খণ্ডিতা
খণ্ডিতা ।। চন্দ্রাবলীর উক্তি ।। কামোদ ।।
এই পথে নিতি, কত গতায়তি,
নূপুরের ধ্বনি শুনি।
রাধা সঙ্গে বাস, আমারে নৈরাশ,
আমি বঞ্চি একাকিনী।।
বন্ধু হে! ছাড়িয়া নাহিক দিব।
হিয়ার মাঝারে, রাখিব তোমারে,
সদাই দেখিতে পাব।।
শুন সখীগণ, করিয়া যতন,
লয়ে চল নিকেতনে।
আজকার নিশি, রাধিকা রূপসী,
বঞ্চুক নাগর বিনে।।
এতেক শুনিয়া, করেতে ধরিয়া,
লইয়া চলিল বাস।
রাধা ভয়ে হরি, কাঁপে থরথরি,
ভণে দ্বিজ চণ্ডীদাস।।
————–
গতায়তি যাতায়াত। বঞ্চি – কাটাই।
খণ্ডিতা লক্ষণঃ–
“অন্য নায়িকা ভোগ করিয়া নায়ক। আইছে অঙ্গেতে নখ চিহ্নাদি যাবক।।
দেখিয়া কুপিত মনে ভর্ৎসনাদি করি। উপেক্ষা করয়ে খণ্ডিতাবনতা নারী।।”
–ভক্তমাল।
খণ্ডিতা ।। শ্রীরাগ ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
চন্দ্রাবলী! আজি ছাড়ি দেহ মোরে।
শ্রীদাম ডাকিছে, যাব তার কাছে,
এই নিবেদন তোরে।।
কাল আসি হাম, পুরাইব কাম,
ইথে নাহি কর রোষ।
চন্দ্রাবলী নাথ, ভুবনে বিদিত,
জগতে ঘোষয়ে দোষ।।
তুমি যে আমার, আমি যে তোমার,
বিবাদে কি ফল আছে?
লোক জানাজানি, কেন কর ধনি!
পিরীতি ভাঙ্গিবে পাছে?
দাদা বলরাম, করে অম্বেষণ,
ভ্রময়ে নগর মাঝে।
চণ্ডীদাসে কয়, সে যদি জানয়,
সবাই পড়িবে লাজে।।
————–
চন্দ্রাবলী – বৃষভানু রাজার ভ্রাতা রত্নভানু রাজার কন্যা।
কাম – কামনা।
ইথে – ইহাতে।
খণ্ডিতা ।। বিহাগড়া ।। (চন্দ্রাবলীর উক্তি)
কে বলে আমার, তুমি সে রাধার,
তাহার দুখের দুখী।
করিয়া চাতুরী, যাবে বুঝি হরি,
রাধারে করিতে সুখী।।
বঁধু হে! তুমি রাধার নাথ!
তব ভারিভূরি, ভাঙ্গিব মুরারি,
রাখিব আপন সাথ।।
এতেক বলিয়া, করেতে ধরিয়া,
চুম্বয়ে বদন চাঁদে।
রসিক নাগর, হইয়া ফাঁকর,
পড়িল বিষম ফাঁদে।।
হেথা সুবদনী, সখী সঙে বাণী,
কহয়ে কাতর ভাষে।
নিশি পোহাইল, পিয়া না আইল,
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে।।
————–
ভারিভূরি – আত্ম শ্লাঘা, জাঁক। সুবদনী – শ্রীরাধিকা। সঙে – সঙ্গে।
খণ্ডিতা ।। ধানশী ।।
চন্দ্রাবলী সনে, কুসুম শয়নে,
সুখেতে ছিলেন শ্যাম।
প্রভাতে উঠিয়া, ভয়ে ভীত হৈয়া,
আসিলা রাধার ঠাম।।
গল পীতবাস, করিয়া সাহস,
দাঁড়াইল রাইয়ের আগে।
দেখে ফুলমালা, তাম্বুলের ডালা,
ফ্রিয়াছে রাই রাগে।।
নাগরে দেখিয়া, মানিনী না চান,
আছেন আপন কোপে।
ভয়ে যে ভূরুর, ভঙ্গিম দেখিয়া
নাগর তরাসে কাঁপে।।
রোষেতে নাগরী, থাকিতে না পারি,
নাগরেরে পাড়ে গালি।
চণ্ডীদাস ভণে, লম্পটের সনে,
কথা কৈলে তবু ভালি।।
————–
ঠাম – নিকটে। তরাসে – ত্রাশে, ভয়ে। নাগরেরে পাড়ে গালি – শ্রীকৃষ্ণকে গালি দেন। ভালি – ভাল।
খণ্ডিতা ।। ললিত ।।
ভাল হৈল আরে বঁধু আসিলা সকালে।
প্রভাতে দেখিলাম মুখ দিন যাবে ভালে।
বঁধু তোমায় বলিহারি যাই।
ফিরিয়া দাঁড়াও তোমার চাঁদ মুখ চাই।।
আই আই পড়েছে মুখে কাজরের শোভা।
ভালে যে সিন্দূর তোমার মুনির মনোলোভা।।
খর নখ দশনে অঙ্গ জর জর।
ভালে সে কঙ্কণ দাগ হিয়ার উপর।।
নীল পাটের শাটী কোচার বলনী।
রমণী রমণ হৈয়া বঞ্চিলা রজনী।।
সুরঙ্গ যাবক রঙ্গ উরে ভালে সাজে।
এমন কহ মনের কথা আইলা কিবা কাযে।।
চারি দিকে চায় নাগর আঁচলে মুখ মুছে।
চণ্ডীদাস কহে লাজ ধুইলে না ঘুচে।।
————–
শাটী – শাড়ী। যাবক – আলতা। উরে – বক্ষঃস্থলে।
খণ্ডিতা ।। রামকেলী ।।
ছুঁইওনা ছুঁইওনা বন্ধু ঐখানে থাক।
মুকুর লইয়া চাঁদ মুখ খানি দেখ।। ধ্রু।।
নয়ানের কাজর, বয়ানে লেগেছে,
কালের উপরে কাল!
প্রভাতে উঠিয়া, ওমুখ দেখিলাম,
দিন যাবে আজ ভাল।।
অধরে তাম্বুল, বয়ানে লেগেছে,
ঘুমে ঢুলু ঢুলু আঁখি।
আমা পানে চাও, ফিরিয়া দাঁড়াও,
নয়ন ভরিয়া দেখি।।
চাঁচর কেশের, চিকণ চূড়া।
সে কেন বুকের মাঝে।
সিন্দূরের দাগ, আছে সর্ব্বগায়,
মোরা হলে মরি লাজে।।
নীলকমল, ঝামরু হইয়াছে,
মলিন হইয়াছে দেহ।
কোন রসবতী, পেয়ে সুধানিধি,
নিঙড়ে লয়েছে সেহ।।
কুটিল নয়ানে, কহিছে সুন্দরী,
অধিক করিয়া ত্বরা।
কহে চণ্ডীদাস, আপন স্বভাব,
ছাড়িতে না পারে চোরা।।
————–
মুকুর – দর্পন; আয়না। ঝামরু – মলিন। নিঙড়ে – নিঙ্গাড়িয়া।
খণ্ডিতা ।। বিভাস ।।
হেদে হে নিলাজ বঁধু লাজ নাহি বাস।
বিহানে পরের বাড়ী কোন্ লাজে আস?
বুক মাঝে দেখি তোমার কঙ্কণের দাগ।
কোন কলাবতী আজি পেয়েছিল লাগ?
নখ পদ বিরাজিত রুধিরে পূরিত।
আহা মরি কিবা শোভায় করিল ভূষিত।।
কপালে সিন্দূর রেখা অধরে কাজল।
সে ধনী বিহনে তোমার আঁখি ছল ছল।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে শুন বিনোদিনি।
না ছুঁইও আমি ইহার সব রঙ্গ জানি।।
————–
বিহানে – প্রাতে; সকালে। কলাবতী – রসিকা।
খণ্ডিতা ।। সিন্ধুড়া ।।
বঁধু কহনা রসের কথা শুনি!
কেমন কামিনী সঙ্গে, যাপিলা যামিনী রঙ্গে,
কত সুখে পোহালা রজনী?
নীল নলিনী আভা, কে নিলে অঙ্গের শোভা,
কাজরে মলিন অঙ্গ খানি।
চিকণ চূড়ার ছাঁদ, কে নিলে বরিহা ফাঁদ,
আজি কেন পিঠে দোলে বেণী?
ধন্য সে বরজ বধু, যে পিয়ে অধর মধু,
পাষাণে নিশান তার সাখী।
রক্ত উৎপল ফুলে, যৈছে ভ্রমর বুলে,
ঐছন ফিরয়ে দুন আঁখি।।
রচিয়া সিন্দূরের বিন্দু, কে নিল অমিয়া সিন্ধু,
নাসার ছলে নাকের মুকুতা।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, এ কথা অন্যথা নয়,
ভালে জানে বৃষভানু সুতা।।
————–
যাপিলা – কাটাইলা। বহিলা – (হিন্দি) উৎকৃষ্ট। সাখী – সাক্ষী।
খণ্ডিতা ।। রামকেলী ।।
এস এস বন্ধু, করুণার সিন্ধু,
রজনী গোঙালে ভালে।
রসিকা রমণী, পেয়ে গুণমণি,
ভালত সুখেতে ছিলে?
নয়নে কাজর, কপালে সিন্দুর,
ক্ষত বিক্ষত হে হিয়া।
আঁখি ঢর ঢর, পরি নীলাম্বর,
হরি এলে হর সাজিয়া।।
ধিক্ ধিক্ নারী, পর আশাধারী,
কি বলিব বিধি তোয়।
এমত কপট, ধৃষ্ট, লম্পট, শট,
হাতেতে সোঁপিলি মোয়।।
কাঁদিয়া যামিনী, পোহালাম আমি,
তুমিত সুখেতে ছিলে?
রতি চিহ্ন সব, লইয়া মাধব,
প্রভাতে দেখাতে এলে?
এই মিনতি রাখ, ঐ খানেতে থাক,
আঙ্গিণাতে না আইস।
ছুঁইলে তোমারে, ধরমে আমারে,
না করিবে পরশ।।
লোক মুখ কত, শুনিতাম যত,
প্রতীত আজি হ’ল সব।
চণ্ডীদাস কয়, নাগর দয়াময়,
এত দয়ার স্বভাব।।
————–
খণ্ডিতা ।। ললিত ।।
আরে মোর আরে মোর সোণার বঁধুর।
অধরে কাজর দিল কপালে সিন্দূর।।
বদনকমলে কিবা তাম্বিল শোভিত।
পায়ের নখর ঘায় হিয়া বিদারিত।।
না এস না এস বঁধু আঙ্গিণার কাছে।
তোমারে দেখিলে (১) মোর ধরম যাবে পাশে।।
শুনিয়া পরের মুখে নহে পরতীত।
এবে সে দেখিনু তোমার এই সব রীত।।
সাধিলা মনের সাধ যে ছিল তোমারি।(২)
দূরে রহু দূরে রহু (৩), প্রণাম হামারি।।(৪)
চণ্ডীদাস কহে ইহা বলিলা কেমনে?
চোর ধরিলেও এত না কহে বচনে।।
————–
(১) পাঠান্তর–“ছুঁইলে”।-প্রা, কা, সং।
(২) বিভিন্ন পাঠ–“সাধিলা মনের সাধ কি আর বিচার।”-প, ক, ত।
(৩) পাঠান্তর–“দূরে দূরে রহু বঁধু”।-প্রা, কা, সং।
(৪) বিভিন্ন পাঠ–“প্রণতি আমার”।-প, ক, ত।
খণ্ডিতা ।। ললিত ।।
আহা আহা বঁধু তোমার শুকায়েছে মুখ।
সে সাজাল হেন সাজে হেরে বাসি দুখ।।
কপালে কঙ্কন দাগ আহা মরি মরি!
কে করিল হেন কাজ কেমন গোঁয়ারী?
দারুণ নখের ঘা হিয়াতে বিরাজে।
রক্তোৎপল ভাসে যেন নীল সরঃ মাঝে।।
কেমন পাষাণী যার দেখি হেন রীতি।
কে কোথা শিখাল তারে এ হেন পিরীতি।।
ছল ছল আঁখি দেখি মনে ব্যথা পাই।
লাচজে ব’স আঁচলেতে মুখানি মুছাই।।
বড় কষ্ট পাইয়াছ রজনী জাগিয়া।
চণ্ডীদাস কহে শোও হিয়ায় আসিয়া।।
————-
শুন শুন সুনয়নি আমার যে রীত।
কহিতে প্রতীত নহে জগতে বিদিত।।
তুমি না মানিবে তাহা আমি ভাল জানি।
এতেক না কহ ধনি অসম্ভব বাণী।।
সঙ্গত হইলে ভাল শুনি পাই সুখ।
অসঙ্গত হইলে পাইব বড় দুখ।।(১)
মিছা কথায় কত পাপ জানহ আপনি।
জানিয়া না মানে যে সেইত পাপিনী।।
পরে পরিবাদ দিলে ধরমে সহে কেনে?
তাহার এমত বাদ হইবে তখনে।।
চণ্ডীদাস বলে যেবা মিছা কথা কবে।
সেই সে ঠেকিবে পাপে তোমার কি যাবে।।
————–
(১) পাঠান্তর–“অসঙ্গত কৈলে কি লাভ শুনিতে না হয় সুখ”।-প্রা, কা, সং।
খণ্ডিতা ।। রামকেলী ।। (শ্রীরাধিকার প্রত্যুত্তর)
ভাল ভাল, কালিয়া নাগর,
শুনালে ধরম কথা?
পরের রমণী মজালে যখন,
ধরম আছিল কোথা?
চোরার মুখেতে, ধরম কাহিনী,
শুনিয়া পায় যে হাসি।
পাপ পূণ্য জ্ঞান, তোমার যতেক,
জানয়ে বরজবাসী।।
চলিবার তরে, দেও উপদেশ,
পাতর চাপিয়া পিঠে।
বুকেতে মারিয়া চাবুক ঘা,
তাহাতে লুণের ছিটে।।
আর না দেখিব, ওকাল মুখ,
এখানে রহিলে কেনে।
যাও চলি যথা, মনের মানুষ,
যেখানে মন যে টানে।।
কেন দাঁড়াইয়া, পাপিনীর কাছে,
পাপেতে ডুবিবা পাছে!
কহে চণ্ডীদাস, যাও চলি যথা,
ধরমের থলী আছে।।
—————
খণ্ডিতা ।। ধানশী ।। (পুনঃ শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
না কর না কর ধনি এত অপমান।
তরুণী হইয়া কেনে একে দেখ আন?
বংশী পরশি আমি শপথ করিয়ে।
তোমা বিনু দিবা নিশি কিছু না জানিয়ে।।
ফাগু বিন্দু দেখি সিন্দূর বিন্দু কহ।
কণ্টকে কঙ্কন দাগ মিছাই ভাবহ।।
এত কহি বিনোদ নাগর চলি যায় ঘর।
চণ্ডীদাস কহে রাই কাঁপে থর থর।।
—————
ফাগু – আবীর।
খণ্ডিতা ।। ধানশী ।।
ললিতা কহয়ে শুনহে হরি।
দেখে শুনে আর রহিতে নারি।।
শুন শুন ওহে রসিক রাজ।
এই কি তোমার উচিত কাজ।।
উচিত কহিতে কাহার ডর।
কিবা সে আপন কিবা সে পর।।
শিশু কাল হ’তে স্বভাব চুরি।
সে কি পারে রহিতে ধৈর্য্য ধরি।।
এক ঘরে যদি না পোশে তায়।
ঘরে ঘরে ফিরে পায় কি না পায়।।
সোণা লোহা তামা পিতল কি বাছে।
চোরের কি কখন নিবৃত্তি আছে।।
এ রস দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।
চোরের কখন মন শুদ্ধ নয়। *
——————-
* পদার্ণব সারাবলী।
খণ্ডিতা ।। ধানশী ।।
কনক — বরণ করিয়া মনে।
ভ্রমই মাধব গহন বনে।।
হিমকর হেরি মূরছি পড়ি।
ধূলায় ধূসর যাওত গড়ি।।
অপরাধী আমি কোথায় যাব?
রাই সুধামুখী কেমনে পাব?
এতেক কহিতে মিললি রাই।
চণ্ডীদাস তব জীবন পায়।। *
——————-
কনক-বরণ – রাধিকা।
হিমকর হেরি মূরছি পড়ি – চন্দ্রকে দেখিয়া শ্রীরাধার মুখচন্দ্র মনে উদয় হইয়া শ্রীকৃষ্ণ মূচ্ছিত হইলেন।
* লীলাসমুদ্র।