপার ঘটাতে চলেছে মারুফ। সে সামান্য মুচির সন্তান। অথচ চালবোল দিয়ে সুলতানকে বুঝিয়েছে সে জগৎ বিখ্যাত বকিসওদাগর।সত্য ঘটনাটা যখন উঘাটিত হয়ে যাবে তখন বেচারার কী দশা হবে। ও কি জানে না সুলতানের সঙ্গে প্রতারণা করার কী কঠিন সাজা?

কিন্তু মহম্মদ হতভম্ব হয়ে গেলো যখন দেখলো সত্যি সত্যিই মারুফ বিশাল এক বাহিনী নিয়ে শহরের পথ দিয়ে এগিয়ে চলছে। সুলতানের উজির আমীর সেনাপতিরা স্বাগত অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে বরণ করে প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না মহম্মদ।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে বসে রইলো চুপ করে।

 

নয়শো ঊনসত্তরতম রজনী : আবার সে বলতে থাকে–

প্রাসাদে পৌঁছলে সাদর অভ্যর্থনা করে সুলতান তার পাশে এনে বসালো মারুফকে।

মারুফ তার নফরদের বললো, প্রথমে হীরে জহরতের বাক্সগুলো এনে এখানে খোলো।

সুলতানসহ দরবারের সবাই তাজ্জব হয়ে দেখতে থাকলো সেই অভাবনীয় ঐশ্বর্য।

মারুফ সে সব দু’হাতে বিতরণ করতে লাগলো উপস্থিত আমীর উজির এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে। সুলতান রাগে ফুঁসতে লাগলেন, ইস্ জামাইটা কী আহম্মক। এমন সব অমূল্য মণিরত্ন এইভাবে নয় ছয় করে বিলোচ্ছে সে। কিন্তু মুখ ফুটে কথাটি বলার। সাহস হলো না তার।

কিন্তু এক এক করে যখন প্রায় গোটা পাঁচেক বাক্স উজাড় হয়ে গেলো তখন আর মনের ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না তিনি।

—থাক থাক অনেক হয়েছে বাবা, আর বিলিয়ে কাজ নাই। এভাবে দানছত্র করলে শেষ পর্যন্ত আমাদের থাকবে কী?

কিন্তু মারুফ হাসতে হাসতে বললো, আপনি উতলা হবেন না আব্বাজান, আমার ভাড়ার শেষ হবার নয়।

কিছুক্ষণ পরে উজির এসে জানালো, জাঁহাপনার কোষাগার পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আর তিল ধারণের স্থান হবে না।

সুলতান বললেন, প্রাসাদের অন্য একটা মহল খালি করে নিয়ে তাতে রাখবার ব্যবস্থা কর।

মারুফ বললো, শুধু একটাতে হবে না জাঁহাপনা, আপনি আরও চার পাঁচটা বড় বড় কামরা খালি করার হুকুম দিন। আমার সব সামানপত্র তাতেও ধরবে কিনা সন্দেহ আছে।

রাত্রে শাহজাদীর ঘরে এসে মারুফ এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়লো। একদিনে কেঁদে কেঁদে মুখ চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে সে। স্বামীর অদর্শন বিরহ তাকে কাবু করে ফেলেছিলো খুবই। এখন তার অভিমান প্রতিহত হয়ে বর্ষার মতো ঝরে পড়তে লাগলো।

-তুমি আমার সঙ্গেও ছলনা করতে পেরেছ, সোনা? এটা কি তোমার উচিত হয়েছিলো। মারুফ অবাক হয়ে বলে, তোমার সঙ্গে ছলনা? হায় আল্লাহ, একি কথা শোনালে আমায়? খোদা কসম তোমার কাছে কোনও কথা লুকাইনি আমি?

-লুকাওনি? মিথ্যেবাদী কোথাকার। কেন তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়ে বলেছিলে, তুমি এক দীন দরিদ্র মুচির ছেলে? কেন বলেছিলে, তুমি আমার বাবাকে ধাপ্পা দিয়ে আমাদে শাদী করেছ? উজির যখন বাবাকে বিষিয়ে দিচ্ছিল তখন তুমি কোনও প্রতিবাদ করলে না কেন? কেন আমার পরামর্শে প্রাসাদ থেকে পালাবার ছল করে সরে পড়লে? কেন? কেন?

দু হাতে এলোপাতাড়ী কিল বসাতে লাগলো সে মারুফের বুকে পিঠে। মারুফ হাল্কা হাতে ঠেকাবার চেষ্টা করতে করতে বলে, আহা শোনই না আমার কথা!

-না না, আমি শুনবো না, কিছুতেই শুনবো না। তুমি একটা ঠগ প্রতারক্ ধাপ্পাবাজ। মারুফ এবার শাহাজাদীকে শান্ত করার জন্য একটু শক্ত হাতে বুকের সঙ্গে লেপ্টে ধরে অধরে অধর রাখে। মুহূর্তে সব দাপাদাপি শেষ হয়ে যায় শাহজাদীর। সেও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে।

তারপর শান্ত নিস্তব্ধ কয়েকটি মুহূর্ত কেটে যায়।

তারপর আবার ঝড় ওঠে। সে ঝড়ের দাপাদাপিতে কোথায় যে কিভাবে তছনছ ছিন্ন ভিন্ন ছত্রাকার হয়ে যায় সব, তার আর খেয়াল থাকে না কারো।

প্রথম অধিবেশন সমাপ্ত হয়ে গেলে মারুফ শাহজাদীকে নিজের হাতে জড়োয়ার গহনা পরিয়ে দিতে থাকে। গলায় সাতনরী মুক্তোর মালা। নাকে হীরের নাকছাবি, কানে চুণী পান্নার মাকড়ী, কোমরে রত্নবিছা, পায়ে হীরে বসানোে মল, হাতে বাজুবন্ধ, বাহুতে সাপের মাথার মণি বসানো তাগা, মাথায় টায়রা, আর কত কী?

মারুফ বলে, আমার যত আছে রোজ এক প্রস্থ করে নতুন নতুন গহনা এবং সাজ-পোশাক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরতে পারবে। কোনওটা ঘুরিয়ে পরার দরকার হবে না, মণি।

শাহজাদী বলে, এ সবে আমার তেমন আসক্তি নাই, সে তো আমাকে ভালো করেই পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছ। সোনা, আমি চাই তুমি আমার বুকে থাকবে জিন্দগী ভর। আমি তোমার বাঁদী

হয়ে সেবা করবো—এই আমার একমাত্র সাধ!

পরদিন খুব ভোরে সুলতান এসে করাঘাত করলেন দরজায়।

দরজা খুলে সুলতানকে উদভ্রান্ত পাণ্ডুর অবস্থায় দেখে শাহজাদী বিস্ময়াহত হয়ে বাবাকে হাতে ধরে একটা কুর্শিতে বসায়।

-কী হয়েছে বাবা, তোমাকে এমন উদ্বিগ্ন দেখছি কেন?

একটা বাটিতে করে খানিকটা জল এনে সে সুলতানের চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। সুলতান হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে বলে, বড়ই দুঃসংবাদ বেটী। ভাবছি, তোমাদের এই সুখ-মিলনের মুহূর্তে তা বলা ঠিক হবে কিনা।

মারুফ এগিয়ে এসে বলে, আপনি কোনও রকম দ্বিধা সঙ্কোচ না করে খুলে বলুন বাবা, কী হয়েছে?

সুলতান বলে, তোমার লোকজন যারা লটবহর সঙ্গে করে এনেছিলো তারা সংখ্যায় হাজারেরও বেশি হবে। এই এক রাতের মধ্যে তারা কীভাবে কোন দরজা দিয়ে উধাও হয়ে গেছে আমার সদা জাগ্রত প্রহরী কেউই কিছু বলতে পারছে না। শহরের কোনও লোকেরও চোখে পড়েনি তাদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়া। এ তো একেবারে ভুতুড়ে কাণ্ড! কিছুই আমি বুঝতে পারছি না, এমন এক অসম্ভব কাণ্ড ঘটলো কি করে? আমি ভয়ে মরছি, তোমার কাছে এর কৈফিয়ৎ নেব।

মারুফ হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

-আপনি ও নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনা করবেন না, বাবা। ওরা যথাস্থানেই চলে গেছে। এবং হঠাৎ ওদের এই অন্তর্ধানে মোটেই আমি অবাক হইনি। আবার আমি ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে আবার তারা এসে হাজির হবে এখানে। ওদের কোনও অনিষ্ট হয়নি, বেশ বহাল তবিয়তেই সবাই স্বদেশে ফিরে গেছে।

একথা শুনে সুলতান কৌতুক বোধ করলেন। এমন মজার ব্যাপার উজিরকে না বলে কি পারেন তিনি?

-এ সব শুনে তোমার কী মনে এখনও সন্দেহ জাগছে উজির, আমার জামাতা যে সে লোক নয়! তার ওপর আল্লাহর অশেষ করুণার দৃষ্টি আছে। না হলে এমন অসম্ভব কখনও সম্ভব হতে পারে?

উজির মনে মনে বললো, এইবার মওকা পেয়েছি। কি করে প্রতিশোধ নিতে হয় এবার দেখিয়ে দেব বাছাধনকে।

সুলতানকে উদ্দেশ করে সে বলে, জাঁহাপনা, এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। আপনি যদি শোনেন তবে আমার ধারণা, আপনার মনের আঁধার কেটে যাবে।

– বলো কী বলতে চাও?

-এত ধন-দৌলতের উৎস কোথায়, তা যদি জানতে চান তবে আমীর মারুফকে মাতোয়ারা করে দিতে হবে। তাহলে তিনি নিজেই আপনাকে বলে দেবেন এর গুপ্ত রহস্যের কথা। যখন তিনি সরাবের নেশায় নাচতে থাকবেন তখন আপনি তাকে কায়দা করে প্রশ্ন করবেন। এবং দেখবেন তখনই সে গড় গড় করে বলে দেবে সত্যি কথাটা।

সুলতান লাফিয়ে উঠলেন, বাঃ চমৎকার মতলব এঁটেছে তো উজির! সেইদিনই সন্ধ্যাকালে, সুলতান মারুফ এবং উজিরকে সঙ্গে নিয়ে পানাহারে বসলেন।

একে একে অনেকগুলো পাত্র উজাড় করে দিলো মারুফ। ক্রমে নেশা জমে উঠলো। এবং একটু পরে কথা জড়িয়ে আসতে লাগলো তার। কারণে অকারণে হাসির গমকে গড়িয়ে পড়তে থাকলো সে। সুলতান সুযোগ বুঝে মারুফকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বেটা, তোমার জীবনের বিচিত্র অভিযানের কোনও কাহিনীই শোনা হয়নি এতদিন। আজ শোনাবে?

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো সত্তরতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

নেশার ঘোরে আগাগোড়া সব কাহিনী বলে গেলো মারুফ। কাইরোত এক দরিদ্র মুচির ঘরে তার জন্ম, তার দজ্জাল বৌ, তার অমানুষিক অত্যাচার, বাড়ি থেকে পলায়ন—ইত্যাদি ইত্যাদি। সব শেষে কীভাবে তার ভাগ্য পরিবর্তন ঘটলো—কী করে সে দৈব আংটি পেয়ে রাতারাতি বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হতে পারলো—সব কাহিনীই আদ্যোপান্ত বলে গেলো সে গড় গড় করে।

সুলতান এবং উজির উন্মুখ হয়ে তাকালেন মারুফের হাতের দিকে। উজির বললো, আমীর সাহেব, ঐ আংটিটা একবার দেখিয়ে আমাদের চোখকে ধন্য করবেন?

মারুফ বলে, অবশ্যই।

এই বলে নির্বোধ মারুফ সেই মহামূল্য আংটিটা খুলে শত্রু উজিরের হাতে তুলে দিলো।

—এই নিন, এই আংটির মধ্যেই বাস করে ঐ জিন দৈত্য।

প্রায় ছোঁ মেরে আংটি মারুফের হাত থেকে তুলে নেয় উজির। নিজের আঙ্গুলে পরে নিয়ে ঘর্ষণ করে।

সঙ্গে সঙ্গে গুরুগম্ভীর সেই কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

—এই তো আমি এখানে, আদেশ করুন মালিক, কী করতে হবে? যদি বলেন কোনও এক সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিতে পারি, অথবা গড়ে দিতে পারি এক বিশাল শহর সলতানিয়ত। অথবা যদি হুকুম করেন এনে দিতে পারি কোনও সুলতান বাদশাহর শির।

উজির বললো, শোনও আংটির বান্দা, এই খানকীর ছেলে সুলতান আর এই মুচিটাকে এখুনি নিয়ে গিয়ে রেখে এসো এক উত্তপ্ত বালুকাময় মরুভূমির মধ্যে।

সঙ্গে সঙ্গে সুলতান এবং মারুফ শোঁ শোঁ করে ওপরে উঠে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

উজির দরবারে গিয়ে তখতে বসলো। উপস্থিত আমির ওমরাহ সৈন্যধ্যক্ষদের বোঝাতে লাগলো, ঐ অপদার্থ সুলতান এবং তার জামাই এই দেশটাকে রসাতলে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। আমি তাদের ঊষর মরুভূমিতে নির্বাসন দিয়েছি। এখন থেকেই আমিই তোমাদের সুলতান। আমাকে যদি তোমরা সহজভাবে মেনে নাও অতি উত্তম। কিন্তু যদি কেউ বিদ্রোহ করার চেষ্টা কর তবে জেনে রেখ মউৎ, তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

দরবারের কেউই একথার প্রতিবাদ করতে সাহস করলো না। এরপর উজির শাহাজাদীর কাছে সংবাদ পাঠালো, আমাকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হও, শাহজাদী। এতদিন ধরে তোমাকে পাওয়ার জন্যই আমি আকুল হয়ে আছি।

শাহজাদী পূর্বাহ্নেই খবর পেয়েছিলো, উজির বিদ্রোহ করে তার বাপ এবং স্বামীকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। সে বুদ্ধিমতী মেয়ে, খোজা নফরকে দিয়ে খবর পাঠালো, আমি আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আপনি এই বাঁদীকে পায়ে আশ্রয় দিয়ে কৃতার্থ করুন। কিন্তু একটা কথা বলতে শরম হচ্ছে, এখন আমি রজস্বলা হয়েছি। এই অপবিত্র দেহ ক’টা দিন আপনার ভোগে লাগবে না। আমি যখন শুদ্ধ হবে তখন আপনাকে খবর দেব।

উজির বলে পাঠালো, ওসব মাসিক-ফাসিক আমি জানি না, জানতে চাই না, আজই এক্ষুনি আমি তোমাকে সম্ভোগ করতে চাই। আমি যাচ্ছি, তুমি প্রস্তুত থেক।

শাহজাদী জানালো, বেশ আপনার যদি অরুচি না হয় আমার আর আপত্তি কিসের? আসুন, নিজের চোখেই দেখে যান।

খুব দামী সাজ-পোশাকে নিজেকে সাজালো সে। দুষ্প্রাপ্য আতরের খুশবু মেখে নিলো সারা অঙ্গে।

উজির এলো। লাস্যময় বিলোল কটাক্ষ হেনে হাসিমুখে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে কোনও ত্রুটি রাখলো না শাহজাদী।

—আজ আমার কি পরম সৌভাগ্য! এই মধুময় রাত্রিটির জন্য আমি কত কাল ধরে প্রত্যাশা করে বসেছিলাম। এতদিনে সে সাধ আমার আজ পূর্ণ হবে—এ আনন্দ আমি রাখবো কোথায় প্রভু!

এরপর সে ধীরে ধীরে তার অঙ্গবাস ছেড়ে ফেলতে আরম্ভ করে।

হঠাৎ শাহজাদী আর্তনাদ করে উঠে বোরখা টেনে নিয়ে নিজেকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। উজির উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী? কী ব্যাপার অমন চিৎকার দিয়ে উঠলে কেন?

—আপনি কী? একটা অচেনা পরপুরুষের সামনে আমাকে আর বিবস্ত্র হতে বলছেন?

উজির ঘরের এদিক ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে অনুসন্ধান করার ১ চেষ্টা করতে থাকে।

-কই কাউকেই তো দেখছি না, শাহজাদী। তুমি আমি ছাড়া ঘরে তো তৃতীয় প্রাণী কেউ নেই?

শাহজাদী বললো, নেই মানে? আপনার ঐ আংটির ভিতরে একটা আস্ত দৈত্য বসে আছে, আর বলছেন কেউ নেই?

উজির লজ্জিত হয়ে বললো, ইয়া আল্লাহ, একথা তো আমার খেয়ালই ছিলো না একেবারে। হুঁ, তাইতো, এই বান্দাটা চুরিয়ে চুরিয়ে সব দেখে ফেলতে পারতো আমাদের কাজ কারবার? ছিঃ ছিঃ, কি বে-শরম ব্যাপার হতো বলত, শাহজাদী? ভাগ্যে তুমি খেয়াল করেছিলে! দাঁড়াও, এটাকে খুলে বালিশের তলায় চাপা দিয়ে রাখছি। তা হলে তো আর দেখতে পারবে না ব্যাটা।

শাহজাদী বললো, তা বটে। বালিশের নিচে চাপা পড়ে থাকলে আর দেখবে কি করে?

আংটিটা খুলে বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখে উজির উদগ্র কামনা নিয়ে শাহজাদীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ঠিক এই সময় তাক বুঝে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি বসিয়ে দেয় শাহজাদী। একেবারে উজিরের বিচির উপর। অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ে যায় সে মেঝের উপর। এবং সেই সুযোগে বালিশের তলা থেকে টুক করে আংটিটা তুলে নিয়ে নিজের হাতের আঙ্গুলে পরে নিয়ে আস্তে একবার ঘর্ষণ করে শাহজাদী।

-বান্দা আপনার সামনেই আছে, হুকুম করুন মালকিন! শাহজাদী বললো, এই শয়তানটাকে অন্ধকার কূপ-কারাগারে নিক্ষেপ কর। তারপর আমার বাবা এবং স্বামীকে নিয়ে এসো এই প্রাসাদে। দেখো, তাদের যেন কোনও তখলিফ না হয়।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো একাত্তরতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

তৎক্ষণাৎ উজিরকে দলা পাকিয়ে তুলে নিয়ে যায় অদৃশ্য দানব। এবং পর মুহূর্তেই শাহজাদী দেখলো, তার বাবা এবং স্বামী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

-তোমার খুব কষ্ট হয়েছে না?

শাহজাদী বাবা এবং স্বামীর কাছে এগিয়ে আসে।

সুলতান বলে, হ্যাঁ তা বেশ হয়েছে। ধূ ধূ করা উত্তপ্ত মরুপ্রান্তরে কোথাও একবিন্দু পানির চিহ্ন নাই। তবে অনেক ভাগ্য যে অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরিয়ে আনতে পেরেছ তুমি। না হলে দু-একদিনের মধ্যেই মরতে হতো সেখানে। কিন্তু মা, এমন অসাধ্য সাধন কী করে করলে তুমি। উজিরের হাত থেকে তোমার হাতে এলো কী করে ঐ আংটিটা?

শাহজাদী বললো, সে সব কথা পরে বলছি বাবা, আগে তোমরা একটু জিরিয়ে নিয়ে খানাপিনা করে নাও।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে উজিরের বদমাইশির সব কাহিনী সবিস্তারে বললো শাহজাদী। সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইলেন। ওকে আমি ফাঁসী দেব, আগুনে পুড়িয়ে মারবো। কী বলো, মারুফ?

-তাই করুন বাবা, ও লোকের আর বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নাই। তারপর শাহজাদীর দিকে হাত বাড়িয়ে সে বললো, কই আমার আংটিটা আমাকে দিয়ে দাও, মণি।

শাহজাদী ভ্রূকুটি হেনে বললো, না, এটা আমার কাছেই থাকবে। তোমার হাতে থেকেই তো এই বিপত্তি ঘটলো। তোমাকে দিলে আবার কখন কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে কে জানে। তার চেয়ে আমার কাছেই থাক।

মারুফ বললো, তা যা বলেছ। আমি তো ছাই অত প্যাচ পয়জার বুঝি না। কখন কে ঠকিয়ে হাতিয়ে নেবে কে জানে। থাক, ওটা তোমার কাছেই থাক।

পোলো মাঠে উজিরের ফাঁসীর মঞ্চ তৈরি করা হলো। তার নিচে সাজানো হলো কাঠের লকড়ি। এবং তাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো আগুন। হাজার হাজার শহরবাসীর উপস্থিতিতে উজিরের জীয়ন্ত দেহটা লেলিহান অগ্নিশিখায় পুড়ে আংরা হয়ে গেলো মুহূর্তে।

সুলতান মারুফকে সিংহাসনে বসিয়ে শাসনভার তুলে দিলেন তার হাতে। আংটিটা শাহজাদীর হেফাজতেই রয়ে গেলো। এরপর মারুফ সুখে শান্তিতেই বেশ কিছুকাল কাটালো।

কিন্তু বিপদ ঘটলো একদিন রাত্রে।

প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে নিজের কামরায় এসে সবে শুয়ে পড়েছে, এমন সময় অতর্কিতে এক আধবুড়ো মেয়ে মানুষ ঝাপিয়ে পড়লো তার গায়ের ওপর। বাঘিনীর মতো সে হুঙ্কার ছাড়লো। মারুফের দাড়িগুচ্ছ মুঠি করে ধরে বেদম ঘুষি চালাতে লাগলো। ফলে, তার আরও দু’খানা দাঁত ভেঙ্গে পড়ে গেলো তক্ষুণি।

এই অর্ধ বুড়িটা যে কে তা নিশ্চয়ই আপনাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি? মারুফের বৌ ফতিমা খুঁজতে খুঁজতে এত দূর দেশ অবধি চলে এসেছে।

—হুম, তুমি ভেবেছ, দেশ ছাড়া হয়ে পালিয়ে বাঁচবে? আমাকে না বলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুবার কী করে তোমার সাহস হলো সেই কৈফিয়ত আমার চাই। ওরে কুত্তার বাচ্চা, তুই কি ভেবেছিলি পালিয়ে নিস্তার পাবি আমার হাত থেকে? মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব তোর, শয়তান, বেল্লিক কোথাকার!

মারুফ কোনও প্রকারে ফতিমার কজা থেকে নিজেকে মুক্ত করে চোচা দৌড় দিয়ে শাহজাদীর ঘরে এসে ঢুকে পড়ে। মাথার টুপী উড়ে গেছে গায়ের কামিজ আধখানা ফতিমার হাতের মুঠোতেই রয়ে গেছে। পায়ে চটি নাই।

শাহজাদী মারুফের এই উদভ্রান্ত, আতঙ্কিত মূর্তি দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, কী হয়েছে? তোমার এ দশা হলে কী করে?

—আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও সোনা। এই বলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো শাহজাদীর পায়ের তলায়।

একটা বাটিতে করে জল এনে স্বামীর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতে থাকে শাহজাদী। একটু পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকায় মারুফ। ঠিক এই সময় দজ্জাল ফতিমা রণমূর্তি ধরে শাহজাদীর কামরায় ঢুকে পড়ে চড়া গলায় জিজ্ঞেস করে, কোথায় সেই খানকীর বাচ্চা, আজ তারই একদিন কি আমারই একদিন দেখে নেব আমি।

তারপর শাহজাদীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিয়ে দাঁত কড়মড় করে চোখ পাকিয়ে তাকায়, হুম, তাহলে তুমিই সেই মেয়েমানুষ। দাঁড়াও তোমারও ওষুধের ব্যবস্থা করছি।

শাহজাদী বুঝতে পারলো উন্মাদ মেয়েছেলেটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই মুহূর্তে সে আংটিটা ঘষে দৈত্যকে হুকুম করলো, ঐ মেয়েটাকে পাকড়াও কর যেন সে আমার ওপর চড়াও হতে না পারে।

ফতিমা প্রাণপণে কসরৎ করেও নিজের হাত পা এক চুল এদিক ওদিক করতে পারে না। ক্রোধে দাঁত কড়মড় করতে পারে শুধু। চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলতে থাকে।

মারুফ এগিয়ে আসে ফতিমার কাছে। কিন্তু তার সেই বীভৎস ভাবে দাঁত মুখ খিচানো দেখে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

শাহজাদী আংটির দৈত্যকে বলে, ওকে এবার বাগানে নিয়ে গিয়ে একটা গাছের গুড়ির সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে দাও।

এরপর ফতিমার কি হয়েছিলো জানি না, তবে মারুফ আর শাহজাদী সুখে সম্ভোগের মধ্যে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলো দু’জনে।

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে থামলো।

সুলতান শারিয়ার বললো, রাত তো এখনও অনেক বাকী। আর একটা আরম্ভ কর শাহরাজাদ। তোমার গল্প শোনার নেশা আমায় পেয়ে বসেছে।

শাহরাজাদ বলে, সে তো আমার সৌভাগ্য, আঁহাপনা! আপনি যত দিন শুনতে চাইবেন ততদিনই তো আমি বেঁচে আছি। আমি যেদিন আপনার মনমত কিসসা শোনাতে পারবো না সেইদিনই তো আমার দিন শেষ হয়ে যাবে।

থাক ওকথা। এবার নতুন কাহিনী শুনুন, জাঁহাপনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *