নায়িকার পূর্বরাগ
* শ্রীরাধা কৃষ্ণের লীলা বর্ণ উদ্দেশ্যে শ্রীরাধাকে নায়িকা এবং শ্রীকৃষ্ণকে নায়ক সম্বোধন করা হইয়াছে।
।।কামোদ।।
সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম |
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ||
না জানি কতেক মধু শ্যাম-নামে আছে গো
বসন ছাড়িতে নাহি পারে |
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে ||
নাম-পরতাপে যার ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কি বা হয় |
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিল গো
যুবতী-ধরম কৈছে রয় ||
পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায় |
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায় ||
———————
দেখিয়া বা গুণ শ্রবণ করিয়া সঙ্গমের (মিলনের) পূর্বে হৃদয়ে যে রাগ লোভ হয় তাহাকেই পূর্বরাগ বলা হইয়াছে।
“সঙ্গমের পূর্ব্বে যেই দেখিয়া শুনিয়া। জনমে রাগ লোভ হৃদয়ে পশিয়া।।
সেই পূর্ব্বরাগ …………………………. । ……………………………….।। ”
–ভক্তমাল
পশিল – প্রবেশ করিল। কতেক – কত। পরতাপে – প্রতাপে। ঐছন – এই রূপ। কৈছে – কি প্রকারে। পাসরিতে করি মনে – ভুলিব মনে করি। যাচায় – যাচিয়া দান করে।
।। তিরোতা (চিত্রপট দর্শন)।।
হাম সে অবলা, হৃদয় অখলা
ভাল মন্দ নাহি জানি।
বিরলে বসিয়া, পটেতে লিখিয়া
বিশাখা দেখাল আনি।।
হরি হরি! এমন কেন বা হলো!
বিষম বাড়বা অনল মাঝারে,
আমারে ডাবিয়া দিল।
বয়সে কিশোর, রূপ মনোহর,
অতি সুমধুর রূপ।
নয়ন যুগল, করয়ে শীতল,
বড়ই রসের কূপ।।
নিজ পরিজন, সে নহে আপন,
বচনে বিশ্বাস করি।
চাহিতে তা পানে, পশিল পরাণে,
বুক বিদরিয়া মরি।।
চাহি ছাড়াইতে, ছাড়া নহে চিতে,
এখন করিব কি?
কহে চণ্ডীদাসে, শ্যাম নব রসে,
ঠেকিলা রাজার ঝি।।
——————-
হাম – আমি। অখলা – সরলা। বিশাখা – শ্রীরাধিকার অষ্টসখীর মধ্যে দ্বিতীয় সখী।
“দ্বিতীয় বিশাখা ললিতার সম গুণে। প্রিয়সখী সম রয় জন্ম এক গ্রামে।।
……………………। ………………………।।
দূত কর্ম্মে পণ্ডিতা সন্ধিতে বুদ্ধিমান। চতুষ্টয় জ্ঞাতা ভেদ দণ্ড সামদান।।
পত্রাবলী রচনায়-বাদ্য-নৃত্য-গীতে। ……………………… ।।
বেণী বেশ রচনায় সূচী কর্ম্ম আদি। সূর্য্য-পূজা সামগ্রীর আবিষ্কারে সুধী।।
শ্রীরাধিকার মনোবৃত্তি কহিতে আনন্দ। গলাগলি দোঁহে কৃষ্ণ কথায় প্রবন্ধ।।
……………………। ………………………।।”
—ভক্তমাল
ডাবিয়া – নিক্ষেপ করিয়া। বিদরিয়া – ফাটিয়া। রাজার ঝি – বৃষভানু রাজার কন্যা—শ্রীরাধিকা।
নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ । (সাক্ষাদ্দর্শন)।।
জলদবরন কানু, দলিত অঞ্জন জনু,
উদয় হয়েছে সুধাময়।
নয়ন চকোর মোর, পিতে করে উতরোল,
নিমিখে নিমিখ নাহি সয়।।
সখি দেখিনু শ্যামের রূপ যাইতে জলে।
ভালে সে নাগরী, হয়েছে পাগলী,
সকল লোকেতে বলে।।
কিবা সে চাহনি, ভুবন ভুলনী,
দোলনি গলে বনমাল।
মধুর লোভে, ভ্রমরা বুলে,
বেড়িয়া তহি রসাল।।
দুইটি মোহন, নয়নের বাণ,
দেখিতে পরাণে হানে।
পশিয়া মরমে, ঘুচায়া ধরমে,
পরাণ সহিত টানে।।
চণ্ডীদাস কয়, ভুবনে না হয়,
এমন রূপ যে আর।
যে জন দেখিল, সে জন ভুলিল,
কি তার কুল বিচার?
——————-
জনু – যেন। পিতে – পান করিতে। উতরোল – উৎকণ্ঠিত হয়। নিমিখ – নিমিষ। ভালে সে – ভাগ্যে সে। তহি – তাহাকে।
নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।
বরণ দেখনু শ্যাম, জিনিয়াত কোটি কাম,
বদন জিতল কোটি শশী।
ভাঙ ধনুভঙ্গী ঠাম, নয়ান কোণে পূরে বাণ,
হাসিয়ে খসয়ে সুধা রাশি।।
সই এমন সুন্দর বর কান।
হেরিয়া সেই মূরতি, সতী ছাড়ে নিজ পতি,
তেয়াগিয়া লাজ ভয় মান।।
এ বড় কারিকরে, কুঁদিলে তাহারে,
প্রতি অঙ্গে মদনের শরে।
যুবতী ধরম, ধৈর্য্য-ভুজঙ্গম,
দমন করিবার তরে।।
অতি সুভোশিত, বক্ষ বিস্তারিত,
দেখিনু দর্পণাকার।
তাহার উপরে, মালা বিজারিত,
কি দিব উপমা তার।।
নাভির উপরে, লোম লতাবলী,
সাপিনী আকার শোভা।
ভূরুর বলনী, কামধনু জিনি,
ইন্দ্র ধনুকের আভা।।
চরণ নখরে, বিধু বিরাজিত,
মণির মঞ্জীর তায়।
চণ্ডীদাস হিয়া, সে রূপ দেখিয়া,
চঞ্চল হইয়া ধায়।।
——————-
ভাঙ – ভ্রু। বিধু – চন্দ্র। মঞ্জীর – নূপুর।
নায়িকার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।
শ্যামের বদনের ছটার কিবা ছবি।
কোটি মদন জনু, জিনিয়া শ্যামের তনু,
উদইছে যেন শশী রবি।।
সই, কিবা সে শ্যামের রূপ,
নয়ান জুড়ায় চেঞা।
হেন মনে লয়, যদি লোক ভয় নয়,
কোলে করি যেয়ে ধেঞা।।
তরুন মুরলী, করিল পাগলী,
রহিতে নারিনু ঘরে।
সবারে বলিয়া, বিদায় লইলাম,
কি করিবে দোসর পরে।।
ধরম করম, দূরে তেয়াগিনু,
মনেতে লাগিল সে।
চণ্ডীদাস ভণে, আপনার মনে,
বুঝিয়া করিবে যে।।
——————-
উদইছে – উদয় হইয়াছে। চেঞা – চাহিয়া। ধেঞা – ধাইয়া।
নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।
সুধা ছানিয়া কেবা ও সুধা ঢেলেছে রে
তেমতি শ্যামের চিকণ দেহা |
অঞ্জন রঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন বসাইল রে
চাঁদ নিঙ্গাড়ি কৈল থেহা ||
থেহা নিঙ্গাড়িয়া কেবা মুখানি বনাইল রে
জবা নিঙ্গাড়িয়া কৈল গণ্ড |
বিম্বফল জিনি কেবা ওষ্ঠ গড়িল রে
ভুজ জিনিয়া করি-শুণ্ড ||
কম্বু জিনিয়া কেবা কণ্ঠ বনাইল রে
কোকিল জিনিয়া সুস্বর |
আরদ্র মাখিয়া কেবা সারদ্র বনাইল রে
ঐছন দেখি পীতম্বর ||
বিস্তারি পাষাণে কেবা রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা |
কানড়-কুসুমে কেবা সুষমা করিল রে
এমতি তনুর দেখি আভা ||
আদলি উপরে কেবা কদলী রোপল রে
ঐছন দেখি ঊরুযুগ |
অঙ্গুলি উপরে কেবা দর্পণ বসাইল রে
চণ্ডীদাস দেখে যুগ যুগ ||
———————-
দেহা – দেহ। থেহা – স্থৈর্য্য। গণ্ড – গাল। বিম্ব ফল – তেলাকুচাফল। শুণ্ড – হাতীর শুঁড়। কম্বু – শঙ্খ। আরদ্র – হরিদ্রা। সারদ্র – সহিত আরদ্র – পীতবর্ণ। সুষমা – পরম শোভা। আদলি – (আদলা) ঘৃতকুমারী।
নায়িকার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।
সজনি, কি হেরিনু যমুনার কূলে!
ব্রজ-কুল-নন্দন, হরিল আমার মন,
ত্রিভঙ্গ দাঁড়াঞা তরু-মূলে।
গোকূল নগর মাঝে, আর কত নারী আছে।
তাহে কেন না পড়িল বাধা।
নিরমল কুলখানি, যতনে রেখেছি আমি,
বাঁশী কেন বলে “রাধা রাধা”?
মল্লিকা চম্পক দামে, চূড়ার চালনী বামে,
তাহে শোভে ময়ুরের পাখে।
আশে পাশে ধেয়ে ধেয়ে, সুন্দর সৌরভ পেয়ে,
অলি উড়ি পড়ে লাখে লাখে।।
সে কিরে চূড়ার ঠাম, কেবল যেমন কাম,
নানা ছাঁদে বাঁধে পাকমোড়া।
শির বেড়ল বৈলান জালে, নব গুঞ্জামণি মালে,
চঞ্চল চাঁদ উপরে জোড়া।।
পায়ের উপর থুয়ে পা, কদম্বে হেলায়ে গা,
গলে শোভে মালতীর মালা।
বড়ু চণ্ডীদাস কয়, না হইল পরিচয়,
রসের নাগর বড় কালা।।
——————-
দাঁড়াঞা – দাঁড়াইয়া। বৈলান জাল – চূড়াবন্ধনবেণী। বড়ু – ব্রাহ্মণ-তনয়।
নায়িকার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।। (সখীর উক্তি)
ঘরের বাহির, দণ্ডে শতবার,
তিলে তিলে আসে যায়।
মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন,
কদম্ব কাননে চায়।।
রাই এমন কেনে বা হলো?
গুরু দুরজন, ভয় নাহি মন,
কোথা বা কি দেব পাইল।।
সদাই চঞ্চল, বসন অঞ্চল,
সম্বরণ নাহি করে।
বসে থাকি থাকি, উঠয়ে চমকি,
ভূষণ খসিয়ে পরে।।
বয়সে কিশোরী, রাজার কুমারী,
তাহে কুলবধূ বালা।
কিবা অভিলাষে, বাড়ায় লালসে,
না বুঝি তাহার ছলা।।
তাহার চরিতে, হেন বুঝি চিতে,
হাত বাড়াইল চাঁদে।
চণ্ডীদাস ভণে, করি অনুমানে,
ঠেকেছে কালিয়া ফাঁদে।।
——————-
কোথা বা কি দেব পাইল – কোথা বা ভূতে পাইল। খসিয়ে -খুলিয়া।
রাধার পূর্বরাগ ।। সিন্ধুড়া।।
রাধার কি হৈল অন্তরের ব্যাথা |
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা ||
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে
না চলে নয়ান-তারা |
বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে
যেমত যোগিনী-পারা ||
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি
দেখায়ে খসায়ে চুলি |
হসিত বয়ানে চাহে মেঘ-পানে
কি কহে দুহাত তুলি ||
একদিঠ করি ময়ূর-ময়ূরী
কণ্ঠ করে নিরিক্ষণে |
চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয়
কালিয়া-বঁধুর সনে ||
———————
একলে – একলা, একাকিনী। ধেয়ানে – ধ্যানে। “বিরতি আহারে”–পদকল্পলতিকা। পারা – মত; ন্যায়। “ফুলয়ে গাঁথনি” পাঠও আছে। চুলি – চুল।হসিত বয়ানে – হাসি মুখে। একদিঠ – এক দৃষ্টি।
রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।
কালিয়া বরণ, হিরণ-পিঁধন
যখন পড়য়ে মনে।
মুরছি পড়িয়া, কাঁদয়ে ধরিয়া,
সব সখী জনে জনে।।
কেহ কহে মাই, ওঝা দে ঝাড়াই,
রাইয়েরে পেয়েছে ভূতা।
কাঁপি কাঁপি উঠে, কহিনা না টুটে,
সে যে বৃষভানু-সুতা।।
রক্ষামন্ত্র পড়ে, নিজ চুলে ঝাড়ে,
কেহ বা কহয়ে ছলে।
নিশ্চয় কহি যে, আনি দেও এবে,
কালার গলার ফুলে।।
পাইলে সে ফুল, চেতন পাইয়া,
তবে উঠবেক বালা।
ভূত-প্রেত আদি, ঘুচিয়া যাইবে,
যাইবে অঙ্গের জ্বালা।।
কহে চণ্ডীদাসে, আন উপদেশে,
কুলের বৈরী যে কালা।
দেখাও যতনে, পাইবে চেতনে,
ঘুচিবে অঙ্গের জ্বালা।।
——————-
হিরণ-পিঁধন -হিরণ্য পরিধান অর্থাৎ পীতাম্বর। দে – দিয়া। ভূতা – ভূত।
“পাইলে সে ফুল…যাইবে অঙ্গের জ্বালা”–এইটুকু একখানি হস্ত লিখিত গ্রন্থ হইতে গৃহীত। প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহ।।
রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।
ওঝা আনি গিয়া পাছে আছে ভূতা।
কাঁপি কাঁপি উঠে এই বৃষভানু সুতা।। ধ্রু।।
কালিয় কোঙর হিরণ-পিঁধন যবে পড়ে মনে।
মূরছি পড়িয়া কান্দে ধরি ভূম খানে।।
রক্ষা রক্ষা মন্ত্র পড়ে ধরি ধনীর চুলে।
কেহ বোলে আনি দেহ কালার গলার ফুলে।।
চেতন পাইয়া তবে উঠবেক বালা।
ভূত প্রেত ঘুচিবেক যাইবেক জ্বালা।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয় যারে কহ ভূত।
শ্যাম চিকণিয়া সে নন্দের ঘরের পুত।।
——————-
কোঙর – কুমার। পুত – পুত্র।
রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।
সোণার নাতনী, এমন যে কেনি,
হইলা বাউরী পারা।
সদাই রোদন, বিরস বদন,
না বুঝি কেমন ধারা।।
যমুনা যাইতে, কদম্ব তলাতে,
দেখিলা যে কোন জনে।
যুবতী জনার, ধরম নাশক,
বসি থাকে সেই খানে।।
সে জন পড়ে তোর মনে।
সতীর কুলের কলঙ্ক রাখিলি,
চাহিয়া তাহার পানে।।
একে কুলনারী, কুল আছে বৈরী,
তাহে বড়ুয়ার বধূ।
কহে চণ্ডীদাসে, কুল-শীল নাশে,
কালিয়া প্রেমের মধু।।
——————-
কেনি – কেন। বাউরী – বায়ুগ্রস্থা।
রাধার পূর্বরাগ ।। কামোদ ।।
সোণার নাতিনি কেন, আইস যাও পুনঃ পুনঃ,
না বুঝি তোমার অভিপ্রায়।
সদাই কাঁদনা দেখি, অঝরু ঝরয়ে আঁখি,
জাতি কুল সকল পাছে যায়।।
যমুনার জলে যাও, কদম তলার পানে চাও,
না জানি দেখিলা কোন জনে।
শ্যামল বরণ হিরণ-পিঁধন, বসি সাথে যখন তখন,
সে জন পড়েছে বুঝি মনে।।
ঘরে আসি নাহি খাও, সদাই তাহারে চাও,
বুঝিলাঙ তোমার মনের কথা।
এখনি শুনিলে ঘরে, কি বোল বলিবে তোরে,
বাড়িয়া ভাঙ্গিবে তোর মাথা।।
একে তুমি কুল নারী, কুল আছে তোমার বৈরী,
আর তাহে বড়ুয়ার বধূ।
কহে বড়ু চণ্ডীদাসে, কুল শীল সব ভাসে,
লাগিল কালিয়া-প্রেম-মধু।।
——————-
অঝরু – নির্ঝর। বুঝিলাঙ – বুঝিলাম। বাড়িয়া – বাড়ি দিয়া।
রাধার পূর্বরাগ ।। সুহই ।।
না যাইও যমুনার জলে, তরুয়া কদম্বমূলে,
চিকণকালা করিয়াছে থানা।
নব জলধর রূপ, মুনির মন মোহে গো,
তেঞি জলে যেতে করি মানা।।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা ভাতি বহিয়া মদন জিতি,
চাঁদ জিতি মলয়জ ভালে।
ভুবন বিজয়ী মালা, মেঘে সৌদামিনী কলা,
শোভা করে শ্যামচাঁদের গলে।।
নয়ান কটাক্ষ চাঁদে, হিয়ার ভিতরে হানে,
আর তাহে মুরলীর তান।
শুনিয়া মুরলীর গান, ধৈরজ না ধরে প্রাণ,
নিরখিলে হারাবি পরাণ।।
কানড়া কুসুম জিনি, শ্যামচাঁদের বদন খানি,
হেরিবে নয়াণের কোণে যে।
দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণে, চাহিয়া গোবিন্দ পানে,
পরাণে বাঁচিবে সখি কে।।
——————-
থানা – স্থান (আড্ডা)। তেঞি – তাই। করি মানা – নিষেধ করি।
রাধার পূর্বরাগ ।। ধানশী ।।
যমুনা যাইয়া, শ্যামরে দেখিয়া
ঘরে আইল বিনোদিনী।
বিরলে বসিয়া, কান্দিয়া কান্দিয়া
ধেয়ায় শ্যামরূপ খানি।।
নিজ করোপর, রাখিয়া কলোপ
মহাযোগিনীর পারা।
ও দুটি নয়ানে, বহিছে সঘনে,
শ্রাবণ মেঘেরি ধারা।।
হেন কালে তথা, আইল ললিতা,
রাই দেখিবার তরে।
সে দশা দেখিয়া, ব্যথিত হইয়া,
তুলিয়া লইল কোরে।।
নিজ বাস দিয়া, মুছিয়া পুছয়ে,
মধুর মধুর বাণী।
আজু কেনে ধনি, হয়েছি এমনি,
কহ না কি গালি শুনি।।
আজনম সুখে, হাসি বিধুমুখে,
কভু না হেরিয়ে আন।
আজু কেন বল, কান্দিয়া ব্যাকুল,
কেমন করিছে প্রাণ।।
চাঁচর চিকুর, কিছু না সম্বর,
কেনে হইলে অগেয়ান।
চণ্ডীদাস কহে, বেজেছে হৃদয়ে,
শ্যামের পিরীতি বাণ।।
——————-
ধেয়ায় – ধ্যান করে। কপোল – গাল। ললিতা – শ্রীরাধার অষ্ট সখীর মধ্যে আদ্যা সখী।
“শ্রীললিতা আদ্যা অষ্টমধ্যে শ্রেষ্ঠা। সতের দিনের শ্রীমদ্রাধা হৈতে জ্যেষ্ঠা।।
অনুরাধা অন্য নাম বামা প্রখরা। গোরোচনা নিন্দি কান্তি শিখিপিচ্ছম্বরা।।
সর্ব্বকর্ম্মে নিপুনতা সর্ব্বার্থ সাধিকা। সকলের মান্য ধন্য প্রাধান্যা পাত্রিকা।।
……………………………………………………।।”
—ভক্তিমাল।
অগেয়ান— অজ্ঞান।
রাধার পূর্বরাগ ।। তুড়ি ।।
অঙ্গ পুলকিত, মরম সহিত,
অঝরে নয়ন ঝরে।
বুঝি অনুমানি, কালা রূপ খানি,
তোমারে করিয়া ভোরে।।
দেখি নানা দশা, অঙ্গ যে বিবশা,
নাহত এত বড় ভারে।
সে বর নাগর, গুণের সাগর,
কিবা না করিতে পারে।।
শুন শুন রাই, কহি তুয়া ঠাঁই,
ভাল না দেখি যে তোরে।
সতী কুলবতী, তুয়া যে খেয়াতি,
আছয় গোকুল পুরে।।
ইহাতে এখন, দেখি যে কেমন,
নাহি লাজ গুরুতরে।
কহে চণ্ডীদাসে, শ্যাম নব রসে,
বুঝিলে বুঝিতে নারে।।
——————-
খেয়াতি – খ্যাতি। আছয় – আছে।