অনুরাগ–নায়ক সম্বোধনে
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
ভাদরে দেখিনু নটচাঁদে।
সেই হৈতে উঠে মোর কানু পরিবাদে।।
এতেক যুবতীগণ আছয়ে গোকূলে।
কলঙ্ক কেবল লেখা মোর সে কপালে।
স্বামী ছায়াতে মারে বাড়ী।
তার আগে কুকথা কয় দারুন শ্বাশুডী।।
ননদিনী দেখয়ে চোকের বালী।
শ্যাম নাগর! তোমায় পাড়ে গালি।।
এ দুঃখে পাঁজর হৈল কাল।
ভাবিয়া দেখিনু এবে মরণ সে ভাল।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে পুনঃ কয়।
পরের বচনে কি আপন পর হয়?
————–
ভাদরে – ভাদ্রে। নটচাঁদে – নষ্টচন্দ্রে।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। সিন্ধুড়া ।।
যখন পিরীতি কৈলা, আনি চাঁদ হাতে দিলা,
আপনি করিতা মোর বেশ।
আঁখির আড় নাহি কর, হিয়ার উপরে ধর,
এবে তোমা দেখিতে সন্দেশ।।
একে হাম পরাধিনী, তাহে কুল কামিনী,
ঘর হৈতে আঙ্গিনা বিদেশ।
এত পরমানে প্রাণ, না যায় তবুত আন,
আর কত কহিব বিশেষ।।
ননদী বিষের কাঁটা, বিষ মাখা দেয় খোঁটা,
তাহে তুমি এত নিদারুণ।
কবি চণ্ডীদাস কয়, কিবা তুমি কর ভয়,
বন্ধু তোর নহে অকরুন।।
————–
এবে তোমা দেখিতে সন্দেশ – এখন তোমার সস্বাদ পাওয়া যায় না।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। ধানশী ।।
যখন নাগর, পিরীতি করিলা,
সুখের না ছিল ওর।
সোতের সেঁওলা, ভাসাইয়া কালা,
কাটিলা প্রেমের ডোর।।
মুঞিত অবলা, অখলা হৃদয়,
ভাল মন্দ নাহি জানি।
বিরলে বসিয়া, চিত্রেতে লিখিয়া,
বিশাখা দেখালে আনি।।
পিরীতি মূরতি, কোথা তার স্থিতি,
বিবরণ কহ মোরে।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
এত পরমাদ করে।।
পিরীতি বলিয়া, এ তিন আখর,
ভুবনে আনিল কে?
অমৃত বলিয়া, গরল ভক্ষিণু,
বিষেতে জ্বারিল দে।।
নদীর উপরে, জলের বসতি,
তাহার উপরে ঢেউ।
তাহার উপর, রসিকের বসতি,
পিরীতি না জানে কেউ।।
চণ্ডীদাস কয়, দুই এক হয়,
ভাবে সে পিরীতি রয়।
(নতু) খলের পিরীতি, তুষের আনল,
ধিকি ধিকি যেন বয়।।
————–
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। পঠমঞ্জরী ।।
তোমার প্রেমে বন্দী হৈলাম শুন বিনোদ রায়!
তোমা বিনে মোর চিতে কিছুই না ভায়।।
শয়নে স্বপনে আমি তোমার রূপ দেখি।
ভরমে তোমার রূপ ধরণীতে লেখি।।
গুরু জন মাঝে যদি থাকিয়ে বসিয়া।
পরসঙ্গে নাম শুনি দরবয়ে হিয়া।।
পুলকে পূরয়ে অঙ্গ, আঁখে ঝরে জল।
তাহা নেহারিয়ে আমি হইয়ে বিকল।।
নিশি দিশি বন্ধু তোমায় পাসরিতে নারি।
চণ্ডীদাস কহে হিয়ায় রাখ স্থির করি।।
————–
ভায় – দীপ্তি পায়।
দরবয়ে – দ্রব হয়। “দড়বড়ে” পাঠও আছে।
পূরয়ে – পূরণ করে।
নেহারিয়ে – দেখিয়া।
বিকল – বিহ্বল, কাতর।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। সুহই ।।
কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।।
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।।
কোন বিধি সিরজিল সোতের সেঁওলি।
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।।
বাশুলী আদেশে দ্বিজ দণ্ডীদাস কয়।
পরের লাগিয়ে কি আপন পর হয়।।
————-
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। তুড়ি ।।
তোমারে বুঝাই বঁধু তোমারে বুঝাই।
ডাকিয়া সুধায় মোরে হেন জন নাই।।
অণুক্ষণ গৃহে মোর গঞ্জয়ে সকলে।
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।।
এ ছার পরাণে আর কিবা আছে সুখ?
মোর আগে দাঁড়াও তোমার দেখিব চাঁদ মুখ?
খাইতে সোয়াস্তি নাই নাহি টুটে ভুক।
কে মোর ব্যথিত আছে কারে কব দুখ।।
পরের বোলে কেবা প্রাণ ছাড়িবার চায়?
চণ্ডীদাস কহে রাই ইহা না যুয়ায়।।
————–
গঞ্জয়ে – গঞ্জনা দেয়। নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে – নিশ্চয় জানিও আমি বিষ খাইব।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। সুহই ।।
হেদে হে বিনোদ রায়।
ভাল হৈল ঘুচাইল পিরীতের দায়।।
ভাবিতে গণিতে তনু হৈল অতি ক্ষীণ।
জগ ভরি কলঙ্ক রহিল চির দিন।।
তোমার সনে প্রেম করি কি কাজ করিনু।
মৈলাম লাগে মিছা কাজে দগদগি হৈনু।।
না জানি অন্তরে মোর হৈল কিবা ব্যথা।
একে মরি নানা দুঃখে আর নানা কথা।।
শয়নে স্বপনে বন্ধু সদা করি ভয়।
কাহার অধীন যেন তোমার প্রেম নয়।।
ঘায়ে না মরিয়ে বন্ধু মরি মিছা দায়।
চণ্ডীদাস কহে কার কথায় কিবা যায়।।
————–
জগ ভরি কলঙ্ক রহিল চির দিন – বিভিন্নপাঠ–“জগভরি কলঙ্ক রহিল এই চিন।” প, ক, ত। জগ – জগৎ।
একে মরি নানা দুঃখে আর নানা কথা – বিভিন্নপাঠ–“একে মরি মনোদুখে আর নানা কথা।” প, ক, ত।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। শ্রীরাগ ।।
সকলি আমার দোষ, হে বন্ধু,
সকলি আমার দোষ।
না জানিয়া যদি, কৈরাছি পিরীতি,
কাহারে করিব রোষ।।
সুধার সমুদ্র, সমুখে দেখিয়া
আইনু আপন সুখে।
কে জানে খাইলে, গরল হইবে,
পাইব এতেক দুখে।।
সো যদি জানিতাম, অলপ ইঙ্গিতে,
তবে কি এমন করি।
জাতি কুল শীল, মজিল সকল,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া মরি।।
অনেক আশার, ভরসা মরুক,
দেখিতে করয়ে সাধ।
প্রথম পিরীতে, তাহার নাহিক
বিভাগের আধের আধ।।
যাহার লাগিয়া, যে জন মরয়ে,
সেই যদি করে আনে।
চণ্ডীদাস কহে, এমনি পিরীতি,
করয়ে সুজন সনে।।
————–
সো যদি জানিতাম – পাঠান্তর–“মো যদি জানিতাম।” প, ক, ত।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। কামোদ ।।
বন্ধু কহিলে বাসিবে মনে দুখ।
যতেক রমণী ধনী, বৈঠয়ে জগত মাঝে,
না জানি দেখয়ে তুয়া মুখ।।
লোক মুখে জানিনু, লখি আগে না দেখিনু,
আমারে কুমতি দিল বিধি।
না বুঝিয়া করে কাজ, তার মুণ্ডে পড়ে বাজ,
দুঃখ রহে জনম অবধি।।
কেন হেন বেশ ধর, পরের পরাণ হর,
স্ত্রী বধিতে ভয় নাহি কর?
গগন ইন্দু আনিয়া, করে করে দর্শাইয়া,
এবে কেন এমনি আচর?
পিরীতি পরশে যার, হিয়া নাহি দরবয়ে,
সে কেনে পিরীতি করে সাধ?
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, মোর মনে হেন লয়,
ভাঙ্গিলে গড়িতে পরমান।।
————–
লখি- লক্ষ করিয়া।
অনুরাগ।–নায়ক সম্বোধনে ।। ভাটিয়ারি ।।
তুমি ত নাগর, রসের সাগর,
যেমত ভ্রমর রীত।
আমি ত দুঃখিনী, কুল কলঙ্কিনী,
হইনু করিয়া প্রীত।।
গুরু জন ঘরে, গঞ্জয়ে আমারে,
তোমারে কহিব কত।
বিষম বেদন, কহিলে কি যায়,
পরাণ সহিছে যত।।
অনেক সাধের, পিরীতি বন্ধু হে,
কি জানি বিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদ হইলে, পরাণে মরিব,
এমনি সে মনে লয়।।
চণ্ডীদাস কহে, পিরীতি বিষম,
শুনহ বড়ুয়ার বহু।
পিরীতি বিষদ হইলে বিপদ,
এমন না হউ কেহু।
————–
বিষদ – বিষদাতা।