He says that woman speaks with Nature.
That she hears voices from under the earth.
That wind blows in her ears and trees whisper
to her. That the dead sing through her mouth…
Woman and Nature–Susan Griffin
কচি ।। বডো আব্বা ইকরাতনকে কেন তালাক দিয়েছিলেন, দাদিমা?
দিলরুখ বেগম ॥ সে ডাহিন আওরত ছিল।
কচি ॥ ডাহিন– ডাইনি? ডাইনি কী দাদিমা?
দি বেগম ॥ তারা নাঙ্গা হয়ে রেতের বেলা মাথায় চেরাগ জ্বেলে মাঠে-জঙ্গলে যায়। তারা গাছপালার সঙ্গে কথা বলে। হাওয়ার সুরে গাওনা করে। সেই গাওনা। শুনে মুর্দারা কবর থেকে উঠে আসে।
কচি ॥ বোগাস! তোমাদের যুগের লোকেরা একেবারে বাজে ছিল।
দি বেগম ।। কচি! ইকরাতন সত্যিই ডাইনি ছিল। এক নিশুতি রেতে আয়মনিখালা আমাকে আর শাশুড়িসাহেবাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেখিয়েছিল। পুকুরের ওপারে খোঁড়াপিরের দরগায় ইকরাতন নাঙ্গা হয়ে মাথায় চেরাগ জ্বেলে দাঁড়িয়ে ছিল। ও যে হিঁদুর মেয়ে ছিল, তা জানিস?
কচি ।। বলেছিলে। আবদুল ডাকাত তাকে ভাগিয়ে এনেছিল!
দি বেগম ॥ ভাগিয়ে না, জবরদস্তি তুলে এনেছিল। তখন হিন্দু মরদের মউত হলে তার আওরতকেও মুর্দার সঙ্গে পুড়িয়ে মারত। আবদুল ওকে শ্মশানের চিতে থেকে–
কচি ।। কিন্তু তখন তো সতীদাহ অলরেডি বে-আইনি! পুলিশ কী করছিল? (একটু পরে) হুঁঃ! পুলিশ যা করে, দেখতেই তো পাচ্ছি। খোকা ঠিকই বলে।
দি বেগম । সেই দেখার পর শাশুড়িসাহেব পরদিন ইকরাতনকে ডেকে পাঠালেন। খুব নসিহত (ভর্ৎসনা) করলেন। বললেন, বউবিবি! তুমি একে কলমা শেখাও। নামাজ পড়া শেখাও। ইকরাকে বললেন, তুমি রোজ দুকাঠা চাল পাবে। বোজ দুবেলা বউবিরির কাছে এসে ইসলামি এলেম তালিম করো। তাজ্জব লাগে বে! ইকরাতন তারপর থেকে রোজ দুবেলা আসত। তাকে কোরানশরিফের ‘আমপারা পুরো মুখস্থ করিয়েছিলাম।
কচি ।। (উত্তেজিতভাবে) দাদিমা! বুঝতে পেরেছি, ইউরেকা!
দি বেগম ॥ কী হল? চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
কচি ।৷ তুমি বলছিলে? বড়ো আব্বার নজর পড়েছিল মেয়েটার দিকে। বড়ো আম্মা তাই তাঁর হবু সতীনকে তৈরি করছিলেন।
দি বেগম ৷। কার দেলের (হৃদয়ের কথা কে জানে ভাই? তো নুরপুরে তাকে নিকাহ করে শ্বশুরসাহেব প্রায় একবছর থেকে গেলেন। এদিকে ওঁর এবাদতখানায় আলি বখশ একলা থাকতে নারাজ। রোজ রেতে তাকে নাকি কালা জিনেরা এসে জ্বালাতন করে। তখন আনিসুর সর্দার আর সব মাথা-মাথা লোক তোর দাদাজিকে বললেন, পিরজাদা! আপনি গিয়ে এবাদতখানায় থাকুন। লোকেরা এসে হুজুরের নামে দানখয়রাত করছে। সব আলি বখশ মেরে দিচ্ছে। তাই নিয়ে ভাসুর-সাহেবের সঙ্গে আলি বখশের খুব কাজিয়া হত। উনি পয়জার মেরেছিলেন আলি বখশকে। সেই থেকে মাতব্বররা রফা করে দিলে । তোর দাদাজি গিয়ে এবাদতখানায় বহাল হলেন। শুনেছি, এবাদতখানায় উনি নামাজ পড়তেন আর সেই নামাজের সময়ে ওঁর পেছনে কাতার (সারিবদ্ধ) দিয়ে শাদা জিনেরা নামাজ পড়ত। ল্যাংড়াভ্যাংড়া মানুষ। কিন্তু খুব সাহসী আর গোঁয়ার ছিলেন। খুব বদমেজাজিও।
কচি ॥ তুমি তোমার স্বামী সম্পর্কে যখনই কথা বল, লক্ষ্য করেছি, বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য কর ওঁর সম্পর্কে! কী ব্যাপার?
দি বেগম ।। (ক্রুদ্ধস্বরে) কচি! ছোটো মুয়ে বড়ো বাত কবি না।
কচি ।। (হাসতে-হাসতে) ঠিক আছে বাবা! তোমাদের প্রাইভেট ব্যাপারে নাক গলাব না! এবার বলো, কেন বড়ো আব্বা ইকরাতনকে তালাক দিলেন? ও দাদিমা! প্লিজ! আর কখনো ওকথা বলব না। বলো না কেন ইকরাতন বিবিকে তালাক দিলেন বড়ো আব্বা?
দি বেগম ।। (কিছুক্ষণ পরে শ্বাস ফেলে) কয়লা যায় না ধুলে/খাসিয়ৎ যায় না মলে। শ্বশুরসাহেব যখন মসজিদে ‘এত্তেকাফে’ থাকতেন, তখন ইকরাতন আবার ডাহিনগিরি করত। হুজুরের কানে সেকথা পঁহুছে দিত লোকে! তবে কথা কী জানিস, ভাই? বনের পাখি খাঁচায় ঢোকালেই কি পোষ মানে? ইকরাতনের চিরটাকাল বেপরদা মাঠেঘাটে ঘোরা খাসিয়ৎ। সে পরদায় বন্দী থাকতে পারবে কেন? তাই যেন ইচ্ছে করেই তালাক নেবার জন্যেই ওইসব করত। শেষে শ্বশুরসাহেব দেখলেন, ভুল কাম হয়েছে। তাঁর ইজ্জত বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। তখন মজলিশ ডেকে তাকে তালাক দিলেন। তারপর নুরপুর থেকে আবার ফিরে এলেন মৌলাহাটে। সেদিন। মৌলাহাটে আবার সে কী ভিড়! কাতারে-কাতারে লোক আগাম খবর পেয়ে দুদিন ধরে পথ তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাদশাহি সড়কের দুধারে লোক। সক্কালে খবর হল, দূরে হুজুরের নিশান দেখা গেছে। টাঙ্গাগাড়িব মাথায় সবুজ নিশান, তাতে শাদা চাঁদতারা। ইসলামি নিশান।
কচি ।। কিন্তু ইকরাতনের কী হল?
দি বেগম ॥ হুঁ, সেকথা বলি। (একটু চুপ করে থাকার পর) সবই শোনা কথা। আয়মনিখালা ছিল আমার ছোট্ট দুনিয়ার জানালা। সে আমাকে তাবৎ খবর দিত। তো নুরপুরে বড়ো এক রেশম কারখানা ছিল। তার মালিক ছিল এক গোরা সাহেব। সে ‘স্বদেশীদের হাতে খুন হয়েছিল। তারপর কারখানাটা এক হিন্দু জমিদার কিনে নেন। কিন্তু চালাতে পারেননি। তাবৎ কারিগর আর সুতোকাটুনিরা কষ্টে পড়ল। তখন বেম্মপুরে– যেখানে তোর ছোটদাদাজি হিন্দু হয়ে থাকতেন, সেখানে তাঁতের কারখানা ছিল। তারা অনেকে সেই কারখানায় গেল। ইকরাতনও শুনেছি সেখানে গিয়ে সুতোকাটুনির কাম করত। তোর ছোটোদাদাজির সঙ্গে সেখানেই তার দেখা হয়।
কচি ॥ ছোটোদাদাজি জানতেন ইকরাতনকে ওঁর আব্বা বিয়ে করেছিলেন?
দি বেগম ॥ জানি না! শুনিনি। হিজরি ১৩২৩ সনে এক বর্ষার রেতে উনি এসেছিলেন। আম্মার সঙ্গে কয়ঘড়ি কথাবার্তা বলে বেরিয়ে গেলেন। শাশুড়িসাহেব তখন জবাইকরা মানুষের মতন মেঝেয ধড়ফড় করছেন। আর এমন বেদিল বেরহম মানুষ, অমন করে চলে গেলেন! কেনই বা এসেছিলেন, কেনই বা আম্মার দেলে (হৃদয়ে) চাকু মেরে চলে গেলেন, কে বলবে সেই খবর?
কচি ।। একমিনিট দাদিমা! হিজরি কত সন বললে?
দি বেগম ।। হিজরি ১৩২৩ সন। রবিউস-সানি মাসের ২৭ তারিখ।
কচি ॥ (পঞ্জিকা দেখে হিসেব করার পর), ইংরিজি ১৯০৫ সাল। জুলাইয়ের। এনড অর অগাস্টের ফার্স্ট উইক। থাক বাবা। পরে কামালস্যারের কাছে জেনে নেব। কিন্তু আমার অবাক লাগছে দাদিমা, সনতারিখটা কেন তোমার মুখস্থ? (দিলরুখ বেগম চুপ করে আছেন দেখে) বলো না দাদিমা? ঠিক আছে, বলল না। (একটু পরে) ওঃ হো! ইতিহাস বইতে পড়েছি, ওই বছর ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন হয়েছিল। হিন্দু মুসলমানের হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিল। বড়লাট কারজন আর ঢাকার নবাব সলিমুল্লা ষড়যন্ত্র করে কাণ্ডটা বাধায়, জান তো?
দি বেগম ।। আমি ওসব জানি না। আমি কি তোর মতো লেখাপড়া জানি?
কচি ।। (হঠাৎ উত্তেজিত) সেই রাতটার কথা তোমার স্পষ্ট মনে আছে?
দি বেগম ॥ (স্মৃতির ভেতর থেকে আচ্ছন্ন স্বরে) আছে। অবিকল সব দেখতে পাই। পানি বর্ষাচ্ছে। জানালায–
কচি ।। ওয়েট, ওয়েট! ছোটোদাদাজির হাতে রাখি বাঁধা ছিল? দি বেগম ॥ কী?
কচি ।। রাখি, রাখি! লাল সিলকের সুতোয় বাঁধা রাংতার নকশাকরা শাদা। শোলার তকমা। এবার বুঝলে?
দি বেগম ।। (চমকে উঠে) ছিল! দেখেছি।
কচি ।। হুঁ –থাকা উচিত। তুমি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নাম নিশ্চয় শুনেছ?
দি বেগম ॥ কে সে?
কচি ॥ ভ্যাট! তুমি হোপলেস দাদিমা। জান? উনি তখন কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ছিলেন। বেরিয়ে পড়লেন নাখোদা মসজিদে গিয়ে মুসলমানদের হাতে রাখি পরাবেন বলে। কবিগুরুকে বলা হল, মুসলমানরা ওঁকে মেরে ফেলবে। ওঁকে আটকানো হল। আমার কষ্ট হয়, দাদিমা! মুসলমানরা কি এতই জানোয়ার? মুসলমানরাও ওঁকে বিশ্বকবি বলে মানেনি বুঝি? সেদিন যদি কবিগুরু নাখোদা মসজিদে গিয়ে মুসলমানদের হাতে রাখি বাঁধতেন, উঃ! কী ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যেত! (আস্তে) দেশভাগ হত না। তোমার চাচাজির ছেলেরাও পাকিস্তানে যেতেন না। মৌলাহাটে আমাদের কী বিরাট ফ্যামিলি হত, কল্পনা করো! কেন যে কবিগুরুকে ওরা মিথ্যে ভয় দেখাল, বুঝি না বাবা!
দি বেগম ॥ মানুষটা কে রে?
কচি ।। (উঠে গিয়ে একটি বই এনে এবং খুলে) এই দেখো ইনিই রবীন্দ্রনাথ।
দি বেগম ॥ চোখে তত শোজে না। কিন্তু ওনাকে তো অবিকল শ্বশুরসাহেবের মতন লাগছে রে! হ্যাঁ –ওইরকম পোশাক, ওইরকম বাবরি চুল, সফেদ (শাদা) দাড়ি। ওইরকমই!
কচি ।। বলল তাহলে!
দি বেগম ।। কিন্তু ছবি দেখা গোনাহের কাম, কচি! তুই আবার আমাকে গোনাহগার করলি!
কচি ॥ যাব্বাবা! মৌলাহাটে আর কি সেই পিরিয়ড আছে? কজন ফরাজি আছে আর? আবার তো হানাফি হয়ে গেছে লোকেরা। ঘরে ছবি টাঙায়। গানবাজনা করে। মহরমে তাজিয়া করে। (হাসিতে অস্থির হয়ে) আর তোমাদের পির ফ্যামিলি কী করছে? বড়োদাদাজির বংশধররা? আমরা? আমি আমি বেপরদা হয়ে স্কুলে যাচ্ছি। তার বেলা?
দি বেগম ।। তোর আব্বা যত নষ্টের গোড়া। রফি ঠিক খোকার মতো হিঁদুঘেষা ছিল। রফিকে বোঝায় কার হিম্মত? পিরের খান্দানি রফিই নষ্ট করেছিল।
কচি ।। কখনো না। ছোটোদাদাজি।
(খোকা এল হন্তদন্ত হয়ে। দিলরুখ বেগম পুরনো আমলের খাটে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। কচি পা ঝুলিয়ে। বাইরে শরৎকালীন বিকেলের রোদ্দুর। ভ্যাপসা গরম দিনভর। খোকাকে দেখে দুজনেই চমকে উঠেছিল)।
খোকা ।। দাদিজি! কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। কেউ জিগ্যেস করলে বোলো, জানি না। আর এই পুঁচকি মেয়ে! সাবধান! (সে দেয়াল থেকে ব্যাগ নামিয়ে প্যান্ট-শার্ট-তোয়ালে এইসব জিনিস দ্রুত ভরে নিয়ে বেরিয়ে গেল। এক বৃদ্ধা এবং এক তরুণী হতবাক হয়ে বসে রইল)।……
‘She claims him with her great blue eyes
She binds him with her hair;
Oh, break the spell with holy words,
Unbind him with a prayer!’*
–The Witch of Wenham–J.G. Whittier
‘ফার্সি হুসিয়ারনামা কেতাবে জে২ প্রকারে বর্ণিত আছে, আওরতটির দেহেও সদৃশ নমুদ ছিল। বাঙালামুলুকে ইহাদিগের ‘ডাহিন’ কহা জায়। উহাকে শয়তানের কবজ হইতে বাঁচাইবার নিমিত্ত নুরপুরনিবাসী মোছলেমবৃন্দকে কহিলাম, কেহ কি এই আওরতকে নিকাহ, করিতে তৈয়ার আছে? সকলে বহুত২ ডর পাইল। কেহ করিল, হজরতে আলা! আমরা শুনিয়াছি জে, আপনি জনৈক জমিদারবাবুর কন্যাকে শয়তানের কবজ হইতে বাঁচাইয়াছেন। আমরা উহাকে বাঁধিয়া আপনার হুজুরে হাজের করিতেছি। উহাদিগকে খামোশ করিলাম। কিছু দিবস পরে কাজীছাহেব আমাকে জ্ঞাত করিলেক কে বিবি ইকরাতন নিজমুখে কহিয়াছে জে তোমারদিগের পিছাহেবের যদি আমার নিকাহ দেওয়ার একপ্রকার তাকি থাকে তাহা হইলে তিনিই আমাকে নিকাহ করুন। আমার অজুদ শিহরিত হইল। কহিলাম, প্রেরিত পুরুষ বহুত২ জেহাদে মৃত য়েহুদা এবং নাছারাদিগের বেওয়া আওতগণকে মোছলেমদিগের সহিত নিকাহ দ্বারা ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন হাদিছে এমত বর্ণিত আছে। রসুলে আল্লাহ (সাঃ) নিজেও এমতে জনৈক নাছারা বেওয়াকে নিকাহ করেন।…..
“আরবদেশে আইয়ামে জাহলিয়াতের (অজ্ঞানতার যুগের) কাল হইতে একপ্রকার মনুষ বিদ্যমান ছিল। উহাদিগের ‘কাহিন’ বলা হইত। উহারা শয়তানের বান্দা-বাঁদী ছিল। ওই কাহিনরা মুখে একপ্রকার আওয়াজ করত সংগীতের মারফত আজগৈবি কথাবার্তা জানান দিত। মসজেদে সপ্তরাত্র এত্তেকাফে অতিবাহিত করিয়া অষ্টরাত্রে গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া চমকিয়া উঠিয়াছিলাম। বিবি ইকরাতন কোরান শরিফ পাঠ করিতেছে ভাবিয়া কিয়দ্দণ্ড কর্ণপাত করিতেই জানিলাম সে আল্লাহের কালাম আবৃত্তি করিতেছে না। উহা অন্যপ্রকার কিছু হইবেক। তৎক্ষণাৎ গৃহ প্রবেশ করিয়া উহার মুখে আছার বাড়ি মারিলাম। শয়তানি আছা ধরিয়া ফেলিল।….
“বিবি ইকরাতন আদতে কাহিন-আওরত ছিল। উহাকে তালাক দিবার সমুদায় হেতু এরূপে বর্ণিত হইল।…..
“এক বৎসর পর লোকমারফৎ সম্বাদ পাইলাম জে হারামজাদী কাহিন পুনরায় হিন্দু হইয়াছে। বরমপুর অথবা বেহ্মপুর নামক জায়গায় গিয়া তাঁত কারখানায় সূতা কাটিতে কাটিতে আমার কুৎসামূলক সংগীত গাহে। সেইদিবস জুম্মাবার ছিল। মসজেদে জাইয়া খুৎবাপাঠের সময় মোছলেম ভ্রাতৃবৃন্দকে কহিলাম, প্রেরিত পুরুষের তাওয়ারিখ (ইতিহাস)-লেখক ইবনেহিশামের এই বৃত্তান্তটি শ্রবণ করুন।….
‘বনু খাতমা (খাতমাবংশীয় ট্রাইব)-দিগের মধ্যে আস্মা-বিন্তে-মানোয়ান নামে জনৈক ‘কাহিন’ ছিল। সে রসুলে আল্লাহর (সাঃ) নামে কুৎসামূলক সংগীত গাহিত। একদিবস হুজুর পয়গম্বর (সাঃ) ব্যথিতচিত্তে কহিলেন, এমন কেহ কি নাই জে আমাকে মারোয়ানের কন্যার কুৎসা হইতে অব্যাহতি দিবেক? সেইস্থানে বনু খাতুমার জনৈক ইমানদার উমায়ের-ইবনে-আদি হাজির ছিল। সে তৎক্ষণাৎ তলওয়ার খুলিয়া ধাবিত হইল। সেই রাত্রে উমায়ের আমাকে কোতল করিয়া আসিয়া কহিল জে হে পয়গম্বর! আমি উহাকে কোতল করিয়াছি। প্রেরিত পুরুষ কহিলেন জে তুমি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সেবা করিয়াছ। উমায়ের কহিল জে হে পয়গম্বর! আসমা নিদ্রিত ছিল এবং উহাব বক্ষে বাচ্চা ছিল। সে পাঁচটি বাচ্চার মাতা। হে রসুলে আল্লাহ আমার গোনাহ হইবেক কি? প্রেরিত পুরুষ কহিলেন জে উহার জন্য দুইটি ছাগলও ডাকিয়া উঠিবে না। ইহার অর্থ হইল জে গোনাহ দূরের কথা, একজন কাহিনকে কোতল করিলে কেহই তাহাব জন্য কাঁদিবে না। বেরাদানে ইসলাম! তাহার পর বনু খামার সমুদায় লোক ইসলাম কবুল করিয়াছিল। ইবনেহিশাম লিখিয়াছেন জে এই ঘটনা ইসলামের শক্তি সাব্যস্ত করিয়াছিল। আরও কহি জে এই ঘটনা বদরের জঙ্গের (যুদ্ধের) পর ঘটিয়াছিল।….
“জমাদিউল আউল মাসের ১১ তারিখে বিবি ইকরাতন কোতল হয়। সন স্মরণ নাই। সেইকালে তাবৎ মুলুকে ভয়ংকর বন্যা হয়। হাজার ২ মানুষ এবং জানোয়ার ভাসিয়া যায়। শয়তানী কাহিনের কাতেল (হত্যাকারী) তিনদিবস পরে তালডোঙ্গায় চাপিয়া ফিরত আসিল এবং কহিল জে হারামজাদীর লাস পানিতে ভাসিয়া গিয়াছে!…..
“সেই রাত্রে আসমান ছিদ্রযুক্ত হওনের নিমিত্ত পানি গিরিতেছিল। এবাদতখানায় বসিয়া আছি। আচানক দেল ফাটিয়া গেল। দুই হস্তে মুখ ঢাকিয়া ক্রন্দন করিতে থাকিলাম। হে পরওয়ারদিগার। হে কুমখলুকাতের মালেক! বনু আদমের মৃত্তিকা নির্মীত এই অজুদের ভিতরে তুমি কী গোপন চীজ (জিনিস) স্থাপন করিয়াছ জে সামান্য ধাক্কায় সমুদায় জিন্দেগী কাঁপিয়া উঠে? হতভাগিনী ‘কাহিন’ আওরত! কেয়ামতের পর হাশরের ময়দানে আমি উহার জন্য নেকির অর্ধাংশ দানে তৈয়ার। রহিলাম!…..”
মেহেরবাঁ হোকে বুলালো মুঝে চাহো জিস্ ওয়াক্ত
ম্যায় গ্যায়া ওয়াক্ত নেহি হুঁ কে ফির আভি না শাকুঁ….
মৌলাহাটে ফিরে আসার পর ‘হজরত’ বদিউজ্জামান (আর তাঁকে কেউ মৌলানা বা মওলানা বলত না) কিছুকাল এবাদতখানায় নিঃসঙ্গ কাটান। কথিত আছে, তাঁর খিদমতগার আলি বখশকে তিনি এসে আর দেখতে পাননি। পরে খবর হয়, আলি বখশ বীরভূম জেলার আমভুয়া গ্রামের মসজিদে আজান হাঁকার অর্থাৎ মোয়াজ্জিনের কাজ পেয়েছে। বোনকেও সেখানে নিয়ে গেছে। আলি বখশের কণ্ঠস্বর মোলায়েম এবং সুরেলা ছিল। তাছাড়া বদুপিরের খিদমতগার হিসেবে তার একটি পৃথক কৃতিত্ব ছিল জনসাধারণের কাছে, সরকারি চাকরির বেলায় দরখাস্তে এক্সপিরিয়েন্স শীর্ষক আইটেম যেমন প্রার্থীকে যোগ্যতর প্রতিপন্ন করে। অবশ্য আলি বখশের এই পলায়নের কারণ হুজুরের সঙ্গে ইকরাতন বিবির নিকাহ।
প্রতিবন্ধী মনিরুজ্জামান তার পিতার ফিরে আসার খবর পেয়েই বাড়ি চলে যায়। সে এবাদতখানায় সম্ভবত জীবনে প্রথম অলৌকিকতার আস্বাদ পেয়ে থাকবে। জ্যোতি জিনগুলি অথবা নিঃসঙ্গতা (আলি বখশ তাকে পছন্দ করত না বলে এড়িয়ে চলত), প্রাকৃতিক পরিবেশজনিত রহস্যময় নৈঃশব্দ্য, আর এবাদতখানার ভেতরে বুজুর্গ পিতার চিহ্নগুলি– এই-সমস্ত তার জড়তাগ্রস্ত চেতনাকে পুনঃপুন আঘাতে জর্জরিত করত। আর অন্তত এটুকু সে বুঝত, তার আওরত তাকে পছন্দ করে না। সে ততদিনে ছেলের বাপ হতে পেরেছে এবং এটিকে সে কৃতিত্ব বলে গণ্য করছে এবং তার আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। অথচ ওই খুবসুরত আওরতটি তাকে বৃক্ষলতা কিংবা চতুস্পদ প্রাণী গণ্য করে। তাই তার মনে অভিমান ছিল। জ্বালা ছিল। এবাদতখানার প্রশান্তি– যা একটি সরোবর, বনানী, নির্জনতা, জ্যোৎস্না, অন্ধকার, চাঁদ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, পাখি ও পোকামাকড়ের দ্বারা নির্মিত পরাবাস্তবতা, তাকে একপ্রকার অলৌকিকতার আস্বাদ দিয়েছিল। নারীর জন্য প্রেম, পুত্রের প্রতি বাৎসল্য– এসব বাস্তবতাকে ওই সংক্রামিত পরাবাস্তবতা গ্রাস করে। মাকড়সার জাল যেমন পোড়ো বাড়ির দরজাকে ঢেকে রাখে, তেমনিভাবে স্ত্রী-পুত্র-জননী সংসারকে মনিরুজ্জামান ধূসর একপ্রকার সূক্ষ্ম তন্তুজালে আবৃত দেখত। তার এবং,রুকুর মধ্যে একটি শিশু পরিণামে দূরত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু মনিরুজ্জামান সম্পর্কে একটি ঘৃণ্য বিষয়ের উল্লেখ জরুরি। পশুর তীব্র যৌনবোধ থেকে এই হতভাগ্য। প্রতিবন্ধী নিষ্কৃতি পায়নি। সে স্বমৈথুনে অভ্যস্ত ছিল। এবাদতখানার পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে সে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে আসত। বাড়ি ফেরার পর যখন তার ওই মেটামরফসিস ঘটে গেছে এবং সে পরাবাস্তবতাময় জীবনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তখনও সে হঠাৎ-হঠাৎ কামনাজর্জর হত এবং পায়খানাঘরের ভেতর যৌনতা থেকে মুক্তি চেয়ে নিত। এভাবেই রুকুকে বর্জনের চেষ্টা করত সে।
এদিকে হজরত বদিউজ্জামান কিছুকাল পরে ধীরে আত্মম্বসরণের সাধনায় লিপ্ত হন। তিনি চিত্তের প্রশান্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। স্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়ার তাকিদ অনুভব করতেন। একদা ঠিক তাঁর স্ত্রী যেভাবে প্রতীক্ষা করতেন, তিনিও সেইভাবে প্রতীক্ষায় থাকনে। হয়তো সেজন্যই আর খিদমতগার বহাল করেননি। বাড়ি থেকে খানা আনিয়ে আহার করতেন। কোনো-কোনো বেলা তিনি কোনো একটি খাদ্যে সাইদার স্পর্শ-গন্ধ-স্বাদ টের পেতেন। সাইদা আর রুকুর রান্নায় স্বাভাবিক পার্থক্য ছিল। বুজুর্গ ব্যক্তিটির রসনা কেন, দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য ছিল না সেই পার্থক্যের।
ক্রমশ তিনি কিছু গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপে মন দেন। পুকুরটির পরবর্তীকালে যা পিরপুকুর নাম পায়, তার উত্তরপাড়ে একতলা কয়েকটি ঘর গড়ে ওঠে। সেটি এতিমখানা। মসজিদসংলগ্ন মক্তবটি পুরোপুরি মাদ্রাসা হয়ে ওঠে এবং এর পিছনে হরিণমারার বড়োগাজির প্রচুর মদত ছিল। মৌলানা নুরুজ্জামানের সঙ্গে এ নিয়ে। তুমুল বাহাস (বিতর্ক) হয় বড়োগাজির। নুরুজ্জামান মাদ্রাসাটিতে দেওবন্দি কারিকুলাম চালু করতে চেয়েছিলেন। শুধু আরবি-ফারসি-উরদু ছাড়া আর কোনো ভাষায় পড়াশোনা হারাম –এই ছিল তাঁর মত। কিন্তু বডোগাজি আলিগড়ি ধাঁচের পক্ষপাতী। তিনি বাঙলা আর ইংরাজিকেই আবশ্যিক করতে চান। সুবিখ্যাত ক্যালকাটা মাদ্রাসার দৃষ্টান্ত দেন তিনি (১৮২০ ইংরাজি সনের ১৫ জুলাই কলকাতার তালতলায় যার শিলান্যাস এবং ১৮২২ সনের অগাস্ট মাস থেকে পঠনপাঠন শুরু)। হজরত বদিউজ্জামান বড়োগাজির মতে সায় দেন। ফলে বাংলা ১৩০৯ সন, হিজরি ১৩২০ সন, খ্রীস্টীয় ১৯০২ সনে মৌলাহাট মাদ্রাসা স্কুল স্থাপিত হয়। কয়েক মাসের মধ্যে সরকারি অনুমোদন এবং আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে বড়োগাজি, সবিক্রমে কলকাতা থেকে ফিরে আসেন। অসংখ্য ছাত্র সংগৃহীত হয় এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে। হুজুরের পাঞ্জা এবং নিশান নিয়ে বড়োগাজি, ছোটোগাজি, মৌলাহাটের চৌধুরিসাহেব, আনিসুর সর্দার প্রমুখ লোকেরা গ্রামে-গ্রামে সভা করে বেড়াতেন। পরের বছর বাইরের ছাত্রদের জন্য ‘তালেবুলএলেমখানা’ (হোসটেল) তৈরি হয়। ছাত্রদের তখনও ‘তালেবুলএলেম’ বলা হত এবং জনগণের উচ্চারণ-বিকৃতিবশে সেটি ‘তালবিলি’-এ রূপ নিয়েছিল।
একদিন বদিউজ্জামান এবাদতখানার উত্তরের বনভূমিতে গিয়ে অভ্যাসমতো দাঁড়িয়ে আছেন (কিংবদন্তি অনুসারে তিনি ওইভাবে নির্জনে বৃক্ষবাসী জিনদের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন), বাঘনখা নামে একটি বেঁটে চওড়া পাতাওয়ালা গাছের তলায় একটি যুবককে বসে থাকতে দেখেন। এইসব গাছের ফলন গড়ন বাঘের নখের মতো। বদিউজ্জামান অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, সে নির্জনে বসে কেতাব পড়ছে। তার মাথায় টুপি, পরনে যেমন-তেমন একটি কুর্তা আর চু পাজামা, খালি পা। মুহূর্তের জন্য চমকে উঠেছিলেন বদিউজ্জামান, যুবকটির মুখের অর্ধাংশ শফির মতো। তিনি একটু কেশে সাড়া দিতেই যুবকটি ঘুরল এবং হজরত পিরসাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর ছুটে এসে সসম্ভ্রমে তাঁর পদচুম্বন করল। বদিউজ্জামান জিগ্যেস করলেন, কে তুমি বাবা? যুবকটি মৃদুস্বরে কুণ্ঠিতভাবে বলল, আমি তালেবুলএলেম। আমার নাম জালালুদ্দিন। হজরত বললেন, তোমার মোকাম?…জি, বীরভূমের মখদুমনগর গ্রামে।…এখানে তুমি কেতাব পড়তে আস দেখছি!…জি, হা…তুমি জান না এই জায়গায় কারুর আসা বারণ? জালালুদ্দিন বিব্রতভাবে বলল, হজরতে আলা! আমি নতুন এসেছি। কেউ আমাকে একথা বলেনি। গোস্তাকি মাফ করবেন। আর কখনও আসব না। এই বলে সে পা বাড়ালে বদিউজ্জামান ডাকলেন, বেটা! শোনো! তুমি কী কেতাব পড়ছিলে এখানে, দেখি। জালালুদ্দিন সংকোচে দুহাতে হুজুরের পাক হাতে কেতাবটি তুলে দিয়ে বলল, জনাবে আলা! এখানি উরদু শাইরি। হিন্দুস্থানের নামজাদা শায়ের (কবি) গালিবের কেতাব। হিজরি ১২৮৬ সনে উনি ইন্তেকাল করেছেন। বদিউজ্জামান কেতাবখানির পাতা ওলটাচ্ছিলেন। একটি পাতা তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন দেখে জালালুদ্দিন শালীনতাবশে চুপ করল। বদিউজ্জামান আস্তে বললেন, মির্জা গালিবের কথা আমি কিছু শুনেছি। সে তো শরাবি ছিল! তবে আল্লাহপাকের কুদরত বোঝা দায়। ব্যানাবনে মুক্তা ছড়ানো বলে একটা কথা আছে। পরওয়ারদিগার কী খেয়ালে রাবি দিওয়ানাদের দেলে হীরা-জহরত-মুক্তা ছড়ান, সেই কুদরত নাদান মানুষ কী করে বুঝবে? জালালুদ্দিন, কেতাবখানি এবেলা আমার কাছে থাউক। মগরেবের ওয়াক্তের পর তুমি এবাদতখানায় এসো। ফেরত দেব। জালালুদ্দিন এমন ভঙ্গিতে চলে গেল সে হুজুরের সঙ্গে এই আশ্চর্য মোলাকাত এবং কেতাব দেওয়ার কথা সাড়ম্বরে সকলকে বলবে। আচানক চোখঝলসানো নুর (জ্যোতিঃ) এবং পাক ছুরত (পবিত্র মূর্তি) এবং কাছে থেকেও দূরবর্তী কণ্ঠস্বরের মতো কণ্ঠস্বর শোনার কথাও সে হয়তো না বলে ছাড়বে না। বস্তুত কথিত আছে হজরত বদিউজ্জামানের কণ্ঠস্বর আসমান থেকে ভেসে আসার মতো বোধ হত। হিন্দুশাস্ত্রে যাকে দৈববাণী বা আকাশবাণী বলা হয়, হজুরের কণ্ঠস্বরে সেই দূরত্ব ছিল।
বদিউজ্জামান গালিবের যে পঙক্তিটি পড়ছিলেন, তা হল : মেহেরবাঁ হোকে বুলালো মুঝে…।
‘যখনই ইচ্ছা, করুণাপ্রবণ হয়ে আমাকে ডেকে পাঠাও/আমি তো চলে যাওয়া সময় নই যে, ফিরে আসতে পারব না!’
সেই রাত্রে দুখু শেখ খানা আনে এবং বদ্দিউজ্জামান খানা খাওয়ার পর তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। খাগের কলম এবং কেশুরেপাতার রস আর মাটির হাঁড়ির তলার পোড়ো কালোরঙের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি কালি তাঁর এবাদতখানায় সর্বদা মজুদ থাকত। একখণ্ড তুলোট কাগজে তিনি গালিবের পঙক্তিটি লিখে দুখু শেখের হাতে দেন। বলেন, এই খতখানি তুমি বিবিসাহেবাকে দিও। খর্বদার! কালা জিন যদি দেখ ঝামেলা বাধায়, ফিরে এসে খবর দেবে। এসো, তোমার মাথায় দোয়া ফুকে দিই। কোনো ডর কোরো না। দুখু শেখ ইমানদার মানুষ। সে পুকুরের ঘাটে হুজুরের খাদ্যপত্র ভক্তিভরে দেওয়ার পর দ্রুত লানটিনহাতে ফিরে যায়। তার বুকে টেকির পাড় পড়ছিল। ইদানীংকালে বিবিসাহেবা তাকে দেখা দেন। কারণ হাদিস কৈতাবে এমত বর্ণিত আছে, ‘গৃহের বান্দারাও স্বজনবর্গের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের সামনে পরদার প্রয়োজন নেই।’ দুখু শেখ প্রকৃতই একজন বান্দা ছিল। সে দলিজঘরে থাকত। গেরস্থালির সব কাজ তাকেই করতে হত। সে রাত্রে বিবিসাহেবার পাক হাতে সে খতখানি সসম্ভ্রমে অর্পণ করে। রুকু তখন রান্নাশালের কাজ সামলে। নিচ্ছিল। রফি তার বাবার পাশে ঘুমন্ত। রুকু আড়চোখে দৃশ্যটি দেখে এবং অবাক। হয়। খতখানি পড়ার পর সাইদা খাস ফেলে বলেন, বউবিবি! দুখুভাইয়ের খানা। বেড়ে দাও! রুকু বলে, দলিজঘরে ঢাকা আছে।
সাইদা খান্দানি মিরপরিবারের মেয়ে। লালবাগ অঞ্চলের ওদিকে ভগবানগোলায় তখনও খান্দানি মুসলিমরা দ্বিভাষাভাষী। বাঙলা আর উরদু উভয় ভাষা জানতেন। খতখানি যে শাইরি (কবিতা), সাইদা তা বুশতে পেরেছিলেন। খতের তলায়। বদিউজ্জামানের আঙ্গুটির মোহরের ছাপ ছিল। রুকু হাতের কাজ শেষ করে বদনাহাতে পায়খানাঘরের দিকে যাওয়ার সময় শাশুড়িসাহেবাকে পেয়ারাতলায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং একটু ইতস্তত করে জানতে চায়, কিসের খত আম্মা? সাইদা আস্তে বলেন, খত না, তাবিজ-রফির জন্য।…..
Und so tragt er scine Bruder,
Seine Schatze, seine Kinder
Dem erwartenden Ergeuger
Freudebrausend an das Herz.*
[* পয়গম্বর হজরত মহম্মদ সম্পর্কে কবি গ্যযটেব কবিতার অংশ। ডেভিড লুকের ইংরেজি অনুবাদ. ‘And thus he carries his brothers, his treasures, his children, all tumultuous with joy, to their waiting Parent’s bosom.’]
কচি ।। কিন্তু তাবিজ নয়?
দিলরুখ বেগম ॥ (সকৌতুকে) উঁহু, খত। চিঠি। চিঠিতে একটি বয়েৎ ছিল। মানে বুঝতে পারিনি।
কচি ।। তারপর কী হল, দাদিমা?
দি বেগম ॥ (মুখ টিপে হেসে, চাপা স্বরে) এক রেতে শাশুড়িসাহেবার দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। তখন আর আয়মনিখালা শুতে আসত না ওঁব কাছে। একলা শুতেই পছন্দ করতেন। তো ভাবলাম, বুঝি পেসাব করতে বেরুলেন। আমি কান করে আছি। একটু পরে
কচি ।। একমিনিট! তোমার বুঝি ঘুম হত না রাত্তিরে?
দি বেগম ॥ না রে! নিঁদ এলেই খালি কতরকম খোয়াব (স্বপ্ন)। ইচ্ছে করেই জেগে থাকতাম। হাজার কথা মাথায় আসত। আর রেতের বেলা কী হয, সে আমি জানি! ছোটো কথা বড়ো হয়। বুজকুড়ির মতন। ফোটে, ভেঙে যায়।
কচি ॥ হুঁ পড়েছি? ‘Beware thoughts that Come in the night!’ তোমার সেই ফারসি কেতাব ‘হুঁশিয়ারনামায়’ অবিকল একই কথা আছে। কে কার থেকে চুরি করেছে কে জানে?
দি বেগম ।। বকবক করবি, নাকি শুনবি?
কচি ।। সরি! বলো!
দি বেগম ॥ তো খিড়কির দরজাটা একটু আঁটো ছিল। সহজে খুলতে চাইত না। সেখানে আওয়াজ শুনে ভাবলাম, উনি এত রেতে ওদিকে বেবুচ্ছেন কেন? উঠে জানালা দিয়ে দেখি, উনি বেরিয়ে গেলেন। তখন আধখানা চাঁদ উঠেছে। একটু চাঁদনি ছিল। চত্তির মাস। খুব হাওয়া দিচ্ছে।
কচি ।। তারপর? তারপর দাদিমা?
দি বেগম ॥ গেলেন তো গেলেন। আর আসেন না, আর আসেন না। ডরে কাঁপছি। অমন করে কোথায় গেলেন? কচি, ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। এমনি চাঁদনি রাতে আমার আম্মা– (জোরে শ্বাস ছেড়ে চুপ করলেন)
কচি ॥ আঃ, বলল না!
দি বেগম ॥ ভাবছি তোর দাদাজিকে ডেকে তুলব নাকি। কিন্তু সে তো ল্যাংড়াভ্যাংড়া মানুষ। দুখুচাচাকেই ডাকি বরঞ্চ। এই ভেবে উঠতে যাচ্ছি, খিড়কির দরজায় আওয়াজ হল। জানালায় উঁকি মেরে দেখি, শাশুড়িসাহেবা ফিরে এলেন। (ফোকলা দাঁতে হেসে) তখন কি জানি উনি কোথায় গিয়েছিলেন? পরদিন খবর হল, পিরসাহেব বাড়ি আসছেন। ফজরের নামাজে দুখুচাচা মসজিদে গিয়েছিল। সেই খবর আনল। তারপর দেখি কী, শাশুড়িসাহেবা ঘরদোর সাফ করছেন। তাড়া লাগিয়েছেন। সাজো-সাজো রব এই বাড়িতে।
কচি ॥ (প্রচণ্ড হেসে) মাই গুডনেস! বড়ো আম্মা অভিসারে গিয়েছিলেন বলো। দারুণ! অসাধারণ! ওঃ! ভাবা যায় না!
দি বেগম ॥ (কপট ক্রোধে) হিঁদুগিরি ছাড় দিকি! হিঁদু মেয়েগুলানের সঙ্গে মিশে তোর এই স্বভাব হয়েছে। না হিন্দুস্থান-পাকিস্থান হবে, না মৌলাহাটে হিঁদুদের বসতি হবে!
কচি ।। দাদিমা! তুমি বড় সাম্প্রদায়িক! জান না ওরা তোমার মোছলেম বেরাদারদের জুলুমে ইস্টবেঙ্গল থেকে এ দেশে পালিয়ে এসেছে? আজ শ্রাবণী নামে যে মেয়েটা এসেছিল, তুমি জান কি ও খড়ের গাদায় লুকিয়ে না থাকলে ওকে জবাই কবা হত? তখন ও এতটুকু ফ্ৰকপরা মেয়ে! তবু দেখো, ওরা আমাদের ঘৃণা করছে না!
দি বেগম ॥ (আস্তে) মেয়েটা ভালো! (শ্বাস ছেড়ে) তোর আব্বার হিন্দু বন্ধুরাও খুব ভালো ছিলেন। লুকিয়ে-চুরিয়ে রেতের বেলা এসে আমার হাতের খানা খেতেন। কত তারিফ করতেন। তোর আম্মা ওঁদের দেখা দিত। কথা বলত। তোর আম্মার। নিমুনিয়া হল –ডবল নিমুনিয়া! তখন তোর আব্বার হিন্দু বন্ধুরাই সদর থেকে ‘সিবিল সার্জেং’ ডাক্তার এনেছিলেন। বিলেত-পাস ডাক্তার। তোর আব্বার সাধ্যি ছিল তাঁকে আনবার? সেই পেথম হাওয়াগাড়ি এল মৌলাহাটে। হাওয়াগাড়ি দেখলাম! সিবিল সার্জেং তোর আম্মাকে পরিক্ষে করে বললেন, দের হয়ে গেছে। আর উপায় নেই। উনার হাওয়াগাড়িও রওনা দিল, তোর আম্মাও
কচি ॥ আঃ! ওসব কথা থাক। বড়ো আব্বার বড়ো আম্মার কথা বলো!
দি বেগম ।। আর কী কথা! সেই থেকে শশুরসাহেব একহপ্তা করে এবাদতখানায় থাকতেন। তখনও এ তল্লাটে বোরখার চলন ছিল না। শাশুড়িসাহেবাদের বাপের তল্লাটে ছিল। শাশুড়িসাহেবার একটা বোরখা ছিল প্যাটরায় ভরা। কোনো কোনো রোজ সেই বোরখা পরে উনি নিজেই এবাদতখানায় খানা দিতে যেতেন। দুখুচাচাও সঙ্গে যেত। সেই দেখাদেখি মৌলাহাটে অনেক বাড়িতে বোরখার ফ্যাসাং হল। বেশিদিন চলেনি। গাঁ তো তখনও চাষাভুষোর।
কচি ॥ কথাটা ফ্যাশান, ফ্যাশাং নয়! তুমি এমন বংশের মেয়ে! শুদ্ধ কথাবার্তা বলতে পার না?
দি বেগম ।। ওই হল। তবে প্রেথম-প্রেথম আমি বোরখা পরতে পারতাম না। দম আটকে যেত। রোজি– তোর বড়োদাদিজি বোরখা পরতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল! ছোটোবেলা থেকে আমাদের দু-হিনেরই পাড়া বেড়ানো খাসিয়াৎ! কিন্তু তখন ওদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ। না– রোজির দোষ ছিল না। জানিস তো আমরা যাওয়া (যমজ) বহিন ছিলাম? এখন বুঝতে পারি, রোজিকে আমার কাছে তোর বড়োদাদাজিই আসতে দিতেন না। রোজির কোন দোষ নেই। সে তার মরদকে খুব ডর করত।
কচি ।৷ আর তুমি তার উলটো! দাদাজিক মানুষ বলেই মনে করতে না!
দি বেগম ॥ (চটে গিয়ে) আঃ কচি! ফের গেটো মুখে বড়ো কথা? মু বন্ধ কর!
কচি ।। ঠিক আছে বাবা! ঘুম পাচ্ছে। আর ডেকো না। সামনে টেসট এগজামিনেশন!…..
চুন্ য়কি বাশদ্ হমি ন বাশদ্ দুঈ
হম্ মনি বর্ খিজদ্ ইন্জা হম্ তুঈ…
…..জালালুদ্দিনকে আমি কেন এত স্নেহ করি? বুড়বক উজবুগরা এই নিয়ে জল্পনাকল্পনা করে, কানে আসে। সেদিন হরিণমারার ছোটোগাজি কুণ্ঠিতভাবে বলছিলেন, হজরত! জালালুদ্দিনকে আপনি মোজেজা দেখিয়েছেন। আর আমি। এতদিন আপনার খিদমত করে আসছি, কিছুই পেলাম না! বান্দার ওপর হুজুর নিশ্চয় কোনো কারণে নারাজ আছেন। এই ছোটোগাজি লোকটি মন সরল। সে তার বড়োভাইয়ের মতো ধূর্ত নয়। ভণ্ড নয়। সে যা বলে, মন খুলে বলে। কিন্তু দুনিয়ায় এমন মানুষই বেশি, যারা জিন্দেগানির চারপাশে টুড়ে বাড়তি জিনিস আদায় করতে চায়। এমন জিনিস, যা ধরাছোঁয়া যায় না, অথচ আছে। তবে সত্যিই তো, আমি যখন তাদের কাছে বুজুর্গ ব্যক্তি, তখন আমার মারফত ওই বাড়তি জিনিসের ঈষৎ আভাস তারা আশা কবতেই পারে। একটু হেসে বললাম, জালালুদ্দিনকে কী মোজেজা দেখিয়েছি গাজিসাহেব? ছোটোগাজি বললেন, আপনি ওই জঙ্গলে পাখ পাখালি পোকামাকডের সঙ্গে কথা বলছিলেন, জালালুদ্দিন শুনেছে। গম্ভীরমুখে বললাম, গাজিসাহেব! আল্লাহ কি সকল মানুষকেই হরবখত্ত মোজেজা দেখান না? ওই দেখুন, আনারগাছটি কত উঁচু হয়ে উঠেছে। কোথায় ছিল ওই গাছ? একটি ছোট্ট বীজ থেকে পয়দা। আর ওই দেখুন ফুলগাছটিকে। কোথায় ছিল ওই রঙিন জিনিসগুলিন? এগুলিন কি মোজজা নয়? ছোটোগাজি সায় দিলেন বটে, কিন্তু মনে হল, তিনি চান, জাদুগিরের জাদুর খেল দেখাই। তিনি জালালুদ্দিনের নাম ফের উচ্চারণ করেই থেমে গেলেন। তখন তাঁকে বললাম, জালালুদ্দিন যদি কিছু দেখে থাকে, তার মধ্যে আল্লাহ ইলম (প্রজ্ঞা) দিয়েছেন বলেই দেখেছে। ঠিক এই সময় আচানক একটা ঘটনা ঘটল। চৈত্রমাসের শেষ দিন ছিল এটি। জঙ্গলের দিক থেকে প্রচণ্ড একটি ঘূর্ণিহাওয়া এসে পড়ল এবং ছোটোগাজির টুপিটি উড়িয়ে নিয়ে গেল। ঘূর্ণিহাওয়াটি উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর পুকুরের পানিতে হুলস্থুল বাধিয়ে। এতিমখানার গা ঘেঁষে সড়কে পৌঁছুল। ছোটোগাজি চোখ বুজে ফেলেছিলেন। বললাম, দেখুন, দেখুন! ছড়ি তুলে দেখিয়ে দিলাম, তাঁর টুপিটি তালগাছ-সমান। উঁচুতে ভেসে চলেছে। দেখামাত্র ছোটোগাজি আমার পায়ের সামনে কাটাগাছের মতো আছড়ে পড়ে আবেগে কেঁদে ফেললেন, হজরত! হজরত! আমি নাদান বান্দা! খাতাহ (ত্রুটি) মাফ করুন। ভর্ৎসনা করে তাঁকে টেনে ওঠালাম। তওবা নাউজুবিল্লাহ! মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারুর কাছে নত হবে না। ছোটোগাজি ভিজে চোখে হাসলেন। অতিশয় উজ্জ্বল হাসি। এবার হাসতে-হাসতে বললাম, কমবখত্ত জিনের তামাসা! শিগগির যান, টুপিটি সড়কের ওধারে ছুঁড়ে দেখুন। ফেলে দিয়ে গেছে। ছোটোগাজি, তখনই হন্তদন্ত এবাদতখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। টুপিটির তল্লাসে উনি মাদ্রাসার একদল তালেবুল এলেমকে (ছাত্র) ডেকে নিয়ে যান। হ্যাঁ, টুপিটি পাওয়া গিয়েছিল। একটি কাঁটাঝোপে আটকে ছিল সেটি। যাই হোক, জালালুদ্দিনকে অতিশয় স্নেহের কারণ আমি বৈ এক আল্লাহ জানেন। আর কেউ জানে না। যদি সেদিন মির্জা গালিবের শাইরি কেতাবখানি আমার হাতে না আসত, সাইদার সঙ্গে হয়তো এ জিন্দেগিতে আর মিলন হত না। আজ জালালুদ্দিন আরেকখানি কেতাব দিয়ে গিয়েছিল। এখানি ফারসি কেতাব। চুন য়কি বাশ হমি….. বুকের ভেতর দরিয়ার ঢেউ উঠল। কী আশ্চর্য কথা লেখা আছে? ‘যদি শুধু এক থাকে। যদি না থাকে দুই। আমার ওপর সেই একের ঢেউ যদি আছড়ে পড়ে। তাহলে আর কথা কিসের। এবার সবই তুমি হয়ে গেছ। আমিও হয়ে গেছি তুমি।…’ মারহাবা! মারহাবা! ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে পূর্বের নিচু পাঁচিলের দরওয়াজা খুলে জঙ্গলে ঢুকলাম। তন্ময় আচ্ছন্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, আশেপাশে একটি কাঠবিল্লি ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে, পুকুরের কিনারায় ঘন কালকাসুলে ঝোপে হলুদ ফুলের ওপর শাদা ছোটো-ছোটো একঝাক প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, মনে খালি ওই বয়েৎ চুন য়কি বাশ হমি…..’ সেইসময় শুকনো পাতার আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখি, কালো বোরখাপরা এক আওরত। দেখামাত্র চিনতে পেরে খুশি ও বিস্ময়ে বলে উঠলাম, সাইদা! সাইদা আস্তে বলল, শফির খত এসেছে। ডাকের পিওন দিয়ে গেল। সে একখানি পোস্টকার্ড বোরখার ভেতর থেকে বের করে দিল। লক্ষ করলাম সে কাঁপছে। দ্রুত খতখানি পড়লাম। বাঙ্গালায় লেখা? “মা, অদ্য রাত্রে আপনাকে স্বপ্নে দেখিয়া চিত্ত এতই চঞ্চল হইল যে ইচ্ছা করিল, এতদ্দঙে ছুটিয়া যাই। কিন্তু আমার এক্ষণে যাওয়ার উপায় নাই। যে কর্মচক্রে আবদ্ধ রহিয়াছি, তাহা হইতে কিয়ৎক্ষণ দূরে সরিলে প্রভূত ক্ষতি হইবেক। শুধু জানিয়া রাখুন, আমি জীবিত রহিয়াছি। কোনও একদিবস ফুরসত পাইলেই ঝড়বৃষ্টিপাত হউক কিম্বা মহাপ্রলয় ঘটুক, গিয়া চরণদর্শন করিব। অধম সন্তানকে মার্জনা করিবেন। সহস্র ২ প্রণামান্তে–শফিউজ্জামান।” খতখানি পড়েই বললাম, এই খত তুমি পড়েছ? সাইদা কেঁদে ফেলল। তখন ভর্ৎসনা করে বললাম, ছিঃ সাইদা! শফিকে মুর্দা গণ্য করবে। সে হিন্দু হয়ে গেছে। সে খতে কোনো ঠিকানা দেয়নি। কিন্তু আমি জানি সে কোথায় আছে। সাইদা আত্মসংবরণ করে বলল, আপনি। জানেন? বললাম, জানি। কিন্তু তোমার দেলে বাজবে বলে বলি নাই। নুরপুরে থাকার সময় সম্বাদ পাই, সে বেহ্মপুর নামে এক নয়া আবাদে আছে। সম্বাদদাতা আমার হুকুম চেয়েছিল, জবরদস্তি শফিকে সেখান থেকে তুলে আনবে। আমি তাকে বলি, এ খবর ঝুট। সে অন্য কেউ হবে। আমার শফিউজ্জামান দেওবন্দে আছে। সাইদা কান্নাজড়ানো স্বরে বলল, কেন আপনি ওকে ধরে আনতে হুকুম দেননি? বললাম, সাইদা! তুমি বুঝতে পারছ না, তাতে আমার নামে হানাফিরা কেচ্ছা কেলেঙ্কারি রটনার মওকা পেত। সাইদা রুষ্টভাবে বলল, কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির বাকি তো রাখেননি কিছু? শুধু শফির বেলায়– সে কথা শেষ না করে দ্রুত চলে গেল। দেখলাম, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দক্ষিণে ঘুরে সে সড়কে উঠল। সড়কের ধারে বটতলায় আয়মনি গায়ে চাদর জড়িয়ে (আজলাফ আওরতদের ওটাই পরদা) দাঁড়িয়ে আছে। দুই আওরত সড়ক পেরিয়ে চলে গেলে পোস্টকার্ডটি আবার পড়তে থাকলাম। তারপর আমিও আত্মসম্বরণ করতে পারলাম না। এবাদতখানায় ঢুকে দরওয়াজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ ক্রন্দন করলাম! মনে-মনে বললাম, হায় রে, কানাঘোড়ার সওয়ার! আর আল্লাহ ছাড়া তোকে বাঁচানোর শক্তি কারুর নেই! আসরের বৈকালিক) নামাজের জন্য ঘাটে অজু করতে গেছি, সেই সময় দুখু এসে সম্ভাষণ করে মৃদুস্বরে বলল, হুজুর! বিবিসাহের হুকুম হয়েছে, হুজুরের কাছে একখানা খত আছে, নিয়ে এসো!, খতখানি আমার কলিজায় বিধে ছিল। দুখুর হাতে তা ফেরত দিয়ে অজু করতে গেলাম। পানির ধারে দাঁড়াতেই উলটো দুনিয়াটি চোখে পড়ল। অমনি মনে হল, আমার ঔরসে ওই উলটো দুনিয়ার এক উলটো মানুষ জন্মেছিল!…..
‘Celui qui prodigua
Les lions aux ravins du Jabel Kronnega,
Les perles a la mer et les astres a l’omber
Peut bien donner un peu de joie
a l’homme sombre.’
–Hugo.
এক বিকেলে ব্রাহ্মণী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই পিরের সাঁকোব চিহ্নমাত্র। নেই। আচানক বুক হু-হুঁ করে উঠল। মনে হল, অতর্কিত শূন্যতার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। কোথাও কিছু নেই, শুধু শূন্যতা। তারপর মনে হল, থামগুলি দেখতে পাচ্ছি। সিঁদুরের উজ্জ্বলতা থামগুলিকে নিটোল, মসৃণ, কোমল করে তুলতে-তুলতে এক নাঙ্গা আওরত তওবা! নাউজুবিল্লাহ! শয়তানের জাদু। তবে এতখানি না করলেই পারতাম। সূর্য দিগন্তে লাল চাকার মতো আটকে আছে। একফালি ঝিরঝিরে স্রোত বালির চড়ায় এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি পাখি নাচের ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। আকাশে শনশন শব্দে বুনো হাঁসের ঝাক চলেছে উলুশরাব দিকে। আঁকটির গতিপথ লক্ষ করতে পিছু ফিরলে দেখলাম তিনজন লোক আসছে। চিনতে পারলাম। বড়োগাজি, জালালুদ্দিন, আর একজন কেউ। কাছে এলে চিনলাম, নুবপুরে সেই উকিল দিদারুল আলম। কী ব্যাপার? সম্ভাষণের পর বড়োগাজি বললেন, হজরতে। আলা! জরুরি কারণে আপনাকে বিরক্ত করলাম। দিদারুল এখনই ফিরে যাবে। আপনাকে বলেছিলাম ‘তবলিগ-উল-ইসলাম সমিতি’র কথা। দিদারুলের ইচ্ছা, জেলাসমিতির সভাপতি আপনি হোন। দিদারুল একটি ছাপানো বাঙলা ইস্তাহার দিল। দিয়ে বলল, হজরত! এখানেই আমরা বরং মগরেবের নামাজ পড়ে নিই। এবাদতখানায় গিয়ে দস্তখত আর মোহরের ছাপ দেবেন। ইস্তাহারে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, কাজটি মহৎ। নামাজের ওয়াক্ত হয়েছিল। নদীর পানিতে অজু করে বালির শুকনো চড়ায় ছড়িটি সামনে পুঁতে আমরা নামাজ পড়লাম। এও আল্লাহের মহিমা! এরা না এলে শয়তানের জাদু আমাকে বিপন্ন করত। ফিরে যাওয়ার সময় দিদারুল অনর্গল কথা বলছিল।….হজরত! যে ইউরোপীয় মনীষীদের জোরে হিন্দুরা নিজেদের ধর্মের নতুন-নতুন ব্যাখ্যা করছে, তাঁদেব জোরে আমরাও ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা করতে পারি। আপনি জানেন হজরতে আলা? মনীষী হিউগো রসুলুল্লাহ (সাঃ)। সম্পর্কে কাব্য রচনা করেছেন! ইস্তাহারে সেইসব উদ্ধৃতি দিয়েছি। হিউগো পয়গম্বরের উক্তি ব্যাখ্যা করে লিখেছেন? জেবেল (আরবি শব্দ, অর্থ : পর্বত) ক্রোনেগার গিরিখাতে সিংহেরা যাঁর কৃপায় অবাধে বিচরণ করে, সমুদ্রে মুক্তা এবং মহাকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ ব্যাপ্ত থাকে, বিষাদগ্রস্তকে তিনিই কিয়ৎপরিমাণে আনন্দদান করতে পারেন। আরেক মনীষী গ্যেটে প্রশংসা করে লিখেছেন–বড়োগাজি সম্ভবত আমাকে জ্ঞান দেওয়ায় অপমানিত বোধ করব ভেবেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দিদারুল! হুজুরের অজানা কিছু নেই। দিদারুল জিভ কেটে বলল, জি হ্যাঁ। মাফ করবেন হজরত!…আমি অন্যমনস্ক। আমার বুকের ভেতর তখন গিরিখাতের সিংহেরা গর্জন অথবা হাহাকার করছে– যত দূরে সরে যাচ্ছি ব্রাহ্মণী নদী থেকে,
তত ওই গর্জন অথবা হাহাকার। যত সরে চলেছি তত পিছনে সমুদ্রের তলায়। ঝলমল মুক্তার মতো স্মৃতি, আর আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জে পিঙ্গলচক্ষু এক নাঙ্গা আউরত আমার দিকে তাকিয়ে আছে।…..