3 of 4

৪.১২ মুতাবাকিল আল্লাহর বিত্ত বৈভব

খলিফা হারুন অল রসিদের পৌত্র অল মুতাবাকিল তস্য পৌত্র মুতাসিব বিল্লাহ অতিশয় বিনয়ী নম্র এবং প্রিয়দর্শন সুলতান ছিলেন। রূপে গুণে শৌর্যে কি বীর্যে বিক্রমে তার তুল্য নরপতি বড় একটা দেখা যায় না। কবি হিসাবেও তার খ্যাতি ছিলো দেশ জোড়া।

তার দরবারে আটজন পরশ্রীকাতর উজির ছিলো। তারাই হুকুমতের কাজকর্ম দেখাশোনা করতো। তার সুবিশাল সলনিয়ত বিস্তৃত ছিলো একদিকে শ্যাম মরুভূমি সীমা থেকে শুরু করে মূর অধ্যুষিত অঞ্চল এবং অন্যদিকে খুরাসন পর্বতমালা থেকে ভারত ও আফগানিস্তানের পশ্চিম সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত।

খলিফা মুসতাবিদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলো আহমদ ইবন হামদুন। একদিন দুটি যুটি প্রাসাদ উদ্যানের এক শ্বেত পাথর নির্মিত চবুতরার উপর বসে সাহিত্য-দর্শন প্রভৃতি নানাবিধ আলাপ আলোচনায় মগ্ন হয়েছিলো। বয়সে দু’জনে নবীন নওজোয়ান। চোখে ওদের নানারকম রঙিন স্বপ্ন। কল্পনার ডানায় ভর করে দূর দিগন্তে ভেসে চলে ওরা। একজন বলে, আমরা যদি পাখীদের মতো সত্যই ওই নীল নভমণ্ডলে উড়ে বেড়াতে পারতাম। তা হলে কি ভালোই না হতো বলো? অন্যজন বলে, দেখ, দুনিয়ার মানুষ কত কাজে সদা ব্যস্ত। এই যে প্রকৃতির অপরূপ শোভা—এদিকে নজর দেবার ফুরসুতই নাই কারো। তা না হলে এমন সুন্দর কুসুম সুরভিত বাগিচার ধারে কাছে একটি মানুষও পা বাড়ায় না! কাজ—শুধু কাজ জীবনে সব। জীবনকে মধুর করে তুলতে হলে খাওয়া পরা ছাড়াও তো আরও অনেক কিছু চাই বন্ধু।

মুসতাবিদ আর হামদুন বণিকের ছদ্মবেশে ঘুরতে ঘুরতে ঐ বাগানের মধ্যে তরুণদ্বয়ের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের এইসব কথাবার্তা শুনছিলেন। মুসতাবিদ অবাক হয়ে ভাবলেন, এতো অল্প বয়সে এরা এতো সুন্দর সুন্দর ভাব-দর্শনের কথা সব বলতে পারছে কি করে? আমি দেশের সুলতান খলিফা, লোকে আমাকে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলে জানে, কিন্তু এই শেষ বয়সেও এসব দর্শনের ভাবনা তো আমাকে কখনও আন্দোলিত করেনি। মুসতাবিদ বুঝতে পারেন না কে এই তরুণ দুটি। এমন সুন্দর উদ্যান-তার সংলগ্ন প্রাসাদোপম বাড়ি! হামদুনকে তিনি বললেন, দোস্ত আমারই শহরে এই সুরম্য অট্টালিকা, নয়ন-মনোহর এই বাগিচা-এর মালিক কে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তুমি কিছু জান?

হামদুন বলে, না, আমিও কিছু বলতে পারবো না ধর্মাবতার, তবে ছেলে দু’টিকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই জানা যাবে।

হামদুন এগিয়ে গিয়ে ছেলে দুটির সামনে দাঁড়িয়ে বলে, আমরা পরদেশী বণিক। তোমাদের মালিককে একবার খবর দাও, আজ রাতে আমরা তার মেহেমান হতে ইচ্ছুক।

ছেলে দু’টি খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বিনয়-বিগলিত কণ্ঠে বললো, মেহেরবানী করে যদি আমাদের সঙ্গে আসেন আপনারা।

ছেলে দুটিকে অনুসরণ করে খলিফা ও হামদুন প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। একটি সুসজ্জিত বিরাট কক্ষ। দুনিয়ার সেরা সেরা জিনিসপত্রে ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো-গোছানো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই গৃহস্বামী এসে অতিথিদের সাদর অভ্যর্থনা জানালো। সাজে-পোশাকে আদব-কায়দায় চেহারা-চরিত্রে বিশেষ একটা খানদানি ছাপ সুস্পষ্ট। ঘরে ঢুকেই সে সালাম সাবুদ জানিয়ে বিনয়াবনত হয়ে বাদশাহী কেতায় বললো, অনেক পুণ্যের ফলে আজ আপনাদের দর্শন পেলাম জনাব। আপনাদের পদধূলিতে এ গরীবখানা তীর্থভূমি হয়ে গেলো। এখন হুকুম করুন মালিক, কি ভাবে আপনাদের সেবা করতে পারি।

ঘরের এক পাশের সারা দেওয়াল জুড়ে একখানা স্ফটিকের আয়না। আর সেই আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে প্রাসাদ-সংলগ্ন ফুলবাগিচার প্রায় পুরো দৃশ্য। বাগিচার ঠিক মাঝখানে একটি নিরন্তর নিঝর ঝর্ণা ঝরে পড়ছে। মুসতাবিদ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে থাকলেন সেই অপরূপ শোভা। মনে হতে লাগলো ঘরের মধ্যে যেন একটি ফুলের বাগান আর একটি ঝর্ণা অনর্গল জলধারা সিঞ্চন করে চলেছে। মন-প্রাণ এক অপূর্ব পুলকে নেচে উঠতে চায়। খলিফা মনে মনে তারিফ করে, গৃহস্বামীর বাহারী রুচি আছে বলতে হয়। অর্থ অবশ্যই ব্যয়িত হয়েছে, কিন্তু শুধু পয়সা খরচ করলেই এ বস্তু বানানো যায় না। তার জন্যে চাই সূক্ষ্ম রুচিবোধ। মুসতাবিদ ভাবেন, আমি তো সুলতান, ইচ্ছা করলেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে পারি কিন্তু এমন সুন্দর পরিকল্পনা তো আমার মাথায় আসেনি কখনও।

বাগিচায় নানা রঙের নানা সুবাসের কত রকমের কুসুম। কেউ বা সব দল মেলে ধরেছে। কেউ বা আধো আধো লজ্জায় ফুটিফুটি করেও ফুটে শেষ হতে পারছে না। আবার কতকগুলো নেহাতই কলি-কুঁড়ি।’।

এ ছাড়াও আরও চারটি প্রস্ফুটিত কুসুম দল মেলে পাশাপাশি বিকশিত হয়ে আছে। তাদেরই অপরূপ শোভায় সুবাসে সারা বাগিচায় খুশির বান ডেকেছে।

এরা চারজনেই রুপসী যুবতী। সে রূপের বর্ণনা এখানে বাহুল্য। শুধু মনে মনে কল্পনা করে নিন, জাঁহাপনা, ওরাও চারটি সদ্য ফোটা ফুল।

গৃহস্বামী নিজের পরিচয় দেয়, আমার নাম আবু অল হাসান আলী ইবন আহমদ, খুরাসনে আমাদের আদি বাস।

খলিফা বললেন, এবার তাহলে আমার পরিচয় শোনো, আমি স্বয়ং খলিফা মুসতাবিদ।

এই কথা শুনে গৃহস্বামী থর-থর করে কাঁপতে লাগলো। আভূমি আনত হয়ে সে খলিফাকে কুর্ণিশ করলো।

-যদি কোনও অন্যায় করে থাকি, যদি কোনও অসম্মান করে থাকি, শাহেনশাহ মহানুভব, গোলামের গোস্তাকি মাফ করবেন, জাঁহাপনা।

খলিফা মৃদু হেসে বললেন, অমন সঙ্কুচিত হওয়ার কোনও কারণ নাই। তোমার ব্যবহারে আমি বিশেষ প্রীত হয়েছি। শুধু একটা কথা, তোমার গৃহের এই যে সব বৈভব এবং তোমার অঙ্গের এই যে সাজ-পোশাক দেখছি, এ সবই কিন্তু আমার ঠাকুর্দা মূতাবাকিল আলা আল্লাহর। ব্যাপারটা কি,খুলে বলতে পার আমাকে? এসব ছাড়াও কী তোমার কাছে আমার পূর্বপুরুষদের আরও অনেক ব্যবহার্য সংবাদপত্র আছে? এখানে এসব জিনিস দেখে আমি তাজ্জব বনে গেছি। যাই হোক, সমস্ত ঘটনাটা আমার জানা দরকার। আশা করি কোনও কিছু লুকোছাপা করবে না। তার পরিনাম ভালো হবে না।

খলিফার হুমকিতে গৃহস্বামী মৃদু হাসলো মাত্র।

—আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করুন, জাঁহাপনা। সত্য অন্তরের ভূষণ, বাইরের সজ্জাটার নাম আন্তরিকতা, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে অবস্থান করুন, আমি আপনাকে সত্য ভাষণই শোনাব।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

আটশো ষোলতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–

একটা কুর্শিতে বসে আবু হাসান বলতে শুরু করলো? শুনুন, জাঁহাপনা, আমি কোনও শাহজাদা নই বা আমার পিতৃদেবও কোনও সুলতানের পুত্র ছিলেন না। কোনও ভাবেই আমার ধমনীতে শাহ-রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন অদ্ভুত ব্যাপার কি করে সংঘটিত হয়েছিলো, সেই বিচিত্র কাহিনীই বলছি। এই ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র এবং আমার।

অঙ্গের সাজ-পোশাক দেখে আপনি স্বভাবতই সংশয়চ্ছন্ন এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আমার বলা শেষ হলে আপনার মনে আর কোনও খেদই অবশিষ্ট থাকবে না।

এরপর এক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলো আবু হাসান। হয়ত বা পুরোনো স্মৃতি মনে মনে একবার ঝালাই করে নিতে চাইলো।

যদিও আমির বাদশাহর বংশে জন্ম নয় তবু ধনে মানে আমার বাবাও কারো থেকে খাটো ছিলেন না। এক সময়ে এই বাগদাদ শহরে সম্ভ্রান্ত সওদাগর হিসাবে যথেষ্টই তার নাম ডাক ছিলো। আমি তার একমাত্র সন্তান। তার ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু এই শহরের গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। আরব পারস্যের নানা দেশে তার বাণিজ্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই শহরের প্রায় প্রতিটি বাজারে আমার বাবার নানারকম কারবারের অনেকগুলো দোকান ছিলো। কোনটা কাপড়ের,কোনটা ওষুধের, আবার কোনওটা বা পরদেশী মুসাফীরদের জন্য শখের সামানের। প্রত্যেকটি দোকানের দেখা-শোনার জন্য একটি করে সুদক্ষ কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন তিনি।

প্রত্যেক দোকানের পিছন দিকে একটি করে বিলাসকক্ষ নির্মাণ করেছিলেন বাবা।

দুপুরের দাবদাহেবাগদাদ যখন জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যেতে থাকে সেই সময় আমার বাবা সেই বিলাসকক্ষে সুশীতল পাখার বাতাসে আরামে নিদ্রা যেতেন।

আমি বাবার একমাত্র সন্তান-বড় আদরের ধন। সুতরাং কোনও ব্যাপারেই আমার ওপর কখনও বাধা-নিষেধ আরোপ করেননি তিনি। আমার লেখাপড়া, খেলা-ধূলা, সাজ-পোশাক, আহার বিহার, কোনও বিষয়েই তার কোনওরূপ কাপর্ণ ছিলো না।

একদিন বৃদ্ধবয়সে বাবা দেহ রাখলেন। আমি তার বিপুল বিত্তের একমাত্র মালিক হলাম। বাবাকে যা যা করতে দেখেছি, আমিও হুবহু তারই পথ অনুসরণ করে যথাবিহিত দোকান-পাটের দেখা শোনা করে বহাল তবিয়তে দিন কাটাতে লাগলাম।

এই সময় আমার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা স্বভাবতই অনেক বৃদ্ধি পেতে থাকলো। কিন্তু তাতে কি, আমার যা রোজগার তাতে ভালোমন্দ খেয়ে-দেয়ে আর কত ফুরানো যায়!

আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেই অনেকবার বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে প্রলুব্ধ করেছে কিন্তু আমি তাদের সে-সব প্রস্তাব সযত্নে পরিহার করে পাশ কাটিয়ে যেতে পেরেছি।

বন্ধুরা একে একে হতাশ হয়ে কেটে পড়লো। আমি প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। কিন্তু তাতেও আমার কোনও অসুবিধা হয়নি।

কিন্তু কোনও মানুষের জীবনই সহজ-সরল পথে চিরকাল চলে না। তেমনি আমার জীবনেও একদিন জটিলতার সৃষ্টি হলো। চোদ্দ বছরের একটি মাত্র মেয়ে সব ওলটপালট করে দিয়ে গেলো।

একদিন আমার এক দোকানে বসে ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে লঘুরসের আলাপ-সালাপ করছি, এমন সময় একটি কিশোরী এসে দাঁড়ালো সেখানে। মেয়েটি জাতে জিপসী।নাচগান করে পয়সা রোজগার করাই তার পেশা। আমার সামনে লাস্যময়ী ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে বিলোল কটাক্ষ হানলো। বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, সেই মুহূর্তে আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেলো। অমন সর্বনাশা যৌবনবতী মেয়ে আমি আর দেখিনি। ওর চোখে কি যাদু ছিলো বলতে পারবো না। মুহূর্তেই আমি সম্মােহিত হয়ে গেলাম।

মেয়েটি আমাকে লক্ষ্য করে প্রশ্নবাণ ছুঁড়লো, এটা কি আবু অল হাসান সাহেবের দোকান? কথাগুলো গান হয়ে আমার কানে বাজলো। আমি বললাম, হ্যাঁ, এটা আপনার বান্দারই দোকান।

মেয়েটি দোকানের ভিতরে এসে শাহজাদীর কেতায় একখানা কুর্শিতে উপবেশন করলো। সারা শরীরে এক অভূতপূর্ব রোমাঞ্চ অনুভব করলাম আমি। মেয়েটি দ্বিধা-সঙ্কোচহীন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, কোথায় সে?

আমি তখন উত্তেজনায় কাঁপছি, মুখ দিয়ে কথা সরতে চায় না। কোনও রকমে বলতে পারলাম, আমিই হাসান।

-ও, আচ্ছা আপনার লোককে বলুন সে যেন আমাকে তিনশো দিনার গুণে একটা থলেয় ভরে দেয়।

আমি যন্ত্রচালিতের মত আমার তহবিলদারকে বললাম, তিনশো দিনার ওজন করে এক তোড়ায় বেঁধে দাও।

আমার নির্দেশমতো তহবিলদার দিনারের তোড়াটা মেয়েটির সামনে রাখতেই সে প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে পলকের মধ্যে দোকান থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।

তহবিলদার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কার নামে খরচ লিখবো, মালিক?

আমি তখনও তন্ময় হয়ে মেয়েটির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে তারই কথা ভাবছিলাম, কর্মচারীর কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, এ্যাঁ। কার নামে লিখবে? তা কার নামে লিখবে আমি কি করে বলবো?

—কেন, ঐ কন্যাটির নাম জানেন না আপনি?

-নাম? না, না-তো!

-তবে? তবে অতগুলো টাকা ওকে দিতে বললেন কেন, মালিক? আমি বললাম, ও যে চাইলো।

বাঃ, এ কি কথা, চাইলো বলেই আপনি দিয়ে দেবেন? দাঁড়ান আমি দেখছি। এই বলে সে দোকান থেকে বেরিয়ে ছুটে চলে গেলো মেয়েটির দিকে। কিন্তু একটুক্ষণ পরে একহাতে বাঁ চোখটা চেপে ধরে কাতরাতে কাতরাতে ফিরে এসে বললো, আমি মেয়েটির সামনে গিয়ে রুখে দাঁড়াতেই ও আমার এই চোখের ওপর বেমক্কা একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। আমি চোখে আঁধার দেখে মাটিতে পড়েছিলাম, সেই ফাঁকে সে হাওয়া হয়ে গেলো। উফ, হাতের কী জোর! যেন কামারের হাতুড়ি। মনে হচ্ছে, চোখটা আমার খতম হয়ে গেছে।

পরদিন আবার এলো সে। যথারীতি আবার শাহজাদীর মতো দোকানে ঢুকে একখানা কুর্শিতে বসে পড়ে বললো, গতকাল একটা ছোট্ট থলেয় কিছু দিনার দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কি আপনি কাতর হয়ে পড়েছেন?

আমি বললাম, না না, কে বললো আপনাকে? মোটেই না। এ দোকান তো আপনারই জন্য। আপনাকে কিছু দিতে পেরে আমি ধন্য হয়েছি, বলুন আর কি চাই?

মেয়েটি সহজভাবেই বললো, তাহলে আপনার লোককে বলুন, সে যেন আমাকে আজ পাঁচশো দিনার দেয়।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি তহবিলদারকে নির্দেশ দিলাম। এবং স্বল্পক্ষণের মধ্যে সে পাঁচশো দিনারের থলেটা নিয়ে উধাও হয়ে গেলো।

সারাদিন রাত আমি অনুতাপে দগ্ধ হতে থাকলাম। এ কি জাদুকরীর পাল্লায় পড়লাম আমি এভাবে চলতে থাকলে খুব শিগ্নিরই তো ফতুর হয়ে যাবো।

পরদিন সকালে বিষণ্ণ মনে দোকানে বসে মেয়েটির সম্মােহনের কথাই ভাবছি, এমন সময় আবার সে এসে বসলো আমার সামনে। এবার সে মুখে একটি কথাও উচ্চারণ করলো না! সামান্য একটু হাসলো মাত্র। তারপর চোখের ইশারা করে তাকে রাখা একটা মখমলের বটুয়া চাইলো। আমিও নির্বোধের মতো মুল্যবান জড়োয়া অলঙ্কার ভর্তি বটুয়া এনে তার হাতে তুলে দিলাম। একটি কথাও সে বললো না। বটুয়াটা নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো সতেরোতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

মুহূর্তে আমি আত্মস্থ হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে ধাওয়া করলাম মেয়েটিকে।

মেয়েটিকে যখন দেখতে পেলাম তখন সে টাইগ্রিসের কুলে গিয়ে পৌঁচেছে। তার কাছে পৌঁছবার আগেই সে ঘাটে অপেক্ষমান ছোট্ট একখানা ডিঙিতে চেপে দাঁড় টানতে টানতে নদীর কিনারা ছেড়ে দূরে চলে গেলো। তীরে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে থাকলাম। ডিঙিখানা বেয়ে সে অন্য একটা ঘাটে ভিড়লো। সেই ঘাটের পাশে আপনার ঠাকুর্দার একখানা বিলাসমহল ছিলো। মেয়েটি ডিঙি থেকে নেমে সোজা গিয়ে ঢুকে পড়লো সেই বাড়িটার ভিতরে।

ব্যাপারটা কি কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে চিন্তিত বিষণ্ণ হয়ে বাড়ি ফিরে এসে আমার মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। মা শিউরে উঠলেন, তুই ঠিক দেখেছিস বাবা, মেয়েটি খলিফার রঙমহলে গিয়ে ঢুকলো?

-ঠিক দেখবো না কেন মা?

—তা হলে বাবা, ওদিকে আর ভুলেও নজর দিসনি। সুলতান বাদশাহর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের থাকতে নাই। ওতে অনেক বিপদ বাড়ে। আমি দশ মাস পেটে ধরেছি, বুকে করে মানুষ করেছি, এই বুড়ো বয়সে তোকে হারাবার দুঃখ আমাকে দিসনি, বাবা। আমার কথা শোনো।

আমি মাকে আদর করে বললাম, বৃথা আশঙ্কা করো না, মা। আমার নসীবে যা লেখা আছে তা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। যা ঘটার ঘটবেই। আমি উপলক্ষ্য মাত্র।

পরদিন সকালে স্যাকরাপট্টিতে আমার গহনার দোকানে বসে আছি, আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো আমার দাওয়াখানার প্রধান কর্মচারী। বয়সে প্রবীণ, দক্ষ লোক, আমার বাবার খুব প্রিয়পাত্র ছিলো সে। তোমাকে এমন শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছ কেন? তোমার পিতাজী চলে যাওয়ার পর অনেক ঝড় ঝঞাই গেছে কিন্তু তোমাকে তো এমনটা কখনও দেখিনি।

আমি বললাম, না-চাচা শরীর আমার ভালোই আছে, তবে দু-একটা ঘটনায় একটু বিচলিত হয়ে পড়েছি।

–কি রকম?

—দু-তিন দিন হলো একটা ছোট্ট মেয়ে আমাকে বড় বিভ্রান্ত করে তুলেছে। এর পর পর কয়দিনের সব ঘটনা তাকে খুলে বললাম।

—হুঁ, চিন্তাই বটে। যাক, ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। এক দর্জির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে। সুলতানের দরবারের উজির আমিরদের সে পোশাক বানায়। তার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব আমি। তুমি যদি তাকে কিছু কাজ-টাজ দাও তাহলে সে তোমার উপকারে আসতে পারে।

এরপর সে আমাকে ঐ দর্জির কাছে নিয়ে গেলো। প্রথম আলাপেই বুঝলাম লোকটি বেশ সদাশয়। আমার কামিজের একটা পকেট ছিঁড়ে গিয়েছিলো, ভাব জমাবার জন্যেই বললাম, জেবটা একটু ঠিক করে দিন তো।

তখুনি সে সুন্দর করে জামাটা রিপু করে দিলো। আমি খুশি হওয়ার ছল করে দশটা দিনার গুঁজে দিলাম তার হাতে। লোকটা একটু বোকা-সোকা ধরনের। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ওটা আপনি রাখুন। আপনার কাজ আমার খুব পছন্দ হয়েছে, শেখ।

দর্জি বললো, আপনার সাজ-পোশাক দেখে তো বনেদী বণিক-সওদাগর বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু ব্যবহারটা আসলে তাদের মত নয়, মালিক।

কথাটার নিগূঢ় অর্থ বুঝতে না পেরে আমি বললাম, মানে?

সে বললো, দশ রিহামের কাজ না পেলে এক দিরহাম হাত দিয়ে গলে না কোনও সওদাগরের, আপনি ফালতু ফালতু দশটা দিনার খয়রাতি করে দিলেন আমাকে? এতো আমির বাদশাহ ছাড়া আর কেউই দেয় না। অবশ্য আরও একজন দেয়, কিন্তু সাহেব, আপনি কি প্রেমে পড়েছেন সদ্য?

আমি লজ্জা পেলাম, আপনি ঠিকই ধরেছেন, শেখ। প্রথম দর্শনেই আমি মূৰ্ছা গেছি। দর্জি মুচকি হেসে বলে, খরগোশ, না হরিণী।

—সে হরিণী-নয়না।

—তা হলে তো পোয়া-বারো। হরিণী শিকারের ওস্তাদী আমার বহুৎ আচ্ছা-তরা জানা আছে, মালিক, ঘাবড়াবেন না কিছু। কি নাম তার?

-খোদা জানেন। আর চেষ্টা করলে আপনি জানতে পারবেন।

—ঠিক আছে, কোই বাত নাই, কি রকম দেখতে, বলুন। আমার সাধ্যমতো তার রূপ-যৌবনের বর্ণনা দিলাম।

আমার কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠলো, ইয়া আল্লাহ, এ তো মুক্তাবানু! খলিফার জলসা-ঘরে বাঁশী বাজায়। আমার কাছে তো তার খুদে খোজা নফরটা হামেশাই আসে।

ওর কথা শেষ হতে না হতেই একটা সুন্দর ফুটফুটে ছোকরা এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। ঝুলন্ত একটা ছোট্ট কামিজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটার কত দাম নেবে শেখ আলী? চটপট বলো, আমার দাঁড়াবার সময় নাই, দেরি হলে আবার মুক্তাবানু বকুনি লাগাবে।

জামাটা খুলে নিয়ে ছেলেটির হাতে দিয়ে বললাম, এই নাও, তোমাকে উপহার দিলাম এটা। আমি দাম দিয়ে দেব।

ছেলেটি মিষ্টি করে হাসলো। হঠাৎ ওর হাসির ঝিলিক আর কটাক্ষ দেখে আমার মুক্তাবানুর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অদ্ভুত মিল তো। তফাতের মধ্যে সে মেয়ে আর এ ছেলে।

নিশ্চয়ই আপনি খুরাসনের আবু অল হাসান ইবন আহমদ।

ছেলেটি আমাকে চিনলো কি করে? অবাক হলাম। এবং প্রীত হলাম ছেলেটির ওপর। আমার হাতের একটা আংটি খুলে পরিয়ে দিলাম ওর আঙ্গুলে।

তুমি তো ঠিকই চিনেছ, খোকা। কিন্তু কে তোমাকে বললো আমার নাম, কার কাছ থেকে শুনেছ?

-বাঃ, চিনবো না কেন, আমার মালকিন তো সারা দিন-রাতে হাজার বার আপনার কথা বলে। তার মুখ থেকে আপনার চেহারা চরিত্রের নিখুঁত বর্ণনা শুনে শুনে আমার সব মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি কি কচি খোকাটি আছি নাকি এখনও, বুঝতে পারি না, সে আবু অল হাসান আলীকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে? তবে মালিক, আপনিও যদি আমার মালকিনকে ভালোবেসে থাকেন তবে খোদা কসম, আমার দিক থেকে যা করা দরকার তো আমি করবো।

আমি ওকে বললাম, তোমার মালকিনকে দেখার পর থেকে আমি ভালোবাসার আগুনে। জ্বলছি। জানি না, তাকে না পেলে আমি জানে বাঁচবো কিনা।

ছেলেটি বললো, তা হলে ঠিক আছে, আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

আটশো আঠারোতম চনী :.

আবার সে বলতে থাকে– কিছুক্ষণ বাদে ছেলেটি ফিরে এলো। তার হাতে একটা মোড়ক। বললো, এর মধ্যে খলিফা মুতাবাকিল আলা আল্লাহর সান্ধ্য পোশাক আছে। আর আছে এক শিশি আতর। খলিফা ঐ রঙমহলে আসেন এই পোশাক পরে। রঙমহলের দোরগড়ায় এই আতর ঢেলে দিলেই দরজা খুলে যায়। আপনি আজ সন্ধ্যায় সেজে-গুজে আসুন, তারপর যা করতে হয় আমি করবো।

ছেলেটি আর দাঁড়ালো না। মোড়কটা আমার হাতে দিয়ে চলে গেলো।

আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। কিন্তু নতুন অভিজ্ঞতার আকর্ষণও এড়াতে পারলাম না।

সন্ধ্যার পর সেজে-গুজে রঙমহলে চলে এলাম। জলসাঘর ছাড়িয়ে ওদিকে অন্দরমহল— হারেম। দুরু দুরু কম্পিত বুকে পায়ে পায়ে আমি এগিয়ে গেলাম।

হারেমের রুদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আতর ঢেলে দিলাম চৌকাঠে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। ভিতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না, এই সংশয়ে দুলছি, এমন সময় মচমচ পায়ের শব্দে চমকে পিছনে তাকিয়ে আত্মা শুকিয়ে গেলো। সর্বনাশ, স্বয়ং খলিফা মুতাবাকিল আলা আল্লাহ। তার দুইপাশে জনাকয়েক তাগড়াই দেহরক্ষী। তাদের সকলের হাতেই চিরাগ-বাতি। কি করবো, কি করা উচিত কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। পালাবারও পথ নাই। পিছনে সদলবলে সুলতান এগিয়ে আসছেন। সামনে হারেমের মহল। উপায়ান্তর না দেখে হারেমের ভিতরেই ঢুকে পড়ে উভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগলাম। এ ঘর ছেড়ে ও ঘর ছেড়ে অন্য এক ঘর। কিন্তু কোথায় লুকাবো কিছুই ঠিক করতে পারলাম না।

অবশেষে আর একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম। একটি প্রায় বিবস্ত্রা পরমাসুন্দরী মেয়ে আমাকে আচমকা দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পালঙ্কের শয্যায় নিজেকে লুকোবার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি কি করবো কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। মেয়েটি মৃদু কণ্ঠে বললো, আপনি তো আবু অল হাসান আলী। মুক্তাবানু আমার বোন, আপনি বসুন, কোনও ভয় নাই। এ ঘরে কেউ আসবে না। আমার বোন আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু আপনার মনোভাব এখনও তার অজানা।

আমি বললাম, আমাকে বিশ্বাস করুন, এখন আমার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান আপনার ভগ্নী। সে ছাড়া আমি আর অন্য কোনও মেয়েকে ভাবতে পারি না।

মেয়েটি হাতে তুড়ি বাজাতেই সেই ছোট্ট ছেলেটি এসে দাঁড়ালো।

—শোন্, এখানে মুক্তাবানুকে নিয়ে আয়, বল্ পিস্তাবানু ডাকছে। যা, জলদি ডেকে নিয়ে আয়।

একটুক্ষণ পরে নীলরঙের রেশমী বোরখা পরে একটি মেয়ে এলো। রাতের অস্পষ্ট আলোতেও বুঝতে অসুবিধে হলো না—সে এসেছে। আপনাকে বোঝাতে পারবো না তখন আমার কি অবস্থা। ভয়-উত্তেজনা মিশ্রিত সে এক অভূতপূর্ব রোমাঞ্চ।মুখে কোনও কথা বলতে পারলাম না। সেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো আমার সামনে। কোনও কথা বললো না।

তারপর একসময় আমার বাহুর আকর্ষণে অথবা তারই স্বেচ্ছা-সম্পর্কে, দেখলাম সে আমার বুকের মধ্যে হারিয়ে গেছে। মুখখানা নামিয়ে নিয়ে ওর অধরে এঁকে দিলাম গভীর একটি চুম্বন। ওঃ সে কি মধুর, কি করে বোঝাই আপনাকে। মনে হলো শতবর্ষ পরমায়ু বেড়ে গেলো আমার।

জানি না ঐভাবে একাত্ম হয়ে কতক্ষণ আমরা ছিলাম সেখানে।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো উনিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে আমরা যখন প্রেমালাপে মত্ত সেই সময় খলিফার আগমন সংবাদ পেয়ে আমি ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম। খলিফা আজ ঠিক করেছেন পিস্তাবানুর ঘরে আসবেন। সঙ্গে সঙ্গে ওরা আমাকে একটা বিরাট বড় কাঠের বাক্সের মধ্যে ভরে ফেললো।

আমি বাক্সের মধ্যে শুয়ে শুয়ে শুনলাম, আপনার নানাজী বলছেন, এই যে মুক্তাবানু, তুমি যে এ সময়ে তোমার দিদির ঘরে? কই তোমাকে তো এ কদিন রঙমহলে দেখিনি! কোথায় গিয়েছিলে? সারা মহল তোমার গুঞ্জরণে মুখর হয়ে থাকে। অথচ কদিন একটা কলিও শুনিনি। যাক, আজ যখন সামনে পেয়েই গেছি, আমাকে একটা গান শোনাও দেখি।

মুক্তাবানু জানতো, সুলতান তার বোন পিস্তাবানুকেই ভালোবাসেন। মুক্তার কাছে তিনি শুধু গান শুনতেই ভালোবাসেন।

মুক্তার গান শুনে মুগ্ধ হলেন খলিফা। তারিফ করে বললেন, সত্যিই, কি গানে কি বাজনায় তোমার জুড়ি নাই, মুক্তো। আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাকে আমি ইমাম দিতে চাই, বলো তুমি কি চাও? যা চাইবে তাই দেব, এমন কি আমার সলতানিয়তের অর্ধেকটাও চাইতে পার, দিয়ে দেব হাসিমুখে।

–খোদা ধর্মাবতারকে চিরজীবী করুন, আমার আর কোনও বাসনাই নাই জাঁহাপনা, আপনি আমাকে আর আমার বোন পিস্তাকে মেহেরবানী করে পায়ে ঠাই দেবেন, তা হলেই ধন্য হবে।

-সে তো ঠিক আছে। এ ছাড়া অন্য কিছু চাও—যা খুশি।

—জাঁহাপনার যদি এতোই ইচ্ছা তবে বলছি, তিনি যেন আমাকে খালাস দিয়ে দেন। আর সেই সঙ্গে এই মহলের যাবতীয় পোশাক-আশাক আসবাবপত্র যা আছে সেগলোও আমি নিতে চাই।

তাই হলো, আজ থেকে এ সব তোমার। আমি তোমায় মুক্তি দিলাম। তোমার যেখানে খুশি তুমি চলে যেতে পার। অথবা থাকতেও পার এখানে।

এরপর খলিফা আর সে-ঘরে অপেক্ষা করলেন না।

এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। পরদিন সকালে খোজাদের ডেকে রঙমহলের তামাম জিনিসপত্র সব এক এক করে বের করে নিয়ে এলাম আমার এই বাড়িতে। ঐ যে ওপাশে দেওয়ালের ধারে লম্বা বাক্সটা দেখছেন, ঐ কাঠের বাক্সটায় ওরা আমাকে লুকিয়ে রেখেছিলো সেদিন।

সেইদিনই আমি মুক্তোকে শাদী করে আমার বিবি বানালাম।

এই হচ্ছে, জাঁহাপনা আমার কাহিনী। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনার নানাজীর এই সমস্ত বাদশাহী আসবাবপত্র এবং সাজ-সরঞ্জাম কি করে আমার ঘরে এলো? আপনাকে যা বললাম, তার একবর্ণও মিথ্যে নয়, খোদা কসম।

খলিফা মসতাবিদ বললেন, তোমার কথায় খুব প্রীত হয়েছি হাসান আলী। আমাকে। এক-টুকরো কাগজ আর দোয়াত কলম দাও। আমি তোমাকে কিছু উপহার দেব।

কাগজ কলম আনা হলে খলিফা হামদুনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ফিরমানকে হুকুমনামা লিখে দাও, আজ থেকে হাসান আলী যতকাল জীবিত থাকবে, তার সব কর মুকুব করে দেওয়া হলো।

হামদুন লিখে খলিফার সামনে ধরতে তিনি দস্তখত করে দিলেন। এবং বললেন, এখন থেকে তুমি আমার দরবারের অন্যতম আমীর হলে হাসান আলী। এর ফলে প্রায় রোজই তোমার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ ঘটবে। দিনে দিনে আমরা আরও নিকট সৌহার্দ্যে পৌঁছতে পারবো।

সেই থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আবু অল হাসান আলী আর খলিফার মধ্যে কোনও বিচ্ছেদ ঘটেনি।

গল্প শেষ করে শাহরাজাদ চুপ করলো। কিন্তু প্রভাত হতে তখনও দেরি ছিলো। একটুক্ষণ পরে সে বললো, আর একটা কিসসা শুরু করছি, জাঁহাপনা। এবার সুলতান মামুদের কাহিনী শুনুনঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *