০৯. শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। বরাড়ী ।।

বাদিয়ার বেশ ধরি,                      বেড়ায় সে বাড়ী বাড়ী,
আইলেন ভানুর মহলে।
খুলি হাঁড়ি ঢাকনি,                      বাহির করয়ে ফণী,
তুলিয়া লইল এক গলে।।
বিষহরি বলি দেয় কর।
শুনিয়া যতেক বালা,                      দেখিতে আইল খেলা,
খেলাইছে মাল পুরন্দর।।
সাপিনীরে দেয় থোব,                      সাপিনী বাঢ়য়ে কোব,
দন্ত করি উঠি ধরে ফণা।
অঙ্গুলী মুড়িয়া যায়,                      সাপিনী ফিরিয়া চায়,
ছুঁয়ে যায় বাদিয়ার দাপনা।।
খেলা দেখি গোপীগণ,                      বড় আনন্দিত মন,
কহে “তুমি থাক কোন্‌ স্থানে”?
“থাকি বনের ভিতরে,                      নাগদমন বলে মোরে,
নাম মোর জানে সব জনে।।
বসন মাগিবার তরে,                      আইনু তোমার ঘরে,
বস্ত্র দেহ আনিয়া আপনি।
ছেঁড়া বস্ত্র নাহি লব,                      ভাল একখানি পাব,
দেখি দেও শ্রীঅঙ্গের খানি।”
“বটের ভিখারী হও,                      বহু মূল্য নিতে চাও,
নহিলে শোভিত চায় বটে।
বনে থাক সাপ ধর,                      তেনা পরিধান কর,
সদাই বেড়াও নদীতটে।”
বেদে কহে ধীরে ধীরে,                      “তোমার বস্ত্র নিব শিরে,
মনে মোর হবে বড় সুখ।
তোমার সঙ্গ করিতে,                      অভিলাষ হয় চিতে,
তুমি যদি না বাসহ দুখ।।”
“চুপ করে থাক বেদে,                      যা পাও তা নেও সেধে,
ভরমে ভরমে যাও ঘরে।”
“চুরি চারি নাহি করি,                      ভিক্ষা করি পেট ভরি,
আমি ভয় করিব কাহারে?
তোমা লঞা করি ক্রীড়া,                      তুমি কেন মান পীড়া।
সুখী কর এ দুখিয়া জনে।”
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়,                      বাদিয়া যে এই নয়,
বুঝিয়া দেখহ আপন মনে।।

————–

ভানুর মহলে – বৃষভানু রাজার বাড়ীতে। পুরন্দর – বিষ্ণু। থাবা। থোব – কোপ, রাগ। নাগদমন – কালীয় দমন–সাপুড়ে। বটের – কড়ি। তেনা – ছেঁড়া বস্ত্র। ভরমে ভরমে – (এখানে) মানে মানে।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। বালা ধানশী ।।

 গোকুল নগরে,                 ইন্দ্র পূজা করে,
দেখি আইল যত নারী।
নগর ভিতর,                 মহা কলরব,
নাগর হইল পসারী।।
দোকান দাকান,                 মেলিল তখন,
দেখিয়া গাহকীগণ।
কহয়ে পসারী,                 “বহু দ্রব্য আছে,
যে নিতে চাহে যে ধন।।
মুকুতা প্রবাল,                 মণিময় হার,
পোতিক মাণিক যত।
বহু দিন মেনে,                আনিনু যতনে,
তোমাদের অভিমত।।”
খন্তিক পুতিয়া,                 মুকুতা ঝুলায়া,
কহয়ে গাহকী আগে।
শুনি গাহকিনী,                 আসিয়া আপনি,
দোকান নিকটে লাগে।।
সুমধুর বাণী,                 বলে সে দোকানী,
কিসের লইবে ছড়া।
মুকুতা মাল,                লইবে ভাল,
কড়ি যে লাগিবে বাড়া।।
শুনি নারীগণ,                 বলয়ে বচন,
“গাহকী নহি যে মোরা।”
“কিবা ভাগ্য মেনে,                 দেখিছি জনমে।
এমন ধন যে তোয়া।।”
যুবতী রসাল,                 নিল এক মাল,
দিল এক সখী গলে।
পরিমাণ হলো,                 আনন্দ বাড়িল,
“কতেক লইবে” বলে।।
আর এক জনে,                সাধ করি মনে,
লইল সোণার সূচ।
লই চলি যায়,                 বেতন না দেয়,
পসারী ধরিল কুচ।।
ফেরা ফেরি করে,                 কুচ নাহি ছাড়ে,
কহে “মূল্য দেহ মোর।”
সঘন বদন,                 করয়ে চুম্বন,
“এমতি কাজ যে তোর।”
কাড়াকাড়ি ঘন,                 না মানে বারণ,
অজারক হলো পারা।
যাহার যে ধন,                 কাটে সেই জন,
রক্ষক হইবে কারা!
রজকী সঙ্গতী,                 চণ্ডীদাস গতি,
রচিল আনন্দ বটে।
দোকান দাকান,                 হলো সমাধান,
সকল গেল যে লুটে।।

————–

পসারী – দোকানী। খন্তিক – খন্তা। পরিমাণ হলো – মাপে ঠিক হলো। বেতন – মূল্য। সমাধান – শেষ।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। তুড়ি ।।

কানুর পিরীতি,                 কুহকের রীতি,
সকলি মিছাই রঙ্গ।
দড়াদড়ি লৈঞা,                 গ্রামেতে চড়িয়া,
ফিরয়ে করিয়ে সঙ্গ।।
সই! কানু বড় জানে বাজি।
বাঁশ বংশীধারি,                 মদন সঙ্গে করি,
ঢোলক ঢালক সাজি।।
মদন ঘুরিয়া,                 বেড়ায় ফিরিয়া,
যুবতী বাহির করে।
দুইটী গুটিয়া,                ফেলাঞা লুফিয়া,
বুকের উপর ধরে।।
ধীরি ধীরি যায়,                 ভঙ্গী করি চায়,
রঙ্গ দেখে সব লোকে।
দড়ায়ে পায়ে,                 উঠয়ে তাহে,
থাকি থাকি দেহ ঝোঁকে।
মুকুতা প্রবাল,                উগরে সকল,
আর বহুমূল্য হীরা।
একবার আসি,                 উগরে রাশি,
নাচিয়া বেড়ায় ফিরা।
কতক্ষণ বই,                 বাঁশ হাতে লই,
যুবতী হিয়ার পাড়ে।
জঙ্ঘে জঙ্ঘ দিয়া,                 পায়েতে ছান্দিয়া,
বাঁশের উপর চড়ে।।
চড়িয়া উপরে,                 ঝুলিয়া পড়য়ে,
চুম্বই যুবতী মুখে।
মুখে মুখ দিয়া,                 পান গুয়া নিয়া,
ঘুরিয়া বেড়ায় সুখে।।
লোক নহে রাজি,                কেমন সে বাজি,
রমণী ভুলাবার তরে।
চণ্ডীদাস কয়,                 বাজি মিছে নয়,
রঙ্গ কে বুঝিতে পারে।

————–

কুহক – বাজিকর। লৈঞা – লইয়া। দড়ায়ে পায়ে – পায়ে দড়ি জড়াইয়া। উগরে – উদ্গীরণ করে। কতক্ষণ বই – কতক্ষণ পরে।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। কামোদ ।।

নামিল আসিয়া,                   বসিল হাসিয়া,
কহয়ে বেতন দেও।
বেতনের কালে,                   হাত দিয়া গালে,
যুবতী সকলে কয়।।
সই! বাজিকরে নিবে যে কি?
যত কিছু দেই,                   কিছুই না লয়,
(বলে) আমারে জিজ্ঞাস কি?
মনে এই কই,                   দেহ কুচ-গিরি,
আর তব মুখ-সুধা।
আর এক হয়,                   মোর মনে লয়,
তাহা মোরে দেহ জুদা।।
সুন্দরীগণে                   বুঝিল মনে,
ইহার গ্রাহক তুমি।
চিটের চিটানি                   খেতের মিঠানি,
সকলি জানি যে আমি।।
চণ্ডীদাস কয়,                   তবে কেন নয়,
জানিয়া চতুরপণা।
বুঝিলে না বুঝে,                   কহিলে না সুঝে,
তাহার বলি যে কালা।।

————–

জুদা – স্বতন্ত্র, পৃথক। চিটের চিটানি – চতুরের চাতুর্য্য। মিঠানি – মিষ্টরস।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

না ভাঙ্গিল মান দেখি চতুর নাগর।
বিশাখারে ডাকি কহে বচন উত্তর।।
শুনহ আমার কথা বিশাখা সুন্দরী।
আমারে সাজায়ে দেহ নবীন এক নারী।।
চূড়া ধড়া তেয়াগিয়া কাঁচলি পরিল।
নাপিতিনী বেশ ধরি নাগর দাঁড়াইল।।
জয় রাধে শ্রীরাধে বলি করিল গমন।
রাইয়ের মন্দিরে আসি দিল দরশন।।
“কি লাগিয়ে ধূলায় পড়ে বিনোদিনী রাই।
হের এস তুয়া পায়ে যাবক পরাই।।”
চরণ মুকুরে শ্যাম নিজ মুখ দেখে।
যাবকের ধারে ধারে নিজ নাম লেখে।।
সচকিত হয়ে ধনী অরণ পানে চায়।
আচম্বিতে শ্যাম অঙ্গের গন্ধ কেন পায়।।
ইঙ্গিতে কহিল তখন বিশাখা সুন্দরী।
নাপিতিনী নহে তোমার নাগর বংশীধারী।।
বাহু পসারিয়া নাগর রাই নিল কোলে।
“আর না করিব মান” চণ্ডীদাসে বলে।

————–

যাবক – আলতা।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

ধরি নাপিতিনী বেশ,                     মহলেতে পরবেশ,
যেখানেতে বসিয়াছে রাই।
হাতে দিয়া দরপণী,                      খোলে নখ-রঞ্জণী,
বোলে বৈস, দেই কামাই।।
বসিলা যে রসবতী নারী।
খুলিল কনক বাটী,                      আনিয়া জলের ঘটী,
ঢালিলেক সুবাসিত বারি।।
করে নখ-রঞ্জণী,                      চাঁছয়ে নখের কণি,
শোভিত করিল যেন চাঁদে।
আলসে অবশ-প্রায়,                      ঘুম লাগে আধ গায়,
হাত দিলা নাপিতিনী কাঁধে।।
নাপিতিনী একে শ্যামা,                      ননীর পুতলী, ঝামা
বুলাইছে মনের আনন্দে।
ঘসি ঘসি রাঙ্গা পায়,                      আলতা লাগায় তায়,
রচয়ে মনের হরষেতে।।
রচয়ে বিচিত্র করি,                      চরণ হৃদয়ে ধরি,
তলে লিখে আপনার নাম।
কত রস পরকাশি,                      হাসয়ে ঈষৎ হাসি,
নিরখি নিরখি অবিরাম।।
নাপিতিনী বলে “ধনি,                      দেখহ চরণ খানি,
ভাল মন্দ করহ বিচার।”
দেখি সুবদনী কহে,                      “কি নাম লিখা উহে,
পরিচয় দেও আপনার।।”
নাপিতিনী কহে “ধনি,                      শ্যাম নাম ধরি আমি,
বসতি যে তোমার নগরে।”
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়,                      এই নাপিতিনী নয়,
কামাইলা যাও নিজ ঘরে।।

————–

যাবক – আলতা। নখ-রঞ্জণী – নরুণ। চাঁছয়ে – বিভিন্ন পাঠ “চাঁকয়ে।” একে – “বরণ একে” পাঠান্তর। প্রা, কা, সং। আনন্দে – “আকুতে” পাঠও আছে।

নাপিতিনী বলে “ধনি,                      দেখহ চরণ খানি,
ভাল মন্দ করহ বিচার।”
দেখি সুবদনী কহে,                      “কি নাম লিখা উহে,
পরিচয় দেও আপনার।।”
বিভিন্ন পাঠঃ
নাপিতিনী বাণী শুনি,                      দেখিয়া চরণ খানি,
তলে লেখা দেখে শ্যাম নাম।
তবে বুঝি আপন মনে,                      চাহে নাপিতিনী পানে,
বলে তুমি কহ আপন নাম।।
–প্রা, কা, সং।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সুহিনী ।।

নাপিতিনী কহে “শুন লো সই।
অনাথী জনের বেতন কই?
কহ তুমি যাই রাইয়ের কাছে।
বেতন লাগিয়া বসিয়া আছে।।
যদি কহে তবে নিকটে যাই।
যে ধন দেন তা সাক্ষাতে পাই।।”
শুনি সখী কহে রাইয়ের কাছে।
“নাপিতিনী বসি আছয়ে নাছে”।।
রাই কহে “তবে আনহ তায়।
কতেক বেতন আমায় চায়?”
সখী যাই কবে ডাকয়ে “আইস।
আসিয়া রাইয়ের নিকটে বৈস।”
বসিল দুঃখিনী নাপিতিনী শ্যামা।
“কহয়ে বেতন দেহ যে রামা।।”
রাই কহে “কিবা হইবে তোর।”
সে কহে বেতন নাহিক ওর।।”
হাসিয়া কহয়ে সুন্দরী রাই।
“হেন নাপিতিনী দেখি যে নাই।।
এমতে ধন যে করেছ কত?”
সে কহে, “ভুবনে আছয় যত।।
এক ধন আছে তোমার ঠাঁই।
সে ধন পাইলে ঘরকে যাই।।
হৃদয়ে কনক কলস আছে।
মণিময় হার তাহার কাছে।।
তাহার পরশ রতন দেহ।
দরিদ্র জনারে কিনিয়া লহ।।”
হাসিয়া কহয়ে সুন্দরী গৌরী।
“ভাল নাপিতিনী পরাণ চুরি।।
পরশ রতন পাইবা বনে।
এখনে চলহ নিজ ভবনে।।”
চণ্ডীদাস কহে না কর লাজ।
নাপিতিনী নহে রসিক রাজ।।

————–

নাছে – পশ্চাদ্বার।

বসিল দুঃখিনী নাপিতিনী শ্যামা।
“কহয়ে বেতন দেহ যে রামা।।”
কথান্তরঃ
আসি নাপিতিনী কহয়ে তায়।
বেতন কেন না দেও আমায়।।
–প, ক, ত।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সুহিনী ।।

এক দিন মনে রভস কাজ।
মালিনী হইল রসিক রাজ।।
ফুলমালা গাঁথি ঝুলায়ে হাতে।
“কে নিবে, কে নিবে” ফুকারে পথে।।
তুরিতে আইলা ভানুর বাড়ী।
রাই কহে “কত লইবে কড়ি?”
মালিনী লইয়া নিভৃতে বসি।
মালা মূল করে ঈষৎ হাসি।।
মালিনী কহয়ে “সাজাই আগে।
পাছে দিবা কড়ি যতেক লাগে।।”
এত কহি মালা পরায় গলে।
বদন চুম্বন করিল ছলে।।
বুঝিয়া নাগরী ধরিলা করে।
“এত টীটপনা আসিয়া ঘরে?”
নাগর কহয়ে “নহি যে পর।”
চণ্ডীদাস কহে কি কর ডর।।

————–

রভস – রহস্য। রাজ – কৃষ্ণ। ফুকারে – চিৎকার করে। মূল – মূল্য, দাম। টীটপনা – চতুরতা।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ভাটিয়ারী ।।

 “গোকুল নগরে,                     ফিরি ঘরে ঘরে,
বেড়াই চিকিৎসা করি।
যে রোগ যাহার,                     দেখি একবার,
ভাল যে করিতে পারি।।
শিরে শির শূল,                     পিরিতের জ্বর,
হয়ে থাকে যে রোগীর।
বচন না চলে,                     আঁখি নাহি মেলে,
তাহারে পিয়াই নীর।।
কেবল একান্ত ধম্বন্তরি।
নাহি জানে বিধি,                    এমন ঔষধি,
পিয়াইলে যায় জ্বরি।।
ঔষধ খেয়ে,                     ভাল যে হয়ে,
বট দিও তবে পাছে।”
একজন তথা,                     শুনিয়া সে কথা,
কহিল রাধার কাছে।।
পরের মুখে,                     শুনিয়া সুখে,
হরষিত হলো মন।
বলে যে “যাইয়া,                     আনহ ডাকিয়া,
দেখি সে কেমন জন।।”
এ কথা শুনিয়া,                    বাহির হইয়া
কহে এক সখী ধাই।
“মোদের ঘরে,                     রোগী আছে জ্বরে,
দেখ একবার যাই।।”
এই বাড়ী হইতে,                     আসিছি তুরিতে,
কহে “হেথা থাক বসি।”
সাজ সাজাইতে,                     চলিল নিভৃতে,
চণ্ডীদাস কহে হাসি।।

————–

ফিরি ঘরে ঘরে – বিভিন্ন পাঠ–“প্রতি ঘরে ঘরে” প, ক, ত। জ্বরি – জ্বর। বট – কড়ি।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ভাটিয়ারী ।।

আপন বসন                 ঘুচায়ে তখন,
লেপয়ে কেশেতে মাটী
তবল্লক ছাঁদে,                 বসন পিঁধে,
সঙ্গে চলয়ে হাঁটি।।
মনোহর ঝুলি কাঁধে।
তাহার ভিতর,                 শিকড় নিকর,
যতন করিয়া বাঁধে।।
ঘুচাইয়া লাজে,                 চিকিচ্ছার কাজে,
বসিলা রোগীর কাছে।
ঘুচায়ে বসন,                 নিরখে বদন,
(বলে) “রোগ যে ইহার আছে।।”
বাম হাত ধরি,                 অঙ্গুলি মোড়ি,
দেখে ধাতু কিবা বয়।
“পিরিতের জ্বরে,                 জ্বরেছে ইহারে,
পরাণ রহে কি না রয়।।”
হাসিয়া নাগরী,                 উঠি অঙ্গ মোড়ি,
“ভাল যে কহিলা বটে।
বল কি খাইলে,                হইলে সবলে,
বেয়াধি কেমনে ছুটে।।”
“ঔষধ যে হয়,                 মনে করি ভয়,
এখনি খাওয়ায়ে যেতেম।
ভাল যে হইত,                 জ্বর যে যাইত
যদি সে সময় পেতেম।।”
তখন নাগরী,                 বুঝিলা চাতুরী,
টীট নাগররাজ।
বাশুলী নিকটে,                 চণ্ডীদাস রটে,
এমন কাহার কাজ।।

————–

বসন – পাঠান্তর–“বরণ”। তবল্লক – তকল্লুবী। নিকর – রাশি। পিরিতের জ্বরে – পাঠান্তর–“পিরিতের বিষে” (প, ক, ত)।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। বরাড়ী ।।

দেয়াশিনী বেশ সাজি বিনোদ রায়।
ধীরি ধীরি করি চলে হরষ অন্তর।।
গোকুল নগরে এই শব্দ উঠিল।
এক জন দেয়াশিনী ব্রজেতে আইল।।
তাহারে দেখিবার তরে লোকের গহন।
সব ব্রজবাসী চলে হরষিত মন।।
প্রণমিল দেয়াশিনীর চরণ কমলে।
বয়ান ভাসিল প্রেমে নয়নের জলে।
দ্বিজ চণ্ডীদাসের মনে আনন্দ বাড়িল।
কোথা হইতে আইলা তুমি এ ব্রজ মণ্ডল।।

————–

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। শ্রীরাগ ।।

মধুরা পুরেতে ধাম,                      কপটে বলয়ে শ্যাম,
আইলাম এই বৃন্দাবনে।
মম মনে বাঞ্ছা এই,                     সকল তোমারে কই,
শুন শুন বলি তোমা স্থানে।।
দেবী আরাধনা করি,                      ভিক্ষার লাগিয়া ফিরি,
আর করি তীর্থেতে ভ্রমন।
হই আমি তীর্থবাসী,                      সদাই আনন্দে ভাসি,
এই সত্য বলিহে বচন।।
জিজ্ঞাসা করিলা যেই,                      তাহাতে তোমারে কই,
ব্রজমাঝে রব কিছুকাল।
ইহা বলি দেয়াশিনী,                      চলে পুন একাকিনী,
ঘন ঘন বাজাইয়া গাল।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভণে,                      আনন্দিত হয়ে মনে,
জিজ্ঞাসিল কোথা ভানুপুর।
দেখিব তাহার ধাম,                      কপটে বলয়ে শ্যাম,
রস লাগি রসিক চতুর।।

————–

ভানুপুর – বৃষভানু রাজার বাড়ী।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সিন্ধুড়া ।।

দেয়াশিনী বেশে,                     মহলে প্রবেশে,
রাধিকা দেখিবার তরে।
সুরক্ত চন্দন,                     কপালে লেপন,
কুণ্ডল কাণেতে পরে।।
নাগর সাজী বাম করে ধরে।
পিঁধিয়া বিভূতি,                     সাজল মূরতি,
রুদ্রাক্ষ জপয়ে করে।।
কহে “জয় দেবী                     ব্রজপুর সেবি,
গোকুল রক্ষক নীতি।
গোপ গোয়ালিনী,                     সুভাগ্য দায়িনী,
পূজ দেবী ভগ্যবতী।।”
আশীর্ব্বাদ শুনি,                     গোপের রমণী,
আইলা দেয়াশিনী কাছে।
জিজ্ঞাসা করয়ে,                     যত মনে লয়ে,
বোলে ‘গোপ ভাল আছে।।
সবাকার জয়,                     শত্রু হবে ক্ষয়,
মনে ভয় না ভাবিবে।
তোমাদের পতি,                     সুন্দর সুমতি,
সবাকার ভাল হবে।।”
সঙ্গেতে কুটিলা,                     আসিয়া জটিলা
পড়য়ে চরণে ধরি।
“আমার বধূর,                     পতির মঙ্গল,
বর দেহ কৃপা করি।।”
শুনি দেয়াশিনী,                     হরষিত বাণী,
জটিলা সমুখে কয়।
“বর যে লইবে,                    ভালই হইবে,
নিকটে আনিতে হয়।।”
জটিলা যাইয়া,                     আনিল ধরিয়া,
আপন বধূর হাতে।
বসিলা হরষে,                     দেয়াশিনী পাশে,
ঘুচায়া বসন মাথে।।
দেখি দেয়াশিনী,                     বলে শুভ বাণী,
“সব সুলক্ষণযুতা।
গন্ধর্ব্ব পাবনী,                     যশোদা নন্দিনী,
রাধা নাম ভানুসুতা।।”
ধরি ধনির হাতে,                     মনের আকুতে,
নিরখে বদন তার।
দেখিতে দেখিতে,                     আনন্দিত চিতে,
মদন কৈল বিকার।।
সাজিটি খুলিয়া,                     ফুলটি তুলিয়া,
বাঁধেন নাগরী চুলে।
“আনন্দে থাকিবে,                     সকলি পাইবে,
কলঙ্ক নহিবে কুলে।।”
শুনিয়া সুন্দরী,                     কহে ধীরি ধীরি,
“এ কথা কহবি মোয়।
আমার হিয়ার,                     ব্যথাটি ঘুচয়ে,
তবে সে জানি যে তোয়।।”
“একটি শপথি,                     রাখহ যুবতী,
কহিতে বাসি যে ভয়।
পরপতি সনে,                     বেঁধেছ পরাণে,
ইহাই দেবতা কয়।।”
হাসিয়া নাগরী,                     চাহে ফিরি ফিরি,
“দেয়াশিনী ঘর কোথা?”
“আমার ঘর                     হয় যে নগর।
কহিব বিরল কথা।।”
সঙ্কেত বুঝিয়া,                     নয়ান ফিরিয়া,
তাক করে এক দিঠে।
নিরখি বদন,                     চিহ্নল তখন,
শ্যাম নাগর টীটে।।
ধীরি ধীরি করি,                     বসন সম্বরি,
মন্দিরে চলিলা লাজে।
চণ্ডীদাস কয়,                     সুবুদ্ধি যে হয়,
বেকত করয়ে কাজে।।

————–

বিভূতি – ভষ্ম। কুটিলা – শ্রীরাধিকার ননদিনী। জটিলা – শ্রীরাধিকার শ্বশ্রূ। বধূর – শ্রীরাধিকার। সুলক্ষনযুতা – সুলক্ষনযুক্ত। আকুতে – আগ্রহে। পরপতি – উপপতি।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। সিন্ধুড়া ।।

নাগর আপনি                     হৈলা বণিকিনী,
কৌতুক করিয়া মনে।
চুয়া যে চন্দন,                    আমলকী-বর্ত্তন,
যতন করিয়া আনে।।
কেশর, যাবক,                    কস্তূরী, দ্রাবক,
আনিল বেণার জড়।
সোন্ধা সুকুঙ্কুম,                    কর্পূর চন্দন,
আনিল মূথা শিকড়।।
থালিতে করিয়া,                    আনিল ভরিয়া,
উপরে বসন দিয়া।
মিছামিছি করি,                    ফিরে বাড়ী বাড়ী,
ভানুর দুয়ারে দিয়া
চুকব লইয়ে,                    ফুকরি কহয়ে,
আইস দাসী যে তবে।
“মোদের মহলে,                    অসি দেহ” বোলে
“অনেক নিতে যে হবে।।
থালিতে ধরিয়া,                    আনিল লইয়া,
যেখানে নাগরী বসি।
“চুয়া, সুচন্দন,                    করহ রচন”
বেণ্যানী মনেতে খুসি।।
“চন্দন চুবক,                    লইবে কতেক,
জানিতে চাহি যে আমি।”
“সকলি লইব,                    বেতন সে দিব,
যতেক আনহ তুমি।।”
আমলকী হাতে,                    দিল যে মাথে,
ঘসিতে লাগিল কেশ।
ঘসিতে ঘসিতে,                    শ্রম যে হইল,
নাগরী পাইল ক্লেশ।।
সুমধুর বাণী,                    কহে বে বেণ্যানী,
চুয়া মাখিবার তরে।
চুল যে ঝাড়িয়া,                    হাত নামাইয়া,
মাখায় হৃদয়পরে।।
পরশে নাগরী,                    হইলা আগরী,
পড়িলা বেণ্যানী কোরে।
নিন্দ সে আইল,                    অতি সুখ হইল,
সব শ্রম গেল দূরে।।
বেণ্যানী বলে,                    “গেল সে বেলে,
যাইতে চাহি যে ঘরে।”
উঠিলা নাগরী,                    বসন সম্বরী,
কহে “কি লাগিবে মোরে।।”
বট আনিবারে                    কহিলা সখীরে,
শুনিয়া নাগর রাজে।
কহে “না লইব,                    আর ধন নিব,
না কহি তোমারে লাজে।।”
“কহ না কেনে,                    কি আছে মনে,
শুনিতে চাহি যে আমি।
থাকিলে পাইবে,                    নতুবা যাইবে,
থির হইয়া কহ তুমি।।”
বেণ্যানী কহয়ে,                    “হিয়ার ভিতরে,
বড় ধন আছে সেহ।
কৃপা যে করিয়া,                    বাস উঘারিয়া,
সে ধন আমারে দেহ।।”
তখনে নাগরী,                    বুঝিলা চাতুরী,
হাসিয়া আপন মনে।
“গন্ধের বেতন,                    হইল এমন,
জীবন যৌবন টানে।।
কর সমাধান,                    বুঝিলাম কান’,
আর না বলিহ মোরে।
এতেক গুণে,                    মারহ পরাণে,
কেবা শিখাইল তোরে।।
পরের নারী,                    আশয়ে করি,
মরয়ে আপন মনে।
কোথা বা হৈয়াছে,                    কেবা বা পেয়েছে,
না দেখি যে কোন স্থানে।।”
চণ্ডীদাস কয়,                    কত ঠাঁই হয়,
যাহাতে যাহাতে বনে।
যৌবন ধনে,                    কিবা বা মানে,
সুঁপে সে প্রাণে প্রাণে।।

——————-

আমলকী-বর্ত্তন – আমলকীর গুলি; ইহা মাথা ঘসিবার নিমিত্ত অদ্যাপি ব্যবহৃত হয়। কেশর – নাগকেশর (গন্ধদ্রব্য)। নিন্দ – নিদ্রা। সেহ – সেই। উঘারিয়া – খুলিয়া। সমাধান – অবধান। কান’ – কানু—শ্রীকৃষ্ণ। বনে – যাহার সহিত মনের মিল হয়।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

শুনিয়া মালার কথা রসিক সুজন।
গ্রহ বিপ্র বেশে যান ভানুর ভবন।।
পাঁজি লয়ে কক্ষে করি ফিরে দ্বারে দ্বারে।
উপনীত রাই পাশে ভানু রাজ পুরে।।
বিশাখা দেখিয়া তবে নিবাস জিজ্ঞাসে।
শ্যামল সুন্দর লহু লহু করি হাসে।।
বিপ্র কহে ঘর মোর হস্তীনা নগর।
বিদেশে বেড়ায়ে খাই শুন হে উত্তর।।
প্রশ্ন দেখাবার তরে যে ডাকে আমারে।
তাহার বাড়ীতে যাই হরষ অন্তরে।।
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে এই গ্রহাচার্য্য!
প্রশ্নেতে পারগ বড় গণনাতে আর্য্য।।
তোমাদের মনেতে যে আছে যে বলিবে।
ইহারে জড়ায়ে ধর উত্তর পাইবে।।

——————-

রসিক সুজন – শ্রীকৃষ্ণ। বিপ্র – আচার্য্য। লহু লহু করি হাসে – অল্প অল্প হাসে—মুচকিয়া হাসে।

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। তুড়ি ।।

একদিন বর,                    নাগর শেখর,
কদম্ব তরুর তলে।
বৃষভানু সূতে,                    সখীগণ সাথে,
যাইতে যমুনাজলে।।
রসের শেখর,                   নাগর চতুর,
উপনীত সেই পথে।
শির পরশিয়া,                   বচনের ছলে,
সঙ্কেত করল তাতে।।
গোধন চালায়ে,                   শিশুগণ লয়ে,
গমন করিলা ব্রজে।
নীর ভরি কুম্ভে,                   সখীগণ সঙ্গে,
রাই আইলা গৃহমাঝে।।
কহে চণ্ডীদাসে,                   বাশুলী আদেশে,
শুন লো রাজার ঝিয়ে।
তোমা অনুগত,                   বঁধুর সঙ্কেত,
না ছাড় আপন হিয়ে।।

——————-

শ্রীকৃষ্ণের স্বয়ং দৌত্য ।। ধানশী ।।

যাইতে জলে,                 কদম্বতলে,
ছলিতে গোপের নারী।
কালিয়া বরণ,                 হিরণ পিঁধন,
বাঁকিয়া রহিল ঠারি।।
মোহন মুরলী হাতে।
যে পথে যাইবে,                 গোপের বালা,
দাঁড়াইল সেই পথে।।
“যাও আন বাটে,                 গেলে এ ঘাটে,
বড়ই বাধিবে লেঠা।”
সখী কহে “নীতি,                 এ পথে যাই,
আজি ঠেকাইবে কেটা?”
হয় বোলা বুলি,                 করে ঠেলাঠেলি,
হৈল অরাজক পারা।
চণ্ডীদাস কহে,                 কালিয়া নাগর,
ছি ছি! লাগে মরি মোরা।

————–

ঠারি – দাঁড়াইয়া। আন বাটে – অন্যপথে। বোলা বুলি – বলাবলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *