০৮. কালো ঘোড়াটির পিঠে

….all my blood has turned
into her black poison/I am
the sinister glass in which
the shrew beholds herself.
–Baudelaire

কালো ঘোড়াটির পিঠে জিনের বদলে পুর তুলোর গদি এবং তার ওপর নকশাদার গালিচার সঙ্গে লাল জাজিম চাপানো ছিল। ঘোড়াটির কপালে সাজানো ছিল পেতলের। ঝকঝকে কলকা গড়নের সাজ। তাতে দুটি তলোয়ার আড়াআড়িভাবে খোদিত এবং শীর্ষে একফালি চাঁদ-তারা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এটি বুঝি মহরম অনুষ্ঠানে সেই দুলদুল। আসলে এইসব প্রতীক ছিল নবাববাহাদুরের নবারি ঐতিহ্যের ইজ্জতের স্মারক। নবাববাহাদুর তাঁর প্রিয় দেওয়ানকে ঘোড়াটি উপহার দিয়েছিলেন। আর সেই কালো এবং নবারি ইজ্জতের প্রতীক ঘোড়াটির পিঠে দেওয়ান বারি মিয়াঁ যখন শফিকে দুহাতে তুলে ধরে বসিয়ে দিলেন, শফি বুঝতে পারল, মানুষটির গায়ের জোরও কম নয়।

প্রথমে কিছুক্ষণ ঘোড়াটি কদমে হাঁটছিল। চাষাভুষো মানুষজন সসম্ভ্রমে রাস্তার দুধারে সরে দাঁড়াচ্ছিল। সকলেই আদাব বা সেলাম দিচ্ছিল দেওয়ানসাহেবকে। স্ত্রীলোকেরা থোমটার ফাঁক দিয়ে প্যাটপ্যাট করে চেয়ে দেখছিল। শফি বারি চৌধুরীর পেছনে পুতুলের মতো বসে ছিল। সে প্রশ্ন করতে চায়নি, এভাবে তাকে কোথায়। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেদিন ঠিক এমনি করে বারিমিয়াঁ তাকে হাতির পিঠে চাপিয়ে উলুশরার জঙ্গলে নিয়ে যান, সেদিনও তো সে প্রশ্ন করেনি!

তবে আজ তার এভাবে যাওয়ার মধ্যে চাপা একটা আড়ষ্টতা ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, সেদিন হাতির পিঠে যাওয়ার সঙ্গে আজকের এই ঘোড়ার পিঠে যাওয়ার। মধ্যে একা গুরুতর পার্থক্য কাছে। হরিণমারা পেরিয়ে গিয়ে শুকনো খটখটে সড়কে পৌঁছে বারি মিয়াঁ বললেন, আমাকে চেপে ধরে থাক এবার। নইলে ছিটকে পড়ে যাবি। তারপর শফি দেখল কালো ঘোড়াটি ছুটতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল শফি। একটু ভয়ও পেল। নিঃসাড় দুহাতে বারিমিয়াঁকে জোরে আঁকড়ে ধরল সে। আর সেই সময়, জীবনে এই প্রথম গতির সঙ্গে পরিচয় হল তার; সে গতি এমনই দ্রুততাপূর্ণ, এমনই দুর্দান্ত যে চরাচরের যাবতীয় রঙ-রূপ ও স্থিতি এককার হয়ে উলটো দিকে অপসৃত হতে থাকল। দুধারের বিস্তীর্ণ ধানখেত, ঘাস, গাছপালা, সবকিছুই হয়ে উঠল দাগড়া-দাগড়া সবুজ রঙের বিশাল একটা পোচ। শফি এই প্রথম গতি চিনল এবং জানল। সেই গতি তার শরীরকে কিছুক্ষণের জন্য জড়পিণ্ড করে ফেলল। তার চোখে পার্থিব সবকিছুই নিজস্বতা হারিয়ে একাকার হয়ে উঠল। সে জানল, গতি দুর্বার হলে মানুষ তার দৃষ্টিশক্তি যেন হারিয়ে ফেলে। সে অন্ধ হয়ে ওঠে। বাদশাহি সড়ক এবার ঢালু হয়ে উতরায়ে নেমেছে। জায়গায়-জায়গায় খানাখন্দে জল কাদা রয়েছে। কালো ঘোড়াটি প্রতিটি খানাখন্দ পার হবার সময় গ্রীবা আর মাথাটি উঁচু করে লাফ দিচ্ছিল আর প্রতিবার বারিমিয়াঁ শফিকে হুশিয়ার করে দিচ্ছিলেন। শফি আরও জোরে আঁকড়ে ধরছিল তাঁকে। কিছুক্ষণ পরে রাস্তা আবার শুকনো হয়ে উঠল। চড়াইয়ের দিকে মাথাতোলা রাস্তার দুপাশে এবার বাঁজা ডাঙা, তালগাছের সারি, কোথাও ঢিবির ওপর জীর্ণ মন্দির বা ভেঙেপড়া মসজিদ। ঘোড়ার খুরের আঘাতে ধুলো উড়ছিল। বারি মিয়াঁ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, এদিকটায় এবার চাষবাস হয়নি। নেচার বড়ো খেয়ালি, শফি! ফতেপুর অব্দি এই অবস্থা।

ফতেপুর চটি বলতে গোটাকতক দোকানপাট। প্রকাণ্ড এক বটের তলায় গোরুমোষের গাড়ি। দুটো একা ঘোডাগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সওয়ারিদের সঙ্গে কোচোয়ানের দরকষাকষি চলেছে। দেকানপাটের সামনে কিছু লোক দাঁড়িয়ে শালপাতার ঠোঙায় কিছু খাচ্ছে। একটা অশথগাছের ধার ঘেঁসে একটা মন্দির। তার উঁচু চত্বরে বসে আছে জনাদশেক সাধু। ছাইমাখা শরীর, মাথায় জটা, কোমরে একটুকরো লাল কৌপিন। তারা গাঁজার ছিলিম টানছে। বারি চৌধুরীর ঘোড়া থামতেই সামনের ময়রা-দোকান থেকে একটা কালো ঢ্যাঙা গড়নের লোক, পরনে হাঁটু অব্দি খেটে ধুতি, খালি গা, গলায় তুলসীকাঠের মালা, হন্তদন্ত বেরিয়ে এসে আদাব দিল। দোকানের সামনে ছোট্ট বাঁশের মাচা। তার ওধারে একটি আটচালা। আটচালায়। একদল লোক বসে তর্কাতর্কি করছিল। তারাও চুপ করে গেল এবং কালো ঘোড়াটিকে অবাক চোখে দেখতে থাকল। ময়রা লোকটি আদাব দিয়েই ঝটপট একটা কম্বল এনে বাঁশের মাচায় বিছিয়ে দিল। তখন বারিমিয়াঁ বললেন, বসব না হরিনাথ। রসকরা বা মনোহরা যা থোক কিছু দাও। বলে শফির দিকে ঘুরলেন।– হরিনাথের রসকরা খুব বিখ্যাত, বুঝলি শফি? আষাঢ়ে আমাদের ইন্দ্রাণী কাছারিবাড়িতে পুন্যার (পুণ্যাহ)দিন একমণ করে রসকরা লাগে। প্রজারা কাছারিতে ভেট দিতে আসে। তাদের কিঞ্চিৎ মিষ্টিমুখ করাতে হয়।

হরিনাথ একগাল হেসে শফির উদ্দেশে বলল, তা দেওয়ানসাহেব ঠিকই বলেছেন, বাবা! শুধু ইন্দ্রাণী কেন, হরিণমারার জমিদারবাবুদের বাড়িতে শুভকাজ হলেই এ হরিনাথকে তক্ষুনি তলব। আপনারা বসুন দয়া করে।

বলে সে দোকানে ঢুকল। বারিমিয়াঁ বললেন, কী রে শফি? তুই মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?

শফি হাসবার চেষ্টা করে বলল, না তো। এমনি। বারি চৌধুরী মিটিমিটি হেসে বললেন, বড়োগাজির কাছে তলোয়ারখেলা শিখছিলি। আমি হঠাৎ গিয়ে বাগড়া দিলাম বলে রাগ করে আছিস বুঝি? কাছারিবাড়িতে চল না। দেখবি, আমারও তলোয়ার আছে।

শফি আসলে তখনও শরীর থেকে গতির ঝাঁকুনি আর জড়তাটা কাটাতে পারে নি। বারি মিয়াঁ তার হাত ধরে বাঁশের মাচানে পাতা কম্বলের ওপর বসালেন। তারপর পাশে বসে বললেন, রসকরা খেয়েছিস কখনও?

শফি আস্তে বলল, বড়োগাজির সঙ্গে অমি নাশতা খেয়েছি। আর কিছু খাব না, চাচাজি।

তোকে নাশতা খাইয়েছে বড়োগাজি? বারি মিয়াঁ হেসে উঠলেন। খুব ভালো । ওকে আমি বলে রেখেছিলাম তোর দিকে নজর রাখতে। কারণ খোনকারের ছেলেটাকে আমি জানি। ভীষণ বখাটে ছেলে। ওর স্বভাবচরিত্রও নাকি ভালো নয়। এই বয়সেই কীসব কেলেঙ্কারি করে বসে আছে। তুই নিশ্চয় জানিস!

শফি অবাক চোখে তাকাল। সে জানে না।

হরিনাথ দুটি শালপাতার ঠোঙা এনে বলল, নিন দেওয়ান সাহেব।

শফি লক্ষ্য করল, সে দেওয়ানসাহেবের ছোঁয়া বাঁচাতে ডানহাতের ঠোঙাটি একটু ওপরে থেকে প্রায় থপাস করে ফেলে দিল। তার অবাক লাগাল, বারি চাচাজি দুহাত পেতে ঠোঙাটি লুফে নিলেন। শফি গোঁ ধরে বলল, আমি কিছু খাব না।

হরিনাথ একটু সাধাসাধির ভান করল। কিন্তু শফি হাত বাড়াল । তখন। বারি মিয়াঁ বললেন, ঠিক আছে, হরিনাথ। এতেই হবে। তুমি বরং জলের ব্যবস্থা করে।

বারি মিয়াঁ নিজের ঠোঙা থেকে একটা রসকরা তুলে জোর করে শফির মুখে খুঁজে দিলেন। শফি আড়ষ্টভাবে রসকরাটি গিলে ফেলল। মিষ্টান্নটি সুস্বাদু। কিন্তু এ মুহূর্তে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। একটু পরে হরিনাথ একটি কাঁচের গেলাস এনে কম্বলের ওপর রাখল। বারি মিয়াঁ শফিকে বললেন, গেলাসটা ধর শফি! হরিনাথ, ওকে জল দাও।

শফি গেলাসটি ধরলে হরিনাথ ঘটি থেকে আগের মতোই ছোঁয়া বাঁচিয়ে জল ঢেলে দিল। শফি গেলাসটা ধরে আছে দেখে বারি মিয়াঁ বললেন, কী? পানি খাবি নে?

শফি মাথা নাড়ল।

বারিমিয়াঁ ধমকের সুরে বললেন, তোর কী হয়েছে বল্ তো? মিষ্টি খেলি অথচ পানি খাবি নে কেন?

হরিনাথ হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল, খাও বাবা জল খাও! মিষ্টি খেয়ে জল না খেলে অম্বলের ব্যামো হয়। অগত্যা শফি জলটা খেয়ে ফেলল। তার রাগ হচ্ছিল, এই ময়রা লোকটি তাদের অত খাতির করছে। অথচ ছুঁতে চাইছে না। এদিকে কম্বলখানা যে পেতে দিয়েছে, তাতে তারা বসে আছে– এই কম্বলখানাও কি সে ছোঁবে না? এই সময় তার মনে পড়ে গেল, হরিণমারা স্কুলের গেটে বিস্কুটওয়ালা বদলাদের কথা। বদলাদ তো হাতে হাতে বিস্কুট দেয় মুসলমান ছাত্রদের!…

কিছুক্ষণ পরে বারি মিয়াঁ জল খেয়ে গ্লাসটি কম্বলের ওপর রেখে পয়সা মেটালেন। হরিনাথ দুহাত পেতে লুফে নেওয়ার ভঙ্গিতে পয়সা নিল। আবার আদাব দিল। বলল, অধমের দিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন, দেওয়ানসাহেব। কাছারিবাড়িতে গিয়ে দেখা করব’খন। একটুখানি নালিশ আছে।

কালো ঘোড়াটি মাচানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। পাথরের ঘোড়ার মতো সে স্থির। রাস্তার ওধারের বটগাছটি খানিক ছায়া পাঠিয়ে দিয়েছিল মাচান অব্দি। বারি চৌধুরী উঠে গিয়ে ঘোড়াটির গালে মৃদু থাপ্পড় মেরে আদর করতে-করতে বললেন, তোমার আবার কী নালিশ, হরিনাথ?

হরিনাথ করজোড়ে চাপা স্বরে বলল, আমার জ্যাঠতুতো দাদা–সেই অম্বিকা, সেই যে সেই–

বারি মিয়াঁ বললেন, কী করেছে অম্বিকা?

হরিনাথ ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে বলল, নগদ সাত টাকা পাঁচ আনা সেলামি গুনে দিয়ে অনাবদি জমিখানার বন্দোবস্ত নিয়েছি। নায়েবমশাই সাক্ষী –জিগ্যেস করে দেখবেন হুজুর! এখন অম্বিকা বলছে, ওই জমি নাকি আমার ঠাকুর্দার বন্দোবস্ত নেওয়া ছিল। আগের বছর ইস্তফা দিয়ে এসেছিল! আমি বললাম, বেশ –সেই ইস্তফানামা কাগজপত্র দেখাও।

বারি মিয়াঁ শফিকে বললেন, উঠে পড় শফি। শফি রেকাবে পা রেখে ঘোড়ার পিঠে চাপল। তারপর একটু পিছিয়ে বারি মিয়াঁকে জায়গা করে দিল। শফি সেই মুহূর্তে আবার টের পেল, কালো ঘোড়াটির শরীর থেকে একটা জোরালো স্পন্দন তাব শরীরে সংক্রামিত হচ্ছে। বারি মিয়াঁ ঘাড় ঘুরিয়ে হরিনাথের উদ্দেশে বললেন, ইস্তফাঁদেওয়া জমি নতুন বন্দোবস্ত দিলে তাতে আগের মালিকের হক থাকে না।

ঘোড়াটির যখন কদমে পা ফেলেছে, তখনও হরিনাথ করজোড়ে অনুসরণ করে জোর জলায় বলছিল, বলুন– বলুন তাহলে এটা অন্যায্য কি না!…।

হঠাৎ ঘোড়াটি ছুটতে শুরু করল। শফি আবার আঁকড়ে ধরল বারি চৌধুরীকে। বাদশাহি সড়ক আবার ঢালু হয়ে নেমে গেছে। আবার দুধারে দাগড়া-দাগড়া সবুজ শস্যক্ষেত্র, জটপাকানো ঝোঁপঝাড়, গাছপালা। আবার খানাখন্দ, জলকাদা। তারপর ঘোড়াটি খাল। সামনের প্রাচীন সাঁকোটি ভাঙা। একফালি অপ্রশস্ত কাঁদর দেখা যাচ্ছিল। রাস্তার ডানদিকে ঢালের ওপর গোরুমোষের দাগ। নিচের একটা ঘাসজমি পেরিয়ে দাগগুলো জলের ধারে শেষ হয়েছে। ওপাবে আবার সেই দাগগুলো ব্যানাকাশের জঙ্গল চিরে এগিয়ে গেছে। শিক্ষিত ঘোড়াটি সেই পথে নেমে সাবধানে জল পেরিয়ে ওপারে পৌঁছলে বারি মিয়াঁ বিরক্তমুখে বললেন, জেলাবোর্ডের এই সাঁকোটা মেরামত করার কথা। তদ্বির করে-করে হন্যে হয়ে গেছি। বড়োগাজিকেও বলেছি। কোনো লাভ হয়নি। আর স্থানীয় লোকেরাও যেমনি কুঁড়ে তেমনি বদমাইশ। এখানে প্রায়ই রাতবিয়েতে রাহাজানি হয়। গাড়োয়ানদের খন্দের বস্তা লুঠ হয়। তবু কেউ কিছু করবে না। ডিসট্রিকট কালেকটার ম্যাকফার্সনা সায়েবকে না ধরলে কাজ হবে না দেখছি।

ঘোড়াটি আবার ভালো রাস্তা পেয়ে দুলকি চালে হাঁটতে লাগল। বারি মিয়াঁ তাকে ছোটাতে চাইছিলেন না, সেটাই কারণ। কিছুক্ষণ পরে বারি মিয়াঁ সামনে একটা প্রকাণ্ড ঢিবির ধারে একটি বটগাছ দেখিয়ে বললেন, ওখানে গিয়ে একটু বসব আমরা। কেন তোকে এভাবে হঠাৎ তুলে নিয়ে এলাম, তোকে বলা দরকার।

এই বটতলাটি জনহীন। মৌলাহাটের দীঘির মতোই একটি বিরাট দীঘি দেখা যাচ্ছিল দুটি ঢিবির মাঝখান দিয়ে। কিন্তু তেমন কোনও বাঁধানো ঘাট দেখতে পেল না শফি। তবে বটগাছের পেছনে ঢিবির পারে ভেঙেপড়া একটা মসজিদ দেখল সে। প্রকাণ্ড সব পাথরের চাঙড় গড়িয়ে এসে বটগাছের গোড়ায় আটকে আছে। ঘোড়া থামিয়ে দুজনে নামল। ঘোড়াটা আগের মতো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।

একটা চাঙড়ে বসে বারি মিয়াঁ বললেন; সঙ্গে বন্দুক থাকলে আজ আমি ওই হারামজাদি মেয়েটাকে গুলি করে মেরে আসতাম।

শফি তাকাল। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করল না।

বারি মিয়াঁ বললেন দরিয়াবানুর সঙ্গে আজ আমার খুব ঝগড়া হয়ে গেছে। আমি ওকে বোঝাতে গিয়েছিলাম, রোজির সঙ্গে নুরুজ্জামানের শাদি দেয় তো দিক। রুকুর জন্য বরং অপেক্ষা করুক। শফি লায়েক হোক। লেখাপড়া শেখা শেষ হোক। তখন না হয় রুকুর সঙ্গে তার শাদি হবে। কিন্তু দরিয়াবানুর এক কথা। একই সঙ্গে দুই বেটির শাদি হবে। তার চেয়ে সাংঘাতিক কথা, ওই ধূর্ত মেয়েছেলে আগেই টের পেয়েছিল, আমি তোর শাদিতে নারাজ। তাই কী করেছে জানিস? বিয়ের তারিখ এগিয়ে এনেছে। সামনে শুকুরবার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। তুই তো জানিস, তোর আব্বা মসজিদেই থাকেন। সাংসারিক ব্যাপারে আর মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাঁর কথা হল, যা করার তা নুরু আর তোর মা করুন। তাতে তাঁর অমত হবে না। আর ব্যস! দরিয়াবানু কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।

একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ফেলে বারি চৌধুরী বললেন, তোর আব্বা বা তোর বড়ো ভাই আলেম লোক। তার ওপর ওহাবি না ফরাজি। ওঁরা আশরাফে আজলাফে (উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণে) বিশ্বাস করেন না। আমি ধর্মটর্ম মানি না। কিন্তু আমিও মানুষের মধ্যে ভেদাভেদে বিশ্বাস করি না। তবে আমি জানি, এজুকেশান কালচার বলে একটা ব্যাপার আছে। সেদিক থেকে আশরাফ-আজলাফ না মেনে পারা যায় না। দরিয়াবানু আজলাফ ঘরের মেয়ে। তার রুচি আলাদা। সে এজুকেশান কালচাব বোঝে না। সে শিক্ষার মূল্য কী জানে না।

বারি চৌধুরী চুপ করলেন। একটু পরে শফি মৃদুস্বরে বলল, আপনি আব্বাব সঙ্গে দেখা করেননি?

করেছিলাম।

আব্বা কী বললেন?

বারি মিয়াঁ একটু হাসলেন।…দরিয়াবানু আর তোর বড়ো ভাই যা বলছে, তাই বললেন। তবে তোর বড়ো ভাই আলেম হয়ে দেওবন্দ থেকে ফিরেছে। সে আমাকে খুব তম্বি করল। হুমকি দিল। বলল, আমি নাকি হিন্দুদের স্কুলে খ্রিস্টানি শেখাচ্ছি। শুনেছি, তোর বড়ো ভাই নাকি তোর আব্বার সঙ্গেও আজকাল কোরান-হাদিস নিয়ে তর্ক করে। সেদিন, নাকি মসজিদ-ভরা লোকের মধ্যে তোর আব্বাকে নুরু চার্জ করেছিল, কেন উনি তোকে ‘কুফরি কালাম (বিধর্মীর বিদ্যা) শিখতে দিয়েছেন? তোর আব্বা ওকে থাপ্পড় তুলে মারতে এসেছিলেন। লোকেয়া নুরুকে টানতে-টানতে সরিয়ে নিয়ে যায়।

শফি উঠে দাঁড়াল।…আমার এসব শুনতে ইচ্ছে করছে না। ইন্দ্রাণী আর কতদূর?

বারি মিয়াঁ আস্তে বললেন, আর ক্লোশ দুই মাত্র। চল, রওনা হওয়া যাক।

ইন্দ্রাণীতে নবাববাহাদুরের কাছারিবাড়িটি বিশাল। গেটে দুজন সঙ্গীনধারী দারোয়ান আছে। তিনদিকে সারবন্দি অনেকগুলো ঘর। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের অংশটি দোতালা। নিচের ঘরগুলিতে খাজাঞ্চিখানা, সেরেস্তা, মহাফেজখানা এইসব। প্রজাদের ভিড়ে কাছারিবাড়িটি গিজগিজ করছে। মাঝখানে খোলামেলা বিশাল এক চত্বর। দুধারে পাম আর ঝাউগাছের সারি। টুকরো-টুকরো কিছু ফুলবাগিচা। একখানে পুরনো ফোয়ারা। কিন্তু ফোয়ারাটি শুকনো। মাঝখানের যে স্তম্ভের ছিদ্র দিয়ে জল ছড়িয়ে পড়ত, তার মাথায় একটি মার্বেলের পরি সামনে ঝুঁকে কুণ্ডে জল ভরার ভঙ্গি করছে।

গেটের দুধারে দুটি কাঠমল্লিকা ফুলের গাছ। সেই ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ শফিকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল মৌলাহাটের খোঁড়াপিরের মাজারে রুকু-রোজির সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই আশ্চর্য সময়টির কথা। আর তখনই সে আবিষ্কার করেছিল, একটা কালো ঘোড়া তাকে রুকুর কাছ থেকে দূরে –বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের জন্য অসহায় অস্থিরতায় তার বুকের ভেতরটা কেঁপে-কেঁপে উঠেছিল।

দোতালার কয়েকটি ঘর নিয়ে সপরিবারে বাস করেন এসটেট ম্যানেজার প্রফুল্লরতন সিংহ। পাশেই হলঘরে মতো একটি ঘর দেওয়ানসাহেবের জন্য সব। সময় সাজানোগোছানো থাকে। ঘরের দেয়ালে হরিণ আর বাঘের স্টাফকরা মাথা, নবাববাহাদুরবংশের লোকেদের বড়ো-বড়ো সব তৈলচিত্র, একখানে একটি টেবিলআয়না। বড়োসড়ো সব জানলা। মাঝখানে কয়েকটা সুদৃশ্য গদিআঁটা চেয়ার আর মধ্যিখানে। মার্বেল পাথরেব ডিমালো একটি টেবিল। একধারে একটি পালঙ্কে বিছানা পাতা। বড়োগাজির ঘরটিকে একপলকেই তুচ্ছ করে ফেলেছিল এই ঘর। শফি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। প্রফুল্লবাবু কথা বলছিলেন বারি চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁরা কথা বলতে বলতে খোলা ছাদের দিকে এগিয়ে গেলে শফি উত্তরের জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। দেখল সামান্য দূরে একটা ছোট্ট নদী। নদীর এধারে নিচু বাঁধ। হিজল-জারুল জামগাছের সারি। নদীটি কানায়-কানায় ভরা। ওপারে শাদা কাশফুলের ভেতর একটি কুঁড়েঘর। তার সামনে একটা গাবগাছের তলায় বাঁশের মাচান। মাচানে বসে এক প্রায়-ন্যাংটো লোক তকলি ঘুরিয়ে সুতো কাটছে। জনহীন কাশবনের ভেতর একলা এক কুঁড়েঘর আর এক মানুষ শফিকে অবাক করে রাখল কিছুক্ষণের জন্য।

তারপর সে দক্ষিণের জানালায় গেল। নিচের প্রাঙ্গণ, পাম আর ঝাউগাছের সারি, ফুলবাগিচা, মৃত ফোয়ারা ও পরি আর তার ওধারে সেই হাতিটিকে শিরীষগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে সাতমার কান্নু পাঠানকে খুঁজল। কিন্তু দেখতে পেল না কোথাও।

প্রফুল্লবাবু আর বারি মিয়াঁ ঘরে ঢুকলে সে ঘুরে দাঁড়াল। প্রফুল্লবাবু বেঁটে গালাগোলা মানুষ। মাথায় টাক আছে। গোঁফটি প্রকাণ্ড। ভুরু কুঁচকে এবং মিটিমিটি হেসে শফিকে বললেন, কী? দেওয়ানসাহেবের পাল্লায় পড়ে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছ দেখছি! বসো, বসো! একটু জিরিয়ে নাও। তারপর কথাবার্তা হবে।

এইসময় উরদি-পরা একটি লোক ট্রেতে দু-গ্লাস শরবত এনে টেবিলে রাখল। প্রফুল্লবাবু শফির হাত ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। বারি মিয়াঁও বসলেন। প্রফুল্লবাবু যখন একটা গ্লাস তুলে শফির দিকে এগিয়ে দিলেন, সে গ্লাসটি নিল। আর তখনই এই হিন্দু মানুষটিকে তার আপন মনে হল। হরিনাথ কি এঁর চেয়েও উঁচুদরের মানুষ?

প্রফুল্লবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, বাবিবাহ মন্দ না! দেওয়ানসাহেব তা যাই বলুন! এই দেখা না, আমার বিয়ে হয়ে। হল ঠিক তোমার বয়সে। তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। এফ, এ পড়ার বছর আমি ছেলের বাপ হলাম। মন্দ কী ।

বারি মিয়াঁও হাসলেন…ঘরের শত্রু বিভীষণ একেই বলে! সিঙ্গিমশাই, ওকে তাতাবেন না।

প্রফুল্লবাবু মুখে কপট গাম্ভীর্য এনে বললেন, আলবত তাতাব। লোককে তাতানোই আমার কাজ।

বলে শফির দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে সকৌতুকে বললেন ফের, দেওয়ান সাহেবকে তুমি কী বল?

শফি সলজ্জ হেসে বলল, চাচাজি!

ঠিক আছে। আমাকে তুমি কাকাজি বলবে।

বারি মিয়াঁ বললেন, দ্যাটস এ টার্কি ওয়ার্ড সিঙ্গিমশাই! মুসলিমতুর্কিদের ভাষা।

আপনাকে নিয়ে পারা যায় না চৌধুরীসায়েব! প্রফুল্লবাবু শফির দিকে ঘুরলেন– ওঁকেও চাচাজি বলবে, আমাকেও চাচাজি বলবে। এটা হয় না। চাচাজি আর এই কাকাজি এক বস্তু নয়। থাকো কিছুদিন– হাড়ে-হাড়ে টের পাবে।

বারি মিয়াঁ বললেন, জানো তো শফি, সিঙ্গিমশাই মুখে বলছেন বাল্যবিবাহের পক্ষপাতী। এদিকে এখনও দুই মেয়ের বিয়ে দেননি। তাদের দিব্যি শহরের স্কুলে। কলেজে পড়াচ্ছেন।

প্রফুল্লবাবু সে-কথায় কান না করে উঠে পড়লেন।…ওসব থাক চৌধুরীসায়েব। বারোটা বাজে প্রায়। এবেলা শুনলাম মেহমানখানায় আপনাদের খাওয়া রেডি করেছে। যাই হোক, ওবেলা এই বান্দার ঘরে দুমুঠো খেতে হবে। কী গো? তুমি নাকি পিরসায়েবের ছেলে। খাবে তো হিন্দুবাড়ি? তোমার এই চাচাজি ভদ্রলোকের কিন্তু বহু আগে জাত গেছে!

বারি মিয়াঁ চোখে ঝিলিক তুলে বললেন, জাত কি আপনারও যায়নি সিঙ্গিমশাই?

ঠোঁটে আঙুল রেখে প্রফুল্লবাবু বললেন, চুপ, চুপ…

দুপুরে শফি ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকেলে কার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখল উদরদিপরা সেই লোকটা চায়ের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আদাব দিয়ে বলল, আর ঘুমোবেন না খোকামিয়াঁ! উঠে পড়ুন।

শফি উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, চাচাজি কোথায়?

দেওয়ানসাহেবের কথা বলছেন তো? উনি তোপপাড়া গেছেন। ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে।

সে সসম্ভ্রমে চায়ের পেয়ালাটি শফির হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল। শফি পেয়ালাটি হাতে দিয়ে দক্ষিণের জানালায় গিয়ে দাঁড়াল।

নদীর ওপারে কুঁড়েঘরের লোকটি এখন ভরা নদীতে জাল ফেলছে। বিকেলের রোদ টেরচা হয়ে পড়েছে নদীর বাঁকের ওপর। এপারের বাঁধে দাঁড়িয়ে আরেকটা লোক ওপারের লোকটিকে চিৎকার করে কিছু বলছে। এপারের লোকটিকে একটু পরেই চিনতে পারল শফি। এ সেই সাতমার কাল্লু পাঠান। এখন তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে কুর্তা, রীতিমতো মিয়াঁসাহেবটি। শফি চা শেষ করে নিচে নেমে গেল।

বিকেলেও সেরেস্তা আর খাজাঞ্চিখানায় লোকজনের ভিড়। শফি ফোয়ারাটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শাদা পাথরের পরিমূর্তির দিকে তাকিয়ে আবার তীব্রভাবে রুকুর কথা তার মনে পড়ে গেল। আর তখনই একটা প্রচণ্ড ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসল, সে কি চুপিচুপি পালিয়ে যাবে? বারিচাচাজি নেই। কেউ তাকে বাধা দেবার নেই। হঠকারিতায় সে গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেল। গেটের দুধারে দুটি কাঠমল্লিকাফুলের গন্ধ তার সেই হঠকারিতার গতি বাড়িয়ে দিল। শফি রাস্তায় পৌঁছুল।

ইন্দ্রাণী গ্রামটি কাছারিবাড়ির পেছনদিকটায় শুরু হয়েছে। বাদশাহি সড়ক গেছে তার মাঝখান দিয়ে। কয়েক পা এগিয়ে গেছে, কাল্লু পাঠানের ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল শফি। ঘুরে দেখল, কাল্লু হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। শফির বুকে রক্ত ছলকে উঠল। এই লোকটিকে কি তাহলে বারিচাচাজি তার পাহারায় রেখে গেছেন?

কাল্লু সেলাম ঠুকে বলল, ছোটাসাব! আপনি এসেছেন, হামি খবর পেয়েছে। তো উধার কাহা ঘুমতে যাচ্ছেন? আসেন, আসেন। আমি আপনাকে ঘুমিয়ে লিয়ে আসি।

শফি দাঁড়িয়ে আছে দেখে কান্দু চোখ নাচিয়ে বলল, গাওঁকি অন্দর কী দেখবেন ছোটোসাব? উধার কুছ ভি দেখনেকা নেহি আছে। আসেন, আপনাকে কোঠিবাড়ির জঙ্গল দেখিয়ে লিয়ে আসি।

সে হাত তুলে উত্তরদিকের ঘন গাছপালাঢাকা একটা জায়গা দেখাল। শফি বলল, না। আমি কোথাও যাব না।

কাল্লু খ্যা খ্যা করে অদ্ভুত হাসল ।…তো ঠিক হ্যায়! লেকিন গাওকি অন্দর মাত যাইয়ে।

শফি বলল, কেন?

গাঁওবালেকি সাথ হামলোগোঁকা বহত ঝামেলা মেলা চলছে। উও মাহিনা কাছারিতে হামলা কোরতে এল; তো মেনিজারবাবু পাইক ভেজে সব ঠাণ্ডা করে দিল।

আজ তো চাচাজির সঙ্গে গাঁয়ের ভেতর দিয়ে এলাম!

কাল্লু আবার হাসল।…দেওয়ানসাবের কথা আলাদা আছে। উনহিকে কৈ কিছু বলবে ইয়েহিম্মত কার আছে বোলেন? আরে ছোটাসাব, উনহি তো সব কাজিয়া রফা করে দিলেন।…কাল্লু চাপা স্বরে বলল, ওহি যো মেনিজারবাবু আছে না? উনহি খালি ঝুটঝামেলা কোরবেন — ফিকির কোরবেন। লেকিন ছোটাসাব, আপকা গোড় পাকড়ে বলছি, মেনিজারবাবুর কাছে বোলবেন না।

শফি আবার কাছারিবাড়িতে এসে ঢুকল। কাল্লু বারবার তাকে চাপা স্বরে অনুরোধ করছিল, ম্যানেজারবাবুর কানে কথাটা যেন না যায়। ফোয়ারার কাছে পৌঁছে শফি বলল, আমি কি কাছারিবাড়ির লোক যে আমাকে মারবে?

কাল্লু চলল, কুছু বিশোয়াস নাই ছোটাসাব। আপনাকে দেওয়ানসাহেবের সঙ্গে আসতে দেখেছে কী না বোলেন? তো ব্যস, আপনিভি কাছারির লোক হয়ে গেছেন।….

সে রাতে বারি চৌধুরী ফিরে আসার পর শনি জানতে পেরেছিল, কাল্লু পাঠান মিথ্যা বলেনি। বিশাল ইন্দ্রাণী পরগনা জুড়ে কিছু ছিমহল আছে। সেগুলোর মালিক হিন্দু বা মুসলিম জমিদার। নবারি মহলের সঙ্গে তাদের প্রায়ই সংঘর্ষ বাধে। ইন্দ্রাণী গ্রামটি এক মুসলিম জমিদারের এলাকাভুক্ত। সম্পর্কে তিনি হরিণমারার বড়োগাজির। আত্মীয়। মাঝে-মাঝে বড়োগাজি এসেও রফা করে দিয়ে যান। গ্রামটি মোটামুটি মুসলিমপ্রধান। এদিকে নবারি এসটেটের ম্যানেজার প্রফুল্ল সিঙ্গি মুখে যত অমায়িক হোন, অতিশয় ধূর্ত মানুষ। তাঁর কী অভিসন্ধি ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু বারি চৌধুরী জানেন, উনিই সব সংঘর্ষের প্ররোচনা দিয়ে থাকেন। খোলা ছাদে বসে যখন চাপাস্বরে বারি চৌধুরী শফিকে এসব কথা বলছিলেন, সেই সময় প্রফুল্লবাবু এলেন লণ্ঠন হাতে। বললেন, আপনারা অন্ধকারে এখানে বসে– এদিকে হরিবন্ধু আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আসুন, আসুন । আহারাদি প্রস্তুত।

সত্যিই প্রস্তুত অবশ্য হয়নি। ঝাড়লণ্ঠনটি জ্বলছে সন্ধ্যা থেকে। শাদা টেবিলে শুধু একটি জলের পাত্র। সেটি চীনেমাটির এবং কারুকার্যকরা। ওধারের ঘর থেকে দুটি লোক প্ৰকাঙ কাঁসার থালায় ভাত নিয়ে এল। ট্রেতে সাজিয়ে একগুচ্ছের তরিতরকারির বাটি আনল। এই প্রথম শফি হিন্দুবাড়ির রান্না খেতে চলেছে। প্রকাণ্ড থালার পাশে কী-সব ভাজাভুজি আর সবজির দলা দেখে সে পার্থক্যটা বুঝতে পারছিল।

একটু পরে ঘোমটা টেনে এক প্রৌঢ়া হিন্দু মহিলা এলেন। বারি চৌধুরীকে আদাব দিয়ে শফিকে দেখিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, এই বুঝি আপনাদের পিরসাহেবের ছেলে?

প্রফুল্লবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, দেখে কী মনে হচ্ছে বলো?

সিঙ্গিগিন্নি বললেন, চেহারা দেখে মনে হয় বাঙালির ছেলে। মুসলমান বলে চেনাই যায় না।

বারি চৌধুরী একটু হেসে বললেন, আপনাদের খালি ওই কথা! মনে পড়ে আমাকে প্রথমবার দেখে বলেছিলেন? আমাকে দেখেও নাকি

সিঙ্গিগিন্নি ঝটপট কথা কেড়ে এবং বিব্রত মুখে বললেন, না-না। সেভাবে বলিনি। সত্যি তো! মানুষের চেহারায় কি কিছু তফাত আছে? তবে যাই বলুন দেওয়ানসাহেব, এই ছেলেটিকে যদি ধুতিশার্ট পরিয়ে দেন, বামুনের ছেলে মনে হবে না? কেমন টকটকে গায়ের রঙ, কেমন নামুখের গড়ন!

প্রফুল্লবাবু একটু তফাতে চেয়ার টেনে বসে হতাশ ভঙ্গি করে বললেন নাও। শুরু হল! আরে বাবা, পোশাকের ভেতর মানুষ তো একই? সেই দুখানা ঠ্যাং, দুখানা হাত, একটা মুণ্ডু!

বারি চৌধুরী বললেন, তবে বউদির কথায় একেবারে সত্য নেই, তা নয়। পোশাকও বটে, আবার মুখের ভাষাতেও খানিকটা পার্থক্য থেকে গেছে হিন্দু মুসলমানে। কালচারাল ডিফারেন্স বলা যায়।

সিঙ্গিগিন্নি শফিকে দেখছিলেন। এক পা এগিয়ে এসে বললেন, বাড়িতে আর কে-কে আছে বাবা তোমার? বাবা তো শুনলাম পিরসাহেব। মা আছেন–শুনলাম। ক ভাইবোন তোমার?

শফি মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, তিন ভাই।

বোন?

বোন নেই।

বারি চৌধুরী বললেন, সমস্যা হল –মেজো ভাই প্রায় জড়বুদ্ধি। একটু বিকলাঙ্গও বলা যায়। ইদানীং নাকি কিছুটা সেরে গেছে কোন কবরেজের ওষুধ টষুধ খেয়ে। ওদিকে ওর দাদিআম্মা –মানে ঠাকুমা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। বড়ো ভাই দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে পাস করে মৌলবী হয়ে ফিরেছে। তারপর ঘটনা বলুন, দুর্ঘটনা বলুন –হঠাৎ বড়ো ভাই– আর এই নাবালক ছেলের একই সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। পরশু শুক্রবার বিয়ের দিন। কন্যা দুটি যমজ বোন। আমারই দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের মেয়ে। সে-ভাইটি অবশ্য বেঁচে নেই।

প্রফুলবাবু বললেন, আপনার বউদিকে বলেছি সব কথা।

সিঙ্গিগিন্নি শফিকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ক্লাসে পড়ছ তুমি?

জবাবটা দিলেন বারি মিয়াঁ।…ক্লাস সিক্স। অথচ এতদিনে ওর এনট্রান্স পাস করা উচিত ছিল। আসলে ওর বাবা মৌলানপির মানুষ। একেবারে যাযাবর স্বভাব। আজ এ গ্রামে, কাল ও গ্রামে– এই করে সপরিবারে ঘোরেন। ফলে শফির লেখাপড়ার কনটিনিউটি থাকে না।

শফি এই প্রথম হিন্দুবাড়ির রান্না খাচ্ছিল। অন্য এক স্বাদ যেন বড়োগাজির বাড়ির খাদ্যের চেয়েও সুন্দর একটা আস্বাদ পাচ্ছিল সে। এত ভালো ডালরান্না কখনও সে খায়নি। সামান্য শাকসবজিও যে এমন সুস্বাদু হয়, তার জানা ছিল না। ভাজা মাছের ঝোলটাও খুব তারিয়ে-তারিয়ে খাচ্ছিল সে। খাওয়ার দিকে মন থাকায় সে ওঁদের কথাবার্তায় কান করছিল না।

ভাতের শেষে চাটনি এল। তারপর দই আর সন্দেশ। দুপুরের বিরিয়ানি আর হালুয়া আজ রাতে তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। যদিও হরিনাথ ময়রার মতো সিঙ্গিগিন্নি শফির সঙ্গে দূরত্ব রেখে কথা বলছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বরে স্নেহ ছিল। আর ওই স্নেহের স্বাদও তার খাওয়াটিকে মধুর করে তুলছিল।

প্রশস্ত পালঙ্কে মশারির ভেতর শুয়ে সে-রাতে শফির ঘুম আসছিল না। একটু তফাতে বারিচাচাজির নাকডাকা, বাইরে নিঝুম চরাচরে পোকামাকড়ের ডাক, তারপর হঠাৎ দেউড়িতে ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনি। আর শফির মনে হল তার মা দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ কণ্ঠস্বরে কথা বলছেন। তার ইচ্ছে করছিল, চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু দেউড়িতে দারোয়ান আছে। ফটক বন্ধ। রুকুর কথা সে মন থেকে মুছে ফেললেও মাকে মুছে ফেলতে পারছিল না। অমন করে সেদিন কেন সে হঠাৎ মায়ের ডাক পিছনে ফেলে এল, একথা ভেবে তার বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা আবেগ ঠেলে বেরুতে চাইছিল। দেউড়ির ঘড়িতে যখন ঢং ঢং করে তিনবার ঘণ্টা বাজল, তখনও শফির চোখে ঘুম ছিল না।

পরদিন আব্দুল বারি চৌধুরী যখন তাকে ঘুম থেকে জাগালেন, তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। বারি মিয়াঁ বললেন, ঝটপট চা-নাশতা খেয়ে নাও। আজ থেকে তোমাকে ঘোড়ায় চড়া শেখাব।

শফির মনমরা ভাবটা অমনি কেটে গিয়েছিল। সেই কালো ঘোড়াটির পিঠে তাকে চাপিয়ে বারি মিয়াঁ কাছারিবাড়ির সামনের গোড়ো চটানে নিয়ে গেলেন। প্রথমে কিছুক্ষণ লাগাম নিজে ধরে পাশে-পাশে হেঁটে চললেন। তারপর লাগামটি শফির হাতে তুলে দিলেন। শিক্ষিত কালো ঘোড়াটি শফিকে মেনে নিল। ঘোড়ার চড়ার নেশা শফির পেছনের জীবনকে মুছে ফেলে আরেক জীবনে নিয়ে যেতে চাইছিল। সেই জীবন গতিময়। সে-জীবনে রুকু নেই, আর কেউ নেই। সে একা। তার মনে। হচ্ছিল, এই জীবনের চেয়ে কাম্য আর কিছু থাকতে পারে না।

আর এর তিন দিন পরে বড়োগাজি হঠাৎ এসে খবর দিয়েছিলেন, দরিয়াবানুর দুই মেয়ের সঙ্গে বদুপিরের দুই ছেলের শাদি হয়ে গেছে। দিল আফরোজের সঙ্গে নুরুজ্জামানের এবং দিলরুখের সঙ্গে মনিরুজ্জামানের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *