১২. কানা ঘোড়ার সওয়ার  

কানা ঘোড়ার সওয়ার  

…পান্না পেশোয়ারিকে ইট মেরে জখম করে শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। বারিচাচাজি বললেন, ‘লালবাগ ইজ দা টাউন অব দা ডেডস’–মৃতদের শহর, আর সেই মৃতদের শহরে শয়তানের প্রতিনিধি ছিল পান্না পেশোয়ারি। এই লোকটাকে দেখলেই সবরকমের লোক সেলাম ঠুকে বলত, আদাব পান্নাসাব! তাগড়াই চেহারা, ফিনফিনে মলমলের কোর্তার ওপর কালো ভেলভেটের জরিদার শলুকা বা সরি, কোমরবন্ধে গোঁজা বাঁকা খাপে চাকা ছোরা, মাথায় পাগড়ি, পায়ে নকশাদার লাল নাগরা পরে পান্না পেশোয়ারি বিকেলে ছড়িহাতে গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়াত। নবাব বাহাদুর ইন্সটিটিউশনে আমার সহপাঠী বিড়, যে ছিল নবারি খানদানের ছেলে, আমাকে বলেছিল, পান্নাবকো সবকোই সালাম দেতা, লেকিন হম নেহি। কাহে কী, আই বিলং টু দা নবাব ফ্যামিলি। বাট ইউ মাস্ট শফি, ভুলো মাত, হি ইজ আ ডেনজারাস ম্যান– খুদ শয়তান উসকো গার্ড দে রহা।

এই কথাটাও পান্না পেশোয়ারির প্রতি আমার রাগের কারণ হতে পারে। ‘মৃতদের শহরটা প্রচণ্ড ভিড়ে ভরা দিনমান। সন্ধ্যার পর থেকেই তার চেহারা কবরখানার। কেল্লাবাড়ি, যার পোশাকি নাম ছিল নিজামত কেল্লা, প্রায় এক বর্গমাইল জুড়ে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। তিনদিকে তিনটে প্রকাণ্ড দেউড়ি, একদিকে গঙ্গা। কেল্লাবাড়ির ভেতর নবাববাহাদুরের মোতিমহল, তার পিছনদিকটা জুড়ে ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গল। তার ভেতর জরাজীর্ণ সব একতালা খোপড়িঘর। আর উঁচু পাঁচিলটা ছিল অনেক জায়গায় টুটাফাটা। ভেতরে বাস করত নবাব-খানদানের অসংখ্য লোক। বিড্ডু তাদেরই একজনের ছেলে। গদ্দিনশিন নবাববাহাদুর-পরিবারের লোকেরা তাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করতেন। ওঁরা থাকতেন মোতিমহলে। এদিকে নহবতখানার ফটকের পেছনে ভেঙেপড়া কয়েকটা বাড়ি। তার ওপাশে কেল্লাবাড়ির পাঁচিল ঘেঁসে সারবন্দি ঘুপচিঘর। সেই ঘরগুলোতে থাকত বাতিল চাকর-নফরদের পরিবার। সাতমার কাল্লু পাঠান কেল্লাবাড়ির ভেতর পিলখানা বা হাতিশালায় যে ঘর পেয়েছিল, সেটা ছেড়ে চলে আসার কারণ, বিড্ডুর মতে, তার দুসরি বহু সিতারা। আর এটাই আশ্চর্য সিতারা ছিল কেল্লা বাড়ির অস্বীকৃত ‘নবাব’দের মেয়ে, তার বাবা আতা বেগ ছিলেন রোশন মহল্লার এক দরজি। দরজিগিরি করলেও লোকে। তাঁকে বলত আনবাব। বিড্ডু বলত, কেল্লাবাড়ির বান্দা-বাঁদিদের বংশও নিজেদের নবাব বলে চালায়, আর উজবুক শহরের লোক সেটা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে। কিন্তু পরে বারিচাচাজি বলেছিলেন, কাল্লুর ছোটোবউ সিতারা বিন্দুর এক চাচির (কাকিমা) মেয়ে। আর তখন থেকেই সিতারার দিকে আমার চোখ যায়।

নহবতখানার কাছে সারবন্দি একতালা ঘরের একটা জবরদখল করেছিল কাল্লু পাঠান। সেই ঘরটাতে থাকত এক বুড়ি, ইসমাইল কোচোয়ানের মা। ইসমাইল তার মাকে বাঁচাতে পারেনি, তার কারণ নাকি পান্না পেশোয়ারি। ইসমাইল থাকত রোশনিমহল্লার বস্তিতে। মাকে অগত্যা সেখানে নিয়ে যায়। আর তারপর থেকে পান্নাসাবেরও চোখ পড়ে সিতারার দিকে।

এসব কথা বিড্ডুর কাছে শোনা। বিড্ডুর আসল নাম ছিল মির্জা আরিফ বেগ। লম্বা, ছিপছিপে, ফরসা এই ছেলেটি আমাকে পাত্তা দিত। কাল্লুর ছোটো ভাই চুরু ছিল পিলখানার এক নোকর। চুল্লুর সঙ্গে বিছুই আমার পরিচয় করিয়ে দেয় ‘পিরসাহেবের ছেলে’ বলে এবং দুর্ধর্ষ চুলুই ছিল একমাত্র লোক, যে পান্নাসাবের থোড়াই পরোয়া করে। ফলে চুল্লুকে আমার ভালো লেগে যায়। বিড্ডু তার কাছে লুকিয়ে গাঁজার ছিলিম টানতে যেত। আমিও চুম্বুরই কথায় ছিলিম টানি। সারারাত পড়ে থাকি চুল্লুর ঘরে। ভাগ্যিস তখন বারিচাচাজি কোনো মহালে গিয়েছিলেন, আর তখন শীতকাল, ফসল ওঠার মরশুম, খাজনা আদায়ের তাগিদ তখন থেকেই শুরু হয়। মৃতদের শহরটা প্রথম দিন থেকেই খুব রহস্যে ভরা মনে হয়েছিল বলে রহস্য ফর্দাফাই করার জন্য সেটাই ছিল আমার সুসময়। বিড্ডুর সঙ্গে টো-টো-করে ঘুরতাম দিনে রাতে। স্কুলটাতে তত কড়াকড়ি ছিল না। কারণ বেশিরভাগ ছাত্ৰই নবারি খানদানের আর বাদবাকি সব নবাববাহাদুরের কর্মচারীদের সন্তান। ইংরেজির ওপরই বেশি ঝোঁক ছিল, তাই স্কুলে যাওয়াটা আমার পক্ষে ছিল ভারি অস্বস্তিকর। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই অ্যাংলো-ইনডিয়ান। একজন মেমসায়েবও ছিলেন, আলাদা ঘরে বোরখাপরা মেয়েদের ইংরেজি পড়াতেন। সেই প্রথম গোরাসায়েব এবং, মেমসায়ের দেখেছিলাম। তাঁদের মনে হত কথাবলা আজব রঙিন পুতুল। দুজন হিন্দু শিক্ষক, প্রচণ্ড বুড়োমানুষ, বাঙলা পড়াতেন। তাঁদের ক্লাসে বেশিরভাগই বাঙালি কর্মচারীদের ছেলেরা এবং মুসলিম ছাত্র মোটে কয়েকজন, আমিও। তবে প্রতাপশালী শিক্ষক বলতে আরবি-ফারসি-উরদুর মৌলবিসাহেবরা। কোনো–এক পিরসায়েবের ছেলে বাঙলা পড়ে, এটা তাঁদের কাছে বেজায় বেশরিয়তি, তাই আমাকে দেখলে তাঁরা মুখ ঘোরাতেন। কোন সুনির্দিষ্ট কারিকুলামহীন, খেয়ালখুশিমাফিক পড়াশোনার এই প্রাইভেট স্কুলে তবু ক্লাস, পরীক্ষা এসব ব্যাপার ছিল এবং ছাত্ররা কেউ ফেল করত না। আমিও ফেল করিনি।

বারিচাচাজি মহাল থেকে ফেরার পর নতুন বই কিনে দিয়েছিলেন। তাঁর খুশি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম নবারি স্কুলটি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই। গঙ্গার ধারে কেল্লাবাড়ির প্রধান দেউড়ির লাগোয়া দোতলা একটি ঘরে তিনি থাকতেন। ঘরটিতে প্রচুর বই আর পত্রিকা– বেশিরভাগই ইংরেজি, এবং বই-পত্রিকার দিকে আমার একটুও ঝোঁক ছিল না। আমার ভালো লাগত গঙ্গার পাড়ে ঝকঝকে একফালি রাস্তার ধারে ফুলবাগিচা, কাঠের ছাতাবসানো চবুতরা, সানবাঁধানো ছোট আর বড়ো ঘাট, আর গঙ্গা। শীতে কালো জলের তলায় ঝিকমিক করত কী সব জিনিস, মনে হত কবে কোন নবাবজাদির কানের মোতির ‘ল হারিয়ে গিয়েছিল, তারই খুঁড়ো। আর বিড্ডু বলত, উও সিরফ বালু– জাস্ট স্যানড। তুম কভি গঙ্গা নেহি দেখা, শফি? দিস রিভার যিতনি দুইরাসে আতি, যিতনি দুইবোসে যাতি, বহতি, মেরা খানদানকা মুল্লুক থি। শালে ইংলিশ লোগোনে লুঠ লিয়া। আই হেট দা বাটার্ডস। বিড্ডুর বাবা কলকাতায় চাকরি করতেন। তাঁকে কখনও দেখিনি। বারিচাচাজি বলেছিলেন, বিড্ডুব আব্বা কলকাতায় এক মেমসাহেবের সরদার খানসামা । কিন্তু সাবধান, বিড়কে বলিসনে এসব কথা। বলিনি। বিড্ডু বলত, সে বড়ো হলে ফৌজ জোটাবে। পান্নসাব তাকে সাহায্য করবে। সেই ফৌজ নিয়ে সে ইংলিশম্যানদের সঙ্গে জেহাদ লড়বে। কথাটা আমার, কে জানে কেন, ভালো লাগত। সেই ভালোলাগার সূত্রে পান্না পেশোয়ারিকেও সবে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম! অথচ সেই বিড্ডুই যখন বলত, সে পান্নাবকে ঘৃণা করে এবং লোকটা বিপজ্জনক, তখন অবাক লাগত। আসলে বিড্ডু ছিল অস্থিরচিত্ত, চঞ্চল, কিছুটা ভীতু স্বভাবের ছেলে। পান্না পেশোয়ারিকে দূর থেকে দেখলে এড়িয়ে যেত। ফিসফিস করে বলত, নজর কারকে দেখো, দেয়ার ইজ এ ডারক হ্যালো বিহাইনড হিম, বহত খতরনাক! উসকা সাথ বাত মাত করো কভি। হি ইজ ডেনজারাস।

বারিচাচাজির বাবুর্চি-নোকর বলতে বুড়ো করিম বখশ। সেও আমাকে পান্নাসায়েবকে এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিত। পরে একদিন করিম বখশ মুখ বিকৃত করে বলেছিল, পান্না পেশোয়ারির কাছে লড়কালড়কির কোনো ফারাক নেই। আপনার মতো সুন্দর ছেলের ওপর ওর নজর পড়লে মুসিবত হবে। সঙ্গে-সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। পান্না পেশোয়ারির ওপর আমার রাগের তৃতীয় কারণ এই।

একদিন কোনো মহালে প্রজাদের সঙ্গে হাঙ্গামা বেধেছে, বারিচাচাজি হাতি চেপে সেখানে গেছেন, সঙ্গে সাতমার কান্নু এবং একদঙ্গল ভাড়াটে বরকনদাজ, যারা তলব পেলেই আশেপাশের এলাকা থেকে এসে হাজির হত হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সামনে। তখন স্কুলে ছিলাম বলে সেই জঙ্গি সমাবেশ দেখতে পাইনি। করিম বখশ এবং পরে বিড্ডু এসে খুব রঙ চড়িয়ে বলল, ফৌজ রওয়ানা দিয়েছে। এতে বিড্ডুর খুশি আর উত্তেজনার কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না! গদিনশিন নবাববাহাদুর পরিবারের সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড শতা। অথচ বিড্ডুর নবারি রক্ত তোলপাড় হচ্ছে নাকি, বিড্ডু বলল, দা সেইম ব্লড শফি, খানদানকা খুন! সেই উত্তেজনায় সে আমাকে এখানে নিয়ে গিয়ে মজা লুঠবে বলে টানছিল। দক্ষিণের বড়ো দেউড়ির কাছে পৌঁছে পড়ে গেলাম পান্নাসাবের পাল্লায়। এড়ানো গেল না তাকে।

পান্নাবকে দুধারের টুলে বসে থাকা লিকলিকে চেহারার দুই প্রহরী, যাদের হাতে খুব লম্বা দুটো গাদা-বন্দুক এবং ডগায় সঙ্গিন আটকানো, সেলাম দিচ্ছিল। পান্নাসাবের চোখ পড়ল আমাদের দিকে। হেসে বলল, আরে বিড়! আআ যা মেরা পাশ! তারপর আমাকে দেখল সুরমাটানা চোখে। ইয়ে কৌন বে?

বিড্ডু আস্তে বলল, বাঙ্গালি। ছোটা দেওয়ানসাবকা ভাতিজা।

পান্না পেশোয়ারি এসে আমার চিবুক ধরে বলল, ওয়াহ! ওয়াহ! (বাঃ বাঃ)

ঝটপট সরে এলাম। প্রহরীদের একজন মুচকি হেসে বলল, কৈ পিরসাহাবা আওলাদ (পুত্র) হুজুর! বঙ্গাল মুল্লুককা বড়া পির, শুনা!

পান্না পেশোয়ারি সুরমাটানা কুতকুতে চোখে আমাকে দেখতে-দেখতে বলল, তো তুমি পিরসাহাবকা আওলাদ ঔর ছোটা দেওয়ানসাহাবকা ভাতিজা। ঠিক হয়! চলোমেরা সাথ ঘুমনো চলল! এ বিড্ডু তু ভি আ যা।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, বিড্ডু ইশারায় আমাকে দৌড়ে পালাতে বলছে, পান্না পেশোয়ারি ফের আমার চিবুক ধরতে এল!…কী? হামার কোথা সমঝাতে পারছ না? হাম হোড়া-থোড়া বাঙলা বোলে। বোলো, কী বোলবে, বোলো! মেঠাই খাবে? তো এসো, হামার সোঙ্গে এসো।

আবার পিছিয়ে গেলাম। বিড়ু হনহন করে চলে গেল রাস্তার দিকে। সেই সময় কোত্থেকে এসে পড়ল চুল্লু পাঠান। বলল, কা হুয়া পান্নাসাব? ঝামেলা মাত করো! মুশকিল হো যায়ে গা।

পান্না পেশোয়ারি বাঁকা হাসল ।…হাঁ বে চুল্লু! মুশকিল তো হরঘড়ি হোতা। তেরা ছোটিভাবিভি বলি কী, চুল্লু বাহাদুর মর্দ হো গেয়া– মুশকিল হো যায় গা। তো ঠিক হ্যায়।

সে টলতে-টলতে দেউড়ির ভেতর দিয়ে কেল্লাবাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। চুমু একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, শফিসাব, চলিয়ে মেরা সাথ।

বললাম, কোথায়?

চুল্লু হাসল ।… জানিবাবার মাজারে উরসশরিফের মেলায় যাচ্ছি আমি। ওইখান থেকে দেখলাম কী, শয়তান পান্নাসাব আপনাদের সঙ্গে কোথা বলছে। খবরদার! উও জাহান্নামি যোখন সামনে আসবে, দেখকে দূরে চলে যাবেন। ওই দেখুন, বিজ্ঞসাব কোথাতে চলে গেসে।

সে দেখিয়ে দিল রাস্তার ধারে একটা সন্দেশের দোকানের কাছে ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিন্দু। তার কাছে চলে গেলাম। আমাকে দেখেই বিড্ডু, বলল, কান্ অন্ শফি। জলদি আও।

বললাম, চুল্লু আমাদের ডাকছে।

চুল্লু-উল্লু ছোড়ো! বলে সে আমাকে টানতে-টানতে নহবতখানার দিকে হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। চুল্লু নিশ্চয় অবাক হয়েছিল। একবার ঘুরে দেখে নিলাম, সে সেখানেই দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। আমরা ডাইনে মোড় নিয়ে উত্তরের রাস্তায় হাঁটছিলাম। নহবতখানার তলা দিয়ে রাস্তাটা গেছে। পেরিয়ে গিয়ে বললাম, চুল্লু কোন্ উরসশরিফের মেলায় যেতে ডাকছিল। গেলে ভালো হত, বিন্দু।

বিড্ডু বলল, তার চাইতে বঢ়েয়া জায়গায় আমি তোমাকে লিয়ে যাচ্ছি। সে মুখ টিপে হাসল। তার কোর্তায় আতরের গন্ধ ভুরভুর করছিল। রাস্তাটা ঘিনজি, কালো পাথরের ইট এলোমেলো বসানো, খানাখন্দ এবং দুধারে জঙ্গলের ভেতর ধ্বংস্তূপ, কোথাও একলা-দোকলা জরাজীর্ণ একতালা ইটের বাড়ি-পলেস্তারা-খসে যাওয়া, শ্যাওলায় সবুজ, দাঁতবেরকরা কঙ্কালের মতো বাড়ি। গাছপালার ভেতর মসজিদের গম্বুজে একঝাক পায়রা বসে আছে। রাস্তাটা একেবারে জনহীন। বাঁয়ে ঘিনজি গলির ভেতর ঢুকে বিড্ডু জানাল, বিবিমহল্লা এটা। শুধু ছিটেবেড়ার ঘর, খড়ের চাল, কোথাও ইটের বাড়ি– একইরকম হতশ্রী। গোরু ছাগল মুরগি আর আনমনা লোকে ঠাসা। খাঁটিয়ায় বসে বুড়ো-বুড়িরা চাপা স্বরে কথা বলছে এবং হুঁকো টানছে। কেশে অস্থির হচ্ছে। দরজায়, অথবা ফোকর বলাই উচিত, একদঙ্গল করে মেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তারা বিড় আর আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসছিল। এমন সব ঠাট্টা করছিল যে আমি লজ্জায় আর অস্বস্তিতে আড়ষ্ট। আরপর আমার মাথায় এল, এরাই তাহলে বেশ্যা। আমি আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। মহল্লা ছাড়িয়ে গিয়ে সোজা বিকেলের গঙ্গার মুখোমুখি হলাম। পাড়ে একটা খাড়া পাচিল দাঁড়িয়ে, তার পাশ দিয়ে যাবার সময় বিড় চাপা হেসে বলল কানিজা-নানির হাভেলিতে তোমাকে লিয়ে যাচ্ছি। তুমি ভি নানি বোলবে। বুঢ়িয়া খুশি হবে।

ধ্বংসস্তূপ, গম্বুজওয়ালা পোড়ো মসজিদ, তার ভেতর একটা উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। একতালা একটা বাড়ি। বাড়িটার একটা উঁচু দেউড়ি আছে। কাঠমল্লিকার প্রকাণ্ড গাছ দেউড়ির পাশে। বন্ধ বিশাল কপাট জুড়ে কাঠের ফুলকারি, কপাট দুটো কোনো এক সময় ভীষণ লাল ছিল আর দেউড়িটাও ছিল শক্ত। এখন টুটাফাটা। কপাটের ফোকরে একটা মোটা দড়ি ঝুলছিল। দড়ির শেষে একটা লোহার ছোট্ট ডাভা। সেটা ধরে বিছু বার কতক টানল। ভেতরে ঢঙ ঢঙ করে ঘণ্টা বেজে উঠল। কপাটের। অন্য পাশটায় আরও একটা ঘুলঘুলি এবং সেখানে দুটো চোখ দেখে চমকে উঠলাম। কপাট ফাঁক হলে দেখলাম যার চোখ, সে একজন মোটাসোটা মধ্যবয়সী মেয়ে, সালোয়ার-কামিজ-উড়নি পরা। বিড্ডুকে সে আদাব দিল। বিছু বলল, মুন্নিখালা, ইয়ে মেরা দোস্ত শফি। বহত উঁচা খানদান। উঠোনে একটা ডালিমগাছের পাশে খাঁটিয়ায় একঝাঁক মেয়ে শুয়ে, বসে এবং পরস্পর হেলান দিয়ে কথা বলছিল। আমাদের দেখতে লাগল। বারান্দার ওপর ছোটো তত্তাপোশের বিছানায় বসে এক বৃদ্ধ ফরসিতে তামাক টানছিল। মোটাসোটা মেয়েটি গিয়ে তাকে বলল, বিড্ডুসাব আয়া আম্মি।

বৃদ্ধা ভুরু কুঁচকে বলল, কৌন রি?

বিড্ডু গিয়ে বলল, নানি! ম্যয় বিড্ডু হুঁ! ক্যায়সি হো তুম নানিজান? খবর আচ্ছি তো? বলে সে আমার নামটাই শুধু বলল। বৃদ্ধা ঘোলাটে চোখে আমাকে দেখতে দেখতে নলে টান দিতে থাকল!

মুন্নি, সেই মেয়েটা, আমার দিকে ঘুরে বলল, তুমি বাঙ্গাল আছ বাবু?

ততদিন আমার জানা হয়ে গেছে, এ শহরের উরদুভাষীদের ‘বাবু’ ‘হিন্দু বাবু’ নয়। বাবা আদরে বাবু হয়। বিজ্ঞ আমার পাঁজরে আঙুল ঠেকাল। বললাম, হ্যাঁ।

বৃদ্ধা, বিড্ডুর কানিজা-নানি নির্বিকার স্বরে বলল, বিড়ুয়া, তু বহৎ ঝুটবাজ।

কাহে রি নানি? বিড্ডু তার পাশে বসে পড়ল। আমাকেও অন্য পাশে বসতে ইশারা করল। কিন্তু আমি বসলাম না।

বৃদ্ধা ধোঁয়ার মধ্যে বলল, কোতোয়ালসাবকো তু কুছ নেহি বলিস! কাল হারামিবাচ্চা দারোগাবাবুকো সাথ লেকে আয়া। লোঠিশ লটক দিয়া দেউড়িমে। বোলা কী, আদালতকা পেয়াদাভি আবে! তো ম্যয় হাবেলি ছোড় কার কালকাত্তা জাউঙ্গি? কা?

বিড্ডু বলল, তেরা কিরিয়া নানি, খোদাকা কসম, কোতোয়ালসাবকো হাম

ছোড় বে শালে পাঠঠে! বৃদ্ধা তার পিঠে থাপ্পড় মারল বাঁ হাতে। ম্যয় পান্নাবকো খবর ভেজুঙ্গি।

মুন্নি এবার আমাকে একটা তেঠেঙ্গে কুরসি এনে দিল ঘর থেকে। কুরসিটার গদি আছে। মুন্নি আমার কাঁধ ধরে বসিয়ে দিল। অমনি বৃদ্ধা একটা হাত বাড়িয়ে বলল, এ বাঙ্গাল ছোঁড়া! কিতনা রূপেয়া হ্যায় তোরা পাস? নানিকো তো কুছ ইনাম দেনা পড়ে গা! দে!

নানি! বিড্ডু বলল। উও বাঙ্গালকা সবসে বড়া পিরসাবকা আওলাদ। উসকো পাস কৈ ফিকির মাত করুগি তু। উও সিরফ, তেরি সাথ মুলাকাতকে লিয়ে আয়া।

বৃদ্ধা ভুরু কুঁচকে বলল, আবে ছোড় শালে পাঠঠে! তেরা মতলব ময় সমঝি। উত্ত ভি রাঙিবাজ লড়কা!

নানি, এক শরিফ লড়কাকো তু–

বৃদ্ধা থাপ্পড় তুললে বিড্ডু উঠে দাঁড়াল। ইশারায় আমাকেও উঠতে বলল। ডালিমতলায় খাঁটিয়ায় মেয়েগুলো ভীষণ ফরসা –পাতাচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে। বিড্ডু বারান্দার ধাপ বেয়ে নেমে তাদের কাছে গেল। আমি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বিড়ু চাপাস্বরে মেয়েগুলোকে কিছু বলল। ওরা হাসতে লাগল আমাকে দেখিয়ে। রাগ করে বললাম, বিজ্ঞ আমি চলে যাচ্ছি।

একটি মেয়ে ভেংচি কেটে বলল, চোলে যাচ্ছি! বিড়ু দেখ বাঙ্গাল ছোকরা চোলে যাচ্ছে। এসো, এসো। যাবে কেনো? জেরা দুধ খেয়ে যাও, কোলে তো বোসো!

সে তার কোর্তা নামিয়ে স্তন দেখানোর ভঙ্গি করল। বিজ্ঞ খি-খি করে হেসে উঠল। আমি রাগে, দুঃখে লজ্জায় দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রকাণ্ড কপাটের হড়কো তুলে বাইরে গেলাম। মুন্নি হা-হা করে দৌড়ে এসে কপাট বন্ধ করল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিড্ডুর অপেক্ষা করলাম। কিন্তু বিজ্ঞ এল না।

বিবিমহল্লার ভেতর দিয়ে ফিরতে ইচ্ছে করল না। ডাইনে ধ্বংসস্তূপ, একটা কবরখানা আর ঝোঁপজঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে দূরে নহবতখানা চোখে পড়ল। কিছুটা হাঁটার পর একফালি পায়েচলা রাস্তা, রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে গঙ্গার দিকে, সেখানেই দেখা হয়ে গেল কাল্লু পাঠানের বউ সিতারার সঙ্গে।

সিতরা মাটির কলসি নিয়ে জল আনতে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বলল, শফিসাব! তুমি এখানে একেলা কী করছ? কী হয়েছে তোমার? অমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?

ওকে বলা যায় না আমি কোথায় গিয়েছিলাম, কী ঘটেছে এবং বিড্ডুই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সিতারার যতই বদনাম থাক খারাপ মেয়ে বলে, সেই মুহূর্তে সে কানিজাবেগমের হাভেলির বেশ্যাদের মতো কেউ নয়, একটি চেনাজানা মেয়ে এবং তার চেহারার নবারি খানদানের ছাপ, তার চলা-ফেরায় বা কথাবলার ভঙ্গিতে একটা চাপা আভিজাত্য– তা হোক না সে সাতমার কা পাঠানের বউ। আর বারিচাচাজি বলতেন, আনবাব জাত মানেন না, কেল্লাবাড়িতে একঘরে সেজন্য। বেচারার দুর্ভাগ্য, সাত আটটা মেয়ে, একটাও ছেলে নেই। তো কী করবেন? যাকে পছন্দ হয় এবং টাকা দিতে পারে, তাকেই একটা করে গছিয়ে দেন। তিন মেয়ের অবশ্য ভালো বর জুটেছে। তারা কলকাতায় আছে। বাকিগুলো বিলিয়ে দিয়েছেন যেখানে-সেখানে। তবে সিতারা কাল্লুর ঘরে গিয়ে ভালোই আছে শুনেছি।…

সিতারার কথার জবাবে বললাম, এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছি।

বিড্ডুকে সাথে নাওনি আজ? সিতারা হাসল। কাজিয়া হয়েছে নাকি?

নাঃ!

তো এসো আমার সাথে। আমি গোসল (স্নান) করব। তুমি আমাকে পাহারা দেবে।

ঘাট অব্দি আর একটা কথাও বলল না সে। আমিও চুপ করে থাকলাম। গঙ্গার পাড়ে একসময় দালানকোঠা ছিল। সব ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। ঘাটের দুধারে প্রকাণ্ড সব চাঙড়। ঘাটে স্বচ্ছ জলেও প্রচুর চাঙড় মাথা উঁচু কবে আছে। কলসিটা বুকে নিয়ে জনহীন ঘাটে সাঁতার কাটতে থাকল সিতারা। ওর পরনে বাঙালি মেয়েদের মতো শাড়ি। লম্বাহাতা কোর্তা। বাড়িতে সে লাল চটি পরে ঘোরে। এখানে তাকে দেখতে দেখতে আসমার কথা মনে পড়ে গেল।

নদীর সঙ্গে মেয়েদের কী যেন সম্পর্ক আছে– আমি ভাবছিলাম একটা চাঙড়ে বসে। যত ভাবছিলাম, তত আমাকে টানছিল নদী। তবে এ নদী সেই ছোট্ট নদীটি নয়। এর জলের রঙ স্বচ্ছ কালো। এ নদী বড়ো, এর বিস্তার আছে, কিন্তু স্রোত বইছে কি না বোঝা যায় না। দূরে জেগে আছে বালির চড়া। বাঁদিকে ঘুরে গেছে বলে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, যদিও জানি ওদিকটায় কেল্লাবাড়ি, ইমামবাড়া, হাজারদুয়ারি প্যালেস, মোতিমহল। হঠাৎ আমার কোর্তায় জল ছিটিয়ে দিল সিতারা। জলের শব্দের সঙ্গে বলল, আও শফিসাব–এসো! খেলা করব।

যদি এ নদী হত ইন্দ্রাণী কাছারির পেছনে সেই খরস্রোতা বেহুলা, আর সিতারা হত আসমা, তক্ষুনি ঝাঁপ দিতাম। কালো জলের দিকে তাকিয়ে আমার ভয় করছিল। ভয় করছিল সিতারাকেও। দূরে ওপারে বাঁশবনের পেছনে সূর্য ডুবে গেছে। আবছায়া ঘনিয়ে এসেছে চারদিকে। কালো জল আরও কালো হয়ে উঠেছে। সিতারা আবার জল ছুঁড়ে মারল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, এখনই ঠিক করে ফেলা উচিত, এই কালো নদীটিকে ভয় করব, না করব না। সে আমাকে টানছে, পাল্টা টান দেব কি না। কিন্তু টাগ অব ওয়ারে হেরে গেলাম।

হেরে গেলাম অথবা জিতে গেলাম। পায়ে চলা রাস্তাটা ধরে এগিয়ে বড়ো রাস্তায় পৌঁছে একবার মনে হল, সিতারা কী ভাবল আমাকে। যাই ভাবুক, ওর নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছি, এই আমার সুখ। আমি যদি জলে ঝাঁপ দিতাম, ও নষ্ট হয়ে যেত। কেউ ওকে বাঁচাতে পারত না, আমিও না।

সে রাতে খেতে বসে করিম বখশকে বললাম, হাবেলি কী করিম?

করিম বলল, কোনো? কোঠি। তো আপনি কোন হাবেলির কথা বলছেন ছোটোসাব? এ টৌনমে তো একহি হাবেলি আছে। বহুত খারাব জায়গা। কানিজা বেগমকি হাবেলি। বাইজিলোক থাকে।

কথায় কথায় সে একটা ইতিহাস শুনিয়ে দিল। রিসালাদার মির মুর্গিন খায়ের বউ ছিল কানিজা বেগম। বিশ বছর আগে মুর্গিন খাঁকে ডাকাত বদনাম দিয়ে সদর কালেকটার সিপাহি-পলটন পাঠায়। তোপখানার জঙ্গলে একটু লড়াই হয়েছিল। মুর্গিন ধরা পড়ে। সদর আদালতে তার ফাঁসির হুকুম হয়। কানিজা বেগম নাকি তার মৃত্যুতে খুশির খানা দিয়েছিল। কেল্লাবাড়ির কোতোয়াল বাকিউদ্দিনের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। সেই সময় কেল্লাবাড়ির গরিব মেয়েদের কিনে নেয় কানিজা এবং বাকিউদ্দিন তাকে সাহায্য করে। আসলে কানিজা নিজে ছিল বাইজির মেয়ে। লখনউ থেকে তাকে ভাগিয়ে এনেছিল মুর্গিন। ইতিহাসটি দীর্ঘ। খাওয়ার পরও করিম শোনাতে থাকল। বাকিউদ্দিন লোকটা নিজেই চোর, সে কেল্লাবাড়ির দামী জিনিস লুকিয়ে বেচে দেয়। তারপর কানিজার যৌবন ফুরিয়ে গেলে কীভাবে কোতোয়ালসাব ত্যাগ করে, করিম ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রচুর রস মিশিয়ে সেই বৃত্তান্ত বলল। কোতোয়ালসাব বহত হারামি লোক। থানার দারোগাবাবু তার দোস্ত। সদরে কালেকটারবাহাদুরকে দরখাস্ত ভেজেছে, হাবেলিতে খানকি লিয়ে বেওসা হচ্ছে। তো আফশোস কি বাত, গদ্দিনসিন নবাববাহাদুর ভি সহি দিয়েছেন দরখাস্তে। নোটিশ জারি হয়েছে, হাবেলি ছেড়ে দিতে হবে। এখন বলুন ছোটাসাব, বেউশ্যা বলুন কী কসবি বলুন কী খানকি বলুন, বিবিমহল্লার কথা উঠল না কেনো? না –পান্নাসাব বিবিমহল্লার জিম্মাদার! করিম বখশ হাসল। দাড়ি চুলকে বলল, কুছু হোবে না। কুছু হবে না, কেনো– কী, কানিজা বেগম বড়ি ধড়িবাজ আওরত আছে। পান্নাবকে ধরবে। ব্যস!…

.

পরদিন স্কুলে বিড্ডুর সঙ্গে দেখা হলে সে স্কুলের পেছনে গঙ্গার পাড়ে নিয়ে গেল আমাকে। হাসতে হাসতে বলল, ইউ আর কাওয়ার্ড, শফি। ভেগে এলে। কেনো? হোয়েন ইউ গো দেয়ার, ইউ মাস্ট নিড এ বিট পেশেন্স। আজ যাবে তো, বোলো?

বললাম, না।

বিড্ডু আমাকে তার বরাতে শেষ অব্দি কী ঘটেছিল, না শুনিয়ে ছাড়ল না। সেই অশ্লীল গল্প শুনে এত খারাপ লাগল যে ঠিক করলাম, আর ওর সঙ্গে মিশব না। নিজেকে আর নষ্ট হতে দেব না। ছুটির পর সেদিন সে আমাকে ডাকতে আসবে ভেবে কেল্লাবাড়ির ভেতর মোতিমহলের সামনে দিয়ে হেঁটে হাজারদুয়ারি প্যালেসের কাছে একটা চবুতরায় বসলাম। নিচে ধাপবাঁধানো ঘাট। চবুতরায় কেন্দ্রে কাঠের ছাতার তলায় বসে গঙ্গা দেখছিলাম। সূর্য ডুবছিল ওপারের গ্রামের আড়ালে। তারপর হঠাৎ নির্জনতা অসহ্য লাগল। ইমামবাড়ার পাশ দিয়ে উত্তরের ফটক পেরিয়ে ডাইনে ঘুরেছি, আবার পড়ে গেলাম সিতারাব সামনে।

সে স্নান কবে বাড়ি ফিবছিল। কাঁখে মাটিব কলসি। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, সেও বিড্ডুব মতো একটা কিছু বলবে। ঠাট্টা কববে। কিন্তু তেমন কিছু কবল না সে। একটু হেসে বলল, বোজ এমন কোবে তোমাব সাথে দেখা হলে মুশকিল শফিসাব!

বুঝতে না পেবে বললাম, কী মুশকিল তোমার?

আছে। তোমাকে বলব না।

চুপ কবে আছি দেখে সে ফেব বলল, তুমি এত্তো কম কথা বোলো কেনো শফিসাব? জওয়ান লডকা– তুমি মেয়েলোকের মতো চুপ থাকো হবঘডি। কুছু তো বলবে? তো বোলো। আমি শুনব।

আস্তে বললাম, কী বলব তোমাকে?

বলবে। আমি দেখতে পাই, তোমার মুখে বহত কথা লিখা আছে। তাই বলবে।

কিছু লেখা নেই আমার মুখে।

পিছু ফিবলে সিতারা ডাকল, শফিসাব, শুনো! একটা কথা শুনো।

কী?

আমি কাল্লু-পাঠানেব বহু বলে তুমি আমাকে কামিনা নীচ লড়কি ভেবো না। মুখসুদাবাদ নিজামতেব সবচাইতে উঁচা খানদানেব খুন আছে আমার গাযে!

অবাক হয়ে বললাম, ওসব কী বলছ, সিতারা?

আমি কসবি না।

সিতারা! তুমি কেন এসব বলছ?

সিতারা মুখ উঁচু করে বলল, আমরা শিয়া আছি। তোমরা সুন্নি আছ। তোমার আব্বাজান শুনেছি বুজুর্গ পির। তা না হলে লালবাগের কোনো শিয়া মেয়েলোক তোমার সাথে কথা বলত না!

বলে সে ভিজে কাপড়ের শব্দ তুলতে-তুলতে চলে গেল। তারপর মনে পড়ল, প্রথম যেদিন কাল্লু পাঠান আমাকে খাতির করে তার বাড়ি নিয়ে যায়, সিতারাকে জানিয়ে দিয়েছিল, শফিসাব সৈয়দ। সিতারা বাঁকা হেসে বলেছিল, সৈয়দ? তো সুন্নি কাহে? আব্বাজান বোলা, সব সৈয়দ শিয়া হোনে লাগে। শফিসাব, তুমি কেমন সৈয়দ আছ দেখি। সে খপ করে আমার হাত ধরে ফেলেছিল। কাল্লু হেসে অস্থির! সিতারা বলেছিল, সৈয়দ হলে আমার হাত পুড়ে যেত। গেল না। তুমি ঝুটা সৈয়দ আছ! অবশ্য সে হাসছিল। তুমি রাগ করেছ আমার কথায়? দেখ, মোতিমহলের। নবাববা বলে তারা সাচ্চা সৈয়দ। তারা আমাদের বলে, বান্দা-চাকর-নোকরের খানদান। লেকিন তুমি দেখো, যখন আমি তোমার হাত পাকড়ালাম, সাচ বোলো, আমার হাত আগুন মনে হয়নি? কাল্লু হেসে গড়িয়ে পড়েছিল! জবাব দিজিযে ছোটাসাব! হামি কুছু বলবে না। আপনার জবাব আপনি দেবেন। ঔব যে সিতারা! তমিজসে বাত কব উনহি কা সাথ। তুম তুম কবতি কিঁউ বি? সিতারা তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, চুপসে বৈঠো! ছিলিম পিও। ম্যয় মেহমানকা সাথ আপনা খোলসে বাত কবুঙ্গি …।

একটা কামানের ওপর বসে থাকতে-থাকতে চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াতে শুরু করল। তখন নহবতখানার দিকে হাঁটতে থাকলাম ফটক পেরিয়ে। ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর পর সারবন্দি একতালা ঘরের এদিকে শেষপ্রান্তে কাল্লুর বাড়ি। সামনে বেড়াঘেরা। একটুকরো উঠোনে পেয়ারাগাছ। বারান্দায় লানটিন জ্বলছে।

আস্তে ডাকলাম, সিতারা!

সিতারা ‘কৌন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধড়াস করে উঠল। ভাবলাম পালিয়ে যাই চুপিচুপি। কিন্তু সিতারা আমার স্বর চিনতে পেরেছিল এবং জ্যোৎস্নাও তখন স্পষ্ট। সে বারান্দা থেকে নেমে বেড়ার আগড় খুলে বলল, এসো। অমন দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। ভেতরে এসো।

বারান্দার খাঁটিয়ায় সে একটা সুজনি এনে বিছিয়ে দিল। এতক্ষণে দেখতে পেলাম, ঘরের ভেতরে কেউ শুয়ে আছে কাঁথামুড়ি দিয়ে। সেদিকে তাকাচ্ছি দেখে সিতারা একটু হেসে বলল, মেরি শাস– শাশুড়ি আছে। রিমার হয়েছে।

কাল্লুর মা কাঁথা থেকে মুখ বের করে বলল, কৌন রি বহু?

ছোটা দেওয়ানসাবকা ভাতিজা। পিরসাবকা আওলাদ। উওদিন আয়া থা না?

হাঁ। বলে বৃদ্ধা আবার কাঁথামুড়ি দিল।

সিতারা আস্তে বলল, বোলো!

কী বলব? হঠাৎ মনে হল, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ হয়তো। তাই চলে এলাম।

সিতারা একটু চুপ করে থাকার পর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চায়পাত্তা আছে। চায় খাও! আমিও খাব।

এমন করে চলে এসে অস্বস্তি হচ্ছিল। বললাম, না, থাক।

কেন থাকবে? বলে সিতারা বারান্দার কোনায় উনুন জ্বালতে বসল। পাশের ঘরগুলোতে লোকেরা চাপাগালায় কথাবার্তা বলছিল। একটা কুকুর ক্রমাগত ডাকছিল। সে থামলে কাছেই কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল। অমনি কুকুরটার চেঁচামেচি বেড়ে গেল। আশেপাশের জঙ্গলে বাঘ আছে বলেছিল করিম বখশ। শীতের সময় তোপখানার ঝিলের দিকে সে নাকি বাঘের ডাক শুনেছে। এদিকটা একেবারে নিশুতি, শহরের শেষপ্রান্ত এবং ধ্বংসস্তূপ, কবরখানা, পোডড়া মসজিদ, জঙ্গল আর মাইলের পর মাইল আমরাগান। ভাবছিলাম নহবতখানার ওদিক দিয়ে ফিরব না। যে পথে এসেছি, সেই পথই নিরাপদ। তবে উত্তরের ফটক খোলা পাব না! স্কুলবাড়িটার পেছনে ভাঙা পাঁচিলের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। গঙ্গার ধারে পৌঁছতে পারলে আর ভাবনা নেই। চেনা জায়গা। কেউ জানতেও চাইবে না আমি কে।

সিতারা চায়ের পাতা মাটির হাঁড়িতে সেদ্ধ করে তাতে দুধ আর একগুচ্ছের বাতাসা ফেলে দিল। ওর চায়ের স্বাদ অন্যরকম। শাদা ন্যাকড়ায় ছেকে দারুণ সুন্দর দুটো চিনেমাটির পেয়ালায় ঢালল। মেঝেয় বসে বলল, পিও–খাও! সে হাসল। বাঙলা কথা আমি শিখতেই পারলাম না। কী করে শিখব? বিয়ের পর কেল্লাবাড়ি থেকে বাইরে আসলাম। তখন একটু শিখলাম। আগে তো কুছু জানতাম না– একটা কথা বলতে পারতাম না। বোলো, এখন কত পারছি। পারছি না?

পারছ।

তুমি বেশি কথা বললে অনেক শিখা হয় যেন! বোলো কথা বোলো।

তুমি আগে বলল, কেন রাগ করেছ আমার ওপর?

আমার খুশি। তুমিও রাগ করতে পার। পার না?

না।

কিছুক্ষণ ফু দিয়ে শব্দ করে-করে চা খাওয়ার পর সিতারা একটু হাসল।… তুমি আরও বড়ো হও। জওয়ান হও পুরা। তখন সব সমঝাবে। সব কথা বুঝতে পারবে। এখন তুমি ছোটা লড়কার মাফিক আছ, শফিসাব। জান? তুমি তাই আমাকে খারাব মেয়ে ভেবেছ।

পেয়ালা রেখে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, আমি খারাপ মতলব নিয়ে আসিনি তোমার কাছে।

আমার গলার স্বর একটু চড়া হয়ে গিয়েছিল। কাল্লুর মা কাঁথা থেকে মুখ বের করে বলল, কারি বহু? কিসকা সাথ করার করতি তু? কাল্লুবেটাকো আনে দো–

চুপ! চুপ্‌ সে নিদ যাও। গলা দাবা দুঙ্গি!

সিতারার চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। উঠোনে নেমে সে আমার সঙ্গ নিল। তুমি তাহলে রাগ করতে পার দেখলাম। বাহাদুর তুমি! সে হাসতে লাগল।

পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে আগড়টা খুঁজছিলাম। হঠাৎ সিতারা এসে আমার একটা হাত নিল। শিউরে উঠলাম। তারপরই মনে হল, ও আমাকে হয়তো পরীক্ষা করছে। হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম। সিতারা শাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে বলল, নাদান! বুদ্ধ! আমার হাতকে কী ভাবলে তুমি? গরম লাগল? আগুন জ্বলে গেল?

সে এগিয়ে গিয়ে আগড়টা খুলে দিয়ে একটু তফাতে দাঁড়াল। আমি বেরিয়ে গেলে সেটা জোরে বন্ধ করে দ্বিল। যখন হেঁটে চলেছি, মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। কোথায় যাব জানা নেই।….

.

সেই বসন্তকালে মৃতদের শহরে সিতারা আর আমি যেন একটা অদ্ভুত লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছিলাম। মাঝে-মাঝে মনে হত, খুব শিগগির আমার বড়ো হওয়া দরকার–সিতারার ভাষায় পুরা জওয়ান। তবে মানুষের জীবনে একেকটা সময় আসে, যখন মনের বয়স শরীরের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। সেই দ্রুতগামিতায় একটা অন্ধ ঘোড়ার গতিবেগ থাকে যেন। আমি ছুটছিলাম, ছুটছিলাম, ছুটছিলাম এক বিব্রত সওয়ার হাতে চাবুক নেই আর ঘোড়াটাও লাগামছাড়া। এই ছুটে চলার মধ্যেই কদিন পরে এক সন্ধ্যার জ্যোৎস্নায় গঙ্গার ধারে নির্জন চবুতরায় সিরাকে আবিষ্কার করে চমকে উঠেছিলাম। সে বলল, তোমার সাথে একটা জরুরি কথা আছেশফিসাব। করিম বুঢ়া হারামি লোক। তোমার চাচাজি কুছু বললে তোমার বদনাম হবে। সেজন্য এখানে বসে আছি।

বুঝলাম সে ফটক থেকে আমার এখানে এসে বসে থাকা লক্ষ্য করেছে বোজ। কাঠের লম্বা বেনচের এক কোণে বসে ছিল সিতারা। তার ওপর কাঠের ছাতার গাঢ় ছায়া পড়েছিল। একটু তফাতে বসে বললাম, বলল।

সিতারা বলল, তুমি আমার কাছে আসবে? এসো– এখানে এসো। কেউ দেখতে পাবে না।

একটু সরে গেলে সে আমার হাত ধরে আরও কাছে টানল। আমার শরীর, হারামজাদা কুত্তা শরীর, ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠতে চাইল–আর্তনাদের মতো। কিন্তু সিতারা হাত ছেড়ে দিল তখনই। ফিসফিস করে বলল, ভেবেছিলাম বিড়কে দিয়ে তোমাকে ডাকব। লেকিন বিড় আমকে খারাব ভাববে। ছোটদেওয়ানসাব ফিরে এলে তুমি তাকে একটা কথা বলতে পারবে –আমার জন্য?

বললাম, কেন? কাল্লুভাইকে বললেই পার।।

চুপ। সব সেই হারামির কারসাজি। সিতারা তেমনি চাপা স্বরে বলল। পান্নাসাব বহত জুলুম করছে পরশুরোজ থেকে। আজ দুপুরে আমার ওপর জুলুম করতে এল। চাকু দেখাল। আমি তলোয়ার দেখলাম– আমার ঘরে তলোয়ার আছে। তখন। হারামজাদ খবিস বলে গেল, আমাকে লুঠ করে কলকাত্তায় বেচে আসবে।

তুমি চুল্লুকে বললে না কেন? পান্নাসাব চুল্লুকে ভয় করে।

চুলু একা। পান্নাসাবের পিছে টেনের অনেক গুণ্ডা আছে। খানদান লোকেরা আছে। পান্নাসাব শুধু ছোটাদেওয়ানসাবকে ভয় করে। কেনো কী– নবাববাহাদুরের কাছে বললে কালেকটার বাহাদুরকে উনি খবর ভেজবেন। তখন শয়তানকে কয়েদখানায় নিয়ে যাবে সিপাহিলোক।

একটু চুপ করে থাকার পর বললাম, তুমি নিজে চাচাজিকে বলবে না কেন?

সিতারা মুখ নিচু করে বলল, আমার শরম বাজে।

পরে বুঝেছিলাম এও তার খেলা। শরম একটা মিথ্যে ওজর। আসলে সে আমাকেই তাতাতে এসেছিল। আমি কী বলি, কেমন হয়ে উঠি, কী করি, এইসব আঁচ করতে চেয়েছিল সে। আর বোকার মতো আমি সেই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। সিতারার মুখ নিচু করে আধো-আধো স্বরে ভিজে গলায় শরম’ শব্দটা উচ্চারণ আমাকে এমন ঝাঁকুনি দিল, একটা চরম বোঝা পড়ার ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসল। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চলি।

চবুতরা থেকে লাফ দিয়ে নামলে সিতারা বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ? একটু বসো।

সেও নেমে এল। আমার কাঁধে হাত রাখল। বললাম, তুমি আর এখানে থেকো না! টহলদার বেরোনোর সময় হয়েছে।

দেউড়ির দিকে ঘণ্টাঘড়ি বাজছিল। গুনে দেখিনি কবার বাজল। কিন্তু ঘণ্টার শব্দ শুনেই সিতারা হনহন করে চলে গেল। মোতিমহলের পাশ দিয়ে পেছনের কেল্লাবাড়ির মুখ থুবড়ে পড়ে-থাকা ফটকের ভেতর তার অদৃশ্য হওয়া পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, জ্যোৎস্না এত উজ্জ্বল। বুঝতে পারলাম সে রাত কাটাতে যাচ্ছে বাপের বাড়িতে।

পান্না পেশোয়ারির আস্তানা ছিল রোশনিমহল্লার ভেতর একটা ঘিনজি গলির মুখে। বিড্ডু একদিন বাড়িটা চিনিয়ে দিয়েছিল। বাড়ির লাগোয়া বুকসমান উঁচু একটা খোলামেলা চবুতরা-ধাঁচের চত্বর। সেখানে খাঁটিয়ায় বসে পান্নাসাব দুটি কমবয়সী ছেলের সেবা নিচ্ছিল। ঘরের দরজা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়েছিল তার ওপর। খালি গায়ে বসে আরামে চোখ বুজেছিল পান্না পেশোয়ারি, তার চুল ছুঁয়ে জ্যোৎস্না আর। লানটিনের আলো।

মৃতদের শহরে সবখানেই ধ্বংসস্তূপ এবং যথেচ্ছ ইট পায়ের কাছে। একটা টুকরো-ইট কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়লাম। সেই নড়াচড়াটা চোখে পড়ায় হাত পা টিপে দিচ্ছিল যে ছেলে দুটি, একগলায় বলে উঠল, কুত্তা নেহি, আদমি! পান্না পেশোয়ারি চোখ না খুলে বলল, আবে শালে! আপনা কাম কর! ছেলে দুটি দেখছিল আমাকে, কী করছি। ইটটা মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে জোরে পান্না পেশোয়ারির মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম। পান্না পেশোয়ারি আই বাপ বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল। ছেলে দুটি চেঁচিয়ে উঠল, মার ডালা! মার ডালা পান্নাবকে! ঘরের ভেতর থেকে দুটো লোক বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে দৌড়ে চললাম। পেছনে চিৎকার চাচামেচি শুরু হয়ে গেল। ঘিনজি গলিটায় কোনো আলো ছিল না, শুধু জ্যোৎস্না আর। খাপচা-খাপচা অন্ধকার। এবার গলির ভেতর সাড়া পড়ে গেল। চোর-চোর চিৎকার উঠল। আমি দৌড়চ্ছি দেখে লোকেরা চোর-চোর বলে আমাকে তাড়া করল। গলির পর ঝোঁপ-ঝাড়। নিচে একটা নালা। জলকাদা ভেঙে ওপারে ঘন গাছপালার ভেতর ঢুকে পড়লাম। বুঝলাম, এটা একটা আমরাগান। আমরাগানটা কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। যখন শেষ হল, তখন একটা কাঁচা রাস্তা। রাস্তায় পৌঁছে গাছের তলায় ধপাস করে বসে পড়লাম। দম আটকে আসছিল। মনে হল, আমি বুক ফেটে মরে যাব।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *