১০. জ্যোৎস্নার মৃত্যুর ঘ্রাণ

জ্যোৎস্নার মৃত্যুর ঘ্রাণ

নুরুজ্জামান মৌলাহাট মসজিদে তার পিতার ভূমিকা নিয়েছে কিছুদিন। কারণ বদিউজ্জামান গেছেন তিন ক্রোশ দূরের এক শিষ্য-গ্রাম শিসগাঁয়ে। নবীন মৌলানা নুরুজ্জামান তাই নমাজ-পরিচালক হয়েছে। গত জুম্মাবারের নমাজে তার খোবা পাঠে (শাস্ত্রীয় ভাষণ) মৌলাহাটের মুসল্লিদের মধ্যে ধুম পড়ে যায়। শোভানাল্লা! কী গলার আওয়াজ! কী উচ্চারণ! একেই বলে, ‘বাপকা বেটা সিপাহিকা ঘোড়া। কুছ নেহি তো হোড় হোড়া।’

ফজরের নমাজ সেরে বাড়ি ফিরে সে তার বালিকাবধূকে তখনও কোরান পাঠে ব্যাপৃত দেখেছিল। বারান্দায় পাতা জায়নামাজ বা প্রার্থনা আসনটি একটি রঙিন গালিচা। দেওবন্দমুলুক থেকে কিনে এনেছিল নুরুজ্জামান। এ মুহূর্তে মনে হল, খোদাতালার কী মহিমা! পরিস্তানের এক পরিকে মন দিয়ে অনুভব করছিল নুরুজ্জামান। কিন্তু শালীনতাবশে উঠোন থেকে সে একটু সরে কুয়োতলায় গেল। একটু কাশল। বাড়িটা যেন জনহীন। রোজির কোরান-পাঠের মৃদু ধ্বনিপুঞ্জে সারা বাড়ি পবিত্রতার মধ্যে ঝুঁদ হয়ে আছে। তার কাশির শব্দটুকু কোনো পৃথক স্পন্দন তুলল না। তিনটি ঘরের একটি দলিজ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেখানেই বালিকাবধূ নিয়ে রাত্রিযাপন করে নুরুজ্জামান। মাঝের ঘরটিতে থাকে মনিরুজ্জামান আর তার বালিকাবধূ। শেষ ঘরটিতে দাদি আম্মা কামরুন্নিসা আর মা সাইদা বেগম। বাড়িতেও রোদ আসেনি। ধূসর আলোর ভেতর দরজাখোলা তিনটি ঘরের ভেতর ঘন কালো ছায়া থমথম করছে। তবু নুরুজ্জামান দেখতে গেল, সাইদা তার শাশুড়ির একাঙ্গ ডলে দিচ্ছেন। মাঝের ঘরে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এক মুহূর্তের জন্য নুরুজ্জামানের মাথায় এল, তার ভ্রাতৃবধূ আজও সম্ভবত কোরান পাঠ করেনি। কিছুদিন থেকে থেকে এ ব্যাপারটা চোখে পড়েছে তার। রোজ দুই বোন পাশাপাশি বসে ভোরবেলায় কোরান পাঠ করত। হঠাৎ এমন ঘটছে কেন? রোজিকে জিগ্যেস করবে দুইবোনে ঝগড়াঝাটি হয়েছে নাকি।

সেই মুহূর্তে মাঝের ঘর থেকে এলোমেলো কাপড়, খোঁপাভাঙা চুল, বেরিয়ে এল রুকু। এসেই ভাসুরসায়েবকে দেখে থমকে গেল। তারপর আবার ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতর থেকে এইসময় গোঙানির মতো ভুতুড়ে হাসির শব্দ ভেসে এল। নুরুজ্জামান বিকৃতমুখে গলার ভেতর বলল, জানোয়ার!

রোজির কোরান পাঠ শেষ। কোরান বন্ধ করে সে সেই পবিত্র ঐশীগ্রন্থটিকে চুম্বন করে কপালে ঠেকাল। তারপর নকশাদার লাল রেশমি কাপড়ের আধারে ঢুকিয়ে শেষপ্রান্তের সরু চিকন দড়িটি দিয়ে জড়াল। রেহেল বা কাঠের পুস্তকাধারটিও ভাঁজ করে নিয়ে বারান্দার তাকে রাখল। গালিচাটি গুটিয়ে ঘরে নিয়ে যাবার সময় সে ঘুরে দেখতে পেল, তার স্বামী তাকে অনুসরণ করছে। একটু হাসল রোজি। তারপর নিজের ঘরে ঢুকল।

নুরুজ্জামান ঘরে ঢুকেই তক্তাপোশের বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে। সে। হাসছিল না। রোজি গালিচাটি রেখে তার পাশে এসে বসে পড়ল এবং বুকের ওপর ঝুঁকে চাপা স্বরে বলল, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন গো?

নুরুজ্জামান আস্তে বলল, কিছু না।

আপনি আমার উপর গোঁসা করেছেন?

এবার নুরুজ্জামান একটু হাসল। তোমার ওপর গোঁসা করার হিম্মত কার? এইসা নেক আউরত তুম!

রোজি তার তরুণ স্বামীর দাড়িসুষ্ঠু চিবুক ধরে বলল, আবার ওই খোট্টাপনা? ওসব করবেন মসজিদে গিয়ে। আমার কাছে নয়।

নুরুজ্জামান হাসল। মুসলমানের জবান, রোজি।

রোজি কপট অভিমান দেখিয়ে বলল, তো যে-মুলুকে ছিলেন সেই মুলুক থেকে কাউকে শাদি করে আনলেই পারতেন।

নুরুজ্জামান রোজিকে বুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলে রোজি নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ভ্রূ কুঞ্চিত। যেন বলতে চায়, দরজা খোলা। কেউ এসে পড়লেই কেলেংকারি হবে না বুঝি?

নুরুজ্জামান একটু চুপ করে থাকার পর বলল, একটা বাত পুছ করব রোজি!

কী?

বহিনের সাথ কি তোমার কাজিয়া হয়েছে?

মুহূর্তে রোজি একটু গম্ভীর হয়ে গেল। স্বামীর শাদা কোর্তার বোম খুঁটতে খুঁটতে মাথাটা শুধু নাড়ল।

নুরুজ্জামান বলল, তোমরা একসাথ কোরান তেলাওয়াত (পাঠ) করছ না! আলগ-আলগ থাকছ।

রোজি দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বুকুকে আটকে রখে।

নুরুজ্জামান দ্রুত উঠে এসে বসল। বলল, কে? ওই কমবখত শয়তানটা?

চুপ। বলে রোজি উঠে দাঁড়াল। কই সরুন বিছানা গুছোই। সুজনিটা ময়লা হয়েছে। কাঁচতে হবে।

নুরুজ্জামানের টুপিটা বালিশে পড়ে গিয়েছিল। সে সেটি তুলে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধভাবে বলল, এইসা নাহি চলে গা। আমি এসব বরদাস্ত করব না।

রোজি ধমকের ভঙ্গিতে বলল, আপনি আসুন তো। কেলেংকারি যা হবার হচ্ছে, আর বাড়াবেন না।

নুরুজ্জামান অবাক হল।…কী হচ্ছে?

রোজি জবাব দিল না। সুজনি গোটাতে ব্যস্ত হল। বাইরে সাইদার গলা শোনা গেল, বড়ো বউবিবি! একবার আসবে, মা?

রোজি সুজনি নিয়ে বেরিয়ে গেল শাশুড়ির ডাকে। সাইদা বললেন, আমার হাতে মালিশের তেল। সাজিমাটি দিয়ে না ধুলে যাবে না। ততক্ষণ তুমি নাশতার জন্য আটা মাখো। বিবিজি আজ পরোটা-হালুয়া খেতে চেয়েছেন। বয়োমে ঘি আছে দেখো গে ।

সাইদা কুয়োতলায় গেলেন। রোজি সুজনিটা বারান্দায় রেখে ডাকল, রুকু!

ভেতর থেকে আওয়াজ এল, যাই!

একটু পরে সে বেরুল। রোজি বলল, আয়, নাশতা বানাতে হবে।

দুজনে রান্নাঘরের বারান্দায় গেছে, এমন সময় নড়বড় করে চৌকাঠ ধরে বেরিয়ে এল মনিরুজ্জামান। সে এখন কোনোরকমে টলতে-টলতে হাঁটতে পারে। গত জুম্মায় বড়োভাই নুরুজ্জামান তাকে মসজিদে নিয়ে গিয়েছিল। দেওবন্দ থেকে ফিরে মনিরুজ্জমানকে মুসল্লি বানানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছে নুরুজ্জামান। নামাজ, দোওয়াদরুদ আবৃত্তি করা শেখাচ্ছে। জড়ানো গলায় অনেক কষ্টে দু-চারটি বাক্য উচ্চারণ করতে পারে সে, অনবরত লালা গড়ায় যার মুখে, তাকে ঐশীবাণী আবৃত্তি শেখানো সহজ নয়, নুরুজ্জামান বুঝতে পারে। তবু এইটুকু উন্নতি দেখে সে খুবই অবাক হয়ে গেছে। পিতার সঙ্গে জ্যোতির্ময় জিনেদের গোপন সম্পর্ক এখন তার বিশ্বাস্য মনে হয়।

মনিরুজ্জামানের পরনে ডোরাকাটা তহবন্দ। খালি গা। সে বারান্দায় পা বাড়ালে কুয়োতলা থেকে সাইদা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, অই! অই! অ মেজোবউবিবি দ্যাখো, দ্যাখো কোথা যাচ্ছে!

মনিরুজ্জামান গোঙানো গলায় উচ্চারণ করল, মুঁ ধোঁ-ধোঁ–

মুখ ধুবি তো ওখানেই বস। সাইদা ধমক দিলেন। বস ওখানে। পানি দিচ্ছি।

মনিরুজ্জামান গ্রাহ্য করল না। বেপরোয়া ভঙ্গিতে বারান্দার বাঁশের খুঁটি ধরে সিঁড়িতে পা রাখল। তারপর টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে নিচে পড়ল। সাইদা আর্তনাদ করে দৌড়ে এলেন। নিজের ঘর থেকে নুরুজ্জামান একবার উঁকি মেরে ব্যাপারটা দেখল শুধু।

সাইদা ধরতে গেলে মনিরুজ্জামান একটা চাপা হুংকার দিল। বোঝা গেল, সে এই দুনিয়ায় পা ফেলে হাঁটার জন্য অন্যের ভরসা করতে রাজি নয়। মায়ের হাতটা সে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। তারপর হাঁচড়-পাঁচড় করে উঠে দাঁড়াল। নড়বড় করে পা ফেলে কুয়োতলার দিকে এগোতে থাকল।

রান্নাঘরের বারান্দায় আটা মাখতে মাখতে দৃশ্যটা রোজি দেখছিল। মুখ টিপে হাসছিল। আর রুকু উঠোনের দিকে পিঠ করে বসেছে পিঁড়িতে। উনুনে খুঁটে সাজাচ্ছে। এবারও ঘুরল না এদিকে। তার মুখে নির্লিপ্ততার গাঢ় ছাপ। রোজি ফিসফিস করে বলে উঠল, তোর দামাদ (বর) খেপল কেন রে? তখন কানে আসছিল, দুজনে খুব যুদ্ধ করছিলি যেন!

রুকু বলল, বেশ করছিলাম। তাতে তোর কী?

রোজি হাসল। তারপর ঠোঁট উলটে বলল, আমার আবার কী? কানে এল, তাই বলছি।

রুকু শলাইকাঠি জ্বেলে একগোছ খড়ের নুড়ি ঢোকাচ্ছিল উনুনের ভেতর সাজানো ঘুঁটের স্কুপে। বলল, চিরকাল আড়িপাতা তোর স্বভাব।

রোজি চাপা হাসতে লাগল। আব্বাসায়েব ফিরে এলে বলিস, কালো জিনটা এখনও পালায়নি তোর দামাঁদের কাছ থেকে।

রুকু ঝাঁঝালো স্বরে বলল, ভালো হবে না বলছি, রোজি!

বেশ বাবা, বেশ। তোমার দায় তুমি সামলাও। আমার কী? বলে রোজি পরোটা বেলতে থাকল। দুলতে-দুলতে কাজ করা তার স্বভাব।

সাইদা প্রতিবন্ধী পুত্রের সঙ্গ ছাড়েননি। কুয়োতলায় তাকে আগের মতো মুখ ধুইয়ে না দিলেও পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তবে তিনি মনে-মনে এখন ভারি খুশি। খোঁড়া পিরের দরগায় গোপন মানত অথবা কোবরেজমশাইয়ের ওষুধের গুণেই হোক, এতকাল পরে মনি যে হাঁটতে বা কথা বলতে পারছে, এ এক বিস্ময় তাঁর। তবে এজন্য তিনি দরিয়াবানুর কাছে ঋণীও বটে। কতবার করে বলেন, তোমার গুণ কী দিয়ে শুধব বেয়ান? রোজ কেয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে দাঁড়িয়ে খোদাতালাকে বলব, আমি যেটুকু নেকি (পুণ্য) করেছি, তার অদ্ধেক আমার বেয়ানকে দিচ্ছি! দরিয়াবানু বলে, ওকথা বলতে নেই বেয়ান! আমি মুরুক্ষু চাষার বেটি । রাতজোরে মিয়াঁর ঘর করতে এসেছিলাম। তবে হ্যাঁ, এটুকুন জানি– কিসে কী হয়। যদি ছোটোবেলা থেকে ছেলেটাকে হাঁটাচলা শেখাতে, চেষ্টাচরিত্তির করতে– বাছার এমন দশা হত না!

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বিয়ের পরই যেন রাতারাতি বদলে গেছে মনিরুজ্জামান। লালা গড়ালে মুছতে পারে। হাতদুখানির নুলো দশা কিছুটা ঘুচে গেছে মালিশের গুণে। নিজের হাতেই খেতে চেষ্টা করে। যেন স্বাভাবিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য তার আত্মার ভেতর কী এক উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটেছে।

কিন্তু সেই উদ্দীপনাই যেন তাকে ইদানীং কেমন হিংস্র করে ফেলেছে। মুখে হাত ঢুকিয়ে উনিশবছরের এই নালা ছেলেটি আর খ্যাখ্যা করে হাসে না। পাখ পাখালি দেখে আগের মতো অবাধ খুশিতে তার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। বরং হুংকার দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করে। গাইগোরুটির দুধ দুইয়ে দিত আয়মনি। তার হঠাৎ কি হয়েছে, পিরসাহেবের বাড়ির আনাচে-কানাচেও তাকে দেখা যায় না। আয়মনি দুধ দুইয়ে বিবিসাহেবাকে দুধভরা পেতলের পাত্রটি দিতে এলে বারান্দা থেকে মনি দুহাত নড়বড়িয়ে শিশুর মতো ছটফট করত। গোঙানো স্বরে দুধ খাওয়ার জন্য কিছু বলার চেষ্টা করত। আর আয়মনি তাকে সস্নেহে বলত, সবুর বাপাজান! একটুখানি সবুর! কাঁচা দুধ খেয়ে ছ্যারানি হবে জান না? কী যে হাসত আয়মনি এইসব কথা বলতে-বলতে! আর মনির মুখ থেকে লালা গড়াত। সে দুপাশে দুলত। হাতদুটো সামনে নাড়া দিত। পাছা ঘসটাতে-ঘসটাতে কখনও রান্নাঘরের দিকে এগোনোর তালে থাক। আয়মনি বলত, অই! অই! সাহস দেখছ ছেলের?

এখন দুধ দুইতে আসে দুলির মা নুরি। হাঁটুর নিচু অব্দি ডোরাকাটা তাঁতের খেয়রাপরা দুলির বুকে আয়মনির ভাষায় ‘কুসুমফুল ফুটেছে। তবু খালি গা ওই মেয়ের। শাড়ি পরালে নাকি ঝটপট ‘কুসুমফুল’ ডাগর হয়ে যাবে। নুরি দুধ দোহায়। তার মেয়ে বাছুরটার দুই কান ধরে আটকে রাখে। বাছুরটা তার পেটে ঢু মারে। পরশু এক কাণ্ড ঘটেছিল।

বাছুরের টুতে দুলির খেরো খুলে এক লজ্জা-লজ্জি ব্যাপার। রোজি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার আব্রু রক্ষা করেছিল। কিন্তু বারান্দায় বসে অভ্যাসে হাত চুষতে গিয়েই মনির যেই চোখ পড়ে, সে প্রচণ্ড এক হুংকার ছেড়েছিল। বাড়িতে সেই সময় যারা ছিল, প্রত্যেকে টের পেয়েছিল এ কিসের হুংকার। মনিরুজ্জামান মানুষে পরিণত হচ্ছে। মেয়েদের আবু বুঝতে পেরেছে সে।

ফেনিল দুধের পাত্রটি সামনে দিয়ে নিয়ে যেতে দেখলে এখন তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে বটে, কিন্তু চুপচাপ বসে থাকে। অপেক্ষা করে কখন মা তার জন্য গেলাসে করে দুধ আনবেন। চামচে করে ফুঁ দিয়ে খাওয়াবেন।

এদিন সে আরও আশ্চর্য এক কাণ্ড করল।

শাশুড়িকেও কাছে বসে খাওয়াতে হয়। পক্ষাঘাতের বুগি কামরুন্নিসা নিজের জীবিত একটি হাত দিয়ে খেতে পারেন, তবে গিলতে কষ্ট হয়। সাইদা তদারক করেন। তারপর খাওয়াতে যান মনিকে।

আজ মনি একটা হাত নেড়ে মাকে বুঝিয়ে দিল, তাঁর হাতে খাবে না। সাইদা ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, নে! তোর আজ আবার কী হল?

মনি গোঙানো স্বরে কিছু বলল।

বুঝতে না পেরে সাইদা রেগে গেলেন। আর কত জ্বালাবি তোরা আমাকে? তোদের জন্য আমার হাড়মাস কালি হয়ে গেল। এবারে গোরে গিয়ে ঢুকি, তবে তোদের শান্তি হয়– তাই না?

রোজি তার স্বামীকে নাশতা দিতে গিয়েছিল। সাইদার চড়া গলা শুনে বেরিয়ে এল। রুকু রান্নাঘরের বারান্দার উনুনে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। কোনদিকে লক্ষ্য নেই, শুধু আগুন দেখছে।

সাইদা ছেলের সামনে নাশতার থালা রেখে রান্নাঘরে গেলেন। রোজি দেখল, মনি চোখ বড়ো করে তাকিয়ে আছে –হ্যাঁ, রুকুরই দিকে। রোজি ঠোঁটের কোনায় হেসে এগিয়ে এল দেওরের কাছে। চাপা স্বরে বলল, কী মিয়াঁ? আজ বুঝি বিবির হাতে খানা খাওয়ার ধান্দা?

মনি গ্রাহ্য করল না তাকে। তখন রোজি আলতো পায়ে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় গেল। শাশুড়ি গম্ভীর মুখে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করছেন। রোজি পা বাড়িয়ে রুকুর পেছনটা ছুঁল। রুকু ঘুরে ওকে একবার দেখে নিয়ে বলল, কী?

সাইদা দুজনের দিকে তাকালে রোজি ঝটপট বলল, রুকুকে ডাকছেন মেজোমিয়াঁ।

সাইদা একটু চুপ করে থেকে খাস ছেড়ে বললেন, সে আমি কী বলব মা? তোমাদের ইচ্ছে। কেউ যদি ওর খিদমত (সেবা) করে, আমি তো বেঁচে যাই। এখন যা ভালো বোঝ, করো।

রুকু পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। সাইদা শাশুড়ির ঘরে গিয়ে ঢুকলে রোজি ধমক দিল বোনকে।-ইশ! শরমে গলে হালুয়া! নিজের দামদকে খাওয়াবে, তাতে শরম। কেন, আমি খাওয়াই না বড়োমিয়াঁকে?

রুকু কোনো জবাব দিল না। আঁচল বাড়িয়ে দুধের পাত্রটা উনুন থেকে নামাল। তারপর উঠোনে নেমে হনহন করে খিড়কির ঘাটের দিকে চলে গেল। রোজি শুধু বলল, দেখছ?

মনির নিষ্পলক চোখদুটো অনুসরণ করছিল রুকুকে। খিড়কি খুলে রুকু ঘাটে নামতেই চাপা হুংকার দিয়ে সে নাশতার থালাটায় লাথি মারল।

সাইদা দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। নিচের উঠোনে হালুয়া-পরোটা ছড়িয়ে পড়েছে। থালাটা উলটে গেছে। সাইদা জীবনে যা করেননি, করবেন বলে কল্পনাও করেননি, আজ তাই করে বসলেন। তাঁর পায়ে কালো চটিজুতো। একপাটি খুলে মেজোছেলের মাথায় মারতে শুরু করলেন।…জানোয়ার! শয়তান! আজ তোমার জান সুদ্ধ খতম করে দেব! মুখের রুজি তুমি ছুঁড়ে ফেলতে পারলে?

সাইদার সারা জীবনের জমানো রাগ ফেটে পড়ছিল বুঝি। কামরুন্নিসা চেঁচামেচি করে জানতে চাইছিলেন, কী হয়েছে? অ বউবিবি? হয়েছে কী? অ রোজি! অ রুকু!

মনি মায়ের চটিটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। পারছিল না। রান্নাঘরের বারান্দায় খুঁটি আঁকড়ে ধরে রোজি থ। তারপর মনি মায়ের কাপড় খামচে ধরল। গলায় বিকট গোঙানির আওয়াজ। নুরুজ্জামান এঁটো হাতে বেরিয়ে একমুহূর্ত দৃশ্যটা দেখল। সে চেঁচিয়ে উঠল, আম্মাজান! ইয়ে ক্যা হো-রাহা?

সে দৌড়ে এসে মাঝখানে দাঁড়াল। তারপর ভাইয়ের হিংস্র হাত থেকে মায়ের কাপড় মুক্ত করে বলল, তওবা! তওবা! এসব কী শুরু করেছেন আপনারা? ইজ্জত বরবাদ করে দিচ্ছেন। এ কি পির-মওলানা আশরাফ-মোখাদেমের বাড়ি, না চাষাবাড়ি? ছুঃ দুঃ!

নুরি তার মেয়েকে নিয়ে একটু আগে চলে গেছে। বাড়িতে এ মুহূর্তে বাইরের লোক নেই। নুরু ভাইয়ের হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ আগে যাকে সে জানোয়ার বলে গাল দিয়েছে, এখন তার জন্য দরদ জেগেছে মনে। কিন্তু মনি তার হাতে কামড় দিতে গেলে সে ঝটপট হাত সরিয়ে নিল। ফের খাপ্পা হয়ে বলল, অ্যাই উজবুক আকেলমন্দ বেতমিজ? কী হয়েছে তোের? উল্লুকা মাফিক কাম করছিস কেন? বেশরম খবিস কাহেকা!

সাইদা কাঁদতে-কাঁদতে শাশুড়ির কাছে ফিরে গেলেন। রোজি এতক্ষণে উঠোনে নেমে হালুয়া-পরোটা থালায় তুলে নিল। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি। উঠোনে ধুলো জমেছে। নাশতাটা তাই সাবধানেই তুলেছিল সে। এ বাড়ির শিক্ষা, মুখের বুজি নষ্ট করতে নেই। নিজে খেতে না পার, তো ফকিরমিশকিন লোককে দান করে দাও। নেকি হবে।

রোজি সেই কথা ভেবেই থালাটা রান্নাঘরে নিয়ে গেল। নুরু ফিরে গিয়ে অবশিষ্ট নাশতায় মন দিল। ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না সে। রোজির প্রতীক্ষা করতে করতে পরোটার শেষ টুকরোটা চিবুতে থাকল সে।….

ঘাটের মাথায় খিড়কির দরজার পাশেই কলাগাছগুলো বেশ ঝাঁক বেঁধে উঠেছে। রুকু সেখানে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া ঘটনাটা দেখছে। হঠাৎ তার ইচ্ছে করছিল, ছুটে গিয়ে ওই জমানুষটাকে বাঁচায়। কিন্তু ওকে পালটা আক্রমণ করতে দেখেই থমকে গেছে। মরুক। মেরে ফেলুক ওকে বিবিজি! রুকু মনে-মনে বলছিল।

তারপর সব শান্ত হয়ে গেছে। বাড়িটা চুপ। রুকু ব্যাপারটা দেখেছে, অন্তত রোজি যেন জানতে না পারে– এই ভেবে সে কলাগাছের আড়ালে সরে এল।

কিন্তু বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করছিল না তার। যদি পারত, পালিয়ে যেতে কোথাও। অন্তত একটা দিনের জন্যও যদি বাইরে কাটাতে পারত। মায়ের কাছে গেলে তো বকুনি পিটুনি দুই-ই খাবে। বাবাকে দুই বোনে শুধু দূর থেকেই জানত। মা-ই তাদের। সব। এতদিন মা তাদের শিয়রে ছিল। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে দিয়েছে। সেই স্বাধীনতা হঠাৎ কেড়ে নিয়ে তাদের দরদিনী মাও কেমন হিংস্র হয়ে উঠল– কেন এমন হল, রুকু আজও বুঝতে পারে না। বারিচাচাজির সঙ্গে ঝগড়াই কি এর কারণ? আরও অবাক লাগে, বারিচাচাজি আসাই ছেড়ে দিলেন মৌলাহাটে!

আর আয়মনিখালা! তারও কী হল, এবাড়ি আর আসে না। বিবিজি কি কিছু মন্দকথা বলেছেন ওকে? রুকু খুঁজে পায় না। কলাগাছের পাশে দাঁড়িয়ে রুকুর ইচ্ছে করছিল বুক ফেটে কাঁদে। কিন্তু কান্নাতেও আজকাল কী এক ভয়। সবকিছুতেই ভয়। দুনিয়াসুদ্ধ পর হয়ে গেলে যে ভয় মানুষকে পেয়ে বসে, সেই ভয় –কিংবা অন্য কোনো ভয়। সে পুকুরের ওপারে জঙ্গলের ভেতর খোঁড়াপিরের মাজারের। বটগাছটির দিকে তাকাল। মনে-মনে মাথা কুটল, পিরবাবা! আমাকে বাঁচাও। নইলে আমি হয়তো মরে যাব।

কখন রোজি নিঃশব্দে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, রুকু টের পায়নি। আস্তে একটি ডাক শুনে ভীষণ চমকে উঠল।

রোজির নাসারন্ধ্র স্ফুরিত। চোখ বড়ো। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, ঢঙ দেখে বাঁচিনে। কেন নিজের দামদকে খাওয়াতে অত শরম কিসের রে? খামোকা ওকে মার খাওয়ালি। গাঁসুদ্ধ রটতে দেরি হবে না জানিস? আর মায়ের কানে গেলেই হয়েছে। কী হবে বুঝতে পারছিস?

রুকু আর সামলাতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

রোজি চাপা গলায় ধমক দিল, চুপ! চুপ মুখপুড়ি! বাইরে এসে কাঁদতে শরম হয় না? কাঁদবি তো ঘরে ঢুকে কাঁদ গে না।

নুরির গলা শোনা গেল বাড়ির ভেতর। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেছে। এবার থালা হাঁড়িকুড়ি মাজতে আসবে ঘাটে। রোজি বোনের মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিসফিসিয়ে উঠল, চুপ! চুপ! নুরিখালা এসেছে। কেলেংকারি হয়ে যাবে।

রুকু ঝটপট ঘাটে গিয়ে নামল। হেমন্তের শুরুতে পুকুরটা এখনও জলে ভরা। ঘন দাম জমে আছে। ঘাটের সামনেটা শুধু পরিষ্কার। রুকু মুখ হাত পা রগড়ে ধুল। এ বাড়ি খালিপায়ে থাকার রীতি নেই। তার ওপর পিরমওলানা বাড়ির বউবিবি। রুক খালি পায়ে এসেছিল। চটিজোড়া রান্নাঘরের বারান্দায়, নাকি ঘরে খুলে এসেছে, মনে পড়ল না। :

সে উঠে দাঁড়ালে রোজি চাপা স্বরে বলল, মেজোমিয়াঁ খায়নি। চল্, আমি ফের নাশতা বেড়ে দিচ্ছি। তুই নিয়ে যাবি।

রুকু গলার ভেতর বলল, কচি বাচ্চা নাকি? আর-সবে তো–

চুপ! রোজি বোনকে ধমক দিল। যা বলছি, করবি। নইলে মাকে সব বলে পাঠাব।

সে রুকুকে যেন অদৃশ্য হাতে টানতে টানতে নিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে একটা থালায় দুটো পরোটা আর সুজির হালুয়া তুলে দিল রুকুর হাতে। বলল, তুই যা। আমি পানির গেলাস নিয়ে যাচ্ছি।

একটু ঠেলে দিলে রুকু পা বাড়াল। কামরুন্নিসা আর সাইদা চুপিচুপি কথা বলছিলেন। নাকঝাড়ার ফোঁসফোঁস শব্দ ভেসে আসছিল। নুরিকে বাসি হাঁড়ি বাসনকোসন এগিয়ে দিতে থাকল রোজি। একটা চোখ রুকুর দিকে। মেজোমিয়াঁ একটু আগে নিজের ঘরে ঢুকে গেছে। রুকু ঘরে ঢুকলে রোজি মাটির কলসি থেকে। কাঁচের গেলাসে জল ঢালতে ব্যস্ত হল।

গেলাসটা নিয়ে রাজি মুখ টিপে হেসে সোজা চলে গেল মেজোমিয়াঁর ঘরে। গিয়ে দেখল, বিছানায় বসে পা দুটো স্বাভাবিক মানুষের মতো ঝুলিয়ে একটু-একটু করে দোলাচ্ছে মনিরুজ্জামান। কিন্তু মুখটা নিচু। চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। লালার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আর তার সামনে মাথায় ঘোমটা টেনে নাশতার থালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে রুকু।

ন্যালা তরুণটিকে এভাবে কাঁদতে কখনও দেখেনি বোজি। মুহূর্তে তার মন নরম হয়ে গেল। আস্তে বলল, ছিঃ! কাঁদে না! আম্মা মেরেছেন, না অন্য কেউ? খান দিকি, নাশতা খান। দুনিয়ায় কার আম্মা কাকে মারেন না? এই যে আপনার শাশুড়ি– আমাদের মা –আমাদের দুবোনকে কম মারধর করেছেন?

রুকু অবাক হচ্ছিল। রোজির কণ্ঠস্বরে বুড়ি মেয়েমানুষের হাবভাব! তারপর রোজি তাকে ঠেলে দিল। বলল, যাঃ! হাতে নাশতা তুলে দে না!

তাই করতে গেলে মনি হাত নাড়ল। বুঝিয়ে দিল, খাবে না। তখন রোজি তার পাশে বসে পড়ল। কাঁধে হাত রেখে বলল, লক্ষি ভাইজান! আমি তোমার ভাবি হই। শুনবে না ভাবির কথা? তারপর হেসে উঠল সে ….এই মেয়েটাকে তুমি এখন চিনতে পারনি? বড় বদমাইশ মেয়ে। বুঝলে?

আর মনি তাদের দুজনকেই অবাক করে গোঙানো কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, টোঁ-টোঁ-টোঁমরা খেয়েছ?

রোজি হাসতে লাগল।….কথা শোনো মিয়াঁর! তুমি না খেলে আমরা খাব? গোনা হবে জান না? কত্তো বেলা হয়ে গেল! খিদে পায়নি বুঝি আমাদের? নাও– নাও! ও রুকু, পরোটা ছিঁড়ে টুকরো করে দে তোর দামদমিয়াঁকে।

মনি গোঁ ধরে বলল, টুঁ-টুঁমি ডাঁও!

তার মানে রুকুর ওপর তার রাগ এখনও পড়েনি। ভাবি তাকে খাইয়ে না দিলে সে খাবে না। রোজি হাসতে-হাসতে পরোটা টুকরো করতে থাকল।

.

এদিন থেকেই তেরো বছরের বালিকাবধূ রোজি এ সংসারে সাইদা বেগমের ঠাঁইটি দখল করে ফেলল যেন। শাশুড়ি আর দাদিশাশুড়িরও সেবাযত্ন তদারক সারাক্ষণ, কোমরে আঁচল জড়িয়ে ব্যস্ত গম্ভীর হয়ে ছুটোছুটি, নুরিকে কথায়-কথায় ধমক, কত কিছু। আর রুকু আরও উদাসীন নির্লিপ্ত। দুই যমজ বোনের মাঝখানে একটি অদৃশ্য পাঁচিল গড়ে উঠেছিল। প্রায়ই শিষ্যবাড়ি থেকে ধানচাল, বিবিধ খন্দ, গুড়ের হাঁড়ি এসে পৌঁছয়। কত দূর-দূরান্তর থেকে শিষ্যরা গোরুর গাড়ি বা টাটু ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে, নয়তো নিজেরাই বয়ে আনে হরেক গুরুপ্রণামী। সাইদার মতো আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে নেপথ্যের কণ্ঠস্বরে রোজি নির্দেশ দেয়, কোথায়। জিনিসগুলো রাখতে হবে। নুরুজ্জামান বাড়িতে থাকলেও এই খবরদারি রোজির। রুকু লক্ষ্য করে, রোজির মধ্যে তার মায়ের আদল ফুটে বেরুচ্ছে। প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা তাকে। খুব ভেতর থেকে তাতিয়ে দেয়। ভাবে, যদি সে ‘জ্যুমানুষটা’র বউ না হত, তাহলে সংসারে কর্তৃত্বের ন্যায্য শরিকানাটি দখল করত সেও হয়তো কোমরে আঁচল জড়াত। কিন্তু কী দরকার অত ঝামেলায় নাক গলিয়ে? বেশ তো আছে।

না–সত্যিই সে ভালো নেই। যখন-তখন একটা জ্যুমানুষের কামার্ত আক্রমণ, এমন-কি রজস্বলা অবস্থাতেও রেহাই নেই। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে রুকু তার অবশ শরীর রেখে পালিয়ে যায়– পালাতেই থাকে, দূরে-বহুদূরে। কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছেই বা তার এই মানসিক সফর? খালি মনে হয়, খোঁড়াপিরের দরগায় ভাঙা ফটকে কাঠমল্লিকার ফুলবতী গাছের কাছে উলটো মুখে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। ভয় পেয়ে পিছু হটে ফিরে আসে নিজের। বেইজ্জত শরীরের ভেতর ঘৃণা, ঘৃণা আর ঘৃণা! নিজের ওপর, সবকিছুর ওপর।….।

অনেকদিন পরে আয়মনি এল খিড়কির দরজা দিয়ে। রোজি কুয়োতলার পাশে বিকেলের রোদে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। রুকু বারান্দায় সুজনি সেলাই করছিল। কদিন থেকে ওই নিয়ে লেগে আছে। কদিন থেকে কামরুন্নিসার বুকে ব্যথা-ব্যথা ভাব। তেল দিয়ে বুক ডলে দিচ্ছেন সাইদা। রোজি আয়মনিকে দেখে চোখ পাকিয়ে। বলল, সাপের পা দেখেছ, নাকি দিনে তারা দেখেছ আয়মনিখালা? যাও, যাও। অবেলায় আমরা মেহমান নিই নে!

আয়মনি একটু হাসল।…আসা হয় না মা! বাপজানের শরীল ভালো না। বলে সে রুকুর দিকে ঘুরল। বুকু, কেমন আছ মা?

রুকু আযমনিকে বলল, ভালো। সে আয়মনিকে দেখছিল। কেমন যেন নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে ওকে। সেই সাজগোজের ঘটা আর নেই। কপালে টিকলি নেই, কোমরে রুপোর চন্দ্রহার নেই, পায়ে নেই রুপোর মল! কানের সোনার বেলকুঁড়িটা নেই।

রোজির কাছেই দাঁড়িয়ে রইল আয়মনি। এইতেও রুকুর খারাপ লাগল। ওকে দেখেই বুকের ভেতরটা দুলে উঠছিল চাপা আবেগে। কত কথা জমে আছে মনে!

রোজি হাসতে-হাসতে ছড়া কেটে বলল, ‘এসো কুটুম বসো খাটে। পা ধোওগে ডোবার ঘাটে!

আয়মনি একটু হাসল। আমি কি কুটুম? পর বই তো লই।

রোজি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, তাহলে পরের বাড়ি এলে যে বড়ো?

এলাম একটুকুন কাজে।

আয়মনির কণ্ঠস্বরে কী একটা ছিল, রোজি আর রুকু একই সঙ্গে তার দিকে স্থির চোখে তাকাল। তারপর রোজি আস্তে বলল, কী কাজ আয়মনিখালা?

আয়মনি বলল, দরিবুবু পাঠাল। সনজেবেলা দুই বহিন একবার যেও।

দরিয়াবানু বেয়ানবাড়ি কদাচিৎ এসেছে। মেয়েদের বিয়ের পর এ অঞ্চলের প্রথা হল, বিনা আমন্ত্রণে আর অদ্ভুত বেয়ানরা পরস্পরের বাড়ি যাবে না। সাইদা সেই একবার মৌলাহাটে প্রথম পোঁছে গাড়ির ধুরিভাঙার দুর্ঘটনার দরুন দরিয়াবানুর বাড়ি উঠেছিলেন। ছিলেনও কয়েকটা দিন। কিন্তু তখনও তিনি ভাবতে পারেননি, এই চাষাঢ়ে স্বভাবের স্ত্রীলোকটি তার বেয়ান হবে। ছেলেদের বিয়ের সময়ও তিনি যাননি, যদিও বরপক্ষের সঙ্গে বাড়িতে মেয়েদেরও যাওয়ার নিয়ম। আসলে ওই বিয়েটা ছিল একটা হঠকারিতা। একটা আকস্মিক ঘটনামাত্র।

তবু যে দরিয়াবানু বেয়ানবাড়ি গায়ে চাদরমুড়ি দিয়ে কখনও এসেছে সেটা তার পক্ষেই সম্ভব। এসে ঈষৎ লজ্জা আর কুণ্ঠায় বলেছে, এখন আমি পিরসাহেবের বেয়ান। আগের মতো মাঠেঘাটে চাষবাসের তারকে বেরুতে শরম হয়,বহিন! বেয়াইসাহেবের কানে উঠলে উনিও শরমেন্দা হবেন। অথচ দেখো, বড় ক্ষেতিও হচ্ছে। মুনিশ-মাহিন্দার লুটেপুটে খাচ্ছে। সমিস্যেয় পড়েছি।

আরও কিছু সমস্যা ছিল তার স্বামীর স্থানীয় আত্মীয়দের নিয়ে। জমিজমার শরিকানা নিয়ে ঝুটঝামেলা বাধত। মৌলানা এবং ‘পির’ বদিউজ্জামান কুটুম্ব হওয়ায় গ্রামের লোক এখন দরিয়াবানুর দলে। তাই সেসব ঝামেলা বাইরে-বাইরে দেখা যায় না। এবার দরিয়াবানু তদারকের জন্য নিজে মাঠে যেতে পারে না বলে চৌধুরী আর খোনকার সায়েবর যেন আড়াল থেকে মুনিশমাহিন্দারকে প্ররোচনা দিচ্ছেন। ঠিকমতো নিড়ান দেওয়া হয় না। সেচ পড়ে না। এবার ধানের ফলন নিয়ে দরিয়াবানু ভাবনায় পড়ে গেছে।…..

আয়মনির কথা শুনে রোজি বলল, তুমি বিবিজিকে বলে যাও আয়মনিখালা! উনি না বললে যাব কেমন করে? আর শোনো, তুমি এসে নিয়ে যাবে– তবে যাব বলে দিচ্ছি, হ্যাঁ।

আয়মনি একটু হেসে সাইদাবেগমের ঘরে গেল। সাইদা তাকে দেখে বললেন, কী আয়মনি! এ বাড়ি আসা যে ছেড়েই দিয়েছ?

আয়মনি সে-কথা কানে করল না। চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে আদাব জানিয়ে বলল, দরিবুবু রোজি-রুকুকে সনজেবেলা একবার ডেকেছে। আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব –তাই বলতে এলাম বিবিজি!

সাইদা একটু হাসলেন। বেশ তো, যাবে, বলে শাশুড়ির বুক ডলে দেওয়ার কাজটা থামিয়ে মুখ তুললেন। নুরু বলছিল, সকালে তাকেও ডেকেছিল বেয়ান। কীসব ঝামেলা হচ্ছে উঁইখেত নিয়ে। তো নুরু বলল, ভুইখেতের আমি কী বুঝি? তবে শাশুড়ি বলছেন যখন, তখন বরঞ্চ

আয়মনি কথার ওপর বলল, হুঁ –তাও বলল দরিবুবু। আমি বলি কী বিবিজি, আপনার বড়ো ছেলে বরঞ্চ দরিবুবুর মাথার ওপর গিয়ে দাঁড়াক। মৌলবি হয়েছে বলে দুনিয়াদারি করতে নাইকো?

স্বামীর কথাগুলো মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সাইদার।…ইসলাম যেমন দুনিয়াদারি করতে বলছে মানুষকে, তেমনি আখেরাতের কাজও করতে বলেছে। তাই যে মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নমাজে বসে দুহাত তুলে মোনাজাত করে, সেই মোনাজাতের। মানে হল : ‘হে খোদা! আমাকে ইহকাল-পরকালের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো দান করো।’

ইসলাম দুনিয়াদারিও চায়। দুনিয়ার সেরা জিনিসগুলোও ভোগ করতে চায়। বদিউজ্জামান পরক্ষণে হাসতে-হাসতে বললেন, তবে আমার যেন দুনিয়াদারি সয় না। বড়ো ঝকমারি লাগে।

সাইদা বললেন, হ্যাঁ– নুরু বলছিল, এবার থেকে শাশুড়ির বিষয়-সম্পত্তির দেখাশোনা করতে হবে। মৌলাহাটওয়ালা ফরাজি হয়েছে। মনটা তো রাতারাতি বদলায় না।

আপনার মাথা খারাপ, বিবিজি? আয়মনি বলল। তার কণ্ঠস্বরে ঝাঁঝ ছিল। মুখে সব আল্লা আমিন করছে, এদিকে ভেতর-ভেতর যা ছিল তাই। লোকদেখানো ভড়ং। এখন পিরসায়েব সফরে বেরিয়েছেন। গিয়ে দেখে আসুন গে, রাস্তায়-রাস্তায় মাঠে-ঘাটে আবার মেয়েলোকগুলো বেশরম ঘুরছে।

পেছন থেকে রোজি বলে উঠল, তুমিও বুঝি বেপরদা হয়ে ঘোর না আয়মনিখালা?

রোজি হাসছিল। আয়মনি বিব্রতভাবে কী বলতে যাচ্ছিল, সাইদা মৃদু ভসনার ভঙ্গতে বললেন, ছি বউবিবি! আয়মনি বড়ো ভালো মেয়ে। আর বেপরদা হয়ে ঘোরে তো কী হয়েছে? চাষিবাড়ির বউঝিরা পরদা করে বসে থাকলে সংসার চলবে?

রোজি হাসতে-হাসতে সরে গেল। আয়মনি পিরজননীর হালহকিকতের খবর নিয়ে রুকুর কাছে গেল। উঁকি মেরে দেখেও নিল, ঘরের ভেতর বিছানায় বসে ন্যালা দামদমিয়াঁটি ঠ্যাঙ দোলাচ্ছে। আয়মনি রুকুর কাছে দাঁড়ালে রুকু একবার নির্লিপ্ত মুখ তুলে তাকে দেখে নিল। তারপর লাল সুতোয় পদ্মফুল তৈরি করতে ব্যস্ত হল। আয়মনি একটা শ্বাস ছেড়ে আস্তে বলল, আসি রুকু। সনজেবেলা এসে তোমাদের নিয়ে যাব।–

.

হেমন্তসন্ধ্যায় এদিন আকাশে ঝলমলিয়ে চাঁদ উঠেছে। অলিগলি রাস্তা, তারপর। পুকুরপাড় দিয়ে ঘুরে আয়মনি দুবোনকে চুপচাপ নিয়ে যাচ্ছিল তাদের মায়ের কাছে।

খিড়কির দরজায় লণ্ঠন রেখে দরিয়াবানু প্রতীক্ষা করছিল। পুকুরের জল ছুঁয়ে আসা একঝলক হাওয়া হঠাৎ হিম দিয়ে চলে গেল তার বাড়ির ভেতর। কেন যেন। শিউরে উঠল দয়াবানু। চাঁদের আলোয় আবছা তিনটি মূর্তি সামনে দেখেও দরিয়াবানু চুপ।

আয়মনি বলল, কী হল দরিবুবু?

দরিয়াবান লণ্ঠনটি তুলল। দুই মেয়েকে দেখল। তারপর বলল, আয়।

বারান্দায় লক্ষ্যের আলোয় বসে মাহিন্দার বরকত গায়ে তেল মাখছে। শোবার আগে এই কাজটা সে করে। উঠোনে দুটো ধানের মরাই। তার ওপাশে দেয়াল ঘেঁষে। হাঁসমুরগির দরমা। পেছনে গোয়ালঘর। এ বাড়ির চাল টিনের। মেঝেয় লাইমকংক্রিটের ওপর লাল পলেস্তারা। দুই বোনই লক্ষ করল, পলেস্তারা চটে গেছে অনেক জায়গায়। ঘরে ঢুকে লণ্ঠনটি রেখে দরিয়াবানু হঠাৎ রুকুকেই বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রোজি আর আয়মমি একটু অবাক।

একটু পরে চোখ মুছে রুকুকে, তারপর রোজিকে টেনে পাশে বসাল দরিয়াবানু। আয়মনি চৌকাঠের কাছে বসল কপাটে হেলান দিয়ে। দরিয়াবানু ধরা গলায় বললেন, দুপুরবেলা হঠাৎ দেওয়ানসায়েব এসেছিল ঘোড়ায় চেপে।

রোজি চমকখাওয়া স্বরে বলল, বারিচাচাজি?

দরিয়াবানু তার থান কাপড়ের আঁচল খুঁটতে-খুঁটতে মুখ নামিয়ে বলল, আবার কাজিয়া করে গেল। বললে কী, একটা ছেলের জিন্দেগি আমি নষ্ট করে দিয়েছি। এটার ছাস্তি আমাকে না দিয়ে ছাড়বে না। চাষার বেটি, মুরুক্ষু হারামজাদি বলে একশো গালমন্দ!

রোজি খাপ্পা হয়ে বলল, তুমি কিছু বললে না?

দরিয়াবানু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কী বলব মা? আমিই তো মেয়েটাকে আবার হু হু করে কেঁদে ফেলল সে।

রোজি বলল, মা! মা! তুমি কিছু করনি। রুকু তো ভালো আছে। মেজোমিয়াঁও ভালো হয়ে গেছে কত্তো। রুকু, তুই বল না মাকে। চুপ করে আছিস কেন?

রুকু চুপ। আয়মনি একটু হেসে বলল, ছাড়ো তো দরিবুবু! দেওয়ানসাহেব লবাববাহাদুরের লোক– লববাহাদুর তো লয়কো যে তাকে এত ডর? কী ক্ষেতি সে করতে পারে? ভুইখেত যা-কিছু, সবই তো তোমার লিজের নামে কেনা। তুমার বিটিজামাইরাই তা ভোগ করবে।

দরিয়াবাবু রুকুর দিকে ঘুরল। আবার তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তব রুকু চুপ। রোজি আর আয়মনিও।

কিছুক্ষণ পরে শান্ত হয়ে আবার চোখ মুছে দরিয়াবানু উঠে দাঁড়াল। আস্তে বলল, খইয়ের লাডু বানিয়ে রেখেছি। পাঠাইনি। আপন হাতে খাওয়াব বলে।

সিকেয় ঝুলন্ত হাঁড়ি নামিয়ে সেটি নিয়ে এল দরিয়াবানু। একটা নাড়ু রুকুর, আরেকটা রোজির মুখে গুঁজে দিল। আয়মনিকে বলল; বারান্ডায় কলসিতে পানি আছে। ওই দ্যাখ কাঁসার গেলাস। পানি নিয়ে আয় তত বহিন!

আয়মনি ব্যস্তভাবে আদেশ পালন করতে গেল। দরিয়াবানু বলল, সকালে নুরুকে ডেকেছিলাম। বললাম, আমার তো আর কেউ নাইকো বাপজান তুমরা ছাড়া। পিরসাহেব দুনিয়াদারির ধার ধারেন না। কিন্তুক তুমাকে ভিনরাস্তায় হাঁটতে হবে– নইলে জো নাইকো। নুরু বলল, তার আপিত্য নাইকো। বললে পরে এবাড়ি এসেই থাকবে।

রোজি বলল, বিবিজির তবিয়ত ভালো না। দাদিশাশুড়িরও এখন-তখন অবস্থা। আমরা এলে চলবে?

দরিয়াবানু রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, রুকু তো আছে।

বলে সে রুকুর মাথায় হাত বুলোতে থাকল। রুকু লাড়ু চিবুচ্ছিল। তেমনি নিপ। আয়মনি দু’ গেলাস জল খাটের পাশে প্রকাণ্ড সিন্দুকটার ওপর রেখে বলল, খুব ভালো কথা বুলেছ দরিবুবু। ইটা একটা কাজের কথা বটে।

দরিয়াবানু রুকুর উদ্দেশে বলল, দেল (হৃদয়) শক্ত করো, বেটি! এই যে আমাকে দেখছ– আমি কী করে সংসার সামলেছি। তোমার আব্বাজান কী করে বেড়াত, মনে করে দ্যাখো। সেইসব কথা ভেবে বড়ো হও। বরাত বেটি! আমারই ভুলে তোর এই কষ্ট।

রোজি বলল, কিসের কষ্ট? ও কিছু না।

দরিয়াবানু ভাঙা গলায় বলল, সব কানে আসে! গাঁয়ের লোক কত হাসাহাসি করে। লোকু ছড়াদার সঙের গান বেঁধেছে। কুচ্ছোর শেষ নাইকো আমার নামে! রাগে দুঃখে ঘেন্নায় ছাতি ফেটে যায় রে!….

.

রোজির তাড়ায় বেরুনো গেল। বেশ রাত্তির হয়ে গেছে। হাঁড়ির নাডু বয়ে নিয়ে গেল আয়মনি। এবার তার হাতে দরিয়াবানুর লণ্ঠন। পুকুরপাড় থেকে চাঁদের আলোয় খিড়কির ধারে দাঁড়ানো মায়ের আবছা মূতিটা চোখে পড়ছিল দু’বোনের। রুকু বার-বার ঘুরে দেখছিল। মায়ের এই চেহারা সে কোনো দিন দ্যাখেনি। তাছাড়া মায়ের শরীর থেকে কী যেন একটা গন্ধ তীব্র হয়ে তাকে অনুসরণ করছিল। তার মা কি আতর মেখেছে?

সে রাতে রুকু ঘুমোতে পারছিল না। মায়ের শরীরের সেই অদ্ভুত গন্ধটার কথা ভাবছিল। পাশের জম্ভমানুষটি এ রাতে তার বউকে জ্বালাতন করেনি। কোবরেজের বড়ি নিজেই চেয়ে নিয়ে খেয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছ। মাঝরাতে হিমটা আরও ঘন হল। সেই হিম বুকুকে ধীরে ঘুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল। ঘ্রাণটাও হারিয়ে গেল।

আর সেই ঘুম ভোরবেলা ভেঙে গেল রুকুর। রোজির কোরানপাঠের সুর শুনে নয়, কী একটা প্রচণ্ড চেঁচামেচিতে। নুরি কান্নাকাটি করে কী একটা বলছে শুনতে পেল। বেরিয়ে যেতেই নুরি হাহাকার করে বলে উঠল, ওরে বেটিরা! তোদের কপাল ভেঙেছে রে! তোদের মা ডুমুরগাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে রে!

রুকু একপলক শুধু দেখল রোজিকে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গিয়েছিল, কাল জোৎস্নারাতে পুকুরপাড়ে ডুমুর গাছটার পাশ দিয়ে আসার সময় কী একটা ঘ্রাণ পেয়েছিল, বুঝতে পারেনি। এখন বুঝল, সে ছিল তার মায়ের গায়ের ঝাঝালো ঘ্রাণ– মৃত্যুর ঘ্রাণ ।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *