3 of 4

৪.২১ কাঠুরিয়া যুবরাজ

আটশো ছেষট্টিতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে–

দুনিয়াজাদ বলে, এবার ঐ চীন-সম্রাটের জামাতা ভারত রাজপুত্রের কাহিনীটা শোনাও দিদি।

শাহরাজাদ বলে, হ্যাঁ এবার তো খলিফা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেন।

রাজকুমার, তোমাকে দেখে আমার প্রত্যয় হয়েছে অতি সদ্বংশ জাত তুমি। আমার এই শহরে কি উদ্দেশ্যে তোমার আগমন যদি বলল, আমি খুশি হয়ে শুনবো।

যুবরাজ যথাবিহিত কুর্ণিশাদি জানিয়ে অতি বিনয় সহকারে বলতে শুরু করে :

ধর্মাবতার আমি কোনও রাজদূত হয়ে আসিনি আপনার মুলুকে। অথবা কোনও কৌতূহল চরিতার্থের বাসনা নিয়েও আমার আগমন নয় এখানে। শুধু আর একবার আমার জন্মভূমিকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্যই আমি এসেছি আপনার শহরে। আমার কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ। বুঝতে পারছি শোনার জন্য চিত্ত আপনার ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ঠিক আছে আমি আর বিলম্ব করবো না।

 

এই বাগদাদ শহরে আমার জন্ম। এক দরিদ্র কাঠুরিয়া পরিবারে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও আমার বিবি আর আমার গ্রাসাচ্ছাদন করতে পারতাম না।

একে অভাবের তাড়না তার ওপর আমার দজ্জাল স্ত্রীর অষ্টপ্রহর লাঞ্ছনা গঞ্জনা জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলো। বৌটার না ছিলো রূপ, না ছিলো এক ফোটা গুণ।কিন্তু যত রকম বজ্জাতি এবং শয়তানিতে সে ছিলো মহা ওস্তাদ।

সারাদিন খেটেখুটে ঘরে ফিরে এসে যে একটু শান্তি পাবো তার জো ছিলো না। প্রতি মুহূর্তেই সে ঝাটা নিয়ে তেড়ে আসতো।

প্রতিদিন বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে তল্লাশী করে দেখেনিত কাঠ বেচার সব পয়সা তাকে দিয়েছি না দু একটা আধলা কোথায় লুকিয়ে রেখেছি।

একদিন বৌকে ভয়ে ভয়ে বললাম, কিছু পয়সা দাও তো, একগাছা দড়ি কিনতে হবে?

পয়সার কথা শোনামাত্ৰ ক্ষেপে গেলো সে।

–পয়সা? দড়ি কেনার জন্য পয়সা? কেন দড়ি কি হবে, গলায় দিয়ে ঝুলবে নাকি? তোমার মতলব আমি বুঝি না বলতে চাও। যেই পয়সাটি হাতে পাবে অমনি তো বাগদাদের বেবুশ্যে মাগীদের পাড়ায় ছুটবে। তোমাকে চিনতে আমার বাকী আছে?

আমি বলি, আরে না না, ওসব ভাবছো কেন? একটা মোটা রশি কেনা দরকার। তা না হলে বড় গাছ কেটে নামানোর খুব অসুবিধে হচ্ছে। আর বড় গাছপাট করতে না পারলে পয়সা কড়িই বা রোজগার হবে কি করে?

আমার কথা শুনে খানিকক্ষণ গুম মেরে থাকলো সে। তারপর বললো, তোমার চালাকী আমি বুঝি, ওসব ভড়কি দিয়ে আমার কাছ থেকে পয়সা বের করতে পারবে না। তা বেশ তো বাজারে চলল, আমি নিজে পছন্দ করে তোমার দড়ি কিনে দেব। কিন্তু উঁহু, তোমার হাতে একটি কানাকড়ি দেব না।

আমাকে প্রায় হিড় হিড় করে টানতে টানতে সে বাজারে নিয়ে গেলো। আমি চেয়েছিলাম একটা মোটা রসি কিনতে। কিন্তু তার দাম একটু বেশি, সে বললো, অত পয়সা খরচ করতে পারবো না।

এই বলে সে আমার মতামত অগ্রাহ্য করে একগাছি সরু দড়ি কিনে বাড়ি ফিরে এলো।

আমি বললাম, দড়িটা কিনলে বটে কিন্তু কোনই কাজে লাগবে না।

–কাজে লাগবে না? কেন কাজে লাগবে না?

—অত বড় ভারি গাছ-এর ভার কি টেনে রাখতে পারবে ঐ দুবলা দড়ি? ফালতু পয়সা নষ্ট করলে তুমি?

খাণ্ডারনি বৌটা ঝাঝিয়ে ওঠে, মেলা ব’কো না তো। আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। চলো আজ তোমার সঙ্গে যাবো আমি। দেখবো তোমার গাছ কত মোটা।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি যাবে পাহাড়ের জঙ্গলে?

-কেন? যাবো না কেন? তোমার আপত্তি কিসের? না, সেখানে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করার ব্যবস্থা সব পাকা আছে, আমি গেলে সব ভেস্তে যাবে?

মেয়েছেলেটার কথার প্রতিবাদ করতে প্রবৃত্তি হলো না। বললাম, ঠিক আছে, তোমার যা ইচ্ছে করতে পার।

গাধার পিঠে চেপে বসলো সে। আমি পিছনে পিছনে হেঁটে চললাম।

পাহাড়ের দুর্গম পথ, পুরুষমানুষই উঠতে নামতে হাঁপিয়ে যায়, কিন্তু আমার বিবি মরদের বাড়া, দিব্যি সে গটমট করে উঠে গেলো পাহাড়ের মাথায়।

আমার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো। বাড়িতে যতক্ষণ থাকবো ততক্ষণ এই মেয়েছেলেটার, জ্বালায় প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আবার এই কাজের স্থলেও যদি সে এসে আমার কর্মসঙ্গিনী হয় তা হলে তো পাগল হয়ে যাবো।

পাহাড়ের মাথায় ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মাঝখানে একটি শুখা কুয়ো ছিলো। আমার মাথায় বদ বুদ্ধি খেলে গেলো একটা।

বৌকে বললাম, শোনো বিবিজান, আসল কথাটা সত্যিই তোমাকে বলিনি। তা তুমি যখন নাছোড়বান্দা হয়ে সঙ্গেই এলে তখন আর লুকিয়ে রেখে ফয়দা ওঠাতে পারবো না।

বৌটা বিজ্ঞের হাসি হাসতে হাসতে বললো, হুঁ হুঁ বাবা, সে কি আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছো? চোখ দেখলে আমি পুরুষমানুষের বজ্জাতি ধরতে পারি।

আমি বললাম, আহা বজ্জাতির কথা বলছো কেন? এই কূয়োটার মধ্যে অনেক ধনরত্ন আছে, শুনেছি। সেই জন্যে একটা দড়ি কিনতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, কুয়োটার তলা থেকে অনেক ধনরত্ন তুলে নিয়ে গিয়ে তোমাকে হঠাৎ তাক লাগিয়ে দেব।

—আহা থাক, আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না। তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে ধনদৌলত তুলে নিয়ে গিয়ে তোমার পেয়ারের মাগীর ঘরে তুলতে। সে কি আর আমি বুঝি না? যাক, ওসব হেঁদো কথা রাখ, তোমাকে আমি একদম বিশ্বাস করি না। আমি নিজে নামবো এই কূয়ার নিচে। ধনরত্ন যা পাবো নিজে হাতে তুলে আনবো। তুমি আমাকে দড়িতে বেঁধে নিচে নামিয়ে দাও।

আমিও তাই চেয়েছিলাম। ওর কোমরে দড়ি বেঁধে কূয়ার নিচে নামিয়ে দড়িটা কূয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে বললাম, আমার সঙ্গে যে ব্যবহার তুমি করেছ এতকাল, এই তার সাজা। থাক এইখানে, আমি চললাম।

আমি আর দাঁড়ালাম না সেখানে। বনের অন্য প্রান্তে চলে গেলাম কাঠ কাটতে।

দু’টো দিন বেশ শান্তিতেই কাটলো।

কিন্তু মনটা কেমন খচ খচ করতে লাগলো। তিন দিনের দিন সকালে বাজার থেকে আর একটা দড়ি কিনে নিয়ে পাহাড় জঙ্গলে গেলাম।

পুরো দুটো দিন মেয়েটা না খেয়ে শুকিয়ে মরছে। এবার ওকে ওপরে তুলতে হবে। না হলে মরে যাবে নির্ঘাৎ।

কূয়ার ধারে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলতে থাকলাম, শোনো ও ভালো মানুষের মেয়ে, আশা করি তোমার যোগ্য শিক্ষা হয়েছে। এর পর হয়তো আর আমার সঙ্গে ঐ রকম দুর্ব্যবহার করবে না।

কিন্তু নিচে থেকে কোন সাড়া এলো না। ভয় হলো, তবে কি মেয়েটা মরে গেছে? দড়িটা নামিয়ে দিলাম। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম সে আঁকড়ে ধরেছে! প্রাণপণ শক্তিতে

আমি টেনে তুলতে থাকলাম।

কিন্তু বিবির বদলে উঠে এলো বিশালকায় এক আফ্রিদি দৈত্য। ভয়ে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার দাখিল হলো, কিন্তু আফ্রিদি আমাকে অভয় দিয়ে বললো, ভয় করো না! আজ যে উপকার তুমি করলে আমার, জীবনে তা ভুলবো না কখনও। এক দৈত্যের শাপে আমি আকাশে ওড়ার ক্ষমতা হারিয়েছি। কিন্তু পায়ে হেঁটে বায়ু বেগে চলতে পারি! অনেক কাল আগে এক দৈত্য এই কূপে ফেলে দিয়ে গেছে আমাকে। সেই থেকে মুক্তির দিন গুনছিলাম। আজ তুমি আমাকে উদ্ধার করলে। আমি অকৃতজ্ঞ নই, এর পুরস্কার তোমাকে দেব আমি।

দৈত্যর কথা শুনে খানিকটা ধাতস্থ হতে পারলাম আমি। সে বলতে থাকুলো, হিন্দুস্তানের এক পরমাসুন্দরী কিশোরী কন্যা আছে। তার সঙ্গে আমি তোমার শাদী করিয়ে দেব।

আমি হাসলাম, বাগদাদের এক দরিদ্রতম কাঠুরে আমি। সে হবে হিন্দুস্তানের সুলতানের। জামাতা?

আফ্রিদি বললো, ভরসা রাখ, আমার অসাধ্য কিছুই নাই। ফিকিরটা আমি বাতলে দিচ্ছি। শোনো।

আমি ভারত শাহজাদীর দেহে প্রবেশ করে তার মুখ দিয়ে এমন সব কথবার্তা বলাতে থাকবো যাতে তাকে পাগলী বলে মনে করবে সবাই। সুলতান কন্যার চিকিৎসার জন্য দেশ বিদেশের নানা হাকিম বদ্যিকে ডেকে আনবে। কিন্তু আসলে তো আর শাহজাদী পাগলী নয়, তাই তাদের দাওয়াই পত্রে কিছুই সুরাহা হবে না। তখন প্রাণ-প্রতিম কন্যার রোগমুক্তির জন্য সম্রাট যে-কোনও শর্তের ফরমান জারি করবেন। মেয়ের জন্য তিনি তাঁর সাম্রাজ্যও ছেড়ে দিতে কুণ্ঠা করবেন না। কিন্তু তাতেও কেউ তাকে রোগমুক্ত সুস্থ করে তুলতে পারবে না। সুলতান আবার ঘোষণা করবেন, যে তার কন্যাকে সারিয়ে তুলতে পারবে তাকে তিনি অর্ধেক রাজত্ব এবং শাহজাদীর সঙ্গে শাদী দিয়ে দেবেন। এইবার তুমি সুলতানের দরবারে হাজির হয়ে বলবে, আমি সারিয়ে দিতে পারি আপনার কন্যাকে।

আমি দৈত্যকে বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু আমি কি করে সারাববা? আমি তো হেকিমির কিছুই জানি না?

সে বললো, সে সব জানার কোনই দরকার নাই। শুধুমাত্র এক পাত্র পানি হাতে নিয়ে শাহজাদীর সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ঐ পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে বিড় বিড় করে মুখে যাহোক একটা কিছু আওড়াবে। ব্যস, বাজীমাত হয়ে যাবে। আমি তৎক্ষণাৎ শাহজাদীর অঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাবো। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। রাজদরবারে, দেশে বিদেশে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে তোমার নামে। সুলতান তোমাকে জামাতা করে মসনদে তার নিজের পাশে বসিয়ে রাখবেন।

আফ্রিদি বললো, আমি আজই হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাচ্ছি। তুমিও তৈরি হয়ে আজই বেরিয়ে পড়। আমার যেতে একদিনও লাগবে না। কিন্তু তোমার পৌঁছতে পুরো দু’মাস সময় লাগবে।

আমি বললাম, কিন্তু আমার বিবি যে এই কূয়ার নিচে ছিলো, তার কি হয়েছে?

আফ্রিদি বললে, তোব তোবা ঐ নষ্ট খাণ্ডারনিটা তোমার বিবি ছিলো। সে আমার ওপর জোর জুলুম আরম্ভ করেছিল। মানুষের মেয়ে যে এতো কামুক হয় আমার জানা ছিলো না, আমি তাকে বার বার প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও সে আমাকে ছাড়তে চায় না। কিল চড় ঘুষি মেরে মেরে আমাকে নাস্তানাবুদ করতে লাগলো সে। তাও আমি মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম। কিন্তু গত রাতে আমি যখন ঘুমিয়েছিলাম সেই সময় সে আমার কোমরের ওপরে বসে পড়েছিলো, তখন আর সহ্য করতে পারিনি, মেয়েছেলেটাকে এক হাতে ধরে আছাড় দিয়েছি। আর সে ওঠেনি।

মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হাজারহলেও শাদী করা বউ তো। আমার মনের অবস্থা আঁচ করে অফ্রিদি বললো, দুঃখ করো না। ভ্ৰষ্টা নারীর চেয়ে শূন্য ঘর অনেক ভালো। আমি তাকে মেরে ফেলার জন্য আছাড় দিইনি, কিন্তু কি করবো, আমার ছোট্ট আছাড়টাও সে সহ্য করতে পারেনি।

আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমিও ঘরে ফিরে এসে সেইদিনই হিন্দুস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করলাম।

এর পরের ঘটনা যথারীতিই সংঘটিত হয়েছিলো। শাহজাদীর ভূয়া ব্যাধি সারাতে আমার একদিনও সময় লাগেনি। সুলতান সন্তুষ্ট হয়ে তার ওয়াদা পুরণ করলেন। সেই থেকে আমি সুলতান-কন্যাকে শাদী করে হিন্দুস্তানের ভাবী উত্তরাধিকারী হয়েছি।

অনেক কাল দেশ ছাড়া। জন্মভূমিকে দেখার জন্য মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তাই গতকাল আপনার শহরে এসেছি, জাঁহাপনা। এতোকালের পিতৃপুরুষের ভিটেয় পা দিতে পেরে জীবন সার্থক হয়ে গেছে আমার।

যুবকের কাহিনী শেষ হলে খলিফা মসনদ ছেড়ে নেমে এসে নিজে হাতে ধরে তাকে নিয়ে গিয়ে পাশে বসালেন।

তারপর খলিফা দরবারের সমবেত আমির উজিরদের উদ্দেশ্য করে বললেন, কাল সন্ধ্যায় এক ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধকে মুক্ত হস্তে দান করতে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। আজ সে-ও এখানে হাজির আছে, এবার তার জবানী থেকে কিছু শোনা যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *