১৫. চান্দ্রমাস জেলহজ্জের দশম দিবসে কেয়ামত

In Heaven a spirit doth dwell
“Whose heart-strings are a lute”
None sing so wildly well
As the angel Israfel…

‘চান্দ্রমাস জেলহজ্জের দশম দিবসে কেয়ামতের (মহাপ্রলয়) নিদর্শন প্রকাশ পাইবে। সেই দিবস সূর্য উঠিবে না। দুনিয়া অন্ধকার থাকিবে। মানুষসকল ভাবিবে, ইহা কী হইল? তাহারা সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িবে। অতঃপর তাহারা আশ্চর্যান্বিত হইয়া দেখিবে, পশ্চিমদিকে সূর্য উঠিতেছে। তখন তাহারা জানিবে, কেয়ামত নিকটবর্তী কিন্তু হায়! তখন তওবার (ক্ষমাপ্রার্থনা) দুয়ার আল্লাহ বন্ধ করিয়াছেন। তাহারা পবিত্র কেতাব খুলিয়া দেখিতে পাইবে, হরফসকল অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। আর এই সময় আরবদেশের সাফাপর্বত বিদীর্ণ করিয়া দাব্বাতুল আরদ বাহির হইবে। ইহার মুখের চেহারা মানুষের মতন। কিন্তু গর্দান ঘোড়ার মতন। পা উটের মতন। লেজ গোরুর মতন। পশ্চাদ্দেশ হরিণসদৃশ। শিং দুইটি বলদের তুল্য। আর হস্ত দুইটি বাঁদরের। ইহার এক হস্তে থাকিবে পয়গম্বর সোলেমানের আংটি, অপর হস্তে থাকিবে পয়গম্বর মুসার লাঠি। দাব্বাতুল আরদ অবিশ্বাসীদের ললাটে ওই আংটি দ্বারা কালো চিহ্ন এবং বিশ্বাসীদের ললাটে ওই লাঠি দ্বারা শাদা চিহ্ন দাগিয়া দিবে। তাহার পর জুম্মাবার প্রত্যুষকালে আল্লাহ ফেরেস্তা ইস্রাফিলকে শিঙায় ফুঁ দিতে বলিবেন। প্রথমে অতিক্ষীণ ধ্বনি বাড়িতে থাকিবে! মানুষসকল ভাবিবে, ইহা কিসের শব্দ? ক্রমে ক্রমে ইস্রাফিলের শিঙার ধ্বনি কানে তালা ধরাইবে দিবে। দুনিয়া কাঁপিতে থাকিবে! পর্বতসকলও মাটি পেঁজা তুলার মতন উৎক্ষিপ্ত হইবে। প্রাণিসকল মৃত ও নিশ্চিহ্ন হইবে। সমস্ত নিরাকার শূন্যে পরিণত হইবে। শুধু থাকিবেন আল্লাহ এবং তাঁহার বান্দা ফেরেশতাবৃন্দ। আর আল্লাহ তখন ইস্রাফিলকে দ্বিতীয়বার শিঙায় ফুঁ দিতে বলিবেন। এক্ষণে মৃত সকল প্রাণী, সকল মানুষ ও জিন পুনরায় জীবিত হইবে।’

খোকা ।। দাদিজি, এই গুলতাপ্পি কে ঝেড়েছে বলে তো?

দিলরুখ বেগম ॥ তওবা! আস্তাগফিরুল্লাহ! খোকা, জবান সামলে কথা বল! তুই বুজুর্গ পিরের খানদান!

কচি ॥ খোকা, তুই হাফ-এজুকেটেড। গুলতাপ্পি বলছিস? পৃথিবী বুঝি ধ্বংস হবে না? বিজ্ঞানের বইতে কী লেখা আছে জানিস? আর চারশো কোটি বছর পরে সৌরজগৎ ধ্বংস হবে।

খোকা ॥ কচি, আমাকে জ্ঞান দেবার চেষ্টা করবি নে বলে দিচ্ছি। থাপ্পড় খাবি।

দি বেগম ॥ কাজিয়া করে না ভাই-বোনে। ওই কেতাব আমার শশুরসাহেবের লেখা। হরিণমারার বড়োগাজিসাহেব কলিকাতা থেকে ছেপে এনেছিলেন। দে, সিন্দুকে তুলে রাখি। আর একটা কথা বলি, কক্ষনো নাপাক হাতে সিন্দুক খুলবি নে! দে কেতাবখানা!

কচি ॥ দাদিমা, আমি পড়ব। আমার কাছে থাক। প্লিজ দাদিমা!

খোকা ॥ এই মেয়েপণ্ডিত! তুই জানিস ইস্রাফিল কে? বল্ তো কে সে?

কচি ॥ খোকা, বিদ্যে ফলাবি নে আমার কাছে। ক্লাস নাইনে ফেল করা ছেলের মুখে ‘ইস্রাফিল কে’ এ প্রশ্ন মানায় না।

খোকা ।৷ তুই জানিসই না, ইস্রাফিলকে মুসলমানরা বাইবেল থেকে চুরি করেছে। প্যাটপ্যাট করে তাকাস নে। আমার কাছে জেনে নে। ইস্রাফিল স্বর্গের মিউজিশিয়ান।

কচি ।। বাজে বকিস নে। খোকা ॥ বাজে? দাঁড়া, তোকে ছোটোদাদাজির একটা বই দেখাচ্ছি।

দি বেগম ।। খোকা! সিন্দুক খুলিস নে আর। ও কচি, ওকে বারণ কর।

কচি ।। দাদিমা, একটু চুপ করো না! ওর বিদ্যের দৌড়টা দেখি।

খোকা ।। এই দ্যাখ। ছোটদাদাজি আনডারলাইন করে রেখেছেন।

কচি ।। এ তো ইংরিজি পদ্যের বই! এডগার অ্যালেন পো। কী অবাক। নামকরা কবি বুঝি?

খোকা ॥ ছোটোদাদাজি পণ্ডিত লোক ছিলেন। একগাদা ইংরেজি বই ভরা আছে সিন্দুকে।

দি বেগম। ওই কেতাবগুলো জেহেলখানা (জেল) থেকে ওঁর ফাঁসির পর পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি সিন্দুকে তুলে রেখেছিলাম। যেদিন খবর এল—হা খোদা!

খোকা ॥ আঃ দাদিজি! কান্নাকাটি থামাও। ইংরেজরা অসংখ্য লোককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। তাদের জন্য কাঁদবার লোক নেই।

কচি ।। আছে রে! শহিদ বলে স্টাচু গড়েছে। মালা দিচ্ছে বার্থডেতে। শুধু ছোটোদাদাজির জন্য কিছু হয় না। হয়তো মুসলমান বলেই হয় না।

খোকা ॥ ভ্যাট! ছোটেদাদাজি আমার ধারণা, ফ্রিডম ফাইর ছিলেন না, বুঝলি কচি? উনি ছিলেন অ্যানারকি। বুঝিস কাদের অ্যানারকি বলে? যারা রাষ্ট্র বলে সরকার বলে কিছু মানে না। যারা বলে মানুষ বর্‌ন্‌-ফ্রি।

কচি ।। বুঝেছি। তুই পাঁচুবাবুর পাল্লায় পড়েছিস! খোকা, সাবধান কিন্তু। কামাল স্যার বলছিলেন, লোকটা এখানে এসে জুটেছে কোনো মতলবে। ওকে শিগগির পুলিশে ধরবে।

খোকা ।। তোদের কামালস্যারকে বলবি, প্রি-পার্টিশন পিরিয়ডে তো লিগের লিডার ছিল। এখন ভোল বদলে কংগ্রেস কেন? গিরগিটির বাচ্চা! বহুরূপীর দল গাছেরও খাবে, তলারও কুড়ুবে।

কচি ॥ খোকা, যা-তা বলবি নে বলে দিচ্ছি। কামালস্যার না থাকলে আমার পড়াশুনো হত না।

দি বেগম খোকা? আবার কোথায় বেরুচ্ছিস এই বরাদুরে?

খোকা ॥ আসছি।

কচি ।। দাদিমা!

দি বেগম ।। উঁ?

কচি ।। তুমি আমাক বলনি সিন্দুকে এত কি আছে! গুপ্তধনের মতো আগলে রেখেছ! ভাগ্যিস খোকা সিন্দুক খুলল, তাই জানতে পারলাম। দাদাজির আব্বা বই লিখতেন, ছোটোদাদাজি ইংরেজি পদ্য পড়তেন! ভাবা যায় না!

দি বেগম ।। তোরা বুজুর্গ আলেমের খানদান, ভাই! কেতাবই তোদের সম্পত্তি। শ্বশুরসাহেব বলতেন, তুচ্ছ মাটির ওপর কেন লোভ মানুষের? বলতেন, মাটি আমার। সয় না। তাই যা পেতেন, দুহাত ভরে বিলিয়ে দিতেন। ইচ্ছে করলে কত জমিজমার মালিক হতে পারতেন। হননি। ওঁর কাছেই শিখেছিলাম মাটির কোনো দাম নেই।

কচি ৷ কিন্তু বড়োদাদাজি? উনি তো সাত পুরুষের সম্পত্তি করে গেছেন সেটা বললো!

দি বেগম ॥ ভাসুরসাহেব বাপের এলেম কিছু পাননি। অন্য ধাতের মানুষ।

কচি ।। তোমাকে ফাঁকি দিয়ে পথে বসিয়ে –আর তোমার নিজের মায়ের পেটের বোনটিও বাবা আচ্ছা!

দি বেগম ॥ ছিঃ কচি! মু বন্‌ধ্‌ কর্‌। বলতে নেই।

.

Whose heart-strings are a lute

স্বাধীনবালা তার বাবা খুনীকে খুন করতে চায় এবং আমার কাছে একটা পিস্তল চাইতে এসেছিল! এই কথাটা যখনই ভেবেছি, বুকের ভেতর কী একটা নড়ে উঠেছে। মেয়েরা কেন আমার কাছে নালিশ জানাতে আসে ভেবে পাইনি। কাল্লু সাতমারের বউ সিতারা বেগমও এক জ্যোৎস্না রাতে অন্য ভাষায় এমন একটা নালিশ তুলেছিল। কী আছে আমার মধ্যে, বুঝি না। যেন তারা ভাবে, এই অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন পৃথিবীকে অর্থপুর্ণ আর উদ্দেশ্যময় করার জন্য দু-একটা মানুষ দরকার। তাই হয়তো পিরবুজুর্গ-পয়গম্বর-সাধুসন্ত-মহাত্মা-নেতাদের দরকার হয়। কথাটা পরে খুঁটিয়ে ভেবে দেখেছি। দেবনারায়ণদার এই নয়া আবাদের প্রায় শুরু থেকে আমি আছি। প্রথম-প্রথম স্পষ্ট বুঝতে পারতাম, এখানে যত-সব মানুষ এসে জুটেছে, বা জুটছে, তারা নিছক মাটির লোভে লোভী। ক্রমশ একটা আমূল রদবদল ঘটতে থাকল ওদের মধ্যে। মাটি পাওয়ার পর ওরা যেন এই বেঁচে থাকার — এই জীবনের এবং তার পারিপার্শ্বস্বরূপ এই পৃথিবীর ওপর কোনো একটা অর্থ আরোপ করতে চাইল। বাঁধ আর উঁচু ঢিবির ওপর দু বছরের মধ্যে যেসব বসতি গড়ে উঠল, দেবনারায়ণদা সেগুলোর নাম রাখলেন কেশবপল্লী, শিবনাথপল্লী, দেবেন্দ্রপল্লী, বিজয়পল্লী, আনন্দপল্লী। এসব নাম কেন? জিজ্ঞেস করলে দেবনারায়ণদা আমাকে দু ঘণ্টা অথবা। তিন ঘণ্টা কিংবা চার ঘণ্টা ধরে নিরাকার ব্রহ্মের স্বরূপ, ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের পন্থা, তারপর এই পথে যারা ব্ৰহ্মজ্ঞানের পিদিম হাতে (যেহেতু পৃথিবী ‘অজ্ঞানতার তিমিরে আচ্ছন্ন) হেঁটে চলেছেন, তাঁদের নামগুলো জেনে রাখতে বললেন। শুধু বললেন না, কাগজে সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখেও দিলেও দিলেনঃ “কেশবচন্দ্র সেনের নামে কেশবপল্লী, শিবনাথ শাস্ত্রীর নামে শিবনাথপল্লী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে দেবেন্দ্রপল্লী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নামে বিজয়পল্লী এবং আনন্দমোহন বসুর নামে আনন্দপল্লী। তারপর মিটিমিট হেসে বললেন, কিন্তু তুমি লক্ষ করছ নিশ্চয়, আমাদের আদি পথপ্রদর্শক ও পরম গুরু রাজা রামমোহন রায়ের নামে কোনো পল্লী স্থাপন করি নাই। বিস্মিত হয়ো না। নুপুর রেশমকুঠির নিকট অনাবাদি ত্রিশ বিঘা ডাঙ্গা জমি স্ট্যানলি সায়েবের কাছেই শীঘ্র বন্দোবস্ত নিচ্ছি। ওই স্থানে রামমোহনপল্লীর অঙ্কুরোদগম হবে। পাশেই বাদশাহি সড়ক। কাজেই একটা হাটও স্থাপন করব। এই ব্রহ্মপুরের কিছু সমস্যা আছে। স্থানটি নিম্নভূমি হওয়ায় বন্যার আশঙ্কা প্রবল। পশ্চিমে তিন ক্রোশ দূরে বাদশাহি সড়ক। তুমি জান, সড়ক জাতীয় সম্পদের তুল্য, যেহেতু অধিকসংখ্যক লোকালয় ও মনুষ্যগণের মধ্যে সড়ক যোগসূত্র স্থাপন করে। শফি, যাত্রার জন্য প্রস্তুত হও। দেবনারায়ণদা কথায়-কথায় সংস্কৃত শ্লোক বা ফারসি বয়েৎ আওড়ান। কথার শেষে এই ফার্সি বয়েৎ মৃদুস্বরে আবৃত্তি করলেন:

কিশতি শিকস্ত্‌ গাঁয়েম অ্যায় বাদ্‌-এ শুর্তা বরখেজ
বাশদ্‌কে ওয়জ্‌ বিন্‌য়েম দিদার-এ আশনারা…

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওহে পিরজাদা! কিছু বুঝলে? আস্তে বললাম, আমি ফারসি জানি না। দেবনারায়ণদা উদাত্তস্বরে বললেন, কবি হাফিজ বলছেন? ‘নৌকায় উঠে বসেছি। হে অনুকূল বায়ু! প্রবাহিত হও। সেই প্রিয় বন্ধু দর্শন পেতে পারি যাতে।’

বাদশাহি সড়ক! কথাটা যতবার শুনেছি, বারিচাচাজির সেই কালো ঘোড়াটার হ্রেষা আর খুরের শব্দে আক্রান্ত হয়েছি। ইচ্ছে করেছে, এখনই ছুটে যাই, ফিরে যাই মৌলাহাটে। মায়ের জন্য ছটফট করেছি। আয়মনি খালার জন্য মন কেমন করেছে। অথচ তারপর অনিবার্যভাবে রুকুর কথা মনে পড়েছে। অর্ধমানব অর্ধপশু এক উদ্ভট প্রাণীর কবলে হরিণের মতো কিশোরী। হোক না আমার সহোদর ভাই, ঘৃণা আমাকে তেতো করে ফেলেছে। পালিয়ে যেতে পারেনি রুকু? পারেনি তার মায়ের মতো ঝুলে পড়তে?…এইসব চিন্তার মধ্যে একদিন স্বাধীনবালা এসে বলল, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, শফিদা?

একটু হেসে বললাম, কিছু না। তুমি—

থামলে যে? কী?

তুমি ইদানীং উপাসনাসভায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছ কেন, স্বাধীন?

দেবুজ্যাঠা বলেছিলেন কিছু?

না। আমার চোখে পড়েছে।

তুমি আমার দিকে অত লক্ষ্য রাখ কেন?

একটু চমকে ওর চোখের দিকে তাকালাম। বললাম, হয়তো আমার ভয় হয়, তুমি তোমার বাবার মতো একটা কিছু করে বসবে।

করতে তো ইচ্ছে করে। স্বাধীনবালা শক্ত মুখে বলল। তারপর চাপা শ্বাস ফেলল। দৃষ্টি দূরে রেখে ফের বলল, মায়ের এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। মা ঠাকুরদেবতা-ছেড়ে নিরাকার ভজনা করতে চায় না। পালিয়ে যেতে বলে। কিন্তু আমি এখানে থাকতে চাই।

স্ট্যানলিকে খুন করার জন্য?

স্ট্যানলিকে খুন করার জন্য।

হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে। স্বাধীনবালা রাগ করে বলল, তুমি আমাকে কী ভাব? আমি খুব সামান্য মেয়ে নই। বাবা বলতেন, আমার মধ্যে ছেলেদের স্বভাব আছে।

লক্ষ্য করেছি বটে!

এদিন আকাশ ছিল মেঘলা। ভাদ্র মাস। গুমোট গরম। ব্রহ্মোপাসনা-মন্দিরের পাশে খালের ধারে একটা বটতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম! খালের ওপারে নতুন আবাদের মাঠে টুকরো-টুকরো সবুজ ধানখেতে একঝাঁক শাদা বক দাঁড়িয়ে ছিল। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হলে বটের গুঁড়ি ঘেঁষে দাঁড়ালাম। স্বাধীনবালা গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজছিল। বলল, তুমি দেবুজ্যাঠাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলেছ কি?

বললে নিশ্চয় টের পেতে। কিন্তু তুমি ভিজছ কেন?

ইচ্ছে করছে।

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি মুসলমান বলে তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর স্বাধীন?

স্বাধীনবালা চমকে উঠল। আস্তে বলল, হঠাৎ একথা তুমি ভাবলে কেন? আশ্চর্য তো!

লক্ষ্য করেছি, তুমি সব সময় একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বল। তা ছাড়া তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে ভিজছ, তবু এখানে আসছ না।

স্বাধীনবালা এবার হাসল। ওর দুচোখে যেন কৌতুক ঝিলিক দিল। নির্লজ্জ ভঙ্গিতে বলে উঠল, মুসলমান বলে নয়। তোমাকে আমার কেন যেন ভয় করে।

বলেই সে হনহন করে চলে গেল। অবশ্য বৃষ্টিটা বাড়ছিল। সে মন্দিরের পেছন ঘুরে চাতালে উঠলে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। চোখ ঝলসে দিল বিদ্যুৎ। আবার মেঘ গর্জে উঠল। আমি খুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। রাগে দুঃখে অভিমানে অস্থির। এই মেয়েটির মধ্যে সিতারার অনেকখানি আছে। কিন্তু সিতারাকে আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করত। স্বাধীনবালাকে ভালোবাসার কথা ভাবাও যায় না। ও হিন্দু আমি মুসলমান বলে নয়, কী একটা কঠিন আর দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান আছে বলে চিন্তা হয়। সেটা কি ওর পুরুষালি হাবভাবের জন্য? সত্যি বলতে কী, ইন্দ্রাণীতে বেহুলা নদীর পারে জঙ্গলের ভেতর এক আদিম মেয়ে আসমা খাতুনের শরীর আমার পবিত্র রক্তে যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল, তার জ্বালা এখনও ঘোচনি। অসংখ্যাসংখ্য মেয়ের পায়ের তলায় মাথা কুটতে ইচ্ছে করত, তোমরা আমাকে ক্ষমা করো, ক্ষমা

[১৭৫টি মিসিং]

বিছানা। দেবনারায়ণদার দেখাদেখি বিছানায় বইপত্র ছড়িয়ে রাখি। দরজার তালা দেওয়ার দরকার হয় না। শেকল তোলা থাকে মাত্র । ঘরের দরজা খোলা। মেঘবৃষ্টির দরুন ভেতরটা আবছা। একটু অবাক হলেও ব্যস্ত হইনি। চুরি করার মতো কিছু নেই আমার ঘরে।

কিন্তু চমকে উঠতে হল। জানালার পাশে বসে স্বাধীনবালা বৃষ্টি দেখছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে ঘুরে বলল, নিজের ভয় ভেঙে দিতে ট্রেসপাস করলাম! ইংরিজি বইয়ে পড়েছি ‘ট্রেসপাসার উইল বি প্রসিকিউটেড। দেখা যাক।

গম্ভীর হয়ে বললাম, তুমি আমাকে যেমন, তেমনি নিজেকেও বিপদে ফেলতে চাও, স্বাধীন! এটা খুব বাড়াবাড়ি।

স্বাধীনবালা পালটা চটে গিয়ে বলল, আমি তোমার প্রেমে পড়িনি। আমার সব সময় মনে থাকে, তুমি ব্রাহ্ম হও, কী যাই হও, তুমি মুসলমান। আর আমিও হিন্দু।

বেশ তো! তাহলে এভাবে মুসলমানের ঘরে কেন ঢুকেছে?

ওই যে বললাম, নিজের ভয় ভাঙাতে।

এটা খুব বিপজ্জনক খেলা, স্বাধীন!

বলে আমি লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালাম। স্বাধীনবালা আস্তে ডাকল, শফিদা! শোনো, কথা আছে।

বলো!

তুমি হাজারিলালকে চেন?

হ্যাঁ।

তুমি নিশ্চয় জান না ওর নাম হাজারিলাল নয়?

বলো কী!

কাউকে বলবে না কিন্তু। ওর আসল নাম হবিনারায়ণ ত্রিবেদী। ও ব্রাহ্মণ । এখানে হাজারিলাল নামে হিন্দুস্থানী সেজে আছে। স্বাধীনবালা আরও চাপা স্ববে বলল, হরিদা জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। ওর কাছে পিস্তল আছে। কাউকে বোলো না। আর শোনো, হরিদা বলেছে, ওর পায়ে চোট লেগেছে। খুঁড়িয়ে হাটে, দেখনি?

আবাক হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। বললাম, হঠাৎ এসব কথা আমাকে বলতে এলে কেন?

হরিদা স্ট্যানলিকে মারবে। কিন্তু সঙ্গে একজন সাহসী লোক চায়।

একটু হেসে বললাম, তুমি তো আছ।

না। একজন পুরুষমানুষ চাই ওর। আমি ওকে তোমার কথা বলেছি। সন্ধ্যায় যখন সবাই মন্দিরে যাবে, তুমি ঘরে থেকো। ওকে ডেকে আনব। থাকবে কিন্তু।

স্বাধীনবালা চলে গেল। ভাগ্যিস বারান্দা এবং অন্য কোথাও এসময় কেউ ছিল । চোখে পড়লে কী ভাবত, জানি। কিছুক্ষণের জন্য একটা দুর্ভাবন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। সত্যি বলতে কী, এখানে আমাবও থাকা হাজাবিলালের মতো থাকা। একজন ফেরারির অজ্ঞাতবাসে আত্মগোপন। আসলে আমি একটা উদ্দেশ্যহীন জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। দেবনারায়ণ রায়ের আশ্রয় আর সাহচর্যে দিনেদিনে আমার ভেতর একটা রূপান্তার ঘটতে শুরু করেছিল। মনে হচ্ছিল, জীবনের কোনো একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিশ্চয় আছে –যা বুঝে ওঠার জন্য একটা বয়স দরকার। দরকার একটা অনুকূল পরিবেশ। সেই বয়স আর পরিবেশ এতদিনে পেয়ে গেছি। আবছা টের পাচ্ছি দেবনারায়ণদা যাকে ‘কর্মযজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেন, তার মধ্যে আনন্দের স্বরূপ এবং ‘অব্যক্তের ব্যক্ত’ হওয়ার ব্যাপার আছে। আর কী আশ্চর্য মিল ঈশোপনিষদ গ্রন্থের এই শ্লোকের সঙ্গে মুসলমানদের নামাজের সঙ্গে উচ্চারিত দোয়াটিতে, আব্বা যার একই ব্যাখ্যা করতেন:

ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ
তেন ত্যক্তেন ভূণ্টীথাঃ মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধনং…

না! আমি ধার্মিক নই। ব্রাহ্ম মুসলমান নাই। মুসলমানও নই আর। বারিচাচাজি আমার মাথায় সেই যে কবে নেচার’ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তাই আমাকে গিলে খেয়েছে। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় নাকি ছেলেবেলাতেই ‘পরম সত্য টের পান। আমিও কি পেয়েছিলাম? সেই যেদিন উলুশরার মাঠে গাড়ির সারির পেছনে আসতে-আসতে একলা হয়ে গেলাম, আর তৃণভূমিতে প্রকৃতির রহস্যময় সংগীত শুনতে পেলাম:

Whose heart-strings are a lute…

কেউ ফিসিয়ে উঠল, শফিদা! হরিদা আসছে! আবছা আলো-আঁধারে মিলিয়ে গেল একটি মেয়ে। মন্দিরের দিক থেকে দেবনারায়ণদার গম্ভীর গলায় বেদমন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছে। বিলিতি বাতি জ্বলছে। দরজার সামনে আবছা একটা মূর্তি এসে পরিচিত গলায় বলল, সেলাম শফিসাব!

হাজারিলালকে একটু সন্দেহের চোখে যে না দেখতাম, এমন নয়। সে থাকে কেশবপল্লীতে। তার ভাঙা হিন্দুস্থানী কথাবার্তায় দু-একটা ভদ্রলোকসুলভ শব্দও শুনেছি। কিংবা রহস্যময় তার একলা থাকার স্বভাব। দেখা হলেই ধান বা গমের খেত থেকে সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছে, সেলাম শফিসাব!

সে কিনা এক হরিনারায়ণ ত্রিবেদী! শুনেছি ত্রিবেদীবা নাকি আসলে পশ্চিমে বামুন! বাঙলামুলুকে তারা চলে এসেছে। হ্যাঁ, হাজারিলালের হিন্দুস্থানীতে কথাবার্তা বলার হক আছে, সে হরিনারায়ণ ত্রিবেদী যখন। বললাম, আসুন, দাদা!

হরিনারায়ণ ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে বসলেন। বয়সে আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড়োই হবেন। একটু চুপচাপ থাকার পর বললেন, আপনি আমার পরিচয় জেনেছেন। আমিও কিন্তু আপনার পরিচয় জেনেছি। তবে আমার এভাবে লুকিয়ে থাকার একটা উদ্দেশ্য আছে। আপনার কী উদ্দেশ্য ভাই?

চমকে উঠেছিলাম। বললাম, আমার পরিচয় তো সবাই জানে। আমি এক পিরসাহেবের ছেলে, সে তো সবাই জানে।

হরিবাবু একটু হাসলেন। বললেন, এখন যদি তুমি বলি, রাগ করবেন? আপনি আমার বয়ঃকনিষ্ঠ।

খুশি হয়ে বললাম, নিঃসংকোচে তুমি বলতে পারেন। আমিও আপনাকে হরিদা বলব।

তুমি কৃষ্ণপুরে নাম শুনেছ?

না। কেন?

কৃষ্ণপুরের জমিদার অনন্তনারায়ণ ত্রিবেদী আমার বাবা। আমার বোন রত্নময়ীকে নাকি ভূতে বা জিনে পেয়েছে। নায়েব গোবিন্দরাম সিংহের সঙ্গে দুমাস আগে দৈবাৎ আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ। কাজেই আমার কথা গোপন রাখবেন বলে বিশ্বাস করি।

হরিবাবু চাপা শাস ছেড়ে ফের বললেন, আমি পিতৃদ্রোহী– নানা কারণে। আমার পিতৃদেব ইংরেজের পা-চাটা কুকুর। যাই হোক, গোবিন্দদার কাছে খবর পেলাম, রত্নময়ীকে নিয়ে উনি মৌলাহাটে এক পরসাহেবের কাছে গিয়েছিলেন। সেই পিরসাহেব কথাপ্রসঙ্গে গোবিন্দদাকে বলেছেন, তাঁর ছোটো ছেলে শফি লালবাগ টাউনে লেখাপড়া করত। তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি তাঁর অনুগত জিনদের খুঁজতে পাঠিয়েছেন–

হাসতে-হাসতে বললাম, তারপর?

হরিবাবুও হাসছিলেন। বললেন, তবু গোবিন্দদাকে তিনি অনুরোধ করেছেন, যদি দৈবাৎ শফির খোঁজ কোথাও পান, তাঁকে যেন খবর দেওয়া হয়।

হাসি থেমে গেল আমার। আস্তে বললাম, আপনি গোবিন্দবাবুকে কিছু বলেছেন?

নাঃ। হরিবাবু জোর দিয়ে বললেন। আমি একজন বিপ্লবী। কিছু নীতি মেনে চলি। স্বাধীনের বাবা যামিনী মজুমদার ছিলেন আমার দীক্ষাগুরু।…এক কাজ করা যাক। এখানে কথা বলা ঠিক নয়। চলল, আমরা মাঠের দিকে যাই।

দুজনে ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে বাঁশপাতার গেট খুলে একটা পোড়ো জমিতে পৌঁছুলাম। তারপর বাঁধে গিয়ে দেখলাম, সারাদিনের বৃষ্টিতে কাদা জমেছে। হরিবাবু বললেন, আমার ডেরায় যাওয়া যাক বরং।

বাঁধের পথে কিছুদূর চলার পর কেশবপল্লী। বাঁধের একদিকে টুকরো-টুকরো টিবির ওপর মাটি বা ছিটেবেড়ার ঘর। কোনো-কোনো ঘরের দাওয়ায় আলো জুগজুগ করছিল। চাপা গলায় লোকেরা কথা বলছিল। কুকুর ডাকতে থাকল। আকাশে সামান্য মেঘ। মাঝে-মাঝে চাঁদ বেরিয়ে পড়ছে। লক্ষকোটি পোকামাকড় ডাকছে। এক আশ্চর্য অনুভূতি জেগে উঠল। সত্যিই ‘এত প্রাণ এত গান আছে ভুবনে’! দেবনারায়ণদার ‘পরমা প্রকৃতি’র অস্তিত্ব শুধু বীজের অঙ্কুরোদগমে, শস্যের বেড়ে ওঠায়, ফুলের প্রস্ফুটনে, দিন-রাত্রি-মাস-ঋতুচক্র-আবর্তনে সীমাবদ্ধ নয়, প্রাণের চিৎকারেও তার স্পন্দন। কেন ওই চিৎকার? কিসের ডাকাডাকি? হরিবাবু বললেন, এই আমার ডেরা। একটু দাঁড়াও। লণ্ঠন জ্বালি। পা ধুতে হবে।

ছিটেবেড়ার ঘরের ভেতর একটি খাঁটিয়ায় জীর্ণ খেজুরতালাই বিছানো আছে। একখানা তুলোর কম্বল ভাঁজ করা আছে নোংরা বালিশের ওপর। কোনার দিকে মাটির হাঁড়ি, সরা, একটি লোহার ছোট্ট কড়াই– এসব জিনিস। একটি কোদালের ওপর আলো পড়ে ঝকমক করছিল। কৃষ্ণপুরের জমিদারপুত্রের এই জীবন আমার ভেতর দিকে নাড়া দিচ্ছিল।

তুমি কিছু খাও, ভাই! তুমি আমার অতিথি।

হরিবাবু কথা শুনে দুত বললাম, না। এখন আমার খিদে নেই।

হরিবাবু ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবছিলেন। একটু পরে বললেন, তোমাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখা ঠিক হবে না। কাজের কথাটা সেরে নিই।

আব্বার সংবাদ জানতে আগ্রহ ছিল। তাই একটু হেসে বললাম, আপনার বোনের জিনটার কী অবস্থা?

হরিবাবুও হেসে ফেললেন। তুমি কি বিশ্বাস কর এসবে?

কী জানি। তবে বাবার অনেক ব্যাপার দেখেছি। রহস্যময় মনে হয়েছে।

রত্ন নাকি তোমার বাবার সঙ্গে আরবি ভাষায় তর্কাতর্কি করেছে– গোবিন্দদা বলছিলেন। প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল ওখানে। তিনদিন চেষ্টার পর নাকি জিনটা পালিয়ে গেছে। হরিবাবু হঠাৎ থেমে লণ্ঠনের দম কমিয়ে দিলেন। তারপর বেরিয়ে গিয়ে বাইরে কাউকে বললেন, কৌন বা?

কেউ নিচের জমি থেকে সাড়া দিল, আমি সুধন্য, হাজারিদা।

হরিবাবু বললেন, সুধন্য? ক্যা বে? কৌন কাম করছিস তু?

মাছলি— মাছ ধরছি হাজারিদা! ‘বিত্তি’ পেতেছিলাম, দেখি মাছ পড়ল নাকি।

ঠিক হ্যায়!

হরিবাবু ভেতরে ঢুকে বললেন, এখানে আসার পর আমার পঞ্চেন্দ্রিয় প্রখর হয়েছে। উপরন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয় লাভ করেছি। অন্ধকারের প্রাণীদের মতো সবকিছু দেখতে পাই। শুনতে পাই। জানতে পারি কে শত্রু কে মিত্র।

সুধন্যকে আমি চিনি।

চিনবে। কে না চেনে ওকে? হরিবাবু বসে বললেন। ছেলেটা প্রাণীদের মতোই প্রকৃতিচর। ওর একটা গুণের কথা জান কি? ও অসাধারণ গান গায়। যে গ্রামে ওর বাড়ি ছিল, সেখানে নাকি বেহুলা-লক্ষিন্দরের পালায় বেহুলা সাজত। দেবনারায়ণবাবুর কানে গেলে ওর একটা সদগতি হবে নিশ্চয়। কিন্তু তাহলে ওকে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে-গাইতে মারা পড়তে হবে। অর্থাৎ ওর মাঠেঘাটে ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে। আচার্যদেবের হাতে বন্দী হতে হবে। হরিবাবু খিকখিক করে হাসতে লাগলেন…

.

রক্ততিলক

‘বাং ১২৯৯ সনের শুভ ১০ই বৈশাখ সন্ধ্যারাত্রে আমার প্রথম নরহত্যা। বহু বৎসর পরে জানিতে পারি, নরাধম পশু পান্না পেশোয়ারির পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছে। একখণ্ড ইষ্টক বস্তৃপিঙ মাত্র। উহা স্থাবর এবং অনড়। তুমি মনুষ্য। অস্থাবর ও গতিশীল। তুমি বস্তুপিণ্ডকে তোমার গতি দান করিতে সমর্থ। তুমি জান না, তোমার মধ্যে প্রকৃতি অসীম গতিশক্তিপ্রবাহ সঞ্চারিত করিয়াছে। তুমি জীবনে ইহার তিলার্ধ কাজে লাগাইতে পার কি না, দেখ। অবশ্যই পারিবে।..

‘আর দেখ, প্রকৃতিতে সকল ঘটনাই উদ্দেশ্যপূর্ণ। তাই রক্ত ও অশুর পৃথক পৃথক মূল্য নাই। মূল্যবিচারের তৌলদণ্ড নাই। উহা মনুষ্যহৃদয়ে স্থাপিত। যে-কোনও ঘটনার দুইটি দিক আছে। একটি বিষয়গত, অপরটি বিষয়ীগত। দ্বিতীয় দিক হইতে দেখিলেই দুঃখ ভ্ৰাস অনুতাপ প্রভৃতি বহুবিধ প্রতিক্রিয়া জাগিবে। প্রথম দিক হইতে হইলে বোধ হইবে, নিশ্চয় ইহা উদ্দেশ্যমূলক। তোমার আগোচর কোনও হিতের নিমিত্ত ঘটিয়াছে।…

‘আমার দ্বিতীয় নরহত্যা বাং ১৩০২ সনের শুভ দোসরা আশ্বিন বৈকালে। নুরপুর বানুককুঠিয়াল রিচার্ড স্ট্যানলি ওই দিবস ঘোড়া ছুটাইয়া দেবনারায়ণ রায়ের সন্নিধানে উপস্থিত হয়। স্বাধীনবালা হরিনারায়ণ এবং আমাকে সম্বাদ দেয়। হরিনারায়ণ এবং আমি যখন জঙ্গলের ভিতর দিয়া রওয়ানা হইতেছি, পশ্চাতে পদধ্বনি শুনি। ঘুরিয়া দেখি, স্বাধীনবালা দে ছাইয়া আসিতেছে। তাহাকে রণরঙ্গিনী অথবা উন্মাদিনী বোধ হইতেছিল। সে বলিল, দাঁড়াও। তোমাদের জয়তিলক পরাইয়া দিই। তাহার হাতে একটি ছুরিকা ছিল। সে তাহার দক্ষিণ হস্তের তর্জনী চিরিয়া আমাদের দুইজনের ললাটে রক্তচিহ্ন আঁকিয়া কহিল, বন্দেমাতরম্! আমরা কহিলাম, বন্দেমাতরম্। সে দাঁড়াইয়া রহিল। যতদূর যাই, মাঝে মাঝে ঘুরিয়া দেখি, সে দাঁড়াইয়া আছে। হরিনারায়ণ কুদ্ধভাবে কহিলেন, ওই নির্বোধ যুবতী সৰ্ব্বনাশ বাধাইয়া ছাড়িবে।…

‘নুরপুর বানুকের উদ্ধত সমুচ্চ ইষ্টকস্তম্ভটি বহুদূর হইতে দেখা যায়। শুনিয়াছি, উহা ষাট-সত্তর ফুট উচ্চ। কিছুদূরে নিম্নভূমিতে আমরা কাশবনের মধ্যে আত্মগোপন করিলাম। পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড আলিপথ। উহা স্থানী লোকের মতে, কেদাররাজার আইল। উহা নাকি একরাত্রে ওই রাজার উপাস্যা দেবী মঙ্গলচণ্ডী কর্তৃক নির্মিত। স্ট্যানলি এই আলিপথে ফিরিবে। এতদঞ্চলে সে টাংলিসাহেব নামে পরিচিত ছিল। শুনা যায়, ইংরাজি ১৭৪৪ সনে যে মেজর মনরো আড়াইশত বিদ্রোহী সিপাহীকে কামানের নলের মুখে বাঁধিয়া তোপের আগুনে উড়াইয়া দেয় (সেইটি ভারতবর্ষের প্রথম সিপাহী বিদ্রোহ), এই শয়তান স্ট্যানলি তাহারই বংশধর। ওই সিপাহীদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বী লোক ছিলেন। ইংরাজি ১৮৫৭ সনে মহাবিদ্রোহের সময় স্ট্যানলির পিতা এতদঞ্চল হইতে একশত দুবৃত্ত দস্যু সংগ্রহ করিয়া বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করিতে বহরমপুরের ব্যারাকে উপস্থিত হয়। ওই মহাবিদ্রোহে আমার পিতামহ সিপাহীদের সহযোগিতা করায় তাঁকে অশেষ নির্যাতন ভোগ করিতে হইয়াছিল। এইসব কথা আমি পিতামহী মরহুমা কামবুন্নিসা বেগমের কাছে যখন শ্রবণ করি, তখন নিতান্তই বালক। সম্যক কিছু বুঝি নাই। এক্ষণে সেই কাহিনী মনে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল। হরিনারায়ণ আমাকে একটি তলোয়ার দিয়াছিলেন। হরিণমারার বড়োগাজির তলোয়ারখানির ন্যায় সুদৃশ্য নহে। কিন্তু শান দিয়া অত্যন্ত ক্ষুরধার করা হইয়াছে।…

‘হঠাৎ হরিনারায়ণ কহিলেন, এক কাজ করা যাউক। আলিপথে যতখানি সম্ভব গভীর করিয়া গর্ত খনন কবি। শীঘ্র আইস। শালার আসিবার সময় হইয়াছে। তুলোয়ার দ্বারা আমি লম্বালম্বি গর্ত খনন করিলাম। হরিনারায়ণ মাটি তুলিয়া সাহায্য করিলেন। কাৰ্য্য প্রায় অর্ধেকের অধিক সম্পন্ন হইয়াছে, এমন সময় দিগন্তে অশ্বারোহী মূর্তি দৃষ্টিগোচর হইল। আমরা বিদ্যুৎগতিতে নিম্নস্থ কাশবনে আত্মগোপন করিলাম। সূর্য অস্ত যাইতেছিল। ঘোড়ার খুরের শব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হইতেছিল হরিনারায়ণ পিস্তলহাতে প্রস্তুত হইয়াছেন দেখিয়া আমি তলোয়ার বাগাইয়া ধরিলাম। স্ট্যানলির ঘোড়া গর্তের কয়েকহস্ত দূরে থমকিয়া দুই পা উর্ধ্বে তুলিল। সাহেব লাগাম টানিয়া ধরিয়াছিল। পরমুহূর্তে সে একটা কিছু অনুমান করিয়া দ্রুত পিস্তল বাহির করিল। অমনি হরিনারায়ণ বন্দেমাতরম’ গৰ্জন করিয়া তাঁহার পিস্তলের ঘোড়া টানিলেন। প্রথম গুলি সাহেবের কাঁধে, দ্বিতীয় গুলি ফসকাইয়া গেল। কিন্তু প্রথম গুলিতেই সায়েব ধরাশায়ী হইল। ঘোড়াটি সভয়ে চিত্রার্পিত দাঁড়াইয়া রহিল। সাহেব কাত হইয়া গর্তে পড়িয়াছিল। পিস্তল ব্যবহারের পূর্বেই আমি দুইহাতে। তলোয়ার ধরিয়া তাহার মস্তকে আঘাত করিলাম। উপর্যুপরি আঘাতে সে নিশ্চল। হইল। তথাপি আমার রক্তের নেশা ঘুচিল না। তাহার সর্বাঙ্গে তলোয়ারের কোপ মারিতে থাকিলাম। হরিনারায়ণ পিছন হইতে আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন, শফি! শফি! লোক আসিতেছে। আমি সম্বিৎ ফিরিয়া পাইলাম। হরিনারায়ণ স্ট্যানলির পিস্তলটি কুড়াইয়া লইলেন। কহিলেন, আইস! কাশবনের ভিতর দিয়া পলায়ন করি। আমার জামা-কাপড়ে স্ট্যানলির রক্ত। কিয়দুরে গিয়া বিলের জলে ঝাঁপাইয়া পড়িলাম। তখন আমার দেহ মৃতমনুষ্যবৎ, অনুভূতিহীন। শুধু ললাটে রক্ততিলক চড়চড় করিতেছে।…

‘আর সেই মুহূর্তে একটি কথা ভাবিয়া শিহরিত হইলাম। সিতারার জন্য পান্না পোশোয়ারিকে আঘাত করিয়াছিলাম। এইবার স্বাধীনবালার জন্য স্ট্যানলিকে আঘাত করিলাম! নিয়তি বলিয়া সত্যই কি কিছু আছে?…’

.

যার হৃদয়তন্ত্রী একটি বীণা

কচি ॥ দাদিমা, ঘুমোলে?

দিলরুখ বেগম ।। না ভাই। পোড়াচোখে নিদ নেই। কবরে গিয়ে আরামে নিদ যাব।

কচি ॥ ফের আজেবাজে কথা? শোনো, আজ কামাল-স্যারের কাছে ইংরিজি পদটা বুঝে নিয়েছি। ‘Whose heart-strings are a lute’! যার হৃদয়তন্ত্রী একটি বীণা। বুঝলে কিছু?

দি বেগম ।৷ আমি কী বুঝব? আমি কি তোর মতো লেখাপড়া জানি?

কচি ॥ ছোটোদাদাজি একটা মেয়েকে ভালোবাসতেন। হিন্দু মেয়েকে। তা জান তো?

দি বেগম ।। কচি, চুপ কর। ওসব কথা থাক।

কচি ।৷ সত্যি! ছোটোদাদাজির একটা খাতা পেয়েছি সিন্দুকে।

দি বেগম ॥ ওঁর মতন বেদিল বেরহম (হৃদয়হীন নির্দয়) মানুষ কেউ ছিল না রে!

কচি ॥ কী বল, বুঝি না। যারা মানুষ খুন করে, তারা বুঝি কাউকে ভালোবাসতে পারে না?

দি বেগম ॥ ওঁর জানে মুহব্বত বলে কিছু ছিল না। তুই চুপ কর। কচি ॥ তুমি চটে যাচ্ছ কেন? আশ্চর্য তো!

দি বেগম ।। রাত হয়েছে, ঘুমো।

কচি ॥ দাদিমা! সেই রাখালছেলের গল্পটা বলনি কিন্তু। এখন বলল না।

দি বেগম ।। আমার শ্বশুরসাহেবও– বলতে নেই, খুব বেরহম ছিলেন।

কচি ॥ সে কী! কেন? ও দাদিমা, কেন ওকথা বলছ?

দি বেগম ॥ ছেলেটার একটা দোষ, বাঁশি বাজাত। বাঁশি শুনলে গোনাহ। তাই—

কচি ।। Whose heart-strings are a lute! গল্পটা বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *