২২. উন্মাদ হইবার পূর্বে রাজা লিয়র

I will do such things–
What they are yet I know not–
but they shall be
The terror of the earth…..

উন্মাদ হইবার পূর্বে রাজা লিয়র ওই কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু আমি উন্মাদ হই নাই, যদিচ উন্মাদনা থাকিতে পারে।

উহাতে নীটসের দর্শনের বীজ রহিয়াছে।

এবং শোপেনহাওয়ার, বাকুনিন…..

এবং পকুধ কচ্চায়ন, পূরণ কস্‌সপ…

গঙ্গার দক্ষিণ তীরে ছেদন করিতে, ছেদন করাইতে, অঙ্গহীন করিতে, অঙ্গহীন করাইতে, …  

উহা তোমার পরিকল্পনা, মানসিক কর্ম্ম তৎকালে।

পরিকল্পনাহেতু কৃষ্ণপুরে পঁহুছিলাম।

পূৰ্বে তোরণের প্রহরীদ্বয় তোমাকে হাঁকাইয়া দিয়াছিল। কারণ তোমার বেশভূষা মলিন, দরিদ্রবৎ আকৃতি, কোটরগত চক্ষে করুণা-প্রার্থনার কাপট্য ছিল।

উত্তরতোরণে গিয়াছিলাম, যেখানে প্রজাসাধারণকে অবাধ অপমানিত প্রবাহ বোধ হইতেছিল।

খাজাঞ্চিখানা, দরখাস্ত, গোমস্তা, মুহুরি, শবদেহে কীট, থকথকে, কদর্য ক্রেদপুঞ্জ ভাসিতেছিল।

মুন্সি আবদুর রহিম ইঙ্গিতে চলিয়া যাইতে বলেন।

তুমি যাও বাবু গোবিন্দরামের নিকট।

সাদরে গ্রহণ করেন তিনি।

পদ্মতীরে তাঁহার বাসগৃহ ছিল।

গঙ্গাতীরে ক্ষুদ্র একতলা দালানবাটিকা এবং নিরলঙ্কত জীবনযাপন করিতেন।

তুমি চাকুরি চাহিলে। ছবিলাল গোমস্তা হইলে। সাত টাকা মাহিনা।

মহালে যাইতাম। দাড়ি রাখিয়াছিলাম।

তুমি কৃষকদিগের বলিতে, যে-মাটি চষিতেছ, উহা তোমারই।

বলিতাম, কেহ কাহারও প্রজা নহে। রাজা মাড়াইকল! রাষ্ট্র খাঁচাকল। পেয়াদাপাইক বরকন্দাজ পুলিশ সেনাবাহিনী সমুদয় বেতনখোর দুর্বৃত্ত। খাজনা দিও না।

তাহারা বুঝিত না।

ক্রমে বুঝিয়াছিল।

আশ্চৰ্য্য দেখ, কৃষকেরা তোমাকে সাধু ভাবিয়া নত হইত আর গ্রামে পুলিশ আসিলে পূৰ্বে সম্বাদ সংগ্রহ করিত।

চৌকিদারগণ মাংসপুঞ্জ হইত! যেরূপ পকুধ কচ্চায়ন কহিয়াছেন, এক উপাদান অন্য উপাদানে পরিবর্ত্তিত হওয়ার কথা, সেইরূপ।

বাবু গোবিন্দরাম সিংহ বলিতেন, জ্বালাইয়া দাও! ভাঙ্গিয়া ফেল! পূণ্য হইবে।

নিশীথরাত্রে তাঁহার গৃহে যাইতাম। তিনি প্রতীক্ষা করিতেন! পরামর্শ দিতেন।

একদিন তিনি বলেন যে জমিদারবাবু গঙ্গাতীরব্যাপী নিত্য অপরাহ্নে অশ্বরোহণে গমনাগমন করেন, যাহা বহুকালবধি শৌখিনতা।

আমাকে নির্জ্জনে দণ্ডায়মান দেখিয়া অনন্তনারায়ণ বলেন, এই বেটা, ঘোড়ার লাগাম ধর। মুত্র ত্যাগ করিব।

তিনি ঝোপমধ্যে যোধপূরী ব্রিচেশের বোতাম খুলিয়া দণ্ডায়মান অবস্থায়। মূত্রত্যাগে রত হন। কিন্তু কানে পৈতা জড়াইতে ভোলেন না।

ঝোঁপটি পুষ্পবতী সৌন্দর্যময়ী ছিল।

উহা পৃথিবীতে প্রকৃতির চুম্বনের চিহ্ন।

প্রকৃতি অপমানে জর্জ্জরিত হইলেন দেখিয়া অশ্বের লাগাম ছাড়িয়া নিকটে গেলাম এবং মুখ ঘুরাইবার সঙ্গে-সঙ্গে….

কুকরি দ্বারা গর্দানে কোপ মারিলে। অশ্বটিও তুষ্ট হইল। কারণ সে চিত্রার্পিত ছিল।

গঙ্গার উত্তর দেশ হইতে গোর্খারা চাকুরি খুঁজিতে আসিত।

এক ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ গোর্খার নিকট চারি আনার কুকরি খরিদ করিয়াছিলে।

উহা চর্ম্মকোষে আবদ্ধ ছিল, কারুকার্য্যখচিত সুন্দর বিভীষিকা!

আর দেখ, তুমি কৃষকদিগের বলিতে, ভাইসকল! তোমরা পৃথিবীকে সাজাইয়াছ। তোমরা রূপকার!

বলিতাম, তোমরা প্রকৃতির মহৎ সন্তানহেতু প্রকৃতির স্বাধীনতাস্রোতে ভাসিতেছ।

বৃক্ষলতা রৌদ্র বৃষ্টি নদী শস্য মেঘ যেরূপ স্বাধীনতাময়।

বাবু গোবিন্দরাম পলাইতে পরামর্শ দেন, যেহেতু মুন্সি আবদুর রহিম আমাকে চিনিতেন!

তুমি রত্নময়ীর সহিত সাক্ষাত করিতে চাহিয়াছিলে!

সাময়িক মোহ মাত্র। অথবা তাহাকে জানাইবার ইচ্ছা ছিল যে, তাহার বাঞ্ছা। পূরণ করিয়াছি।–

দক্ষিণে যাইতে বাদশাহী সড়কে একটি চটীতে উপস্থিত হইলে।

তখন রাত্রিকাল।

চটীর পিছনে উচ্চ দীঘির পাড়ে আলো জ্বলিতেছিল। চটীর মালিক বলেন, ‘মুসলমান সাধুর ওই ডেরায় যাইলে আশ্রয় পাইবেন।’

সেখানে অজিফামামী এবং মস্তানবাবাকে আবিষ্কার করিয়াছিলাম।

স্ত্রীলোকটির ক্রোড়ে একটি সুন্দর শিশু ছিল, যে বালিকা।

একদা এই ক্ষুদ্র বর্ণাঢ্য মাংসপুঞ্জরূপী উপাদানকে ভিন্ন উপাদানে পরিণত করিতে গিয়াছিলাম ভাবিয়া অনুশোচনা জাগিল।

তোমার চক্ষু সেই প্রথম অশ্রুসিক্ত হয়, জীবনে একবার।

মস্তানবাবাকে সজাগ প্রহরী জানিয়াছিলাম বলিয়া সভয়ে চলিয়া আসিলাম।

বাদশাহী সড়কে চলিতে স্মরণ হইল, এই পথ মৌলাহাটে পৌঁছিয়াছে। তখন পূর্বমুখী হইলে।

তখন উষাকাল। বিহঙ্গসকল প্রকৃতির জয়গান গাহিতেছিল। উহাদের কণ্ঠরোধ করিবার সাধ্য নাই, অথচ মনুষ্যদিগের নিয়ত কণ্ঠরোধ করা হয়।

রাষ্ট্র মাড়াইকল। শাসকবৃন্দ পাদুকাবাহী। পুলিশ সেনাবাহিনী ভাড়াটিয়া গুণ্ডা।

উহাদিগের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা কর্ত্তব্য।

যতদিন না ওইগুলিন ধ্বংস হইতেছে ততদিন নির্বাণ দুঃসম্ভব।

উহাই নির্বাণ, উহাই মোক্ষ, যাহা ব্যক্তিকে স্বরাট করে, সার্বভৌম সত্তাকে পরিণত করে।

যুদ্ধ চলিতেছে যুগযুগান্ত কাল হইতে–

মুক্তির জন্য যুদ্ধ, নির্বাণের জন্য যুদ্ধ, পদযুগলকে শূন্যতা হইতে ফিরাইয়া আনিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ।

যথেষ্ট হইয়াছে। এইবার আরও পূর্বমুখী হও, উহাও গঙ্গার দক্ষিণ তীর।

ছেদন করিতে ছেদন করাইতে, অঙ্গহীন করিতে অঙ্গহীন করাইতে–

গ্রাম হইতে নগরে, গঞ্জে,….

.

আভি মুহরিবাবু নেহি হ্যায়। আমার চেহারায় নিশ্চয় হিন্দুস্থানী আদল ছিল। একমুখ গোঁফদাড়ি। অবশিষ্ট শার্ট আর ধুতিটি পরনে ছিল। রক্তমাখা কাপড়চোপড় এবং ভোজালিটি ভাগীরথীতে ডুবিয়ে রেখে এসেছি। অমলকান্তির কাছে শুনেছিলাম, বারিচাচাজি বহরমপুরের গোরাবাজারে থাকেন এবং ওকালতি করেন। আমি এবার বারান্দায় উঠে গিয়ে আস্তে বললাম, আমি শফি-শফি-উজ্জামান। বারি চৌধুরি নিষ্পলক চোখে একটু তাকিয়ে থাকার পর বললেন, কোর্টে সারেনডার করতে এসেছ? বুকের ভেতর ধাক্কা লাগার ফলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, হ্যাঁ। কয়েক মুহূর্ত তেমনি তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমার একটা হাত ধরে টেনে ভেতরে ঢোকালেন! দরজা বন্ধ করে দিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বললেন, কেন তুমি এমন হয়ে গেলে, শফি? কিসের অভিমান তোমার? চুপ করে রইলাম। এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন বারিচাচাজির? হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, উই লিভ বাট এ ফ্র্যাকশন অব আওয়ার লাইফ! পরমুহূর্তে আবেগ দমন করে পানজাবির হাতায় চোখ মুছলেন। আমার পাশে এসে বসলেন। আস্তে বললেন সারেনডার করতে আসার আগে মাকে দেখা করে এসেছ? বললাম, না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমার বিরুদ্ধে বাঢ়ের জমিদারদের অসংখ্য নালিশ কালেকটরসায়েবের কাছে জমা আছে। কৃষ্ণপুরের জমিদারকে খুনের নালিশ আছে। আরও কিছু খুন খারাপির নালিশও আছে শুনেছি। জানি না তোমাকে বাঁচাতে পারব কি না। সবকিছু জেনে-বুঝে তবে সারেনডার করতে বলব। আপাতত তুমি গোপনে মৌলাহাটে গিয়ে অন্তত মাকে একবার দেখা করে এসো। বললাম, গতরাত্রে লালবাগে কাল্লু সিপাহীকে খুন করে এসেছি। সেই সাতমার কান্নু খাকে। বারিচাচাজি চমকে উঠে বললেন, কেন? সে কী দোষ করেছিল তোমার? বললাম, জানি না। তবে মনে হয়েছিল ওকে খুন করা দরকার। বারি চৌধুরি শাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, দেন ইউ আর এ হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক। তোমাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়, তোমাকে মানসিক রোগগ্রস্ত প্রমাণ করা। এবং তুমি মানসিক-রোগগ্রস্ত তো বটেই। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বারি চৌধুরি ফের বললেন, তুমি জান কি, হরিণমারার বড়োগাজি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন? উনি এই মহল্লায় থাকেন। সবকারি কর্তাদের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে। ওঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু তুমি আগে মাকে দেখা করে এসো। বললাম, যাব। বলছেন যখন। বারিচাচাজি দুঃখিত মুখে বললেন, যে জীবন তুমি পেয়েছ, যে-জীবনের জোরে দুনিয়ায় বাহাদুরি দেখিয়ে বেড়াচ্ছ, তা কীভাবে পেলে ভেবে দেখছ না? মুখ নামিয়ে বললাম, আমি কি দুনিয়ায় আসার জন্য দায়ী? আমার জীবনের জন্য আমি দায়ী নই। বারি চৌধুরি কষ্টে হাসলেন। বললেন, জীবন তোমাকে কি কিছুই দেয়নি? আগে এ প্রশ্নের জবাব দাও। বললাম, পৃথিবী দুঃখময়। বাসযোগ্য নয়। বাবিচাচাজি বললেন, বেশ তো! তাকে বাসযোগ্য করার জন্য লড়াই করো। বললাম, সেটাই তো করছিলাম। বারিচাচাজি বললেন, নিৎসে নামে একজন ইউরোপীয় দার্শনিক সুপারম্যানের প্রকল্প খাড়া করে গেছেন। বছর পাঁচেক আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তুমি কি নিজেকে সুপারম্যান ভাব নাকি? কোনো জবাব দিলাম না। দার্শনিক বিষয়ে তর্ক করার প্রবৃত্তি ছিল না। বারিচাচাজি জানেন না, আমি এসব বিষয়ে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি জানি আর বুঝি! চুপ করে আছি দেখে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। ডাকলেন, করিম। করিম বখশ। অবাক হয়ে দেখি, কেল্লাবাড়ির সেই বুড়ো করিম বখশ এসে দরজায় দাঁড়াল। কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারল না। বারিচাচাজি বললেন, নাশতার যোগাড় করো। আগে দু পেয়ালা চা পেলে ভালো হয়! করিম বখশ চলে গেল। এই সময় বৃষ্টি শুরু হল। আশ্বিন মাস। উলুশরার বিলের রাস্তায় গেলে মৌলাহাট দশ ক্রোশ, কিন্তু এখন ওদিকটা দুর্গম। জিগ্যেস করলাম, আপনার ঘোড়াটা কি আছে? বারিচাচাজি অন্যমনস্কভাবে বললেন, আছে। কেন? বললাম, মৌলাহাট– কথা কেড়ে বারিচাচাজি মাথা নেড়ে বলবেন, না। প্রকাশ্যে ঘোড়ার পিঠে ওই এলাকায় যাওয়া ঠিক নয়। তোমাকে বরং পালকি ভাড়া করে দেব। সেটাই তোমার পক্ষে নিরাপদ হবে।…..

আমি পালকি নিইনি। পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিলাম। তুমুল বৃষ্টি সে রাত্রে। সে এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। একটা কালো জিন অশ্বরূপে আমাকে বহন করিয়াছিল।…..

‘জেলা সমাচার’ পত্রিকার সম্পাদকীয় (আংশিক উদ্ধৃতি)

“…..বিগত ১৭ই জুন জেলার কুখ্যাত দুর্বত্ত ছফিজামান ওরফে ছবিলালকে দয়রা জজ শ্রীযুক্ত জৰ্জ নীল মহোদয় বেকসুর খালাস দিয়াছেন জানিয়া স্তম্ভিত হইয়াছিলাম। ইংরাজ বিচারব্যবস্থার বিষয়ে আমাদিগের উচ্চ ধারণার কোনও হেতু নাই, উহা পুনরায় প্রমাণিত হইল। বিগত বৎসরে বঙ্গভঙ্গরূপ ঘটনায় মুসলমানদিগের সহিত ইংরাজ শাসনকৰ্ত্তাদিগের কিরূপ ষড়যন্ত্র চলিতেছে, তাহার প্রতি আমরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছিলাম। এক্ষণে এই দুর্বত্ত দ ও হন্তারকের নিস্কৃতিলাভ তাহার আরও একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হইল। অতএব সাধু সাবধান। এই মুসলমানঅধ্যুষিত জেলায় ইহার পর হিন্দুদিগের মানসম্ভ্রম নিরাপদ নহে বিবেচনায় অবশেষে বিভিন্ন স্থানের রাজাবাহাদুর ও জমিদারবৃন্দ কালেকটরবাহাদুর শ্ৰীযুত ম্যাকফার্সন সাহেবের নিকট প্রতিকার প্রার্থনা না করিলে কী ঘটিত ভাবিতেও হৃৎকম্প হয়। অতি আনন্দের কথা যে ওই দরখাস্তে নবাববাহাদুর মুসলমান হইয়াও সহি দেন। ইহার ফলস্বরূপ সুবিজ্ঞ কালেকটরবাহাদুর উক্ত দস্যুর প্রতি ৭ বৎসরের জন্য জেলা হইতে নির্বাসনদণ্ড জারি করিয়াছেন। এই ৭ বৎসর মধ্যে ছফি ওরফে ছবিলাল জেলার মাটিতে পদার্পণ করিলেই দৃষ্টি হওয়ামাত্র উহাকে যে কেহ হত্যা করিতে পারিবে এবং তজ্জন্য দুই হাজার টাকা পারিতোষিক লাভ করিবে। ইহা মন্দের ভাল হইল। জেলাবাসী সজ্জন গৃহস্থ বিত্তবান সকলেই কালেকটরবাহাদুরের প্রশংসা গাহিতেছেন। কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে আমরা অবগত হইয়াছি যে, কতিপয় নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তি এবং অতিশয় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, তাহাদিগের সহিত কতিপয় বিশ্বাসঘাতক স্বজাতিদ্রোহী জয়চাঁদ এবং কালাপাহাড় ওই নির্বাসনদণ্ড প্রত্যাহারের কারণে ষড়যন্ত্র করিতেছে। পুনরায় কহি যে, সাধু সাবধান!…..”

‘And behold! a Messiah cometh unto them.’

কথিত আছে, একদা পশ্চিমের লোকসকল পূর্বদিশ্বলয়ে একটি কৃষ্ণবিন্দু দেখিতে পায়। বিন্দু শূন্যে ভাসমান এবং কম্পমান ছিল। ক্রমেই উহা স্ফীত লাভ করতঃ ভূমিসংলগ্ন হয়। তিনি এক কৃষ্ণবর্ণ অশ্বের আরোহী। লোকসকল প্রণত হইলে ‘তিনি ভর্ৎসনা করিয়া বলেন, অই বৃক্ষ দেখ, যাহা ঋজু, যাহা ছেদিত বা দন্ধ হয়; কিন্তু স্বেচ্ছায় নত হয় না, যাহা ভূমির জন্য কাহাকেও রাজস্ব দেয় না। তোমরা বৃক্ষের নিকট শিখ। আর তোমরা নদীর নিকট শিখ, যাহা গতিশীল। আর তোমরা মেঘের নিকট শিখ, যাহা নিজেকে নিঃশেষিত করিয়া ভূমিকে জীবন দেয়; কিন্তু বক্ষে বজ্র বহন করে এবং গর্জন করে ।

কথিত আছে, ‘তিনি’ কঠিন শিলার ন্যায় দুর্ভেদ্য ছিলেন। আর ‘তিনি’ অগ্নিবর্ণ ছিলেন। লোকসকলকে উত্তপ্ত করিতেন। তাহারা অনুসরণ করিলে তিনি বলিতেন, যাহা বলিয়াছি, পালন কর। আর একদিবস একটি গোরাবন্টন সেই অশ্বের ভয়ঙ্কর মূত্রস্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল। দারোগাবাবুদিগের দেখিলে ‘তিনি বলিতেন, উর্দি খুলিয়া ফেল। উহা শৃঙ্খল। উহা আনুগত্যের হেতু। উহা বিদ্রোহ আগুলিয়া রাখে! কিন্তু বিদ্রোহ স্বাধীনতার পথ এবং স্বাধীনতাই জীবন।

কথিত আছে, এইরূপে ‘তিনি’ অসংখ্য গ্রামপরিক্রমা করেন। সেই গ্রামসকল স্বাধীনতাময় হইয়াছিল। সেইসকল গ্রামের মাটি ও নিসর্গ হইতে ‘স্বাধীনতা। স্বাধীনতা!’ এই ধ্বনি স্পন্দিত হইত ।

এবং কথিত আছে, লোকসকলকে স্বপ্নে দেখা দিয়া ‘তিনি’ বলিয়াছিলেন, “আমি সেই ছবিলাল’। পরবর্তীকালে প্রাজ্ঞ গ্রামীণেরা ব্যাখ্যা করিত, তিনি ছবির ন্যায় রাঙা ছিলেন, সেই হেতু ছবিলাল ॥….

‘I will go no more to Apollo’s inviolate shrine…. The old
prophecies about Laius are losing their power; already
men are dismissing them from mind, and Apollo is
nowhere glorified with honours. Religion is dying….’
Oedipus the Kind–Sophocles.

“বীরভূম জেলার নলহাটি অঞ্চলের দস্যুসর্দার গোবর্ধন ওরফে গোবরা ছিল হাড়িসম্প্রদায়ভুক্ত। লোকে তাহাকে গোবরা হাড়ি বলিয়া জানিত। সে আমাকে ‘ঠাকুর’ বলিয়া মান্য করিত! সে ভাবিত, আমার কিছু অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে। কারণ আমি লাঠি ও তলোয়ার চালনায় দশজন গোবরা হাড়ির অপেক্ষা পারদর্শী ছিলাম। ত্রিশ-চল্লিশ বিঘৎ দূর হইতে বল্লম ছুড়িয়া লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত ছিলাম। তাহার একটি গাদা বন্দুক ছিল। উড়ন্ত পাখি মারিয়া তাহাকে তাক লাগাইয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু সে প্রণাম করিতে নত হইলে তাহার বাবরি চুল ধরিয়া তাহাকে সিধা দাঁড় করাইয়া বলিতাম, খর্বদার! নিজেকে অপমানিত করিবি না। সে বলিত, আপনি ঠাকুর! বলিতাম, ওরে নির্বোধ! ঠাকুর মুসলমানেরও পদবী হয়। তুই গোমূর্খ, তাই জানিস না, উহা মুসলমানী কথা। তুর্কী বাদশাহদের আমলে আমদানি। তুর্কী ভাষায় ‘টাগরি’ অর্থ ঈশ্বর এবং ঈশ্বরবাহাদুরের মর্ত্যের প্রতিনিধি দ্বিপদ প্রাণীবিশেষ, যাহারা বাদশাহ এবং প্রজাসাধারণের মধ্যবর্তী স্থানে থাকিয়া চক্ষু রাঙ্গায়। উহারা বৃক্ষের পরগাছা। উহারা সহজে উৎপাটনযোগ্য …..

“গোবরা কিছু বুঝিতে পারিত না। শুধু বলিত, আজ্ঞে, আপুনি ঠাকুর। স্বীকার করি যে, সে রবিনহুড ছিল না? পথিমধ্যে রাজস্ববাহী শকট এবং বণিকদিগের পণ্যসম্ভার-বিক্রয়লব্ধ নগদ অর্থের খবর পাইলে লুণ্ঠন করিত। ইহাও রাষ্ট্রের কাঠামোতে আঘাত বলিয়া তাহার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম।….

“একদিন গোবরার স্ত্রী হীরার কোলে তাহার কন্যাটিকে দেখিয়া করুণা ওরফে ইকরার কন্যাটির কথা স্মরণ হইল। চাঞ্চল্য বোধ করিলাম। বাদশাহী সড়কের ধারে সেই চটীতে উপস্থিত হইলাম। সঙ্গে স্বয়ং গোবরা ছিল। প্রয়োজনে সে নজর রাখিবে। শিশুটিকে হরণ করিবার অভিসন্ধি ছিল। সন্ধ্যার কিছু পরে চটীর শিয়রে দীঘির পাড়ে অবস্থিত মস্তানবাবার আস্তানাটি একদল পথিকের অধিকৃত দেখিলাম। চটীর মালিককে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, মস্তানবাবা তাঁহার সাধনসঙ্গিনীর দেহান্তের পর ডেরা পরিত্যাগ করিয়া যান। সে প্রায় তিন বৎসর পূর্বের কথা। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া বলিলাম, তুমি কি অই ঘরটি দখল করিয়া লোকদিগের আশ্রয়স্থল করিয়াছ? সে নির্বিকার মুখে বলিল, ঠিক করিয়াছি। বলিলাম, ভাড়া লও কি? সে পূর্ববৎ ভঙ্গীতে বলিল, লই। আপনারা রাত্রিবাস করিতে চাহিলে এক আনা হারে ভাড়া লাগিবে। এখনও চারিজনের স্থান সংকুলান হইবে। তৎক্ষণাৎ তাহাকে চপেটাঘাত করিলাম। চটীতে ভোজনরত কতিপয় লোক মুখ ঘুরাইয়া রহিল। চটীদার চড় খাইয়া এক লাফে কুঠুরিতে ঢুকিয়া একখানি প্রকাণ্ড খাড়া আনিল এবং আস্ফালন করিয়া তুমুল চীৎকার করিতে থাকিল। একটি খর্বাকৃতি শীর্ণ মনুষ্যকণ্ঠে ওইরূপ তীক্ষ্ণ নাদ বিস্ময়কর। গোবরা তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া মিটিমিটি হাসিতেছিল। সহসা পিছন হইতে তাহাকে জড়াইয়া ধরাশায়ী করিল। খাড়া কাড়িয়া লইলাম। গোবরাও তাহাকে ছাড়িয়া দিল। তাহার পর চিত্রবৎ স্থির এবং ভোজনরত লোকদিগের উদ্দেশে বলিল, আমি গোবরা হাড়ি। ইতোমধ্যে দীঘির পাড়ের আস্তানাঘরের লোকগুলি গণ্ডগোল দেখিতে আসিয়াছিল। কথাটি শুনিবামাত্র তাহারা এবং ভোজনরত ব্যক্তিরা আহার ফেলিয়া অন্ধকারে অদৃশ্য হইল। চটীদার কাঁপিতে-কাঁপিতে গোবরার সম্মুখে নত হইয়া বলিল, বাবা! মার্জনা করিবেন। গোবরা বলিল, তবিল আন। আমি তাহাকে ইঙ্গিতে নিবৃত্ত করিয়া বলিলাম, যথেষ্ট হইয়াছে।….

“ইহার পর কিছুকাল মস্তানবাবার সন্ধানে বিস্তর ছোটাছুটি করিয়াছি। লোকটি যেন পৃথিবী হইতে উবিয়া গিয়াছে। অদ্য অকপটে লিখিতেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ওই শিশুকন্যাটি আমার পিতার ঔরসজাত! সুতরাং আমার সহিত উহার রক্তের সম্পর্ক ছিল। যদি প্রমাণের কথা বল, দিতে পারিব না। কিন্তু কন্যাটির গাত্রবর্ণ তাহার জননী অপেক্ষা বহুগুণ সমুজ্জ্বল ছিল, এইটুকু বলিতে পারি। আর একটি কথা লিখিবার আছে। সেই মস্তানবাবা সম্ভবত আ…..”

.

একটি কথোপকথন

কচি ।। এ কী দাদিমা! হঠাৎ এখানেই শেষ কেন? ‘আ’ লিখেই শেষ!

দিলরুখ বেগম ॥ জানি না!

কচি ।। (উত্তেজিতভাবে) কোনো মানে হয়? আ লিখে কলম থেমে গেল। মিস্ট্রিয়াস! কামাল স্যারকে দেখাতে হবে।

দি বেগম ৷। (দৃঢ়স্বরে) না। আমার মরা ধড়ের ওপর দিয়ে তবে ওই খাতা বাইরে নিয়ে যাস!

কচি ॥ (অবাক হয়ে) কী অদ্ভুত। ব্যাপারটা তোমায় পড়ে শোনাচ্ছি। তাহলে বুঝবে—

দি বেগম । আমি বুঝতে চাই না। তুই চুপ কর! রেখে দে সিন্দুকে। আর কক্ষনো সিন্দুকে হাত দিবি নে।

কচি ॥ (একটু পরে দুঃখিতভাবে) একটা ব্যাপার ভাবা যায়। হয়তো ঠিক সেই মোমেনটে সেনট্রিরা এসে ছোটোদাদজিকে ফাঁসি দিতে নিয়ে গিয়েছিল। ফাঁসি শেষরাতে বা ভোরে দেওয়া হয়। হুঁ– তাই হবে। বুট! কাওয়ার্ড! ওরা শেষ কথাটা লিখতে সময় দেয়নি! দাদিমা, আমি ছেলে হলে এর শোধ নিতাম! এখন বুঝতে পারছি, খোকা যা করছে, ঠিক করছে। ওকে আমি সাপোর্ট করি! দুনিয়া জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া দরকার।

দি বেগম ॥ (শাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে) তা তো বলবিই। তোদের যে বদ খুন আছে অজুদে!

কচি ॥ (অন্যমনস্কভাবে) সেই মস্তানবাবা সম্ভবত,…(হঠাৎ নড়ে উঠে) দাদিমা! দাদিমা! সেই মস্তানবাবা বড়ো আব্বার ছোটো ভাই ফরিদুজ্জামান নন তো? শা ফরিদ, ও দাদিমা, সেই শা ফরিদ!

দি বেগম ।। (ফুঁপিয়ে উঠে) আমি জানি না! দোহাই কচি, তুই, চুপ কর!

কচি ॥ কান্নাকাটি করছে কেন? হল কী তোমার? ও দাদিমা!

দি বেগম ।। কবর খুঁড়তে নেই। গোনা হবে।

কচি ॥ কী আশ্চর্য! ফ্যামিলির হিট্রি জানলে গোনা হবে? রাখো তোমার গোনা।

দি বেগম ।। আমার বড়ো ডর নাগে! পা ফেললে বাড়ির মাটি টলমল করে। দেয়ালগুলান দেখি, মনে হয়, ধসে যাবে। ঘরের চালের দিকে তাকাই। ভাবি, মচমচ করে ভেঙে পড়বে। সারারাত বাড়ি চারপাশে ফিসফিস করে কারা।

কচি ।। ডিলিরিয়াম!

দি বেগম ॥ হারামজাদি মেয়ে! দেখছিস না চারদিক থেকে জঙ্গল বাড়িটাকে ঘিরে ধরছে? কিলবিলে সাপের মতন লতাপাতা। চাঁদের আলোয় উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখিস। চারদিক থেকে! চাদ্দিক থেকে!

কচি ॥ কী চারদিক থেকে?

দি বেগম ॥ কালা জিনের মুঠোয় আটকে পড়ছে বাড়িটা। চাদ্দিক থেকে মাকড়সার মতন জাল বুনেছে।

কচি ॥ (হাসতে-হাসতে) বোগাস! দারিদ্র্য! খোকা লেখাপড়া শিখল না। পাস করলে চাকরি পেত। আমি পাস করে বেরুব। চাকরি করব। বাড়ি মেরামত করব। বাস!

দি বেগম ।। ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ ওটা কী?

কচি ।। (লাফিয়ে ওঠে) সর্বনাশ! সাপের খোলস কোত্থেকে এল? (ঘরের কোণে গিয়ে) এম্মা! ইঁদুরের গর্ত যে! এখানে সাপের খোলস– উরে ব্বাস! নিশ্চয় সাপ আছে গর্তে। বেদে ডাকতে হবে। দাঁড়াও, খাতাটা রাখি। রসুল বেদেকে এক্ষুণি ডেকে আনছি।…..

‘……স হোবাচ গার্গি মাতি প্ৰাক্ষীমা তে মূর্ধা ব্যপঞ্চৎ–‘

কৃষ্ণপুরে চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসেছে। বুড়োশিবের মন্দিরের সামনে চটানে ‘ভক্তা’ ‘সন্নেসি’র দল রাঙা কাপড় পরে বেতের ছড়ি হাতে চক্কর মেরে নাচছে, মধ্যিখানে পালাকের সাজপরা একঝাক ঢাক– আকাশ থেকে মেঘের টুকরোগুলি। নেমে এসে মানুষজনের ভিড়ে ডাক ছাড়লে এরকমই ঘটত, তারা দুলত, নাচত, গর্জাত, আর হলুদ ছিপছিপে বেতের ঋজু ও বক্ৰগতি মুহুর্মুহু –ওই মেঘগুলির দেহনিঃসৃত বিদ্যুৎরেখা বলে ভ্রম হয়, আর উপোসি ভক্তরা তালে-তালে নেচে-নেচে হাঁক মারছে, ‘শিবো নামে পুইনন্যা করে বোল শিবো বো-ও-ল!’ বড়োবানের বছর মাগঙ্গা কামড়ে খেয়েছে একগাল মাটি, বুড়ো শিবকে সে বুকে টানতে চেয়েছিল –বুড়ো চির যুবতী বধুর ছলনা বোঝে, তাই পেছনে ওই.শক্ত বটের ঠেকা। মেলায় বড়ো ভিড়। একশো আট পাঁঠা গঙ্গাজলে চুবিয়ে মানুতে লোকেরা হল্লা করছে হাড়িকাঠের কাছে। জনা বিশ কামার রক্তমাখা খাড়া তুলে নাচছে, চক্ষু রাঙা, কপালে রক্তের ফোঁটা। চটানের মাটি ও ঘাস রক্তে থকথকে। শৃঙ্খলাহীন, অসম্বদ্ধ, জোর যার বলি তার নীতি, কার পাঁঠার ধড় কার কাঁধে তোলে, কার পাঁঠার মুণ্ডু কারা কুড়োয় –উঁকি মেরে তাকিয়ে ছিলেন এক মফসরবাবু’ সরে এলেন। মাথায় শোলার টুপি, প্রকাণ্ড গোঁফ, শাদা শার্ট খাকি হাফপ্যান্ট পরনে, পায়ে বুট জুতো। পেছনে হৈ হৈ চিৎকার। সরে যাও! সরে যাও! পাইকের দঙ্গল লাঠি নেড়ে ভিড় দুভাগ করে দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। রাজবাড়ির পাঁঠা আসছে, নধর নিখুঁত কালো এক পাঠা প্রকাণ্ড এক কালো জ্যান্ত অসুরের বুকে, ওই সেই লখনা কামার, যে ইচ্ছে করলে একশো আট পাঠার মুণ্ড ক্রমাগত কোপে ধড়ছাড়া করতে পারে; আর লখনা এখন রাজবাড়ির লোক, পেছনে গরদের শাড়ি পরে স্বয়ং রানীদিদি, ‘মালকান্ (মালিকানী) তিনি, আবার রাজবাড়িতে পুজোপার্বণ শুরু তাঁর আমলে, রাজা বাপটি ছিলেন মেলেচ্ছ কেরেস্তান, মোচলমানের বাড়া, আকাশ থেকে দেবতা নেমে সুদর্শন চক্করে ধড়-মুণ্ডু গঙ্গার এপার-ওপার করেছিলেন। আহা! আবার কতকাল পরে রাজবাড়ির পাঁঠা খাচ্ছেন বাবা বুড়ো শিব– ‘শিবো নামে পুইনন্যা করে বোল, শিবো বো-ও-ল! গর্জন হল দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চৌগুণ –ঢাকের ঝাঁক গর্জাল ঢ্যাঙা ঢ্যাঙ ঢাঢং ঢ্যাং, ভক্তবৎ তাবৎ প্রজাসাধারণ, ভুলুণ্ঠিত, কী অদ্ভুত মায়া! রানীদিদির নাকটি খাড়া, কোটরগত চোখে জ্যোতি, গায়ের বরন সোমলতার মতো, এলো চুলের দুধারে দুই জবাফুল গোঁজা, একটু পরেই মধ্যে পরবেন ওই রাজপাঠার রক্ততিলক– আহা, কতকাল পরে কত-কা-ল স্মরণ হয় না! রানীদিদির শীর্ণ শরীরে পিচ্ছিল গরদ, দুই বাহু অনাবৃত এবং পীত, দুহাতে বুকের কাছে রুপোর প্রকাণ্ড রেকাবে নৈবেদ্য, পাশে প্রত্যাবর্তিত রকের পামশাই, গেরুয়া বসন ও উত্তরীয়, কণ্ঠদেশে রুদ্রাক্ষ, কমণ্ডলুতে গঙ্গাজল– ‘হা গো ঠাকুর এতদিন কতি ছিলেন গো এই ব্যাকুল প্রশ্ন চোখে-চোখে দীপামান! ‘অফসরবাবু নির্নিমেষ দর্শন করেন রূপ অথবা মায়া এবং দূরে সরে যান। ঘিনজি দোকানপাট, আড়ত, ঘরবাড়ির ভেতর দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন। ডাইনে গঙ্গা বা পদ্মা, জেলেবসতি, তারপর বেড়াঘেরা জঙ্গুলে বাগান। মধ্যিখানে একতালা জরাজীর্ণ দালান। বারান্দায় খাঁটিয়া। আসন্ন সন্ধ্যার ছায়ার ভেতর খাঁটিয়াটি শ্মশানের বলে ভুল হয় এবং শায়িত মানুষটিকে মনে হয় মড়া। মড়া জ্যান্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, কে?

‘অফসারবাবু’ টুপি বগলদাবা করে বারান্দায় উঠে আস্তে বলল, আমি ছবিলাল।

গোবিন্দরাম তাকে দেখছিলেন। তারপর উঠে বসলেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন, বসো।

আপনি কি অসুস্থ?

হাঁপানি। গোবিন্দরাম একটু পরে ফের বললেন, আসা ঠিক হয়নি। তোমার চেহারা লুকোবার নয়, তুমি জান না!

‘ছবিলাল’ বলল, রত্নময়ীকে দেখলাম –পুজো দিতে যাচ্ছে।

হিন্দুর সংস্কার। এ তুমি বুঝবে না– তোমাকে বলেছিলাম!

আমি ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলাম!

গোবিন্দরাম আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, কেন?

আমার কিছু কথা ছিল।

আমাকে বলতে পার, আমি সে-কথা পৌঁছে দেব। আমি রাজবাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছি, তাহলেও অসুবিধা হবে না। মুন্সিজির মারফত

সে-কথা মুখোমুখি রত্নময়ীকেই বলার।

গোবিন্দরাম হাসবার চেষ্টা করলেন। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হল। বললেন, শফি! হতভাগিনী, মেয়েটা একটা আশ্রয় পেয়েছে এতদিনে। তাকে আশ্রয়চ্যুত করা উচিত নয় তোমার।।

শফিও হাসল। বলল, সে-কেমন আশ্রয় যে আমাকে দেখলেই তা ধসে যাবে?

তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সে তোমাকে দেখলে কষ্ট পাবে। কারণ হয়তো সে–

বলুন!

আমার ভুল হতেও পারে, কিন্তু তোমার মধ্যে একটা কী আছে, প্রচণ্ড চুম্বক! তুমি জান, তোমার নামে গ্রামে-গ্রামে অদ্ভুত সব গল্প চালু আছে? হয়তো বীরপূজা মানুষের সহজাতবৃত্তি। এইসব বীরমানুষরা সেই সুযোগ নিয়ে দস্যুতা করেছে, কেউ রাজা, হয়েছে। তোমার সঙ্গে তাদের একটা বড়ো তফাত– তুমি বাসনাহীন, উদ্দেশ্যহীন। অকপট।

তাহলে রত্নময়ীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে ভয় কিসের, গোবিন্দবাবু?

ভয় তোমার জন্য নয়, তার জন্য। সে সত্যিই মানসিক বিকারগ্রস্তা। সেজন্য মনে হয়, একমাত্র ধর্মের আশ্রয় ছাড়া তার বিকার ঘুচবে না। কিন্তু সবে সে মন্দিরের সোপানে পা রেখেছে, তাকে কিন্তু ডেকো না, শফি!

শফি চুপ করে থাকল। গোবিন্দরাম খাঁটিয়ার তলা থেকে লণ্ঠন বের করলে সে বলল, থাক। আমি যাই।

কিছু খাও। একটু বিশ্রাম করো। রাত হলে যেও। বলে গোবিন্দলাল শলাইকাঠি হুকে লণ্ঠন জ্বেলে ঘরে ঢুকলেন। একটু পরে পাথরের থালায় ভিজে চিঁড়ে, গুড়, দুটি পাকা কলা নিয়ে এলেন। বলেন, রাতে আমি কিছু খাই না। তাই এগুলোই খাও!

শফির খিদে পেয়েছিল। দ্রুত খেয়ে ফেলল। ঘটি মুখের ওপর তুলে জল ঢেলে দিল গলায়, যা মুসলমানরা অনভ্যাসে পারে না। কিন্তু সে হিন্দু জীবনে অভ্যস্ত। আঁচিয়ে এল উঠোনের কোণে। কিন্তু গোবিন্দরাম তাকে থালাটি ধুতে দিলেন না। শফি মৃদু হেসে বলল, ব্রহ্মপুর আশ্রমে আমরা যে যার থালা ধুয়ে রাখতাম!

গোবিন্দলাল বললেন, তোমার পক্ষে দরখাস্তে হৃদয়লাল শাস্ত্রী স্বাক্ষর দেননি। জান? দেববাবু তো কলকাতায় থাকেন। শুধু মাঘোৎসবে আসেন! তবে উদ্দেশ্য খাজনা আদায়।

শফি বলল, কিসের দরখাস্ত?

তুমি জান না? বারি চৌধুরি উকিল, জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান গাজিসাহেব, হরিণমারার জমিদার বিজয়েন্দুবাবু, আরও অনেক লোক তোমার নির্বাসনদণ্ড প্রত্যাহারের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। রত্নময়ীও সই দিয়েছিল। শুধু তোমার

উঁ? শফি ভুরু কুঁচকে তাকাল!

গোবিন্দবাবু আস্তে বললেন, পিরসাহেব সই দেননি। আমি গিয়েছিলাম, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। উকিলসাহেবকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, শফি হিন্দু। তাই মুর্দা (মৃত)। কিন্তু আমরা জানি, তুমি কী।

শফি বলল, উঠি। একটু পরে বেরিও।

না। এখনই যেতে হবে। বলে শফি একমুহূর্ত ইতস্তত করল। বলল, আমি বহু বছর থেকে কারুর সামনে নত হই না। প্রণাম করি না। কিন্তু আপনাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে।

গোবিন্দরাম দ্রুত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার প্রণামযোগ্য নই। তুমি বয়সে বড়ো হলে আমিই তোমাকে প্রণাম করতাম।

শফি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বারান্দা থেকে বেগে নেমে গেল। বেড়া পেরিয়ে গিয়ে শোলার টুপিটি ফের পড়ল। সে গাজনতলায় গেল। তখনও বলিদান চলেছে। কিন্তু রত্নময়ী নেই। তার পাইকরা নেই। খুঁটিতে-খুঁটিতে মশাল জ্বলছে, আর সেই দপকে-ওঠা আলোয় মাতাল বিশৃঙ্খল ভিড়, হাজার-হাজার বছরের পুরনো মন্দির দেয়ালের টেরাকোটা খণ্ডগুলি থেকে ছিটকে-পড়া মূর্তিগুলির নড়াচড়া –রাত নিশুতি হলে যারা ফিরে যাবে দেয়ালের গায়ে চতুষ্কোণ, স্তরবদ্ধ, পৌরাণিক চরিত্রসমূহের জোটে, অতীতে। আশ্চর্য এদের মধ্যে কিছুক্ষণ আগে রত্নময়ীও ছিল! বিমূর্ত, ধূসর, অথচ একটি চোখেপড়ার মতো গঠন, দেশজ শৈলী-বহির্ভূত বর্ণিকাভঙ্গে ধৃত সেমিতীয় আদল কীভাবে যেন অনুপ্রবিষ্ট অথবা আরোপিত হয়েছিল ওই হিন্দু টেরাকোটায় এবং ক্রমশ সময়ের প্রহারে জর্জবিত হতে-হতে বেরিয়ে পড়ল আদি রূপ এবং সেও যুথের অনুগামী হল, নেমে এল প্রাচীন দেয়াল থেকে জীবন্ত হয়ে– ভাবলে বিস্ময়কর! মুন্সি আবদুর রহিম! আপনারই কারচুপি সবই –সেমিতীয় আদল আরোপকাবী ওহে বুড়ো ক্রান্তদশী, এবার দাডি ছিড়ন, নিজের গালের থাপ্পড। মারুন, আপনার সেমিতী নমস্যকে বলুন, ‘এ কী হৈলা বাপা?’ শফি নিঃশব্দে হাসতে-হাসতে ভিড় ঠেলে হাঁটছিল। Love begins in shadow, ends in light?

রাজবাড়িব উত্তরের ফটক খোলা ছিল। দুধারে দুটি কাঠের খুঁটির মাথায় চৌকো কাঠের ভেতর বাতি জ্বলছিল। দারোয়ানটিকে চেনে শফি। তার নাম মুঙ্গেশ্বর সিং, দ্বারভাঙ্গার লোক, ভাংখোর। গাজনের দিনে ফটকের লাগোয়া ঘুপচি ঘরে খাঁটিয়ায় বসে প্রচুর ভাঙের শরবত খেয়ে পেট ঢোল করেছে, ঢুলছে, শফির মনে পড়ল, গোবরা হাড়ি কতবার কৃষ্ণপুর রাজবাড়িতে যখন-তখন ডাকাতি কত ‘তুচ্ছ কম্ম’ বলে বর্ণনা করেছে, ‘তমে কথা কী জানেন ঠাকুর? মৌলাহাটের পিরছায়েরের পোয্য চ্যাড়াগুলিন আজবাড়ি পাহরা দ্যায়, উদের সঙ্গেতে আঁটা কঠিন– ক্যানে কী, উয়ারা তো হেঁয়া ঠাকুরমশাই! ছেঁয়ার শরীলে কোপ মারা যায় না গো! নৈলে পরে অ্যাদ্দিন কবে –হুঁ হুঁ……’ অদ্ভুত হাসে গোবরা ডাকাত।

ডাকাত! ডাকাতরাও ঘর বাঁধে স্ত্রীলোক নিয়ে। প্রেমিক হয়। পিতা হয়। সন্তানের মুখে চুমু খায় স্নেহে। এ মুহূর্তে বড়ো অবাক লাগে ভাবতে। Oh! faciles nimium qui tristia crimina caedis/Flumina tolli posse putatis aqua!

ম্যানেজারবাবু নাকি?

অন্ধকার থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল শুকনো ফোয়ারার কাছে। শফি বলল, মুন্সিজি!

কে? কে আপনি?

ছবিলাল।

কিছুক্ষণ পরে মুন্সি আবদুর রহিম কাছে এলেন! রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বললেন, কী চাই?

আপনার জহরত-আরাকে।

বেশরম!

তাকে খবর দিন, আমি এসেছি।

চলে যাও। নৈলে দারোয়ান ডাকব।

খবর দিন রত্নময়ীকে, আমি এসেছি।

কণ্ঠস্বর শুনে মুন্সিজি একটু ভয় পেলেন। আস্তে বললেন, কেন–কী দরকার?

প্রশ্ন করবেন না, খবর দিন।

কেন, আগে বলো!

জানতে চাইবেন না। সবকিছু জানতে নেই। বেশি জানতে চাইলে মাথা খসে যায়! মুধা ব্যপপ্ত! মুন্সি আবদুর রহিম খাসক্লিষ্ট স্বরে গর্জন করলেন, বলতে হবে! কেন এসেছ তুমি? কিসের জন্য?…. তারপর সত্যিই তাঁর মুঙুটি খসে পড়ল ফোয়ারার বেদীর নীচে। শুকনো ঘাসে রক্ত উপচে পড়ল। চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে ধাবিত হওয়ার দরুন ১৯১৩ খ্রীস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল রাত ৮-১০ মিনিটে এক সেমিতীয় বৃদ্ধ দার্শনিক শহীদ হন।…..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *