3 of 4

৩.১৬.১ আলা অল-দিন ও আশ্চর্য চিরাগ বাতি

অনেক কাল আগের কথা।

চীনদেশের এক শহরে এক দরিদ্র দর্জি বাস করতো। শহরটার সঠিক নাম আমার মনে নাই। যাই হোক, সেই দর্জির একটি পুত্র সন্তান জন্মেছিলো। আদর করে বাবা মা, তার নাম রেখেছিলো আলা অল-দিন। ছেলেটি কিন্তু মা বাবার ইচ্ছেমতো মানুষ হলো না। লেখাপড়ার ধার দিয়েও সে গেলো না। হরেক রকম বদমাইশি বুদ্ধি সব সময় তার মাথায় ঘোরাফেরা করতো। এইভাবে, খারাপ ছেলেদের কুসংসর্গে পড়ে খুব ছোটতেই সে বয়ে গেলো।

যখন ওর বছর দশেক বয়স, আলা অল-দিনের বাবা সার বুঝে নিলো, ছেলে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে না। মনে বড় আশা করেছিলো, ছেলেকে অন্য কোনও মর্যাদার কাজে শিক্ষানবীশি করাবে। কিন্তু তার চাল-চলন দেখে সে-আশা পরিত্যাগ করলো। ছেলেকে কাছে ডেকে বললো, শোনও বাবা আলা, তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান, তোমার ওপরে অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমার কোনও আশাই পূর্ণ করতে পারবে না তুমি। যাই হোক, বয়স বাড়ছে, কবে আছি, কবে নাই, তুমি এখন আমার দোকানেই বসো। অন্ততঃ দর্জির কাজটাও শেখ। খদ্দেরপাতি যা আছে, দেখেশুনে চললে, তোমার আর তোমার মা-এর কোনও অভাব হবে না।

পরদিন থেকে আলা অল-দিনের বাবা ছেলেকে সঙ্গে করে দোকানে যেতে থাকলো। কীভাবে সাজ-পোশাক তৈরি করতে হয় তার তালিম দিতে শুরু করলো।

কিন্তু আলা অল-দিনের ডাংগুলি খেলার স্বভাব, সুস্থির হয়ে বসে সূক্ষ্ম সুচীকর্ম তার পোষাবে কেন? ফাঁক পেলেই সে দোকান ফেলে সঙ্গীদের সঙ্গে খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে। বাবা কিছুতেই তাকে বশে আনতে পারে না। অনেক বকুনি ধমকানি শাসানি প্রহার কিছুই তাকে দোকানমুখি করতে পারলো না। বাবা হয়তো কোনও খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত-ব্যস, সেই সুযোগে বাছাধন টুক করে কেটে পড়েছে। তারপর সারাদিন আর তার টিকি দেখা গেলো না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও ছেলেকে বাধ্য করে কাজে মন বসাতে পারলো না সে। দিনকে দিন সে মার্কামারা ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে মস্তানি গুলতানি করতে করতে একেবারে চোস্ত রংবাজ বনে গেলে প্রায়।

বাবা মনের দুঃখে সব আশাই ছেড়ে দিলো। ছেলের দুঃখে এবং বয়সের ভারে একদিন সে শয্যা নিলো। তারপর কিছুকাল রোগ-ভোগের পর একেবারে পরপারে চলে গেলো।

বিধবা মা দেখলো, স্বামী চলে গেছে, ছেলে অপদার্থ, সুতরাং দোকান-পাট রেখে আর কী হবে। তাই যা পেলো সেই দামেই বেচে দিলো।

আলাদিনের মা সেলাই-বোনায় বেশ দক্ষ ছিলো। বাজার থেকে পশম কিনে এনে জামা বুনে সে দোকানে দোকানে বিক্রি করে যা লাভ পেত সেই পয়সা দিয়ে ছেলের ও তার নিজের গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করতে পারতো কোনরকমে।

আলাদিনকে সে একমাত্র খাওয়া আর শোওয়ার সময় ছাড়া আর কখনও কাছে পেত না। সারাদিন পাড়ার সমবয়সী বাউণ্ডুলে ছেলেদের সঙ্গে টো টো করে ঘুরে বেড়াতো সে। মা বিরক্ত হয়ে অনেক সময় ভাবতো, ছেলেকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু মায়ের প্রাণ, তা আর পারে না।

এইভাবে ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ইয়ারকি মেরে আলাদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মা চোখের জল ফেলে আর পশমের জামা বুনে রুটির পয়সা রোজগার করে।

আলাদিনের বয়স যখন পনের তখন তার দেহে যৌবনের জোয়ার আসতে শুরু করে। দেখতে সে সুন্দরই ছিলো, প্রথম যৌবনের ছোঁয়া লাগতে আরও সুন্দর মনে হতে লাগলো। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে দল বেঁধে যখন সে ঘুরে বেড়াত, সব ছেলে ছাপিয়ে তার রূপের লাবণ্যই সকলের চোখ ঝলসে দিত। যেমন তার বড় বড় টানা টানা চোখ তেমনই তার নাক মুখ গাল। আর গায়ের রং স্বর্ণচাঁপাকেও হার মানায়।

একদিন বাজারের পাশের একটা ভোলা মাঠে তার সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে সে খেলায় মেতেছিলো, এমন সময় এক দরবেশ ফকির এসে উপস্থিত হলো। লোকটি মূর, মরোক্কোবাসী। আলাদিনকে দেখে সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে। বাঃ, অপূর্ব সুন্দর তো ছেলেটি!

এখানে বলে রাখি এই দরবেশটি আসলে এক যাদুকর। জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ পটু। লোকের মুখ দেখে তার ভাগ্য, বর্তমান-ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে।

আলাদিনকে দেখতে দেখতে সে ভাবে, হ্যাঁ, এইরকম একটি ছেলেরই সে সন্ধান করছিলো এতদিন। এরই অন্বেষণে সে মরোক্কো ছেড়ে সুন্দর এই চীন দেশ পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে এসেছে।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো বত্রিশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

দরবেশ ছেলেদের একজনকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বেটা ঐ খুব সুরত লেড়কাটা কে বলতে পারো?

-ওঃ, ঐ আলাদিনের কথা বলছেন?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলতো বাবা, ও কে?

ছেলেটি বলে, ও তো রাঙা মূলো। ওর বাবা দর্জি ছিলো। কিন্তু ছেলের নাম রেখেছে আলা অল-দিন—যেন সুলতান বাদশাহজাদা।

-তা বাবা, যা ওর রূপ, শাহজাদা হবারই যোগ্য—

ছেলেটি ঠোঁট উল্টে বলতে বলতে চলে যায়, রূপ না হাতি। আর রাঙা মূলোর মতো রূপ থাকলেই শাহজাদা হওয়া যায়?

দরবেশ এবার আলাদিনকে ডাকে। আলাদিন অবাক হয়, এ আবার কে? চিনতে পারে না? পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।

-তোমার নাম তো আলা অল-দিন?

আলাদিন আরও অবাক হয়, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে মালিক?

দরবেশ বলে তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছি বাবা, তোমার আব্বাজান আমার বড় ভাই ছিলো। আচ্ছা তোমাদের দর্জির দোকানটা আছে এখনও?

আলাদিন বলে, না। মা বেচে শেষ করে দিয়েছে।

-কেন, বেচল কেন?

-বা রে, বাবা মারা গেলো, আমি তো দর্জির কাজ শেখার সময়ই পেলাম না। এ অবস্থায় দোকান-পাট দেখে কে? তাই মা বেচে দিয়ে এখন পশমের জামা বোনে বাড়িতে বসে।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো দরবেশ। আলাদিন বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বলে, একি! আপনি কাঁদছেন?

কদবো না? আমার মায়ের পেটের ভাই তোমার বাবা মারা গেছে—আর বলছো, আমি কাঁদবো না? ও হো হো এ আমি কী করলাম, আল্লাহ। নিজের স্বার্থ নিয়েই মেতে থাকলাম সারাটা জীবন? সহোদর ভাই বাঁচলো কি মরলো তার একবার খবর নেবার ফুরসত করতে পারলাম না? যাক, এই বোধ হয় দয়াময় খোদার অভিপ্রায় ছিলো। তা না হলে মরার আগে শেষবারের মতো এক পলক চোখের দেখাও কী তিনি দেখাতে পারতেন না?

দরবেশ চোখের জল মুছে আলাদিনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, আজ বড় ভাই নেই, কিন্তু তোমাকে রেখে গেছে সে। তোমার মধ্যে তাকে আমি খুঁজে পাবো, বেটা, তুমিই আমার দুঃখ শোক ঘুচিয়ে দিতে পারবে।

এই বলে সে আলাদিনের কপাল গাল চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিতে লাগলো।

—আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ বাবা, তোমাকে পেয়েছি। এই শোক তাপে তুমিই আমার একমাত্র সান্ত্বনা। তুমিই তোমার বাবার অভাব পূরণ করতে পারবে—পুত্রবান পিতার কখনও মৃত্যু হয় না।

মূর দরবেশ তার ট্যাক থেকে দশটা সোনার মোহর বের করে আলাদিনের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, এটা তোমার মাকে দিও, বাবা।

আলাদিনের চোখ চকচক করে ওঠে। দরবেশ বলে, তোমরা থাক কোথায়?

আলাদিন বলে, এই কাছেই। আসুন আমার সঙ্গে, বাড়িটা দেখিয়ে দিচ্ছি।

দরবেশের হাত ধরে সে পাশের একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। অদূরে অবস্থিত একটা ছোট্ট কোঠাবাড়ি দেখিয়ে বলে, ঐ যে দেখছেন লালরঙের বড় বাড়িটার পাশে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি-ওখানেই আমরা থাকি।

দরবেশ বলে, ঠিক আছে, আজ আর যাবো না। কাল গিয়ে তোমার মা-এর সঙ্গে আলাপ করে আসব, কেমন? তুমি এই দিনার দশটা তোমার মা-এর হাতে দিয়ে বলবে, তোমার চাচা এসেছে বিদেশ থেকে। তাকে আমার সালাম আর শুভেচ্ছা জানাবে, বুঝলে বাবা?

আলাদিন বলে, জী বুঝেছি। আমি এখুনি গিয়ে মাকে বলছি, কাল আপনি অতি অবশ্য আসবেন।

মূর বলে, নিশ্চয়ই আসবো। সকালেই আসবো। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে কাল সকালে। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, কেমন? বড় ভাই-এর সঙ্গে দেখা হলো না কিন্তু তার কবরটা তো দেখতে পাবো? জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যে ঘরে শুয়ে, যে দাওয়ায় বসে কেটেছে তার, সে জায়গাগুলো তো দেখতে পাবো চোখে। আচ্ছা বাবা, আজ আর নয়, আজ আমি চলি, কাল আবার দেখা হবে।

আলাদিন দরবেশের হাতে চুম্বন রেখে ছুটে যায় মা-এর কাছে। মা ছেলেকে অসময়ে ঘরে ফিরতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়, কী রে, শরীর টরীর খারাপ করেছে নাকি? এখনও খানার সময় হতে ঘণ্টাখানেক বাকী?

আলাদিন ওসব কথা গ্রাহ্য করে না। খুশিতে আজ ডগমগ। চকচকে দশ দশটা সোনার মহর তার কোমরে।

-না মা, শরীর ভালোই আছে। তোমাকে একটা সুখবর দিতে ছুটে এলাম।

-সুখবর? কীসের সুখবর?

মা অবাক হয়ে তাকায় আলাদিনের মুখের দিকে। ভবঘুরে বাউণ্ডুলে অপদার্থ ছেলে আলাদিন—সে দেবে সুখবর? সন্দেহ অবিশ্বাসের দৃষ্টি ফুটে ওঠে ওর চোখে।

-হ্যাঁ, মা খুব শুভসংবাদ। আমার এক চাচা পরবাস থেকে ফিরে এসেছেন। আজ আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে তার। জান মা, কী নজর, আমাকেই দেখে বললেন, তুমি আলা অল-দিন না? আমি তো অবাক! জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে চিনলেন কী করে? উনি বললেন, তোমার বাবার সঙ্গে হুবহু তোমার চেহারার মিল আছে। তারপর কত কথা হলো। আমাদের দর্জির দোকান আছে। কিনা, তুমি কেমন আছ—এইসব।

মা অবাক হয়, আমার কথাও জিজ্ঞেস করলেন?

-হা মা, খুব ভালো লোক, একেবারে পীর ফকীরের মতো কথাবার্তা, বেশবাস—সব। কাল তোমার সঙ্গে আলাপ করতে আসবেন তিনি।

আলাদিনের মা বলে, কিন্তু বাবা, তোর বাবার কাছে তো তোর এই চাচার কোনও কথা শুনিনি কখনও। তোর এক চাচা ছিলো সে তো অনেক আগে-তুই যখন পাঁচ-ছ বছরের খোকা, সেই সময় মারা গেছে।

আলাদিন বললো, এ চাচা অনেক অনেক দিন আগে দেশান্তরী হয়েছিলো। তারপর নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এই সবে ফিরেছেন।

মা ভাবলেন হতেও পারে। অনেক কাল আগের কথা। হয়তো পুরোনো শোকের আগুনটা আর উস্কে দিতে চায়নি ওর স্বামী! ভেবেছে সে তো আর বেঁচে বর্তে নাই। কী হবে সে সব শোক দুঃখের কথা তুলে?

–ঠিক আছে বাবা, কাল তাকে নিয়ে আয়। হাজার হলেও চাচা–রক্তের সম্বন্ধ।

পরদিন সকাল হতেই আলাদিন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। সাধারণতঃ এত সকাল তার কাছে। মাঝ রাত্রির। সকাল দশটার আগে সে কোনও দিন শয্যাত্যাগ করে না। কিন্তু আজ যে তাকে চাচাকে আনতে যেতে হবে। চটপট তৈরি হয়ে নিলো সে। বিছানার তলা থেকে সেই দশটা মোহর আবার কোমরে বেঁধে নিলো। টাকাগুলো সে মাকে দেয়নি। এবং সে সম্বন্ধে বলেওনি কোনও কথা।

প্রায় ছুটতে ছুটতে সে বাজারের পাশের সেই খেলার মাঠে এসে দাঁড়ায়। দরবেশ তখনও আসেনি। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করতে থাকে। ভাবে, হয়তো তারই আসতে দেরি হয়েছে, চাচা দেখে দেখে ফিরে গেছেন। কিন্তু না, একটু পরেই দেখা গেলে, দরবেশ আসছে।

-এই যে বেটা, আলা অল-দিন কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ? আমার কী আসতে দেরি হয়ে গেলো?

আলাদিন আমতা আমতা করে বলে, না, মানে–ভাবলাম আপনি যদি আগে এসে পড়েন, একা একা দাঁড়িয়ে থাকবেন, তাই—আমিই একটু আগে এসে দাঁড়ালাম।

দরবেশ বলে, তা বেশ করেছ, এই নাও দিনার দুটো ধর, এ দুটো মাকে দিয়ে বলল, আমি আজ তোমাদের সঙ্গে খানাপিনা করবো। অল্প-স্বল্প যা হোক কিছু বাজারটাজার করে নিতে বলো। আমি দুপুরে নামাজ সেরে তোমাদের বাসায় যাবো। আর হ্যাঁ, আর একবার তোমার বাসাটা ভালো করে চিনিয়ে দাও তো বাবা। কাল যদিও দেখে নিয়েছি, তবু গোলমাল না হয়ে যায়।

আলাদিন আবার দূর থেকে বাসাটা দেখিয়ে দিলো মুরকে। তারপর বিদায় নিয়ে মা-র কাছে চলে এলো এক এক ছুটে। দিনার দুটো হাতে গুঁজে দিয়ে বললো চাচা তোমাকে দিতে বললেন, বাজার করে খানাপিনা পাকাও, তিনি নামাজ সেরে খেতে আসবেন।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

সাতশো তেত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

দিনার দুটো হাতে পেয়ে ছেলের কথা আর অবিশ্বাস করতে পারে না মা। আলাদিনের অনেক ফন্দী ফিকিরের সঙ্গে সে পরিচিত। নানা মতলব ভেঁজে কতবার যে তাকে ধোঁকা দিয়ে কত পয়সা বের করে নিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। কাল থেকে সে শুধু ভাবছিলো, এও বোধহয় আলাদিনের নতুন এক চাল। কিছু পয়সা আদায় করার ছল। কিন্তু নগদ দু’টো স্বর্ণমুদ্রা হাতে পেয়ে তার ভাবনাটা ঘুরে গেলো। না, তাহলে সত্যিই হয়তো তার চাচা ফিরে এসেছেন।

যাই হোক, তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে ভালোমন্দ কিছু মাংস সবজী মিঠাই ফল ইত্যাদি কিনে নিয়ে ফিরে এলো সে। খুব যত্ন করে খানাপিনা তৈরি করলো।

দুপুর গড়িয়ে যায় যায়। মা বললো, দেখ রে আমার মনে হচ্ছে তোর চাচা বাড়ি চিনতে পারছে না। একটু বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়া না!

আলাদিন বাইরে বেরুবার উদ্যোগ করছে এমন সময় সদরের কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা গেলো। আলাদিনের চোখে খুশির ঝিলিক খেলে যায়, বলে, ঐ মা, উনি এসেছেন।

ছুটে গিয়ে সে দরজা খুলেই দেখলো, বৃদ্ধ দরবেশ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার পিছনে একটা কুলি। তার মাথায় একটা ঝুড়ি-ফলমূল মেঠাই মণ্ডায় ভর্তি।

কুলিটা ভিতরে ঢুকে ঘরের দাওয়ায় ঝুড়িটা নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আলাদিন মূরকে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালো।

আলাদিনের মা বোরখা পরে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো। বৃদ্ধও মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানালো তাকে।

-খোদা হাফেজ, তাঁর অপার করুণায় আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারলাম, বড় ভাই-এর বিবি। কিন্তু মনে বড় খেদ রয়ে গেলো। আর কটা দিন আগে আসতে পারলে তার সঙ্গে একটিবার দেখা হতো।

শেষের দিকের কথাগুলো বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে এলো। কামিজের হাতাটা দিয়ে চোখ মুছলো মূর। আলাদিনের মাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর দুজনেই আবার নিজেদের সামলে নিতেও পারলো। মূর জিজ্ঞাসা করে, বড় ভাই কোথায় বসতো, কোথায় শুতো? এইসব নানা হৃদয়স্পর্শী তথ্য সে জানতে থাকে।

আলাদিনের মা-র আর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না, সে তার স্বামীর সহোদর ভাই। বলে, আল্লাহর চরণে যে আশ্রয় নিয়েছে তার জন্যে আমরা শোক করি কেন ভাইজান। আসুন, সবাই মিলে তার কাছে আমরা মোনাজাত করি।

মূর বলে, তুমি বড় ভালো কথা শোনালে বড় ভাই-এর বৌ! বড় ভালো কথা শোনালে। সব বুঝি, কিন্তু আমরা সবাই মায়াবদ্ধ জীব, বুঝেও অবুঝের মতো শোক তাপ করে তার আত্মার অকল্যাণ ডেকে আনি। আচ্ছা থাক ওসব কথা, এখন বলো দেখি, আলা-দিন কী করছে। রোজগার পাতি যা করতে পারছে তাতে সংসার ঠিক চলছে তো?

আলাদিনের মা এ কথার কী জবাব দেবে? কী করে বলবে ছেলে একটা অপদার্থ বাউণ্ডুলে? কী করে বলবে, অত বড় ছেলে এক পয়সা রোজগার করে না, তার মা-র ঘাড়ে বসে খায়? আর কী করেই বা বলবে যে পশমের জামা বুনে তার দিন চলে?

-না না, চুপ করে থেক না বড় ভাই-এর বৌ। ওর বাবার অবর্তমানে আমি চাচা—আমিই তার দেখাশোনা করার একমাত্র লোক। আমার কাছে লজ্জাশরম করার তো কোনও ব্যাপার থাকতে পারে না। বলো, সে এখন ব্যবসাপত্র কী করছে?

আলাদিনের মা এবার বলে কিছুই করে না আলাদিন। সারাদিন ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খাবার সময় হলে বাড়ি ফেরে।

মূর গম্ভীর কণ্ঠে বলে, খুবই অন্যায়। কই, আলা অল-দিন, এদিকে আমার সামনে এসে দাঁড়াও।

আলাদিন চোরের মতো জড়োসড়ো হয়ে একপাশে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।

—কী, কাজ কাম করতে মন চায় না, এই তো? আলাদিন কোনও জবাব দেয় না—দিতে পারে না। চোখও তুলতে পারে না মাটি থেকে।

মূর এবার ওকে আদর করে পাশে ডাকে, কিন্তু কাজ করতে মন চায় না কেন? মনের মতো কাজ পাওনি বলে তো? ধর যদি তোমাকে বাজারে একটা বেশ বড় সড় রেশমী কাপড়ের দোকান করে দিই—চালাবে?

আলাদিনের চোখ নেচে ওঠে। বলে, হ্যাঁ।

এর পর খানাপিনা সাজিয়ে দেয় আলাদিনের মা! খেতে খেতে মূর বলে, সে অনেক দিন—প্রায় তিরিশ বছর আগে ভাগ্য অন্বেষণে আমি পরবাসী হই। সিন্ধু, বা হিন্দুস্তান প্রভৃতি নানা দেশ ঘুরতে ঘুরতে মিশরে চলে যাই। সেখানে বছর দশেক কাটাবার পর মরোক্কোতে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে আজ বিশ বছর ব্যবসা করছিলাম। টাকা পয়সা অনেকই রোজগার করলাম, কিন্তু বড় ভাই-এর বৌ, সত্যি কথা বলতে কি মনে শান্তি পেলাম না। যতই বয়স বাড়তে থাকলে দেশের জন্য মন বড় অশান্ত হয়ে উঠলো। তখন কি জানি ভাই আমাকে ডাকছে, তা হলে সব কাজ ফেলে তখুনি চলে আসতাম। আজ যাই কাল যাই করতে করতে এত দেরি হয়ে গেলো যে ভাইকে আর চোখের দেখাটা দেখতে পেলাম না। রক্তের এমনই। টান সেই সুদূর মরোক্কোতে বসেও আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম, ভাই আমাকে। ডাকছে। সেই এলামওদুদিন আগে যদি পৌঁছোতে পারতাম—

মূর আর কথা শেষ করতে পারে না। কান্নায় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে!

আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে আলাদিনের মা। এবার মূরই তাকে সান্ত্বনা দেয়, কেঁদ না, কেঁদ না বড় ভাই-এর বৌ। যে গেছে সে তো গেছেই, যে আছে তাকে বুকে ধরেই তো বাঁচতে হবে। আলাদিন তোমার জীবনের একমাত্র চিরাগ। সেই তোমার জীবন আলোময় করে রাখবে।

আলাদিনের মা দুঃখ করে বলে, সে আশায় আমার ছাই পড়েছে। ছেলে কী আর মায়ের দুঃখ বোঝে। সে তার ইয়ার বন্ধুদের নিয়েই মত্ত থাকে। এখনও গতরে বল আছে, চোখে দৃষ্টি আছে, তাই দু’টো খেতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন অথর্ব হয়ে পড়বো, চোখে ছানি পড়বে, তখন? তখন আমার কী গতি হবে সেই কথা ভেবেই আঁৎকে উঠি। আরও ভয় লাগে আলাদিনের জন্য। এখন ও বুঝতে পারছে না। দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাওয়ার সময় হলে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটিবার ভেবে দেখে না, এই খানাপিনা জুটছে কী করে।

মূর বলে, যা হয়ে গেছে তা গেছে। আমি যখন এসে পড়েছি, আর কোন ভাবনা করতে হবে তোমাদের। আলাদিনকে আমি বাজারে একখানা মস্ত বড় কাপড়ের দোকান করে দেব। গা-গতরে কিছুই খাটতে হবে না ওকে, লোকজন অনেক থাকবে, তারাই সব করবে। আলাদিন শুধু তহবিল নিয়ে বসবে। টাকা পয়সার হিসেবটুকু বুঝে নিতে হবে। কী পারবে না, আলা অল-দিন?

আলাদিন বলে, খুব পারবো।

মূর বললো, তা হলে কালই চলো বাজারে। আগে তোমাকে দোকানের মালিকের মতো সাজ-পোশাকে সেজে এক সওদাগর পুত্র বনতে হবে। জানতো আগে চাই দর্শনধারী—পরে গুণ বিচারী? সেজে-গুজে শাহজাদার মতো গদিতে বসবে। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তোমাকে দেখেই খদ্দেরা মুগ্ধ হয়ে দোকানে ঢুকে পড়বে। যে ব্যবসার যে ভড়ং, তা তো বজায় রাখতেই হবে।

আলাদিনের আনন্দ আর ধরে না। এবং সে বাহারী সাজ পোশাক পরে সওদাগর হবে।

মূর বলে, এবার আমি উঠি। তাহলে ঐ কথাই রইলো। কাল আমি সকালে আসছি। তোমাকে নিয়ে বাজারে বেরুবো।

মূর চলে গেলো। আলাদিনের মা ভাবলো, সাক্ষাৎ আল্লাহর দূত! না হলে তাদের দীন হীন এই দারিদ্র্য দশায় এ রকম পরমাত্মীয় কেউ এসে সব দায় মাথা পেতে নিতে চায়? স্বামীর ছোট ভাই-এর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন।

পরদিন সকালে আবার কড়া নড়ে ওঠে। আলাদিনের মা-ই দরজা খুলে দেয়।

—এস ভাইজান ভেতরে এসে বসো।

—না ভাবী, এখন আর বসবো না, কই আলাদিন কোথায়? ওকে পাঠিয়ে দাও। কাল বলে গিয়েছিলাম না বাজারে যেতে হবে? আজ ওর সাজপোশাক কিনে দেব-খুব বাহারী। দেখবে যে ছেলে ঘরে থাকে না, দোকানে বসতে চায় না, সে কেমন সংসারী হয়ে ওঠে, কেমন পাক্কা সওদাগর বনে যায়! আসলে ওর যাতে ভালো লাগে, সেই পথেই ওকে নিয়ে যেতে হবে। নাও, আর দেরি করবো না, ওকে পাঠিয়ে দাও। আমি বাইরেই দাঁড়াচ্ছি।

আলাদিনের মা বলে, হয়তো সাহেব এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, দেখি যাই ডেকে তুলি গে–

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো পঁয়ত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

বাজারের বড় বড় দোকান ঘুরে ঘুরে ওরা সাজ-পোশাক পছন্দ করতে থাকে। বৃদ্ধ বলে, লজ্জাশরম করো না, বাবা। যেটা খুশি বেছে নাও, দামের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।

বাঁশবনে ডোম কানা, তবু যাই হোক, শেষ পর্যন্ত একটা পোশাক পছন্দ করতে পারলো সে। দোকানদার বললো, আপনার ভাইপোর পছন্দ আছে বলতে হয় জনাব। এর চাইতে ভালো পোশাক আমার কেন, সারা বাজারের কোনও দোকানে পাবেন না আপনি।

মূর হাসে, নজরটা উঁচু না হলে বড় কাজ করবে কী করে?

ডোরাকাটা রেশমী শেরওয়ানী, সাদা পাগড়ীর মধ্যে মধ্যে সোনার জরির কাজ। কাশ্মীরের কোমরবন্ধ। টকটকে লাল চামড়ার জুতো।

দোকানী যা দাম চাইলো, এক পয়সা দরাদরি না করে পুরো টাকা বের করে দিলো বৃদ্ধ। তারপর পোশাকের মোড়কটা আলাদিনের হাতে দিয়ে বললো, চলো বাবা, এবার আমরা হামামে যাবো। খুব আচ্ছাসে ঘষে মেজে গোসল করিয়ে নতুন সাজে সাজাবো তোমাকে।

হামামে ঢুকে মূর নিজে হাতে আলাদিনকে খোসা সাবান দিয়ে ডলাই-মলাই করে ঠাণ্ডা গরম জল মিশিয়ে গোসল করালো। আলাদিন এক নতুন নওজোয়ান যুবক হয়ে বেরিয়ে এলো।

গোসলের পর নাস্তা। হামামেই তার ব্যবস্থা থাকে। দুজনে তৃপ্তি করে খানাপিনা সারলো। বৃদ্ধ বললো নাও, এবার ঐ পাশের ঘরটায় ঢুকে পড়। ওখানে আয়না প্রসাধন সব আছে। খুব পরিপাটি করে ইচ্ছেমত কাজল সুর্মা আতর লাগিয়ে এসো।

এমন বাদশাহী হামাম আলাদিন জীবনে দেখেনি। সেজে-গুজে যখন বেরিয়ে এলো তখন কে বলবে সেশাহজাদা নয়? যেমন চাঁদের মতো রূপ তেমনি জমকালো সাজপোশাক। প্রথম দর্শনেই মনে হয় যেন কোন সুলতান বাদশাহর পুত্র। আলাদিন এসে বৃদ্ধের কর চুম্বন করে। সে-ও তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে।

-এই তোমার যাত্রাপথের শুরু হলো, বেটা। এবার আসল কাজে নামতে হবে। চলো, বাজারের দিকে যাই, কোথায় তুমি দোকান খুলতে চাও আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি সেখানেই তোমার দোকান খুলে দেব।

দোকানের জায়গা পছন্দ করার পর বৃদ্ধ বললো, এবার চলো একটু শহরটা ঘুরে ঘুরে বেড়ানো যাক। লোকে তোমাকে দেখুক। তুমি যে একজন যে সে লোকের ভাইপো নও সেটা তারা জানুক।

আলাদিনকে সঙ্গে নিয়ে সে অনেক বাগান অনেক মসজিদ ঘুরে ঘুরে অবশেষে এক সরাইখানায় এসে হাজির হয়। এই সরাইখানাতেই বৃদ্ধ মূর আস্তানা গেড়েছে।

—এখানেই আমি উঠেছি। চলো, আমার ঘরে চলো। বিরাট একখানা প্রশস্ত ঘর। বেশ সাজানো গোছানো। লম্বা লম্বা টেবিলে কাপড় বিছিয়ে নানারকম খানাপিনা সাজানো হয়েছে। বৃদ্ধ বললো, তোমার সঙ্গে নামজাদা সব সওদাগরদের আলাপ করিয়ে দেব বলে আজ এই ভোজসভার ব্যবস্থা করেছি। বসো, এখুনি সবাই এসে পড়বে।

কিছুক্ষণেই মধ্যেই এক এক করে শহরের সম্রান্ত সওদাগররা এসে উপস্থিত হলো। বৃদ্ধ সকলের সঙ্গে আলাদিনের আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর আরম্ভ হলো খাওয়া-দাওয়া।

এত সব সুন্দর সুন্দর খাবার-দাবার আলাদিন খায়নি কোনও দিন। খুব তৃপ্তি করে খেলো সে।

আসর ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সন্ধ্যা উৎরে গেলো। বাসায় ফিরে আসতে মা ছেলেকে দেখে আর চিনতে পারে না। অমন বাদশাহী সাজ পোশাকে সজ্জিত আলাদিন আর সে আলাদিন নাই।

একেবারে অন্য মানুষ বনে গেছে। বৃদ্ধকে কী বলে যে ধন্যবান জানাবে বুঝতে পারে না।

ভাইজান, আমাদের বড়দুঃসময়ে তুমি আল্লাহর আশীর্বাদ হয়ে নেমে এসেছে। তা না হলে এ-সব তো আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিলো। খোদা, তোমাকে দীর্ঘায়ু করুন।

বৃদ্ধ বলে, আরে—এর জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছ কেন, ভাবী। এ তো আমার কর্তব্য। আলাদিন আমার ভাইপো। তার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক। তুচ্ছ ধন্যবাদ দিয়ে সে-সম্পর্ক খাটো করো na, বড় ভাই-এর বৌ। আলাদিনের বাবার অভাব আমিই তো মেটাবো। আজ বড় ভাই বেঁচে থাকলে যা-করতো আমিও তাই করতে চাই।

আলাদিনের মায়ের দুগাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে। খোদা মেহেরবান, ভাইজান। তা হলে, এ সময়ে তোমার মতো একটা নির্ভরযোগ্য বটের ছায়া আমি পাবো কী করে? এখন থেকে আলাদিনকে তোমার হাতেই সঁপে দিলাম। ছেলেটা একেবারে অমানুষ হয়ে যাচ্ছিল, এবার হয়তো তোমার শাসন শিক্ষায় ও সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে।

—হয়তো কেন ভাবীজী, নিশ্চয়ই পারবে। কালক্রমে দেখবে, তোমার ছেলে সারা দেশের মধ্যে সেরা হয়ে উঠবে। তোমার আশংকা করার কোনও হেতু নাই। যে সৎ বংশে ওর জন্ম সে বংশের ছেলেরা কখনও অসৎ উচ্চুঙ্খল হতে পারে না। তা ছাড়া আলাদিন ছেলে তো খারাপ নয়। খুব শান্ত নম্র বিনয়ী। ওকে বাউণ্ডুলে বলো কী করে?

মা হাসে, চাচাকে দেখে এখন ভয়ে সাধু সেজেছে।

বৃদ্ধ জোর দিয়ে বলে, আর সে অসাধু হওয়ার সুযোগ পাবে না। কাল জুম্মাবার। দোকানপাট সব বন্ধ। পরশুই ওকে দোকানে বসিয়ে দেব। আর অসৎ সঙ্গে মিশতেই পারবে না। কাল ওকে নিয়ে যাবো শহর ছাড়িয়ে ঐ পাহাড়ের পাশে এক বাগানবাড়িতে। সেখানে শহরের নামজাদা সব সওদাগররা যাবে আমোদ প্রমোদ করতে। ওদের সঙ্গে আলাদিনের ভাব-সাব রাখা দরকার। বড় ব্যবসা করতে গেলে বড় মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে হয়। না হলে ব্যবসায় নাম ডাক হবে কী করে? আচ্ছা এখন আমি চলি। কাল এসে নিয়ে যাবো।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো ছত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

সারা রাত ধরে আলাদিনের চোখে আর ঘুম আসে না। জেগে জেগে নানারকম আকাশ-কুসুম রচনা করতে থাকে। সে ব্যবসা করবে। মস্ত বড়ো সওদাগর হবে—অনেক টাকা হবে তার। অনেক ধন দৌলত। তখন কী আর সে এই জরাজীর্ণ পড়ো বাড়িতে পড়ে থাকবে। সুলতানের উজিরের প্রাসাদের মতো একখানা পেল্লাই প্রাসাদ বানাবে। কত লোক লস্কর। কত নফর চাকর, দাসী বাদীতে গম গম করবে সারা প্রাসাদ। সে হবে তার একমাত্র মালিক। তার ইশারাতে কত লোক ওঠ বোস করবে।

আলাদিন আর ভাবতে পারে না। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিশুতি রাত। চারদিক নিস্তব্ধ-নিরন্ধ অন্ধকার। ঘরের মধ্যে চিরাগের সলতেটা নিষ্প্রভ হয়ে ধুকছে। আলাদিন আলোটা জোরালো করে দেয়। আলনায় ঝোলানো পোশাকটায় সে নেড়ে চেড়ে দেখে। ঝুঁকে পড়ে নাক দিয়ে নতুন সাজের গন্ধ আঘ্রাণ করতে থাকে। হামামের সেই আতরের খুসবু তখনও সুবাস ছড়াচ্ছিল সারা পোশাকটায়।

এইভাবে এক সময় সকাল হয়ে আসে। আলাদিন হাত মুখ ধুয়ে সাজপোশাক পরে অধীর আগ্রহে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। সময় যেন আর কাটতে চায় না। অস্থিরভাবে পায়চারী করে এদিক ওদিক।

আজ যেন চাচা একটু দেরি করছেন? কিন্তু দেরি করার মানুষ তো তিনি নন? কিংবা সে-ই অনেক সকাল সকাল উঠে পড়েছে।

যাই হোক, একটু পরেই বৃদ্ধ মূর এসে পড়লো। আলাদিনের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো। কেন জানি না, তার কেবলই মনে আশঙ্কা হচ্ছিলো আজ যদি চাচা না আসেন? তা হলে বেড়াতে যাওয়াটা মাঠে মারা যাবে।

কিন্তু না, আলাদিনের আশঙ্কা অমূলক, একটু বাদেই বৃদ্ধ মূর এসে হাজির হলো। আলাদিন ছুটে গিয়ে ওর কর চুম্বন করে বললো, আমি ভাবলাম, চাচা, আপনি বোধ হয় এলেন না।

বৃদ্ধ হাসে। আলাদিনের পিঠ চাপড়ায়। বলে, খুব অধৈর্য হয়ে উঠেছ বুঝি! চলো, আর দেরি নয়, এখনই বেরিয়ে পড়া যাক। অনেক দূর যেতে হবে।

আলাদিন পা বাড়িয়েই ছিলো। বলে, চলুন।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা শহর প্রান্তে এসে পড়ে। তারপর বিস্তীর্ণ শস্য-শ্যামল প্রান্তর। তাও এক সময় অতিক্রম করে গাছপালা ঘেরা এক গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে। কত সব সুন্দর সুন্দর ঘর-বাড়ি বাগ-বাগিচা পেরিয়ে আরও সামনে এগিয়ে চলে।

আলাদিন ক্লান্ত বোধ করে। বলে, চাচা, কত পথ পার হয়ে এলাম। আর কত দূর যেতে হবে। সামনে তো ঐ পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখছি না? আমি আর চলতে পারছি না, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। বৃদ্ধ মূর একটা ঝোলা থেকে অনেক ফল এবং পিঠে বের করে আলাদিনের হাতে দেয়।

—নাও খেয়ে নাও। আর বেশি দূরে নয়, ঐ তো কাছেই এসে পড়েছি। পৌঁছলে দেখবে কী মজার জায়গা? সারা দুনিয়ায় তার জুড়ি নাই।

এইভাবে নানা আশার কথায় ভুলিয়ে আলাদিনকে পাহাড়-সন্নিহিত সেই মরু-প্রান্তরও পার করে নিয়ে যায় মূর।

অবশেষে ওরা এসে পৌঁছয় পাহাড়ের পাদদেশে এক সুন্দর উপত্যকায়। একটা পাথরের চাইকে আসন করে ওরা পাশাপাশি বসে। মূর আলাদিনের কাঁধে হাত রাখে। বলে, নাও, এবার একটু বিশ্রাম করে নাও এখানে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, না? আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়। তারপর আমি তোমাকে এক অলৌকিক মজার জিনিস দেখবো। সে জিনিস, সারা দুনিয়ার কেউ তোমাকে দেখাতে পারবে না। এবং আমার বিশ্বাস পৃথিবীর কোনও মানুষই কোনও কালে দেখেনি তা। যখন তুমি দেখবে, সারাদিনের এই যে এত পথশ্রম সব সার্থক হবে তখন। আর, এখন হয়তো আমার ওপর কিছুটা বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হয়েছ, তাও কেটে যাবে তৎক্ষণাৎ। প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো সেদিন যেমন আমাকে ভালো লেগেছিলো তোমার, আজ তার চেয়েও বেশি ভালো মনে হবে। যা আর কথা নয়, এবার একটু জিরিয়ে নাও। পাদু’খানা ছড়িয়ে দিয়ে আমার কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর আলাদিন চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখে তার চোখের সামনে বিস্তীর্ণ এক লতাগুল্মের ঝোপ জঙ্গল। মূর বলে, ওঠ, উঠে পড়। যাও, ঐ জঙ্গল থেকে এক আঁটি

শুকনো ডাল-পালা কুড়িয়ে নিয়ে এসো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আলাদিন এক বোঝ শুকনো ডাল-পালা এনে হাজির করে। বৃদ্ধ বলে, বাঃ, চমৎকার। এবার আমার পিছনে এসে দাঁড়াও।

আলাদিন আজ্ঞাবহর মতো মূর-এর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মূর তার কোমর থেকে একটা চকমকির বাক্স বের করে কাঠের পালায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। শুকনো কাঠ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। এবার বৃদ্ধ একটা ছোট্র কচ্ছপের খোলের বাক্স বের করে। তার ভেতর থেকে খানিকটা ধূপের গুঁড়ো বের করে মন্ত্র পড়ে জ্বলন্ত অঙ্গারে ছড়িয়ে দেয়। গল গল করে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকে ঊর্ধ্বাকাশে। বৃদ্ধ বিড় বিড় করে মন্ত্র আওড়ে চলে। ধীরে ধীরে গগন-মণ্ডল অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। আলাদিন বুঝতে পারে, সারা পাহাড়টা দুলছে। হঠাৎ বিরাট এক শব্দ করে পাহাড়ের এক ধারটা বিদীর্ণ হয়ে যায়। আলাদিন লক্ষ্য করলো, অদূরে আট-দশ হাত ব্যাসের এক দারার মত গর্ত হয়ে গেছে। বৃদ্ধ ওর হাত ধরে বললো, এসো, দেখবে এসো।

গর্তটা খুব একটা গভীর নয়—আট দশ হাত হবে। মূর বললো, তাকিয়ে দেখ, গর্তটার নিচে একখানা শ্বেতপাথরের চাঁই। দেখতে পাচ্ছো?

আলাদিন বললো, হ্যাঁ পাচ্ছি।

—আর কী দেখছো?

–পাথরটার মাঝখানে দু’খানা পিতলের কড়া। বৃদ্ধ বললো, নিচে নেমে পড়। এই কড়া দুখানা ধরে পাথরটাকে টেনে তুলতে হবে।

আলাদিন শিউরে ওঠে, ওরে বাবা,ওই পেল্লাই পাথর আমি টেনে তুলতে পারি নাকি? ও আমি পারবো না।

—আমি বলছি পারবে। নামো, নেমে পড়।

আলাদিন ভয়ে কাঁপতে থাকে। না না, আমি পারবো না। আপনি সুষ্ঠু নামুন। দুজনে মিলে চেষ্টা করি তবে হয়তো ওঠানো যেতেও পারে।

বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলে, কথার অবাধ্য হয়ো না আলাদিন। আমাকে দিয়ে হলে তোমাকে সঙ্গে আনতাম না। আমার কথা শোনো, নেমে কড়াটা ধরে টান দিয়ে দেখ, পাখির পালকের মতো হাল্কা মনে হবে। তোমাকে কোনও জোরই খাটাতে হবে না।

বৃদ্ধ বলতে থাকে, যা বলছি খুব মন দিয়ে শোনো। ঐ পাথরের নিচে এক অতুল ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার আছে। আল্লাহ তোমার জন্যেই তা বরাদ্দ করে রেখেছেন। তোমার কপালের লিখন আমি পড়ে দেখেছি। যদিও আমার অসীম ক্ষমতা ইচ্ছ করলে পলকে প্রলয় ঘটিয়ে দিতে পারি, তবু ঐ পিতলের কড়া দুটো স্পর্শ করার কোনও এক্তিয়ার আমার নাই। একমাত্র তুমি ছাড়া ঐ পাতালপুরীতে অন্য কেউই প্রবেশ করতে পারবেনা। শুধু তুমিই ঐ গুপ্ত ধন আবিষ্কারের একমাত্র হকদার। এখন কী ভাবে কী করতে হবে তাই তোমাকে বাতলে দিচ্ছি। হা শোনো, যা পাওয়া যাবে তা আধাআধি বখরা করে নেব আমরা।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

সাতশো আটত্রিশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?

এতক্ষণে আলাদিন-এর মন থেকে সব ভয় মুছে যায়। বলে, আমি রাজি। বলুন চাচা, কী কী করতে হবে আমাকে। আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।

-এই তো শেরকা মাফিক কথা। বৃদ্ধ বুকে জড়িয়ে ধরলো আলাদিনকে। গা মাথায় আদর করতে করতে বললো, তুমি আমার প্রাণাধিক পুত্রের চেয়েও প্রিয় বাবা। এ-দুনিয়ায় আমার বলতে আর কেউই নাই। তুমিই আমার সব। আমার যা বিষয়-আশয় কালে তুমিই পাবে। শুধু তোমার ভালোর জন্য ঐ সুদূর মরোক্কো থেকে এসেছি আমি। আচ্ছা আর দেরি নয়, এবার নামো। ঐ কড়া দু’টো ধরে টেনে তোল পাথরখানা!

আলাদিন লাফ দিয়ে নিচে নামলো। বৃদ্ধ বললো, তোমার বাপ ঠাকুর্দার নাম নিয়ে এবার কড়ায় হাত লাগাও, দেখবে পেঁজা তুলোর মতো হাল্কা হয়ে উঠে আসবে।

আলাদিন কড়া দুটো দুহাতে চেপে ধরে বললো, আমি আলীর নাতি, মুসতাফার ছেলে আলাদিন,

এই বলে টানতেই পাথরের সেই প্রকাণ্ড চাইখানা আলগা হয়ে হাতের সঙ্গে উঠে এলো। আলাদিন চাইখানা একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখলো।

নিচে একটা গুহা। উঁকি দিয়ে দেখলো, সিঁড়ি নেমে গেছে। বারোটা ধাপের নিচে একখানা বিরাট দরজা। রুদ্ধ দরজার পাল্লা দু’খানা তামার পাতে গড়া। অসংখ্য বন্টু আঁটা। বৃদ্ধ নির্দেশ করে, নিচে নেমে যাও। দরজাটা আপনা আপনি খুলে যাবে। দরজা দিয়ে ঢুকলে দেখতে পাবে একখানা বিরাট ঘর। ঘরখানা তিনটি দরজা দিয়ে তিনখানা কামরায় বিভক্ত করা আছে। প্রথম কামরায় দেখতে পাবে বিরাট বিরাট চারটি তামার জ্বালা। সেগুলো তরল সোনায় ভরা। পাশের কামরায় দেখবে ঐ রকম চারটি রূপোর জ্বালা। তার মধ্যে আছে সোনার গুড়া। আর শেষ কামরায় দেখবে চারটি সোনার জ্বালা। তার মধ্যে আছে সোনার মোহর। তুমি কিন্তু এসব কিছুই লক্ষ্য করবে না। সাবধান, ভুলেও ঐ জ্বালার গায়ে হাত ঠেকাবে না। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পাথর হয়ে যাবে তোমার সর্বাঙ্গ।

তৃতীয় কামরার শেষে আর একটা দরজা পাবে। সেই দরজা দিয়ে এগোলে এক মনোরম বাগিচার মধ্যে গিয়ে পড়বে তুমি। চারদিকে কত রকমের ফুল আর ফল। দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু ওসব দিকে নজর করার মতো সময় নাই, আরও খানিকটা এগুলে দেখবে একটা থামে লাগানো আছে একখানা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে সোজা ওপরে উঠে যাবে। দেখবে, একটা ছাদের আঙ্গিনা। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালেই দেখতে পাবে দুটি থামের মাঝখানের ফাঁকে একটা কুলুঙ্গি। ঐ কুলুঙ্গির ওপরে একটা পিতলের পিলসুজ। তার মাথায় একটা চিরাগ জ্বলছে। এগিয়ে যাবে, ফুঁ দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দেবে। তারপর চিরাগটাকে হাতে তুলে নিয়ে ছাদের ওপর উপুড় করে সব তেলটুকু ঢেলে দিয়ে তোমার কামিজের তলায় লুকিয়ে আবার নিচে নেমে আসবে। তোমার এই মূল্যবান কামিজ কুর্তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করো না। কারণ চিরাগের তেলে কোনও দাগ লাগবে না! ও তেল সাধারণ কোনও তেল না।

এরপর আর কোথাও দাঁড়াবে না। যে পথে যাবে ঠিক সেই পথ ধরেই আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। তবে ঘাবড়ে যেও না। মুখের হাব ভাব দেখে যেন বোঝা না যায় যে চিরাগ-বাতি চুরি করে পালাচ্ছে। এমন সহজ সাধারণ ভাবে চলবে যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়। বড় জোর দেখে মনে হতে পারে বাগানে বেড়াতে এসেছে তুমি।

চিরাগটা যদি একবার এনে আমার হাতে দিতে পারো, আলাদিন, তখন আর কে পায় আমাদের। তামাম দুনিয়ার সেরা ধনী হতে পারবো আমরা। তার আর জুড়ি পাওয়া যাবে না কোথাও!

মূর তার নিজের আঙ্গুল থেকে একটা আংটি খুলে আলাদিনকে ছুঁড়ে দিলো, এটা পরে নাও। এই আংটি মন্ত্রপূত, কাছে থাকলে কোনও বিপদ হয় না। শয়তান নজর দিয়ে কোনও কাজ নষ্ট করে দিতে পারে না। তাছাড়া বুকে সাহসও অনেক বেড়ে যাবে, দেখো। এখন ভালোয় ভালোয় কাজ সমাধা করে ফিরে এসো। তারপর দেখবে আমরা কত বড় লোক হয়ে গেছি। শোনও আলাদিন, তোমার ঐ শেরোয়ানীটা গুটিয়ে কোমরে গুঁজে নাও। দেখবে সাবধান, কোনক্রমেই যেন ঐ জালাগুলোর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়ে যায়। তা হলে তুমিও খতম হয়ে যাবে, আর চিরাগ-বাতি লাভের আশাতেও ছাই পড়বে।

আলাদিন নিচে নেমে গেলো। কুর্তার ঝুল কোমরে গুঁজে নিলো। দরজার সামনে দাঁড়াতেই পাল্লা দু’খানা সরে গেলো। আলাদিন ঘরে প্রবেশ করলো। চাচার কথা মতো কোনও দিকেই সে দৃষ্টিপাত করলো না। এক এক করে তিনখানা ঘরই পার হয়ে বাগানের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। সামনেই সেই সিঁড়ি। সোজা উপরে উঠে গেলো আলাদিন। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো কুলুঙ্গির ভিতরে জ্বলন্ত চিরাগ-বাতিটা!

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদা গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

সাতশো উনচল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

একটা পিতলের পিলসুজ কুলুঙ্গির মাথার ওপর বসানো। কাছে গিয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো আলাদিন। তারপর বাতিটা হাতে নিয়ে সব তেলটুকু নিঙড়ে ফেলে দিয়ে কামিজের তলায় লুকিয়ে নিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।

বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করছে। কিন্তু নিজেকে সহজ শান্ত রাখতে হবে, চাচা বলে দিয়েছেন। তাই সে নির্বিকার হওয়ার ভান করে বাগানের এদিকে ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখতে থাকলো।

ফলের ভারে গাছগুলোর ডাল মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। আর সে যে কত বিচিত্র রকমের বাহারী সব ফল! আলাদিন এমন ফল কখনও দেখিনি। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো। কোনওটা বা কপূরের মতো সফেদ। কোনওটা মোমের মতো সাদা। আবার কেউ বেদানার মতো টুকটুকে লাল। কোনওটা কমলা রঙের। কোনওটা হাল্কা সবুজ, কোনওটা গাঢ় সবুজ, কোনওটা হলুদ, -বেগুনি, নীল। এত রং। সব রং-এর নামই সে জানে না।

আলাদিন বুঝতে পারেনি, ঐ সাদা ফলগুলো সব হীরে, মুক্তো, আর চন্দ্রকান্তমণি। লালগুলো পলা। সবুজ সব পান্না। নীলগুলো নীলকান্তমণি। হলুদগুলো পোখরাজ। মোটকথা ফলগুলোর সবই কোনও না কোনও মহামূল্য রক্তমণি।

আলাদিন অনেক আশা নিয়ে একটা ফল হাতে ধরে ছিড়ে নেয়। কিন্তু একি! এতো খাওয়ার ফল নয়। পাথরের মতো শক্ত যে। আলাদিন ভাবলো আসলে এগুলো নানারকম রঙিন কাচের খেলনা। হতাশায় ছেয়ে গেলো মন। যাই হোক, মাকে দেখাবে বলে যতটা পারলো ছিড়ে ছিড়ে কামিজের পকেটে কোমরের বন্ধনীতে ভরে নিলো সে।

আবার সেই তিন কামরার জ্বালাগুলোর স্পর্শ বাঁচিয়ে অতি সন্তর্পণে পার হয়ে আসে আলাদিন। বারখানা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসতেই দেখে পাথরের চাইটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ। তার চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, এনেছো? আমার চিরাগ? কই দাও।

আলাদিন হাসতে হাসতে বলে, এনেছি চাচা। দিচ্ছি। চলুন ওপরে উঠি, তারপর এই কাঁচের খেলনাগুলো সব নামাই তারপর বের করে দিচ্ছি।

মুরের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, না এখনই—এখনই দাও।

বাঃ রে, দেখছেন না, আমার সারা কামিজ কুর্তা ভরে আমি এই কাচের ফলগুলো নিয়ে এসেছি। এগুলো নামাতে দিন, তাড়াহুড়ো করলে সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে না? এগুলো ঠিক মতো নামিয়ে রাখি, তারপর আপনার চিরাগ বাতি বের করে দিচ্ছি। সে তো একেবারে আমার পেটের সঙ্গে গোঁজা আছে। এক্কেবারে তলায় চাপা পড়ে আছে।

মূরের চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরোয়, হুম্ বুঝেছি, আমার সঙ্গে চালাকী শুরু করেছে। ভেবেছো, আমি কিছু বুঝি না? ওসব কোনও কথা শুনতে চাই না, দেবে কিনা, বলল। তা না হলে এখুনি মজা টের পাইয়ে দেব; কুত্তার বাচ্চা বের কর বলছি।

আলাদিন বুঝতে পারে না হঠাৎ চাচা কেন এত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। বলে, কিন্তু আমাকে বের করতে দেবেন তো, চাচা!

-চাচা! কে তোর চৌদ্দপুরুষের চাচা রে শয়তান। ভেবেছ, আমাকে ফাঁকি দিয়ে তুমি পালাবে! সেটি হচ্ছে না।

এই বলে মূর আচমকা দুই থাপ্পড় বসিয়ে দিলো আলাদিনের গালে। আলাদিন টাল সামলাতে পেরে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে গেলো।

সিঁড়ির নিচে পড়ে সে ভাবলো, এখন ওপরে ওঠা ঠিক হবে না। চাচার রাগ খানিকটা প্রশমিত হলে তারপর ওঠা যাবে।

এদিকে বুড়ো হা-হুতাশ করে চুল দাড়ি ছিড়তে থাকলো। এই গুহায় নামার এক্তিয়ার নাই তার। তার কাছে নিষিদ্ধ এলাকা। তাই সে আলাদিনের পিছু ধাওয়া করতে পারলো না। ওপরেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুসতে লাগলো।

ওরে শয়তানের বাচ্চা, ভেবেছিস পালিয়ে বাঁচবি। দাঁড়া তোকে এমন শিক্ষা দেব, জীবনে ভুলতে পারবি না।

লাফ দিয়ে সে ওপরে উঠে এসে কাঠের পাঁজায় আগুন জ্বালিয়ে ধূপের গুঁড়ো ছড়িয়ে মন্ত্র পড়তে লাগলো। আর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়টা আবার দুলে উঠে ফাটলটা বন্ধ হয়ে গর্তের মুখ জোড়া লেগে গেলো।

আপনারা আগেই শুনেছেন, এই বুড়ো মূরটা আসলে আলাদিনের কেউ না। মরোক্কোর সে এক কুখ্যাত জাদুকর।

এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *