২১. পদ্মার চরে ঘুরতে

‘Oh! faciles nimium qui tristia crimina caedis Fluminea tolli posse putatis aqua!’ Fasti–Ovid

রত্নময়ী কেন সেদিন হঠাৎ আমাকে প্রণাম করেছিল, জানি না। খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রামের পর বিকেলে ইচ্ছে হল, পদ্মার চরে ঘুরতে যাব। একজন পরিচারিকা চা দিয়ে গেল। তার কাছে জানতে পারলাম, রত্নময়ীর শরীর খারাপ। শুয়ে আছে। নীচে গিয়ে মুন্সিজির খোঁজ করলাম। বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে শুকনো ফোয়ারার কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তখন উনি এলেন। কপালে হাত তুলে নিঃশব্দে আদাব দিলেন। বললাম, একটু বেরুব ভাবছি। পাহলোয়ানকে’ আনতে বলুন। মুন্সিজি একটু হেসে বললেন, সে হচ্ছে। রাজবাড়ি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হল, বলুন শুনি। বললাম, কী ধারণা হবে? মুন্সিজি প্রথমে যেন অবাক হলেন। তারপর বললেন, এই বাড়িতে আমি তিরিশ বছর আছি। আমারও তবু যখন ধারণা হয়নি, তখন আপনারই বা কেমন করে হবে? তবে ঠাহর করে দেখুন, বাড়িটার গায়েও মুসলমানি ছাপ। আপনি লালবাগে মোতিমহল দেখেছেন কি? বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ। বাড়িটা নবালি ধাঁচের মনে হচ্ছে! মুন্সি আবদুর রহিম আমার হাত ধরে ফোয়ারার শুকনো বৃত্তাকার মারবেল চত্বরের কাছে নিয়ে গেলেন। পাশাপাশি বসলাম দুজনে। তারপর বললেন, এখান থেকে একক্রোশ দূরে বিহার মুলুক। নবারি আমলে এই বাড়িটার মালিক ছিলেন বিহারের ফতেগঞ্জের এক মুসলমান ফৌজদার। পরে লিটন নামে এক ইংরেজ কিনে নেন। তাঁর কাছে কেনেন অনন্তনারায়ণবাবুর বাবা! তাহলে দেখুন। মুসলমানি আর ইংরেজি দুই জমানা এ বাড়িতে গেছে। অনন্তনারায়ণবাবুর দোষ। নেই। ইংরেজি আর মুসলমানি দুইরকম কেতায় তিনি বড়ো হয়েছেন। নবাববাহাদুরের ক্লাসফ্রেনড ছিলেন ইংলনড দেশে। সেই থেকে দোস্তি। ফলে লালবাগ হাভেলি থেকে মন্নুজান বাইজির এ বাড়িতে আসা। কিছু বুঝলেন? বললাম। মুন্সিজি হাসলেন।–বোঝেননি এখনও। এ বাড়ির চাকর-নোকর-ঝি-আয়া-বাবুর্চি-খানসামা, খাওয়াদাওয়ার রীতি সবেতেই ইংরেজি-মুসলমানি কেতা মিশে আছে। অনন্তনারায়ণবাবুর আত্মীয়স্বজন গোঁড়া হিন্দু এবং তাঁরা বিহারে থাকেন। তাঁরা বহু বছর এ বাড়ির সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। তাতে অনন্তনারায়ণবাবুর আরও সুবিধে হয়েছে। মুসলমানপ্রধান এলাকা। লাঠিয়াল-পাইকবরকন্দাজ সবাই মুসলমান। কর্মচারীরাও বেশির ভাগ মুসলমান। আর প্রজারাও ভাবে, তাদের ‘রাজাবাবু’ আধা-মুসলমান। কলমা পড়তে বাকি! –মুন্সিজি হাসলেন। কিন্তু বাঁকা হাসি। তারপর আস্তে বললেন, একজন ভণ্ড লম্পট, মাতাল– আস্ত শয়তান! তার অধীনে চাকুরি করছি যদি বলেন, তার জবাব শুনুন। জহরত-আরার জন্য! জিগ্যেস করলাম, কে জহরত-আরা? মুন্সিজি দুঃখিত মুখে বললেন, আপনি পিরের খান্দান। মুসলমান। তবু জিজ্ঞেস করছেন? ইচ্ছে হল, একটা কড়া জবাব দিই! কিন্তু বৃদ্ধ লোকটির জন্য কেন কে জানে করুণা হচ্ছিল। চুপ করে থাকলাম। তখন মুন্সিজি বললেন, জহরত-আরা ফারসি কথা। জহরত মানে রত্ন। আরা মানে ছটা। এবার হেসে ফেললাম। বললাম, বুঝেছি। মুন্সিজি বললেন এতটুকু থেকে মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো দেখে আসছি। ওর বয়স যখন সাত বছর, তখন ওর মা কড়িকাঠ থেকে ঝুলে– বাধা দিয়ে বললাম, রত্নময়ীর ধারণা, তার মাকে তার বাবা খুন করেছিলেন। মুদি একটু চুপ করে থেকে বললেন, রাজবাড়িতে গুজব রটেছিল। সে-গুজব বাইরেও ছড়িয়েছিল। জহরত-আরার কানে গিয়ে থাকবে। তবে ওর লালন-পালনের কোনো ত্রুটি করেননি অনন্তনারায়ণবাবু। মেমসায়েব রেখে বাড়িতে ইংরেজি শিখিয়েছেন। আমার কাছে নিজের চেষ্টায় আরবি শিখেছে। একজন হিন্দুপণ্ডিত কিছুকাল বাঙলা সংস্কৃত শেখাতেন। পরে জাতিপাতের ভয়ে তিনিও গতিক বুঝে কেটে পড়েন। কিন্তু জহরত-আরা বুদ্ধিমতী। অত্যন্ত মেধাবী। ঝটপট সবকিছু শিখে নেওয়ার ক্ষমতা ওর আছে। বললাম, বাবু গোবিন্দরাম কেমন লোক? মুন্সিজি গম্ভীর মুখে বললেন, খুবই সাচ্চা লোক। কিন্তু মনে হচ্ছে, তিনিও আর থাকবেন না। মালিকের প্রতি আমার মতোই অসন্তুষ্ট। তিনি একজন উদারহৃদয় হিন্দু। জহরত-আরাকে তিনিও আমার মতো স্নেহ করেন। আমরা দুজনে পরামর্শ করেই আপনার আব্বা-হজরতের কাছে ওকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলাম। জমিদারবাবুকে দিয়ে চিঠি আমরা লিখিয়ে নিয়েছিলাম। জানেন তো উনি খুব ভালো ফারসি জানেন। মুন্সি আবদুর রহিম তাঁর শীর্ণ আঙুল খুঁটতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে খাস ছেড়ে ফের বললেন, আপনার আব্বা-হজরতের দয়ায় জহরত-জারার অসুখ একেবারে সেরে গিয়েছিল। কিন্তু আবার কিছুদিন থেকে সেই আগের মতো বেহুঁশ হয়ে পড়ছে। বেশের সময় আরবি জবানে আগের মতো নিজের বাবার বিরুদ্ধে কুৎসিত কথাবার্তা বলছে। মাঘমাসে ব্রহ্মপুরে– আবার দ্রুত বাধা দিয়ে বললাম, রত্নময়ীর দাদার কথা বলুন, শুনি! মুন্সিজি ভীষণ চমকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, জহরত আপনাকে কতটুকু বলেছে জানি না। সদর শহরে থেকে কালেজে পড়ার সময় হরিনারায়ণ স্বদেশীদের পাল্লায় পড়ে। কালেকটারকে গুলি করতে গিয়েছিল। একজন দারোগা মারা পড়ে গুলিতে। কোথায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল জানি না। পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছিল। বিচার চলার সময় জেলহাজত থেকে সে পালিয়ে গেছে। কীভাবে পালাতে। পারল কে জানে? অনন্তনারায়ণবাবুর ব্যাপার তো বললাম। ইংরেজদের সঙ্গেও খুব দহরম মহরম আছে ওঁর। কাজেই ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র বলে ঢোলশহরত জারি। করেছেন। খবরের কাগজেও সেকথা ছাপিয়েছেন– ইংরেজি কাগজে। বুঝলেন। তো? বললাম, বুঝলাম। হরিবাবু কোথায় আছেন, জানেন কি? মুন্সিজি বিষণ্ণভাবে হেসে বললেন, মাঘমাসে ব্ৰহ্মপুর থেকে ফিরে এসে জহরত আমাকে সব বলেছে। আমার ধারণা দাদার সঙ্গে ওর দেখা হওয়াটা উচিত হয়নি। আগে জানলে গোবিন্দবাবুকে নিষেধ করতাম। ব্রহ্মপুর থেকে ফিরে আসার পর থেকেই অসুখটা আবার দেখা দিয়েছে। এখন আমার খালি ভয় হচ্ছে, বেহঁশের ঘোরে বাঙলা জবানে যদি দৈবাৎ দাদার সম্পর্কে কিছু বলে ফেলে, মুশকিল হবে। সরকার হরিনারায়ণকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবেই জেনে রাখুন। আর দেখুন শফিসাহেব! জীবনে অনেক ঠকে শিখেছি, মানুষকে খুন করে মানুষের ভালো করা যায় না। আপনি কজনকে খুন করবেন? এত বড়ো দুনিয়া, এত মানুষ! কতজনের ভালোর জন্য কতজনকে খুন করতে হবে? মুখ মানুষ এই কথাটা কেন বোঝে না যে খুনীর হাতের রক্ত কিছুতেই ধোয়া যায় না! যতই করুন, রক্তের ছাপ হাত থেকে মোছা যাবে না।– দার্শনিক বৃদ্ধের দিকে করুণা এবং বিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ রোমান কবি ওভিদের একটি কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল : হায়! যারা ভাবে, হত্যার মতো কদর্য অপরাধ সহজেই নদীর জলে ধোয়া যাবে, তারা কী গোবচারা! শিউরে উঠলাম। বললাম, ‘পাহলোয়ানকে আনতে বলুন সহিসকে। পদ্মার চরে ঘুরে আসি। মুন্সিজিও উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হল, আরও অনেক কথা যেন বলার ছিল।–

Love begin in shadow and end in light’

“পদ্মার ধসিয়া-পড়া ঢালু তীরে দুর্বাঘাসের হরিদ্বর্ণ কোমলতা এবং তাহারও নিম্নে একফালি নীলাভ জলের অধিকতর কোমলতার পর চরের ধূসর বালির মিশ্রিত কোমলতা একটি কালো চতুষ্পদ প্রাণীর কঠিন খুরে বিক্ষত হইতেছিল! পাহলোয়ান, তুই বর্বর। তুই একজন ভ্যানডাল! পাহলোয়ান, বলিল, কাহাকে গালি দিতেছ? আমি নিমিত্ত মাত্র। পাহলোয়ানের সহিত নির্জনে এরূপ কথোপকথনের সূত্রপাত হইল। চরটি ক্রমে-ক্রমে কচ্ছপের পিঠের আকৃতি বোধ হইল এবং বালি দৃঢ়তম হইতে মাটিতে পরিণত হইল। শীর্ষদেশে, কেন্দ্রস্থলে একটি বৃক্ষ দেখিলাম। যখন। বৃক্ষটি দেখিতেছিলাম, তখন পাহলোয়ান বলিল, অমন করিয়া কী দেখিতেছ? বলিলাম, একটি বৃক্ষ। পাহলোয়ান এবার একটি আশ্চর্য বাক্য উচ্চারণ করিল। যখন প্রান্তরে কোনও বৃক্ষকে দেখ, তখন প্রান্তর দৃষ্টির অগোচরে থাকে। বলিলাম, ঠিক বলিয়াছ। বৃক্ষ ও প্রান্তর একই সঙ্গে দর্শন অসম্ভব বটে! পাহলোয়ান বলিল, অথচ দেখ, প্রান্তর না থাকিলে বৃক্ষ থাকে না। প্রান্তরই বৃক্ষকে প্রকাশ করে। বলিলাম, এমন কথা কেন বলিতেছ? কৃষ্ণকায় অশ্বটি মুন্সি আবদুর রহিমে পরিণত হইল। বলিল, অবতরণ কর। বলিতেছি। তাহার পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিলে সে বলিল, পরিপ্রেক্ষিত ব্যতিরেকে সকল বস্তু –জড় হউক, কী অ-জড় হউক, মায়াবিভ্রম মাত্র । তুমি সতর্ক হও। মায়াবিভ্রম–উহা মরীচিকা। উহার দিকে ধাবিত হইও না। শূন্যতায় নিক্ষিপ্ত হইবে! ভুদ্ধ হইয়া বলিলাম, ইহার অর্থ কী? ইহা বলারই বা উদ্দেশ্য কী, রূপান্তরিত সত্তাটি বলিল তোমার জন্য দুঃখ হয়। তুমি পরিপ্রেক্ষিত ব্যতিরেকে সকল কিছু দর্শন কর। তুমি সিতারা বেগম, স্বাধীনবালা মজুমদার, কিম্বা রত্নময়ী ত্রিবেদীকে ওই বৃক্ষবৎ দেখিয়াছ। আরও ভাবিবার আছে। দেখ, দেখ! বৃক্ষে একটি পক্ষী আসিয়া বসিল। এবার বৃক্ষটি আর নিতান্ত বৃক্ষ রহিল কি? উহা পক্ষীময় হইল। এবার দেখ, একজন মানুষ আসিয়া বৃক্ষতলে দাঁড়াইল। বৃক্ষটি আরও পরিবর্তিত হইল। উহার নির্জনতার আকৃতি লোপ পাইল। দেখ দেখ মানুষটির কাঁধে একটি বন্দুক! বৃক্ষটি নিজস্বতা হারাইল। পক্ষী, মানুষ, বন্দুক, বৃক্ষ মিলিয়া একটি জটিল বিভ্রম। সক্রোধে বলিলাম, বিভ্রম গুঁড়াইয়া ফেলিতেছি। দেখ, কী করি! বলিয়া অগ্রসর হইলাম। এই বিশাল চরসমাকীর্ণ নদীটি পূর্ববাহিনী। পশ্চিম হইতে অস্তসূর্যের পীতাভ লাল আলোয় মানুষটিকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। একজন গোরা সাহেব! সে বৃক্ষের মূলে বসিয়া কাণ্ডে হেলান। দিয়া উত্তরে কিছু দেখিতেছে। আমি ও পাহলোয়ান দক্ষিণে নিম্নভূমিতে থাকায় সে আমাদের দেখিতে পায় নাই বোধ হইল। নিকটবর্তী হইলে সে আমার পায়ের শব্দে চমকিয়া মুখ ঘুরাইল। তাহার পর ধমক দিয়া বলিল, হেই ব্যাবু! ইদার মাত আও! গো অ্যাওয়ে! সে ইঙ্গিতে স্থান ত্যাগ করিতে বলিল। সম্ভবত গোরা সাহেবটি হাঁস মারিতে আসিয়াছে! তবু আমি তাহার দিক যাইতেছি দেখিয়া সে বন্দুক তাক করিয়া বলিল, ইউ ড্যাম নেটিভ কুত্তা! ভাগো! সহস্যে দ্রুত বলিলাম, স্যার! আই মে হেল্প ইউ টু ফাইন্ড আউট এ প্লেস হোয়্যার উ উইল সি থাউজ্যাণ্ডস অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস্ অফ ওয়াইন্ড ডাক। গোরা শিকারী বন্দুক নামাইল । চকিতদৃষ্টে চতুর্দিকে দেখিয়া লইলাম। উঁচু চরটির উত্তৰ-পূর্বাংশ ঢালু হইয়া পরিব্যাপ্ত কালো জলে মিশিয়াছে। দূরে কয়েকটি নৌকা। পশ্চিমেও জল –কিন্তু উহা দিনশেষের ম্রিয়মাণ আলোকে ঈষৎ রঞ্জিত। দক্ষিণে দূরে উঁচু জনহীন। দক্ষিণ-পূর্বে আরও দূরে কৃষ্ণপুর। দিগন্তরেখার সহিত মিশ্রিত। গোরাসাহেব উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ডোন্ট মাইন্ড ব্যাবু! আই অ্যাম ড্যাম টায়ার্ড। লেটস গো দেয়ার। ও মাই গড! সে বন্দুক তুলিবার পূর্বেই ভূতলশায়ী হইল। তাহার বুকে মাত্র একহাত দূর হইতে পিস্তল-এর গুলি গিয়া ঢুকিয়াছিল। তাহার তলপেটে একটি পা দাবাইয়া ঝুঁকিয়া পড়িলাম। দ্বিতীয় গুলি তাহার কপাল ফুটা করিল। বন্দুকটির জন্য লোভ সম্বরণ করিলাম। পুনর্বার চাবদিক চকিতদৃষ্টে দেখিয়া লইয়া ধীরে গম্ভীর শরীরে পাহলোয়ানের নিকট ফিরিলাম। দেখিলাম, উহার দার্শনিক সত্তা লোপ পাইয়া পুনরায় চতুষ্পদ বাহনে পরিণত হইয়াছে। পাড়ে উঠিয়া একটু ভাবনা হইল। পাহলোয়ানের খুর এবং আমার। জুতার ছাপ ফেলিয়া আসিলাম! তবে হরিবাবু এবং স্বাধীনবালার কাছে সগৌরবে এবং সবিস্তারে বর্ণনার যোগ্য একটি কীর্তি বটে! পাড় হইতে কিছুদূর শস্যশূন্য জমি এবং ঝোঁপঝাড়ের পর কাঁচা রাস্তায় পৌঁছাইয়া ভাবিলাম, রত্নময়ীকে ঘটনাটি বলিব কি? তৎক্ষণাৎ মনে হইল, কিন্তু কেন এই কদর্য কর্মটি কবিলাম? মুন্সিজির সেই উক্তির উপযুক্ত প্রত্যুত্তরদান হইল কি? স্ট্যানলির পিস্তলে আর চৌদ্দটি কার্তুজ অবশিষ্ট রহিল। যদি গুলি না ছুটিত, গোরা শয়তানটির বন্দুক কাড়িয়া লইতাম সন্দেহ নাই। কিন্তু কেন এ কাজ করিলাম? পাহলোয়ান! ব তো ভাই, কেন আবার এই দুর্মতি ঘটিল? পাহলোয়ান চুপ করিয়া রহিল। তখন বলিলাম, ওই শালা আমাকে নেটিভ কুত্তা বলিযা তাক করিয়াছিল। উত্তরের ফটক দিয়া রাজবাড়িতে ঢুকিলাম। ঘুরিয়া বাড়ির সম্মুখে যাইলে রত্নময়ীকে দেখিতে পাইলাম। আবছা আঁধারে ফোয়ারার বৃত্তাকার বেদীতে একা বসিয়া আছে। আমাকে দেখিয়া সেই সহিস দৌড়াইয়া আসিল। পাহলোয়ানকে কিছুক্ষণ টহল খাওযাইবার নির্দেশ দিয়া রত্নময়ীর কাছে গেলাম। সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে আমার প্রিয়তমের দেখা হয় নাই? কিছু তফাতে বসিয়া বলিলাম, একজন গোরা সাহেবকে দেখিয়াছি। নিশ্চয় সে তোমার প্রিয়তম নহে? রত্নময়ী বলিল, বুঝিয়াছি। তুমি মতিগঞ্জের কুঠিয়াল রিজলিকে দেখিয়াছ। জিজ্ঞাসা করিলাম, সে কে? রত্নময়ী বলিল, সে রেশম কারবারী। তাঁতী এবং জোলাদিগকে বেমরশুমে দাদন দেয়। রেশমী থান রেলপথে। কলিকাতা চালান করে। বাবার সহিত তাহার খুব বন্ধুতা আছে। আস্তে বলিলাম, লোকটি কি প্রকৃতির? রত্নময়ী শুধু বলিল, বাবার বন্ধু! বুঝিলাম সে কী বলিল! একটু পবে বলিলাম, বৈকালে শুনিয়াছি, তোমার শরীর খারাপ। বাহির হইলে কেন? রত্নময়ী আস্তে বলিল, তোমার প্রতীক্ষা করিতেছি। সে কিয়ৎক্ষণ নীরব রহিল। বলিলাম, আমি এখনই রওয়ানা হইব। দাওয়াত করিয়াছিলে। দাওয়াত খাইয়াছি। এইবার বিদায় চাহি। রত্নময়ী শ্বসমিশ্রিত স্বরে বলিল,দাওয়াত শব্দের অর্থ শুধু খাদ্যবিষয়ক নহে। তোমাকে আমার জিনটির সঙ্গে ডুয়েলে লড়িতে ডাকিয়াছিলাম। তুমি বিস্মৃত হইয়াছ দেখিতেছি। হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, কোথায় সে? তাহাকে ডাক। দেখি, লড়িতে পারি নাকি। রত্নময়ী উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, আমার সহিত আইস। দেখাইতেছি। এইসময় প্রাসাদের পার্লারের এদিকে, ফোয়ারার পিছনে আবছা একটি মূর্তি দৃষ্টিগোচর হইল। বলিলাম, কে? মুন্সিজি সাড়া দিয়া বলিলেন, কতদূর ঘুরিলেন? মনে হইল, লোকটি আড়ালে দাঁড়াইয়া কথা শুনিতেছিল। বলিলাম, বিহারের মাটি দেখিয়া আসিলাম। মুন্সিজি বলিলেন, চরে যান নাই? বলিলাম, না। ঘোড়া লইয়া যাইবার রাস্তা দেখিলাম না। পার্লারের কড়িকাঠ হইতে একটি ঝাড়বাতি জ্বলিতেছে। সেখানে মুন্সিজি আসিয়া মৃদুস্বরে ডাকিলেন, মা জহরত! রত্নময়ী বলিল, জী, মুন্সিজির মুখ দেখিয়া মনে হইতেছিল, অন্য কিছু বলিবেন। কিন্তু বলিলেন, বেশী চলাফেরা করিও না। বেশী কথাবার্তা বলাও ঠিক নহে। মুন্সিজি কথাটি বলিয়াই চলিয়া গেলেন। হলঘরেও ঝাড়বাতি জ্বলিতেছিল। রত্নময়ী গালিচাঢাকা কাঠের সোপানে বালিকার ন্যায় উঠিতেছিল– চঞ্চল ও দ্রুতগতি। উত্তর-পূর্ব কোণে হরিবাবুর সেই কক্ষের বারান্দায় এক পরিচারিকা দাঁড়াইয়া ছিল। রত্নময়ী বলিল, দুইখানি চেয়ার পাতিয়া দাও। আর বাবুমহাশয়ের জন্য চা লইয়া আইস। কিছু খাদ্যও আনিবে। আপত্তি করিবার সুযোগ পাইলাম না। রত্নময়ী চেয়ারে বসিয়া বলিল, বস। জ্যোৎস্নারাত্রে এখানে বসিয়া আমি এবং দাদা পদ্মা দেখিতাম। একটু পরে চাঁদ উঠিবে। সে হাসিল। পুনরায় বলিল, ওইখানে আমার প্রিয়তম জিনটি শাদা ঘোড়ায় আমাকে চড়াইয়া খেলা করে। কী? চুপ করিয়া রহিলে যে? তুমি কি আমাকে মিথ্যাবাদিনী ভাবিতেছ? রত্নময়ীর কথায় তীব্রতা ছিল। বলিলাম, না। তুমি যখন বলিতেছ, তখন উহা সত্য বলিয়া মানিব। রত্নময়ী উষ্ণস্বরে বলিল, আমি কিছু বলিলেই উহা সত্য হয় না। তুমি বলিলেও হয় না। যাহা সত্য, তাহা সত্য। ইংলিশ প্রবচনটি নিশ্চয় অবগত আছ যে ‘টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।’ তোমাকে দেখাইতেছি। বলিয়া সে বারান্দা দিয়া ছায়ার ভিতর মুছিয়া গেল। আমাকে অবিলম্বে স্থান ত্যাগ কবিতে হইবে। মানসিক অস্থিরতা প্রবলতর হইতেছে। চরে পাহলোয়ান ও আমার পদচিহ্ন রহিয়া গিয়াছে। পদচিহ্নগুলি ষড়যন্ত্রপূর্ণ চাপাস্বরে কথাবার্তা বলিতেছে। পবিচারিকা ইংলিশ খাঞ্চায় (ট্রে) খাদ্য এবং চায়ের সরঞ্জাম বেতের টেবিলে রাখিয়া চলিয়া গেল। এই বাড়ির মানুষগুলি পুতুল। কোনও অদৃশ্য হাত ইহাদের চালনা করিতেছে যেন। সেই চালনায় বদ্ধ ফটক খুলিয়া যায়। সহিস দৌড়াইয়া আসে। বান্দা-বাঁদীরা হুকুম তামিল করিতে মুহঁতমাত্র বিলম্ব করে না। মনে হইল, বাড়িটি একটি কারখানা। কিম্বা এই প্রথম জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশের জন্য এইসব ধারণা হইতেছে। সম্ভবত সকল রাজা-নবাব-জমিদার-বিত্তশালীদের গার্হস্থ্য জীবনযাত্রা এমনভাবে ঘড়ির কাঁটার নিয়মে চালিত হয়। কক্ষের ভিতর শেজবাতি ছিল। তাহার আলোকে বারান্দা ঈষৎ আলোকিত! কিয়ৎক্ষণের মধ্যে রত্নময়ী আসিয়া কক্ষ হইতে বাতিটি আনিয়া টেবিলে রাখিল। তাহার হাতে একখণ্ড কাগজ ছিল। বসিয়া বলিল, এই দেখ। ইহাতে সত্য চিত্রিত করিয়াছি। আলোয় কাগজটি ধরিলাম। উহাতে নিম্নরূপ ছক রহিয়াছে।

অলীক মানুষ

রত্নময়ী গম্ভীরমুখে বলিল, কিছু বুঝিলে? চিন্তা কর। খাইতে খাইতে চিন্তা কর। গভীর মনোযোগের ভান করিয়া বলিলাম, আহার চিন্তার প্রতিকূল। বরং পানীয়–বিশেষত উষ্ণ পানীয় মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করার অনুকূল। রত্নময়ী দ্রুত চা প্রস্তুত করিল। চায়ে চুমুক দিয়া বলিলাম, ‘আমি’টা কে? রত্নময়ী সমিশ্রিত স্বরে বলিল, আমি উহা দেখিলে আমি! এক্ষণে তুমি দেখিতেছ। সুতরাং তুমি এক্ষণে ‘আমি’ হইয়াছ। মুখে গম্ভীর্য রাখিয়া বলিলাম, ‘আমি’ রক্তবর্ণ কেন? রত্নময়ী চক্ৰান্তসঙ্কুল অথচ যন্ত্রণাপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বলিল, ‘আমি’ নিয়ত আক্রান্ত। শরবিদ্ধ। রক্ত ঝরিতেছে। তাহার দিকে চাহিলাম। সে আমার দিকে চাহিয়া আছে। চক্ষুদ্বয়ে নিঃশব্দ অশ্রুজনিত সিক্ততা। বিস্মিত ছইয়া বলিলাম, তুমি কাঁদিতেছ কেন রত্নময়ী? (বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ নবেলের প্রসিদ্ধ উক্তিটির প্রতিধ্বনি করিয়াছিলাম বটে; কিন্তু তৎকালে উহা স্মরণ ছিল না)। রত্নময়ী বলিল, কেহ আমাকে উদ্ধার করার নাই। বলিয়া কাঁদিতেছি! ভাবিয়াছিলাম –সে চুপ করিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, কী ভাবিয়াছিলে? এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তখন বলিলাম, তুমি বিত্তবান ব্যক্তির কন্যা। কেন-না-কেহ একদিন তোমাকে বিবাহ করিবে। বিত্ত-ঐশ্বর্য এমন বস্তু, যাহা জাতিপাতজনিত সংস্কার পদদলিত করিয়া থাকে। ডোজ বেশ কড়া হইয়া ছিল। আমি ঠিক ইহাই চাহিয়াছিলাম। রত্নময়ী সহ্য করিতে পারিল না। হুংকার ছাড়িয়া বেতের টেবিলটি উল্টাইয়া দিল। সুদৃশ্য বাতি এবং চীনামাটির সুন্দর পাত্রগুলি চূর্ণ বিচুর্ণ হইল। অন্ধকারে উহার শাসপ্রশ্বাসের শব্দে ঝড় বহিতেছিল। তাহার পর সে মুর্ছিতা হইল। চেয়ার উল্টাইয়া মুহূর্তে উহাকে ধরিয়া ফেলিলাম। বিস্ময়ের কথা, এই বাড়ির অদৃশ্য জাদুকরের হাতের খেলা এমনই নিপুণ যে তৎক্ষণাৎ লণ্ঠন হাতে পরিচাক পরিচারিকারা আসিয়া পড়িল। উহারা কি সতত এই জিনগ্রস্ত রাজকন্যাটির গতিবিধির প্রতি নজর রাখিয়া আড়ালে ওত পাতিয়া থাকে? উহাদের হাতে কম্পিত শীর্ণ যুবতীদেহটি অৰ্পণ করিয়া দ্রুত চলিয়া আসিলাম। হলঘরে নামিলে মুন্সিজির সহিত দেখা হইল। বলিলাম, আমি এখনই রওনা দিতেছি। আসুন, পাহলোয়ানের আস্তাবল দেখাইয়া দিন। মুন্সিজি বিলম্ব করিলেন না! বুঝিলাম, তিনি এই অবাঞ্ছিত আপদবিদায়ের জন্য ব্যগ্র ছিলেন।…”

‘Stand out of my way you are blocking the sun.’
–Diogenes to Alexander, the Great.

একদিন ‘হাজারিলালে’র কুটিরে যাবার সময় বিজয়পল্লীর পাশে বাঁধের কিনারায় একটি প্রকাণ্ড ছাতিমগাছের তলায় ভিড় দেখলাম। ভিড়ের কারণ একজন সাধু কিংবা ফকির। মাথায় জটা আছে। কিন্তু পরনে কালো আলখেল্লা। গলায় মোটা-সোটা লাল পাথরের মালা। হাতে একটি প্রকাণ্ড লোহার চিমটে। চিমটের ডগায় তামার আংটা। সে চিমটেটি বুকে ঠুকছে। ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে। বাঁকা সর্দার এবং আরও কিছু লোক সামনে বসে আছে। বাঁকা গাঁজা ডলছিল। একটু পরে বুঝলাম, সাধু নয়, মুসলমান ফকির। একে লোকে মস্তানবাবা বলে। সে চোখ বুজে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কিছু আওয়াচ্ছে। একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলাম। হাজারিলাল কুটিরে নেই। পাহলোয়ানের চালাঘর খালি। এদিক-ওদিক খুঁজে দেখি, একটু দূরে জলার ধারে পাহলোয়ান ফাঁড়িঘাস চিবুচ্ছে। পেছনের পা-দুটি যথারীতি বাঁধা। সে লাফ দিয়ে চলাফেরা করে এবং পছন্দসই ঘাস বেছে খায়। কিছুক্ষণ বাঁশের মাচানে একা চুপচাপ বসে কাটালাম। সারাক্ষণ অস্বস্তি। পদ্মার চরে চিহ্ন রেখে এসেছিলাম। পরদিন বিকেলে কালবোশেখির ঝড়বৃষ্টিতে সেগুলি ধুয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগে যদি ধূর্ত কোনো দারোগার চোখে পড়ে থাকে? একটি কালো ঘোড়া এবং তার সওয়ার কৃষ্ণপুরের অসংখ্য ঘোড়া সওয়ারদের মধ্যে যদি মিশে গিয়ে না থাকে? মাচান থেকে নেমেছি, টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। অগত্যা কুটিরের দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি থামলে জুতো খুলে ধুতি গুটিয়ে ফিরে চললাম। বিজয়পল্লীর সামনে গিয়ে দেখি সেই মস্তানবাবা একা দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমাকে দেখামাত্র সে কালো আলখেল্লা দুদিকে সরিয়ে নিজের নগ্ন শরীর দেখাল। থমকে দাঁড়ালাম। লোকটির শরীর ঘন লোমে ঢাকা। কিন্তু চামড়ার রঙ ফ্যাকাসে, শাদা। মুখের রঙের সঙ্গে কোনো মিল নেই। খাড়া নাক। লাল চোখ! পুরু কাঁচাপাকা ভুরু। মুখে শিশুর হাসি। সে খি খি করে হাসছিল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, কী দেখলি? জবাব না দিয়ে চলে আসছি, বাঁধের উলটোদিকের একটি ঘরের দাওয়া থেকে একটি লোক একগাল হেসে বলল, বড় খারাপ স্বভাব মশাই! কাউকে মানে না। সব্বাইকে ওইরকম! বাঁকার জন্য ওর রক্ষে। নৈলে কবে মেরে তাড়িয়ে দিত। সে কথা বলতে-বলতে আমার সঙ্গ নিল। মাথা থেকে পিঠ ঢেকে পেছনে হাঁটু অব্দি লম্বা তালপাতার একরকম আচ্ছাদন তার। কোটরের মতো দেখতে এই আচ্ছাদনের স্থানীয় নাম ‘টাপোর। বর্ষায় চাষীরা কেউ মাথাল, কেউ তালপাতার এই টাপোর পরে মাঠের কাজ করে। লোকটি বলতে-বলতে চলল, পয়সার ওপর কিন্তু লোভ নেই। খাওয়াদাওয়াতেও তেমনি। কেউ দিল খেল, নয়তো না। তবে সিদ্ধপুরুষ বলে মনে হয়, জানেন? ছেলেপুলেদের খুব ভালোবাসে। সে হাসতে লাগল। ভালোও বাসে, আবার ওই দুষ্টুমিও আছে। বুঝলেন? যদি বলে, ও মস্তানবাবা, হিসি করোদিকিনি, দেখি! অমনি হিসি করে দেখাবে। অবশ্যি সাধুফকির-সিদ্ধপুরুষরা ওইরকমই হয়।– দেবনারাণয়দার স্বর্গরাজ্যের অবস্থা দিনে-দিনে এভাবে বদলে যাচ্ছে তাহলে। সেদিনই ওঁকে মস্তানবাবার কথাটা বললাম। একটু চুপ করে থেকে বললেন, লোকটিকে। দেখেছি। একদিন সন্ধ্যার প্রার্থনাসভা থেকে চোখ পড়ল, একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ব্ৰহ্মকীর্তনের সময় বুকে চিমটে ঠুকে তাল দিতে দিতে নাচতে লাগল। কীর্তন শেষ হল। তখন ও গান গেয়ে উঠল। গলাটা গাঁজা খেয়ে নষ্ট করেছে। কিন্তু সুরেলা। সত্যি বলতে কী, সমস্ত সভা স্তব্ধ, নিস্পন্দ। তুমি কোথায় ছিলে জানি না। ছিলে কি? বললাম, নিশ্চয় ছিলাম না। তাহলে শুনতে পেতাম। দেবনারায়ণদা বললেন, একখানা মারফতি গান গাইল। মনে হল, জীবাত্মা-পরমাত্মার কথাই বলছে। গানের বাণীটি শোনো। পরে লিখে নিয়েছি। বলে তিনি একটি ডায়রিবই খুলে পড়ে শোনালেন?

সবে বলে আল্লা-আল্লা আমি জানি দুই।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লা মিছা জানি মুই।।
একদেশেতে দুজন রাজা
কেউ কারুরো নয়কো প্রজা
আরশে প্রেমের খেলা বুঝলি না গো তুই।।

দেবনারাণয়দা বললেন, ফকিরদের মধ্যে অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী সবরকম আছে দেখেছি? এ একটি গভীর গবেষণা আর চিন্তার বিষয়। বহু বছর আগে আরেকজন মারফতি ফকিরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে এমন পাগলাটে প্রকৃতির নয়। গম্ভীর লোক। তার একখানি গান লেখা আছে।

যার আকার নাই তার খুঁজলে কী পাই বল আমারে।
নিরাকার নিরঞ্জন সে ভাই শুনি সর্বশাস্তরে।।
কী দেখে নাম প্রচার হয়
যার নাই কি তাহার পিছু কী হবে দোড়ে-দোড়ে ।।

দেবনারায়ণদাব কাছে যাওয়া ভুল হয়েছিল। হাতে পেলে সহজে নিষ্কৃতি দেন না। এবার তিনি গুনগুন করে ব্রহ্মসঙ্গীতে গাইতে শুরু করলেন। শাস্ত্রীজি এসে উদ্ধার করলেন। ডাকঘরে গিয়েছিলেন। আশ্রমের চিঠি-পত্রিকার বোঝা বয়ে এনেছেন। বাইরে ভিজে ছাতি রেখে বললেন, বছরের লক্ষণ ভালো বোধ হচ্ছে না। দেবনারায়ণদা চিঠি-পত্রিকার বান্ডিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই সুযোগ বেরিয়ে গেলাম। লাইব্রেরি-ঘরে স্বাধীন জানালার পাশে বসে খুব মন দিয়ে কী বই পড়ছিল। মুখ তুলে একটু হাসল । বললাম, হাসছ কেন? স্বাধীন বলল, কানে আসছিল দেবুজ্যাঠা তোমাকে গান শেখাচ্ছেন! বললাম, না–না-মস্তানবাবা! স্বাধীন ভুরু কুঁচকে বলল, মস্তানবাবা? তারপর হেসে উঠল। ও, বুঝেছি! লোকটা ভারি অদ্ভুত জান? সেদিন ব্ৰহ্মমন্দিরে গেটের সামনে দেখি, মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, কী দেখছ অমন করে? বলে কী– বেটি! বাবুকে শিগগির বল গিয়ে, এত বড়ো দরজা করেছে, এক্ষুণি বন্ধ করে দিক। নৈলে এখান দিয়ে মন্দির-টন্দির সব পালিয়ে যাবে। চমকে উঠে বললাম, কী আশ্চর্য! স্বাধীন বলল, আশ্চর্য মানে? বললাম, তোমাকে দেখাচ্ছি। আলমারি থেকে বাঁধানো প্রকাণ্ড একটি বই বের করলাম। ব্যস্তভাবে খুঁজতে থাকলাম। স্বাধীন কয়েকবার প্রশ্ন করে তাকিয়ে রইল। বহুক্ষণ পরে পাতাটি খুঁজে পেলাম। বললাম, সমাচারদর্পণ পত্রিকার এই পাতাটি পড়ে দেখো। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর শনিবারের সংখ্যায় দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ‘দৈঅজিনিস’ সম্পর্কে কী লেখা আছে দেখো। তুমিও অবাক হয়ে যাবে। স্বাধীন বাঁধানো পত্রিকাবইটি নিয়ে পড়তে থাকল। বললাম, দিও-জেনিস। ইংরেজিতে ‘সিনিসিজম’ প্রসঙ্গে তাঁর কথা পড়েছি। তিনিই নাকি আলেকজান্দারকে বলেছিলেন, ‘সরে দাঁড়াও! রোদ আড়াল কোরো না।’ স্বাধীন বিরক্ত হয়ে বলল, পণ্ডিতি ছাড়ো। পড়তে দাও! একটু পরে সে উত্তেজিতভাবে বলল, শোনো, শোনো!

‘ঐ দৈজিনিস এক দিন এক ক্ষুদ্র শহরের উচ্চ প্রাচীর
ও অতি উচ্চ তাহার দ্বার দেখিয়া শহরের
কর্তারদিগকে কহিল যে তোমরা বার বন্ধ কর নতুবা
শহর পলাইয়া যাইবে।’–

এর কিছুদিন পরে স্বাধীনকে জিগ্যেস করলাম, কী খুকু? গোপনে জ্ঞানী মস্তানবাবার দীক্ষা নিলে নাকি? স্বাধীন খাপ্পা হয়ে বলল, লোকটা অসভ্য। পাগল। ছিঃ! হেসে ফেললাম। বুঝলাম ‘বেটিকে’ কী দেখিয়েছে সে।

কাহারও শিরচ্ছেদ করা হত্যা নহে; একটি উপাদানকে
অপর একটি উপাদানে পরিবর্তিত করা মাত্র।
–পকুধ কচ্চায়ন (দীঘনিকায়)

আশ্রমের তন্তুবার সমিতির ম্যানেজার বসন্তবাবুকে পছন্দ করি না, জানেন। তবু গায়েপড়া স্বভাব! এ ধরনের লোকেরা সচরাচর ছিদ্রান্বেষী হন! সবখানে খুঁত খুঁজে পান এবং অপরকে সেটি দেখিয়ে দিতে ছটফট করে বেড়ান। গায়েপড়া স্বভাবের কারণ হয়তো এটাই। জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা খুঁতযুক্ত আমিও মানি। প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্তও হই। কিন্তু আমি বসন্তবাবু নই। কিছুদিন আগে তিনি একটি আশ্চর্য খুঁতের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেটি সুতোকাটুনি করুণা ওরফে ইকরাতনের মধ্যাঙ্গ। সেখানে স্ফীতি ছিল। বসন্তবাবু বহু আগেই ওই ওই স্ত্রীলোকটিকে ‘ব্যাড ক্যারেকটার’ ছাপ সেঁটে দিয়েছিলেন। এবার বলেন, ম্যাথমেটিকস শফিবাবু! ২+২ = ৪ হওয়া অনিবার্য। বর্ষার এক সন্ধ্যায় বসন্তবাবু আমাকে জানান, খুঁতটি মেরামত করা হয়েছে। গর্ভবতী সুতোকাটুনি দেবনারায়ণদার হুকুমে স্বর্গলোক থেকে নির্বাসিত এবং বিজয়পল্লীতে আশ্রয় নিয়েছে। দেবনারায়ণদার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামব কি না ভাবছিলাম। কিন্তু তাঁর নীতিবাদ, জেদ আর খেয়ালের কথা জানি। আমিও নিজের স্বভাব সম্পর্কে সচেতন। নানা কারণে এখন আমার এই সুদৃঢ় আশ্রয়। প্রয়োজন। তাই চুপ করে থাকলাম। বসন্তবাবু মাঝে-মাঝে গায়ে পড়ে জানিয়ে যেতেন বাঁকাসর্দার একটি হবু-রক্ষিতা লাভ করেছে। স্ত্রীলোকটিকে সে একটি কুটির গড়ে দিয়েছে। তখনও বিষয়টির গভীরতা আর রহস্য আঁচ করিনি। শ্রাবণ মাসে হঠাৎ বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। আকাশ ভয়ংকর নীল হয়ে উঠল। ওই সময় পাঁচ কোশ দূরে রায়দীঘি গ্রামের পুলিশের থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন হরিবাবু। দারোগা চন্দ্রনাথ হাটি এবং জমাদার ফারাকত খা এই দুজন ছিল লক্ষ্যবস্তু। স্ট্যানলি হত্যার পর সারা মহকুমায় বহু নির্দোষ লোককে বিকলাঙ্গ করা হয়েছিল। তার সঙ্গে এই দুই বীরপুঙ্গবও জড়িত ছিল। আমরা রাত্রে রওনা হব। বিকেলে ভ্রমণের ছলে কেশবপল্লীতে হরিবাবুর কাছে যাচ্ছিলাম। বিজয়পল্লীর সামনে ছাতিমগাছটির তলায় প্রায়ই মস্তানবাবাকে ঘিরে ভিড় থাকত। এদিন একটি দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম। মস্তানবাবা হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। তার সামনে দুহাতে ন্যাকড়ায় জড়ানো। একটি শিশু নিয়ে একটি স্ত্রীলোক বসে আছে, সে করুণা নয়। কারণ করুণা তার পাশে। মস্তানবাবা চোখ বুজে বিড়বিড় করছিল। হঠাৎ বুকে শিশুটির বুকে জোরে ফুঁ দিয়ে বলল, যা। এবার স্ত্রীলোক দুটি উঠে দাঁড়াল। করুণার কোলে শিশুটিকে অপর স্ত্রীলোকটি তুলে দেওয়ামাত্র চিনতে পারলাম। অজিফামামী। ইচ্ছে হল,চিৎকার করে বলি, ভুল! মিথ্যা! অসম্ভব। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরল না। দ্রুত স্থানত্যাগ করলাম। স্ত্রীলোকদিগের স্বভাব সত্যই বিচিত্র! ‘হাজারিলাল’ আমাকে দেখে বললেন, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? অসুখ করেনি তো? বললাম, না। খবর জানতে এলাম। হরিবাবু চাপাস্বরে বললেন, আমাদের মধ্যে চর ঢুকেছে সন্দেহ হয়। খবর এসেছে, গতকাল রাত্রে রায়দীঘি থানায় একজন গোরা সার্কেল অফিসার পঞ্চাশ-ষাটজন সিপাহি নিয়ে শিবির করছে। কাজেই পরিকল্পনা স্থগিত। সংঘের সদস্যদের আপাতত কয়েকদিন স্থানান্তরে আত্মগোপন করার নির্দেশ দিয়েছি। আমি এইমাত্র স্বাধীনকে দিয়ে তোমার কাছে খবর পাঠিয়েছি। রাস্তায় দেখা হয়নি? বললাম, না তো! হরিবাবু বললেন, তাহলে মাঠের রাস্তায় গেছে। তুমি এখানে থেকো না! আমি কয়েকদিন বিলের জঙ্গলে কাটাব। আর শোনন, তোমার ঘোড়াটির ব্যবস্থা করা দরকার। তুমি আশ্রমে আছ। দেববাবু তোমার পৃষ্ঠরক্ষা করবেন। কিন্তু–ঘোড়াটি তোমার-আমার সংযোগসূত্র। বরং ওকে নিয়ে গিয়ে শিগগির বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। একটু ভেবে বললাম, দেবনারায়ণদার কেন জানি না, ঘোড়া সম্পর্কে কিছু কুসংস্কার আছে বলে ধারণা। হরিবাবু হেসে বললেন, ঋগ্বেদের অশ্বসূক্তের কথা উল্লেখ করবে। বললাম, সুধন্যকে যদি মাহিনা দিই, সে পাহলোয়ানের দেখাশুনা করবে না? হরিবাবু চিন্তিতমুখে বললেন, ছোকরা বড়ো অন্যমনস্ক। তবে দেখি, কী করা যায়। বলে উনি হাঁক দিলেন, সুধনিয়া! হে সুধনিয়া! সুধন্য তার কুটির থেকে সাড়া দিল। তারপর দৌড়ে এল। হাজারিলাল’ বললেন, আরে সুধনিয়া! বাত শুনো। হামি কয় রোজকে নিয়ে আপনা মুল্লুক যাচ্ছে। তু শফিবাবুর ঘোড়ার জিম্মাদারি লে। মাহিনামে তনখা মিলেগা। হামরে দেতে তিন রুপৈয়া। আমার দিকে ইশারা করলে বললাম, পাঁচ টাকা পাবে। হাজারিলাল লাফিয়ে উঠলেন, আরে ব্যাস! পাঁচ বুপৈয়া! শালে, তু বড়া আদমি বন জায়গা। পাঁচ পেয়া! ঢাই মন চাউলকা দাম! জয় বজরঙ্গবলী! সুধনন্যর চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ঝলমল করছিল। জীবনে কখনও সে পাঁচ টাকা একসঙ্গে দেখেছে কি না সন্দেহ। তাকে অগ্রিম হিসেবে দুইটি রুপোর টাকা দিলে সে স্বপ্নাচ্ছন্নভাবে দুহাতে গ্রহণ করল। হাজারিলাল চোখ নাচিয়ে বললেন, তব তো শফিবাবু হৈয়ে গেল। এ সুধনিয়া! যা! উও দেখ পাহলোয়ানজি ঘাস খাচ্ছে। দোস্তি-উস্তি করতে হোবে তো, না কী? সুধন্য দেীডে বাঁধের নীচে নেমে গেল। এই আদিম পৃথিবীতে ঘোড়াটি ক্রমশ কিছুটা বন্যস্বভাবগ্রস্ত হয়ে উঠছে দিনেদিনে। কিন্তু কিছু করার নেই। মাঝে-মাঝে এসে তাকে সঙ্গ দিই। বাঁধের পথে বহুদূর যাই। লক্ষ করি, কদম ভুল করছে। কখনও অবাধ্যতার লক্ষণ দেখি। মনে হয়, প্রকৃতি ওকে করতল-গর্ত করে ফেলছে। সে একদা আমার সঙ্গে চমৎকার বাক্যালাপ করত। তাকে দার্শনিক বোধ হত। এখন মনে হয়, সে যেন দিওজিনিসে রূপান্তরিত হচ্ছে। স্বাধীনতাময়, সিনিক, উন্মাগী একটি কালো প্রবাহ। সভ্যতাকে খুরে ভাঙচুর করতে-করতে সে ছুটতে চায়। আমার মতো? হ্যাঁ, ঠিক আমার মতো। উদ্দেশ্যহীনতায় আক্রান্ত দুটি প্রাণী। সেদিন ফেরার পথে বিজয়পল্লীতে দেখলাম, মস্তানবাবা বুকে চিমটে ঠুকে ছাতরানো গান করছে। ভিড় করে লোকেরা শুনছে। বাঁদিকে একটি চালাঘরের উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে অজিফা মামী শিশুটির দেহে তেলহলুদ মাখাচ্ছে। স্বর্গভ্রষ্টা স্ত্রীলোকটি উঠোনের উনুনে পাতা ঠেলে জ্বাল দিতে-দিতে মুখ ঘুরিয়ে শিশুটিকে দেখছে এবং তার মুখে কী এক হাসি। তখনই সিদ্ধান্ত করলাম, শিশুটি বধযোগ্য। হত্যা কী? একটি উপাদানকে ভিন্ন উপাদানে পরিবর্তিত করা মাত্র! প্রকৃতিতে ইহা সতত ঘটিতেছে। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মের অভিব্যক্তি। স্বভাবতঃ সৰ্ব্বমিদং প্রবৃত্তম। লাইব্রেরিতে ঢুকে বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দীঘনিকায়’ খুলে বসলাম। স্বাধীন লণ্ঠন জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল। ফিরে এসে আস্তে বলল, হরিদা খবর পাঠিয়েছেন– তাকে থামিয়ে বললাম, জানি। হরিবাবুর কাছ থেকে এখনই আসছি। স্বাধীন বলল, কী বই পড়ছ? বললাম, শোনো!

‘মহারাজ! যে করে এবং করায়, যে ছেদন করে এবং ছেদন করায়, যে অঙ্গহীন করে এবং অঙ্গহীন করায়, যে শোক ও নির্যাতনের কারণ হয়, যে কম্পিত হয় এবং কম্পিত করায়, যে প্রাণনাশ করে, যে সন্ধি ছিন্ন করে, যে অদত্ত গ্রহণ করে, যে লুণ্ঠন করে, যে চৌর্য্যে প্রবৃত্ত হয়, গুপ্ত স্থান হইতে যে হঠাৎ পথচারীকে আক্রমণ করে, যে পরদারগমন করে, মিথ্যাভাষণ করে, তাহার এইসকল কর্মছাড়া পাপ হয় না। যদি কেহ ক্ষুরধার চক্রের দ্বারা পৃথিবীর প্রাণীগণকে এক মাংসখণ্ডে, এক মাংস-পুঞ্জে পরিণত করে, তজ্জন্য কোন পাপ হয় না, পাপের আগম হয় না। যদি ওই ব্যক্তি আঘাত করিতে ছেদন করিতে হত্যা করিতে২ ছেদন করাইতে২ অঙ্গহীন করাইতে গঙ্গার দক্ষিণ তীরবর্তী হইয়া গমন করে, তজ্জন্য কোন পাপ হইবে না, পাপের আগম হইবে না।’–

স্বাধীন শ্বাসরুদ্ধ স্বরে বলল, এসব কার উক্তি? বললাম, অক্রিয়াবাদী দার্শনিক পূরণ কসপের। তিনি বুদ্ধ ও মহাবীরের সমকালের লোক। স্বাধীন বলল, কী ভয়ানক কথা! বললাম, খুকু! তুমি একদিন স্ট্যানলিকে হত্যার জন্য আমাকে পিস্তল দিয়েছিলে। অবশ্য সে তোমার পিতৃঘাতী ছিল। কিন্তু হরিবাবু এবং আমি তাকে হত্যা করেছিলাম। স্ট্যানলির স্ত্রীপুত্রকন্যার দিক থেকে চিন্তা করো। তাদের মর্মযাতনার কথা ভাবো। পাতঞ্জল দর্শনে বলা হয়েছে, ‘অস্মিতা’ অর্থাৎ আমি ভাব যাবতীয় ক্লেশের অন্যতম প্রধান কারণ। বৌদ্ধ মিলিন্দপহ গ্রন্থে সে-জন্যই হয়তো বলা হয়েছে, ‘পুদ্‌গলো নূপলবভতি।’ পুদ্‌গল অর্থাৎ আত্মা নেই। স্বাধীন রুক্ষ স্বরে বলল, চুপ করো! পণ্ডিতি অসহ্য লাগে। বুঝলাম, স্বাধীন এই মুহূর্তে আমাকে চিনতে পারল। তার চোখে ভীতি এবং মুখে পাণ্ডুরতা ছিল। সে সশব্দে শ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বইটি বন্ধ করে বসে রইলাম। ব্রহ্মমন্দিরে উপাসনা শুরু হয়েছে। দেবনারায়ণদার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কানে এল, ‘আত্মানং বিদ্ধি।’ মনে পড়ল পিতার শাস্ত্রীয় ভাষণে মুসলমানদের পয়গম্বরের উক্তির বজ্র-প্রতিধ্বনি, ‘যে নিজেকে চিনেছে, সে আল্লাহকে চিনেছে।’ আর গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসও বলেছিলেন, ‘নিজেকে জানো!’ কিন্তু কে আমি? কিছু আকস্মিক ঘটনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া স্বরূপ একটি চেতনামাত্র। আমার পুদ্‌গল নেই। পদ্মার চরে পাহলোয়ান বলেছিল, ‘আমি নিমিত্ত মাত্র।’ মধ্যরাত্রে বেরিয়ে পড়লাম। বিজয়পল্লীতে একটি একদিখোলা চালাঘরে বধ্য ক্ষুদ্র মাংসপুঞ্জ অপর একটি বৃহৎ মাংসপুঞ্জের সংলগ্ন হয়ে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক নিয়মে যথাক্রমে নিদ্রিত এবং ভূতলস্থিত। এবার আর একটি জৈবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম ক্রিয়াশীল হতে চলেছে। কিন্তু চালাঘরটির কাছে যেতেই আরও একটি জৈবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম ক্রিয়াশীল হল। একটি অস্পষ্ট হুংকার, পায়ের শব্দ, অন্ধকারের কালো একটি জীব, ঝুনঝুন কোমল ধ্বনিপুঞ্জ, আবার হুংকার। ঘুরে দেখি, মস্তানবাবা! ঝোঁপঝাড় ভেঙে নেমে গেলাম। ধানখেতে জলকাদা এবং সকল আদিম ব্যাপকতার আঠালো পিচ্ছিল স্তরগুলি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে-নিতে পিছনে আবার হুংকার। তৎক্ষণাৎ জানিলাম, ক্ষুদ্র ওই মাংসপুঞ্জ আমার বধ্য নহে।…

Then the sluices of the sky opened
and
everything human was transformed
into mud…
–Epic of Gilgamesh.

এক বৃষ্টির দিনে বারান্দায় শাস্ত্রীজির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, দেববাবু! এ কী শুরু হল? যেন আকাশ ছ্যাঁদা হয়ে গেছে। অন্য কেউ বললেন, ছ্যাঁদা কী বলছেন শাস্ত্রীজি? বলুন, আকাশের দরজা খুলে দিয়েছেন ঈশ্বর। ঘরের দরজা থেকে উঁকি মেরে দেখি, প্রভাসরঞ্জনবাবু। দুজনে ছাতি রেখে বৃষ্টি দেখছেন। প্রভাসরঞ্জন একজন আশ্রমিক। শুনেছি প্রচুর জমি দেবনারায়ণদাকে দেওয়া ঋণবাবদ শুধু সুদের হিসেব দেখিয়ে হাতাতে পেরেছেন। ওঁকে দেখলেই মস্তানবাবা অথবা দিওজেনিসের উক্তি মনে পড়ে যায়, ব্রহ্মমন্দিরের দরজা দিয়ে একদা ঠিকই মন্দির পালিয়ে যাবে। অথচ দেবনারায়ণদার পেয়ারের লোক। আরও শুনেছি প্রভাসরঞ্জনের বড়ো ছেলে নরেশরঞ্জন-এর সঙ্গে স্বাধীনবালার বিয়ের একটা প্রস্তাব উঠেছে। স্বাধীনের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার বলার কথা থাকতে পারে না। কিন্তু বৃষ্টির দিনে প্রভাসরঞ্জনকে দেখে মনে হল, স্বাধীনকে আমার কিছু বলা উচিত। নরেশূকে আমি বাঁকাসর্দারের সঙ্গে গাঁজার ছিলিম টানতে দেখেছিলাম।

সারা ভাদ্র মাস শুকনো গেছে। আশ্বিনের মাঝামাঝি এই বৃষ্টি শুরু। শুধু বৃষ্টি নয়, ঝড়ও। ঘরে চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, পাহলোয়ান কী অবস্থায় আছে? ছাতি নিয়ে এই দুর্যোগে আধক্রোশ দূরত্ব পেরুনো কতখানি কষ্টসাধ্য হবে, হিসেব করতে থাকলাম। সেই সময় দেবনারায়ণদার ঘরে তর্কাতর্কি বেধেছে কানে এল। শাস্ত্রীজির মতে, আকাশ মহাশূন্য নিরবয়ব, পদার্থহীন সত্তা। অতএব আকাশ। ছাদা হওয়া বা দরজা খুলে দেওয়া নিছক আলঙ্কারিক প্রয়োগ । প্রভাসরঞ্জন বলেছেন, আমরা আধুনিক যুগে এরূপ ব্যাখ্যা করছি মোশমুলর মহোদয়ও বৈদিক ঋকগুলিনের এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, তকালে লোকদিগের ওইরূপ বিশ্বাস ছিল। দেবনারায়ণদা বললেন, মহাভারতে মহাপ্লাবনের বৃত্তান্ত মনে পড়ে কি? ‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্‌…’ কেশব মীনশরীর ধারণ করে বেদ রক্ষা করেন। প্রভাসরঞ্জন বললেন, এরূপ মহাপ্লাবনের গল্প গ্রিস, সুমের সর্বত্র গ্রন্থাদিতে আছে। শাস্ত্রীজি বললেন, বাইবেল এবং কোরান গ্রন্থেও আছে। এগুলির রূপক। গীতার উক্তি স্মরণ করুন, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিঃ…’

বাইরে দুর্যোগ। আর এই বিদ্বান লোকগুলি তত্ত্ব আলোচনা করছেন। ক্রমে ক্ৰমে ছাতি মাথায় আরও আশ্রমিকগণ আসছেন আচার্যের ঘরে। তত্ত্ব আলোচনা আরও জমে উঠছে। কে হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন, শুনেছি সুনয়নী দেবী উৎকৃষ্ট খিচুড়ি রান্না করতে পারেন। খবর দেওয়া হোক ওঁকে। অপর একজন বললেন, খবর নিয়েই আসছি রন্ধনশালা থেকে। হইচই পড়ে গেল। এইসময় শৈশবে শোনা নিরক্ষর চাষাভুষো লোকেদের একটা ছড়া মনে পড়ল :

তিনদিনকার গাজলে
মহিষ মরে হিজলে
টিকটিকিরা বাতায়
উকুন মরে মাথায়
মানুষ মরে খালে
গুধা মায়ের কোলে…

দেবনারায়ণদার গলা শোনা গেল, খনার বচনে কী আছে যেন? মঙ্গলে পাঁচ/ শনিতে সাত/ বুধে তিন/ আর সব দিন-দিন। কী বারে লেগেছে হে ভবেশ? ভবেশ বললেন, বুধবার। দেবনারায়ণদা বললেন, ধুস! আজ তো তিনদিন হল। থামবার লক্ষণ কোথায়? প্রভাসরঞ্জন অট্টহাসি হেসে বললেন, বিভিন্ন শাস্ত্রে আছে, পরমেশ্বর পাপের শাস্তি দিতে নেচারকে লেলিয়ে দেন। ব্রহ্মপুরে স্বামীজী সংঘ এবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেছে না? কেউ বললেন, শিবনাথপল্লীর সেই এঁড়ে চক্কোতি শুনলাম বারোয়ারি পূজা দেবে। দেববাবু স্পর্ধা মার্জনা করবেন। স্বহস্তে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছেন। দেবনারাণয়দা বললেন, আমি নিরুপায় মধুবাবু! আশ্রমবাসীদের মধ্যে বিস্তর অ-ব্রাহ্ম আছেন। তাদের পরিবারবর্গ আছে। হজ্জত হোক, পুলিশের। দারোগার বুটজুতো আশ্রমের পবিত্র মাটি কলঙ্কিত করুক, এ আমার অভিপ্রেত নয়। প্রভাসরঞ্জন ঘোষণা করলেন, ওয়েট অ্যানড সি। পরমেশ্বর পাপীদিগের শাস্তি স্বহস্তে দেবেন।

পাহলোয়ানের জন্য আমি অস্থির। ছাতি মাথায় নেমে আশ্রমসীমানা পেরিয়ে যাওয়া মাত্র দমকা বাতাসে ছাতি উলটে গেল। বৃষ্টিও গেল বেড়ে। একটি গাছের দিকে ছুটে গেলাম। কিন্তু প্রচণ্ড শব্দে কোথায় বাজ পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে কুঁজো হয়ে দৌডুনোর চেষ্টা করে আশ্রমে ফিরে এলাম। ওলটানো ছাতি ঠিকঠাক করে ঘরে ঢুকে ভিজে জামাকাপড় বদলে নিলাম। অস্থির মনে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে দেখি, স্বাধীন চুপচাপ একা বসে আছে। আমাকে দেখে কেমন একটু হাসল। বলল, তোমার দুর্দশা আগাগোড়া দেখলাম! কোথায় যাচ্ছিলে? বললাম, পাহলোয়ানের অবস্থা দেখতে। স্বাধীন বলল, সে তো বাঁধের ওপর হরিদার তৈরি আস্তাবলে আছে। সুধন্য আছে। তার জন্য ভাবনা কিসের? যার জন্য ভাবনা হওয়া উচিত, তার কথা তোমার মনে পড়ল না? সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ে গেল, হরিবাবু নাবাল অঞ্চলে জঙ্গলের ভেতর এখনও কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছেন। বললাম, তাই তো! স্বাধীন মুদুস্বরে বলল, ক্লাবে খবর দেওয়া দরকার। কিছু ছেলে ফিরে এসেছে দেখেছি। তাদের হরিদার খবর নেওয়া উচিত। একটু ভেবে বললাম, হরিবাবু নির্বোধ নন। স্বাধীন স্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কে জানে! যদি বাঁধ ভেঙে যায়?

আমি কী মানুষ! স্বাধীনের হরিবাবুর জন্য দুর্ভাবনাকে প্রেম ভেবে ঈর্ষায় জ্বলে উঠলাম। সে বলেছিল, তার হৃদয়ে পুরুষপ্রেম নেই। তাহলে এ কী? পরমুহূর্তে মনে পড়ল, ও! আমার পুল নেই। তাই আমারও হৃদয় এবং প্রেম নেই। তাহলে ঈর্ষা নিরর্থক।

স্বাধীন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, তোমার ছাতিটা এনে দাও। বললাম, কুটিরে যাবে? সে শক্ত মুখে বলল, না। ক্লাবে। দেখি, যদি ওরা কিছু করে।

আমার আত্মা নেই। তাকে ছাতিটা এনে দিলাম। আত্মা না থাকায় ‘শিভালরিও আমার কাছে নর্থক। শুধু বললাম, দেখো, ছাতি উলটে না যায়। স্বাধীন জাতির আড়ালে আত্মগোপন করে হাঁটতে থাকল। এই সময় দেবনারায়ণদার ঘরের সামনে কে এসে চিৎকার করে বলল, শঙ্খিনীর ধারে নতুন বাঁধ ভেঙে গেছে। আবাদ ভেসে যাচ্ছে।…

‘And now we have come to the place, where,
I toldst thee, thou shouldst : 9e, the wretched
men and women, who have lost the good of their intellect…’

Inferno–Dante.

ও’মালি সায়েবের জেলা গেজেটিয়ারে এই ভয়ংকর প্লাবনের বিবরণ আছে। পদ্মা ভৈরব-জলঙ্গী-ভাগীরথী-ব্রাহ্মণী-দ্বারকা-ময়ূরাক্ষী, জেলার মূল নদীগুলি তাদের অববাহিকার সমস্ত প্রাণ নিশ্চিহ্ন করেছিল। পুরুষানুক্রমে জেলার লোকে ‘বড়বানের বছর’ বলে বিভীষিকাটির স্মৃতি বহন করেছে। আর শা’ ফরিদ মস্তানবাবা বলেছিলেন, দরজা দিয়ে মন্দির পালিয়ে যাবে। পালিয়ে গিয়েছিল বটে। ব্রহ্মপুরে সেই প্রথম রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাব্রতীদের আগমন এবং একটি মিশনও স্থাপিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিক্রিয়া সামলাতে পারেনি। দেবনারায়ণ স্বপ্নদর্শী। বস্তুজগতের এই হঠকারী উপদ্রবের প্রতি সচেতন ছিলেন না। ফলে কোনো সেবাদল ছিল না তাঁর। সারা আবাদ মৃতদেহের দুর্গন্ধে ভরে ওঠে। যারা বাঁচতে পেরেছিল, তারা কেউ ছিঁচকে চোর কেউ দুর্ধর্ষ ডাকাত হয়ে ওঠে। উঁচু এলাকাগুলিতে লুঠপাঠ শুরু করে। বাঁকা সর্দার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ব্রহ্মপুরের ফাড়িটি পুরোপুরি থানায় পরিণত হয়। বিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেবনারায়ণের হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে এসব পরের কথা। স্বামীজিসংঘের যুবকরা রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের সঙ্গে ত্রাণে নেমেছিল! আবাদের বুকে তখন সমুদ্র। একটি নৌকায় উদ্ধারকারী একটি দল জঙ্গলের গাছগুলি থেকে অনেক মানুষকে উদ্ধার করে। সেই নৌকায় স্বাধীনবালা ছিল। সন্ধ্যার মুখে ফেরার সময়। একটি বটগাছ থেকে চিৎকার ভেসে আসে। গাছে শফি ছিল। নৌকায় তাকে ধরাধরি করে নামানো হয়। সে শুধু ‘পাহলোয়ান’ কথাটি উচ্চারণ করে অজ্ঞান হয়ে যায়। স্বাধীন বুঝতে পারে সে তার ঘোড়ার খোঁজে বেরিয়ে ভেসে গিয়েছিল। সেবাশুশ্রূষা আর চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়ে উঠলে একদিন স্বাধীন তাকে হরিনারায়ণের কথা জিগ্যেস করে। শফি একটু হেসে বলে, তিনি একটি কঙ্কাল। স্বাধীন বলে, দেখেছিলে? শফি বলে, বটগাছের ঝুরিতে আটকে ছিলেন। টেনে গাছে তুলতে গিয়ে বুঝলাম তিনি জড়পদার্থমাত্র । খুকু, ওই বটগাছের। তলায় একরাত্রে আমি, হরিবাবু, কালীমোহন, সত্যচরণ–

স্বাধীন দ্রুত সরে যায় তার কাছ থেকে। সে বছর মাঘোৎসব হয়নি। দেবনারায়ণবাবু কলকাতা চলে যান। তারপর থেকে মাঝে-মাঝে আসতেন। খাজনা আদায়ের চেষ্টা করতেন। এক হৃদয়নাথ শাস্ত্রী আশ্রম চালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতেন। শফি তার মাসিক বেতন নিয়মিত পেত, এটা আশ্চর্য বটে! একদিন সুনয়নী ব্যস্তভাবে এসে শফিকে ডেকে চুপিচুপি বলেন, খুকুর কী হয়েছে, তুমি জানো? শফি বলে, না তো! কী হয়েছে মাসিমা? সুনয়নী কান্নাজড়িত স্বরে বলেন, তুমি এসে দেখে যাও। সুনয়নীর কুটিরে গিয়ে শফি দেখে, স্বাধীন শাদা থান পরে দাঁড়িয়ে আছে। শফী বলে, এ কী খুকু। স্বাধীন নির্লজ্জ মুখে নির্দ্বিধায় বলে, আমি বিধবা হয়েছি। সুনয়নী তার গালে চড় মারেন। তবু বৃক্ষবং ঋজু ও স্থির সেই যুবতী অকপট বলে, আমার স্বামী বানের জলে ভেসে গেছেন। আমি বিধবা হব না কেন? শফি বলে, খুকু। তুমি বলেছিলে তোমার হৃদয়ে– স্বাধীনবালা তাকে বাধা দিয়ে বলে, প্রেম এবং বিবাহ সম্পর্কহীন। সেই রাত্রে সুনয়নী কন্যাকে ত্যাগ করে চলে যান। কথিত আছে, তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদিগের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। এরপর বৈশাখ মাসের এক দুপুরে হৃদয়নাথ শাস্ত্রী ডাকঘর থেকে ফিরে ভীতমুখে বলেন, কাণ্ড দেখো শফি! দেববাবু দুধ দিয়ে সাপিনী পুষেছিলেন, দেখ। জেলা সমাচার পত্রিকায় বড়ো-বড়ো হরফে খবর : পুনরায় কালেক্টর বাহাদুরের উপর আক্রমণ/ পিস্তলসহ যুবতী ধৃত। শফি তাকিয়ে আছে দেখে শাস্ত্রীজি চাপা স্বরে বলেন, পড়ে দেখো পুরোটা! স্বাধীনবালার কীর্তি দেখো। শফি, প্রত্যাঘাত আসিতেছে। আশ্রমের পবিত্রভূমি কলুষিত হইবে। আমি বৃদ্ধ। কিন্তু তুমি যুবক। শীঘ্র পলাইয়া যাও। শফি সন্দেহবশে দ্রুত ঘরে ঢোকে এবং তার পিস্তলটি খোঁজে। নাই। নির্বোধ খুকু জানে না, পিস্তলটিতে দুইবার ঘোড়া না টানিলে গুলি ছোটে না। শাস্ত্রীজি উত্তেজিতভাবে বলেন, কী করিতেছ? পালাও। নরক আসিতেছে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *