3 of 4

৪.০৬ শেখ হাসান আবদাল্লার কাহিনী

আমার বাবা কাইরোর একটা সম্ভ্রান্ত সওদাগর ছিলেন। ধন-সম্পদ ছিলো যেমন প্রচুর, তেমনি ছিলেন তিনি সর্বজন-সম্মানিত ব্যক্তি।

আমি তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান। আমার শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে তিনি মুক্তহস্ত ছিলেন। সেই সময়ের সেরা পণ্ডিতদের নিয়োগ করেছিলেন আমার বিদ্যালাভের জন্য।

আমার যখন মাত্র কুড়ি বৎসর বয়স সেই সময়েই বিদ্বজ্জনের মধ্যে আমার পাণ্ডিত্য নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যকর আলোচনা হতে লাগলো। ফলে, অচিরেই আমি দেশ বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে উঠলাম। প্রাচীন পুঁথি পাঠে আমার মতো দক্ষ মানুষ সে-সময়ে আর দুটি ছিলো না।

দিনক্ষণ দেখে বাবা আমাকে এক পরমাসুন্দরী চতুর্দশীর সঙ্গে শাদী দিলেন। আমার বিবি শুধু দেখতেই রূপসী ছিলো না, লেখাপড়াতেও ছিলো বেশ বুদ্ধিমতী। শাদীর পর সুখ-সম্ভোগের মধ্যে পুরো দশটা বছর আমরা একত্রেই কাটিয়েছিলাম।

কিন্তু নিয়তিকে কে এড়াতে পারে? বাবা মারা গেলেন। সেই সঙ্গে সৌভাগ্যও বিদায় নিলো। ব্যবসা বাণিজ্যে দারুণ লোকসান হতে লাগলো। মহাজনদের কাছে ঋণ জমে পাহাড় হয়ে উঠলো। এমন সময় মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-আমার প্রাসাদোপম বিরাট ইমারত আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।

বিপদ কখনও একা আসে না। আমার শেষ সম্বল একটিমাত্র জাহাজ- তাও সমুদ্রঝঞায় তলিয়ে গেলো একদিন।

আমি কপর্দকশূন্য পথের ভিখিরি হয়ে গেলাম। আমি ভবঘুরের মতো দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম। এতো দুঃখে, বিপদেও কিন্তু আল্লাহকে স্মরণ করেছি নিত্য। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিলো, যে দেশেই যাই, মসজিদে সময় মতো নমাজ পড়া। মসজিদে গেলে অনেক সাধু মানুষের দেখা মেলে। তারা অনেক জ্ঞানের কথা, অনেক ধর্মোপদেশের কথা বলেন। আমার সে-সব শুনতে বড় ভালো লাগতো। ঐ নিঃসম্বল জীবনে তাঁরাই ছিলো আমার প্রকৃত আপনজন, বন্ধু।

এইভাবে ভাগ্য অন্বেষণে দেশে দেশে ঘুরে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে অবশেষে একদিন শূন্য হাতে ঘরে ফিরে আসি। আমার বৃদ্ধ বিধবা জননী ও ক্ষুধাক্লিষ্ট সন্তান ও বিবির মুখের দিকে আর তাকাতে পারি না। এমনই আমার দুর্ভাগ্য নিজের মা বৌ বাচ্চাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না? এ হেন তুচ্ছ জীবন রেখে কী লাভ?

একদিন, কোনও উপায়েই আর কিছু সংগ্রহ করতে পারলাম না। আমার বিবি তার অঙ্গের শেষ বস্তুটুকু খুলে আমার হাতে দিয়ে বললো, যাও, এটা বেচে যাহোক কিছু এনে দাও। বাচ্চাটার মুখের দিকে আমি আর চাইতে পারছি না।

মনের ক্ষোভ মনেই চেপে পোশাকটা নিয়ে বাজারে গেলাম। সেখানে দোকানে দোকানে ঘুরে বিক্রির চেষ্টা করছি, এমন সময় খয়েরী রঙের উটের পিঠে এক বাদাবীকে দেখতে পেলাম।

রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

সাতশো ঊননব্বইতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

আমাকে দেখতে পেয়ে সে লাগাম টেনে উটটাকে থামালো। তারপর নিচে নেমে খুব বিনয়াবনত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা মালিক, আপনি কী বলতে পারেন, অল আসারের পুত্র হাসান আবদাল্লার বাড়িটা কোন্ দিকে?

এক পরদেশীর মুখে একথা শুনে আমি আমার দৈন্যদশার কারণেই কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে গেলাম। হয়তো এই বিপদকালে আল্লাহই ওকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে আশীর্বাদ হিসাবে, কিন্তু তবু আমি নিজেকে উন্মুক্ত করে ধরতে পারলাম না ওর কাছে।

আপনি আরব-শ্রেষ্ঠ, কিন্তু জনাব, এই কাইরো শহরে ও রকম নামের কোনও মানুষ তো কেউ বাস করে না।

আমি আর ওর সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। কথা কয়টি বলেই পিছন ফিরে হন হন করে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু বাদাবী ছুটে এসে আমার হাত দুখানা জড়িয়ে ধরলো, খোদা হাফেজ, আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনিই শেখ হাসান আবদাল্লা কিনা? আপনার বাবাই তো অল আসার? আমি বুঝতে পেরেছি কেন আপনি নিজের পরিচয় গোপন করতে চাইছেন। বাড়িতে মেহমান এলে তাকে কী করে সমাদর করবেন এই আশঙ্কাতেই আমাকে এড়াতে চাইছেন, তাই না?

ওর কথায় আমি আর অশ্রু সম্বরণ করতে পারলাম না। আমি কাতর অনুনয় করে বললাম, আমাকে দয়া করে মাফ করুন, আমাকে ভুলে যান।

কিন্তু সে কথায় সে কান দিলো না। আমাকে অনেক আদর সোহাগ করে চুম্বন করতে লাগলো।

-কেন, ভাইসাব এতো দ্বিধা কেন? সব দিন মানুষের সমান যায় না। ধর, আমি যদি তোমার সহোদর বড় ভাই হতাম? পারতে কী মুখ ফিরিয়ে নিতে?

এর পর আর কথা চলে না। আমি ওকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এলাম। উটের পিঠে চাপলো না, আমার পাশে পাশে সে হেঁটেই এলো। সারাটা পথ আসতে আসতে শুধু একটা চিন্তাই আমাকে দংশন করতে থাকলো-মুসাফির মেহমানের সামনে ধরার মতো কোনও সম্বলই তো আমার নাই।

ঘরে ফিরে বিবিকে বললাম সব কথা।—জান বিবিজান, মনে হচ্ছে আল্লাহ স্বয়ং পাঠিয়েছে এঁকে। আর আমাদের দুঃখ কষ্ট থাকবে না, দেখে নিও।

আমার বিবি বললো, কিন্তু সে তো হলো, এখন কী খেতে দেব মেহেমানকে। হাদিসে আছে ঘরে অতিথি এলে পুত্র-কন্যাদের খানাপিনাও তার প্রাপ্য! তুমি দেরি করো না। ছুটে বাজারে যাও। যে দামেই পারো পোশাকটা বেচে কিছু সওদা করে নিয়ে এসো। অতিথি সৎকার শেষে যদি কিছু বাঁচে তবে আমাদের ভোগে লাগবে।

আমি বললাম, কিন্তু এখন বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবো কি করে? বৈঠক খানায় ওকে বসিয়েছি। বেরুতে গেলে ওর সামনে দিয়ে বেরুতে হবে। তা কি তিনি হতে দেবেন? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করবেন, তোমার কামিজের তলায় কী নিয়ে যাচ্ছ ভাই, দেখি? তখন আমি কী বলবো ওকে?

বিবি বললেন, কিন্তু তা বলে অতিথিকে অভুক্ত রেখে চক্ষুলজ্জা নিয়ে ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না গো।

মহা সঙ্কটে পড়লাম। কিন্তু কিই বা উপায়, বাইরে বেরুতে গিয়েই বাদাবী ভাই-এর জেরার মুখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

—দেখি ভাইসাব দেখি, কামিজের তলায় ওটা কী?

আমি থতমত খেয়ে বলি, কই না তো, কিছু না।

-খোদা মেহেরমান, আমার কাছে গোপন করো না ভাই। বলো কী নিয়ে যাচ্ছ—এবং কেন?

আমি পোশাকটা বের করে দেখালাম ওকে। বললাম, আমার বিবির বড় শখের জিনিস। এবং এটাই শেষ সম্বল আমাদের। এতদিন আঁকড়ে ধরেছিলাম। কিন্তু আজ আর কোনও উপায় নাই। তাই বাজারে বেচতে যাচ্ছি।

ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তুমি না আমাকে বড় ভাই বলে ঘরে এনেছ? একজন মেহমানের পরিচর্যার জন্য তুমি বিবির এই শখের জিনিসটা বিক্রি করতে যাচ্ছ? এই নাও, দশটা দিনার। যাও, যা প্রাণ চায় কিনেকেটে নিয়ে এসো। আমরা সবাই মিলে আজ ফলার খাবো।

সে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে দিনারগুলো আমার হাতে গুঁজে দিলো। আমি না করতে পারলাম না।

সেই শুরু হলো। প্রতিদিন বাদাবী আমাকে দশটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বাজার করে আনতে বলে। আমিও নানারকম চর্ব্য-চোষ্য জাতীয় খানাপিনা কিনে মহাস্ফূর্তিতে দিন কাটাতে লাগলাম।

এইভাবে পনেরোটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো। মোল দিনের দিন বাদাবী সর্দার আমাকে বললো, আচ্ছা হাসান আবদাল্লাহ, তুমি কি নিজেকে বিক্রি করতে চাও?

আমি পরিহাস মনে করে তৎক্ষণাৎ জবাব দিই, বান্দা তো আপনার কাছে বিক্রি হয়ে আছে। মালিক।

বাদাবী এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, কী দাম দিলে নিজেকে বিক্রি করবে তুমি?

আমি তখনও লঘুভাবে নিচ্ছি ও-কথাগুলো। বললাম একখানা কোরাণ আর এক হাজার দিনার—এই তো যথেষ্ট এতেই আমার চলবে।

—আমি তোমাকে দেড় হাজার দিনার দেব, আবদাল্লাহ, তুমি রাজী?

হঠাৎ কেমন খটকা লাগলো বাদাবীর কথায়। নাঃ, ও তো তামাশা মজাক ফাঁক করে বলছে এসব। সত্যি সত্যি ব্যবসাদারী চালে দরাদরি করছে। আমি তখন নিজের ফাঁদে নিজে পড়ে গেছি। ওকে এক রকম কথাই দিয়ে দিয়েছি, হাজার দিনার পেলেই আমি ওর হয়ে যাবো। তার বদলে সে বদান্যতা দেখিয়ে বলেছে দেড় হাজার দেবে। আমি ভাবলাম, বাদাবী মন্দ প্রস্তাব করেনি। বৌ বাচ্চার মুখের দিকে আর তাকানো যায় না। টাকাটা পেলে এরা দুটো খেয়ে বাঁচবে। আর আমার জীবন? ও নিয়ে আমার কোনও মায়া মমতা নাই। যদি কেউ ফাঁসী দেবার জন্যেও কিনে নিতে চায় আমার কোনও আপত্তি নাই। কিন্তু সংসারে আমিই, তো সবই নই। আমার বিবি আছে মা আছেন। তাদেরও অনুমতি দরকার। বললাম আমি একবার বিবিকে জিজ্ঞেস করে দেখি। আমার নিজের দিক থেকে বিন্দুমাত্র অমত নাই। আমাকে একটু সময় দিন, মালিক।

—বেশ তো, ভেবে চিন্তে আলাপ আলোচনা করেই আমাকে বলো। এতো তাড়াহুড়োর কী আছে?

এই বলে আমাকে ছেড়ে সে তার নিজের কাজে বেরিয়ে পড়লো।

তারপর শুনুন, জাঁহাপনা, আমার মা বৌকে সব কথা বলতে তারা কেঁদে কপাল চাপড়াতে থাকলো।

আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম, দেখ, তোমরা অবুঝ হয়ো না। যে নিদারুণ দুঃখের দিন দেখেছ এর আগে, এই বাদাবী আসার পর তা কেটে গেছে, বলা যায়। এবং আমার ধারণা, তার প্রস্তাব মেনে নিলে তোমরা সকলে খেয়ে পরে বাঁচবে? এ ছাড়া এখন যদি তার কথা না শুনি সে হয়তো রেগে গিয়ে বলবে, এতদিন তোমার খাওয়ার জন্য যে টাকা দিয়েছি তা ফেরত দিয়ে দাও। তখন আমি কোথা থেকে সে ঋণ শোধ করবো?

আমার বিবি এবং মা শঙ্কিত হলো। তাইতো শয়তান বাদাবীটা যদি টাকার দাবি তোলে তাহলে কী উপায় হবে?

মুখে আর না বলতে পারলো না ওরা। বিকেলে বাদাবী ফিরে এলে আমি বললাম, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি।

বাদাবী তখুনি পনেরোশো দিনার গুণে আমাকে দিলো।

–পয়গম্বরের কাছে প্রার্থনা জানাও, আবদাল্লাহ তোমার ওপর যেন সদয় থাকেন। তাহলে ভাইজান, এখন থেকে তুমি আমার কেনা সম্পত্তি হলে? তোমার আশঙ্কার কোনও কারণ নাই। আমার কাছে সুখেই থাকবে। স্বাধীনতাও ক্ষুন্ন হবেনা কিছুমাত্র। আমি শুধু তোমাকে আমার সুদূর যাত্রাপথের এক বন্ধু সহচর করে রাখবো। জানতো পয়গম্বর বলেছেনঃ বিদেশ ভ্রমণকালে সঙ্গীই সবচেয়ে বড় পাথেয়।

আমি প্রফুল্ল মনে সেই পনেরশো দিনারের তোড়াটা নিয়ে মা এবং বিবির কাছে গেলাম। তারা তখন অঝোরে কাঁদছিলো। অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম ওদের, বাদাবী আমাকে তার আপনজন করেই রাখবে, তোমরা কোনও দুশ্চিন্তা করো না আমার জন্য।

কিন্তু সে-কথায় কী প্রিয়জনকে ভোলানো যায়?

-না না, ঐ রক্তমাখা টাকা আমরা ছোঁবো না। তার চেয়ে না খেয়ে মরবো সে-ও ভালো।

আমি বললাম, তোমরা যা ভয় করছে, তা হবে না। বাদাবী খুব সুন্দর মানুষ। আমাকে কেনার তেমন বিশেষ প্রয়োজন ছিলো না তার। শুধু তোমরা কষ্ট পাবে জেনেই সে অনুগ্রহ করে এটা করলো।

আপনজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাদাবীর সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়লাম। বাদাবী-সদার প্রথমে আমাকে বাজারে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে তাজা তাগড়াই দেখে একটা উট কিনলো আমার জন্য। তারপর সাজ-পোশাক খাবার-দাবার অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় নানারকম সামানপত্র কিনে চাপিয়ে দিলো তার পিঠে। আমি উঠে বসলাম আমার উটে আর বাদাবী তার নিজেরটায়।

তারপর যাত্রা শুরু হলো।

মরুভূমির তপ্ত বালুকারাশির মধ্য দিয়ে একটানা দশ দিন চলতে থাকলাম। সে এক দুঃ সাহসিক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। জীবনে এমন অভিজ্ঞতার স্বাদ এই প্রথম পেলাম। রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো নব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

এগার দিনের দিন আমরা এসে পৌঁছলাম এক শস্য-শ্যামল প্রান্তরে। আনন্দে নেচে ওঠে মন।

সবুজ ক্ষেত পার হয়ে এক বিস্তীর্ণ রুপালী মাঠ। মাঠের মাঝ-বরাবর একটি গ্রেনাইট পাথরের উঁচু পাহাড়ের চূড়াটা দেখে মনে হয় এক তাম্রবর্ণ বিশাল বপু যুবক শীর্ষাসন করে আছে। তার বিস্তৃত ডান হাতের মুঠোয় ধরা পাঁচটা বিরাট চাবি। প্রথম চাবিটা সোনার, দ্বিতীয়টা রূপার, তৃতীয়টা তামার, চতুর্থটা লোহার এবং পঞ্চমটা সীসের তৈরি। সবগুলোই দেখতে বড় অদ্ভুত ধরনের।

এই চাবিগুলো এক একটা নিয়তির প্রতীক। সোনাটা দুঃখের, রূপারটা কষ্টের, তামারটা মোউৎ-এর, লোহারটা যশের এবং সীসারটা সুখের এবং জ্ঞানের।

কিন্তু এতো সবের আমি কিছুই জানতাম না। এবং সেই কারণেই আমার জীবনে নেমে এসেছিলো গভীর দুঃখ বেদনা।

মিনারের পাদদেশে এসে পৌঁছলাম আমরা। বাদাবী তার উটের পিঠ থেকে নেমে পড়লো। দেখাদেখি আমিও নামতে যাচ্ছিলাম এমন সময় দেখি, বাদাবী ধনুকে তীর জুড়ে মিনার শীর্ষের সেই ঊর্ধচরণ যুবকের দিকে তাক করছে। বাঁ হাতে ধনুকটাকে বাগিয়ে ধরে তীরসুদ্ধ ছিলাটাকে বুকের কাছে টেনে এনে নিশানা করে ছুঁড়ে দিলো তীর। কিন্তু তীর ছোঁড়ার অভ্যাস বা তেমন দক্ষতা ছিলো না বলে বোধ হয় তাম্রমূর্তিকে আঘাত করতে পারলো না সে তীর। অনেকটা দূর দিয়ে চলে গেলো। আশাহত বাদাবী আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো, এবার তোমার পরীক্ষা নাও, ধর, দেখি কেমন তোমার নিশানা। ঐ চাবিগুলোকে তাক করবে।

তীর ধনুকটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো সে। ধনুকটা বড় সুন্দর। দক্ষ ভারতীয় কারিগরদের হাতে তৈরি।

প্রথম বাণেই আমি তাম্র-যুবকের হাত থেকে সোনার চাবিটা ফেলে দিলাম নিচে। ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে বাদাবীর হাতে দিতে গেলাম। কিন্তু সে নিতে চাইলো না, বললো, এটা তোমার কাছে রাখ, আমার চাই না। তুমি তো দেখছি চৌকস তীরন্দাজ—এটা তোমার দক্ষতার পুরস্কার।

সুতরাং স্বর্ণ চাবিটা আমার কোমরে গুঁজে রাখলাম। হায় তখন কী জানি সে চাবি দুঃখ-লোকের দরজা খুলে দেবে আমার জীবনে!

পরের বারে রুপার চাবিটাকে নামিয়ে আনলাম। কিন্তু বাদাবী সেটাও আমাকে দিয়ে দিলো। যথারীতি ওটাকেও ট্যাকে গুজলাম আমি। এ চাবিটা কষ্টের পাথারে ডুবিয়ে দেবে আমাকে। কিন্তু সে-কথা তখন জানবো কী করে?

পরের দুই তীরে লোহা আর সীসার চাটি দু’টো পেড়ে আনলাম। এর প্রথমটা যশখ্যাতির এবং দ্বিতীয় সুখসমৃদ্ধি ও জ্ঞান গরিমার প্রতীক। বাদাবী আনন্দে নেচে উঠে দুটোই নিজে নিয়ে নিলো। এবং আমাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুম্বন করে বললো, খোদা তোমার মঙ্গল করুন। আচ্ছা যাও, এবার তুমি মুক্ত। আর তুমি আমার বান্দা নও।

আমি তার বদান্যতায় অভিভূত হয়ে গেলাম। লোকটা কত মহৎ কত উদার। এতে পয়সা দিয়ে আমাকে কিনেছিলো, এই সামান্য কাজের বিনিময়ে সে আমাকে মুক্ত করে দিলো! কৃতজ্ঞতায় মাথা অবনত হয়ে এলো। কোমর থেকে চাবি দুটো বের করে বললাম, এ দুটো আপনার। আপনি রাখুন।

বাদাবী আমাকে আদর সোহাগ করে বললো, না, ও দু’টো আমি তোমাকে দিলাম, ভাইজান।

আরও একটা চাবি তখন মিনার-শীর্ষের তাম্ৰযুবকের হাতে ধরা আছে, সুতরাং ওটাকেও নামিয়ে আনবো এই আমার ইচ্ছা। ধনুকে তীর জুড়ে সবে নিশানা ঠিক করতে পেরেছি, আর একটু হলেই তীরটা হাত থেকে বেরিয়ে যায় আর কি, এমন সময় বাদাবী ছুটে এসে ধনুক সুদ্ধ আমার হাতটা সজোরে নামিয়ে নিম্নমুখী করে দিয়ে প্রায় ভৎসনা করেই বললো, আঃ, কি করছো! যে দুঃখ কষ্ট নিয়েছ তাই বয়ে বেড়াও—আবার ওটার দিকে নজর কেন?

তার এই অপ্রত্যাশিত উম্মায় আমি সেই মুহূর্তে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। তীরটা জ্যাতে আর ধরে রাখতে পারলাম না। কিন্তু ধনুক নিম্নমুখী ছিলো, তাই তীরখানা আমার একখানা পায়ের পাতা ভেদ করে মাটিতে গেঁথে গেলো।

সে কি রক্তারক্তি কাণ্ড। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে গেলাম আমি। বাদামী অবশ্য তীরখানা পা থেকে ছাড়িয়ে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে উটের ওপরে চাপিয়ে দিলো।

সেই শুরু হলো আমার দুর্ভাগ্যের দিন।

একটানা তিন দিন তিনরাত্রি ধরে মরুপ্রান্তর ভেঙ্গে চলেছি। পায়ের অসহ্য ব্যথায় প্রায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছি আমি। বাদাবী আমাকে মাঝে মাঝে সাহস দিয়েছে। কষ্টকে সইবার জন্য মন শক্ত করতে হয়। কিন্তু এই দুঃসহ যন্ত্রণা কী করে মুখ বুজে হজম করা সম্ভব?

খিদেয় পেট জ্বলছিলো। বাদাবী বললো, সামনেই একটা নদী পাবো। নদীর পাড়ে একটা বাগান আছে। হয়তো বরাতে থাকলে কিছু ফলটল মিলতে পারে।

অচেনা সব গাছ। ফলগুলোও সব অজানা। লাল রঙের। দেখতে বড় সুন্দর। তখন খিদেয় পেট,চো চো করছে, পায়ের ব্যথা তুচ্ছ করে প্রায় বাঁদরের মতো লাফিয়ে একটা গাছের ওপরে উঠে গেলাম। ওঃ, যত সব টুকুটুকে পাকা ফল। হাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচে ফেলতে লাগলাম। তারপর নেমে এসে একটা ফল মুখে নিয়ে সবে কামড় বসিয়েছি হঠাৎ আমার ব্রহ্মতালু ঘুরে গেলো। কে যেন আমার চোয়ালে তুরপুন বিধে দিতে থাকলো। আমি আর হাঁ করে ফলটাকে মুখ থেকে বের করে ফেলতে পারি না। চিৎকার দেব তারও উপায় নাই। গোটা ফলটা আমার মুখ অবরোধ করে আছে। হাত পা ছুঁড়ে গোঁ গোঁ করতে করতে আছড়ে পড়ে গেলাম। আমরা অবস্থা আঁচ করতে না পেরে বাদাবী কাছে ছুটে আসে। চোয়ালের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ফলটাকে বের করে ফেলে দেয়।

গাছতলায় যে ফলগুলো পড়েছিলো সেগুলো কুড়িয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে বাদাবী বুঝতে পারে, ফলগুলোর গা ছোট ছোট সোয়া পোকায় ঢাকা। আমি খিদের জ্বালায় ওসব দিকে নজর করার খেয়াল করিনি। এই বিষাক্ত পোকাগুলোর বিষ-যন্ত্রণা তিন দিনের আগে উপশম হয় না। সারা মুখ ফুলে ঢোল হয়ে যাবে।

বাদাবীর কথা শুনে যন্ত্রণা আমার আরও বেড়ে গেলো। এই বিছে কামড়ের জ্বালা তিনদিন ধরে সহ্য করতে হবে! ওরে বাবা, এর চেয়ে যে মৃত্যু অনেক ভালো ছিলো।

ধীরে ধীরে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়লো। যন্ত্রণায় আমি প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলাম সেই গাছতলায়। বাদাবী আমাকে পরিত্যাগ করেনি। সে আমার পাশেই রইলো। চারদিনের দিন সকালে অনেকটা সুস্থ বোধ করলাম। ফোলা এবং ব্যথা অনেকটা কমে এসেছে।

তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। বাদাবী বললো, যাও না, ওদিকে নদী আছে, জল খেয়ে এসো।

আমি নদীর দিকে ছুটলাম। রুপার মতো ঝকঝকে পানি। যতটা পারলাম প্রাণভরে খেয়ে ফিরে এলাম।

বাদাবী বললো, চলো যাত্রা করা যাক। খিদেয় নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে গেছে বোধ হয়। কিন্তু এখানকার কোনও ফল মুখে তোলা ঠিক হবে না। তার চেয়ে চলো, সামনে এগোই। একটা পাহাড় পাবো। তার নিচে অনেক গাছগাছালি আছে। সেখানে কিছু মিললেও মিলতে পারে।

আবার উটের পিঠে চাপলাম দু’জনে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই পেটে বেশ ব্যথা অনুভব করতে থাকলাম। যত এগোই ব্যথাটা বাড়তে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সারা পেট জুড়ে অসহ্য ব্যথায় ছটফট করতে লাগলাম। প্রাণ যায় যায়—এমন অবস্থা।

বাদাবী বললো, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তার নাম জপ কর, কমে যাবে। পাহাড়ের পাদদেশে এসে একটা সুন্দর উপবনে থামলাম আমরা। সামনে নানা জাতের নাম জানা গাছপালা। বাদাবী সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্য থেকে একটা বাঁশের কোড়া জাতীয় একটা জিনিস কেটে নিয়ে এলো। ওপরের খোসা ছাড়াতে ভেতরে বেশ শাঁসালো বস্তু দেখা গেল। বাদাবী বললো, খাও, পেটও ভরবে, তেষ্টাও যাবে!

খেয়ে দেখলাম—বেশ মিষ্টি। পেট ভরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারারাত সুখ-নিদ্রায় কাটলো।

সকালবেলায় শরীর মন বেশ ঝরঝরে বোধ হলো। বাদাবী বললো, কী, এখন বেশ ভালো লাগছে তো? আচ্ছা এবার তোমায় একটা কাজ করতে বলবো। ঐ যে পাহাড়ের চূড়াটা দেখছো ওখানে উঠে যেতে হবে। এখন সূর্য ওঠার দেরি আছে। চূড়ায় উঠে তুমি সূর্যোদয়-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। কিন্তু সাবধান আরোহণের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ো না যেন। সূর্যের লাল আভা যখন দেখতে পাবে তখন পূর্বদিকে মুখ করে নমাজ পড়তে বসবে। তারপর নমাজ শেষ হয়ে গেলে নিচে নেমে আসবে। মনে থাকবে তো?

শরীরের ওপর দিয়ে ক’দিন অনেক ধকল গেছে, তবু বাদাবী আমার পরম হিতৈষী, তার কথা ঠেলতে পারলাম না। পায়ে তখনও বেশ ব্যথা ছিলো, তা সত্ত্বেও কোনও রকমে ওপরে উঠে গেলাম।

পাহাড়ের উপরিভাগ একেবারে ন্যাড়া। কোথাও আড়াল করে দাঁড়াবার উপায় নাই। অথচ প্রচণ্ড দমকা হাওয়ার দাপট ক্ষণেক্ষণেই আমাকে টালমাটাল করে ফেলছিলো। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না, হাওয়ার অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সেই উন্মুক্ত পর্বতশিখরে সটান শুয়ে পড়লাম আমি। দেহ অবসাদগ্রস্ত ছিলো, স্বভাবতই সঙ্গে সঙ্গে ঘুম জড়িয়ে ধরলো আমার চোখে।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো তাকিয়ে দেখলাম,সূর্য সবে উঠেছে। আমি দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য, কে যেন আমার পা দুখানা জোর করে চেপে ধরে রেখেছে, কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারলাম না। শুধু তাই নয়, লক্ষ্য করলাম, আমার ঠ্যাং দু’খানা ফুলে কলা গাছের মতো হয়ে গেছে। পেটের দশাও তাই। মনে হচ্ছিল আমার পেটের মধ্যে কে যেন একটা আধমণি তরমুজ পুরে দিয়েছে। ফুলে ফেঁপে ঢবঢব করছে। ঘাড় কাঁধ কেমন যেন সিটকে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। এদিক-ওদিক নড়াতে-চড়াতে পারছিলাম না।

এতৎসত্ত্বেও আমি বুকে বল সঞ্চয় করে অমানুষিক কায়দা কসরত করতে করতে এক সময় উঠে দাঁড়াতে পারলাম। আমার কেবলই আশঙ্কা হচ্ছিল, সময় মতো নামতে না পারলে বাদাবী হয়তো বা আমাকে ছেড়েই চলে যাবে।

ঐ অবস্থাতেও পূবদিকে মুখ ফিরিয়ে নমাজ সারলাম। অবাক হলাম আমার নমাজ শেষ হতে না হতেই সারা আকাশ ঘন তমসায় আবৃত হয়ে গেলো।

আমি আর অপেক্ষা না করে পাহাড়ের ধাপে ধাপে পা রেখে অতি সন্তর্পণে নিচে নামতে থাকলাম। পা দু’খানা দানবের মতো বিশাল দশমনি ওজনের বলে মনে হচ্ছিল। নিজের পা নিজেই টেনে ওঠাতে পারি না—এমনি আমার অবস্থা।

এভাবে ভারসাম্য রেখে কতক্ষণ আর ঠিক থাকা যায়, একবার একটু বেকায়দায় পা পড়তেই হড়কে গেলাম। ব্যস, তারপর গড়াতে গড়াতে পপাত ধরণীতলে। বলা বাহুল্য আমার কোনও চৈতন্য ছিলো না তখন। দেহের পোশাক-আশাক ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে উড়ে গেছে। সারা অঙ্গে সহস্র ক্ষতে রক্তাক্ত। কী করে যে প্রাণে বাঁচলাম, তা আমার জীবনদাতা বাদাবী মালিকই জানে, আমি বলতে পারবো না।

কয়েকদিন পরে বাদাবীর পরিচর্যায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলাম। সে আমাকে ভরসার বাণী শোনাতে লাগলো।

-অনেকবরাত করে এসেছ, ভাই, তা না হলে ঐ রকম পাহাড়ের চূড়া থেকে গড়িয়ে পড়ার পর কেউ বাঁচতে পারে না। যাক, ফঁড়া ছিলো কেটে গেছে, এবার তোমার ভাগ্যের চাকা অন্যপথে ঘুরবে আল্লাহকে ডাকো, তার ওপর ভরসা রাখো। বুকে সাহস আনন। এরপর আমাদের একনতুন সন্ধানে পা বাড়াতে হবে। জীবনের অনেকগুলো বছর আমি তার অনুসন্ধানে দেশ দেশান্তর ঘুরে বেড়াচ্ছি। মনে হচ্ছে, এবার তার পথের নিশানা আমি পেয়ে গেছি। খোদা হাফেজ, চলো তার নাম করে ঝাপিয়ে পড়ি, বরাত যখন খুলেছে, আল্লাহ নিশ্চয় পাইয়ে দেবেনই।

এরপর কোমর থেকে তরবারী বের করে সামনে পুঁতে দিয়ে সে বললো, এই—এইখানে খুঁড়তে হবে। এখানেই পাওয়া যাবে সেই গুপ্তধনের সন্ধান। এসো, এসো, আর দেরি করো না ভাইজান, হাত লাগাও। ঘায়ের ব্যথা-বেদনা সব ভুলে যাও এখন। তুমি আন্দাজ করতে পারবে না, যে বস্তুর সন্ধানে আমি হন্যে হয়ে দেশে দেশে ফিরছি, তার সন্ধান পেলে, বেহেস্ত কোন্ ছার, সুখ-সম্ভোগ আর ঐশ্বর্য-সম্ভারের সীমা পরিসীমা থাকবে না আমাদের।

কিন্তু ওর ঐ দারুণ উৎসাহ-ব্যঞ্জক কথাবার্তাতেও আমাকে বিন্দুমাত্র চাঙ্গা করতে পারলো না। দেহে শক্তি বলতে এক ফোটা কিছু নাই। সারা অঙ্গে ব্যথা, ক্ষতয় জ্বর-জ্বর। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি উঠে বসতে পর্যন্ত পারলাম না।

এবার বাদাবী বেশ রাগতভাবেই বললো, শোনো হাসান আবদাল্লা, তোমাকে যা বলছি তা শুনছো না। তার ফলে তোমাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে। আমি বলেছিলাম, সাবধান, পাহাড়ের মাথায় উঠে ঘুমিয়ে পড়ো না কখনও, সর্বনাশ হবে। আমার বারণ সত্ত্বেও তুমি সে কাজই করলে। ফলে, এখন দেখছো, এ কী দুর্ভোগে ভুগতে হচ্ছে। ঐ পাহাড়ে শয়তানের বাতাস লেগেছে তোমার হাড়ে। শরীরের সব খুন জহর করে দিয়ে গেছে সে।

বেশ ক্রোধের সঙ্গেই সে বলে গেলো কথাগুলো। কিন্তু তখন আমি দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে কাঁপছি দেখে কিছুটা শান্ত হয়ে বললো, ভেবো না, আমি তোমার ওপর খুব রেগে গেছি। আমি তোমাকে আমার সব রকম চেষ্টা দিয়ে সারিয়ে তুলবো।

এই বলে সে তার কোমর থেকে একখানা তীক্ষ্ণ ফলার ছুরি বের করে আমার সারা দেহের নানা জায়গায় ফুটিয়ে দিয়ে শরীরের বিষাক্ত পানি বের করে ফেলতে লাগলো।

এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনেক পানি বের করার পর শরীরটা কিছুটা হাল্কা বোধ হতে থাকলো। বাদাবীর কাধে ভর দিয়ে উঠে বসতে পারলাম এক সময়।

এরপর দুজনে মিলে বাদাবীর নির্দেশিত জায়গায় গর্ত খুঁড়তে লেগে গেলাম। অনেক মাটি তোলার পর গর্তটা বেশ বড় এবং গভীর হয়ে গেলো। এক সময় দেখলাম, একটা পাথরের গম্বুজ মতো কি একটা বেরিয়ে আসছে। উৎসাহ বেড়ে গেলো অনেক। শরীরের ব্যথা-বিষ আর তেমন অনুভব করতে পারলাম না তখন। ক্ষিপ্রহাতে মাটি কেটে গম্বুজটাকে পরিষ্কার করতে থাকলাম। বাদাবী গম্বুজটা দুহাতে ধরে টানাটানি করতে করতে ওপরের ঢাকনাটা খুলে বেরিয়ে এলো।

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, অসংখ্য ছোট বড় মানুষের কঙ্কাল আর তার ওপর ছাগলের চামড়ায় লেখা একখানা ঐ পাণ্ডুলিপি, যেটা আপনি এখন হাতে ধরে আছেন।

আমার মালিক ছোঁ মেরে এই চর্মপত্ৰখানা তুলে নিলো তার হাতে। উত্তেজনা, এবং কী এক অজানা শঙ্কায় ঠকঠক করে সে কাঁপছিলো তখন। যদিও পাণ্ডুলিপির ভাষাটা দুর্বোধ্য, তবু চোখের সামনে মেলে ধরে পাঠোদ্ধারের জন্য ছটফট করতে থাকলো।

অনেকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকার পর এক সময় সে জয়োল্লাসে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলে বললো, পেয়েছি—পেয়েছি আবদাল্লাহ, এতদিনের স্বপ্ন আমার সার্থক হয়েছে। সেই অমর্তলোকের নিশানা আমি খুঁজে পেয়েছি এতকাল পরে। আবদাল্লাহ, আনন্দ কর, নাচো গাও—আর কোনও ভাবনা নাই। আবার আমরা সঠিক পথ ধরে যেতে পারবো সেই স্বপ্নপুরীতে। আজ পর্যন্ত কোন মানুষ সাদ্দাতের ঐ মিনারের দেশে যেতে পারেনি। কিন্তু আমাদের যেতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হবে না। ঐ মিনারপুরীতে পৌঁছতে পারলেই আমরা সেই লাল গন্ধকের কৌটোটা উদ্ধার করে আনতে পারবো।

আমি বললাম ঐ লাল গন্ধক দিয়ে কী হবে?

—কী হবে? পাগল—তুমি কিছুই জান না। তামাম দুনিয়ার সব ধনরত্ন করায়ত্ব করার বীজমন্ত্র আছে ঐ গন্ধকে।

আমার শরীর আর চলছিলো না। তা ছাড়া পথের বিপদে আমার বড় ভয়। বললাম, আমাকে মেহেরবানী করে ছেড়ে দিন, মালিক। যদি ও আপনার সৌভাগ্যে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি, তবু বলছি ঐসব ধন-সম্পদে আমার কোনও লোভ নাই। আমি মা বৌ-বাচ্চাদের কাছে ফিরে গিয়ে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে চাই। আপনি আমাকে রেহাই দিন।

বাদাবী আমার দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকালো।

-বেচারা! এতো যে দুঃখ-কষ্ট সয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অতটা পথ এলাম সে কি শুধু আমার একার লাভের জন্য?

আমি বিনীতভাবে বলি, তা আমি জানি, মালিক। কিন্তু আমার কপালে অত ঐশ্বর্যর অত সুখ সইবে না। কারণ, আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, এক এক যাত্রায় আমাদের দুজনের দু’রকম ফল হচ্ছে। আমি যা করতে যাচ্ছি তাই আমার কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দুঃখ-যন্ত্রণার সীমা থাকছে না। কিন্তু আপনার বেলায় তো তা ঘটছে না। তাই বুঝতে পেরেছি, ওসব ঐশ্বর্য সম্পদ আমার জন্যে বরাদ্দ করে রাখেননি তিনি।

আমার এসব দুঃখ বিলাপে কর্ণপাত করলো না বাদাবী। তলোয়ারখানা বাগিয়ে ধরে সামনের ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলো এবং অনেকগুলো সেই বাঁশের কোড়া জাতীয় খাবার বস্তু সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বললো, নাও, আর দেরি নয়, ওঠ, চেপে বস।

সে তার নিজের উটে এবং আমি আমার উটে চেপে বসলাম। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে সোজা পশ্চিম দিকে চলতে থাকলাম আমরা। একটানা তিন দিন তিন রাত্রি চলার পর এক নদীর ধারে এসে পৌঁছলাম। এই নদী গলিত পারদ-প্রবাহিনী। ওপারে পার হওয়ার একটি সরু সেতু আছে। সেতুটি স্বচ্ছ স্ফটিকে নির্মিত। কিন্তু উপরিভাগ পিচ্ছিল, পা রাখামাত্র হড়কে নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

আমার মালিক কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ালো না। উট থেকে নামলো। আমাকেও নামতে বললো। বাদাবী একটা ঝোলা থেকে দু’জোড়া পশমের জুতো বের করে এক জোড়া আমাকে দিয়ে বললো, আমি যেমন করে পরছি দেখে দেখে তেমনি করে পরে নাও।

জুতো পরার পর বাদাবী আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললো, একদম আমাকে ছাড়বে না। শক্ত করে ধরে খুব সন্তর্পণে দেখে-শুনে পা ফেলবে।

আল্লাহর মর্জিতে পায়ে পায়ে পার হয়ে গেলাম সেই মরণ-সেতুটি।

কয়েক ঘণ্টা সামনের দিকে পথ চলার পর এক কৃষ্ণ উপত্যকায় এসে পৌঁছলাম আমরা।

দু’পাশে গগনচুম্বী পাহাড়, মাঝখান দিয়ে পথ। পাহাড়ের গায়ে গজিয়েছে বিশাল বিশাল পাইন বৃক্ষ। তার ছায়া-ঘন কালো কুটীল অন্ধকার নেমে এসেছে সারা পর্বতপথে। এদিক-ওদিক নজর পড়তেই আমার পীলে চমকে উঠলো। সেই সব গাছের ডালে জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর সব পাহাড়ী সাপ। ওদের হাঁ-তে গোটা একটা হাতী ঢুকে যেতে পারে। ভয়ে শিউরে উঠে আমি দৌড়ে এগিয়ে পালাতে যাই। কিন্তু পালিয়ে যাবো কোথায়? পাহাড়ের পথ আর ফুরায় না। এবং সারা পথব্যাপীই এই একই ভয়াবহ দৃশ্য।

আমি চোখ ঢেকে পথের ওপরে বসে পড়লাম। কান্নায় কণ্ঠ ঝুঁজে এলো, ইয়া আল্লাহ, এ কোথায় দোজকের দরজায় নিয়ে এলে তুমি! এর চেয়ে অনাহারে প্রাণত্যাগ করাও যে ভালো ছিলো আমার।

বাদাবীর পা দুখানা জড়িয়ে ধরে কাতর কাকুতি করে বললাম, আপনি আমার বিবি বাচ্চাদের জানে বাঁচিয়েছেন। সে কৃতজ্ঞতা কখনও ভোলার নয়। কিন্তু একি করলেন আপনি? এমন ভয়ঙ্কর দেশে কেন নিয়ে এলেন আমাকে? এর চেয়ে এক কোপে কাল্লাটা কেটে নামিয়ে দিলে তো পারতেন মালিক? হায় আল্লাহ, কেন আপনার কাছ থেকে অনুগ্রহ নিতে গিয়েছিলাম আমি? না হয় খেয়ে না খেয়ে কোনও রকমে দারিদ্র্য-যন্ত্রণাতেই দিন কাটাতাম। তবু তো আপন জনের কাছে আপন দেশেই মরতে পারতাম! কেন আপনি আমাকে সুখের লোভ দেখালেন?

বাদামী একটু তীক্ষ কণ্ঠে আমাকে থামিয়ে দিলো, আঃ থাম। ধৈর্য ধর, বুকে সাহস সঞ্চয় কর নওজোয়ান। তুমি না পুরুষমানুষ! ভয় নাই, কেউ তোমাকে সংহার করতে পারবে না। আমরা আবার কাইরো ফিরে যাবোই। এই প্রত্যয় মনে থাকা চাই। কেউ আমাদের অনিষ্ট করতে পারবে। আর যখন আমরা দেশে ফিরবো তখন আর আমাদের কোনও দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা কিছু থাকবে। বদলে পাবো অতুল ঐশ্বর্য সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিলাস।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো বিরানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

এই বলে বাদাবী মালিক আমার পাশে বসে পড়ে সেই চর্মপত্রখানা বের করে নিবিষ্ট মনে নিরীক্ষণ করতে থাকলো। তার একাগ্রতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আশেপাশে ঐ সর্পভয় তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি। মনে হলো, সে যেন তার নিজ গৃহের নিভৃত শয়নকক্ষে নিঃশঙ্ক চিত্তে বসে রয়েছে। আমি কিন্তু ভয়ে মরি।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাণ্ডুলিপি পাঠ করার পর বাদাবী মুখ তুলে বললো। হাসান আবদাল্লা ঝটপট এই জায়গাটা থেকে সরে পড়তে চাও?

-আলবাৎ—একশোবার চাই। আপনি বিশ্বাস করুন, মালিক, অর্থ বা সুখে আমার প্রয়োজন নাই। আমাকে দুঃখ তাপের মধ্যেও আমি আমার বাচ্চা বৌ-এর সঙ্গে দিন কাটাতে চাই। আপনি আমাকে কষ্ট দেবেন না মালিক। আপনি যদি বলেন, আমি আগাগোড়া কোরাণ কণ্ঠস্থ আওড়াতে পারি আপনার কাছে। আপনি যদি হুকুম করেন, আল্লাহর সব পবিত্র বাণী আপনাকে শোনাতে পারি এখনি। যদি বলেন, আপনার পূণ্যার্থে দশ বছর ধরে মক্কা মদিনাতে মোনাজাত করতে পারি আমি। এ ছাড়াও আপনি আরও যা যা ফরমাশ করবেন সবই আমি হাসিমুখে তামিল করে যাবো, কিন্তু একবার আমাকে দেশে ফিরে যাবার অনুমতি দিন।

বাদাবী আমার দিকে স্নেহকোমল দৃষ্টিতে তাকালো একবার।

-না হাসান আবদাল্লাহ, অত বড় বড় কঠিন কাজ তোমাকে করতে হবে না আমার জন্য। এর পরের পথটুকু অত্যন্ত সুগম। কিন্তু তার আগে আর একটি কাজ করত হবে তোমাকে।

আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, কী কাজ?

বাদাবী তীর-ধনুকটা এগিয়ে দিয়ে বলে, সামনে এগোলে অনেক সাপের মধ্যে একটা বিরাট বড় কৃষ্ণফণার সাপ দেখতে পাবে। ঐ সাপটাকে তীর-বিদ্ধ করে মারতে তোমার মতো বিচক্ষণ তীরন্দাজের এমন কিছুই বেগ পেতে হবে না! সাপটাকে মেরে তার কাল্লা আর কলিজা কেটে নিয়ে আসবে আমার কাছে। ব্যস, এরপর আর তোমার কোনও কাজ নাই।

ইয়া আল্লাহ। এই কী একটা সোজা কাজের বায়না হলো। না না, আমি পারবো না, কিছুতেই পারবো না ঐ বিষধর কালনাগিনী মারতে। কেন, অতই যদি সহজ মনে করেন, নিজে মেরে আনুন না? আমি মরে গেলেও পারবো না।

বাদাবী আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, হাসান আবদাল্লাহ সব কথা কী ভুলে গেলে ভাই? মনে করে দেখ, তোমার বৌ ছেলের মুখে যে খানা জুটছে তা কী জন্য?

আমি কেঁচোর মতো কুঁকড়ে গেলাম। কান্নায় ভরে এলো দু’চোখে জল। তীর-ধনুকটা নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।

অতি সহজেই দেখা মিললো সেই কালনাগিনীর। তার বিশাল উদ্যত ফণা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লাম। একটা ড্রাগনের মতো দাপাদাপি করতে করতে একটু পরে সে নেতিয়ে পড়ে গেলো। কোমর থেকে ছোরা বের করে ওর কান্না আর পেট চিরে কলিজাটা কেটে এনে বাদাবীর সামনে রেখে বললাম, এই নিন।

বাদাবী খুব তারিফ করলো আমার কাজের। বললে, তুমি ছাড়া এ কাজ আর কে করতে পারতো এতো সহজে? আচ্ছা এবার একটু আগুন জ্বালাবার বন্দোবস্ত করে দাও।

আশপাশ থেকে গাছের ডালপালা কুড়িয়ে এনে পালা দিলাম। বাদাবী একখণ্ড হীরে বের করে সূর্যকিরণে মেলে ধরতে কিছুক্ষণের মধ্যে শুকনো ডালপাতায় আগুন জ্বলে উঠলো। তখন সে ঝুলি থেকে একটি ছোট্ট লোহার হাঁড়ি এবং পলার পাথরের সরু একটা চোঙ্গা বের করে বললো, এই যে পলার চোঙ্গাটা দেখছো আবদাল্লা, জান, এর মধ্যে কী আছে।

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, কী করে জানবো, আপনি তো বলেননি কখনও।

বাদাবী বললো, এর মধ্যে ফিনিক্স পক্ষীর খুন আছে।

চোঙ্গার মুখের ছিপিটা খুলে লোহার হাঁড়িটার মধ্যে রক্তটুকু ঢেলে দিলো সে। তারপর গনগনে আগুনের উপর বসিয়ে দিলো হাঁড়িটাকে। এরপর সেই সাপের কাল্লা আর কলিজা দুটোও ছেড়ে দিলো হাঁড়িটার মধ্যে। তারপর আপনার হাতের এই চর্মপত্ৰখানা মেলে ধরে সে বিড় বিড় করে কি যেন আওড়াতে থাকলো।

একটুক্ষণ পরে হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমাকে বললো, আমার ঘাড়ে কাঁধে খুব ভালো করে এই হাড়ির পাঁচনটা মালিশ করে দাও তো।

মালিশ করতে করতে আমি লক্ষ্য করলাম ওর কাধের মাংসল জায়গা দুটো আস্তে আস্তে থলথলে নরম হয়ে আসছে। এরপর দেখা গেলো দু’পাশ থেকে দু’খানা ডানা বেরিয়ে পড়ছে। ক্রমশঃ ডানা দু’খানা বেশ বড়সড় হয়ে গেলো একেবারে ঈগল পাখীর মতো।

এবার বাদাবী পাখা দু’খানা আস্তে আস্তে নাড়তে নাড়তে ওপরে ওড়ার চেষ্টা করতে থাকে। আমি দেখলাম বাদাবী আকাশে উড়বে উড়বে তাক করছে। ওর কামিজের খুট খুব শক্ত করে চেপে ধরে রইলাম। বাদাবী ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পলকের মধ্যে শূন্যলোকে উঠে গিয়ে বায়ুবেগে আকাশপথে উড়ে চললো। আমিও চললাম ঝুলতে ঝুলতে।

জানি না, জাঁহাপনা, ঐ ভাবে কতক্ষণ আমরা আকাশপথে উড়ে চলেছিলাম। তবে এক সময় বুঝতে পারলাম, সেই কৃষ্ণ পর্বতমালা পিছনে ফেলে আমরা এক বিশাল বিস্তৃত সুবর্ণ প্রান্তর-শীর্ষে এসে গেছি। এই মাঠের চারপাশটা স্বচ্ছ নীল রঙের স্ফটিকের দেওয়ালে ঘেরা। মাঠের বালুকারাশি সুবর্ণধূলী। আর ছোটো ছোট নুড়িগুলো সব নানা রকমের হীরে জহরৎ।

এই প্রান্তরের ঠিক মাঝখানে বাগান ঘেরা এক প্রাসাদ-নগরী। চারপাশে অজস্র সারি সারি মিনার।

বাদাবী বললো, এই সেই মিনার দেশ—সাদ্দাতের শহর। পাখা দু’খানা ঈষৎ গুটিয়ে নিতেই শোঁ শোঁ করে নিচের দিকে নামতে থাকলাম আমরা।

ধীরে ধীরে ডানা দুটো গুটাতে গুটাতে এক সময় শরীরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো, এবং তখুনি আমরা নিচে নেমে পড়লাম।

প্রাসাদ-নগরীর চারপাশ সোনার দেওয়ালে ঘেরা। প্রবেশদ্বার একটাই। পরপর সাতটা ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলাম আমরা।

ভিতরে একটা বিরাট ফুলবাগিচা। দুইপাশে দুই ফোয়ারা। অবিরল ধারায় পানি ঝরছে। মাঝখানে একটি মঞ্চ। সেই মঞ্চের উপরে একটি সোনার মসনদ। কিন্তু সে মসনদে কোন সুলতান বাদশাহ নেই কেউ। আছে শুধু একটি ছোট সোনার কৌটো—যেটা এখন আপনার হাতে আছে, জাঁহাপনা।

বাদাবী কৌটোটা তুলে নিয়ে খুললো। ভিতরে লাল রঙের খানিকটা গুঁড়ো।

সে চিৎকার করে উঠলো, দেখ দেখ, হাসান আবদাল্লাহ, এই সেই লাল গন্ধক—কি না।

আমি বললাম, কী একটা বাজে জিনিস নিয়ে অমন হৈ হৈ করছেন, মালিক। ওসব ফেলে দিয়ে এদিকে দেখুন, কত বড় বড় সব হীরে জহরত। এগুলো বরং পুটলি বেঁধে নিই, আসুন।

আমি তো বাবা, যতটা পেরেছি পকেট ভর্তি করে নিয়েছি।

বাদাবী বলে, আরে, ওসব তুচ্ছ, ওসব রাখ। এই এক বিন্দু গুঁড়োতে ওরকম হাজার হাজার হীরে জহরত বানানো যাবে। আর, সাবধান এখানকার কোনও মণিমুক্তো সঙ্গে নেবার চেষ্টা। করো না। তাহলে বাইরে পা দেবার আগেই নির্ঘাৎ মৃত্যু হবে তোমার।

তাড়াতাড়ি সে ছুটে এসে আমার পকেট থেকে সব হীরে জহরতগুলো বের করে ফেলে দিলো। কোমর-টোমর ভালো করে লাশ করে দেখে নিলো। তারপর বললো চলো, আমাদের কাজ খতম। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না আমরা।

হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে সাতটা ফটক পার হয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। কিন্তু এ কি! সামনে বিশাল বিস্তীর্ণ স্বর্ণ-প্রান্তর এবং অসংখ্য মিনার দেখে গিয়েছিলাম—সে সব কোথায় উধাও হয়ে গেলো? তাকিয়ে দেখলাম, সেই পারদনদীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা।

সেই স্ফটিক-সেতু পার হলাম দু’জনে। আমাদের উট দুটো যেন আমাদের জন্যেই পথ চেয়ে দাঁড়িয়েছিলো। দুটির পিঠে দু’জনে চেপে বসলাম। বাদাবী বললো, ব্যস, আর কোথাও নয়, সোজা মিশরে যাবো আমরা।

দুহাত তুলে আল্লাহকে সালাম জানালাম।

আমার কোমরে তখনও সেই চাবী দুটি গোঁজা ছিলো, জানতাম না ওরাই আমাকে দুর্ভাগ্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বার বার।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো তিরানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

অনেক দুঃখ দুর্বিপাক কাটিয়ে রুগ্নদেহে অবসন্ন মনে অবশেষে একদিন কাইররা এসে পৌঁছলাম। মনে আশার আলো ফুটলো। কতকাল পরে আবার আমার আপনজনের সঙ্গে মিলিত হবো।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। ঘরে ফিরে কোনও জনপ্রাণীর সাড়া না পেয়ে শঙ্কিত হলাম। পড়শিরা জানালো, আমি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই এক মহামারি রোগে পরিবারের সকলেই ইন্তেকাল করেছে।

আমি শোকে দুঃখে ভেঙ্গে পড়লাম। হায় হায়, একি আমার ভাগ্য! যাদের মুখে অন্ন জোগাবার জন্য এতো দুঃখ কষ্ট সহ্য করলাম তারাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো?

বাদাবী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, দেখ, চিরকাল কেউ বেঁচে থাকতে আসেনি এ সংসারে। সবাইকেই একদিন তার চরণে আশ্রয় নিতে হবে। কেউ দুদিন আগে কেউ দুদিন পরে যাবে তার কাছে। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আবার আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। সুতরাং এ নিয়ে শোক করতে নাই। যে আগে যেতে পারে, সেই বেশি ভাগ্যবান।

বাদাবী আমাকে হাতে ধরে অন্যত্র নিয়ে গেলো।

নীলনদের তীরে এক প্রাসোদোপম মনোহর ইমারত কেনা হলো একটি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকলো বাদাবী। আমার মনের দুঃখ লাঘব করার জন্য বাদাবী তার সম্পদের অর্ধেক আমাকে বাটোয়ারা করে দিলো। এবং কীভাবে ঐ গন্ধক গুঁড়োর সাহায্যে সীসাকে সোনায় রূপান্তরিত করা যায় তার কৌশল শিখিয়ে দিলো। সে প্রায় রোজই মণ মণ সীসা নিয়ে এসে সোনা করে তার অর্ধেক আমাকে ভাগ করে দিতে লাগলো। সে ভেবেছিলো, এইভাবে ধনসম্পদের মোহে আমি প্রিয়জন বিয়োগ-ব্যথা ভুলে আবার হাসি-গানে মেতে উঠবো। কিন্তু আমি তা পারলাম না। অর্থ আমাকে শোক তাপ ভুলাতে পারলো না।

আমার মালিক বাদাবী বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বিলিয়ে দিলো নিজেকে। প্রতিদিন নানারকম বাদশাহী খানা-পিনা নাচ-গান আমোদ-প্রমোদের সমারোহ চলতে থাকলো। বাঁদীহাটের

পরমাসুন্দরী বাঁদীতে ভরে উঠলো সারা প্রাসাদ। তাদের নূপুর নিক্কণে অনুরণিত হতে লাগলো প্রাসাদের প্রতিটি মহল। স্বভাবতই ইয়ার-বক্সীদের ঘাটতি ছিলো না। অনেক রথী-মহারথী আমির শাহজাদারাও মাইফেল করতে আসতে লাগলো নিয়মিত।

বাদাবী বড় দিলদরিয়া মানুষ। দান-ধ্যানে মুক্ত হস্ত। কেউ যদি কোনও সুন্দরী বাঁদীর গান বা নাচে মুগ্ধ হয়ে তারিফ করতো সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে তার হাতে তুলে দিয়ে বলতো, যদি মেহেরবানী করে আমার এই সামান্য দান গ্রহণ করেন, ধন্য হবো।

আমি কিন্তু ওর ঐ জলসা-ঘরে যাইনি কখনও। শোকের পাথরে আমি কুল খুঁজে পাই না, নিভৃতে নিজের ঘরে বসে বসে আত্মবিলাপ করে দিন কাটাই।

একদিন সে আমার ঘরে এলো। সঙ্গে একটি পরমাসুন্দরী লাজুক তরুণী। বাদাবী সুরার মৌজে মশগুল হয়েছিলো। খুশীর বন্যায় সে ভাসছিলো। আমার খুব কাছে এসে সে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। মেয়েটিকে টেনে নিয়ে বসালো তার উরুর ওপর। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, হাসান আবদাল্লাহ, তুমি তো আমাকে কখনও গান গাইতে শাননি, না? আজ আমি তোমাকে গান শোনাবো একটা।

আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সে উদাত্তকণ্ঠে গাইতে শুরু করলো :

আজ রাতে সুরার নেশায় মাতাল আমি
তুমিও বন্ধু সঙ্গী হতে পারতে
কমলানেবুর, গাছগুলো আকাশের সব বাতাস
কী পান করে নিঃশেষ করে ফেলেছে?
আমাকে আর এক পেয়ালা পূর্ণ করে দেবে, বন্ধু?
আমার হৃদয়ে তুফান উঠেছে
দেখ দেখ, কত গোলাপের কুঁড়ি লুটিয়ে পড়েছে পায়ে!
যদিও তোমরা সবাই উলঙ্গ—সুন্দর
তবু ঐ যে এক ফালি ঈদের চাঁদ
তার তুলনা কোথায়?

গান শেষ করে বৃদ্ধ বাদাবী মেয়েটিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আমার শয্যার একপাশে শুয়ে পড়লো। আমি ভাবলাম এবার সে ঘুমিয়ে পড়তে চায়।

কিন্তু মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো। তার চোখেমুখে সে কি নিদারুণ আতঙ্ক!

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, কী? কী হলো? উঠে পড়ছো কেন?

মেয়েটির ইশারাতে বুঝতে পারলাম, আমার এতদিনের সঙ্গী মালিক বাদাবী বন্ধু চিরকালের মতো বিদায় নিয়েছে।

প্রাণপাখী দেহ ছেড়ে উড়ে গেছে, কিন্তু বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মিষ্টিমধুর একটু নরম হাসি তখনও লেগে রয়েছে ওর অধরে।

নিজের হাতে আতর-জলে ওর দেহখানা ধুইয়ে দিলাম আমি। শেষকৃত্যের সমারোহে কোনও ত্রুটি রাখিনি। একটি কর্মবীর সুখ-সমৃদ্ধ জীবনের অবসান হয়ে গেলো।

অনেক দান ধ্যান করলাম। হাজার হাজার ধনী দরিদ্র মানুষকে পরমাদরে আপ্যায়ন করে খাওয়ালাম। এইভাবে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ছিলো আমার মনিবের প্রতি শেষ কর্তব্য করলাম আমি।

মনিবের সব সম্পত্তির তখন আমি একমাত্র উত্তরাধিকারী। আপনার হাতের এই ছোট সোনার বাক্সটা খুলে দেখলাম। লাল গন্ধকের গুঁড়োয় ভর্তি ছিলো কৌটোটা। কিন্তু দু’হাতে অঢেল খরচ। করতে করতে তার অনেকখানিই শেষ হয়ে গেছে। বাকী যেটুকু ছিলো তা এখনও তেমনি আছে ঐ বাক্সে। আমি কিছু খরচ করিনি। কোনও প্রয়োজনই হয়নি। কারণ অর্থে আমার লোভ বা প্রয়োজন ছিলো না তখন। যাই হোক, এখন যেটুকু গন্ধকগুড়ো কৌটোটায় আছে তা আপনার সলতানিয়তের তামাম ঐশ্বর্যের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান, জাঁহাপনা। সেই প্রথম আমি চর্মপত্রটি মেলে ধরলাম। বাদাবী আমাকে পাণ্ডুলিপি পাঠ করার বিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছিলো। তাই পড়তে কোন অসুবিধা হলো না। পাণ্ডুলিপি পাঠ করে বুঝতে পারলাম আমি এতকাল ধরে সোনা আর রুপোর যে চাবি দুটো অতি সযত্নে কোমর খুঁজে রেখেছি তাই আমার যত দুর্ভাগ্যের একমাত্র কারণ। সঙ্গে সঙ্গে চাবি দুটোকে বের করে আগুনে পুড়িয়ে দিলাম।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো চুরানব্বইতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

চাবি দুটো যখন আগুনে পুড়ছে ঠিক তখনই খলিফার পেয়াদা এসে দরজায় কড়া নাড়লো। দরজা খুলতেই তারা আমাকে হাতকড়া দিয়ে ধরে নিয়ে গেলো সুলতানের সামনে।

সুলতান থাইলুন, আপনার পিতা, ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, আমি খবর পেয়েছি নকল সোনার কারবার চালাচ্ছো তুমি। এক্ষুণি আমার সামনে সব কায়দাকানুন খুলে বলো, না হলে কঠোর সাজা পেতে হবে।

আমি বলতে অস্বীকার করায় তিনি আমাকে বেদম প্রহার করালেন। কিন্তু আমি মুখ খুললাম না। তখন তিনি আমার হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে অন্ধকার কারাগারে কম ন নিক্ষেপ করলেন। তন্ন তন্ন করে এই কৌটোটা হস্তগত করে আমার প্রাসাদটা ধুলোয় গুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করলেন না তিনি।

কয়েদখানায় ছুঁড়ে দিয়েও ক্ষান্ত হলেন না তিনি। প্রতিদিন নিয়ম করে আমার ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাতে থাকলেন। তাঁর আশা ছিলো, অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন না একদিন আমি ঐ গুপ্ত রহস্য বলতে বাধ্য। হবো। কিন্তু তাঁর সে আশা পূর্ণ হয়নি। কারণ আমার জেদ ছিলো, অন্যায় জুলুমের কাছে মাথা হেট করবো না আমি।

কিন্তু আজ চল্লিশ বছর পরে আমি এক অন্য মানুষ হয়ে গেছি। আজ আমার কোনও অহঙ্কারই নাই, জেদ নাই, লোভ মোহ উচ্চাশা কিছুই নাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর পদাশ্রয়। তিনিই একমাত্র ভরসা। কী হবে আমার ঐশ্বর্যে, তাই আপনাকে আমি এই কৌটোর সব রহস্য অকপটে খুলে বলে দিলাম। আপনি সুলতান, আপনার অর্থের প্রয়োজন আছে। ওটা গ্রহণ করে আমাকে ভারমুক্ত করুন, জাঁহাপনা!

 

সুলতান মহম্মদ তখত থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ হাসান আবদাল্লাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

-খোদা হাফেজ, আপনার মতো সদাশয় মানুষ এতো শাস্তি কেন ভোগ করলো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এই বিধাতার বিচার?

এরপর সুলতান মহম্মদ হাসান আবদাল্লাকে তার দরবারের প্রধান উজিরের পদে বহাল করে তার সুচিন্তিত পরামর্শ নিয়ে বহুকাল সভাবে হুকুমত পরিচালনা করেছিলো।

ঐ গন্ধক গুডোর সাহায্যে শত শত মণ সীসা সোনায় পরিণত করেছিলো সুলতান। কিন্তু নিজের ভোগের জন্য সে সোনার একটা কণা কখনও ব্যবহার করেনি। তাবৎ মূল্যে বিশাল এক মসজিদ বানিয়েছিলো সে। আজও মিশরের সেই সেরা মসজিদ সুলতান মহম্মদ ইবন থাইলুনের মসজিদ নামে জগদ্বিখ্যাত। শোনা যায় মসজিদটি বানাতে সাতহাজার মানুষের সাত বছর লেগেছিলো। আর অর্থ ব্যয় হয়েছিলো-সাড়ে সতের হাজার মণ স্বর্ণমুদ্রা।

গল্প শেষ করে শাহরাজাদ থামলো। সুলতান শারিয়ার বললো, বুঝলাম বিধিলিপি কেউ খণ্ডন করতে পারে না। তোমার কিত্সাটা শুনে মনটা বড় দুঃখে কাতর হয়ে গেলো, শাহরাজাদ।

শাহরাজাদ জানতে চায়, কার কিসসা শোনাবে, শাহরাজাদ বলে সুলতানের বয়স্য মজিদ অল দিন আবু তাহির মহম্মদের হাস্য-মধুর একটি কাহিনী শুনুন, জাঁহাপনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *