১৯. স্বাধীন মূর্ছিতা রত্নময়ীর চেতনা

We are the bird’s eggs, flowers, butterflies…
we are leaves of ivy and sprigs of wallflower.
…lilies and roses and peach, we are air.
We are flame… We are Woman and
Nature. And he says he cannot hear us speak.
But we speak.
Woman and Nature- Susan Griffn.

কে আপনি?

মানুষ।

কী মানুষ?

পুরুষমানুষ।

জাতি?

মানুষ।

ধর্ম?

মানুষত্ব।

দেশ?

পৃথিবী।

স্বাধীন মূর্ছিতা রত্নময়ীর চেতনা ফেরাতে গেলে সে উঠে বসে এবং আমার। দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্নগুলি করে এবং ওই উত্তরগুলি দিই। মনে হয় দুজনেই এভাবে একপ্রকার খেলা করছিলাম। স্বাধীন মুখ টিপে হাসছিল। রত্নময়ীর শেষ বাক্যটি ছিল : পৃথিবী একটি আবর্তনশীল গ্রহ এবং মানুষ দ্বিপদ প্রাণী-মাত্র। সম্ভবত উহার মুখ দিয়া ‘জিনটিই’ বাক্যগুলি উচ্চারণ করিতেছিল। স্পষ্ট মনে আছে, ধর্মের প্রশ্নে আমি ‘মনুষ্যত্ব’ বলিনি, ‘মানুষত্ব’ বলেছিলাম। এ দুয়ের তফাত আছে।

গিয়াসপণ্ডিত হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করতেন। তিনি বাবু গোবিন্দরাম। সিংহকে রত্নময়ীকে চিকিৎসার জন্য অনুরোধ জানান। বলেন, এই ব্যধির নাম হিসটিরিয়া। হোমিওপ্যাথিতে এর উৎকৃষ্ট ওষুধ হল ইগনেশিয়া। শুনেছি, গিয়াসপণ্ডিত কয়েক ডোজ ওষুধও দিয়েছিলেন। পরে গোবিন্দরাম রত্নময়ীকে নিয়ে। কৃষ্ণপুর রাজবাড়িতে ফিরে গেলে একদিন গিয়াসপণ্ডিত আশ্রমের একটি বৈঠকে কথাপ্রসঙ্গে বলেন, পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা বহু দুঃখক্লেশ-সন্তাপ মুখ বুজে সহ্য। করতে বাধ্য হয় এবং পরিণামে সেইগুলিন মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি করে। সেই বৈঠকেই দেবনারায়ণদা সহসা একটি অদ্ভুত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আমি বাকরহিত এবং কুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসি। প্রস্তাবটি হল, গিয়াস-কন্যা রেহানার সঙ্গে আমার বিবাহ!

ব্ৰহ্মপুরে ক’ মাস পরে দেবনারায়ণদা একটি হাট বসান। ক্রমশ কিছু দোকানপাটও বসতে থাকে। সামান্য সেলামি আর বার্ষিক খাজনায় দেবনারাযণদা মাটির বন্দোবস্ত করতে ব্যর্থ ছিলেন। বুঝতে পারতাম, তার ধর্ম প্রচারণাকে উত্তরোত্তর আর্থিক চাপ দাবিয়ে রাখছে। তাঁর পরিকল্পিত স্বর্গরাষ্ট্রে এভাবেই নাবকীয় সংক্রমণ ঘটছিল। ব্রাহ্ম বালক আর বালিকাদের দুটি পৃথক বিদ্যালয় ছিল। সেখানে অ-ব্রাহ্ম ছাত্র-ছাত্রীদের নেওযা হতে থাকে। যে বাঁজা ডাঙ্গায় শিবনাথ শাস্ত্রী বক্তৃতা করেছিলেন, এক বছরের মধ্যে সেটি বসতিতে পরিণত হয়। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের দাপট বাড়তে থাকে। সেখানে দেবদেবীর পূজাও শুরু হয়। কিন্তু আশ্রম এলাকাকে দেবনারায়ণদা কঠোর হাতে রক্ষা করতেন। তাহলেও ক্রমশ তাঁর প্রিয় আবাদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। দুর্ধর্ষ বাঁকা সর্দার বিজয়পল্লীতে চৈত্রসংক্রান্তিতে শিবের গাজন চালু করে। সঙের দলের মজা দেখতে খুব ভিড় হয়েছিল। কুদ্ধ দেবনারায়ণ পাইকদল পাঠান, দাঙ্গার উপক্রম হয়। ব্রহ্মপুরের ভদ্রলোকেরা গিয়ে রক্ষা করেন। তারপর ব্রহ্মপুরে একটি পুলিশ-ফাঁডি বসে।

আদিবাসীরাও নিজেদের ধর্ম পালন করত। মুরগি বলি দিত। মাঝে-মাঝে তাদের সঙ্গে বাঁকার দলের দাঙ্গা বাধত। তীর-ধনুক-টাঙ্গি হাতে সাঁওতালরা দুর্ভেদ্য পাঁচিলের মতো দাঁড়াত। খুনখারাপি হত। এভাবে আবাদে অশান্তি বাড়ছিল। কিন্তু দেবনারায়ণ তবু তার স্বর্গরাষ্ট্রস্থাপনে বিশ্বাস হারাননি। তাঁত-কারখানা, তালাই আর মাদুর তৈরি, সমবায়কৃষিঋণ দানসমিতি– এসব কাজে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। স্ট্যানলির নুরপুর রেশমকুঠি কিনেছিলেন এক হিন্দু জমিদার। চালাতে পারেননি। সেখান থেকে দলেদলে হিন্দু তাঁতি আর মুসলিম জোলারা এসে ব্রহ্মপুরে ভিড় করে। প্রায় একশোটি তাঁতে সারাক্ষণ মাকুর খটাখট শব্দ শোনা যেত। সুতোকাটুনি মেয়েরা খোলা মাঠে বা গাছতলায় বসে সুর ধরে গান গাইতে-গাইতে চরকায় সুতো কাটত।

একদিন সেই সুতোকাটুনিদের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখে চমকে উঠি। তাকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল। তাঁত-কারখানার জন্য দেবনারায়ণ একজন ম্যানেজার নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর নাম বসন্ত প্রামাণিক। কালো, লম্বাটে এবং মোটা হাড়ের কাঠামো এই লোকটির মেজাজ ছিল রুক্ষ। আশ্রম এলাকায় তিনিই প্যানট কোট পরে। থাকতেন। তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন না। দেবনারায়ণদার মতে, বসন্তবাবু অভিজ্ঞ এবং দক্ষ লোক। তবে তিনি আমার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে চলতেন। তখন আমি আশ্রম লাইব্রেরিয়ান। মাসে আর হাতখরচ নয়, রীতিমতো পনেরো টাকা বেতন পাই। সেই কয়েকটি বৎসর আমি গ্রন্থকীটে পরিণত হয়েছিলাম। তো সেকথা থাক। একদিন দুপুরে গাছতলায় ওই সুতো-কাটুনিকে দেখার পর বসন্তবাবুকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করি! তখন বসন্তবাবু আমাকে প্রচণ্ড অবাক করে বলেন, সে কী! করুণাকে আপনি চেনেন না? কে না চেনে ওকে? ও আপনার স্বজাতির মেয়ে। দেবনারায়ণবাবু ওকে হিন্দু ধর্মে– অবশ্য ব্রাহ্মধর্মেই বলা উচিত, দীক্ষিত করেছেন। তবে কাউকে বলবেন না যেন, ওর স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়। বসন্তবাবুর চেহারাতেও রুক্ষতা ছিল। হাসলে মনে হত, কামড়াতে আসছেন। সেই হাসি হেসে ফের বললেন, সুতোকাটুনিরা গোপনে আমাকে বলেছে, করুণা ডাকিনীবিদ্যা জানে। নিশুতি রাত্তিরে নাকি গাছে চড়ে সে। সেই গাছ আকাশে উড়িয়ে কামরূপ-কামাখ্যায় যায়। ভোরের আগে ফিরে আসে। অল সর্টস অফ ননসেনস টকিংস! আই ডোনট বিলিভ শফিবাবু! আসলে মেয়েটা চরিত্রহীনা। আপনি দেখবেন, শি উইল ডিমরালাইজ গ হোল সেটলমেনট। আমার মশায় কর্তার ইচ্ছায় কম্ম। দেববাবুর সুনজরে না থাকলে ওকে অ্যাদ্দিন তাড়িয়ে দিতাম।

হুঁ, চিনলাম। এ নিশ্চয় মৌলাহাটের সেই আবদুলের বউ ইকরা। কিন্তু মেয়েটি ধূর্ত এবং সাতিশয় কপট। বিকেলে সুতোকাটুনিরা সুতো জমা দিতে কারখানার সামনে ভিড় করে। সে সুতো জমা দিয়ে কাটুনিপাড়ার দিকে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল। বেলা পড়ে এসেছে। খালের এধারে উঁচু জমির ওপর ছিটেবেড়ার ছোট ছোটো ঘর। আগাছার ঝোঁপের ভিতর দিয়ে একফালি সংকীর্ণ পায়েচলা পথ। আমার পায়ের শব্দে সে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে বললাম, ইকরা, আমাকে চিনতে পারছ?

সে ভুরু কুঁচকে সেই বেড়ালের মতো পিঙ্গল দুটি চোখে আগুনের ছটা এনে বলল, কে ইকরা? আমার নাম করুণা।

ইকরা! আমি মৌলাহাটে শফি! আমি তোমাকে যেমন চিনি, তুমিও আমাকে চেন!

বাজে কথা বলবেন না, বাবু! এক্ষুণি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব।

ক্রোধ সংবরণ কবে চলে এলাম। বুঝলাম এই নারী ভয়ংকরী। ভাবলাম, দেবনারাযণদাকে এর সম্পর্কে সতর্ক করা দবকার। কিন্তু ওই কালে বহির্জগৎ সম্পর্কে এক প্রগাঢ় নির্লিপ্ততা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আরও কিছুদিন পরে বসন্তবাবু একরাত্রে আমার ঘরে এলেন। একথা-সেকথার পর হঠাৎ সেঁতো হেসে চাপা গলায় বললেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। কিছু মনে করবেন না যেন।

বললাম, না। আপনি বলুন!

আপনি নাকি এক পিরসাহেবের ছেলে। সত্য কি?

হ্যাঁ।

মৌলাহাটের পিরসাহেবই কি আপনার বাবা?

চোখে চোখ রেখে মাথা দোলালাম। উনি চুপ করে আছেন দেখে তখন বললাম, কেন?

শুনলাম –আই মিন, কাটুনিদের মধ্যে আমার লোক আছে, অবশ্যই স্ত্রীলোক, আপনার বাবা নুরপুরে ছিলেন কিছুকাল।

আস্তে বললাম, শুনেছিলাম।

শোনেননি করুণা যখন মুসলমান ছিল, তখন তাকে আপনার বাবা বিয়ে করেছিলেন, পরে ডিভোরস করেন?

দিস ইজ অ্যাবসার্ড!

বসন্তবাবু সেঁতে হাঁসি হেসে বললেন, করুণা তাই বলেছে। সে আপনার বাবার। নামে অকথ্য-কুকথ্য নিন্দামন্দ করেছে। কাটুনিরা অনেকেই জেনে গেছে সে-কথা। বোঝেন তো ওসব ছোটোলোক মেয়েদের ব্যাপার-স্যাপার। ওদের পেটে কথা থাকে না। আমি দেববাবুকে বলতে সাহস পাই না। আপনি বলুন ওঁকে। শিগগির মেয়েটাকে এখান থেকে তাড়ানো দরকার।

কেন?

বসন্তবাবু ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ গোঁফে তা দিলেন। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। আমার সন্দেহ হল, লোকটি ইকরা ওরফে করুণার প্রেমভিখারি। কিন্তু আমার পিতা ইকরাকে বিয়ে করেছিলেন, ভাবতে অবাক লাগল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। পিতার মুখে অসংখ্যবার শাস্ত্রীয় বাচন শুনেছি, যা তিনি। জীবনযাপনেও সতর্ক এবং দৃঢ়ভাবে পালন করতেন, হে মুসলমান! পাক কেতাবে আল্লাহ বলেছেন, যদি মনে কর একাধিক আওরতের প্রতি সমান আচরণ ও সুবিচার করতে পারবে, তবেই দুটি, তিন এবং চার পর্যন্ত নিকাহ করতে পার। তাছাড়া তিনি কোথাও কেউ দ্বিতীয় বিবাহ করছে শুনলে ক্ষুব্ধ হতেন। সতর্ক করে দিয়ে শাস্ত্র আবৃত্তি করতেন। তাঁর পক্ষে ইকরাকে বিয়ে করা অসম্ভব।

গিয়াসপণ্ডিতের কন্যাকে বিয়ে করতে চাইনি বলে উনি আমার সঙ্গে আগের মতো কথাবার্তা বলতেন না। নেহাত প্রয়োজনে দু-চারটি কথা বলতেন মাত্র। সেবার। আশ্রমে বাঙলা নববর্ষ উৎসব হল। হৃদয়নাথ শাস্ত্রী বেদপাঠ করলেন। দেবনারায়ণদা বাইবেলের “সাম্‌স্‌” অংশ পড়লেন। গিয়াসপন্ডিতের কন্যা রেহানা কোরান আবৃত্তি করল। (হায়! এই বিদূষী তরুণীর মধ্যে একটি খাঁচার পাখিই দেখিয়াছিলাম। আমি যে প্রকৃতিচর– বনের পাখিই আমার প্রিয়)। ত্রিপিটক পাঠ করলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আচার্য ভবতোষ গাঙ্গুলি। শেষে দেখি, ‘হাজারিলাল’– হরিবাবু তুলসীদাসের কয়েকটি দোঁহা সুর ধরে আবৃত্তি করলেন।

আগের দিন চৈত্রসংক্রান্তিতে বিজয়পল্লীতে খুব জমকালো গাজন হয়েছিল। সভার ব্রাহ্ম বক্তারা প্রত্যেকে একথা উল্লেখ করে কড়া সমালোচনা করলেন। বিশেষ। করে সঙের গানে ও নাটকে নাকি ‘ওই ইতরজনেরা নামী সজ্জনদের সম্পর্কে কুৎসা ও খেউড় কীর্তন করেছে।’ তারপর গিয়াসপন্ডিত বক্তৃতা দিতে উঠলেন। বাঙলা নববর্ষ এবং হিজরিসনের সম্পর্কের ইতিহাস বর্ণনার পর হঠাৎ জ্বালাময়ী ভাষণ। দিতে শুরু করলেন। একটু পরে চমকে উঠলাম শুনে : ‘মৌলাহাটের মহাসম্মানিত একেশ্বরবাদী সাধকপুরুষ হজরত সৈয়দ বদিউজ্জামান, যার সুবিদিত ওহাবি ভাবধারার মধ্যে আমাদিগের ব্রাহ্মধর্মের বহু সাদৃশ্য বিদ্যমান– যেহেতু আমরাও ধর্মক্ষেত্রে নিরাড়ম্বর সারল্য এবং তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথাঃ– ত্যাগের দ্বারা ভোগব্রতে। ব্রতী, হজরত বদিউজ্জামানও অনুরূপ ব্রতের প্রচারক এবং বিলাসিত বর্জন করে পরমব্রহ্মের সম্মুখীন হওনের নিমিত্ত আহ্বান করেন, তিনিও তৌহিদ বা একত্ববাদের প্রবক্তা, সেই হেতু তিনিও আমাদিগের নমস্য –অথচ গতকল্য বিজয়পল্লীতে দুর্বত্ত ব্যক্তিরা তাঁর নামেও সঙের ন্যক্কারজনক গীতাদি নাট্যাদি অভিনয় করত কুৎসা রটিয়েছে। এমন কী, এক দুর্জন হারামজাদ ব্যক্তি শনের দাড়ি এঁটে টুপি পরে ওই মুসলমান আচার্যের নকল করেছে। ধিক! শত ধিক! সুধন্য নামে আরেক দুর্বত্ত যুবক স্ত্রীলোক সেজে দাড়িটুপিজোব্বাধারী শয়তানের সঙ্গে– ছি! ছি! মুখে উচ্চারণ করতে ঘৃণা বোধ হয়।’

সভায় ধিক্কারধ্বনি শোনা গেল, অবশ্য তা মৃদু এবং ম্রিয়মাণ। আমি বাঁধের পথে বিভ্রান্তভাবে হেঁটে গেলাম। বিজয়পল্লীর কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। তারপর উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে-হাঁটতে আবাদ এলাকা পেরিয়ে শঙ্খিনীর ধারে নতুন বাঁধে একটি ঝুঁকে পড়া গাছের ছায়ায় শুকনো বালির চড়ায় বসে পড়লাম। একটি সাঁওতাল যুবক তীর-ধনুক হাতে ওপারের জঙ্গল থেকে নদীতে নামল। হাঁটুজল পেরিয়ে এসে সে আমাকে দেখতে পেল এবং নির্লিপ্ত দৃষ্টে তাকিয়ে নিয়ে চলে গেল। নিসর্গের অন্তর্ভুক্ত একটি সত্তার প্রকাশ যেন, একটি ক্ষুঙ্কাতর কাঠবেড়ালির সঞ্চরণ যেভাবে দেখি । উহাদিগের বিদ্রোহের বৃত্তান্ত পড়িয়াছি। উহার বস্তৃত নিসর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার চেষ্টা করিয়াছিল।’দিকু’গণ উহাদিগকে আবার নিসর্গের অঙ্গীভূত করিয়াছে। ওই কৃষ্ণকায় যুবকটিকে দেখিয়া হঠাৎ আবার Revelation ঘটিল। নিসর্গ কি সত্যই প্রশান্তিময়? নাকি আমার ‘দিকু-অবচেতনাঘটিত বিভ্রম? এখানে ধারাবাহিক সংগ্রাম। টিকিয়া থাকার জন্য মরণপণ যুদ্ধ। প্রকৃতির যে নিভৃত বৃত্তটি নিসর্গরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, উহার মধ্যেও সংগ্রামস্রোত বহিতেছে। বৃক্ষলতাও এখানে সংগ্রামরত। মাটি ও জলও সংঘর্ষে লিপ্ত। জড় ও অজড়, স্থাবর ও জঙ্গম মুখোমুখি লড়িতেছে। কোথাও জাড্য নাই। হেনরি ডেভিড থরো কি ইহাকেই ‘strange feelings’ বলিয়াছেন? বড়ো বিলম্বে উপলব্ধি করিলাম বাক্যটির প্রকৃত মর্মাথ কী। ‘Disobedience’ তত্ত্বের উৎস এইখানেই নিহিত। আত্মস্থ আত্মসমর্পণ নহে, অবাধ্য হও।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। ছায়া ঈষৎ প্রলম্বিত হয়ে স্রোত ছুঁই-ছুঁই করছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। নদীর স্বচ্ছ জল পান করে যখন ফিরে চলেছি, তখন আমার ভিতরকার ঘাতক-সত্তা দীর্ঘ নিদ্রার পর আড়মোড়া দিচ্ছে। শুকনো খাল পেরিয়ে সুনয়নী দেবীর কুটিরের সামনে পৌঁছে স্বাধীনকে দেখতে পেলাম। সে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু শুনছিল বা দেখছিল। সুতোকাটুনিদের কারখানার দিক থেকে চাচামেচি কানে এল। ওরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে। নতুন ঘটনা নয়। স্বাধীন আমাকে দেখে বলল, এদিকে কোথায় গিয়েছিলে? একটু থেমে ফের বলল, তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?

কিছু না। বলে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর ডানদিকে তাকাতেই একটি বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ল। দুটি স্ত্রীলোক মুখোমুখি যুযুধান মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা দুজনকে নিরস্ত করার জন্য চাচামেচি করছে। একজনকে চিনতে পারলাম। ইকরা ওরফে করুণা। অন্যজন গ্রেীঢ়া। হাড়গিলে চেহারা। সে। বেশি মারমুখী। নিছক কৌতূহলে কিছুটা কাছাকাছি গেলাম। তাঁতশালার পুরুষেরা বারান্দা থেকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করছে। সম্ভবত বসন্তবাবু ভাতঘুম দিচ্ছেন স্বগৃহে। নতুবা এতখানি বাড়াবাড়ি ঘটত না। প্রৌঢ়া যে মুসলমান, তার চেহারা আর কথাবার্তায় স্পষ্ট। সে চেরা গলায় বলছে, বেউশ্যা ডাহিন মাগী! আমার ননদাই (ননদের স্বামী) বুজুর্গ পির –তেনার ঘরে একশো জিন পোষা আছে, দ্যাখ, তোর কী খোয়র করে। খপর যেতে দেরি! হা আল্লা, এখানে কি মোসলমান নাই একজনাও, এই হারামজাদিকে জবাই করে গাজি হয়?

বুক ধড়াস করে উঠল। আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। ইকরার পিঙ্গল চোখ থেকে আগুন জল হয়ে ঝরছে। মনে হল, ইতিমধ্যে যথেষ্ট গাল দিয়ে তার পুঁজি শেষ। অথবা ক্রোধে সে বাকরহিত।

প্রৌঢ়ার দিকে তাকালাম। অথবা স্মৃতির দিকে। চেনা মনে হয় কি? প্রতিপক্ষ পরাহত বুঝে সে ফের হুংকার দিল। থাম, থাম! পিরসাহেব যদি বা তোকে মাফ করেন, আমি করব না। আজই ভগবানগোলায় খপর ভেজছি মিরের ব্যাটার কাছে। তার নামে বাঘেগোরুতে একঘাটে পানি খায়। এখানেই তার লোক আছে ঘাপটি পেতে। থাম, ডেকে আনছি বাঁকা বাগদিকে।

চিনলাম। অজিফা-মামীই বটে! মামা তাঁকে তালাক দেওয়ার পরদিন ভগবানগোলায় গিয়েছিলাম। অজিফা-মামী তাহলে পেটের দায়ে এখানে এসে সুতোকাটুনি হয়েছে।

দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে চলে এলাম। নিজের ঘরে ঢুকে আচ্ছন্ন অবস্থায় বসে রইলাম। কী বিচিত্র এই জীবন! অভিজাতবংশীয় দুটি লোক– একজন শ্যালক, অপরজন তাঁর ভগ্নিপতি– তাঁদের পরিত্যক্তা দুটি স্ত্রীলোক অপ্রসাঙ্গিক কলহে লিপ্তা। হতভাগিনীদের কে বোঝাবে তাঁরা বস্তৃত কী? একজন দস্যুসর্দার, অপরজন ধর্মগুরু। কিন্তু দুজনেই পুরুষ।

সেইরাত্রে অন্ধকার ঘরে স্বপ্নের মধ্যে আমি এই প্রকার কথোপকথনে লিপ্ত হইয়াছিলাম। আমার সম্মুখে দুইটি স্ত্রীলোক দণ্ডায়মান ছিল।

তোমরা কে?

আমরা পাখি, ফুল, প্রজাপতি।

কে তোমরা?

আমরা বায়ু, অগ্নিশিখা।

তোমরা কি মনুষ্য নহ?

আমরা স্ত্রীলোক, প্রকৃতি।

তোমরা কি মনুষ্যের ভাষা বুঝিতে পার না?

উহারা শুনিতে পায় না।

তোমরা কী বলিতেছ?

আমরা কথা বলিতেছি।….
‘Heaven is nearer through football
than through the Gita.’

সকালে ‘হাজারিলালে’র খোঁজে গেলাম। আমার মধ্যে স্বাধীন-কথিত ‘দুর্দান্ত বাঘ’ গরগর করছিল। গত কয়েকটি বছর আমি নিজের ভিতর যেন সমাহিত ছিলাম! শুধু গ্রন্থপাঠ আর উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ। জীবন এবং জগৎকে ব্যাখা করার চেষ্টা। হরিবাবু আমার হাবভাব আঁচ করেই আর বিশেষ যোগাযোগ করতেন না। কিন্তু মানুষের মনের রহস্য বোঝা কঠিন। কোথায় আঘাত লাগে, কোথায় ঝনঝন শব্দ ওঠে। পিতার নামে কুৎসার আঘাতই কি আমাকে বিলম্বিত ‘হাইবারনেশন’ থেকে জাগিয়ে দিয়েছিল? জানি না। বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝি, প্রচণ্ডভাবে বেজে উঠেছিল মনের অন্য একটি তন্ত্রী। গ্রাম্য প্রবাদে আছেঃ লঙ্কাধামে রাবণ মলো/বেউলা কেঁদে রাঁড়ি হল? হাসির কথা নয়। এমনই হয়।

হরিবাবু তাঁর কুটিরের সামনে গাবগাছের তলায় বাঁশের মাচানে বসে পাথরের থালায় ছাতু খাচ্ছিলেন। আমাকে আসতে দেখে তাকিয়ে রইলেন। কাছে গিয়ে অনুচ্চস্বরে বললাম, বন্দেমাতরম্!

হরিবাবু হাসলেন। কী ব্যাপার? হঠাৎ–

মাচানে বসে বললাম, মনে বাতব্যাধি ধরে গেছে। একটা কিছু করতে চাই। ছোটাছুটি, চিৎকার, হত্যা– এরকম কিছু।

হরিবাবু চুপচাপ ছাতু শেষ করলেন। ঘটি থেকে গলায় জল ঢাললেন। তারপর নীচের গভীর নয়ানজুলিতে ঘোলা জলে পাত্রটি সযতে ধুয়ে আনলেন। সেটি কুটিরের ভেতর রেখে মাচানে এসে বসলেন। গামছায় গোঁফ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুছে বললেন, নতুন কোনো বই পড়লে বুঝি?

সব বই-ই পুরনো, হরিদা! নতুন—

চুপ। বাতাসের কান আছে। হাজারিদা বলো!

হাজারিদা আমি এখানে আর থাকব না। আমার চুপচাপ সঙ সেজে বসে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না।

ফুটবল খেলো!

নড়ে বসলাম। বললাম, পরিহাস করছেন?

হরিবাবুর মুখে কৌতুকের চিহ্ন ছিল না। গম্ভীরমুখে বললেন, তুমি নিশ্চয় স্বামী বিবেকানন্দের নাম শুনেছ?

শুনেছি। শাস্ত্রীমশাইয়ের ছেলে অজয়ের কাছে তাঁর চিকাগো বক্তৃতা নামে একটি বইও পড়েছি। আমাদের লাইব্রেরিতে ওঁর কোনো বই দেখিনি।

হরিবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ব্রাহ্মরা ওঁকে সম্ভবত পছন্দ করে না। অথচ সারা ভারতবর্ষ স্বামীজির নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। তোমাকে যে ফুটবল খেলতে বললাম, বাক্যটি তাঁরই। Heaven is nearer through football than through the Gita’.

কেন একথা বলেছেন উনি?

হরিবাবু চারদিক দেখে নিয়ে বললেন, আমরা থেমে নেই। তুমি তো নিয়মিত সম্বাদপত্র, পড়।

নিয়মিত নয়, মাঝে-মাঝে পড়ি।

বন্দেমাতরম্ সমিতির সদস্যরা নতুন একটি বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছে। গত ২৪ মার্চ জনৈক ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র– তিনি পি মিত্র নামে খ্যাত, তিনি, সতীশচন্দ্র বসু, পুলিনবিহারী দাশ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি কলিকাতায় অনুশীলন সমিতি নামে একটি দল গড়েছেন। প্রকাশ্যে এই গুপ্ত বিপ্লবী দলের কাজকর্ম হল, তরুণ তরুণীদিগের খেলাধুলা, ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চা, লাঠি-ছোরাখোলা ইত্যাদি ইত্যাদি। কালীমোহনদা ব্ৰহ্মপুরে এসে স্বামীজি সংঘ নামে একটি ক্লাব স্থাপন করে গেছেন। তুমি যেন আশ্রমে এসব কথা ঘৃণাক্ষরে আলোচনা কোরো না।

আমি কী করব, বলুন?

শফি, বললাম তো ফুটবল খেলো! অলীক মানুষ-১৬

আপনি খেলেন কি?

আমার কথায় ক্ষোভ ছিল। হরিবাবু মুচকি হেসে বললেন, স্বামী বিবেকানন্দ গীতার একটি উক্তি শ্লোগানের মতো সারা ভারতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন : ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ। ফুটবলও একপ্রকার বলের সঞ্চার করে দেহে। তবে হাজারিলালকে ফুটবল খেলতে দেখলে টিকটিকি মাথা নেড়ে দেবে। ব্যস! কাজেই হাজারিলাল– যার দেশ কি না বিহার মুল্লুক এবং যেখানে লাঠিখেলা না জানলে মরদ বলে না, সে লাঠিখেলা শেখাবে। শেখাচ্ছে।

লাঠি! ধুস! তলোয়ারখেলা হলেও মনে হয়।

ধীরে-ধীরে সবই হবে। পিস্তল বন্দুক বোমা –সব হবে। হরিবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন ফের, তোমার ডিউটি-পিরিয়কি বাঁধা?

হ্যাঁ। নটা থেকে বারোটা, সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত্রি নটা। তবে আমি তত ডিউটিফুল নই। কখনও খুকুকে, কখনও রেহানাকে বসিয়ে দিয়ে ঘুরতে বেরোই।

হরিবাবু আস্তে বললেন, নেচার-বায় ছাড়ো! নেচারে কিছু নেই হে! হোয়াট রিমেনস ইজ ম্যান।

দারুণ কথাটা তো! কার?

জানি না। কোথায় যেন পড়েছিলাম। যাই হোক, অজয়কে বলল –সে তোমার ক্লাবের মেমবার করে নেবে। আশা করি, দেববাবুর আপত্তি হবে না। স্বাধীনের ব্যাপারে তো হয়নি।

অবাক হয়ে বললাম, স্বাধীন ওই ক্লাবে খায় নাকি? কী করে? ছোরাখেলা শেখে। একটা কথা। আপনারা কি বন্দেমাতরম শ্লোগান ছেড়ে দিয়েছেন?

হরিবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তোমার মাথা খারাপ? বন্দেমাতরমই আমাদের প্রেরণা। বলে আমার দিকে ঘুরলেন। কেন? তুমি কি

দ্রুত বললাম, আমি তো এসেই আপনাকে বন্দেমাতরম বলে সম্ভাষণ করলাম। আপনি প্রত্যুত্তর দিলেন না।

ভেবেছিলাম, আফটার অল তুমি মুসলমান। তাই হয়তো ওভাবে দূরে সরে গিয়েছিল। হ্যাঁ –একটা কথা। বহুকাল ধরে বলব ভেবেছি, বলিনি। ধর্মত ন্যায়ত যখন ওটা তোমারই, তখন–

কিসের কথা বলছেন?

স্ট্যানলির পিস্তলটার কথা।

ওটা আছে।

মরচে ধরে অচল হয়ে গেছে হয়তো।

না। মাঝেমাঝে রাত্রে ওটা খুলে তেল দিই। তবে কার্তুজগুলানের অবস্থা জানি না। পরীক্ষা করে দেখব।

হরিবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, না, না। প্রয়োজনে কার্তুজ পাবে।

হাসতে-হাসতে বললাম, দূর জঙ্গলে গিয়ে টেসট করব।

হরিবাবু কাঁধে হাত রেখে খাস ছেড়ে বললেন, ভাই শফি! লোহাগড়ার। কৃষকবিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। তবে যা হয়, মঙ্গলের জন্যই হয়। কৃষকদিগের ব্যাপারটা হল হড়কা বানের মতো। ওরা আদর্শ বোঝে না। বৈষয়িক স্বার্থ বোঝে। কিন্তু এই বিরাট কাজে আদর্শবাদেরই প্রয়োজন। আদর্শবাদ শিক্ষা ছাড়া গড়ে ওঠে না। সেই কারণে শিক্ষা-ব্যবস্থার সহযোগী হতে চাই আমরা। শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই স্বাধীনতা চাই। হরিবাবু খি-খি করে হাসতে থাকলেন। কথা আছে না? ‘যার শিল তার নোড়া/তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া!

তিনি হঠাৎ মাচান থেকে নামলেন। বললেন, ভুলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনকে রত্ন একটি চিঠি লিখেছিল। স্বাধীন তোমাকে কিছু বলেনি?

বলেছিল, আমাকে তিনি নেমন্তন্ন করেছিলেন। যাচ্ছি না কেন।

তুমি চিঠিটা নিয়ে যাও। আমার কাছে থাকা ঠিক নয়। স্বাধীনকে ফেরত দিও। বলে হরিবাবু কুটির থেকে একখানি খাম এনে দিলেন। বললেন, তুমি পড়ে দেখো। তেমন কিছু গোপনীয় নেই এতে।

I was once the trunk of a fig free.
A carpenter, doubtful whether to make me
into a god or a bench, finally decided to
make me a god.
Satires–Horace.

‘স্ট্যানলির পিস্তলটি বেঢপ গড়নের। উহার যান্ত্রিক পদ্ধতি এবং ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সমুদয় বদ্ধ ঘরে কোনো কোনো রাত্রে নাড়াচাড়া করিতে-করিতে শিখিয়া ও বুঝিয়া লইয়াছিলাম। উহাতে চক্রাকারে আঠারোটি খোপ ছিল। স্ট্যানলি মৃত্যুর পূর্বে একটিও কার্তুজ ব্যবহার করিবার সুযোগ পায় নাই। সুতরাং আঠারোটি কার্তুজ খোপে সজ্জিত ছিল। সতর্কতাহেতু কার্তুজগুলিন খুলিযা অস্ত্রটি পরীক্ষা করিতাম। হরিবাবুর সঙ্গে ক্লারবিষয়ক কথাবার্তার পর একদিন বহুদূরে দুর্গম কাশবনের ভিতর গিয়া ঘোড়া টানিলাম। ফটাস করিয়া অদ্ভুত শব্দ হইল। বন্দুকের শব্দের সহিত ইহার পার্থক্য বুঝিলাম। বারিচাচাজির বন্দুকে হ্যাঁমার বলিয়া একটি যন্ত্র ছিল। পিস্তলটিতে তাহা ছিল না। পরবর্তী কার্তুজ কীভাবে ব্যবহার করিব, তাহা নির্ণয়হেতু দ্বিতীয়বার ঘোড়া টানিলাম। কোনো শব্দ হইল না। ঝাঁকুনি লাগিল না। নিরাশ হইয়া আবার ঘোড়া টানিলাম। আবার কার্তুজটি বারুদের কটুগন্ধ ছড়াইয়া শব্দ করিল। তখন বুঝিলাম দুইবার করিয়া ঘোড়া টানিতে হইবে! পরে জানিয়াছিলাম, পিস্তলটি আটোমেটিক নহে। কাশবনের ভিতর একটি হিজলগাছ একাকী দাঁড়াইয়া ছিল। টিপ পরীক্ষা করিতে মাতিয়া উঠিলাম। খুঁড়িতে একস্থানে কাদার ক্ষুদ্র পিঙ সাঁটিয়া আনুমানিক কুড়িহাত দূর হইতে পদ্ধতিঅনুসারে দুইবার ঘোড়া টানিলাম। এবার দক্ষিণ হস্তে পিস্তল এবং বামহস্তে দক্ষিণহস্তের কর্জি চাপিয়া রাখিলাম, যাহাতে পিতলের ঝাঁকুনিহেতু নলের মুখ লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়। গুলি লক্ষ্যভেদ করিল। আনন্দে লাফাইতে ইচ্ছা করিল।…..

“স্বামীজিসংঘের সদস্য হওয়ার পর একটা বিষয় লক্ষ্য করি। ক্লাবঘরে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি এবং সাধুসন্ন্যাসীদিগের চিত্র লটকানো ছিল। সকলেই হিন্দু। মধ্যস্থলে দেবী কালীর প্রকাণ্ড ছবিটির সামনে দাঁড়াইয়া সকল সদস্য করযোড়ে মস্তক ঈষৎ নত করিযা প্রণাম করে এবং অনুচ্চ স্বরে ‘বন্দেমাতরম’ বলিয়া প্রাঙ্গণে খেলিতে যায়। আরও একটি প্রক্রিয়া দেখি। দেয়ালের তাকে একখানি গীতাগ্রস্থ ছিল। উহার সম্মুখেও প্রণাম এবং উহাতে হাত রাখিয়া অনুচ্চস্বরে ‘আমি দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ বলিদানে প্রস্তুত’ এই বাক্যটি মন্ত্রবৎ উচ্চারণ করা হয়। ধর্মের প্রতি ঘৃণাহেতু প্রথম প্রথম সংকোচবোধ করিতাম; মুসলমানবংশজাত বলিয়া নহে। পরে এই প্রক্রিয়ার প্রতি সংকোচ কাটিতে থাকে। বহু অহেতুক আচরণ মনুষ্যগণের মধ্যে দেখা যায়। আমি ব্যতিক্রম নহি। শখিনীর তীরে কত বৃক্ষের কাঙে হাত রাখিয়া তাহাকে জীবিত। প্রাণী ভাবিয়া শিহরিত হইয়াছি! এরুপ অসংখ্য আচরণে আমি অভ্যস্ত। অথচ উহার কোনোপ্রকার উদ্দেশ্য বা উহার মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নাই। সুতরাং আমি সংকোচ কাটাইয়া উঠিয়াছিলাম। কিন্তু আশঙ্কা করিতাম, এই প্রক্রিয়া মুসলমানদিগের দূরে সরাইয়া রাখিবে! সত্যচরণবাবু বলিয়াছিলেন, মুসলমান-সমাজকেও আমরা সঙ্গে চাই। কিন্তু এই নিয়ম বিপ্লবীদের পক্ষে বিঘ্ন ঘটাইবে। মুসলমানগণ সম্ভবত তাহাদের বৈরীভাবাপন্ন হইবে।

“সমস্যা হইল, আমি মুসলমানবংশজাত। এ-অবস্থায় আমি যদি এই প্রশ্নটি উত্থাপন করি, ‘উল্টা বুঝিলি রাম’ হইবারও অশঙ্কা আছে। উহারা ভাবিবে, আমি মুসলমান বলিয়াই এরূপ বলিতেছি। উহারা যদিও আমাকে হিন্দু সাব্যস্ত করিয়াছে, প্রকৃতপক্ষে আমি হিন্দু বা মুসলমান নহি, একজন মনুষ্য –দ্বিপদ প্রাণীদিগের একটি সামান্য নিদর্শনমাত্র। এইসব ভাবিয়া প্রশ্নটি তুলি নাই। বিস্ময়ের কথা, উহাদের কাহারও মনে এই প্রশ্ন কেন জাগে না?…..

“বহুকাল যাবৎ আমার একটি গোপন আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাহা অন্য কিছুই নহে, একটি ঘোড়া। ঘোড়াটি বারিচাচাজির সেই ঘোড়াটির ন্যায় তেজস্বী ও গতিশীল হওয়া চাই! এই স্থলে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আশ্রমবাসী ভদ্রজনেরা পাল্কী এবং অব্রাহ্ম হিন্দুসকলও পাল্কী ও এক্কা, টমটম, টাঙ্গা প্রভৃতি ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহার করিতেন! শুধু সরকারী পদস্থ ব্যক্তি, ডাক্তার এবং পুলিশের দারোগারা ঘোড়ার পিঠে চাপিতেন। ব্রহ্মপুরে মিয়াঁ-মুসলমানের বসতি হয় নাই। কিন্তু অন্যান্য স্থানে প্রায় সর্বত্র দেখিয়াছি, অধিকসংখ্যক মুসলমান ঘোড়াসওয়ার হওয়ার পক্ষপাতী। কদাচিৎ কোনো জমিদার ও বিত্তবান হিন্দু ভদ্রলোক ঘোড়াসওয়ার হইতেন। অবশ্য ইহা গ্রামাঞ্চলের কথা। নগরাঞ্চলে প্রবণতা অন্যরূপ হইতে পারে। তবে ইহা হইতে আমার সিদ্ধান্ত হইল, এতদ্দেশীয় সর্বশ্রেণীর মুসলমানগণের ঘোড়সওয়ার হওয়ার প্রবণতাতে। একটি ট্রাডিশনের লক্ষণ পরিস্ফুট। বহির্দেশীয় জাতিবর্ণের ভারতজয়ের পিছনে প্রাচীনকালে সম্ভবত অশ্বারোহণ মুখ্য উপাদানস্বরূপ বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। বেদ-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-শাস্ত্রাদিতে অশ্বচালিত রথের সগৌরব বৃত্তান্ত রহিয়াছে। কিন্তু অশ্বারোহীর কথা নাই। অশ্বমেধযজ্ঞের অশ্ব আরোহীবিহীন অবস্থায় ছাড়িয়া দিয়া যোচূবর্গ পদব্রজে তাহার অনুসরণ করিতেন। ঐতিহাসিক যুগেও দেখা যায়, বহির্দেশীয়রাই অশ্বারোহণে সক্ষম। এই যুগে যাহারা ভারতজয়ে সমর্থ হইয়াছে, তাহারা সকলেই অশ্বারোহী হইয়া এই দেশে প্রবেশ করিয়াছে। আরব, তুকী ও মোগলগণও অশ্বারোহী হইয়া এই দেশ জয় করে। অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ এবং অশ্বচালিত রথে আরোহণ এই দুইয়ে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া রাণ প্রবৃত্ত হওয়া আর অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়া অস্ত্রচালনা করার মধ্যেও শৌর্য এবং গতিশীলতার প্রভূত ফারাক! প্রাচীন ও মধ্যযুগে হিন্দুদিগের মধ্যে উক্ত প্রবণতা ছিল না বলিয়াই তাহারা বিদেশীর পদানত হয়, অনুমান করি। তবে বিজিত হইবার। পর বিজেতাদের সহযোগিতায় হিন্দু অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণে মনোযোগী হয়। আমার এবম্প্রকার ধারণার কারণ, অতি সাধারণ গ্রাম্য মুসলমানও অন্তত একটি অশ্ব পুষিবেই। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদিগের মধ্যে অশ্ব পালনের দৃষ্টান্ত দুর্লভ। অখ গতি, শৌর্য এবং দূরত্বের প্রতীক। ঋগ্বেদ সংহিতায় অশ্বসূক্ত পাঠ করিয়াছি। আর্য ঋষিগণ অশ্বের মধ্যে ঐশী শক্তির অভিব্যক্তি লক্ষ্য করিয়াছিলেন। বিশ্বপ্রকৃতির সকল শক্তিতে তাঁহারা ‘অশ্ব’ কথাটিকে যুক্ত করিয়াছেন। সেই হেতু কি তাঁহারা অশ্বপৃষ্ঠে মনুষ্যের আরোহণ পাপকর্ম বিবেচনা করিতেন? যেন অমর দেবতা ছাড়া নশ্বর মনুষ্যের পক্ষে অশ্বারোহী হওয়া গর্হিত কর্ম। তবে অশ্বচালিত রথে আরোহণ করার প্রথা অনুমোদন করিয়াছেন। যেহেতু– যেন অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণের অধিকার শুধুমাত্র দেবতাদিগেরই! এই ধারণার মাশুল হিন্দুদিগকে যুগযুগ ধরিয়া গুণিতে হইয়াছে।

“আমার বেতনের সমুদয় অর্থ সঞ্চিত ছিল। গুণিয়া দেখিলাম দুইশত টাকা জমিয়াঁছে। কিন্তু কথাটি দেবনারায়ণদার কাছে তুলিতে তিনি সহাস্যে বলিলেন, তোমার দেখিতেছি ঘোড়ারোগ ধরিয়াছে। অবশ্য আমার উহাতে আপত্তির কারণ নাই। তবে ভাবিয়া দেখ, ঘোড়ার বিস্তর ঝামেলা আছে। উহার জন্য আস্তাবল আবশ্যক। খাদ্য এবং সেবাযত্ন প্রয়োজন। বলিলাম, হাজারিলাল কথা দিয়াছে, সে তাহার কুটিরের পার্শ্বে একটি চালাঘর গড়িয়া দিবে। জলাভূমিতে ঘোড়ার প্রচুর খাদ্যও আছে। সে বিহারমুলুকের লোক। ঘোড়ার সকলকিছু অবগত। দেবনারায়ণদা উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, দেখ বাপু! ঘোড়ারোগ কঠিন রোগ। তবে ইহার সঙ্গে আমাকে জড়াইও না। তোমার ঘোড়া, তুমিই দেখিবে। আমার কী বলিবার আছে? পরদিন হাজাবিলালকে সঙ্গে লইয়া রহিমপুর ঘোড়াহাটায় হাজির হইলাম। অসংখ্য ঘোড়ার মধ্যে একটি সুন্দর কালো ঘোড়া পছন্দ হইল। ঘোড়া সম্পর্কে আমার বহুবৎসর পূর্বের যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করিয়া বুঝিলাম, এইটি আমার উপযুক্ত হইবে। আমাকে অবাক করিয়া বিশাল গুধারী হিন্দুস্থানীটি দাম হাঁকিল, বাবুজী, দেড়শও রূপেয়া কিম্মত! ইয়ে পাহলোয়ান ঘোড়েকা মালেক ভি জবরদস্ত পাহলোয়ান থা। লেকিন উও মর গেয়া। উকা বাচ্চা কৈ নেহি হ্যায় উস্কা জেনানা ক্যা করে? মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া টাকা গুণিয়া দিলাম। রক্ত নাচিয়া উঠিল। হাজারিলাল চুপিচুপি বলিলেন, ঠকিয়াছ। এই হাটে সর্বোৎকৃষ্ট ঘোড়ার দাম একশত টাকার বেশি নহে। তাঁহার কথায় কান দিলাম না। বাকি টাকায় রেকাব জিন-লাগাম-চাবুক সমুদয় খবিদ করিলাম। হাজারিলাল সারাক্ষণ বকবক করিতেছিলেন। দুইশত টাকায় পাকি প্রায় দুইশতমন চাউল পাওয়া যায়। কখনও ক্ষুব্ধভাবে বলিতেছেন, অশ্বপৃষ্ঠে বিপ্লবের দিন আর নাই। বিপ্লবীরা পদাতিক না হইলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। সিপাহীবিদ্রোহের ইতিহাস পড়িয়া দেখ! সম্মুখসমরে ইংরাজশক্তির সহিত আঁটিয়া উঠিবে না। গুপ্তভাবে চিতাবাঘের ন্যায় আচমকা একেকটি শক্তিকেন্দ্রের উঁটিতে কামড় বসাইতে হইবে। সন্ত্রাসের সৃষ্টি করিতে হইবে। ব্যক্তিহত্যাই উদ্দিষ্ট সন্ত্রাস সৃষ্টিতে সমর্থ। রহিমপুরের রাস্তায় পৌঁছিয়া একলম্ফে কৃষ্ণকায় অশটির পৃষ্ঠে উঠিয়া বলিলাম, হরিদা! ইহাকে একটি নাম দিন। ‘হাজারিলাল’ পরিহাসবশে বলিলেন, পাহলোয়ান! আমার মনঃপূত হইল। চিৎকার। করিয়া সম্বোধন করিলাম, পাহলোয়ান? পরক্ষণে চাবুক নাচাইয়া দুই হাঁটুর ধাক্কা দিলাম। ঘোড়াটি সুশিক্ষিত। ধূলিধূসর পথে বিদ্যুৎদ্বেগে ধাবিত হইল। আধক্রোশটাক গিয়া লাগাম খিচিয়া ধরিলাম। গতি সম্পৃত হইল। সেখানে একটি বৃক্ষতলে নামিয়াঁ ‘হাজারিলালে’র অপেক্ষা করিতে থাকিলাম। তিনি যেন ইচ্ছা করিয়াই ধীরে ধীরে হাঁটিতেছিলেন। মুখখানি গম্ভীর দেখাইতেছিল। পৌঁছিয়াই কিন্তু খি খি করিয়া হাসিতে থাকিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, পাহলোয়ান। পাহলোয়ান বটে।

“পাহলোয়ানকে পাইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিলাম! কেন জানি না, আশ্রমিকরা আমার এই ‘ঘোড়ারোগ’টিকে পছন্দ করিতেন না। এই বৎসর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়াছিল। গিয়াসপণ্ডিত তাঁহার কন্যা এবং গৃহস্থালিসহ আশ্রমত্যাগ করেন। এলাকায় তাহার বিরুদ্ধে মুসলমানদের নিন্দামন্দ ইহার অন্যতম কারণ হইতেও পারে, তবে শুনিয়াছিলাম, দেবনারায়ণদার সঙ্গে কোনো বিষয়ে প্রবল মতান্তর উহার উপলক্ষ্য। তাঁহার মতে নাকি ‘ব্রাহ্মগণ যে ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ব্রতী, তাহা শুধু ধর্মকেন্দ্রিক নহে উপরন্তু মধ্যবর্তী প্রায় সাতশত বৎসরের মুসলমান শাসনকালের সভ্যতা-সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ সমন্বয়বাদী ধারাটির প্রতি তাঁহারা শীতল মনোভাব অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা রাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুসলমানদিগের কৃতিত্বের প্রতি অবলোকন করিতেছেন না। তাঁহাদিগের মধ্যে দুই-চারিজন বাদে মোটামুটিভাবে সকলেই সুপ্রাচীন বৈদান্তিক এবং আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন ও সমুদয় তত্ত্বচিন্তাকেই প্রাধান্য দিতেছেন। ইহা শুভ লক্ষণ নহে। মৌলবি গিরিশচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যতিক্রম। পত্রাকারে এটি কলিকাতা হইতে গিয়াসুদ্দিন পরে আমাকে জানান এবং এ বিষয়ে চিন্তা করিতে বলেন। তিনি কলিকাতার তালতলায় তাঁহার আত্মীয় মৌলবি আফতাবুদ্দিনের নিকট আছেন। ‘জাগরণ’ নামে পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হইয়াছেন। উদারহৃদয় কতিপয় অ-ব্রাহ্ম হিন্দুও এই পত্রিকায় লিখিতেছেন!’…..

“অশ্ব-উন্মাদনাবশে ইহার প্রতি গুরুত্ব দিই নাই। মাঝেমাঝে স্বাধীন আসিয়া জানাইত, রেহানা তাহাকে পত্র লেখে। স্বাধীন মুচকি হাসিয়া বলিত, রেহানাকে বিবাহ করিলে সুখী হইত! একদিন পুনরায় সে ওই কথা বলিলে আমিও অনুরূপ কৌতুকে বলিয়া উঠিলাম, জীবনে একজনকে বিবাহ করিলেই হয়তো সুখী হইতাম! স্বাধীন। বলিল, সে কে? বলিলাম, নাম বলিব না। শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, একথা সে সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দিয়াছিল, তাহার হৃদয়ে পুরুষপ্রেম বলিয়া কোনো পদার্থ নাই। স্বাধীন সঙ্গে-সঙ্গে গম্ভীর হইয়া স্থানত্যাগ করিল। আমিও হাসিতে গিয়া গম্ভীর হইলাম। এই যুবতাঁকে কি আমি সত্যই ভালোবাসি? না তো! আমার হৃদয়ে ঠিক উহার মতোই নারীপ্রেম বলিয়া কোনো পদার্থ নাই! তাহা গলিয়া পচিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইয়া পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া গিয়াছে।…

“সেই বৎসর বসন্তকালে ডাকপিওন আমাকে একখানি খাম দিয়া গেল। আমার নামঠিকানা সুন্দর ইংরাজিতে লেখা। খুলিয়া চমকিয়া উঠিলাম।

‘প্রিয় পুরুষমানুষ!
দাওয়াত দিয়াছিলাম। প্রতীক্ষা করিতে করিতে কি চুল পাকিয়া যাইবে? আরবি গ্রন্থে পড়িয়াছি, আরবগণের মধ্যে প্রথা আছে, দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করিলে সে শত্ৰ গণ্য হয়। সৈয়দরা তো আরব। সংপ্রতি শ্ৰীমতী স্বাধীনবালার পত্রে অবগত হইলাম, আপনাকে ঘোড়ারোগে ধরিয়াছে। উত্তম সম্বাদ। আমার প্রেমিক জিনটিরও অবস্থা তাই। সে ঘোড়ার পিঠে আমাকে চাপাইয়া পদ্মার চরে লইয়া যায়। উহার সহিত আপনাকে ডুয়েল লড়াইতে ইচ্ছা করে। চরে। বসিয়া জ্যোৎস্নারাত্রে দেখিব, দুই ঘোড়সওয়ার ডুয়েল লড়িতেছে। অধিক বাক্য নিষ্প্রয়োজন। ইতি-র।

পুনশ্চ : পিতৃদেব তাঁহার প্রিয়তমাসহ কলিকাতাগমন করিয়াছেন। তাই বলিয়া আতিথ্যের ত্রুটি ঘটিবে না। মুন্সিচাচাকে আপনার কথা বলিয়াছি।

“মনস্থির করিতে দুইদিন কাটিয়া গেল। হরিবাবুকে জানাইব কি না, ঠিক করিতে পারিতেছিলাম না। অবশেষে সিদ্ধান্ত করিলাম, কাহাকেও কিছু জানাইব না। তবে দেবনারায়ণদাকে বলিতে হইল বহু বৎসর হইল পিতামাতার চরণদর্শন করি নাই। তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। পরদিন প্রত্যূষে যাত্ৰা করিলাম। কৃষ্ণপুর উত্তরপূর্ব কোণে বিহার সীমান্তে অবস্থিত। দূরত্ব প্রায় আট-নয়ক্রোশ হইবে, শুনিয়াছি। পথিমধ্যে দুই স্থানে বিশ্রাম করিলাম। একবার পথ ভুল করিলাম। গ্রামসমূহের মধ্য দিয়া যাইবার সময় লক্ষ্য করিলাম, সকলেই সপ্রশংস দৃষ্টে আমাকে দেখিতেছে। ভাবিতেছে, না জানি কোন জমিদারনন্দন হইবে! তৎকালে হিন্দু জমিদারদিগকে তাঁহাদের হিন্দু-মুসলমান সকল প্রজা রাজা বলিয়া উল্লেখ করিত। জমিদারবাটীকে ‘রাজবাড়ি’ বলিত। মুসলমান জমিদারের সংখ্যা জেলায় মুষ্টিমেয়। তবে তাঁহাদিকে প্রজারা ‘নবাব’ বলিত না, জমিদারই বলিত। নবাব বলিতে জেলায় শুধু লালবাগের নবাববাহাদুর। ইংরেজ বহু জমিদারকে বিশেষ-বিশেষ উপলক্ষে রাজা খেতাব দিত। তাছাড়া মুসলমান শাসনকালের রাজা খেতাবপ্রাপ্ত কিছু জমিদারও ছিলেন!…..

“মাটির রূপ বদলাইতেছিল। বন্ধুর, বৃক্ষবিরল, উষর প্রান্তর চতুর্দিকে। বামদিকে সড়ক ঘুরিল। ক্রমশ বৃক্ষলতাগুল্মদি দৃষ্টিগোচর হইল। সমতলভূমি ও শস্যক্ষেত্র শ্যামলতা ক্লান্তি দূর করিল। এতক্ষণে বিশাল পদ্ম উত্তরে বিলম্বিত দেখিলাম। তাহার বিশালতা মনোমুগ্ধকর। ক্লোশটাকে দূরত্বে কিছু ইটের বাড়ি দেখিতে পাইলাম। রাস্তায় টাঙ্গা, এক্কা এবং বলদ গাড়ির প্রাচুর্য দেখিয়া বুঝিলাম কৃষ্ণপুর সমৃদ্ধ গঞ্জ হইবেক। এইবার দেহে মুহুর্মুহ শিহরন ঘটিতে থাকিল। গঞ্জে ঢুকিয়া এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলে সে ‘রাজবাড়ি’র রাস্তা দেখাইয়া, এমন কী আমার পশ্চাতে হন্তদন্ত আসিতে থাকিল। বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, রাজবাড়ির চতুর্দিকে গভীর পরিখা। সম্মুখস্থ ফটকের দরজায় একজন সঙীনধারী প্রহরী এবং অপর একজন গোখাপ্রহরী কুকরি কোষবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। পরিখার কাঠের সেতু পার হইলে তাহারা সেলাম দিল। বলিলাম, মুন্সী আবদুর রহিমকে সম্বাদ দাও। আমি ব্ৰহ্মপুর আশ্রম হইতে আসিতেছি। লালবাগের হাভেলিতে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, সঙীনধারী একটি দড়ি ধরিয়া টানিল। ভিতরে আবছা ঘণ্টার শব্দ হইল। __ বিশাল কপাটের একাংশে ঘুলঘুলিতে একটি মুখ ভাসিয়া উঠিল এবং অদৃশ্য হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে কপাটের একটি ফোকর খুলিয়া একজন বৃদ্ধ মুসলমান বাহির হইলেন। তিনি যেন ভড়কাইয়া গিয়াছিলেন। মৃদুস্বরে তিনি কিছু বলিলে প্রহরীদ্বয় কপাট খুলিয়া দিল। বলিলাম, আপনিই কি মুন্সিজি? তিনি মৃদু হাস্যে মাথা দোলাইলেন। বলিলেন, আসুন। চারদিকে উচ্চ প্রাচীর, প্রাঙ্গণে বাগিচা, মর্মরমূর্তি, কেন্দ্রে দ্বিতল একটি প্রাসাদ। অন্যদিকে সারবন্দি একতলা ঘর। অনুরূপ একটি ফটক দৃষ্টিগোচর হইল। ঘোড়া হইতে নামিলে একজন লোক ছুটিয়া আসিয়া আমার হাতের লাগাম সবিনয়ে গ্রহণ করিল। মুন্সিজি বলিলেন, আপনার ঘোড়ার সেবাযত্নের ত্রুটি হইবেক না। মকবুল সহিস ঘোড়ার সহিত বাক্যালাপে পটু। বুঝিলাম, ইনি রসিক ব্যক্তি …..।

“প্ৰকাণ্ড হলঘরে দেয়ালচিত্র, জানোয়ারের স্টাফকরা মস্তক, প্রকাণ্ড শ্বেতপাথরের টেবিল, বিবিধ আসন সজ্জিত। ঝাড়বাতি ঝুলিতেছে। মুন্সিজি আমাকে একটি আসনে বসাইয়া একজন ভৃত্যকে দিয়া খবর পাঠাইলেন, বলিলেন, গোবিন্দবাবু মহালে গিয়াছেন। রাজাবাবুও কলিকাতায় তবে কোনো টি ঘটিবে না। এই সময় ভৃত্যটির সঙ্গে হলঘরের একপ্রান্তের গালিচা-মোড়া সোপান বাহিয়া ঝর্নাধারার মতন রত্নময়ী। আসিল। সে ‘আসোলামু আলাইকুম’ সম্ভাষণ করিল না। হাস্যমুখে শুধু কহিল, আমার সৌভাগ্য! আসুন। তাহাকে অনুসরণ করিলাম। মুন্সিজি হয়তো স্তম্ভিত হইয়াছিলেন। দ্বিতলে বারান্দা দিয়া ঘুরিয়া উত্তর-পূর্বকোণে একটি সুসজ্জিত ঘরে। ঢুকিয়া রত্নময়ী বলিল, ওই দেখুন পদ্মা! ওই সেই চর। তাহাকে সেদিনকার মতন অপ্রকৃতি দেখাইতেছিল না। বলিলাম, এ ঘরে কে থাকে? বতুময়ী বলিল, দাদা থাকিতেন এক্ষণে আপনি থাকিবেন। দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া বলিলাম, আমার জন্য আপনি ঝামেলায় পড়িবেন না তো? রত্নময়ীব কোটরত চক্ষুদুটি জ্বলিয়া উঠিল। বলিল একজন মুসলমানীবাইজী অপেক্ষা একজন সৈয়দবংশীয় পিরের সন্তানের স্পর্শে এই প্রাসাদ কি অপবিত্র হইবে? বরং এক্ষণে জাহান্নাম বেহেশতে পরিণত হইল। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, কিন্তু আমি তো ধর্মবিশ্বাসী নহি। সুতরাং বাইজী অপেক্ষাও নারকী শয়তান! রত্নময়ী শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলিল, ডো নো দ্যাট স্যাটান ওয়াজ ওয়ান্স। অলসো অ্যান অ্যাঞ্জেল ইন দা সেমিটিক ট্র্যাডিশন? চমকিত হইয়া বলিলাম, হ্যাঁ, তাহা সত্য। সেই নাকি বিশ্বের প্রথম বিদ্রোহ। শয়তান সর্বচর– অবাধ তাহার অর্থ, বিদ্রোহই কোনো সত্ত্বাকে প্রকৃত স্বাধীন করে। বিদ্রোহই স্বাধীনতার প্রবাহে ভাসাইতে পারে। রত্নময়ী জ্ব কুঞ্চিত করিয়া ঠোঁটের কোণে হাসির কণা রাখিয়া বলিল, এত স্বাধীনতার গৌরব প্রচার কেন? আশা করি, স্বাধীনবালার প্রেমে পড়েন নাই? হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, খুকু অর্থাৎ স্বাধীন বলে, তাহার হৃদয়ে পুরুষপ্রেম বলিয়া কোনো পদার্থ নেই। আমিও তদ্রপ প্রেমহীন পুরুষ। রত্নময়ীর কী হইল, সহসা আমার পায়ে ঢিপ করিয়া প্রণাম করিয়া আস্তে কহিল, ইউ আর অ্যান অ্যাঞ্জেল!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *