১৩. শনশন শব্দ

‘হুঁশিয়ার রাত যখন কালো বোরখায় ঢাকে
দিনকে / আর হুঁশিয়ার যখন স্পষ্টতা
আবছায়া হয়ে যায় / আর হুঁশিয়ার
রাতে যা কিছু ভাবতে থাকো / শয়তান
সে তো অশরীরী / তাই।
হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…..’

শনশন শব্দ করতে-করতে বাইরে একটা হঠাৎ-আসা বাতাস চলে গেল। তারপর গাছপালায় শব্দ, পানিতে শব্দ, কতক্ষণ ধরে ফিশফিশ, চাপা হাসি বা কান্না– কিংবা এরকম কিছু গোপনীয় মানবিক আর্তি, আর চক্রান্তের আভাস চারিদিকে, তখনও পেছনদিকের সবচেয়ে উঁচু তালগাছে বাগড়ায় খড়খড় ঝাঁকুনি, বাদশাহি সড়কের ধারে অশথগাছটায় ক্রমাগত পতপত করে পাতাগুলোর ধারাবাহিক অস্থিরতা, কিছু কি ঘটতে চলেছে, কিছু কি সত্যিই ঘটবে, কান পেতে থাকি। অপেক্ষা করি। আবার শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো চারদিকে হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…! প্রতিটা রাত আসে আর এই হুঁশিয়ারি শুনি। ফারসি ‘হুঁশিয়ার-নামা’ কেতাব বুজিয়ে লানটিনের দম কমিয়ে দিলাম। এবার জানালার বাইরেটা কিছু স্পষ্ট হল। জ্যোৎস্না ঝলমল করছে দীঘির জলে! ইচ্ছে হল শানবাঁধানো নতুন ঘাটে গিয়ে বসি। কিন্তু উঠতে গিয়ে এতক্ষণে কানে এল কারা চাপা গলায় কথা বলছে। ঘঁ, কথা নয়, তকরার। নুরুজ্জামান খুব তর্ক করে বটে। আর বড়োগাজিও তাই। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেওবন্দির সঙ্গে আলিগড়ির বাহাস (তক) চলেছে। সড়কের ধারে ঘোড়াটার একটা রেকাবে পা রেখেও বড়োগাজি বলছেন, যাই বলুন মৌলবিসাহেব, আপনার ওই ঢাকার নবাব মস্ত ভুল করছেন। হা….আশরাফ আতরাফ আমি মানি। তাই বলে বাঙ্গলার আশরাফের জবান হবে উরদু, এটা আমি মানি না। নুরুজ্জামান বলল, আপভি ভুল করছেন গাজিসাহেব। আতরাফ নেহি, আজলাফ বলিয়ে। বড়োগাজি ঘোড়ার পিঠে বসে বললেন, ঠিক আছে। আজলাফ বলুন কী আতরাফ বলুন, এরা এদেশের লোক। আশরাফরা আরব-পারস্য থেকে এসেছে ঠিকই। কিন্তু এখন তারা এদেশের লোক কি না? মুসলমান যে দেশে গেছে, সে দেশের জাবানেই কথা বলেছে। এলেম শিখেছে। বড়োগাজি হাসতে লাগলেন ।…আর আপনি মওলানা মোহাম্মদ কাসেম সাহেবের কথা বললেন। ওঁরা তো ওহাবিদের মতো এদেশকে ‘দারুল হরব’ (শত্রুর দেশ) বলেছেন, এমন-কি এদেশের জুম্মার নামাজ নাজায়েজ (অসিদ্ধ) বলে ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্ত মওলানা কেরামত আলি সে-ফতোয়া নিয়ে বাহাস করে বলেছেন, এ ফতোয়া দেওয়াই নাজায়েজ! নুরুজ্জামান টিট হয়ে গেল। বলল, ফির বাত করেঙ্গে। বহত রাত হয়ে গেল। হোশিয়ারিসে যাইয়ে গাজিসাহাব। বড়োগাজি হঠাৎ তার তালোয়ার বের করে ফেললেন। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে উঠল তলোয়ার। চমকে উঠলাম। বড়োগাজি তলোয়ার দেখিয়ে বললে, জুলফিকার মৌলবিসাহেব! হজরত আলির তলোয়ার জানবেন! নুরুজ্জামান রাগ করে চলে গেল যেন। হজরত আলির তলোয়ারের নাম ছিল জুলফিকার! বড়োগাজি তার তলোয়ারকে জুলফিকার বলায় নুরুজ্জামানের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। তবে শিয়ারা শুনলে বড়োগাজির মাথা যেত। বড়োগাজির ঘোড়ার পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল। আমি হেসে ফেলেছিলাম। এই দুই নাদান বুড়বকের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে হাসি। কিন্তু আবার সব চুপচাপ। তারপর আবার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার –চারদিক থেকে। মনে মনে বললাম, হে কুলমখলুকাতের মালিক! হে আল্লাহ! এ বান্দা সবসময় হুঁশিয়ার। দুমাস হল, মসজিদের উলটোদিকে সড়কের এধারে এই ‘এবাদতখানা তৈরি করে দিয়েছে লোকেরা। মসজিদে থাকায় আমার খুব অসুবিধে হচ্ছিল। কিছুতেই একা থাকা যায় না মসজিদে। দিনভর এত লোক আসে! সে এক জুলুম বটে! শেষে কাতারে-কাতারে লোক হাত লাগিয়ে এবাদতখানা (ভজনালয়) বানিয়ে দিল। এখনও চুনের গন্ধ ঝাঁঝালো। অস্বস্তিকর এই গন্ধটা। আর আশ্চর্য, এই গন্ধটা কেন যেন আমাকে শফিউজ্জমানের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। কেন? পুকুরের ঘাটের মাথায় গিয়ে বসে ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ মনে হল, হ্যাঁ –খয়রাডাঙার স্কুলবাড়িতে নিজে তাকে ভর্তি করিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, তখন স্কুলবাড়িটা সদ্য চুনকাম করা হয়েছিল। ঠিক, ঠিক! শফির জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। দেওয়ানসাহেব নাকি এখনও ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিশ্বাস করি না। খালি মনে হয়, শয়তানের হাতে আমার ছেলেকে তুলে দিয়েছিলাম। আফসোস! লোকেরা আমার এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেন আমার মেজাজ এমন বদলে গেল, আস্তে শান্তভাবে কথা বলি, কাউকে তম্বি করি না আগের মতে, ঠোঁটে সবসময় হাসি ফুটিয়ে রাখি, এসব কেউ লক্ষ্য রাখে না! উঁচুতে উঠে গেলে যেন মানুষের সবটুকু চোখে পড়ে না নিচে থেকে। ওরা ভাবে, আমার ঘরগেরস্থালি নেই, স্ত্রী-পুত্র নেই, আমি অন্য এক মানুষ। অথচ আমার মধ্যে এইসব জিনিস আছে। টিকে থেকে গেছে সবকিছুই। সাইদার আহাম্মুকির শোধ নিতে আমি যদি নিকাহ করি, লোকের চোখে ছোটো হয়ে পড়ব, এই ভয়। ওরা ভাববে, তাহলে বুজুর্গেরও খাহেস (কামনা-বাসনা) আছে? আসে নাদান বেঅকুফ! পবিত্র কেতাবে বলা হয়েছে, চাষী যেমন তার শস্যক্ষেত্রের দিকে নয়, পুরুষ যাবে তার আউরতের দিকে। পবিত্র কেতাবে আরও আছে? ‘আউরত তার পুরুষের খাহেস পূর্ণ করতে সবসময় তৈরি থাকবে, যদি সে রজস্বলা না হয়। তাঁর ওই মুসলমান প্রতিদিন পাঁচবার নমাজের সময় হাত তুলে বলে, হে দয়াময়! আমাকে ইহলোক ও পরলোকের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো দাও’ সে কথাও ভেবে দেখতে হবে। ‘পুরুষ ও নারী পরম্পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’– এও পবিত্র কেতাবের কথা। স্রষ্টা আদমকে গড়েছিলেন। সে পুরুষ। তার বাঁ পাজরের হাড় থেকে বিবি ‘হবা’কে তৈরি করেছিলেন। কেন? বিবি হবাকে গন্দমগাছের ফল খাওয়ার জন্য শয়তান কুমতলব দিল। সাইদাকে শয়তান হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। তাকে বাঁচানো উচিত। কিন্তু কী করব? কদিন আগেও একবার ইচ্ছে হল, বাড়ি যাই। তারপর হঠাৎ মাথায় এল, জুম্মাবারে আমি খোবা (শাস্ত্রীয় ভাষণ) পাঠের সময় দৃষ্টান্ত দিয়েছিলাম। প্রেরিত পুরুষ একবার পুরো একটি চান্দ্রমাস স্ত্রীদের কাছ থেকে সরে গিয়ে একা মসজিদবাসী ছিলেন। সেই মাসটিতে উনত্রিশটি দিন ছিল। প্রেরিত পুরুষের খানদানে আমার জন্ম। কিন্তু আমি আল্লাহ এবং তার প্রেরিত পুরুষের একজন দীন সেবক মাত্র। কাজেই আমার এই সরে থাকার কাল আরও বেশি হওয়া দরকার।’….এই কৈফিয়ত দেওয়া জরুরি ছিল। ভেবেছিলাম প্রেরিত পুরুষের স্ত্রীদের নিয়েও যেমন মুসলমান নামধারী মোনাফেকরা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি রটাত, তেমন মোনাফেকের তো অভাব নেই। তারা গোপনে কেলেঙ্কারি রটাতে পারে, এই ভেবেই দৃষ্টান্তটি দিয়েছিলাম। তবে যা দেখছি, অনেক উঁচুতে উঠে গেলে নিচের লোকেদের তত নজর চলে না। অথচ আমার কষ্ট। আমার মনে খাহেস। তসবিহ জপে ভুল হয়। তখন মনে পড়েছিল ‘হুশিয়ারনামা’ কেতাবটির কথা। আমার চারদিকে তারপর থেকে হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…অথচ রাত নিশুতি হলে সেই হুঁশিয়ারির মধ্যও চাপা হাসি-কান্নার মনবিক আর্তি ভেসে আসে। কেই বা হাসে, কেই বা কাঁদে চুপিচুপি ভেবে পাই না। বুঝতে পারি না আমার কী করা উচিত। সারারাত ঘুম আসে না দুচোখে। খালি চিন্তা, উটকো সব কথা, গাছ থেকে পাতা পড়ার মতো কিছু খসে পড়ে, দমকা হাওয়া এসে পাতাগুলো ওড়ে, ছত্রভঙ্গ পায়রার ঝাকের মতো, আবছা, ফালতু কী সব কথা খালি কথা আর কথা, আর সঙ্গে সঙ্গে হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার। হুঁশিয়ার…পুকুরের পানিতে ঝিলমিল করে জ্যোত্মা কাঁপছে হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার! ওপারের কালো গাছপালার ভেতর গাঢ় ছায়ায় বসে শয়তান নজর রেখেছে হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার। আমার গা ছমছম করছিল। আমি এত একা! ‘আল্লাহ আমাকে শয়তানের হাত থেকে বাঁচাও!’ বারকতক এই কথাগুলো আবৃত্তি করাম। মাঠের দিকে শেয়াল ডেকে উঠল। গ্রামের দিকে কুকুর। তারপর রোদে বেরনো চৌকিদারের হাঁক ভেসে এল হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…অসহ্য।

.

ভেড়ার পিঠে টুপিপরা জিন

আমার খিদমতগার (সেবক) আলি বখশ সকালের খানা তৈরি করতে করতে বলল, হুজুরে আলা! একটা কথা শুধোব, তবে ডর লাগে। লোকটি বেজায় কালো, একটু কুঁজো, নিচের একটা দাঁত নেই। তবে না থাকলেও বোঝা যায় না। সারা জীবন দাঁতে মিশি ঘষে সব দাঁতই কালো। মিশি নাপাক (অপবিত্র) বলায় সে ওটা ছেড়েছে। তার বদলে জামালগোটার ডাল ভেঙে আমার মতো দাঁত মাজে। কিন্তু ওই নাপাক কালো রঙ আর ঘুচবে না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছি। তখন সে একটু বিব্রত হয়ে বলল, তাহলে থাক হুজুর, বলব না। একটু হেসে বললাম, না– তুমি বলল আলি বখশ। সে বলল, হজরত! (হজরত সম্বোধন আজকাল সবাই নুরুজ্জামানের দেখাদেখি করে থাকে, তবে আলি বখশের মুখে শুনে হাসতে লাগলাম। সে আরও ঘাবড়ে গেল।) বলল, খাতাহ (ত্রুটি) মাফ করবেন হুজুরে আলা! আমি নাদান আদমি। একটু আগে সে বাদশাহি সড়কের দিকে উৎসুক দৃষ্টে তাকাচ্ছিল আর পরোটা সেঁকছিল। সড়কে একপাল ভেড়া যাচ্ছিল। এখান থেকে এখনও দেখা যাচ্ছে পালটাকে। খুব ধুলো উড়ছে সড়কে। আমার বুঝতে দেরি হল না যে ভেড়া সম্পর্কে তার কী জিজ্ঞাস্য। বললাম, আলি বখশ! তুমি কি জানতে চাইছ, ভেড়াগুলোর পিঠে আমি জিনদের দেখতে পাচ্ছি কি না? দারুণ চমকে আমি বখশ হাঁ করল। ওর জিভটা দেখা যাচ্ছিল। ফের বললাম, আলি বখশ আমি জিনগুলোকে দেখতে পাচ্ছি। ওদের মাথায় টুপি আছে। শাদা গোল আর আঁটো টুপি। আলি বখশ খুব খুশি হল একথা শুনে। বলল, হজরত! আমার দাদো (পিতামহ) ছিল সামান্য লোক। সে ছিল জিনের রোজা! তার মুখে শোনা কথা। জিন ভেড়ার পিঠে চাপতে ভালবাসে। বললাম, হ্যাঁ– জিনেরা এটা করে। কেন–বলি শোনন। ওই জিনেরা কমবয়সি। এটা ওদের খেলা। ওই দেখো আলি বখশ, ঘূর্ণি আসছে। ঘূণিটা ওদের বাবা। এবার দেখো, কী হুলুস্থুলু শুরু হল। বাচ্চা জিনেরা পালিয়ে যাচ্ছে ভেড়ার পিঠ থেকে। কয়েকজনের টুপি খসে পড়েছে। কুড়াচ্ছে!….পরোটার তাওয়া নামিয়ে আলি বখশ উঠে দাঁড়াল। আমি হাসতে লাগলাম। সে ব্যাপারটা দেখতে থাকল। তারপর কাঁচুমাচুমুখে ঘুরে বলল, হজরত! সত্যিই একটা মোজজা দেখালেন দীন বান্দাকে। আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম হঠাৎ। অন্যমনস্কভাবে ঘাটের দরজায় চলে গেলাম। আমি কি সত্যিই ভেড়ার পিঠে টুপিপরা জিন দেখি, যেন দেখি। সত্যিই এ একটা ধাঁধা। মনে পড়ে গেল, বহুবছর আগে একটা ভীষণ রুক্ষ এলাকার গ্রামে থাকার সময় এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। সে একটা নদী সম্পর্কে…

.

নদী, সিঁদুর, নারী

নদী। বদিউজ্জামানের ধারণায় নদীটি ছিল প্রাচীন। কিন্তু ঠিক কতখানি প্রাচীনতা তার উপযুক্ত, সে সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতেন। বিস্তীর্ণ রুক্ষ মাঠে সেই গ্রামের লোকেরা ছিল অলস, অকর্মণ্য, আড্ডাবাজ) অসংখ্য আব-সদৃশ নিচু ঢিবির বন্ধুরতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে-কাটিয়ে অতি সুকৌশলী এক লুপ্ত নদীর গতিপথ তাঁর চোখে আশাব্যঞ্জক অস্পষ্টতায় প্রতিবিম্বিত হত এবং তিনি শুধু এটুকুই বুঝতেন, এ হয়তো মরীচিকা নয় –যা তিনি দেখছেন বা দেখতে চান। কেন একটি প্রাচীন নদীর আকাক্ষার ভূত তাকে পেয়ে বসেছিল, তিনি জানতেন না। এমন নয় যে মৌলানা বদিউজ্জামান কোনো নদীতীরবর্তী দেশ থেকে উষর, বৃক্ষবিরল ওই গ্রামে নির্বাসিত হয়েছিলেন। নদী সম্পর্কে এ ধরনের মাথাকোটা আদিখ্যেতার অর্থ এও নয় যে, তিনি ইতিহাসবেত্তা ছিলেন, কিংবা জানতেন নদীর সঙ্গে সভ্যতার যোগ আছে। ইসলামি তহজিব-তমদুনের (সভ্যতা-সংস্কৃতি) বাইরে সব সভ্যতাই তো তাঁর কাছে ছিল বর্বরতা এবং ইসলামের অভ্যুদয় মরুমাটিতে! তিনি অপ্রকৃতিস্থ মানুষও ছিলেন। অথচ এই বন্ধুর মাঠের শাদামাঠা লৌকিক বাস্তবতার কোনো সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ওই অলৌকিক অশ্বডিম্ববৎ পরাবাস্তবতা ছত্রাকের মতো তাঁর সুরমা টানা চোখে গজিয়ে উঠেছিল, এও এক রহস্য। প্রথম দর্শনে, প্রতি বিকেলে দাঁড়িয়ে তাঁর খালি মনে হত, ওইখানে একটি নদী থাকলে ভালো হত অথবা ওইখানে সত্যিই একটা নদী ছিল। ক্রমশ নদীটি সম্পর্কে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যায়। ক্রমে ক্রমে মগরেবের (সান্ধ্য) নামাজের পর ওই পরাবাস্তবতাটিকে মাঠের সান্ধ্য কুয়াশার ভেতর গর্ত থেকে লেজ টেনে সাপ বের করার মতো টেনে আনতেন, তাকিয়ে থাকতেন আঁকাবাঁকা ছায়া-নদীটির দিকে। প্রায় পৌত্তলিক পটুতায় তাকে উদ্ধারের তাগিদ অনুভব করতেন। তারপর ধূসর গোধূলির পটভূমিতে প্রতিভাসিক বক্ররেখাঁটি তাঁকে শিহরিত করত, হঠাৎ আবিষ্কার করতেন সিঁদুরে আভা, আর সেই রেখার কোমলতা যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবেন এবং তৎক্ষণাৎ উদ্ধারযোগ্য স্রোতস্বিনীকে শয়তানের ইন্দ্রজাল ভেবে চোখ বুজে ফেলতেন। অথচ শয়তানের শিল্পকলায় সিঁদুরের উজ্জ্বলতা, কোমলতার কোলাহল, আর স্নিগ্ধতার অনুপুঙ্খময় চাপে যেন বা একটি স্ত্রীলোক– তওবা! নাউজুবিল্লাহ!

.

পিরের সাঁকো, আবদুল কুঠোর বউ

সে অবশ্য একটা ব্যর্থতা। পরে –অনেক পরে এক নিশুতি রাতে মনে পড়েছিল, কী ঘটেছে। মরহুম আব্বার (স্বর্গীয় পিতা) সঙ্গে ছেলেবেলায় যেতে-যেতে একটি নদীর ধারে একটি বীভৎস ঘটনা দেখি। একজন হিন্দু স্ত্রীলোককে তার স্বামীর চিতায় বসিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে….হ আল্লাহ! আব্বা আমার চোখে তাঁর পাক (পবিত্র) হাত ঢাকা দিয়ে বলেন, উধার মাত তাকাও। তার আগেই আমি দেখে নিয়েছি। যুবতীটির সিঁথিতে দগদগে সিঁদুর ছিল। সাইদাকে গল্পটা যখন বলি, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ঠেছিল। সেই সাইদা আজ….

আলি বখশ এসে বলল, হজরত! আমি খানা তৈরি করলাম। এদিকে এক কান্ড দেখুন। মাঝলা (মেজো) বউবিবি হুজুরের জন্য নাশতা পাঠিয়েছেন। বললাম, তুমি খেয়ে নাও। আলি বখশ তবু দাঁড়িয়ে রইল। রাগ করে বললাম, যা বলছি, তাই করো আলি বখ। সে গলার ভেতর বলল, মাঝলা মিয়াঁসায়েব দাঁড়িয়ে আছেন। হজরত! ঘুরে দেখি লাঠিতে ভর দিয়ে মনিরুজ্জামান এবাদতখানার দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে একটা নেংটির মতো গামছাপরা আদুড়-গা ছেলে। সেই রাখাল ছেলেটা! সে আমাকে দেখে হি-হি করে হাসতে-হাসতে পালিয়ে গেল। ওই ছেলেটা সাইদার গাইগোরুটি চরাতে নিয়ে যায় দেখেছি। আমাকে দূর থেকে দেখেই বেআদবি করে –হাসে। একদিন আলি বখশ তাড়া করেছিল ওকে। মনিরুজ্জামান তাকাল। তাকে ধমক দিয়ে বললাম, কেন এসব এনেছ? বাড়ি নিয়ে যাও, বলছি। মনিরুজ্জামান গোমড়ামুখে নড়বড় করতে-করতে চলে গেল। তার উদ্দেশে ফের বললাম, বলেছি–তোমরা কেউ আমার এবাদতখানায় খানা পাঠাবে না। তবু কেন এসব কর? এবাদতখানার সীমানায় আমার হুকুম আগে না নিয়ে কারুর আসা বারণ। আলি বখশকে খুব বকাবকি করলাম। সে কাঁচুমাচু মুখে তিনদিকঘেরা পাকশালার দিকে চলে গেল। আমার খানা রেশমি কাপড়ে ঢেকে রেখেছে এবাদতখানার বারান্দায়। খেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কেনই বা খাব না? আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের জন্য রোজ রজি মেপে দেন। এ আমার প্রাপ্য। খেতে-খেতে দেখলাম, আলি বখশ এদিকে পিঠ রেখে বসে খাচ্ছে। সাইদা কিংবা সত্যিই মেজবউবিবি কী নাশতা পাঠিয়েছে, জানতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আলি বখশের খাওয়ার ভঙ্গিতে যেন লুকিয়ে খাওয়া চোরাগোপ্তা জানোয়ারের আদল, একটি বেড়াল অথবা একটি কুকুর চুপিচুপি ঝোঁপের আড়ালে কিছু নিয়ে গিয়ে যেভাবে খায়। নাউজুবিল্লাহ! এসব আমি কী ভাবছি? খাওয়া শেষ করেও কতক্ষণ আলি বখশের খাওয়ার ভঙ্গিটি বিরক্তিকর স্মৃতির মতো আমাকে মাঝে-মাঝে খোঁচা দিচ্ছিল। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ ধ্যানে বসলাম। কিন্তু মন বিক্ষিপ্ত। হরিণমারার ছোটোগাজির দেওয়া দিওয়ান-ই-হাফিজের পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে এলাম তাক থেকে। খুলতেই চোখ গেল ।

‘জে পাদ্‌শাহ ব জুদা ফারিগম ব হম্‌দ্‌ ইল্লাহ্‌
জুদা এ খাকে দরে দোস্ত পাদশাহে মন্ অস্ত…’

‘উপাস্যকে প্রশংসা! বাদশাহ থেকে আমাকে ফারাক করেছেন / দোস্তের দরজার ধুলোই এখন আমার বাদশাহ। মারহাবা! শাবাশ! কিন্তু কোথায় আমার দোস্ত আর দরজা? উপাস্য আল্লাহ কি এ বান্দার দোস্ত হতে পারেন, তাঁর দোস্ত শুধু প্রেরিত পুরুষ। আমি বেঅকুফ ফরিদুজ্জামানের মতো সুফি নই, আমার সহোদর ভাই ছিল ফরিদুজ্জামান। সে নিজেকে বলত ‘মাশুক’ (প্রমিক)। তার মাথায় মেয়েদের মতো লম্বা চুল ছিল। সে গান গাইত। নাউজুবিল্লাহ। তার চুল কেটে জুতো মেরে ভাগিয়ে দিয়েছিলাম তার জঙ্গলের আস্তানা থেকে। আমার বুকে হাতুড়ির ঘা পড়ল। আমার সহোদর ছোটো ভাই! কোথায় আছে সে এখন? বেঁচে আছে না মরে গেছে? তাকে সামনে পেলে জেনে নিতাম আল্লাহের মাশুক হওয়ার যোগ্যতা কি প্রেরিত পুরুষ ছাড়া অন্য মানুষের সত্যিই আছে? বারান্দায় কাশির শব্দ। তারপর আলি বখশ মৃদুস্বরে বলল, আনিসুর রহমান এসেছেন হুজুরের কাছে। বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেলাম। এবাদতখানা ঘরের ভেতর কাউকে ঢুকতে দিই না। আনিসুর নিচে প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে প্রথমে ‘আস্-সালামু আলায়কুম’ সম্ভাষণ করল। সম্ভাষণের জবাব দিলে সে বলল, হজরত। কুঠো আবদুলের বিবিকে নিয়ে ঝামেলা বেধেছে। আবদুল মরার পর সে ডাহিন (ডাইনি) হয়েছে। নদীতে পিরের সাঁকোর কাছে রাতে নাঙ্গা (উলঙ্গ) হয়ে চেরাগ জ্বেলে হিন্দুদের মতো পুজো করে। অনেক লোক দেখেছে। এবারে একটা ব্যবস্থা না করলে আমাদের মান থাকে না। হানাফি-গাঁয়ের লোকে তামাশা করে। বলে, তোমাদের পিরসাহেবের কুদরতি (লীলমাহাত্ম্য) এবার দেখাও! হুজুর হজরতে আলা! আপনিই মৌলাহাট ফরাজি-জমাবে সর্দার করেছেন আমাকে। তাই আপনার হুকুম ছাড়া কিছু করব না। আনিসুরের কথা শুনতে-শুনতে পুকুরের ওপর দিয়ে নজর পাঠিয়ে দিলাম উত্তর-পশ্চিম দিকে দূরে নদীর পুরনো সাঁকোটির দিকে। একটা ঘূর্ণি বয়ে যাচ্ছে সেদিকে। ধুলো, খড়কুটো, ছেঁড়া শুকনো পাতার ঝক– জিনেরা পাগড়ির মতো। কোনো কালাজিনই হবে.! আনিসুর বলল কী? ওর প্রশ্নবোধক সম্ভাষণে আস্তে আস্তে বললাম, আউরতটির নাম কী যেন? আনিসুর বলল, ইকরা –ইকরাতন।, ‘ইকরাতন’ মানে আবৃত্তিকারিণী। দূরের ভাঙা পোড়ো সাঁকোর কাছে ‘আবৃত্তিকারিণী’কে আবার সেদিন দেখেছিলাম। বললাম, আপনাদের কিছু করতে হবে না আনিসুর রহমান! আমি দেখছি। বলেই ঘরে ঢুকে গেলাম। বাইরে আনিসুর আর আলি বখশ চাপাস্বরে কীসব বলাবলি করতে থাকল। আমি উত্তরের জানালার ধারে গিয়ে আবার কালো সাঁকোর থামগুলো দেখছিলাম। তারপর চমক খেলে গেল। ঝড়বৃষ্টির রাতে সাইদার কাছে গেলে সে আমাকে বলেছিল, ইকরাতনের দিকে আমার নজর পড়েছে। দ্রুত আবৃত্তি করলাম :

‘হাসানুল্লাহ নি’মাল আকিলু!
আলাল্লাহি তাওয়াকাল্‌না—’

বালা-মুসিবতে (অস্বাস্থ্যে ও বিপদে) এই পবিত্র বাক্যটি পাঠ করার নিয়ম! সেই ঘূর্ণি হাওয়াটি এখন কালো পুরনো থামগুলিকে ঘিরে ফেলেছে। আমার নজর খুলে যাচ্ছে। একটি কালো থামের গায়ে দগদগে লাল সিঁদুরের ছোপ এতদূর থেকে দেখতে পাচ্ছি– নাকি দেখতে চাইছি বলেই দেখছি? আল্লাহ জানেন আমার চোখের কী ক্ষমতা তিনি দিয়েছেন। কালো থামের মধ্যে চেহারা নিচ্ছে একটি স্ত্রীলোক, নাঙ্গা আউরত সিঁথিতে সিঁদুর, আর ওই নদী, চিতার মতো দাউদাউ রোদ, আব্বার পবিত্র হাত আমার চোখ ঢেকে দিক। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি বিগড়ে গেল কি? অথবা প্রকৃতই একটি মোজেজা দর্শন করলাম। বিবি ইকরাতন কি হিন্দু স্ত্রীলোক? তাকে কি আবদুল কুঠো ভাগিয়ে এনেছিল তার স্বামীর চিতা থেকে? আবদুল শুনেছি দুর্ধর্ষ ডাকু ছিল। আমি বেরিয়ে গিয়ে দেখি, আনিসুর তখনও দাঁড়িয়ে। বললাম, ইকরাবিবি কি হিন্দু আউরত ছিল, জানেন? আনিসুরের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। গাঢ় স্বরে বলল, হজরতে আলা! আপনার অজানা কিছু নেই। আপনি যা বলছেন, তা এবার সত্যি হল। কেননা, আমরা শুনেছি, আবদুল তাকে কোত্থেকে ভাগিয়ে এনেছিল। এও শুনেছি, সে নাকি হিন্দু আউরত। বাম্ভন (ব্রাহ্মণ) ঘরের বেটি। শুনে শুধু বললাম, দেখছি।….

.

হাম্মালাতাল্‌ হাতাব্‌

পবিত্র কেতাব সুরা (অধ্যায়) ‘লাহাবের’ শেষ বাক্যটি আজকাল যখন-তখন মনে ভেসে আসেঃ ‘হাম্মালাতাল্‌ হাতাব্‌।’ যে-স্ত্রীলোকের কাঁধে খেজুরপাতার আঁশ দিয়ে তৈরি দড়ি ঝুলছে। প্রেরিত পুরুষের এক আত্মীয় আবু লাহাবের স্ত্রী ছিল কাঠকুড়োনি মেয়ে। আবুলাহাব হাত দিয়ে আঘাত করেছিল প্রেরিত পুরুষকে। সে অভিশপ্ত। আর তার কাঠকুড়োনি স্ত্রীও অভিশপ্ত। কারণ সে ছিল কুৎসাকারিণী। জানালা দিয়ে পুকুরের ওপারে কাঁধে দড়িঝোলা এবং হাতে-কাটারি ইকরাকে দেখে বাক্যটি ভেসে এল। বাক্যটি স্থির হয়ে ভাসছিল চোখের সামনে। কাঁপতে-কাঁপতে ছত্রখান হয়ে মিলিয়ে গেল। আজকাল আমাকে বাইরে বেরুনোর নেশা এসে জুলুম করে। কিন্তু বেরুলেই ভিড়। জীবনের এতটা সময় আমি যেখানেই থেকেছি, ইচ্ছেমতো বাইরে ঘুরেছি, কেউ নজর রাখত না বিশেষ। এমন অবস্থা দুর্বিষহ। প্রতিদিনই সড়কে কাতারে-কাতারে লোক এসে জড়ো হয় দোয়া মাঙতে, দোয়াপড়া জল নিতে, কবচ-মাদুলির আশায়। জুম্মাবারে সে এক অদ্ভুত অবস্থা। হাজার-হাজার মানুষ! গোরুমোষঘোড়ার গাড়ি, পালকি, চারদোলা, দুদোলা– কতরকম বাহন। সেই অসহ্য ভিড় থেকে বাঁচতে এই এবাদতখানা! আজ হঠাৎ পুকুরের ওপারে ওই ‘হাম্মালাতুল হাতাব্‌কে’ দেখে মনে হল, জীবনের কোনো একটা সময়ে প্রয়োজন আসে, জরুরি হয়ে ওঠে, প্রতিটি জায়গায় তন্নতন্ন তল্লাস। তল্লাস করো কোন্ জায়গাটিতে তোমার বাসভূমি হওয়া উচিত। কিন্তু কী তাজ্জব, কথাটা এখন কেন ভাবতে বসলাম? এতকাল কি এই কাজটাই করে বেড়াইনি? অথচ দেখো, বদিউজ্জামানের তল্লাসি জিন্দেগানিতে আবার নতুন তল্লাসি পরোয়ানা হাজির। এই এবাদতখানাও তোমার যেন প্রকৃত বাসস্থান নয়। আমার চিন্তা আমাকে ঘুরিয়ে মারছে এবাদতখানার চারদিকে অনেক দূর।

‘ম্যায় হুঁ বাদশাহ্‌ যিত্‌না দূরোঁতক জরিপ ক্যরে/
মুঝ্‌কা দখলদারি কৈ না বরবাদ কার শ্যাকে/–‘

জানালা বন্ধ করে দিতে গিয়ে পারলাম না। বেরিয়ে গিয়ে পুকুরের ঘাটে দাঁড়ালাম। ‘হাম্মালাতুল হাতাব্‌’ জঙ্গলের ভেতর থেকে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাকে দেখছে। নীল জ্বলজ্বলে চোখ! ওকে কি তাড়া করব এখন? ময়ূরমুখো আবলুস কাঠের ছড়িটি ছুঁড়ে মারব? পুকুরের ওপর দিয়ে ছুটে যেতে পারবে কি এই ‘আসা’ (ছড়ি)? হজরত মুসা –তিনিও এক প্রেরিত পুরুষ, তাঁর আসা দিয়ে নীলদরিয়ার বুকে বাড়ি মেরেছিলেন আর দরিয়া দুভাগ হয়েছিল। আমি কি দেখব চেষ্টা করে? নাউজুবিল্লাহ! ওহাবিরা এসব মোজেজায় বিশ্বাসী নন। তাঁরা বলেন, আসা কথাটির আরেক মানে ‘গোষ্ঠী’। মুসা নীলদরিয়ায় ভাটা পড়ার সময় গোষ্ঠীসহ পালিয়ে গিয়েছিলেন মিশর থেকে কেনান মুলুকে। অথচ ওহাবি হয়েও আমি যেন মোজেজা দেখি। অলৌকিক ঘটনা অনুভব করি। আমাকে আল্লাহ কোন রাস্তায় নিয়ে চলেছেন? আমি যে সত্যিই পির বুজুর্গ হয়ে পড়লাম! বুকের ভেতর আর্তনাদ উঠল, আমি মানুষ! আমি মানুষ! নিতান্ত এক মানুষ!

আলি বখশ এসে খবর দিল, সড়কে একজন বিদেশী এসে আমার দর্শনের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ভুরু কুঁচকে বললাম, বিদেশী? কে সে? আলি বখশ বলল, জানি না হুজুর। মাথা ভাঙছে সে। বললাম, নিয়ে এসো। প্রাঙ্গণের কুলগাছটাকে কাটতে দিইনি। তলায় যেন কাঁটা না পড়ে, আলি বখশ সাফ করে রেখেছে। সেখানে। গিয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম,দুরু দুরু বুকে! শফির খবর নিয়ে এসেছে কি? তারপর দেখি, বিদেশী বলতে আলি বখশ একজন হিন্দুকে বুঝিয়েছে। একটু ইতস্তত করে বললাম, ভেতরে আসুন। গায়ে মেরজাই, মাথায় পাগড়ি, পরনে মালকোচ-করা ধুতি, এবং জুতো বাইরে খুলে রেখে তিনি ফটকে ঢুকছিলেন। এসে দুহাত জোড় করে একটু ঝুঁকতেই বললাম, আমাকে গোনাহগার করবেন না বাবু! আমি মানুষ। মানুষ মাথা নোয়বে শুধু পরমস্রষ্টার কাছে। বাবুটি একটু বিব্রত হেসে বললেন, আপনি সাধক পুরুষ পিরসাহেব! গোস্তাকি মাফ করবেন। অধীনের নাম গোবিন্দরাম সিংহ। আমি আসছি কৃষ্ণপুর থেকে। বাবু জমিদা: অনন্তনারায়ণ ত্রিবেদী আমাকে পাঠিয়েছেন। খত আছে। আস্তে বললাম, পড়ুন, শুনি। মেরজাইয়ের ভেতর থেকে ফারসিতে লেখা খত(পত্র) বাবুটি সুন্দর উচ্চারণে পাঠ করলেন : মাহাত্মপ্রদর্শনকারী। অলৌকিক কীর্তিধর পুরুষ, সাধু মুসলমান পিরের প্রতি তাঁর সবিনয় নিবেদন, তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা জিনের (ভূত) পাল্লায় পড়েছে বলে তাঁর বিশ্বাস। কারণ সে সম্ভবত আরবি ভাষায় অদ্ভুত কথাবার্তা বলে। অনন্তনারায়ণ ফারসি জানেন। আরবি শেখা হয়নি সুযোগের অভাবে। তা ছাড়া অধুনা আরবি-ফারসির বদলে বাঙলা-ইংরেজি ভাষার চর্চা দেশে প্রচলিত হয়েছে। মহানুভব মহাত্মা যদি এই ‘বান্দা’র প্রতি হুকুম জারি করেন, সে তার জিনগ্রস্ত কন্যাকে নিয়ে সাধুমহাত্মার সমীপে হাজির হবে।…

আজকাল হিন্দুরাও আমার কাছে আরজি নিয়ে আসেন। আমি একটু ভেবে বললাম, আলি বখশ! খতখানি নাও। আর বাবু, আপনি গিয়ে জমিদারবাবুকে বলুন, তিনি যখন খুশি হাজির হতে পারেন। আমি চেষ্টা করে দেখব। গোবিন্দরাম সিংহ আবার করজোড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেলেন। তারপর মনে হল, কেন আমি একথা বললাম বাবুটিকে? আলি বখশ খুশিমুখে খতটি হাতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল! নিঃশব্দে হাত বাড়ালে সে খতটি সসম্ভ্রমে দুহাতে তুলে আমাকে দিল! খুলে হাতের লেখা দেখে ভালো লাগল। আমার দাদাজির (পিতামহ) আমলে আংরেজশাহি ফারসি তুলে দিয়েছে। ফারসি ছিল দরবারি ভাষা হিন্দুস্তানে! জুলুমবাজ ‘নাসারা’ (ন্যাজারেথবাসী প্রেরিত পুরুষ ইসার অনুগামী, কিন্তু ইসলামি মতে পথভ্রষ্ট) হুকুমত। হুঁ, আসলে ফারসি খতখানি আমাকে অনন্তনারায়ণ সম্পর্কে আগ্রহী করেছে। খতখানি হাতে নিয়ে আবার পুকুরের ঘাটে সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মনে কেন এত অহংকার আজ? আংরেজশাহির আমলে এখনও একজন হিন্দু ফারসি খত লিখেছেন বলেই কি? মুখ তুলে দেখতে পেলাম সড়কের ধারে অশ্বখগাছের, তলায় একটি পালকি, কিছু লোক এবং বাবু গোবিন্দরাম বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি জানি, মেহমানির দাওয়াত দিলে বাবু বিব্রত বোধ করবেন। কিন্তু আল্লাহর কুদরত। (লীলা)! হিন্দু জমিদারবাবুর কন্যা আরবি জবানে কথা বলে আমার দেখা দরকার, জানা দরকার। জলের দিকে ঘুরে শিউরে উঠলাম। জলের তলায় নীল আসমান ভাঙচুর করে ঢেট কী খেলা দেখাতে চাইছে আমাকে? হাফিজ আবৃত্তি করলাম।

‘অ্যায় শাহানশাহে বুলন্দ্‌ আখতার খুদায়া হিম্মতে
ত-ব-বোসম্‌ হামেচো গর্দুন খাকে অ্যায়বানে শুমা..’

হে উচ্চতম রাজাধিরাজ! করুণা ভিক্ষা চাই যেন ওই আসমানের মতো তোমার উচ্চস্থিত আসনের ধুলো চুম্বন করতে পারি। তারপরই মনে পড়ে গেল, বাচ্চা শফিউজ্জামান তার মাকে হরবখত প্রশ্ন করত, মা পানির তলায় দুনিয়া আছে? বলো না মা, পানির তলায় সব উলটো কেন? তার মা বলত, উলটো মানুষদের দুনিয়া আছে– তোর আব্বাকে পুছ করিস! শফি আমাকে প্রশ্ন করতে সাহস পেত না। কিন্তু সত্যি বুঝি পানির তলায় উলটো মানুষদের দুনিয়া আছে! খুব মন নিয়ে লক্ষ্য করতে করতে ঢেউ থেমে গেল। পুকুরের পানির ভেতর খুঁটিয়ে দেখতে-দেখতে চারদিকে মাটি আর বৃক্ষলতার ভেতর একখানে আবিষ্কার করলাম– নাউজুবিল্লাহ! সেই হাম্মালাতুল হাতাব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কাটারি, কাঁধে রঞ্জু। মুখ তুলতেই আবার চোখাচোখি হল। নীল রোশনি ঠিকরে পড়েছে রাতের জানোয়ারের মতো! ডাকলাম, আলি বখশ! সে এলে বললাম, ওই বেশরম আউরত কে? বেপরদা হয়ে জঙ্গলে ঘুরছে, কে ওই খান্নাস (শয়তানের অনুচরী)? আলি বখশ বলল, হজরত! ওই সেই আবদুল কুঠোর বিবি। বললাম, ওকে ডেকে নিয়ে এসো। আলি বখশ কুণ্ঠিতভাবে বলল, হুজুরে আলা! ওর লজ, (কথাবার্তা) খুব খারাপ। গালমন্দ করবে। খুনখারাপি করতেও ওর ডর নেই। ছড়িটা হাতে নিয়ে পুকুরের দক্ষিণ পাড় হয়ে পুর্বপাড়ে, তারপর পেছনে পায়ের শব্দে ঘুরে দেখি, আলি বখশ আসছে। তাকে ধমক দিয়ে বললাম, এবাদতখানায় যাও বেঅকুফ। কুত্তা ঢুকবে! সে মুখ গোমড়া করে ফিরে গেল। উত্তরপাড়ে গিয়ে গিয়ে দেখি, ‘হাম্মালাতুল হাতাব মাঠের দিকে চলেছে। বারবার পিছু ফিরে দেখে নিচ্ছে আমাকে। এইসময় আচানক একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গিয়ে সে প্রায় নাঙ্গা হবার উপক্রম। আমি চোখ বুজে ফেললাম। নাউজুবিল্লাহ!….

.

মাটি, হায় মাটি!

এবাদতখানার দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তরে ডাঙা জমিগুলোর মালিক হরিণমারার হিন্দু জমিদার। নবারি মহলের ভেতর ছিটমহল। যেন চারদিক থেকে হিন্দুরা হাত বাড়িয়ে মুসলমানের মাটি কবজা করছে, আংরেজ-শাহি মদত দিচ্ছে। ছোটোগাজি বলছিলেন, কতকটা তাই। তবে নবাববাহাদুরও দুবলা হয়ে পড়েছেন। খাজনার দায়ে ছোট খাটো মহল নিলাম হয়ে যাচ্ছে। হিন্দু পয়সাওয়ালারা কিনে নিচ্ছে। যখন বললাম, এবাদতখানার চারদিকের মাটি আমার দরকার, কারণ এতিমখানা (অনাথ-আশ্রম) আর মেহমানখানা (অতিথিনিবাস) খুলতে চাই, তখন ছোটোগাজি খুশি হয়ে বললেন, আজই জমিদারবাবুকে গিয়ে বলব। তিনি আপনাকে খাতির-ভক্তি করেন বলে জানি। আমাকে একটা খোয়াব (স্বপ্ন) আচ্ছন্ন করেছে ইদানীং। দূর-দূরান্তর থেকে লোকজন আসে। তাদের থাকার ব্যবস্থা করা উচিত আর এতিমখানায় এতিম– বাপমাহারা অনাথ ছেরেমেয়েরা থাকবে, এলেম শিখবে, ইসলামের ক্ষয়ে যাওয়া বুনিয়াদ হিন্দুস্তানে আবার মজবুত হবে। বিকেলে বড়োগাজিও এলেন ভাইয়ের কাছে কথাটা শুনে। এই লোকটিকে বোঝা যায় না। ওঁর নাকি খুব আংরেজি এলেম আছে। সবতাতেই লড়াই করতে তৈয়ার। বলল, হজরত! জমিদার নবেন্দুনারায়ণকে মদু (হোটোগাজি) চেনে না। খুব মতলববাজ লোক সে। মদু কথা বলতে গিয়ে বেইজ্জত হয়েছে। জমিদারবাবু বলেছে, পিরসাহেবের তো এত ভক্ত। আমি পঞ্চান্নহাজারে কিনেছি। চাঁদা করে দিক ওরা। বিক্রিকবালা করে দেব। তবে পিরসাহেবের খাতির, পাঁচবিঘের মতো মাটি ওঁর নামে দানপত্র করে দিতে রাজি। চালাকি হজরত! বিলকুল ঝুট। যে-পাঁচবিঘে দানপত্র করবে বলেছে, আমি জানি, সে-মাটি ওর এক জ্ঞাতির। সেই নিয়ে কলকাতার আদালতে মামলা চলছে। বললাম, তাহলে তো মুশকিল। বড়োগাজি বললেন, কিসের মুশকিল হুজুর? আপনার হুকুমে এলাকার তামাম মুসলমান জান কোরবানে তৈয়ার। আমরা লড়াই করে মাটি দখল করব। বললাম, গাজিসাহেব! লড়াই পরে। আগে আমার খত নিয়ে যান জমিদারবাবুর কাছে। আমি ওঁকে সব বুঝিয়ে লিখে দেব। বড়োগাজি একটু অবাক হলেন নিশ্চয়। আমার চালচলনে ইদানীং জঙ্গিভাব নেই আগের মতো, সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারি। বডোগাজি আস্তে বললেন, হজরতের যা ইচ্ছা। ফারসিতে খত লিখে শিলমোহর দেগে দিলাম। বড়োগাজি একটু হেসে বললেন, আমি ফারসি ভালো পড়তে পারি না। মদু পারে। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাব! নবেন্দুনারায়ণ আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত! এমনিতে তত দুষ্ট লোক নয়। কিন্তু মাটি ওর জান। কালেকটার বাহাদুর প্যাটারসনসাহেব ওকে খুব খাতির করে। বড়োগাজি চলে গেলেন ঘোড়া ছুটিয়ে। আমি এবাদতখানা থেকে বেরিয়ে পুকুরপাড় হয়ে জঙ্গলটার ভেতর ঢুকলাম। কী আশ্চর্য স্তব্ধতা সেখানে। গুমোট গরম পড়েছে। ঝিঁঝিপোকা, পাখপাখালির ডাক সেই স্তব্ধতার ভেতর মিশে যাচ্ছে। আল্লাহর কুদরত! নীচু হয়ে ঝুঁকে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছড়ির ডগায় খুঁচিয়ে একটু খুঁড়ো মাটি তুলে নিলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এই তো সেই মাটি! এ মাটি কোনদিন এমন করে খুঁটিয়ে দেখিনি– যে মাটি থেকে আল্লাহ প্রথম পুরুষ আদমকে বানিয়েছিলেন। আমার অজুদে (দেহে) এই মাটি আছে। এই মাটি দিয়ে দুনিয়াও গড়া হয়েছে। আমার মউত হলে আমার অজুদ এই মাটিতে মিশে যাবে। আর ফেরেশতা ইস্রাফিল যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন, এই মাটির দুনিয়াও ধ্বংস হয়ে যাবে। হায় এই মাটি! পবিত্র কেতাবে সেদিন সম্পর্কে বলা হয়েছে:

আলকারিয়াহ্‌ ত মালকারিয়াহ্‌….

মহাপ্রলয়! মহাবিপদ! কিসের বিপদ? মহাপ্রলয়ের। শিউরে উঠলাম। বান্দা বদিউজ্জামান। এই দুনিয়ার জন্য তোর এত মায়া, এত স্বপ্ন! প্রচণ্ড হতাশা, তারপর অর্থহীনতা আমাকে পেয়ে বসল। কিন্তু আমি তো কোনদিন মাটির প্রত্যাশী ছিলাম না! আজ কেন মাটির জন্য এ খাহেস? এতিমখানা, মেহমানখানা, এবাদতখানা। কী অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে কয়েদি হয়ে গেছি বা হতে চলেছি ক্ৰমে ক্ৰমে। অনিত্য মাটির কথা ভেবেই কি এতদিন মুসাফিরের মতো ঠাঁই বদলে-বদলে ঘুরে বেড়াইনি? অথচ আজ আমি এইসব গাছের মতো শেকড় বিধিয়ে দাঁড়াতে চাইছি। মাটির গুঁড়ো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। একটা কাঠবেড়ালি শুকনো পাতার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে কুর-কুর করে কী চিবুচ্ছিল। ওইটুকু আওয়াজে বেচারা দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর শিরশিরে একটা হাওয়া এল মাঠের দিক থেকে। যেন চারপাশে ফিসফিসিয়ে হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার!….

.

নাঙ্গা আবৃত্তিকারিণী

চোখ বুজে তসবিহ নিয়ে আল্লাহর নাম জপ করছিলাম। তারপর মনে হল আশ্চর্য একটা দৃশ্য আবছা নজর হচ্ছে। একদল ঘোড়সওয়ার, পরনে শাদা পোশাক তাদের, আর ঘোড়াগুলোর গায়ের রঙ নীল, বড় বড় টানা চোখে পুরু সুরমা টানা, আর সওয়ারদের হাতে খোলা তলোয়ার, তারা আমার হুকুমের প্রতীক্ষা করছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললাম। এ কিসের নমুদ (নিদর্শন) দেখাচ্ছেন আল্লাহ, ওরা কি আসমান থেকে নেমে আসা জিন, আমার মদতের জন্য দাঁড়িয়ে আছে? এ অবস্থায় তসবিহ নিষ্ফল। লানটিনের দম একটু বাড়িয়ে ‘হুঁশিয়ার নামাহ’ কেতাবটি রেহেলে রেখে পাতা ওলটাতেই দেখি:

‘হুঁশিয়ার পিঙ্গলচক্ষু নারী সম্পর্কে। আর
হুঁশিয়ার ঠোঁটে তার যদি থাকে
তিলচিহ্ন। হুঁশিয়ার যদি সে বারবার
স্থানপরিবর্তন করে। যদি হয় সে
চঞ্চলা মৃদুভাষিণী / উদ্দেশ্যহীন
তার গমনাগমন—’

এই সময়ে বাইরে দূরে আবছা কোলাহল। মুখ তুলে কান পাতলাম। এ রাতে খুব হাওয়া দিচ্ছিল। দুনিয়া জুড়ে একটা অস্থিরতা। গোলমালের আওয়াজ কখনও স্পষ্ট কখনও অস্পষ্ট। তারপর আলি বখশের সাড়া পেলাম বারান্দা থেকে। সে খুকখুক করে কাশছিল। কোনো কথা বলার দরকার হলে তার এই অভ্যাস। বন্ধ দরজার বাইরে তার কাশি শুনে ভেতর থেকে ডাকলাম, আলি বখশ! সে বলল, হজরত! গাঁয়ে ডাকাত পড়েছে মনে হচ্ছে। বললাম, ডর নেই তোমার। চুপচাপ শুয়ে থাকে। সে উত্তেজিতভাবে বলল, হুজুর! আওয়াজ এদিকেই আসছে। হুকুম পেলে আমি একটু দেখে আসি। হুকুম দিলাম। গোলমালটা বাদশাহি সড়কের দিকে এগিয়ে আসছে বটে। আমার ঘরের দেওয়ালে আঁটা গোপন সিন্দুকে টাকাকড়ি সোনাদানা আছে। মুরিদদের (শিষ্য) নজরানা। ওই দিয়ে এতিমখানা মেহমানখানার খরচ চালাব। হুঁশিয়ার থাকা দরকার। প্রেরিত পুরুষ স্বয়ং তলোয়ার ধরে দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ওহোদের লড়াইয়ে তাঁর পবিত্র দাঁতে আঘাত লেগেছিল। মুসলমান সব সময় তো লড়াইয়ের জন্য তৈয়ার। কুতুবগঞ্জের গোমস্তা আবদুল কাদির বহুবছর আগে আমাকে তাঁর মরহুম (প্রয়াত) পিতার একটি ঢাল ও তলোয়ার উপহার দিয়েছিলেন। এবাদতখানার দেওয়ালে তা টাঙিয়ে রেখেছি। একটু ইতস্তত করে দোয়া পাঠ করলাম:

‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাসায়ালুকা ফি নুহুরিহিম অ
নাউজুবিকা মিন শুরুরিহিম…’

দুশমনদের ধ্বংসের দোয়া এটি। ঢাল আর তলোয়ার হাতে নিয়ে দরজা খুলে পা বাড়িয়েছি, কী বা কেউ আমার পাশ দিয়ে ঢুকেই লানটিন বুতিয়ে (নিবিয়ে) দিল। হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। হুঁশ এলে ঘুরে গর্জন করতে গিয়ে গলায় কিছু আটকে গেল। না, আলাহর কসম, উর নয়। অন্ধকার ঘর। বাইরে এতক্ষণে একফালি চাঁদের আবছা হলুদ আলো। গোলমালটা এবার উত্তরে পুকুরের ওপাড়ে জঙ্গলের দিকে শোনা যাচ্ছে। আলি বখশ ফিরে এল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ডাহিন হজরত! ডাহিন! নাঙ্গা হয়ে খোঁড়াপিরের মাজারে মাথায় পিদিম জ্বেলে– বাধা দিয়ে বললাম, ইকরাতন? আলি বখশ বলল, জি হুজুর! আমার শরীরে বিজলির চমক। বললাম, আলি বখশ! পাক কেতাবে লেখা আছে, আল্লাহর ঘর –মসজিদ এবাদতখানা, সবই ‘মসজিদুল হারাম!’ তার মধ্যে বা চারদিকে শও হাত জমিনে মানুষ হোক কী জানোয়ার, তাকে আঘাত নাজায়েজ (অসিদ্ধ)। আলি বখশ কিছু বুঝতে পারল না। শুধু বলল, জি হজরত! তখন বললাম, আলি বখশ! গিয়ে ওদের বলল, আমার হুকুম– সবাই বাড়ি ফিরে নিদ যাক। আর শোনো, তুমি নিজের বাড়ি গিয়ে তোমার বহিনের (আলি বখশের ইবি মারা গেছে। আর নিকাহ করেনি।) একটা শাড়ি নিয়ে এসো। আলি বখশ! কেউ বা তোমার বহিন কিছু শুধোলে বোলো, আমার বারণ আছে জবাব দেওয়া। আর শোনো আলি বখশ। অমি দুজন জ্বেন (জিন) পাঠিয়ে তোমাদের ডাহিনকে পাকড়ে আনছি। তাকে তওবা পাঠ করিয়ে খাঁটি মুসলমান করব। আলি বখশের চোখ চাঁদের আলোয় বিস্ময়ে। ঝলমল করছিল। সে আবার দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তখন আমি ঘুরে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়া ‘খান্নাসটিকে আস্তে বললাম, অ্যাই বেশরম লেড়কি! তোর এত সাহস হল কী করে যে তুই আমার ঘরে ঢুকে পড়লি? চাপা ফোঁপানির মধ্যে সে বলল, ওরা আমাকে মেরে ফেলত। একটু হেসে বললাম, তুই ডাহিন আওরত? নাঙ্গা হয়ে মাথায় চেরাগ রেখে নাচ করিছিলি? শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জবাব এল, আমি থানে ওষুধ তুলতে গিয়েছিলাম…নাঙ্গা হয়ে কেন?….নৈলে ওষুধে ফল হয় না। …বুডুবক খবিস! কিসের ওষুধ তুলে গিয়েছিলি….রুপমারির একটা মেয়ের অসুখ। দুকাঠা চাল দেবে বলেছিল।….হাসতে-হাসতে বললাম, লোককে ঠকিয়ে ধোঁকা দিয়ে রোজগার কবিস! ফুঁপিয়ে উঠে বলল, পোড়। পেটের দায়, পিরসাহেব!…তুই হিন্দু আউরত ছিলিস? এবার না-জবাব হয়ে কাঁদতে শুরু করল। ধমক দিয়ে বললাম, চুপ! নাদান বেশরম কাহেকা। তবু সে কাঁদতে থাকল। একটু ভেবে বললাম, আলি বখশ কাপড় আনতে গেছে। তোকে ওর সঙ্গে হরিণমারায় ছোটোগাজির বাড়ি পাঠিয়ে দেব। সেখানে থাকবি। রাজি?…জি হ্যাঁ।…তোকে তওবা করতে হবে আগে। তুই কলমা জানিস? আবদুল তোকে মুসলমান করেছিল তো? জি হা…বাইরের গোলমাল থেমে গেছে। আলি বখশ আসতে একটু দেরি হবে। বললাম, আমি যা বলছি, বল্। না বললে মুশকিলে পড়বি। বকৰ্মা শাহাদত:

‘লা এলাহা ইল্লাল্লাহ মহম্মদর রসুলাল্লাহ’

আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই, মহম্মদ তাঁর প্রেরিত পুরুষ। আশ্চর্য, আশ্চর্য এবং আশ্চর্য! সে চমৎকার আবৃত্তি করল কান্নাজড়ানো গলায়। বললাম, মারহাবা! শাবাশ! এত সুন্দর তোর লবজ! সে আস্তে বলল, রুকু আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। আমার মেজবউবিবি? জি হ্যাঁ। মারহাবা! মারহাবা! অ্যাই লেড়কি! তোর নামের মানে কী জানিস? যে আউরত মুখস্ত বলতে পারে। কী মুখস্ত বলতে পারে– আল্লাহর কথা, রসুলের কথা। আর ইকুরাতনন্নেসা! তোর কি মনে পড়ে, আমার সঙ্গে নদীর ধারে তকরার করেছিলি?…জি হ্যাঁ।…এইসময় আলি বখশ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পড়ল। তাকে চাপাস্বরে বললাম, আমার জ্বেন (জিন) মেয়েটাকে ধরে এনে বেঁধে রেখেছে, আলি বখশ! তার হাত থেকে কাপড়টা নিয়ে অন্ধকারে ঘরের ভেতর ছুঁড়ে ফেললাম। দরজা বন্ধ করে জেনদের উদ্দেশে বললাম, ওকে তোমরা কাপড় পরিয়ে দাও। আলি বখশ জড়োসড়ো হয়ে বারান্দায় বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে আপনমনে বলল, সবই হুজুরের কেরামতি!

.

আরও একটি ব্যর্থতা

‘হুশিয়ারনামাহ’ কেতাবে যেমতো লিপিবদ্ধ ছিল। ইকরার চোখ দুটি সত্যিই ছিল পিঙ্গলবর্ণ, গ্রামে যাদের ‘কয়রাচোখি’ মেয়ে বলা হত, বেড়ালের মতো চোখ। চঞ্চলও ছিল সে। আর তার ঠোঁটে সত্যিই তিল ছিল। কথা কম বলত। দ্রুত স্থান পরিবর্তন করত। সেরাত্রে হরিণমারা যাবার পথে বেচারা কমজোর আলি বখশকে ধাক্কা মেরে কাঁদরের জলে ফেলে দিয়ে সে পালিয়ে যায়। আলি বখশ হুজুরের ভয়ে একটা গল্প বানিয়েছিল। কাঁদরের কাছে যেতেই একদল কালা জিন তাকে ঘিরে ধরে। তাকে। প্রহার করে। প্রমাণ হিসেবে সে গায়ের ছেঁড়া ফতুয়া এবং কপালে, হাতে ও পায়ে ছড়ে-যাওয়া ক্ষতচিহ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু আগাগোড়া একটি নাটকীয় ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ‘বদুপিরের এই ছোট্ট পরাজয়ের চেয়ে জিনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুসাব্যস্ত হয়। তবে বদিউজ্জামানেব জীবনে এও আরেকটি ব্যর্থতা — তাঁর নিজের কাছে। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি ব্রাহ্মণী নদীর সেই প্রাচীন সাঁকোব কাছে দাঁড়িয়ে দুঃখে ব্যর্থতায় ক্রোধে অভিমানে ক্ষিপ্ত হতেন। তারপর সাঁকোর পাথরের থামগুলো খুঁড়িয়ে ফেলাব ফতোয়া জারি করেন। পুরনো সাঁকোটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অথচ এবাদতখানায় বসে, অথবা পুকুরপাড়ে নিশুতি রাতে দাঁড়িয়ে বদিউজ্জামান অবিকল সিঁদুরের ছোপমাখা থাম দেখতে-দেখতে এক নাঙ্গা আউরতকে দেখে চোখ বুজে ফেলতেন। বিড়বিড় করে পাঠ করতেন : আল্লাহ! শয়তানের জাদু থেকে আমাকে বাঁচাও। আসলে জীবনের অনিবার্য স্পষ্টতাগুলো নিজেকে উঁচুতে তুলে রাখার দরুন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *