3 of 4

৪.০৯ ভ্রষ্টা নারী এবং তার নওজোয়ান নাগর

কোনও এক সময়ে মিশরের এক তহশীলদার বাস করতো। কর আদায় উপলক্ষে সারা বছরের বেশির ভাগ সময়ই তাকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হতো।

তহশীলদারের ঘরে ছিলো যুবতী বৌ। স্বামীর অবর্তমানে বৌটার নিঃসঙ্গ রাত আর ফুরায় না। উদ্দাম যৌবন কেঁদে কেঁদে সারা হয়। কিন্তু তহশীলদারটার বয়সে ভাটা পড়েছিলো। তার

উপর হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যেদিন সে ঘরে ফিরে আসে সেদিন আর শরীরটাকে ধরে রাখতে পারেনা। খেয়ে-দেয়ে বিছানায় শোয়া মাত্র নাক ডাকাতে থাকতো। বৌটা দেহের জ্বালায় জ্বলে জ্বলে খাক হয়ে ক্ষেপে উঠলো। কিছুদিনের মধ্যেই সে এক নওজোয়ান খুবসুরত নাগর জুটিয়ে নিলো।

ছেলেটির গায়ে তাগদ অনেক। বৌটা যখন ডাকতো তখনই এসে তার মনঃস্কামনা পূর্ণ করে যেত। মেয়েটির দেহমন খুশিতে ডগোমগো হয়ে ওঠে। কারণে অকারণে ছেলেটিকে সে নানারকম সাজ-পোশাক কিনে দেয়, নগদ অর্থও মুঠি মুঠি গুঁজে দেয় জামার পকেটে।

এই ভাবে দুটি নর-নারী অবৈধ সুখ-সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে বেশ কয়েকটা বছর পার করে দিলো।

একদিন তহশীলদার ঘরে ফিরে এসে তার পর দিনই বৌকে বললো, আমার খচ্চরকে দানা-পানি খাইয়ে দাও। আর আমাকেও কিছু একটা খানা-পিনা দাও, এখুনি বেরুতে হবে।

বৌটা মনের আনন্দে চটপট স্বামীকে বিদায় করার জন্য কাজে লেগে গেলো। খচ্চরকে দানা-পানি খাইয়ে তার পিঠে জীন লাগাম চাপিয়ে দিলো। কিন্তু তহশীলদারকে খেতে দিতে গিয়ে দেখে রুটি চাপাটি কিছুনাই ঘরে। নিগ্রো দাসীটাকে বললো, এই, চট করে দু’খানা রুটির মতো খানিকটা গম পিষে দে তো, তোর মালিক খেয়ে এখুনি কাজে বেরুবে।

তহশীলদার বললো, এখন গম পিষে রুটি বানাতে বানাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তার দরকার নাই, আমি বরং বাজার থেকে দু’খানা তন্দুরী রুটি কিনে নিয়ে আসছি। এই বলে সে দ্রুতপায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজারের পথে চলে গেলো। রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে।

শাহরাজাদ গল্প থামিযে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো একতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

বৌটা তার স্বামীর বাজার থেকে ফেরার অপেক্ষায় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়েছিলো। দূর থেকে ওর নাগর ছেলেটা মেয়েটিকে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবলো, তহশীলদারটা বোধ হয় কাজে বেরিয়ে গেছে, তাই বৌটা দরজা ধরে তারই প্রতীক্ষা করছে।

ছেলেটি বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েটিকে বললো, আমার এখুনি তিনশো দিরহাম দরকার।

মেয়েটি বলে, কিন্তু আজ তো আমার হাতে কিছু নাই, গো।

ছেলেটি বলে, তোমাদের তো একটা খচ্চর আছে দেখছি। ওটা আমাকে দাও। আমি বিক্রি করে নেব। টাকাটা আমাকে আজ জোগাড় করতে হবে।

—তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। আমার স্বামী ফিরে এসে যদি দেখে খচ্চরটা নাই, আমাকে আস্ত রাখবে সে?

কিন্তু ছেলেটি নাছোড়বান্দা। তার আব্দার এড়াতে পারেনা প্রেমিকা। খচ্চরটা নিয়ে চলে যায় ছেলেটি।

কিছুক্ষণ পরে তহশীলদার রুটি কিনে ফিরে আসে। আস্তাবলে ঢুকে রুটি ক’খানা ঝোলার মধ্যে পুরে নিতে যায়। কিন্তু এ কি! খচ্চরটা গেলো কোথায়? জীন লাগাম সব পড়ে আছে অথচ খচ্চরটা নাই! সে ছুটে আসে বৌ-এর কাছে। কী ব্যাপার খচ্চরটা কোথায়?

বৌটা শান্ত গলায় বললো, তুমি বাজারে যাওয়ার একটু পরেই খচ্চরটা মানুষের রূপ ধরে আমাকে বললে, আমাকে যাদু করে খচ্চর বানিয়ে রাখা হয়েছিলো। আসলে আমি সুলতানের কাজী। এখন আমি দরবারে চললাম। এই বলে সে গটগট করে বেরিয়ে গেলো।

তহশীলদার রাগে ফেটে পড়লো, তুমি আমার সঙ্গে মসকরা করছো?

-বারে মসকরা করতে যাবো কেন? যা ঘটেছে তাই বললাম। তোমার সঙ্গে ছলচাতুরী করে আমার কি ফয়দা হবে? তোমাকে বলতে আমি সাহস করিনি, খচ্চরটা সত্যিই মাঝে মাঝে মানুষের মতো কথা বলতে আমার সঙ্গে। আমি তো শরমে মরি। তাড়াতাড়ি বোরখায় মুখ ঢেকে আস্তাবল থেকে পালিয়ে আসতাম। কিন্তু আজ একেবারে তাজ্জব কাণ্ড ঘটে গেলো। আমি ঘরে দাওয়ায় বসে কাজ করছি হঠাৎ দেখি আস্তাবল থেকে এক সদাশয় বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালেন। আমি ছুটে ঘরের মধ্যে পালাতে গেলাম। তিনি আমাকে মা বলে ডাকলেন। বললেন, মা, আমাকে শরম করার কিছু নাই। আমি তোমার বাপের মতো। কপাল দোষে এতদিন খচ্চর হয়ে ছিলাম। আজ আমার মুক্তি হয়েছে। আমি সুলতানের কাজী। এখন তাঁর দরবারেই ফিরে যাচ্ছি।

তহশীলদার চোখ কপালে তুলে বলে, ইয়া আল্লাহ, এমন আজব কাহিনী তো জীবনে কখনো শুনিনি। কিন্তু খচ্চর ছাড়া এখন আমি কাজে বেরুবো কী করে? আজ আমাকে কত গ্রামে যেতে হবে কর আদায় করতে! কী করে যাবো বলতো?

বৌটা পরামর্শ দেয়, তুমি এক কাজ কর। এক আঁটি বিচালী নিয়ে দরবারে গিয়ে কাজীকে দূর থেকে দেখাতে থাক। তা হলেই তিনি বুঝতে পারবেন। খচ্চর ছাড়া তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে। তখন তিনি দরবার ছেড়ে তোমার সঙ্গে চলে আসবেন।

তহশীলদারের খুব পছন্দ হলো বৌ-এর কথাগুলো। তখুনি একগোছা বিচালি নিয়ে দরবারে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করতে লাগলো।

বৌটা বললো, একটা কথা কিন্তু মনে রেখ, খুব সাবধান, কাজী আর খচ্চর একই ধাঁচের জানোয়ার। ওরা ভীষণ বদলা দেবার ফিকিরে থাকে। এতকাল তুমি ওঁর উপর যে-সব অত্যাচার করেছ, সে-সব কিন্তু তিনি একটুও ভুলে যাননি। মওকা পেলে তোমার ওপর শোধ তুলতে কসুর করবেন না তিনি।

বৌ-এর শেষ উপদেশটুকু মাথায় রেখে অতি সন্তর্পণে সে কাজীর আদালতে প্রবেশ করে। কাজী সাহেব তখন তার আসনে বসে মামলার কাজ পরিচালনা করছিলেন। বিরাট কক্ষের একেবারে পিছনে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো তহশীলদার। হাতে এক আটি বিচালি, মাঝে মাঝে কাজী সাহেবের দিকে একটু উঁচু করে তুলে ধরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকলো।

ব্যাপারটা কাজীর নজর এড়ালো না। ইশারা করে ডাকলেন তিনি, এদিকে এগিয়ে এসো আমার সামনে।

কিন্তু তহশীলদার সেখান থেকে এগিয়ে না গিয়ে কাজী সাহেবকে ইশারা করে ডাকলো, আপনিই আসুন আমার কাছে।

কাজী সাহেব তহশীলদারকে চিনেছিলেন। সে যে সরকারের এক তহশীলদার তা তিনি জানতেন। ভাবলেন নিশ্চয়ই কোনও গোপন কাজকর্মের জন্য কোতোয়াল তাকে পাঠিয়েছে এখানে। তাই, সেদিনের মতো আদালতের সব কাজ মুলতুবী রেখে সকলকে বিদায় করে দিলেন

তিনি। তারপর তহশীলদারের কাছে এসে বললেন, কী ব্যাপার, কী হয়েছে? খুব কি জরুরী কিছু?

তহশীলদার সে-কথার কোনও জবাব না দিয়ে বিচালির গোছাটা কাজীর সামনে ধরে জিভ আর তালুর সাহায্যে পশু পোষ মানানোর মতো অদ্ভুত এক আওয়াজ তুলে তাকে পায়ে পায়ে আদালতের বাইরে ডেকে আনতে প্রলুব্ধ করতে লাগলো।

কাজী সাহেব ব্যাপারটা অনুধাবন করতে না পেরে তহশীলদারকে অনুসরণ করতে করতে আদালতের বাইরে বেরিয়ে এলেন। তখন তহশীলদার তার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলে, খোদা হাফেজ, সত্যিই আমি আপনার ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা শুনে মর্মাহত হলাম। আপনি ভাববেন না, শুধু শুধু আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি এখানে। আজ আমাকে অনেক গুলো গাঁয়ে যেতে হবে আদায় করতে। সেজন্য আদালতের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। তার আগেই আপনাকে ডাকতে হলো। যাই হোক, আর দেরি করা চলে না, নিন এবার আপনি আবার খচ্চরের রুপ ধরুন, আমি আপনার পিঠে চেপে এখুনি রওনা হবো।

কাজী সাহেব আতঙ্কে শিউরে ওঠেন, এ কি অদ্ভুত কথা!

তহশীলদার বেশ বিনীতভাবে বললো, না না, আর ওসব ভয় করবেন না। একবার যখন জেনেছি আপনি আসলে জানোয়ার নন, তখন কী আর আপনার পাছায় চাবুকের ঘা মারতে পারি? আমি জানি, আমাদের মানুষের পাছাগুলো কী থলথলে নরম! চাবুকের আঘাত পেলে বড় ব্যথা লাগে। আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, আপনার কোনও ভয় নাই। চাবুক ছড়ি আমি হাতেই নেব না। যাক, আর দেরি করবেন না, এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। নিন লুন। কথা দিচ্ছি, রোজ রাতে যা দানা-পানি দিই আজ থেকে তার দু’গুন বরাদ্দ করে দেব।

কাজী সাহেব বুঝলেন, পাগলা গারদ থেকে কোনও ভাবে এই রুগীটা পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ছে। ভয়ে তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এক পা এক পা করে পিছু হটতে হটতে আদালতকক্ষের দরজা পেরিয়েই তিনি এজলাসের দিকে দৌড়ে পালাতে গেলেন। কিন্তু তহশীলদারও ছাড়বার পাত্র নয়। সেও তাকে ধাওয়া করে ছুটে এলো। কাজী সাহেব প্রমাদ গুণলেন। ঘরের সব লোককে তিনি ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। সেই শুন্য কক্ষে তহশীলদারের কবল থকে উদ্ধার পাওয়ার আর কোনও পথ নাই। কাজী সাহেব খুব করুণ কণ্ঠে বললেন, বুঝতে পারছি, আপনার খচ্চরটা খোয়া গেছে। এবং একটা খচ্চর না হলে আপনার কাজ-কর্মও সব অচল হয়ে যাবে। ঠিক আছে, এক কাজ করুন, এই নিন তিনশো দিরহাম আপনাকে দিচ্ছি আমি। এ দিয়ে বাজার থেকে সেরা জাতের একটা খচ্চর কিনতে পারবেন অনায়াসেই। নিন ধরুন, টাকাটা নিয়ে আমাকে রেহাই দিন।

এই বলে ট্যাক থেকে তিনশো দিরহামের একটা তোড়া তহশীলদারের হাতে গুঁজে দিয়ে কাজী সাহেব আর কোন দিকে দৃকপাত না করে আদালত কক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে চেঁচা দৌড় দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।

তহশীলদার ভাবে, কাজী সাহেব লোকলজ্জা এড়াতে তিনশো দিরহামের এই তোড়াটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে পালালেন। তা যাক, ভালোই হলো, তিনশো দিরহামে ওর চাইতে তাজা তাগড়াই খচ্চর কিনতে পারবে সে।

তহশীলদার বাজারে গিয়ে একটা একটা করে অনেকগুলো খচ্চর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে থাকে। কিন্তু মনমতো পছন্দ হয় না একটাও। একটা দালাল বললো, কত দামের মধ্যে খুঁজছেন শেখ?

—পছন্দ হলে তিনশো দিরহাম পর্যন্ত দিতে পারি।

লোকটি লোলুপ উৎসাহে বলে, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ভালো মাল এনে দেখাচ্ছি। আপনাকে।

পাশের একটা কামরা থেকে একটা বেশ তাগড়াই খচ্চর বের করে নিয়ে এসে সে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, দেখুন, চলবে?

ততক্ষণে তহশীলদারের চোখ কপালে উঠেছে, একি, এ যে তারই সেই খচ্চরটা। যেখানে যা যা খুঁত ছিলো সবহুবহু ঠিক আছে। তহশীলদার খচ্চরটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো একটু, তারপর দালালটাকে বললো, না হে, এ রকম জানোয়ার চলবে না আমার। সত্যিকারের জানোয়ার চাই আমার।

লোকটা দাঁত-মুখ খিচিয়ে ওঠে, সত্যিকারের জানোয়ার মানে? এটা কি তবে মিথ্যেকারের জানোয়ার নাকি? কী বলতে চান আপনি। সওদা করতে এসেছেন না মসকরা করতে এসেছেন এখানে?

তহশীলদার বলে, না মসকরা করবো কেন? তবে যে কারণেই হোক, এটা আমি কিনবো না। অন্য কিছু আছে।

—বেশ তত পছন্দ না হয় অন্য খচ্চর দেখাচ্ছি।

তিনশো দিরহাম দিয়ে আর একটা খচ্চর পছন্দ করে সে কিনে বাড়ি ফিরে আসে। বলা বাহুল্য, আগাগোড়া কাহিনী সবিস্তারে বৌকে শোনালো সে।

এইভাবে চতুরা নষ্ট নারীর বুদ্ধির কৌশলে সবদিকই রক্ষা পেলো। মেয়েটি তার নাগরকে নিয়ে রসের সায়রে কেলি করে দিন কাটাতে থাকলো। তহশীলদার একটা নতুন তাগড়াই খচ্চর ফিরে পেলো এবং কাজী সাহেব মিথ্যা কেলেঙ্কারীর হাত থেকে অব্যাহতি পেলেন। অবশ্য তার জন্যে তিনশশ দিরহাম গচ্চা দিতে হলো তাকে। তা যাক, আদালতের ফি বাড়িয়ে দিয়ে তিনি তা উসুল করে নেবেন সুদে আসলে।

এই সময় রাত্রি শেষ হলে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *