3 of 4

৪.৩৮ অল মালিক বাইবারসের দরবারে – দ্বাদশ সর্দারের কাহিনী

শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :

এক সময়ে মিশরের কাইরো শহরে তুরস্কের এক স্বনামধন্য সুলতান অল মালিক অল জাহির রুক অল-দিন বাইবারস অল বুন্দুকদারি শাসন করতেন। তার শাসন সময়ে ইসলাম আপন মহিমায় দিগন্ত উদ্ভাসিত করে ফেলেছে। পূর্ব পশ্চিম যে দিকেই যাও না কেন, ইসলামধর্মী ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব ছিলো না তখন।

সুলতান বাইবারস নিজে যেমন প্রজাদের মঙ্গল কামনা করতেন, প্রজারাও তেমনি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। প্রজারা কীভাবে দিন গুজরান করে তা তিনি নজর রাখতেন সর্বদা।

সুলতানের যে ক’জন সিপাই-সর্দার ছিলো তারা সকলেই তার একান্ত অনুগত এবং বিশ্বস্ত। তাদের মারফতেই তিনি প্রজাদের সুখ দুঃখের সংবাদ সংগ্রহ করতেন নিত্য। সারাদিন কাজের শেষে সুলতান সমীপে হাজির হতেন তারা। সুলতান ওদের নিয়ে গল্পের মজলিস বসাতেন। এক একদিন এক একজন সিপাইসর্দার তার অভিজ্ঞতার কাহিনী বর্ণনা করতো। আজ সেইসব কাহিনীই এখানে শোনাবো জাঁহাপনাকে।

শাহরাজাদ বলতে থাকে, সুলতানের সামনে মুইন অল দিন নামে তার অন্যতম এক সর্দার তার অভিজ্ঞতার কাহিনী বলতে শুরু করলো :

 

প্রথম সর্দারের কাহিনী

আমি যখন প্রথম কাইরোয় এসে সিপাই দলে ভর্তি হই তখন আমাদের সর্দার ছিলেন আলম অল দিন মঞ্জার। তার আগেই অবশ্য আমি বেশ নাম কিনেছিলাম এই কাজে।

শহরের যত সব চোর ছাচোড়, মেয়েমানুষের দালাল, লোচ্চা, বদমাইশ, ইতর, বেল্লিকরা আমার নাম শুনলে ঠকঠক করে কাপতো। আমি যখন ঘোড়া ছুটিয়ে শহরের পথে চলি তখন ভয়ে কুঁকড়ে গর্তে ঢুকে যেত যতসব চোর, বদমাইশ, বেতমিজরা। আড়াল থেকে তারা আমাকে উকি দিয়ে দেখতো আর তাদের সঙ্গীদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতো, ঐ দ্যাখ সাক্ষাৎ যম যাচ্ছে।

আমি কিন্তু কোনদিকে ভ্রক্ষেপ করি না। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধুলো উড়িয়ে প্রবল প্রতাপে শহর পরিক্রমা করে বেড়াই।

একদিন আমি আমার কোতোয়ালীতে একটা আরাম-কেদারায় বিশ্রাম করছি, এমন সময় হঠাৎ আমার কোলের ওপর এসে পড়লো একটা ভোড়া। খুলে দেখি শ’খানেক দিরহাম মাত্র। হঠাৎ কী করে আমার কোলে এসে পড়লো ওটা আন্দাজ করতে না পেরে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুব তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করতে লাগলাম। কিন্তু ধারে কাছে তেমন কাউকেই নজরে পড়লো না! কেমন খটকা লাগলো, তবে কি এটা আল্লাহর পাঠানো ইনাম! আমার সুকর্মের পুরস্কার!

পরদিন সকালে কাজ কাম সেরে আবার আমি বিশ্রাম করতে বসেছি আরাম কেদারাটায়, আবার একটা তোড়া এসে পড়লো আমার কাঁধের ওপর। খুলে দেখে অবাক হলাম। একই ব্যাপার, প্রায় শ’খানেক দিরহাম। এদিক ওদিক ভালো করে দেখলাম, না, কোথাও কেউ নাই তার কাছে।

আমি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, আমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খোয়াব দেখছি? কিন্তু না, আমি তো ঘুমিয়ে নেই? তবে? একি তাজ্জব ব্যাপার?

যাই হোক, ভিতরে তোলপাড় হতে থাকলেও বাইরে সে ভাব চেপে যেন কিছুই ঘটেনি এমন সহজ মেজাজে সামনের আঙ্গিনায় আমি পায়চারী করতে থাকলাম।

কিন্তু পরদিন সকালে কাজ সেরে আমি খুব সজাগ হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দেখি সে দিনও সে ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি হয় কিনা।

আমার শ্যেন দৃষ্টির বাণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উপায় নাই কারো। আজ যদি আসে সে নির্ঘাৎ তাকে ধরবো।

এই সব ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। প্রচণ্ড পরিশ্রমের ক্লান্তিতেই বোধ হয় কিছুটা তন্দ্রা এসেছিলো।

হঠাৎ অনুভব করতে পারলাম, কুসুম-পেলব কোমল একখানি হাত যেন আমার নাভিকুণ্ডলীর চারপাশে কি যেন সন্ধান করে বেড়াচ্ছে।

চোখ মেলে দেখলাম, নানা রত্নাভরণ-ভূষিতা সালঙ্কারা পরম রূপবতী এক কিশোরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে লাস্য হেনে হাসছে।

আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কে তুমি সুন্দরী? কোন্ বাগানের বুলবুলি?

আমার সোহাগ সম্বোধনে কিছুমাত্র লজ্জা পেলো না সে। মুখে কোনও কথা বললো না, ইশারায় জানালো, ওঠ, চলো আমার সঙ্গে।

আমি কেমন ঘাবড়ে গেলাম, কে তুমি?

সে সপ্রতিভ ভাবে বললো, আমি কে যদি জানতে চাও তবে আমার সঙ্গে চলো, মুইন।

আমি আর দ্বিধা না করে তৎক্ষণাৎ উঠে ওকে অনুসরণ করে চলতে থাকলাম। এমন সহজ নিঃশঙ্কভাবে তার পিছনে পিছনে আমি চলছিলাম যে, যে কেউ দেখলে ভাবতে পারতো সে যেন আমার কত কালের চেনা আপনজন।

চলতে চলতে এক সময় আমরা একটা অন্ধ গলির শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। মেয়েটি আমাকে বললো, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে মুইন।

আমি গদগদ হয়ে বললাম, বান্দা প্রস্তুত মালকিন, বলো কী করতে হবে?

মেয়েটি বললে, এই শহরের কাজীর মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব। একদণ্ড না দেখলে আমি থাকতে পারি না। আমরা দুজনে একসঙ্গে গল্প করি, খেলা করি, খাই, বেড়াই এবং এক বিছানাতেই রাত কাটাই। ও আমার চোখের মণি, বুকের কলিজা, ওকে ছাড়া আমি জানে বাঁচবো

না! ওকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাবো। আমরা দুজনে দুজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, জীবনে কোনও পুরুষকে শাদী করবো না আমরা।

এইভাবে আমাদের অনেকদিন কেটেছে। কিন্তু কাজী সাহেব আমাদের এই মাখামাখি সুনজরে দেখতে পারলেন না। প্রথমে তিনি তার কন্যাকে নিষেধ করলেন আমার সঙ্গে মেলামেশা করতে। কিন্তু তাতেও যখন ফল হলো না, তখন তিনি ঘরে তালা দিয়ে রেখে। দিলেন তাকে। আমাকে শাসালেন তিনি, ফের যদি তার দরজা মাড়াই, মেরে ঠ্যাং  খোঁড়া করে দেবেন আমার। সেই থেকে আমার ভালোবাসাকে আর আমি, দেখিনি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে তার অদর্শনে। একমাত্র তোমার দ্বারাই, আবার তার সঙ্গে আমার মিলন ঘটতে পারে সর্দারজী। সেই কারণে আজ আমি তোমার শরণাপন্ন হয়েছি।

কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো আমার। মেয়েটা বলে কী? সেও একটা মেয়ে, কাজীর মেয়েও একটা মেয়ে। মেয়েতে মেয়েতে এ কি রকম মহব্বত? না—তবে কি এ আসলে কোনও মেয়ে নয়—ছেলে?

অস্থির এক যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলাম, কিন্তু আমি তো তোমার কথার মাথামুড়কিছুই বুঝতে পারছি না সুন্দরী, কী বলতে চাইছো তুমি? ভালো করে বুঝিয়ে বলো তো। একটা মুরগী কি আর একটা মুরগীর পিছনে ছোটে কখনও?

ধৈর্য ধর, মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলে, সব খোলসা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি একটা হাঁদা, ভালোবাসার এমন গুঢ় রহস্যের খোঁজ রাখ না কিছু! অবশ্য তোমাকে কি দোষ দেব, ক’জনই বা রাখে?

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো সাঁইত্রিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে : এরপর আমাকে মোটামুটি প্রকৃত ব্যাপারটা খুলে বললো সে।

—আশা করি আর বেশি খুঁটিনাটি না শুনলেও আমাদের দু’জনের সম্পর্কটা অনুমান করতে পারছো? এবার বলল, কী ভাবে আমি তাকে পেতে পারি, এবং এ ব্যাপারে তুমিই বা আমাকে কতটুকু সাহায্য করতে পার? তবে মনে রেখ, উপকারের প্রতিদান দিতে আমি কার্পণ্য করি না।

আমি মনে মনে পুলকিত হলাম; ওঃ কি তোফা! দু’জনের যাকে পছন্দ তাকে আমি অঙ্কশায়িনী করব। দুনিয়াতে অনেক রকম মাগীর দালালীর কাহিনী শুনেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত দালালী এবং তার ইনামের কথা কি কেউ ভাবতেও পেরেছে?

বলতে কি, এর জন্যে নির্দিষ্ট কোনও আইনের বিধান নাই। সুতরাং ভয় কি, এগোনো যাক। গলা খাঁকারী দিয়ে আমি বললাম ওকে, মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বড় গোলমেলে। যাই হোক, আমি তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি। জানি না কতটা সফল হতে পারবো।

মেয়েটি কাকুতি মিনতি জানাতে থাকলো, শুধু একবারের তরে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দাও, তারপর আর তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমরাই ঠিক করে নেব।

ঠিক আছে, সুন্দরী, তাই হবে। তবে একটা কথা, কাজীর বাড়িতেই কাজীর মেয়ে থাকবে। আমি আমার দপ্তরেই বসে থাকবোতোমাদের মিলন ঘটিয়ে দেব।

—বহুৎ আচ্ছা সর্দারজী। কিন্তু আমার মাথায় একটা ফিকির এসেছে, তুমি মন দিয়ে শোনো, তারপর বলে কোনও ফাঁক আছে কিনা।

এরপর মেয়েটি তার মতলবের কথা আমাকে শোনালো : আজ সন্ধ্যায় আমি খুব ঝলমলে সাজে সেজেগুজে কাজীর বাড়ির পাশের রোয়াকটায় বসে থাকবো। তুমি যাবে তোমার সিপাই-সান্ত্রী সঙ্গে নিয়ে। আমার পোশাকে আতরের উগ্র গন্ধ থাকবে। তার ফলে অতি সহজেই আমার অবস্থিতি বুঝতে পারবে তুমি। তারপর আমার কাছে এসে বলবে, কে তুমি? এতো রাতে এখানে কেন?

আমি অসহায়, ভাব দেখিয়ে বলবো, আমার বাবা সুলতানের এক আমির। বাজারে কেনা-কাটা করতে বেরিয়েছিলাম, তাই ফিরতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের প্রাসাদের সদর ফটকে তালা পড়ে গিয়েছে। আজ রাতের মতো সে প্রাসাদে আর ঢুকবার কোনও উপায় নাই। তাই হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি। ভাবলাম, যদি কোনও চেনা আপনজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পথে। কিন্তু নসীব খারাপ, তেমন কারুরই সাক্ষাৎ পেলাম না। তাই কাজীর বাড়ীর সামনে এসে বসে আছি। এ জায়গাটায় বোধহয় চোর ডাকাতরা আসতে সাহস করবে না।

তখন তুমি বলবে, তোমার ভুল ধারণা মেয়ে। চোর ডাকাতরা এইসব জায়গাতেই বেশি ঘোরাফেরা করে। এই রাতে তোমাকে এমনভাবে রাস্তায় রেখে তো যেতে পারি না আমি।

তখন আমি বলবো, তাহলে আমাকে আপনার কোতোয়ালীতে নিয়ে চলুন, অথবা আপনার বাড়িতে, রাতটা সেখানে কাটিয়ে কাল সকালে ঘরে ফিরে যাবো।

তাতে তুমি বলবে, সে হয় না, রাতের বেলা কোতোয়ালী চোর বদমাশে ভরে যায়, সেখানে তোমার মতো সুন্দরী অভিজাত মেয়ের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হতে পারে। এবং তা যদি হয়, তুমি আমির কন্যা আমার চাকরী যাবে। তার চেয়ে বরং এই কাজী সাহেবকে বলে কয়ে এঁর বাড়িতেই রাতটা কাটাবার চেষ্টা দেখছি।

তুমি যদি কাজী সাহেবকে আমার বিপদের কথা বুঝিয়ে বলল, তিনি না করতে পারবেন না। আর একবার তার হারেমে ঢুকতে পারলে আমি কাজ হাসিল করে নেব।

মেয়েটির বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না। বললাম, ঠিক আছে, তাই হবে। যথাসময়ে আমি কাজীর বাড়ীর সামনে দলবল নিয়ে হাজির হবো।

সন্ধ্যা গড়িয়ে বেশ রাত হয়ে গেলো। আমি আমার সিপাইদের নিয়ে শহরে টহল দিতে বেরুলাম।

চলতে চলতে এক সময় কাজী-বাড়ির সামনে এসে দেখলাম একটি দামী রেশমী বোরখা পরা মেয়ে বোয়াকের একপাশে বসে আছে। চিনতে অসুবিধা হলো না, এই-ই সেই মেয়ে। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি বাছা, এতো রাতে এখানে কেন?

মেয়েটি প্রায় কাঁদ কাঁদ হয়ে জবাব দিলো, আমার বাবা এখানকার সুলতানের আমির। কিছু কেনাকাটার জন্য বাজারে বেরিয়েছিলাম। ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো। প্রাসাদের সামনে গিয়ে দেখি সদরে তালা পড়ে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। তালা যখন একেবারে পড়েছে শত চেষ্টা করেও আজ রাতে সে তালা কেউ খোলাতে পারবেনা। পথে অন্য কোন চেনালোকের সঙ্গেও দেখা হলো না যে, তাদের বাড়িতে গিয়ে রাতটা কাটাই, তাই এখানে এসে বসে আছি।

আমি বললাম, কিন্তু এ শহর চোর বদমাশদের আড্ডা—বিশেষ করে রাতের বেলায়। তোমার গায়ে তো অনেক মূল্যবান গহনা দেখছি।ওরা একবার সন্ধান পেলে তোমাকে তো রেয়াত করবে

বাছা।

-তা হলে আপনার বাড়িতে নিয়ে চলুন আমাকে আজকের রাতের মতো। কাল সকালে উঠে চলে যাবো?

আমি আঁৎকে উঠলাম, ওরে ব্যস, তোমার মতো রূপসী মেয়েকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তুললে আমাকে বঁটাপেটা করবে যে।

—তা হলে আপনার কোতোয়ালীতেই নিয়ে চলুন আমাকে।

-না তাও হয় না। রাতের বেলায় ও জায়গাটা মাতাল আর চোর ডাকাতে ভরে যায়। ওখানে তোমার ইজ্জত রাখতে পারবো না!

মেয়েটি হতাশ হয়ে করুণ চোখে আমার দিকে তাকালো—তা হলে?

আমি বললাম, দাঁড়াও দেখছি, কি করা যায়। কাজী সাহেবকে একবার বলে দেখি, তিনি যদি রাজি হয়ে যান, তা হলে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারবে তুমি।

কাজী সাহেব অতি সদাশয় মানুষ। সমস্ত শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, যাও মা, অন্দরে যাও। তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। আমার মেয়ে আছে, তারসঙ্গে দিব্যি রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবে।

মেয়েটি কাজীর হারেমে প্রবেশ করলো। আমি ফিরে গেলাম আমার কাজে।

পরদিন সকালে পায়ে পায়ে কাজীর বাড়িতে এসে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য মেয়েটির খবরাখবর নেওয়া। আমাকে দেখেই কাজী সাহেব তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, সব তোমার দোষ, তোমার জন্যেই এই সর্বনাশটা আমার ঘটলো। একটা চোরকে আমার ঘরে ঢুকিয়ে গিয়েছিলে তুমি! সে আমার যথাসর্বস্ব ফাঁক করে নিয়ে গেছে।

-বলেন কী, চুরি করে পালিয়েছে, কত টাকা? কাজী ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, চুরি করে পালিয়েছে? আহা নেকা, কিছুই যেন জান না? দাঁড়াও, তোমায় আমি মজাটা দেখাচ্ছি। এখুনি সুলতানের কাছে তোমার নামে নালিশ ঠুকে দেব আমি। ওহো, ছয়টি হাজার দিনার নিয়ে সে চম্পট দিয়েছে।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এমনভাবে একটা মেয়ে আমাকে ধোঁকা দিতে পারে ভাবতেও পারিনি।

কাজীকে বিনীতভাবে বললাম, যা ঘটার তো ঘটবে বলেই ঘটে গেছে। যাই হোক, আমার চোখে ধুলো দিয়ে সে পার পাবে না।

কাজী বললেন, ওসব ছেদো কথা আমি শুনতে চাই না। সুলতানের কাছে মামলা করবো তোমার নামে। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা! তোমার গর্দান যাবে।

আমি করজোড়ে বললাম, মেহেরবানী করে আমাকে তিনদিনের সময় দিন হুজুর। তার মধ্যে মুলজিমকে হাজির করবো আমি।

কাজী মৌন হয়ে ভাবলেন ক্ষণকাল। তারপর বললেন, ঠিক আছে, তিন দিনের সময় দিলাম তোমাকে। কিন্তু ঐ তিনদিনই। তারপর তিন পলকও দেরি করব না। সুলতানকে জানিয়ে দেব, মনে থাকে যেন।

ঘরে ফিরে এসে মহা ভাবনায় পড়লাম। এত বড় শহরে কোথায় খুঁজে পাব তাকে? সে যদি পুরুষ-মানুষ হতো তা হলে না হয় কথা ছিলো, একটা বজ্জাত মেয়েমানুষকে খুঁজে বের করবো কি করে? আইনের কোন বিধান নাই কোনও সিপাই-সান্ত্রী কারো হারেমে তল্লাশি চালাতে পারে। সুতরাং এ তো অকুল দরিয়া সামনে!

পথে ঘাটে বৃথা খোঁজাখুঁজি করে কোনও ফয়দা হবে না নিশ্চিত জেনে ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলাম তিনদিন। ভাবলাম মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু কি করা যাবে। নিজের বোকামীর কুফল তো নিজেকেই ভোগ করতে হবে।

সময়ের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলো। আর ঘরে বসে থেকে বা পালিয়ে বেড়িয়ে কোনও লাভ নাই। তাতে আরও খারাপ হবে আখেরে। তাই কাজির বাড়ির দিকে রওনা হলাম। মনে মনে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি, কাজীর কাছে প্রাণ ভিক্ষা করে দেখবো, তিনি যদি নিজগুণে এ যাত্রা মার্জনা করে দেন তবে প্রাণটা রক্ষা পাবে।

কাজী সাহেবের বাড়িতে ঢুকতে যাবো এমন সময় নারীকণ্ঠের ডাকে পিছন ফিরে তাকালাম। তাজ্জব ব্যাপার! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। যাকে আমি একান্তভাবে চাইছিলাম সেই মেয়ে নিজেই এসে হাজির হয়েছে আমার সামনে?

ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছেড়ে গেলো। যাক, প্রাণদণ্ডটা আর হবে না এ যাত্রা। আসামীকে আল্লাহর আশীর্বাদে বিনা চেষ্টায় কজায় পেয়ে গেছি। এবার তাকে কাজীর হাতে তুলে দিলেই আমি দায়মুক্ত হয়ে যাবো।

আমি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে খুব মোলায়েম সুরে বললাম, তোমার কি কাণ্ড বলতো, সকালবেলায় আমার সঙ্গে একবার দেখা করবে তো?তা না, কাজ হাসিল করেই একেবারে কেটে পড়লে? আমি তোমাকে তামাম শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর তুমি দিব্যি গা ঢাকা দিয়ে রয়েছ? তুমি আন্দাজ করতে পেরেছ তোমার জন্যে আমাকে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলতে হতো?

মেয়েটি একেবারে আমার মুখোমুখি এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। বেশ অনুভব করতে পারলাম, ওর ভুঁড়িটা আমার ভুঁড়ির সঙ্গে লেপটে গেছে। মুখে ওর দুর্বোধ্য দুষ্টুমির হাসি। ভুরু নাচিয়ে বললো, কাপ্তেন সাহেবের ভয় লেগেছে বুঝি? যাই হোক ওসব কেচ্ছা আর শুনিয়ে লাভ নাই, সবই আমি জানি। আমাকে সশরীরে ধরে কাজীর সামনে হাজির করার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, এবার তোমার ফাঁসী অবধারিত। কেউ তা রদ করতে পারতো না, কিন্তু আমি এখনও পারি, মুইন সাহেব।

আমি ওকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। সত্যিই তো ও যদি নিজে থেকে এসে আমার হাতে ধরা না দিত তবে সারা জীবন ধরে তল্লাশ করেও তো ধরতে পারতাম না আমি। আমি ওর একখানা হাত টেনে নিয়ে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললাম, তোমার মতো এমন অপূর্ব মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।

—আহা অমন উতলা হচ্ছো কেন! আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না! আমি তো কথা দিচ্ছি, কোনও অনিষ্ট তোমার হবে না। ছাড়, হাত ছাড়, চলো আমার সঙ্গে চলো।

আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে পিছনে অনুসরণ করে চললাম। অনতি দূরে একটি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো সে। আমিও ঢুকলাম।

একটি সুসজ্জিত কক্ষ। এক ধারে পাশাপাশি দুটি সিন্দুক। দুটিরই ডালা খুলে ফেললো সে। আমি তো দেখে তাজ্জব হয়ে গেলাম। ও বললো, কী দেখছো মুইন কাপ্তেন? এই সব এক একটা হীরে জহরতের গয়নার দাম কত জান? ছয় হাজার নয়, ছত্রিশ হাজারের বেশি। তা আমার এই সিন্দুক দুটোয় কত টাকার হীরে জহরত আছে বলে তোমার মনে হচ্ছে?

আমি আমতা আমতা করে বলি, কী করে বলবো? এ সব জিনিষ তো চোখে দেখিনি কখনও, দাম আন্দাজ করবো কী করে?

মেয়েটি বললো, এর মধ্যে যা দেখছো, ফেলে ছড়িয়েও এর দাম পাঁচ লাখ দিনার হতে পারবে। আর জান, এগুলোর মালিক কিন্তু আমি একা। কোনও ভাগীদার নাই। তা হলে এবার তোমার প্রত্যয় হচ্ছে কি কাজীর ঐ তুচ্ছ ছয় হাজার টাকার তোড়া চুরি করার জন্য আমি যাইনি সেখানে?

আমি কোনও রকমে বলতে পারি, তো তো বটেই, তা তো বটেই। এতো যার ধন-দৌলত, সে কেন সামান্য ছয় হাজার দিনারের তোড়া চুরি করবে?

-কাজী যাই ভাবুক, তুমি তো জান কাপ্তেন, কেন আমি তার বাসায় সে রাত কাটিয়েছিলাম?

—বিলক্ষণ জানি? কিন্তু কাজী সাহেবের টাকার তোড়াটা গেলো কোথায়?

—অবশ্যই আমি সঙ্গে করে এনেছি। কেন এনেছি তার কারণ আছে। তবে এটা তো ঠিক চুরি করার জন্য আনিনি। তাহলে শোনো আমার ফিকির।

ঐ টাকাটা চুরি না করে আনলে আমার আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতো না। সে রাতের ব্যাপার সেখানেই ইতি হয়ে যেত। কিন্তু আমি তো তা চাইনি। আমার ভালোবাসাকে আমি চিরকালের করে পেতে চাই। এবং সেই উদ্দেশ্যেই এই ফন্দী আঁটতে হয়েছিলো আমাকে।

আমি বুঝতে না পেরে বললাম, কিন্তু এতে তো ব্যাপারটা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে!

—জট ভালোভাবে না পাকালে তা কি ছাড়াবার প্রয়োজন হয়? ওসব থাক, এবার আমার মতলব শোনো :

এখান থেকে সোজা তুমি কাজীর কাছে যাও।

আমি শিউরে উঠলাম, একা?

ও হেসে বললো, হ্যাঁ একা, ভয় নাই আমি পালিয়ে যাবো না। আর কাজীও তোমাকে শূলে চাপাতে পারবে না।

কাজীর সামনে দাঁড়ালেই ক্রোধে সে ফেটে পড়বে! লোকটা ভীষণ কঞ্জুস। অতগুলো টাকা খোয়া গেছে, সে শোক সে ভুলতে পারছে না। তোমাকে বলবে, কোথায় সে আসামী? কোথায় আমার তোড়া? জানি তুমি আনতে পারবে না। তবে এবার তোমার রক্ষা নাই। এখনি আমি সুলতানের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে।

তখন তুমি তার অনেক মহত্ত্বের গুণগান করে বলবে, আমি সারা শহর তোলপাড় করেছি আপনার তোড়াশুদ্ধ আসামীকে গ্রেপ্তার করতে। কিন্তু না কোথাও সে নাই। আমি নারী-গুপ্তচরকে পাঠিয়ে অনুসন্ধান করেছি শহরের সব বাড়ির অন্দরমহল। না সে কোথাও নাই। অবশেষে এই সন্দেহই আমার মনে মাথা চাড়া দিয়েছে। ওই মেয়েটি আপনার গৃহেরই কোনও গোপন স্থানে অবস্থান করছে। আপনিই ভেবে দেখুন হুজুর, আপনার গৃহে যা সুরক্ষা তাতে এখান থেকে কোনও মানুষ চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে সক্ষম হবে না। আপনি যদি অনুমতি করেন তবে আমি আমার দলবল দিয়ে আপনার বাড়িটা একবার তল্লাশি করে দেখি।

তোমার কথা শুনে কাজী সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, কী এতো বড় কথা! আমি ন্যায়-বিচারের প্রতিমূর্তি, আমাকে তুমি সন্দেহ করছো?

তখন তুমি আরও বেশি বিনীত ভাব দেখিয়ে বলবে, আমায় সর্বদা মার্জনা করবেন হুজুর। কিন্তু আমি কর্তব্যের দাস মাত্র। খানা-তল্লাশি আমাকে করতেই হবে। আমি বলছি না, আপনি জেনে-শুনে কিছু গোপন করতে চাইছেন আমার কাছে। এমন তো হতে পারে, এর মধ্যে আপনার গৃহের অন্য ব্যক্তির কারসাজি আছে।

কাজী সাহেব চীৎকার করে উঠবেন, বলবেন, বেশ, কর তল্লাশি। কিন্তু ইয়াদ রেখো, আমার বাড়িতে যদি কিছু না পাওয়া যায় আরও গুরুতর সাজা পাবে তুমি।

তুমি বলবে, আমি জানি হুজুর, মৃত্যুই আমার একমাত্র দণ্ড। তার অধিক আর কী সাজা হতে পারে?

তখন তুমি সিপাইদের নিয়ে কাজীর ঘরদোর তল্লাশ করতে করতে কিছু না পেয়ে অবশেষে রসুইঘরে পৌঁছবে। সবশেষে তুরুপের তাসটা ওল্টাবে। ঐ ঘরে একটা বিরাট জালা বসানো আছে। আগে তেল রাখা হতো, এখন খালিই পড়ে থাকে। ওটার মধ্যে হাত দিয়ে তুমি কতগুলো সাজ-পোশাক টেনে তুলবে। দেখবে ওগুলো রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। ভয় নাই, কোনও নরহত্যা নয়। একটা কুকুর কেটে তার রক্ত মাখিয়ে একটা মোড়কে ভরে সে দিন আমি কাজীর গৃহে নিয়ে গিয়েছিলাম। কাজী সাহেবের মনে কোনও সন্দেহ জাগেনি। কারণ তাকে বলা হয়েছিলো, আমি কেনাকাটা করতে বাজারে বেরিয়েছিলাম। তারপর আর বাড়ি ঢুকতে পারিনি।

এই সময় আমি বললাম, কিন্তু আমিও তো বুঝতে পারিনি, ঐ মোড়কে তুমি খুন মাখানো কাপড়-চোপড় মুড়ে নিয়ে এসেছিলে?

মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বললো, তোমরা মাথা মোটা সেপাই। বরকন্দাজ মানুষ, এমন সূক্ষ্ম বুদ্ধি থাকলে কোকা ঘুরিয়ে বেড়াও? যাক এসব, এবার আমার মোক্ষম প্যাচের কথাগুলো মন দিয়ে শোনো।

ঐ রক্তমাখা শেমিজ, কাঁচুলি, ইজের, বোরখা প্রভৃতি দেখে বুঝতে অসুবিধা হবে না, সেগুলো কোনও নারীর।

এরপরে কাজীর আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। হয়তো সে অজ্ঞান হয়েও অক্কা পেতে পারে। লোকটা যদি তখুনি মারা যায় তাহলে তো পোয়বার। আর যদি না মরে তবে তুমি বলবে, আপনি সাক্ষাৎ ন্যায়মূর্তি আর আপনার ঘরে এই কাণ্ড! এসব দেখলে সুলতান কী করবেন, আপনার কী হবে সে আমি জানি না, হুজুর। কিন্তু আমার কর্তব্য তো আমাকে করতেই হবে।

এরপর দেখবে কি হয়? একটু আগে তোমার প্রাণ যায় যায় হয়েছিল, এবার তার প্রাণ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে।

এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তুমি যদি কঞ্জুস কাজি সাহেবের সমস্ত সঞ্চিত সম্পদও দাবী করো তাও সে দিতে বাধ্য হবে।

আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠে শুধু বলতে পারলাম, সা-বা-স!

আমাকে দেখেই কাজী সাহেব গর্জে উঠলেন, হুম, তাহলে খালি হাতে এসেছ দেখছি! কোথায় সে আসামী? আর কোথায়ই বা আমার ছয় হাজার দিনারের তোড়া?

কাজী সাহেবের তড়পানীতে মুহূর্তের জন্য আমি ভড়কে গেলাম। মুখে কোনও কথা সরলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, সারা কাইরো শহর আমি তোলপাড় করে ফেলছি হুজুর। মেয়েছেলে গুপ্তচর পাঠিয়েছি প্রত্যেক বাড়ির হারেমে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মেলেনি! কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমার চৌকস সিপাই-বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে থাকবে এমন আসামী তো জীবনে দেখিনি? তবে সে গেলো কোথায়?

কাজী বললো, ওসব ঘেঁদো কথায় আমি ভুলবো না মুইন। যে-কোনও কারণেই হোক, তুমি যখন তাকে বামাল শুদ্ধ হাজির করতে পারলে না, তখন তার ফল তোমাকে পেতেই হবে।ফসীর দড়ি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমি বললাম, মরতে আমি ভয় পাই না হুজুর। তবে তদন্ত আমাকে শেষ করতে দিন আগে। —তদন্ত? কাজী প্রশ্ন করে, আবার কিসের তদন্ত?

আমার গোস্তাকি মাফ করবেন হুজুর, আমার সন্দেহ হচ্ছে মুলজিম আপনার গৃহেই কোথাও আত্মগোপন করে আছে।

কাজী ক্রোধে ফেটে পড়লেন, কী? এত বড় কথা? আমি সুলতানের কাজী, ন্যায় বিচার আমার ধর্মকর্ম, আর কিনা তুমি বলতে চাইছে, আমি তাকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখে তোমার ঘাড়ে মিথ্যে অভিযোগ চাপিয়েছি?

আমি জিভ কেটে বললাম, না, হুজুর, অতবড় স্পর্ধা আমার হতে পারে না। আমার সন্দেহ, আপনার গৃহের অন্য কোনও ব্যক্তি আপনাকে চুপিয়ে মেয়েটিকে লুকিয়ে রেখেছে কোথাও। আমাকে একবার তল্লাশি করতে অনুমতি দিন আপনি।

কাজী বললেন, এভাবে আর কতটুকু কালক্ষয় করতে পারবে কাপ্তেন? বেশ, কর তল্লাশি। কিন্তু মনে রেখ, আমার বাড়িতে যদি কিছু না পাওয়া যায়, তবে তোমার সাজা আরও কঠিন। হবে।

আমি হেসে বললাম, মৃত্যুর বড় সাজা আর কী হতে পারে হুজুর। আমি তার জন্যে মাথা বাড়িয়েই বসে আছি। কিন্তু তাই বলে তো কর্তব্যে অবহেলা করতে পারি না।

এই বলে সিপাইদের সঙ্গে নিয়ে কাজীর বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়লাম আমি। বাড়ির প্রতিটি ঘর তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করলাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না।

কাজী সাহেব ক্রমশঃই উত্তেজিত ক্রুদ্ধ হতে থাকলেন। অবশেষে রসুইঘরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আমার সিপাইরা হাঁড়ি পাতিল উল্টে পাল্টে দেখতে থাকলো। আমি কিন্তু তখন বড় জালাটার মধ্যে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছি। কাজী সাহেব বিদ্রুপ করে বললেন, আরে হাত ঢুকিয়েই দেখ না, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন! ওটা আজ কয়েক বছর ধরে খালি পড়ে আছে এঘরে। সেই থেকে ওটা ইঁদুর আরশোলাদের দুর্গ হয়ে উঠেছে।

আমি সত্যিসত্যিই হাত ঢুকিয়ে টেনে তুললাম এক পোঁটলা রক্তমাখা সাজপোশাক। সায়া, শেমিজ, কাঁচুলি, ইজের, বোরখা ইত্যাদি। অর্থাৎ যা যা একটি মেয়ের অঙ্গে থাকতে পারে সব।

কাজী সাহেব দু’হাতে মুখ ঢেকে ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর অস্ফুট আওয়াজ তুলে মেঝের ওপর ঢলে পড়লেন।

তাকে ধরাধরি করে শোবার ঘরে নিয়ে গেলো আমার সিপাইরা। শুইয়ে দিলো পালঙ্কে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে তার চৈতন্য ফিরে এলো। চোখ মেলেই তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমার একটা কথা রাখবে ভাই?

আমি সবিনয়ে বললাম, আজ্ঞা করুন হুজুর।

-বিশ্বাস কর, প্রকৃত ঘটনা কী আমি জানি না। তবে এভাবে নিজের দোষ-ক্ষালন করতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র। এ খবর যদি একবার বাইরে রাষ্ট্র হয়ে পড়ে তবে আত্মহত্যা করে মরা ছাড়া আমার আর উপায় থাকবে না। মরতে আমিও ভয় পাই না ভাই, তবে কি জান, সারাটা জীবন উচ্চ সম্মানের আসনে বসেছিলাম আমি। দেশবাসী আমাকে ন্যায় এবং সুবিচারের প্রতীক বলে মনে করে। তারা তো ভাবতে পারে না, আমার দ্বারা কোনও সামান্যতম অপরাধও হতে পারে। সেই বিশ্বাস শ্রদ্ধা সম্মান ভক্তি সব নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তার বদলে ঘৃণা অবজ্ঞা অপমান অসম্মানের জুতোর মালা পরতে হবে গলায়। না, না সে আমি সইতে পারবো না। তার আগে এ জীবন শেষ করে দেব আমি নিজের হাতে।

আমি আনত মস্তকে বললাম, এক্ষেত্রে আমাকে কী করতে বলেন হুজুর।

কাজী সাহেব হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন, তুমি আমার ইজ্জত বাঁচাও ভাই। তোমার হাতেই আমার বাঁচা মরা নির্ভর করছে। আমার যা কিছু সঞ্চিত অর্থ আছে সব তোমাকে দিচ্ছি, নিয়ে যাও, শুধু তার বদলে এই খবরটা যেন চিরকালের মতো চাপা পড়ে যায়।

আমি বললাম, ঠিক আছে—তাই হবে হুজুর। এরপর অর্থের শোকেই হোক আর আতঙ্কেই থোক, তিন রাত্রি পর্যন্ত কাজী সাহেব টিকে থাকলেন না।

তার মৃত্যুর পর তাঁর কন্যাকে নিয়ে ঐ মেয়েটি নীলের উপকূলে এক প্রাসাদে গিয়ে উঠেছে।

কাপ্তেন মুইন তার কাহিনী শেষ করলে দ্বিতীয় কাপ্তেন উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, শাহেনশাহ মহানুভব, এরপর আমি আমার, জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাচ্ছি, জাঁহাপনাকে?

দ্বিতীয় কাপ্তেন বলতে শুরু করে :

জাঁহাপনা, আমার চাচার মেয়ের সঙ্গে আমার শাদীর প্রস্তাব হলো। তাতে সে সম্মতি দিয়েছিলো তিনটি শর্তে।

-তোমার সঙ্গে সাদী আমার হতে পারে, কিন্তু সারাটা জীবন তিনটি শর্ত মেনে চলতে হবে তোমাকে।

আমি জানতে চাইলাম, কী শর্ত?

-এক, জীবনে কখনও তুমি চরস খেতে পারবে না। দুই, কখনও তরমুজ ছোঁবে না, আর তিন, কখনও কোনও চেয়ারে বসবে না।

আমি বললাম এ বড় বিদঘুটে শর্ত। যাই হোক, আমি রাজি। ব্যস, তারপর যথানিয়মে ধুমধাম করে আমাদের দু’জনের শাদী হয়ে গেলো।

এরপর অনেককাল কেটে গেছে। তার ভালোবাসায় আমার জীবন ভরে উঠেছে। কিন্তু মাঝে-মাঝেই বিবির ঐ শর্তের কথাগুলো আমাকে হনন করতে থাকে। কেন সে আমাকে চরস আর তরমুজ খেতে বারণ করেছে, আর কী কারণেই বা চেয়ারে বসতে দিতে চায় না সে?

অনেকবার কথার ছলে তার কাছ থেকে এর প্রকৃত কারণ—জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতিবারই সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, ওসব কথায় তোমার কী দরকার? শর্ত করেছ, শর্ত রাখবে।

এরপর চুপসে যাওয়া ছাড়া আমার আর কি করারই বা থাকে। কিন্তু একদিন আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। মনে মনে ঠিক করলাম, ওসব শর্তফর্ত গুলি মারবো আমি।

সেইদিনই দোকানে গিয়ে একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়লাম। একটা পাকা দেখে তরমুজ আনিয়ে গোটা তরমুজটা গোগ্রাসে খেয়ে পেটটা জয়ঢাক বানালাম। তারপর দোকানীকে বললাম, এক ছিলিম চরস সাজ তো ভাই।

চরসের গোলাপী নেশাটা বেশ জমে উঠলো। আমার প্রাণটা ফুরফুরে হাওয়ায় ডালিমগাছের ডালে বসে শিস দিয়ে উঠলো বহুকাল পরে।

ঘরে ফিরে আসতেই আজব ব্যাপার ঘটে গেলো মুহূর্তে। আমার শাদী করা বিবি বোরখার নাকাব মুখে ঢেকে রাগে ফেটে পড়তে চাইলো।

-তুমি একটা কুত্তার বাচ্চা, যার জবানের ঠিক থাকে না সে আবার মানুষ নাকি! কি দরকার ছিলো কসম খেয়ে শর্ত করার? শর্ত করেই শাদীই যখন করেছিলে আজ তা ভাঙ্গলে কোন্ আক্কেলে? চলো, এক্ষুণি কাজীর কাছে চলো। আমি আর তোমার ঘর করবো না, তালাক চাই।

আমার মেজাজটা তখনও বেশ শরিফ ছিলো, বিবিকে শান্ত করার জন্য মিথ্যে করেই বললাম, কেন বাজে বকছো, বাওবা, আমি তো শর্তের খেলাপ করিনি।

-মিথ্যে কথা, ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো সে, এই তো দেখছি নেশায় বেশ কথা জড়িয়ে আসছে তোমার। আর তরমুজ তুমি যে খেয়েছ তা তোমার কাপড়-চোপড়ে রসের দাগ দেখেই দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। পিছনে নজর করে দেখ, তোমার কুর্তার ঝুলটা কেন কুঁচকে রয়েছে। অমনটা তো চেয়ারে বসলেই হতে পারে!

নেশার ঘোরে তবু আমি স্বীকার করলাম না বিবির অভিযোগ। বললাম, ভুল—সব ভুল ধারণা তোমার।

এবার বিবি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো, কী, আমি মিথ্যে বলছি? ঠিক আছে চলো, কাজীর কাজে যাই। এখনি ফয়সলা হয়ে যাবে। মোটকথা তোমার মতো বাজে বেজন্মা লোকের সঙ্গে আমি আর ঘর করবো না।

কাজী সাহেব বিশেষ সদাশয় সুবিবেচক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। সব শুনেটুনে তিনি আমার বিবিকে নানা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে লাগলেন, স্বামীর ঘর হুট করে ছাড়বো বললেই কি ছাড়া যায়? কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। সমানে সে কাজীর সঙ্গে তর্ক করে যেতে লাগলো। তার এক কথা, কেন আমি আমার কথার খেলাপ করেছি।

অবশেষে আমার বিবি কাজীকে বললো, আপনি যদি আমার তিনটি প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন তবে আপনার উপদেশ আমি মেনে নিতে পারি।

কাজী সাহেব বললেন, বেশ বলল, কী তোমার প্রশ্ন?

আমার বিবি বললেন, প্রথমে থাকে হাড়ের মতো দড়, পরে হয় শক্ত পেশী তারপর একেবারেই থলথলে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে যায়। কেন? এবং কি কারণে?

বড় অদ্ভুত প্রশ্ন। কাজী সাহেব তো মহা ফাপরে পড়লেন। অনেক ভেবে চিন্তেও কোনও জবাব দিতে পারলেন না তখন। বললেন, সারাদিনে অনেক জটিল মামলা চালিয়েছি। এখন তোমার এ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না, ভালো মানুষের মেয়ে। তবে কাল সকালে আদালত বসার পরে এর জবাব তুমি পেয়ে যাবে।

সেদিনের মতো আদালতের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে গেলেন কাজী। প্রশ্ন তিনটি নিয়ে সারাক্ষণ নাড়াচড়া করতে থাকলেন মনে মনে। কিন্তু কিছুতেই সুরাহা করতে পারলেন না।

খেতে বসে ভালো করে খেতেও পারলেন না তিনি। কাজীর কিশোরী কন্যা বাবার চিন্তাম্বিত মুখ দেখে কাছে এগিয়ে এসে বললো, তোমাকে আজ ভীষণ চিন্তিত দেখছি, আব্বাজান! কী হয়েছে?

মেয়েকে আদর করে কাজী সাহেব বললেন, সে বড় কঠিন প্রশ্ন মা, কিছুতেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না।

—কী প্রশ্ন আব্বাজান, বলই না আমাকে। দেখি তার জবাব দেওয়া যায় কিনা।

তখন কাজী সাহেব আগাগোড়া সমস্ত খুলে বললেন মেয়ের কাছে। মেয়ে সব শুনে হাসতে হাসতে বললল, এইজন্য তুমি এতো দুর্ভাবনা করছো? এতো পানির মতো পরিষ্কার। পুরুষদের পনের থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষাঙ্গ হাড়ের মতো কঠিন থাকে। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বীর্যের তেজে ভাটা আসতে থাকে। পঁয়ত্রিশ থেকে ষাট অবধি আর হাড়ের মতো শক্ত হতে পারে না, মাংসপেশীর মতো মনে হয়। এবং ষাটের পর একেবারেই থলথলে মাংসপিণ্ড হয়ে যায়।

ঐটুকু মেয়ের বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে যান কাজী।

পরদিন আদালতে এসে আমার বিবির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন কাজী সাহেব।

কাজী সাহেবের জবাবে তুষ্ট হয়ে আমার বিবিজান সে যাত্রা আমার গুনাহ মাফ করে দিয়ে ঘরে টেনে নিয়ে এসেছিলো।

দ্বিতীয় কাপ্তেনের কাহিনী শেষ হলো। এবার অন্য এক কাপ্তেনের পালা।

 

তৃতীয় কাপ্তেন বলতে শুরু করে।

তা হলে শুনুন জাঁহাপনা, গল্পটা আমার মা-র কাছে শোনা।

এক সময় এক লবণ হ্রদের তীরে এক ধীবর-দম্পতি বাস করতো। মোটামুটিভাবে তাদের কোনও অভাব ছিলো না। স্বামী রোজ সকালে জাল চুপড়ি নিয়ে হ্রদের তীরে মাছ ধরতে যায়। সারাদিনে সে বেশি মাছ ধরার চেষ্টা করে না। যতুটুক প্রয়োজন তার বেশি কিছুতেই না। ওতে ওদের বেশ ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু অসময়ের জন্য সঞ্চয় হচ্ছিল না কিছু। অবশ্য তা ওরা চায়ও না কখনও।

একদিন জেলের অসুখ হলো। জেলেনী বললো, ঘরে খানাপিনা বাড়ন্ত। মাছ না ধরলে তো খাবার জুটবে না গো!

জেলে বলে, কিন্তু আমি সেরে না উঠলে মাছ কী করে ধরবো?

জেলে-বৌ বললো, এক কাজ কর, আমি জাল আর চুপড়ি মাথায় নিচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে আস্তে আস্তে হ্রদের ধারে চলো তো। শুধু জাল ফেলার পাচটা আমাকে হতে ধরে দু’একবার শিখিয়ে দেবে, দেখবে আমিই মাছ ধরতে পারবো।

জেলে বললো, ধৎ তাও কি হয়? তাছাড়া তোমার মতো রূপসী মেয়ে ঘাটে গিয়ে জাল ফেললে হাজার লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়বে না?

জেলে-বৌ হেসে বলে, ওগো ভয় নাই, ওগো ভয় নাই, তোমার বৌ হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তা এক কাজ করা যাক, ঐ যে সুলতানঘাট-যার পাশে সুলতানের প্রাসাদ গো, চলো ঐ ঘাটে যাই। ওখানে উটকো লোকের ঝামেলা নাই। কেউ নজর দেবে না তোমার সুন্দরী বিবির দিকে।

সুলতান জানালার পাশে বসে হ্রদের মনোহর শোভা দেখছিলো। হঠাৎ তার নজর পড়লো জেলে-বৌয়ের দিকে। আহা, কী খাসা রূপ! এমন মেয়ে জেলের ঘরে শুকিয়ে মরছে!

জেলে-বৌয়ের জ্বলন্ত যৌবনের লেলিহান শিখা সুলতানের বুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিজেকে আর কিছুতেই সংযত রাখতে পারে না সে। উজিরকে ডেকে বলে, দেখ উজির ঐ জেলেটার বিবির কি রূপ আর যৌবন! আমি তো কিছুতেই আর ঠিক থাকতে পারছি না। জেলেটাকে খুন করে মেয়েটাকে এক্ষুণি আমার সামনে হাজির কর।

উজির বিচক্ষণ ব্যক্তি, একটু ভেবে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, সে কাজটা কি ভালো হবে, ধর্মাবতার? আপনি ন্যায়ধর্মের ধ্বজা ধরে প্রজা পালন করছেন। বিনা অপরাধে একটা লোককে খুন করলে প্রজাদের মনে বিষক্রিয়া ঘটবে না? তারা ভাবতে পারে এ রাজ্যে জীবনে বেঁচে থাকার কোনও স্থিরতা নাই। সুলতানের খেয়ালে যে-কোনও মানুষের যে-কোনও সময় জান চলে যেতে পারে। আপনার সম্পর্কে তারা একবার অনাস্থার কথা চিন্তা করলে দেশের শান্তি বজায় রাখা শক্ত হবে।

সুলতান বললো, তুমি যথার্থই বলেছ উজির। বিনা দোষে কাউকে প্রাণদণ্ড দিলে প্রজাদের মনে বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে। কিন্তু ঐ জেলে-বৌটাকে যে আমার চাই-ই। ওকে দেখা মাত্র আমার রক্তে তুফান শুরু হয়ে গেছে।

উজির বললো, সে আর এমন বেশি কি কথা জাঁহাপনা! আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না, সে পথ আমার জানা আছে ঢের।

তখুনি উজির সিপাই পাঠিয়ে দিলো জেলের কাছে, যাও লোকটাকে এখানে হাজির কর।

দুরু দুরু কম্পিত বুকে জেলে এসে সুলতানের সামনে দাঁড়ালে উজির বললো, তোমাকে তিনদিন সময় দেওয়া হচ্ছে। এই তিনদিনের মধ্যে ওই দরবারের মেঝেটা একখানা মাত্র গালিচা দিয়ে মুড়ে দিতে হবে তোমাকে। কোনও রকম জোড়াতালি দেওয়া চলবে না। তা যদি না পার

তোমার গর্দান যাবে। এই সুলতানের হুকুম।

জেলে বিনীতভাবে বলে, আমি জেলের পো, মাছ ধরে খাই। মাছের ব্যাপারে আদেশ করুন, আমি সাধ্যমতো তামিল করবো। কিন্তু তাতীর কাজ আমার দ্বারা হবে কী করে? আস্ত একখানা গালিচা চোখেই দেখিনি জীবন ভোর। তা আবার বানাবো আমি! এ অসম্ভব কাজ আমার ঘাড়ে চাপাবেন না হুজুর।

উজির ধমক দিয়ে ওঠে, চুপ কর, মেলা বকো না। যা হুকুম হয়েছে তা তোমাকে করতে হবে। সে কাজ তুমি জান কি জান না, সে সব আমার জানার দরকার নাই। এই ধর চুক্তিনামা, টিপসই। দাও একটা।

—জী টিপসই চান, একটা কেন হাজারটা দিচ্ছি কিন্তু ঐ গালিচা-ফালিচা বানানো আমার কর্ম নয়।

উজির বললো, তোমার এসব ফালতু কথা শোনার সময় নাই আমার। ধর টিপ ছাপ দাও এখানে।

দলিলে টিপসই দিয়ে ঘরে ফিরে এলো জেলে। স্বামীকে বিষয় দেখে কাছে এগিয়ে এসে বৌটা জিজ্ঞেস করলো, কী হলো গো, সুলতান কেন তলব করেছিলেন তোমাকে?

জেলে বললো, কী করিবলতো বিবিজান? আমি জেলের ছেলে, মাছ বই অন্য কিছু জানি না। আমাকে বানিয়ে দিতে হবে একখানা এমন গালিচা যা দিয়ে আগাগোড়া সুলতানের দরবারের মেঝে মোড়া হয়ে যাবে। জোড়াতালি চলবে না; ছোটবড় হলে হবে না; একেবারে মাপে মাপে চাই। না না, বিবিজান এ অসম্ভব কাজ তো আর আমাদের দ্বারা হবে না। সুতরাং নির্ঘাৎ আমার গর্দান যাবে। চলো, আর দেরি না করে আজ রাতেই আমরা এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে অন্য কোনও দেশে চলে যাই।

জেলে-বৌ স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো, এই সামান্য কাজের ভয়ে তুমি দেশত্যাগী হবে? কোনও ভয় ভাবনার কারণ নাই। তুমি খেয়ে-দেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাও গে, যা করার যথাসময়ে করে আমি সামাল দেব।

জেলের পো বলে, কিন্তু এই অসম্ভব কাজ তুমি করবে কি করে?

বৌটা বলে, আমাদের বাড়ির পিছনে যে বুড়ো বটগাছটা আছে, তার নিচে দাঁড়িয়ে আর্জি জানাবে, ও বটবৃক্ষ, তোমার বন্ধু আজ বিশেষ বিপদে পড়েছে। সুলতানের হুকুম হয়েছে তার দরবার-মহলটা একটা মাত্র গালিচায় ঢেকে দিতে হবে। তুমি ছাড়া এ কাজ তো উদ্ধার হবে না, বৃক্ষ বাবা। তখন দেখবে সে তোমাকে একটা সুতোর গুলি দেবে। সেই গুলিটা জেবে ভরে তুমি উজিরের কাছে গিয়ে বলবে, আমাকে একটা লোহার গজাল দিন। গজালটা তুমি ঘরের চারপাশে ঘোরাতে থাকবে। ব্যস আর কিছু করতে হবে না, দেখবে সুন্দর একখানা ঘরজোড়া গালিচা তৈরী হয়ে যাবে।

তিনদিন পরে চারদিনের দিন ভোরবেলায় জেলে ঐ বুড়ো বটগাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। দু’হাত জোড় করে প্রার্থনা জানায়, ওগো বৃক্ষপতি আজ বড় বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। সুলতানের হুকুম তার দরবারের আগাগোড়া মেঝে একখানা মাত্র গালিচায় ঢেকে দিতে হবে। এই অসম্ভব কাজ করে দিতে না পারলে আমার গর্দান যাবে। তুমি আমাকে প্রাণে বাঁচাও বৃক্ষবাবা!

একটা দমকা বাতাস বয়ে গেলো। জেলে তাকিয়ে দেখলো তার পায়ের কাছে এসে পড়েছে। একটা সুতোর গুলি।

গুলিটা কামিজের জেবে ভরে সে সুলতানের প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলো। উজির বললো, এই যে জেলের পো, এসেছ দেখছি। তা তোমার চুক্তি কেমন করে রক্ষা করবে? তা না হলে এখুনি তোমার গান যাবে।

জেলে বলে, আমার ওয়াদা আমি পূরণ করবো। তার আগে আমাকে একটা বড় লোহার গজাল এনে দিন।

উজির প্রশ্ন করে, গজাল দিয়ে কি করবে?

–এই সুতোর গুলি দিয়ে আমি গালিচা বুনে দেব এখনই।

উজির সুলতানের দিকে তাকিয়ে বললো, লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, জাঁহাপনা। এতো বড় দরবারের মেঝে ঢাকার জন্য একটা সুতোর গুলি জেবে ভরে এনেছে।

সুলতান বললো, ঠিক আছে, ওকে একটা গজাল এনে দাও, দেখা যাক কী করে।

সঙ্গে সঙ্গে গজাল এসে গেলো। জেলে ওটাকে ঘরের একপাশে পুঁতে সুতোর প্রান্তটা বেঁধে দিয়ে গুলিটাকে ঘরের চারপাশে ঘোরাতে থাকলো।

উজির ততক্ষণে জল্লাদকে নির্দেশ দিয়েছেন, খাঁড়া হাতে এসে দাঁড়াতে।

শাণিত অস্ত্র কাঁধে করে ঘাতক এসে দাঁড়ালো দরবারের দ্বারদেশে। উজিরের ইশারা পাওয়া মাত্র সে জেলেকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবে। সেইভাবে সে প্রস্তুত হতে লাগলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে একখানা ঘরজোড়া সুন্দর গালিচা বানিয়ে ফেললো জেলে। উজিরের মুখ চুন হয়ে গেলো। জেলে বললো, দেখুন হুজুর, গালিচাটা পছন্দসই হয়েছে কিনা?

উজির বললো, তা হয়েছে। কিন্তু তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে। সুলতানের হুকুম। আজ থেকে ঠিক আটদিন বাদে এই দরবারে হাজির হতে হবে তোমাকে। সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে একটি আটদিনের শিশু। সে বাচ্চা অনর্গল গুলতাপ্পির গল্প শোনাতে পারবে সুলতানকে।

জেলে বললো, এমন গাঁজাখুরি কথা শুনেছে নাকি কেউ কখনও, মাত্র আটদিনের কোনও মানব-শিশুর মুখে কথা ফোটে?

-ওসব অজুহাত শুনতে চাই না আমি। যেমন করে পার সংগ্রহ করে আনতে হবে সেই শিশুকে। এই ধর চুক্তিপত্র, একটা টিপ ছাপ দাও।

জেলে বললো, একটা কেন হাজারটা টিপসই আমি দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আটদিন কেন, আমার জিন্দগীভর চেষ্টা করলেও অমন আজব বস্তু আমি জোগাড় করতে পারবো না, হুজুর।

-আঃ অবাধ্য হয়ো না। ভুলে যেও না একুম স্বয়ং সুলতানের। যথা সময়ে তামিল করতে পারলে তোমার গর্দান যাবে।

প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে আসে জেলে। উৎকণ্ঠিত হয়ে বিবি কাছে আসে, কি গো, গালিচা বুনে দিতে পারলে?

-না না, সে কাজ অতি চমৎকার ভাবেই হয়ে গেছে। কিন্তু এক নতুন ফরমাস হয়েছে। আটদিনের একটা কচি বাচ্চাকে যোগাড় করতে হবে—যে অনর্গল গুলতাপ্লির গল্প শোনাতে পারবে সুলতানকে। তা-না হলে আমার গর্দান যাবে। এবার আর বাঁচার কোনই উপায় নাই বিবিজান। চলো আমরা দেশত্যাগ করে পালিয়ে যাই আজই রাতে।

রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো একচল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

জেলে-বৌ বললো, সুলতানের শয়তানীর আর শেষ নাই, দেখছি। নচ্ছারটার নজর পড়েছে আমার দিকে। কোনও একটা ছলছুতোয় তোমাকে মেরে ফেলে আমাকে হারেমে তোলার সাধ হয়েছে মুখপোড়ার। ঠিক আছে, তুমি কোনও চিন্তা করো না, ওর সাধ আমি মিটিয়ে দিচ্ছি। এখন

তুমি বিশ্রাম করছে, আটদিন বাদে যথাসময়ে আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।

নয়দিনের দিন সকালে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে জেলে-বৌ ঐ বটবৃক্ষের নিচে এসে দাঁড়ালো।

–ও বাবা বটবৃক্ষ, তোমার দয়াতে একবার আমার স্বামীর জীবন রক্ষা হয়েছে, সেজন্য তোমাকে শতকোটি সালাম জানাই। কিন্তু আবার এক নতুন বিপদ এসেছে। সুলতান হুকুম করেছে একটা আটদিনের বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হবে তার সামনে। সে বাচ্চা অনর্গল গুলগল্প শোনাতে পারবে সুলতানকে। সুলতানের এই অসম্ভব বায়না যদি মেটাতে না পারে তবে আমার স্বামীর গর্দান যাবে। আপনি আমাদের পরিবারের হিতৈষী বন্ধু, আপনার সাহায্য না পেলে এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবো না।

সঙ্গে সঙ্গে শোঁ-শোঁ আওয়াজ করে একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলো। এবং পরক্ষণেই ওরা দেখতে পেলো একটা প্রায় সদ্যজাত শিশু ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে পায়ের কাছে।

বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ফিরে এলো ওরা। জেলে হতাশ হয়ে বললো, কিন্তু বিবিজান, এ বাচ্চা তো শুধু কাঁদতেই জানে, কথা বলবে কী করে?

জেলে-বৌ বলে, তোমার কোন ভাবনা নাই গো, দেখো ঠিক সময়ে এর মুখে খৈ ফুটবে!

ছেলেটাকে কোলে করে জেলে সুলতানের দরবারে আসে। উজির বলে, এনেছ? কই দেখি? এই বাচ্চা কথা বলে?

এই বলে সে শিশুটির গাল টিপে দিয়ে বলে, তোমার নাম কি খোকা? বাচ্চাটা কিন্তু উজিরের প্রশ্নের জবাব দেয় না, শুধু ওঁয়া ওঁয়া করে কেঁদে ওঠে।

উজির বলে, এ তো দেখছি এর মুখে এখনও বোল ফোটেনি, সুলতানকে গুলগল্প শোনাবে কী করে এ?

জেলে রাগতভাবে বলে, ও দিয়ে আপনার মাথা ঘামাবার দরকার নাই হুজুর, আপনি আমাদের বসার ব্যবস্থা করে দিন।

উজিরের নির্দেশে সেখানে একখানা নরম গদীর বড় ডিভান এনে বসানো হলো। ছেলেটাকে কোলে করে জেলে বসে পড়লো তার ওপর।

সুলতান তখুনি তার পার্শ্বচর আমির ওমরাহ এবং শহরের গণ্যমান্যদের উপস্থিত হতে ফরমান দিলো। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উপস্থিত হয়ে যে যার যথাযোগ্য আসন গ্রহণ করে বসলো। সুলতান ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো, এই কি তোমার সেই বাচ্চা, যে আমাকে গুলগল্প শোনাবে?

জেলে সবিনয়ে বললো, জী হ্যাঁ; জাঁহাপনা?

সঙ্গে সঙ্গে সারা দরবারমহলে কৌতূহলের স্তব্ধতা নেমে এলো। জেলের কোলে বাচ্চা হঠাৎ কথা বলে উঠলো, সুলতান মহানুভব।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো সকলে। একটা প্রায় সদ্যজাত শিশু সুলতানকে যথাযোগ্য অভিনন্দন জানালো?

সুলতান বললো, ওহে গুণধর, আমি তোমার কাছে কিছু গুলতাপ্পির গল্প শুনতে বাসনা করি!

সকলে তাজ্জব হয়ে শুনতে লাগলো, ছেলেটি বলছে : কোনও এক সময়ে—তখন সবে আমি প্রথম যৌবনে পা দিয়েছি—একদিন শহরের বাইরে ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে দ্বিপ্রহরের প্রচণ্ড দাবদাহে প্রায় দগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। মনে বাসনা হলো একটা রসালো তরমুজ উদরস্থ করি। একটুক্ষণের মধ্যে সংগ্রহও করলাম একটা বেশ বড়সড় গোছের পাকা তরমুজ। দু’ভাগ করার জন্য ছুরি বসিয়ে দিলাম, কিন্তু জাঁহাপনা কী বলবো, তরমুজটা কেটে দেখি তার মধ্যে একটা গোটা শহর—কত ঘরবাড়ি, প্রাসাদ, মসজিদ বাগ-বাগিচা—কত মানুষজন তার আর ইয়ত্তা নাই, আমি তো তাজ্জব! এমনটা যে ঘটতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। যাই হোক আর কালক্ষেপ না করে তরমুজটার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বড় চমৎকার শহর। যতদূরে যাই সুন্দর সুন্দর সব ইমারত, ফুলবাগিচা হাটবাজার—আরো কত কী? একটা বাগানে ঢুকে দেখি গাছে গাছে কত রং-বেরঙের পাকাপাকা ফল। দু’চারটা পেড়ে খেলাম। কি মিষ্টি! প্রাণ ভরে গেলো। এরপর আমি আবার চলতে থাকি। চলতে চলতে এক সময় শহর ছাড়িয়ে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলাম। চারদিকে সবুজ শস্যের মেলা। একটা চাষীর বাড়ির সামনে তরকারীর চাষ হয়েছে। লাউ, কুমড়ো, শশা, বরবটি নানারকম তরকারি! একটা বরবটি ছিঁড়ে নিয়ে তার বিচি খাব বলে খুললাম। দেখি বরবটিটার মধ্যে চাষীরা লাঙ্গল গরু নিয়ে জমি চাষ করছে। অদ্ভুত লাগলো।, বরবটির মধ্যে ঢুকে পড়লাম! মাঠের আল ধরে চলেছি। চলতে চলতে একটা খামারবাড়ি পেলাম। সেখানে দেখি মেয়েরা পেঁকিতে ধান ভানছে, কেউ বা যবের ছাতু বানাচ্ছে। চাকী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। আবার কিছু লোককে শস্য মাড়াই করতে দেখলাম। আরও একটু এগোতে দেখি একটা নোক ঘরের দাওয়ায় বসে আছাড় দিয়ে দিয়ে ডিম ফাটাচ্ছে। এক একটা করে ডিম আছাড় দিয়ে খানিকক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকছে! আর কী আশ্চর্য, ডিমের কুসুম থেকে কুঁক কুঁক করে ডাক ছেড়ে এক একটা মোরগ মুরগী বেরিয়ে চেঁচা দৌড় মেরে পালাচ্ছে এদিক ওদিক। আরও একটু এগিয়ে দেখলাম একটা গাধা পিঠে করে বয়ে চলেছে এক বোঝা ডালের রুটি। লোভ আর সামলাতে পারলাম না। খানকতক তুলে নিয়ে একখানা রুটিতে সবে একটা কামড় বসিয়েছি হঠাৎ দেখলাম আমি তরমুজটার বাইরে বেরিয়ে এসেছি। আমার সামনে গোলগাল অর্থাৎ তরমুজটা যেমন রেখেছিলাম কাটার আগে ঠিক তেমনি আস্তই পড়ে আছে, দেখতে পেলাম। এই হচ্ছে আমার কাহিনী, জাঁহাপনা।

সুলতানি হাসি আর চাপতে পারে না; হো হো হো করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে আর কি! হ্যাঁ বাবা, গুলেরও একটা সীমা থাকা দরকার। এ যে দেখছি গুলের বাদশা। আচ্ছা, হে গুণধর গুলবাজ! তুমি যে বললে ডিম আছাড় দিতে মোরগ মুরগী ডাক ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো, একি কোন যুক্তির কথা হলো?

বাচ্চাটা বললো, গোস্তাকি, মাফ করবেন জাঁহাপনা! আজকালকার জগতে যুক্তিবহ কিছুই চলে না।মিথ্যা, জালিয়াত, প্রবঞ্চনা, অসম্ভব এবং অবাস্তবতার দাপটেই নিরীহ শান্ত সৎ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে আজ! আপনি নিজেকে দিয়েই এর বিচার করুন জাঁহাপনা। আপনার কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য এই নিরপরাধ নিরীহ জেলের পো-কে আপনি অসম্ভব অবাস্তব কাজের বায়না চাপিয়েছেন। না পারলে তার গর্দান নেবেন আপনি। এটা কি কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তির কথা? আসলে আপনার উদ্দেশ্য যেন তেন প্রকারে জেলের-পোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে তার সুন্দরী বৌটাকে উপভোগ করা। এটা কি কোনও সঙ্গত ব্যাপার, ধর্মত আপনি বলুন, জাঁহাপনা?

দরবারে উপস্থিত আমির ওমরাহরা অবাক হয়ে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে।

আচমকা এমনটা ঘটতে পারে ভাবেনি সুলতান। নিজের লজ্জা ঢাকতে সে তখন চটপট দরবার সমাপ্ত ঘোষণা করে উঠে দাঁড়ালো।

এরপর বাচ্চাটা বললো, চাচা আর এখানে নয়, চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। শিশুটিকে কোলে করে জেলে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলো! কেউ তাকে আর বাধা দিতে এগিয়ে এলো না।

তৃতীয় কাপ্তেন তার গল্প শেষ করলে সুলতান বাইবারস বললেন, চমৎকার—চমৎকার তোমার কিসসা।

এরপর সুলতানের চতুর্থ কাপ্তেন মুহী অল দিন এগিয়ে এসে যথাবিহিত কুর্নিশাদি জানিয়ে বললো, এবার আমার কাহিনী শুনুন, জাঁহাপনা।

 

চতুর্থ কাপ্তেনের কাহিনী : আমার এ কাহিনী আগের কাহিনীরই শেষাংশ জাঁহাপনা।

কালক্রমে ঐ জেলের একটি চাদের মতো ছেলে হয়েছিলো। ঠিক মায়েরই মতো।

সুলতানেরও এক পুত্রসন্তান জন্মেছিলো। কিন্তু সে দেখতে হয়েছিলো ঠিক বাঁদরের মতো। গায়ের রঙও কালিপড়া হাঁড়ির সুলতানের ছেলে আর জেলের ছেলে একই পাঠশালায় পড়াশুনা করে। প্রতিদিন পাঠশালায় এসেই সুলতানের ছেলে জেলের ছেলেকে জেলে গরীব ভিখিরি বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। জেলের ছেলেও ছেড়ে কথা কয় না, সে বলে, এই যে শাহাজাদা, তা ভাই তোমার শরীরটা একটু ভালো করে ডলাইমলাই কর না কেন? ঘষতে ঘষতে, দেখবে, চামড়া একদিন সফেদ হয়ে গেছে

এইভাবে প্রায় দু’টো বছর কেটে গেলো। একদিন সুলতান-তনয় এসে বাবার কাছে নালিশ করলো, আমি আর ঐ পাঠশালায় যাবো না আব্বাজান। জেলের ছেলে আমার চেহারা নিয়ে রোজ ঠাট্টা তামাশা করে।

ক্রোধে জ্বলে ওঠে সুলতান। এতো বড় স্পর্ধা জেলের ছেলের। এখুনি এনে ওকে কোতল করবো।

কিন্তু আগের সেই বে-ইজ্জতের ঘটনা স্মরণ করে আপাতত সে পরিকল্পনা মুলতুবি রাখতে হলো তাকে। ভাবলো, ছেলেটাকে এনে ফাঁসী দিলে প্রজাদের মনে অসন্তোষ বাড়তে পারে। তারা হয়তো ভাবতে পারে, সেদিনের দরবারে জেলেকে কোতল না করতে পারার ঝাল মিটিয়েছি আমি।

পাঠশালার মৌলভীকে ডেকে তিনি বললেন, শোনও শেখ, আমার কথা মতো কাজ করতে হবে। তাহলে অনেক ইনাম দেবো তোমাকে। সেই সঙ্গে পাবে সুন্দরী সুন্দরী গুটিকয়েক রক্ষিতা। তোমার পাঠশালায় জেলের ছেলে পড়তে যায়। তাকে খতম করতে হবে, যে ভাবে পার।

মৌলভী কুর্নিশ জানিয়ে বললো, এ আর এমন কঠিন কী কাজ জাঁহাপনা। আমার মা’র দুনিয়ার বার। কয়েকদিনেই ওকে আমি পিটিয়ে শেষ করে দেব।

পরদিন পাঠশালা শুরু হতে না হতেই জেলের ছেলেকে মোটা লাঠি দিয়ে বেমক্কা পেটাতে লাগলো মৌলভী। মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে এক সময়। সারা দেহ দিয়ে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো। মৌলভী দেখলো ছেলেটা আর সাড়া শব্দ করে না। ভয়ে সে সরে গেলো, কিন্তু মুখের বোলচাল ঠিকই চলতে থাকলো, যত্তোসব অপগণ্ড। একেবারে মাথায় কিছু ঢোকে না। আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল আবার পেটাবো।

বিকেলে রক্তাক্ত দেহে বাড়ি ফিরে এসে জেলের ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবাকে মৌলভীর অহেতুক মারের কাহিনী বললো।

-কাল থেকে আর আমি ঐ পাঠশালায় যাবো না, বাবা। বাবা বললো, ঠিক আছে, লেখাপড়া করে আর কাজ নাই, চলো কাল থেকে আমার সঙ্গে মাছ ধরতে যাবি।

পরদিন সকালে সে জাল চুপড়ি মাথায় নিয়ে বাবার সঙ্গে হ্রদের তীরে মাছ ধরতে আসে। প্রথম জালে কোনও ভালো জাতের মাছ উঠলো না। উঠলো একটা চ্যাং। ছেলেটি বললো, এটা দিয়ে আমি নাস্তা করবো।

এই বলে সে চুপড়িতে ফেলে রাখলো। চ্যাংটা মুখ হাঁ করে কথা বলে উঠলো, আমাকে খেয়ে ফেলো না জেলের পো। আমি সত্যিই কোনও মাছ নই। স্থানভ্রষ্ট এক জিন কন্যা। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। দেখো, সময়কালে আমি তোমার যথেষ্ট উপকার করবো।

জেলের ছেলে বললো, ঠিক আছে; তোমাকে যেখান থেকে তুলেছিলাম সেখানেই আবার ফেলে দিচ্ছি।

এই বলে সে হ্রদের জলে চ্যাংটাকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার জাল ফেললো।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো বিয়াল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

দুইদিন পরে। সুলতান মৌলভীকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী? জেলের ছেলেটাকে খতম করতে পেরেছ?

মৌলভী ভীত চকিত হয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, না হুজুর, প্রথম দিন আমার মার খেয়ে বাড়ি চলে গেলো; এই দুদিন আর সে পাঠশালায় আসেনি। খবর পেলাম, সে আর লেখাপড়া করবে না, ওর বাবার সঙ্গে মাছ ধরবে।

ক্রোধে জ্বলে উঠলো সুলতান, দূর হ খানকির ছেলে, আমার সামনে থেকে ভাগ।

তারপর সে উজিরকে ডেকে বললো, ছোঁড়াটা এখনো বেঁচে আছে। এখন আমাদের কী কর্তব্য, উজির?

উজির মাথা চুলকে বলে, একটা পথ আমি বের করছি, হুজুর।

-বলো, শুনি।

উজির বলতে থাকে, সবুজ শহরের সুলতানের এক পরমাসুন্দরী রূপবতী কন্যা আছে। তার সঙ্গে আমাদের শাহজাদার শাদী হলে চমৎকার মানাবে। কিন্তু মুশকিল হলো সবুজ শহরের সুলতান বড় একলোখা বদমেজাজী মানুষ। যে সব শাহজাদারা তার কন্যার পাণিপ্রার্থনা করতে গেছে এ যাবৎ, তারা আর ফিরে আসতে পারেনি। সুলতান তাদের সকলকে শূলে চড়িয়েছেন। এখন আমার মতলব হলো, ঐ জেলের ছেলেকে সেখানে পাঠানো। তাকে আপনি হুকুম করুন, যেভাবেই পার ঐ সবুজ দেশের শাহজাদীকে এনে হাজির করতে হবে এখানে, তার সঙ্গে আমার ছেলের শাদী হবে।

সুলতান বললো, আশ্চর্য তোমার বুদ্ধি উজির। চমৎকার হবে। ডাক তাকে এখানে-এক্ষুণি।

সুলতানের পেয়াদা জেলের বাড়িতে এসে এত্তেলা দিলো।

জেলেপুত্র মহম্মদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরবারে এসে হাজির হলো। উজির বললো, শোনও সুলতানের হুকুম, তোমাকে একটা কাজ করে আসতে হবে। সবুজ শহরের সুলতানের কাছে যাবে তুমি। তার পরমাসুন্দরী কন্যাটিকে আমাদের চাই। শাহজাদা তাকে শাদী করবে।

মহম্মদ বললো, কিন্তু সবুজ শহর কোথায় কোন দিকে কিছুই তো জানি না আমি।

উজির উত্তেজিত হয়ে বলে, ওসব কিছুই শুনতে চাই না আমি। এ সুলতানের কুম। যদি অগ্রাহ্য কর গর্দান যাবে তোমার।

মহম্মদ সাশ্রনয়নে ঘরে ফিরে এসে মায়ের কাছে সব বললো। মা বললো, বিপদে ধৈর্য হারাতে নাই, ভয় পেতে নাই বাবা। খোদা ভরসা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের এই নদীটা যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিশেছে সেই মোহনায় গিয়ে তুমি দাঁড়াও-দেখবে, সব পথের সন্ধান পেয়ে যাবে।

মায়ের কথামতো মহম্মদ সমুদ্র-মোহনায় গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু এদিক ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোনও জনমানুষের সন্ধান পেলো না। হতাশ হয়ে ফিরে আসবে এমন সময় জল থেকে লাফিয়ে একটা চ্যাং মাছ ডাঙায় উঠে এসে মানুষের মতো বলতে লাগলো, আমাকে চিনতে পারছে মহম্মদ, আমি তোমাদের জালে ধরা পড়েছিলাম একদিন। সেদিন তোমার দয়াতেই প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলাম। আজ তোমাকে মনে হচ্ছে খুব চিন্তিত। কিন্তু কী ব্যাপার বলো

তো বন্ধু?

মহম্মদ বলে, ব্যাপার গুরুতর, আমার ওপর সুলতানের হুকুম হয়েছে, সবুজ দেশের শাহজাদীকে নিয়ে এসে দিতে হবে তার ছেলের জন্য। কিন্তু সে দেশটা কোথায়, কী ভাবেই বা যাবো, কিছুই আমার জানা নাই।

চ্যাং বললো, মাত ঘাবড়াও। আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো সেই দেশে।কিন্তু সবুজ দেশের সুলতান বড় কড়া মেজাজের মানুষ। তার সামনে দাঁড়ালেই শূলে চড়াবে তোমাকে। যাই হোক, আমি যখন সঙ্গে থাকবো তখন তোমার ঘাবড়াবার কিছু নাই। সব পথ বাতলে দেব। তার আগে তুমি উজিরের কাছে বলল, সে দেশের শাহজাদীকে আনতে হলে সোনার তরী চাই। সে নৌকো ভোগবিলাসের যাবতীয় সামগ্রীতে ঠাসা হতে হবে। তা না হলে শাহজাদীর মন উঠবে কেন?

মহম্মদের ফরমাশ মতো সোনার পানসী-নৌকা বানিয়ে দিলো উজির। নানা রত্ন-মাণিক্যে সাজিয়ে দিলো সুন্দর করে।

মহম্মদ মা-বাবার কাছে বিদায় নিয়ে নৌকো ছেড়ে দিলো।

চ্যাং বন্ধু আগে আগে পথ দেখিয়ে চলে। মহম্মদের আর কোনও অসুবিধা হয় না। আটদিন পরে সবুজদ্বীপের ঘাটে এসে নৌকো ভিড়ে। সোনার নৌকো দেখার জন্য শহরবাসীরা ভেঙ্গে পড়ে। আজব বস্তু, এমন জিনিস না দেখে কি থাকা যায়।

চ্যাঙের পরামর্শে নৌকো ছেড়ে ডাঙ্গায় নামলো না মহম্মদ। দলে দলে শহরবাসীরা এসে নৌকোর চমৎকারিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে চলে যায়।

এইভাবে একটা সপ্তাহ কেটে গেলো, মহম্মদ চ্যাংকে জিজ্ঞেস করলো, এভাবে আর একা একা এখানে কতদিন বসে থাকবো বন্ধু?

চ্যাং বললে, সবুর কর বন্ধু, সময়ে মেওয়া ফলবে। সারা সবুজ শহরে লোকের মুখে সোনার তরী ছাড়া আর কোনও কথা নাই। শাহজাদী সুলতানের কাছে আব্দার ধরলো, আব্বাজান, শুনেছি আমাদের ঘাটে এক সোনার নৌকো এসে ভিড়েছে। সে নাকি চমক্কার দেখার মতো জিনিস। তুমি আমাকে অনুমতি দাও বাবা, আমি একবার দেখে আসি।

সুলতানের ততটা ইচ্ছা নয়, কিন্তু প্রাণাধিক্য কন্যার কোনও কথা, ঠেলতে পারেন না তিনি। তাই বললেন, ঠিক আছে, কাল সকালে গিয়ে তুমি দেখে এসো। আমি তাঁড়া দিয়ে দিচ্ছি, কেউ কাল বাড়ি এ থেকে পথে বেরুতে পারবে না।

পরদিন প্রত্যুষে জনহীন রাজপথ ধরে শুধুমাত্র সখী পরিচারিকা পরিবৃত হয়ে শাহজাদী ঘাটে এসে পৌঁছলো। মহম্মদ তাকে স্বাগত জানালো নৌকোর ভিতরে এসে সবকিছু দেখার জন্য।

শাহজাদী তার প্রধান পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে নৌকোয় উঠলো।

আহা, কী সুন্দর করে সাজানো গোছানো! কত মূল্যবান হীরে জহরতের নিখুঁত মনোহর কাজ চারধারে! চোখ জুড়িয়ে যায়।

দেখতে দেখতে বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলো শাহজাদী। খেয়ালই ছিলো না, সে এক নৌকোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একটা দোলা লাগাতে চমকে উঠে ছই-এর বাইরে এসে দেখলো, নৌকোটা তীর ছেড়ে অনেকটা ভিতের এসে তরতর করে বয়ে চলেছে। শাহজাদী বুঝতে পারলো সবুজ দ্বীপ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে এসে পড়েছে। মহম্মদকে সে জিজ্ঞেস করলো, এমনটা করলে কেন?

–তা না হলে সহজ পথে তোমাকে তোমার বাবার দূর্গ থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারতাম না।

–কোথায় নিয়ে চলেছ আমাকে?

-ভয় নাই, দোজকে নয়। এক সুলতানের প্রাসাদে। তার পুত্রের সঙ্গে তোমার শাদী হবে। শাহজাদী ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে। কিন্তু সে শাহজাদা দেখতে কেমন? তোমার মতো রূপবান? মহম্মদ বলে সে আমি বলতে পারবো না। চলো, গিয়ে নিজের চোখেই দেখতে পাবে তাকে।

শাহজাদী তার হাতের একটা আংটি জলে ফেলে দিলো। কিন্তু চ্যাং বন্ধু নিচে তলিয়ে যাওয়ার আগেই গপ করে গিলে ফেললো সেটা।

—শাহজাদী বললো, না আমি অন্য কোনও সুলতান বাদশাহর ছেলেকে শাদী করতে চাই না। তোমাকে আমার মনে ধরেছে। তুমিই হবে আমার স্বামী। এসো, আর দেরি করে লাভ নাই, নিচে এই দরিয়ার পানি আর ওপরে ঐ আসমানের চাঁদ সাক্ষী রেখে তোমার আমার শাদী হয়ে গেলো আজ।

শাহজাদীকে বুকে জড়িয়ে সুখ-সম্ভোগের মধ্যে আটটা দিন কেটে গেলো। নৌকো এসে ভিড়লো তার নিজের দেশে সুলতানের প্রাসাদ ঘাটে।

মহম্মদ সুলতানকে গিয়ে বললো, আপনার আদেশ মতো সবুজ দেশের শাহজাদীকে সঙ্গে করে এনেছি, জাঁহাপনা। এবার তাকে যথা মর্যাদায় বরণ করে প্রাসাদে নিয়ে আসতে হবে। ঘাটের সিঁড়ি থেকে প্রাসাদের হারেম পর্যন্ত সারাটা পথ সবুজ রেশমের গালিচায় মুড়ে দিতে হবে। তার ওপরে পা রেখে শাহজাদী হাঁটবেন।

সুলতান উজিরকে নির্দেশ দিলেন, যত অর্থের প্রয়োজন হয় তোক, যেমনটি দরকার ঠিক তেমনি সমাদরে তাকে প্রাসাদে নিয়ে আসতে হবে।

সুলতানের হুকুমে দেশ-বিদেশের মহামূল্যবান সবুজ গালিচা সংগ্রহ করে এনে পেতে দেওয়া হলো। শাহজাদীকে বরণ করে নিতে এলো শাহজাদা।

-আমি তোমাকে আমার বেগম করে রাখতে চাই। তুমি রাজি তো? শাহজাদী বললো, রাজি হতে পারি, একটা শর্তে।

-কী শর্ত? পথে আসতে আসতে দরিয়ার পানিতে আমার হাতের একটা আংটি পড়ে গেছে, সেই আংটিটা আমার চাই, ওটা এনে দিতে হবে।

মহা-সমস্যা; সমুদ্রের জলে যে আংটি পড়ে গেছে তাকে কখনও উদ্ধার করা সম্ভব?

উজির বললো, জাঁহাপনা আপনি কিছু ভাববেন না, এই মওকায় জেলের ছেলেকে খতম করে দেব।

মহম্মদকে ডেকে সে বললো, শোনও জেলের ছেলে, এই শাহজাদীর হাতের আংটি সমুদ্রের পানিতে খোয়া গেছে।ওটা তোমাকে খুঁজে এনে দিতে হবে। না হলে শাহজাদী শাদীতে মত দিচ্ছে না।

চ্যাং বন্ধু আংটিটা যথাসময়ে মহম্মদের হাতে দিয়ে বলেছিলো, এটা শহজাদীর হাতের আংটি। ভালো করে রাখ, সময়ে কাজ দেবে।

মহম্মদ বললো, সে আংটি আমি এখুনি এনে দিচ্ছি।

আংটির সমস্যা মিটে গেলো। এবার শাহজাদী কোন্ ছলনার আশ্রয় নেবে? রাজকুমারী বললো, আমাদের দেশে যে নিয়ম চালু আছে সেই নিয়মেই শাদীর অনুষ্ঠান হতে হবে।

সুলতান তাতেই সম্মত হয়ে বললো, বেশ তাতেই আমি রাজি। বলো তোমাদের দেশের কি প্রথা?

শাহজাদী বলতে থাকে : বাসরঘর থেকে ঘাট পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ কাটতে হবে। সেই। সুড়ঙ্গপথ ধরে পাত্র আসবে গোসল করতে। কিন্তু আসার সময় তাকে সারা সুড়ঙ্গপথ, গনগনে কাঠের আগুনে পা রেখে আসতে হবে। এই ভাবে আগুন-পানিতে শুদ্ধ হয়ে তবে সে আমাকে গ্রহণ করতে পারবে। আমি নৌকোতেই অবস্থান করবে তার জন্য।

সুলতান শঙ্কিত হলো। সুড়ঙ্গ কাটা হলো প্রাসাদকক্ষ থেকে ঘাট পর্যন্ত। এবং সারা সুড়ঙ্গে কাঠের ডালপালা ভরে দেওয়াও হলো। কিন্তু ঐ আগুনের হলকার মধ্যে ছেলেকে নামিয়ে দিতে তার মন সরলো না। রাজকুমারী অবশ্য আশ্বাস দিয়েছিলো, আমাদের দেশে শাদীর মতো পবিত্র বস্তু আর কিছুই নাই। সেই কারণে আল্লাহর আশীর্বাদে পাত্রের দেহে আগুনের আঁচ লাগে না এতটুকু।

তবু সুলতানের ভরসা হলো না। উজির বললো, এক কাজ করা যাক। সুড়ঙ্গের ধুনিতে আগুনি দিয়ে আগে মহম্মদকে পাঠিয়ে দেওয়া যাক। সে যদি অক্ষত শরীরে ঘাটে গিয়ে পৌঁছতে পারে তবে বুঝতে হবে সত্যিই খোদার মাহাত্ম্য আছে। তখন আমরা শাহজাদাকে সঙ্গে নিয়ে সদলবলে সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে ঘাটে গিয়ে শাহজাদীকে বরণ করে নিয়ে আসবো।

সুলতান বললো, আহা কি চমৎকার তোমার বুদ্ধি, উজির!

চ্যাং বন্ধু জল থেকে লাফিয়ে উঠে মহম্মদকে বললো, এবার তোমাকে সুড়ঙ্গের মধ্যে পাঠাবে উজির। তবে তোমার কোনও ভয় নাই, আগুন তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। তুমি শুধু দু’কানে হাত রেখে এই মন্ত্রটা আওড়াতে থাকবেঃ আল্লাহ তোমার দোয়াতেই আমি বেঁচে আছি। ব্যস্ দেখবে তোমার দেহে কোনও উত্তাপ লাগবে না।

সুলতানের আদেশে মহম্মদকে হাজির করা হলো। উজির বললো, মহম্মদ এই সুড়ঙ্গের পবিত্র আগুনের মধ্যে দিয়ে তোমাকে সব আগে ঘাটে গিয়ে পৌঁছতে হবে। আমরা দেখবো, তোমার গায়ে যদি আঁচ না লাগে তা হলে আমরা শাহজাদাকে নিয়ে সুড়ঙ্গ অতিক্রম করবো।

মহম্মদ বললো, ঠিক আছে! সুড়ঙ্গে আগুন দেওয়া হোক। আমি নেমে যাচ্ছি নিচে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো সুড়ঙ্গের কাঠ।

মহম্মদ আল্লাহর নাম স্মরণ করে কানে হাত চাপা দিয়ে নিচে নেমে গেলো। এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অক্ষত দেহে এসে পৌঁছলো ঘাটে।

সুলতানের ভরসা হলো! শাহজাদাকে সঙ্গে করে সদলবলে সে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে নেমে গেলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটার তাই ঘটে গেলো। সুলতান সপরিবারে অঙ্গার হয়ে গেলো নিমেষে।

এর পরের কাহিনী আর না বললেও নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, জাঁহাপনা? চতুর্থ কাপ্তেন তার কাহিনী শেষ করলো।

 

পঞ্চম কাপ্তেন এগিয়ে এলো সুলতান বাইবারসকে গল্প শোনাবার জন্য।

-তাহলে শুনুন জাঁহাপনা। সে বলতে থাকে–

একদা এক সুলতান তার উজিরকে বললেন, দেখ উজির, আমি এমন একটা আংটি চাই যা পরলে আমার ইচ্ছামতো ক্রুদ্ধ বা আনন্দিত হতে পারি।

উজির বাজারে গিয়ে প্রতিটি স্যাকরাকে বললো সুলতানের অভিপ্রায়। কিন্তু কেউই বানিয়ে দিতে পারে বলে জানালো না।

সুলতান শুনে রুষ্ট হলেন। বললেন, কী আশ্চর্য, এই সামান্য একটা বস্তু আমার সলনিয়তে সংগ্রহ করা যাবে না? যাও, তুমি শহর ছেড়ে দূর দেশে চলে যাও। যেখান থেকে পার নিয়ে এসো ঐ রকম একটা আংটি।

সুলতানের হুকুম তামিল করতে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যায় উজির।

এক বৃদ্ধ শেখ তার খামারবাড়িতে গম ঝাড়াই করছিলো। উজির তার কাছে গিয়ে বললো, আচ্ছা শেখ সাহেব, এমন কোনও গুণী লোকের সন্ধান দিতে পার, যে একটা আংটি বানিয়ে দিতে পারে। সে আংটি পরলে ইচ্ছামত ক্রোধ বা পুলক জাগতে পারে?

বৃদ্ধ চাষী বললো, আপনি একটু অপেক্ষা করুন জনাব, আমি আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে আসি।

বৃদ্ধের কিশোরী কন্যা অসাধারণ রূপগুণবতী। সব শুনে সে বললো, হ্যাঁ বাবা, আমি পারি। আমি বানিয়ে দেব। তুমি মেহেমানকে এখানে খানাপিনা করতে বলল। আমি তার মধ্যে তৈরি করে দিচ্ছি আংটিটা।

সুলতান আংটিটা পেয়ে আনন্দিত হলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই আংটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে বুঝলেন, প্রকৃতই আংটিটির দৈব ক্ষমতা আছে। উজিরকে তিনি বললেন, এমন যে গুণবতী কন্যা, তাকে আমি শাদী করতে চাই। তুমি ব্যবস্থা কর, উজির।

পরদিনই মহাধুমধামে সুলতানের সঙ্গে কৃষক-কন্যার শুভ পরিণয় হয়ে গেলো। চাষীর মেয়ে এসে উঠলো সুলতানের হারেমে।

কিন্তু কয়েকদিন পরে চাষী-কন্যা যুঁই অসুস্থ হয়ে পড়লো। হাকিম ডাকা হলো। তিনি বললেন, গ্রামের মেয়ে, খোলামেলা জায়গায় থাকা অভ্যেস। হারেমের বদ্ধঘরে এসে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এ ছাড়া অন্য কোনও রোগ নাই তার। ওকে : একটু নির্মল বায়ু সেবন করানো দরকার।

সুলতান উজিরকে বললেন, নদীর ধারে আমার প্রমোদ-প্রাসাদে বেগমকে রাখা হবে, তুমি সব ব্যবস্থা কর।

সুলতানের ইচ্ছায় সেইদিনই – নদীতীরের প্রাসাদে যুঁই-এর থাকার ব্যবস্থা হলো।

জানলা খুললেই সামনে স্রোতস্বিনী। ঝিরঝির করে সুশীতল হাওয়া বয়ে চলে সারাক্ষণ। সুন্দরী যুঁই জানলার পাশে বসে নদীর মনোহর দৃশ্য দেখে দেখে পুলকিত হয়।

একদিন সে জানলার পাশে বসে এক জেলের মাছ ধরা দেখছিলো। লোকটা এক একবার জাল ফেলে গুটিয়ে আনছে আর এক এক ঝুড়ি রুপোলী মাছ তুলছে।

জেলেটাকে ডেকে সে বললো, এই শোনো, আমার জন্য একবার জাল ফেলতো। আমি তোমায় একটা মোহর দেব। তবে যা উঠবে সব আমার।

জেলে বললো, তোমার মতো সুন্দরীর হাত থেকে পয়সা নেব না। আমি এমনিই তোমার জন্য একবার জাল ফেলেছি।

সেবারে জালে কোনও মাছ উঠলো না। উঠলো একটা তামার কৌটো। ঢাকনা দিয়ে মুখটা ঢাকা। যুঁই একটা দিনার দিতে গেলো জেলেকে। ওটা আমাকে দিয়ে দাও, এই নাও তোমার মোহর।

জেলে তাম্রপাত্রটি সুন্দরীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললো, পয়সা আমি নেব না।

যুঁই বলে, সে কি, তা কি করে হয়? তুমি আমাকে শুধু শুধু দেবে তা হয় না।

জেলের ছেলে বলে, তা যদি দেবার এতই ইচ্ছে তবে সোনা-দানা কিছু চাইনে, তোমার অধরে ছোট্ট একটা চুম্বন করবো, এই অনুমতি দাও।

যুঁই শিহরিত হয়ে ওঠে। জেলের ছেলের লৌহ-কঠিন বলিষ্ঠ বাহুপেশীর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সে। ওর প্রার্থনা একেবারে নামঞ্জুর করতে পারে না। জানলা দিয়ে মুখখানা সে বাইরে বাড়িয়ে দেয়। ছেলেটাও এগিয়ে আসে চুম্বন বাসনায়। কিন্তু মুহূর্তে বিপর্যয় ঘটে যায়। সুলতান স্বয়ং সব শুনে ফেলেছিলেন। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে এসে তরবারীখানা আমুল বসিয়ে দেন তার বুকে।

তারপর যুঁই-এর দিকে অগ্নিবাণ হেনে বলে, আমার হারেম তোমার জন্য নয়। তোমার যেখানে খুশি চলে যেতে পার।

যুঁই পথে নেমে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে সে এক সময় এসে পৌঁছয় শহরের অপর প্রান্তে। এক দোকানের দাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে।

পরদিনও দোকানদার যুঁইকে একই জায়গায় একইভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, কে গো বাছা, কাল থেকে দেখছি তুমি এইখানে বসে আছ?

যুঁই বলে, আমি পরদেশী। আজ দু’দিন আমার খাওয়া হয়নি কিছু।

—আহা, তা বলনি কেন? চলো আমার বাড়িতে চলো। সেখানে খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে নেবে।

যুঁইকে সঙ্গে করে দোকানদার তার বাড়িতে এসে বৌকে বলে, দেখ, এই মেয়েটি আজ দুদিন অনাহারে আছে। একে কিছু খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ কর।

দোকানীর বৌ যুঁই-এর রূপে ঈর্ষান্বিত হয়ে নিগ্রো নফরটাকে বলে, এই আঁটকুড়িটাকে মুরগীর ঘরে নিয়ে গিয়ে তালা দিয়ে রাখ।

সারাটা দিন কেটে গেলো, কিন্তু খানাপিনা কিছুই দিয়ে গেলো না কেউ। যুঁই খিদেয় ছটফট করে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যেতে থাকে। কিন্তু এক বিন্দু জলও ওরা পাঠালো না।

অবশেষে তামার কৌটোটার ঢাকনা খুলে ফেলে সে। নদীর তলায় পড়েছিলো, হয়তো একটুও জল থাকতে পারে ওতে।

কিন্তু ঢাকনাটা খুলেই সে অবাক হয়ে গেলো। কৌটোটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা সুন্দর জলের ঝারি। আর বেরুলো খানকয়েক রেকাবী। সেগুলো মেঝেয় বিছিয়ে পাততেই নানারকম মুখোরচক খানায় পূর্ণ হয়ে উঠলো।

যুঁই-এর ক্ষুধাও ছিলো ভীষণ। কী করে সে সব সংঘটিত হলো তখন আর ভাববার সময় নাই যুঁই-এর। গোগ্রাসে সে খেয়ে নিলো সব।

খাওয়া শেষ করে কৌটোটার দিকে লক্ষ্য করতে সে দেখতে পেলো তার ভিতরে ছোট্ট ছোট্ট কতকগুলি সুন্দর সুসজ্জিত পুতুল। ওগুলো বের করে সামনে রাখতেই পুতুল-সুন্দরীরা পলকে পরমাসুন্দরী কিশোরীর আকার ধারণ করে নানা ছন্দে নাচতে থাকলো।

দশজন নাচুনীর হাতে দশটি তোড়া ছিলো।

নাচতে নাচতে এক সময় তারা সেগুলো যুঁই-এর পায়ের কাছ নামিয়ে রাখলো। তারপর নাচ শেষ করে এক সময় আবার তারা ঢুকে পড়লো ঐ কৌটোর ভিতরে।

যুঁই-এর মনে আর দুঃখ নাই। সারাদিনে রাতে যখনই প্রয়োজন কৌটোটা খুললেই খানাপিনা পেয়ে যায় সে। তার সঙ্গে প্রতিবারই ঐ দশটি সুন্দরী নাচ শেষ করে প্রণামী রেখে যায় দশটি মোহরের হোড়া।

কয়েকদিন পরে নিগ্রো নফরটা মালকিনকে জিজ্ঞেস করে, মালকিন, ঐ মেয়েটি যাকে মুরগী ঘরে তালা দিয়ে রেখে এসেছিলাম তাকে তো খানাপিনা কিছু দেওয়া হয়নি?

দোকানীর বৌ ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে তুই থামতে, ও বিদেয় হয়েছে।

নিগ্রোটার কিন্তু বিশ্বাস হয় না সে কথা। মুরগী-ঘরে গিয়ে দেখে মেয়েটা সেইখানেই শুয়ে আছে।

চাকরটা দোকানীর কাছে ছুটে গিয়ে খবর দেয়। দোকানদার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট বন্ধ করে বাড়িতে বৌকে গালমন্দ করে মুরগীর ঘরে যায়।

যুঁই বলে, আল্লাহর দোয়ায় পেট ভরেই খেয়েছি এতদিন।

দোকানী বলে এবার তুমি কী করবে, বাছা? কোথায় যাবে বলো, আমি তোেমাকে পৌঁছে দেব।

যুই টাকার থলেগুলো দোকানীর হাতে তুলে দিয়ে বলে, এই শহরে আমি একখানা চমৎকার বাড়ি বানাতে চাই। এই নিন টাকা—দরকার হলে আরও অনেক দেব। আপনি আমাকে একখানা সুরম্য প্রাসাদ বানিয়ে দিন।

কয়েকদিনের মধ্যেই বিশাল প্রাসাদ তৈরি হয়ে গেলো যুঁই-এর জন্য। ইতিমধ্যে যুঁই-এর মুরগী-ঘর মোহরের তোড়ায় ভরে গেছে।

বাজারের সবচেয়ে সেরা সেরা জিনিসে প্রাসাদের কক্ষ সাজানো হলো। যুঁই এক যুবক। সুলতানের ছদ্মবেশ পরে এসে উঠলো তার প্রাসাদে।

সুলতান উজিরকে সঙ্গে নিয়ে শহর-পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন ছদ্মবেশে। চলতে চলতে তিনি যুঁই-এর মনোহর প্রাসাদের সামনে এসে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। উজিরকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা উজির, এখানে তো এই প্রাসাদটা ছিলো না। কী ব্যাপার, এ তো দেখছি আমার প্রাসাদের চেয়েও সুরম্য। মনে হচ্ছে, অন্য কোনও দেশের সুলতান আমার শহরে ঢুকে পড়েছে, আমার অনুমতি ছাড়াই।

উজির বললো, আপনি কাল শহরে উঁাড়া দিয়ে জানিয়ে দিন জাঁহাপনা, কাল রাতে কেউ আলো জ্বালাতে পারবে না। যদি দেখেন এই প্রাসাদও অন্ধকার হয়ে আছে তবে বুঝবেন সে আপনার অনুগত এক প্রজামাত্র। কিন্তু আপনার নির্দেশ অমান্য করে সে যদি আলো জ্বালায় তবে বুঝতে হবে সে অন্য কোনও পরাক্রমশালী সুলতান বাদশাহ আপনার সলনিয়ত জবরদখল করে বসেছে।

সুলতানের ফরমান শহরবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হলো পরদিন সকালেই! সন্ধ্যায় সুলতান এবং উজির আবার পথে বেরুলেন ছদ্মবেশে। পথ ঘাট ঘরবাড়ি সারা শহর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধু ঐ প্রাসাদটি আলোয় ঝলমল করছে। সুলতানের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। কোনও এক যুদ্ধবাজ আক্রমণকারী বাদশাহ তার শহরে অনধিকার প্রবেশ করেছে।

পরদিনও একই ফরমান জারী করা হলো। সে রাতেও কেউ আলো জ্বালালো না। কিন্তু ঐ প্রাসাদ আলোয় আলোময় হয়ে রইলো।

সুলতান বললেন, আর দেরি করে লাভ নাই উজির, চলো আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। জানতে চাইবো, কেন সে আমার শহরে প্রবেশ করেছে?

উজির বাধা দিয়ে বললো, আগেই আপনার পক্ষে যাওয়া সহজ হবে না জাঁহাপনা। ব্যাপারটা কী আমি গিয়ে পরখ করে আসি প্রথমে, তারপর আপনি যাবেন।

সুলতান বললেন, ঠিক আছে আজ তাহলে তুমিই দেখে এসো। আমি প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছি।

দ্বাররক্ষীর কাছে বলতেই সে উজিরকে এক বিশাল দরবার-মহলে নিয়ে এলো। ঘরের মাঝখানে একটি সোনার সিংহাসনে যুঁই তরুণ সুলতানের ছদ্মবেশে আসীন ছিলো। উজিরকে দেখা মাত্র সে তাকে চিনতে পারলো। আদর করে বসতে দিলো পাশের আসনে। সঙ্গে সঙ্গে নানারকম খানা-পিনা এলো। যুঁই উজিরকে অনুরোধ করলো, আপনি অতিথি, মেহেরবানী। করে আহারাদি সমাধা করুন।

উজির গোগ্রাসে উদরস্থ করলো সব। যুঁই তাকে একটা মোহরের তোড়া উপহার দিয়ে বললো, আপনার সাজ-পোশাক দেখে মনে হচ্ছে আপনি অতি গরীব-সরীব মানুষ।দয়া করে এই তোড়াটা রেখে দিন।

উজির ফিরে এসে সুলতানকে ঐ প্রাসাদ এবং তার প্রিয়দর্শন তরুণ সুলতানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো, আপনি বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, অত ঐশ্বৰ্য্য আমি জীবনে দেখিনি কখনও। টাকা যেন তার কাছে খোলামকুচি। দু’হাতে বিলিয়ে দিচ্ছে। এই দেখুন, না চাইতে আমাকে কত মোহর দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, বিপদ আসন্ন। তার অর্থ এবং পরাক্রম আমাদের তুলনায় ঢের বেশি বলে আমার মনে হয়েছে। সুতরাং আত্মরক্ষার উপায় দেখতে হবে আমাদের।

সুলতান বললেন, কাল সন্ধ্যায় আমি নিজে যাবো সেখানে। স্বচক্ষে দেখে এসে তারপর যা করার করা যাবে।

পরদিন সন্ধ্যাবেলায় সুলতান এক বণিকের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লেন। প্রহরীকে বলতেই সে সসম্মানে সুলতানকে যুঁইএর সিংহাসন সম্মুখে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করলো।

যুঁই অলক্ষ্যে মৃদু হেসে সাদর অভ্যর্থনা জানালো তাকে। খানা-পিনায় আপ্যায়ন করলো যথোচিত। তারপর কৌটোটা থেকে দশটি ঘোট ঘোট পুতুল সামনে দাঁড় করাতেই চোখের পলকে তারা এক একটি পরমাসুন্দরী কিশোরীতে রূপান্তরিত হয়ে সুললিত ছন্দে নৃত্য করতে লাগলো। পরিশেষে প্রত্যেকে তাদের হাতের তোড়া যুঁই-এর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে আবার কৌটোর কোটরে ঢুকে পড়লো।

সুলতান বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন।

—এ বস্তু আপনি কোথা থেকে কিনেছেন সুলতান?

যুঁই বললো, না, কিনিনি। একজন আমাকে দিয়েছে।

—দিয়েছে? এমন জিনিস কেউ শুধু শুধু হাতছাড়া করে?

—শুধু শুধু নয়, অর্থের বিনিময়ে আমি তার কাছ থেকে কিনতে চেয়েছিলাম প্রথমে। কিন্তু সে রাজি হয়নি। তার দাবী ছিলো অন্য। অবশেষে সেই দাবীই পূরণ করে এটা পেতে হয়েছে আমাকে।

—কী ছিলো তার দাবী? যুঁই লজ্জারক্ত হয়ে বলে, সে কথা খোলাখুলি আপনাকে কী করে বলি? তবে জেনে রাখুন একটা মোরগ একটা মুরগী দেখলে যা করতে চায় তাই সে একটি বার দাবী করেছিলো আমার কাছে। এবং বুঝতেই পারছেন, আমি তা পূরণ করেছিলাম।

যুই এখানে কিছুটা মিথ্যা ভাষণ করলো।

সুলতান উত্তেজিত হয়ে বললো, ঠিক আছে আমি একবার নয় দু’দুবার সে কর্মে রাজি আছি। আপনি আমাকে ওটা দিন।

যুঁই আর হাসি চেপে রাখতে পারে না। কিন্তু এখনই হেসে ফেললে সব মাটি হয়ে যাবে। সে বললো, দু’বারে তো আমার সুখ হবে না, সাহেব? অন্ততঃ চারবার চাই।

সুলতান তৎক্ষণাৎ বললো, আমি তাতেই রাজি। কিন্তু ওটা আমার চাই-ই, সুলতান। আমাকে ফেরাবেন না আপনি।

যুঁই বলে, না ফেরাবো না। তবে এই দরবার-মহলে তো সে কাজ হবে না। আপনি পাশের শয়নকক্ষে চলুন।

সুলতানের আর তর সয় না। সে তখুনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, চলুন তা হলে পাশের ঘরে এসে সুলতান হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

যুঁই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

-আপনি এই সলতানিয়তের বাদশা। আপনার বিত্ত বৈভব পরাক্রমের অন্ত নাই। কিন্তু সামান্য একটা তাম্র-পাত্রের জন্যে একি আপনার লালসা! তার জন্য অতি জঘন্যতম কাজে লিপ্ত হতেও পিছ-পা হন না আপনি। অথচ এই আমি আপনার বেগম এই বস্তু এক ধীরব-সন্তানের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম ছোট্ট একটি চুম্বনের প্রতিশ্রুতিতে। আহা বেচারা, তার মনের সাধ মনেই রয়ে গেলো। এ জীবনের মতো আর কোনও দিন কোনও নারীকে চুম্বন করতে পারবে না সে। আপনার শাণিত তরবারী তার জীবনের সব সাধ ঘুচিয়ে দিয়েছে সেদিন।

সুলতান স্তব্ধ, বিস্মিত, বিমূঢ়!

এই সেই যুঁই—তার বেগম। একে তিনি একদিন প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন পরকীয়া প্রেমের অপরাধে!

সুলতান দু’হাত বাড়িয়ে যুইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তার মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। শুধু তাকে বুকে চেপে হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব করার চেষ্টা করতে থাকেন।

কাপ্তেন গল্প শেষ করে থামে। সুলতান বাইবারস মুগ্ধ হয়ে বলে, চমৎকার তোমার কাহিনী নূর অল দিন।

এরপর ষষ্ঠ কাপ্তেন এগিয়ে এসে তার কাহিনী শুরু করে।

এক সুলতানের পরম রূপবতী এক কন্যা জন্মেছিলো। যখন তার বয়স সবে সাত, সেই সময় সে একদিন মাথায় চিরুণী দিতে দিতে একটা ঢাউস উকুন খুঁজে পেলো। উকুনটাকে সে এক তেলের শিশিতে পুরে মুখে ছিপি এঁটে ভাড়ার ঘরের তাকে রেখে দিলো।

এরপর অনেক কাল কেটে গেছে। শাহজাদীর আর স্মরণে নাই কবে ছোটবেলায় সে একটা শিশিতে ভরে রেখেছিলো।

শাহজাদী এখন প্রায় যোড়শী। আরও সুন্দরী, আরও চমৎকার হয়েছে দেখতে।

একদিন সে সুলতানের পাশে দাঁড়িয়েছিলো দরবারে। এমন সময় উন্মত্ত মোষের মতো দাপাতে দাপাতে সেখানে এসে হাজির হলো কিম্ভুত কিমাকার এক জানোয়ার।

শাহজাদী শিউরে উঠলো, সর্বনাশ বাবা, ঐ জানোয়ারটা আসলে একটা উকুন। ওকে আমি খুব ছোটবেলায় একটা তেলের শিশিতে পুরে রেখেছিলাম।

সুলতান উজিরকে বললেন, ওটাকে মেরে ওর ছাল ছাড়িয়ে প্রাসাদের সদর ফটকে ঝুলিয়ে রাখ। ঘোষণা করে দাও, যে ঐ ছালটা দেখে বলতে পারবে কিসের, কোন্ প্রাণীর চামড়া, তার সঙ্গে আমার কন্যার শাদী দেব। কিন্তু যদি কেউ বলতে এসে ঠিক ঠিক বলতে না পারে তবে তার মুন্ডুকেটে ঝুলিয়ে রাখা হবে ফটকে।

সুলতানের কুমমতো উজির জাদকে নির্দেশ করতে সে খাঁড়ার এক কোপে ঐ বিশালাকৃতি উকুনটাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো। এবং সেই দিন তার ছালটা ছাড়িয়ে প্রাসাদ-ফটকে লটকে দিয়ে ঘোষণা করে দেওয়া হলো সুলতানের ফরমান।

দেশ-বিদেশ থেকে কত সুলতান বাদশাহর ছেলেরা এসে প্রাণ বিসর্জন দিলো। কেউ বললো, ওটা একটা বুনো মোষ, কারো বা ধারণা, ওটা এক ধরনের রামছাগল। প্রায় চল্লিশটি শাহজাদার নরমুণ্ড প্রাসাদ-ফটকে ঝুলতে লাগলো।

অবশেষে একদিন অপূর্ব সুন্দর শাহজাদা এসে বললো, আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি ওটা একটা বৃহদাকার উকুনের চামড়া। উকুনটা বহুকাল তেলের শিশিতে আবদ্ধ ছিলো। কিন্তু একদিন সে বিরাট আকার ধারণ করে তৈলপাত্র ভেঙ্গে-চুরে বাইরে বেরিয়ে আসে।

সুলতান আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, ঠিক-ঠিক বলেছ তুমি! তাহলে তুমিই আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করবে।

সেইদিনই কাজীকে ডেকে শাদীনামা তৈরি করা হলো। মহা আড়ম্বরে সমাধা হয়ে গেলো শাহজাদীর শাদী।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো ছেচল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে—

একটানা চল্লিশ দিন ব্যাপী উৎসবে মুখর হয়ে থাকলে সারা শহর-প্রাসাদ।

তারপর জামাতা এসে সুলতানকে বললো, এবার অনুমতিকরুন জাঁহাপনা, আমার বেগমকে আমি দেশে নিয়ে যাই। আমার মা বাবা সবাই অধীর হয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমিও বাদশাজাদা, সুতরাং চিরকাল তো শ্বশুরালয়ে পড়ে থাকা আমার শোভা পায় না!

সুলতান বললেন, সে তত একশোবার। তোমার শাদী করা বেগম-তাকে স্বদেশে নিয়ে যাবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে! ঠিক আছে, কালকের দিনটা অপেক্ষা কর,

তোমার দানযৌতুক সব গুছিয়ে দিক আমার নফর চাকররা।

জামাতা বললো, ওসবের কিছু প্রয়োজন নাই, জাঁহাপনা। ঐশ্বর্য আমার অগাধ আছে। আমি শুধু আপনার কন্যাকেই নিয়ে যেতে চাই।

সুলতান বললেন, বেশ তাই হবে। তবে কনের সঙ্গে তার মাকেও নিয়ে যাও। সে দেখে আসুক তোমাদের দেশ। চিনে আসুক পথঘাট—যাতে সময়ে অসময়ে আমাদের সে পথ নির্দেশ করে নিয়ে যেতে পারবে তোমার শহরে।

—শাশুড়ীকে আবার কেন, জামাতা আপত্তি জানায়, তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। পথের ধকল তর সইবে না। বরং আমিই মাঝে মাঝে এনে দেখিয়ে যাব আপনাদের কন্যাকে।

সুলতান বললেন, অতি উত্তম। তবে তাই হোক, আজই তুমি যাত্রা কর। এই শাহজাদা জামাতাটি আসলে কোনও সুলতান বাদশাহ-পুত্র নয়। একটি বহুরূপী দানব। পর্বত-চূড়ায় তার আবাস। সে শাহজাদীকে সেখানেই নিয়ে গিয়ে তুললো।

শাহজাদী দু-একদিনেই স্বামীর অন্য পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠলো। সারাদিন সে বাইরে বাইরে কাটায়। রাতের বেলায় যখন সে ফিরে আসে তখন সারা অঙ্গ রক্তমাখা হয়ে থাকে। শাহজাদী আন্দাজ করতে পারে তার স্বামী অনেক হত্যাকাণ্ড সমাধা করে এসেছে।

একদিন সে একটা নরমুণ্ড হাতে ঝুলিয়ে ঘরে ফিরে এসে বললো, এটাকে বেশ ভালো করে পাকাও দেখি।

শাহজাদী আতঙ্কে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বললো, একি বলছো তুমি? আমি কি নরমাংস খাবো?

দানব আর জুলুম করলো না। আবার বাইরে বেরিয়ে গেলো তখুনি। এবং ক্ষণকালের মধ্যে একটা নাদুস-নুদুস ভেড়া মেরে নিয়ে এলো।

সারাদিন দানবটা নানা জন্তু-জানোয়ারের ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে সারা দেশ তছনছ করে বেড়ায়। তার আতঙ্কে কত গর্ভবতী নারী অকালে মৃতাবসা হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা জাগে না। বনের সিংহের সঙ্গে লড়াই করে অবলীলাক্রমে প্রাণ সংহার করে তার। অথচ সে যখন ঘরে ফিরে আসে তার বিবির কাছে, তখন সে একেবারে অন্যরকম। শান্তশিষ্ট নিরীহ প্রিয়দর্শন এক যুবকের রূপ ধরে হাজির হয় সে শাহজাদীর সামনে।

একদিন মায়াবী দানবটা শাহজাদীর মায়ের রূপ ধারণ করে নিজের বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লো। শাহজাদী জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো তার মা এসেছে। ছুটে গিয়ে সে দরজা খুলে জড়িয়ে ধরলো দানবকে, মা, মা তুমি এসেছ? কিন্তু এই দুর্গম পথ একা একা এলে কি করে মা?

মায়াবী দানব বলে, ভালোবাসার টানে মা, ভালোবাসার টানে। পেটে তো এখনও ধরিসনি, যদি তার দয়ায় দুটি-একটি হয় তখন বুঝবি, সন্তান কি বস্তু!

—তা মা শুনলাম, তোর স্বামী একটা মায়াবী দানব? সে নাকি তোকে নরমাংস খেতে বলে? এই কথা শুনে আমি তো আর রাতে ঘুমাতে পারি না, মা। না না—দৈত্যদানবের কাছে তোকে আর রেখে যাব না আমি। এখন সে ঘরে নাই, এই ফাঁকে চলো আমরা কেটে পড়ি এখান থেকে।

মায়ের কথায় প্রসন্ন হতে পারে না শাহজাদী। বলে, কে তোমাকে এই আজগুবি কথা জানিয়েছে, মা। আমার স্বামী মানুষ নয় মায়াবী দানব, সে আমাকে নরমাংস খাওয়াতে চায়, এসব তো ডাহা মিথ্যা কথা মা। আমি খুব সুখে আছি আমার স্বামীর কাছে। তার আদর সোহাগ রাখবার জায়গা নাই আমার। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে দেশে ফিরে যাও মা, আমার জন্য কোনও দুশ্চিন্তা করো না।

মায়াদানব নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। যাক, তার বিবি তাকে সত্যিই ভালোবাসে প্রাণ দিয়ে।

কিছুক্ষণ পরে সে আবার তার মানব রূপ ধারণ করে একটা ভেড়া কাঁধে করে ফিরে আসে। দল-অল স্বামীকে বলে, জান, আজ মা আমাকে দেখতে এসেছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে চাইলো না।

-ইস, আজই ফিরতে আমার দেরি হয়ে গেলো। তোমার মা-এর সঙ্গে দেখা হলে বড় আনন্দ পেতাম। তোমার এক মাসী আছে না? তাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?

দল-অল লাফিয়ে ওঠে, করে না আবার! কিন্তু কে তাকে নিয়ে আসবে? মায়াদানব বলে, কাল আমি তাকে খবর দিয়ে আসবো।

কয়েকদিন বাদে মায়াদানব দল-অল-এর মাসীর মূর্তি ধারণ করে এসে দরজায় করাঘাত করলো।

মাসীকে দেখে দল-অল-এর আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু মাসী হা-হুতাশ করে কেঁদে আকুল। বলে, হায়-হায়-হায়, একি সর্বনাশ হলো! শেষ পর্যন্ত তোর ভাগ্যে লেখা ছিলো এক মায়াদানব!

আনন্দে উদ্ভাসিত দল-অল মুহূর্তে ক্রোধে ফেটে পড়ে চুপ কর মাসী। আমার স্বামীর সম্বন্ধে যা তা কথা তোমার মুখে শোভা পায় না। কে বলেছে, কোথা থেকে শুনেছ এইসব আজগুবী খবর? আমার স্বামী এক বাদশাহর ছেলে। আমার বাবার চেয়ে ঢের ঢের বেশি তার ঐশ্বর্য সম্পদ। আর তার মতো রূপবান পুরুষ কেই বা কটা দেখেছে, মাসী?

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে! শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো সাতচল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

মাসী-বেশী মায়াদানবকে অল-দল ভেড়ার মাংস দিয়ে ভুরিভোজন করালো।

—খেলে তো মাসী, কীসের মাংস আমরা খাই তা নিজেই বুঝতে পারলে?

তোমার তো ধারণা আমরা নরমাংস ছাড়া আহার করি না। ছি, ছি, এতো নীচ তোমাদের ধারণা!

মাসী বললো, আমি না হয় বুঝলাম, বাছা। কিন্তু কত লোকে কত কী বলে যাচ্ছে তোর বাবার কাছে। একবার তিনি এসে চক্ষে দেখে গেলে ভালো হতো।

বেশ তো মাসী, বাবাকে একবার আসতে বলো না আমার বাড়িতে। তার প্রাণাধিক কন্যা কি নিদারুণ দুঃখ কষ্টে কাটাচ্ছে নিজের চোখেই তিনি দেখে যান।

মাসী বললো, বেশ তাই বলবো, এখন চলি বাছা।

একটু পরে মায়াদানব আবার মানুষরূপ ধরে একটা ভেড়া কাঁধে করে ঘরে ফিরে আসে। সব শুনে বলে, আমার বরাতটাই খারাপ, একটুর জন্য মাসীর সঙ্গে দেখা হলো না।

কয়েকদিন পরে সে দল-অল-এর পিতা সুলতানের রূপ ধরে এসে উপস্থিত হলো। বাবাকে পেয়ে কন্যা আকুল হয়ে ছুটে গেলো। সুলতানরূপী মায়াদানব দল-অলকে আদর করে সাশ্রনয়নে বললেন, মা, এই তোর ভাগ্যে ছিলো! শেষে আমি তোকে একটা মায়াবী দানবের হাতে তুলে দিলাম।

বাবার চোখের জল দেখে সব গোলমাল হয়ে গেলো দল-অল-এর! ফিসফিস করে বললো, চুপ, বাবা, আস্তে। হয়তো সে এখুনি এসে পড়বে। জান বাবা, সে সত্যিই কোনও সুলতান বাদশাহর ছেলে নয়। দানবই বটে। প্রথম প্রথম সে আমাকে নরমাংস খাওয়াবার অনেক চেষ্টা করেছিলো। আমি খেতে অস্বীকার করায় সে অবশ্য আমাকে জোর-জুলুম করেনি। তারপর থেকে রোজ একটা করে ভেড়া নিয়ে আসে সে আমার জন্য। কিন্তু নিজে খায় মানুষের মাংস। আমার ভয় হয় বাবা, একদিন না সে আমাকে মেরে খেয়ে ফেলে!

দল-অল-এর শেষ কথাটা তার মুখেই রয়ে গেলো, মায়াদানব তার ভয়াল ভয়ঙ্কর দানবের রূপ ধারণ করে দাঁতমুখ খিচিয়ে তেড়ে এলো। বলা বাহুল্য আতঙ্কে শিউরে উঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেলো দল-অল।

—হুম্, এবার বুঝেছি, তুমি আমার নামে কি রকম নিন্দে করেছ তাদের কাছে।

দল-অলকে এক হাত দিয়ে তুলে আবার ছুঁড়ে দিলো সে।

-আমাকে বাঁচাও, প্রাণে মেরো না। কসম খাচ্ছি, আর কক্ষনো কাউকে বলবো না।

-তোমাকে আর বিশ্বাস করি না। তোমার যখন ধারণাই হয়েছে কোনদিন তোমাকেই আমি খেয়ে ফেলবো, সে ধারণা আমি মিথ্যে হতে দিতে পারি না। আমি তোমাকে খাব? কিন্তু বলল, কোন্‌দিক থেকে শুরু করবো?

দল-অল আর্তনাদ করে ওঠে, এই আমার নিয়তি। এইভাবে তোমার হাতে আমাকে মরতে হবে, আমি তা ঠেকাবো কেমন করে।ঠিক আছে, তোমার যখন ইচ্ছে, খেও, আমাকে। কিন্তু আজ আমার শরীর ননাংরা হয়ে আছে। এই অবস্থায় আমার দেহের মাংস খেতে তোমার আস্বাদ লাগবে না। আমাকে হামামে নিয়ে চলো, আগে আমি ঘষে মেজে গোসল করে সাফ হয়ে উঠি তারপর আমি নিজে থেকেই তোমার খাবার টেবিলে বসবো। তখন তুমি আমার শরীরের যেখান থেকে শুরু করতে ইচ্ছে কর, করো; তখন তোমার রুচিও হবে, খেতেও ভালো লাগবে আমাকে।

দল-অলের কথা মায়াদানবের মনে ধরলো। বললো, ঠিক আছে তাই হবে।

তৎক্ষণাৎ সে স্নানের কাপড়-চোপড় এবং একটা বড় সোনার গামলা সঙ্গে নিয়ে তার একটা অনুচর ভৃত্যকে যাদুবলে গাধায় রূপান্তরিত করে এবং নিজে একটা রাখাল বালকের রূপ ধরে দল-অলকে ঐ গাধার পিঠে চাপিয়ে গ্রামান্তরে এক হামামের উদ্দেশে রওনা হলো।

কিছুক্ষণ পরে সে হামামের কাছে এসে পৌঁছলো। হামামের নারী-প্রহরীর হাতে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা গুঁজে দিয়ে মায়াদানব বললো, শোনো মেয়ে, ইনি হচ্ছেন এক শাহজাদী। একে অন্দরে নিয়ে গিয়ে খুব ভালো করে শাহী কেতায় গোসল করিয়ে তারপর আমার কাছে দিয়ে যাবে, কেমন?

মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বললো, আপনি কিছু ভাববেন না, আমি ওকে দামী আতর-পানীতে গোসল করিয়ে দিচ্ছি। আপনি এই দরজার পাশে বসুন।

এই বলে দ্বার-রক্ষিণী দল-অলকে নিয়ে হামামের ভিতরে চলে গেলো।

হামামঘরের বৈঠকখানায় অপেক্ষমান অন্য মেয়েদের পাশে দল-অলকে বসিয়ে দ্বার-রক্ষিণী চলে গেলো। একে একে অন্য মেয়েরা স্নানের ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু দল-অল আর ওঠে না। বিষণ্ণ বদনে বসে সে নিজের নসীবের কথা ভাবতে থাকে। আর একটু বাদেই সে মায়াদানবের

পেটে চলে যাবে! উফ ভাবতেও কাটা দিয়ে ওঠে শরীর? চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে।

একদল মেয়ে হাসিতে উচ্ছল হয়ে হামামে ঢোকে। দল-অলকে কাঁদতে দেখে ওরা বলে, সে কি কাঁদছো কেন গো? গোসল করবে তো? চলল, আমাদের সঙ্গে চলো, একসঙ্গে মজা করে গোসল করা যাবে।

দল-অল ঘাড় নাড়ে, না ভাই তোমরা যাও। আমি আর গোসল করে কী করবো? এ জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ আমার শেষ হয়ে গেছে!

মেয়েগুলো আর ওকে ঘাঁটালো না। হামামের ভিতরে ঢুকে গেলো!

একটু পরে এক বুড়ি মাথায় একটা চুপড়ি নিয়ে প্রবেশ করলো। এই হামামে সে নিত্য চিনেবাদাম ও পানিফল বিক্রি করতে আসে। যারা এখানে গোসল করতে আসে তাদের কাছে বিক্রি করে এক আধলা পায়। তাই দিয়ে সে কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করে। বুড়িটার নিজের কোনও গৃহ নাই। সারাদিন ফিরি করার পর এই হামামেরই এক কোণে সে পড়ে থেকে রাত কাটায়।

বুড়িটাকে ইশারায় কাছে ডাকে দল-অল। বলে, হ্যাঁগো বুড়িমা, আমাকে খানিকটা চিনেবাদাম দাও তো।

বুড়ি একটা ঠোঙায় চিনেবাদাম ভরে দল-অল-এর হাতে দেয়।

-কত দাম? বুড়ি বলে আধ দিরহাম, মা।

নিজের গলার মূল্যবান জড়োয়ার হারটা খুলে সে বুড়ির হাতে দেয়, এটা রাখ, তোমার বালবাচ্চারা সুখে থাকবে।

বুড়ি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে দল-অল-এর দিকে। দল-অল বলে, আচ্ছা বুড়ি মা, তোমার এই ঝুড়ি আর পরনের সাজপোশাকগুলো আমায় দিতে পার? যদি দাও তবে তোমাকে এই সোনার গামলাটা এবং আমার গায়ে যত গহনা আছে সব দেব।

বুড়ি এবার রেগে ওঠে। গরীব বলে কি আমি মানুষ নই মা? এইভাবে তামাশা অপমান করবে?

দল-অল বলে, সত্যি, বিশ্বাস কর বুড়ি মা, আমি তোমার সঙ্গে একবিন্দুরঙ্গতামাশা করছি না। যদি সত্যি সত্যিই তোমার সাজপোশাক আর ঐ ঝুড়িটা আমাকে দাও, আমি কথা দিচ্ছি, আমার বলতে এখানে যা আছে সব তোমাকে দেব।

বুড়ি তার ময়লা ছেড়া জামাকাপড় ছেড়ে দিলো। দল-অল সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ থেকে মূল্যবান সাজপোশাক খুলে দিলো বুড়িকে। বুড়ির ময়লা ছেড়া সাজপোশাক এবং বোরখা পরে চিনেবাদাম আর পানি-ফলের ঝুড়িটা মাথায় তুলে নিয়ে গুটি গুটি সদরের দিকে এগিয়ে গেলো অল-দল।

হামামের দরজার পাশে বসেছিলো রাখাল-বেশী মায়াদানব। দরজা পার হয়েই অল-দল হাঁক শুরু করলো, চিনেবাদাম পানিফল নেবে গো

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। মায়াদানব দ্বার-রক্ষিণীকে তাগাদা দিলো, কই গো মেয়ে, আমার মালকিন এখনও বেরুচ্ছে না কেন? যাও না একবার দেখে এসো।

মেয়েটি ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, তুমি বাপু অত অধৈর্য হচ্ছে কেন? একি যেমন তেমন গোসল নাকি। পুরো বাদশাহী কেতায় আতর গোলাপ-পানিতে নাহাতে হবে। তারপর পরিপাটি করে সাজপোশাক পরাতে হবে। গায়ে খুশবু ছড়াতে হবে, সময় লাগবে না?

মায়াদানব ঘাড় নেড়ে বলে, তা বটে, তা বটে।

রাত ঘনিয়ে আসে। এবার দ্বাররক্ষী হামামের সদর বন্ধ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু মায়াদানব রুখে দাঁড়ায়, এ্যাঁই, এটা কি হচ্ছে? আমার মালকিন রয়ে গেলো অন্দরে, আর তুমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছ যে?

মেয়েটি বলে, সে কি! হামামের ভিতরে তো কোনও খদ্দের নাই। সবাই গোসল করে চলে গেছে। শুধু মাত্র এক ফিরিওলি বুড়ি শুয়ে আছে এক কোণে। তা সে তো রোজই এখানে রাত কাটায়।

মায়াদানব এবার লাফিয়ে এসে মেয়েটির টুটি চেপে ধরে, তোমার ওসব বুজরুকী আমি শুনতে চাই না। আমার মালকিনকে বের করে দাও। না হলে গলা টিপে শেষ করে দেব।

মেয়েটি প্রাণপণে মায়াদানবের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে চিৎকার তোলে, ওগো কে কোথায় আছ বাঁচাও-বাঁচাও, আমাকে মেরে ফেললো।

চেঁচামেচি চিৎকারে নিমেষে হাজার লোক জমায়েত হয় সেখানে। মায়াদানব বেগতিক দেখে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়।

দল-অল ফেরিওলির ছদ্মবেশে হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটা গ্রাম পিছনে ফেলে ঘন্টা-কয়েকের মধ্যে এক খরস্রোতা নদীর কূলে এসে দাঁড়ায়।

পথশ্রমে সে অত্যন্ত ক্লান্ত। সবুজ ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে অঞ্জলিভরে নদীর জল পান করে সে। তারপর আবার শুরু হয় পথ চলা।

চলতে চলতে একদিন সে এসে উপস্থিত হয় এক শহরে। সেখানকার সুলতানের প্রাসাদে গিয়ে প্রহরীকে বলে, আমি এক সুলতান-কন্যা, তোমাদের বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।

খবর পেয়ে সুলতান তার পুত্রকে পাঠালেন অতিথিকে স্বাগত জানাতে। শাহজাদা দল-অলের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার পাণিপ্রার্থনা করলো।

দল-অল সম্মত হলো। সেইদিনই কাজী-সাক্ষী ডেকে শাদীনামা তৈরি করালো সুলতান।

সারা শহরে প্রাসাদে উৎসবের ধূম পড়ে গেলো। বিকেলের দিকে এক শেখ এলো সুলতান-সমীপে। তার সঙ্গে ছিলো একটা তাগড়াই ভেড়া। সুলতানকে কুর্নিশ জানিয়ে সে ভেড়াটা ভেট দিলো সুলতানের পুত্রের শাদী উপলক্ষে। বললো, এই ভেড়াটাকে অনেক আদর যত্ন করে লালনপালন করেছি আমি, জাঁহাপনা। আজ শাহজাদার শাদী উপলক্ষে এটা আপনাকে প্রদান করে ধন্য হতে চাই আমি।

সুলতান প্রীত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, এই ভেড়ার মাংস বড় উপাদেয় হবে মনে হচ্ছে। কাল সকালে একে জবাই করা হবে।

শেখ বললো, কিন্তু জাঁহাপনা একটা কথা, ভেড়াটাকে আমার বিবি সবসময় হারেমের মধ্যে রেখে পালন করতেন। তাই নারীসঙ্গ ছাড়া সে শান্ত থাকতে পারে না। আমার অনুরোধ, আজকের রাতটা একে আপনার হারেমে বেঁধে রাখবেন। না হলে এ ব্যাটা মহা অশান্তি করে সকলের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাবে।

সুলতান হারেমের খোজাকে বললেন, আজ রাতটা এই ভেড়াটাকে হারেমে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখবে। কাল সকালে জবাই করা হবে।

অনেক রাতে ভেড়ারূপী মায়াদানবটা তার আসল মূর্তি ধরে দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে দল-অল-এর বাসরকক্ষের দিকে ধাবমান হলো। কিন্তু ঐ সময় দল-অলকে পাহারা দিচ্ছিল বেহেস্তের এক জিন। মায়াদানবের উগ্র রূপ দেখে সে বুঝতে পারলো, এই শয়তান রাক্ষসটা নিশ্চয়ই শাহজাদীকে অপহরণ করবে। তৎক্ষণাৎ সে রাক্ষসটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুমদাম গোটাকতক কিল ঘুষি বসিয়ে দিতেই সে অক্কা পেয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেয়।

পরদিন সকালে সবাই দেখলো, ভেড়াটা বাসরঘরের দরজার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দল-অল বিপদ মুক্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

এরপর সপ্তম কাপ্তেন এগিয়ে এলো তার কাহিনী শোনাতে। সে বলতে থাকে

আমি যে জেলায় বাস করতাম সেই জেলায় এক চাষীর বাড়িতে এক রাতে এক আরব দস্যু হানা দিয়েছিলো। সে যখন গমের বস্তা ধরে টানাটানি করছিলো, তখন গৃহস্বামী জেগে উঠে চোর চোর বলে সোরগোল তুলে পাড়াপড়শীদের জাগিয়ে তুললো। চোরটা এমনভাবে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো যে, আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার টিকি দেখতে পেলাম না! নিরাশ হয়ে চলে যাবো ভাবছি, এমন সময় গমের বস্তার গাদা থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমিও ছুটে গেলাম সেইদিকে। দেখলাম একটা লোক বুকের ওপর একটা আড়াই-মণি গমের বস্তা নিয়ে শুয়ে আছে ঘাপটি মেরে।

লোকটিকে টেনে বের করে দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রশ্ন করলাম, কী ব্যাপার, অমন আওয়াজ করে ধরা দিলে কেন?

লোকটা বললো, আওয়াজ আমি ইচ্ছে করে করিনি, মালিক। গমের বস্তাটা পেটের ওপর এমনভাবে চেপে বসেছিলো যে পেটের বায়ু সশব্দে বেরিয়ে গেছে।

সপ্তম কাপ্তেন বললো, তারপর চোরটাকে আমি বেদম প্রহার দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম।

সপ্তম কাপ্তেনের এই অতি ক্ষুদ্র কাহিনী শুনে সুলতান সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি অষ্টম কাপ্তেনকে ডাকলেন।

 

অষ্টম কাপ্তেন বলতে শুরু করে।

এক বাঁশী-বাদকের বৌ একদা একটি পুত্র-সন্তানের জন্ম দিয়েছিলো। স্বামীটার কোনই সঙ্গতি ছিলো না! ধাইকে তার পাওনা-গণ্ডাও দিতে পারলো না। প্রসূতির জন্য পথ্যও সংগ্রহ হলো না।

অগত্যা সে ঘর ছেড়ে পথে বেরুলো ভিক্ষা করতে।

সে মাঠের পথে চলতে চলতে এক সময় লক্ষ্য করলো, একটা খামারবাড়ির খাঁচার ওপর বসে একটা মুরগী আজান দিচ্ছে।

খাঁচার মধ্যে মুরগীর গোটাকয়েক ডিম দেখে সে আর লোভ সামলাতে না পেরে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে টুক করে ডিমগুলো তুলে নিলো এক হাতে এবং অন্য হাত দিয়ে খপ করে ধরে ফেললো মুরগীটাকে।

ঘরে ফিরতে ফিরতে সে ভাবলো, যাক, আল্লাহর দোয়ায় আমার বাবাকে মুরগার ঝোল খাওয়াতে পারবো। আর এই ডিম কটা দিয়ে ধাই-এর ঋণ শোধ করা যাবে।

বাজারে ঢুকে বাঁশী-বাদক এক স্যাকরার দোকানের পাশ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় ইহুদী জহুরীর ডাকে থমকে দাঁড়ালো সে।

–কি গো বাছা, তোমার হাতে কী? বাঁশীবাদক বলে, একটা মুরগী আর কয়েকটা ডিম। জহুরী জিজ্ঞেস করে, ডিম কটা বেচবে?

-হ্যাঁ।

-কত নেবে?

বাঁশী-বাদক ভাবছে কত চাইবে। ইহুদী আবার বললো, খুব বেশি হলে দশ দিনারের বেশি হওয়া উচিত নয়, কী বলো?

এবার বাঁশীবাদক বুঝতে পারে ইহুদীটা তার সঙ্গে মস্করা করছে। না হলে কয়েকটা ডিমের দাম দশ দিনার বলে কেউ?

-আপনি তো ভালোই জানেন জহুরী সাহেব, এই ডিমের ও দাম হতে পারে না। তবু আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন কেন? আমি গরীব বলে?

জহুরী ভাবলো, লোকটা বুঝি আরও বেশি কিছু চায়, তাই সে বললো, ঠিক আছে, পনের দিনার নিও?

বাঁশী-বাদক চিৎকার দিয়ে ওঠে। ইয়া আল্লাহ, এ কি মসিব্বতে ফেললে আমাকে।

জহুরী অন্যরূপ ভাবলো। সে বললো, আচ্ছা কুড়ি দিনারই দেব।

বাঁশীবাদক দেখলো লোকটা রসিকতাই করুক আর যাই করুক, ডিমগুলো সে ছাড়বে না। বাঁশী-বাদক ডিমগুলো ওর সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো, কই দামটা দিয়ে দিন।

জহুরী গুণে গুণে কুড়িটি স্বর্ণমুদ্রা তুলে দিলো বাঁশী বাদকের হাতে। টাকাগুলো পকেটে পুরে সে ঊর্ধশ্বাসে ছুটে চললো ঘরের দিকে। জহুরী তার পিছনে ছুটতে ছুটতে এসে বললো, হ্যাঁগো, এমন ডিম কি আরও আছে তোমার ঘরে? যদি থাকে কাল আবার নিয়ে এসো। এইরকম দামই দেব।

বাঁশী-বাদক বলে, মুরগীটা যদি পাড়ে তবে কাল সকালে তোমাকে বেচে যাবো।

জহুরী বললো, না না, তোমার আর কষ্ট করে আসার দরকার নাই। তার চেয়ে তোমার বাড়িটা আমাকে চিনিয়ে দাও, কাল থেকে রোজ সকালে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো। আর শোনো, এবার থেকে প্রতিটির জন্য কুড়ি দিনার করে দেব।

বাঁশী-বাদক সম্মত হয়ে জহুরীকে বাড়িটা চিনিয়ে দিয়ে বিবির জন্য বাজার থেকে অন্য একটা মুরগী কিনে বাড়ি ফিরলো।

পরদিন সকালে উঠে বাঁশী-বাদক তার বিবিকে বললো, দেখো, ভুলেও যেন কখনও ঐ মুরগীটাকে জবাই করে খেও না। ওর এক একটা ডিম কুড়ি দিনারে বিকাবে। এইভাবে কিছুদিন যদি সে ডিম দেয় তবে দেখে নিও, আমরা আর এইরকম গরীব থাকবো না।

এইসময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো উনপঞ্চাশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

ইহুদী প্রতিদিন সকালে আসে। বাঁশী-বাদক একটা করে ডিম দেয় তাকে। সে খুশি মনে কুড়িটি স্বর্ণমুদ্রা গুণে দিয়ে যায়।

এইভাবে কালক্রমে বাঁশী-বাদকের হাতে বেশ মোটা টাকা জমে ওঠে। একদিন সে বাজারে একটা দোকান কেনে।

এখন আর সে গরীব বাঁশী-বাদক নয়, শহরের বেশ গণ্যমান্য পয়সাওলা সওদাগর। তার পুত্রের পাঠশালা যাওয়ার বয়েস হলো। সে এক অবৈতনিক পাঠশালা খুলে দিলো তার বাড়ির পাশে। মাইনে করে মৌলভী রাখলো। পাড়ার অন্য সব গরীব ছেলেদের সঙ্গে তার ছেলেও লেখাপড়া শিখতে থাকলো।

বাঁশী-বাদকের এখন অনেক পয়সা। মক্কায় গিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করে আসবে এই বাসনায় সে তীর্থযাত্রীদের দলে ভিড়ে গেলো। যাবার আগে বিবিকে সাবধান করে গেলো, জহুরীটা হয়তো তোমাকে অনেক টাকার লোভ দেখাবে। কিন্তু খুবরদার, কোনও দামেই মুরগীটা তাকে বেচে দিও

কিন্তু!

পরদিন সকালে ইহুদীটা একটা বাক্স কাধে নিয়ে বাঁশী-বাদকের বিবির কাছে এলো। বাক্সের ডালা খুলে সে বললো, এই যে বাক্সভর্তি মোহর দেখছো, এগুলো সব তোমাকে দেব, তার বদল তুমি আমাকে তোমার মুরগীটা বিক্রি করে দাও।

এক বাক্স চকচকে স্বর্ণমুদ্রা দেখে বাঁশী-বাদকের বিবির চোখ নেচে ওঠে। কিন্তু স্বামীর সতর্কবাণী স্মরণ করে সঙ্গে সঙ্গে চুপসে যায়। না গো, সে পিরবো না। সে যাওয়ার সময় বলে গেছে, আমি যেন তোমাকে শুধু ডিমই বিক্রি করি। মুরগী বেচতে বারণ করে গেছে।

জহুরী বাক্সটা মেঝের উপর উপুড় করে ফেলে দেয়। একরাশ সোনার দিনার। জহুরী বলে, কতগুলো মোহর, একবার তাকিয়ে দেখ, এতো টাকা পাওয়া যাবে ঐ একটা মাত্র মুরগীর জন্যে, তা কি তোমার স্বামী ভাবতে পেরেছিলো কোনও দিন?

বাঁশী-বাদকের বিবি বলে, ঠিক আছে মুরগীটা তাহলে বেচেই দিচ্ছি তোমাকে নিয়ে যাও।

ইহুদী বলে, না গো মেয়ে, ও মুরগী আমি নিয়ে যাবো না সঙ্গে করে। তুমি কেটেকুটে আচ্ছা করে বানাও আমার জন্য। আমি একটা কাজে যাচ্ছি ফিরে এসে খাবো। কিন্তু একটা কথা, আমার মুরগীর একটুকরো মাংসও যেন গাড়া মেরো না। যত চালাকী করেই কাট আমি খেতে বসে সব বুঝতে পারবো কোন মাংসটা নাই। আমার মাংসের একটা টুকরো যদি পেটে পুরো তবে আমি পেট চিরে তা বের করে নেব, বলে দিলাম।

বাঁশী-বাদকের বিবি বলে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার মাংস কেউ মুখে দেবে না।

দুপুরে মাদ্রাসা থেকে ফিরে আসে ছেলে।খিদেয় সে চনমন করছিলো।রসুইঘরে এসে বলে, মা খেতে দাও, বড় খিদে পেয়েছে।

মা বলে, একটু দাঁড়া বাবা, বানিয়ে দিচ্ছি। এখন তো কিছু তৈরি হয়নি।

ঘরের একপাশে রাখা সদ্য রান্না করা মুরগীটার সুগন্ধ পেয়ে সে বলে, ঐ তো দেখছি মুরগী বেঁধেছ, আমাকে দাও আমি খাব।

—সর্বনাশ! ও মুরগীর দিকে নজর দিসনি। ইহুদী জহুরী এক বাক্স মোহর দিয়ে আমার কাছ থেকে কিনেছে খাবে বলে। বলে গেছে, একটা টুকরো কম হলে সে ধরে ফেলবে। তুই একটু বস বাবা, আমি এখুনি তোর খানা পাকিয়ে দিচ্ছি।

মা ছেলের খানা বানাতে ব্যস্ত ছিলো, এই ফাঁকে ক্ষুধার্ত পুত্র গামলার ঢাকনা খুলে মুরগীর একটা টুকরো তুলে মুখে পুরে দেয় অলক্ষ্যে।

জিভে স্বাদ লাগে, আরও একটুকরো তুলে নেয় সে মায়ের অজান্তে। এই ভাবে এক এক করে পুরো মুরগীটাই সাবাড় করে ফেলে সে।

হঠাৎ মায়ের নজর পড়ে শুন্য গামলার দিকে। সে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে। এ কি করলি বাবা? লোকটা বিধর্মী, ধূর্ত ইহুদী। আমার সঙ্গে শর্ত হয়েছে, তার মাংস কেউ খেলে তার পেট চিরে সে বের করে নিবে সেই মাংস। এখন কী উপায় হবে বাবা?

ছেলেটি বলে, আমি সটকে পড়লাম। ইহুদীটা এলে বোলো, আমি চুরি করে খেয়ে পালিয়েছি। তারপর দেখা যাবে সে ব্যাটা কেমন কাপ্তেন।

যথাসময়ে ইহুদীটা এসে বললো, কই আমার মাংস দাও।

বাঁশী-বাদকের বৌ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলে, খোদা হাফেজ, আপনার জন্য মাংসটা বানিয়ে আমি ঢেকে রেখেছিলাম যত্ন করে। কিন্তু, কি বলবো, আমার ছেলেটা মাদ্রাসা থেকে ফিরে আমাকে না বলেই সবটা খেয়ে ফেলেছে।

ইহুদীহুঙ্কার ছাড়ে, কোথায় সে? আমি তার পেট চিরে বের করবো আমার হকের মাংস। একি মাঙনা চাইছি নাকি? নগদ এক বাক্স সোনার মোহর দিয়েছি তোমাকে ঐ একটা মুরগীর জন্য। তোমার সঙ্গে আমার যা ওয়াদা তা পূরণ করতেই হবে তোমাকে।

বৌটা বলে, কিন্তু ছেলে তো ঘর ছেড়ে পালিয়েছে! কোথায় পালাবে? আমি তাকে ধরবোই। এই বলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

শহর ছেড়ে প্রান্তর, প্রান্তর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে আবার প্রান্তর গ্রামে অনুসন্ধান করে বেড়াতে লাগলো ইহুদী। অবশেষে এক বাগানের মধ্যে দেখতে পেলো ছেলেটিকে। কাছে এসে বললো, তুমি আমার মুরগী খেয়েছ, তোমার পেট চিরে আমি ঐ মাংস বের করবো।

এই বলে ছুরিটা বাগিয়ে ধরলো সে ছেলেটির পেটের দিকে। কিন্তু অসামান্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সে ইহুদীর হাত থেকে কেড়ে নিলো অস্ত্রখানা। বললো, তোমার লজ্জা করে না? একটা তুচ্ছ মুরগীর মাংসের জন্য তুমি আমার পেট চিরতে এসেছ? যাও এখান থেকে। না হলে তোমার ঐ ছুরি তোমারই বুকে বসে যাবে।

ইহুদী তখন ক্রোধে হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলেছে। ছেলেটির ওপর সে ঝাপিয়ে পড়লো। এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা ঘটা সম্ভব তাই ঘটে গেলো পলকে।

ছেলেটির হাতের ছুরি বিদীর্ণ করে দিলো ইহুদীর বুক। প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

এরপর ছেলেটি বাড়ি ফেরার জন্য ছুটতে লাগলো। কিন্তু পথ ভুলে সে বাড়ির বদলে এসে পৌঁছলো এক সুলতানের প্রাসাদ-ফটকে। সেখানে সশস্ত্র প্রহরীরা দামামা পিটিয়ে ঘোষণা করছিলো, তামাম দুনিয়ার জাঁদরেল নওজোয়ানদের : দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছেন শাহজাদী। যদি কারো তেমন তাগদ থাকে তবে তিনি এগিয়ে আসতে পারেন। শাহজাদীকে যিনি পরাস্ত করতে পারবেন তার গলাতেই মালা দেবেন তিনি। কিন্তু খেয়াল থাকে যেন, যদি লড়াই-এ পরাজয় ঘটে, তবে কোতল হতে হবে তাকে।

ছেলেটি সুলতানের সামনে উপস্থিত হয়ে বললো, আমি আপনার কন্যার সঙ্গে শক্তির পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত, জাঁহাপনা।

সুলতান বললেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। কেন বেঘোরে প্রাণটা হারাবে বাছা! আমার

কন্যা অপরাজেয়। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে হারাতে পারেনি। কত শত শাহজাদার প্রাণবলি ১০ হয়েছে, এ পর্যন্ত তা কি তুমি জান?

ছেলেটি বলে, ওসব জেনে আমার লাভ নাই। আমি তার সঙ্গে লড়তে এসেছি। তাকে হারিয়ে আমি শাদী করবোই। আর আমি যদি হারি, তবে তো আপনি আমার গর্দান নেবেন, তাও আমার অজানা নয়।

সুলতান বললেন, ঠিক আছে, তা হলে এই চুক্তিনামায় সই কর। চুক্তির শর্ত সব এতে পরিষ্কার করে লেখা আছে।

কুস্তির লড়াই শুরু হলো।

দরবার-প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে গালিচা বিছানো হলো। ছেলে আর মেয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। উভয়ে প্রস্তুত হতে লাগলো।

এরপর দুজনে দুজনকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে প্রবল বিক্রমে একে অন্যকে কাবু করার কসরৎ ভাজতে থাকলো।

সে এক অভূতপূর্ব মল্লযুদ্ধের দৃশ্য। একবার ছেলেটি মেয়েটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে আছাড় মারতে উদ্যত হয়। আবার কখনও বা মেয়েটি সাপিনীর মতো আশেপাশে জড়িয়ে ধরে ছেলেটিকে।

এইভাবে একটানা দু’ঘণ্টা চলতে থাকে ওদের লড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই কাউকে গালিচায় ফেলে দাবিয়ে রাখতে পারে না।

সুলতান ক্রোধে আরক্ত হয়ে ওঠেন। বুঝতে পারেন, তার কন্যা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সপ্রমাণ করতে পারছে না কিছুতেই। চিৎকার করে ওঠেন তিনি, থাক থাক খুব হয়েছে, আজ থাম তোমরা। কাল আবার দেখা যাবে।

সুলতান তার কক্ষে চলে গেলেন এবং সেরা হাকিমকে তলব করলেন।

—শোনও হকিম, আজ রাতে ঐ ছেলেটিকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে ওর সর্বাঙ্গ ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে। আমি বুঝতেই পারছি না, যে কন্যাকে এর আগে উনচল্লিশ জন জাঁদরেল জোয়ান ছেলে কাবু করতে না পেরে প্রাণ হারিয়েছে, তাকে কি করে এই ছেলেটা আজ সামাল দিতে পারলো? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই সে এমন কোনো বস্তু অঙ্গে ধারণ করেছে, যার অমিত বিক্রমকে পরাস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না আমার কন্যার পক্ষে। তুমি আজ রাতে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখ ছেলেটিকে! তার দেহাভ্যন্তরে নিশ্চয় কোনও অলৌকিক বস্তু লুকানো আছে। সন্ধান করে আজ রাতেই তা বের করে ফেলতে হবে তার শরীর থেকে! এ কাজ যদি যথাযথ সমাধা করতে পার যথাযোগ্য ইনাম পাবে তুমি। কিন্তু যদি ব্যর্থ হও, তা হলে তোমার মুণ্ডুহীন ধড়খানা কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।

সুতরাং রাত্রি গভীর হলে হাকিম নিদ্রিত ছেলেটির পাশে এসে কড়া-জাতের একটা ওষুধ ওর নাকের সামনে ধরলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি অসাড় হয়ে এলিয়ে পড়লো বিছানায়। হাকিম পরীক্ষা করে বুঝতে পারলো, ছেলেটির পেটে একপ্রকার মুরগীর মাংস আছে। এবং ঐ মুরগীর মাংসের বলেই সে মহা বলবান হতে পেরেছে।

নিপুণ হাতে পেটে ছুরি বসিয়ে ঐ মুরগীর মাংসখণ্ডগুলি এক এক করে সব বের করে দিলো হাকিম। তারপর সুক্ষ্মভাবে সেলাই করে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। সে ওষুধের এমন গুণ কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে নিখুঁতভাবে জোড়া লেগে যায় কাটা চামড়া। এরপর নাকে ভিনিগার ঘষে দিয়ে সে বেরিয়ে গেলো।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই ছেলেটি বুঝতে পারলো তার দেহের অসাধারণ শক্তি বিলুপ্ত হয়েছে। অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো সে। তখন সে বেশ বুঝতে পারলো, গতকাল তার। দেহে অমিত বিক্রম এসেছিলো ঐ মুরগীর মাংস ভক্ষণের জন্য। পেটে হাত বুলিয়ে সে শিউরে উঠলো। না, আজ তো তার পেট প্রায় খালি। এই অবস্থায়, কোন সাহসে সে ঐ শাহজাদীর সঙ্গে কুস্তি লড়ার দুঃসাহস করবে।

প্রাসাদ ছেড়ে সে পালালো সেই মুহূর্তে। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে একসময় সে এসে থামলো বিবদমান তিন বন্ধুর এক আড্ডায়। ওরা ভীষণ রকম চেঁচামেচি করে ঝগড়া-ঝাটিতে মত্ত হয়ে উঠেছে।

-কী ব্যাপার, কেন তোমরা এমন ঝগড়া করছো? কিসের এতো গোল? ছেলেটির প্রশ্নের জবাবে ওরা বললো, একটা জিনিস নিয়ে।

-কী এমন বস্তু?

একজন বললো, এই গালিচাটা। এটা যাদুমন্ত্র করা। এই গালিচায় চেপে তুড়ি বাজিয়ে তুমি যেখানে যেতে ইচ্ছে কর যেতে পারবে। তা সে কাফ পর্বতমালার উতুঙ্গ চুড়াতেই হোক না কেন, নিমেষে তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেবে।

ছেলেটি বললো, এই মূল্যবান বস্তুখানি নিয়ে টানাটানি না করে এসো আমি তোমাদের বিরোধের একটা সুসঙ্গত সমাধান করে দিই।

ওরা বললো, ঠিক আছে, আমরা রাজি। তুমিই এর মীমাংসা করে দাও। ছেলেটি বললো, আগে গালিচাখানা মাটিতে বিছাও। আমি দেখি কতটা লম্বা, কতটা চওড়া।

সঙ্গে সঙ্গে ওরা ধরাধরি করে গালিচাখানা বিছিয়ে দিলো সামনে। এবার ছেলেটি ছোট্ট একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে ঐ গালিচার ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো শোনো, আমি এক দুই তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে এই ঢিলটা ছুঁড়ে দেব! তোমাদের মধ্যে যে আগে ছুটে গিয়ে এটা কুড়িয়ে আনতে পারবে সেই এই গালিচার মালিক হবে। কী, রাজি সবাই?

তিনজনেই সমস্বরে লাফিয়ে উঠলো, রাজি, আমরা রাজি।

ছেলেটি এক দুই তিন গোনা মাত্র প্রাণপণে জোরে ঢিলটা ছুঁড়ে দিলো অনেক দূরে। সঙ্গে সঙ্গে তীরবেগে ছুটে গেলো ওরা তিনজন। আর সেই ফাঁকে ছেলেটি তিনবার তুড়ি বাজিয়ে বললো, ওহে গালিচা, যেখান থেকে আজ সকালে আমি পালিয়ে এসেছি এবার আমাকে ঐ প্রাসাদের সেই কক্ষে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।

ছেলেটির মুখের বাক্য শেষ হতে না হতে শোঁ শোঁ করে উধ্বাকাশে উঠে গেলো গালিচাখানা, তারপর বায়ুবেগে উড়ে চলতে থাকলো।

চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ছেলেটি দেখলে গালিচাখানা এসে নামছে সেই প্রাসাদের দরবার-প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে—গতকাল যেখানে সে শাহজাদীর সঙ্গে মল্লযুদ্ধে মেতেছিলো।

ছেলেটি বুকে চাপড় মেরে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালো, কই, কে কোথায় আছ, লড়বে এসো আমার সঙ্গে। আমি এবার এক প্যাচে কাত করে দেব।

শাহজাদী এই আহ্বান উপেক্ষা করতে পারে না। তাকে পরাজিত করে যাবে এমন লড়াকু জোয়ান সে আজও দেখেনি।

গালিচার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি, ছেলেটির একেবারে মুখোমুখি। এই সময় ছেলেটি তিনবার তুড়ি বাজিয়ে বললো, সোজা নিয়ে চলো কাফের চূড়ায়।

মুখের কথা শেষ হতে না হতে গালিচাখানা উপরে উঠে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। সুলতান তথা উপস্থিত হাজার দর্শক হতবাক নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে রইলো শূন্য আকাশের

দিকে তাকিয়ে।

পলকে কাফের চূড়ায় এসে নামলো ওরা। ছেলেটি প্রশ্ন করলো, এবার কে জিতলো, সুন্দরী? তোমরা কায়দা করে আমার পেট থেকে মুরগীর মাংসগুলো বের করে নিয়ে অসদুপায়ে নির্জীব করার জঘন্য কৌশল তো করেছিলে! এবার আমিও শঠে শাঠ্যং করেছি। কুস্তির লড়াই করবো বলে ছল করে তোমাকে এই গালিচায় দাঁড় করিয়ে লোপাট করে এনেছি। এখন বলো তোমাদের ফন্দীর তুলনায় আমার চাতুরী কতটা বেশি দোষের?

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো পঞ্চাশতম রজনী

পরদিন আবার সে বলতে থাকে–

মেয়েটি মিনতি জানিয়ে বললো, যা হয়ে গেছে সেজন্য আমাকে ক্ষমা কর তুমি। এখন আমি তোমার কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করছি। যদি মেহেরবানী করে আমাকে আমার বাবার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, কথা দিচ্ছি, আমার বাবাকে দিয়ে ঘোষণা করিয়ে দেব, তুমিই হবে আমার একমাত্র স্বামী।

ছেলেটি বললো, সে তো অতি উত্তম কথা। কিন্তু একটা প্রবাদ আছে জানতো, লোহা যখন তেতে লাল হয়ে থাকে তখনই তাকে পিটিয়ে প্রয়োজন মতো আকারের জিনিস বানাতে পারা যায়। সুতরাং এসো এই মুহূর্তেই তোমার কুমারীত্ব আমার হাতে খতম হয়ে যাক।

মেয়েটি বললো, বেশ তাই হোক।

মেয়েটিকে গালিচার ওপর চিৎ করে শোয়ালে সে। তারপর যথাকর্তব্য সম্পাদনের জন্য তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কটিদেশ স্থাপন করার পূর্বে মেয়েটি প্রচণ্ড জোরে ছেলেটির তলপেটে একটা লাথি বসিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে বেশ খানিকটা দূরে ছিটকে পড়লো সে। আর সেই মওকায় মেয়েটি তিনবার তুড়ি বাজিয়ে গালিচাকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমাকে আমার প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।

পলকে গালিচা উড়ে চলে গেলো। ছেলেটি একা পড়ে রইলো, সেই নির্জন কাফ পর্বত-চূড়ায়।

পাহাড়ের শিখরে অসংখ্য গাছপালা। সবই অজানা অচেনা। কত গাছে কত রকমের বিচিত্র সব ফুল ফল। কিন্তু ছেলেটির কিছুই ভালো লাগে না। সে ভাবে এই দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়-চুড়া থেকে কীভাবে কতদিনে সে মাটির সমতলে নামতে সক্ষম হবে।

দুটি দিন অনাহারেই কেটে গেলো। গাছে গাছে অনেক ফল, কিন্তু ভরসা করে খেতে পারে না। কে জানে সে সব ফল খাদ্য কি অখাদ্য।

কিন্তু খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। আর সহ্য করা যায় না, যাই ঘটুক, ঐ গাছের ফল সে খাবেই। যদি সে ফলের বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু ঘটে, তবু তাকে খেতে হবে।

হলুদ আর লাল রঙের দুই রকমের ফল দেখতে পেলো সে পাশাপাশি দুটি গাছে। একটা হলুদ বর্ণের ফল ছিঁড়ে নিয়ে কামড় বসাতেই সারা শরীর রি রি করে উঠলো মুহূর্তে। ছেলেটি দিশাহারা হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফলটি। কিন্তু ততক্ষণে তার ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো তার মাথা দিয়ে শিং গজাচ্ছে। এবং একটা দুটো নয়, যোলটা।

তখন শিংগুলো বড় হতে হতে বিশাল আকার ধারণ করে তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। আরও কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রত্যেক শিং থেকে অসংখ্য ডালপালা গজিয়ে সে এক বীভৎস আকার ধারণ করলো।

মৃত্যু অবধারিত জেনে মরিয়া হয়ে সে একটা লাল ফল ছিঁড়ে নিয়ে কামড় দিলো। আর কি, এক আশ্চর্য অলৌকিক মন্ত্রবলের ন্যায় মূহুর্তে শিংগুলো আবার মাথার মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেলো।

তৎক্ষণাৎ ছেলের মাথায় ফন্দী খেলে গেলো। দুই পকেটে হলুদ আর লাল ফলে ভরে নিয়ে পায়ে পায়ে সে নিচের দিকে নামতে থাকলো।

পাহাড়ের দুর্গম উতরাই পথ। একটু পা হড়কালে হাজার হাজার হাত নিচে গড়িয়ে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে সে। যাই হোক আল্লাহর দোয়ায় অবশেষে একদিন সে সুস্থ দেহে সমতল মাটিতে নামতে পারলো।

তারপর পায়ে হেঁটে প্রায় মাসাধিক কাল পরে একদিন সে ঐ সুলতানের প্রাসাদ-সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো।

হলুদ ফলগুলো একটা চুপড়িতে নিয়ে ফিরিওলার বেশ ধরে সে প্রাসাদের সামনে দিয়ে হাঁক দিতে দিতে চলতে লাগলো ও ফল নিবে গো, বহুত মজাদার পাহাড়ী ফল। একবার খেলে বার বার খেতে হবে। এ ফল যে খাবে সেও পস্তাবে, যে না খাবে সেও পস্তাবে। ফল নেবে গো,বড় আজব পাহাড়ী মিষ্টি ফল

শাহজাদী জানলার পাশে বসে লোজনদের পথচলা দেখছিলো। ফেরিওয়ালার মাথায় অদ্ভুত ধরনের ঐ ফল দেখে সে খোজা বান্দাকে বললো, যা তো কিছু ফল নিয়ে আয়।

খোজাটা ছেলেটার কাছ থেকে গোটাকয়েক হলুদ ফল কিনে এনে শাহজাদীর হাতে দিলো।

-বাঃ কি সুন্দর দেখতে

এই বলে একটা ফলে কামড় বসাতেই শাহজাদীর সারা শরীরে রি রি করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মাথার চারপাশ দিয়ে যোলটা শিং ফুঁড়ে বেরুতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যে শিংগুলো বাড়তে বাড়তে বিশাল প্রাসাদকক্ষ ভরে গেলো। অসংখ্য ডালপালা বেরিয়ে এক ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করলো ক্রমশঃ!

সারা প্রাসাদে হৈ চৈ পড়ে গেলো। হাকিমকে ডেকে আনা হলো। কিন্তু অনেক ভাবে পরীক্ষা করেও সে ব্যাধির কারণ বুঝতে পারলো না। তখন সুলতান সারা দেশে তাঁড়া পিটে ঘোষণা করে দিলেন, তার কন্যার ব্যাধি যে সারিয়ে দিতে পারবে তার সঙ্গে তার শাদী দিয়ে দেবেন তিনি।

এই মওকাতেই দিন গুনছিলো ছেলেটি। সুলতানের সামনে এসে জানালো, শাহজাদীর অসুখ সারিয়ে দিতে পারবে সে।

লাল ফলের একটা ছোট্ট টুকরো সে শাহজাদীর ঠোঁটে ঘঁষে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার বহু শাখা-বিস্তৃত শিংগুলি সুড়সুড় করে মাথার মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখেই সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো।

সুলতান বিশ্বাস করলেন, এই ছেলের দ্বারাই তার কন্যার রোগ নিরাময় হতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করে দিলেন, এর সঙ্গে শাহজাদীর শাদী হবে।

কাজী ও সাক্ষীকে ডাকা হলো। শাদীনামা তৈরি করে দিলেন তারা। সেই দিনই শুভ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলো।

সুলতান জামাতাকে সাদর স্বাগত জানালেন। দেশবাসী আনন্দ উৎসবে মুখর হয়ে উঠলো। বাসরঘরে ছেলেটি শাহজাদীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, তা হলে শেষ পর্যন্ত কার জিত হলো শাহাজাদী?

শাহজাদী চোখ মেলে দেখলো, সেই ছেলেটি, যাকে কুস্তিতে হারাবার জন্য তার পেট চিরে মুরগীর মাংস বের করা হয়েছিলো, যাকে সে একদা অত্যুচ্চ কাফ পর্বতচূড়ায় একা ফেলে যাদু গালিচায় চেপে উড়ে পালিয়ে এসেছিলো।

লজ্জায় সে ছেলেটির বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো।

এরপর নবম কাপ্তেন এগিয়ে এসে তার কাহিনী শুরু করে—

 

একটা বাঁজা মেয়ের কাহিনী শুনুন জাঁহাপনা। মেয়েটির যৌবন ছিলো ডগমগে। স্বামী-সহবাসও সে নিত্যই করতো। কিন্তু হায়রে কপাল! একটা সন্তানও সে পেটে ধরতে পারলো না।

মেয়েটি এতকাল আল্লাহর কাছেই পুত্র-সন্তানই কামনা করে এসেছে, কিন্তু তাতে তিনি সদয় হলেন না দেখে এবার সে নিদেনপক্ষে একটি কন্যাই প্রার্থনা করলো।

খোদা এবার প্রসন্ন হলেন। যথাসময়ে একটি ফুটফুটে সুন্দর কন্যা-সন্তান প্রসব করলো সে।

আদর করে মেয়ের নাম রাখলো সে সিত্তুখান।

যখন তার দশ বছর বয়স, সেই সময় একদিন সে তার ঘরের জানলার পাশে বসেছিলো। এমন সময় সুলতান-পুত্র সেই পথ অতিক্রম করার সময় তার নজর গিয়ে পড়লো সিখানের ওপর। এবং প্রথম দর্শনেই যাকে বলে মূৰ্ছা-প্রায় সেই দশা হলো শাহজাদার।

অনেক হাকিম বদ্যি এলো। অনেক দাওয়াই কবচ দিলো তারা। কিন্তু শাহজাদার অসুখ আর সারে না।

অবশেষে একদিন এক বৃদ্ধা এসে শাহজাদাকে পরীক্ষা করে বললো, এ তো কোন বিমার নয়। হয় আপনি কোনও মেয়ের প্রেমে পড়েছেন। নয়তো কোনও মেয়ে আপনাকে গভীরভাবে প্রেম-নিবেদন করেছে।

শাহজাদা বললো, আমি প্রথম দর্শনেই প্রেমে মজে গেছি। কিন্তু কে সে? আমি তো তাকে চিনি না, জানি না, তার কী নাম? পার তুমি? পার তুমি তার পরিচয় জেনে দিতে?

বৃদ্ধা মৃদু হেসে বললো, আমি সেইজন্যেই এসেছি আজ। তার নাম সিখান, দশ বছরের চাদের মতো সুন্দর একটি মেয়ে—জানলার ধারে সে বসেছিলো। আপনার চোখ ওর চোখে পড়ে গিয়েছিলো। কী, তাই না?

শাহজাদা বৃদ্ধার হাত চেপে ধরে, তুমি ঠিকই ধরেছ, বুড়িমা। ঐ সেই মেয়ে। ওকে দেখামাত্র আমি পাগল হয়ে উঠেছি। উঃ, কী যে যন্ত্রণা এই বুকে, কী করে তোমাকে বোঝাবো।

বৃদ্ধা বললো, শান্ত হোন, ধৈর্য ধরুন বেটা। তার সঙ্গে যাতে দেখা-সাক্ষাৎ হয় তার ব্যবস্থা আমি করে দেব।

এই বলে সে সেদিনের মতো শাহজাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সটান চলে এলো সিখানের বাড়িতে।

-সুখবর আছে মা, তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে? স্বয়ং সুলতানের ছেলে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তোমাকে না দেখতে পেলে সে আর বাঁচবে না।

সিত্তুখান বলে, কিন্তু কি করে তা সম্ভব হবে বুড়িমা? সে বাদশাহর ছেলে, আর আমি এক গরীবের মেয়ে?

বুড়ি বলে, সে ব্যবস্থা আমি করবো। তুমি এক কাজ কর, তাতীর বাড়ি গিয়ে শনের কাজ শেখো।

সিখান মা-এর কাছে গিয়ে বায়না ধরে, মা আমি শনের তত বোনা শিখবো। ও পাড়ার তাঁতী-বৌর কাছে বলে তুমি ব্যবস্থা করে দাও।

মা বলে ওসবের দরকার নাই মা। শনের গন্ধ নাকে গেলে তুই সহ্য করতে পারবি না—সে বড় কঠিন কাজ।

মেয়ে তবু নাছোড়বান্দা। বলে, না, আমার কিছু হবে না। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।

অগত্যা বাধ্য হয়ে মেয়ের জন্য মা তাঁতীর বাড়ি যায়।

পরদিন থেকে সিখান তাতে কাজ শিখতে থাকে। কিন্তু দিন দুই পরে মাকু চালাতে চালাতে হঠাৎ এক সময় শনের ধারালো সুতো বিঁধে যায় সিখানের নখের ভিতরে।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

অনেক চেষ্টার পর জ্ঞান ফিরে আসে সিখানের। কিন্তু শরীর বড় দুর্বল হয়ে পড়ে। হাকিম বলে যায়, মেয়েকে নদীর মুক্ত বাতাসে রাখতে পারলে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে।

সিক্তখানের বাবা একটা বজরা ভাড়া করে মেয়েকে নদীর নির্মল বায়ু সেবনের ব্যবস্থা করে।

এদিকে ঐ বৃদ্ধা শাহজাদাকে গিয়ে খবর দেয়, আপনার ভালোবাসাকে দেখার এক চমৎকার সুযোগ এসেছে। সিত্তখান এখন নদীর কিনারে এক বজরায় বাস করছে।

সেইদিনই বিকালে শাহজাদা উপস্থিত হলো নদীর ঘাটে। বৃদ্ধা আগে থেকেই হাজির ছিলো সেখানে।

সিখান দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানায় শাহজাদাকে। শাহজাদা সে আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারে না।

আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে দু’জনে দু’জনকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে।

এইভাবে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। বৃদ্ধা বলে আজ রাত হলো। এখন আপনি প্রাসাদে ফিরে যান শাহজাদা। কাল আবার আসবেন।

পরদিনও এলো শাহজাদা : তার পরদিনও।

প্রেমের বন্যায় দুকূল ছাপিয়ে যেতে চায় দু’জনের। জীবনে এতো ভালোবাসা থাকতে পারে, এর আগে কেউই অনুভব করতে পারেনি।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে সিখানের বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে করতে শাহজাদা বলে, আমার বোধহয় আর আসা হবে না তোমার কাছে।

—কেন, কেন?

মেয়েটি শঙ্কিত হয়ে আবার জড়িয়ে ধরে শাহজাদাকে।

–আমি সুলতানের ছেলে, তুমি অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে। তোমার সঙ্গে আমার এই মাখামাখি আমার মা বাবা উজির আমির কেউই ভালো চোখে দেখছেন না।

সিখান কেঁদে আকুল হয়, তা হলে? তা হলে কী করে আমি বাঁচবো?

ছেলেটিও কেঁদে সারা হয়। আমারও তো সেই কথা সিত্তু? তুমি ছাড়া তামাম দুনিয়া আমার কাছে অন্ধকার হয়ে আসবে।

পরদিন শাহজাদা আর এলো না। তারপর দিনও না। সিত্তুর বিরহে গাছের পাখিরা কাঁদে। ফুল শুকিয়ে ঝরে ঝরে পড়তে থাকে।

বিকেল হলেই সিত্তু বজরা ছেড়ে নেমে নদীর ঘাটের পাশে শ্যামল দূর্বাদল শয্যায় লুটিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু পড়ে থাকাই সার হয়। বৃথা চোখের জল চোখে শুকিয়ে যায়, সে আর আসে না।

একদিন বিকেলে সিখান ঘাসের শয্যায় শুয়ে বিরহের গান গাইছিলো। হঠাৎ তার নজরে পড়লো, অদূরে ঘাসের ওপর পড়ে আছে একটা পাথর-বসানো আংটি! বেশ চকচক করছিলো।

আংটিটা কুড়িয়ে নিয়ে সিত্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে থাকে। অতি সাধারণ ধাতুর তৈরি। কানাকড়িও দাম হবে না। কিন্তু পাথরটা বড় চমৎকার। ঘোরাতে ঘোরাতে তারার আলোর ঝিলিক হানে। বাঁ হাতের মধ্যমাতে পরে নিলো সি। ডান হাতের তালুতে একটু ঘষে ধুলো ময়লা পরিষ্কার করতে গেলো। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার সামনে এসে উপস্থিত হলো এক বিশালাকার দৈত্য। আভূমি আনত হয়ে সে সিদ্ভুখানকে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, বান্দা হাজির মালকিন। আজ্ঞা করুন, কী করতে হবে?

প্রথমে ভয়ে তো শিউরে উঠেছিলো সিত্তুখান। কিন্তু দৈত্যের বিনয়াবনত ভাবভঙ্গী দেখে ধড়ে প্রাণ পেলো সে। বুকে সাহস এনে বললে, শোনও দৈত্য ঐ যে সুলতানের প্রাসাদ দেখছো, ঠিক ঐ রকমই আর একখানা প্রাসাদ আমাকে বানিয়ে দিতে হবে ওরই ঠিক পাশে।

দৈত্য সেলাম জানিয়ে বলে, জো হুকুম মালকিন।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সিখান দেখলো সুলতানের প্রাসাদের পাশে আর একখানা তাদৃশ ইমারত গর্বিত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।

দৈত্য এসে বললো, আপনার হুকুম তামিল করেছে বান্দা। আর কোনও আজ্ঞা আছে মালকিন?

সিত্তু বলে, না। এখন শুধু আমাকে ওখানে পৌঁছে দিয়ে যাও। তারপর আবার যখন দরকার হবে ডাকবো।

শাহজাদা মা-এর কাছে এসে বললো, মা, ওটা কাদের প্রাসাদ? আমাদের চেয়েও তো বাহারী দেখছি।

-কী জানি বাবা, হয়তো কোনও পরদেশী সুলতান। বাদশাহর হবে।

পুত্র বলে, মা তুমি একবার গিয়ে আলাপ-সালাপ করে এসো না ওদের শাহজাদীর সঙ্গে।

মা বললো, ও প্রাসাদে শাহজাদী আছে, কে বললো তোকে!

—আমি যে ওকে দোতলার বারান্দার জাফরীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, মা! মা হাসলেন, ও, আচ্ছা এখন তুই যা আমি খোঁজ নিচ্ছি।

সেইদিনই বেগমসাহেবা সিত্তুর বাড়ি এলো। সির অসামান্য রূপ লাবণ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। বললেন বেটি, এখনও তুমি শাদী করনি কেন?

কোন সুযোগ-সুবিধা হয়নি বেগমসাহেবা।

সিত্তু নিরুত্তাপ কণ্ঠে কথাগুলো বলে। বেগমসাহেবা অবাক হলো, সে কি! তোমার মতো এমন রূপবতী কন্যাকে মাথার মণি করে নিয়ে যাওয়ার বাদশাহজাদার অভাব আছে নাকি। তুমি যদি রাজি থাক মা, তবে আমার ছেলের সঙ্গে তোমার শাদী হতে পারে।

সিত্তুবলে, আপনার ছেলেকে আমি শাদী করতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে।

—কী শর্ত, বেটি?

আপনার ছেলের মৃত্যু হয়েছে এটা চাউর করে দিতে হবে। এবং সেও সত্যিই মরার মতো পড়ে থাকবে। তারপর তাকে পর পর সাতখানা শব আচ্ছাদনে ঢেকে সারা শহরের পথ ধরে শোক-মিছিল করে ঘুরিয়ে এনে আমার এই বাগানে নামাতে হবে!

বেগমসাহেবা বললেন, বেশ ঠিক আছে। তোমার শর্তের কথা গিয়ে বলি আমার ছেলেকে।

প্রাসাদে ফিরে এসে বেগমসাহেবা পুত্রকে সব বললেন। শাহজাদা তখুনি মরার মতো ভান করে পড়ে রইলো। মা কেঁদে ভাসাতে লাগালেন!

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট এক শোক-মিছিল বের হলো শহরের পথে। শাহজাদার অকালমৃত্যুতে সারা শহরবাসী চোখের জল ফেললো। তারপর এক সময় শবাধার এনে নামানো হলো সিখানের প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে।

সবাই বিদায় নিলে সিত্তুখান নিচে নেমে এসে এক এক করে শবাচ্ছাদনগুলো সরিয়ে দেখলো। সে এরই জন্যে এতদিন দিন গুনছিলো।

-আরে তুমি?

সিখান বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকায়। শাহজাদাও লাফিয়ে ওঠে আরে তুমি? আমি যে তোমার জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করছিলাম মণি!

গল্প এখানেই শেষ।

সুলতান বাইবারস প্রীত হয়ে বললেন, চমৎকার তোমার কাহিনী জালান অল-দিন। এর আগে এমন কাহিনী শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

এরপর দশম কাপ্তেন এগিয়ে এলো তার কাহিনী শোনাতে।

এক সময়ে এক বাদশাহ ছিলো। তার একমাত্র পুত্র। নাম মহম্মদ। একদিন শাহজাদা বাদশাহকে বললো, বাবা আমি শাদী করবো।

বাদশাহ বললেন, অতি উত্তম কথা। তবে কিছুদিন সবুর কর, আগে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করি, হারেমের কোনও সঙ্গীকে সে পছন্দ করে রেখেছে কিনা তোমার জন্য।

শাহজাদা বললো তার চেয়ে বাবা, আমি নিজেই পছন্দ করে ঠিক করে নিই? বাদশাহ বললো, আমার তাতেও আপত্তি নাই। এরপর শাহজাদাকে সুন্দর একটা তাজি ঘোড়ায় চাপিয়ে বিদায় দিলেন বাদশাহ।

একটানা দুইদিন চলার পর এক মাঠের ধারে এসে শাহজাদা দেখতে পেলো, এক চাষী পিয়াজকলি কাটছে আর তার পাশে এক যুবতী কন্যা সেগুলো গুছিয়ে আঁটি বাঁধছে।

শাহজাদা ওদের পাশে গিয়ে সালাম জানিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ে মেয়েটিকে বলে, আমাকে একটু পানি খাওয়াও তো?

মেয়েটি জল এনে দেয়। শাহজাদা নিঃশেষ করে ফিরিয়ে দেয় পাত্রটি। তারপর চাষীর দিকে তাকিয়ে বলে, শেখসাহেব, আপনার কন্যাটি আমার হাতে দেবেন?

চাষী কৃতার্থ হয়ে বলে, আমি আপনার বান্দা। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?

শাহজাদা বলে, তা হলে ওই কথাই রইলো। এখন আমি আমার শহরে ফিরে যাচ্ছি। শাদীর সব উৎসব আয়োজন করে আবার ফিরে আসবো?

শাহজাদা প্রাসাদে ফিরে এসে বাদশাহকে বলে, বাবা পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি। এক চাষীর মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওকেই আমি শাদী করবো।

বাদশাহ বললেন, এক চাষীর কন্যাকে তোমার মনে ধরলো? ঠিক আছে, তোমার মাকে সেখানে পাঠাচ্ছি। সে সব জেনে আসুক, দেখে আসুক।

শাহজাদা বললেন, বেশ তাই পাঠান।

যথাসময়ে নফর-চাকর-দাসদাসী সমভিব্যাহারে বেগমসাহেবা চাষীর খামারে পৌঁছলেন! চাষী-কন্যা আদর আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি রাখলো না। মেয়েটির রূপলাবণ্য এবং বিনীত ব্যবহারে প্রীত হয়ে বেগমসাহেবা প্রস্তাব রাখলেন, তোমাকে দেখে আমার বড় পছন্দ হয়েছে মা, আমার ইচ্ছা তুমি আমার পুত্রবধূ হও।

মেয়েটি বললল, কিন্তু তা তো হতে পারে না। আমি কোনও সুলতান বাদশাহব, ছেলেকে স্বামী বলে বরণ করবো না।

বেগমসাহেবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেন মা, কী কারণ?

মেয়েটি সপ্রতিভভাবে জবাব দেয়, আমার স্বামী হাতে-কলমে কাজ-কাম করবে এই আমি চাই! কিন্তু আপনার পুত্র সোনার চামচ মুখে করে জন্মেছেন, তিনি কি কুটোগাছটা হাতে ধরতে পারবেন?

ক্রোধে আরক্ত হয়ে ফিরে এলেন বেগমসাহেবা। স্বামীকে বললেন, একেবারে বাজে। এতো বড় স্পর্ধা! মেয়েটা বলে কিনা বাদশাহর ছেলেকে সে শাদী করবে না।

কারণ? বাদশাহ প্রশ্ন করেন।

কারণ, মেয়েটি তাকেই স্বামীত্বে বরণ করবে, যে তারই মতো চাষবাসের কাজে মেতে থাকবে।

বাদশাহ বললেন, সে তো ঠিকই বলেছে। কিন্তু শাহজাদা একথা শুনে শয্যা গ্রহণ করলো।

সুতরাং বাদশাহ সমস্ত চাষী এবং কারিগরদের প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে সমবেত হতে ফরমান জারি করলেন। সুলতানের আদেশ অমান্য করে সাধ্য কার! যথা সময়ে দেশের তাবৎ কলাকুশলীরা হাজির হলো।

প্রথমে এক সূত্রধরকে প্রশ্ন করলেন বাদশাহ, তুমি আমার পুত্রকে কতদিনে তোমার কাজ শিখিয়ে দিতে পারবে?

সূত্রধর বলে, অন্তত দু’টি বছর সময় লাগবে, জাঁহাপনা।

সুলতান তাকে পাশে দাঁড়াতে বলে এক কর্মকারকে প্রশ্ন করলেন। তুমি কতদিনে পারবে তোমার জাতব্যবসার কাজ শেখাতে?

কর্মকার বললো, তা হুজুর বছরখানেক লাগবে।

তাকেও পাশে সরিয়ে দিলেন বাদশাহ। কিন্তু এক এক করে যাকেই প্রশ্ন করেন সেই বলে এক বছর কিংবা দু বছর। আবার কেউ তারও বেশি সময় প্রার্থনা করে।

বাদশাহ হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে।

এমন সময় একটা বেঁটে বাঁটকুল দুবলা লোক ল্যাং প্যাং করে লাফাতে লাফাতে বাদশাহর সামনে এগিয়ে আসতে থাকে।

বাদশাহ ঈষৎ বিরক্ত হয়েই তাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার তুমি অমন করে বাঁদর নাচ নাচছো কেন?

—জী হুজুর, আমিও এক কারিগর। জাঁহাপনার তলব পেয়ে এসেছিলাম এই সভায়। তা আমার সুরৎ আকার দেখে বুঝি শাহেনশাহর নজরেই ধরলো না। তাই ঐ রকম অঙ্গভঙ্গী করে বান্দা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো, গুপ্তাকী মাফ করবেন জাঁহাপনা।

—তা তুমি কি কর?

—জী আমি তাতী। কাপড় বুনে খাই।

-বেশ, এখন বলত, তোমার তাতের কাজ আমার ছেলেকে কতদিনে শেখাতে পারবে?

—মাত্র এক ঘণ্টায় জাঁহাপনা!

বাদশাহ অবাক হয়ে তাকায় লোকটার দিকে? পাগল নাকি?

—এক ঘণ্টায় শেখাবে তোমার বিদ্যা, একি সম্ভব?

—আলবত সম্ভব, জাঁহাপনা।

–ঠিক আছে, শাহজাদাকে আমি তোমার সঙ্গে দিচ্ছি। তাকে নিয়ে যাও তোমার বাড়িতে। শাহজাদাকে সঙ্গে করে তাতী তার নিজের ঘরে ফিরে এলো। এবং তাঁতের পাশে বসিয়ে সে তাকে বললো, আপনি শুধু আমার হাতের দিকে লক্ষ্য করুন, হুজুর। এই মাকুটা আমি এদিক থেকে চালিয়ে দেব আর ওদিক দিয়ে ধরে নেব।

শাহাজাদা এক মনে তাতীর তাঁত বোনা দেখতে থাকে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মোটামুটি সুন্দর একখানা রুমাল বুনে ফেলে সে।

এরপর তাঁতী বলে, এবার আপনি তাতে এসে বসুন হুজুর। যেমনটি দেখলেন ঠিক তেমনিভাবে মাকু চালিয়ে আপনিও একখানা রুমাল বুনুন দেখি।

শাহজাদা অতি সহজেই একখানা চমৎকার কাজকরা রুমাল বুনে ফেলতে পারে।

দু’খানা রুমাল হাতে করে শাহজাদাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসে তাঁতী। রুমাল দু’খানা বাদশাহর হাতে দিয়ে বলে, এই দু’খানার মধ্যে একখানা আপনার পুত্র বুনেছে। এখন আপনি বলুন দেখি, জাঁহাপনা, কোনখানা আপনার পুত্রের বোনা?

অপেক্ষাকৃত নিরেস রুমালখানা দেখিয়ে বাদশাহ বলেন, এইখানা মনে হচ্ছে!

-না হুজুর, ওখানা আমার হাতের।

বাদশাহ অবাক হয়ে বলেন। এতো চমৎকার আমার ছেলের হাতের কাজ?

তখুনি তিনি বেগমের কাছে গিয়ে বললেন, এই দ্যাখো, তোমার ছেলে পাকা তাতী হয়ে গেছে। যাও, গরীব চাষীর মেয়েকে বলে কয়ে রাজি করাও গে!

চাষী কন্যা শাহজাদার হাতের বোনা দেখে মুগ্ধ হয়ে বললো, এরপর আমার আর অমত নাই। আপনি শাদীর ব্যবস্থা করতে পারেন বেগমসাহেবা।

গল্প শেষ হলো।

সুলতান বাইবারস বললেন, চমৎকার হিতোপদেশের কাহিনী শোনালে হে কাপ্তেন!

এরপর একাদশ কাপ্তেন সালা অল-দিন কাহিনী শোনাবার জন্য এগিয়ে এলেন।

 

এক সুলতানের বেগম এক শুভ নক্ষত্রে একটি পুত্র-সন্তানের জন্ম দিলেন। ঠিক সেইদিনই সেই ক্ষণে সুলতানের আস্তাবলের এক গর্ভবতী ঘোড়া একটি বাচ্চা প্রসব করলো।

সুলতান বললেন, আল্লাহ আমার পুত্রের জন্যই বুঝি তাকে একইসময়ে দুনিয়ায় পাঠালেন।

শাহজাদার তরুণ বয়সকালে বেগমসাহেবা দেহ রাখলেন একদিন। আর কি আশ্চর্য, সেইদিনই আস্তাবলের ঐ ঘোড়াটারও মৃত্যু হলো।

যাই হোক, দিন কাটছিলো! বাদশাহ হারেমের এক বাঁদীকে বেগম করলেন। নবপরিণীতা বাঁদী-বেগমের মোহে সারা দিনরাত আচ্ছন্ন হয়ে কাটান সুলতান। তার একমাত্র পুত্র অনাদরে অবহেলায় কোনও রকমে বাড়তে থাকে প্রাসাদে। একা একাই বিদ্যালয়ে যায়। একা একাই ফিরে আসে। এতবড় প্রাসাদপুরীতে একমাত্র ঐ ঘোড়া ছাড়া তার আর পেয়ারের বলতে কেউ ছিলো না।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহারাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো বাহান্নতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে : শাহজাদার সৎমাটি ছিলো একটি অসৎ মেয়ে। প্রাসাদের হাকিমের সঙ্গে তার ছিলো অবৈধ প্রণয়।

একদিন তারা যুক্তি করলো পথের কাঁটা ঐ ছেলেটাকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে। হাকিম – বললো, ঠিক আছে, আমি বিষ এনে দেব, তুমি ওর খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিও!

বিদ্যালয় থেকে ফিরেই শাহজাদা সোজা গিয়ে ঢেকে আস্তাবলে। তার একমাত্র বন্ধু। ঘোড়াটাকে আদর সোহাগ করে দানাপানি খেতে দেয়। সেদিন সে বিদ্যালয় থেকে ফিরে আস্তাবলে গিয়ে দেখে ঘোড়াটা অঝোরে কাঁদছে। কাছে গিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করে সে, কি দোস্ত, কাঁদছো কেন? তোমার কি কোনও অসুখ করেছে?

ঘোড়াটা ঘাড় নেড়ে বলে, না সেজন্য নয়। আমি কাঁদছি তোমার জন্য?

—আমার জন্য? কেন?

ঘোড়া বলে, তোমার সত্য যে তোমাকে আজ রাতে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেবে। দোহাই তোমার, ও খাবার তুমি খেও না।

শাহজাদা সোহাগ জানিয়ে বলে, তুমি আমাকে এতো ভালোবাস? ঠিক আছে, ও খাবার আমি খাব না।

সন্ধ্যা হতে না হতে সত্য নিজের হাতে খাবার সাজিয়ে শাহজাদাকে ডেকে বলে, খেয়ে নাও বাবা।

শাহজাদা খেতে বসে খাবারে একটা পোকা পড়েছে বলে রেগে মেগে থালাগুলো সব উল্টে ফেলে দিয়ে উঠে পড়ে। টেবিলের নিচে যে পোষা বিড়ালটা প্রসাদের আশায় বসেছিলো, আস্ত ফলারটা পেয়ে সে গোগ্রাসে খেতে খেতে তখনি মেঝেয় ঢলে পড়লো।

এই দৃশ্য শাহজাদার নজর এড়ায় না। কিন্তু সে যেন কিছুই দেখেনি, এমনি ভাব দেখিয়ে নিজের ঘরে শুতে চলে গেলো।

বাঁদী-বেগম তার প্রণয়ীকে প্রশ্ন করলো, কী ব্যাপার ছেলেটা আগে থেকে সব টের পেলো কি করে?

হাকিম বললো, ঐ ঘোড়াটা সর্বজ্ঞ। দৈব ক্ষমতাবলে সব ও দিব্য চক্ষুতে দেখতে পায়। ওই সাবধান করে দিয়েছে শাহজাদাকে।

বাঁদীটার হিংস্র চোখ জ্বলে উঠলো, তা হলে আগে ঐ ঘোড়াটাকেই খতম করতে হবে।

হাকিম বললো, হ্যাঁ, তাছাড়া আর উপায় নাই। তুমি অসুখের ভান করে পড়ে থাক। সুলতান আমাকে ডাকবেন। তখন আমি তাকে বলবো, এ অসুখ একটিমাত্র দাওয়াই-এ সারতে পারে। তা আপনার সবচেয়ে প্রিয় অশ্বের বুকের কলিজা দিয়েই কেবল তৈরি করা সম্ভব।

হাকিমের পরামর্শমতো বাঁদী-বেগম শয্যা নিলো। সুলতান চিন্তিত হয়ে হাকিমকে ডাকলো।

সব শুনে সুলতান বললেন, ব্যাপারটা একটু মুশকিলের। ঘোড়াটা ছেলের বড় আদরের। যাই হোক, সে পাঠ শেষ করে ফিরে আসুক, তাকে বুঝিয়ে রাজি করাচ্ছি।

বিদ্যালয় থেকে ফিরে এলো শাহজাদা। সুলতান তাকে কাছে ডেকে বললেন, তোমার মা অসুস্থ। একমাত্র তোমার ঘোড়ার কলিজার বিনিময়ে তার রোগ নিরাময় হতে পারে। মায়ের রোগমুক্তির কথা : ভেবে আমি তোমাকে ঘোড়াটার মায়া ত্যাগ করতে চায় বলছি, বাবা।

শাহজাদা ক্ষণকাল মৌন থেকে বললো, ঠিক আছে বাবা, আমি সম্মত আছি। তবে আমার জন্মের পর থেকে ওর পিঠে আমি চড়িনি কোনও দিন। ও তো চিরদিনের মতো চলেই যাবে আমার কাছ থেকে, তাই শেষ বিদায় দেবার আগে আজ আমি ওকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরে। আসি।

সুলতান বললেন, বেশ যাও, শেষ বারের মতো তোমার মনের সাধ মিটিয়ে এসো।

আস্তাবলে গিয়ে উত্তম সাজে সজ্জিত করলো সে ঘোড়াটিকে। তারপর বাইরে এসে পিঠে চেপে বসলো। পক্ষীরাজ তীরবেগে ছুটে গেল, পোলো মাঠের ওপ্রান্তে। আবার চোখের পলকে ফিরে এলো প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে। আবার সে বাঁক নিয়ে বায়ুবেগে ছুটতে থাকলো শহরের সদর রাস্তা ধরে।

ছুটতে ছুটতে এক সময় সে শহরের শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে ফাঁকা মরু-প্রান্তরে গিয়ে পড়লো।

এরপর আর পিছন দিকে ফিরে তাকালো না শাহজাদা। ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে বিশাল প্রান্তরও অতিক্রম করে অন্য এক গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করলো।

একটানা তিনদিন ছুটার পর এক নতুন এ সলতানিয়তের শহরে এসে উপনীত হলো ওরা।

সুলতানের প্রাসাদ-সংলগ্ন একটি মনোহর? উদ্যান। সেই উদ্যানের ওপারে একটা জলের কূয়া। একটা লোক জোড়াবলদের ঘানি ঘুরিয়ে কপিকলের সাহায্যে জল তুলছিলো।

শাহজাদা ঘোড়া থেকে নেমে লোকটির কাছে গিয়ে বললো, আমি পরদেশী। সঙ্গে কোনও রেস্ত নাই। আমাকে যদি একটা কাজ-কামের ব্যবস্থা করে দাও তবে খুব ভালো হয়।

লোকটি বললল, আমার এই ঘানির বলদ দুটোকে চালাতে হবে, পারবে? শাহজাদা বলে, খুব পিরবো।

এরপর সে ঘোড়াটার কাছে গিয়ে বলে, এবার বিদায় বন্ধু, তুমি চলে যাও। এখানেই আমার একটা হিল্লে হয়ে গেলো।

ঘোড়াটা বললো আমার ঘাড়ের একগাছি লোম ছিঁড়ে রাখ বন্ধু। যখনই প্রয়োজন হবে একটা ললামে আগুন ধরালে সঙ্গে সঙ্গে আমি হাজির হবো তোমার সামনে।

কূয়ার ওপাশে ফুলবাগিচা। সেই বাগিচায় প্রতিদিন বিকালে সুলতানের সাতটি কন্যা বেড়াতে আসে।হঠাৎ সেদিন ওরা এক প্রিয়দর্শন তরুণকে ঘানির রাখালের কাজ করতে দেখে অবাক হয়ে যায়। এক বোন বলে, দ্যাখ দ্যাখ, ছেলেটি কি সুন্দর। মনে হয় বড় ঘরের আদরের দুলাল।

ছোট বোন বলে, রাখালই হোক আর যেই হোক ওকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে শাদীই করবো না।

সুলতান মেয়েদের ডেকে বললেন, আমি ঠিক করেছি পছন্দমতো পাত্রের সঙ্গে তোমাদের শাদী দিয়ে দেব।

সুলতান ঘোষণা করে দিলেন, তাঁর সাতটি কন্যার শাদী দেবেন তিনি। দেশে অবিবাহিত যুবকরা ইচ্ছা করলে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে সমবেত হতে পারে। কন্যারা যে যাকে পছন্দ করবে তার সঙ্গেই সেই কন্যার শাদী দেওয়া হবে।

যথাসময়ে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার তরুণ যুবক এসে সমবেত হলো। কন্যারা রুমাল হাতে বসলো অলিন্দে। তারপর নিজের নিজের পছন্দসই পাত্রের দিকে ছুঁড়ে দিলে সেগুলো।

সুলতান দেখলেন, ছ’খানি রুমাল ছ’জন ভাগ্যবান যুবকের মাথায় গিয়ে পড়েছে।

যথাসময়ে ঐ ছয়টি পাত্রের সঙ্গে ছয়টি কন্যার শাদী হয়ে গেলো। কিন্তু ছোট কন্যা তার রুমাল নিক্ষেপ করেনি। সে কারণে তার শাদী আর হতে পারলো না।

সুলতান ছোট কন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বড় বোনরা সবাই যে যার মতো স্বামী – পছন্দ করে নিলো, কিন্তু তুমি করলে না কেন?

ছোট কন্যা বললো, আমি যাকে শাদী করতে চাই, সে আপনার আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়নি, বাবা।

-কে সে?

—আমাদের বাগানের পাশে যে কুয়াটা আছে তার ঘানির রাখালকে আমি স্বামী হিসেবে পেতে চাই বাবা।

–বেশ তো, তাই হবে, আমি তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি।

সেইদিনই রাখালবেশী শাহজাদার সঙ্গে ছোটকন্যার শাদী হয়ে গেলো মহা ধুমধামে।

এরপর বাদশাহী জামাই-আদরে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। একদিন শাহজাদা খবর পেলো যে তার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। এবং শূন্য সিংহাসনে চেপে বসেছে সেই হাকিম। ঘোড়ার একটি লোমে আগুন ধরিয়ে দিলো শাহজাদা। আর তক্ষুণি এসে হাজির হলো এই ঘোড়াটি। শাহজাদা বললো, বন্ধু, বাবা দেহ রেখেছেন। এখন আমার সিংহাসন অধিকার করে বসেছে ঐ হাকিম। চলো, আর দেরি নয়, এখুনি আমাকে দেশে ফিরতে হবে।

শ্বশুরের এক বিশাল সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে সে সেইদিন নিজের শহরে রওনা হয়ে গেলো।

এরপর ঐশয়তান হাকিমের কি দশা হয়েছিলো নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন জাঁহাপনা।

গল্প শেষ হলো।

সুলতান বাইবারস বললেন, চমৎকার!

এরপর দ্বাদশ কাপ্তেন এগিয়ে এসে তার গল্প শুরু করলো।

 

এক সুলতানের এক বন্ধ্যা বেগম ছিলো। দেশ-বিদেশের কত হাকিম বদ্যি এসে দাওয়াই বড়ি দিয়ে গেছে কিন্তু বেগম সন্তান-সম্ভবা হতে পারেননি।

একদিন এক মূর এলো। নিজের পরিচয় দিয়ে সে বললো, আমি আপনার বেগমের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

সুলতান জিজ্ঞেস করেন, কী শর্ত?

-আপনার বেগমের গর্ডে প্রথম যে সন্তান উৎপাদন হবে তা আমাকে দিয়ে দিতে হবে।

সুলতান তৎক্ষণাৎ সম্মত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই দেব!

মুর তখন দু’টি মণ্ডা বের করে সুলতানের হাতে তুলে দিলেন। তার একটি সবুজ আর একটি লাল রঙের।

—এই সবুজটা আপনি নিজে খাবেন, জাঁহাপনা। আর এই লাল মাটি খেতে দেবেন বেগমসাহেবকে। এরপর যা করার তিনিই করবেন।

এই বলে মূর বিদায় নিলো। যথাসময়ে বেগম একটি পুত্র-সন্তান প্রসব করলেন। সুলতান তার নাম রাখলেন মহম্মদ।

অপরিসীম আদর-যত্নের মধ্যে লালিত হতে লাগলো মহম্মদ। তার লেখা-পড়ার জন্য বিশেষভাবে যত্নবান হলেন সুলতান।

এরপর বেগমসাহেবা দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম দিলেন। তার নাম রাখা হলো আলী। আলী কিন্তু মহম্মদের মতো প্রিয়দর্শন বা মেধাবী হলো না। এরপর আরও একটি পুত্রসন্তানের মা হলেন বেগমসাহেবা। তার নাম মাহমুদ। এই ছেলেটি একেবারে গবেট হাঁদা।

দশ বছর পরে।

একদিন ঐ মূর এসে সুলতানকে বললেন, আপনার ওয়াদা পূরণ করুন, জাঁহাপনা। আমার প্রাপ্য জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে আমার হাতে দিয়ে দিন।

সুলতান বেগমের কাছে গিয়ে মূরের দাবীর কথা জানাতে বেগম প্রবল আপত্তি করে বললো, না, সে হতে পারে না। আপনি বরং আলীকে দিয়ে দিন ওর হাতে।

আলীকে সঙ্গে নিয়ে মূরটি বিদায় হলো। হাঁটতে হাঁটতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। প্রচণ্ড সূর্যতাপে দুনিয়া তখন ঝলসে যাচ্ছে। এক জায়গায় থেমে মূর আলীকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার খিদে-তেষ্টা পায়নি।

আলী বললো, পাক্কা আদ্ধেক দিন ধরে একটানা হাঁটছি, এখনও আপনি জিজ্ঞেস করছেন, খিদে পেয়েছে কিনা? আশ্চর্য!

মূর গম্ভীর হয়ে শুধু একটা আওয়াজ করলো, হুম!

তারপর সে আলীকে নিয়ে আবার ফিরে এলো সুলতানের প্রাসাদে।

-এ ছেলে তো আমার নয়, জাঁহাপনা? তিনজনকেই একসঙ্গে এনে দাঁড় করান এখানে, আমি নিজে চিনে নেব কোনটা আমার।

সুতরাং নিরুপায় সুলতান তিন পুত্রকেই এনে পাশাপাশি দাঁড় করালেন। মহম্মদকে দেখিয়ে মূর বললেন, এটা হচ্ছে আমার।

মহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে আবার সে হাঁটাপথে রওনা হলো। প্রায় আধখানা দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। সূর্যের খরতাপে দগ্ধ হচ্ছে দুনিয়া। একসময় মূর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মহম্মদকে জিজ্ঞেস করলো, খাবে কিছু? খিদে-তেষ্টা পায়নি তোমার?

মহম্মদ বিনয়াবনত হয়ে বললো, আপনি যদি তৃষ্ণার্ত হন তবে আমিও তৃষ্ণার্ত। আপনি যদি ক্ষুধার্ত বোধ করেন, তবে আমি ক্ষুধার্ত সন্দেহ নাই।

যাদুকর বুকে জড়িয়ে ধরলেন মহম্মদকে। আদর সোহাগ করে বললেন এই তো বুদ্ধিমান বিনয়ী ছেলের কথা। তুমি জ্ঞানে গরিমায় শ্রেষ্ঠ হবে। তুমিই আমার সন্তান।

মহম্মদকে হাতে ধরে সে মরোক্কো শহরে এসে উপস্থিত হলো। একটি উদ্যানের সুশীতল ছায়ায় বসে দু’জনে খানাপিনা করলো। তারপর মহম্মদের হাতে একখানা কিতাব তুলে দিয়ে মূর বললো, খুলে পড় দেখি!

মহম্মদ বইটার পাতা ওলটাতে থাকলো। কিন্তু একটা বর্ণও বুঝতে পারলো না কিছু। একেবারে দুর্বোধ্য ভাষা।

ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইলো মূর, তোমাকে আমি নিজের পুত্র বলে গ্রহণ করেছি। অথচ এই বই তুমি পাঠ করতে পারছো না? দেখ চেষ্টা কর, এর পাঠোদ্ধার তোমাকে করতেই হবে। তা না হলে গগ এর ম্যাগগের নামে শপথ করে বলছি, একমাস পরে তোমার ডান হাতখানা আমি কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেব। এই আমি চললাম। ঠিক একমাস পরে আবার আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে। এই সময়ের মধ্যে যেভাবে পার এর পাঠোদ্ধার করবে।

এই বলে মহম্মদকে ঐ বাগানে ফেলে রেখে সে হন হন করে বেরিয়ে গেলো।

এরপর ঊনত্রিশটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। মহম্মদ ঐ বইখানা নিয়ে সারাদিন রাত নাড়াচাড়া করে। কিন্তু বইটার যে কোন্ দিক সোজা আর কোন্ দিক উল্টো-তাই সে আন্দাজ করতে পারে না। বইটাকে ফেলে রেখে সে উঠে দাঁড়ালো, না, মরতে যখন হবেই তখন ঐ দুর্বোধ্য পুঁথির পাতায় মুখ থুবড়ে পড়ে থেকে কী লাভ? তার চেয়ে সে খোলামেলা মুক্ত হাওয়ায় ঘুরে বেড়াবে বাকী দিনটা। দেখবে প্রকৃতির শোভা, গাইবে গান প্রাণভরে।

পায়ে পায়ে সে বাগানের অপর প্রান্তে চলে যায়। কতরকম ফুলে ফলে ভরা বাগানটি। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় মহম্মদের।

হঠাৎ একটা গাছের ডালের দিকে নজর পড়তে আঁৎকে ওঠে সে। একটি পরমাসুন্দরী কিশোরী। তার মাথার দুটি বেণী দিয়ে বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে গেছে কেউ! মহম্মদ কাছে গিয়ে মেয়েটিকে মুক্ত করে নিচে নামালো। কৃতজ্ঞতায় অশ্রু ভরে এলো মেয়েটির চোখে। দু’হাত বাড়িয়ে মহম্মদকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, কে তুমি? এখানে এলে কী করে?

মহম্মদ বললো, তার কাহিনী।

উনত্রিশটা দিন চলে গেছে। সে বইএর একবর্ণও আমি উদ্ধার করতে পারিনি। আগামীকাল মুরের আসার তারিখ। আমি জানি, কালই আমার এই ডান হাতখানা কেটে ফেলবে সে।

মেয়েটি বললো, অমন বিচলিত হয়ো না। আমি জানি ঐ পুঁথি পাঠ করতে। বলবে কী করে কার কাছে শিখেছি? কারো কাছে শিখিনি, আমার অন্তর থেকেই আমি শিক্ষা পেয়েছিলাম। ঐ মুর আমাকেও বলেছিলো, পুঁথিখানা পাঠ করতে। আমি গড় গড় করে পড়ে দিতেই সে রাগে ফেটে পড়লো। তারপর চুলের বেণী ধরে নিয়ে এলো এই গাছতলায়। তারপর একটা ডালে ঝুলিয়ে রেখে চলে গেলো। সেই থেকে আমি এখানে এইভাবে ঝুলছিলাম। যাক, সে সব কথা, এখন চলো তোমাকে আমি পুঁথিটার পড়া শিখিয়ে দিই।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মহম্মদ গড়গড় করে পড়ে যেতে পারলো গোটা বইটা। মেয়েটি বললো কাল যখন মূর এসে তোমাকে পড়তে বলবে, তুমি কিন্তু ভুলেও পড়ে দিও না। তাহলে

সে তোমাকেও গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখবে।

মহম্মদ বললো, কিন্তু তা না হলে ও যে আমার ডান হাতখানা কেটে ফেলবে?

—সেজন্য তুমি ভেব না। আমি সব ঠিক করে দেব। এবার আর দেরি করো না। আমি যেমনটি গাছের ডালে ঝুলছিলাম তেমনি করে আমাকে আবার ঝুলিয়ে রেখে এসো ঐ ডালে।

পরদিন যাদুকর মূর এসে উপস্থিত হলো।

-এবার নিশ্চয়ই পুঁথিখানা পড়ে শোনাবে আমাকে?

মহম্মদ আমতা আমতা করে বলে, তা কি করে সম্ভব, বলুন! আমি তো ঐ ভাষার একটি বর্ণও চিনি না।

মূর রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললো, ওসব কোনও ওজর আমি শুনতে চাই না।

এই বলে সে তলোয়ারটা খুলে এক কোপে নামিয়ে দিলো মহম্মদের ডান হাতখানা।

—এই আমি চললাম, কিন্তু আবার আসবো একমাস পরে। তখনও যদি দেখি তুমি পড়তে পারছ না তা হলে তোমার গর্দান নেব আমি।

মূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সেখানে। মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো কোথায়।

কাটা হাত নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মহম্মদ এসে দাঁড়ালো মেয়েটির সামনে।

—তোমার কথামতো কাজ করে এই আমার লাভ হলো। মেয়েটি মৃদু হেসে বললো, আমাকে আগে নামাও, তারপর আমি তোমার হাত জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি।

ছেলেটি ওকে নিচে নামালে সে একটা গাছের তিনটি পাতা ছিঁড়ে এনে রস করে কাটা হাতে লাগিয়ে দিতে হাতখানা জোড়া লেগে গেলো।

মহম্মদ অবাক হয়ে বললো, এমন অলৌকিক দাওয়াই তুমি পেলে কার কাছে? ঐ মূর শিখিয়েছে?

মেয়েটি ঠোঁট ওলটায়, মূর? ঐ মূর শেখাবে আমাকে? ও কি জানে যে শেখাবে?

এই বিদ্যেটা আয়ত্ত করার জন্য আজ চল্লিশটা বছর হন্যে হয়ে ঘুরছে সারা দুনিয়া। কিন্তু চল্লিশ বছর ঘুরলেও, আমি জানি, এ বিদ্যা সে শিখতে পারবে না কারো কাছে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসেই রইলো।

 

নয়শো তিপ্পান্নতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে :

এরপর মেয়েটি পুঁথিখানার কয়েকটা ছত্র আবৃত্তি করে পাঠ করলো। এবং অন্য একটা লতার পাতা হাতে নিয়ে তুলতেই বায়ুবেগে ধেয়ে এসে দাঁড়ালো দু’টি উট। মাথা মাটিতে নুইয়ে ওরা সালাম জানালো মেয়েটিকে।

সে বললো, এই উট দুটো কোনও সাধারণ উট নয়। এরা তীববেগে ছুটে চলতে পারে। এসো আমরা দুজনে দু’টোর পিঠে চেপে বসে নিজের দেশে পালিয়ে যাই। পরে যথাসময়ে তুমি আমার বাবার কাছে এসে আমার পাণিপ্রার্থনা করো। আমার বাবার সলনিয়ত তোমার অজানা নয়। পথঘাট সব বলে দিচ্ছি।

মহম্মদ প্রাসাদের এক খোজা নফরকে বললো, এই উটটা আজই হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিয়ে আয়। কিন্তু খবরদার, এর লাগামটা যেন বেচে দিসনি।

হাটে গিয়ে এক চরসখোর দালালের পাল্লায় পড়ে দারুণ জমে গেলো খোজাটা। কারণ সেও চরসের এক ভক্ত। ঝোকের মাথায় গল্প জমাতে জমাতে দালালটা খোজাকেও একটু প্রসাদ দিয়েছিলো। আর তাতেই সে বেলালুম সব গুলে খেয়ে শাহজাদার কথা অমান্য করে লাগাম সুদ্ধ উটটা প্রায় জলের দরে বেচে দিয়ে গেলো তার কাছে।

দালালটা উটকে তার দোকানের সামনে বেঁধে একটা কাঠের গামলায় খানিকটা পানি এনে ধরলো তার সামনে। লাগামটা খুলে দিলো। উটটা পানিতে মুখ না দিয়ে এক এক করে চারখানা পা ডুবিয়ে দিলো গামলার মধ্যে। আর কী আশ্চর্য্য, ঐ অত বড় পাহাড় সমান উটটা নিমেষে এতটুকু ইঁদুর ছানার মতো হয়ে গিয়ে জলের মধ্যে ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

চরসখোর দালালটা গেল গেলো ধর ধর’আওয়াজ তুলে পাড়া-পড়শীদের হতচকিত করে দিলো। মুহূর্তে ছুটে এলো সবাই চারদিক থেকে।

-কী, কী হলো শেখ?

—আমার উটটা ঐ পানির গামলার মধ্যে ডুবে গেছে। ওকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।

প্রতিবেশিরা মুচকি হেসে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। একেই না বলে চরসখোর! এ তো গরুকেও গাছে তুলে দিতে যাচ্ছে।

এদিকে যখন এই ঘটনা ঘটছে তখন ওদিকে সেই যাদুকর মূর, পাখিরা পালিয়েছে দেখে ক্রোধে জ্বলতে থাকে। হুম্ আমাকে ধাপ্পা দিয়ে কোথায় পালাবে বাছারা? পৃথিবী বা যে-কোন গ্রহনক্ষত্রেই তোমরা থাক, খুঁজে আমি বের করবোই।

আর তিল মাত্র সময় বিলম্ব না করে সে তখুনি মহম্মদের শহরে রওনা হয়। এবং চোখের পলকে এসে পৌঁছয় সেই উটের দালালের দোকানের সামনে! দালালটা তখন উট হারানোর শোকে কপাল চাপড়িয়ে হা-হুতাশ করছিলো। যাদুকর ওকে আশ্বাস দিয়ে বললো, তোমার উট আমি খুঁজে এনে দেবো, শেখ। কিছু চিন্তা করো না। এখন একটা কাজ কর, উটের এই লাগামটা আমাকে দিয়ে দাও। তার বদলে আমি তোমাকে উটের কেনা দামের চেয়ে আরও একশো দিনার বেশি দিচ্ছি।

দালালটা এক কথায় সম্মত হয়ে লাগামটা দিয়ে দিলো মূরকে। খুশির আনন্দে নেচে  উঠলো যাদুকর। ঐ লাগাম মন্ত্রপুত। ওটার সাহায্যে আবার উটটা ফিরে পাওয়া সম্ভব ছিলো। এ ছাড়াও ঐ লাগামটা ইচ্ছামতো যেকোনও মানুষকে যেকোনও স্থান থেকে পাকড়াও করে এনে হাজির করতে পারে।

লাগামটা ধরে তাকে আদেশ করা মাত্র প্রাসাদ থেকে মহম্মদকে টেনে বের করে আনলো সে। যাদুকরের সামনে এসে মহম্মদ মন্ত্র-চালিতের মত হাঁটু গেড়ে বসে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালো। যাদুকর তাকে পলকের মধ্যে একটি উটে রূপান্তরিত করে লাগামটা তার মুখে পরিয়ে দিয়ে পিঠের ওপর চেপে বসলো।

এবার যাদুকর যাবে ঐ শাহজাদীর শহরে।

উট হয়ে মহম্মদ যাদুকরকে পিঠে করে সারাটা পথ বয়ে নিয়ে এলো। এবং সারাক্ষণ ধরে সে দাঁত দিয়ে লাগামের দড়িটা কুট কুট করে কাটতে কাটতে আসছিলো। শাহজাদীর প্রাসাদ-সংলগ্ন বাগানের মধ্যে এসে থামলো যাদুকর। নিচে নামার জন্য উটকে হাঁটু গেড়ে নিচু হওয়ার জন্য নির্দেশ করলো সে। উট মহম্মদ তখন লাগামের দড়িটা প্রায় কেটে শেষ করে এনেছে। হঠাৎ মাথায় ঝকানি দিতে লাগামের দড়িটা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে লাগামের দৈবগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মহম্মদ শাপমুক্ত হয়ে একটা ডালিম গাছের অত্যুচ্চ শাখায় একটা বিরাট ডালিম হয়ে ঝুলতে থাকলো। অনেক চেষ্টা করেও আর তাকে নাগালের মধ্যে পেলো না যাদুকর।

শাহজাদীর বাবা সুলতানের দরবারে উপস্থিত হয়ে মুর তার পরিচয় দিয়ে প্রার্থনা জানালো, আপনার উদ্যানের একটি ডালিম যদি আমাকে দান করেন প্রভু, তবে আমার অন্তসত্ত্বা বিবির মনোবাসনা পূরণ করতে পারি। আপনি তো জানেন জাঁহাপনা, গর্ভবতী নারীর কামনা-বাসনা অপূর্ণ রাখলে স্বামীকে দোজকে যেতে হয়।

সুলতান বললেন, কিন্তু দরবেশ জী, এখন তো ডালিমের সময় নয়, কী করে আপনাকে সে ফল দেব? আপনি বরং অন্য কোনও ফল যাঞ্চা করুন। আমি আপনার অভিলাষ পূর্ণ করতে চাই।

যাদুকর বললো, কিন্তু অন্য ফলে আমার কাজ হবে না; প্রভু আপনার বাগানে যে একটি মাত্র ডালিম হয়েছে সেইটিই আমার আবশ্যক।

সুলতান বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার উদ্যানে একটি ডালিম ধরেছে এখন? আপনি কি অন্য ফলকে ডালিম ভ্রম করেননি ফকিরসাহেব?

যাদুকর বলে, না শাহেনশাহ।

তখুনি বাগানের প্রধান মালিকে সুলতান হুকুম করলেন, যাও, বাগানের ডালিম গাছগুলোর মধ্যে একটায় নাকি একটা ডালিম ধরেছে। ওটা পেড়ে নিয়ে এসে এই দরবেশজীকে দিয়ে দাও।

মালি বললো, একি অসম্ভব সংবাদ শোনাচ্ছেন জাঁহাপনা! সূর্য পশ্চিমে উদয় হতে পারে কিন্তু অকালে কখনও ডালিম গাছে ফল ধরে না।

—তবু আমার আদেশ, একবার বাগানের গাছগুলো পরীক্ষা করে এসো। মালি অবিশ্বাস নিয়ে দরবার ছেড়ে চলে গেলো। এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো, না হুজুর, আপনি যে সংবাদ পেয়েছিলেন তা যথার্থ নয়।

এবার যাদুকর বেশ কঠিন কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বলে, এই মালি সত্য ভাষণ করছে না জাঁহাপনা। আমি এখনও বলছি আপনার উদ্যানে একটি মাত্র ডালিম ধরে আছে। ও ভালো করে না দেখেই আপনাকে ধোকা দিচ্ছে। আমার সঙ্গে সে চলুক, আমি দেখিয়ে দেব ডালিমটা। আর যদি দেখাতে না পারি শাহেনশাহ যেন আমার গর্দান নেন।

সুলতান বললেন, আপনার কথাই মেনে নিলাম ফকিরসাহেব। আপনি মালির সঙ্গে বাগানে যান।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মালি বিরাট আকারের একটা ডালিম এনে সুলতানের হাতে দিলো। অত বড় ডালিম সুলতান জীবনে দেখেননি কখনও। খুশিতে তিনি ডগমগ হয়ে উঠলেন। উজিরকে বললেন, এমন একটা আশ্চর্য ফল আমি অন্যকে দান করতে চাই না উজির।

উজির বললো, কিন্তু আগেই তো আপনি শর্ত করেছেন জাঁহাপনা! যদি এই ফলটি সত্যিই বাগানে না পাওয়া যেত, তবে তো আপনি এই ফকিরের গর্দান নিতেন।

—অবশ্যই। কারণ শর্ত তাই ছিলো।

উজির বলে, তা হলে শর্তের অন্য দিকটাও আপনাকে রক্ষা করতে হবে, না হলে অবিচার হবে হুজুর।

সুলতান ঘাড় নেড়ে বললেন, তুমি যথার্থ বলেছ উজির। তাহলে ঘোরতর অধর্ম হবে।

এই বলে সুলতান ডালিমটা যাদুকরের হাতে অর্পণ করতে গেলেন। কিন্তু কি কারণে বোঝা গেলো না, ডালিমটা হাত ফসকে শ্বেত পাথরের মেঝেয় পড়ে ফেটে চৌচির হয়ে সব দানাগুলো ইতস্ততঃ ছড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে যাদুকর দু’হাত দিয়ে দানাগুলো খুঁটে খুঁটে কোচড়ে ভরতে লাগলো।

এইভাবে একটি বাদে সব কটি দানাই সে সংগ্রহ করে নিতে পারলো। কিন্তু যেটি নাগালের বাইরে একটি গর্তের মধ্যে ঢেকে গেছে সেটাকে আর কিছুতেই কজা করতে পারলো না। অথচ যাদুকর নিশ্চিত জানে, ঐ দানাটির মধ্যে মহম্মদ অবস্থান করছে।

গর্তটার মধ্যে মুখ নামিয়ে সে হাত বাড়িয়ে দিলো দানাটিকে তুলে আনবার জন্য। হঠাৎ প্রচণ্ড এক আর্তনাদ করে উল্টে পড়ে গেলো যাদুকর! সুলতান এবং দরবারের সবাই লক্ষ্য করলেন, একখানা তরবারীর আমূল বিদ্ধ হয়ে গেছে যাদুকরের বক্ষদেশ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।

গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে মুহূর্ত মধ্যে যাদুকর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। আর তখুনি ঐ গর্ত থেকে নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এলো প্রিয়দর্শন শাহজাদা মহম্মদ।

সুলতানের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো শাহজাদী, সে বাবাকে বললো, এই সেই শাহজাদা মহম্মদ। এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম আমি।

এরপর সুলতান মহম্মদকে আদর করে পাশে বসালেন। সেইদিনই কাজী সাক্ষী ডেকে নিজের কন্যার সঙ্গে শাদী দিয়ে দিলেন মহম্মদের।

দ্বাদশ কাপ্তেন নাসর অল দিনের কাহিনী শেষ হলে সুলতান বাইবারস প্রীত হয়ে প্রত্যেক কাপ্তেনকে একশত দিনারের অতিরিক্ত মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিলেন।

শাহরাজাদ মুচকি হেসে কাহিনী শেষ করে থামলো।

সুলতান শাহরিয়ার প্রীত হয়ে বললেন, শাহরাজাদ আজ সত্যিই মনে হচ্ছে রাতগুলো কত ছোট ছোট। অথচ একদিন ছিলো যখন বিনিদ্র রাত্রির প্রহর গুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তখন মনে হতো ওরা যেন অশেষ অনন্ত, কিছুতেই ফুরোতে চাইতো না। আজ এই অসম্ভব সম্ভব হতে পেরেছে—সে শুধু তোমার এই সব মধুর গল্পের জন্য।

শাহরাজাদ বলে, তাই যদি মনে করেন জাঁহাপনা, তবে আরও অনেক কাহিনী আপনাকে শোনাতে পারি।

—সে তো শুনবোই, শাহরাজাদ।

শাহরাজাদ আবার এক নতুন কাহিনী শুরু করে—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *