পরমা
কর্মস্থল পুনে। কলকাতায় জন্ম হলেও কর্ম নয়। পনের বছরেরও ওপর প্রবাসে কেটে গেল। এখানে আর আমার শেকড় থাকার কথা না। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক বৃক্ষের মতো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বুঝি ভিন্ন মাটিতে রোপণ করা যায় না। নিজস্ব মাটির গন্ধ তাকে ভেতরে ভেতরে পেছু হাঁটাবেই। বুকের মধ্যে আনচান ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরে। কোন মহাজলধির অন্ধকার গর্ভগৃহ থেকে পাতালশঙ্খের ধ্বনি আবর্তিত হতে হতে উঠে আসে। জলকল্লোলের মধ্যে পিষ্ট হতে থাকে অস্তিত্ব। আঁকুপাঁকু করে জেগে উঠি। প্রাণপণে বর্তমানের সচেতনের ভাঙা পাড় আঁকড়ে ধরি, যা নাকি অবচেতনের অনুপাতে আইসবার্গের দৃশ্যমান এক অষ্টমাংশের মতই অকিঞ্চিৎকর। নিজের পায়ের ছাপ ধরে ধরে মাঝে মাঝেই তাই ফিরে আসি বর্তমানের অব্যর্থ শরসন্ধানে যদি অতীতের বিক্ষিপ্ত হারানো তীরের ফলাটা বিদ্ধ করে আনতে পারি। কিন্তু পারি না। যা নিজেরই হৃৎপিণ্ডের গভীরে প্রোথিত তাকে কি নিজ হাতে তোলা যায়? কেউ কি পেরেছে?
এবার আসাও বিশেষ করে সেই বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। মূলের সঙ্গে যোগ সর্বস্তরে হওয়া চাই। নইলে বৃক্ষ বাঁচে না। প্রত্যেকবারই অনেক ব্যবহারিক উদ্দেশ্যের তলায় এই জরুরি আসল উদ্দেশ্যটা চাপা থাকে। কোনবারই কাজটা হয়ে ওঠে না। এবার আমার সেই প্রয়োজন আমার সমস্ত অস্তিত্বের টুঁটি টিপে ধরেছে। আর সবুর সইছে না। ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। ফাউন্ড্রির গরমের মধ্যে বসে অন্য এক গূঢ়তর তাপ আমায় দগ্ধায়, থেকে থেকে দম আটকে আসে।
খবর দেওয়া ছিল না। নইলে দুই দাদার কেউ না কেউ নিশ্চয়ই স্টেশনে যেতেন। যেন আমি অথর্ব কি পঙ্গু। কত বার বলেছি এসব কর না। এক চিলতে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে মিনি কি স্পেশ্যাল কি একটা ট্যাক্সি ধরে হাওড়া স্টেশন থেকে মাইল চারেক পথ চলে আসা সমর্থ পুরুষমানুষের কাছে কিছু না। মাধবী কিংবা পিকলু থাকলেও বা কথা ছিল। কিন্তু দাদারা শোনবার পাত্র নন। মুখে কিছু বলেন না, শুধু ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মের গলিতে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে বড়দার কাঁচাপাকা চাপ-দাড়ি-অলা শেল-ফ্রেমের চশমায় তপস্বী তপস্বী চেহারাখানা, কিংবা ছোড়দার ভারি শরীরের ওপর রদ্যাঁর ভাস্কর্যের মতো বসানো ভারি মাথাটা আমাকে যুগপৎ অপরাধী এবং তৃপ্ত করতে থাকে। সত্যিকারের ভদ্রতা এবং আন্তরিকতার মধ্যে অর্থের কোনও তফাত বোধ হয় নেই। এবারে খবর দিইনি। ঠিকও করলাম হঠাৎ। খবর দেবার সময় ছিল না।
ট্যাক্সি থেমেছে কি না থেমেছে বড়দার ছেলে সৌম্য দৌড়ে এসে দরজাটা খুলে ধরল। চীনে চীনে মুখে ঠোঁটজোড়া হাসিতে সরলরেখা হয়ে গেছে। কি করে বুঝল কে জানে! পেছন পেছন ছোড়দা। হাত থেকে সুটকেসটা কেড়ে নিয়ে বললেন—‘কি রে আর কোনও মাল নেই তো?’
হেসে বললাম—‘আসল মাল রেখে এসেছি। হালকা হয়েই ট্রাভল করা ভালো।’
—‘গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস!’
সদর ঘরের জানলা দিয়ে দুই বউদির হাসি-হাসি মুখ উঁকি মারছে। মধ্যিখানে মুনিয়ার কোঁকড়াচুলে ভরা ছোট্ট মাথাটা। দেরিতে উদয় হয়ে মুনিয়াটা মা আর জেঠিমাকে অতিরিক্ত স্নেহের মাখনে সেঁটে স্যান্ডউইচ বানিয়ে রেখেছে। এইজন্যেই বোধ হয় আমি আনন্দ লেনের বাড়িতে ঘুরে ফিরে আসি। এই হাসি মুখ, উৎসুক চোখের আদর-চাউনি দেখতে, আমন্ত্রণের উদ্যত হাত ধরে এতগুলো মানুষের বুকের মাঝখানে অনায়াসে পৌঁছে যেতে। এইজন্যেই এখানে এলে মনে হয় পৃথিবীর এই এক জায়গায় আমার মতো হতভাগার জন্যেও ঠাঁই চিরকালের মতো কায়েম হয়ে আছে।
বড় বউদি চা নিয়ে এল। ছোট বউদি খাবার। বললাম—‘আমাকে মুখ হাত ধোবার অবসরও বোধ হয় তোমরা দেবে না। পিসিমার ভাষায় এই অ্যাড়াব্যাড়া কাপড়ে, ট্রেনের ছত্তিশ জাতের নোংরা মেখে…’
—‘খুব হয়েছে, তাড়াতাড়ি কর তো। লেকচার দিতে হবে না। লুচিগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
—‘বা বা বা! অ্যাদ্দিন পর এলুম আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চামড়া-চামড়া লুচি দিয়ে অভ্যর্থনা? নাঃ, কদন্নে পুণ্ডরীকাক্ষ করে ছাড়বে দেখছি!’
—‘তা কি করব? খবর না দিয়ে এলে আমাদের দোষ! তাও কদিন ধরে তোমার দাদার মনটা সুকু-সুকু করছিল বলেই না রোজ এ সময়টা খাবার-দাবার রাখি। নইলে হরিমটর। তা তোমার ট্রেন লেট করলে আমরা কি করব?’
বউদিদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এই রকমই। নিজের ভাইবোন নেই। এই জাঠতুতো দাদাদের সুখী পরিবারের জন্য কোনদিন বুঝতে পারিনি। জ্যাঠাইমার কোলে-পিঠে মানুষ। কোনদিন বুঝিওনি এঁরা আমার সহোদর নন।
ট্রেনের কাপড় ওরা ছাড়তে দিল না। শুধু মুখ হাত পা ধুয়ে আসবার ছুটিটুকু দিল। আমার মুখচোখ নাকি বলছে আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আসলে এক সময়ে দারুণ শরীর-চর্চা করতুম। তখন আমার শরীরের যত্ন, খাওয়া-দাওয়ার নানান খুঁটিনাটির হাঙ্গামা দুই বউদি পুইয়েছে। ওরা মনে করে এখনও আমি সেই হেভিওয়েট লিফটার সুকুমারই রয়ে গেছি যে গব্য দুগ্ধের বরাদ্দ ছাড়াও সয়াবীনের প্রোটিনের জন্য বউদিদের নিত্য জ্বালিয়েছে।
সবে লুচিতে বেগুনভাজা মুড়ে একটা কামড় দিয়েছি কি দিইনি, বড় বউদি দ্বিতীয়বার চা আনবার জন্যে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে, ছটকুন অর্থাৎ ছোটবউদি হঠাৎ চুপিচুপি গলায় বলল,—‘জানো সুকু, রঞ্জুটার না এমন বিশ্রী চেহারা হয়ে গেছে!’
এমন চমকে দিয়েছে যে জিভ কামড়ে ফেলেছি। ছটকুন অপ্রস্তুত। ঢোঁক গিলে বলল—‘খারাপ বলতে অসুখ-বিসুখ কিছু মনে কর না। বিশ্রী মোটা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বাচ্চাটা হবার পর থেকেই বেঢপ একেবারে। চুলগুলোও যে কি করে অমন পাতলা হয়ে গেল! সে রঞ্জু বলে চিনতে পারবে না, মাইরি বলছি।’
এই ছটকুনের একটা মস্ত দোষ। কথায় কথায় এই মাইরি বলা। ছোড়দা থাকলে ধমক দেন। আমার কিন্তু খুব মজার লাগে, মেয়েলি মুখে গুরুগম্ভীর চালে ওই মাইরি বলা। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লুম। ছটকুন কাঁচুমাচু মুখে বলল—‘রান্না রেডি হতে বেশ দেরি, রোববারের বেলা সুকু, আর দুখানা লুচি নিলে না? যাও, তবে, এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোওগে যাও!’
ঘুমোব। শুধু কদিন পর। কতদিনের নিঘুম রাত উশুল করা ঘুম। এখন ঘুম জানি না, জাগাও জানি না। পর্দা ফেলে দিয়ে এখন চুপচাপ বসে থাকবো। জানলার ধারে, বারান্দার দিকে মুখ করে। এই বারান্দার পাড়ে ইয়ো-ইয়োর মতো পাক খেতে খেতে কেটেছে আমার বাল্য। এই বারান্দা চিরে দুরন্ত কৌতূহলী পায়ে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে কৈশোর। এখন আমার পরিণত যৌবন এই বারান্দায় কুমীর-পিঠ পেতে কিছুক্ষণ ক্ষান্তির রোদ পোহাক। ছোট ছোট তীক্ষ্ণ চঞ্চু পাখিরা আসুক সব, মস্তিষ্কের ফাঁক-ফোঁকর থেকে টেনে বার করে ফেলে দিক স্মৃতির ভুক্তাবশেষ। যা পুষ্ট করেছে, লালিত করেছে, অতীতের সেই স্বাস্থ্যকর স্মৃতি গভীর সুখে পরিপাক করি। যা ভেতরে প্রবিষ্ট হতে চাইল না, সেই উঞ্ছ-উদ্বৃত্ত নিয়ে কি করব?
এই ঘরে ডন দিতুম। মুগুর, ভাঁজতুম। সে মুগুরগুলো সৌম্য ব্যবহার করলে অমন পলকা চেহারা হত না ছেলেটার। ওই টেবিলে লক্ষ করলে এখনও দেখতে পাওয়া যাবে জটিল অঙ্ক ভাবতে ভাবতে কত অন্যমনস্ক কাটাকুটি করেছি। পৈতৃক বাড়ির অংশ আমি নিইনি। দাদারা বদলে আমাকে টাকা দিয়েছেন। সেই নগদ টাকা দিয়ে নামী কোম্পানির নিরাপদ শেয়ার কিনে আমি আমাদের তিনজনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করেছি। কিন্তু আমার সাবেক ঘরটা বউদিরা সযত্নে গুছিয়ে রেখেছে। এটা এখনও ‘সুকুর ঘর’। এতো মায়া! বলে—‘ঘরটুকু না থাকলে তুই আর আসবি না সুকু।’ অন্য সময় সৌম্য থাকে বোধ হয়। ওর ডাক্তারির বই-টই টেবিলের ওপর দেখেছি। অ্যানাটমি, মেটিরিয়া মেডিকা। কিন্তু আমি এলে কেউ বিরক্ত করে না। নিজের সমস্ত বসবাসের চিহ্ন সৌম্য বেচারি নিঃশেষে তুলে নিয়ে যায়।
এ ঘরের গোপনীয়তা আমার নিজের সংসারেও কোথাও নেই। সেখানে মাধবীর সঙ্গে ভাগের কারবার। বারোয়ারি বৈঠক, অংশীদারীর শোবার ঘর। এমন নির্জন বারান্দা সেখানে নেই, নেই এমন পূর্ণকুম্ভ শূন্যতা। জানলার প্রত্যেকটা গরাদ এখানে নীরবে আমার সঙ্গে কথা বলে, ঘরের প্রত্যেকটি কোণে হারানো দিনের কণ্ঠ গমগম করে। সওয়াল জবাব চলতে থাকে মেঝের সঙ্গে, ছাদের সঙ্গে। স্বল্প আসবাবকটা আলাপচারিতে যোগ দেয়।
—‘কেন তুমি চলে গেলে?’
—‘নদীর স্রোত আর সময় তো চলেই যায়!’
—‘সময় যাক, তুমি কেন গেলে?’
—‘সময় দিয়েই যে তৈরি জীবন, সময় দিয়েই তৈরি শরীর।’
—‘কিন্তু তুমি তো গিয়েও পুরোপুরি যাওনি?’
—‘কেন? কেন? কেন, সুকু?’
কিন্তু ছটকুন আচমকা কি যেন একটা বলে গেল! রঞ্জু মোটা হয়ে গেছে? সেই কঞ্চির মতো ফিনফিনে রঞ্জু মোটা! ভাবতে পারছি না। স্থূলত্ব অনেকের অঙ্গে, অনেক প্রসঙ্গে সয়ে যায়, মীনামাসিমা এক সময় ডিগডিগে রোগা ছিলেন। কণ্ঠার হাড়ের গর্তে টেনিস বল ঢুকে যেত, এখন মীনামাসিমার ঘাড় নেই, কণ্ঠা নেই, বুক-পেট-পিঠ আলাদা করে চেনা যায় না। রঞ্জুর বেলা স্থূলত্ব সইবে না। স্থূলত্ব রঞ্জুর বেলা অশ্লীল। চুল নাকি পাতলা হয়ে গেছে! বাহান্ন বিঘের চওড়া কালো রাস্তাটা যুগল শিরিষের তলা দিয়ে যেখানে লাল কাঁকরের পায়ে চলা মেঠো পথটার সঙ্গে মিশেছে সেখানে অব্যবহৃত কুয়োর পরিত্যক্ত চাতালে ওই তো রঞ্জু প্রাণপণে স্কিপিং করে যাচ্ছে, যেমন ওকে প্রথমে দেখেছিলুম মোটা বেণীটা সপাং সপাং করে পিঠের ওপর চাবুক মারছে! লাল আকাশে কালো বিদ্যুৎ, নীলের কোলে কিশোরী বিজলি চমকে যাচ্ছে। তির্যক, নিটোল। আদিম, পৃথিবীর বুকে প্রথম বৃক্ষের জন্মের মতো বিস্ময়কর!
গতবারেও ছটকুন বলেছিল—‘জানো সুকু, রঞ্জুটা যে কি কালো, শ্রীহীন হয়ে গেছে, তুমি ধারণাই করতে পারবে না। তেমনি বুড়োটে। এখন দেখলে তোমার পিসিমা মনে হবে।’
আমার চোখের সামনে রঞ্জুকে কে থাবড়া থাবড়া কালি মাখিয়ে দিতে লাগল! এ যেন শুধু বাঁদুরে রঙের বীভৎস এক হোরিখেলা। রঞ্জুর দাঁতগুলো, তাই থাকে কেন? খসে পড়তে লাগল ঝরঝর করে, মাথা থেকে চুলগুলো কোন অদৃশ্য চুম্বকের টানে লোহার তারের মতো ছিটকে ছিটকে যেতে লাগল। আমার চারপাশে যেন রাক্ষসীর চুলের স্তূপ। রঞ্জু, কেশহীনা দন্তহীনা কদর্য রঞ্জু বেলুনের মতো ফুলতে লাগল। ফুলতে ফুলতে ফটাশ। মনে মনে বলতে চাইলুম—‘সুরঞ্জনা, সুরঞ্জনা, তুমি আজ মৃত।’ তারপরেই দেখলুম সমস্ত ঘরে বিদেহী রঞ্জুর শব্দহীন রূপদ্যুতিময় হাসি তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে। রঞ্জনার হাতের অশরীরী মুদ্রা বঙ্কিম বিভঙ্গে ঘরের কোণে কোণে মঙ্গলঘটের মতো স্থিত। যতই মারি সুরঞ্জনাকে আমি মেরে ফেলতে পারি না। ও আবার বেঁচে ওঠে। নতুন শক্তি নিয়ে নবোদগত যৌবন নিয়ে। ওর এই অনন্ত যৌবন নিয়ে বেঁচে ওঠা অহোরাত্র আমায় মারছে, আবার এই মৃত্যু না থাকলে আমি যে কেমন বাঁচা বাঁচতুম, তাও জানি না। সুরঞ্জনার স্মৃতিভারহীন সে কেমন লঘু, নিরর্থ জীবন?
হাতের কাজ সেরে দুপুরবেলায় দুই বউদি উলটুল নিয়ে আমার ঘরে এসে গুছিয়ে বসল। দাদাদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সৌম্য রবিবাসরীয় আড্ডায়। মহিলামহলে আমিই একমাত্র হংসমধ্যে বক। বউদিদের মতে অবশ্য নিছক মেয়েলি আড্ডা খুব ক্লান্তিকর। একজনও অন্তত পুরুষ থাকা চাই, নইলে ভারসাম্য থাকে না।
—‘কি সুকু, টোয়েন্টি-নাইন হবে?’
—‘খুকিদের খেলা ছেড়ে এবার একটু সাবালক হও বউদি।’
—‘এ জন্মে আর হল না রে।’
—‘শিখিয়ে দিচ্ছি ব্রিজ, তাস দাও।’
—‘শেখাতে চাইলেই শিখছে কে রে?’
—‘নাঃ বউদি, হোপলেস তোমরা। ইনকরিজিব্ল্। তিনজনে তবে আর গোলামচোর ছাড়া হবেটা কি?’
মুনিয়াটা অনেকক্ষণ জেঠিমার কোল ঘেঁষটে বসেছিল, নতুন গল্পের বই হাতের মুঠোয়, নতুন পুতুল কোলের ভেতর আঁকড়ে ধরে। খেলা দেখতে দেখতে চোখে ঘুমের ঢল নামল। ছটকুন বলল—‘আচ্ছা দিদিভাই, আমি বললে সুকুটা বিশ্বাস করতে চায় না, তুমিই বলো তো রঞ্জু কিরকম খিটখিটে খটখটে মতো হয়ে গেছে না আজকাল?’
বড় বউদি বলল—‘কিছু মনে করিসনি মিতু, মায়ের পেটের না হলেও হাজার হোক তোর বোনই তো, শ্যামলীর বিয়েতে দেখলুম যেন জয়ঢাক। তার ওপর সব সময় গলা বাড়িয়ে চেঁচাচ্ছে।’
আমি আস্তে বললুম—‘তোমরা থামবে?’
বড় বউদি বলল—‘থামব বইকি। মিতু কথাটা তুলল তাই। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই রে সুকু। কে যে পরে কি দাঁড়াবে সে গোড়ার রকমসকম দেখে খানিকটা বোঝা যায় বইকি। রাখ্ তো ওসব। তোদের খবরাখবর এখনও ভালো করে শোনাই হল না। এই মিতু, রাখ্ তো তাস। মাধবীকে কতদিন দেখিনি। পিক্লুর ছবি এবারেও আনিসনি তো!’
কেন যে ছটকুন এভাবে বারবার রঞ্জুর প্রসঙ্গ তোলে! প্রথম প্রথম তুলত না। বহু বহু দিন এ বাড়িতে রঞ্জ কবরস্থ ছিল। মাধবী এসেছে। পিকলু এসেছে। পুনের সংসার স্থায়ী হয়েছে। কোনদিন এ বাড়িতে মৃতের পুনরুত্থান হবে ভাবিনি। সে জীবিত ছিল একটিমাত্র মানুষের নিদ্রাহীন রাত্রির গূঢ়ৈষায়। বছর তিন আগে ছটকুন হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে এলোমেলো খানিকটা রঞ্জুর নিন্দে করে গেল। খুব নাকি গুমুরে হয়েছে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। আমি যতই লুকোতে চাই, এই সব করুণ হৃদয় মহিলা জেমস্ বন্ড কেমন করে নির্ভুল জেনে গেছে রঞ্জু আমার হর্ষ, রঞ্জু আমার বিষাদ, রঞ্জু আমার চোখের তারায়, রঞ্জু আমার হাতের পাতায়, নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে, এখনও, এখনও। ওরই জন্যে আমি অফিসের কাজের নাম করে একা একা উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসি। অবোধ বালক যেমন মায়ের পরিত্যক্ত শাড়ির মাতৃগন্ধে সান্ত্বনা পায়, কলকাতার হাওয়ায় তেমনি আমি সুরঞ্জনার দেহগন্ধ পাই। শুধু একবার দেখব। দেখা হয় না। বড় ভয় করে। রঞ্জু যে আমার ছিন্ন অঙ্গ, আমি অন্ধ। রঞ্জু আমার দৃষ্টিশক্তি হরণ করে হারিয়ে গেছে। হে ঈশ্বর, বিমূর্ত আলো দাও। আমি আর একবার রঞ্জুকে প্রত্যক্ষ করি। এতো বড় জীবনের পরিসরে আর কেউই যে আমার পরিপূর্ণ আপন হল না। বড় ভয়! রঞ্জু মোটা হয়ে গেছে। কণ্ঠে আর সুরবাহার বাজে না। তার চাইতে ও সেখানে থাক যেখানে আছে। ভেতরে এবং বাইরে। রঞ্জুর ছবি গোপন অ্যালবামের পাতায় সেঁটে বহনক্লান্ত, রাহুগ্রস্ত আমি আবার কি ফিরেই যাবো?
সন্ধের দিকে বেরোলুম। একটু ঝিরঝিরে মতো বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাগুলো অশ্রুময়। গাছের ডগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে। কর্নওয়ালিস স্ত্রীটের দুধারে পসরা। পলিথিনের ঢাকা সরিয়ে ফেলছে হকাররা। মানুষ হাঁটার জায়গা নেই। কম্বুলিটোলা দিয়ে বেরিয়ে শোভাবাজারের দিকে হাঁটা দিলুম। আবার মুখ ফিরিয়ে জোড়াবাগান। পার্কের পূর্বকোণে রায়চৌধুরীদের রঙিন কাচওয়ালা বারান্দায় ইলেকট্রিকের আলো পড়ে রঙ চলকাচ্ছে। কোথাও যাবো না। সর্বত্র যাবো।
লোডশেডিং হয়ে গেল। সমস্ত উত্তর কলকাতা নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে হারিয়ে গিয়ে অন্ধকারেই জেগে উঠল আবার। প্রত্যেকটি বাড়ির, পার্কের, রাস্তার, যানবাহনের প্রেত তাদের দ্বিতীয় অস্তিত্বের জানান দিয়ে আমার দ্বিতীয় অস্তিত্বকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল। —‘ভয় কি? বেরিয়ে আয়। কতকাল আর চোখ ধাঁধানো আলোর অন্ধকারে চাপা থাকবি?’ আমি খুব প্রাণবন্ত এক আত্মবিশ্বাসী, তরতাজা, টগবগে যুবককে আমার ভেতর থেকে সবেগে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথ ধরে দক্ষিণমুখো ছুটে যেতে দেখলুম। খুব ঝকমকে দাঁতে সে প্রাণখোলা হাসি হাসছিল। হাতে একটা ব্যাডমিন্টন র্যাকেট। চৌরঙ্গির অন্ধকার চিরে তন্বী আলোর রেখা জেগে উঠছে। এতো ক্ষীণ যে ভয় হয় হারিয়ে যাবে। রঞ্জনাকে পাশে নিয়ে আমার অতীত হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছে। চিবুক উঠছে, নামছে। বেলকুঁড়ি থেকে শব্দের সৌরভ।
তারপরেই সেই অতীত, যা এখনকার আমার থেকে বহুগুণে সত্য এবং জীবন্ত, একটা ডবলডেকার থেকে ভীষণ রুষ্ট মুখে রঞ্জনাকে হাত ধরে নামাল।
—‘লোকটা কি রকম বিশ্রীভাবে তোমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল, রঞ্জু, তুমি তো কিছু বললে না?’
—‘কই আমি তো বুঝতে পারিনি। অত ভিড়ের মধ্যে বোঝা যায় না কি?’
—‘বেশ বোঝা যায়। ভালোই বুঝতে পারছিলে।’
—‘মানে?’ রঞ্জনার চোখে আহত বিস্ময়।
আকাশের মেঘ মিলিয়ে এসেছে। মেঘ ফুঁড়ে রোদ্দুরের তীর। গোধূলির আকাশে হেলান দিয়ে সুরঞ্জনা গান গাইছে। গোধূলি-লগ্নে কার আগমনীর গান।
—‘রঞ্জু তোমার কলেজ গেটে কাল ওটা কে তোমার সঙ্গে কথা বলছিল?’
—মনে করার চেষ্টায় রঞ্জুর ভ্রূ কুঁচকে গেছে। —‘কে বলো তো?’
—‘ওই তো ঝাঁকড়াচুলো, মোটা ঝুলপিঅলা…
—‘ওঃ, ও তো রীমার দাদা। আমার স্কুলের বন্ধু রীমা, চেনো তো? ওর সেই ফটোগ্রাফার দাদা! লাইফ ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফি কম্পিটিশনে প্রাইজ পেলো!’
—‘কি চায়?’
—‘কিছু তো না! রীমাকে নিতে এসেছিল, কাকে যেন এয়ারপোর্টে সী-অফ করতে যাবে।’
—‘তোমার সঙ্গে অত কিসের কথা?’
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল—‘বা রে, রীমা আমার পুতুলখেলার বয়সের বন্ধু, এইটুকু বয়স থেকে ওদের বাড়ি যাচ্ছি। ওর দাদা আমার সঙ্গে দেখা হলে কথা বলবে না?’
নিঃশব্দে চা খেয়ে যাচ্ছি। সুরঞ্জনা আরও গান গাইছে। সন্ধ্যার আকাশ সুরে ভাসিয়ে। কিন্তু কানে আর মধু ঢালছে না। রসহীন, শুষ্ক, নিরর্থক গান সব।
যাবার সময় আড়ালে ডেকে বলে গেলুম—‘কলেজ গেটে কি আর কোথাও কোনও ঝুলপি-মোচঅলা ফন্দিবাজকে আমি যেন আর তোমার সঙ্গে কথা বলতে না দেখি। আর কাল থেকে তোমায় ট্যাকসিতে নিয়ে বেরোব।’
—‘ট্যাকসি কেন, সুকুদা? পালকি নয়? ওপরে দু পরত ঘেরাটোপ, দুপাশে দুই আসাসোঁটাধারী বরকন্দাজ। আর তুমি চলবে রাঙা ঘোড়ায় চড়ে টগবগিয়ে আমার পাশে পাশে…’
সারা শরীরে রঞ্জু নাচের ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
—‘রঞ্জু তোমার আঁচল ঠিক করো।’
—‘কি ঠিক করব? ঠিকই তো আছে।’
—‘উড়ছে, উড়ছে, এক্ষুণি উড়ে যাবে।’
—‘বাঃ, দমকা হাওয়ায় ওড়বার জন্যেই তো আঁচল। তখনই তো একমাত্তর নিজেকে পাখি পাখি লাগে।’
—‘হুঁ। আর রাস্তাসুদ্ধু লোক তোমার পাখি-ওড়ানো দেখুক।’
রঞ্জু হাসতে থাকে—‘সত্যি, পাখি দেখার চোখ যাদের আছে তারা ছাড়া আর কেউই পাখি দেখতে পায় না, জানো না? আলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে থাকলেও দেখে, অন্ধকারের আড়ালে থাকলেও দেখে। … আর তা ছাড়া এই ভর দুপুরবেলা এখানে দেখার লোক কই?’
—‘তুমি অত্যন্ত অশালীন হয়ে যাচ্ছো রঞ্জনা।
উল্টো দিক থেকে একটা নিম্নশ্রেণীর লোক মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে কিসের তাড়ায় কে জানে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। রঞ্জুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। আমি বাঘের মতো গিয়ে তাকে ধরলুম, তারপর ব্যায়াম-করা চওড়া হাতের পাঞ্জায় একটা ঘুঁষির বোমা ফাটালুম তার রগে—‘উল্লুক, বেতমিজ, বেয়াদব।’ লোকটা অবাক হয়ে এক পলক তাকিয়ে পাল্টা গালাগাল আরম্ভ করল। তখন লাগালুম কষে চড়, থাপ্পড়, লাথি। লোক জমে গেল। ভদ্রমহিলার শ্লীলতাহানির চেষ্টার দায়ে অবশেষে তাকে এক বাইকধারী সার্জেন্টের হাতে সমর্পণ করে গনগনে মুখে বিবর্ণ রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললুম—‘এখনই দেখছ কি? তোমাকে আমি ঘরে বন্ধ করে রাখব। ছাদের দরজায় তালা লাগাব। জানলায় লোহার জালি।’ প্রচণ্ড রাগের মাথায় খেয়াল করিনি রঞ্জুর মুখে জোঁক লাগছে, কণ্ঠনালীতে দাঁত বসিয়েছে রক্তচোষা বাদুড়।
পরদিন ওকে নির্দিষ্ট জায়গায় পাইনি। পরদিনও না। তারপর সোজা ওর বাড়ি। ছটকুনের মেসোমশাই বললেন—‘সে কি সুকুমার, রঞ্জু যে ওর বন্ধুদের সঙ্গে রাজগীরে এক্সকারশনে গেল। তোমায় বলে যায়নি? ওখান থেকে বেনারস যাবে, চুনার যাবে, লম্বা প্রোগ্রাম যে ওদের এবার!’
পিঞ্জরাবদ্ধ বাঘের মতো ছটফট করছি ক্রোধে। বেনারস থেকে ছোট্ট চিঠি। সম্বোধন নেই। সই নেই।
“এতদিনের সম্পর্ক ভাঙতে কি হয়, যে ভাঙে সেই জানে। ছেড়ে দাও আমায়। নিজেও শেষ হবে, আমাকেও শেষ করবে। কোনও কিছুর খাতিরেই আমি সন্দেহভাজন আসামীনী হয়ে অমূল্য জীবন লোহার গারদে আটক কাটাতে পারব না।”
বহু ক্ষমাভিক্ষা, অনুনয়-বিনয়, প্রতিশ্রুতি। টলাতে পারলুম কই? আর একবারও সে দেখাই করল না। আত্মীয়স্বজন কারো মতামত গ্রাহ্য করেনি। কারণ বলেনি কাউকে। কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নয়। খালি বলেছে ব্যথার গলায় ‘ভালো লাগছে না, ভালো লাগছে না।’ ছোট বউদি আজও জানে না ঠিক কি ধরনের মনান্তরের ফলে আমাদের সম্পর্ক ছিঁড়ে গেল। আমার প্রতি মমতায়, বোনের প্রতি বিতৃষ্ণায় কত কিই যে বলে যায় বেচারি ছটকুন। বোধ হয় ভাবে ওর বিরুদ্ধে আমার মনটাকে তেতো করে দিতে পারলে সেই তিক্ততায় আমার এ বিষক্ষত সেরে যাবে। সবই বুঝি। শুধু বুঝি না কতটা সত্যি কতটা মিথ্যা এই সব রটনা।
কতগুলো দীঘল বছর কেটে গেছে। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মাঝরাত তো নয় যেন মাঝগাঙ। হাবুডুবু খেতে খেতে জেগে উঠি। রঞ্জু! রঞ্জু! ডুবন্ত মানুষের আর্ত চিৎকার কেউ শোনে না, ডুবন্ত মানুষের উদ্যত হাত ধরে টেনে কেউ ডাঙায় তোলে না। মাঝ নদীতে ভরাডুবি। অপঘাত। বকুল ঝরছে। তারা খসছে। উল্কাপিণ্ড ফেটে গেল। রঙের ফানুস পুড়ে যায়। রজনী তামসী। দেবী পশ্চিমাস্যা। অমাবস্যার কালো আকাশে কালো বরফের চাদরের মতো সুরঞ্জনা বিছিয়ে আছে।
শ্রীহীনা, রুক্ষভাষিণী, স্থূলাঙ্গিনী রঞ্জুকে একবার দেখতে পেলেই কি মহাকালের ধ্যানভঙ্গ হবে? এ ধ্যান কি রূপের ধ্যান? অপঘাত ঠেলে ফিরতে পারব ডাঙায়? ফিরতে পারব ভাঁটির প্রবল টান এড়িয়ে জীবনের কাছে?
শ্যামবাজারের মোড় থেকে শহরতলির বাস নিলুম। অভিজ্ঞ দুপুর এখন শান্তিপর্বের শরশয্যায়। তাকে ঘিরে সমস্ত প্রশ্ন চুপ। পশ্চিম দিগন্তে শেষকৃত্যের মহাপ্রস্তুতি আরম্ভ হচ্ছে। দক্ষিণ শহরতলির সুদূরতম প্রান্তে যখন পৌঁছলুম কামনারঙের শিখাগুলি তখন ভষ্ম উদ্গার করছে। লাল মাটির রাস্তায় আবীরের মতো ছড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী। ঝিরিঝিরি পাতার কাঁপনের মধ্যে দিয়ে অস্থির দিঘির মতো চাপ চাপ আকাশ। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি বাগানঘেরা ছোট্ট বাড়িটা। আটলান্টিকের মাঝ-মধ্যিখানে যেন নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে একলা জাহাজ। এখুনি ভোঁ বেজে উঠবে, বোগেনভিলিয়ার বেগুনি মাস্তুল উঁচিয়ে পালতোলা মাটির জাহাজ চলতে আরম্ভ করবে। শুনেছি ওই বাড়ির দোতলাটা পুরোই স্টুডিও। রঞ্জুর স্বামী শিল্পী। উত্তর দিকের দেওয়ালে কাচের ওপর অস্তরাগ প্রতিফলিত হয়ে আকাশের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আমি কি ওঁর সামনে গিয়ে এমনি উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়াব? দাঁড়াব সিকন্দরের সামনে শৃঙ্খলিত পুরুর মতো মাথা উঁচু করে? ভিক্ষুকের মতো দাঁড়াব গিয়ে কাঙাল চোখে? শিল্পীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। উনি কি বুঝতে পারবেন আমি কে? উনি আমাকে কিভাবে নেবেন? আমিই বা ওঁকে, আমার ওই মেঘলোকবাসী প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোনদিনই যাঁকে সম্মুখ সমরে চূড়ান্ত দ্বৈরথে পেলুম না, তাঁকে কিভাবে নেবো? ভাবতে ভাবতে বাগানের গেটে হাত বেধে গেল। খুলতে গিয়েও খুলতে পারলুম না। দূরদূরান্ত শব্দে কাঁপিয়ে ট্রেন চলে গেল। পেছু ফিরে দাঁড়ালুম এসে এক জোড়া অশ্বত্থের তলায়। কোলের কাছে মাতৃগর্ভের মতো কোমল অন্ধকার। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলুম সেখানে। যেন আমি জন্মের জন্য অনন্তকাল প্রতীক্ষারত অজাত ভ্রূণ।
গোধূলি গিয়ে সাঁঝ। সাঁঝ পেরিয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। শহরতলি কাঁপিয়ে ঝিঁঝির তানকর্তব শুরু হয়ে গেল। মুক্তাঙ্গনে লক্ষ নর্তকীর নূপুরশিঞ্জিনী। বেগবান হাওয়ার সমৰ্থ সঙ্গত। ঘড়ি দেখতে ভুলে গেছি। আকাশে চাঁদ নেই। শুধু তারার আলোয় জেগে আছে অলৌকিক জাহাজ বাড়ি, তারার আলোয় দাঁড়িয়ে আছে ত্রিকাল-সাক্ষী অশত্থ। কতক্ষণ পর জানি না, কাঁকর-ভাঙার মৃদু আওয়াজে চমক ভেঙে গেল। তারার জ্যোৎস্নায় দেখলুম—কি আশ্চর্য! কি পরমাশ্চর্য! সুরঞ্জনা আসছে! ছটকুন কি যেন বলেছিল? বড় বউদি কি যেন দেখেছিল? সুরঞ্জনা তো অবিকল তেমনি আছে! মাথার ওপর কালপুরুষ, পায়ের তলায় দিবারাত্রির গতিভঙ্গে ঘূর্ণিত হচ্ছে পৃথিবী, আলোকলতার আকর্ষের মতো বাহু দুলছে, ফুলন্ত ডালের মতো বঙ্কিম ঠামের বাঙ্ময় চলনভঙ্গি, সর্পিল বেণী সেই বহু বছর আগেকার কুমারী নদীর ভঙ্গিতে গ্রীবার পাশ দিয়ে পথ কেটে বুকের কমনীয় অববাহিকায় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখলুম উনিশ বছরের তরুণী সুরঞ্জনা অর্বুদার্বুদ আলোকবর্ষ দূরের কোন ছায়াপথ থেকে ম্যারাথন যাত্রা করে অর্বুদার্বুদ আলোকবর্ষ দূরের কোন জ্যোতির্লোকের দিকে অন্তহীন চলেছে। ত্বরাহীন। আত্মমগ্ন। প্রেক্ষাপটের প্রান্তে আমাকে ও দেখতে পাচ্ছে না। আমি যে স্থাবর। আর এই মহাস্থবির ও ওই চিরপ্রচলার মাঝখানে শুধু আপূৰ্যমাণ, অচলপ্রতিষ্ঠ মহাশূন্য, মহাকাল।