বিবাহ-বিভ্রাট
‘জোতে শালার কারবার শুনেচিস তপ্না?’
—‘বেইজ্জত করে ছেড়ে দিলে মাইরি!’
—‘শুধু বেইজ্জত? কেলো! কেলো!’
—‘দু-দুবার হড়কে কোনমতে তো একটা এম এস করেচিস। তা মনে করেচিস কি নিজেকে?’
—‘করাচ্চি মনে। এর পর ক্লাবে এলে অ্যায়সা ঝাড় দেব না…’
আমাকে মাঝখানে এক চিলতে নেটের মত সাক্ষীগোপাল খাড়া রেখে শৈল-গোরা দুই বন্ধু দুদিক থেকে উপরি-উক্ত কায়দায় পিংপং পারাপারি করে গেল। দুজনেই মারকুটে, দুজনেরই হাতে বাছা বাছা শট। ঝাড় দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে শৈলটা একটা পয়েন্ট স্কোর করল মনে হল। আপাতত বিরতি। বললুম—‘কেসটা কি রে?’ টানা আড়াই বছর বেকার-বৃত্তির পর মাত্র মাস ছয় হল দুর্গাপুর স্টীলে কাজ পেয়েছি। প্রোবেশন চলছে। ছুটি-ছাটার তাই সুবিধে নেই। কিন্তু দিন তিনেকের সীজ-ওয়ার্কের সুযোগে প্রথম ট্রেনেই ক্লাবে হাজরে দিয়েছি। মাত্র ক’মাসের মধ্যে এমন কি ফাটাফাটি ব্যাপার হল যে এরা সব্বাই জ্যোতির ওপর এতো খাপ্পা।
শৈলই মুখভঙ্গি করে বলল—‘ঢাক্তারি ফাস করে উনি ফ্র্যাকটিস শুরু করেছেন।’
—‘সে তো ভালো কথা। তা আমাদের থেকেও ফি-টি নিচ্ছে নাকি রে?’ এটা এদের উষ্মার একটা সঙ্গত কারণ হতে পারে বটে।
—‘হুঁঃ! কার কড়ি কে ধারে? ওসব ফিস-ফাস নয়। উনি মেয়ে দেখা ফ্র্যাকটিস শুরু করেছেন।’
শেষের কথাগুলো শৈলর দাঁতের ফাঁক দিয়ে চিবোনো ডাঁটার মতো ছিবড়ে হয়ে বেরুলো। সেরেছে! জোতেটা শেষ পর্যন্ত নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ল। ছি! ছি! জোতের এমন ন্যক্কারজনক পরিণতি হতে পারে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। সম্পর্ক কি আজকের? ছেলেবেলাকার বন্ধু। শুধু এক পাড়ার নয়, এক স্কুলের, এক ক্লাসের। দুজনে দুজনের হয়ে লড়ে যাচ্ছি সেই মার্বেল-ডাংগুলির বয়স থেকে। হায়ার সেকেন্ডারির পর থেকে দুজনের পথ দুদিকে হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু পয়লা নম্বরের দোস্ত্ বলতে এখনও আমার জোতে, জোতের আমি। সেই জোতে উন্মার্গগামী হয়ে গেল ভেবে খুবই মুষড়ে পড়েছি। বিমান মাঝে পড়ে প্রাঞ্জল করে দিল ব্যাপারটা।
—‘জ্যোতিবাবু বিয়ে করবেন। গড়ে দশখানা করে কমসে কম মেয়ে দেখে যাচ্ছেন ফি মাসে। তা হলে পাঁচ মাসে কটা হয় হিসেব কর। পাঁচ দশে পঞ্চাশ প্লাস ফাউ। তিন দিনে একখানা করে রেট। স্পীড শিগগির বাড়বে মনে হচ্ছে। দুখানা বাংলা কাগজে “পাত্রী চাই” অলরেডি আউট।’
শৈল মন্তব্য করল—‘তবে আর কি? শালার পোয়াবারো। মাগ্গি-গণ্ডার বাজারে টিফিনটা রোজ মেয়ের বাপের ঘাড় দিয়েই উঠে আসবে। চেম্বার তো এখনও গড়ের মাঠ। কারবার জানি না আমরা?’
গোরা বলল—‘ওঠাচ্ছি ওর টিফিনের খরচা। আমাদের ও চেনেনি এখনও। ডাউরি-সিসটেম উঠে গেল, মেয়েরা বাপের সম্পত্তির শেয়ার পাচ্ছে; লিগ্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যানসি অ্যাক্ট পাস হয়ে গেল, এখনও শালা খোঁপা খুলিয়ে, পায়ের গোছ দেখে, রসগোল্লা-পানতোয়া-শিঙারা-কচুরির ছেরাদ্দ করে বিয়ে করবে? প্রগতি সঙ্ঘের মেম্বার হয়ে? মামদোবাজি! আজ থেকে তিন দিনের মধ্যে যদি গলির মোড়ে রাতের অন্ধকারে কে বা কাহারা ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে না যায় তো আমার নামে তোরা কুকুর বেড়াল যা ইচ্ছে পুষিস!’
জিগগেস করলুম—‘মনস্থির করতে পারছে না, না কি?’
—‘মন ওর আছে, যে তার স্থির-অস্থির?’ শৈল বলল-‘একেবারে হার্টলেস চশমখোর। অ্যাদ্দিন মিশছি টের পাইনি। এইবারে খড় বেরিয়েছে।’
বিমান বলল—‘বিবির বাগানের হরিহর উকিলের সেজ মেয়েকে দেখেছিস তো তপ্না? সুন্দরী না হোক, গ্ল্যামারস, অস্বীকার করতে পারিস? জোতে দেখে এসে কি বলে জানিস? সব ভালো, নাক ছোট। কতো বড় নাক নিবি রে শালা? বৌ-এর নাক ধুয়ে কি জল খাবি? নাকি কেটে নিয়ে নিজের খ্যাঁদা নাকে সেলো দিয়ে জুড়বি?’
শৈল বলল—‘আরও আছে। আরও আছে। মুখ ভালো তো রঙ কালো, রঙ চলে তো মুখ চলে না। হাড়-জিরজিরে, চোখ কুতকুতে, ঘাড়ে-গর্দানে, ভুঁড়িদাস, শিড়িঙ্গে, হিড়িম্বা, হোঁৎকা, চ্যাপ্টা, মোটকা, বাঁটকুল…’
—‘জোতের নিজের চেহারাখানার কথা চিন্তা করে পার্সপেকটিভটা ঠিক করে নিস তপ্না,’ গোরা হেঁকে উঠল, ‘এ ব্যাপারে চামচাগিরি করতে এলে তুইও ইম্মিজিয়েটলি আউট।’
বিমান সখেদে বলল—‘কিছুতেই আর নাক-চোখ-মুখের সাইজ ঠিক হয় না শালার। মেজারিং টেপ পকেটে নিয়ে ঘুরছে। গত হপ্তায় একটা মেয়ে দেখে এসে বললে, এখানেই লাগিয়ে দিতুম, কিন্তু চুলের কালারটা কেমন ম্যাড়মেড়ে, অ্যাকিউট ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি। শিগগিরই পেকে যাবে। বল, এর জবাব আছে! পাকেনি, পাকবে, এর পরে বলবে মোটায়নি মোটাবে। শিঁটোয়নি শিঁটোবে, বুড়োয়নি বুড়োবে।’
গোরা বলল—‘আরে বাবা অপ্সরী বিদ্যেধরী মেয়ে এতো লোক থাকতে তোর মতো হামবড়া বোম্বেটেকে কেন মালা দিতে যাবে সে কথা একবারও ভেবে দেখেছিস?’
আমার এই পাড়াতুত বন্ধুদের কিঞ্চিৎ ‘স’-এর গোলযোগ আছে। উপরন্তু ল্যাজা-মুড়োয় শালা ছাড়া কেউ কথা বলতে পারে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমাদের এ এলাকার শান্তি-সংস্কৃতি রক্ষায় এদের এই প্রগতি সঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে নিছক কথার কথা নয় তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। চাঁদা নিয়ে গেরস্থকে জোর-জুলুম, শেতলা-রক্ষাকালী মা-মনসার নাম করে লাউডস্পীকারের হামলা, যখন-তখন বোমবাজিতে পিলে চমকানো—এইসব পাড়ার-ছেলেসুলভ ক্রিয়াকলাপ প্রগতি সঙ্ঘের প্রোগ্রাম বহির্ভূত। আমাদের রাস্তা বারো মাস ছিমছাম, পরিষ্কার, মিউনিসিপ্যালিটির জমাদার চলে যাবার পর দফায় দফায় রাস্তায় জঞ্জাল ফেলা নিষিদ্ধ। বর্ষায় জলকাদা জমে না, মেয়েদের ‘আওয়াজ’ দেওয়া, বয়স্কদের অসম্মান করা, পরিত্যক্ত কবরখানায় মদের ভাঁটি, পলিটিক্যাল পার্টির পেটোয়া গুণ্ডাদের নাশকতামূলক কার্যকলাপ—সব বন্ধ হয়েছে এই প্রগতি সঙ্ঘেরই উদ্যোগে। বিপদে-আপদে সঙ্ঘ হামেহাল হাজির। রাজদ্বারে শ্মশানে চ দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে একেবারে আক্ষরিক অর্থে। ইঁটখোলার জনার্দন ঢ্যাং প্রতিবেশীর দক্ষিণ চেপে তেতলা তুলছিল, পিলার ঢালাই শুদ্ধু সারা। প্রগতি সঙ্ঘ কোর্ট ইনজাংশন বার করে আনল। ইনকাম ট্যাক্সের ঘোষদা, জনান্তিকে ঘুষদা, বাড়ির উঠোনে কি সব বিদঘুটে কেমিক্যাল তৈরি করতে আরম্ভ করে, কিছুতেই কারো কথা শুনবে না, এদিকে বিষাক্ত গ্যাসে লোকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রগতি সঙ্ঘের দরবারে কুটিরশিল্প দপ্তরের নির্দেশনামা নিয়ে পুলিশ এসে দু মিনিটে কারখানার বারোটা বাজিয়ে দিল। এই তো সেদিন সুশান্তদার দু বছরের পুঁচকে মেয়েটা স্রেফ প্রগতি সঙ্ঘের তৎপরতার জন্যেই বেঁচে গেল। দোতলার বারান্দার গ্রিল বেয়ে বেয়ে কেমন করে উঠেছিল, ধুপ করে পড়ে যায়, গোরা-মুরারির চোখের সামনে। তক্ষুনি দুজনে ট্যাকসি ধরে তাকে নিয়ে ছুট। মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সি ইউনিটে তার চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে, তখন সুশান্ত-বৌদি ফোনে খবর পেয়ে বারান্দায় ছুটে এসে কান্না জুড়ে দেন।
কাজেই জ্যোতির এ ব্যবহারে প্রগতি সঙ্ঘের কার্যনির্বাহক সমিতির সভ্যরা অর্থাৎ বিমান-শৈল-গোরা-মুরারি ক্রুদ্ধ হতে পারে বইকি। সে অধিকার এদের আছে। অতএব জরুরি অবস্থামূলক শীর্ষ সম্মেলন করে স্থির হল জোতেকে আর একটি মাস চান্স দেওয়া হবে, তার মধ্যে ও এসপার-ওসপার কিছু একটা করুক। আলটিমেটাম শুদ্ধু সমনটা আমাকেই ধরাতে যেতে হবে। অন্যথায় গণ আদালতে জোতের গণ বিচার। গর্দান গেলেও যেতে পারে।
এমার্জেন্সি। সুতরাং সেইদিনই সন্ধেবেলায় জ্যোতিকে পাকড়াও করা গেল। শূন্য চেম্বারে বসে খুব গম্ভীর মুখে নাকে চশমা এঁটে জ্যোতি একখানা মেডিক্যাল জার্নাল পড়ছিল। আরও এক ঝাঁক জার্নাল টেবিলের পাশে গাদা করা। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পড়ার ভান করার পর বলল,—‘কবে এলি?’
—‘এই তো সকালে। তোর কি খবর? রুগীপত্তর কেমন হচ্ছে?’
—‘ওসব আস্তে আস্তে হয়। একদিনে ছপ্পর ফুঁড়ে রোগী পড়ে না। ওয়েট করতে হয়।’
বাপ্ রে। ফোর ফর্টি ভোল্ট। বোম হয়ে আছে। প্র্যাকটিস জমছে না। মেজাজ খারাপ। তায় আবার আমি ভগ্নদূত। কপালে যে আজ কি আছে! যাক, যা হবার তাড়াতাড়ি হতে দেওয়াই ভালো। বললুম—‘তুই নাকি… বিয়ে…টিয়ে… করবি-টরবি? মেয়ে-টেয়ে… দেখছিস-টেখছিস…!’
জ্যোতি এক হাতে কলম আর এক হাতে জার্নাল নিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। ঝড়ের আগের অবস্থা। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল—‘দ্যাখ তপন, এখানেও একটা ফুল-ফ্লেজেড এস্পিয়নেজ সিসটেম কাজ করে যাচ্ছে। মগজের মধ্যে বিলট-ইন ওয়্যারলেসও বলতে পারিস,’ নিজের মাথায় টোকা মারল জ্যোতি, ‘তোর প্রগতি সঙ্ঘের এগজিকিউটিভ কমিটিকে বলে দিস একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইনটারফিয়ায় করাটা অরিজিন্যাল স্ট্যাটুটে ছিল না।’
আমি বললুম—‘না… মানে… কোন্টা ব্যক্তিগত কোন্টা নয়… আসলে ওদের ফিলিংটা… মানে ওরা ভাবছে…’
—‘চেষ্টা করিসনি। চেপে যা তপ্না। তবে কথা বলতে না পারিস মগজটা তো একটু-আধটু খেলাতে পারতিস এককালে! এখন কি একেবারে ধোলাই করিয়েই ঢুকেছিস?’
—‘না… মানে…
—‘মানে-ফানে নয়। বিয়েটা কার? তোর না বিমানের না শৈলর না গোরার? ছাঁদনাতলায় তোরা কে দাঁড়াচ্ছিস? খুলে বল, যে দাঁড়াবি তার ফরমাসমাফিক এগোবো। তবে হ্যাঁ, বিয়েটা যদি আমার হয় সেটা আমাকেই করতে দে। প্রমিস করছি বরযাত্রীর নেমন্তন্ন পাবি। পেয়ে যাবি।’
আমি শান্তির জল ছিটোতে থাকি—‘এই জ্যোতি, যা যা তুই শুধুমুধু রেগে যাচ্ছিস। আচ্ছা, তোর পয়েন্টগুলোও তো একটু খোলসা করে এক্সপ্লেন করতে পারিস। জানতে পারলে আমার সুবিধে হত।’
জ্যোতি বলল—‘তা তুই জানতে চাইতে পারিস তপনা। সে এক্তেয়ার তোর আছে। বলি জেলা-ইস্কুলে বরাবর ফার্স্ট হয়ে গেছে কে? আমি না তুই?’
—‘তুই।’
—‘দস্তুরমতো ভায়া কমপিটিশন, ভায়া প্রপার চ্যানেল মাটিয়া কলেজে ঢুকেছি। নো বাবা-মামা-কাকা বিজনেস! সত্যি কি না?’
—‘ওহ শিওর, শিওর।’
—‘নাইনটি পার্সেন্ট বাঙালীর মতো জিয়ার্ডিয়া আর অ্যামিবিক ডিসেন্টরিতে ভুগি না। ফার্স্ট ক্লাস ফুটবলে খেলেছি। ইদানীং জ্যোতিশংকর ডাট ছেড়ে দেবার পর তোদের ক্লাব ফার্স্ট ক্লাস সকার থেকে অর্ধচন্দ্র খেয়েছে? এ শর্মাকে রিপ্লেস করতে পারিসনি। ঠিক কিনা?’
—‘ঠিক।’
—‘বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা-চরস-পান-জর্দা-বিয়ার-হুইস্কি চলে না। অর্থাৎ ট্যাঁকের পয়সা চট করে ফুঁকে দিচ্ছি না। ক্যানসারের চান্স মোটে ফর্টি-ফাইভ পার্সেন্ট।’
—‘এটা জানি না ভাই।’
—‘আচ্ছা, যা জানিস না তেমন আরও কটা বলছি। শুনে যা। ডাউরি-সিসটেম ওঠেনি, পুরোদস্তুর চালু। যে কোনও বিয়ের দলিলে বিটুইন দা লাইনস অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখা থাকে। আমি, ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, এক নয়া পয়সাও নিচ্ছি না। ফ্রীজ, টিভি, সোনার বিস্কুট এ বিয়েতে ট্যাবু।’
—‘বাঃ বাঃ’, আমি প্রশংসায় বিগলিত।
—‘আরও শোন। যে যতই যাই বলুক মেয়েরা শ্বশুর-শাশুড়ি- জা-ননদ- দেওর-ভাসুর পছন্দ করে না, কেমন তো?’
—‘তা যা বলেছিস।’
—‘আমি ঝাড়া হাত পা। আছেন খালি এক পিসীমা। তা তিনি হলেন গিয়ে সেই গরু যে খাবে কম, দুধ দেবে বেশি… ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের জপতপ, নিরামিষ হেঁশেল নিয়ে আছেন। তবে?’
—‘তবে কি?’
—‘তবে আমি একটা মনের মতো বিয়ে করতে পারব না কেন? বুঝিয়ে দে। শিক্ষিত, খুব উচ্চশিক্ষিত নয়, স্মার্ট, ওভারস্মার্ট নয়, সুশ্রী। প্রকৃত সুন্দরী-টুন্দরী দরকার নেই। সপ্রতিভ অথচ নাক উঁচু নয় এমন একটি সহধর্মিণী যিনি আমার পাশে বেশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন। খুব বেশি চাইছি?’
—‘মোটেই না’, আমি উৎসাহ দিয়ে বলি, ‘তা পাচ্ছিস না?’
—‘না। উদাহরণ দিই শোন। তোর ওই শৈল গোরা যাই বলুক না কেন। বালিগঞ্জে মেয়ে দেখতে গেছি। বেশ হাসি-খুশি, মিষ্টি-মিষ্টি, চটপটে, তোদের মতো মিটমিটে ফন্দিবাজদের হ্যান্ডল করতে পারবে মনে হচ্ছে। মডার্ন বাড়ি। অভিভাবকরা কথা বলবার সুযোগ দিয়ে আড়ালে আবডালে অপেক্ষা করছেন। জিগগেস করলুম—‘আপনার হবি কি?’ একগাল হেসে বললে, ‘মার্কেটিং। মার্কেটিং করতে না আমার ভী-ষণ ভালো লাগে।’ বোঝ তপনা। এ হবির ফুল ইমপ্লিকেশনটা ভালো করে বোঝ। বিষম খেয়ে জল চাইলুম। স্ট্রীট-সিঙ্গারদের হারমোনিয়মের মতো প্যাঁ পোঁ করে বললে—‘ব্যা-রা, সাবকো বাস্তে পানি লাও।’ মনশ্চক্ষে দ্যাখ তপন, সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে, হাজারটা রোগ আর রোগী ঘেঁটে কেটেকুটে বাড়ি ফিরে জল চাইছি, আর গিন্নি সেজেগুজে মার্কেটিং সেরে মানে পয়সাগুলো স্রেফ ফুঁকে দিয়ে ফিলিম ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে মেমসায়েবি কেতায় হেঁকে বলছে—‘ব্যা-রা পানি লাও।’ লাইফ যে হেল হয়ে যাবে রে!’
আমি বললুম—‘বেশ, এ তো গেল একটা। আরগুলো? শুনলুম ডজন ডজন মেয়ে দেখেছিস?’
—‘হুঁ। শৈলরা তোকে বেশ বায়াস্ড্ করেই বাজারে ছেড়েছে দেখছি। তোকে জিগগেস করি তপন, তুই খোনা মেয়ে বিয়ে করবি? করতে চাস তো বল। আমার হাতে অপূর্ব রূপসী মেয়ে আছে, এক্ষুনি লাগিয়ে দিচ্ছি।’
—‘কি রকম? কি রকম?—জ্যোতির প্রত্যাখ্যাত সুন্দরী পাত্রী রিবাউন্ড করে আমার দিকে আসার সম্ভাবনায় আমি আগ্রহী হয়ে পড়ি।’
—“এ মেয়ে বউবাজারের। দুধে আলতা রঙ। গ্র্যাজুয়েট। পায়ের পাতাগুলো অবিকল পদ্মফুলের পাপড়ির মতো, বাড়িয়ে বলছি না তপনা। চোখদুটো লিটর্যালি স্যানসক্রিট কাব্য স্টাইল—জোড়া ভোমরা বসে আছে। নাম জিগগেস করলুম, বললে মিনতি মান্না। তখনও বুঝতে পারিনি। ম, ন সবই অনুনাসিক বর্ণ তো? —‘কোন্ কলেজে পড়েছেন?’ —‘মণীন্দ্র নন্দী।’ আবার ম, ন। গান শুনতে চাইলুম। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিগ্রি পাওয়া মেয়ে। গান শুনতে চাওয়া কি আমার অন্যায় হয়েছে বল? গাইয়ে মেয়ের কাছে তো লোকে এমনি এমনিও শুনতে চাইতে পারে। তখনই শুরু হল। নাসিকা বাদ্য বা নাক সানাই যা বলিস। যাঁও যাঁও যাঁও গোঁ এঁবাঁর যাঁবাঁর আঁগে রাঁঙিয়ে দিঁয়ে যাঁও। ওরে বাপ রে বাপ। তখন আমি যাওয়া ছেড়ে লেজ তুলে দৌড় লাগাতে পারলে বাঁচি।”
জ্যোতির প্রস্তাব পরদিনই ওর একটা মেয়ে দেখতে যাবার কথা। আমি যেন ওর সঙ্গে যাই। ওরও দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকলে সুবিধে হয়, আমিও ওর বিরুদ্ধে চার্জ শীট তৈরি হয়ে যাবার আগে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসতে পারি।
অতঃপর স্থান—উত্তর কলকাতা। কাল—সকাল সাড়ে নয়। পাত্র—জ্যোতিশংকর ডাট এম বি এম এস এবং অধম।
দেউড়িওলা পুরনো স্টাইলের বাড়ি। জ্যোতি চুপিচুপি বলল—‘এদিকের বিখ্যাত মিত্তির বাড়ি রে! প্রথমত মিত্তির কুটিল অতি। দ্বিতীয়ত বুর্জোয়া ফ্যামিলি। বুর্জোয়া ব্যাকগ্রাউন্ড আমার পছন্দ নয়।’ মনে মনে বললুম মরেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডই পছন্দ নয় তো এলে কেন বাবা।
ধবধবে ধুতি মেরজাই পরা ফর্সা ফর্সা গোলগাল মাঝবয়সী ভদ্রলোক আমাদের এগিয়ে নিতে এলেন। ট্যাকসি থেকে নামালেন প্রায় জামাই খাতিরে। লম্বা দালান। দুদিকে পালিশ-করা কাঠের দরজা। মোটা মোটা পেতলের ডাণ্ডা থেকে ভারি ভারি পর্দা ঝুলছে। দালানের শেষ প্রান্তে একটা গোল চত্বর। দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। কারুকার্যকরা সেকেলে কাঠের চেয়ার, পুরু গদী দেওয়া, মোরাদাবাদী পেতলের টপওয়ালা এক জমজমাট টেবিল। এইখানেই আমরা উপবিষ্ট হলুম। আমি বসেছি হাত-পা গুটিয়ে মাছ কুটুনির পাশে মেনি বেড়াল মেনি বেড়াল ভঙ্গিতে। জ্যোতি বসেছে সোজা, বুক চিতিয়ে, স্মার্টলি। ওর এখন এসব জল ভাত। অবশ্য পাঁচ দশে পঞ্চাশ প্লাস একের স্ট্যাটিসটিকসটা যদি সত্যি হয়। বসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির দাসী ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এলো। ফুলকো ফুলকো সাদা-সাদা কচুরি, আলুর দম, মাংসের ঘুগনি, ক্ষীর… সর্বনাশ। এরা কি পাকা-দেখার খাওয়াটা আজকেই খাইয়ে দিচ্ছে।
জ্যোতি গম্ভীর মুখে বললে—‘আমাদের তো এসব চলবে না।’
বড় মিত্তির বললেন—‘সে কি বাবা, ইয়াং ম্যান, এটুকু আর খেতে পারবে না? সকালবেলা! জলযোগের সময়!’
জ্যোতি বাধা দিয়ে বলল—‘আজ্ঞে পারব না তা তো বলিনি, বলেছি খাবো না। অন প্রিন্সিপল। পাত্রী দেখতে এসে ফাঁসির খাওয়া খাওয়াটা আমাদের সমাজের একটা বিশ্রী রীতি। খুব দৃষ্টিকটু এবং ক্রুয়েল।’ অর্থাৎ প্রগতি সঙেঘর সব কথাই কানে গেছে জোতেটার। বেশি করে সাধু সাজা হচ্ছে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, যাতে গিয়ে রিপোর্ট করতে পারি।
অনেক উপরোধে একটা রাজভোগ তুলে নিল জ্যোতি। আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল—‘তুমি খাও না তপন, তুমি তো ভাই থার্ড পার্সন। এঁরা খুব অতিথিবৎসল, মনে দুঃখু পাবেন।’
দুই মিত্তির বললেন—‘ঠিক বাবা, তুমি শুরু করো। ও কি কথা, সম্বন্ধ হোক চাই না হোক, একটু সামান্য জলযোগ করাতে কি দোষ?’
আমি মোটেই ওর ও চালে ভুললুম না। মহা ধড়িবাজ ছোকরা। একটা বালিশের মতো চিত্রকূট তুলে নিয়ে আমিও সব প্রত্যাখ্যান করে দিলুম।
তারপর সামনের সিঁড়ি দিয়ে, যাঁর জন্য আসা সেই দ্রষ্টব্যা কন্যাটি নেমে এলেন। আহা! আহা! আহা! দ্রষ্টব্যা তো নয় দর্শনীয়া! নেমে আসা তো নয় অবতরণ! এদেরই বোধ হয় সংস্কৃত সাহিত্যে বরবৰ্ণিনী বলত। বর বর্ণই বটে। ক’পুরুষ রূপটান মেখে মেখে যে এরা চামড়ার এমন জেল্লা পায়! আগাগোড়া চেহারাটি যেন পলসনের মাখন দিয়ে গড়া। খোলা চুল কোমরের একটু ওপর অবধি এসে থেমে গেছে। মাথার পেছনে চমৎকার একটি চালচিত্তির। সাদা লাল পাড় শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, কপালে একটি সূক্ষ্ম কুমকুমের টিপ ছাড়া কোনও প্রসাধন নেই। কানের লতিগুলো পর্যন্ত দোপাটির পাপড়ির মতো ভিজে ভিজে নরম নরম।
খুব সহজভাবে এগিয়ে এসে নমস্কার করে মেয়েটি বসল। বিনা ভূমিকায় মিষ্টি হেসে বলল—‘আমি যশোধরা মিত্র। গত বছর বেথুন থেকে বটানি অনার্স নিয়ে বি এসসি পাশ করেছি। এখন সায়েন্স কলেজে এম এসসি করছি। এক বছর চিকেন-পক্সের জন্য পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমার একুশ বছর বয়স।’
জ্যোতির মুখে কথা নেই। আমারও না।
একটু পর মেয়েটি আবার তেমনি সহজভাবেই বলল—‘আমি গান খুব ভালোবাসি। বিশেষত ইনডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল। অ্যাপ্রিশিয়েট করবার মতো শিখেছি, গাইবার মতো শিখিনি। সেলাই করতে একদম ভালোবাসি না। ডিসকো-মিউজিক পছন্দ করি না। দেশ-বিদেশের রান্না করতে পারি। বাড়িতে শেফ রেখে শিখেছি। ডাল-ঝোল-সুক্তো-চচ্চড়ি ঠাকুমার কাছে।’
জ্যোতি কিছু বলছে না। আমিও না।
বড় মিত্তির বললেন—‘তোমরা কিছু জিগগেস করবে না? লজ্জা-সঙ্কোচ কোরো না। আমরা দু ভায়ে না হয় একটু সেরেস্তায় গিয়ে বসি। কাজকর্মও আছে তো আবার।’
জ্যোতি হাত তুলে বলল—‘না না-না-না-না-না। আপনি ব্যস্ত হবেন না।’
ছোট মিত্তির বললেন—‘বেশ তো তোমরা একটু নিরিবিলিতে আলাপ-সালাপ করতে।’
‘কোনও দরকার নেই,’ জ্যোতি বলল, —‘যা বলার উনি তো নিজেই সুন্দর গুছিয়ে বলে দিলেন। যা জানবার পরিষ্কার জেনে গেলুম। তা ছাড়া আমাদের দেখাও তো হয়ে গেছে।’
আড়চোখে তাকালুম। এ মেয়েটি কি আবার ওভার-স্মার্টের ধাক্কায় পড়ল? যা স্ক্রু-ঢিলে ছোকরা। কিন্তু শুনলুম জ্যোতি বলছে—‘আমাদের পছন্দ হয়ে গেছে। অভিভাবক নেই তাই নিজ মুখেই বললুম কথাটা, মনে কিছু করবেন না। আপনাদের যখন সুবিধে দিন ঠিক করুন। তবে তিন মাসের মধ্যে। বরং ইতিমধ্যে আমার সম্বন্ধে যদি ফার্দার কিছু জ্ঞাতব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকে…’
দু’ভাই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন—সে কি কথা! সে কি কথা! তোমার সম্পর্কে সমস্ত খোঁজখবর না নিয়ে কি আর আমরা অ্যাদ্দূর এগিয়েছি! তুমি যখন কথা দিয়ে দিলে, তখন বাড়ির মেয়েদের বলি, ঠাকুরমশাইকে ডাকাই। বাঃ, খুব চমৎকার চুকে গেল তো ব্যাপারটা!’ দু’ভাই যৎপরোনাস্তি খুশি হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
জ্যোতি মুখ ফিরিয়ে এবার পাত্রীর দিকে তাকাল।
—‘আমার কথা তো শুনলেনই। আপনাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার একটা চান্স দেওয়া উচিত। আপনার কিছু বলার নেই?’
মেয়েটি হাসিমুখে বলল—‘হ্যাঁ।’
—‘বলুন কি জিগগেস করবেন।’
—‘কিচ্ছু জিগগেস করব না, শুধু একটা কথা বলব। আমি বিয়ে করব না।’
মেয়ের বাবা-কাকা দুজনেই হাঁ-হাঁ করে উঠলেন—‘কী বলছিস রে খুকি! বিয়ে করবি না কখনও তো বলিসনি?’
—‘করব না তো বলিনি। এখানে করব না।’
—‘কেন মা, তোকে তো সব জানিয়েছিলুম।’
—মেয়েটি কিছু না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
—‘তবে কি তোর পছন্দ হয়নি।’
—‘না।’
জ্যোতি গোঁ ধরে বসেছিল বিয়েই করবে না। কতলোক তো চিরকুমার হয়ে, ব্রহ্মচারী হয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। তাদের দিন কি এমন মন্দ কাটে? তা ছাড়া সবাই যদি সংসার ধর্ম করবে তো দেশের কাজ, দশের কাজ করবেটা কে শুনি?. এই হতভাগা দেশে প্রজাবৃদ্ধি করেই বা কি লাভ? ডাক্তারের লাইফ এক হিসেবে ডেডিকেটেড লাইফ। বিয়ে করলে সাধনায় বিঘ্ন হতে পারে! জ্যোতির গার্হস্থ্য-সুখ-ত্যাগে গ্রামে গ্রামে, গঞ্জে-গঞ্জে কতো দরিদ্র, চিকিৎসা বঞ্চিত, মূঢ়-ম্লান-মূক মুখে হাসি ফুটবে। বিবেকানন্দ, বিধান রায় বলে গেছেন… ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক করে বোঝানো হল চোরের ওপর রাগ করে কি কেউ মাটিতে ভাত খায়? সব শুনে এমন কি খোদ কার্যনির্বাহক কমিটি পর্যন্ত বোঝাতে এসেছিল। হাজার হোক বন্ধু লোক। ডিপ্রেশনে ভুগছে, বন্ধুদের একটা মানবিক দায়, একটা নৈতিক দায়িত্ব নেই? বিবাদ যা ছিল সে ইডিওলজিক্যাল, বাস্তবের মানবিক দাবীর কাছে ইডিওলজি? আদালত থেকে কেস তুলে নেওয়া হয়েছে। সত্যিই ছেলেটার একটা বিয়ে দরকার। তিনসংসারে কেউ নেই। এক বৃদ্ধা পিসীমা। তিনি চোখ বুজলে দুটো ভাত বেঁধে দেবে কে? সারাদিন হাসপাতাল ঠেঙিয়ে ছেলেটা শুকনো মুখে চেম্বারে বসে থাকে।
জ্যোতির জন্যে আমার দ্বিতীয় মেয়ে দেখা দক্ষিণ হাওড়ায়। শুধু আমি নই। এবার আমরা। আমি, শৈল, বিমান, গোরা, মুরারি, শিবে এবং জ্যোতি স্বয়ং তো বটেই। আমরা এতোজনে যেতে ইতস্তত করছিলুম। কিন্তু কন্যাপক্ষ নাকি পই-পই করে বলে দিয়েছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতে।
মাঘ মাসের সন্ধে। ধোঁয়ায় চারদিক ধোঁয়াক্কার। ভারতবর্ষের শেফীল্ড সগর্বে ধূম্র-উদ্গীরণ করে ভারি বাতাসে দিব্যি একটি ধূম্রজালিকার চাঁদোয়া বিছিয়ে দিয়েছে। তার নিচ দিয়ে আমরা পাত্রী সন্দর্শনে সবেগে ধাবিত হচ্ছি। গলির গলি, তস্য গলি। ঢুকছি তো ঢুকছি, বেঁকছি তো বেঁকছিই।
মুরারি বললে—‘শ্ শালা। এ যে দেখছি শহরের স্মল ইনটেসটিন! আর ক’ গণ্ডা টার্ন নেবে বাবা! মুখস্থ করতে করতে চল্ রে জোতে, জামাই-ষষ্ঠীর দিন “কিছু মিছু” মাথায় নিয়ে মহা বেকায়দায় পড়ে যাবি নইলে, আই মীন বিয়েটা হলে।”
গোরা বলল—‘ডাইনে পানা-পুকুর, বাঁয়ে ভাগাড়, বাঃ। ইলেকট্রিক্যাল ফিটিংস-এর দোকান বাঁয়ে রেখে ঢুকছি। টিউবওয়েল, লাইন পড়েছে, মিউনিসিপ্যালিটি জল দেয়নি মনে হচ্ছে, ‘শ্রী নিবাস’, ওন্ড হাওড়া স্টাইল, নতুনদার কায়দায় বলতে ইচ্ছে করছে “ছিরিনিবাস।” টিউবওয়েল নাম্বার টু, লোক নেই, অর্থাৎ ঘটাং-ঘটাং না-ই রস না—ই। ডাইনে বেঁকলুম রাখোহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশ দিয়ে, বাপ রে গলির মধ্যে যে পেল্লায় নার্সিংহোম হাঁকিয়েছে রে। বাঁ-ডান, বাঁ-ডান, একি রিপাবলিক ডে’র কুচকাওয়াজ প্র্যাকটিস করাচ্ছে! সেন্ট এলিজা নার্সারি স্কুল। সেন্ট এলিজাটি আবার কে রে? সেন্ট কি চাদ্দিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজায়?’
ব্লাইন্ড লেন। বিরাট গেটওয়ালা দুর্গের মতো দুর্ধর্ষ বাড়ি। আমাদের ট্যাকসিটা দাঁড়াতেই দু-তিনটে অ্যালসেশিয়ান আর গ্রে-হাউন্ড গাঁউ-গাঁউ করে গম্ভীর অভ্যর্থনা জানাল। বিরাট হাতা। অনেকটা হেঁটে পাত্রীর বাবা এবং আরও বিস্তর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভেতরে ঢোকা গেল। জ্যোতি চুপিচুপি বলল—‘যৌথ পরিবার, যদ্দূর শুনেছি তিনপুরুষ একসঙ্গে থাকে। তা এ মেয়ে আমার আপনি-আর-কপনির বাড়িতে থাকতে পারবে তো রে?’
গোরা বলল—‘তুই চুপ যা।’
হলঘরের মতো বৈঠকখানা। একদিকে বিরাট চৌকির ওপর ফরাস পাতা। তাকিয়া-টাকিয়া দিয়ে জমিদারি ব্যাপার। তিন-চারটে তাসের প্যাকেট পড়ে আছে। অর্থাৎ নিয়মিত তাসের আড্ডা বসে। অন্যদিকে সোফা-কৌচ। সেখানেই আমাদের আদর করে বসানো হল। পরিচয়ের আদান-প্রদান, আসুন-বসুন, কি সৌভাগ্য। খাতিরের চোটে আমাদের নিজেদের এক-একটা নবাবজাদা মনে হতে লাগল। একটি বাচ্চা ছেলে এই শীতের মধ্যে খানিকটা গোলাপজল স্প্রে করে গেল, আর একজন রুপোর রেকাবিতে তবক-দেওয়া মিঠে পান দিয়ে গেল। ওদিকে ঘড়র-ঘড়র করে জেনারেটর চলছে, তিন সেট ঝাড়বাতি। এলাহি ব্যাপার।
অন্দরের দিকের দরজার পর্দাটা নড়ে উঠতেই শৈল চুপিচুপি বলল—‘এই তপন, আমার কিন্তু খেতে-টেতে খুব লজ্জা করবে যাই বলিস। এ মেয়েটাও যদি জোতেকে নো করে দেয়?’
কিন্তু না। খাবার-দাবার নয়, মেয়েই এলো। বাঃ। প্রথম দর্শনেই আমাদের সব্বার একযোগে পছন্দ হয়ে গেল। বাগবাজারের মেয়েটির মতো রূপসী বলাকা হয়তো নয়। কিন্তু মেয়েলি প্রবাদ বাক্যের যাথার্থ্য প্রমাণ করে—নাকটি চাপা চোখটি ভাসা এ মেয়েটি দেখতে সত্যিই খাসা। জোতের সমান সমান। বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। ঢেউ খেলানো চিকণ চুল। বড় বড় পল্লব ঘেরা কালো চোখ। আসল কথা, দেখবামাত্র ভালো লেগে যায়। চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল এখানেই ফাইন্যাল। আমি মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াতে লাগলুম। যবে থেকে আমি দেখতে আসছি তবে থেকেই জ্যোতির ভাগ্য খুলে গেছে। মেয়েটি একটু ঘাবড়ে গেছে মনে হল। চোখ নিচু করে রইল। নমস্কারও করল না।
শিবুই গলা-খাঁকারি দিয়ে জিগগেস করল—‘আপনার নামটা যেন কি?’
মেয়ের বাবা বললেন—‘ললিতা।’
শিবু বলল—‘পড়াশোনা কদ্দূর করেছেন?’ বড় বড় কথা বলা সত্ত্বেও শিবেটা সনাতন পদ্ধতিতে এগোচ্ছে।
মেয়ের জ্যাঠা বললেন—‘বি এ তো পাশ করে গেছে বাবাজি। চিঠিতে তো সব খুলে লিখেছিলুম! ডিগ্রি-টিগ্রিগুলো আনব? ওরে মদ্না, তোর খুড়িমার কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে মার্কশিট-টিটগুলো নিয়ে আয় তো!’
আমরা সবাই সমস্বরে—‘না না ওকি কথা, না না সে কি কথা,’ করতে থাকি।
শিবু ইনটারভিউটা একচেটে করে নিচ্ছে দেখে এই সময়ে বন্ধুদের মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। বিমান তাড়াতাড়ি জিগগেস করল—‘কোন কলেজে পড়েছেন?’ গোরা বলল, ‘কি কি সাবজেক্ট ছিল?’ শৈল বলল—‘এম এ-টা পড়লেন না কেন?’
এক বৃদ্ধ, খুব সম্ভব পাত্রীর দাদু, দাড়ি নেড়ে ফোকলা মুখে ফকফক করে বললেন—‘আজকাল তো অনার না হলে এম এ পড়তে দেয় না, জানো না বাবারা! তাই তো দিদিভাইয়ের আমার ইউনিভার্সিটিটা আর দেখা হল না। নইলে ছাত্রী কি খারাপ ছিল? ডিস্টিংশন তো ক’নম্বরের জন্যে ফসকে গেছে!’
এই সময়ে ভেতর থেকে পাকামাথায় সিঁদুর এক মোটাসোটা মহিলা গুচ্ছের কাগজপত্র এবং পর্বতপ্রমাণ টেবিল ক্লথ, ট্রে ক্লথ, রুমাল, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ইত্যাদি নিয়ে ঢুকলেন। মেয়ের স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত সমস্ত প্রোগ্রেস রিপোর্ট, সার্টিফিকেট, মার্কশীট এবং সূচীকর্ম। খুলে খুলে প্রত্যেকটি দেখাতে লাগলেন সবাই। ভদ্রমহিলা ঘোমটা টেনে বললেন—‘নিজের নাতনি বলে বাড়িয়ে বলচি না বাবা, ললির মতো লক্ষ্মী মেয়ে আমাদের এতো বড় বংশেও আর দ্বিতীয় নেই। লেকাপড়া তো শিকেইচে, ঘরের কাজ-কর্মে একেবারে এসপাট। ইকিবেন শিকে ফুল দিয়ে ঘর যা সাজায় দেখলে চক্ষু জুড়িয়ে যাবে। এইসব সেলাই-ফোঁড়াই অন্য লোকের করা ওর বলে চালাচ্চি মনে কর না বাবা, সব নিজ হাতে একটি-একটি করে করেচে। যেমন ছুঁচের কাজ, তেমনি কাটিং।’
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলুম নিচের ঠোঁটটা সজোরে কামড়ে ধরেছে। জ্যোতি আমার কানে কানে বললে—‘ওসব সেলাই-ফেলাই রাখ তপন। আমি কি দর্জি খুঁজতে এয়েচি নাকি? গলার আওয়াজটা খুব ইমপর্ট্যান্ট। পদ্মিনী মেয়ের স্বর হবে সেতারের মতন। এ যে কথাই বলে না রে? এতো লজ্জাশীলা হলে তো আমাকে না করে আমার দাদুকে বিয়ে করলেই পারত!’
ওর নির্দেশমতো জিগগেস করলুম—‘ইকেবানা শিখেছেন কার কাছে?’ মেয়ে চুপ। আমাদের ধারণা ঠিক। জ্যাঠা-বাবা-কাকা-দাদুরা উত্তরটা জানেন না। মেয়েটি যেন কেমন-কেমন চোখে জ্যোতির দিকে তাকাল। চোখদুটো ছলছল করছে।
জ্যোতি বলল—‘জাপানী মহিলা?’
মেয়ে ঘাড় নাড়ল।
—‘কি নাম ভদ্রমহিলার? আমারও খুব শেখবার ইচ্ছে কি না তাই জিগগেস করছি।’
সবাই চুপ। মেয়েটি দু-একবার ঠোঁট ফাঁক করল। ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। ঘড়ির কাঁটা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পার। দশ মিনিট পার। আমরা সবাই ঘামছি।
জ্যোতিই প্রথম উঠে দাঁড়াল। সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল—‘আচ্ছা, তবে চলি।’
যেন হিমঘরের নীরবতার মধ্যে দিয়ে আমরা এগোচ্ছি। বাইরের দিকের দরজা দিয়ে জনাদশেক লোক ঢুকে এল। শেষজন ঢুকল কোলাপসিব্ল গেটটা সশব্দে টেনে দিয়ে।
—‘কোথায় চোললেন দাদারা? অ্যাতো তাড়া কিসের?’ কথায় হিন্দুস্থানী টান। ইয়া ছাতি, ইয়া গুল।
—‘মেয়ে কেমোন দেখলেন?’
মুরারি চড়া গলায় বলল—‘ডিফেকটিভ মেয়ে গছাবার তালে ছিলেন আবার কেমন দেখলুম জিগ্গেস করছেন?’
—‘কিসের ডিফেকট?’
—‘কিসের ডিফেকট আপনিও জানেন, আমিও জানি।’
—‘কাকে চোখ রাঙাচ্ছেন দাদা তোখন থেকে?’ বলতে বলতে একজনের হাত জ্যোতির কলারে উঠে এলো।
গায়ে হাত তুলছে যে? আমরা প্রগতিরা হাঁ-হাঁ করে এগিয়ে যাই। দশ ষণ্ডামার্কা বজ্রমুষ্টিতে আমাদের হাত ধরে ফেলে। একজন ঠাণ্ডাগলায় বলে—‘যোগাড় যোন্তোর সোব রেডি। মোন্তোরগুলো পোড়ে লিয়ে বেরুবে, আগে নোয়।’
—‘মানে?’—আমাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। গোরা-শৈল-বিমান আস্তিন গোটাতে থাকে। —‘জোর করে বিয়ে দেবে? মগের মুলুক নাকি? পুলিশ নেই?’
—‘সেই কোথাই তো বলছিলাম দাদা?’ ষণ্ডামার্কাতম একটা নীলচে পিস্তল লোফালুফি করতে করতে হেসে বলে—‘ছন্নুর ডেরায় পুলিশ ভি ঘুঁষতে ভোয় পায়, আর আপনেরা তো জেনারল্ পাবলিক আছেন।’
এই সময় সেই দাড়িঅলা দাদু এগিয়ে এসে বললেন—‘কিছু মনে কর না বাবারা, এরা ললিদিদিকে বড্ড ভালবাসে। নাতনির আমার কোনও খুঁত নেই। পার্ট ওয়ান পরীক্ষার পর বরশুলে মামাবাড়ি গিয়ে যে কি সর্বনেশে জ্বর নিয়ে এল, ডাক্তার ধরতে পারলে না। পনের-ষোল দিন যমে-মানুষে টানাটানি। ফিরে এল বটে কিন্তু সেই থেকে দিদি আমার নীরব। ফিসফিসিয়ে বই কথা বলতে পারে না, কোঁচার খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। বৃদ্ধ, ‘তুমি ডাক্তার বলেই আরও তোমার ওপর ওর বাপমায়ের ঝোঁক ভাই। ডাক্তার হয়ে যদি একটা নিদ্দুষী মেয়েকে এ বিপদ থেকে বাঁচাতে না পারো তবে আর কেন লাখ-লাখ টাকা খরচ করে সরকার তোমার মতো সোনার চাঁদদের ডাক্তার করে? তোমার হাতযশে আর পয়ে ওর ও-রোগ তো সেরে যেতেও পারে, জন্মগত তো আর নয়। আমি বৃদ্ধ মানুষ। বলছি তোমার মঙ্গল হবে।’
মেয়ের বাবা বললেন—‘তোমাকে আমরা চৌরঙ্গিতে চেম্বার সাজিয়ে দেব বাবাজীবন। আড়াই লাখ টাকা এক্ষুনি তোমার নামে ব্যাঙ্কে ট্রানসফার করে দিচ্ছি। কাগজপত্র রেডি।’
—‘টাকার লোভ দেখাচ্ছেন আমাকে? ছি! ছি! ছি! টাকা দিয়ে জামাই কিনবেন? টাকা দিয়ে মানুষ কিনতে চান?’
—‘টাকার লোভ ঠিক দেখাইনি বাবা। তা হলে তো আরও আগে মেয়ে পার করতে পারতুম। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? মেয়ের উপযুক্ত জামাই খুঁজছিলুম বাবাজি। নইলে টাকাটা গাপ করে বৌকে ত্যাগ করে কি তার ওপর অত্যাচার করতে কতক্ষণ? এতো আখচার হচ্ছে আজকাল।’
—‘আমি তা করব না জানলেন কি করে?’ জ্যোতি তেরিয়া।
—‘সে তুমি পারবে না বাবাজি। তোমার সম্পর্কে আমরা খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়েছি। এমন কি তোমার এই বন্ধুদের সম্পর্কেও। এই “অগ্রগতি সঙঘ” না কি? বন্ধু দিয়েই মানুষের পরিচয় এমনি একটা ঋষিবাক্য আছে না? বলো না বাবাজিরা! তোমরা কি তোমাদের বন্ধুকে অ্যাতো বড় একটা অন্যায় করতে দেবে?’ সম্ভাব্য অন্যায়ের ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ একতরফা, এ বিষয়ে দেখলুম ভদ্রলোকের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
পূর্বোক্ত ষণ্ডামার্কাদের একজন এই সময়ে বাড়ির ভেতর থেকে একটা চওড়া পাড় বেনারসি জোড় আর একটা জমকালো টোপর নিয়ে ঢুকে গ্রাম্ভারি চালে বলল—‘কুর্তা-পাৎলুন ছেড়ে এ সাড়ি পোরে লিন জলদি। টোপর লাগিয়ে লিন। কনে রেডি।’ হাঁ-হাঁ করতে করতেই ছন্নু এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দুর্ভেদ্য ব্যূহর মধ্যে জ্যোতির বস্ত্রহরণ এবং বস্ত্র পরিবর্তন পালা সমাধা হল অ্যালসেশিয়ান কুলের গাঁউ গাঁউ রবের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মধ্যে দিয়ে। আমাদের কুংফু, ক্যারাটে কিচ্ছু কাজে লাগল না। হাতে হাতেই অন্দরে পাচার হয়ে গেল জ্যোতে। একটু পরে আমাদেরও ডাক পড়ল। যদিদং তদিদং করে জ্যোতিশংকরের বিবাহ-পর্ব চুকে গেল।
মেজাজে আছে জ্যোতি। অন্তত আমি তো তাই দেখছি। চৌরঙ্গিতে রাজোয়াড়া চেম্বার। চেম্বারই রুগী টানছে। এর পর হাতযশ চাউর হয়ে গেলে পসার মারে কে? ফি মাসে জ্যোতির শ্বশুরবাড়িতে প্রগতি সঙ্ঘর নেমন্তন্ন বাঁধা। ওর শ্বশুরমশাই অবশ্য কক্ষনো প্রগতি বলেন না, বলেন অগ্রগতি। উনি নাকি ‘অগ্রগতি’র ভরসাতেই মেয়ে দিয়েছেন। সুতরাং জ্যোতির চাইতে অগ্রগতির খাতিরই ওর শ্বশুরবাড়িতে বেশি। মোগ্লাই, চীনে, গোয়ানীজ ভোজ হয়ে গেছে। পরের মাসে শুনছি ফরাসী কুইজিন। জ্যোতি বড় বড় ই এন টি দেখাচ্ছে। ভেলোরে নিয়ে যাবে শীগগির। সেখানে কিছু না হলে ভিয়েনা। তবে জনান্তিকে আমায় বলেই রেখেছে—‘দ্যাখ তপন, সারলে ভালো, না সারলে আরো ভালো। মেয়েদের কথা বলার চান্স দিয়েছিস কি মরেছিস?’