২৬. পরিশিষ্ট (চণ্ডীদাসের পদাবলী)

পরিশিষ্ট (চণ্ডীদাসের পদাবলী)

অনুরাগ—আত্মপ্রতি ।। সুহই ।।

জনম গেল পর দুঃখে কত বা সহিব।
কানু কানু করি কত নিশি পোহাইব।।
অন্তরে রহিল ব্যথা কুলে কি করিবে।
অনুরাগে কোন দিন গরল ভখিবে।।
মনেতে করেছি কুলে দিব তিলাঞ্জলী।
দেশান্তরি হ’ব গুরু দিঠে দিয়া বালি।।
ছাড়িনু গৃহের সাধ কানুর লাগিয়া।
পাইনু উচিৎ ফল আগে না বুঝিয়া।।
অবলা কি জানে এমত হইবে পাছে।
তবে এমন প্রেম করিবে কেন যেচে।।
ভাল মন্দ না জানিয়া সুঁপেছি হে মন।
তেঞি সে অনলে পুড়ি যায় দেহ প্রাণ।।
চণ্ডীদাস কয় প্রেম হয় সুধাময়।
কপাল ক্রমে অমৃতেতে বিষ উপজয়।। *

——————-

* পদসমুদ্র।

অনুরাগ—আত্মপ্রতি ।। ধানশী ।।

হলধর ভয়ে মালা নাহি পারে দিতে।
ফিরিয়া আইল সুখী করিয়া সঙ্কেতে।।
হেন কালে আইল কাক খাদ্য দ্রব্য বলে।
সেই হেতু নিল মালা ওষ্ঠে করি তুলে।।
আহার নাহিক হলো দিল ফেলাইয়া।
পবনে দিলেক তাহা বেগে উড়াইয়া।।
আসিয়া পড়িল ঠোঙ্গা চন্দ্রাবলী ঘরে।
খুলিয়া দেখিল মালা অতি মনোহরে।।
সঙ্কেত জানিয়া এথা খুঁজে শ্যাম রায়।
দেখিতে না পায় পুন সাতলী খেয়াল।।
এথা সেই মালা লয়ে আনন্দে পুরিল।
চন্দ্রাবেশ করি সেই মালা পরি এল।।
রাইকে দেখিবার তরে এল তার পাশ।
প্রশ্নেতে জানিল ভাল কহে চণ্ডীদাস।।

—————–

নায়িকার প্রতি সখী বাক্য ।। বালা-ধানশী ।।

এ সখি সুন্দরি কহ কহ মোয়।
কাহে লাগি তুয়া অঙ্গ অবশ হোয়।।
অধর কাঁপয়ে তুয়া ছল ছল আঁখি।
কাঁপিয়া উঠয়ে তনু কণ্টক দেখি।
মৌন করিয়া তুমি কি ভাবিছ মনে।
এক দিঠি করি রহ কিসের কারণে।।
বড়ু চণ্ডীদাসে কহে বুঝিলাম নিশ্চয়।
পশিল শ্রবণে বাঁশী অতত্ত্ব সে হয়।। *

——————-

* বি, প্র, প।

নায়িকার বাক্য ।। বিভাষ ।।

আমিত অবলা, তাহে এত জ্বালা, বিষম হইল বড়।
নিবারিতে নারি গুমরিয়া মরি, তোমারে কহিল দঢ়।।
সহজে আপন, বয়স যেমন, আর নহে হাম জানি।
স্বপনে ভালিয়া, সে রূপ কালিয়া, না রহে আপন প্রাণী।।
সই! মরণ ভাল।
সে বর নাগর, মরমে পশিল, ভাবিতে হইল কাল।।
কহে চণ্ডীদাসে, বাশুলী আদেশে, এইত রসের কূপ।
এক কীট হয়ে, আর দেহ পায়ে, ভাবিয়ে তাহার রূপ।। *

——————-

* বি, প্র, প।

নায়ক বাক্য ।। বিভাষ ।।

সেই কোন বিধি, আনি সুধানিধি, থুইল রাধিকা নামে।
শুনিতে সে বাণী, অবশ তখনি, মুরছি পড়ল হামে।।
সই! কি আর বলিব আমি।
সে তিন আখর, কৈল জ্বর জ্বর হইল অন্তর গামী।।
সব কলেরব, কাঁপে থর থর ধরণ না যায় চিত।
কি করি কি করি, বুঝিতে না পারি, শুনহ প্রাণ মিত।।
কহে চণ্ডীদাএ, বাশুলী আদেশে, সেই যে নবীন বালা।
তার দরশনে, বাড়িল দিগুণে, পরশে ঘুচব জ্বালা।। *

——————-

* বি, প্র, প।

অনুরাগ— সখী সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।

কি রূপ দেখিনু সই কদম্বের তলে।
লখিতে নারিনু রূপ নয়নের জলে।।
কি বুদ্ধি করিব সই কি বুদ্ধি করিব।
নিতি নব অনুরাগে পরাণ হারাব।।
কিবা নিশি কিবা দিশি কালা পড়ে মনে।
দেখিলে এমন হবে জানিব কেমনে।।
গৃহকাজে নাহি মন কর নাহি সরে।
শ্যাম নাম শুনিতে পুলকে অঙ্গ ভরে।
তাহে সে মোহন বাঁশী রাধা রাধা বাজে।
পরাণ কেমন করে মনু লোকে লাজে।।

——————-

লখিতে নারিনু – দেখিতে পারিলাম না।
মনু – মরিলাম।

অনুরাগ— প্রকারান্তরে ।। শ্রীরাগ ।।

যাবট নিকট দিয়া,                      যায় বেণু বাজাইয়া,
তখন আমি দুয়ারে দাঁড়ায়ে।
দেখি বলি আইনু আমি,     ফিরিয়া না চাহিলে তুমি,
আঁখি রহিল চাঁদ মুখ চেয়ে।।
শ্রীদামের সঙ্গে সঙ্গে,                নাচিতে নাচিতে রঙ্গে,
দাঁড়াইলে হলধরনের বামে।
কাঁদিতে কাঁদিতে হাম,                    হয়ে বাউরী নিয়ম,
প্রবেশিলাম ললিতার ধামে।।
তোঁহা রূপ গুণ স্মরি,                  ধৈরজ ধরিতে নারি,
মূরছিত মুরলীর গানে।
হৃদয়ে বাঢ়য়ে রতি,                 যে না মিলে পতী সতি,
কুলের ধরম নাহি জ্ঞানে।।

——————-

যাবট – বৃন্দাবনের একটি পল্লী।
হয়ে বাউরী নিয়ম – পাগলের মত হইয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *