১৬. বেদা’য়াতে সাইয়্যেয়া

বেদা’য়াতে সাইয়্যেয়া

মেজবউবিবি দিলরুখ ওরফে রুকু বেগমের গর্ভজাত শিশুটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন সাইদা বেগম। তাঁর বুজুর্গ স্বামী এই শিশুর জন্মের সময় ইসলামি কানুন অনুসারে তার দুই কানে আজান দিতে আসেননি, অথচ সাতদিন পরে খত্না (circumcision) এবং আকিকা (নামকরণ) অনুষ্ঠানে তাঁর খিদমতগার আলি বখশ মারফত একটুকরো কাগজ পাঠান। ওতে বাঙলায় বড়ো-বড়ো হরফে কামরুজ্জামান শব্দটি লেখা ছিল। সাইদা কাগজটি পড়েই ছিঁড়ে ফেলেন। দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বলেন, আয়মনি, আলি বখশকে বলে দাও, বাচ্চার নাম রাখা হয়েছে রফিকুজ্জামান। আলি বখশ বিবিসাহেবার উদ্দেশে সালাম জানিয়ে এবাদতখানায় ফিরে যায়। আর আয়মনি পা ছড়িয়ে বসে শিশুটিকে তেল-হলুদ মাখাতে-মাখাতে সুর ধরে বলতে থাকে, ‘সোনামানিক রফি রে। বড়ো কবে হবি রে। চাচা ছুঁড়তে যাবি রে। রফির চাচা শফি রে…’ গ্রাম্য মেয়েদের এই রীতি প্রথাসিদ্ধ। তারা অনর্গল অনুরুপ বাক্যনির্মাণে পটু। এভাবেই গ্রাম্য ছড়াগুলি অসম্বদ্ধতা থেকে বিমূর্ত সম্বদ্ধতায় উত্তীর্ণ হয়। আয়মনি শিশুটিকে কেন্দ্র করে ছড়া গেয়ে-গেয়ে একটি শিল্পবৃত্ত গড়ে তুলত, যার মধ্যে এক বন্ধ্যা স্বামী ত্যাগিনী ও সাহসিকার জোরালো স্নেহ ছিল, হৃদয়-নিঃসৃত কোমলতা ছিল। আয়মনি শিশুটিকে পেয়ে আত্মভোলা। কিন্তু সাইদা বেগম সবসময় পরীক্ষা করে দেখতেন, শিশুটির মধ্যে তার প্রতিবন্ধী জনকের কোনো বৈলক্ষণ্য আছে কি-না। মনিরুজ্জামানের শৈশবকে মিলিয়ে দেখতেন সাইদা। অবশেষে নিঃসংশয় হন, শিশুটির মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক স্বাভাবিকতা আছে। এরপর থেকে আত্মঘাতিনী বেহান দরিয়াবানুর স্মৃতিকথায় তিনি তাঁর সংসার জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলতে থাকেন। রুকু বিব্রত বোধ করত। মায়ের স্মৃতি তার অসহ্য ছিল। সাইদা কান্নাজড়ানো স্বরে বলতেন, বেহানসাহেবার জন্য হাশরের ময়দানে দাঁড়িয়ে খোদাকে বলব, আমার আদ্ধেক নেকির (পুণ্য) বদলে ওকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও! সাইদা একথা বলতেন এবং আন্তরিক এই প্রতিশ্রুতির কারণ, আত্মঘাতীদের জন্য সুনিশ্চিত দোজখ। রুকুও নামাজ ও কোরানপাঠের পর মনে-মনে তার আত্মঘাতিনী মায়ের জন্য নিজের পুণ্যের অর্ধাংশ দান করতে চাইত। শিশুটিব প্রতি তার যেন কিছু উদাসীনতা ছিল। শাশুড়ি বা আয়মনি তাড়া না দিলে ক্রন্দনরত রফিকে সে বুকের দুধ খাওয়াতে চাইত না। সাইদা ভাবতেন, মেজবউবিবির বালিকাদশাই এর কারণ। তাঁর জীবনেও এমন ঘটেছিল। শাশুড়ি কামরুন্নিসা বেগমই তাঁর তিনপুত্রকে লালনপালন করেছিলেন। আয়মনি বলত, ত্রিমে-ত্রিমে সব জানবে গো! এই সেদিন ন্যাংটো মেয়ে দেখেছি দুই বহিনকে। এখন দেখছি বেটার মা। শিশুটির বয়স ছ মাস হলে সাইদা আর আয়মনি একটি গোপনীয় কাজ করেন। গভীর রাত্রে শিশুর মঙ্গলকামনায় পরিত্যক্ত খোঁড়া পিরের মাজারে সিন্নি দিতে যান। শিশুটিকে নিয়েই যান। তার শরীরে ঘুমন্ত অবস্থায় মাজারের ধুলো মাখিয়ে দেন। গোপনীয়তার কারণ, টের পেলে ফরাজি মৌলাহাটে ছিছিকার পড়ে যাবে! ওঁরা ফিরে না আসা পর্যন্ত রুকু খিড়কির দরজায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু গ্রামজীবনে কোনকিছু গোপন থাকে না, এটাই আশ্চর্য! গ্রাম প্রকৃতির করায়ত্ত এবং প্রকৃতি সহস্রনোচন সত্তা– এ ছাড়া পরবর্তী ঘটনার ব্যাখ্যা মেলে না। কীভাবে রটে যায়, ফরাজি ধর্মগুরুর বিবিসাহেবা প্রাচীন যুগের এক সুফি পিরের দরগায় সিন্নি দিয়েছেন। প্রত্যূষে নতুন মাটির মালসায় রাখা কিছু বাতাসা, খই এবং মাটির ঘোড়া (আয়মনির ঘরে প্রাক-ফরাজি আমলের এই খুদে ঘোড়াগুলি ছিল) অনেকের চোখে পড়ে। হই-চই শুরু হয়ে যায়। হুজুরের কাছে খবর যায়। পরবর্তী জুম্মাবারে হুজুর বহুদিন পরে মসজিদে গমন করেন। এদেশের মসজিদ পূর্বমুখী। পশ্চিমদেয়ালের মাঝখানে একটি ত্রিকোণ কোটরসদৃশ খিলান থাকে, যার উৰ্বাংশ ফুলের পাপড়ির মতো। কোটরে কাঠের একটি মিম্বার (বেদি) থাকে, যার তিনটি ছোট্ট ধাপ আছে। ফরজ (আবশ্যিক) নমাজের পর নমাজ, পরিচালক ইম (যিনি খতিব নামেও অভিহিত হন এবং এই কাজটি যে-কোননা ইমানদার মুসলিমই করার অধিকারী) ওই সিমবারে বসে ধাপে পা রেখে ‘খোবা’ (শাস্ত্রীয় ভাষণ) পাঠ এবং শাস্ত্র ব্যাখ্যা করেন। তো সেই জুম্মাবারে হুজুর বদিউজ্জামান স্বয়ং খোবা-পাঠের সময় কেতাবটি হঠাৎ বন্ধ রেখে আগেকার বজ্রগর্ভ কণ্ঠস্বরে বলে ওঠেন, মোনাফেক (ভ্রান্ত মুসলিম– যোগরূঢ়ার্থে) কলঙ্ক-রটনাকারীদের প্রতি আল্লাহের লানৎ(অভিশাপ)! যারা যা দেখেছে, তারা শয়তানেরই কারবার দেখেছে। শয়তান আউরতের চেহারা ধরতে পারে। শয়তানের সাগরেদ কালা জিনেদের ডেরা ওই খোঁড়া পিরের মাজার। নাউজুবিল্লাহ! ওই পিরেরা নিজেদের সুফি নামে জাহির করত। ওরা ছিল ভঙ। ওদের একজন মনসুর হাল্লাজ বলত, ‘আনাল হক! আমিই খোদা। তওবা নাউজুবিল্লাহ! হুজুরের এই বাণী উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে সারা মসজিদ, মসজিদ থেকে প্রাঙ্গণ, প্রাঙ্গণ থেকে সড়ক পর্যন্ত প্রচণ্ড প্রতিধ্বনি ওঠে, তওবা নাউজুবিল্লাহ! আর সেই জুম্মাবারে নামাজের পর ফরাজি মুসলিমরা কোদাল আর গাঁইতি হাতে ছুটে যায়। খোঁড়া পিরের মাজারটি ব্রাহ্মণী নদীর পিরের সাঁকোর মতোই ধ্বংস করা হয়। এমনকি কাঠ-মল্লিকার পুষ্পবতী গাছটিও টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। শুধু বটগাছটি তার বিশালতাহেতু অক্ষত থাকে। কথিত আছে, ওই জুম্মাবারে মানুষের চেহারায় বিস্তর শাদা জিনও উপস্থিত ছিল। অদূরে অবস্থিত হানাফিগ্রাম অছিপুরের লোকেরা যদি বাধা দিতে আসত, শাদা জিনেরা তাদের আসমানে ছুঁড়ে মারত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ঘটনার পর আরেকটি ঘটনা ঘটে, যা আরও বিধ্বংসী শুধু নয়, অকল্পনীয়ও বটে! তবে প্রাসঙ্গিক একটি ক্ষুদ্র তথ্য আছে। খোঁড়া পিরের মাজার ধ্বংসের দিন সন্ধ্যার পরে হুজরের পবিত্র হাতে লেখা এক টুকরো পবিত্র কাগজ আলি বখশ দিয়ে যায় সাইদাকে আয়মনি সেটি সাইদাকে দিলে তিনি ছুঁড়ে ফেলেন। বউবিবি রুকু বেগম সেটি কুড়িয়ে নেয়। ওতে লেখা ছিলঃ “বেদা’যাতে সাইয়্যেয়া অতিশয় গোনাহের কাজ। সেই কাজগুলি হইল : কবরে সিন্নি মানত, কবরে নামাজ পাঠ, মাজার অথবা দরগাহ নির্মাণ। আমার ইন্তেকাল হইলে যেন এইগুলি না ঘটে।”…

হাফিজ ইন খির্কা কি দারি তু বিবিনি ফরদা
কি চি জুয়ার জে জের-অশ ব জফা বিকুশায়েদ

পুকুরের বাঁধাঘাটে বসে ছোটোগাজির কেতাবখানি পড়ছিলাম। ‘দিওয়ানে হাফিজ’ আমাকে চিন্তারূপী শয়তানের হাত থেকে মাঝে-মাঝে রক্ষা করে। আজ দিনভর উপদ্রব গেছে। উপদ্রবই বলা উচিত। বড়োগাজির সঙ্গে একজন অদ্ভুত প্রকৃতির লোক এসেছিলেন। বড়োগাজি তাঁর পরিচয় দিলেন মৌলবি আফতাবুদ্দিন আহমদ বলে। মৌলবি লোকটি নাকি এতখানি জানেন, যা তামাম হিন্দুস্তানে কোনো ব্রাহ্মণপণ্ডিতও জানেন না। আমি বললাম, মারহাবা! আংরেজি শিখে নাসারা। আংরেজকে বরবাদ করতে হবে। তেমনি বুত-পরস্ত (পৌত্তলিক) এলেম শিখে হিন্দুদের ভুল ঘোচাতে হবে। আফতাবুদ্দিনকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। বললেন, জনাবে হজরত! খ্রীস্টানদের মতোই হিন্দুরা পথভ্রষ্ট। বুত-পরস্তি অনার্যদের ধর্ম। প্রকৃত হিন্দুধর্ম আর্যধর্ম। সেই ধর্মের কেতাবের নাম বেদ। বেদে বলা হয়েছে, পরম স্রষ্টা নিরাকার। তিনি একজন মাত্র, ইসলামের মূলতত্ত্বের সঙ্গে বৈদিক মূলতত্ত্বের এতটুকু ফারাক নেই। উপনিষদ নামে কেতাব আছে। তা বেদের ব্যাখ্যা। তাই এগলানকে বেদাঙ্গ বলা হয়। আপনি কি রাজা রামমোহন রায়ের নাম শুনেছেন? তিনি ইসলামি এলেমে সু-পণ্ডিত ছিলেন। বড়োগাজি তাঁর কথার মধ্যে বলে উঠলেন, রাজা ব্রাহ্মধর্ম নামে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করে গেছেন। ব্রাহ্মদের সঙ্গে মুসলমানদের বহু বিষয়ে মিল আছে। এই সময় আমি বললাম, দেখুন মৌলবিসাহেব! আল্লাহ পাক মনুষ্যগণের পথ-প্রদর্শনের জন্য এক লক্ষ সত্তর হাজার পয়গম্বর পাঠিয়েছেন দুনিয়ায়। শেষ পয়গম্বর হজরত মোহম্মদ (সাঃ)। আর দেখুন, ঐশী কেতাবের সংখ্যা মাত্র চার। তওরাত, জবুর, ইঞ্জিল এবং ফুরকান (কোরান)। এগুলানকে আহলে কেতাব বলা হয়। আপনার বেদ কখনও আহলে কেতাব নয়। আফতাবুদ্দিন বললেন, হুজুরে আলা! আপনি সুবিজ্ঞ আলেম। আপনি কি মনে করেন, হিন্দুস্তানের কোটি-কোটি লোকের জন্য আল্লাহ, কোনো পয়গম্বর পাঠাননি। এবং কোনো ঐশী কেতাব অবতীর্ণ হয়নি? ধূর্ত ও আমুদে বড়োগাজি মুখ টিপে হেসে বললেন, ভাববার কথা। এরপর আফতাবুদ্দিন হিন্দুদের মতো বিস্তর সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে তার অর্থ বুঝিয়ে দিলেন। আমি বললাম, মৌলবিসাহেব, আপনি মুসলমান না ব্রাহ্ম? আফতাবুদ্দিন ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবে বললেন, দুনিয়ায় আল্লাহের ধর্ম একটাই। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বিভিন্ন নাম। হিন্দুস্তানে তাঁর নাম ব্ৰহ্ম। আরবে তাঁর নাম আল্লাহ। তাই আমি নামাজ পড়ি, আবার ব্রহ্মোপাসনাতেও যোগ দিই। বড়োগাজি বললেন, নুরপুরে তল্লাটে এক জমিদার নয়া আবাদ পত্তন করেছেন। তিনি ব্রাহ্ম। সেই আবাদে ব্রাহ্মদের বড়োঘাঁটি। আফতাব সাহেবের বাড়ি নুরপুরে। আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে রূঢ় স্বরে বললাম, আপনি ব্রাহ্ম না মুসলমান? আফতাবুদ্দিন একই ভাবে জবাব দিলেন, যিনি আল্লাহ তিনিই ব্রহ্ম। আরও রূঢ় স্বরে বললাম, আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন? আফাতাবুদ্দিন বিব্রতভাবে বললেন, হিন্দুস্তানের বর্তমান অবস্থায় ব্রাহ্ম ও মুসলমানদের ঐক্য প্রয়োজন। ব্রাহ্ম হিন্দুরা মুসলমানদের বেরাদর (ভাই) বলে জানেন। আপনাকে জানানো উচিত, ব্রাহ্ম পণ্ডিতদের কেউ-কেউ পাক হাদিস কেতাবগুলান বাঙলায় অনুবাদ করছেন। পাক কোরানও অনুবাদ করার প্রস্তাব আছে। মাঝে-মাঝে কলিকাতা গিয়ে সেই কাজে আমি তাদের সাহায্য করি। আমার ইচ্ছা, হিন্দুরাও জানুক ইসলাম কী। আমি বড়োগাজির দিকে চোখ রেখে বললাম, এই কাজের জন্য মুসলমানের হিন্দু হওয়ার দরকার নেই। গাজিসাহেব! আপনার এই দোস্ত (বন্ধু) শয়তানের পাল্লায় পড়েছেন। এঁকে এখনই আমার এবাদতখানা থেকে নিয়ে যান। বড়োগাজি তৎক্ষণাৎ ‘মৌলবি’ খেতাবধারী লোকটিকে ইশারায় উঠতে বললেন। দুজনে বেরিয়ে গেলে আমি প্রাঙ্গণে নেমে পায়চারি করতে থাকলাম। বহু বছর আগে ঠিক এভাবে একজন আংরেজ পাদ্রি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনিও বোঝাতে চেয়েছিলনে, খ্রীস্টান আর মুসলমান বেরাদর! দুনিয়ায শয়তান কত চেহারায় ঘুরে বেড়োচ্ছ! বিকেল পর্যন্ত আমার অস্থিরতা ঘুচল না। আশঙ্কা হচ্ছিল, বড়োগাজি শয়তানের পাল্লায় পড়লেন কি না! পুকুরঘাটে বসে “দিওয়ানে হাফিজ’ কেতাবের পাতা ওলটাচ্ছি, সেই সময় চোখে পড়ল এই বয়েতটি : হাফিজ ইন খির্কা কি দারি তু বিবিনি ফরদা/কি চি জুন্নার জে জের-অহ্ ব জফা বিকুশায়েদ…’তওবা, তওবা! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।

হাফিজের এই পোশাক যদি টেনে খুলে ফেল/
দেখবে তার তলায় আহে যজ্ঞোপবীত…

ভাবলাম, দিনশেষে শয়তান এই সুন্দর কেতাবের হরফ বদলে দিয়ে জঙ্গলের কালো ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাসছে। দ্রুত পাতা উলটে শেষদিকের একটি বয়েতে চোখ রাখলাম।

হর হল্‌কা এমঘান্‌ আম্‌ আন্‌ পিসর্‌ চে খোস্‌ গুফ্‌ত্‌
ব কাফিরা কে কার অত গর বুত না মি পরভি…

তওবা, তওবা! এতদিন এ কোন কেতাব পড়ে তারিফ করে আসছি? কামিজের তলায় কুৎসিত ক্ষতচিহ্ন বেরিয়ে পড়ল এবার। এই হাফিজ লোকটি নিশ্চয় সুফি. ছিল। সুফিরা মুসলমান-ভেকধারী মোনাফেক!

অগ্নিপূজক মধদের মজলিশে ওই বালক/
কী চমৎকার কথা বলে উঠল/
‘যদি না শিখতে পারলে মূর্তিপূজা/
কাফেরদের সংস্পর্শে এসে কী লাভ হল বলো’…

কেতাবখানি পুকুরের পানিতে ছুঁড়ে ফেললাম। ইচ্ছে করল, এ মুহূর্তে ছোটোগাজি সামনে থাকলে ওই নাদানকে চল্লিশ পয়জার মারতাম। আলি বখশ সবসময় আমার দিকে নজর রাখে। সে দৌড়ে এসে পাংশু মুখে শুধু বলল, হজবত! বললাম, কিছু নয়। সে অবাক, ভীত চোখে পানির দিকে তাকিয়ে ছিল। ছড়িটি তুলে বললাম, অ্যাই কমবখত! এখানে কিছু দেখার নেই। ভাগো! সে মুখ নীচু করে চলে গেল। একটু পরে ওকে বলব, কালা জিনের মুখে কেতাব ছুঁড়ে মেরেছি। তাহলে ও খুবই খুশি হবে। আসলে মানুষের এই স্বভাব, চারপাশের সবকিছুতে অলৌকিককে টুড়তে চায়। মোজেজা অন্বেষণ করে। ওরা ভাবে, এই মাটির দুনিয়াই কি সব? ঠিকই তো, মাটির দুনিয়া নিশ্চয় সব নয়। পানির তলার ওই প্রতিবিম্বের মতো অনেক কিছু আছে। তা জানার জন্য ইলম (পজ্ঞা) অর্জন করা চাই। কিছুক্ষণ পরে আলি বখশ ফের এসে বলল, আনিসুর সর্দার, আরও জনাকতক হুজুরে আলার সঙ্গে করতে এসেছেন। ভাবলাম, এই অস্থিরতা ঘোচানোর জন্য কিছু হালকা গল্পগুজব করা দরকার। ওদের কাজ যত জরুরি হোক, আমি পাত্তা দেব না। বললাম, ওঁদের এখানে নিয়ে এসো। মৌলাহাট জামাতের মুরুব্বি লোকগুলি সম্ভাষণ করতে করতে ঘাটে এলেন। ওঁদের বসতে বললাম। বিপরীত দিকের চত্বরে ওঁরা বসলেন। তারপর আনিসুর কিছু বলতে মুখ খুলেছেন, আচানক সড়কের দিক থেকে বাঁশির সুর ভেসে এল। সঙ্গে-সঙ্গে দুই কানে আঙুল গুঁজে বললাম, কে ওই শয়তান আমার চল্লিশ দিনের বন্দেগি (তপজপ) বরবাদ করল? ওকে জলদি পাকড়াও …

.

নুসাইবা নামে এক নারী

দিলরুখ বেগম কচি, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি রে?

কচি ॥ না, না, না! বলল না, শুনছি। রোজ বলি, অত হুঁ দিতে পারব না!

দি বেগম। শাশুড়িসাহেবার কাছে শুনেছি, পয়গম্বরের জমানায় আববে এক তেজী আউরত ছিলেন। তাঁর নাম ছিল নুসাইবা খাতুন। খোদা জিব্রাইল ফেরেশতার মারফত পাক কোরানের সুরা (অধ্যায়) পাঠিয়ে দিতেন। পয়গম্বর সেইগুলান মুখস্থ করতেন। পরে মজলিশে তা মোমিনদের শোনাতেন। তো একদিন নুসাইবা খাতুন রাগ করে পরগম্বর হুজুরকে বললেন, হজরত! খোদা কেন শুধু পুরুষ-মানুষদের। লক্ষ করে কথা বলেন? মেয়েরা কি মানুষ নয়? আদমের বাঁ পাজর থেকে আমাদের তিনি তৈয়ার করেছেন। তাহলে কেন খোদা আমাদের লক্ষ্য করে পয়গাম (বার্তা) পাঠাচ্ছেন না?

কচি। মার্ভেলাস! তারপর দাদিমা, তারপর?

দি বেগম ॥ শাশুডিসাহেবা বললেন, তারপর থেকে খোদার পয়গামে ‘মুসলিমান ওয়া মুসলিমাত’ কথা দুটো আসতে লাগল।

কচি ।। তার মানেটা কী বলবে?

দি বেগম ।। বুঝলি নে? পুরুষমানুষ আর মেয়েমানুষ দু’তরফকে লক্ষ করে খোদার পয়গাম এল। পাক কোরান পড়ে দেখিস। মর্দানা-আউরত খোদার কাছে সমান। কেউ ছোটো, কেউ বড়ো নয়।

কচি ।। হঠাৎ নুসাইবার কথা কেন, দাদিমা? রাখালছেলেটার কী হল?

দি বেগম ॥ ছেলেটার নাম ছিল ফজু। বাপ-মা কেউ ছিল না। আমাদের সংসারে কাজকাম দেখাশুনা করত দুখু। তারই ভাগ্নে। তখন বয়স বোধ করি নয়-দশ বছর হবে। আমাদের একটা বাঁজা গাইগরু ছিল। তার নাম মুন্নি। ভাসুরসাহেব কতবার এসে সাধাসাধি করতেন, কোরবানিতে মুন্নিকে হালাল করি। শাশুড়িসাহেবা চোখমুখ লাল করে ভাগিয়ে দিতেন। তো মুরিদরা (শিষ্যরা) একটা দুধেল গাই দিয়েছিল। তার নাম আমি কাজলি’ রেখেছিলাম। তার গায়ের রঙ ছিল কাজলা।

কচি ॥ আহা, রাখালছেলেটা–

দি বেগম ॥ বলছি তোআমাদের একটা ছাগলও ছিল। তার নাম ছিল কুলসুম। ফজু সেই মুন্নি, কাজলি আর কুলসুমকে চরাতে নিয়ে যেত। ছেলেটা ছিল ভারি রগুড়ে। শালিকপাখি পুষেছিল। তার জন্য বাঁশের খোলে করে নদীর ওপার থেকে ঘাসফড়িং ধরে নিয়ে আসত। আর ওই এক শখ বাঁশি বাজানো।

কচি ॥ এক মিনিট দাদিমা! রাখালছেলেরা বাঁশি বাজাবেই। কেন বলো তো?

দি বেগম ।। মাঠেঘাটে ঘোরে দিনমান। সময় কাটাতেই বোধ করি বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বেড়ায়।

কচি ।। দারুণ বলেছ! তবে আমার মনে হচ্ছে কী জান? প্রকৃতির মধ্যে গেলে মানুষ একা ফিল করে– লোনলি ফিলিংস! অথবা– প্রকৃতিতে সারাক্ষণ সুর বেজে চলেছে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পদ্যে পড়েছি। সেই সুরকে মানুষ, মানে রাখালছেলেটা, মানে তোমাদের ফজু বাঁশিতে নিতে চাইত। প্রতিধ্বনির মতো! Whose heart-strings are a lute!

দি বেগম ।। নিজেই বকবক করবি, নাকি গল্পটা শুনবি?

কচি ।। সরি! বলো, তারপর কী হল? তোমার বিক্রমশালী শশুর রাখাল বেচারাকে কুলগাছে বেঁধে জুতো মারছিলেন। শ্রদ্ধাভক্তি আর রইল না বাবা! ভ্যাট!

দি বেগম ।। উনি ফরাজি আলেম ছিলেন। মৌলাহাটে সে-জমানাও ছিল আলাদা। তো ফজুকে উনি এবাদতখানার উঠোনে কুলগাছে বেঁধে রেখেছেন। বাঁশিটা ভেঙে পুকুরের পানিতে ফেলেছেন। সেই খবর এল যখন, তখন শাশুড়িসাহেবা মগরেবের জন্য বদনায় পানি নিয়ে অজু (প্রক্ষালন) করতে যাচ্ছেন। আমি তোর আব্বাকে তোর দাদাজির কোলে দিয়ে বদনা হাতে নিয়েছি। হেন সময়ে দুখু কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ঢুকল। শাশুড়িসাহেবার হাত থেকে বদনা পড়ে গেল। শুধু পলকের জন্য দেখলাম, বেপরদা হয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

কচি ।। তারপর দাদিমা, তারপর?

দি বেগম ॥ তখনও দিনের আলো আছে। বাদশাহি সড়ক ধরে ছুটতে-ছুটতে–

কচি ।। ছুটতে-ছুটতে?

দি বেগম ॥ যারা দেখেছিল, তারা বলেছিল। তবে মরদলোকেরা ওঁকে তো কেউ চিনত না। উনি এবাদতখানায় ঢুকে কুলগাছ থেকে ফজুর বাঁধন খুলে দিলেন। ছেলেটা তখন আধমরা। মুখে খুন ঝরছে। কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘কত বড়ো বুজুর্গ হয়েছে, কত জিন পোষা আছে, দেখি। সাধ্যি থাকে তার জিনেরা আমার। কাছ থেকে কেড়ে নিক। এই বলে এবাদতখানা থেকে বেরিয়ে এলেন।

কচি ।।  অসাধারণ! বড়ো আম্মা, তোমার প্রতি হাজার-হাজার সালাম! তুমি নুসাইবার বাড়া!

দি বেগম। পরে এই নিয়ে হাজার কথা রটেছিল। তবে গাঁয়ের লোকেরা মনে মনে শাশুড়িসাহেবার ওপর খুশিই হয়েছিল ‘ শ্বশুরসাহেব এরপর সাতদিন এবাদতখানার ভেতর এত্তেকাফ’ নিয়েছিলেন। সাদিন পরে শুনলাম, উনি সফরে রওনা দিয়েছেন। আলি বখশ এবাদতখানার জিম্মাদার রইল। তাকে কালা জিনেরা এসে খুব জ্বালাত।

কচি ॥ কোথায় গেলেন উনি?

দি বেগম ॥ মাসতিনেক পরে খবব হয়েছিল, নুরপুরে আছেন।

কচি ।। ছোটোদাদাজি তখন ওই এরিয়ায় ছিলেন। দেখা হয়নি?

দি বেগম ॥ শুনেছি তিনক্রোশের ফারাক। তাই দেখা হয়নি। আর দেওরসাহেব আব্বাকে দেখা দেবেনই বা কেন? উনি তখন নাকি হিন্দু হয়েছেন। সত্যিমিথ্যে জানি নে, শুনেছি।…

.

হাম্মালাতুল হাতাব!

নুরপুর মৌলাহাট থেকে পনের ক্রোশ দূরে। কাজি গোলাম হোসেন ক-বছর আগে ফরাজি মজহাবভুক্ত হয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই মৌলাহাট এসে নুরপুর সফরের অনুরোধ করতেন। ‘মৌলবি’ খেতাবধারী আধামুসলমান আফতাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই মনে নুরপুর যাওয়ার খাহেস ছিল। পাঁচক্রোশ দূরে সাহাগঞ্জ থেকে কাজিসাহেবের কাছে আগাম খবর পাঠিয়েছিলেন। পরদিন মগরেবেব সময় দেখি, তেজী দুইটি ঘোড়ার টাঙ্গাগাড়ি হাজির। কাজি সাহেবও স্বয়ং হাজিব। মাঘমাস। রাস্তায় ঘন ধুলো। সকালে রোদ একটু চাঙ্গা হলে রওনা দিয়েছিলাম। সাহাগঞ্জের সড়কের দুধারে কাতারে-কাতারে মানুষ। তারা বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করে বিদায় জানাচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে বহু হিন্দুও ছিলেন। কৃষ্ণপুরের জমিদারকন্যার জিন ভাগানোর খবর জেলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। নুরপুর পৌঁছুতে বিকেল হল। দূর থেকে উঁচু স্তম্ভটি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, ওটি একটি রেশমকুঠি। কাজিসাহেবের কাছে শুনলাম, কমাস আগে ওই কুঠির আংরেজ মালিক খুন হয়েছে। বললাম, মাশাল্লাহ! শাবাশ! এই কাজ যে করেছে, তার জন্য বেহেশত বরাদ্দ। কাজিসাহেব বললেন, স্ট্যানলিসাহেব খুব জুলুমবাজ ছিল। এলাকার সকলেই ওর দুশমন। তাই পুলিশ খুনীদের পাত্তা পায়নি। তবে স্ট্যানলির গায়ে গুলির জখম থাকায় গবরমেন্টের সন্দেহ, একাজ ‘বন্দেমাতরমওয়ালাদের’। জিগ্যেস করলাম, তারা কারা? কাজিসাহেব যা বললেন, শুনে মনে হল, হিন্দুরা হিন্দুস্তানে বাদশাহি কায়েম করতে চায়। এটা ভালো লক্ষণ নয়। কথাপ্রসঙ্গে সেই মৌলবিটির খবর জিগ্যেস করলাম। কাজিসাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন, আফতাব আবার একটা মানুষ? শুনেছি সে এখন কলিকাতায় আছে। খবরের কাগজ ছাপবে। নুরপুরে টাঙ্গা পৌঁছুলে খুশি হয়ে দেখি, এখানেও কাতারে কাতারে তোক দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে। কাজিসাহেব বললেন, ইনশা আল্লাহ! নুরপুরেও একটি ফরাজি জামাত কায়েম হবে। এই নুরপুরে থাকার সময় একজন আংরেজিজানা যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার নাম দিদারুল আলম। সেই আমাকে ফরাজি মজহাবের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করত। একদিন সে আমার কাছে একখানি প্রকাণ্ড কেতাব হাতে হাজির হয়। বলে, হজরত! আপনি হাজি শরিয়তুল্লার কথা বলেছিলেন। এই বহিখানি পুরাতন একটি সম্বাদপত্রের সংকলন। আমার আব্বা সদর শহরে ওকালতি করতেন। সম্বাদপত্র এবং বহি সংগ্ৰহ তাঁর বাতিক ছিল। হঠাৎ এই বহিখানির একটি পৃষ্ঠা পড়ে আমার খুন টগবগ করছে। আপনি এই পৃষ্ঠাটি পড়ে বলুন, এ সম্বাদ সত্য না মিথ্যা। বিরাট কেতাবখানি খুলে দেখি বাঙলা হরফে ছাপা। পৃষ্ঠাটিতে চোখ রাখলাম। তারপর আমারও খুন টগবগ করে ফুটতে থাকল।

“শ্রীযুক্ত দর্পণ প্রকাশকমহাশয় বরাবরেষু।–সংপ্রতি জিলা নদীয়ার অন্তঃপাতি নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমির নামে এক জবন বাদশাহি লওনেচ্ছায় দলবদ্ধ হইয়া প্রথমত গোবরডাঙ্গানিবাসি বাবু কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ধনপ্রাণবিষয় এবং আর ২ হিন্দুরদিগের জাতি প্রাণ ধ্বংস করণে প্ৰবৰ্ত্ত হইলে তথাকার ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব এ বিষয় দাঙ্গা বোধ করিয়া ফৌজদারী নাজির মোহম্মদ পুলিসকে কএকজন চাপড়াশ সমেত নারিকেলবাড়িয়া পাঠাইয়াছিলেন। দুষ্ট জবনেরা নির্দয়তারূপে ঔ অভাগা পুলিস নাজিরকে বধ কবিলে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের রিপোর্টর্মতে কলিকাতা হইতে অশ্বারূঢ় ও পদাতিক সৈন্য প্রেরিত হইয়া তিতুমির জবন একাকালীন নিপাত হইল।”

মুখ তুলে বললাম, দিদারুল। তিতুমিরের কথা আমি জানি। মরহুম আব্বাসাহেবের কাছে তাঁর পাহলোয়ানির বিবরণ শুনেছি। তিনি শহিদ এবং বেহেশতে তাঁর স্থান সুনিশ্চিত। দিদারুল বলল, হজরত! পরের কথাগুলান পড়ুন। ওই পৃষ্ঠায় আবার নজর দিলাম। চমকে উঠলাম। আমার চোখ নিষ্পলক হয়ে রইল।

…ইদানিং জিলা ফরিদপুরের অন্তপাতি শিবচর থানার সরহদ্দে বাহাদুর গ্রামে সরিয়তুল্লা নামে এক জন বাদশাহি লওনেচ্ছুক হইয়া নূনাধিক ১২০০০ জোলা ও মোসলমান দলবদ্ধ করিয়া নূতন এক সরা জারী করিয়া নিজ মতাবলম্বি লোকদিগের মুখে দাড়ি কাছাখোলা কটিদেশে চৰ্ম্মের রঞ্জু ভৈল করিয়া তৎচতুর্দিগস্থ হিন্দুদিগের বাটী চড়াও হইয়া দেবদেবীপূজার প্রতি অশেষ প্রকার আঘাত জন্মাইতেছে এবং এই জিলা ঢাকার অন্তঃপাতি মালকতগঞ্জ থানার সরহদ্দে রাজনগরনিবাসি দেওয়ান মৃত্যুঞ্জয় রায়ের স্থাপিত দ্বাদশ শিবলিঙ্গ ভাঙ্গিয়া নদীতে বিসর্জন দিয়াছে এবং ঐ থানার সহচ্ছে পোড়াগাছা গ্রামে একজন ভদ্রলোকের বাটিতে রাত্রিযোগে চড়াও হইয়া সর্বস্ব হরণ করিয়া তাহার গৃহে অগ্নি দিয়া অবশিষ্ট যে ছিল ভস্মরাশি করিলে একজন জবন ধৃত হইয়া ঢাকার দাওয়ায় অর্পিত হইয়াছে।…আর শ্রুত হওয়া গেল দলভুক্ত দুষ্ট জনেরা ঐ ফরিদপুরের অন্তঃপাতি পাটকান্দা গ্রামের বাবু তারিণীচরণ মজুমদারের প্রতি নানাপ্রকার দৌরাত্ম্য অর্থাৎ তাঁহার বাটীতে দেবদেবীপূজার আঘাত জন্মাইয়া গোহত্যা ইত্যাদি কুকর্ম উপস্থিত করিলে মজুমদারবাবু জবনদিগের সহিত সম্মুখযুদ্ধ অনুচিত বোধ করিয়া ঐ সকল দৌরাত্ম্য ফরিদপুরের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের হুজুরে জ্ঞাপন করিলে ঐ সাহেব বিচারপূর্বক কয়েক জনকে কারারুদ্ধ করিয়াছেন এবং এবিষয়ের বিলক্ষণ অনুসন্ধান করিতেছেন।…আমি বোধ করি সরিতুল্লা জবন যে প্রকার দলবদ্ধ হইয়া উত্তর ২ প্রবল হইতেছে অল্পদিনের মধ্যে হিন্দুধর্ম লোপ হইয়া অকালে প্রলয় হইবেক। সরিতুন্নার জোটপাটের শত অংশের এক অংশ তীতুমির করিয়া ছিল না। …ইতি ১২৪৩ সাল তারিখ ২৪ চৈত্র। জিলা ঢাকানিবাসি দুঃখি পিগণস্য।

আমি চোখ তুলে দেখি দিদারুল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বলল, সমাচারদর্পণ পত্রিকার ইংরাজি ১৮৩৭ সালের ২২ এপ্রিল এই চিঠি ছাপা হয়েছিল। এ সম্পর্কে আপনার কী মত? আত্মসংবরণ করে বললাম, মরহুম আব্বার কাছে শুনেছি, হাজি শরিয়তুল্লা একজন জবরদস্ত আলেম ছিলেন। হিজরি ১২১৮ কী, ১২১৯ সনে দিল্লিতে ওহাবি আলেম আবদুল আজিজ ফতোয়া জারি করেন, নাসারাদের বিরুদ্ধে মুসলমানের জেহাদে নামতে হবে। সইদ আহমদ বেরিলভি তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। হিজরি ১২৭৪ সনে হিন্দুস্তানের তামাম হিন্দু-মুসলমান সিপাহী আংরেজশাহির সঙ্গে জেহাদ লড়েছিল। সেই জেহাদে ওহাবিরাও যোগ দিয়েছিলেন। হাজি শরিয়তুল্লা সেই রাহের (রাস্তার) রাহি। হিন্দুস্তানের মুসলমানকে বুত-পরস্তি পৌত্তলিকতা), শের্ক (ঈশ্বরের অংশীদারি), বেদায়েত (উন্মার্গগামিতা) থেকে বাঁচাতে এই আলেম জানকবুল করেছিলেন। এই খতের (চিঠির) বয়ান বিলকুল ঝুট! দিদারুল উত্তেজিতভাবে বলল, চিঠির বয়ানে স্পষ্ট, শরিয়তুল্লা শুধু হিন্দু বড়োলোক জমিদারদের জুলুম থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সুবে বাঙলায় মুসলমানের অবস্থা চিন্তা করুন হজরত! তারা গরিব হয়ে পড়েছে দিনে-দিনে। হিন্দুরা ইংরেজি শিখে ইংরেজের ধূর্ত বুদ্ধি অর্জন করেছে। তারা মুসলমানদের পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নিচ্ছে। আরও দেখুন হজরত, পলাশীর যুদ্ধে শুধু মিরজাফর বেইমানি করেনি একা। জগৎশেঠ, আমিরাদ, রাজবল্লভ রায়দুর্লভ, মানিকচাঁদ, নন্দকুমাররাও বেইমানি করেছিল। ১৮৫৭ সনের সিপাহি বিদ্রোহে যখন সারা হিন্দুস্তানে হিন্দু-মুসলমান এককাট্টা হয়ে লড়েছে, তখন বাঙলার ইংরেজিশিক্ষিত হিন্দু ইংরেজের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আমার কলেজজীবনের হিন্দু-বন্ধুদের কেউ-কেউ তামাসা করে বলে, তোমরা সাতশো বছর আমাদের জুলুম করেছ। আমরা তা ভুলতে পারব না। আমি ওদের বলি, ওটা ইংরেজের শেখানো কথা। রাজাবাদশাহরা প্রজার ওপর জুলুম করতেই পারে। এর কোনো হিন্দু-মুসলমান নেই। কিন্তু সত্যিই যদি তাই হত, যদি তোমাদের ধর্ম ধ্বংস করত মুসলমানরা, তোমাদের মন্দির চুরমার করত, তাহলে হিন্দুস্তানে এত প্রাচীন মন্দির থাকত না। এত হিন্দু থাকত না। ইংরেজের ইতিহাস পড়ে তোমরা বল, এই জেলায় মুর্শিদকুলি খাঁ হিন্দু মন্দির ভেঙেছিলেন। চলো, তোমাদের দেখিয়ে দিই, তাঁর আমলের কত মন্দির কাটরা হয়ে পড়েছিলাম। আচানক সামনেকার জঙ্গল থেকে একটি আউরত মাথায় লকড়ির পাঁজা নিয়ে বেরুল এবং আমার চোখে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সবিস্ময়ে দেখলাম, এতো সেই আবদুল কুঠোর বিবি– ‘হাম্মালাতুল হাতাব’। আমি হো হো করে হেসে ফেললাম! অমনি ইকরাতন লকড়ি নামিয়ে রেখে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরল। বিব্রত হয়ে বললাম, ছাড় ছাড়! এ কী করছিস তুই– নাদান বেশরম লড়কি! ইকরাতন কান্নাজড়ানো গলায় গলায় বলল, হুজুর! আমাকে মাফ করুন। আমি আপনার কথা মানিনি। আপনি আমার জান বাঁচিয়েছিলেন। বললাম, তুই তো ছোটোগজির বাড়ি ভালোই থাকতিস! আলি বখশকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে গিয়েছিলি কেন? ইকরাতন উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে মুখ নামিয়ে বলল, বড়োগাজির ভয়ে। সে লোক ভালো নয়। আর হুজুর, আলি বখশ আমার হাত ধরেছিল। খাপ্পা হয়ে বললাম, ঝুট বলিস না! আলি বখশ পরহেজগার (ধার্মিক) লোক। ইকরাতন আবার কেঁদে উঠল, আল্লার কসম, হুজুর! বললাম, তুই এখানে কোথায় আছিস? নিকাহ করেছিস কি? সে মাথা নেড়ে আস্তে বলল, আমার সোয়ামির বহিনের বাড়িতে আছি! তারও সোয়ামি নেই। ধান ভেনে। খায়! আমিও ধান ভানি তার সঙ্গে। খুব ভালো মেয়ে! মায়ের পেটের বহিনের মতন জানে আমাকে। হাসতে-হাসতে বললাম, ডাহিনগিরি ছেড়েছিস, নাকি এখনও চালিয়ে যাচ্ছিস? সে এবার মুখ নামিয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, জি না। আর বদ্যির কাজ করি না। খুশি হয়ে বললাম, ভালো করেছিস। তো এই যে বেপরদা হয়ে একা জঙ্গলে আসিস, তোর ডর হয় না? বলল, ডর হয়। তবে কী করব? বললাম, তুই নিকাহ করছিস না কেন? বলল, সে-ইচ্ছা আমার নেই হুজুর। পুরুষলোকেরা নেমকহারাম। আমার ঘেন্না হয়। সে লকড়ির পাজা তুলে করুণ সুরে ফের বলল, দোহাই হুজুর, এখানে কাউকে যেন বলবেন না আমি ডাহিন (ডাইনি) ছিলাম। সে পা বাড়ালে ডাকলাম, ইকরাতন! একটা কথার জবাব দিয়ে যা। সে ঘুরে দাঁড়ালে বললাম, তুই কি সত্যই হিন্দু ছিলিস? বলল, জি হ্যাঁ। বললাম, বাম্ভন ছিলিস কি? ইকরাতন গলার ভেতর বলল, যা চাপা আছে, তা চাপা থাক হুজুর। আপনি পির। আপনার না জানা কিছু নেই। সে দ্রুত চলে গেল। আমি তাকিয়ে থাকলাম, যতদুর গেল! চেহারায় বদল হয়েছে মেয়েটার। খাওয়াদাওয়া। ভালোই জুটছে বোধ করি! দিনশেষে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। সামনে একটা পুকুর দেখলাম। ভাবলাম, ওই পানিতে অজু করে নমাজ পড়ব । কিন্তু সঙ্গে বদনা আনিনি। আর পানির ধারে পাক। তাই জঙ্গল থেকে দূরে একটি বাঁজা ডাঙায় গেলাম। ডাঙাটিতে অসংখ্য তালগাছ। সূর্য ডুবলে একখানে পরিষ্কার নাঙ্গা মাটিতে হাত দুখানি ঘষে ‘তৈয়ম্মুম’ (জলের অভাবে এভাবে অজুর বিধি আছে) করলাম! হা আল্লাহ! নামাজের সময় সামনেকার তালগাছটি বারাদার একটি নাঙ্গা আউরতের মতো বোধ হচ্ছিল। ‘হাম্মালাতুল হাতাব’– ওই কাঠকুড়ানি মেয়েটি কি কালা জিনের কোনো জাদু? ও কে? কে ও?…।

Her feet are tender, for she sets her steps,
Not on the ground but on the heads of men….
–Homer

হিজরি ১৩১৬ সনের কথা। জ্যৈষ্ঠ মাস ওই মাসে মহরমের দিন অছিপুরের হানাফিরা তাজিয়া নিয়ে মৌলাহাটের মাঠঅব্দি এসেছিল। খোদার কুদরত! আচানক খুব ঝড়পানি এসে গেল। মৌলাহাটের ফরাজিরা লাঠিবল্লম তলোয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। শ্বশুরসাহেবনুরপুরে আছেন। অছিপুরওয়ালারা ভেবেছিল, মৌলাহাটওয়ালারা আগের জমানার মতন তাদের তাজিয়া আর জঙ্গ দেখবে। মুখোমুখি দুইদল দাঁড়িয়ে গেছে। হরিণমারা থানায় ঘোড়া ছুটিয়ে খবর দিতে গেছেন ভাসুরসাহেব। হেন সময়ে মেঘ ডাকল। আসমান কালো হয়ে গেল। দড়বড় করে শিল পড়তে থাকল। আমার শিলকুড়নো অভ্যাস ছিল। শাশুড়িসাহেবা বকাবকি করছিলেন। তারপর ঝডপানি এল। দুখু ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে গেল ফজুকে খুঁজতে! ভয় করছিল, বাজ পড়ে ও মারা না যায়। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে হাসতে-হাসতে বলল, মাঠে যাব কী, অছিপুরের তাজিয়া উড়িয়ে নিয়ে গেছে। বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে হারামজাদারা ভেগে গেছে। শাশুড়িসাহেবা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ফজুর কী হল কে জানে? দুখু বলল, ফজু খুব চালাক ছেলে, বিবিসাহেবা! ভাববেন না। ঠিক তাই। সন্ধ্যার মুখে ঝড়পানি থামলে ফজু দিব্যি ফিরে এল। কোনো গাছতলায় গোরুছাগল নিয়ে বসে ছিল। কিন্তু তখনও জানতাম না কী খবর আসছে। লম্ফ জ্বেলে রফিকে দুধ খাইয়ে ওর আব্বার কোলে দিয়ে দলিজঘরে গেছি, মেঘ ভেঙে মহরমের চাঁদ বেরিয়ে পড়েছে। দরজা খুলে দুনিয়ার অবস্থা দেখছি। সেই সময় প্যাঁচপেচে কাদায় এক ঘোড়সওয়ারকে আসতে দেখে চমকে উঠলাম। ঘোড়াটা দলিজের বারান্দার কাছে দাঁড়ালে যিনি নামলেন, তিনি বারিচাচাজি! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, চাচাজি! চাচাজি! বারিচাচাজি আস্তে বললেন, রুকু? তোরা কেমন আছিস, মা? আমি বুক ফেটে কেঁদে ফেললাম। বারিচাচাজি আমাকে টেনে দলিজঘরে ঢুকলেন। শাশুড়িসাহেবা ডাকছিলেন, বউবিবি! কী হল? ও বউবিবি? বারান্দায় গিয়ে বললাম, বারিচাচাজি এসেছেন, আম্মা! শাশুড়িসাহেবা ব্যস্তভাবে লণ্ঠন নিয়ে এলেন। লণ্ঠনটা দলিজঘরে রেখে বললাম, এতদিন কোথায় ছিলেন চাচাজি? শাশুড়িসাহেবা দরজার ওপাশ থেকে মৃদুস্বরে বললেন, ভাইঝিরা কেমন আছে, কী হালে আছে ভাইসাহেবের জানার গরজ কিসের? বারিচাচাজি একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কোন্ মুখে আপনাদের সামনে দাঁড়াব, আপা? শফিকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাকে হারিয়ে ফেললাম। দেখলাম, শাশুড়িসাহেবর দরজা থেকে সরে গেলেন। বললাম, চাচাজি! আপনার এ কী চেহারা হয়েছে? বারিচাচাজি বললেন, তোর অবস্থাও ভালো দেখছি না! যাই হোক, শোন আমি দেওয়ানি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বহরমপুরে আছি। সেদিন তোর ভাসুরসাহেবের সঙ্গে দেখা হল। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছেন বললেন। কথায়-কথায় জিগ্যেস করলাম, ওঁর শাশুড়ির সম্পত্তির ফারাজ (শরিয়তি বণ্টন) হয়েছে কি না। বললেন, হবেন। রুকুকে তো ধান-খন্দের ভাগ পাঠিয়ে দিই। একথা শুনে আস্তে বললাম, পাঁচ বস্তা ধান, আধবস্তা ছোলা দিয়েছে এ বছর। রোজির আমার সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন থেকে। বারিচাচাজি বললেন, সেকথা ভেবেই এলাম! কালই মজলিশ ডেকে তোর মায়ের সম্পত্তির ফারাজ বের করব। বললাম, ওকথা থাক। হাত-মুখ ধোন! পানি। এনে দিই। বারিচাচাজি বললেন, দাঁড়া। বড়ো খবর আছে একটা! তোর শাশুড়িকে ডাক! উনি শফির জন্য আমাকে মাফ করতে পারেননি। তবে শফিকে আমি ঢেঁড়ে বের করবই। ডাক ওঁকে। খুব জরুরি খবর আছে। শাশুড়িসাহেবা বারান্দার একটু তফাতে খুঁটি আঁকড়ে বোধ করি কাঁদছিলেন। ডাকলে চোখ মুছে কয়েক পা এগিয়ে এলেন! বারিচাচাজি বললেন, পিরসাহেবের খবর রাখেন, আপা? শাশুড়িসাহেবা বললেন, না। তাঁর খবরে আমার কাম কী? বারিচাচাজি একটু ইতস্তত করছিলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কোনো খারাপ খবর নয় তো চাচাজি? বারিচাচাজি হঠাৎ কেমন হাসলেন। বললেন, নুরপুরের কাজি গোলাম হোসেন কাল বহরমপুরে গিয়েছিলেন। আমার চেনা লোক। উনি একটা আশ্চর্য খবর দিলেন। পিরসাহেব একটি মেয়েকে নিকাহ করেছেন। বললাম, সে কী! বারিচাচাজি বললেন, পয়গম্বরের তরিকা (পস্থা) মেনে চলতেই পারেন। তাছাড়া মুসলমান চারবিবি রাখতে পারে। এটা কোনো কথা নয়। আমার অবাক লাগল, মেয়েটি এই মৌলাহাকেই নাকি কোনো চাষাভুষো একজনের বউ ছিল। কী যেন নামটা– শাশুড়িসাহেবা শক্ত গলায় বললেন, ইকরাতন! বারিচাচাজি বললেন, যা–ইকরাতন। আমার কী হল, ছুটে গিয়ে শাশুড়িসাহেবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। শাশুড়িসাহেবা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললেন, খামোশ! বেয়াদপ লড়কি! তারপর বারিচাচাজির উদ্দেশে শান্ত স্বরে বললেন, এ কোনো নতুন খবর নয়, চৌধুরীসাহেব। এ আমি জানতাম। বারিচাচাজি বললেন, আপনি জানতেন? শাশুড়িসাহেবা আস্তে বললেন, বউবিবি, চাচাজিকে হা-মু ধুতে পানি দাও। আমি খানার ইন্তেজাম করি। রফির আব্বা রফিকে শুইয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। দেয়াল ধরে এগিয়ে দলিজে গেলেন। গোঙানো স্বরে আসোলামু আলাইকুম বললেন। আমি ওকে বললাম, আপনার আব্বার কাণ্ড শুনেছেন? সেই আবদুল কুঠার বিবিকে নিকাহ করেছেন। রফির আব্বা বিকটগলায় হাসতে থাকলেন। রাগেদুঃখে বেরিয়ে এলাম। বালতি ভরে পানি আর বদনা নিয়ে যাবার সময় রান্নাঘরের উনুনের সামনে শাশুড়িসাহেবাকে দেখলাম। হতভাগিনী চুপিচুপিকাঁদছেন…

“I go and come with a strange liberty in Nature,
a part of herself…”

নুরপুর বানুকের কুঠিয়াল রিচার্ড স্ট্যানলিকে হত্যা করে যখন আশ্রমে পৌঁছাই, তখনও মন্দিরে খোল বাজিয়ে ব্রহ্মকীর্তন চলেছে। হরিবাবুর কুটির হয়ে এসেছিলেম। তিনি এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বারণ করি। মন্দিরের পেছন ঘুরে ঘরে দ্রুত ভিজে কাপড় বদলে নিই। মন্দির থেকে যেটুকু আলো আসছিল, তাতেই চোখে পড়ে, কাপড়ে-চোপড়ের সব রক্ত ধুয়ে যায়নি। সেগুলি নিয়ে কী করব ভাবছি, সেই সময় স্বাধীনবালা এসে গেল। বললাম, কাজ শেষ। বখশিস দাও। অমনি স্বাধীন আমার পাদুটো ছুঁয়ে প্রণাম করল আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার দেহে-মনে তীব্র আনন্দস্রোত বয়ে গেল। সম্ভবত ইতিহাসে এই প্রথম এক হিন্দু যুবতী একজন মুসলমান যুবককে প্রণাম করল! এ স্বপ্ন না সত্য? বিচলিত বোধ করছিলাম। প্রণামের পর সে সোজা হলে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ঝাঁপটা এসে আছড়ে পড়ল আমার মুখে। আবিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে বলে উঠল, হরিদা কোথায়? তাকেও প্রণাম করতে চাই। এবার আমার ভাবাবেগটুকু নিমেষে ঘুচে গেল। আঃ! কী ভেবেছিলাম আমি? বললাম, হরিবাবু তাঁর কুটিরে আছেন। কিন্তু আমার একটু প্রব্লেম হয়েছে। এই জামাকাপড়ে স্ট্যানলির রক্তের ছোপ আছে। এখনই এর একটা বিহিত করা দরকার। স্বাধীন কাপড়ের পিণ্ডটি আমার হাত থেকে নিয়ে বলল, আমি পুতে ফেলব। তুমি ভেবো না। সে চলে গেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলাম, স্বাধীনের এই প্রণাম কৃতজ্ঞতামাত্র। সে আমাকে প্রণাম করেনি, করেছে তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধগ্রহণকারীকে। আমি মানবেতর প্রাণী হলেও এক্ষেত্রে আমাকে সে প্রণাম করত। এইসব কথা যত ভাবলাম, তত ক্ষোভদুঃখ অনুশোচনা আমাকে জর্জরিত করতে থাকল। সে রাতে ভোজনশালায় গেলাম না। কেউ আমার খোঁজ করতেও এল না। দেবনারায়ণদার ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত কিসের আলোচনা হচ্ছিল। বাইরে সে এক ভয়ঙ্কর শরৎকালীন জ্যোৎস্না। আমি বিনিদ্র। নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল। স্ট্যানলিকে কেন আমি হত্যা করলাম? এই বিশ্বজগতে স্ট্যানলি-নামক এক গোরার সঙ্গে আমার কিসেব সম্পর্ক ছিল? পান্না পেশোয়ারিকে আঘাতের অবশ্য একটা কারণ ছিল। সিতারা নিশ্চয় নিমিত্তমাত্র। পান্না পেশোয়ারির জঘন্য সমকামী স্বভাবতই আমার ওই আচরণের কারণ। কিন্তু স্ট্যানলির সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় পর্যন্ত ছিল না। তাহলে কেন তাকে হত্যা করলাম? কেন, কেন এবং কেন?

ক্রমাগত এই প্রশ্নের ফলে অবশেষে কয়েকদিনের মধ্যে ধর্ম জিনিসটাকে ঘৃণা করার অত্যদ্রুত সিদ্ধান্ত আমাকে গ্রাস করে। জিনগ্রস্তের মতো একলা, জনহীন কোনো স্থানে থুথু ফেলে মনে-মনে বলি, ঘৃণা ধর্মকে –যা মানুষের মধ্যে অসংখ্য অতল খাদ খুঁড়ছে। ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা! ধর্ম নিপাত যাক। ধর্মই মানুষের জীবনে যাবতীয় কষ্ট আর গ্লানির মূলে। ধর্ম মানুষকে হিন্দু অথবা মুসলমান করে। ধর্ম মানুষের স্বাভাবিক চেতনা আর বুদ্ধিকে ঘোলাটে করে। তার চোখে পরিয়ে দেয় ঘানির বলদের মতো ঠুলি। স্ট্যানলিহত্যার পর সারা এলাকায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। নুরপুরে গোরাপলটন এসে ছাউনি করেছিল। পুলিশবাহিনী গ্রামে-গ্রামে হানা দিয়ে যাকে খুশি ধরে নির্মম জুলুম করছিল। তারা ব্ৰহ্মপুর নয়া আবাদেও যখন-তখন এসে হাজির হত। কিন্তু দেবনারায়ণুদার সঙ্গে জমিদারিসূত্রে জেলার ইংরেজ কর্তাদের পরিচয় ছিল। তা ছাড়া অধশতাব্দীকাল ব্রাহ্ম আন্দোলনের নির্দোষ ধর্মকর্মের ঐতিহ্যটি ইংরেজের চোখে তত সন্দেহযোগ্য সাব্যস্ত হয়নি। বরং, আমার মতে, কলিকাতার ব্রাহ্ম নেতারা ইংরাজশাসনের পৃষ্ঠপোষকতাই করে এসেছেন, সমালোচক ভূমিকাটিকে আমি ‘শত্ৰুরূপে ভজনা’ই বলতে চাই। এসব কারণেই ব্ৰহ্মপুর আশ্রমে পুলিশকর্তারা এসেই স্মিতহাস্যে বলতেন, জাষ্ট এ রুটিন ওয়ার্ক, দেবনারায়ণবাবু! ভাগ্যিস যামিনী মজুমদার ব্রাহ্ম কিংবা আশ্রমেব লোক ছিলেন না! পুলিশদল ব্ৰহ্মপুরে আসবে ভেবে আমি সারাদিন আবাদের জঙ্গল এলাকায় কাটাতাম। আবাদিদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতাম। হরিবাবুকে দেখতাম তার কয়েক টুকরো ধানখেতে হাঁটু মুড়ে বসে আগাছা ওপড়াচ্ছেন। নয় তো সুধন্যর সঙ্গে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছেন। কিছুকাল আমরা পরস্পর দেখাসাক্ষাৎ বা বাক্যালাপ করতাম না। এভাবে প্রতিদিন প্রকৃতিতে থাকার ফলে আমার যেন একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। শঙ্খিনী নদীর ধারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা ভোলা ঘাস জমি ছিল। তার কেন্দ্রে একটি কাত হয়ে-থাকা বয়স্ক হিজলগাছ। মাটির সমান্তরালে ছড়ানো একটা মোটা ডালে অনেকক্ষণ বসে থাকা অভ্যাস ছিল। একদিন বিকেলে হঠাৎ একটি বিস্ময়কর চেতনা আমাকে নাড়া দেয়। আরে, কী অবাক! এখানে খাজনা-আদায়কাবী গোমস্তা নেই, পাইক-বরকন্দাজ নেই, আদালতের পেযাদা নেই, পুলিশ নেই, বাজাজমিদাব নেই, বুজুর্গ পির বা ব্রাহ্মণেরা নেই, ধর্মসমাজ-সম্প্রদায় নেই, সরকার বাহাদুব নেই, রাষ্ট্র নেই! মানুষের কোনো নির্মাণই নেই। এখানে যা আছে, তা প্রকৃতিসৃষ্ট এবং স্বাভাবিক। এইসব উদ্ভিদ, পাখি, প্রজাপতি, শিশির, পোকামাকড়, চতুষ্পদ যাবতীয় প্রাণী কী অবাধ, স্বাধীনতাময়।

এর কিছুদিন পরে দেবনারায়ণদা আমার চালচলনে অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করার পর জেরা করে জেনে নিতে চাইতেন, কী ঘটেছে? তাঁকে প্রকৃতি সম্পর্কে আমার ওই ধারণার কথা বলায় তিনি হেসে ওঠেন। বলেন, শফি! মনে হচ্ছে, তুমি এতদিনে পরমা প্রকৃতির ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি করছ। তুমি সৃষ্টির অন্তর্বর্তী আনন্দধারার নিকটবর্তী হয়েছ। তবে সাবধান! তুমি আমেরিকান মনীষী হেনরি ডেভিড থরো তে পরিণত হয়ো না। আমার আবাদে থরোর অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারক হলে বিপত্তির কারণ ঘটবে। বছরে আমাকে সতের হাজার তিন শত ছিয়ানব্বই টাকা নয় আনা তিন পাই খাজনা কালেকটরিকে আদায় দিতে হয়। জিগ্যেস করলাম, কেন থরোর কথা বলছেন? তখন দেবনারায়ণদা আমাকে একখানি বই এনে দিলেন। বইটি দিয়ে বললেন, ওয়াল্ডেন এবং ব্রহ্মপুর এক নয়। মানুষজনও পৃথক। তবু তুমি প্রকৃতির কথা বললে, সেইহেতু বইটি পড়ে দেখতে পার। আশা করি, ইংরাজি এতদিনে মোটামুটি রপ্ত করেছ। বইটির পাতা উলটেই একটি বাক্য চোখে পড়ল। চমকে উঠলাম। স্ট্রেজ লিবাটি! সত্যই তাই। আমিও প্রকৃতিতে যাই এবং ফিরে আসি ‘অদ্ভুত স্বাধীনতা নিয়ে, সেই স্বাধীনতা প্রকৃতিরই অংশ! খুব মন দিয়ে বইখানি পড়তে শুরু করলাম। যেসব শব্দের মানে জানা নেই, অভিধান খুলে দেখে নিই।….

.

রূপান্তর ও জন্মান্তরবৃত্তান্ত

সে বছর ভালো বর্ষা হয়নি। ‘আবাদ’ অঞ্চল নিচু এবং কয়েকটি ছোট্ট নদীর অববাহিকা হওয়ায় মোটামুটি ফসলের আশা ছিল। এই নদীগুলির মধ্যে একমাত্র শঙ্খিনীকেই নদী বলা চলে। বাকিগুলি নিতান্ত সেতা। এ অঞ্চলে এগুলিকে ‘খাগড়ি’ বলা হয়। উলুশরার অনাবাদি তৃণভূমিতে এমন একটি খাগড়ি দেখেছিলাম এবং একজন আশ্চর্য শাদা মানুষ (আরও আশ্চর্য, তাকে এখনও জিন বলে বিশ্বাস হয়, কিংবা বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী সূক্ষ্মতম সীমান্তে অভিজ্ঞতাটি ঘড়ির দোলকের মতো দোলে।) আমাদের পথ দেখিয়েছিল। কতকাল আগের কাহিনী বলে মনে হয়! সোঁতাগুলির কাছে গেলে স্বপ্নের মতো ফিরে আসে চৈত্রের একটি মেঘলা দুপুরবেলা। আরও আশ্চর্য কথা, ‘আবাদের আরণ্য নিসর্গে যেন প্রত্যাশা করি শাদা কোনো জিনের! একদিন বিকেলে শঙ্খিনীর তীরে হিজলগাছের সেই ডালটিতে বসে একটি হ্রস্বাকার ইংরাজি বই পড়ার চেষ্টা করছি, সামান্য দূরে গাছপালার ভেতর দুটি লোককে দেখতে পেলাম। তারা ঘন ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল! কৌতূহলী হয়ে ডাল থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম হরিবাবু ওরফে হাজারিলাল কাঁধে কুড়ুল নিয়ে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে হরিবাবু ইশারায় কাছে ডাকলেন। এই সময় বাঁদিকে গাছপালার ফাঁকে নদীতে একটা নৌকা দেখতে পেলাম। নৌকায় কয়েকজন দাঁড়িমাঝিশ্রেণীর লোক এবং তাদের দুতিনজনেব মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা। বুঝলাম ওরা পাইক এবং সশস্ত্র। কাছে গেলে হরিবাবু বললেন, শফি! ইনিই আমার বাবার নায়েবমশাই গোবিন্দরাম সিংহ। গোবিন্দবাবু চমকে উঠে বললেন, কী আশ্চর্য কী আশ্চর্য! নমস্কার! নমস্কার! আপনি মৌলাহাটের পিরবাবার নিরুদ্দিষ্ট পুত্র? আপনার পিতাসাহেব আপনার জন্য–

দ্রুত বললাম, সেকথা নিষ্প্রয়োজন।

গোবিন্দবাবু একটু হেসে বললেন, এইমাত্র আপনার বৃত্তান্ত ছোটবাবুর নিকট অবগত হলেম। আপনার সঙ্গে পরিচয়ের জন্য আগ্রহ হচ্ছিল! পরমেশ্বরের কৃপায় এই সৌভাগ্য লাভ হল। আপনি মহাপুরুষের সন্তান।

অয় ফরোগে মাহে হুসন্ অজ্‌ বুএ রুখশানে শুমা
অ এ খুবি অজ, চাহে জনখ্‌খানে শুমা…

এই ফারসি বয়েৎ আবৃত্তি করলেন গোবিন্দবাবু। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে হরিবাবু বললেন, আমার পিতাবাহাদুরের সংসর্গে গোবিন্দদা ফারসিনবিশ হয়েছেন। অবশ্য পিতাবাহাদুরের ফারসি শিক্ষা আর মুসলমানি কালচারের পশ্চাতে বিষয়স্বার্থ আছে। মুর্শিদাবাদের নবাববাহাদুর নামক রঙিন পুতুলটিকে নিয়ে ইংরাজের সঙ্গে তিনি সমকুশলতায় খেলা করেন। গোবিন্দদা, সুজাপুর মহল আশা করি আপনার মনিবমহাশয়ের এতদিনে কুক্ষিগত হয়েছে?

গোবিন্দ ওঁর কথায় কান দিলেন না। আমার দিকে উজ্জ্বল, ভক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, পিরজাদা! আপনার অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী দেখে কবিবর হাফিজের এই বয়েটি আবৃত্তি করলাম। এই বয়েতে মুখশ্রীর প্রশংসা আছে।

আস্তে বললাম, আমি আরবি-ফারসি হরফ চিনি। অর্থ বুঝি না। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যেটুকু পড়েছিলাম, স্মরণ নেই। পরে আমি সংস্কৃত আর ইংরাজি পড়েছি।

হরিবাবু আমার কাঁধে একটি হাত রেখে বললেন, শফির মুসলমানি আর নেই। সে রীতিমতো হিন্দু– তবে ‘বেহ্মজ্ঞানী’!

গোবিন্দবাবু জিগ্যেস করলেন, আপনি কি সত্যই ব্রাহ্ম হয়েছেন?

একটু চুপ করে থাকার পর বললাম, আমি ধর্ম মানি না।

হরিবাবু অট্টহাসি হাসলেন। নিঝুম বনভূমি কেঁপে উঠল। গোবিন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হল, সে কথা বিশ্বাস করেননি। বললেন, আপনি এভাবে পরিবারের সংশ্রব ত্যাগ করেছেন কেন, জানি না। হরিনারায়ণের এই অজ্ঞাতবাসের প্রয়োজন আছে, জানি। পিরবাবা এবং মৌলাহাটের বিশিষ্ট ব্যক্তিদিগের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, আপনার সেরূপ প্রয়োজন ছিল না। তাঁদের ধারণা, পিরবাবার বৈরী কালোজিনেরা আপনাকে হত্যা করেছে। শফিসাহেব, আপনি যদি কারুর প্রতি অভিমানবশে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকেন, তাও আপনার চিন্তার এটি। গোস্তাফি মাফ করবেন একথার জন্য। বেশ তো! আপনি যদি পরিবারের সংশ্রব থেকে দূরে থাকতে চান, থাকুন! কিন্তু জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী পিতা-মাতাকে অন্তত একখানি পোস্টকার্ডে ডাকমারফত জানিয়ে দিন যে, আপনি জীবিত এবং নিরাপদ। ঠিকানা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর যদি এ বান্দাকে আজ্ঞা করেন, আমিও খুশহালে পোস্টকার্ড লিখে পাঠাব।

দৃঢ় স্বরে বললাম না।

হরিবাবু বললেন, গোবিন্দদা, দোহাই আপনার, শফির ব্যাপারে নাক নাই বা গলালেন? আর-একটা কথা, আপনি এভাবে আমার কাছে আর আসবেন না। আমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না আর! এখনও আমার জীবনের ব্রতপালন সম্পূর্ণ হয়নি।

গোবিন্দবাবুর মুখে দুঃখভাব ফুটে উঠল। আস্তে বললেন, হরিনারায়ণ! মায়াবশে আসি। তবে এবারকার আসার উদ্দেশ্য তোমার বোনের তাগিদে। সে তোমার জন্য এতই উদ্বিগ্ন যে আশঙ্কা হয়, দুবৃত্ত কালো জিনটি আবার তাকে না। আক্রমণ করে। হরিনারায়ণ! মনুষ্যাত্মা দুর্বল হলে প্রেতশক্তি তাকে করায়ত্ত করে। মুসলমান মতে যা কালো জিন, খ্রিস্ট্রানিমতে তা স্যাটান, বৌদ্ধমতে তা মার, জরুথুস্ট্র মতে তা আহিরমান এবং হিন্দুমতে তা অশুভ প্রেতশক্তি।

বুঝলাম, এই গোবিন্দরাম সিংহ মহাশয় সুপণ্ডিত ব্যক্তি। কথাগুলি বিমর্ষভাবে বলেই তিনি নৌকার দিকে অগ্রসর হলেন। তখন হরিনারায়ণ তাঁকে অনুসরণ করে বললেন, ঠিক আছে। আপনি মাঘমাসে ব্ৰহ্মপুর আশ্রমে ব্রাহ্মদিগের মাঘোৎসব উপলক্ষে রত্নময়ীকে নিয়ে আসুন। স্বাধীনবালা নামে আশ্রমে একটি মেয়ে আছে। সে কৌশলে রত্নময়ীকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাবে।

গোবিন্দবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলেন, মাঘোৎসব কোন্ তারিখে?

আগামী ১১ই মাঘ।

গোবিন্দবাবু চলে গেলেন। নৌকাটি বাঁকের মুখে অদৃশ্য হলে হরিবাবু সশব্দে শাস ছেড়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আমি বিপ্লবব্রত গ্রহণ করেছি। ‘আনন্দমঠ’ আমার জীবনের আদর্শ। কিন্তু দেখো শফি, মানবহৃদয় কী দুর্বল উপাদানে গহিত! আমার বোন রত্নময়ীর উন্মাদদশার কারণ আমিই জানি! ভূতপ্রেত বাজে কথা! রত্নময়ীর মানসিক বৈকল্যের মূলে আমি! গোবিন্দদার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করেছিলাম কেন জান কি? রত্নময়ীর শুভাশুভ জানবার জন্যই। তার সুস্থতার কারণ, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার পিতা নন, আমি। হ্যাঁ, আমিই। আমি সুস্থশরীরে বেঁচে আছি জেনে রত্ন সুস্থ হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কথা বলতে-বলতে হরিবাবু সেই হিজলগাছটির কাছে এলেন। কুড়ুলখানি মাটিতে সজোরে বিদ্ধ করে রেখে একটু হাসলেন। বললেন, প্রায়ই তুমি এখানে এসে বসে থাক দেখেছি। পাছে কেউ সন্দেহ করে, তোমার কাছে তাই আসি না। তবে তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে! এই সুযোগে বলে নিই। তোমার হাতে ওখানি কী বই?

বললাম, ফরাসি পন্ডিত ভোলতেয়ারের লেখা। দেবনারায়ণদা পড়তে বলেছেন।

বইখানি দেখার পর হরিবাবু বললেন, তুমি হিউমের বই অবশ্য পড়বে। তিনিও একজন সুবিজ্ঞ দার্শনিক। যাই হোক, সেই কথাটা বলি। এবৎসর দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বৃষ্টি হয়নি। আকালের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সম্বাদ পেয়েছি বিহার মুলুকে ইতোমধ্যেই ভয়াবহ আকাল শুরু হয়েছে! তুমি কি লক্ষ্য করেছ, দলে-দলে ওই মুল্লুক থেকে সাঁওতাল-মুণ্ডারা বাঙলায় চলে আসছে? এই আবাদেও কয়েকটি দল এসে জুটেছে, জান কি?

হ্যাঁ। দেবনারায়ণদার কাছে শুনেছি। উনিও খুব উদ্বিগ্ন।

তিরু হাড়াম নামে একজনের কাছে ‘বীরসা মহারাজ’ নামে একজন মুসর্দারের বিস্ময়কর কীর্তিকলাপের কথা শুনলাম। সে নাকি শিক্ষিত লোক। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছিল। তার কারাদণ্ড হয়। সম্প্রতি সে রাঁচি শহরের জেল থেকে মুক্তিলাভ করে আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শুধু ইংরেজ নয়, দেশবাসী হিন্দুদের বিরুদ্ধেও তার ভীষণ আক্রোশ। আমাদের সে দিকু’ বলে। একথার প্রকৃত অর্থ অসভ্য। বহু গ্রামে সে হানা দিয়েছে। আমার সন্দেহ হয়, দলে দলে ওরা বাঙলায় আসছে, এই আবাদেও এসে জুটেছে, কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না।

সম্বাদপত্রে পড়েছি এসব কথা। লাইব্রেরিতে কয়েকটি ইংরেজি-বাংলা সম্বাদপত্র আসে। হাসতে-হাসতে বললাম, সম্বাদপত্র মিথ্যাভাষী। কলিকাতার বাবুগণ স্বপ্নদর্শী।

হরিবাবুও হাসলেন। তুমি দেবনারায়ণবাবুর প্রতিধ্বনি করছ। তাঁর মতে, ব্রহ্মদের সম্বাদপত্র ছাড়া অন্যগুলিন মতিচ্ছন্ন ও মরীচিকাদর্শন করে। এবার আমার মুখে কিছু প্রকৃত সম্বাদ শ্রবণ করো। গোবিন্দদার কাছে যা শুনলাম, মনে হল, ইংরেজ কলেকটরি বরাবরকার রক্তপায়ী জীবের মতন এবারও অজন্মার ওজর গ্রাহ্য করবে না। জমিদারের উপর চাপ দেবে এবং তারা কৃষকদিগের উপর জুলুম করে খাজনা আদায় করবে। এর পরিণাম মর্মান্তিক হতে পারে। শফি, প্রস্তুত হও।

কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, আবার কাকে হত্যা করতে হবে, দাদা?

হরিবাবু বললেন, এক নয়, একাধিক হত্যার প্রয়োজন হবে।

আমাকে নীরব দেখে একটু পরে হরিবাবু আস্তে বললেন, শফি, তুমি জন্মান্তরবাদ কী জান কি?

জানি। কেন একথা?

হতে পারে তোমার জন্ম মুসলমান মাতার গর্ভে, কিন্তু তুমি পূর্বজন্মে অবশ্য হিন্দু ছিলে।

সকৌতুকে বললাম, আপনি কি জানেন আমার দেহে মুসলমানদের পরমপুরুষ। পয়গম্বরের কন্যার রক্ত আছে? আমরা সৈয়দ। আমার পিতামহ লখনউ শহরে ভূমিষ্ঠ হন। তাঁর পিতা ছিলেন পেশোয়ারবাসী। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। তাই আমাদের বংশগত নামের সঙ্গে আলখোরাসানি যুক্ত আছে। খোরসান পারস্যদেশের অন্তর্গত।

আমাকে অবাক করে হরিদা বলে উঠলেন, শফি! শফি! তোমার দেহে তাহলে আর্যরক্তও আছে। তুমি মোক্ষমূলরের পুস্তক পাঠ করো। তুমি আর্য, আমিও আর্য। খ্রস্টপূর্ব দেড় হাজার অব্দ নাগাদ আর্যগণ ভারতে আগমন করেন। আর্যসভ্যতার কালে ইউরোপীয়রা নরমাংসভোজী আদিম জাতি ছিল! আর্যদের অপৌরুষেয় গ্রন্থ বেদ এবং ঋষিদের বেদব্যাখ্যাই বেদান্ত! ব্রাহ্মণ বেদান্তব্যাখ্যায় ভ্রান্ত। বেদমাতা গায়ত্রীই দশপ্রহরধারিণী দুর্গারূপে প্রকাশমানা হন। তিনিই ভারতবর্ষ। শফি, বন্দেমাতরম ধ্বনিতে ভারতাত্মার স্পন্দন আছে।

এই উচ্ছ্বসিত বাক্যসমূহ হরিবাবুর মুখ থেকে নির্গত হওয়ার কথা কল্পনাও করিনি। হাঁ করে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ তিনি কুড়লখানি কাঁধে তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, হেই সুধনিয়া! ইয়া ক্যা করছিস বে?

ঘুরে দেখলাম, সুধন্য আর বাঁকা বাগদি সামান্য দূরে নদীর জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁকা লোকটিকে আমার পছন্দ হয় না। তাকে কোথায় যেন দেখেছি। ভগবানগোলায় মামুজির বাড়িতে যে ডাকাতদলটিকে দেখেছিলাম, তাদের একজনের চেহারার সঙ্গে বাঁকার অত্যন্ত মিল। একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।

সূর্য অস্তগামী। গাছপালার ফাঁক দিয়ে গোলাপি রোদ্দুর এসে পড়েছে এখানে। অন্যমনস্কভাবে ভোলটেয়ার সাহেবের বইখানির পাতা ওলটালাম। একখানে দৃষ্টি আটকে গেল –কী আশ্চর্য!

‘Is it not quite natural that all the metamorphoses seen on earth led in the East, where everything has been imagined, to the notion that our souls pass from one body to anther? A nearly imperceptible speck becomes a worm; this worm becomes a buttefly. An acorn is transformed into an oak, an egg into a bird. Water becomes cloud and thunder. Wood changes into fire and ashes. In short everything in nature appears to be metamorphosed… the idea of metapsychosis is perhaps the most ancient dogma of the known universe, and it still reigns in a large part of India and China.’

এদিন থেকেই আমার মনে এক চাপা আলোড়ন শুরু হয়। যখনই স্বাধীনবালাকে দেখতে পাই, তীব্র ইচ্ছা জাগে, তাকে বলি যে পূর্বজন্মে আমি কী ছিলাম বলে তার ধারণা হয়? হরিবাবু আমার দেহে আর্যরক্ত আবিষ্কার করেছেন, একথাও তাকে বলার ইচ্ছা হয়। কিন্তু তেজস্বিনী, মুখরা ওই যুবতীর প্রতি আমার বুঝি গোপন আতঙ্ক ছিল। তারক নরসুন্দর নামে একজন নাপিত সপ্তাহে দুদিন ব্রহ্মপুরে ক্ষৌরকর্মে আসত। খালের ধারে বটতলায় সে আশ্রমবাসীদের গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে দিত। প্রবীণদের মধ্যে দাড়িগোঁফ রাখার ফ্যাশন ছিল। মধ্যবয়সী বা আমার মতো নবীন যুবকরা গোঁফ রাখার পক্ষপাতী ছিল। আমি অবিকল পান্না পেশোয়ারির গোঁফের অনুকরণ করেছিলাম। তারকের চৌকো আয়নাটিতে নিজের মুখ দেখতে-দেখতে নিজেই মুগ্ধ হতাম। সত্যই আমি কবি হাফিজ-বর্ণিত মুখশ্রীর অধিকারী। কিন্তু ভোলটেয়ার মহোদয়ের সেই বাক্যগুলি পাঠের পর থেকে তারকের আয়নায় নিজের হিন্দুত্বের লক্ষণ খুঁজতাম। তারক সন্দিগ্ধভাবে জানতে চাইত, গোঁফের গড়নে কোনো হেরফের ঘটিয়ে ফেলেছে কি না। মৃদু হেসে বলতাম, আচ্ছা নরসুন্দরদাদা, সত্যি করে বলো তো আমাকে দেখে কি তোমার হিন্দু বলে মনে হয়? তার খুব রসিক লোক ছিল। বস্তুত এদেশে নরসুন্দরদের রসিকতা প্রথাসিদ্ধ এবং যত স্থূল হোক না কেন তারা সুযোগ পেলেই রসিকতা করবে। তা ছাড়া বহু লোক অথবা পরিবারের গোপন কেলেঙ্কারির তথ্য তার জানা থাকবেই। গালে জল ঘষতে-ঘষতে বা ক্ষুরটিকে চামড়ার ফালিতে শান দিতে-দিতে পছন্দসই মক্কেলকে সে সেই তথ্য পাচার করবেই। তো আমার কথায় তারক মুচকি হেসে বলত, মিয়াঁসাহেব। আপনি ‘বড়খাসির মাংস খাওয়া ছেড়েছেন বলেই আপনার রূপ খুলেছে। হ্যাঁ, কোন্ গুখেকোর বেটা বলে আপনি মোচলমান? ‘বড়খাসি’ কথাটি গোরুর প্রতিশব্দ। একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এই নরসুন্দর বা হিন্দু নাপিতরা ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-সদগোপ-গোপ প্রমুখ জাতির ক্ষৌরকর্ম যেমন করে, তেমনি মুসলমানদের ক্ষৌরকর্মেও তাদের আপত্তি নেই। এজন্য বার্ষিক কিছু ধান পায়। কিন্তু তারা কদাচ বাগদি কুনাই-কুড়র-হাড়ি-মুচি-ডোম প্রমুখ নিম্নবর্গীয়দের ক্ষৌরকর্ম করবে না। আবাদের নিম্নবর্গীয়দের জন্য হিন্দুস্থানী এক নাপিত বা হাজাম আসে। তার নাম ফাগুলাল। তার বাড়ি নুরপুরের চটিতে (ছোট্ট বাজার)। ফাগুলাল হাজাম আবাদ এলাকায় ঢুকলে হুলস্থুল পড়ে যায় দেখেছি। সে কেশবপল্লীর কাছে একটি প্রকাণ্ড গাবগাছের তলায় গম্ভীর মুখে বসে। হিন্দুস্থানী হাজামদের সঙ্গে বাঙালি হাজামদের আমূল ফারাক। ফাগুলালরা রসিক নয়, ভাঁড়ামি জানে না। একদিন দেবনারায়ণদার ঘরে কথা প্রসঙ্গে আমি এই বৈসাদৃশ্যের কথা তুললে উনি খুব হাসলেন। বললেন, তুমি ঠিকই লক্ষ্য করেছ। তোমার পর্যবেক্ষণশক্তি অসামান্য। এবিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। ওইসময় বাঁকিপুরের ব্রাহ্মাতা গিয়াসুদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। নুরপুরের ধর্মসমন্বয়বাদী মৌলবি আফতাবুদ্দিন তাঁর আত্মীয় ছিলেন। গিয়াসুদ্দিন বললেন, আরেকটি আশ্চর্য ব্যাপারে আমার চিন্তা হয়। সারা ভারতবর্ষ পানি বলে, শুধু বাঙালি হিন্দুরা জল বলেন। দেবনারায়ণদা অভ্যাসমতো বললেন, না গিয়াসভাই, দাক্ষিণাত্য বলে না। দেবনারায়ণদা বললেন, বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণাঞ্চল একদা অনার্য-অধ্যুষিত ছিল। রামায়ণে সে বৃত্তান্ত আছে। ওখানকার ভাষা আর্যভাষা নয়। গিয়াসভাই ঠিক বলেছেন। আর্যভাষাভাষীরা সমুদায় পানিই বলে। আমরা শুধু জল বলি। শাস্ত্রীমহোদয় বললেন, অবশ্য পানি সংস্কৃত মূল থেকে উৎপন্ন। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কিছু চিন্তা আছে। সবাই একগলায় বললেন, বলুন, বলুন। শাস্ত্রী মহোদয় বললেন, আমার দেশভ্রমণের বাতিক আছে। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের বহু স্থানে ভ্রমণ করেছি। তবে আর্যাবর্তে একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি। ধর্মব্ৰতী অংশ বাদে সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য বিদ্যমান। পোশাকপরিচ্ছদ, ভাষা, এমন কি হিন্দু আর মুসলমানের নামেও ঐক্য সুপ্রচলিত। কিন্তু বঙ্গদেশে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য সত্বেও বিস্তর অনৈক্য। এই প্রদেশ ছাড়া কুত্রাপি মুসলমানদের যবন অথবা নেড়ে বলা হয় না। এ প্রদেশে আরও প্রচুর বৈষম্য দেখা যায়। গিয়াসুদ্দিনও পন্ডিত ব্যক্তি। একটু হেসে বললেন, ইতিহাসহির মর্মানুসারে সিদ্ধান্ত হয়, ব্রাহ্মণ্যধর্মের চাপে বৌদ্ধরা আর্যাবর্ত থেকে পূর্বখণ্ডে চলে আসেন। তাঁর ছিলেন মুণ্ডিতমস্তক। এতপ্রদেশেও ব্রাহ্মণ্যপ্রকোপে তাঁরা মুসলমান হন। সেজন্য সমূহ মুসলমানসম্প্রদায়কে ‘নেড়ে’ বলা স্বাভাবিক। দেনারায়ণদা তাঁর উদাত্ত হাসি হেসে বললেন, ব্রাহ্মভ্রাতা গিরিশচন্দ্র সেনকে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন মহোদয় পবিত্র কোরানগ্রন্থ বাঙ্গালাভাষায় অনুবাদের নির্দেশ দেন। একযুগ পূর্বে তিনি নিজে লখনউ থেকে আরবিভাষা শিখে মহৎ কর্মটি সুসম্পন্ন করেছেন। এতে আনন্দিত মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ তাঁকে মৌলবি খেতাব দিয়েছেন। কিন্তু পৌত্তলিক হিন্দুদিগের নেতৃবৃন্দ চটে আগুন। তারা গিরিশবাবুকে যবন, নেড়ে ইত্যাদি গালি দিচ্ছে। তাতে দুঃখ নেই। শুধু দুঃখ যে, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র অনুবাদ সমাপ্ত দেখে। যেতে পারেননি। আপনারা জানেন কি, বঙ্গপ্রদেশের বহু মুসলিমকন্যা ভ্রাতা গিরিশচন্দ্রকে পিতা সম্বোধন করে চিঠি লেখেন? মুসলিম ভাইরা তাঁকে ভাই গিরিশচন্দ্র বলে সম্ভাষণ করেন। গিয়াসুদ্দিন সসম্ভ্রমে বললেন, গত বছর কলিকাতায় তাঁর দর্শনলাভ করে ধন্য হয়েছি। আফতাবুদ্দিন সম্প্রতি কলিকাতা গিয়াছেন। একখানি সম্বাদপত্র প্রকাশের অভিপ্রায় আছে। তাঁর পত্রে অবগত হলেম, গিরিশভাই অসুস্থ। এই সময় শাস্ত্রী-মহোদয়ের চোখ পড়ায় আমাকে বললেন, শফি! তুমি চুপ করে আছে কেন? তুমি শুনলাম ইংরাজি-নবিশ হয়ে উঠেছ। আলোচ্য বিষযে তোমার কোনো প্রস্তাব থাকলে বলো। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে আপনার কী মত? শাস্ত্রীমহোদয় যেমন, তেমনি সভাস্থ সকল প্রবীণই অট্টহাসি হেসে উঠলেন। দেবনাবায়দা বললেন, জন্মান্তরবাদ অসিদ্ধ। জীবাত্মা মৃত্যুর পর পরমাত্মায় বিলীন হয়। হৃদয়নাথ বললেন, জন্মান্তরবাদ বৌদ্ধধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। পরমাত্মা মহাসমুদ্রবৎ। যেরূপ মহাসমুদ্র থেকে মেঘের উদ্ভব এবং বারিবিন্দু বর্ষিত হয়, সেইরূপ জীবাত্মাও পরমাত্মা থেকে উদ্ভূত হয়। বারিবিন্দু আবার মহাসমুদ্রে গমন করে। এই সৃষ্টিচক্র অনন্তকাল ধরে চলেছে। এবার বলো, ইউরোপীয় সাহেবগণের এবিষয়ে কী মত? আমি ভোলটেয়ারের বইখানির কথা তুলব ভাবলাম। কিন্তু কী লাভ? দেবনারায়ণদা বললেন, হঠাৎ তোমার মাথায় এই প্রশ্ন জাগার কারণ কী, শফি? অগত্যা বললাম, তারক নরসুন্দর বলে, আশ্রমের ভোজনশালার আনাচে-কানাচে যে কুকুরগুলান ঘুরঘুর করে, তারা তাকে দেখলেই ঘেউঘেউ করে কেন? তারা পূর্বজন্মে সকলেই তার মক্কেল ছিল। তারা ক্ষৌবকর্ম করতে চায়। আমার কথা শুনে সভায় আবার অট্টহাসি উঠল। তখন আমি ভাবলাম, তারকের প্রভাবে আমি সম্ভবত কিছুটা রসিক হতে পেরেছি। অথবা আমি বছরের পর বছরের জমে-ওঠা বুকের ভেতরকার শীতলতা সহ্য করতে আর পারছি না। বলেই পরিহাস-উন্মুখ হতে চাইছি? সেদিন বিকেলে একটি ঘটনা ঘটল। খালের ধারে বটগাছটার দিকে যাওয়ার সময় স্বাধীনবালার মায়ের মুখোমুখি হলাম। সুনয়নীর কুটিরের চারদিকে ফুল ও ফলের গাছ। সারাদিন ওঁকে ফুল-ফলের গাছের পরিচর্যারতা দেখতাম। তাঁর স্বামীর ঘাতকের মৃত্যুর পর কিন্তু তিনি এতদিনে একবারও আমাকে অন্তত আভাসেও জানতে দেননি, তাঁর কী প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। স্বাধীনকেও এবিষয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি। এদিন সুনয়নী মৃদুস্বরে আমাকে ডাকলেন, বাবা! শোনন। কাছে গিয়ে কী হল, প্রণামের জন্য নত হলাম। অমনি তিনি যেন সসংকোচে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। থাক বাবা, থাক। আশীর্বাদ করি, দেশের ও দশের মুখ উজ্জ্বল করো। তোমাকে গোপনে একটা কথা বলতে চাই বলেই ডাকলাম। আস্তে বললাম, বলুন! সুনয়নী চারপাশ দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বললেন, কাউকে যেন বোলো না বাবা! তুমি মুসলমানের ছেলে বলেই বলতে সাহস পাচ্ছি। এখানে আমার মন তিষ্ঠোতে পারছে না। ছত্রিশ জেতের লোক একসঙ্গে খাচ্ছেদাচ্ছে। বাবা, আমি হিন্দুর মেয়ে। আমার এসব মেলেচ্ছ আচার সহ্য হচ্ছে না। এখানে আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যাব। আমি জানি, তুমি বাবামায়ের ওপর রাগ করে এখানে আশ্রয় নিয়েছ। তুমি মুসলমান। তুমিও এখানে বেশিদিন থাকবে না– থাকতে পারবে না। তাই তোমাকেই বলছি। সুনয়নী চুপ করলেন। আঁচলের। খুঁটে চোখ মুছে বললেন, আমার আরও চিন্তা খুকুর জন্য। সে এখানে এসে যেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, ভয় হয়, সে নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা শফি, তুমি যদি রেতের বেলা দোপুকুরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এস আমাদের, আমরা বহরমপুরে ফিরে যেতে পারব। দোপুকুরিয়ায় খুকুর বাবার এক জ্ঞাতি আছেন শুনেছি। নাম জানি না। সে আমরা খুঁজে বের করে নেব। সুনয়নীর এই কথা শুনছিলাম আর তার কুটির ও ফুল-ফলের গাছগুলি দেখছিলাম। খুব বিস্ময় বোধ হচ্ছিল। বললাম, স্বাধীন কী বলে? সুনয়নী বললেন, ওকে বলব দোপুকুরিয়ায় ওর কাকার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। আসলে আমি স্ত্রীলোক, সঙ্গে উঠন্তবয়সী মেয়ে, রাতবিরেতে যাওয়ার সাহস নেই। সঙ্গে একজন শক্তসমর্থ পুরুষমানুষ থাকা দরকার। খুকুর কাছে শুনেছি, তুমি খুব ডানপিটে ছেলে। লাঠিখেলা তরোয়ালখেলা জান। কোন্ গুণ্ডাকে তুমি নাকি মেরে নাকাল করেছ। আরও শুনেছি, তোমার সঙ্গে খুকুর বাবার খুব চেনাজানা ছিল। একটু হেসে বললাম, ছিল। যামিনীবাবু আমাকে তার বিপ্লবী দলে টানতে চেয়েছিলেন। এতক্ষণে সুনয়নী আমার খুব কাছে এলেন। ফিসফিস করে বললেন, জানি। খুকু বলেছে, তুমি মুসলমান হয়েও বন্দেমাতরমদলের লোক। তোমার কাছে নাকি খুকুর বাবার মতন পিস্তলও আছে। স্বাধীনবালার মায়ের এই কথায় চমকে উঠলাম। ভাবলাম, এতসব বলেছে স্বাধীন, কিন্তু কেন বলেনি যে আমি স্ট্যানলিকে খুন করেছি? বললাম, আপনি তো ইচ্ছে করলে দিনেই দেবনারায়ণবাবুকে বলে দোপুকুরিয়া চলে যেতে পারেন! আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি বললে তিনি বাধা দেবেন কেন? বরং পালকির ব্যবস্থা করেও দেবেন। সুনয়নী ঝাঝালো স্বরে বললেন, বলেছিলাম। উনি ঠাট্টা করে বললেন, তুমি বেহ্ম হয়েছ। কেউ তোমাকে নেবে না। বাড়ি ঢুকতে দেবে না। আসলে আমি বুঝতে পেরেছি, খুকুকে উনি কাজে লাগিয়েছেন। ছোটোলোকেদের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য খুকুর মতন মেয়ে আর পাবেন কোথায়? তাই ওকে আটকে রাখতে চান। বাবা শফি, তোমাদের আপির-ভগবানের দোহাই, আমাকে মা বলে জেনো– যেন এসব কথা কারুর কানে যায় না।

আপনাকে কাল একসময় বলব। বলে খালের দিকে না গিয়ে বাঁধের পথে উঠলাম। তারপর মনে হল, আমি কি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলাম? কেশবপল্লীতে হাজারিলালের কুটিরের দিকে অন্যমনস্কভাবে হেঁটে চললাম। কুটিরের কাছাকাছি পৌঁছে বাঁধের ডানদিকে নীচের আবাদি জমির একধারে একটি গাছের দিকে দৃষ্টি গেল। সেখানে উজ্জ্বল রোদ পড়েছিল। হাজারিলাল একটা কোদালের বাঁটে বসে আছেন এবং তাঁর মুখোমুখি বসে আছে স্বাধীনবালা। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, একটা প্রচণ্ড থাপ্পড় মারল কেউ। দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালাম? কেউ তো নেই। অথচ শরীরে কোথাও চপেটাঘাতের জ্বালা! শিউরে উঠলাম…

.

Angelos Satan me colaphiset!’

ওই অলৌকিক থাপ্পড়টি আমার পিতার প্রেরিত কোনো জিনের; এই ধারণার পিছনে পূর্বসংস্কারের তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণ অনস্বীকার্য। সত্যি বলতে কী, বেশ কিছুদিন আমি খুব ভীত আর আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। ওই কয়েক দণ্ডের জন্য আমি নিতান্ত অবোধ বালকে পরিণত হয়েছিলাম যেন। তাহলে কি সত্যিই পিতার প্রেরিত জিনেরা নিরন্তর আমার পাহারায় রত? একজন হিন্দুকন্যার প্রণয়াসক্ত যাতে না হই, যাতে তজ্জনিত ঈর্ষায় আক্রান্ত না হই, সেই কারণে আমাকে সতর্ক করা হল! আমার বুজুর্গ পিতা অবশ্যই জানেন আমি কোথায় আছি। পান্না পেশোয়ারিকে আঘাত করা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি অত্যন্ত নিরাপদ। এর একটাই ব্যাখ্যা হয়। লালবাগ শহর থেকে এক জ্যোত্মা-সন্ধ্যায় পালিয়ে আসার মুহূর্ত থেকে পিতা তার অনুগত জিনের মারফত আমার কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন। অতএব, আমি তাঁর অনভিপ্রেত কাজ করব না। ঠিক করলাম, স্বাধীনবালাকে ঘৃণা করতে থাকব। তার দিকে চোখ তুলে চাইব না। এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে বাধ ধরে এগিয়ে বাঁদিকে নেমে শঙ্খিনীর ধারে সেই হিজলগাছটার কাছে যাবার উপক্রম করছি, পিছনে ‘হাজারিলালের চিৎকার শুনতে পেলাম, শফিসাব! ঠারিয়ে! ঠারিয়ে! ঘুরে দাঁড়ালাম! ‘হাজারিলাল’ ফের চেঁচিয়ে বললেন, ঘোড়াসা বাত আছে আপনার সোঙ্গে। দেখলাম, ওরা দুজনেই হেমন্তের হলুদধানখেতের আল দিয়ে জোরে হেঁটে আসছে। কাছে আসার পর প্রথমে স্বাধীনবালাই কথা বলল। শফিদা! দুপুবে তুমি কোথায় ছিলে? দেবুজ্যাঠা আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দিলেন –দেখো না, কী ঝামেলা! তার হাতে কিছু কাগজ আর একটি পেন্সিল ছিল। তার দিকে না তাকিয়ে বললাম, কী ঝামেলা? জবাব দিলেন হরিবাবু। বাঁকা হেসে বললেন, দেবেন্দ্রপল্লীতে স্ত্রীলোক গণনা। কেউ দেবনারায়ণবাবুর কানে তুলেছে, দেবেন্দ্রপল্লীর স্ত্রীলোকেরা নাকি মূর্তিপুজা করে। তাই ব্ৰহ্মমন্দিরের সান্ধ্য উপাসনায় তাদের উপস্থিতি বিরল। হাসবার চেষ্টা করে বললাম, দেবনারায়ণদা কি এবার হাজিরা খাতা খুলবেন নাকি? হরিবাবু বললেন, বড়োলোকের নবারি খুশখেয়াল। খুলবেন বলেই মনে হচ্ছে। স্বাধীনবালা বলল, নাম লিখতে গিয়ে হাজার কৈফতের ঠ্যালায় অস্থির। চাষাভুষো লোক ওরা। ভাবল, খাজনার অঙ্ক বাড়বে। বলে আমার দিকে তাকিয়ে চোখে ঝিলিক তুলল। বলল, কাল তোমাকে নতুন-পল্লীতে পাঠাবেন– ওই যে দেখছ, সাঁওতালদের বসতি, ওখানে। না –ভয় পেয়ো না! ব্রাহ্মধর্মের প্রচারে নয়, লোকগণনায়। এই সময় হরিবাবু চাপা স্বরে বললেন, শফি। আগামীকাল সন্ধ্যায় তুমি কোনোপ্রকারে আমার কুটিরে আসবে? বিশেষ প্রয়োজন। বললাম, আসব। বলে বাঁধ থেকে নামতে যাচ্ছি, স্বাধীনবালা বলল, শফিদা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? চলো, আমাকে আশ্রমে পৌঁছে দেবে। বললাম, কেন? এখনও তো সন্ধ্যা হয়নি। হরিবাবু বললেন, আমিই যেতাম– যেতে হত। বিজয়পল্লীতে ইদানীং কিছু অবাঞ্ছিত লোক উপদ্রব করছে। তারা। নেশাভাং করে এসময় উন্মত্ত থাকে। দেবনারায়ণবাবু জানেন। কিন্তু বাঁকা সর্দার নামে বিজয়পল্লীর যে মোড়লটি জুটেছে, সে ওঁর স্নেহধন্য। জমিদারি রক্ত, শফি! সকলে তো আমার মতো সংস্কারবর্জন করতে পারে না। বাঁকা কুখ্যাত ডাকাত ছিল। পরে সে লাঠিয়ালি পেশা গ্রহণ করে। দেবনারায়ণবাবুর দক্ষিণ হস্ত সে। জানি না, লোকটির আমার হাতে মৃত্যু আছে কি না। স্বাধীনবালা বলল, চুপ করো, হরিদা! সর্বত্র বীরত্ব দেখানো ঠিক নয়। শফিদা, বিজয়পল্লী বা বাঁকা-টাকার জন্য নয়, সে একটু হাসল…ইদানীং আমার ভূতের বড়ো ভয়। হরিবাবু হাসতে হাসতে বললেন, স্ট্যানলির ভূত। স্বাধীনবালা বলল, চুপ করো! শফিদা, লক্ষ্মীটি! আশ্চর্য, যখন ওর সঙ্গে পা বাড়ালাম, নিজের থাপ্পড় খাওয়ার অস্বস্তিকর জ্বালাটি আর নেই। আর সেই মুহূর্তে ঘৃণা করার ইচ্ছাটি ও ঘুচে গেল। চারিদিকে কুয়াশার সঞ্চার। গাছে গাছে পাখিরা তুমুল কলরব করছে। ইতস্তত পল্লীগুলিতে শান্ত নীরবতা এবং শঙ্খধ্বনি। ডাকলাম, খুকু! স্বাধীনবালা প্রচণ্ড চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। বলল, আমার ডাকনাম তোমাকে কে বলল? বললাম, তোমার মা। স্বাধীনবালা চুপ করে গেল। তখন বললাম, খুকু! তোমার মা আমাকে আল্লাপির-ভগবানের। দোহাই দিয়ে কথাটি বলতে নিষেধ করেছেন কাউকে। কিন্তু আমি ধর্ম মানি না। তাছাড়া কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনবালা থমকে দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কী কথা শফিদা? একটু ইতস্তত করে বললাম, তুমি শিক্ষিতা। বুদ্ধিমতী। কলহ না করে মায়ের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে নিও। তবে কথাটি গোপন না রেখে তোমাকে বলার কারণ– আমি থেমে গেলে স্বাধীনবালা বলল কী? চুপ করে থেকো না! আমি নির্বোধের হাসি হেসে বললাম, হরিবাবু তোমার জন্য কষ্ট পাবেন ভেবেই কথাটি বলা দরকার। স্বাধীনবালা আবার চমকে উঠল। আবছা আলোয় তারে নাসারন্ধ্র স্ফুরিত এবং চোখে ছটা দেখতে পেলাম। কিন্তু হঠকারী তাড়নায় আমিও উত্তেজিত। সুনয়নীর সঙ্গে আমার কথাবার্তা দ্রুত এবং সংক্ষেপে ওকে জানিয়ে দিলাম। স্বাধীনবালার প্রতিক্রিয়া ম্লান হাসিতে প্রকাশ পেল মাত্র। শ্বাস ছেড়ে সে বলল, আমি জানি। মায়ের এখানে থাকতে কষ্ট হয়। মানিয়ে চলতে পারে না। তবে এ কোনো নতুন কথা নয়। মা আমাকে বহুবার বলেছে, চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই। কিন্তু মা বুঝতে পারছে না, কোথায় গিয়ে উঠবে? কী খেয়ে বেঁচে থাকবে? বহরমপুরে– তুমি জান না– আমরা পরাশ্রিতা ছিলাম। আমিই দেবুজ্যাঠাকে চিঠি লিখি। তখন উনি আমাদের নিয়ে আসেন। সে এতক্ষণে পা বাড়াল। খুব নিস্তেজ তার গতি। একটু পরে ফের বলল, তবে তুমি হরিদা আর আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ কর তা ভুল। আমি হরিদাকে শ্রদ্ধা করি। তার দেশের জন্য আত্মত্যাগ এবং কষ্টস্বীকারের মধ্যে বাবাকে দেখতে পাই। স্বাধীনবালার কণ্ঠস্বর শুনে দুঃখিতভাবে বললাম, তুমি কি কাঁদছ, খুকু? আমাকে ক্ষমা করো। আমার চোখে পাপ আছে। মুসলমান শাস্ত্রে পাপকে শয়তানের ক্রিয়াকলাপ বলা হয়। খুকু কিছুক্ষণ আগে আমি যখন তোমাদের একত্র বসে থাকতে দেখি, তখন একটি অদৃশ্য হাতের থাপ্পড় খেয়েছিলাম, জান কি? স্বাধীনবালা কোনো কথা বলল না। বললাম, থাপ্পড়টি জিনের ভেবেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, শয়তান আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। মনীষী ভোলটেয়ারের দর্শনগ্রহে পড়েছি, বাইবেলে উল্লেখ আছে। যে, সেন্ট পলকে শয়তান একবার চপেটাঘাত করেছিল। Angelos Satan me colaphiset স্বাধীনবালা সন্ধ্যার অন্ধকারে আমার বাঁ হাতটি ধরে বলল, শফিদা! আমাকে ভুল বুঝো না! তার হাতের স্পর্শে আমার হাত মুহূর্তে নিঃসাড় হয়ে গেল। পরক্ষণে সে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তবে একটা কথা তোমাকে জানানো উচিত। আমাকে ঈশ্বর অনেক কিছু দান করেছে। একটি জিনিস বাদে। সে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলে আস্তে বললাম, সেটি কী খুকু? স্বাধীনবালা ফের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, পুরুষের প্রতি প্রেম। শফিদা এ জীবনে কোনো পুরুষ মাথা ভেঙেও এই জিনিসটি আমার কাছে পাবে না। দ্রুত বললাম, কেন? স্বাধীনবালা এ প্রশ্নের জবাব দিল না। চলার গতি বাড়িয়ে দিল। আশ্রম পর্যন্ত আর একটি কথাও বলল না। তখন মন্দিরে আসর বসেছে। বেদিতে বসে দেবনারায়ণদা উদাত্তস্বরে উপনিষদ পাঠ করছেন। বহুত কঠোপনিষদের একটি শ্লোকের সঙ্গীতময় ধ্বনিযুক্ত ভেসে এল কানে:

ন তন্ত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্‌
নেমা বিদ্যুতো ভাস্তি কুতোহয়মগ্নিঃ

পরদিন সকালে গিয়াসুদ্দিনের সঙ্গে একজন মুসলমান যুবক আশ্রমে এলেন। গিয়াসুদ্দিন আমাকে দেখিয়ে তাঁকে সহাস্যে বলে উঠলেন, এই সেই পলাতক পিরজাদা। শফি! এঁর নাম দিদারুল আলম। নুরপুরে নিবাস। তবে বহরমপুর শহরে ওকালতি করেন। আমার আত্মীয়। দিদারুল হাত বাড়িয়ে বললেন, আস্সালামু আলায়কুম! বহুকাল পরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রত্যুত্তর দিলাম এবং আমার কণ্ঠস্বর আড়ষ্টতা ছিল। দিদারুল গম্ভীর মুখ বললেন, আপনার আব্বাসাহেব আমাদের গ্রামে এসেছেন জানেন কি? বললাম, না। দিদারুল বললেন, আপনার কথা গিয়াসভাইয়ের কাছে শোনামাত্র ছুটে এসেছি। একটু আড়ালে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। গিয়াসুদ্দিন বললেন, আমি দেববুভাইয়ের কাছে গিয়ে বসছি। তোমরা কথা বলল। দিদারুল আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, চলুন। ওই খালের ধারে যাই। আকস্মিকতার ধাক্কা ততক্ষণে কাটিয়ে উঠেছি। শক্ত মনে খালের ধারে একটি জামগাছের তলায় গেলাম। দিদারুলের পরনের আচকান, মাথায় লাল তুর্কি টুপি, গোড়ালির উর্ধ্বে পায়জামা দেখে বুঝলাম এই নবীন উকিল ফরাজি। তিনি বিনা ভূকিায় ভর্ৎসনার সুরে বললেন আপনি সৈয়দবংশীয়। আপনার আব্ব জুর্গ আলেম। অথচ আপনি এই হিন্দুদিগের আশ্রমে হিন্দু লেবাস পোশাক পরে হিন্দু চেহারা নিয়ে বাস করছেন? তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ! এ আপনি কী করছেন? যারা হিন্দুস্থানে সাতশো বছরের মুসলমান তহজিব-তমুদ্দনকে নাকচ করে খ্রীস্টানশাহির মদতে বেদ-রামায়ণ-মহাভারতের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, আপনি তাদের কদমে কদম মিলিয়েছেন, ভাই? আপনি নাকি প্রচুর কেতাব পাঠ করেন। আপনি বুঝতে পারছেন না –ডোঞ্চু আনডারস্ট্যানড দ্যাট দা হিন্দুজ আর ডেলিবারেটলি ট্রাইং মিসলিড দেয়ার নিউ জেনারেশন? দে আর মিসাইনটারপ্রিটিং দা হিস্ট্রি! এডুকেশনাল কারিকুলাম পর্যন্ত অভিসন্ধি প্রণোদিত! আপনি ব্রাহ্মদিগের লিবার্যাল অ্যাটিচুড়ের কথা বলতে পারেন। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মদিগের লাইন চেঞ্জ হয়ে গেছে। বিস্তর দলাদলি চলেছে তাঁদের মধ্যে। কিন্তু একটা বিষয়ে সকলের এক রা। হিন্দুত্বের পুনরুজ্জীবন। যা কিছু মুসলমানের, তা পরিত্যাজ্য। বাঙ্গালা ভাষা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে আরবি-ফার্সি-তুর্কি বর্জন চলেছে। সংস্কৃতেব আধিপত্য– দিদারুলকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আপনিও কিন্তু সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করছেন! দিদারুল হাসলেন। বললেন, অভ্যাস। বলেই শব্দটি বদলালেন, খাসিয়াৎ। তবে আমি একথা মানি না যে বাঙালি মুসলমানের জবান হবে উরদু। যাই হোক, ভাই শফিউজ্জামান আপনি সৈয়দ। আপনার দেহে পাক খুন বইছে। আপনাকে আমাদের সমাজের খুবই প্রয়োজন। আপনাকে আমি নিতে এসেছি। এখনই আমার সঙ্গে নুরপুরে চলুন। আপনার আব্বাসাহেবের কদম মোবারকে (পবিত্র পদে) হাজের হলেই শয়তান আপনার সঙ্গ ছেড়ে ভেগে যাবে। দিদারুল হাসতে থাকলেন। আমার ইচ্ছা করল, এই উকিলটিকে স্ট্যানলির পিস্তলদ্বারা হত্যা করি। কিন্তু পিস্তলটি আমার ঘরে লুকানো আছে। আমি চুপ করে আছি দেখে দিদারুল আমার একটা হাত ধরে টানলেন। অমনি হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, আপনি এখনই আশ্রম ছেড়ে চলে যান। যদি না যান, বিপদে পড়বেন। দিদারুল স্তম্ভিত হয়ে বললেন, সে কী কথা! বললাম, আপনি যদি গিযাসসাহেবের সঙ্গে না আসতেন, আপনাকে –আমি থেমে গেলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, সৈয়দজাদা! এখনও হিন্দুস্থানে মুসলমান তত কমজোর হয়ে পড়েনি। আপনার আব্বাসাহেবকে খবর দিলে তমাম এলাকার মুসলমান এসে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা নয়, আপনার ওপর জবরদস্তি করি। আপনি আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনি কি ভেবেছেন, হিন্দুরা আপনাকে আপন বলে গ্রহণ করবে কোনোদিন? সৈয়দজাদা। এ আপনার আকাশকুসুম খোয়াব। হিন্দুদিগের আপনি চেনেন না। যারা নিজেদের মধ্যে একজাতি অপরজাতিকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করে, তারা মুসলমানকে ভেতর-ভেতর কী চোখে দেখে, নিজেই ভেবে দেখুন। এবার আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। দ্রুত স্থানত্যাগ করলাম। দিদারুল গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমি প্রায় শুকিয়েপড়া খালটি এক লাফে ডিঙিয়ে মাঠে গিয়ে পড়লাম। তারপর হলুদ এবং ভূলুণ্ঠিত পাকা ধানখেতের ভেতর দিয়ে উদভ্রান্তের মতন হাঁটতে থাকলাম। তখনও রাতের শিশির শুকোয়নি। হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গেল। কোথায় সামান্য জলকাদা, কোথাও ঝোঁপজঙ্গল। সবখানে মাকড়সার জালে শিশিরবিন্দুগুলিন ঝলমল করছিল। শঙ্খিনীর তীরে সেই হিজলগাছটির কাছে পৌঁছে মনে হল, আমি নিরাপদ। আঃ। কী রাজার ঐশ্বর্য চতুর্দিকে দীপ্যমান। কী রহস্য ওই অরণ্যের বুকে ঘননীলবর্ণ কুয়াশায়। কোথায় পাখি ডাকল। এই তো সেই পবিত্র ভূমি যেখানে পৌঁছুলেই মনে হয়, কেউ একজন আছে, যে চিরকালের নারী, যার জন্য পুরুষদিগের জন্ম, যাকে লক্ষ্য করে সমুদয় কবিগণ কবিতা রচনা করেন, ‘Whose heart-strings are a lute’। শখিনী নদীর জলে পা ধুয়ে এসে। মাটির সমান্তরাল হিজল ডালটিতে বসামাত্র মনে হল, কী আশ্চর্য! এই তো আমার রাজত্ব। কার সাধ্য আমাকে এখান থেকে স্থানচ্যুত করতে পারে?

I am monarch of all I survey,
My right there is none to dispute…….
[William Cowper (1731-1800)]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *