3 of 4

৪.১৩ সুলতান মামুদের কাহিনী

মিশরের জ্ঞানী-গুণী এবং বিচক্ষণ সুলতান হিসাবে সুলতান মামুদের নাম বিশ্ববিখ্যাত ছিলো।

বিশাল সলনিয়ত এবং অপর্যাপ্ত ধন-গৌরবের মালিক হয়েও কিন্তু সুলতান বড় দুঃখী বড় নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি। প্রায় বেশির ভাগ সময়ই তিনি প্রাসাদের একান্ত নিরালা নিভৃত কক্ষে বিষাদ-বিষণ্ণ জীবন যাপন করতেন। আল্লাহ তাকে অফুরন্ত ঐশ্বর্য দিয়েছিলেন, এবং দিয়েছিলেন ভোগ করার মত সুন্দর সুস্থ স্বাস্থ্য যৌবন-দীপ্ত কামনা-বাসনা। তার শৌর্য বীর্য খ্যাতি প্রতিপত্তির কোনও অভাব ছিলো না। মিশর তখন দুনিয়ার সেরা শহর, তার প্রাকৃতিক শোভা নয়নাভিরাম। আর নারীসঙ্গ? তার তো কোনই অভাব ছিলো না। নীলের জলের মতো সুন্দরী নারীর সমুদ্রে তিনি সাঁতার কেটে অবগাহন করতে পারতেন ইচ্ছা করলেই।

কিন্তু এসবই তার কাছে তুচ্ছ বিষাদময় এবং সাহারা তুল্য ছিলো। দরবারের কাজকর্ম শেষ হতে না হতে তিনি প্রাসাদে গিয়ে প্রবেশ করতেন। তারপর সারা দিনে-রাতে তার আর সাক্ষাৎ পেত না কেউ। অবশ্য কি যে তার দুঃখ, কি যে তার ব্যথা, সে কথা সারা দেশের একটি মানুষও জানতো না। সুলতান মামুদ নিজেই কি তা জানতেন?

একদিন তিনি নিজের নিভৃত কক্ষে বিষণ্ণ বদনে বসেছিলেন। এমন সময় তার প্রধান উজির এসে সভয়ে বললো, জাঁহাপনা, পশ্চিম সীমান্ত দেশ থেকে প্রবীণ প্রাজ্ঞ অলৌকিক গুণধর এক ব্যক্তি এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। শুনেছি তিনি নাকি আল্লাহর আশীর্বাদধন্য এক ধন্বন্তরী হাকিম। কোনও কঠিন রোগই নাকি তার কাছে দুরারোগ্য নয়। তাঁর দাওয়াই নাকি যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। জাঁহাপনা যদি অনুমতি করেন তবে তাকে আপনার সামনে হাজির করতে পারি।

সুলতান মামুদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। উজির উৎফুল্ল হয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো।

রাত্রির অন্ধকার কাটতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো কুড়িতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

প্রায় শতবর্ষের এক বৃদ্ধকে সঙ্গে করে উজির এসে দাঁড়ালো। চুল দাড়ি সব তুলোর মত শুভ্র। চোখ দুটি কোটরাগত, কিন্তু দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত।

বৃদ্ধ কুর্নিশ জানালো না। বিচিত্র এক কণ্ঠস্বরে বললো, খোদা তোমার মঙ্গল করুন সুলতান মামুদ। আমার ভাই আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমি তারই দোয়া বয়ে নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।

বৃদ্ধ সুলতানের হাত ধরে তাকে একটা বন্ধ জানালার পাশে নিয়ে গেলো। বললো, জানালাটা খুলে ফেলো।

সুলতান মন্ত্রমুগ্ধের মতো জানালাটা খুলে দিলেন।

বৃদ্ধ বললো, সামনে তাকিয়ে দেখ!

অদূরে একটা পাহাড়। তার মাথার ওপর থেকে একদল সৈন্য তরতর। করে নিচে আসছে। দেখতে পেলেন সুলতান। সকলের হাতেই উন্মুক্ত তরোয়াল। তিনি বুঝতে পারলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঐ বিশাল সৈন্যদল তার শহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ইয়া আল্লাহ, আর বাঁচবার কোনও পথ নাই, আমার মোউৎ এসে গেছে।

বৃদ্ধ ক্ষিপ্রহাতে জানালা রুদ্ধ করে দিলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার খুলে ফেললো। সুলতান দেখলেন সেনাবাহিনী অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাহাড়টা জনমানবশূন্য অনড় জড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র।

এবার বৃদ্ধ ওঁকে আর একটা জানালার পাশে নিয়ে গেলো। সেজানালা খুলতে দেখা যায় তার বিরাটশহরটা।বৃদ্ধের নির্দেশে তিনি জানালার কপাট খুলে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। শহরের চার শতাধিক মসজিদ, অসংখ্য প্রাসাদ ইমারত সব দাও দাও করে জ্বলছে। ধোঁয়ার কালো কুণ্ডলী গগনমণ্ডল ঢেকে ফেলেছে। দামাল হাওয়ায় আগুনের লেলিহান শিখা উল্কার বেগে প্রাসাদের দিকে তেড়ে আসছে। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রচণ্ড দাবদাহে তার প্রসাদ ভস্মীভূত হয়ে যাবে। হতাশায় শঙ্কায় ভেঙ্গে পড়লেন সুলতান। ভাবতে লাগলেন, তার এমন সুন্দর শহর প্রাসাদ সব পুড়ে ছাই হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পাশের মরুভূমির সঙ্গে ওর আর কোনই ফারাক থাকবে না।

বৃদ্ধ জানালাটা বন্ধ করে আবার খুলে দিলো। কি আশ্চর্য, সব আগুনের শিখা কোথায় মিলিয়ে গেছে। শহরটা যেমন ছিলো তেমনি আছে পূর্ববৎ।

বৃদ্ধ এবার টানতে টানতে তৃতীয় জানালার পাশে নিয়ে গেলো সুলতানকে। এ জানালা খুললে নীল নদের মনোহর শোভা চোখে পড়ে।

জানালা খুলতে মামুদ শিউরে উঠলেন, সর্বনাশ নদীর বাঁধ ভেঙ্গে দুর্বার গতিতে জলস্রোত তেড়ে আসছে শহরের দিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জলের তোড়ের সুন্দর সাজানো শহরটা ভেসে যাবে। ঐ উত্তাল জলরাশি ঝাপিয়ে পড়লে শহরবাসীরা বাড়ির ছাদে উঠেও প্রাণ রক্ষা করতে পারবে না। নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কায় থর-ধর করে কাঁপতে লাগলেন তিনি।

বৃদ্ধ জানালাটা ভেজিয়ে দিয়েই আবার খুলে ধরলেন, এই দ্যাখো, কিছু নাই। নদীর বাঁধ যেমনটি ছিলো তেমনি অটুট আছে।

সুলতান বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েন। বৃদ্ধ এবার তাকে চতুর্থ জানালাটির পাশে নিয়ে গিয়ে বলে, খোলো।

সুলতান মামুদ পাল্লা খুলে ধরেন। তখন তিনি নতুন আশঙ্কার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। কিন্তু জানালা খুলতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। সামনে বিস্তীর্ণ শস্য-শ্যামল প্রান্তর। রাখাল বাঁশী বাজিয়ে পশুচারণে চলেছে। গাছে গাছে কত ফুল-ফলের সমারোহ। নির্মেঘ নীল আকাশে দল বেঁধে উড়ে চলেছে পাখীরা। মাথার ওপরের আকাশটা গোল হয়ে নিচে নেমে এসে দূর চক্ৰবালে মিশে গেছে।

সুলতান মামুদ ভাবতে পারেন না, তিনি জেগে, না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন? কিংবা এই বৃদ্ধ শেখ তাকে যাদু করেছে! নাকি তিনি পাগল হয়ে গেছেন।

বৃদ্ধ এবারে তাকে পাশে ছোট্ট ফোয়ারাটার কাছে এনে দাঁড় করালো।বললো ঐ চৌবাচ্চাটার নিচে তাকিয়ে দেখ।

মাথা ঝুঁকিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই তিনি বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধ তাঁকে চৌবাচ্চার জলে চেপে ধরেছে।

পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলেন, বিরাট একটা সমুদ্রের পাশে একটা পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। নিচে একখানা জাহাজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে জলের তলায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। পাহাড়ের অন্য প্রান্তে কতকগুলো গুণ্ডাগোছের লোক তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে খিক খিক করে হাসছে।

ক্রোধে ফেটে পড়লেন সুলতান। বৃদ্ধকে উদ্দেশ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, তুমি একটা আস্ত শয়তান। আমাকে সমুদ্রে এনে জাহাজ ডুবি করে মজা দেখছ। তোমার শয়তানী আমি ঘুচিয়ে দেব। জান, আমি সুলতান মামুদ, ভালো চাও তো এখনও বলছি, ভাগো।

সুলতানের ক্রোধ এবং চিৎকারে লোকগুলো আরও মজা পেলো। হো হো করে এক সঙ্গে হেসে উঠলো সকলে।

লোকগুলো কি ভীষণ দেখতে! হাসলে তার মুখমণ্ডল আকৰ্ণ বিস্তৃত হয়ে পড়ে। হাঁ-গুলো সব এক একটা গুহার মতো। ওদের যে সর্দার, সে লোকটা এগিয়ে এসে সুলতানের মাথার মুকুট আর গায়ের কামিজ কুর্তা ছিনিয়ে নিয়ে নিলো। তারপর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে নীল ডোরাকাটা মোটা সুতীর একটা পোশাক পরিয়ে দিলো তাকে। পায়ে পরতে দিলো হলদে রঙের এক জোড়া বাজখাঁই চপ্পল। বললো, চলো আমাদের দেশে নিয়ে যাব, সেখানে আমাদের মতো গায়ে গতরে খেটে খেতে হতে তোমাকে।

মামুদ আপত্তি জানিয়ে বলেন, কিন্তু আমি তো কাজ-কাম কিছু করতে পারি না।

ওদের একজন বললো, বেশ তো কাজ করতে না পার, গাধার মতো মোট বইবে। গাধা হতে তো আর কোনও বুদ্ধির দরকার হয় না!

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো একুশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

লোকগুলো আসলে চোর-গুণ্ডা নয় কেউ। একদল খেটে-খাওয়া চাষী মানুষ। দিনের শেষে মাঠের কাজ-কাম শেষ করে তারা জাহাজ ডুবি দেখতে এসেছিলো।

চাষের হাল, কোদাল গাঁইতি প্রভৃতি নানারকম ভারি ভারি সাজ-সরঞ্জাম সব সুলতান মামুদের মাথায় চাপিয়ে দিলো ওরা। বোঝার ভারে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রায় ধুকতে ধুকতে এসে পৌঁছলো ওদের আস্তানায়। ওরা ওকে শুকনো রুটি আর নুন লঙ্কা খেতে দিলো। খিদের মুখে তাই বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে ফেললেন সুলতান।

পরদিন সকালে ওরা তাকে পুরোপুরি একটা গর্দভই বানিয়ে ফেললো। হাত দু’খানা মাটিতে গেড়ে সোয়ার নেবার ঢংএ পিঠ পেতে দাঁড় করালো তাকে। জিন লাগাম এনে চাপিয়ে দেওয়া হলো। তারপর ওঠাতে লাগলো নানারকম যন্ত্রপাতি, বোঝা বোঁকা। সুলতান আর নড়তে পারে না। কিন্তু কে যেন তার কান মলে দিয়ে বললো, ওহে বুড়ো খোকা, গতরটা এবার একটু নাড়াও। তোমার জন্যে তো আর আমরা এখানে বসে থাকবো না। পাছার ওপরে সপাং করে কে যেন দু ঘা বসিয়ে দিলো, কথা কানে যাচ্ছে না, বুঝি!

অগত্যা শরীরে না সইলেও মারের চোটে পা চলতে থাকলো।

এইভাবে দিনের পর দিন সুলতান মামুদকে দিয়ে মোট বওয়াতে লাগলো। দিনে-দিনে ১ মাসে-মাসে বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো।

এখন আর তাকে ওরা মাঠে নিয়ে যায় না। কলুর ঘানিতে জুড়ে দিয়ে তেল তৈরি করে। দিন-রাত ধরে একই বৃত্তপথে তিনি নীরবে নিঃশব্দে ঘানি টেনে চলেন।

পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো। একদিন হঠাৎ ঘানির জোয়াল ভেঙ্গে পড়ে গেলো। সেইমওকায় সুলতান সকলের অলক্ষ্যে ঘানিঘর থেকে বেরিয়ে গা ঢাকা দিয়ে কেটে পড়লেন।

চলতে চলতে অজানা অচেনা শহরে এসে উপনীত হলেন মামুদ। কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো তার। পরদেশী মুসাফির দেখে এক দোকানের সদাশয় বৃদ্ধ মালিক ওঁকে তার বাসায় নিয়ে গেলো সঙ্গে করে। বৃদ্ধ বললো, আমাদের শহর তোমার কেমন লাগলো, বেটা।

-খুব ভালো, বেশ চমৎকার সাজানো গোছানো।

বৃদ্ধ বলে, তোমার মতো নওজোয়ান ছেলেদের এখানে খুব কদর। থাকবে এখানে?

আমার কোনও আপত্তি নাই। শুধু দয়া করে কাঁচা বীনগুলো খেতে দেবেন না। এতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।

–কাঁচা বীন? সে কি! সে সব তো গাধা ঘোড়ার খাদ্য।

—বিশ্বাস করুন, পুরো পাঁচটা বছর আমাকে ঐ অখাদ্যই খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়েছে।

বৃদ্ধ বলে, না না, তোমার জন্য নিত্য নানারকম মাংসের কাবাব কালিয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বীন কেন খেতে যাবে তুমি? তোমার যা যা খেতে প্রাণ চাইবে তাই পাবে। আমাদের শহরে তোমার মতো জোয়ান ছেলেদের জন্য খানাপিনার অভাব নাই।

সুলতান মামুদ বললেন, ঠিক আছে, আমি এই শহরেই থাকবো। কী কাজ করতে হবে আমাকে।

কাল সকালে তোমাকে আমাদের শহরের হামাম বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দেব। ঐ হামামে যতগুলো মেয়ে ঢুকতে যাবে তাদের প্রত্যেককে একের পর এক প্রশ্ন করবে, তোমার কী শাদী হয়েছে? প্রথম যে মেয়েটি বলবে না, আমি এখনও কুমারী, তারই স্বামী হয়ে যাবে তুমি। সেই মেয়ের সঙ্গেই তোমার ধর্মমতে শাদী হয়ে যাবে। এই হচ্ছে এ দেশের আইন। কিন্তু সাবধান, সতর্ক থেক, যতগুলো মেয়ে হামামে ঢুকতে যাবে পর পর সব মেয়েকে একই প্রশ্ন করবে। কাউকে বাদ দিতে পারবে না। প্রথম যে মেয়ে বলবে সে কুমারী সেই হবে তোমার স্ত্রী। ব্যস, তার পরে আর কোনও মেয়েকে কোনও প্রশ্ন করবে না। খেয়াল রেখ, পরপর যে মেয়েগুলো আসবে যতক্ষণ না কুমারী মেয়ের সন্ধান পাচ্ছ, কেউ যেন না বাদ পড়ে! তাহলে মহা বিপত্তি ঘটবে। এ-ও আমাদের দেশের আইনের এক কড়া অনুশাসন।

পরদিন সকালে সুলতানকে একটা হামামের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ দোকানে চলে গেলো।

প্রথম মেয়েটি এক কিশোরী।বয়স বড়জোর তের হবে। বেশ সুন্দরী। সুলতানের বুক দুরুদুরু করতে থাকে। মেয়েটিকে পেলে জীবন ভরে যাবে। এক পা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, মালকিন, আপনি কি কুমারী?

-না। আমার শাদী হয়ে গেছে।

গম্ভীর কণ্ঠে জবাব আসে। তারপর আর এক একটি কথা না বলে সে হন হন করে হামামে ঢুকে যায়।

পরের জন এক হত কুৎসিত-দর্শনা বৃদ্ধা। মামুদ শিউরে উঠলেন। কিন্তু উপায় নাই, প্রশ্ন করতেই হবে।

-আপনি কি বিবাহিতা?

-হ্যাঁ।

যাক বাঁচা গৈলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মামুদ।

বুড়িটা চলে যাওয়ার পর আর একজনের আবির্ভাব হলো। বিরাট দশাসই চেহারা। সারা অঙ্গ দামী সাজ-পোশাক আর জড়োয়া অলঙ্কারে মোড়া এক মেদবহুল মুটকী। এর চেয়ে ঐ বুড়িটাও বুঝি দেখতে অনেক ভালো ছিলো।

—আপনি কি বিবাহিতা? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন মামুদ। মেয়েটি আকর্ণ বিস্তৃত দন্তরাজি বিকশিত করে হেসে বললো, তুমি আমার চোখের মণি, তোমার পথ চেয়েই তো বয়সটা বিকেল হয়ে গেছে সোনা, সেই এলে, আর ক’টা বছর আগে আসতে পারলে না? যাক, শেষ পর্যন্ত তোমার দেখা পেলাম, এই আমার ভাগ্য।

মেয়েটি মামুদের কাঁধে হাত রাখতে এগিয়ে আসে। কিন্তু মামুদ এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, আহা-হা, আমার গায়ে হাত দিও না, দেখছো না, আমি একটি গাধা। এই দেখ কলুর ঘানি টেনে টেনে কাঁধে আমার কড়া পড়ে গেছে। তুমি অমন খুবসুরৎ জেনানা, আমার মতো একটা গাধাকে শাদী করে জিন্দিগীটা বরবাদ করে দেবে কেন, চাচী?

কিন্তু চাচী সে কথায় কর্ণপাত করলো না। হুমড়ি খেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে সে জাপটে ধরলো মামুদকে! তারপর চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে তুললো হল সে। মামুদ ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে, আহা-হা, আস্তে-আস্তে, আমার ঠোঁটফোট ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেলো যে। বিশ্বাস কর, আসলে আমি মানুষের বাচ্চা নই, গাধা-কলুর ঘানি টানা একটা গাধা। এই দ্যাখো, আমার ঘাড়ে কি রকম জোয়ালের কড়া? আঃ, ছাড় ছাড়, লাগছে—মরে যাবো যে—

প্রায় অমানুষিক জোর করে প্রচণ্ড ঝকানি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি ফোয়ারার চৌবাচ্চা থেকে মাথা তুলে দাঁড়ালেন।

সুলতান মামুদ অবাক হয়ে দেখলেন, তিনি তার নিজের প্রাসাদের মাঝখানে ফোয়ারার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে উজির আর হারেমের সুন্দরীরা। ওদের সকলের হাতে আতর, তেল, তোয়ালে, সাবান, শরবত ইত্যাদি। আর দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ ফকির।

বৃদ্ধ আশীর্বাদের ভঙ্গী করে হাত তুলে বললো, খোদা তোমার মঙ্গল করবেন, মামুদ। সব দুঃখ হতাশা কেটে যাবে তোমার মন থেকে!

এর পরই পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলো বৃদ্ধ। কেউ আর তাকে দেখতে পেলো না। আশ্চর্য!

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে শারিয়ারের দিকে তাকালো।

সুলতান বলে, চমৎকার কিসসা শাহরাজাদ। এ থেকে আমার অনেক শিক্ষা লাভ হলো।

শাহরাজাদ বললো, এরপর আর একটা কাহিনী শুনুন, জাঁহাপনা।

সে বলতে শুরু করে :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *