3 of 4

৪.০৩ কামর ও হালিমার কাহিনী

সাতশো আশিতম রজনী।

শাহরাজাদ নতুন কাহিনী বলতে শুরু করে :

কোনও এক সময়ে এক শহরে আবদ অল রহমান নামে এক ধনী সওদাগর বাস করতো। আল্লাহর কৃপায় সে একটি পরম রূপবান পুত্র এবং পরমাসুন্দরী এক কন্যা লাভ করেছিলো।

সওদাগর পুত্র-কন্যার অলোকসামান্য রূপলাবণ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওদের দুজনকে ঘরের মধ্যে তালাবন্ধ করে লোকচক্ষুর অন্তরালে লালন-পালন করতে থাকে। একটিমাত্র বিশ্বাসী বৃদ্ধ নফর ওদের দু’জনকে দেখাশুনা করতো। ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে ওরা বড় হতে থাকে।

এইভাবে চৌদ্দটা বছর কেটে গেছে। ছেলের দেহে যৌবনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। একদিন সওদাগর-গৃহিণী স্বামীকে একান্তে ডেকে বললো, বলি ছেলের বয়স কত হলো খেয়াল আছে?

সওদাগর বলে, থাকবে না কেন, এইতো চৌদ্দ চলছে।

—তবে ছেলে কি এখনও সেই কচি খোকাটি আছে নাকি ভাবছ? তার বিয়ে শাদী দিতে হবে? তাকে ব্যবসা-বাণিজ্য বুঝে শুনে নিতে হবে না। ঐভাবে অন্ধকার ঘরে ওদের বন্দী করে কী ফয়দা ওঠাবে শুনি?

–আহা বিবিজান, সওদাগর স্ত্রীর উন্মা শান্ত করতে বলে, তুমি বুঝছ না কেন, কামর তো আর বাচ্চা ছেলের মত সাধারণ রূপলাবণ্য নিয়ে জন্মায়নি। ওর দিকে তাকালে যে ভয় করে আমার। অমন সর্বনাশা রূপ তো বাপু আমি আমার জীবনে কোথাও দেখিনি। আল্লাহর একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকা উচিত। একটামাত্র আমার পুত্র-সন্তান, সুলতান বাদশাহর ঘরে জন্মায়নি, গায়ে গতরে খেটে খেতে হবে। সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে মিশতে হবে না। এমন ঘরে এতো রূপবান পুত্রের কী দরকার ছিলো বিবিজান?

-ওমা, একি কথা, সওদাগর-গৃহিণী ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, তুমি বাপ হয়ে একি কথা মুখে আনছে গো? ছেলেমেয়ে দেখতে সুন্দর হবে, এ তো বাবা মায়ের চির-জীবনের সাধনা। কোথায় খুশিতে ডগমগ হবে, তা না আল্লাহর উপর দোষারোপ করছো?

সওদাগর বলে, তুমি আমার আসল কথাটাই বুঝলে না, বিবিজান। ছেলেমেয়ে খুবসুরত হবে, তা তো বলিনি। সব বাবা-মাই চায় তাদের সন্তানরা সুদর্শন সুন্দর হোক। কিন্তু তা বলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ঘরে আসমানের চাঁদ—একি শোভা পায়, বলল, না এর ঝামেলাই সহ্য করা যায়?

-ঝামেলা? ছেলেমেয়েকে তুমি ঝামেলা মনে কর?

—এ্যাঁই দ্যাখো, আমি বলতে চাইছি এক আর তুমি বুঝছো আর এক। কী মুশকিল বলতো।

–থাক থাক, অত বোকা বুঝিয়ে আর কাজ নেই। সে যাকগে, এখন যা বলছি মন দিয়ে শোনো।

-বলো।

—বলি আখেরের কথা তো কিছু ভাবতে হবে?

-আলবত ভাবতে হবে।

—তাহলে ছেলেকে ঘরের মধ্যে কয়েদ করে রাখছ কেন? তাকে দোকানে বসাতে হবে না। তোমার বয়স হয়েছে। আল্লাহ করুন তুমি শ’ সাল বেঁচে থাক! কিন্তু মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের কথা কিছুই বলা যায় না। আমিও আগে যেতে পারি, তুমিও পার। ধর যদি অসময়ে তেমন কিছু একটা বিপদই ঘটে যায় তখন ছেলেমেয়ে দুটো কি পথে বসবে?

সওদাগর বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, কেন, পথে বসবে কেন? জান, বাজারে আমার কত বড় দোকান, এতে আমার খদ্দেরপাতি। দেখে শুনে খেলে সাত পুরুষের কোনও ভাবনা থাকবে না।

—দেখে শুনে খেলে—তা দেখাশোনাটা কে করবে শুনি। ছেলেকে তো ঘরে পুরে রেখেছ। ধর আজ বাদে কাল তুমি ইন্তেকাল করলে। তখন হঠাৎ যদি একটা ফুটফুটে ছেলে গিয়ে গদীতে গিয়ে বসে বলে, এ দোকানের আমিই মালিক। লোকে শুনবে?তারা মুখ টিপে হাসবেনা? বলবে না, কই সওদাগর সাহেবের কোনও লেড়কা আছে বলে তো আমরা কখনও শুনিনি? তোমার ছেলেকে যদি দোকানে তারা ঢুকতে না দেয় তখন আমি কি কাছারীআদালত করতে যাবো? সংসারে বাঁচতে গেলে সমাজ ছাড়া বাঁচা যায় না। তাদের সকলের মতামত অগ্রাহ্য করেও টিকতে পারা যায় না। তাই আগে থেকেই সাবধান হতে হয়।

সওদাগর অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করে, তা—এখন কী করতে বলো আমায়।

-কী আবার বলবো, ছেলেটাকে এখন থেকে সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে যাও। গদীতে বসিয়ে রাখ তাকে। পাঁচজনে দেখুক, জানুক এ তোমারই ঔরসজাত সন্তান। তারপর আস্তে আস্তে দোকানদারীও শিখে নেবে সে। খদ্দেরদের সঙ্গেও জানপছান হবে।

সওদাগর অনেকক্ষণ ধরে গৃহিণীর কথাগুলো অনুধাবন করে দেখলো।হুম, নাঃ, অন্যায় কিছু বলেনি কামরের মা। আজ যদি সে হঠাৎ মারা যায় তখন ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠতে পারে। পাড়া-পড়শী বা সমব্যবসায়ীরা কামরকে হঠাৎ দেখে তার ঔরসজাত সন্তান বলে স্বীকার নাও করতে পারে। হয়তো এমনও ভাবতে পারে, স্ত্রীর অন্য কোনও ভালোবাসার ছেলে! ছিঃ ছিঃ, সে কি লজ্জার ব্যাপার হবে।

-কই গো শুনছো, সওদাগর বিবিকে ডেকে বলে, ভেবে দেখলাম, তোমার কথাই ঠিক। ছেলেকে পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করানো দরকার। তা আর দেরি কেন, আজ থেকেই নিয়ে যাবো। ওকে খাইয়ে-দাইয়ে সাজিয়ে তৈরি করে দাও।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো একাশিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে : ছেলের হাত ধরে সওদাগর দোকানের পথে রওনা হয়। কিন্তু মুহূর্তেই বিপদ ঘনিয়ে আসে। পঙ্গপালের মতো পথচারিরা এসে হেঁকে ধরে কামরকে। সকলের চোখে-মুখে দারুণ বিস্ময়। এমন আসমানের চাঁদ মাটিতে নেমে এলো কী করে? কেউ হাত ধরে টানে। কেউ গাল টিপে আদর করে। কেউ বা চুমু খেয়ে যায়।

সওদাগর প্রাণপণে ভিড় ঠেলতে থাকে। ভয় হয় ভীড়ের চাপেই বুঝি তার ছেলেটা মারা যাবে। সে চিৎকার করে ওঠে, কী করছো তোমরা, সরে যাও। ছেলেটা মরে যাবে যে।

কিন্তু সে কথায় কেউ কর্ণপাত করে না। মুহূর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আজব বস্তু দেখার কৌতূহলে দলে দলে ছুটে আসতে থাকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।

সওদাগর ছেলেকে নিয়ে কোনক্রমে ছুটতে ছুটতে এসে দোকানে ওঠে। ছেলেকে পাঠিয়ে দেয় দোকানের পিছনের দিকে। কিন্তু জনতা তখন উত্তাল হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ দোকানের সামনে এসে হুড়োহুড়ি করতে থাকে।

এই সময় ভিড় ঠেলে এক পলিতকেশ বৃদ্ধ দরবেশ এসে ঢুকলো। দোকানে। সওদাগর সসম্রমে স্বাগত জানালো ফকিরকে।

-কোথায় তোমার লেড়কা? সওদাগর বললো—ওই ওপাশে বসে আছে। এদিকে রাখলে বাজারের মানুষ ওকে ছিঁড়ে খাবে। তাই লোকের চোখের আড়ালে VI বসিয়ে রেখেছি।

দরবেশ কামরের পাশে গিয়ে বসে। দোকানের বাইরে জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।ওই লোকটাকে বাইরে বের করে দিন। বুড়ো দরবেশগুলো ছেলে খাওয়ার যম।

সওদাগর চিন্তিত হয়ে ওঠে। সত্যিই এই সব ঘাটের মড়া ফকিরগুলো সাধারণতঃ ভীষণ বদ হয়। ছোট ছোট খুবসুরত ছেলেদের ওপর ওদের ভীষণ লোভ। সওদাগর দিশাহারা হয়ে পড়ে। অবস্থায় কী করে সে ছেলেকে উদ্ধার করবে?

-ফকির সাহেব, এবার তাহলে আসুন, আমার দোকান বন্ধ করে ঘরে যাবো।

সওদাগর নিরুপায় হয়ে দোকান বন্ধ করে পালাবার সিদ্ধান্ত পাকা করে। কিন্তু দরবেশ ওঠার নাম করে না। সওদাগর ভাবে, লোকটা পয়সা-কড়ি না নিয়ে নড়বে না। একটা মোহর তোড়া ওর সামনে রেখে বলে, আজকের মতো ক্ষান্তি দিন। আমি দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যাবো।

গৃহিণীর ওপর আক্রোশে মনে মনে সে গজরাতে থাকে, আজ আগে বাড়ি যাই, তারপর তারই একদিন কী আমারই একদিন, দেখে নেব। উফ, ছেলেকে দোকানদারী শেখাতে হবে। এখন শেখাও দেখি দোকানদারী। কাল থেকে মা-বেটাকে দোকানে পাঠাবো। দেখবে, কত ধানে কত চাল।

দোকানের ঝাপ বন্ধ করে দেয় সওদাগর আবদ অল রহমান। দরবেশ টাকার তোড়াটা স্পর্শ করে না। ওদের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে।

সওদাগর ছেলের হাত ধরে হন হন করে বাড়ির পথে রওনা হয়। কিন্তু দরবেশটা ওদের পিছু ছাড়ে না। সে ততোধিক লম্বা লম্বা পা ফেলে রহমানের পাশে এসে চলতে চলতে বলে, আজকের রাতটা আমি তোমার বাড়িতে মেহমান হতে চাই সওদাগর।

লোকটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে রহমানের। এখনকী উপায় হবে। হাদিসের নির্দেশ আছে কোনও মুসাফীর যদি মেহমান হয়ে আসে তাকে ফিরিয়ে দিলে মহাপাতক হতে হবে। ইসলামের নির্দেশ অমান্য করবে কী করে সে? কিন্তু লোকটার মতলব ভালো নয়, ওকে বাড়িতে আশ্রয়ই বা দেবে কী করে সে?

একবার যখন সে নিজের মুখে বলেছে তার ঘরে মেহেমান হবে তখন কিছুতেই তাকে না করতে পারবে না রহমান। কিন্তু তা বলে লোকটাকে সারারাত সে আশ্রয় দেবে না তার ঘরে। সকাল সকাল খাইয়ে ওকে বিদেয় করে দেবে সে। কিন্তু লোকটা যদি বদ মতলব নিয়ে আমার ছেলের দিকে নজর দেয় তবে মেহমান বলে আর রেয়াত করবো না ওকে। আস্ত কবর দেব আমার বাগানে। তারপর ফৌজকে যেতে হয় যাবো, কুছ পরোয়া নাই।

লোকটার ভড়ং আছে আঠারো আনা। বাড়িতে পৌঁছেই সে নামাজের ব্যবস্থা করতে বলে রহমানকে। মেহমানের যাতে অনাদর না হয় সে দিকে সওদাগর সচেতন। মাদুর পেতে দিলো। রুজু করার পানি এনে দিলো। দরবেশটা নামাজাদি শেষ করে কোরাণ পাঠ করতে থাকলো। সওদাগর ভাবে, নিয়মমতো অনেকেই কোরাণের কিছু অংশ পাঠ করে রেখে দেয়। কিন্তু অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, লোকটা কোরাণ থেকে আর চোখ ফেরায় না। পাতার পর পাতা সে পাঠ করতে থাকে। সওদাগর নিরুপায়। রাত গভীর হয়ে আসে। কিন্তু ফকিরকে বলতে পারে না পাঠ শেষ করুন, খানা-পিনা সেরে নিন, আপনাকে চলে যেতে হবে। কিন্তু লোকটা থামতে জানে না বোধ হয়। রহমান ছটফট করতে থাকে। ঘরছেড়ে ভিতের চলে যায়।

কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে অতিথিকে একা ফেলে অন্যকাজে মন দিতে নাই। তাই সে কামরকে বলে, যা তো বাবা, ফকির সাহেবের পাশে গিয়ে বসে কোরাণ পাঠ শোন। ধর্ম কথা কানে গেলেও পুণ্য হবে।

কামর বলে, কিন্তু আব্বাজান লোকটা দোকানে হাত লাগিয়ে আমার গাল টিপে দিয়েছিলো।

রহমান হাসে, বুড়ো মানুষ, একটু আদর করেছে, তাতে দোষ কী। যা কাছে গিয়ে বোস। যদি একটু আধটু আদর টাদর করে, উঠে আসবেনা যেন। হাজার হলেও মেহেমান তো, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।

ছেলেকে দরবেশের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে কিন্তু রহমান নিশ্চিন্ত হতে পারে না। দোতলার একটা ঘরের জানলার পাশে গিয়ে বসে সে। সেখান থেকে দরবেশকে পুরো নজর করা যায়। কিন্তু দরবেশ তাকে দেখতে পাবে না।

কামর আসে। দরবেশের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটার চোখ ছলছল করে ওঠে।

—এসো এসো, কাছে এসো, বেটা। এখানে আমার কোলে এসে বোস।

আহা গলায় যেন মধু ঢালা। কামরকে এতক্ষণ না দেখতে পেয়ে মনে মনে সে যে হা হুতাশ করছিলো তা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কামর তার কোলে অবশ্য বসেনা, কিন্তু বেশি দূরত্ব না রেখে প্রায় গা ঘেঁষেই বসে পড়ে।

দরবেশ বলে, বসো বেটা ভালো করে বসো। কোরাণ পাঠ করি, মন দিয়ে শোন।

দরবেশ এক মনে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে থাকে। ভাবাবেগে অশ্রুধারা নামে তার দু’গাল বেয়ে। দোতলার ওপর থেকে রহমান এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে অবাক হয়। মিথ্যাই সে তাকে সন্দেহ করে ছিলো। আসলে সে তো এক ধর্মপ্রাণ।

তাড়াতাড়ি সে নিচে নেমে আসে। দরবেশের সামনে হাত জোড় করে বলে আমার গোস্তাকি মাফ করবেন ফকির সাহেব। আপনার চোখে জল কেন? আমার আদর যত্নে কী কোনও দোষ হয়েছে।

দরবেশ স্মিত হেসে বলে, না বাবা সে সব কিছু নয়।

-তবে?

-কেন বাবা আমার পুরোনো ক্ষত খুচিয়ে আবার ঘা করে দিতে চাইছো?

রহমান বলে, আমি আপনাকে জোর করছিনা, বাবা সাহেব। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তবে আমাকে শোনাতে পারেন। শুনতে বড় কৌতূহল হচ্ছে আমার। বৃদ্ধ বললো, বেশ তাহলে বলছি, শোনো।

আমি এক কপর্দকশূন্য দরিদ্র দরবেশ। এ সংসারে নিজের বলতে কোনও ধন-সম্পদই আমার নাই। আল্লাহর আশীর্বাদই আমার একমাত্র পাথেয়। তাই সঙ্গে করে দেশে দেশে পথে-পথে ঘুরি।

এমনি ভাবে চলতে চলতে একবার এক জুম্মাবারের সকালে বসরাহ শহরে পৌঁছলাম। বাজারে ঢুকে দেখি কোথাও কোনও জনপ্রাণী নাই। অথচ প্রতিটি দোকানপাট খোলা। নানারকম জিনিসপত্রে ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো গোছানো। অবাক কাণ্ড, আতিপাতি করে তলাশ করেও না কোনও খদ্দের, না কোনও দোকানী—কারও দেখা পেলাম না। চারদিকে যেন কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। ভাবতে লাগলাম, দোকানপাট যেভাবে পসরা সাজানোতাতে মনে হয় এইমাত্র সবাই ছিলো, কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মুহূর্তে সকলে উধাও হয়ে গেছে।

খিদেয় আমার পেট জ্বলছিলো। সামনেই দেখলাম এক হালুইকরের দোকান। থরে থরে মিঠাই মণ্ডা সাজানো। মনে হলো, এইমাত্র বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। দোকানে ঢুকে যতটা প্রাণ চায় খেলাম। পাশেই একখানা কাফিখানা। সেখানে ঢুকে নানারকম কাবাব, কোরমা, বিরিয়ানী, কালিয়া যা ইচ্ছে হলো পেট পুরে খেয়ে নিলাম। সত্যি, বিশ্বাস কর, অমন মুখরোচক সুগন্ধী খানা আমি তার আগে কখনও আস্বাদ করিনি। এরপর আমি এলাম এক শরবতের দোকানে। এক পেয়ালা খুসবুওয়ালা পেস্তার শরবত খেয়ে প্রাণটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ জানাতে থাকলাম।

শরবত খেয়ে দোকান থেকে রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটছি। চারদিক নিথর নিস্তব্ধ। নিজের পায়ের শব্দে নিজেইচমকে উঠতে থাকলাম।এতো বড় শহর, কোথাও কোনও জনপ্রাণী নাই—যেন এক বিরাট কবরখানার মধ্যে দিয়ে চলেছি।

হঠাৎ এক বাজনার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম! তবে কী কেউ বা কারা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। নানারকম বাদ্যযন্ত্রের লহরা কানে স্পষ্টতর হতে থাকলো। কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম, এ সঙ্গীত কোনও শুভ সংকেত নয়। নিশ্চয়ই কোনও শয়তানের কাজ। আমি একটা গুদোমের পালাকরা বস্তার আড়ালে লুকিয়ে রাস্তার দিকে চোখ মেলে রাখলাম। সেখান থেকে পথচারীদের আমি সবই প্রত্যক্ষ করতে পারবো কিন্তু ওরা শত চেষ্টা করলেও আমাকে দেখবে না কেউ।

একটু পরেই বুঝতে পারলাম বাদ্যযন্ত্রীদের সঙ্গে একটা মিছিল আসছে। উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলাম পথের দিকে।

পরীর মতো সুন্দরী চল্লিশটি মেয়ে পথের দুধার দিয়ে দুই সারি বেঁধে চলেছে। তাদের রূপের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু এহ বাহ্য। এদের পিছনে একটা খচ্চরের পিঠে আসীন এক অলোকসামান্যা পরমাসুন্দরীকে দেখে আমার মাথা ঘুরে গেলো। পথে প্রবাসে ঘুরে ঘুরেই আমার দিন কাটে। জীবনে অনেক ভালো অনেক খারাপ অনেক সুন্দর অনেক অসুন্দর আমি দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর বাবা, সে দিন যাকে দেখেছিলাম তার জুড়ি দেখিনি কোথাও? কোনও মেয়ে যে অমন রূপসী হতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। আমার মুখে এমন কোনও ভাষা নাই যে তার রূপের বর্ণনা দিতে পারি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিল পার হয়ে গেলো, আমি বস্তার আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, যে দোকানপাট একটু আগেও জনশূন্য খাঁ-খাঁ করছিলো তা আবার মুহূর্তেই দোকানী আর খদ্দেরে সরগম হয়ে উঠেছে। একজনকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, কাকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে গেলো ওরা? আমার প্রশ্ন শুনে লোকটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আপাদমস্তক এক সন্দেহের চোখে একবার দেখে নিয়ে ভীতচকিত হয়ে সরে গেলো, কোনও জবাব দিলো না। আর একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু সেও ভূত দেখার মত ভয় পেয়ে ছুটে পালালো। এরপর যাকেই জিজ্ঞেস করি কেউ আমার কথার জবাব না দিয়ে সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে কেটে পড়ে। শেষে এক নাপিতকে পাড়কাও করলাম, ও নাপিত ভাই, ব্যাপার কী বলতে পার, কে গেলো মিছিল করে?

আমার কথা শুনে নাপিত কানে আঙ্গুল দিলো। ফিস ফিস করে বললো, ওসব কথা জিজ্ঞেস করতেও নাই, জবাব দিতেও নাই। মনে হচ্ছে আপনি পরদেশী, এখানে আর আপনার একদণ্ডও থাকা উচিত নয় মুসাফির। আপনি এ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। এর বেশি আর কিছু জানতে চাইবেন না, বলতে পারবো না। জানে যদি বাঁচতে চান, এখুনি শহর ছেড়ে পালান। ভাগ্যে আপনি মিছিল আসার আগে বুদ্ধি করে আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলেন, না হলে আপনার কাটা মুণ্ডু এখানে গড়াগড়ি যেত। আমরা সদা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকি। একটু আগের দোকান-পাটের অবস্থা দেখে টের পেয়েছেন আশা করি। কখন যে কার ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, কেউ জানি না আমরা।

নাপিতের কথা শুনে বুঝলাম ও-শহরে আমার মতো ভাব-ভোলা মানুষের আর এক দণ্ডও অবস্থান করা উচিত নয়। তাই সেই মুহূর্তেইশহর ছেড়ে প্রান্তরের পথে বেরিয়ে পড়লাম। চলতে চলতে অবশেষে আজ এসে পৌঁচেছি তোমাদের এই শহরে। এসেই দেখলাম তোমার এই পুত্রকে। আহা, চোখ জুড়িয়ে যায়। তখন থেকে আমার শুধু একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছে, এ ছেলের একমাত্র জুটি ঐ বসরাহ-সুন্দরী! বসরাহতে তাকে দেখার পর থেকে শুধু এই কথাই ভেবেছি, এমন তুলনাহীন সুন্দরীর যোগ্য বর কোথায় মিলবে? তা আল্লাহ যখন তাকে পয়দা করেছেন, তার উপযুক্ত জুটিও যে বানাবেন তাতে আর সন্দেহ কী? তোমার পুত্রকে দেখে বুঝলাম এ পাত্র একমাত্র তারই যোগ্য হতে পারবে। এখন খোদর কী অভিপ্রায় জানি না, তবে এরা একসঙ্গে মিললে সোনায় সোহাগা হবে।

দরবেশ তার কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো, ব্যস, আজ এই পর্যন্ত। এবার আমি বিদায় নিচ্ছি, সওদাগর। তোমার আতিথেয়তা আমার মনে থাকবে। আমি আশা করবো তোমার পুত্র বসরাহ-কন্যাকে শাদী করে সুখ-সম্ভোগে বসবাস করুক।

এরপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই রাতের অন্ধকারেই পথে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

তরুণ কামর সারাটা রাত বিনিদ্রভাবে কাটালো। বৃদ্ধ দরবেশ তার মনে নতুনরঙ ধরিয়ে দিয়ে গেলো। কল্পনার তুলি দিয়ে মনে মনে সে সেই বসরাহ-কন্যার ছবি আঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই তার অলোকসামান্যা রূপলাবণ্যের মূর্তিটি প্রতিভাত করতে পারে না।

পরদিন সকালে উঠে সে মা-এর কাছে গিয়ে বায়না ধরে, মা আমি আজইবরাহ পথে রওনা হবো। আমার সামান-পত্র গুছিয়ে দাও। ঐ বসরাহ-কন্যাকে না পেলে এ জিন্দগী বরবাদ হয়ে যাবে আমার।

মা কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। স্বামী আবদ অল রহমানকে ডেকে বললো, শোনো তোমার ছেলের কথা। সে গোঁ ধরেছে, বসরাহয় যাবে। সেই মেয়েকে ছাড়া আর কাউকে সেশাদী করবে না।

রহমান ছেলেকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো। বিদেশ বিভূঁই জায়গা। জানা নাই, চেনা নাই, আন্দাজে কোথায় যাবি, বাবা?

কিন্তু কামর তার মত বদলাতে রাজি নয়। সে যখন ভেবেছে, যাবেই। তাতে যা ঘটে ঘটুক। সে বললো, আমি যাবই। এতে যদি তোমরা বাধা দাও, আমার মরা মুখ দেখবে।

মা-বাবা দুজনেই শিউরে ওঠে, ওকি কথা! অমন অলুক্ষণে কথা মুখে আনতে নাই বাবা।

রহমান সব দোষ তার বিবির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে, তুমিই যত নষ্টের গোড়া। তোমার বুদ্ধিতে চলতে গিয়ে আজই ছেলেটাকে খোয়াতে বসেছি।

দুঃখে হতাশায় সে ভেঙ্গে পড়ে, আবদ অল রহমান, নিজেকে বড় বুদ্ধিমান ভেবেছিলো! অতি সাবধানে ছেলেকে সিন্দুকে পুরে আগলে রাখতে চেয়েছিলো। ঠিক হলো, এই তোমার উচিত পুরস্কার পাওনা ছিলো।

যার নসীবে যা লেখা থাকে কেউই খণ্ডন করতে পারে না। কামর-এর মা স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে, এ নিয়ে আর হা-হুতাশ করে কী করবে বলো। যা ঘটবার তা ঘটবেই। তুমি আমি হাজার কোসিস করেও ঠেকাতে পারবো না।

 

ছেলের যাত্রার গোছগাছ করে দিলো মা। একটা বটুয়াতে ভর্তি করলো হীরে চুনী পান্না! ছেলের হাতে দিয়ে বললো, ভালো করে সঙ্গে রাখিস। বিপদ আপদের সহায়!

রহমান ছেলেকে নব্বই হাজার দিনার রাহাখরচ দিলো। এবং তার পুরোনো নফরদের দু’জনকে সঙ্গে দিয়ে বললো, এরা দু’জন আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং প্রিয় বান্দা, তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, দেখাশুনা করবে। এদের পরামর্শ অমান্য করো না। কারণ, নফর হলেও, এরা তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়—জ্ঞান বৃদ্ধ।

উটের পিঠে রসদ এবং অন্যান্য সামানপত্র চাপিয়ে সেইদিনই কামর ইরাকের পথে রওনা হয়ে গেলো। এবং কিছুদিন পরে নিরাপদেই বসরাহতে এসে পৌঁছলো।

রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

সাতশো তিরাশিতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–

সেদিনও ছিলো জুম্মাবার। কামর শহরে প্রবেশ করেই দরবেশের কথার সত্যতা বুঝতে পারে। কী আশ্চর্য, পথঘাট জনশূন্য, দোকানপাট খোলা! থরেথরে সামানপত্র সাজানো। কিন্তু কোনও দোকানে দোকানীও নাই, খদ্দেরও নাই। যেদিকে তাকায় খাঁ খাঁ করছে। নিজের পায়ের শব্দেই সে চমকে ওঠে।

খিদে পেয়েছিলো ভীষণ। একটা দোকানে ঢুকে পেটপুরে খেয়ে নিলো কামর। কিন্তু দাম মেটাবে কাকে? কেউ তো দোকানে নাই। যাই হোক, বাইরে বেরিয়ে আসতেই দূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ বাদ্য-সঙ্গীত শুনতে পেয়ে সে দরবেশের কথা স্মরণ করে একটা গুদোমের পালাকরা বস্তার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো।

একটু পরেই মিছিল বাজারের পথের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো। কামর উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলো পথের দিকে।

চল্লিশটি সুবেশা অপ্সরীর মতো সুন্দরী রমণী-পরিবৃতা হয়ে এক নবযৌবন-উদ্ভিন্না সুকুমারী ভ্রমণে বা বিহারে বেরিয়েছে। দরবেশ তার লাবণ্যের অসামান্যতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেনি, শুধু বলেছিলো দুনিয়ার সর্বত্র সে ঘুরেছে সারা জীবনভোর, কিন্তু অমন রূপ সে কখনও দেখেনি। কামর ভাবলো, ফকির সাহেব সত্যিই বলেছিলো—এ রূপের জুটি মেলা ভার।

রুদ্ধশ্বাসে অপলক দৃষ্টিতে তরুণীর রূপসমুদ্রে অবগাহন করতে থাকে কামর। এতদিনের পথ-শ্রম, মা-বাবার মনে দুঃখ দিয়ে চলে আসা—সব আজ তার কাছে সার্থক হয়ে উঠলো এই মুহূর্তে। মনে মনে নিজেকে সহস্র ধন্যবাদ জানাতে থাকে সে,-ধন্য কামর, তুমি আজ সত্যই ধন্য হয়ে গেলে। আজ দুচোখ ভরে যে রূপ তুমি দর্শন করলে, তারপর তোমার যদি মৃত্যুও আসে কোনও খেদ থাকবে না।

মিছিল অদৃশ্য হয়ে গেলে কামর বাইরে এসে দেখে পথঘাট হাটবাজার জনসমাকীর্ণ। দোকানী 1 দোকানে বসেছে, খদ্দের দরদাম করে কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কী আশ্চর্য, এদের মুখ দেখে বুঝবারই জো নাই, একটু আগেই তারা আতঙ্কে গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো।

কামর একটা দোকানে ঢুকে খুব জমকালো একটা সাজ-পোশাক কিনে বাজার সন্নিহিত হামামে গিয়ে খুব ভালো করে ঘষে মেজে সাফ করে অনেক জল ঢেলে স্নান করে শাহজাদার মতো সাজে সেজে-গুজে পথে বেরিয়ে এলো। অদূরেই সেই নাপিতের দোকান। লোকটা তখন একজনের মাথায় ক্ষুর ধরেছে। প্রায় আধখানা মাথা সাফ করে এনেছে, এমন সময় কামরকে ঐ বেশে তার দোকানে ঢুকতে দেখে হতচকিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সেলাম ঠুকে স্বাগত জানায়। কামর ওর হাতে একটা মোহরের তোড়া গুঁজে দিয়ে বলে, তোমার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে। তা এখানে তো তোমার খদ্দেররা রয়েছে, একটু বাইরে আসবে?

নাপিত তোড়ার ওজনটা অনুভব করে বুঝতে পারে মালকড়ি নেহাত কম নাই। বিচলিত হয়ে বলে, কী যে বলেন হুজুর, আপনি হুকুম করলে আমি জাহান্নামেও যেতে পারি।

দু’জনে দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে একটু নিরালা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। কামর বলে, শুনেছি প্রতি জুম্মাবার সকালে এই পথ দিয়ে একটা মিছিল যায়। এবং যে-কোনও কারণেই হোক, সেই সময়টায় পথঘাট, হাটে বাজারে কোন জনপ্রাণী থাকে না। কিন্তু কেন? কার ভয়ে? আমি এই শহরে নবাগত। আড়ালে লুকিয়ে ঐ মিছিলের সুন্দরীকে আজ আমি দেখেছি। এক কথায় বলতে গেলে, চোখে আমার ধাঁধা লেগে গেছে। এমন রূপ কখনও দেখিনি। তা বলতে পার, এই ডানাকাটা পরীটি কে?

নাপিত গম্ভীর হয়ে গেলো। কী যেন ভাবলো এক মুহূর্ত। তারপর বললো, আমি ঠিক জানি, মালিক। তবে এইটুকু বুঝেছি, শুক্রবার সকালে ঐ মিছিল পার হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কেউ দোকান পাটে বসতে বা কেনাকাটায় বেরুতে সাহস করে না।

–এর কারণ কী? ভয়টা কোথায়?

নাপিত কাচুমাচু মুখে বলে, আজ্ঞে এর বেশি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আমি জানি না, বলতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, আমার বিবি সব জানে। তাকে জিজ্ঞেস করলে এবং সে যদি রাজি হয় সব আপনাকে বলতে পারবে। আপনি একটুক্ষণ এখানে দাঁড়ান, হুজুর, আমি আমার বিবিকে জিজ্ঞেস করে আসি। সে যদি রাজি হয়, আমি আপনাকে নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে।

এই বলে নর-সুন্দরটি তার দোকানের আধ ন্যাড়া খদ্দেরটির কথা একেবারে বিস্মৃত হয়ে তোড়াটা নাচাতে নাচাতে বাড়ির পথে ছুটে যায়।

বিবির হাতে মোহারগুলো তুলে দিয়ে বলে, বহুত বড়িয়া এক মালদার সওদাগরকে পাকড়াও করেছি। এক্ষুনি তাকে নিয়ে আসছি তোমার কাছে, বরাতে থাকলে আরও কিছু মিলতে পারে বিবিজান। আচ্ছা আমি যাচ্ছি। ওকে নিয়ে আসছি তোমার কাছে, কেমন?

ছুটতে ছুটতে সে কামরের কাছে এসে বলে, বিবিজান আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে—আর ভাবনা নাই, আপনি আসুন, মালিক।

নাপিতের সঙ্গে কামর ওর বাড়িতে এসে পৌঁছয়। নাপিত-গৃহিণী বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে বেশ। কামরকে যে অতিথির অধিক আদর আপ্যায়ন করে বসালো, দামী খুসবুওলা শরবত এনে খেতে দিলো এবং পরম স্নেহময়ীর মতো কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো।

এই সুদুর প্রবাসে এসে এমন একজন মাতৃসমা মমতাময়ীর দেখা পেয়ে কামর উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। নাপিত-গৃহিণী কামরকে নানারকম খানা-পিনা এনে খেতে দেয়। মুখে মধু ঢেলে বলে, কী আর খেতে দেব বাবা, গরীব-সরীব মানুষ। ঘরে যা ছিলো দিলাম, জানি না তোমার মুখে রুচবে কিনা।

কামর লজ্জিত বোধ করে, কী যে বল মা, ভালোবেসে দিলে খুদ-কুঁড়োও অমৃত মনে হয়।

খানা-পিনা শেষ হলে, কামর জেব থেকে এক মুঠো মোহর বের করে নাপিত-বৌ-এর হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, এটা ছেলের ভালোবাসার দান, নাও মা। তোমার আদর-যত্নের দাম এই তুচ্ছ টাকা পয়সা দিয়ে হতে পারে না! কিন্তু আমি এখানে পরদেশী, এর বেশি তো আর কিছুই দিতে পারবো না, মা।

মোহরগুলো ওড়নার খুঁটে বাঁধতে বাঁধতে নাপিত-বৌ বলে, অমন করে বলো না বাছা, আমাদের এই গরীবখানায় তোমার বড় কষ্টই হবে।

–ও-নিয়ে তুমি একদম ভাববে না, মা। আমাকে না ঘরের ছেলে বলে মনে করেছ? তবে অমন পরপর ভাবছো কেন? নিজের ছেলের মতো করে ভাববা, দেখবে আর খুঁত খুঁত করবে না মন। যাই হোক মা জননী, আমি যে উদ্দেশ্যে তোমার কাছে এসেছি, এবার সে সম্বন্ধে কিছু শোনাবে?

নাপিত-বৌ বলে, আলবৎ, একশোবার শোনাবো, বেটা। তবে শোনো :

আমাদের এই বসরাহর সুলতান একদিন ভারতের সম্রাট-এর কাছ থেকে একটা ইয়া বড় মুক্তো উপহার পেলেন। আমরা তো দেখিনি, শুনেছি, অত বড় মুক্তো নাকি হয় না! একেবারে ছোটোখাটো একটা সূর্যের মতো। সব সময় তার গা থেকে আলোর রোশনাই ঠিকরে বেরোয়।

সুলতান বাজারের জহুরীদের ডেকে মুক্তোটা দেখিয়ে বললেন, আমার ইচ্ছে এটা গলায় পরে থাকি! কিন্তু মুক্তোটা তো আনকোরা। সূতো পরানোর কোনও ফুটো নাই। তোমরা খুব সাবধানে এটায় সূতো পরাবার মতো সূক্ষ্ম একটা ফুটো করে দাও।

জহুরীরা এক এক করে সকেলেই সেই পরমাশ্চর্য মুক্তোটা, নেড়ে চেড়ে দেখে বিষণ্ণ বদনে সুলতানের হাতে ফেরত দিয়ে বললো, এ বস্তু জীবনে আমরা এই প্রথম দেখলাম। হাজার হাজার মুক্তো আমরা কেনাবেচা করেছি, করছি, কিন্তু এমন অসাধারণ রত্ন কখনও চোখে পড়েনি, জাঁহাপনা। জানি না এর কত মূল্য। অথবা কোনও অর্থের বিনিময়ে আদৌ এ বস্তু কেনা যায় কিনা—তাও আমাদের অজানা। সেই কারণে এই অমূল্য রত্নে যন্ত্র চালিয়ে ফুটো করার দুঃসাহস আমাদের কারো নাই। যদি কোনও কারণে টুটে যায় তা হলে? তা হলে কী দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে পারবো আমরা? না না, হুজুর, আমরা অপারগ, এ মুক্তোয় আমরা বিদ করতে পারবো না।

সুলতান হতাশ হয়ে বললেন, সে কি কথা? তোমরা সব আরব দুনিয়ার তুখোড় সব জহুরী। তোমরা যদি না পার কে পারবে? আমার যে বড় শখ, মুক্তোটা কারে ঝুলিয়ে গলায় পরবো। আমার বুকের ওপর জ্বলন্ত সূর্যের গোলার মতো দুলবে সারাদিন। লোকে অবাক হয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে—আমার এই শখটা মিটবে না?

জহুরীদের একজন বললো, এই শহরে উবেদ নামে এক বৃদ্ধ কারিগর আছে। জাঁহাপনা যদি তাকে তলব করেন, আমাদের মনে হয় সে একাজ করে দিতে পারবে।

সুলতান আশান্বিত হয়ে বললেন, বেশ তো তাকে ডাকো।

সুলতানের হুকুমে তখনই বৃদ্ধ উবেদকে হাজির করা হলো। সুলতান বললেন, দেখ এই মুক্তোটা। এটা ফুটো করে দিতে হবে। আমি গলায় ধারণ করবো? কিন্তু সাবধান, কোনও ক্রমেই যেন চোট না খায়। যদি আমার ইচ্ছা পূরণ করতে পার তবে তোমার মনঃস্কামনাও আমি পূরণ করবো-তা সে যাই হোক।

বৃদ্ধ উবে মুক্তোটা হাতে নিয়ে নিরীক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। তারপর কোমর থেকে একটা তুরপুণ বের করে আশ্চর্য দক্ষতায় পলকের মধ্যেই এপার ওপার করে দিলো! সুলতানের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, দেখুন জাঁহাপনা, আপনার রত্নের গায়ে কোনও চোট লেগেছে কিনা!

সুলতান দেখলেন একটা সূক্ষ্ম সুতো পরাবার মতো নিখুঁত একটি ছিদ্র হয়ে গেছে অথচ মুক্তোর গায়ে কোথাও আঘাত লাগেনি।

—সাবাস, চমৎকার হয়েছে। এবার তোমার পালা। বল বৃদ্ধ, কী চাও তুমি? যা চাইবে আমার ওয়াদা মত আমি পূরণ করবো। বলো, নির্ভয়ে বলল তোমার মনের বাসনা।

বৃদ্ধ উবেদ বলে, জাঁহাপনা বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়েছি আমি। এবং বুদ্ধিসুদ্ধিও আমার বরবরই কিছু কম। ঘরে আমার রূপসী বিদুষী তরুণী বিবি আছে। দেখতে যেমন সে ডানাকাটা পরী, গুণেও তেমনি সে সেরা। তার বুদ্ধির কাছে অনেকেই হার মানে। তার মতামত ছাড়া কোনও কাজই করি না আমি। জাঁহাপনা যদি অনুমতি দেন, আমি বিবিজানের কাছ থেকে জেনে আসি।

সুলতান বললো, বেশ তো, চটপট যাও, জেনে এসো। কথা যখন দিয়েছি ওয়াদা আমি পূরণ করতে চাই।

বৃদ্ধ উবেদ ঘরে ফিরে এসে সুলতানের অভিপ্রায়ের কথা বলে বিবিকে।

উবেদ-বৌ আনন্দে নেচে ওঠে, উ কী মজা! এতদিনে আমার। মনের বাসনা পূর্ণ হবে।

উবেদ বলে, হবে মানে?যা চাইবে তাই পাবে, বিবিজান। যত টাকা পয়সা, সোনাদানা-যা চাইবে তাই পাবে। একবার মুখ দিয়ে বের করতে। পারলেই হবে। বিবিজান, আমার ভাবতে কী রকম গা শিরশির করছে। আর আমাদের এই রকম দীন ভিখারির মতো দিন কাটাতে হবে না। কাল। থেকেই আমরা আমির ওমরাহ বনে যেতে পারবো। শুধু একবার বেশ বুদ্ধি করে ভেবে চিন্তে বলো কী চাইতে হবে! আমি মুখ দিয়ে বের করা মাত্র। সুলতান বলবেন, আর্জি মঞ্জুর। ব্যস, আর দেখতে হবে না—আমরা রাতারাতি বড় লোক হয়ে যাবো। যাই হোক, আর দেরি করো না বিবিজান, চটপট বলো কী চাইতে হবে। আমাকে আবার এখুনি দরবারে ফিরে যেতে হবে, এখুনি।

উবেদ-বৌ বলে, ভাববার কিছু নাই গো, অনেক আগেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, জীবনে যদি তেমন কোনও সুযোগ আসে তবে আমার একটা সাধ মেটাবো প্রাণ ভরে।

-কী সাধ গো, বলো না?

-বলছি বলছি। বলবো বলেই তো ছটফট করছি তখন থেকে। ভালো করে শোনো, সুলতানকে গিয়ে বলবে, জাঁহাপনা, আমার বাসনাটা নিতান্তই সামান্য। টাকাকড়ি বলতে কিছু চাই না আমি। শুধু আপনি অনুমতি করুন, প্রতি জুম্মাবার সকালে আমার বিবি শহর পরিক্রমায় বেরুবেনামাজের দুঘন্টা পূর্বে। সেইসময় শহরবাসীরা কেউ ঘর ছেড়ে পথে বেরুতে পারবেনা। যদি কেউ পথে বা হাটে বাজারের কোথাও থেকে থাকে তবে মিছিলের বাদ্য-সঙ্গীত শোনামাত্র যে যার কাছের মসজিদে প্রবেশ করে আত্মগোপন করে থাকবে। কিন্তু একটা কথা, দোকানপাট নিত্য যেমন ভোলা থাকে তেমনি ভোলামেলাই পড়ে থাকবে। কিন্তু কোনও দোকানে কোনও খদ্দের বা দোকানী থাকতে পারবে না সে সময়। সবাইকে ছুটে গিয়ে কাছের মসজিদে আশ্রয় নিতে হবে। যদি কারো মাথা দেখা যায় তবে আমার স্ত্রীর প্রহরীদের উদ্যত খঙ্গ তার মুণ্ডচ্ছেদ করে ফেলবে তৎক্ষণাৎ। এজন্য জাঁহাপনার কাছে আমি বা আমার বিবি নরহত্যার দায়ে সোপর্দ হবো না।

এক নিশ্বাসে এতোগুলো কথা বলে উবেদ-বৌ থামলো। বৃদ্ধ উবেদ তো থ। এ আবার কী বদখদ চাওয়া হলো?

দুনিয়াতে এতো জিনিস থাকতে এইরকম ফালতু চাওয়া কী কেউ চায়?

বৃদ্ধ মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে, হায় হায়, কেন সে মেয়েমানুষের বুদ্ধি নিয়ে কাজ করবে ভেবেছিলো।

যাই হোক, বৃদ্ধেরা তরুণী ভার্যাকে চটাতে সাহস করে না। তাই উবেদও মনের দুঃখ মনে চেপে সুলতানের দরবারে ফিরে আসে।

সুলতান উবেদের মনোবাঞ্ছ শুনে প্রীত হয়ে বলেন, বহুত আচ্ছা, আজই আমি তাঁড়া পিটে ফরমান জারি করে দিতে বলছি, প্রতি জুম্মাবারে নিত্য যেমন হাটবাজার, দোকানপাট খোলা থাকে তেমনি ভোলা থাকবে। কিন্তু নামাজের দু ঘণ্টা আগে থেকে ঘর ছেড়ে পথে বেরুতে পারবে না কেউ। যারা হাটে-বাজারে বা পথে-ঘাটে রয়ে যাবে তারা কাছাকাছি মসজিদে গিয়ে মাথা লুকাবে। যদি কারো শির দেখা যায় প্রহরীর তলোয়ারের ঘায়ে কোতল করে দেবে।

সেই থেকে প্রতি শুক্রবার উবেদ-বেগম শহরে পথ-বিহারে বের হয়। সে সময় কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে—পথে-ঘাটে বের হতে পারে! এই নিয়ম চলে আসছে সেইদিন থেকে। জানি

আর কতকাল এভাবে শহরবাসীরা জুম্মাবারে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিন কাটাবে।

নাপিত-বৌ থামলো। তারপর একটু মৃদু হেসে কামরের দিকে তাকিয়ে বললো, কিন্তু বেটা, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার এই কিসসা শুনে তোমার পেট ভরলো না! যতক্ষণ না নিজের চোখে উবেদ-বেগমকে একবার দেখতে পাচ্ছো স্থির থাকতে পারবে না!

—আপনি ঠিকই ধরেছেন, মা। শুধু তাকে দেখার জন্যে তার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যে আমি আমার স্বদেশ ছেড়ে এতো দূরদেশে এসেছি। ঘরে আমার মা বাবা চোখের পানি ফেলছেন।কিন্তু তাও উপেক্ষা করে চলে এসেছি এখানে তার সঙ্গে দেখা করবো বলে।

নাপিত-বৌ বলে, ঠিক আছে, সব আমি ব্যবস্থা করে দেব। এখন বলতো বাবা, সঙ্গে কী পয়সাকড়ি এনেছ?

কামর বলে হীরে মুক্তো, চূণী পান্না এই চার রকমের জহরত কিছু আছে সঙ্গে। আর আছে কয়েকটা থলিতে হাজার আশী দিনার।

নাপিত-বৌ বলে, চমৎকার। তা হলে ওঠো। চলো আমার সঙ্গে। বাজারে যেতে হবে। ওখানে জহুরী উবেদের একটা দোকান আছে, আগে ওখানেই যাবো আমরা। এখন শুধু তোমার জহরতের থলেটা সঙ্গে নাও। তারপর আমি যা যা শিখিয়ে দেব সেই সেই মতো কাজ করবে।

একটা কথা, বড় কিছু করতে গেলে অসীম ধৈর্যের দরকার। আমার এই উপদেশটুকু মনে রাখলে আখেরে তোমার লাভ হবে। তবে কার্য উদ্ধার হয়ে গেলে এই গরীব মাকে ভুলে যেও না, বেটা। আমার স্বামী বড় দরিদ্র। সারাদিন খেটে সে দু’বেলা রুটি সংগ্রহ করে। তুমি যদি দয়া করে খুশি মনে তাকে দু’টো পয়সা দিয়ে যাও—আল্লাহ তোমার ভালো করবেন।

কামর বলে, ও-নিয়ে আপনি ভাববেন না, মা। আপনাদের এই উপকার আমি ভুলবো না।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো চুরাশিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

শহরের এক প্রান্তে উবেদের স্যাকরার দোকান। জনাকয়েক কারিগর নিয়ে সে কাজ করে। অলঙ্কার নির্মাণে উবেদের নাম শহরজোড়া। তাই কাজেরও অভাব হয় না। নানারকম মানুষের নানারকম বায়না। উবেদ সকলের কাজই যত্নসহকারে করে দেয়-সবচেয়ে কম মজুরীতে।

কামর এসে দোকানে উঠতেই উবেদ আদর অভ্যর্থনা করে বসতে দেয়। কামরের রূপ আর জমকালো সাজপোশাক দেখে ভাবে, নিশ্চয়ই কোনও আমির বাদশাহর সন্তান।

জহরতের থলে থেকে ছোট্ট একখণ্ড হীরে বের করে উবেদের হাতে দেয় কামর। বলে, আমার ইচ্ছে একটা আংটিতে বসিয়ে দিন আপনি। এ শহরের সবাই এক বাক্যে আপনার নামই করলো, তাই অন্য সব দোকান ফেলে আপনার কাছেই এলাম।

উবেদ হীরেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলে, কী ধরনের আংটির ওপর বসাতে হবে, মালিক? নক্সা দেখাববা?

কামর বলে, না না, ওসব দেখাবার কোনও দরকার নাই। আমি খবর নিয়েছি, আপনি শুধু সেরা জহুরীই নন—উঁচুমানের শিল্পীও। সুতরাং ওটা আপনার মনমতো একটা আংটির ওপর বসিয়ে দেবেন। বিশ্বাস করি, তা দেখে আপনার পছন্দ তারিফ করবে সকলে। ও হ্যাঁ, এই নিন না, সামান্য কিছু অগ্রিম রাখুন। পুরো মজুরী নেবার সময় দেবো।

এই বলে অন্য একটা থলে থেকে এক মুঠো মোহর বের করে উবেদের হাতে দিলো কামর। এবং দোকানের কর্মরত কর্মচারীদের প্রত্যেককে বকশিশ করলো একটা করে মোহর দিয়ে।

ইতিমধ্যে কামরকে দেখার জন্য কিছু ইতর মানুষের ভিড় হয়ে গেছে। কামর আর এক মুঠো স্বর্ণমুদ্রা বের করে ওদের প্রত্যেককে একটা একটা করে দান করলো। তারপর বিস্ময় বিমুগ্ধ উবেদকে আর কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কোনও সুযোগ না দিয়ে দোকান ছেড়ে পথে নামতে নামতে বললো, তা হলে আজ আসি শেখ সাহেব। কাল নিতে আসবো?

উবেদ বিস্ময়ে বিগলিত হয়ে যুক্ত করে বলে, আপনার মাল মজুত থাকবে মালিক। আপনার যখন খুশি এসে নিয়ে যাবেন।

উবেদ সব কাজ ফেলে নিজে হাতে একটা আংটি তৈরি করতে লেগে গেলো। দক্ষ কারিগরের নিপুণ হাতের যাদুতে সন্ধ্যার আগেই এক মনোহর কারুকার্য করা অদ্ভুত সুন্দর এক আংটি তৈরি হয়ে গেলো। অনেকদিন পর এতো সুন্দর একটি কাজ ওঠাতে পেরে খুশিতে ভরে ওঠে উবেদের মন। বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের সৃষ্টি নিরীক্ষণ করতে থাকে সে! অনেক যত্ন নিয়ে করেও এমন মনের মতো কাজ সব সময় হয় না। আংটিটা দেখতে দেখতে নতুন এক সৃষ্টির গর্বে গর্বিত হয়ে ওঠে সে। এমন একটা অসামান্য কীর্তি তার প্রিয়তমা তরুণী ভার্যাকে না দেখিয়ে কী সে থাকতে পারে! তাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময় আংটিটা সঙ্গে নিতে ভোলে না।

ঘরে ফিরে আংটিটা বিবির হাতে দিয়ে বলে, দেখতে কেমন হয়েছে? আমি নিজে হাতে বানিয়েছি। বাজি রেখে বলতে পারি, সারা দুনিয়ায় এমন কোনও স্যাকরা নাই যে এর জুড়ি একটা বানিয়ে দিতে পারে। হুঁ হুঁ বাবা, আমার নাম উবেদ!

সত্যিই আংটিটার গঠনরীতি, কারুকার্য এবং হীরেটাকে বসানোর দক্ষতা এক কথায় অপূর্ব। উবেদ-বিবি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আংটিটার দিকে। আংটির কাজ না, হীরে কোন্টা বেশি তাকে মোহিত করে ঠিক বুঝতে পারে না।

—এমন দামী জহরত দিয়ে এই শখের আংটি বানায় যে সে মানুষটি কেমন?

উবেদ বলে, ওঃ, তাকে যদি তুমি দেখতে বিবিজান, ভিরমি খেয়ে পড়ে যেতে।

-ওমা সে কি কথা, ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবো কেন?

—কেন জানি না, তবে তার রূপের জেল্লা দেখলে তোমার চোখে ধাঁধা লেগে যেত। এই হীরেটা দেখছ, এদিক ওদিক ঘোরালে কেমন দ্যুতি ছাড়ে? আর তাকে ঘোরাতে ফিরাতে লাগে না। যে পাশ থেকেই তাকে দেখবে —এই রকম হাজার হীরের দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে দেখবে। চোখ না ধাঁধিয়ে পারে? আহা কী তার রূপ? কী করে বর্ণনা দিয়ে তোমাকে বোঝাবো, বিবিজান। মোটকথা আমি বুড়ো হয়ে মরতে বসেছি, তাকে দেখে আমারই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। অমন চোখ, অমন গাল, নাক, অধর আমি দেখিনি কারো। নাঃ, কোনও আমির বাদশাহর প্রাসাদেও নজরে পড়েনি।

উবেদ-ভার্যা বৃদ্ধ স্বামীর কথাগুলো যেন গিলছিলো। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো, উমর কত?

—তা তোমার মতই চোদ্দ-পনের হবে। কিন্তু কী বাড়ন্ত গড়ন। দেখলে মনে হয়, এক তাগড়াই নওজোয়ান।

উবেদ-বিবির যৌবন গলতে থাকে। কামনার বহ্নি জেগে ওঠে। শাদীর পর থেকে বৃদ্ধ উবেদ তাকে এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। মানুষটা বুড়ো হয়েছে। দেহের তাগদ কমে এসেছে। এখন কী সে এই নতুন যৌবনের জোয়ারের সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়! কিন্তু তিলে তিলে সে। তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে। রঙে রসে এখন যে পাকা ফলের মতো টইচম্বুর।

উবেদ-ভার্যা আর কোনও প্রশ্ন করে না। কি জানি মানুষটা যদি কোনও সন্দেহ করে। যদি ভাবে তার বিবি পরপুরুষে আসক্ত হয়ে পড়েছে?

আংটিটা সে একটা আঙ্গুলে পরে নেয়। -বাঃ, দেখ, কেমন সুন্দর মানিয়েছে? মনে হচ্ছে যেন আমার জন্যেই গড়েছ? মেয়েটার চোখ আনন্দে নেচে ওঠে।

উবেদ বলে, সব হুরীদের আঙ্গুল একই রকম হয়। আচ্ছা, কাল সকালে মালিক যখন আসবে তখন তাকে জিজ্ঞেস করবো। সে যদি বিক্রি করতে চায় তোমার জন্যে কিনে নেব। তোমার যখন এতো পছন্দ, দেখবো সে রাজি হয় কি না।

কামর ফিরে আসে নাপিতের বাড়িতে। একশোটা দিনার নাপিত-বৌ-এর হাতে দিয়ে বলে, প্রথম দফার কাজ ঠিক ঠিক মতই করে এসেছি—যেমনটি বলেছিলে। এই নাও এই টাকাটা রাখ, মা। তাহলে এর পর আমাকে কী কী করতে হবে?

নাপিত-বৌ বলে, কাল সকালে যেমন উবেদের দোকানে যাবে, আংটিটা দেখে বলবে, তৈরি খুব সুন্দর হয়েছে, কিন্তু আমার হাতের তুলনায় দেখতে একটু ছোট হয়েছে। যাই হোক, এটা আপনি রেখে দিন, শেখ সাহেব। বরং আর একটা হীরে দিচ্ছি, এটা দিয়ে একটু বড় করে অন্য একটা বানিয়ে দিন। আর এটা আপনাকে আমি উপহার দিলাম। এই বলে তোমার থলে থেকে একটু বড় গোছের একটা হীরে বের করে ওর হাতে দেবে, দেখবে যাদুমন্ত্রের মতো কাজ দেবে।

পরদিন সকালে কামর উবেদের দোকানে পৌঁছলে উবেদ তাকে অভ্যর্থনা করে বসিয়ে আংটিটা বের করে হাতে দেয়। কামর নেড়ে নেড়ে দেখে প্রশংসায় গদগদ হয়ে বলে, আপনার হাতের যাদুতে অসাধারণ হয়ে উঠেছে সন্দেহ নাই। কিন্তু শেখ সাহেব আমার হাতের তুলনায় হীরেটা একটু ছোট হয়ে গেছে। তা হোক, এটা আপনি রেখে দিন, আপনাকে খুশি মনে উপহার দিলাম। আপনি বরং আমাকে আর একটু বড় হীরে দিয়ে একটা বানিয়ে দিন।

এই বলে থলে থেকে অপেক্ষাকৃত একটা বড় হীরে বের করে সে উবেদের হাতে দেয়। সেই সঙ্গে ষাটটি স্বর্ণমুদ্রাও গুঁজে দিয়ে বলে, আপনার কারুকার্যের ইনাম দেবার ধৃষ্টতা আমার নাই, শেখ সাহেব। এটা আমি আপনাকে শরবত খেতে দিলাম। আচ্ছা চলি, কাল সকালে আবার আসবো।

দোকান ছেড়ে বেরুবার সময় সামনে জমায়েত হওয়া দীন ভিখারীদের মধ্যে মুঠো মুঠো দিনার ছড়িয়ে দিয়ে চলে যায় কামর।

বৃদ্ধ জহুরী হতবাক হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবতে পারে না, মানুষ এমন দিল-দরিয়া কী করে হতে পারে।

সেদিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরে আংটিটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বলে, নাও বিবিজান তোমার জন্যেই বোধ হয় গড়েছিলাম। তাই বোধ হয় তার পছন্দ হলো না।

—পছন্দ হলো না? এমন সুন্দর জিনিসটা মনে ধরলো না তার?

—আরে একি তোমার আমার পছন্দ? না জানি সে কোন আমির বাদশাহের ছেলে। দেখে শুনে বললো, হাতের কাজ তোমার খুব সুন্দর শেখ, তবে আকারে কিছু ছোট হয়েছে। সে দোষ তোমার নয়, আমিই হীরেটা ছোট দেখে দিয়েছিলাম। যাই হোক, হারেমের মেয়েদের হাতে মানাবে ভালো, এট তুমি বাড়ি নিয়ে যাও। তাই মনে হচ্ছে, নিজের অজান্তে আমি তোমার হাতের মাপেই বানিয়েছিলাম, বিবিজান। আর খোদার কী মর্জি, তোমার নসীবেই জুটে গেলো! নাও, তোমার পছন্দের জিনিস তোমার কাছেই এসে গেলো।

উবেদ-বিবি বলে, ওমা সে কি কথা, তা হলে তিনি কী পরবেন? এতো শখের জিনিস!

—সেজন্যে ভেব না বিবিজান। আর একটা হীরে আমার হাতে দিয়ে সে বললো, শেখ সাহেব, এটা দিয়ে আর একটা গড়িয়ে দিন আমাকে, আশা করি সেটা আরও সুন্দর হবে।

মেয়েটির অন্তর আকূল হয়ে ওঠে কামরকে দেখার জন্য। কিন্তু মুখে সে আকুলতা প্রকাশ করা সম্ভব না। বৃদ্ধ সন্দেহ করতে পারে। শুধু সে বললো, বানিয়েছ নাকি? কই দেখি কেমন হয়েছে?

বৃদ্ধ বলে, বানাবো না মানে? অমন খদ্দের ক’টা মেলে? আমি নিজে হাতেই এটাও তৈরি করেছি, এই দেখ!

আংটিটা হাতে নিয়ে উবেদ-বিবির চোখ নেচে ওঠে।

-বাঃ, অপূর্ব। আরও সুন্দর হয়েছে।

হাতের আঙ্গুলে পরে নিয়ে বলে, দেখ, দেখ, কেমন সুন্দর মানিয়েছে!

বৃদ্ধ জহুরী বলে, সুন্দর জিনিস সুন্দর হাতেই তো মানায়। আচ্ছা দেখা যাক, যদি তোমার নসীবে থাকে, তবে এটাও হয়তো তোমার হাতেই ফিরে আসবে।

কামর ফিরে এসে নাপিত-বৌকে বিবরণ জানায়। একটা দিনারের তোড়া হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, এরপর কী করতে হবে মা?

নাপিত-বৌ বলে, কাল সকালে জহুরীকে বলবে, এ আংটিটা আবার বেজায় বড় হয়ে গেলো। সে যাক গে, আপনি আমাকে আর একটা গড়িয়ে দিন। এবার তুমি আরও দামী হীরে দেবে ওর হাতে।

পরদিন সকালে কামর আবার উবেদের দোকানে যায়। আংটিটা দেখে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, দারুণ হয়েছে। কিন্তু আমারই ভুল হয়েছে শেখ সাহেব। এতো বড় হীরেটা আমার হাতে মানাবে না। আপনি বরং আর একটা বানিয়ে দিন। আমি মাঝামাঝি আকারের একটা হীরে দিচ্ছি আপনাকে।

এই বলে অন্য একটা হীরে এবং একশোটা স্বর্ণ মুদ্রা তার হাতে দিয়ে বলবে, এটা আপনার জলপানি। আর ঐ আংটিটা আপনার হারেমের কোনও বাঁদীকে উপহার দিলাম আমি।

যথারীতি সেদিনও সে মুক্ত-হস্তে মুদ্রা ছড়াতে ছড়াতে দোকান ছেড়ে নাপিত-বৌ-এর কাছে ফিরে আসে।

এইভাবে সে নাপিত-বৌ-এর প্রতিটি পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে থাকে। প্রতিদিনই সে উবেদের কাছে গিয়ে নতুন আংটির বরাত দিয়ে আগের আংটিটা নাকচ করে উপঢৌকন দিয়ে আসে। আর বোকা বৃদ্ধ জহুরী এক এক করে সবগুলো নিয়ে গিয়ে তরুণী ভার্যার হাতে দিয়ে একটু মন পাওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু সুন্দরী তার বুড়ো স্বামীকে জ্ঞান দিয়ে বলে, আহা তুমি কী মানুষ বলতো! এমন যে লোক, নিত্য তোমার বিবির জন্যে একটা করে জহরতের আংটি উপহার পাঠাচ্ছে তাকে একবার বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খানাপিনা করতেও বলতে পারছো না?

বৃদ্ধ বলে, ও হো হো, তাইতো, ও কথা তো একদম মনে হয়নি, বিবিজান! আমি না হয় একটু মাটো, কিন্তু তুমি তো অনেক বুদ্ধি ধর; তুমিও তো আমাকে হুকুম করনি চাচার মেয়ে? ইস, কী ভুলটাই না হয়ে গেছে!

উবেদ-বিবি বলে, যাক যা হবার তা হয়েছে। কাল তাকে সঙ্গে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসো। আমি খুব আদর আপ্যায়ন করে তোমার সব ভুল শুধরে দেব।

পরদিন সকালে যথারীতি কামর এসে উপস্থিত হয় উবেদের দোকানে। আংটিটা দেখে বলে, নাঃ, আপনার হাতের কাজের প্রশংসা না করে উপায় নাই কিন্তু এই পাথরটা আমার তেমন পছন্দ হচ্ছে না। আপনি বরং এটা আপনার বাঁদীদের কাউকে দিয়ে দিন।

এই বলে কামর আর একটা মূল্যবান পাথর এবং এক তোড়া মোহর জহুরীর হাতে দিয়ে বলে, আজ তাহলে আমি আসি?

উবেদ হাত জোর করে বলে, আপনি বহুত খানদানী বংশের সন্তান। আমাদের গরীবখানায় আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে কুণ্ঠা বোধ করছি। কিন্তু কিছু যদি মনে না করেন তবে মেহেরবানী করে একবার আমার বাসায় পায়ের ধুলো দিয়ে কৃতার্থ করুন মালিক।

কামর বললো, এ তো খুব আনন্দের কথা। বেশ তো, আপনি দোকানপাট বন্ধ করে যখন বাড়ি ফিরবেন, আমাকে আমার সরাইখানা থেকে ডেকে নিয়ে যাবেন দয়া করে। আমি প্রস্তুত থাকবো।

এই বলে সে তার সরাইখানার ঠিকানাটা বৃদ্ধকে দিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো পঁচাশিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

সেদিন সন্ধ্যায় বৃদ্ধ জহুরী সরাইখানা থেকে কামরকে ডেকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছায়।

খানা-পিনা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। দুজনে মিলে তৃপ্তি করে খানা-পিনা সেরে নিলো।উবেদ বিবি নিজে হাতে নানারকম আহার্য বস্তু প্রস্তুত করেছিলো। কোর্মা, কালিয়া, কাবাব, মোরগ মোসাল্লাম, বিরিয়ানী, হালওয়া, পেস্তার বরফী শরবত—আরও অনেক কিছু।

খাবারের শেষে শরবত-এ চুমুক দিতে ঘুমে ঢলে পড়লো দু’জন।

এ কাণ্ড উবেদ-বিবির। আগে থেকেই সে ফন্দী এঁটেছিলো, তাই শরবতের পেয়ালায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো খানিকটা। এবং তার অব্যর্থ ফল হাতে হাতেই ফলে গেলো।

বিরাট ফরাসের এক পাশে বৃদ্ধ অন্য পাশে নওজোয়ান কামর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইলো। আর এদিকে রিরংসা-দংশিতা সেই তরুণী বেশবাস ছুঁড়ে ফেলে কাম-চঞ্চলার মতো ছুটে এসে কামরের দেহের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এলোপাতাড়ি অবলেহন করতে থাকলো। সে সময় সেই রতি-তাড়িত নারীর কাম-কটাক্ষ দেখলে যে-কোন পৌরুষের পতন ঘটতে পারতো নিমেষে।

এরপর, আল্লাহ জানেন, সে রাতে সে-মেয়ে কামরের নিদ্রা-বিগলিত দেহখানা নিয়ে কী খেলায় মেতেছিলো।

সারারাত ধরে সে কামরের দেহের সঙ্গে লীন হয়ে সেঁটে ছিলো। কিন্তু ভোের হওয়ার আগেই তার গনগনে গরম দেহখানা উঠিয়ে নিয়ে অন্দরে পালিয়ে গেলো। যাবার আগে সে আঙ্গুলে কাজল লাগিয়ে কামরের বুকে পর পর চারটি কাল ছাপ এঁকে দিয়েছিলো।

হারেমে ফিরে গিয়ে হালিমা ওর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচরীকে প্রহরী করে বাইরের ঘরে পাঠায়। এই মেয়েটি সারারাত ধরে উদ্যত খাড়া হাতে দরজায় প্রহরারত ছিলো। হালিমা বললো, যা ওদের নাকে ঘুম ছাড়ার ওষুধটা গিয়ে ধর গে, তা না হলে সারাদিনেও ঘুম ভাঙ্গবে না ওদের।

নাকে ওষুধের ঝাঁজ ঢুকতেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে পড়ে উবেদ।

—ইস্‌ একি কাণ্ড, একেবারে যে সকাল হয়ে গেছে। নামাজের সময় বয়ে যায় দেখে ধরমড় করে উঠে দাঁড়ায়।

,কামরও বুঝতে পারে না, কি করে সারাটা রাত সে একভাবে অসাড়ে ঘুমিয়ে কাটাতে পারলো। এমন বেয়াড়া ঘুম তো কখনও ছিলো না তার। ঘুমের পর এমন অবসাদ তো সেজীবনে কখনও অনুভব করেনি। কে যেন সারা শরীরে ব্যথা ছড়িয়ে রেখে গেছে।

রজু করার সময় ঠোঁটে জল লাগতেই ছ্যান ছ্যান করে জ্বলে উঠলো। ঠোঁট দু’খানা ফেটে চৌচির, ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। ব্যথায় টনটন করছে। গালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো মাঝে মাঝে কেটে ছড়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।

কামর ভেবে পায় না, এমনটা কী করে হলো। ভালোমানুষ সারা গায়ের কোথাও কোনও ব্যথা দরদ ছিলো না, কিন্তু এই একটা রাতের মধ্যে এ সব অসম্ভব ব্যাপার কী করে ঘটতে পারলো?

জহুরী দেখে বললো, ও কিছু নয়, ঘরে মশার বাড়াবাড়ি হয়েছে। ওগুলো মশার কামড় দাগ আর কিছুই না। ঘুমোনের আগে মশারী না টাঙানো বোকামী হয়েছে।

কামর বলে, কিন্তু আপনার মুখে তো এ রকম কোনও দংশন দেখতে পাচ্ছি না?

বৃদ্ধ হেসে বলে, মশারা রসিক। ওরা বেছে বেছে সুন্দর মুখেরই সন্ধান করে। এই বুড়োর কোচকানো ঝুলে পড়া চামড়া ওদের পছন্দ হবে কেন?

এরপর দুজনে নমাজ সেরে নাস্তা সেরে নেয়। তারপর উবেদ চলে যায় দোকানে, আর কামর ফিরে আসে নাপিত-বৌ-এর কাছে।

কামরকে লক্ষ্য করেনাপিত-বৌহাসতে হাসতে বলে, না না, আমাকে আর মুখে কিছু বলতে হবে না, বেটা। আমি তোমার মুখের চেহারা দেখেই সব বুঝে নিয়েছি।

কামর বলে, না না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। সারারাত খুব মশায় কেটেছে।

নাপিত-বৌ এবার হো হো করে হেসে ওঠে, খালি মশার কামড়? আর কিছু দেখতে-পাওনি শরীরে?

কামর বলে, হ্যাঁ মা পেয়েছি। এই দেখুন আমার বুকে কালো কালি মাখা আঙ্গুলের চারটে ছাপ, কিন্তু বুঝতে পারছি না, আমার বুকে এই টিপসই লাগলো কী ভাবে?

নাপিত-বৌ ভালোভাবে পরীক্ষা করে বললো, তুমি খুব সরল সোজা মানুষ, বাবা। ঘোর প্যাচ কিছুই মাথায় ঢোকে না তোমার। তা না হলে কোন্টা মশার কামড়, আর কোন্টা চুম্বনের দংশন, চিনতে পার না? ঐ আঙ্গুলের চারটে টিপ কেন দিয়েছে সে, জান? সে তোমার কাছে। নিজেকে সঁপে দিয়ে দাসখত সই করে দিয়েছে। এখন সে একমাত্র তোমার। এবার তোমার কর্তব্য তুমি ঠিক কর, বাবা। আমার বিশ্বাস ঐ জহুরী আবার তোমাকে নিমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু কাজ হাসিল হলে এই মা-বেটিকে ভুলে যেও না যেন।

কামর বলে, না মা, আপনার উপকার আমার মনে থাকবে।

এরপর কামর বিদায় নিয়ে সরাইখানায় ফিরে যায়।

হালিমা স্বামীকে বেশ কড়া সুরেই প্রশ্ন করে, কালকের রাতটা কেমন কাটালে তোমরা। বাড়িতে একজন মেহমানকে নিয়ে এসে কী রকম ব্যবহারটা করলে তার সঙ্গে?

বৃদ্ধ জহুরী বলে, ব্যবহার তো কিছু খারাপ করিনি, বিবিজান।-তবে কী জান, বেচারা সারারাত মশার কামড় খেয়েছে। একটা মশারী খাটিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।

আজ রাতে যদি তাকে আবার নিয়ে আস, ঐ ভাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না আগেই। নিজে কষ্ট করেও অতিথির সৎকার করতে হয়।

বৃদ্ধ বলে, সেই ভালো, ছেলেটাকে একটু আদর যত্ন করা হয়নি। কী ঘুম যে পেয়েছিলো কাল, কিছুই করতে পারিনি! দেখি আজ যদি তাকে নিয়ে আসতে পারি, আদর যত্নের ত্রুটি রাখবো না।

কামর দোকানে এলে বৃদ্ধ আবার তাকে আমন্ত্রণ জানায়।

কাল রাতে যা ঘুম পেয়েছিলো, কোনও আনন্দই করা যায়নি। আজ যদি আর একবার পায়ের ধুলো দেন–

কামরও এই আমন্ত্রণের আশাই করে এসেছিলো। সহজেই সম্মত হয় সে।

সে রাতেও একই কায়দায় শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দুজনকে শয্যাশায়ী করে ফেলে হালিমা। তারপর উদগ্র কামনার বহ্নি জ্বালিয়ে বিবসনা হয়ে ছুটে এসে কামরের যৌবন-জাগ্রত দেহের সঙ্গে বিলীন হয়ে সারাটা রাত সুরতরঙ্গে মেতে ওঠে।

পরদিন সকালেও একই ধরনের ব্যথা বেদনা অনুভব করে সে, অধরে গালে সারা দেহে। কিন্তু বৃদ্ধকে সে সম্বন্ধে কিছু বুঝতে দেয় না।

জহুরী জিজ্ঞেস করে, আজকের রাতটা কেমন কেটেছে, মালিক?

কামর বলে, খুব ভালো। আজ আর মশা-টশা কামড়ায়নি দেখছি।

সেদিন সে নাপিত-বৌ-এর কাছে ফিরে বলে, আজকেও একই রকম কেটেছে। সারা অঙ্গ ব্যথায় টনটন করছে। আর এই দেখুন আমার দেহে কে যেন এই চাকুখানা ঢুকিয়ে রেখে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না—এর কী অর্থ?

নাপিত-বৌ বলে, খুব সাবধান বেটা, মেয়েটা ভীষণ চটে গেছে। ও জানতে চেয়েছে। আজ রাতেও যদি ঐভাবে অসাড় হয়ে পড়ে থাক তবে তোমাকে সে খুন করে ফেলবে। মেয়েরা যখন কামের তাড়নায় দিশাহারা হয়ে পড়ে তখন তারা বাঘিনীর মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। একা একা ভোগে পরিতৃপ্ত হয় না। তাই তোমাকে সে জাগ্রত পেতে চায়।

কামর অসহায়ভাবে বলে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে এলে কী করে আমি জেগে থাকবো। আমি তো আর ইচ্ছে করে অসাড় হয়ে পড়ে থাকি না। কাল রাতে তো আমি জেগে থাকার অনেক কোসিস করেছিলাম কিন্তু শরবতটা খাবার পর আর চোখের পাতা টেনে তুলতে পারলাম না কিছুতেই।

নাপিত-বৌ যুক্তি দেয়, আজ রাতে বেটা, খানা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন তোমাদের সামনেশরবতের পেয়ালা এনে রাখবে, তুমি কায়দা করে শরবতের পেয়ালা ওঠাতে গিয়ে ফেলে দেবে। কিন্তু লক্ষ্য রেখ, ততক্ষণে বুড়োটা যাতে তার পেয়ালাটা চুমুক দিয়ে খালি করে ফেলে। তাহলে মজাটা চলবে ভালো। দেখবে, জহুরী ঘুমে ঢলে পড়বে তখুনি। কিন্তু তোমার চোখে আর ঘুম আসবে না। তারপর কী করতে হবে, নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

আনন্দে নাপিত-বৌ-এর হাতে চুম্বন করে কামর।

—চমৎকার! আজ রাতে আমি বাজি মাত করে দেব।

সে রাতেও বৃদ্ধ উবেদ কামরকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে তার বাড়িতে। যথারীতি নানা উপচারে আহারাদি শেষ হয়ে গেলো। একটা রেকাবীতে দু’পেয়ালা শরবত সাজিয়ে এনে সামনে রাখে পরিচারিকা। বৃদ্ধ এবং কামর দু’জনে একসঙ্গেই পেয়ালা দু’টো হাতে তুলে নেয়। কিন্তু কামর মুখে ঠেকাতে একটু বিলম্ব করে। ইতিমধ্যে বৃদ্ধের পেয়ালা নিঃশেষ হয়ে যায়। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কামরের হাত কেঁপে পেয়ালাটা নিচে পড়ে যায়।

বৃদ্ধ শুধু চুকচুক করে ওঠে, ইস্ পড়ে গেলো—

আর কোনও কথা সরে না তার, ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসে তার সকল সত্তা। ফরাশের একপাশে ঢলে পড়ে সে।

পরিচারিকা হারেমে ফিরে গিয়ে জানায়, সেশরবত দিয়ে এসেছে ওদের। এবং ওরা দুজনেই অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

হালিমা রাগে জ্বলতে থাকে। মূখটা তার ইঙ্গিত বুঝতে না পেরে আজও শরবতটুকু গিলেছে? যুঁসতে ফুঁসতে হাতে একখানা ছুরি নিয়ে সে ছুটে আসে।

তখন ফরাশের দুপাশে জহুরী আর কামর অসাড় হয়ে পড়েছিলো। হালিমা ছুরিকা হাতে কোমরের ওপর চেপে বসে শাণিত ছুরিটা কামরের বুকে বসিয়ে দিতে উদ্যত হয়। কিন্তু কামর খপ করে হাতখানা চেপে ধরে হো হো করে হেসে উঠে হালিমাকে হতচকিত করে দেয়।

-ওরে দুষ্ট, এই তোমার ঘুম? আমার সঙ্গে তামাশা করছিলে এতক্ষণ? কে, কে তোমাকে এসব শিখিয়ে দিয়েছে, শুনি।

কামর এবার হালিমাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। অধরে অধর রেখে বলে, এক বৃদ্ধা নাপিত-বৌ! সেই আমাকে তোমার টিপ-ছাপ আর ঐ চাকুর অর্থ বলে দিয়েছে।

—ভারি চালাক মেয়েমানুষ তো! সে তোমাকে লায়েক করে তুলেছে, দেখছি! কিন্তু যাদু, আমাকে তো তুমি জান না, আজ সারারাত ধরে তোমাকে আমি উল্টে পাল্টে যাচাই করে দেখে নেব,—সে বুড়ি তোমাকে তালিম দিয়ে কতখানি পাকা পোক্ত করে পাঠিয়েছে।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো ছিয়াশিতম রজনীতে

আবার গল্প শুরু হয় :

উত্তাল উদ্দাম এক ছন্দতরঙ্গে ভাসতে ভাসতে সমুদ্র-স্নান করতে থাকে ওরা। সারারাত ধরে। এক সময় হালিমা বলে, বুকের কলজে ছিঁড়ে দিতে পারি কিন্তু তোমাকে ছাড়তে পারবো না, মেরে জান! এ অমৃত আমি দু’চারদিন বা দু’চার মাস বা বছরের জন্য খেতে চাই না। সারা জিন্দগীভর তোমার যৌবন-সুধা পান করবো আমি। এই আমার পণ। ঐ অপদার্থ নপুংসক বুড়োটার বাদী হয়ে আর থাকবো না। চলো, আমি তোমার দেশে যাবো। তোমাকে ছাড়া একদণ্ড আমার চলবে না, মালিক। এখন যা বলি শোনো। আমাদের এই বাড়ির ধারে-কাছে একখানা বাড়ি ভাড়া করে সরাইখানা ছেড়ে চলে এসো তুমি। বুড়োটা যদি আবার তোমাকে নেমন্তন্ন করে বলবে, পর পর তিনি দিনই যথেষ্ট। তার পর আর ভালো দেখায় না।

কামর কসম খেয়ে বললো, তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মানবো, সোনা।

এরপর আবার ওরা সুরত-রঙ্গে মেতে ওঠে।

এইভাবে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। হালিমা হারেমে ফিরে যায়।

পরদিন সকালে উঠে কামর নাপিত-বৌ-এর কাছে চলে যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় উবেদ আবার কামরকে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু কামর রাজি হয় না। বলে, আমি ঐ সরাইখানা ছেড়ে আপনাদের পাড়ায় একখানা বাড়ি ভাড়া করবো ঠিক করেছি।

বৃদ্ধ জহুরী বোকাসোকা মানুষ। উৎসাহিত আনন্দে কামরের অভিপ্রায়কে স্বাগত জানিয়ে বললো, চমৎকার হবে। তা আমার বাড়ির লাগোয়া বাড়িটাই বাড়া আছে। আপনি যদি অনুমতি করেন আমি ব্যবস্থা করতে পারি।

কামর বলে, বেশ তো, তাই করে দিন, ভালোই হবে। কাছাকাছি পাশাপাশি থাকা যাবে।

সেইদিনই বৃদ্ধ পাশের বাড়িটা ভাড়া নিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলো কামরের জন্য।

প্রতিদিন সকালে জহুরী দোকানে চলে গেলে হালিমা খিড়কীর পথ দিয়ে কামরের ঘরে এসে প্রবেশ করে। সারাটা সকাল ওরা গল্প করে, দাবা খেলে, রঙ্গ তামাশা করে। এবং আদর সোহাগ চুম্বনে মেতে ওঠে।

হালিমা ফন্দী আঁটে। কী করে বুড়ো জহুরীর হাত থেকে মুক্ত হওয়া যায় তারই উপায় উদ্ভাবন করতে থাকে। কামরকে বলে, শোনো মালিক, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

কামর হালিমাকে বুকের কাছে টানতে টানতে বলে, বলো কী করতে হবে? পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে হবে?

হালিমা হাসির ঝরনা হয়ে নিজের উদ্ধত বুকে হাত রেখে বলে, হ্যাঁ, এই পাহাড় থেকে। কামর উন্মত্ত হয়ে ওঠে। হালিমা ওকে শান্ত হতে বলে, আহা, আমি তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছি।। একটু ধৈর্য ধর, আগে একটা কাজের কথা বলে নিই।

এই বলে সে বুকের মধ্যে থেকে একখানা ছোট ভোজালী বের করে কামরের হাতে দিয়ে বলে, দেখছো, কী সুন্দর! এর বাঁটখানা বুড়োটা নিজে হাতে বানিয়েছে।

কামর নেড়ে চেড়ে দেখলো ছুরিখানা। সত্যিই খুব সুন্দর। সোনার বাঁটের সূক্ষ্ম কারুকর্ম একমাত্র উবেদের হাতেই সম্ভব।

হালিমা বললো, এই ছুরিখানা নিয়ে তুমি বুড়োর দোকানে যাও। ওকে দেখিয়ে বলল, এটা তুমি বাজারে একটা লোকের কাছ থেকে কিনেছ একশ’দিনারে। ওকে জিজ্ঞেস করবে, জিনিসের তুলনায় দামটা ঠিক হয়েছে কিনা। বুড়ো যাই বলুক, ছুরিখানা নিয়ে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে এখুনি।

কামর বললো, আমি এখুনি যাচ্ছি।

ছুরিখানা উবেদের হাতে দিয়ে কামর বললো, দেখুন তো শেখ সাহেব, ঠকে গেলাম কিনা। একশো দিনার নিয়েছে।

উবেদ চমকে ওঠে, কার কাছ থেকে কিনলেন?

—এই বাজারেরই একপাশে এক ফিরিওলা বসেছিলো নানারকম বাহারী জিনিসপত্র নিয়ে। ছুরিখানার বাঁটের কাজ দেখে আমার খুব পছন্দ হয়ে গেলো।

উবেদ গম্ভীর হয়ে গেলো। ছুরিখানা কামরের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, না, ঠকেন নি। এর অনেক দাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে উবেদ বাড়িতে ফিরে এসে ক্রোধান্বিত হয়ে প্রশ্ন করে বিবিকে, আমার ভোজালীখানা কোথায়?

হালিমা ইচ্ছে করেই জবাব দেয় না। বৃদ্ধ ফেটে পড়ে, কী চুপ করে রইলে কেন? কোথায় আমার ভেজালী?

হালিমা বলে, কী ব্যাপার হঠাৎ অমন রণমূর্তি ধরে এই অসময়ে ঘরে ফিরে এলে কেন?

বৃদ্ধ এবার চিৎকার করে ওঠে, ওসব কথা পরে হবে, আগে আমার কথার জবাব দাও। বলল কোথায় আমার ভোজালী?

হালিমা কিন্তু শান্ত সহজ কণ্ঠে বলে, কেন? আমার কাছেই থাকে, আমার কাছেই আছে!

-কই, বের কর দেখি?

হালিমা বলে, না। এখন তুমি যে কারণেই হোক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছ আমার ওপর। এ সময় অমন মারাত্মক অস্ত্র তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না আমি। তবে নিশ্চিন্ত থাক, সে জিনিস ঘরেই আছে। এবং আমার বাক্সেই আছে।

দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে ওঠে জহুরী। বলে, না, নাই।

হালিমা ভুরু কোচকায়, মানে? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার? আমি কী মিথ্যে বলছি তোমার কাছে?

—জানি না। এখুনি আমি দেখতে চাই আমার ছুরি।

–বেশ দেখ।

অভিমানে আহত হয়ে কাঁদ কাঁদ ধরা গলায় হালিমা বলে, জানকে আমি পরোয়া করি না। বুকে বসিয়ে দিতে চাও দেবে। দাঁড়াও, এখুনি আমি বাক্স খুলে বের করে দিচ্ছি তোমার ছুরি।

বাক্সের ডালা তুলে ভেজালীখানা বের করে বৃদ্ধের হাতে তুলে দিতে চায় হালিমা, নাও ধর। এই বুক পেতে দিলাম, শেষ করে দাও এ আপদ। এতে সন্দেহ, অবিশ্বাস নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। স্বামী যদি বৌকে বিশ্বাসই না করতে পারলো, কি দরকার সে পোড়া জীবনে!

বেচারা উবেদ! অনুতাপে লজ্জায় মরমে মরে যেতে থাকলো।

-আমাকে মাফ করে দাও, চাচার মেয়ে। আমার ঘাড়ে শয়তান ভর করেছিলো। না হলে তোমার মতো সতী-সাধ্বীকে সন্দেহ করি!

পরদিন সকালে এক বাঁদীর সাজে সেজেগুজে কামরের ঘরে আসে হালিমা।

—দেখ তো মালিক, বিকাবো কিনা বাজারে? কামর অবাক অথচ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে হালিমার যৌবন-মদমত্তা মোহিনী সাজগোজের দিকে।

-লুফে নেবে গো, লুফে নেবে? কোন্ বাদশার প্রাসাদে যাবার শখ হয়েছে, শুনি?

হামিলা কামরকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দেয়, আহা-হা, ধরো না, ধরো না আমাকে। প্রসাধন প্রলেপ সব মুছে যাবে। আচ্ছা, আর দেরি নয়। চলো, আমাকে নিয়ে জহুরীর দোকানে চলো। বুড়োকে বলবে, বাঁদী হাট থেকে হাজার দিনারে কিনেছ আমাকে।

 

বৃদ্ধ উবেদ নিবিষ্ট মনে একটা সূক্ষ্ম কারুকর্মে ডুবেছিলো। কামর আর হালিমার আগমন সে বুঝতে পারেনি প্রথমে। কামর সাড়া দিতে সে সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ তুলে তাকায়। লজ্জিত হয়ে বলে, গোস্তাকি মাফ করবেন মালিক, খেয়াল করতে পারিনি।

কামর বলে, বাঁদীহাটে গিয়েছিলাম। এই বাঁদীটাকে পছন্দ হয়ে গেলো। হাজার দিনার দাম। তা পছন্দ যখন হলো, নিয়েই ছিলাম। দেখুন তো শেখ সাহেব, আপনার শিল্পীর চোখ, ঠকে গেলাম কিনা।

হালিমার মুখের নাকাব খুলে ধরে কামর। বৃদ্ধ তাকিয়েই দু’হাতে চোখ ঢেকে আর্তনাদ করে ওঠে। ব্যস্ তারপর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে।

কিছুক্ষণ পরে উবেদহন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসে। চোখে মুখে তার দারুণ উৎকণ্ঠা আশঙ্কা।

হালিমা তখন একটা আটপৌরে শেমিজ পরে আয়নার সামনে বসে এলায়িত কেশে তেল দিচ্ছিল আর গুনগুন করে মনের আনন্দে গান করছিলো।

 

উবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হালিমার নিশ্চিন্ত নির্লিপ্ত সুন্দর মুখাবয়বের দিকে। এই ঘরোয়া পরিবেশে—প্রসাধন-প্রাক্কালে হালিমার চেহারা তার অনেক দিনের চেনা। একটু আগে। তার দোকানে কী সে এই হালিমাকেই বাঁদীর মোহিনী বেশে দেখেছিলো? না না, অসম্ভব! হালিমা তার ঘরের বিবি। অমন বাঁদীর সাজে সাজবে কেন সে? আর বাঁদীহাটেই বা যাবে কী করে?

কিন্তু তার চোখ কী এতোই ভুল করেছিলো? উবেদ আর ভাবতে পারে না।

হালিমা স্বামীর কাছে এগিয়ে এসে সোহাগ জোড়ানো স্বরে বলে, আহা, তোমার মুখ চোখ অমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন গো, শরীর খারাপ হয়নি তো!

-না হালিমা, ওসব কিছু নয়। আমি বড় ধাঁধায় পড়েছি।

-সে কি, আবার কী ধাঁধা?

বৃদ্ধ ক্লান্ত স্বরে বলে, আজ সকালে কামর সাহেব বাঁদীহাট থেকে একটা বাঁদী কিনে আমার দোকানে আমাকে দেখাতে গিয়েছিলো। কিন্তু কী বলব বিবিজান, মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই আমার মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না হালিমা, সে মেয়ে তুমি নও।

—কী যে যা তা বলল, তোমার মাথার ঠিক নাই। দিনে দিনে সন্দেহ তোমার বাড়ছেই। আমি তোমার শাদী করা বিবি। আমাকে যদি এইভাবে পদে পদে সন্দেহ কর, কী দরকার এই মিথ্যে বন্ধনে?

-না বিবিজান, সন্দেহের কথা নয়। এ আমার নিজের চোখে দেখা। ভুল হবে কী করে।

হালিমা বলে, এক রকম দেখতে দু’জন কী হয় না?

—তা হতে পারে। কিন্তু তা বলে কি নিজের বিবিকে চিনতে ভুল হয় কারো? হালিমা বলে, তোমার বুড়ো বয়সে বাহাত্তরে ধরেছে। যাক, কামর সাহেব-এর বাসা তো আর সাত যোজন দূরে নয়। একবার যাও না, দেখেই এসো না আর একবার। তাহলেই বুঝবে, সে মেয়ে তোমার হালিমা বিবিজান কি না?

উবেদ যেন সমাধান খুঁজে পেয়ে গেছে।

–ঠিক, ঠিক বলেছ, বিবিজান, সত্যিই তোমার বুদ্ধি আছে। তারিফ করতে হয়। আমি এখুনি যাচ্ছি কামর সাহেবের বাসায়।

হালিমা বলে, যাবে নিশ্চয়ই যাবে। ঘরে যখন ফিরেই এলে এই অসময়ে আমি আনারের হালওয়া বানিয়েছি। একটুখানি বসো, জিরিয়ে নাও। আমি নাস্তাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে দেয়ে যাও কামার সাহেবের বাসায়।

উবেদ তার নিজের ঘরে ফিরে আসে। হালিমা পরিচারিকার হাতে হালওয়ার রেকাবীখানা পাঠিয়ে দিয়ে চটপট অন্যরকম সাজ-পোশাক পরে খিড়কীর পথ দিয়ে কামরের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

একটুক্ষণ পরে উবেদ আসে কামরের বাসায়। কামর সাদরে বসতে বলে। একটু পরে হালিমা দু’পেয়ালা সুগন্ধী শরবত এনে দু’জনের সামনে রেখে মাথা নুইয়ে যুক্তকরে উবেদকে সালাম করে।

উবেদ কিন্তু এবার আর মূছা যায় না। নিজের ভুল বুঝতে পারে। খুশি মনে আবার দোকানে ফিরে যায়।

উবেদ বেরিয়ে যেতেই হালিমা কামরের কাছে এগিয়ে এসে বললো, আচ্ছা বলতো, বুড়োটা কী? ও কী বুঝতে পারছে না, ওর প্রাণাধিকা হালিমা আর ওর সম্পত্তি হয়ে এখানে পড়ে থাকতে চায় না? আমি উট ঠিক করে রেখেছি। চলো আজই এক্ষুণি এখান থেকে পালিয়ে যাই।

সেইদিন ওরা দু’জনে বসরাহ ছেড়ে কাইরোর পথে রওনা হয়। এবং কয়েকদিনের মধ্যেই

নিরাপদে এসে পৌঁছয়।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে মা বাবা আনন্দে কেঁদে ফেলে। আবদঅল রহমান জিজ্ঞেস করে, একি শাহজাদী নাকি, বেটা?

কামর বলে, না। তবে ঐ ফকির সাহেব যার কথা বলেছিলেন, এ সেই মেয়ে। আমি একে শাদী করবো বাবা।

কামর তার মা বাবাকে বসরাহ সফরের সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। বাবা শুনে আতঙ্কে শিউরে ওঠে, এ তুই কী করেছিস, কামর। কাকে ধরে এনেছিস আমার খানদানে। একে আমি ছেলের বিবি করে ঘরে তুলবো? কী আছে এর বংশ-পরিচয়? নাম-গোত্রহীন একটি রাস্তার মেয়েছেলেকে আমি পুত্রবধূ করে বরণ করে নেব? যে নষ্ট-চরিত্রের মেয়ে তার নির্দোষ স্বামীকে পরিত্যাগ করে তোর হাত ধরে পালিয়ে এসেছে, তাকে বিশ্বাস কী? দুদিন বাদে তোকেও কলা দেখিয়ে সে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে যাবে না, তার কী প্রমাণ? এসব বেলেল্লায়ানা আমি একদম পছন্দ করি না। তুই একে ছেড়ে দে, বাবা। আমি তোর সঙ্গে অনেক বড় ঘরের পরমাসুন্দরী মেয়ের সঙ্গে শাদী দিয়ে দিচ্ছি। আমার ইয়ার-বন্ধুদের ঘরে অনেক ভালো মেয়ে আছে। তারা আমাকে নিত্য খোসামদ করছে। তুই আমার কথা শোন, এসব বাজে নেশায় মেতে থাকিস না।

কামর বলে, কিন্তু বাবা, আমি তো তোমাদের মত নিয়েই বসরাহয় গিয়েছিলাম। যাই হোক, তোমাদের যখন ইচ্ছা নয়, আমি হালিমাকে শাদী করতে চাই না। তোমরাই মেয়ে পছন্দ কর। আমি তাকেই শাদী করবো।

এরপরে হালিমাকে আবদ অল রহমান তার বাড়ির কাছেই একটা গুদামঘরে কয়েদ করে রেখে দেয়।

অনেক দেখেশুনে কাইরোর কাজীর পরমাসুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে কামরের শাদী দিয়ে দেওয়া হলো। চল্লিশ দিন ধরে আনন্দে উৎসবে মেতে রইলো রহমান-পরিবার।রহমান একমাত্র ছেলের শাদীতে অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করলো না। চল্লিশ দিন ধরে খানা-পিনা নাচগান দান-ধ্যান সমানে চলতে থাকলো। অবারিত দ্বার। ঢালাও আমন্ত্রণ। যার ইচ্ছা পেটপুরে খেয়ে যেতে পারে। কেউ বাধা দেবে না।

কামর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলের খাওয়া দাওয়া তদারক করছিলো। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, ছিন্নবসন দীন দরিদ্র এক কৃশকায় বৃদ্ধের দিকে। চিনতে অসুবিধে হলো না, এই সেই বৃদ্ধ জহুরী উবেদ।

বাবার কাছে ছুটে গিয়ে সে খবর দেয়, সেই জহুরী উবেদ এসেছে, বাবা। মেহমানদের সঙ্গে বসে আছে।

রহমান দ্রুতপায়ে বাইরে এসে খাবার ঘরে ঢোকে। বৃদ্ধের কাছে এগিয়ে গিয়ে আলাপ পরিচয় করে।

—আপনার এমন হাল হয়েছে কেন, শেখ সাহেব? এরকম দীন দশার কী কারণ?

উবেদ বলে, যাদের আপনজন মনে করেছিলাম, তারা যখন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো তখন ঘৃণায় আমি বসরাহ ত্যাগ করে পথে বেরিয়ে পড়ি! কিন্তু নসীব খারাপ, পথে আরব-দস্যুদের হাতে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার সারা জীবনের যা কিছু সঞ্চিত সম্পদ ছিলো সব তারা লুটে নিয়ে গেছে। শুধু আল্লাহর অসীম কৃপায় রক্ষা পেয়ে গেছি কোনক্রমে।

রহমান ওকে হামামে নিয়ে গিয়ে গোসলাদি করিয়ে নতুন সাজ-পোশাক পরতে দিলো!

-আপনি আমার মহামান্য মেহমান। কোনও দ্বিধা সঙ্কোচ করবেন না, শেখ সাহেব। অকপটে প্রাণের কথা জানাতে পারেন আমাকে। সত্য কথা বলতে কোনও ইতস্ততঃ করবেন না। আমি সব জানি। আপনার বিবি হালিমা এখন আমার হেপাজতে নিরাপদেই আছে। কোনও চিন্তা করবেন না। এখন একটু কিছু খানা-পিনা সেরে নিন। আমি ভাবছিলাম, দু’চার দিনের মধ্যেই আপনার বিবিকে আপনার কাছে বসরাহয় পাঠিয়ে দেব। তা আপনি যখন স্বয়ং এসে গেছেন তখন আর তার দরকার হবে না। হালিমাকে আপনার হাতে তুলে দেব। আমার ধারণা, আপনি তার সন্ধানেই এই দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছেন! আপনর এতো দুঃখ ক্লেশের একমাত্র কারণ আপনার এই বিবি। সব কাহিনীই আমি শুনেছি কিন্তু কিছু মনে করবেন না শেখ সাহেব এর জন্যে পুরো দোষ তার একারই! আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি তাকে। তারপর ইচ্ছে করলে তাকে আপনি মার্জনা করে ঘরে নিয়ে যেতে পারেন। অথবা তার প্রাপ্য সাজারও ব্যবস্থা করতে পারেন। সবই আপনার মর্জির ওপর নির্ভর করবে। যাক সে-সব পরে হবে, এখন আগে কিছু একটু মুখে দিয়ে নিন। মনে হচ্ছে, অনেক দিন ভালো করে খাওয়া-দাওয়া হয়নি আপনার।

বৃদ্ধকে মেহমানের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে খানা-পিনা করতে বসে দুজনে। খেতে খেতে রহমান একসময় বলে, একটা নারী যখন কোনও পুরুষকে প্রলুব্ধ করতে থাকে তখন সে পুরুষের পক্ষে তার ফাঁদ এড়িয়ে পালিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার ছেলে কামর, একেবারে অজ্ঞ অনভিজ্ঞ ছিলো কাম-কলায়। কিন্তু আপনার বিবি হালিমা তাকে নিজে হাতে ধরে ধরে সব শিখিয়ে পোক্ত করে তুলেছে! আমি ভেবে পাই না, যে নারী তার স্বামীর সঙ্গে শঠতা করে তারই নাকের ডগায় পরপুরুষ নিয়ে রতিরঙ্গে মত্ত হতে পারে, সে বিবি ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে কী ফায়দা হবে আপনার? কামনা বাসনা মানবদেহে সহজাত। আল্লাহরই দান। কিন্তু তা যদি বিপথগামী হয় তবে তা দিয়ে সংসারের কী কল্যাণ হতে পারে?

জহুরী বিষণ্ণভাবে বলে, আপনি যথার্থই বলেছেন, ভাইসব। আপনার ছেলের কোন দোষ

দেখি না আমি। সব দোষ আমার বিবির। কই, কোথায় সে?

কামর-এর বাবা বললো, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। কাছেই একটা বাড়িতে তাকে আটকে রেখেছি আমি।

রহমান বৃদ্ধকে সঙ্গে করে সেই বাড়িটায় নিয়ে গিয়ে তালা খুলে দিয়ে বলে, ভিতরে যান, এই ঘরেই সে আছে।

জহুরীকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে হালিমা। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে এক পা এক পা করে পিছু হটতে থাকে সে। কিন্তু জহুরীর দুটি হাতের থাবা ওর গলাটা টিপে ধরে।

–ওরে শয়তানী বেবুশ্যা খানকি মাগী, এই তোর পুরস্কার—

রাত্রির অন্ধকার কেটে যায়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো সাতাশিতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :

যদিও ছেলে কামর-এর দোষ ততটা ছিলো না, তবু আবদ অল রহমান অনুতাপের আগুনে পুড়তে থাকে। বৃদ্ধ জহুরী বেচারা কারো ক্ষতি করেনি জীবনে, অথচ এইভাবে তার জিন্দগীটা বরবাদ হয়ে গেলো কেন?

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে থামলো। সুলতান শারিয়ার বললো, এইভাবেই বিশ্বাসঘাতিনীরা সাজা পায়, শাহরাজাদ। সংসারে যেসব মেয়ে ভ্রষ্ট-চরিত্রের হয় তাদের সকলের দশাই হালিমার মতো হয়। শাহরাজাদ, হয়তো তুমি আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলে, কিন্তু মনে করে দেখ, কী ক্রোধের কারণে প্রতিদিন একটি করে মেয়েকে শাদী করে পরদিন সকালে হত্যা করার হলফ নিয়েছি আমি! আমিও নারীর কাছ থেকে পেয়েছি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। এবং সেই কারণেই আমার এতো ক্রোধ—এমন প্রতিজ্ঞা। জান বলতে আজ বুকে বাজে, যেদিন আমার প্রাণাধিকা বেগমকে দেখলাম, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে আমার পবিত্র প্রেমকে কলুষিত করে ফেলেছে। সেইদিনই আমি তাকে এবং তার হারেমের সব সাগরেদ দাসী বাঁদীদের কোতল করেছি।

সুলতান শারিয়ারের দু’গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো।

শাহরাজাদ চুপ করে বসে থাকে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে শারিয়ার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, এই দ্যাখ, আমি কী সব বলে তোমাদের গল্পের মেজাজটাই মাটি করে দিলাম। যাক, এবার নতুন কিসা শুরু কর, শাহরাজাদ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *