১৪. একটি কথোপকথন

একটি কথোপকথন

কচি, ঘুমোলি?

না একটা কথা ভাবছিলাম! আচ্ছা, দাদিমা?

কীরে?

ছোটোদাদাজি যে বাঘদুটো দেখেছিলেন, তারাই যে তোমার শশুরসাহেবের মাজারে সেলাম করতে আসত, কী করে জানলে?

শুনেছি।

সবই খালি শুনেছ। কিছু দেখনি?

কী করে দেখব বল? হিজরি ১৩১৩ সনে শ্বশুরসাহেব মৌলাহাটে এলেন। সেই থেকে খাঁচায় ঢুকলাম! হিজরি ১৩১৪ সনে আশ্বিন মাসে আমাদের দু বহিনের শাদি হল। খাঁচার দরজায় কুলুপ পড়ল।

দাঁড়াও, পঞ্জিকা দেখে হিসেব করি।

আঃ, আলো জ্বালে না। চোখে লাগে।

হুঁ, এটা হিজরি ১৩৩৩ সন। ইংরিজি ১৯১৩। দাদিমা, বিয়ের সময় তোমার বয়স কত ছিল?

বারো-তেরো বছর হতে পারে। পরের বছর তোর আব্বার জন্ম হল।

ওম্মা! ওই বয়সে বিয়ে, বাচ্চার মা– দাদিমা, তুমি কী বলছ!

সে-আমলে তাই তো হত। তবে জানিস কচি, তোর আব্বার জন্মের খবর গেল শশুরসাহেবের কাছে। খুব জাড় পড়েছিল সেবার আঘুন মাসে। দুখু ফিরে এসে বলল, উনি এবাদতখানায় –মানে এখন যেখানে ওঁর মাজারশরিফ, জিনের মজলিশে আছেন।

ভ্যাট! বাজে গপ্প।

দুখু বলল, জানালার ফাঁক দিয়ে শাদা রোশনি ঠিকরে বেরুচ্ছে। তখন শাশুড়িসাহেব বললেন, নুরুকে খবর দে। এসে বাচ্চার কানে আজান দিক।

নুরু– মানে বড়োদাদাজি?

হুঁ। তো ভাসুরসাহেবও পাশকরা মওলানা। দেওবন্দে পাশ! এসে তোর আব্বার কানে আজান দিলেন। তখন শেষ রাত। আয়মনিখালা কুলকাঠের আগুন জ্বেলে আমার গা সেঁকছে। ধাইবুড়ি লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকছে।

দাদিমা, আমার দাদাজি তো ছিলেন। উনি আজান দিলেন না কেন?

ল্যাংড়া বোকাহাবা মানুষ। কষ্টে চলাফেরা করতেন! গলায় আওয়াজ বেরুত না!

আমার দাদাজি তো মেজো?

হুঁ। শশুরসাহেব ইন্তেকাল করার সময় বলে গিয়েছিলেন, সে এই এবাদতখানার মালিক হবে! তারপর যখন মুরিদরা পিরসাহেবের মাজার বানিয়ে দিল, তোর দাদাজি সেখানেই থাকতেন। নজরানাটা সেলামিটা যা পড়ত, আদায় করতেন। বিঘে দশেক ভুই ছিল। তারও ফসল পেতাম আমরা। মায়ের সম্পত্তি এক ছটাক আমি নিইনি।

কেন নাওনি,….ও দাদিমা! বলো না। কেন নাওনি?

সেসব কথা চাপা আছে, চাপা থাক। রাত হয়েছে, নিঁদ যা।

দাদিমা, মাজারে নাকি ডাকাতরা খুন করেছিল দাদাজিকে?

আঃ, চুপ কর তো! খুন কেন করবে? কালা জিন গলা টিপে মেরেছিল।

আচ্ছা, দাদিমা, ছোটোদাদাজি নাকি ডাকাত ছিল?

কচি। ঘুমো।

বলো না দাদিমা, ছোটোদাদাজির কথা। জঙ্গলের ভেতর ভাঙা মসজিদ, চাঁদনি। রাত, দুটো বাঘ– তারপর কী হল?

রাত জাগলে সকালে স্কুল যেতে পারবি নে। ঘুমো।

আলো জ্বালব বলে দিচ্ছি।

না, না!

অন্ধকারের প্রাণী তুমি, দাদিমা।

হুঁ, আঁধার আমার ভালো লাগে। সারাটা দিন আমার কষ্ট হয় রে! দিন কাটে না।

ঠিক আছে! নাও, শুরু করো। জঙ্গলে ভাঙা মসজিদ। চাঁদনি রাত। দুটো বাঘ খেলা করছে।

আমি তো দেখিনি। শুনেছি। এক বর্ষার রাতে দেওরসাহেব এলেন। আম্মাকে দেখা করতে।তখন উনি স্বদেশী করেন। সে আমার শাদির দশবছর পরের কথা! শেষ রাতে চলে গেলেন। পরনে হিন্দুর পোশাক।

ও দাদিমা! তাহলে বলল, ছোটোদাদাজি টেররিষ্ট ছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বইতে ওঁর নাম থাকা উচিত ছিল! আশ্চর্য! কেন নেই?

খুব নামী লোক হয়েছিলেন দেওরসাহেব। জেলা জুড়ে নাম। ম্যাজিসটের লাট। রায়বাহাদুর খান-বাহাদুর ওঁর ডরে গর্তে সেঁধিয়ে থাকত।

তবু হিসট্রিতে নাম নেই!

কথাটা তোর আব্বাও বলত। বলত, হিঁদুরা মোসলমানদের পাত্তা দেয় না। সেইজন্যই তো হিন্দুস্তান-পাকিস্তান হল। তবে দেওরসাহেব শেষে স্বদেশী ছেড়ে খুনখারাপি করে বেড়াতেন। ওঁর মাথার দাম–

ছাড়ো! গল্পটা বলো! জঙ্গল,ভাঙা মসজিদ, জোড়া বাঘ, চাঁদনি রাত।

বলি।….

.

গল্পের কিয়দংশ

জঙ্গল চিরে ধবধরে শাদা মাটির রাস্তা। ঝলমলে জ্যোৎস্না। রাস্তার ধারে ভাঙা মসজিদ। একদল হাটুরে নিকিরি গিয়েছিল শহরে খন্দ বেচতে। কাঁধে বাঁশের বাতার ভার, দুধারে ঝোলানো ঝুড়ি। সেই দলের কাছে জানা হয়েছে এই রাস্তা গেছে পদ্মার ধারে সুপারিগোলার হাট। সামনে ভগবানগোলা। তখনও গঙ্গা বইত ভগবানগোলার। কাছাকাছি। ভগবানগোলায় মামুজি আবু মিরের বাড়ি। পুরো নাম মির মোহাম্মদ আবুতৈয়ব। হাটুরে নিকিরির দল আমাকে খুব খাতির করেছিল আমি আবু মিরের ভাগনে বলে। ওরা বলেছিল, ওরে বাবা! উনি এ তল্লাটের ডাকসাইটে পুরুষ। বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায় ওঁর নামে। ওরা যাবে অনেক দূর। রাস্তায় ঠ্যাঙাড়ের ভয় আছে। তাই ভাঙা মসজিদের উঁচু চত্বরে রাত কাটাতে গেল। বলল, পিরসাহেবের ছেলৈ আপনি। তার ওপর আবু মিরের ভাগনে। থাকুন আমাদের সঙ্গে। ভোরবেলা মিরসাহেবের ঘরে পৌঁছে দিয়ে যাব। একা যাবেন না। লোকগুলোকে ভালো লেগেছিল। ওরা ভাঙা মসজিদচত্বরে বসে আমাকে গুড়মুড়ি খেতে দিল। পাশে একটা পুকুর ছিল। পানি এনে খেল। পানিটা বিস্বাদ। ওরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুল। আমাকে একটা চট দিল শুতে। দেখলাম ওদের কাছে লাঠি বল্লম কাটারি আছে। সেগুলো পাশে রেখে শুয়েছে। বরাবর দেখেছি, এইসব মানুষের ঘুমটা খুব গাঢ়। আমার পক্ষে ঘুমানো অসম্ভব! চট, তা ছাড়া বালিশ নেই। জ্যোত্সার আলোছায়া। হ-হুঁ বাতাস। শনশন অদ্ভুত সব শব্দ। মামুজির কথা ভাবছিলাম। উনি কি আমাকে চিনতে পারবেন? সেই ছ বছর বয়সে একবার আম্মার সঙ্গে গিয়েছিলাম। গিয়ে তো ঝামেলা। পরদিনই ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে আম্মা চলে এলেন। সারা পথ কাঁদছিলেন আম্মা। কেন তা জানি না। মামুজি নাকি নেশাখোর মানুষ, এলাকার ডাকাত-সর্দাররা ওঁর গোলাম। কত অদ্ভুত গল্প শুনেছি দাদি-আম্মার কাছে। মামুজিকে বাচ্চা বয়সে নাকি গোরা পলটন ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওঁর আব্বা হাসু মিরকে না পেয়ে। কেন? দাদি-আম্মা বলেছিলেন, হাসু মির ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। ব্যাপারটা সিপাহি বিদ্রোহ হওয়া সম্ভব। মরহুম দাদাজিও নাকি সিপাহি বিদ্রোহের সময় লুকিয়ে বেড়াতেন। বারিচাচাজির কাছে সিপাহি বিদ্রোহের গল্প শুনেছি। মাত্র বছর আটত্রিশ আগের ঘটনা। হরিণমারার বড়োগাজি বলতেন, বাঙালি হিন্দুরা বিশ্বাসঘাতকতা না করলে হিন্দুস্তান থেকে তামাম ইংরেজকে ভাগিয়ে দেওয়া যেত। ব্যাপারটা কিছু বোঝা যায় না। জানতে ইচ্ছে করে। গত মাসে লালবাগ শহরে মদ খেয়ে এক গোরাপলটন গঙ্গার ঘাটে মেয়েদের বেইজ্জতি করত। আশ্চর্য ব্যাপার, ওই পান্না পেশোয়ারি তাকে শায়েস্তা করেছিল। পান্না শয়তান কিছু ভাল কাজ করে। তাই তাকে শহরের লোকে হয়তো ভালোবাসে। সবাই পান্নার পেছনে না দাঁড়ালে ওর বিপদ হত। মাতাল গোরাটাকে বহরমপুর ব্যারাকে সরিয়ে, নেওয়া হয়েছিল।…কাত হয়ে শুয়ে এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে চোখ খুলে দেখি, একটু তফাতে নীচের ফাঁকা জায়গায় দুটো বাঘ। ওখানে চাঁদের আলো। বাঘদুটোর লেজ নড়ছে। কেমন একটা কেউ-কেউ মিহি আওয়াজ ওদের গলায়। পরস্পরকে আঁচড়াচ্ছে। কামড়াচ্ছে। তারপর একটা বাঘ শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। অন্যটা তার পাশে পেছনের দু-পা ভাঁজ করে বসল এবং মাঝে-মাঝে সামনের একটা পা তুলে চাটি মারতে থাকল অন্যটার গালে, পেটে, থাবায়। আমি কাঠ হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। লোকগুলো নিঃসাড় । নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হঠাৎ মনে হল, বাঘদুটো বাঘ আর বাঘিনী এবং তারা যে আমাদের দেখতে পাচ্ছে না, তার একটাই কারণ — আব্বা একদল জিন পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে বাঘ আর বাঘিনী খেলতে-খেলতে ওদিকে কালো জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। তখন ভাবলাম, আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? লোকগুলোর একজনকে খিমচি কেটে জাগিয়ে ফিশফিশ করে বললাম, বাঘ! সে ঘুমজড়ানো গলায় শুধু বলল, হুঁ! বাতাসের শনশন শব্দের ভেতর দূরে যেন একবার বাঘ ডাকল। বাকি রাত আর ঘুমানো অসম্ভব। ভোর রাতে ওদের সঙ্গে যাবার সময় গল্পটা বললে ওরা গ্রাহ্য করল না। একজন বলল বাঘ মসজিদ সালাম করতে আসে। মানুষের খেতি করে না। অবশ্য সে-আমলে পাড়াগাঁয়ে সবখানে জঙ্গল। সবখানে বাঘ। এরপর যখন দেবনারায়ণ রায় নামে একজন চমৎকার মানুষের সঙ্গে শাঁখালার জঙ্গলে আবাদের কাজ দেখতে যাই, তখন প্রায়ই সেখানে একটা করে বাঘ মারা পড়ত। বাঘ, বুনোশুওর, সাপ। মানুষও মারা পড়ত। তবে এই জোড়া বাঘের গল্প আমি একশ, দুশো বা তিনশো জনকে বলে থাকব। গল্পটা বাজে, অথবা গল্পটা আমার জীবনে খুব মূল্যবান। পরে যতবার মনে পড়েছে, শিউরে উঠেছি। তাহলে আমি আদতে কাদের দেখেছিলাম? মিথুনমত্ত বাঘ আর বাঘিনী এক জ্যোৎস্নারাতের জঙ্গলে– তারা কারা? দেবনারায়ণদা বলেছিলেন, এপ্রিল বাঘেদের মেটিং সিজন। এঁ, ইংরেজি ১৯১৬ সাল। তিরিশে এপ্রিল। তারিখটা মনে আছে। পান্না পেশোয়ারিকে ইট মেরে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। হাটুরে নিকিরির দলের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। ভাঙা নবারি মসজিদ জঙ্গলের ধারে । আসঙ্গলিঙ্গু দুটি বাঘ। বুকের ভেতর ক্রমশ তাদের গজরানি শুনতে পেতাম। তারা খেলতে-খেলতে অবচেতনার অন্ধকারে ঢুকে যেত। এই গল্পটা কাউকে বলা ঠিক হয়নি ।…..

.

ব্ৰহ্ম ও আনন্দ

আবু মির প্রথমে চিনতে পারেননি শফিকে। তাঁর দুটি স্ত্রী ছিলেন। বড়োর বয়সের তুলনায় ছোটোটি নাবালিকা বলা যায়। আবু মিরকে দুজনেই প্রচণ্ড ভয় করতেন। আজিফা বেগম বড়োর নাম, তার সতীনের নাম জরি বেগম। স্বামী বাড়ি না থাকলে দুজনে ঝগড়াঝাটি বেধে যেত। শফি যেদিন ওখানে পৌঁছয়, তার আগের দিন অজিফা বেগমকে তালাক দিয়েছেন আবু মির। হতভাগিনী একটি বাচ্চাও গর্ভে ধরতে পারেননি। আর জরি বেগম স্বামিগৃহে এসেই গর্ভিণী হয়েছেন। আবু মির ফরসি হুঁকোয় তামাক টানছিলেন। উঠোনে একদঙ্গল লোক বসে ছিল। তারা গেজানো তালরস খাচ্ছিল। তাদের পাশে লাঠি বল্লম, টাঙ্গি, তলোয়ার, ঢাল স্তূপীকৃত। কয়েকটি রণপা। এ নিয়ে শফি ছেলেদের খেলতে দেখেছে। ঝাঁকড়া চুল, গোফ, গালপাট্টা লাল চোখ –এইসব লোক যে ডাকাত তার বুঝতে একটু দেরি হয়েছিল। শফিকে অনেকক্ষণ জেরা করার পর আবু মির চিনেছিলেন, ছেলেটি তাঁর বোন সাইদারই সন্তান বটে। কিন্তু তিনি তত পাত্তা দেননি শফিকে। শুধু জরিবেগম শফিকে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। দুপুরে যত্ন করে খাইয়েছিলেন। মুরগির গোশত, মাসকলাইয়ের বড়া আর কুমড়োর তরকারি। ভাতটা মোটা লালচে রঙের। আবু মির তখন বেরিয়ে ছিলেন। শফি খাওয়ার পর বলেছিল, মামিজি আমি যাই। জরি বেগম বলছিলেন, কেন গো? ছোটোমামিকে ভাল লাগছে না বুঝি? বড়োমামি থাকলে ভালো লাগত? তা কী করব বলল, কাল তোমার মামুজি তাকে লোক ডেকে তালাক দিয়েছেন। শফি যদিও বা থাকত, আর থাকার ইচ্ছে করছিল না। সে মৌলাহাটে ফিরে যাবেই। জরি বেগমের চেহারায় একটা নিষ্ঠুরতাও এর কারণ হতে পারে। সে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়িটা কে। শুকনো গঙ্গা পেরিয়ে ওপারে একটা লোকের সঙ্গে দেখা। সে তরমুজখেতে বসে হুঁকো টানছিল। লোকটি তাকে মৌলাহাটের রাস্তা বাতলে দেয়। সেখানে থেকে নাকি চোদ্দ ক্রোশ দূরত্ব। হাঁটতে হাঁটতে একটা চটির কাছে সূর্য ডুবেছিল। চটির পেছনে হাটতলার চালাঘর। সেখানে একদল লোক বিশ্রাম নিচ্ছিল। একটি পালকি ছিল। বেহারারা পা ছড়িয়ে বসে চিড়ে খাচ্ছিল। মাথায় লাল ফেট্টিবাঁধা পাইক হাতে লাঠি নিয়ে তম্বি করছিল লোকগুলোকে। শফি চটির সামনে বাঁশের মাচানে বসে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। এমন সময় হাটতলার পেছন থেকে এক লম্বা চেহারার ভদ্রলোক গাড় হাতে পালকির কাছে এলেন। তাঁর পরনে ধুতি, পায়ে নাগরাজুতো, খালি গা । শফির দিকে চোখ পড়লে তিনি গাড় রেখে তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমার নিবাস?

এভাবেই কপালীতলার জমিদারদের ছোটো তরফবাবু দেবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় শফির। দেবনারায়ণ ছিলেন খেয়ালি মানুষ। দাদা আর জ্ঞাতিদের। সঙ্গে বনিবনা ছিল না তাঁর। কপালীতলায় প্রায় একঘরে হয়ে বাস করতেন। মামলামোকর্দমা করে শাঁখালা নামে একটা অনাবাদি জঙ্গলমহল ভাগে পান। কয়েকটি ছোটো নদী বা সোঁতার অববাহিকায় কয়েক বর্গমাইল নাবাল মাটি। সেখানে বসত বসাতে চলেছেন। একটা দল জমির লোভে কিছুদিন আগে সেখানে চলে গেছেন। এবার দ্বিতীয় দলটাকে নিয়ে চলেছেন। ওরা বা এরা এখনও ঘরকন্না বউকাচ্চা বাচ্চাদের নিয়ে যেতে নারাজ। অবস্থা বুঝলে তারপর নিয়ে যাবে। দেবনারায়ণ মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে জানতেন। জাত-বেজাত মানতেন না। বলতেন, একো ব্ৰহ্ম দ্বিতীয়ো নাস্তি। আমরা মানুষেরা সবাই পরম ব্রহ্মের একেকটি প্রকাশ। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চেতনাময়। কান করে শোনো, প্রকৃতি জুড়ে ব্রহ্মের তান। বায়ুর মর্মরে, বিহঙ্গের কাকলীতে, নদীর স্রোতধ্বনিতে, পুষ্পের প্রস্ফুটনে, সর্বত্র আনন্দরূপ ব্ৰহ্মতান। তাঁরই আনন্দে সৃষ্টি, স্থিতি, লয়। বলে তিনি গম্ভীর গলায় গান গেয়ে উঠতেন।

অর্থাৎ দেবনারায়ণ ব্রাহ্ম ছিলেন।…

.

বন্দেমাতরম

দেবনারায়ণদা ছিলেন পাগল মানুষ। তবে তাঁর পাল্লায় পড়ে আমার জীবন অনেকখানি বদলে গিয়েছিল তো বটেই। শাঁখালা নামটা বদলে তিনি শখিনী রাখেন, যদিও লোকে সেটা নেয়নি। তবে উঁচু মাটির ওপর যে মূল বসতি করে ব্রহ্মপুর নাম দেন, সেটা চালু হয়েছিল। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় উপাসনবেদি। নাম দিয়েছিলেন ব্রহ্মমন্দির। সেখানে চাষাভুষো লোকগুলোকে জড়ো করে আব্বার মতোই গম্ভীর স্বরে ভাষণ দিতেন। বেদমন্ত্র আবৃত্তি করতেন। এসব ব্যাপারে আব্বার সঙ্গে তার খানিকটা মিল তো ছিলই। শুধু আব্বার মতো তর্জন-গর্জনটা ছিল না। শান্ত এবং গম্ভীর, অথচ প্রসন্নতা ঝলমল করত মুখে। মাঝেমাঝে বলতেন, জানিস শফি, ইসলাম ধর্মগ্রন্থ কোরান আমার মুখস্থ? বলে কোনো একটি সুরা আংশিক আবৃত্তি করতেন। আমি উচ্চারণের ভুল শুধরে দিতাম। আমার সঙ্গে ইসলাম আর উপনিষদ নিয়ে আলোচনা করতে চাইতেন। এইসব সময় আমার ভারি বিরক্তিকর মনে হত ওঁকে। আমার কাছ থেকে ততদিনে ধর্মাধর্ম অনেক দূরে সরে গেছে। অবশ্য আমার ভালো লাগত সন্ধ্যাবেলার আসরটা। ব্রহ্মমন্দিবের বেদিতে বসে থাকতেন দেবনারায়ণদা। ব্ৰহ্মকীর্তন শুরু হত। খোল বাজিয়ে গান। দেবনারায়ণদা ওদের বলতেন বৈতালিক। সেই প্রথম খুব কাছে থেকে সংগীতের স্বাদ আমি পাই। আব্বা বলতেন, একবার গানবাজনা শুনলে চল্লিশ বছরের বন্দেগি (উপাসনা) বরবাদ। অথচ এভাবে যদি আল্লার নামে গান গাওয়া হয়, কেন আল্লা চটে যাবেন জানি না। দেবনারায়ণদা আমাকও গলা মেলাতে বলতেন। গান আমার আসে না। আর একটা বিরক্তিকর ব্যাপার ঘটত, কোনও ভদ্রলোক এলেই দেবনারায়ণদা আমাকে দেখিয়ে বলতেন এই আমাদের সমাজের মুসলমান সদস্য। তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। তখন আমার পরনে ধুতি আর কামিজ। তাঁরা বলতেন সত্যি নাকি? তাঁদের মুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠত। আমি রাগ করে সরে যেতাম। একদিন এক ভদ্রলোক এলেন, তাঁর নাম যামিনী মজুমদার। রোগা এবং বেঁটে মানুষ। আমাকে নিয়ে বিকেল বেড়াতে বেরুলেন নতুন বাঁধের পথে। কিছুদূর সত্যিই চুপচাপ পর হঠাৎ বললেন, তুমি কি মুসলমান? বললাম, হ্যাঁ –আমার নাম সৈয়দ শফিউজ্জামান। আমার বাবা একজন পির। যামিনীবাবু আমার একটা হাত নিয়ে আস্তে বললেন, তুমি দেবুদার কাছে জুটলে কীভাবে? তাকে শুধু খানিকটা বললাম। বললাম না পান্না পেশোয়ারিকে মেরে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। যামিনীবাবু বললেন, তুমি এখানে থেকো না। দেবুদাকে এলাকার ভদ্রলোকেরা পছন্দ করেন না। উনি ব্রাহ্ম। জমির লোভে কিছু কিছু ভদ্রলোক এখানে এসে দীক্ষা নিয়েছেন ওঁর কাছে। এতে অনেকেই চটে আছে। এই বাঁধ গড়া হচ্ছে, শয়ে-শয়ে চাষাভুষো কোদাল কোপাচ্ছে –সামনের বছর ফসলও ফলাবে, কিন্তু আমার ভয় হয় কী জান? বর্ষায় বাঁধ কেটে দেবে কেউ। তা ছাড়া তুমি মুসলমান– ব্রাহ্ম হয়েছ। এলাকার মুসলমানরাও এটা সহ্য করবে না। আমি বললাম, আমি ব্রাহ্ম হইনি। যামিনীবাবু হাসলেন। তাহলে এখানে পড়ে আছো কেন? বাবার কাছে ফিরে যাচ্ছে না কেন? বললাম, আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে। যামিনীবাবু বললেন, কেন ভালো লাগছে? একটু ভেবে নিয়ে বললাম, নতুন মাটি আবাদ হচ্ছে। আমাকে দেখাশোনা করতে হয়। যামিনীবাবু বললেন, শুধু এজন্য? বললাম, জঙ্গলে জানোয়ার আছে। মাঝে-মাঝে মারা পড়ে। সাঁওতাল বসতির লোকেরা শিকারের পরবে বেরোয়। তাদের সঙ্গে আমিও যাই। আমার এসব ভালো লাগে। যামিনীবাবু বললেন, এসো। এখানে একটু বসি। বাঁধের কিনারায় ঘাসের চাবড়া বসানো হয়েছে। সেখানে দুজনে বসলাম! একটু পরে যামিনীবাবু গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন। গানটা কোথায় শুনেছি মনে হল। মিঠে সুর।

বন্দেমাতরম/
সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাম
শস্যশ্যামলাং মাতরম/….

উনিগান থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। কেমন লাগছে? বললাম, ভালো । উনি আবার গাইতে থাকলেন,

শুভ্রজ্যোৎস্নাপুলকিতযামিনী
ফুল্লকুসুমিত দ্রুমদলশোভিনীম্‌
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্‌
সুখদাং বরদাং মাতরম্‌,…

যামিনীবাবু বললেন, কিছু বুঝলে? ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যামিনীবাবু হাসতে লাগলেন। দেবুদা তোমার মাথাটি খেয়ে ফেলেছেন। শোনো, গানটার মানে বুঝিয়ে দিই। এবার বললাম, গানটা আমি জানি। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ আমি পড়েছি। তা ছাড়া স্কুলে সংস্কৃত পড়েছি। যামিনীবাবু নড়ে বসে আমার পিঠে হাত রাখলেন, চমৎকার! বললাম, কিন্তু আনন্দমঠে মুসলমানদের ঘেন্না করা হয়েছে। বারিচাচাজি বলছিলেন– যামিনীবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কে তিনি? বললাম, নবাববাহাদুরের ছোটো দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি। যামিনীবাবু ভীষণ চমকে গেলেন। বললেন, চৌধুরিসায়েব তোমার আত্মীয় হন? কী আশ্চর্য! এতক্ষণ বলবে তো! একথা শুনে আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। বারিচাচাজিকে যদি ইনি খবর দেন কোথায় আছি, আমার এখানে আর থাকা হবে না। তাই বললাম, ঠিক আত্মীয় নন, একটু-আধটু চেনা। যামিনীবাবু আমাকে বোঝাতে থাকলেন, বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু এই গানটা সত্য। দেশকে মা বলতে তোমার আপত্তি আছে? দেবুর থাকতেও পারে। সে সর্বত্র ব্রহ্মের অস্তিত্বই মানে। ওরা পুরুষরূপী ঈশ্বরের উপাসনা করে। কিন্তু আমরা উপাসনা করি আসলে দেশের। দেশে আমাদের মা। শফি, দেশকে তুমি ভালোবাস না? স্বীকার কর না দেশের সঙ্গে মায়ের মিল আছে?….এই প্রথম আমি একজন স্বদেশীবাবু’ দেখছিলাম। স্বদেশী”বাবুদের সম্পর্কে আমার তত কিছু ধারণা ছিল না। তাই ব্যাপারটা খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া উচিত মনে হল। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত যামিনীবাবু যা সব বললেন, মনে হল, অবিকল এইসব কথাই আব্বার মুখে কিংবা হরিণমারার বডোগাজির মুখে একটু অন্যভাবে শুনেছি। ইংরেজ আমাদের দুশমন। ফেরার পথে যামিনীবাবুকে বললাম, আপনি এখানে কদিন থাকবেন? যামিনীবাবু একটু হেসে বললেন, কেন? আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে নাকি? বললাম, না। আপনার সঙ্গে আমার যেতে ইচ্ছে করছে। যামিনীবাবু আমার হাত ধরে বললেন, বেশ তো! কিন্তু আর কিছুদিন তুমি এখানে থাকো! এখনই তোমাকে নিয়ে যেতে আমারও কিছু অসুবিধা আছে। তাছাড়া তুমি মনস্থির করো। জিজ্ঞেস করলুম, কেন? আমি আসলে বলতে চাইছিলাম, আমি স্বাধীন। মুক্ত। যেখানে খুশি যেতে পারি। যা খুশি করতে পারি। যামিনীবাবু আমার কথার জবাবে বললেন, আমরা এখনও সংঘবদ্ধ নই। দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। কিছু লোকের মধ্যে– যেমন আমাকে দেখছ, আমার মধ্যেও একটা সংকল্প দানা বেঁধেছে। আমরা চেষ্টা করছি, পরস্পর যোগাযোগ করে একটা সমতি গড়া যায় নাকি। এই এলাকায় আমার আসার উদ্দেশ্যও তাই। এবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নিবাস কোথায়? যামিনীবাবু একটু হেসে বললেন, বহরমপুরে ছিল। ওকালতি করতাম। তাই দেওয়ান বারি চৌধুরিকে চিনি। বললাম, ব্রাহ্মদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? যামিনীবাবু একটু চুপ থাকার পর বললেন, ওদের নিজেদের মধ্যে মতান্তর আছে। সর্বত্র দলাদলি চলছে। একদল পইতে পরার বিরোধী — যেমন দেবুদা। দেবুদারা জাতিভেদ মানে না। ব্রাহ্মণ-শূদ্র-মুসলমান-খ্রীস্টান সবাইকে দীক্ষা দিচ্ছেন। অন্যদল চান ব্রাহ্মণের আধিপত্য। আচার্য হবেন শুধু ব্রাহ্মণ। পইতে ত্যাগ করবেন না ব্রাহ্মণেরা। যাই হোক, দেবুদার কাছে যেসব ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ভদ্রলোক এসে জুটেছেন, তাঁরা কিন্তু জমির লোভেই এসেছেন। বললাম, মুসলমানদের সঙ্গে দেবনারায়ণদার খুব মিল। যামিনীবাবু খুব হাসলেন।…কাদের সঙ্গে ওঁর মিল নেই? ক্রোশ পাঁচেক দূরে এক ইংরেজ সায়েব একটা রেশমকুঠি গড়েছে। তার নাম স্ট্যানলি! তার সঙ্গেও খুব মিল দেবুদার। কবে দেখবে সেও এসে পড়বে এখানে। অথচ আমার ইচ্ছা, ওই গোরাটাকে হত্যা করি। চমকে উঠে বললাম, সে কী! কেন? যামিনীবাবু গম্ভীর মুখে আস্তে আস্তে বললেন, নুরপুর বানুক (রেশমকুঠি) এলাকার তাঁতিদের সর্বনাশ করেছে। আর স্ট্যানলি খুব অত্যাচারী। এইসব কথা বলতে বলতে দেবনারায়ণদার ডেরায় পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যার উপাসনার আসর শুরু হয়েছে। বাঁশের খুঁটিতে কয়েকটা লণ্ঠন ঝুলছে রোজকার মতো। বেদিতে বসে দেবনারায়ণদা আব্বার মতো গম্ভীর স্বরে বেদমন্ত্র আবৃত্তি করছেন। যামিনীবাবু আস্তে বললেন, দেবুদার এটাই স্বর্গরাজ্য। ঘুরে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, হলুদ একটু অন্য বাঁকা হাসি। হাসিটা খারাপ লাগল। মজলিশে অন্যদিনের মতো বসতে যাচ্ছিলাম, যামিনীবাবু আমার হাত ধরে টেনে অন্ধকার অংশ ঘুরে ছিটেবেড়ার ঘরগুলোর দিকে নিয়ে গেলেন। “অতিথিভবন’ নামে সবচেয়ে লম্বা ঘরের বারান্দায় উঠে বললেন, ব্রহ্মসংগীত দূরে বসে শোনাই ভালো। একটু দূরত্বে না গেলে সত্যকে চেনা যায় না। এখান থেকে লোকগুলোকে লক্ষ করো। সত্য ধরা পড়বে।….যামিনীবাবুর এই হেঁয়ালি বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরে দেবনারায়ণদার উদাত্ত গলায় আবৃত্তি ভেসে এল আলোর দিক থেকে,

আনন্দাদ্ব্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে…

যামিনীবাবু চাপা ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, আনন্দ! কোথায় আনন্দ? সর্বত্র নিবানন্দ। সর্বত্র দুঃখ। অপমান অত্যাচার ।….

.

দ্বিতীয় কথাপকথন

দাদিমা। দাদিমা!

আমি এখানে।

আশ্চর্য মানুষ তুমি! বাইরে কী করছ?

খোকা এল না!

না আসুক। তুমি এসে শুয়ে পড়ো! এত রাতে বাইরে থেকো না!

আমার উর লাগে, খোকা কোথায় থাকে এত রাত অব্দি?

কোথাও আড্ডা দিচ্ছে। তুমি এসো। দরজা এঁটে দাও।

জানিস কচি, খোকার স্বভাব অবিকল তোর ছোটোদাদাজির মতো।

তাই বুঝি?

আমার ডর হয়, কবে না পুলিশ ওকে–

আঃ! চুপ করো! ঘুমোও।

তুই আমাকে অনেকদিন পরে দাদিমা বলে ডাকলি, কচি!

কে জানে বাবা! তোমাকে বাহাতুরে ধরেছে। কবে তোমাকে আবার দাদিজি বলতাম!

খোকা দাদিজি বলে। হাঁ, তুই দাদিমাই বলিস বটে। কিন্তু খোকা কেন দাদিজি বলে?

ভূতের মুখে রামনাম! ওর কথা ছাড়ো তো!

কচি, তুই একেবারে হিন্দু হয়ে গেছিস।

বেশ করেছি। হিন্দুদের দেশ। হিন্দু হতেই পারি।

যতই কর কচি, হিন্দুরা তোকে আপন করবে না।

তুমি অন্ধকারের প্রাণী। কী জান, কতটুকু জান? সব বদলে গেছে এখন।

তোর ছোটোদাদাজি বলতেন, মোসলমানদের একটা খোদা। হিঁদুর তেত্তিরিশ কোটি। মোসলমান একটা খোদা বরবাদ কবতে পারে। হিঁদুদের তেত্তিরিশ কোটি খোদা বরবাদ করা কঠিন।

ছোটোদাদাজি তোমার হিরো!

কী বললি?

ছোটোদাদাজি আমারও হিরো!

হিরো– সে আবার কী রে?

দিনে বুঝিয়ে বলব! আমার ঘুম পাচ্ছে।

চুপ! ওই বুঝি খোকা এল! খোকা, এলি?

আশ্চর্য! বাতাসের শব্দ। তোমার কানেও কি বাহাতুরে ধরেছে?

আমার শাশুড়িসাহেবা ঠিক এরকম বলতেন, জানিস? একটু আওয়াজ হলেই সাড়া দিয়ে বলতেন, শফি এলি? সারারাত এরকম। খালি ঘর-বার, খালি ছটফটানি। তারপর এক বর্ষার রাতে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। হাওয়া বইছে উথালপাথাল। আয়মনিখালা শাশুড়িসাহেবার কাছে শুয়ে আছে। হঠাৎ জানলার বাইরে কবিতাটি খুব মন দিয়ে পড়ছি, জানালার ওধারে ফুলগাছের কাছে, আনমনে চোখ তুলে একটি মেয়েকে দেখলাম। তখন যে-কোনো মেয়ে দেখলেই রুকুর সঙ্গে তুলনা। করার অভ্যাস ছিল। হয়তো আমার মনে ওই প্রচণ্ড কবিতাটির আবেগ ছিল, আমার দৃষ্টিতে তার প্রকাশ ঘটে থাকবে, মেয়েটি মুখ নামিয়ে নিল। দেখলাম, সে সাজিতে করে ফুল তুলছে। ওদেরই দেবনারায়ণদা বহরমপুর থেকে নিয়ে এসেছেন জানি। নিজের আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়েছেন। মেয়েটির নাম আমি জানতাম, ভারি অদ্ভুত নাম ও স্বাধীনবালা! তার মায়ের নাম সুনয়নী। সুনয়নী আমাকে অবাক চোখে দেখতে দেখতে বলতেন, তোমাকে বাবা মোছলমান বলে মনেই হয় না! রাগ হলেও মুখে। হাসতাম। বরাবর একটা কথা শুনতে-শুনতে অবশ্য খানিকটা সয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনবালাকে ফুল তুলতে দেখার পর, তাছাড়া ওইরকম সুন্দর চোখনামানো ভঙ্গি, আমার মনে হল, হয়তো যামিনীবাবু ঠিক বলেননি, সেই যে বলেছিলেন, কোথায় আনন্দ’? এই তো আনন্দ। ওই ফুল, ওই মেয়ে। আর ততদিনে দেবনারায়ণদা যেন আমার মাথায় আনন্দ ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আবাদের চাষিদের কোদাল কোপানোতে আনন্দ অনুভব করি। লাঙলের ফালে কর্ষিত উর্বর মাটির চিরে যাওয়াতে আনন্দ দেখি –ওইখানে একদিন অঙ্কুরিত হবে শুকনো বীজ থেকে সবুজ শস্য। বীজও নিজেকে চিরে নিয়ে আসে শ্যামলিমার লাবণ্য। জঙ্গলের ধারে দাঁড়িয়ে বৃক্ষলতার দিয়ে তাকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলে ওঠেন, ‘ওই আভূমিপ্রণত শ্যামলতা দুলিতেছে। আমি বদলে যাচ্ছিলাম অথবা বদলে গিয়েছিলাম। পান্না পেশোয়ারির কথা, সিতারার কথা, লালবাগ শহরের সমস্ত কথা পায়ের তলায় মাড়িয়ে ততদিনে আমার চলার গতি কমেছে। লাগামছাড়া ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়েছি, চলে গেছে। পেছনে, আমি পায়ে হাঁটছি। নিজের পায়ে হাঁটার মধ্যে আবিষ্কার করছি, আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ! যা ধ্বংস, যা মৃত্যু, যা দুঃখ, সবই একটি আনন্দের মৃত্যুর পর অপর একটি আনন্দের জন্ম। কদিন পরে সেই লাইব্রেরি ঘরে বসে “বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটি চটি বই পড়ছি, আমাকে চমকে দিয়ে স্বাধীনবালা ঢুকল। মুখ তুললাম না। সে বইয়ের আলমারিতে কোনো বই খুঁজতে থাকল। তারপর আস্তে বলল, আচ্ছা, লাইব্রেরিতে কোনো উপন্যাস নেই? বললাম, জানি না। স্বাধীনবালা একটু হাসল! কেন? আপনিই নাকি লাইব্রেরিয়ান? বললাম, না তো! স্বাধীনবালা বলল, দেবুজ্যাঠা বলেছেন। আচ্ছা একটা কথা জিগ্যেস করব, রাগ করবেন না তো? মাথা নাড়লাম। স্বাধীনবালা বলল, আপনি কি সত্যিই মুসলমান? ইচ্ছে হল রেগে একটা কড়া জবাব দিই, ওকে বলি –মুসলমান কি সৃষ্টিছাড়া প্রাণী যে তাকে আলাদা করে চিনে নিতে হবে? স্বাধীনবালা বলল, আমরা ব্রাহ্ম হয়ছি। ব্রাহ্মধর্মে হিন্দু মুসলমান খ্রীস্টান ভোদাভেদ নেই। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফের বলল, আপনার নামটা কী যেন –বললাম, সৈয়দ শফিউজ্জামান। স্বাধীনবালা বলল, উচ্চারণ করতে পারব না। ডাকনাম নেই আপনার? আস্তে বললাম, শফি। স্বাধীনবালা বলল, আপনাকে শফিদা বলব। আচ্ছা শফিদা, আপনার বাড়ি কোথায়? বললাম, মৌলাহাট। স্বাধীনবালা জেরা করে ঠিক ওর বাবার মতোই জেনে নিতে চাইছিল, কেন এবং কীভাবে আমি এখানে এসে জুটেছি। আমি একইভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। শেষে বললাম, আপনার বাবার সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল। অমনি স্বাধীনবালা চঞ্চল হয়ে উঠল। মনে হল, বাবা সম্পর্কে ও খুব কম জানে। আমি যামিনীবাবুর সঙ্গে আমার যা-সব কথা হয়েছিল, বললাম। শোনার পর স্বাধীনবালা আনমনা ভঙ্গিতে আঙুলে আঁচল জড়াতে-জড়াতে (আঃ! রুকুর এই ভঙ্গিটি মনে পড়ছিল) বলল, আমার একটা পিস্তল থাকলে আমি স্ট্যানলিকে গুলি করে মারতাম। এই কথাটা আমার বুকের ভেতর ধাক্কা দিল। ওকে কিছু বলতাম, কিন্তু দেবনারায়ণদা এসে গেলেন। মাঠ থেকে এসেছেন। খালিপায়ে ধুলোকাদা। মুখে ঘাম। কোনার দিকে তাপোশে বসে বললেন, একটা কথা মাথায় এসেছে। দুজনেই শো। শফি তো সেকেন্ড ক্লাস অব্দি পড়েছে। স্বাধীন পড়েছিস মাইনর অব্দি। ঠিক আছে। বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের দুজন টিচার পাওয়া গেল। শফি পড়াবি পুরুষদের, স্বাধীন মেয়েদের। কী? রাজি? স্বাধীনবালা খুশি হয়ে বলল, হুঁউ। আমি বললাম, কিন্তু– দেবনারাণদা রাগের ভঙ্গি করে বললেন, তোর মাথার ভেতর একটা কিন্তুর গোজ বসানো আছে ওটা ওপড়ানো দরকার। স্বাধীনবালা হেসে উঠল। দেবনারায়ণদা বললেন, হ্যাঁ। ওই কিন্তুটা তোর সর্বনাশ করবে, শফি! সামনে তোর বিশাল জীবন পড়ে আছে। তাকে ফুলেফলে ভরিয়ে তুলতে হবে –যেভাবে আমি আবাদের কাজে নেমেছি। বঙ্কিমচন্দ্র গোঁড়া হিন্দু। কিন্তু তাঁর ওই প্রশ্নটা আমার দারুণ ভালো লাগে? ‘জীবন লইয়া কী করিব?’ তোকে একটা কথা বলি, শোন। মুসলমান আর ব্রাহ্মদের মধ্যে একটা সাধারণ বেসিক ইউনিফর্মিটি আছে। মুসলমানধর্মে যার জন্ম, তার তিনটে মূল কালচার। ইসলামি কালচার, পারিপার্শ্বিকগত হিন্দু কালচার আর শিক্ষাসূত্রে লব্ধ পাশ্চাত্য আধুনিক কালচার। ব্রাহ্মদেরও তাই। ইসলাম-খ্রীস্টান-হিন্দু। হিন্দু মানে অরিজিন্যাল বৈদিক কালচারের কথাই বলছি। সুতরাং…দেবনারায়ণদা মুখ খুললে থামতে চাইতেন না। আমি আড়চোখে দেখছিলাম, স্বাধীনবালা খুব মন দিয়ে বক্তৃতাটা শুনছে।

এর মাসখানেক পরে এক বিকেলে বাঁধে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, স্বাধীনবালা আসছে। চোখমুখে পাগলাটে ভাব। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, সেই স্ট্যানলি এসেছে দেবুজ্যাঠার কাছে। শফিদা, আমাকে তুমি একটা পিস্তল জোগাড় করে দিতে পার? পার না শফিদা? কতজনের সঙ্গে তোমার জানাশোনা। সে কেঁদে ফেলল। তোমার পায়ে পড়ি শফিদা! আমাকে একটা পিস্তল জোগাড় করে দাও। আমি বিকেলের গোলাপি রোদে ওর কান্নাটা হয়তো উপভোগ করছিলাম।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *