হারান-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ
মেজদার ছেলে অমুর ছবিটা টিভি-তে এলো মঙ্গলবার। মেজবউদি খাটের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল। মেজদা কৌচে বসে। আমি ঘটনাচক্রে ওঘরে ছিলাম সে সময়টা। চেঁচিয়ে ডাকলাম বড়দাকে। বড়দা-বড়বউদি মহুল পাপুল চারজনেই ছুটে এল। দীপ্ত এখন নেই নইলে সেও আসত। আমার ছেলে অরু এ সময়টা কোচিং-এ যায়। মাকে আমি ডাকিনি, মা নিশ্চয়ই ছাদের ঠাকুরঘরে। কিন্তু কি ভাবে আমার ডাকের শব্দ ও অর্থ দুই-ই মায়ের কানে পৌঁছে গেল জানি না, মা-ও দেখলাম তাড়াতাড়ি এসে ঢুকছে। তখন ঘোষণা শেষ হয়ে এসেছে। অমুর একটু গম্ভীরগোছের, ছেলেমানুষি, আঠার বছরের মুখখানা সেকেন্ড কয়েক টিভি-র পর্দায় থমকে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেজবউদির ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। মা বলল—‘মেজবউমা, ওরকম অধীর হয়ো না। ওতে অকল্যাণ হয়!’
বড়বউদি বলল—‘আমরা তো সবাই আছি শীলা, মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই এখন আসল।’
বড়দার একটা নিশ্বাসের শব্দ মনে হল শুনলাম। মা বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন মহুল পাপুল। বড়দা একটু দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন বলবে বলবে করে চলে গেল। বড়বউদিও। মেজদা সিগারেট পাকাতে পাকাতে সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘হুঁঃ।’
অমুর ছবিটা ভালো আসেনি। মুখের বাঁ-দিকটা আবছা। ডান দিকটা অবশ্য চোখ, ভুরু, ওর খাড়া খাড়া কান, চুলের ঢেউ, ছোট্ট পাতলা মেয়েলি ঠোঁট সবসুদ্ধ নিয়ে মোটামুটি স্পষ্টই। এই ছবি দেখে আধা-পরিচিত লোক হলে হয়ত চেহারাটা দেখে চিনতে পারবে কিন্তু একেবারে অচেনা লোকের পক্ষে কতখানি চেনা সম্ভব বলা মুশকিল। আমার মনে হল এই একই ধরনের কিশোর মুখ আমি অনেক দেখেছি। অরুর মুখ, দীপ্তর মুখও মূলত একই ধাঁচের। রাস্তায় বেরোলেই এরকম পাতলা ছাঁচের সরল গম্ভীর চোখ-অলা, নরম চুল, নরম নতুন গোঁফদাড়ির কিশোর যেন অনেক দেখা যায়। মেজদাকে কথাটা বলতে গিয়েও বললাম না। কে যেন আমার বুকের ভেতর বসে নিষেধ করে দিল বলতে। সত্যিই, কথাবার্তা আমাকে অনেক বুঝে-সুজে কইতে হয়। অরুর বাবা যাবার পর আমার মুখে কুলুপ পড়েছে। কানে শুনি অনেক বেশি, চোখেও দেখি বেশি। কিন্তু অত সব দেখলে শুনলে আমার চলবে না এটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে! অরুর বাবার রেখে যাওয়া টাকার সুদে ওর লেখাপড়াটা হয়, খাই-খরচ বাবদ সামান্য কিছু দিতে পারি, কিন্তু মোটের ওপর তো আমি দাদাদের ওপর নির্ভর করেই আছি! মা আছে, এটাই মস্ত ভরসা।
তিন দিন হল অমু নিরুদ্দেশ। উচ্চমাধ্যমিকটা হতে না হতেই অমুটা জয়েন্টে বসল। আই আই টি-র এনট্রান্সটা কিছুতেই দিল না। এ জন্য ওর মা ওর পায়ে মাথাটা কুটতে শুধু বাকি রেখেছে। বড়দা বড়বউদি দুজনে মিলে দীপ্তকে তো তৈরি করেছে ভালো! হাজার হোক দুজনেই মাস্টার। দীপ্তর বেরোতে আর বছর দুয়েক। ওর বাবা-মা মুখে রক্ত তুলে টাকার যোগাড় করছে। বেরোলে আর ভাবনা নেই। মেজদাই বলে, আমি আর জানব কোত্থেকে, ওর বাঁধা চাকরি, চাইকি এক্ষুনি বিদেশি স্কলারশিপ। এই পরিস্থিতিতে মেজবউদির রোখ চেপে যাওয়া স্বাভাবিক। বংশের একটা ধারা আছে তো! ঠাকুর্দা ছিলেন পি আর এস পি এইচ ডি। বাবা হেডমাস্টার, লোকে বলত স্বয়ং নেসফীল্ডও বাবার কাছে গ্রামার শিখে যেতে পারতেন। আমার বড়দাকে ঠিক দেবদূতের মতো দেখতে। স্বভাবেও তাই। অত সরল হাসি, নম্র স্বভাব, বৈষয়িক নির্লিপ্ততা যেন ঠিক এ যুগে, এ সমাজে খাপ খায় না। বড়দাও ঠিক বাবার মতো গ্রামার-পাগল, ডিকশনারি-পাগল। তবে, বাবার যতটা সাফল্য আমরা দেখেছি, বড়দার তার কিছুই নেই। দায়িত্ব নিতে ভয় পায়, সাধারণ শিক্ষক হয়েই জীবন কাটিয়ে দিল।
ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার এসব হওয়া মেজদার কপালে হয়ে উঠল না, সে নেহাত কপালেরই দোষ। ফিজিক্সে অত ভালো মাস্টার্স ডিগ্রি করে মার্চেন্ট অফিসে চাকরি করছে। আসলে বাবার পয়সার জোর ছিল না, মেজদার তাই পয়সার জন্য রোখ চেপে গিয়েছিল। দুঃখের কথা কি বলব আমাকে বাবা নিজে মাস্টারমশাই হয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার সুযোগ দিলেন না, ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তার ফলভোগ আমি করছি, তাঁর সৌভাগ্য তাঁকে এ জিনিস দেখে যেতে হয়নি। আমার ছোড়দা যেটি ছিল, সে তো ক্ষণজন্মা। যা শুনত, অবিকল মনে রেখে দিত। ক্ষণজন্মারা থাকে না, ছোড়দাও থাকেনি। অমুর ওপর ওর বাবা-মায়ের, আমাদের সবার অনেক আশা। দীপ্ত এঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, হোক। অমু আমাদের ডাক্তার হবে। আমার দাদামশাই ছিলেন ধন্বন্তরী কবিরাজ। সেই ঐতিহ্য যদি অমুর মধ্যে বর্তায় আমরা খুশি হই। মেজদার অবশ্য বরাবরের ইচ্ছে অমু দীপ্তর মতো ইলেকট্রনিক্স-এর দিকেই যাক। দীপ্ততর এঞ্জিনিয়ার হোক। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অমুর খুবই ভালো হয়েছে। পাঁচ ছটা লেটার বাঁধা। অঙ্কর দুটো পেপারেই পুরো নম্বর। প্রশ্নপত্র পরীক্ষা করে মেজদা তো খুবই প্রসন্ন মনে হল। মা তারকেশ্বরের কাছে মানত করেছে আমি জানি। বিকেলের দিকে কোন ছেলে আর বাড়ি থাকে! অমুও বেরিয়ে ছিল। কোথায় আর যাবে? পাড়ার ক্লাবে, কিংবা কোনও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারতে। রাত বাড়ল অমু ফিরল না। এখানে ওখানে ফোন, খবরাখবর। কেউ কিছু বলতে পারল না। বাড়ির সামনে একটা দর্জির দোকান। তার মালিক চৈতন্য বলল—‘আরে অমুদাদা তো সন্তুদা আর মিন্টুর সঙ্গে রকে বসে বসে গল্প করছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি কেউ নেই।’
সন্তু আর মিন্টুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। ওরা দুজনেই কিছুক্ষণ অমুর সঙ্গে গল্প করেছে তারপর প্রথমে মিন্টু পরে সন্তু চলে গেছে। সন্তু যখন গেছে তখনও অমু নাকি আমাদেরই রকে বসে।
অগত্যা পুলিশে ডায়েরি। কাগজে ছবি ছাপা, টিভি-তে প্রচার। কিন্তু তিন দিন তো হয়েই গেল। মেজবউদি শয্যা নিয়েছে। বাড়ি সুদ্ধু সবাই হানটান করছে। মেজদা নাম কা ওয়াস্তে অফিস যাচ্ছে। বড়দা দেখছি সারাক্ষণ গালে হাত, ভেতরের দালানের বেঞ্চিটাতে বসে। চোখ বসে গেছে, গালে বাসি দাড়ি। কদিনেই বড়দার টকটকে রঙে একটা ময়লা ছোপ পড়েছে। শুধু অমু বাড়ির ছেলে, সবার প্রিয় বলেই নয়। এই সেদিন পর্যন্ত ও দাদা-বউদির কাছেই পড়াশোনা করত। মাত্র মাধ্যমিকের আগের বছরেই মেজদা ওর আলাদা আলাদা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা টিউটর রেখে দিল।
চতুর্থ দিন ভোরবেলা নিচে একটা হাউমাউ হই-হই মতো গোলমাল শুনে তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি সদর দরজা খুলে বড়বউদি চেঁচামেচি করছে, দরজার সামনে অমু। চেঁচামেচিতে সবাই-ই তখন নেমে এসেছে। নিচের উঠোনে সব জড়ো হয়ে গেল দেখতে দেখতে। অমুর চেহারা এই তিন দিনেই হয়েছে কাঙালির মতো। চুল মাটিমাখা, পরনের জামা-কাপড় ঝুল-ময়লা, কেমন উদভ্রান্তের মতো চাউনি। মেজবউদি তখন খুব কাঁদছে আর বলছে—‘কোথায় ছিলি? কোথা থেকে এলি? শিগগিরই বল, বল, বল।’
অমু দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমার কোনও দোষ নেই। আমাকে একটা লোক ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।’
—‘বলিস কি রে?’ মেজদা এগিয়ে এসে বলল।
বড়দা বলল—‘তোমরা জায়গাটা একটু ফাঁকা করো। ওকে আগে খাওয়া-দাওয়া করতে দাও।’
সত্যিই অমু যেন টলছিল।
স্নান, খাওয়া-দাওয়া এবং লম্বা ঘুমের পর অমু যা বলল তা বড় অদ্ভুত। বিংশ শতাব্দীর শেষ হয়ে এসেছে। জলজ্যান্ত একটা শহরের বুকের ওপর এরকম ঘটনা ঘটতে পারে যেন বিশ্বাস হতে চায় না। পাপুল বলল—‘দ্যাখো দ্যাখো পিসিমণি আমার কেমন গা শিউরোচ্ছে!’
অমুর গল্পটা এইরকম। ও মিণ্টু আর সন্তু আমাদের বাড়ির রকে বসে গল্প করছিল, সন্তু অমু দুজনেই এইচ এস দিয়েছে। মিন্টু পরের বছর দেবে। ওদের খুব ভাব। মিণ্টু আগে চলে যায়, তারপর সন্তু বলে—‘চল ক্লাবে যাই।’ অমু রাজি হয়নি। এমনিই রকে বসেছিল, ভাবছিল এখুনি ভেতরে ঢুকবে। তখন মোটামুটি সন্ধের ছায়া পড়ে গেছে। এমন সময় পেশকার লেনের ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে অমুকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। লোকটার পরনে গেরুয়া জোব্বা। মুখে বেশ লম্বা দাড়ি, চুলগুলো বাবরিমতো, কাঁচা পাকা, হাতে একটা গেরুয়া রঙের থলি ছিল।
মেজদা বলল—‘ডাকল, অমনি তুই চলে গেলি?’
অমু বলল—‘আমি ভেবেছিলুম, ও আমাকে কোনও ঠিকানা-টিকানা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু ও আমাকে দেখেই হাতছানি মতো একটা ইশারা করে চলতে লাগল।’
—‘তুইও অমনি চলতে লাগলি?’
—‘হ্যাঁ। কিন্তু কেন আমি জানি না। লোকটা অলিগলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলেছে আমিও পেছন পেছন চলছি। মাঝে মাঝে খেয়াল হচ্ছে আমার ডান পাশে একটা বড়নদী, কলকারখানা চিমনি, এইভাবে আমি চলেছি। তারপরে কি হয়েছে জানি না। হঠাৎ যেন আমার খেয়াল হল আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছি। একটা লোক আমাকে নিয়ে চলেছে, তখন আমি খুব চেঁচিয়ে উঠি, লোক জড়ো হয়ে যায়। জায়গাটা একটা আধাশহর মতো। দেখি গেরুয়া-পরা লোকটা নেই। ওই লোকগুলোই বলল—জায়গাটার নাম জয়নগর, মেছুয়াপাড়া। ওরাই আমাকে পয়সা দিয়ে বাসে তুলে দিল। তারপর এই এসে পৌঁছচ্ছি।’
মেজদা বলল—‘ব্যাটাকে আমি ছাড়ব না। পুলিশ লাগিয়ে যেমন করে হোক খুঁজে বার করব।’
মা বলল—‘তোমরা তো বিশ্বাস করো না, নিশির ডাক, নিশিতে পাওয়া এসব আছে, এখনও আছে।’
—‘দূর করো তোমার নিশি’ মেজদা বলল, ‘নিশি-ফিশি নয়। ব্যাটা ছেলে-চোর। কত কি বদ উদ্দেশ্যে আজকাল ছেলে গাপ হচ্ছে খবর রাখো?’
বড়দা বলল—‘কিন্তু অমু তো বাচ্চা নয়! ওভাবে একটা লোকের পেছন পেছন যাওয়াটা…’
মেজবউদি বলল—‘নিশ্চয় হিপনোটাইজ করেছিল! কী সাঙ্ঘাতিক!’
বড়বউদি বলল—‘অত বড় একটা ছেলেকে অতক্ষণ ধরে হিপনোটাইজ করে রাখবে, যেখানে খুশি নিয়ে যাবে…এ তো আমি ভাবতেও পারছি না। এরকম হলে তো কারুরই নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না!’
মেজদা তেতো গলায় বলল—‘হিপনোটাইজ অনেক ভাবেই করা যায়; অনেকেই করতে জানে। সেটা কোনও কথা নয়। কথা হল আমার ছেলে হয়ে অমু এতটা সফ্টি হয় কি করে? দুর্বল হয় কেন?’
মেজদা সত্যিই খুব কড়া ধাতের লোক। কোনও আবেগ-সেন্টিমেন্টের ধার ধারে না। ওর বিয়ের সময়ে বাবা চাননি কিন্তু মেজদা নিজেই দশ হাজার টাকা পণ দাবি করেছিল, বাবাকে বলে দিয়েছিল ওই পণের টাকা যার কাছে পাওয়া যাবে সেই বাপের মেয়েকেই ও বিয়ে করবে। মার্কেনটাইল ফার্মের এগজিকিউটিভ জামাই করতে খরচা লাগে। এটা ওর এক ধরনের জেদ। বাবা একটু আদর্শবাদী ধাতের মানুষ ছিলেন। বড়দার ওপর ঝোঁকটা ছিল বেশি। বড়দার বিয়েতে এক পয়সাও নেননি। নিজের সঞ্চয় থেকেই খরচ করেছিলেন। মেজদার সেটা রাগের কারণ ছিল। হিপনোটাইজ করার কথাটা মেজদা ওভাবে বলল কেন বড়বউদি বোঝেনি, আমি কিন্তু বুঝেছি। অমু ওদের একমাত্র ছেলে কিন্তু বড়দা-বউদির বড্ড ন্যাওটা ছিল ছোট থেকে। দীপ্ত, মহুয়া, পাপুয়া, অমু, অরু একটা গ্রুপ। পাঁচজনের খুব ভাব। অনেক সময়ে অমু বড়মার ঘরে শুয়ে পড়ত দাদার পাশে। মেজদা এল টি সি নিয়ে নিয়মিত বেড়াতে যায়। অমু সব সময়ে যেতে চাইত না। এটা মেজদা মেজবউদি ভালো চোখে দেখত না। ছোটতে যখন সুবিধে ছিল ছেলে ট্যাঁকে না থাকার, তখন কিছু বলত না। সিনেমা যেতে, বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি বেড়াতে যেতে অমুকে বড়মার কাছে রেখে চলে যেত। কিন্তু অমু বড় হয়ে যেতে এটা ওদের একদম পছন্দ হচ্ছিল না। অমুর জন্য আলাদা টিউটর রাখাতে বড়দা-বউদি দুজনেই খুব আঘাত পায়। বড়দা অঙ্ক ইংরেজি ভালো জানে। বউদি ভূগোলের টিচার। আমি শুনেছি বড়দা বলছে—‘দ্যাখো উমা, তুমি অসিতকে বারণ করো, অতগুলো পয়সা খরচ করবে কেন শুধু শুধু? ওতো ভালোই করছে আমার কাছে। আমি না পারলে দীপ্ত রয়েছে। যখন আসবে দেখিয়ে দেবে। তা ছাড়া মাধ্যমিকের জোগ্রাফির কত ফ্যাচাং! তুমি না দেখালে কে আর ওভাবে দেখাবে?’
বড়বউদি বলেছিল—‘আমার যা কিছু শেখাবার তা অমু কবেই শিখে গেছে। আমার আর ওর মাস্টারি করবার দরকার নেই। আর ওর বাবা-মা যদি তোমার পড়ানোয় সন্তুষ্ট হতে না পারে, তাতে তোমারই বা এতো কি?’
বড়দা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিল—‘সস্তুষ্ট-অসন্তুষ্টর কথা উঠছে কোথা থেকে? তুমি সবটাই বড় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দ্যাখো। আসলে ও মনে করেছে আমি আদতে ইংরিজির লোক, অঙ্কটা…’
বড়বউদি বলেছিল—‘মনে তো ঠিকই করেছে। তুমি এই নিয়ে রগড়ারগড়ি করা ছেড়ে দাও।’
অমু নিজেও খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল, বলেছিল—’জেঠু আমার অ্যাডিশনাল ম্যাথ্স্ পর্যন্ত সামলে দিচ্ছে! আমার আবার টিউটর কি হবে? ফিজিক্স তো তুমি ইচ্ছে করলেই দেখাতে পারো। কেমিস্ট্রি দরকার হলেই বড়মার কাছে যাই।’
—‘ভূগোলের মাস্টারনি কেমিস্ট্রির কি জানে রে?’ মেজদা তেড়েমেরে বলেছিল।
—‘জানে অনেকরকম। ডাকিনীবিদ্যা, মন্ত্রতন্ত্র’, মেজবউদি মন্তব্য করল। হিপনোটিজমের প্রসঙ্গের উৎস ওইখানে। আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি।
পুলিশের কাছে আবার নতুন করে যাতায়াত শুরু হল। থানার ও-সি মেজদার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন। খাতির আছে। বললেন—‘নৈহাটি অঞ্চলে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয় লোক দুজন যুবককে পিটিয়ে খুন করেছে। ছেলেধরার উপদ্রব আমাদের এদিকে তো ছিল না। অমিতাংশুকে দিয়ে শুরু হল। তার মানে লোকটা চট করে এ অঞ্চল ছাড়বে না। ওকে ফিরে আসতে হবেই। আর তখনই ওকে ধরা পড়তে হবে আমার জালে। এক কাজ করো, অমিতকে আমার সঙ্গে একটু একলা কথা বলতে দাও। দরকারি কথাগুলো জেনে নিই।’
আধ ঘন্টাটাক অমুকে নির্জনে জেরা করে ছেড়ে দিলেন প্রতাপদা। মেজদা বলল—‘প্রতাপ বলেছে বড়জোর এক মাস। তার মধ্যেই ব্যাটা ভণ্ড সন্ন্যাসীকে ও খুঁজে বার করবেই।’
কিন্তু আমরা অমু সম্পর্কে একটু সাবধান হয়ে গেছি। ওকে বড় একটা বাড়ি থেকে বার হতে দেওয়া হয় না। হলে সঙ্গে অরু থাকে। অরু অবশ্য নেহাত ছেলেমানুষ। তবু একটা মানুষ তো! অমুর বন্ধুবান্ধবদেরও পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে ওরা যেন ওকে একলা ফেলে অন্যত্র না যায়।
বড়দা অবশ্য আমাদের এতো সাবধানতা দেখে বলল, ‘ছেলেধরাই যদি হয় তা হলে তোরা অরুর ওপরও নজর রাখ। ও তো সত্যিই পুঁচকে। একলা একলা স্কুল, কোচিং, খেলার মাঠ, বাজার সবই তো করছে। অমুর বয়সের ছেলের চেয়ে অরুর বয়সের ছেলের তো বিপদ বেশি।’
শুনে আমার বুকের মধ্যেটা কেমন কেঁপে উঠল। আমি একেবারেই নিঃসহায়। অরুর ওপর পাহারা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মা বলল—‘অরু ডাকাবুকো ছেলে, ওর ওপর চট করে কেউ হাত দেবে না।’ মা যেন সব জেনে বসে আছে। মহুয়াকে ডেকে বললাম—‘অরুকে একটু তোর কাছে আটকে রাখিস তো!’ দিদিকে অরু খুব মানে। মহুয়া বলল—‘তোমারও ভয় করছে পিসিমণি?’ সাহসী, মাথা-ঠাণ্ডা বলে আমার খুব খ্যাতি এ বাড়িতে। আমার সাহস যে নিরুপায়ের সাহস তা মহুয়া কি করে বুঝবে!
দিন দশেক পরে প্রতাপদা এলেন। মেজদার সঙ্গে কি চুপিচুপি কথাবার্তা হল, তারপরেই শুনলাম আমাদের সবাইকেই, অর্থাৎ বড়দের সবাইকে উনি ডাকছেন। আমি, মা, বড়দা, বড়বউদি সবাই গেলাম। সুব চুপচাপ। প্রতাপদা সিগারেট খাচ্ছিলেন, মাকে দেখে সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন।
‘কী ব্যাপার? কিছু পেলে?’ বড়দা বললেন।
রহস্যময় হাসি হেসে প্রতাপদা বললেন—‘পেলাম আবার পেলামও না।’
‘খুলেই বলো না!’ মেজদা মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছে।
প্রতাপদা বললেন—‘অমিতাংশু আদৌ কারো ডাকে সাড়া দিয়ে যায়নি, এমনি এমনিই চলে গিয়েছিল। ওসব দাড়ি-অলা গেরুয়াধারী ওর কপোলকল্পনা। মিথ্যে কথা।’
মেজদা গরম হয়ে বলল—‘অমু মিথ্যে কথা বলছে?’
বড়বউদি বলল—‘তাতে ওর লাভ?’
‘সেটাই তো ধরতে পারছি না। প্রথমে ওর বর্ণনা থেকে মনে হয়েছিল লোকটা ছদ্মবেশ পরে আছে। দাড়ি চুল সব নকল। সেটা মাথায় রেখেই অমু যেখানে গেছে বলে বর্ণনা দিয়েছে, সেখানে সেখানে খোঁজ করেছি। অমুর খোঁজ পেয়েছি অথচ লোকটার কথা কেউ বলতে পারছে না। অমুর যাত্রাপথটা আমি মোটামুটি ট্রেস করতে পেরেছি।’
‘পেরেছ?’
‘পেরেছি। কিন্তু সেটা লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে। ওর বর্ণনামতে এগোতে গিয়ে দেখলাম ও মিথ্যে কথা বলছে। উত্তেজিত হয়ো না অসিত’, একটু হেসে প্রতাপদা বললেন—‘ছেলে তোমার একা একা কোথাও এখনও যায়নি বিশেষ কিছুই জানে না, চেনে না। বড় নদী, কলকারখানা এইসব অস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে ও আমাদের বোঝাতে চেয়েছে ও গঙ্গার পশ্চিম পাড় ধরে এগিয়েছে মোটামুটি। শেষকালে পৌঁছেছে জয়নগর। অথচ জয়নগরের পথ আদৌ গঙ্গার ধার দিয়ে নয়। আর সেখানে মেছুয়াপাড়া বলেও কিছু নেই। আমি যদ্দূর ধরতে পেরেছি, ও ঘুসুড়ি, বালি, উত্তরপাড়া হয়ে হুগলির দিকে চলে যায়। ব্যান্ডেল পর্যন্ত ও গিয়েছিল, কখনও বাসে, কখনও পায়ে হেঁটে। এখন বলো ওদিকে তোমাদের কোনও আত্মীয় বা অমিতের কোনও চেনাশোনা আছে? কিংবা জয়নগরে? যার কাছে ওর যাওয়ার ইচ্ছে থাকতে পারে!’
আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কেউ নেই। আমাদের চেনা কেউ নেই। না ব্যান্ডেলের দিকে, না জয়নগর। অমুর চেনা কেউ আছে কি না কি করে জানব? এতদিন ধারণা ছিল অমুকে আমরা চিনি, অমুর চেলাদেরও চিনি। এখন মনে হচ্ছে অমুকেও পুরো চিনি না, সে ক্ষেত্রে ওর চেনা অথচ আমাদের অজানা লোক থাকতেই পারে। প্রতাপদা এবার খাটো গলায় বললেন—‘রাগ করবেন না, কোনও লভ অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ার!’
‘পাগল হয়েছে? অমু করবে প্রেম? মেয়ে দেখলে এখনও শিঁটোয়!’
‘ওইরকম ছেলেরাই বেশি প্রেমে-ট্রেমে পড়ে, অসিত।’
বড়বউদি বলল—‘না, না, ওসব নয়। হলে আমি জানতে পারতুম।’
‘পরীক্ষা দিচ্ছিল না?’ প্রতাপদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরীক্ষা কি রকম হয়েছে? কবে রেজাল্ট?’
বড়দা বলল—‘খুব ভাল হয়েছে। জয়েন্টে চান্স পাওয়া তো কারো হাতে নয়, তবে উচ্চমাধ্যমিক খুবই ভালো হয়েছে।’
বড়বউদি বলল—‘রেজাল্ট বেরোতে এখনও অনেক দেরি।’
হু’, প্রতাপদা গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘বাড়িতে কোনও ঝগড়া বিবাদ, ছেলেপুলেদের পক্ষে ট্রমাটিক কিছু! সঙ্কোচ করলে চলবে না।’
মেজদা বলে উঠল—‘প্রশ্নই ওঠে না। এ বাড়ি পাড়ার মধ্যে সব চেয়ে ভদ্র বাড়ি। কোনও ঝগড়া-ঝাঁটি এখানে কখনও হয় না।’
কথাটা সত্যি। আশেপাশের বাড়িতে যখন তখন ধুন্ধুমার ঝগড়া, বাসন ফেলাফেলি, কান্নাকাটির আওয়াজ পাই। আমাদের বাড়িতে ওসব নেই। কিন্তু আওয়াজ নেই বলে যে বিবাদও নেই, কথাটা সত্যি না। মহুল বলে, ‘পিসিমণি আমাদের বাড়ি ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বাড়ি, কি বলো?’ ঠিক কথা। এটা বরাবর ছিল। আমার বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখনও। বাবা বড়দাকে পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন বেশি। বড়বউদির ওপরও তাঁর ভরসা ছিল বেশি। বিনা কারণে হয়নি ব্যাপারটা, বড়দা যেমন নির্মলচিত্ত, স্নেহপ্রবণ, বড়বউদিও তেমন কর্মঠ আপন পর জ্ঞানশূন্য ছিল। সে সময়ে আমাদের পয়সার টানাটানি চলেছে, মেজদার চাকরি হয়নি, ছোড়দা ভুগছে, তখন বড়বউদি ঘরে বাইরে যে পরিশ্রম করেছে ভাবলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। এমনিতে ওর সকালবেলায় স্কুল। দুপুরেও একটা পার্ট-টাইম নিল। বাড়ি ফিরে তিনটে থেকে টুইশনি। সপ্তাহে তিন চার দিন। কোন ভোরবেলা উঠে রান্না সারছে, আমি বাপের বাড়ি থাকলে হয়ত যোগান দিচ্ছি। মা পুজো না করে নিচে নামবে না। বাবারও তখন অনেক ফরমাস ছিল। সেসব মা সামাল দিত। দু হাতে সব কাজ সেরে, গোছগাছ করে বউদি ঝড়ের বেগে স্কুলে চলে যেত। ফিরে স্নান খাওয়া করে আবার। সে সময়টা পাপুল হয়নি। বাবা-মা সব সময়ে বাইরে কিংবা কাজে ব্যস্ত। দীপ্ত আর মহুয়া যে কী করে মানুষ হয়েছে! যাই হোক। মায়ের ঝোঁক কিন্তু বরাবর মেজদার দিকে। ছোটকে মা খানিকটা সমীহ করত। মেজ বরাবর রাগী, জেদী, মা তার রাগকে তেজ, জেদকে দৃঢ়তা বলে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যে এই দুই-দুই চিরকাল অশান্তি জাগিয়ে রেখেছে। ধিকি ধিকি আগুনের মতো। বড়বউদির মার ওপর গভীর অভিমান। বড়দাও বাবা চলে গিয়ে যেন সংসারের মধ্যে খুঁটিহীন একলাটি পড়ে গেছে। মেজবৌ শীলা কোনদিন বড়বউদিকে দেখতে পারে না। ওর জ্বালাটা আমি বুঝি। বড়লোকের মেয়ে, বড় চাক্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, কিন্তু একেবারে গো-মুখ্যু। সংসারে বড়বউদির এই প্রতিষ্ঠা। বাইরে তার মান সম্মান এ জিনিস ও এখনও সইতে পারেনি। মানতে শেখেনি। অথচ বড় ওকে আপন বোনের মতো স্নেহ করতো। স্পষ্টাস্পষ্টি দোষ ধরতে না পারলে জ্বালাটা বোধহয় আরও তীব্র হয়। আমি জানি মেজবউদি তার জ্বালার অনেকটাই মেজদার মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছে। মেজদা আগে থেকেই বড়দার ওপর খাপ্পা ছিল, এখন তাকে একেবারে দেখতে পারে না। বড়বউদিকে বলে মাস্টারনি। বাড়িতে কেউ খেতে এলে, জোর করে মেজবউদিকে দিয়ে একটা পদ রাঁধায়। অতিথিকে খাওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করে—‘কোন কোন রান্নাটা ভালো হয়েছে?’ যদি কেউ এখনও মেজবউদিরটা ভালো বলে তো কূট চোখে চারদিকে তাকায়, বিশ্রী হাসে। শুধু বড়বউদি নয়, মহুয়া পাপুল পর্যন্ত এ জিনিসগুলো ধরতে পারে। পারে না খালি আমার মা। বলে ‘হ্যাঁ, শৌখীন রান্নায় মেজবউমার হাত ভালো। ব্যাগারঠালা কাজ নয়তো!’
বড়বউদির অভিমান হবে না কেন! তা এইসব ক্ষুদ্রতা, প্রতিদিনকার নীচতা কি ভাষায় প্রকাশ করার যোগ্য? না এ কাউকে বলা যায়! অফিস ফেরত মেজদা যে বড় দোকানের কেক-প্যাটিস আনে, ভালো সন্দেশ আনে, দরজা বন্ধ করে স্বামী-স্ত্রী খায়, ছেলের জন্যে রেখে দ্যায়। আর বড়দা যে সামান্য একটু নতুন গুড়ের সন্দেশ আনলেও তার কুটি কুটি ভাগ হয় সবার জন্যে, আর এই জিনিস নিয়ে বড়বউদি কান্নাকাটি করলে মা বলে—‘ও করছে করুক গে, বউমা, তুমি বড়, বড়র মতো ব্যাভার করো’—এ-ও তো সত্যি! দীপ্ত হোস্টেলে থাকে। কিন্তু মহুয়া পাপুয়া যে মেয়ে, সংসারের ভেতরকার সব গোঁজামিল টের পায়। টের পেয়েও চুপ করে থাকে। কখনও কখনও গম্ভীর উদাস হয়ে যায়, এ তো আমি দেখতেই পাই। সত্যিকার মানসিক ধাক্কা খাওয়ার কথা ওই দুটি মেয়ের। অমু, অরু এরা কতদূর এসব অনুভব করে আমার জানা নেই।
প্রতাপদা বললেন, ‘ইনভেস্টিগেশন আমি চালিয়ে যাচ্ছি। তবে কোনও লাভ নেই। আমি নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইন পার্সেন্ট শিওর অমিত মিথ্যে বলছে, সত্যটা তোমরা স্বীকার করো চাই না করো।’
প্রতাপদা বেরিয়ে গেলেন। মেজদা ফুঁসছে। ‘আমার ছেলে মিছে কথা বলবে?’ মেজবউদিও ফোঁপাচ্ছে—‘অমু আমার ছেলে হয়ে মিছে কথা বলবে এ আমি ভাবতেও পারছি না,’ কেন ভাবতে পারছে না ভগবান জানেন। আমি যা জানি তা হল এই মেজদা মেজবউদি প্রায়ই ট্যাক্সি ভাড়া করে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি লৌকিকতা করতে যায় এবং বড়দা-বউদির নামে তাদের ছেলেমেয়েদের নামে অকথ্য সব মিথ্যে কথা লাগিয়ে আসে। আমার নামেও লাগায়। আমি নাকি ননদিনী রায়বাঘিনী, আমার সমস্ত খরচ ওরাই বহন করে, অথচ আমি ছেলেকে চুপিচুপি আলাদা খাওয়াই। পরিবেশন করতে গেলে বড় মাছটা নিজের ছেলের পাতে তুলে দিই। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেলে আমার বা বড়দার পরিবারের আজকাল যে হতচ্ছেদ্দা মিলছে তা এই কারণেই, আমি জানি। এ সব কথা কেন যে লোকে বিশ্বাস করে সেটাও আমার কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। ওরা কি দেখেনি বড়দার নিষ্পাপ চোখ, মহু পাপুর মিষ্টি ব্যবহার। নিজেদের চোখে দেখেনি বড়বউদির ভূতের খাটুনি! দেখেছে, দেখে অনেক সময়েই বলেছে—‘বড়কে একটু সব দিক দেখতে হবে বইকি!’ তা না হয় দেখল। কিন্তু তারপরেই যদি নালিশ করে, ‘সংসারের চাবিকাঠিটি বড়বউমার হাতে! কলকাঠি সব ওই নাড়ছে।’ তবে সেটা অন্যায় হয় না? সে গতরে করবে, বুদ্ধিতে করবে, অর্থ দিয়ে করবে, তোমাদের হাতে চাবিটি তবে থাকে কি করে?
বড়দা বলল—‘অসিত, প্রতাপ যতই হোক একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার, তার কথাটা একেবারে ফেলে দিও না।’
মেজদা তেড়ে উঠল—‘মানে, তুমি তা হলে ওকে মিথ্যেবাদী হতেই শিখিয়েছ?’
বড়দা বলল—‘মিথ্যের প্রশ্নই উঠছে না। আমি বলছিলুম ওকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।’
‘বলছ কি, আমার ছেলেকে পাগল বলছ? পাগল বলতে চাইছ?’
‘শোনো অসিত, মাথা ঠাণ্ডা করো, মাথা গরম করার সময় এ নয়। শুধু পাগলরা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায় না। অনেক রকমের মানসিক বিপদ আছে তা ছাড়াও। তুমি ওকে ডাক্তার দেখাও। ওকে যেন এখন মিথ্যেবাদী বলে শাসন করতে যেও না।’
‘শাসন করব না মানে? পিঠের ছাল তুলে নেব!’
‘তার আগে শিওর হও যে ও মিথ্যে কথা বলছে!’ বড়দাকে কোন দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত কথা মেজদার সঙ্গে বলতে দেখিনি। বড়দা নিজের ঘরে গিয়ে বড়বউদিকে বলল—‘উমা, টাকা বার করো, ও না যায় আমিই ডাক্তারের কাছে যাব।’
বউদি বলল—‘না, তুমি যেতে পারবে না। টাকা আমি দেব না।’
বড়দা আহত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল—‘একথা তুমি বলতে পারলে? এই মহা বিপদের সময়ে তুমি ছোটখাটো সাংসারিক মনোমালিন্যর কথা ভেবে হাত গুটিয়ে নিচ্ছ?’
বউদির চোখ ছলছল করছে, সে বলল—‘সুবর্ণ, তুই সাক্ষী রইলি, যার ছেলে তার সিদ্ধান্তের ওপর হাত দিলে যে কী ভয়ানক অশান্তি হতে পারে তা জানি বলেই নিষেধ করছিলুম। কিন্তু তোর দাদা আমাকে আপাদমস্তক ভুল বুঝল।’ বউদি আলমারি থেকে বার করে দিল টাকা।
বড়দা বলল—‘আমি তো ওকে নিয়ে যাচ্ছি না উমা, ডাক্তারকে শুধু কেসটা বলব, মতামত নেব। কাউকে কিছু বলবার দরকার নেই। আমার প্রাণটা বড় অস্থির লাগছে।’
সত্যিই বড়দা যেন ধড়ফড় করতে করতে বেরিয়ে গেল।
মেজদা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবের পরামর্শে ঠিকই করল অমুকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। সকলেই বলছে কৈশোর বড় খারাপ সময়। ডাক্তার দেখিয়ে নিতে ক্ষতি কি?
অমু প্রত্যেক সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে সিটিং দিতে যায়। দু’বার করে। মেজদার সময় হয় না সব দিন। বেশির ভাগ দিন আমিই যাই। আমার কাজ আর কিছু না। বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে থাকি। আধ ঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় নেন ভদ্রলোক। ইনি শুধু ডাক্তারই নন, সাইকো-অ্যানালিসিসও নিজেই করেন। হয়ে গেলে অমু বেরিয়ে আসে, আমি ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।
মাসখানেক পরে ডাক্তার আমায় ডেকে পাঠালেন। কথাবার্তা যা হল তা এই: ডক্টর চন্দ্র: ‘আপনি তো অমিতাংশুর পিসি!’
‘হ্যাঁ।’
‘নিজের?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কত দিন এদের বাড়িতে আছেন?’
‘বছর দশেক।’
‘আপনার ছেলের বয়স?’
‘চোদ্দ।’
‘আপনার ছেলে অমিতাংশু যে স্কুলে পড়ত সেখানে পড়ে না কেন?’
এসব প্রশ্নের অর্থ কি আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বিরক্তিও লাগছিল। এটা আমার একটা গোপন ক্ষতের জায়গা। অরুকে পাড়ার স্কুলে দিয়েছি। অর্ধেক সময় ক্লাস হয় না। পাজি ছেলেদের আখড়া একটা। পাঁচিল টপকে টপকে সব পালায়। প্রতিবছর অর্ধেক ছেলে ফেল করছে, সবাই প্রোমোশন পেয়ে যাচ্ছে। এখানে আমার দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অরুকে যখন ভর্তি করেছি ওর মাথাটা কাঁচা ছিল, একদম। অমুদের স্কুলটা দূরেও বটে, কড়াও বটে। মেজদা একটু ধরাধরি করলে হয়ে যেত কারণ দীপ্ত, অমু দুজনেই ওই স্কুলের ভালো ছাত্র। কিন্তু মেজদা বা বড়দা কেউই সেটা করেনি। বড়দার স্কুল কলকাতায়। সেখানে ভর্তি করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আমি আশা করেছিলাম, মেজদা না হোক বড়দা অমুদের স্কুলে অরুকে ভর্তি করবার চেষ্টা করবে। কিন্তু করল না। বড়দাও না। আমি এখন বুঝি বড়দা খুব ভালো, কিন্তু মাস্টারমশাই হিসেবে ও ভালো ছেলেদের জন্যে যতটা দরদ অনুভব করে, সাধারণ ছেলেদের জন্য ততটা নয়। তা ছাড়া আমার সন্দেহ হয় অরুর বাবার নামটা ওরা সবার কাছে বার করতে চায় না। অরুকে পড়িয়ে শুনিয়ে অবশ্য বড়দা-বউদিও তারপর তৈরি করেছে। স্কুলের সায়েন্স টিচারের কোচিংয়ে না দিলে তিনি ওকে ঠিকঠাক নম্বর দেবেন না তাই দেওয়া। এত কথা ডাক্তারকে বলা যায় না। বলার মানেই বা কি? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ডক্টর চন্দ্র বললেন—‘প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতাম না। মাই পেশেন্ট ইজ ভেরি মাচ হার্ট।’
আশ্চর্য! কি বলছেন উনি? আমি বললাম—‘দেখুন আমার স্বামীর রেখে যাওয়া সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে আমাকে চলতে হয় অনেকটাই। অমুর স্কুলে পড়াবার আর্থিক সাধ্য আমার নেই। আমার ছেলে ভর্তির সময়ে তত চৌখসও ছিল না। অ্যাডমিশন টেস্টে পারেনি। এ প্রশ্ন উঠছে কেন আমি বুঝতে পারছি না।’
ডক্টর চন্দ্র হেসে বললেন, ‘দেখুন পিসিমণি, আমার পেশেন্ট বহুদিন ধরে লক্ষ্য করেছে বাড়ির সব ছেলেমেয়ে বড়দের কাছ থেকে এক ব্যবহার পাচ্ছে না। আপনার ছেলের স্কুল ভর্তি নিয়ে নিশ্চয় বাড়িতে যথেষ্ট কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমার পেশেন্ট মনে করে আপনার ছেলেকে এবং আপনাকেও অবহেলা করা হচ্ছে, এটা একটা পয়েন্ট। কিন্তু শুধু তাই-ই নয়, অনেক রকম পারিবারিক অবিচার, স্কুলের অবিচার সামাজিক অবিচার ওর মনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘তো কি? ও কি তাই জন্যেই পালিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।’
‘মে বি, হী ওয়াজ ট্রাইং টু গেট অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য ফ্যামিলি, ফ্রম দা সোসাইটি। বাট হী ইজ টেলিং আস ট্রুথ হোয়েন হী সেজ হী ওয়াজ সর্ট অফ ডিউপ্ড্ বাই এ ম্যান। পিসিমণি ওই লোকটি সত্যি। তবে সে লোকজন জড়ো হতে পালিয়ে গিয়েছিল কি না, অমিতাংশু অ্যাট অল ঘুসুড়ির পথে গিয়েছিল না বামুনগাছির পোল হয়ে কোনা জগদীশপুরের দিকে যায় সেটা এখনও বুঝতে পারিনি। বাই দা ওয়ে, আপনারা কি জানেন অমিতাংশু খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে?
—‘না তো! তবে বউদি বলে ম্যাপ-ট্যাপ খুব ভাল আঁকে। বউদির ইচ্ছে ছিল ও জোগ্রাফি পড়ে। কার্টোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করে।’
‘কে বউদি? পেশেন্টের মা?’
‘না, ওর জ্যাঠাইমা, বড়মা বলে।’
‘হুঁ।’ ডক্টর চন্দ্র চুপ করে গেলেন, তারপরে বললেন, ‘অমিতাংশু আমাকে একটা ছবি এঁকে দিয়েছে, ফ্রি হ্যান্ড এঁকেছে, কিন্তু একেবারে নিখুঁত। ওই লোকটির ছবি।’
—‘কে লোক?’
—‘যে ওকে ডেকেছিল।’
ড্রয়ার থেকে সাদা একটা কাগজ বার করে আমার সামনে রাখলেন ডক্টর চন্দ্র। এবং আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। ছবিটা এগার বছর আগে নিরুদ্দিষ্ট আমার স্বামীর। ওর একটা ছবি আমার ঘরে আছে। ধুলোময়লা পড়ে মলিন চেহারা। বছরে একদিন হয়ত হাত পড়ে তাতে। মালা কখনও পড়ে না। যদিও আমার বিশ্বাস ও আর নেই, তবু মালা পরাতে হাত কেঁপে যায়। তা ছাড়া যে মানুষ তার স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকে পুরো সংসারের সামনে একলা অসহায় ফেলে রেখে নিজের যন্ত্রণা, নিজের অভিমানকে বড় করে দেখে পালিয়ে যেতে পারে তার ফটোর কি মালা পরা সাজে? অবিকল সেই ছবিটি এঁকেছে অমু। মাথায় কাঁচা পাকা চুল, কাঁচা পাকা দাড়ি। কিন্তু ভেতরের মুখটি চিনতে অন্তত আমার কোনও ভুল হয়নি। ও কি তবে বেঁচে আছে? সত্যিই আমাদের বাড়ির কাছে এসেছিল? অমুকে ডেকে আমার কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল? তা হলে তা না করে ওকে ওভাবে ডেকে নিয়ে যাবার অর্থ কি? ওভাবে পালিয়ে যাবারই বা অর্থ কি? ওর কি মাথার ঠিক নেই?
ডাক্তার আমার মুখের ভাব দেখছিলেন, বললেন—‘চেনেন?’ আমার দিকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জলটা খেয়ে নিন। তারপরে উত্তরটা শুনব।’
খানিকটা কবুল করতেই, বললেন—‘গোপন করবেন না। ডাক্তার আর উকিলকে কিছু গোপন করতে নেই, জানেন না?’
গোপন করার আর আছেটা কি? তবে সেসব কথা এখন আমার মনে করতেও কষ্ট হয়। অফিসে টাকা তছরূপের দায়ে সাসপেন্ড হলেন। মস্ত দায়িত্বশীল পদে কাজ। পেমেন্টের জন্য বিল সই হতে আসে অজস্র, প্রতিদিন। রুটিন কাজ। গোছা গোছা ফলস বিল সই করিয়ে নিয়ে গেছে। অধস্তন অফিসারদের এতো বিশ্বাস করতেন যে তাঁর নিজের সইয়ের জায়গাটি পর পর খুলে ধরলে বিলে তাদের সই আছে কি না দেখে নেবার দরকারও মনে করতেন না। কখনও কখনও এরা তাড়াতাড়ির নাম করে ব্ল্যাঙ্ক চেকও নাকি সই করিয়ে নিয়েছে। এসব আমি পরে শুনেছি। মুখের কথাই ছিল বিশ্বাস করে ঠকব তা-ও ভালো। তো ঠকো। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের কথা ওর আত্মপক্ষ সমর্থন কেউ বিশ্বাস করেনি। নিজের উকিলও না। কেস যখন সাব জুডিস তখন কোথাও আমাদের মুখ দেখাবার উপায় ছিল না। রকম-সকম দেখে ওর রোখ চেপে গেল, বলল—‘কারা করেছে এখন আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাদের আমি ধরাবই।’ অফিস থেকে কোনও সাহায্য পাবার উপায় নেই। একজন অনুগত পিওনের সাহায্যে প্রত্যেকটি অফিসারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করল, অমানুষিক পরিশ্রম আর বুদ্ধি খরচ করে।
এই পর্যন্ত শোনার পর ডক্টর চন্দ্র বললেন, ‘ও হো মনে পড়েছে, সে তো সেনসেশন্যাল কেস। আসামী ধরা পড়েনি। পি কে দত্ত বেনিফিট অফ ডাউটে মুক্তি পেলেন। আচ্ছা। সেই কেস।’
আমি বললাম—‘আসামী ধরা পড়েছিল। প্রতীক দত্ত বেনিফিট অফ ডাউটে মুক্তি পাননি। বেকসুর খালাস পান। তাঁর অধস্তন তিনজন অফিসার এক সাপ্লায়ারের সঙ্গে মিলে বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে টাকা মারছিল। তাদের শেষ পর্যন্ত প্রতীক দত্তই ধরিয়ে দেন। প্রত্যেকের সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু ডক্টর চন্দ্র, আপনি যেমন কেসটার সম্পর্কে ভুল তথ্য জানেন, বিশ্বসুদ্ধু লোকও তেমনি জানে। কেন জানেন? খবরের কাগজের গাফিলতি। যতদিন একটা পদস্থ, মানী লোককে টেনে মাটিতে নামাবার সুযোগ ছিল, তার নাম কলঙ্কিত করবার সুযোগ ছিল ততদিন রগরগে সংবাদগুলো তেল মশলা ঢেলে পরিবেশন করেছে। তার পরের কথা আর কিছু লেখেনি। কিচ্ছু না। কাজেই আপনার মতো সবাই অর্ধসত্য জানে।’
ডক্টর চন্দ্র মুখে একটা দুঃখসূচক শব্দ করলেন, উনি আমার দিকে সোজা তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, ‘আর আজ আপনার ব্যবহার যা, এগার বছর আগে গোটা সমাজের ব্যবহারও অবিকল তাই-ই ছিল। আমাদের নিজেদের লোকেরা, আমার এবং আমার স্বামীর বাবা ভাই কেউ বিশ্বাস করেননি সে নির্দোষ। বেকসুর খালাস পাবার পরও তার সঙ্গে আপনজনদের ব্যবহারে দ্বিধা অবজ্ঞা অবিশ্বাস মিশে ছিল। উকিল বলেন—‘এইবার আপনি সরকারের নামে মানহানির মামলা করুন মিঃ দত্ত।’ উনি চুপ করেছিলেন। অপরাধীদের ধরতে ওঁর সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এবং অপরাধীরা যে তাঁর ভাইয়ের মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো ছিল, এই চেতনা, এই বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, কেস মিটে যাবার পরও। আর তারপর একদিন শেষ রাতে, এই অসহনীয় সামাজিক নির্যাতন সইতে না পেরে উনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান।’
ডক্টর চন্দ্র বললেন—‘এক্সট্রীমলি ইন্টারেস্টিং। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে উনি বেঁচে আছেন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন। অমিতকে হয়ত নিজের ছেলেই ভেবেছেন। কেন বাড়িতে আসেননি, বাড়ির কাছাকাছি কোথাও বসে ওর সঙ্গে কথা বলেননি, ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই তার কোনও সঙ্গত ব্যাখ্যা আছে। তা হলে আপনারা নিশ্চিন্ত হয়ে যান ইটস নট এ কেস অফ হ্যালুসিনেশন। যদিও একটা কথা আমি আপনাদের বলবই ডাক্তার হিসেবে, অমিতাংশু ছেলেটি একেবারে স্বাভাবিক নয়। একটু বেশি স্পর্শকাতর। ও পরিবারের এবং তার বাইরের বৃহত্তর সামাজিক গণ্ডির সব সমস্যা নিয়েই ভেতরে ভেতরে খুব উদ্বিগ্ন। তা ছাড়াও, ও নিজে যা হতে চায়, তা ওর প্রিয়জনেরা ওকে হতে দিচ্ছে না। এ সমস্যাগুলো ওর রয়েছেই। আপনারা ওর সম্পর্কে একটু সাবধানে চলবেন।’
‘কী হতে চায়, ও’ জিজ্ঞেস করলাম।
—‘সম্ভবত পেন্টার বা আর্কিটেক্ট।’
ডাক্তারবাবুর কথা শেষ হলে তাঁর একশ পঞ্চাশ টাকা পারিশ্রমিক টেবিলে রেখে এয়ার কন্ডিশনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। সপ্তাহে দুবার দেড়শ করে তিনশ, তার মানে মেজদার মাসিক খরচ হল বারোশ, ডাক্তারের ফি বাবদ। এ ছাড়া ব্রেন স্ক্যান, ই ই জি, ইত্যাদির জন্য আলাদা খরচ তো হয়েছেই। ওয়েটিং রুমে ঢুকতেই একঝলক গরম হাওয়া লাগল। অন্ধকার বাইরে। অমু ছিল শেষ পেশেন্ট। শূন্য ঘরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
বললাম—‘অমু, আয় রে, হয়ে গেছে।’
অমু আমার চোখে চোখ রেখে বলল—‘পিসিমণি, আজ এতো দেরি করলে? আজও ডাক্তার দেড়শ টাকাই নিলেন?’
আমি হেসে বললাম—‘আধঘণ্টা তোর সঙ্গে আধঘণ্টা আমার সঙ্গে কাবার করতে হল—ফি-টা আর এমন বেশি কী!’
অমুর মুখে একটা তীব্র প্রতিবাদ ঝলসে উঠল। পরক্ষণেই খুব মোলায়েম গলায় বলল—‘পিসিমণি। ঠিক করলাম, আমি ডাক্তারই হবো।’
—‘কেন রে? এতো রোজগার দেখে?’
—‘তাই-ই। একজন, অন্তত একজনও যদি রোগীকে টাকা ম্যানুফ্যাকচার করবার যন্ত্র বলে না ভাবে, আস্তে আস্তে তার থেকে একটা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে না?’
তা জানি না, কিন্তু ওর এই সিদ্ধান্তে ওর বাবা খুব খুশি হবে না। ডাক্তারের দাঁড়াতে, উপার্জন করতে অনেক বছর কেটে যাবে। সে তুলনায় একজন এঞ্জিনিয়ার অনেক তাড়াতাড়ি উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠে। কিন্তু আড়চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখের সেই ধন্দ-লাগা, বোকা-বোকা উদাস ভাবটা একদম চলে গেছে। আমি জানি, ডক্টর চন্দ্রর সিদ্ধান্ত ঠিক নয়, অমু যার ছবি এঁকেছে, তাকে ও ওর মনের গোপন ইচ্ছা থেকেই এঁকেছে। তাকে ও সত্যি দেখতে পারে না। প্রতীক দত্তর সুইসাইড নোটটা যে আমি পেয়েছিলাম। ঠিক এগার বছর আগে সে আমায় লিখে জানিয়েছিল—সমস্ত জীবন তার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেছে। সে আত্মহননের পথ বেছে নিল। হিমালয়ের দুর্গম প্রদেশে গিয়ে সে বহু ফুট নিচুতে ঝাঁপ খেয়ে নিজের প্রাণ নষ্ট করবে। আমরা কেউ তার দেহ পাবো না।
বুঝলাম, তোমার যন্ত্রণাটা বুঝলাম। তোমার সঙ্গে সঙ্গে যে আমিও সে যন্ত্রণা সমানে ভোগ করেছি, তোমাকে সান্ত্বনা আর সাহস যোগাবার জন্যে যে আমি প্রাণপণ করেছিলাম। কিন্তু প্রতীক, এভাবে পালিয়ে যাওয়ায় তোমার সারা জীবনের সততার ইতিহাসটা মিথ্যে হয়ে গেল। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে শেষ পর্যন্ত রুখে যাওয়া চাই। সত্য যার হাতের অস্ত্র সে কেন কাপুরুষের মতো স্ত্রী-পুত্রকে তার নিজের পরিত্যাগ করা সমাজের হাতে ফেলে রেখে চলে যাবে? তাই তুমি নিরুদ্দিষ্ট। পথভ্রষ্ট। তুমি আমাদের প্রতি প্রাথমিক কৃত্য করোনি, আমিও তোমার শেষকৃত্য করিনি। কিন্তু আমার আশা পূর্ণ হয়েছে। অমু পালিয়ে গিয়েছিল। তার পরিণত কৈশোরের স্পষ্ট সরল দৃষ্টি দিয়ে গোটা সমাজখানার চেহারা দেখে ভয়ে, বিতৃষ্ণায় পালিয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল তার পিসেমশাইয়ের পথটাই একমাত্র পথ। ও-ও তো ওই নিরুদ্দেশের গল্পটাই জানে। পালিয়েছিল। কিন্তু অমু ফিরে এসেছে। এমনি করেই দীপ্ত, অরু, মহুল, পাপুল সব্বাই যে যার পলায়নের জায়গা থেকে যদি ফিরে আসে! আমরা যারা নিরুদ্দিষ্ট, আর আমরা যারা হারিয়ে গেছি, ক্রমাগতই হারিয়ে যাচ্ছি, আমি, মেজদা, বড়দা, মেজবউদি, বড়বউদি, মা, ডক্টর চন্দ্র, সেই সব সাংবাদিক যাঁরা স্টেট ভার্সাস প্রতীক দত্তর মামলার অসম্পূর্ণ অর্ধসত্য বিবরণ ছেপেছিল, এই সব সবাইকে, এমন কি আত্মঘাতী প্রতীক দত্তকেও ফিরিয়ে আনবার দায়িত্ব যদি অমিতাংশুরা নেয়!