০৯. স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ

স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ

…স্পষ্ট মনে পড়ে দিনটিকে। মেঘে ঢাকা আশ্বিনের আকাশ থেকে টিপ-টিপিয়ে বৃষ্টি ঝরছিল। প্রফুল্লবাবু গম্ভীর মুখে বলছিলেন, সেবারকার মতো পাগলি খেপে না ওঠে; এবং একটু পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, পাগলি বলতে তিনি কাছারিবাড়ির পেছনের নদীটিকেই চিহ্নিত করছেন। তারপর প্রফুল্লবাবু যখন ক-বছর আগে কাছারিবাড়িতে বন্যার জল ঢোকার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন অবাক লেগেছিল ওই শীর্ণ বেহুলা নামের স্রোতস্বিনী যাকে এখন এই শরৎকালে বেহালার টানটান তারের মতো দেখায়– যেন ছুঁলেই টুং করে বেজে উঠবে, সে কেমন করে সব-ভাসানিয়া স্বভাব আর সাহস পায়? আর কাল্লু আমাকে বলেছিল, চত্তির মাহিনামৈ তাকে দেখলে তাজ্জব হয়ে যাবেন ছোটাসাব! জেরাসে –এত্তোটুকুন ভি পানি না আছে। বহতু বালি– খালি বালি! ঔর উও বালি চক্কর মারতে-মারতে হাওয়া কি সাথ পাগলা জিনকি মাফিক কাছারিমে ঘুসবে! আঁখ অন্ধা কোরবে! তো ছোটোসাব, বেহুলা এইসি নদীয়া আছে! বহত খেয়ালওয়ালি আছে।

নদীর দিকে কখনও আলাদা করে তাকাতে জানতাম না তখনও। তখনও কি জানতাম আলাদা করে কিছু– ওটা গাছ, এটা মাঠ, ওটা আকাশ এটা কাশবন? উলুশবার মাঠে সারবাঁধা গাড়ির পেছনে নিজেকে একলা করে নিয়ে হেঁটে আসতে আসতে সেই যে একটা অবচেতনা গড়ে উঠেছিল –যার মধ্যে স্বাধীনতা আছে, যা প্রকৃতির তাই যেন কাল্লু পাঠানের সঙ্গে কয়েকটি দিনের ভ্রমণে পাগলি বেহুলার মতো টানটান বয়ে যেতে টের পেতাম। কুটিবাড়ির জঙ্গলে, ওপারে মেহরুর কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়ানো গাবগাছের ছায়ায় মাচানে বসে এক আদিম পৃথিবীর গল্প শুনতে-শুনতে একটি পরাবাস্তবতা আমাকে আবিষ্ট করত। বড়ো স্বাধীনতাময় সেই পরাবাস্তবতা যার সঙ্গে মৌলাহাটের একটি মেয়ের নিবিড় সম্পর্ক আছে।, রুকু ছিল সেই স্বাধীনতাময় পরাবস্তাবতার দূরতম প্রান্তে দাঁড়ানো। মাঝে-মাঝে বেহুলা আর রুকু এক হয়ে যেত! কিন্তু বারিচাচাজির সতর্ক প্রহরীর মতো সাতমার কাল্লু খাঁ যেন আমার চারদিকে কী এক দুর্ভেদ্য ব্যুহ গড়ে তুলেছিল। তাই তাকে ঘৃণা করতাম। অথচ তার মধে বিস্ময়কর বহু চুম্বক ছিল– তাকে এড়ানো যেত না।

তো মেঘেঢাকা দুর্লক্ষুণে টিপটিপ বৃষ্টির দিনে ভিজে জবুথবু হয়ে যে ঘোড়সওয়ার কাছারিবাড়ির ফটক দিয়ে ঢুকছিল, প্রথমে তাকে জানালা দিয়ে আমিই দেখতে পাই। তিনিই যে হরিণমারার বড়োগাজি সইদুর রহমান, একেবারে চিনতে পারিনি। তার পরনে ছিল আলিগড়ি চুস্ত পাজামা আর শাদা নকশাদার পানজাবি, মাথায় তুর্কি টুপি। ওপরের হলঘরে যখন তাঁকে সসম্মানে নিয়ে আসা হল, তখন তাঁর নেতিয়েপড়া কাদাটে মূর্তি দেখে হাসি পাচ্ছিল। কারণ কিছুদিন আগেই এই লোকটিকেই সবিক্রমে তলোয়ার সঞ্চালন করতে দেখেছি। কিন্তু তখনও জানতাম না, তিনি কেন হঠাৎ এই দুর্যোগে এতদূর পাড়ি জমিয়েছেন? আর ওই কাদাটে চেহারায় তাঁকে এতটুকু ক্লান্ত বা ম্রিয়মাণ দেখাল না এবং তিনি প্রথমেই সোজা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। ভিজে ঠান্ডা হাতে আমার একটা হাত চেপে ধরে প্রচণ্ড উল্লাসে একটি ইংরেজি বাক্য উচ্চারণ করলেন, মাই বয়! নাও ইউ আর ফ্রি!

বারি মিয়াঁ অবাক হয়ে বলেছিলেন, ফ্রি ফ্রম হোয়াট, গাজি?

ফ্রম ডেনজার! বড়োগাজি এত জোরে অট্টহাসি হাসলেন যে সেই মুহূর্তের শরকালীন মেঘগর্জনও খানখান হয়ে গেল। বড়োগাজি বলেছিলেন ফের, ফ্রি ফ্রম ডেনজার! মৌলানা বদিউজ্জামানের বড়ো এবং মেজো ছেলের সঙ্গে আমার বন্ধু লেট তোফাজ্জেল চৌধুরীর দুই মেয়ের শাদি হয়ে গেছে গতকাল।

প্রফুল্লবু হেসে ফেলেছিলেন বোগাজির অঙ্গভঙ্গি দেখে। কিন্তু বারিচাচাজি হাসছিলেন না। সেই মেঘগর্জন ছিল বজ্রপাতঘটিত এবং আমার মনে হয়েছিল বাজটি আমার ওপর পড়েছে। রুকু! আমার বুকু! তাকে পাশে নিয়ে শোবে মনিভাই– অধপশু অধমানব, বিকলাঙ্গ, উদ্ভট একটা প্রাণী! অকপটে বলছি, ওকে কতোদিন আবছা-আঁধার ঘরে উচ্ছিত শিশ্ন নিয়ে জঘন্য খেলায় লিপ্ত দেখেছি এবং সে-কথা এই বিশাল পৃথিবীর কোনো বৃক্ষকেও জানাতে পারতাম না। এখন নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি বলেই জানিয়ে যেতে যেতে চাইছি। এ মুহূর্তে জীবনের– আমার এই দণ্ডিত জীবনের পুরোটাই আমি পটের মতো ছড়িয়ে দিতে চাই –মাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে হলে তুমিও পা বাড়াতে পার লম্বানেকো শাস্ত্রীভাই!–

একটু পরে বারি চৌধুরী আস্তে বলেছিলেন, গাজি, তুমি কী বলছ!

বড়োগাজি হাসতে-হাসতে বলেছিলেন, শাদিতে আমারও জেয়াফত (নেমন্তন্ন) ছিল চৌধুরী! মইদুর, মানে তোমাদের ছোটো জিরও ছিল। অবশ্য আমি মদুর মতো পিরসায়েবের মুরিদ হইনি। কারণ তাহলে আমাকে ব্র্যানডি-হুইসকি ছাড়তে হবে। সিগারেট ছাড়তে হবে। পাঁচ অক্ত নমাজ পড়তে হবে। ইসলামের জন্য। এতখানি স্যাক্রিফাইস করতে আমি রাজি নই ভাই! আমাকে জেয়াফত করেছিল আমার লেট বুজম ফ্রেনড তোফাজ্জলের বউ। চৌধুরী, শি ইজ এ জিনিয়াস! ইলিটারেট চাষাভুষোর মেয়ে হতে পারে, কিন্তু তার অসামান্য শক্তি। শক্তি আর জেদ। আমি ওর প্রশংসা করি!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বারি চৌধুরী একইভাবে বলেছিলেন, আমি করি না।

কেন বলো তো?

আজও জানি না, সেদিনও বুঝতে পারিনি, কেন বড়োগাজির ওই সরল প্রশ্ন শুনে বারিচাচাজি হঠাৎ ফেটে পড়েছিলেন। আই হেট দ্যাট উওম্যান। ছোটো লোকের মেয়ে! তরতাজা গোলাপের মতো ফুটফুটে একটা মেয়েকে

উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ দেওয়ানসাহেব উঠে গিয়ে জানালার রড মুঠোয় আঁকড়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড়োগাজি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। সামলে নিয়ে শুকনো হেসে বলেছিলেন, সিঙ্গিদা! আপনার দেওয়ানসাহেবকে আজ অব্দি আমি বুঝতে পারলাম না! এলাম ঝড়পানি মাথায় করে এত ক্রোশ পথ একটা সুখবর দিতে! আর মিয়াঁসাহেব উলটে –থাক গে, মরুক গে! আমি চলি।

বুঝতে পেরেছিলাম বড়োগাজি অপমানবোধে আহত। প্রফুল্লবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠেছিলেন, কী মুশকিল! কাপড়-চোপড় বদলে নিন। অনুগ্রহ করে গরিবালয়ে এসে পড়েছেন যখন, তখন এভাবে চলে গেলে গেরস্থের অকল্যাণ হয় জানেন না?

প্রফুল্লবাবুর কথার মধ্যে সরলতা আর কৌতুকও ছিল। কিন্তু বড়োগাজি গ্রাহ্য করেননি। আমার দিকে ঘুরে বলেছিলেন, তোমার কাছে তলব পাঠিয়েছিলেন তোমার। আব্বা– কিংবা আম্মা। যাই হোক, কাজিসাহেব কিছু বলতে পারেননি তুমি কোথায় আছ। আমি অবশ্য বলেছিলাম লোকটাকে সোজা এখানে আসতে। আসেনি সে?

খুব আস্তে বলেছিলাম, না। একটু পরেই ফের বলেছিলাম, জানি না।

আমার হাতে ঠাণ্ডাহিম হাত রেখে বড়োগাজি বলেছিলেন, যাক গ। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। তুমি বেঁচে গেছ। এখন মন দিয়ে পড়াশুনো করো। ওহে চৌধুরী! তোমার আবার হলটা কী? ঘোয়রা এদিকে। আহা!

বলো!

শফি হরিণমারায় ফিরছে কবে?

কেন?

অদ্ভুত প্রশ্ন! বড়োগাজি একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন। ওকে কি স্কুল ছাড়িয়ে দেবে নাকি? মাথা ঠাণ্ডা রেখে আমার কথাটা শোনো। পুজোর ছুটি চলছে এখন। দিনকতক এখানে থাক। তারপর আমার কাছে এসো। কাজির বাড়ি থাকলে ওর লেখাপড়া হবে না। কাজির ছেলেটা বড় শয়তান। শফিকে আমি রাখব। আমার বাড়ি থাকবে। আমি ওকে পড়াব। ইংরেজিতে ও বড় কাঁচা– জান কি?

বারি চৌধুরী চাপা শ্বাস ছেড়ে সরে এসেছিলেন জানালা থেকে।–সেসব কথা পরে হবে। তুমি যেও না। পোশাক বদলে নাও। খাওয়া-দাওয়া করো!

বড়োগাজি পা বাড়িয়ে বলেছিলেন, তোমার মাথা খারাপ? আসার পথে রফিকুল আমাকে দেখেছে। ওর বউ এতক্ষণ গোসা করে বসে আছে।

বলে সিঁড়িতে নেমে একবার ঘুরে ফের বলে গিয়েছিলেন, এতক্ষণ মোরগ হালাল করে ফেলেছে, খোদার কসম!

আমি উত্তরের জানালার ধারে বসে বেহুলাকে দেখছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম, আঁকাবাঁকা বৃষ্টিকে তার ভেতর গাঢ় ও বিস্তীর্ণ শ্যামলতাকে –যা স্বাধীনতাময় । সেই স্বাধীনতাকে ধূসর আলো ও আবহমণ্ডলের মধ্যে আলোড়িত একটি ব্যাপকতার মতো বোধ হচ্ছিল! যেন হাত বাড়ালেই এখন তাকে ছুঁতে পারব। ভেসে যেতে পারব সেই প্রাকৃতিক স্বাধীনতাস্রোতে। আমি এবার কী স্বাধীন! কী স্বাধীন! আমি তো এখন যা খুশি করতে পারি! আমি ‘ফ্রি’– স্বাধীন মানুষ!

প্রফুল্লবাবু চলে গেলে বারিচাচাজি আমার কাছে এলেন। আমার দুকাঁধ ধরলেন। পিঠে তাঁর শরীরের উষ্ণ স্পর্শ। আস্তে বললেন, আমাকে ভুল বুঝিস নে বাবা! ঠিক এমনটি আমি চাইনি! আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে রে, শফি! এ কী ঘটল, বুঝতে পারছি না! আমারও বড্ডা ইচ্ছে ছিল, রুকুর সঙ্গে তোর শাদি হোক। আমি জানি– আমি সব জানি রে!

কী জানেন? এই প্রশ্নটা আমার গলার ভেতর আটকে গেল। জিভ তাকে তুলে ধরতে পারল না। দুই ঠোঁট তাকে বের হতে দিল না। শুধু ঘুরে বারিচাচাজির দিকে তাকালাম। দেখলাম, ওঁর চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। কাঁপা-কাঁপা স্বরে ফের বললেন, এমন ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটাকে হাবাগোবা জড়বুদ্ধি আর বিকলাঙ্গ একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে বাধল না হারামজাদির! ওকে করে মারতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু মেরেও তো আর–

চাচাজি!

আমার ডাক শুনে বারিচাচাজি থেমে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন হঠাৎ আমি ডেকে ফেললাম কে জানে! কী বলতে চাইলাম তাঁকে, মুহূর্তেই ভুলে গেলাম। উনি আমার দুই কাঁধে চাপ দিয়ে বললেন, ছেড়ে দে। গাজি হয়তো ঠিকই বলে গেল, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। মন খারাপ করিস নে বাবা। দুনিয়াটা এরকম। মানুষ যেন এক অদৃশ্য হাতের পুতুল! তার নিজের ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই!

সেদিন ধূসর ভিজে আবহমণ্ডলে এইসব কথা আর ঘটনা অমনই ধূসর আর ভিজে হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল বিশাল এক লোকসংগীত শুনছি চারদিকে। ইচ্ছে করছিল সবকিছুতে লাথি মারি। খুঁড়িয়ে ফেলি সাজানো নবারি ঘরের আসবাবপত্তর। ছুটে বেরিয়ে যাই একটা কালোরঙের ঘোড়ার পিঠে চেপে –ছুটতেই থাকি ক্রমাগত, দিনভর রাতভর –আমৃত্য,। রুকু তো আমারই। আমার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল রুকু। সেই রুকুকে হাত থেকে কেড়ে নিল আমারই এক সহোদর ভাই, অর্ধপশু এক মানুষ– যার কাছাকাছি যেতেও আমার ঘেন্না হত! অস্তিত্বকে আমি কোনোদিনই স্বীকার করিনি! আজ সে আমার বুকুকে কেড়ে নিতেই একটা স্বীকৃত অস্তিত্বে পরিণত। হল। ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা! আমার বুকের ভেতরটা ঘৃণায়, আর অসহায় রোষে আর ক্ষোভে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল।

প্রফুল্লবাবু উদ্বেগ প্রশমিত করে বিকেল নাগাদ বৃষ্টিটা একেবারে থেমে গেল। মেঘের ফাটল দিয়ে ঝকমকে রোদ চুঁইয়ে পড়তে থাকল। সন্ধ্যার কিছু আগে, বারিচাচাজি সম্ভবত তখন বড়োগাজির সঙ্গে কথা বলতে তাঁর আত্মীয় এবং খুদে জমিদার রফিকুল হাসানের বাড়ি গেছেন, আমি বেরিয়ে গিয়ে আস্তাবলে কালো ঘোড়াটির খোঁজ করলাম। সহিস মহিউদ্দিন জানাল, দেওয়ানসাহেব নিয়ে গেছেন ওকে। তখন ভিজে মাটিতে হাঁটতে-হাঁটতে নদীর ধারে গেলাম।

কাল্লুকে খুঁজছিলাম। ইদানীং তাকে প্রায়ই জেলেদের নৌকায় ওপারে মেহরুর কাছে গিয়ে আড্ডা দিতে দেখেছি। দুদিন আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল সে। মেহরু লোকটি দারুণ ভালো। আমি মৌলাহাটের পিরসায়েবের ছেলে শুনে সে আমাকে কোথায় রাখবে, কীভাবে খাতির করবে, ভেবেই পেত না। কিন্তু দ্বিতীয় দিন ওর কাছে গিয়ে আবিষ্কার করি, মেহরুর একটি বউ আছে। আর সেই বউটি আয়মনির বয়সী– যুবতী। তালডোঙা বেয়ে সে ওপারে গিয়ে মধ্যবয়সী স্বামীকে খাদ্য দিয়ে আসে। রাত্তিরটা স্বামীর কাছেই কাটায়। কান্দু চোখে ঝিলিক তুলে বলেছিল, মেয়েটা বহত কসবি আছে।

কসবি শব্দটা ওই বয়সেও কিছুটা রহস্যময় ছিল আমার কাছে। রবির মুখে কসবি শব্দের কোনো ভোলা ব্যাখ্যা শুনিনি। বড়োগাজির দ্বিতীয় পক্ষের বউ– যার সঙ্গে রবি কোনো এক দুপুরে শুয়েছিল, আমি বিশ্বাস করতেই পারিনি– তো তাকে রবি কসবি বলত মনে পড়ে।

এর ফলে মেহরুর বউ সম্পর্কে আমার একটা অসচেতন কৌতূহল জেগে থাকবে। সূর্যাস্তের আগে লালচে রোদে বিস্তীর্ণ বনভূমি, ধানখেত, সব শ্যামলতা খুবই কোমল দেখাচ্ছিল। ভরা ছোট্ট নদীটির এপারে দাঁড়িয়ে যখন কাল্লুকে খুঁজছিলাম, দেখলাম কাল্লু ওপারের মাচানে বসে মেহরুর হুঁকোটি টানছে এবং মেহরু হাত নেড়ে তাকে কিছু বলছে।

আমি কাল্লুকে চেঁচিয়ে ডাকতে যাচ্ছিলাম, থেমে গেলাম আমার বাঁ-পাশে ঝোঁপঝাড় ঠেলে মেহরুর বউকে বেরুতে দেখে। সে যেখানে দাঁড়াল, তার নিচেই কালো তালডোঙাটি বাঁধা আছে। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে আমার দিকে ঘুরল মেহরুর বউ। শেষ বিকেলের লাল রোদে তার নাকছাবিটা জ্বলে উঠেছিল। হঠাৎ ওই আলোর রঙে তার মুখটি আয়মনির চেয়ে অনেক-অনেক বেশি সুন্দর মনে হল। তার গড়নে আয়মনির মতো পুষ্টতা বা বলিষ্ঠতা নেই। কিন্তু জীবনের এ যেন এক বিস্ময়কর খেলা, কোনো এক মুহূর্তে কাউকে প্রচণ্ড চেনা মনে হয়ে যায় –যেন মাথার খুব ভেতরদিকটায় একটা হুলুস্থুল পড়ে যায়, ভাবি– আরে! একে তো কতকাল ধরে চিনি, নিবিড় করে জানি –ঠিক যেমনটি একদিন মনে হত বুকুকে দেখে ।

মেহরুর বউয়ের নাম আসমা, সেটা কাল্লুর জানা। আসমা আমাকে দেখে একটু হেসে বলে উঠল, কী মিয়াঁ, যাবেন নাকি ওপারে?

ঝটপট তার কাছে চলে গেলাম। জলকাদার জন্য খালি পায়ে বেরিয়েছিলাম। আসমা তালডোঙায় চড়ে হাত বাড়াল এবং নির্দ্বিধায় তার হাতটা আঁকড়ে তালভোঙায় পৌঁছুলাম। ডোঙাটা খুব টলমল করছিল। আসমা হাসতে-হাসতে বলল, এই গো! নিজেও ডুববে! আমাকেও ডুবিয়ে ছাড়বে।

জীবনে সেই প্রথম তালডোঙায় চাপা। ডোঙাটার ভেতর একটু জল ছিল। টলোমলো, লম্বাটে তালগাছের গোড়ার দিকটা খোদাই করে তৈরি জিনিসটির ভেতর একটা আশ্চর্য বোধ আমাকে ভূতের মতো পেয়ে বসল। স্রোতের টানে ভেসে চলার বোধ বললে খুব কমই বলা হবে। একটি কালোরঙের ঘোড়া আমাকে যে-গতির হাত ধরিয়ে দিয়েছিল অথবা দিতে চেয়েছিল এবং আমি গতিকে চিনেছিলাম, সেই গতি নতুন চেহারায় সামনে এসে হাত বাড়িয়েছিল। যেন বলছিল, আয় ভাই, আমরা যাই! আর বেহালার টান-টান করে বাঁধা তারের মতো এই নদী আবার গতির প্রতীক হয়ে-ওঠা আরেকটি কালো জিনিস, আর ওই যুবতী নারী– টলায়মান অবস্থায় যখন তার দিকে তাকালাম, আবার একই সঙ্গে তাকালাম যুগপৎ টান টান স্রোতস্বিনী আর কালো প্রতীকটির দিকেও, একটা প্রগলভ মত্ততা আমাকে বাঁচাল। করে ফেলল। আশ্চর্য, আমি হেসে উঠলাম। রুকুর কথা ভুলে গেলাম। অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেল রুকু এইসব কিছুর কাছে, যার ওপারে স্বাধীনতা– প্রকৃতি, বারি চৌধুরীর নেচার। আর আসমাও হাসছিল। তার গায়ে আয়মনির মতো জামা ছিল না। তার পরনে ছিল নীলচে নেতিয়েযাওয়া তাঁতেবোনা শাড়ি–সেও হাঁটুর নীচে অব্দি টানা। তার একহাতে ছোট্ট একটা বৈঠা। অন্যহাতে কীভাবে হঠাৎ খোঁপা-ভেঙেপড়া চুল ঝুটি বাঁধতে গিয়ে উন্মোচিত হয়ে গেল স্তন! ভরাট, নিটোল, কোমলতাময় কাঠিন্যে অসংবৃত তীক্ষাগ্র একটা মাংসপিণ্ড, যা আমার মতো ষোলো-সতেরো বছর বয়সের। একটি ছেলেকে দ্রুত ফিরিয়ে দেয় তীব্র স্মৃতিতে ভরা এক হারানো পৃথিবী আর সময়কে, তার ধোঁয়াটে ধুলোয় ধূসর, শৈশবকে।

এখন ভাবি, পুরুষের জীবনে ওই যেন কঠিন নির্বাসনের কষ্ট-কাল! নারীর জরায়ু থেকে বেরিয়ে এসে নিরন্তর নারীর সঙ্গে স্পর্শে-সাহচর্যে বেড়ে উঠতে-উঠতে তারপর সে ধীরে দূরে সরে যেত থাকে অথবা তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় দূরে। নারীর শরীর, নারীর স্তন, নারীর ঠোঁট তাকে অচ্ছুত করে ফেলে। নিষিদ্ধ হয়ে ওঠে প্রিয় এক জগৎ, এবং নির্বাসিতের মতো, অচ্ছুতের মতো, তারপর দূরে সরে থাকা। আবার প্রতীক্ষায় থাকা, কবে ফিরবে প্রিয়তম ঘরে? কবে ফিরে পাবে সে নারীর শরীর, নারীর স্তন, নারীর ঠোঁট এবং নারীর জরায়ু– শরীরের পারুষ্যের যৌবনের রক্তমূল্য দিয়ে সকল পেশীর শক্তি দিয়ে হবে তার প্রত্যাবর্তনজনিত পুনরভিষেক? কবে সে ফিরবে পুরনো কোমল ঘরে? কৈশোর সেই প্রতীক্ষা আর নির্বাসনের কাল।

অবচেতন বিহ্বলতায় আমি আসমার উন্মোচিত বাম স্তনটিকে দেখছিলাম। ধূর্ত বন্য যুবতী তা বুঝতে পেরেছিল। সে মুখ টিপে হেসে ডোঙাটির মুখ ঘোরাল স্রোতের কোনাকুনি এবং চাপা স্বরে বলে উঠল, খুব যে! আঁ?

কী আসমা? টলোমলো ডোঙায় বসে বাঁচালতা করে বললাম।

আসমা ঠোঁট কামড়ে ধরে বহতা জলের ভেতর নিজের দুধারে পর্যায়ক্রমে বৈঠার আঘাত হানছিল। ওই কামড়েধরা ঠোঁটে শব্দহীন তীক্ষ্ণ হাসি ছিল। ওই হাসিতে কথা ছিল। সেই কথা আমি অনুভব করছিলাম আর আমার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল বারবার দুর্দান্ত স্বাধীনতার ঘা, ওই বৈঠার প্রতিটি শব্দময় ঘা– যা তলোয়ারের কোপের মতো। নীচের নদীটির মতো আমি ভেঙে পড়েছিলাম। আঘাতের শব্দ শুনছিলাম বুকের ভেতর দিকে।

তো ডোঙাটিকে কি ইচ্ছে করেই অসমা দেরি করিয়ে দিচ্ছিল? কিংবা তীব্র স্রোতের টানে, বৃষ্টির পর নদীর জলটাও বেড়েছিল সেদিন, ডোঙাটিকে সরাসরি ওপারে নিয়ে যেতে পারছিল না সে? দেখলাম, মেহরুর কুঁড়েঘর বাঁদিকে সরে যেতে যেতে হিজলহাম-জারুলের জটলার আড়ালে পড়ে গেছে। কোনাকুনি এগিয়ে তীরের কাছাকাছি হয়ে আসমা তার নিচের ঠোঁটকে মুক্তি দিল। ফিক করে হেসে বলল, পিরসাহেবের ছেলে জাদুমন্তর কী দোয়া-দরুদের ভেলকি জানে মোনে হয়। আজ আমাকে কী, আমার ডোঙাকেই যেন বেবশ করে দিলে গো! লাও, টানো এখন কদুর উজোন!

কিন্তু সে উজানে মেহরুর কুঁড়ে অব্দি নিয়ে গেল না ডোঙাটিকে। সামনেই অর্ধবৃত্তাকার ধসছাড়া একটি স্রোতহীন অংশ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। সেখানে মাটির ভিজে চাঙড়ে একটা ভাড়ল গাছের মোটা আর সরু অজস্র শেকড় বেরিয়েছিল এবং গাছটিও ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছিল নদীর দিকে। সেই শেকড় ডোঙার মাথার দিকে হেঁদা। গিটবাঁধা একটা দড়ি বাঁধল আসমা। বৈঠাটি একহাতে, অন্যহাতে ন্যাকড়ায় বাঁধা। তার স্বামীর রাতের খাবার — হয়তো জামবাটিভরা ভাত-তরকারি। সে শেকড়ের ফাঁকে পা বাড়িয়ে দিতে প্যাঁচপেচে কাদায় পা ডুবে গেল। তখন সে খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,ও মিয়াঁর ব্যাটা, ইবারে তুমি আমাকে বাঁচাও। আহা, উঠে এসো না বাপু!

সে এখন আমাকে ‘তুমি’ সম্ভাষণ করছে। আমি শেকড়বাকড়ে পা রেখে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে শক্ত এবং ঘাসে ঢাকা পাড়ে পৌঁছলাম। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলাম। সে তার স্বামীর খাদ্যটা দিল আমাকে। একজন চাষাভুষো মানুষের খাদ্য বইতে হচ্ছে। আমাকে, এটা একদিন আগে ঘটলেও খুব অপমানজনক গণ্য করতাম। কিন্তু আজ আমি ভিন্ন এক মানুষ। আর এখানে স্বাধীনতা– বারি চৌধুরির ‘নেচার’। দুর্দান্ত এক বন্যতা আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার নতুন চুস্ত পাজামা-পানজাবিতে হলুদ পলিমাটি মেখে গেছে যথেচ্ছ। হাত বাড়িয়ে ন্যাকড়ায় বাঁধা জামবাটিটা নিলাম। তখন আসমা বলল, ওখানে রাখো। রেখে আমাকে ইবারে ওঠাও!

তার নির্দেশ পালন করলাম। কিন্তু ভেবেছিলাম, সে বৈঠাটাই বাড়িয়ে দেবে –তা দিল না। বাঁহাতে বৈঠাটা পাঁকে লাঠির মতো দেবে ডানহাতটা বাড়াল। তার হাতে আয়মনির হাতের মতোই একগোছা নানারঙের কাঁচের চুড়ি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়। আয়মনির হাতের ছোঁওয়া একটু-আধটু পেয়েছিলাম। কিন্তু কখনও সে-ছোঁওয়া এমন প্রত্যক্ষ আর জোরালো ছিল না। মনে হল সৌন্দর্য বা চেহারার লালিত্যের তুলনায় আমার হাতখানি ঈষৎ রুক্ষ আর শক্ত। শ্রমজীবী নারীর হাত। আয়মনির বাপের তোজ মিজিরেত আছে প্রচুর। কিন্তু আসমার মধ্যবয়সী স্বামীটি খুবই গরিব মানুষ। সামান্য একখানি ধানখত আর নদীর কাঁধে একটুখানি জমির মালিক সে। ওই ধানখেতের কোনো ভরসা নেই। কারণ হঠাৎ বৃষ্টিতে নদীর এপার ছাপিয়ে বন্যায় সব ভেসে যেতে পারে। এপারে কোন বাঁধ নেই। বাঁধ অন্যপারে কাছারিবাড়ির পেছনে সমান্তরাল।

এখন ঘন গাছপালা। বৃক্ষলতার এমন ঠাসবুনোট কারুকার্য প্রথম যেদিন দেখি, সেদিনকার অনুভূতি আর আজকের দিনশেষের এই অনুভূতি এক নয়। শেষবেলায় নদীর বাঁকের ওপারে বিধ্বস্ত কুঠিবাড়ির জঙ্গলের নিচে সূর্য নেমে গেলে নদী আর এই বনভূমি কী এক রহস্যময় ধূসরতায় ছমছম করছিল। জনহীন এই নিসর্গে প্রকৃতির ফিশফিশ ষড়যন্ত্রের মতো হালকা আর শিরশিরে হাওয়া বইছিল। জামবাটিটা। তুলে নেওয়ার আগে আসমা বৈঠাটা নরম ঘাসেঢাকা মাটিতে বিধিয়ে দুটি মুক্ত হাত উঁচু করে খোঁপা বাঁধতে লাগল। আবার উন্মোচিত হল তার স্তন, পুরোপুরি নয় –অর্ধোন্মোচিত। আর অবিশ্বাস্য হঠকারিতায় প্রাকৃতিক স্বাধীনতা হাহাকার করতে করতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।….

.

দেখো শাস্ত্রী! এই দেখো, আমার হাতের নোম খাড়া হয়ে গেছে। শিরশির করছে রোমাঞ্চের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা সারা শরীরে। তবে সেই প্রথম স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম আমার দেহ-মনে। সেই প্রথম প্রকৃতির করতলগত হওয়া! সেই প্রথম কালো ঘোড়াটির অন্ধ হয়ে যাওয়া। তার হ্রেষা আর খুরধ্বনি সেই প্রথম।

অসমা অর্ধস্ফুট স্বরে বলে উঠেছিল, আ ছি ছি! এ কী, এ কী! তুমি না পিরসায়েবের ছেলে?

ভিজে চবচবে ঘাসের ওপর বাঘের হরিণ ধরার মতো একটা ধস্তাধস্তি চলছিল। আসমার শরীরে আমার শরীর মাথা কোটার ভঙ্গিতে আছড়ে পড়েছিল। হায় শরীর! মানুষের হারামজাদা শরীর! শুয়োরের বাচ্চা শরীর!

কুছ তকলিফ, সাব?

তাকালাম।

ডিপটি জেলরবাবুকো খবর ভেজুঙ্গা ডাগদারকে লিয়ে?

না।

আপ শো যাইয়ে সাব! বারাহ বাজ গয়া!

আপনা কাম করো ভাই, আপনা কাম করো!

লম্বানেকো শাস্ত্রীটির পাশে বেঁটে শাস্ত্রটি এসে দাঁড়াল। বলল, ক্যা জী?

কুছ নেহি ভেইয়া, কুছ নেহি!

বেঁটে ভারী সঙ্গীন বাগিয়ে কাঁধে রেখে আস্তে আস্তে বলল, শোচিয়ে মাত সাব। খুদা কিসিনে জিন্দা রাখনে চাহে তো উসকো মার ডালে কোন? আপিল পেশ কিয়া–শুনা। শোচিয়ে মাত। শো যাইয়ে আরামসে!

সে আরও সমবেদনায় বলে উঠল, কেত্তা আদমি বিমারসে মর যাতা! মউতকো তো সাথ-সাথ লে কর আদমি দুনিয়ামে আতা হ্যায় সাব! আপ লিখা-পঢ়াহ। আদমি। সবহি জানতে হেঁ আপ!

তাদের বুটের শব্দ বুকের ভেতরটা মাড়িয়ে দিয়ে গেল। আমি সরে গিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকালাম। দেখলাম সামনে মেহরু দাঁড়িয়ে অথবা বসে আছে, কিংবা সে কোনো একভাবে আছে। তার কণ্ঠস্বরের আশ্চর্য প্রতিধ্বনি এতকাল পরে ভেসে উঠল। মউতকো তো সাথ সাথ লেকর আদমি আতা হ্যায় দুনিয়ামে! আর মেহরু বলেছিল, জেবন-মরণ দুই ভাই– একই সঙ্গেতে জন্ম লয় মায়ের জঠরে। একই সঙ্গেতে বাড়ে। দু-ভাইয়ে কত ছলচাতুরি, কত লুকোচুরি খেলা। তবে কথা কি কালসাপ নিয়ে মানুষের বসবাস। তমু মানুষের ই কথাটো খ্যাল হয় না গো! তমু মানুষ কী করে সব ভুলে থাকে!

মেহরু বলত, তাদের বংশের পদবি খামরু। সে মেহেরু– মেহেরুদ্দিন খামরু। কারণ তার পূর্বপুরুষের ঢের জোতজমা ছিল। খামার ছিল! খামারবাড়িটা নাকি এত বড়ো ছিল যে লোকেরা তাদের খামরু বলে সম্ভাষণ করত। কিন্তু এই রাক্ষসী নদী আর নবাববাহাদুর আর হরিণমারার বড়োগাজির মামাতো ভাই ইন্দ্রাণীর খুদে জমিদার রফিকুলের পূর্বপুরুষ খামরুবংশকে ভিখিরি করে দিয়েছিল। এখন সে প্রফুল্ল সিঙ্গিকে সেলামি দিয়ে ওই ডুবো জমিটুকু সালগুজারি বন্দোবস্ত নিয়েছে। দু-আনা পাঁচ-গণ্ডা খাজনা আর ম্যানেজারবাবুকে শীতের সময় দশ আড়ি ধান ভেট। আড়ি বেতে তৈরি একটা পরিমাপপত্র। কিন্তু মেহেরুর সন্দেহ, আড়িটার প্রান্তিক বেড়ে দুটো বাড়তি বেতের চক্কর আছে।

এখন এবং আরও পরে মেহরুর কথা মনে এলেই বিব্রত বোধ করতাম। একজন দার্শনিককে আমি ঠকিয়েছি! এদেশের এক মেঠো সোক্রাতেসকে আমি দূর কৈশোরে শুধু মিস করিনি, তাকে অপমানও করেছি! আর কী জঘন্য কথা, লালবাগ শহরের নবারি হাতির সাতমার কাল্লু পাঠান তাকে একদিন ঠাট্টা করে বলেছিল, মেহরু! তুমি কেমন মোরোদ আছ– কী তুমার বিবি এই ভেগে গেল? তো আমাকে দেখো, আমি পাঠানবাচ্চা আছে। হামার উমরভি তুমার সমান আছে। হামারভি ছোটি এক বিবি আছে। তো–

মেহরু, দার্শনিক মেহরু অশালীন খিস্তি করে নিজের শিশ্নটির শক্তি বোঝাতে হাতির পায়ের শেকল বাঁধা লোহার গোঁজের উপমা দিয়েছিল! কাল্লু পাঠান হা হা করে হেসে অস্থির। আমিও খুব হেসেছিলাম। মনে হয়েছিল, সে যা বলছিল, তা কদাচ সত্য নয়।

সত্য নয়, তার কারণ আমি বুঝতে পারতাম। হায় মেঠো দার্শনিক, প্রশ্নটি শিশ্নমূলক নয়, অন্য কিছু। তা হয়তো ভালোবাসামূলক। অনাথা একলা-বেড়ে ওঠা মেয়ে আসমা, যে দুনিয়ার– তা যত ছোটো হোক তার সেই দুনিয়া, শুধু শিশ্ন দেখেছে, দেখেনি ভালোবাসা। ভালোবাসা ভিন্ন এক জিনিস। সব মানুষ তা পায় না– বোঝে না, বা চেনে না। সে প্রকৃতির শেখানো বুলি আওড়ায়। যে আবেগে পাখিরা খড়কুটো বেঁধে বাসা বানাতে ব্যস্ত হয়, সেই জৈব আবেগমাত্র। ভালোবাসা আবার সবাইকে সয়ও না। সায়নি বারি চৌধুরিকে। অনেক পরে যা জানতে পেরে অবাক হয়েছিলাম। কেন তাঁর চিরকুমার থাকার বদখেয়াল, কেন অমন দৃকপাতহীন নির্বিকার ব্রহ্মচর্য, অনেক দেরিতে বুঝতে পেরেছিলাম। আর আমার বেলাতেও তাই। আমি ভালোবাসা পেয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসা আমাকেও সয়নি!….

তো এক আশ্বিনের দিনের বৃষ্টিৰাদলার শেষে ধূসর আলো-আঁধারে ভিজে স্যাঁতসেঁতে ঘাসের ওপর সেই প্রথম নারীশরীরের ভিন্ন এক স্বাদ পেয়েছিলাম। ছটফটে, কোমলতাময়, দৃঢ়, শ্রমজীবী গ্রামীণ এক যুবতীর শরীর কেন্দ্র করে আনাড়ি, অবোধ এক বিস্ফোরণ মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। হয়তো এজন্য হরিণমারার কাজি হাসমত আলির ছেলে রবিউদ্দিনের সহবাসকে দায়ী করা যেতে পারে। হয়তো রবিই আমাকে ভেবে-ভেতরে নষ্ট করে ফেলেছিল। কিন্তু একথাও হয়তো বা সমান সত্যি যে, আমি রুকুর ওপর প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার মাথার ঠিক ছিল না সেদিন। একটা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলতে চাইছিলাম। আর কলঙ্কিনী নামে ইন্দ্রাণীতে বদনাম কুড়ুনি যুবতী আসমা যেন ইচ্ছে করেই সেই সুযোগ করে দিয়েছিল! নইলে কেন সে তার স্বামীর আস্তানা থেকে অতটা দূরে ভাটিতে গিয়ে ডোঙা পাড়ে ঠেকিয়েছিল, যেখানে শিয়রে প্রগাঢ়ভাবে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষলতার আড়াল আর অবাধ নির্জনতা?

হুঁ–সবই তার সাজানো মনে হয়েছিল পরে। কিন্তু কী পেয়েছিলাম আমি? সত্যই কি কোনও জৈব সন্তোষ কিংবা যাকে বলে ‘মানুষের রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘে’র তৃপ্তি এবং বেড়ে-ওঠা লোভ? কিছু না, কিছুই না। বরং আমার গা ঘিনঘিন করছিল। ভবা স্রোতবতী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরকে, আমার নিষ্পাপ শুদ্ধ শরীরের নোংরামিটাকে ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল! কিন্তু পুকুরে সাঁতার কাটার অভ্যাস থাকলেও কখনও স্রোতের জলে সাঁতার কাটিনি –সেই ভয়। আরও এক অদ্ভুত ভয় আমাকে আড়ষ্ট করে ফেলেছিল। আব্বা বলতেন, আমাদের বংশের শরীরে পবিত্ৰপুরুষ পয়গম্বরের রক্তের ধারা বয়ে চলেছে। মাথা নিচু করে নদীর দিকে তাস্যি হ্রাসে কেঁপে উঠেছিলাম! আব্বার অনুচর কোনো জিন কি দেখে ফেলল আমার এই পাপক্রিয়া? ব্রাসে অনুশোচনায় আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আর আসমা তার শাড়িটি নতুন করে পরে নির্বিকার মুখে উঠে দাঁড়াল। তারপর জামবাটি আর বৈঠাটি কুড়িয়ে নিযে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ থামল। বলল, মিয়াঁর প্যাটে-প্যাটে এত, তা জানতাম না!

সে বাঁকা হাসছিল। আমি ভাঙা গলায় অতিকষ্টে ডাকলাম, আসমা!

বুলো।

আমি মাফ চাইছি। তুমি কাকেও–

আসমা দ্রুত এসে খুব হঠাৎ চটাস শব্দে আমার বাঁ গালে চুমু খেল। হাসি আর শ্বাসপ্রশ্বাস জড়ানো গলায় বলল, ও কী কথা গো ছেলের? ওপরে আসমান, নিচে মাটি– পক্ষিটিও জানবে না।

তারপর সে যে কথাটি বলল,আমি অবাক হয়ে শুনে গেলাম। সে ফিশফিশ করে বলে উঠল ফের, এমন করে মোনের সুখ মেটে না। তুমি দুকোরবেলা ওপারে ঝোঁপের ভেতর থেকো। তখন মিনসে থাকে না কুঁড়েতে। দহে মাছ ধরতে যায় জাল নিয়ে। আমি নিয়ে আসব তুমাকে।

বলেই সে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল এবং একবার ঘুরে যখন দেখল, আমি আসছি না, তখন সে ইশারা করল তাকে অনুসরণ করতে। আস্তে বললাম, আমি যাব না।

আসমা চলে-যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ডাক শুনতে পেলাম কাল্লুর, ছোটোসাব! ছোটোসাব!

সাড়া দিলাম না। নদীর পাড়েই একটা কোণ্ড গাছের শেকড়ে বসে একটুকরো শুকনো কাঠি কুড়িয়ে আঁক কাটছিলাম। ভীষণ ক্লান্ত শরীর, শুওরের বাচ্চা হারামজাদা নেড়ি কুত্তা শরীর! এখন এত ভারী, এত বিধ্বস্ত! আর তখন আমার ব্যক্তিগত আবহমণ্ডলে আসমার চুলের আর সারা শরীরের ঘ্রাণ। বুঝতে পারছি না এ ঘ্রাণ নিয়ে আমি কী করব? একে সরাতেও তো পারছি না! বুঝতে পারছি না এ ঘ্রাণ। সুখের, না জঘন্যতার।

কাল্লুর হাসি শুনতে পেলাম পেছনে। ঘুরলাম না তবু। কাল্লু বলল, ছোটাসাব! এখানে কী কোরছেন একেলা বৈঠকার? হামি আপনাকে মেহরুর বহুর সাথে আসতে দেখল। তো ছোঁকড়ি হামাকে বলল, ছোটোসাব একেলা ঘুম কোরতেছে ইধার! আইয়ে, আইয়ে! ইধার সাপ-উপ থাকবে। জংলি জানবার ভি। আইয়ে।

সাপের কথায় এতক্ষণে চমকে উঠলাম। সাপ থাকার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম এতক্ষণ। দিনের শেষ আবছায়াভর আলোটুকু, যা কররেখা অস্পষ্ট করে তুলেছে, চকিতে ফণাতোলা অজস্র সাপের ছবি আঁকতে থাকল আমার চারপাশে। উঠে। দাঁড়ালাম। কাল্লু পথ দেখিয়ে মেহরুর কুঁড়ের দিকে নিয়ে চলল।

গাবতলার মাচানে পা ঝুলিয়ে আসমা বসে আছে । কুঁড়েঘরটির ভেতর রেড়ির তেলের পিদিম জ্বলছে। সেই ম্লান আলো কেন্দ্র করে পোকামাকড় থকথক করে। চক্কর যাচ্ছে। একটু দূরে মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে মেহরু জামবাটি থেকে সশব্দে ভাত খাচ্ছে। আমাদের সাড়া পেয়ে মুখ তুলে একবার দেখার চেষ্টা করে বলল, কাল্লুভাই?

হাঁ। ছোটাসাবকে লিয়ে আসল। মেহরু এঁটো মুখে বলল, বসেন হুজুর, বসেন! আমি খাওয়াটুকুন সেরে লিই! বলে সে বউকে ডাকল, ওরে! কাল্লুভাইকে তামুক সেজে দে দিকিনি!!

আসমা অমনি মাচা থেকে নেমে বলল, সাজো তুমি তামুক। আমি চললাম। আঁধার হয়ে গেল দেখছ না? রহিমা এতক্ষণ ঘর-বার করছে আমার জন্যে।

সে তার মরদকে গ্রাহ্য করল না। গজগজ করতে করতে বৈঠাটি নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল আবছাঁ আঁধারে। দু জায়গায় ঘরকন্নার ঝকমারির কথাই সে বলতে-বলতে গেল। আর তাই শুনে খ্যাখ্যা করে হেসে তার বোকাসোকা দার্শনিক মরদটি এঁটো ঠোঁটের নিচে জঙ্গুলে দাড়িতে এককুচি ভাতহ বলে উঠল, শুনো কথা কাল্লুভাই! হারামজাদির কথা শুনো।

কাল্লু অবাক হয়ে সহাস্যে বলল, আজ তুমহারা বিবি থাকল না তুমার কাছে? বাত ক্যা ভেইয়া মেহর?

মেহরু গুম হয়ে বলল, বাড়িতে আপ্তকুটুম্ব এসেছে। আমার ভাগ্নী কাচ্চাবাচ্চা লিয়ে এসেছে তো! তাদের খাওয়া-দাওয়া, মেহমানি তো করাতে হবে, না কী? তবে তামুকটা সেজে দিয়ে গেলে কী ক্ষেতি হত, বুলো কাল্লুভাই?

কানু বলল, তো ঠিক হ্যায়। আমি সেজে লিচ্ছে।

খড়ের দড়ি জড়িয়ে মেয়েদের চুলের বেণীর মতো বাঁধা একটা জিনিসের মাথায় আগুন জুগজুগ করছিল। ওটাকে ‘বিড়ে’ বলে, আমি জানি। কাল্লু জানে কোথায় তামাক আছে। সে ব্যস্তভাবে তামাক সাজতে বসলে আমি বললাম, কান্ধু! আমরা ওপারে ফিরব কী করে এবারে?

কাল্লু হাসল। রোজ য্যায়সে আনা-যানা করি, ওইসে। বৈঠিয়ে না!

খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মেহরু নদীতে গেল জামবাটি ধুতে। ফিরে এসে সে জাঁকিয়ে মাচানে বসে কাল্লুর হাত থেকে হুঁকো টানতে টানতে খোদাতালার মেহেরবানির কথা ঘোষণা করছিল। আকাশের অবস্থা থেকে কী ডর না পেয়েছিল সে! না– সে এই নদীর সঙ্গে নিজে লড়াই করে জান বাঁচাতে পটু, এমনি অনেক লড়াই সে সারাজীবন লড়ে আসছে। কিন্তু সেজন্য তার ডর জাগেনি। যত ডর দেড়বিঘে ধানখেতটার জন্য। বুকে থোড় গজিয়ে এখন ধানগাছ ডাগরভোগর হয়েছে। জলের তলায় চলে গেলে আর শীষ গজাত না, সেই ডর। তারপর কী করত মেহরু? সেই মাঘ অব্দি প্রতীক্ষায় থাকতে হত এই মাচানের নিচে সামান্য দূরে কাঁধা’ নামে ঢালু জমিটুকু জেগে ওঠার জন্য। সেই জমিতে সে কুমড়ো কাঁকুড় আর তরমুজের বীজ পুঁতবে। খরার মাসে সেগুলো নিয়ে যাবে তার বউ হাটতলায় হাটবারে বেচতে। এইসব কথা বলার সময় লোটার প্রতি যুগপৎ ঘৃণা আর করুণা জাগছিল আমার। ঘৃণা– কারণ আসমাকে সে বউ করেছে। করুণা– কারণ তার এই বেঁচেবর্তে লড়াই। অবশেষে সে হুঁকোয় সুখটান দিয়ে কান্নুকে দিল এবং বলল, ভাবতে গেলে এ দুনিয়াদারি এক ঝকমারি বটে হে, কাল্লুভাই! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, লাথি মেরে ফেলে ফকিরি লিই!

তারপর সে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। কান্নু বলল, গলা ফাড়কে গাও ভেইয়া! তুমি তো বহত ওস্তাদ নোক আছ! গাহনা করো– ছোটোসাবকে শুনাও!

মেহরু এত সুন্দর গাইতে জানে! তখন চারদিক নিঝুম আঁধার। কুঁড়ের ভেতর রেড়ির তেলের পিদিমটি জ্বলছে এবং পোকামাকড়েরা আত্মহত্যায় লিপ্ত। নদীর দিকে আবছা ছলচ্ছল একটা শব্দ শুধু। শরৎ-ঋতুর আকাশে ঝকমক করছে নক্ষত্রের ঝালর। দূরে একটু আগে যে শেয়ালগুলো ডাকছিল, তারা হঠাৎ থেমে গেছে। মেহরু কানে একটা হাত রেখে তান দিল, আহা রে-এ-এ….তা-না-না-না….

‘ভেবো না ভেবো না বিফলো ভাবনা/ভাবিলে যাবে না দূরে—’

কাল্লু পাঠান সমের মাথায় বলে উঠল, বহত আচ্ছা! মেহরু চেরা গলায় গাইতে লাগল। নদীতীরের এই সংগীতধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে দূর-সুদূর ছাড়িয়ে যেতে থাকল। ওপারে কাছারিবাড়ির দোতলায় আলো জ্বলছিল। সেই আলোকে ছুঁয়ে মেহেরুর গান মেঠো দার্শনিকতাকে বয়ে নিয়ে চলল কোথায়– যেন বা ওই নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে, ওই লম্বাটে ছায়াপথের সীমানায়! আর আমি দেখলাম, কী বিশাল ওই আকাশ, কত জ্যোতির্ময়তা! তার কাছে কতটুকু এই মানুষের ভাবনা! মেহরুর ভাবনা! আমার ভাবনা আর এই মেহরুর যুবতী বউয়ের শরীর থেকে প্রতিশোধের ছুতোয় আমি যে শান্তি সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তারই বা মূল্য কতটুকু? ছি ছি এ আমি কী করলাম– কেন করে ফেললাম এ পাপ? অন্ধকারে আমার দুচোখ ভিজে যাচ্ছিল –জানি তা মেহরুর গানের বিষাদজনিত সংক্রমণে নয়, পাপবোধে।

না –ওই বয়সে ঠিক এমন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে কিছু ভাববার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু অনুভূতি ছিল। বোধ ছিল। নিজের ওপর দুঃখে করুণায় আমার কান্না পাচ্ছিল। আমার যে-শরীরে নাকি পবিত্র পুরুষে রক্তধারা বয়ে চলেছে, আর যে শরীর নির্দিষ্ট ছিল অন্য এক নারীর জন্য, যাকে আমি বেহেশতের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও কাম্য বলে গণ্য করতাম– সেই শরীরকে আর হঠকারিতায় আমি হারিয়ে ফেলেছি! আমি নিজের পবিত্র সত্তাটিকে হিজলজামজারুলের জঙ্গলে ভিজে ঘাসের ওপর জবাই করে ফেলেছি। আর এই নিরক্ষর মেঠো লোকটি সুর ধরে আমাকে শোনাচ্ছে, ভেবো না ভেবো না বিফলো ভাবনা/ভাবিলে ভাবনা যাবে না দূরে!

বড়ো অবাক লাগে হে শান্ত্রিদ্বয়! বেহুলা নদীর ধারে এক আশ্বিনের সন্ধ্যারাতে আমার মাথার ভেতর উলটে এক বন্য ঘুণপোকা ঢুকে পড়েছিল। সত্যিই তো! বিশাল পৃথিবীতে বিরাট আকাশের নিচে মানুষের সব ভাবনাই কী অকিঞ্চিৎকর! তবু মানুষ ভাবে। ভাবনা ছাড়া মানুষের চলে না। দার্শনিক মেহরু ভাবনা নামে পোকাটিকে তাড়াতে গিয়ে সেটি আমার মাথায় ঢুকে পড়েছিল। আর সেই ভাবনার কুটকুট কামড়ানিতে অস্থির হয়ে বাকি জীবন আমি ছুটে বেড়ালাম বিভ্রমণে। কী না করে বেড়ালাম! স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত।

মধু জেলে দূরের দহে বিকেল থেকে এক প্রহর রাত অব্দি ছোট্ট নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যেত। সে যথারীতি ফিরে এল মেহরুর কাছে-তামাক খেতে। তার নৌকোয় আমরা ফিরে গেলাম ওপারে।

কাছারিবাড়ির ভেতর ঢুকে প্রতিমুহূর্তে গা শিরশির করছিল। আমাকে দেখে কি বারিচাচাজি টের পাবেন কিছু? আমি কি ধরা পড়ে যাব? আমার চুস্ত পাজামা পানজাবিতে ঘাসের কুটো, পলিমাটির দাগ । কিন্তু দোতালার হলঘরে ঢুকলে বারি চৌধুরী বললেন, আয় শফি! কাল আমরা লালবাগ যাব ঠিক করেছি। কী? দারুণ সুখবর না? বারিচাচাজির সঙ্গে প্রফুল্লুবাবু আর বড়োগাজিও হাসতে লাগলেন।…..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *