মিসেস গুপ্তরা

মিসেস গুপ্তরা

বিকেল সাড়ে তিনটে। গ্রীষ্ম দুপুরের বিশ্রাম-কাম-স্বাস্থ্য-কাম-সৌন্দর্য ঘুম সেরে উঠে টি ভি-র ঢাকনাটার ওপর ট্যাটিং-এর ফুলগুলো বসাচ্ছিলেন মিসেস গুপ্ত। মিসেস গুপ্তর পুরো নাম লীনা গুপ্ত। কিন্তু আপনার আমার মতো অপরিচিত বা আধা-পরিচিত যাদের স্ট্যাটাস বা জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই তারা যদি ওঁকে লীনা বউদি-টউদি ডেকে আদিখ্যেতা দেখায় তা হলে উনি অসন্তুষ্ট হবেন। কারণ ওঁর স্বামী বিখ্যাত বহুজাতিক-সংস্থা বা মালটিন্যাশনালের মাঝারি এগজিকিউটিভ। এই অভিজাত অঞ্চলে বহুদিন আগে জলের দরে কেনা সাড়ে তিন কাঠা জমিতে উনি মাত্র সেদিন সুদৃশ্য দোতলা বাড়িখানা তুললেন। দোতলায় নিজেরা থাকেন, একতলায় চলতি ফ্যাশন মতো অবাঙালি ভাড়াটে। ওঁর ছেলেমেয়ে সকালে রোয়িং, বিকেলে সাঁতার বা সকালে সাঁতার বিকেলে রোয়িং এবং শনি রবিবারে নাচ-গান-ছবি আঁকা ইত্যাদি যা-যা শিক্ষণীয় সব শেখে, পড়াশোনার ব্যাপারেও কলকাতার সবচেয়ে ফ্যাশনদুরস্ত স্কুলে প্রথম দশজনের মধ্যে যাতে থাকতে পারে তার জন্য সাড়ে তিনশ’ চারশ’ দক্ষিণার টিউটর তো বটেই, মিসেস লীনা গুপ্তরও কম ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা নেই। তাঁদের সকালবেলাকার লেবু-রস, ব্রেকফাস্টে স্ক্র্যাম্বলড্‌ এন-অন-টোস্ট, দুধ-কর্নফ্লেক্‌স্‌, দুই স্কুলে দুই আলাদা টিফিন ক্যারিয়ারে মাপা প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট-ভিটামিন সমৃদ্ধ কিছু রাফেজ-সহ ড্রাই লাঞ্চ তিনি যথাযথ যুগিয়ে যান। বেশ ভিটামিন-মিনারল সচেতন জননী তিনি। তা ছাড়া, নিজের অবসর সময়কেও বৃথা যেতে দিতে আদৌ রাজি নন এই কর্মী মহিলা। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে প্রত্যহ মিসেস গুপ্তর কাজ হল ‘শিঙার’ নামের নিকটবর্তী বুটিক-কাম-বিউটি সেলুনে হাজিরা দেওয়া। সন্তান-সন্ততি উঁচু ক্লাসে উঠে গেলে এবং স্বামীরা কেরিয়ার-পর্বতে চড়তে চড়তে উপত্যকাসদৃশ একটা উচ্চমার্গীয় স্থিতাবস্থায় পৌঁছলে কিছু কিছু মহিলার জীবনে একটা উপভোগ্য অবসরকাল আসে। এই রকম কয়েকজন অবসরপ্রাপ্তা, আলোকপ্রাপ্তা জননী-জায়া মিলে ‘শিঙার’ ব্যাপারটা দাঁড় করিয়েছেন। কলকাতার নাগরিকরা আজকাল খুব সৌন্দর্যসচেতন হয়ে উঠেছে, তারই সুযোগে এই ‘শিঙার’। কত রকমের মহিলা যে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাবার জন্য এখানে ভুরু না থাকলেও ভুরু তুলতে, চুল না থাকলেও চুল ছাঁটতে, আবার লম্বা চুল কেটে ফেলে নকল চুলে খোঁপা বাঁধতে, কেমিক্যালের সাহায্যে গাত্রবর্ণ ধোলাই করতে, সোজা চুল কোঁকড়াতে আবার কোঁকড়া চুল সোজা করতে ক্লান্তিহীন ভাবে যাতায়াত করে থাকেন তা একটা পুরো দিন খরচ করে বসে দেখার জিনিস।

বিউটি সেলুনের পাশেই বুটিক। তাঁতের শাড়ির ওপর এমব্রয়ডারির ফুল তোলা ডুপ্লিকেটহীন শাড়ি, বনেদি ঘরানার সেরামিকস্‌, র’ সিল্কের বাতি-শেড, দেয়ালে টাঙাবার তিব্বতি স্ক্রোল, কস্ট্যুম জুয়েলারি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালে মিসেস গুপ্তর হাসি দেখতে পাবেন। এবং ভদ্রতা। সহজাত সেলিং স্ট্রাটেজির অন্তর্গত তৌল করা হাসি, এবং ভদ্রতা। উদ্দেশ্যসাধনের জন্য ব্যবহার্য। স্বাভাবিক ভারি গলাকে আলজিভের কাছ থেকে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে মিহি মোলায়েম স্বরে মিসেস গুপ্ত আপনাকে জিগ্‌গেস করবেন—কিভাবে তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। যেন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের রিসেপশনিস্ট, কিংবা জনসংযোগ আধিকারিক। এই সময়ে তিনি ঘাড়টাকে সামান্য কাত্ করে খুব বড় বড় চোখে আপনার দিকে তাকাবেন। বালিকার মত নিষ্কলুষ অথচ জহুরীর মত সমর্থ সে দৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি সওদা সেরে নিতে পারবেন ওই চাহনির অভিভাবকতায়। কারণ আপনি সহজেই বুঝে যাবেন কোন্ পণ্যটি খরিদ করলে ফ্যাশনলোকের শীর্ষবিন্দুচারিণী বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পারবেন, কোন্‌টা কিনলে অভিজাত সুরুচির জন্য অভিনন্দিত হবার সম্ভাবনা, কোন্‌টা…। কিন্তু একটা কথা। এই ‘শিঙার’ বুটিকের বাইরে যদি কোনদিন মিসেস গুপ্তর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আপনি যেন ফট্‌ করে ‘এই যে কেমন আছেন’-টাছেন জাতীয় কিছু বলে বসবেন না। কারণ, বুটিকের চেনাটা ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কজনিত, নৈর্ব্যক্তিক। সেই মুখচেনার ওপর নির্ভর করে কোনও সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রমহিলার সঙ্গে পথে-ঘাটে আলাপ করা অত্যন্ত ব্যাড ফর্ম। মিসেস গুপ্ত আপনাকে চিনতে পারবেন না, আপনার কথার জবাব দেবেন না। তা ছাড়া আপনি আবার সেই বোকাদের একজন নন তো যাঁরা বিপণিমাত্রকেই দোকান এবং কাউন্টারের ওধারে দেখা মহিলামাত্রকেই নিছক সেলস্ গার্ল ভেবে নিয়ে থাকেন। এই ধরনের প্রগতি-পরিপন্থী মূঢ়দের চেনা দিতে আর যে-ই হোক মিসেস গুপ্ত বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন।

হ্যাঁ। মিসেস গুপ্ত ট্যাটিং-এর ফুলগুলো বসাচ্ছিলেন। ফিকে গোলাপির ওপর সাদা-সাদা ফুল। তাঁর ড্রয়িং রুমের জন্য তিনি আপাতত গোলাপির শেড ব্যবহার করছেন। পর্দা গোলাপী, টেবিল-ঢাকা গোলাপি, কুশন-কভার, বাতির শেড সব গোলাপির রকমফের। ভারি তোষামুদে রঙ। অতিথির চোখে গৃহকর্ত্রীকে, গৃহকর্ত্রীর চোখে অতিথিকে রমণীয় করে। এমন সময় বাড়ির বেলটা তারস্বরে বেজে উঠল। বেল শুনে মিসেস গুপ্ত তাঁর সহজাত ভারি গলায় (কেন না অসময়ে ঘন্টি শুনে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়েছে) ছেলেকে বললেন—‘দ্যাখো তো বাবুয়া, কে।’ ছেলে তখন একটি ভয়ঙ্কর মেরুপ্রদেশীয় হাঙরের বীভৎস কার্যকলাপের বিবরণে আকণ্ঠ মগ্ন। সাড়া দিল না। সুতরাং মেয়ে। মা বললেন, ‘শুস্তা, আগে ম্যাজিক আই দিয়ে দেখবে, চেনা-জানা হলেও আমাকে না বলে খুলবে না।’ তেমন কেউ চেনাশোনা হলে মিসেস গুপ্তকে আপ্যায়ন করতেই হবে, তার আগে হাউজ-কোট পাল্টানো, চুল বাঁধা, প্রসাধন ইত্যাদির প্রস্তুতি আছে। ম্যাজিক-আইয়ে শুস্তার চোখ পৌঁছয় না। সে একটা ছোট মোড়া টেনে নিয়ে তবে ম্যাজিক-আইয়ের নাগাল পেল। তারপরেই ছুটতে ছুটতে শোবার ঘরে এসে সোৎসাহে ঘোষণা করল—‘বড় পিসি এসেছে।’

মিসেস গুপ্তর কপালের চামড়া সর পড়া দুধের মত কুঁচকে গেল। তিনি চোখ সরু করে বললেন—‘কে বললি? বড় পিসি? একা?’

—‘না, রাজাদাদা সোনাদিদি আছে।’

—‘আর?’

—‘আর কেউ না।’

তবু ভালো। ততক্ষণে বেলটা আবার বেজেছে। এরা জানে না, বাড়িতে কেউ থাকলে একবার বাজালেই শুনতে পাওয়া যায়, না থাকলে হাজারবার বাজালেও দরজা খুলবে না।

—‘যাও, খুলে দিয়ে এসো।’ অনুমতি দিয়ে আবার সূচীকর্মে মনোযোগ দিলেন মিসেস গুপ্ত।

একটা বড় আকারের মিষ্টির বাক্স আর প্লাস্টিকের ঝুড়িসমেত ঘরে ঢুকলো শুস্তাদের বড় পিসি। মুখে একগাল হাসি।

—‘কি গো বউদি। আছো কেমন?’

প্ল্যাস্টিকের ঝুড়িটার দিকে আড়চোখে তাকালেন মিসেস গুপ্ত। খেয়েছে, থাকবে নাকি? কুশল প্রশ্নের জবাব দিলেন না। শয্যার দিকে তাকিয়ে গলা উঁচু করে বললেন—‘বকুল এসেছে।’

ঘুমের মধ্যে মিঃ গুপ্ত বা বিমানবাবুর মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে ছিল এবং হাঁ মুখ দিয়ে ফড়িং ওডার মতো একটা ফড়ফড়ে শব্দ বার হচ্ছিল যা এ পল্লী নিবাসী বুটিক পরিচালিকা স্ত্রীর স্বামী, মাল্‌টিন্যাশনাল একজিকিউটিভের মুখ দিয়ে আদৌ বার হওয়া উচিত নয়। কিন্তু মধ্যবয়সী দিবানিদ্রা কেরাণী-অফিসারে তফাৎ করে না। আকস্মিক আহ্বানে তিনি ঘোঁৎ-মতো বেয়াড়া এবং পুনরপি তাঁর পদমর্যাদার অযোগ্য একটা শব্দ করলেন, তারপর লাল লাল চোখে উঠে বসলেন।

বকুল বলল—‘আহা, বড্ড ঘুমোচ্ছিলি রে দাদা। সারা হপ্তার খাটুনি। না ডাকলেই পারতে বউদি। আমরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।’

বউদি শঙ্কিত হলেন। ‘পালিয়ে যাচ্ছি না’ প্লাস প্লাসটিকের ঝুড়ি, আজ এখানেই। অবস্থান না কি? এই সময়ে ননদ হাত বাড়িয়ে বাক্সটা দিল।

—‘সাতগেছের মাখা সন্দেশ। খুব সরেস, খেয়ে দেখো। উনি সাতগেছেয় বদলি হবার পর তো আর আসা হয়নি। গত পুজোতেও তোমরা ছিলে না। বোধহয় এক বছর পর এলুম, নয়?’

মিসেস গুপ্ত একটা শুষ্ক হাসি হাসলেন। এক বছর পুরো পার হয়ে গেছে বুঝি? তাঁর তো মনে হচ্ছে বকুল এই কালই এসেছিল, মাঝে মাঝেই এসেছে। রোজই আসে।

এই ননদের স্বামী পোস্টমাস্টার। যত অজ পাড়াগাঁয়ে ঘুরে ঘুরে কাজ। ছেলেমেয়েরা গ্রামের স্কুলেই পড়ে। বকুলের পরনে হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। মেয়ে বড় হয়েছে, সুতরাং বয়স বেশি না হলেও ও খুব হালকা রঙ ছাড়া পরে না, খুব সম্ভব শীগগিরই সাদা ধরে ফেলবে। ব্লাউজ গলা থেকে কোমর অবধি। এক চিলতে পেট দেখার উপায় নেই। মাথায় অনেক চুল, হাত খোঁপা করা। বড় বড় চোখ। দেখতে খারাপ নয়। বরং ভালোই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মেয়ে বড়। দেখা যাচ্ছে ষোল পার হতে না হতেই শাড়ি ধরে ফেলেছে। ডগমগে ছাপা শাড়ি, হাতে একগাছা করে সোনার চুড়ি। ছেলে হাফ-প্যান্ট এবং ডোরা-কাটা হাফ-শার্ট। গ্রাম্য দর্জির হাতের কাজ। তিনজনেরই মুখময় গ্রামীণ জীবনযাত্রাজনিত নিবিড় মৃত্তিকাময়তা।

মিসেস গুপ্ত দেখলেন শুস্তা তার পিসতুত দিদির হাত ধরে সাভিমানে টানাটানি করছে। একটা মানভঞ্জনের পালা চলেছে সেখানে। সোনা অর্থাৎ ননদের মেয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলছে—‘আমি তো তবু আসি। তুই তো একেবারেই যাস না। থাকবো কেন? আমাদের এ বাড়িটার পেছনে একটা লিচু পেয়ারার বাগান আছে, ঝাঁকে, ঝাঁকে টিয়া আসে, জানিস…।’

শঙ্কা ঘনীভূত হল। মূর্খ মেয়েটা দিদির কাছে আজকের দিনটা থেকে যাবার বায়না ধরেছে।

শুস্তা তখনও বলছে—‘থাকো না সোনাদিদি, অন্ গড্‌ বলছি, আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়ে থাকবো।’

অস্বাস্থ্যকর ঘনিষ্ঠতা। মিসেস গুপ্ত চটপট সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন। গম্ভীর গলায়। বললেন—‘শুস্তা রেডি হও। নাচের স্কুল আছে না!’

—‘আজ যাব না। আজ সোনাদিদিরা এসেছে!’ শুস্তা আদুরে গলায় বলল। শুস্তার বয়সে নতুন-বড়-হওয়া তুতো দিদিদের আকর্ষণ কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর!

—‘বাজে বোকো না।’

বকুল ভাইঝির হয়ে ওকালতি করতে যাচ্ছিল। খুব সময়মত মনে পড়ে গেল এ ধরনের সালিশি দাদা-বউদিদি ছেলে-মেয়ে মানুষ করার ব্যাপারে তৃতীয় ব্যক্তির অবাঞ্ছিত নাসিকাক্ষেপ জ্ঞান করেন। সোনা খুব অবাক হয়ে মামীমার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়েছিল। অনেক দিন আগে যখন ওরা রানাঘাটে ছিল, বাবা মস্ত কোয়াটার্স পেয়েছিলেন তখন সেই একবারই মাত্র মামারা গিয়েছিলেন। তিন দিন আটকে রেখেছিল মামাদের, স্কুলে যায়নি, পুকুরে জাল ফেলিয়ে মাছ ধরানো হয়েছিল, সে কি হই হই মজা! দাদা-দিদি এলে আবার কেউ স্কুলে যেতে পারে না কি! তাও আবার নাচ-স্কুল। কিন্তু শুস্তা তার মায়ের মুড বিলক্ষণ চেনে। যদিও কার্য-করণ এখনও ভালো বুঝে উঠতে পারে না। সে শুকনো মুখে পোশাকি জামা-কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। বকুল দেখল বাবুয়া—অর্থাৎ তার ভাইপো এখনও নিবিষ্টচিত্তে পড়ে যাচ্ছে। রাজা অনেকক্ষণ তার আশেপাশে ঘুরঘুর করে মনোযোগ আকর্ষণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে এখন খুব আত্মবিশ্বাসহীনভাবে বসে আছে। বাবুয়াদাদা যে নাকি জীনস এবং আঁটো হাতা ভেস্ট ছাড়া পরে না, বর্গ-গাভাসকর-মহম্মদ আলি বিষয়ে বড়দের মতো মতামত দিয়ে থাকে; গাভাসকরকে যে গাওস্কর বলে সে হীরো নয় তো কি? তার সেই স্বপ্নলোকের রাজপুত্তুর দাদা আজ তাকে পাত্তাই দিল না। বালকটি তাই ম্রিয়মাণ।

বিমানবাবু বললেন—‘ও। তোমরা এখন সাতগাছিয়ায় আছো! হুঁ। বসো। দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’

বকুল এখন নিশ্চিন্তভাবে ঘাবড়ে গেছে। সে কোথায় বসবে বুঝতে না পেরে পেছু হটতে হটতে ড্রয়িংরুমে এসে পৌঁছল এবং একটা মোড়াতে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ল একটা ছোটখাটো, সুদৃশ্য বুককেসের ওপর যার মাথায় ছিল একটা চ্যাপ্টা আকৃতির পুষ্প সংরক্ষণী। জিনিসটা খুব সময়ে ধরে ফেলেছিল সোনা। নয়তো অপ্রস্তুতের একশেষ হতে হত।

মিসেস গুপ্ত বললেন—‘দাও। ওটা আমার হাতে দাও।’ তিনি ওটা এবং আরও ডজনখানেক নানান সাইজের পুতুল-টুতুল যেগুলো ইতি-উতি সাজানো ছিল সেগুলো তুলে নিয়ে শোবার ঘরে রেখে এলেন। বকুলদের উপস্থিতিতে এই সমস্ত শিল্পসম্মত সাজসজ্জা স্পষ্টই নিরাপদ নয়। বকুল খুব অপদস্থ মুখে বসে থাকল।

বউদি উদার গলায় বললেন—‘শরদিন্দুবাবু ভালো আছেন তো?’ বকুল খুব উৎসাহের সঙ্গে জানাল—‘শরীরটা খুব ভালো নেই। প্রেশারটা বেড়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গের ওখানেই ইতি হয়ে গেল। স্বামীর প্রেশারের সূত্র ধরেও বকুল কোথাও পৌঁছতে পারল না।

বউদি বললেন—‘আমাদের আবার এদিকে ছটায় কলামন্দিরে ফাংশন। না গেলেই নয়। বাবুয়া, তুমি আর একটু পরেই রেডি হবে, টেনিস আছে।’

বকুল বড় বড় চোখ করে বলল—‘তাই না কি? তবে তো খুব মুশকিল!’

মিসেস গুপ্ত মনে মনে বললেন, ‘মুশকিল বইকি! তবে তোমার নয়, আমার।’ মুখে বললেন—‘মুশকিল আর কি? এখন সবে পৌনে চার। আমাদের বেরোতে এখনও ঘণ্টা দেড়েক দেরি আছে।’ বকুল ভাবলো—সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় যে তাদের আসতেই লেগেছে।

মিসেস গুপ্ত বাবুয়াকে বললেন—‘তুমি যাবার আগে কমলাকে বলে যাও, ওদিকের দোকান থেকে একটু কচুরি-মিষ্টি কিনে দিয়ে যাবে।’

শুস্তা সেজেগুজে বেরিয়ে এসেছিল, বলল—‘বা রে, আমাদের যে খেতে দাও না, বলো অসুখ করবে। আজ বুঝি পিসিদের জন্যে। আমিও খাবো।’

এই সব অবোধ বালিকাদের সফিস্টিকেটেড, কালচার্ড পরিশীলিত, মার্জিত, যুবতী বানাতে যে কি পরিমাণ হতাশা-মিশ্রিত মেহনত! ভাবলেন মিসেস গুপ্ত। বিমানবাবু তখন থেকে ধূমপান করে যাচ্ছেন। মুখটা ঈষৎ লালচে।

পিতার মৃত্যুর ছ মাসের মধ্যে স্ত্রীর পৌরোহিত্যে বড় বোন বকুলকে মফস্বলী পোস্টমাস্টারে পাত্রস্থ করেছিলেন। পরের বোনটি লেখাপড়ায় দারুণ চৌখস। বিয়ে-থা করতে চায়নি। বহুদিন ইংলন্ড প্রবাসী। পরের ভাইও বোম্বাইয়ে থাকে। কাছাকাছি। বলতে এই বড় ভাই আর বড় বোন। কিন্তু প্রচুর হিসেবপত্র করে না চললে আর আজকালকার দিনে চাকরি করে বাড়ি তোলাও সম্ভব নয়, ছেলেমেয়েকে মনের মতো মানুষ করাও অসম্ভব। আত্মীয়স্বজন পরিহার না করলে আর…। তা ছাড়া লীনা। লীনা হচ্ছে তার সময়োচিত রোড বাম্পার। এই ধ্রুবতারাটির অমোঘ সব সংকেতের দিকে স্থির লক্ষ্য রেখে চলে চলেই না তিনি আজ এতো সম্পন্ন!

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কচুরি মিষ্টি খেয়ে বকুল রাজা সোনা এবং কলামন্দিরগামী দম্পতি একই সঙ্গে বেরোলেন। বাসে উঠে রাজা বিরক্ত গলায় বলল—‘এই তো এলাম। একটু খেলতে পেলাম না। কিছু না! বাবুদাদা সারাক্ষণ বই পড়তে লাগল। আমাকে আর কক্ষনো মামার বাড়ি আসতে বলবে না।’ সোনা বাসের জানলা দিয়ে এই শহরে তার একমাত্র পরিচিত লম্বা লম্বা গাছগুলোর হলুদ মাথার দিকে চেয়ে রইল। খুব হাওয়া দিচ্ছে। কিন্তু বকুলের মুখ ঘর্মাক্ত। স্বামীকে বলা আছে—‘রান্নাবান্না রেডি রইল। তুমি আজকের দিনটা কষ্ট করে গরম করে নিও। আমাদের দেরি হলে জানবে রয়ে গেছি।’ আগাম অনুমতিপত্র ছাড়া অবশ্য দাদার বাড়ি থাকবার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সাতগাছিয়া থেকে মেমারি, মেমারি থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে প্রত্যন্ত দক্ষিণ। এই দীর্ঘ যাত্রা এত কম সময়ের মধ্যে দু বার!

লেকের ধারে একটা বেঞ্চিতে সন্তর্পণে বসে পড়লেন মিসেস গুপ্ত। পাশে মিস্টার।

বিমানবাবু বললেন—‘বসলে যে! ওদিকে তো তোমার যামিনী কৃষ্ণমূর্তি আরম্ভ হয়ে যাবে? কবে টিকিট কিনলে? বলোনি তো!’

তেরছা চোখে চেয়ে মিসেস গুপ্ত বললেন—‘কিনিইনি। তার জানাবটা কি?’

—‘তবে?’ বলেই বিমানবাবু চুপ করে গেলেন।

—মিসেস গুপ্ত আত্মগত বললেন—‘গেস্ট খাতে আজ নিয়ারলি টেন।’

বিমানবাবু বললেন—‘হুঁ।’

—‘তা ছাড়া বাবু-শুস্তার ক্যারামেল পুডিংটা খাওয়া হল না।’

—‘রাতে দিও।’

বেশ একটু অন্ধকার হতে, খানিক বেড়িয়ে-টেড়িয়ে বাড়ির পথ ধরলেন উচ্চাভিলাষী দম্পতি। আজ আবার ইনস্টিট্যুট অফ কালচারে প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। গড়িয়াহাটা রোড, সাদার্ন অ্যাভেনিউ সব লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের পাশ কাটিয়ে খুব সুখী, তৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরলেন দম্পতি। জটিল অঙ্ক নিজস্ব বুদ্ধিতে সমাধান হওয়ায় প্রফুল্ল, প্রসন্ন মন। রোববারের সন্ধেটা বকুলের দৌলতে খোলা হাওয়ায় কাটল।

ছেলেমেয়ে অনেকক্ষণ এসে গেছে। শুস্তা ঘুমে ঢুলছে। বাবুরও বড় বড় হাই উঠছে। ওদের তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিয়ে মিসেস গুপ্ত কমলাকে বললেন নিজেদের জন্য টেবিল লাগাতে। রাত নটা। ঠিক ডিনারটাইম। বেল বেজে উঠল। অ্যাতো রাতে? অসময়ে গেস্ট আসার কি আজ হিড়িক পড়েছে? সারা মুখে বিরক্তির হিজিবিজি নিয়ে মিসেস গুপ্ত নিজেই দরজার ফুটোয় চোখ লাগালেন। পরক্ষণেই তাঁর চেহারা-চলন-বাচনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিল। তড়িৎগতিতে দরজা খুলে দিয়ে হল্লা করে উঠলেন তিনি, গিটকিরি দিয়ে গমকে গমকে হাসি। —‘আরে আরে, হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! আসবার সময় হল তা হলে? বিমান, শুনছ! বাবু, শুস্তা দেখে যাও, কুইক, কে এসেছে।’

বাইরে একটি সাহেবি চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সঙ্গে খাটো রুপোলি চুল, শাড়ি পরা বিদেশিনী মহিলা, পাশে হিন্দুস্থানী আয়ার হাত ধরে একটি ফুটফুটে বালিকা, এঁরা মিসেস গুপ্তর মাসতুত দাদা, জার্মান বউদিদি এবং তাঁদের প্রৌঢ় বয়সের একমাত্র সন্তান শ্রীরাধা। দাদা আই এফ এস। ফরেন সার্ভিসে যারপরনাই উঁচু পোস্টে আছেন। বিদেশেই থাকেন। দেশে কখনও সখনও ফিরলেও আসবার সময় সুযোগ করে উঠতে পারেন না। সবাই ভেতরে ঢুকে এলেন।

ড্রয়িং রুমের গোলাপি বাতির সম্মোহন জ্বলে উঠল। লীনা গুপ্ত বললেন—‘মোটে কিন্তু ন’টা। এক্ষুনি যাই-যাই করলে চলবে না। একবার যখন পেয়েছি ডিনার খাইয়ে তবে ছাড়ব। গতবার শুস্তার বার্থডে পার্টিতে তো আসব বলে এলে না—।’ শেষের দিকে মিসেস গুপ্তর ঠোঁট সামান্য ফুলল।

বিমানবাবু এয়ার-ইন্ডিয়ার মহারাজার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে দু কান ছোঁয়া হাসি। বাবু শুস্তার চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে। কিন্তু মিঃ শুভরূপ মজুমদার বা তাঁর প্ল্যাটিনাম ব্লনড্ স্ত্রী হিল্‌ডা মোটে বসছেনই না। এঁদের সাড়ম্বর অভ্যর্থনারও কোন জবাব নেই। কিরকম একটা আড়ষ্ট নীরবতা। হিন্দুস্থানী আয়াটির মুখ একবার লাল একবার নীল হচ্ছে লক্ষ্য করে অবশেষে মিঃ মজুমদার একটু মরিয়া এবং রূঢ়ভাবেই বলে উঠলেন—‘উই আর ইন আ হারি লীনা। ইন ফ্যাক্ট ভীষণ জ্যামে পড়ে গেছি। গাড়ি একদম মুভ করছে না। এদিকে প্রবলেম হয়েছে..এই পদমা মানে রাধার আয়া…মানে ইন ফ্যাকট ও একটু তোমাদের টয়লেটটা ইয়ুজ করবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *