ভাবসম্মিলন
ভাব সম্মিলন ।। বেলাবলী ।।
নন্দের নন্দন চতুর কান।
মিলিল আসিয়া হৃদয়ে জান।।
যাহার যেমত পিরীতি গাঢ়া।
তাহারে তেমতি করিলা বাঢ়া।।
মধুরা হৈতে এখনি হরি।
আইল বলিয়া শবদ করি।।
আপন ঘরে আপনি গেলা।
পিতা মাতা জনু পরাণ পাইলা।।
কোলেতে করিয়া নয়ান জলে।
সেচন করিয়া কাঁদিয়া বলে।।
আর দূর দেশে না যাবে তুমি।
বাহির আর না করিব আমি।।
এত বলি কত দেওল চুম্ব।
বারে বারে দেখে মুখারবিন্দ।।
ঐছন মিলল সকল সখা।
আর কত জন কে করু লেখা।।
খাওয়াইয়া পিয়াইয়া শোয়াল ঘরে।
ঘুমাক বলিয়া যতন করে।।
তখন বুঝিয়া সময় পুন।
আওল যমুনা তীরক বন।।
রাইয়ের নিকটে পাঠাইলা দূতী।
বড়ু চণ্ডীদাস কহয়ে সতি।।
————–
ভাব সম্মিলন – বিচ্ছেদান্তে মিলন।
কান – কানাই। গাঢ়া – গাঢ়। জনু – যেন।
বাহির আর না করিব আমি- পাঠান্তর–“মরিব তবে এবারে আমি”।-পদামৃত সমুদ্র।
চুম্ব – চুম্বন।
আর কত জন কে করু লেখা – আর কত জন কে তাহার সংখ্যা করে।
সতি – সত্য।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
কিয়ে শুভ দরশনে, উলসিত লোচনে,
দুহুঁ দোহুঁ হেরি মুখ ছাঁদে।
তৃষিত চাতক, নব জলধরে মিলল,
ভুখিল চকোর চান্দে।।
আধ নয়ানে, দুহুঁ রূপ নিহারই,
চাহনি আনহি ভাঁতি।
রসের আবেশে, দুহুঁ অঙ্গ হেলাহেলি,
বিছুরল প্রেম সাঙ্গাতি।।
শ্যাম সুখময় দেহ, গোরী পরশে সেহ,
মিলায়ল যেন কাঁচা ননী।
রাই তনু ধরিতে নারে, আলাইল আনন্দ ভরে,
শিরিশ কুসুম কমলিনী।।
অতসি কুসুম সম, সম শ্যাম সুনায়র,
নায়রী চম্পক গোর।
নব জলধরে জনু, চাঁদ আগোরল,
ঐছে রহল শ্যাম কোর।।
বিগলিত কেশ কুন্তল, শিখি চন্দ্রক,
বিগলিত নিতল নিচোল।
দুহুঁক প্রেম রসে, ভাসল নিধুবন
উছলল প্রেম হিলোল।।
চণ্ডীদাস কহে, দুহুঁ রূপ নিরখিতে,
বিছুরল ইহ পরকাল।
শ্যাম সুঘড় বর সুন্দর রস রাজ,
সুন্দরী মিলই রসাল।।*
————–
* হস্তলিখিত পুস্তক।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
শতেক বরষ পরে, বঁধুয়া মিলল ঘরে,
রাধিকার অন্তরে উল্লাস।
হারানিধি পাইনু বলি, লইয়া হৃদয়ে তুলি,
রাখিতে না সহে অবকাশ।।
মিলল দুহুঁ তনু কিবা অপরূপ!
চকোর পাইল চাঁদ, পাতিয়া পিরীতি ফাঁদ,
কমলিনী পাওল মধুপ।।
রস ভরে দুহুঁ তনু, থর থর কাঁপই,
ঝাঁপই দুহুঁ দোঁহা আবেশে ভোর।
দুহুঁক মিলনে আজি, নিভাওল আনল,
পাওল বিরহক ওর।।
রতন পালঙ্ক পর, বৈঠল দুহুঁ জন,
দুহুঁ মুখ হেরই দুহুঁ আনন্দে।
হরষ সলিল ভরে, হেরই না পারই,
অনিমিষে রহল ধন্দে।।
আজি মলয়ানীল, মৃদু মৃদু বহত,
নিরমল চাঁদ প্রকাশ।
ভাব ভরে গদগদ, চামর ঢূলায়ত,
পাশে রহি চণ্ডীদাস।।
————–
পাওল বিরহক ওর – বিরহ দূরে গেল।
বৈঠল – বসিল।
নিরমল চাঁদ প্রকাশ – এত দিন শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমন হেতু মলয়ানীল বহে নাই এবং নির্ম্মল চন্দ্র উদয় হয় নাই, আজ তাঁহার আগমনে যেন মলয়ানীল মৃদু মৃদু বহিতেছে এবং নির্ম্মল চন্দ্র উদয় হইয়াছে।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
ভালোল্লাসে ধনী, বঁধুরে পাইয়া,
ভাবে গদ গদ কয়।
ব্রজ পিরীতের, প্রদীপ জ্বালিয়ে,
দীপ কি নিভা’তে হয়।।
কালিয়া কুটিল স্বভাব তোমার,
কপট পিরীতি যত।
ভূরু নাচাইয়ে, মুচকি হাসিয়ে,
অবলা ভুলাইলে কত।।
পিরীতি রসের রসিক বোলাও,
পিরীতি বুঝিতে নার।
মথুরা নগরের, যত নাগরীর,
পিরীতের ধার ধার।।
শুন গিরি ধারী, মথুরা বিহারী,
নারী বধে নাহি ভয়।
পিরীতি করিয়ে, তোমারে ভজিলে,
শেষে কি এই দশা হয়।।
পিরীতি করিলে, কেন দগধিলে,
বিরহ বেদনা দিয়ে।
কালীয়া কঠিন, দয়া হীন জন,
তোর নিদারুণ হিয়ে।।
সোই রসিকতা, পিরীতি মমতা,
সমতা হইলে রাখে।
পিরীতি রতন, রসের গঠন,
কুটিলাতে নাহি থাকে।।
পিরীতির দায়, প্রাণ ছাড়া যায়,
পিরীতি ছাড়িতে নারে।
পিরীতি রসের পসরা তা নাকি,
রাখালে বহিতে পারে।।
যে জনা রসিক, রসে ঢর ঢর,
মরমি যে জন হয়।
হেরে রেরে করে, ধবলী চড়ায়,
সে জনা রসিক নয়।।
রসিকের রীতি, সহজ সরল
রাখালে তাই কি জানে।
চণ্ডীদাস কহে, রাধার গঞ্জনা (১),
সুধা সম কানু মানে।।*
————–
(১) পাঠান্তর–“রাধার ভর্তসনা।”
* হস্তলিখিত পুস্তক।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
শুন শুন হে রসিক রায়।
তোমারে ছাড়িয়া, যে সুখে আছিনু,
নিবেদি যে তুয়া পায়।।(১)
না জানি কি ক্ষণে, কুমতি হইল,
গৌরবে ভরিয়া গেনু।
তোমা হেন বঁধু হেলায় হারায়ে,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া মনু।।
জনম অবধি, মায়ের সোহাগে,
সোহাগিনী বড় আমি।
প্রিয় সখীগণ, দেখে প্রাণসম,
পরাণ বঁধুয়া তুমি।।
সখীগণে কহে, শ্যাম সোহাগিনী,
গরবে ভরয়ে দে।
হামারি গৌরব, তুহুঁ বাঢ়ায়লি,
অব্টুটায়ব কে!
তোহারি, গরবিনী হাম,
গরবে ভরল বুক।
চণ্ডীদাস কহে, এমতি নহিলে,
পিরীতি কিসের সুখ?(১)
————–
নিবেদি – নিবেদন। দে – দেহ। গৌরব – সম্মান।
হামারি গৌরব, তুহুঁ বাঢ়ায়লি, অব্টুটায়ব কে – আমার সম্মান তুমিই বাড়াইয়াছ, কে এখন তাহা লাঘব করিতে সক্ষম?
তোহারি – পাঠান্তর–“তোহারি গরবে”।-প, ক, ল।
(১) পাঠান্তর–“তোমা উপেখিয়া, যে সুখে গোঞাইনু”–পদার্ণব সারাবলী।
(২) পাঠান্তর–“চণ্ডীদাস কহে, মরিয়াছিলাম, না দেখি তোমার মুখ।।”-প, ক, ল।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
বঁধু কি আর বলিব আমি।
জনমে জনমে, জীবনে মরণে,
প্রাণ বন্ধু হইও তুমি।।
অনেক পূণ্যফলে, গৌরী আরাধিয়ে,
পেয়েছি কামনা করি।।
না জানি কি ক্ষণে, দেখা তব সনে,
তেঞি সে পরাণে মরি।।
বড় শুভ ক্ষণে, তোমা হেন ধনে,
বিধি মিলাওল আনি।
পরাণ হইতে, শত শত গুণে,
অধিক করিয়া মানি।।
গুরু গরবেতে, তাহা বলে কত,
সে সব গরল বাসি।
তোমার কারণে, গোকুল নগরে,
দুকুল হইল হাসি।।
চণ্ডীদাস বলে, শুনহ নাগর,
রাধার মিনতি রাখ।
পিরিতি রসের, চূড়ামণি হয়ে,
সদাই অন্তরে থাক।।
—————
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
শুনহে চিকণ কালা!
বলিব কি আর, চরণে তোমার,
অবলার যত জ্বালা।।
চরণ থাকিতে, না পারি চলিতে,
সদাই পরের বশ।
যদি কোন ছলে, তব কাছে এলে,
লোকে করে অপযশ।।
বদন থাকিতে, না পারি বলিতে,
তেঞি সে অবলা নাম।
নয়ন থাকিতে, সদা দরশন,
না পেলেন নবীন শ্যাম।।
অবলার যত দুঃখ, প্রাণনাথ!
সব থাকে, মনে মনে।
চণ্ডীদাস কয়, রসিক সে হয়,
সেই সে বেদনা জানে।।
————————–
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
বঁধু কি আর বলিব আমি!
যে মোর ভরম, ধরম করম,
সকলি জানহে তুমি।।
যে তোর করুণা, না জানি আপনা,
আনন্দে ভাসি যে নিতি।
তোমার আদরে, সবে স্নেহ করে,
বুঝিতে না পারি রীতি।।
মায়ের যেমন, বাপার তেমন,
তেমতি বরজপুরে।
সখীর আদরে, পরাণ বিদরে,
সে সব গোচর তোরে।।
সতী বা অসতী, তোহে মোর মতি,
তোহারি আনন্দে ভাসি।
তোমারি বচন, সালঙ্কার মোর,
ভূষণে ভূষণ বাসি (১)।।
চণ্ডীদাস বলে, শুনহ সকলে,
বিনয় বচন সার।
বিনয় করিয়া, বচন কহিলে,
তুলনা নাহিক তার।।
————–
(১) শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়ের প্রতিপাদিত অর্থ এইরূপ–তোমার সালঙ্কার বচনই আমার অঙ্গরাগ জন্য ভূষণ স্বরূপ; আমি অন্য অলঙ্কার চাহি না।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
শুন সুনাগর, করি জোড় কর,
এক নিবেদিয়ে বাণী।
এই কর মেনে, ভাঙ্গে নাহি জেনে,
নবীন পিরীতি খানি।।
কুল শীল জাতি, ছাড়ি নিজ পতি,
কালি দিয়ে দুই কুলে।
এ নব যৌবন, পরশ রতন,
সঁপেছি চরণ তলে।।
তিনহি আখর, করিয়ে আদর,
শিরেতে লয়েছি আমি।
অবলার আশ, না কর নৈরাশ,
সদাই পুরিবে তুমি।।
তুমি যশরাজ, রসের সমাজ,
কি আর বলিব আমি।
চণ্ডীদাস কহে, জনমে জনমে,
বিমুখ না হোয় তুমি।।
————–
পুরিবে পাঠান্তর–“পুরাইবে”।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
নিবেদন শুন শুন বিনোদ নাগর।
তোমারে ভজিয়া মোর কলঙ্ক অপার।।
পর্ব্বত সমান কুল শীল তেয়াগিয়া।
ঘরের বাহির হইলাম তোমার লাগিয়া।।
নব রে নব রে নব নব ঘনশ্যাম।
তোমার পিরীতি খানি অতি অনুপাম।।
কি দিব কি দিব বঁধু মনে করি আমি।
যে ধন তোমারে দিব সেই ধন তুমি।।
তুমি আমার প্রাণবঁধু আমি হে তোমার।
তোমার ধন তোমারে দিতে ক্ষতি কি আমার।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কহে শুন শ্যাম ধন।
কৃপা করি এ দাসীরে দেহ শ্রীচরণ।।*
————–
* পদার্ণব সারাবলী।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
বঁধু তুমি সে পরশ মণি হে
বঁধু তুমি সে পরশ মণি।
ও অঙ্গ পরশে, এ অঙ্গ আমার,
সোণার বরণ খানি।।
তুমি রস শিরোমণি হে
বঁধু তুমি রস শিরোমণি।
মোরা অবলা অখলা, আহিরিণী বালা,
তো’ সেবা নাহি জানি।।
তোঁহার লাগিয়া, ধাই বনে বনে,
আমি সুবল বেশ ধরি হে।
এক তিলে শত যুগ, দরশনে মানি,
ছেড়ে কি রইতে পারি হে।।
অঙ্গের বরণ, কস্তূরী চন্দন,
আমি হৃদয়ে মাখিয়ে রাখি।
ও দুটি চরণ, পরাণে ধরিয়া,
নয়ান মুদিয়া থাকি।।
চণ্ডীদাস কহে, শুন রসবতি,
তুহুঁ সে পিরীতি জান হে।
বঁধু সে তোমার, এক কলেরব,
দুহুঁ সে এক প্রাণ হে।।*
————–
* হস্তলিখিত পুস্তক।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।।
বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ!
দেহ মন আদি, তোহারে সঁপেছি,
কুল শীল জাতি মান।।
অলিলের নাথ, তুমি হে কালিয়া,
যোগীর আরাধ্য ধন।
গোপ গোয়ালিনী, হাম অতি হীনা,
না জানি ভজন পূজন।।
পিরীতি রসেতে, ঢালি মোর গতি,
মন নাহি আন ভায়।।
কলঙ্কী বলিয়া, ডাকে সব লোকে,
তাহাতে নাহিক দুখ।
তোমার লাগিয়া, কলঙ্কের হার
গলায় পরিতে সুখ।।
সতী বা অসতী, তোমাতে বিদিত,
ভাল মন্দ নাহি জানি।
কহে চণ্ডীদাস, পাপ পূন্য সম,
তোহারি চরণখানি।।
———————
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উত্তর)
রাই! তুমি সে আমার গতি।
তোমার কারণে, রসতত্ত্ব লাগি,
গোকূলে আমার স্থিতি।।
নিশি দিশি সদা, বসি আলাপনে,
মুরলী লইয়া করে।
যমুনা সিনানে, তোমার কারণে,
বসি থাকি তার তীরে।।
তোমার রূপের, মাধুরী দেখিতে,
কদম্বতলাতে থাকি।
শুনহ কিশোরি, চারি দিক হেরি,
যেমত চাতক পাখী।।
তবরূপ গুণ, মধুর মাধুরী,
সদাই ভাবনা মোর।
করি অনুমান, সদা করি গান,
তবে প্রেমে হৈয়া ভোর।।
চণ্ডীদাস কয়, ঐছন পিরীতি,
জগতে আর কি হয়?
এমত পিরীতি, না দেখি কখন,
কখন হবার নয়।।
———————–
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীরাধিকার উক্তি)
অনেক সাধের, পরাণ বঁধুয়া,
নয়ানে লুকায়ে থোব।
প্রেম চিন্তামণির, শোভা গাঁথিয়া,
হিয়ার মাঝারে লব।।
তুমি হেন ধন, দিয়াছি যৌবন,
কিনেছি বিশাখা জানে।
কিবা ধনে আর, আধিকার কার,
এ বড় গৌরব মনে।।
বাড়িতে বাড়িতে, ফল না বাড়িতে,
গগণে চড়ালে মোরে।
গগণে হইতে, ভূমে না ফেলাও,
এই নিবেদন তোরে।।
এই নিবেদন, গলায় বসন,
দিয়া কহি শ্যাম পায়।
চণ্ডীদাস কয়, জীবনে মরণে,
না ঠেলিবে রাঙ্গা পায়।।
——————
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীরাধিকার উক্তি)
বঁধু হে নয়নে লুকায়ে থোব।
প্রেম চিন্তামণি, রসেতে গাঁথিয়া,
হৃদয়ে তুলিয়া লব।
শিশু কাল হৈতে, আন নাহি চিতে,
ও পদ করেছি সার।
ধন জন মন, জীবন যৌবন,
তুমি সে গলার হার।।
শয়নে স্বপনে, নিদ্রা জাগরণে,
কভু না পাসরি তোমা।
অবলার ত্রুটি, হয় শত কোটি,
সকলি করিবে ক্ষমা।।
না ঠেলিও বলে, অবলা অখলে,
যে হয় উচিত তোর।
ভাবিয়া দেখিলাম, তোমা বঁধু বিনে,
আর কেহ নাহি মোর।।
তুলে আঁখি আড়, করিতে না পারি,
তবে যে মরি আমি।
চণ্ডীদাস ভণে, অনুগত জনে,
দয়া না ছাড়িও তুমি।।
——————–
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
আর এক বাণী, শুন বিনোদিনি,
দয়া না ছাড়িও মোরে।
ভজন সাধন, কিছুই না জানি,
সদাই ভাবিহে তোরে।।
ভজন সাধন, করে যেই জন,
তাহারে সদয় বিধি।
আমার ভজন, তোমার চরণ,
তুমি রসময়ী নিধি।।
ধাওত পিরীতি, মদন বেয়াধি,
তনু মন হলো ভোর।
সকল ছাড়িয়া, তোমারে ভজিয়া,
এই দশা হৈল মোর।।
নব সন্নিপাতি, দারুণ বেয়াধি,
পরাণে মরিলাম আমি।
রসের সায়রে, ডুবায়ে আমারে,
অমর করহ তুমি।।
যেবা কিছু আমি, সব জান তুমি,
তোমার আদেশ সার।
তোমারে ভজিয়া, নায়ে কড়ি দিয়া,
ডুবে কি হইব পার।।
বিপদ পাথার, না জানি সাঁতার,
সম্পত্তি নাহিক মোর।
বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে,
যে হয় উচিত তোর।।
—————-
ভাব সম্মিলন ।। ভূপালী ।। (শ্রী্রাধিকার উক্তি)
বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।
এতেক সহিল অবলা বলে।
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হলে।।
দুখিনীর দিন দুঃখেতে গেল।
মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল?
এ সব দুঃখ গেল হে দূরে।
হারাণ রতন পাইলাম কোরে।।
এখন কোকিল আসিয়া করুক গান।
ভ্রমরা ধরুক তাহার তান।।
মলয় পবন বহুক মন্দ।
গগণে উদয় হউক চন্দ।।
বাশুলী আদেশে কহে চণ্ডীদাসে।
দুঃখ দূরে গ্লে সুখ বিলাসে।।
—————
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
জপিতে তোমার নাম, বংশীধারি অনুপম,
তোমার বরনের পরি বাস।
তুয়া প্রেম সাধি গোরি, অইনু গোকুলপুরী,
বরজ মণ্ডলে পরকাশ।।
ধনি তোমার মহিমা জানে কে!
অবিরাম যুগ শত, গুণ গাই অবিরত,
গাহিয়া করিতে নারি শেষ।।
গঞ্জন বচন তোর, শুনি সুখে নাহি ওর,
সুধাময় লাগয়ে মরমে।
তরল কমল আঁখি, তেরছ নয়নে দেখি,
বিকাইনু জনমে জনমে।।
তোমা বিনু যেবা যত, পিরীতি করিনু কত,
সে পিরীতে না পুরিল আশ।
তোমার পিরীতি বিনু, স্বতন্ত্র না হইল তনু,
অনুভবে কহে চণ্ডীদাস।।
————–
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীরাধিকার উক্তি)
শ্যাম সুন্দর, স্মরণ আমার,
শ্যাম শ্যাম সদা সার।
শ্যাম সে জীবন, শ্যাম প্রাণধন,
শ্যাম সে গলার হার।।
শ্যাম সে বেশর, শ্যাম বেশ মোর,
শ্যাম শাড়ী পরি সদা।
শ্যাম তনু মন, ভজন পূজন,
শ্যাম দাসী হলো রাধা।।
শ্যাম ধন বল, শ্যাম জাতি কুল,
শ্যাম সে সুখের নিধি।
শ্যাম হেন ধন, অমূল্য রতন,
ভাগ্যে মিলাইল বিধি।।
কোকিল ভ্রমর, করে পঞ্চস্বর,
বঁধুয়া পেয়েছি কোলে।
হিয়ার মাঝারে, রাখিছ শ্যামেরে,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে।।
————–
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
উঠিতে কিশোরী, বসিতে কিশোরী,
কিশোরী হইল সারা।
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন,
কিশোরী নয়ানতারা।।
গৃহ মাঝে রাধা, কাননেতে রাধা,
রাধাময় সব দেখি।
শয়নেতে রাধা, গমনেতে রাধা,
রাধাময় হলো আঁখি।।
স্নেহেতে রাধিকা, প্রেমেতে রাধিকা,
রাধিকা আরতি পাশে।
রাধারে ভজিয়া, রাধাবল্লভ নাম,
পেয়েছি অনেক আশে।।
শ্যামের বচন, মাধুরি শুনিয়া,
প্রেমানন্দে ভাসে রাধা।
চণ্ডীদাস কহে, দোঁহার পিরীতি,
পরাণে পরাণ বাঁধা।।
————–
সারা – সার।
ভাব সম্মিলন ।। সুহই ।। (শ্রীকৃষ্ণের উক্তি)
উঠিতে কিশোরী, বসিতে কিশোরী,
কিশোরী গলার হার।
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন,
কিশোরী চরণ সার।।
শয়নে স্বপনে, গমনে কিশোরী,
ভোজনে কিশোরী আগে।
করে করে বাঁশী, ফিরে দিবানিশি,
কিশোরীর অনুরাগে।।
কিশোরী চরণে, পরাণ সঁপেছি,
ভাবেতে হৃদয় ভরা।
দেখহে কিশোরী, অনুগত জনে,
করোনা চরণ ছাড়া।।
কিশোরী দাস, আমি পীতবাস,
ইহাতে সন্দেহ যার।
কোটি যুগ যদি, আমারে ভজয়ে,
বিফল ভজন তার।।
কহিতে কহিতে, রসিক নাগর,
তিতল নয়ন জলে।
চণ্ডীদাস কহে, নবীন কিশোরী,
বঁধুরে করিল কোলে।।*
————–
* হস্তলিখিত পুস্তক।
ভাব সম্মিলন ।। কন্যাণী
উঠিতে কিশোরী, বসিতে কিশোরী,
কিশোরী নয়ান তারা।
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন,
কিশোরী গলার হারা।।
রাধে! ভিন না ভাবিহ তুমি।
সব তেয়াগিয়া, ও রাঙ্গা চরণে,
শরণ লইনু আমি।।
শয়নে স্বপনে, ঘুমে জাগরণে,
কভু না পাসরি তোমা।
তুয়া পদাশ্রিত, করিয়ে মিনতি,
সকলি করিবা ক্ষমা।।
গলায় বসন, আর নিবেদন,
বলি যে তুঁহারি ঠাঁই।
চণ্ডীদাসে ভণে, ও রাঙ্গা চরণে,
দয়া না ছাড়িও রাই।।