উত্তর পক্ষ
গল্পটা নাজমা চৌধুরীর।
যে নাজমা চৌধুরী মফস্বল শহরের রাত সাড়ে সাতটার প্ল্যাটফর্মে দু ভাঁজ করোগেটেড শেডের তলায় বিদেশি পারফিউমের মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে ব্যস্তভাবে ঘড়ি দেখতে দেখতে এইমাত্র এসে দাঁড়ালেন। নেভি-ব্লু রঙের জমকালো বাংলাদেশি ঢাকাই পরেছেন। সাদা কাজ। সাদা শালের ওপর শলমার কাজ করা পঞ্চো। কানে ছোট ছোট দুটো স্বচ্ছ পাথর। ডান হাতের অনামিকায় একটা অনুরূপ বড় পাথর। সাঙ্ঘাতিক ঝলসাচ্ছে।
নাজমা চৌধুরীই পূর্বপক্ষে।
শীতকালের সন্ধে। তার ওপর অসময়ের টিপির টিপির বৃষ্টি। স্বাভাবিক নিয়মেই স্টেশন জনশূন্য। একটা কুলি কি রেলকর্মীর চেহারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ফিরিঅলাগুলোও লোপাট। করোগেটেড শেডের ওপর বৃষ্টির টুং-টাং মোটেই কানে জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে না। রেডিওর রোমাঞ্চ-নাটকের গা শিরশিরে আবহসঙ্গীতের মতো শোনাচ্ছে বরং। ফ্লোরেসেন্ট বাতির মৃদু ঠেলায় অন্ধকার সামান্য হঠে গিয়ে বেহায়া বেড়ালের মতো ওত পেতে আছে। ওরা বলে গেছিল কুলিদের জিজ্ঞেস করলেই লেডিজ কামরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে বটে, কিন্তু এতো রাতে লেডিজে না ওঠাই নিরাপদ। ওরা মানে অবশ্য বহুবচন নয়, একবচনই। লিলির মাসতুত দাদা না কে, যে অত্যুৎসাহী ব্যক্তি বিয়ে-বাড়ির শতকাজ তুচ্ছ করে নাজমা চৌধুরীকে আড়াই-তিন মাইল দূরের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে তো গেছেনই, নিতান্ত চক্ষুলজ্জাবশত আরও বেশি দূরে গিয়ে উঠতে পারেননি। পৌঁছে দেবার ভার নিয়ে ভদ্রলোক যখন স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডের কোনদিকের পাল্লাটা খুলবেন ইতস্তত করছিলেন, অভদ্রতা হবে জেনেও নাজমা মৃদু টানে পেছনের পাল্লাটা খুলে ফেলেছিলেন।
গায়ে-পড়া পুরুষমানুষ কোনদিন বরদাস্ত করতে পারেন না নাজমা। শিভ্যালরি বলে একটা মেয়ে-ঠকানো শব্দ আছে বটে। কিন্তু সত্যিকারের দায়িত্ববোধ ও গায়ে-পড়া স্বভাবের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। অনভিজ্ঞ মেয়েরা ধরতে পারে না। নাজমা সতের বছর বয়স থেকে সমাজসেবামূলক কাজের সুবাদে সভা-সমিতি-মিছিল-বক্তৃতা ইত্যাদি করে করে হরেক মুখোশের মোকাবিলায় অভ্যস্ত। কোন মেঘ তাতমেঘা আর কোন মেঘে বৃষ্টি হবে দেখবামাত্র বলে দিতে পারেন। ফুলদানিতে কাগজের ফুলের মতো নিষ্প্রাণ একটা শালীন হাসি ঠোঁটে সাজিয়ে রাখেন। অভদ্র কেউ বলতে পারবে না, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটা তাপমাত্রার ব্যাপার আছে। লিলির মাসতুত দাদার বেলায় হাসিটা হিমাঙ্কর কাছাকাছি ছিল।
ফিরতি টিকিটটা ভাগ্যিস নেমেই কিনে নিয়েছিলেন। বাঙালি জাত সত্যিই বড় দায়িত্বজ্ঞানহীন। নিজেদের খেয়াল চরিতার্থ করা বা ভদ্রতা করা যে নামেই ডাকা যাক না কেন আজ ওরা যেটা করল তার নাম জবরদস্তি। ফলটা ওদের নয়, তাঁকেই ভোগ করতে হবে।
তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন বলেই কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটেয় বিয়ে-বাড়ি পৌঁছনো। দু ঘণ্টার জার্নি। এসেছেনও সেন্টারের বার্ষিক হিসেব-নিকেশের কাজ আধা-খেঁচড়া ফেলে রেখে। এদিকে পরের মাসেই অডিট। পাঁচটা পঁয়ত্রিশের ট্রেন ধরে ভেবেছিলেন সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ হাওড়া পৌঁছে যাবেন, সেখান থেকে পার্ক সার্কাস আধ ঘণ্টা, কেননা অফিস টাইম পার। কোথায় কি? লিলিদের বাড়ি যখন পৌঁছলেন তখন কনে অর্থাৎ লিলি দু-তিন জন বন্ধু নিয়ে বিউটি স্লিপ দিচ্ছে। মা মাসিমা শ্রেণীর গিন্নি-বান্নিরা পান চিবোতে চিবোতে ঝিমোচ্ছেন। পুরুষমানুষরা বোধহয় সবাই রান্না ও ডেকোরেশনের তদারকিতে। বিয়ের লগ্ন নাকি রাত একটায়। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে যাবার কথা শুনে সব যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘নাজমাদি, তুমি বলতে পারলে কথাটা? ভগবান না করুন, বিয়ে তো আর বার বার করছি না! আর সেই আমার একমাত্র বরের সঙ্গে একমাত্র বিয়েতে এসে তোমা হেন লোক কিছু মুখে না দিয়ে চলে যাবে?’
‘বা রে, আর আমার ফেরা? ট্রেনে নিয়ারলি দু ঘণ্টার পথ, তারপর বাস, সে খেয়াল আছে? স্টেশন থেকে তোমাদের বাড়ি আসতেও তো তিন সাড়ে তিন মাইল মনে হল।’
‘আজকে তো থেকে যেতে পারো নাজমাদি, থেকে যাও প্লীজ। হিন্দু বিয়ে তো তুমি অ্যাট ক্লোজ-কোয়ার্টার্স দেখোনি!’
নাজমা মনে মনে বললেন, ‘দেখে আর কাজ নেই। গোহাটায় সস্তা দরে বিকিয়েছ। এবার ঘটা করে তোমায় দাগানো হবে। তারপর ঈদের উটের মতো জবাই। থ্রি-ফোর্থ গলাকাটা, ওয়ান-ফোর্থ দিয়ে বাকি জীবন পরিত্রাহি চেঁচিও। দেখার আর আছেটা কি?’ মুখে বললেন ‘আসছে কাল বারুইপুরে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর প্রোগ্রাম আছে না? তুমি না হয় উদ্বাহর জন্য ছাড়া পেলে, আমাদের বেলাও কি সে একসকিউজ খাটবে?’
‘আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতে গাড়ি তো যাবেই। ছটা পঞ্চান্নর লোক্যালটা ঠিক ধরিয়ে দেব। কি রে সুকান্তদা, পারবি না?’
সুকান্তদা, যিনি আলাপ হয়ে পর্যন্ত ‘কি রে লিলি, ডাকছিলি?’ বলে অন্তত পাঁচ-ছবার ঘরের মধ্যে আসা-যাওয়া করলেন, আকর্ণ হেসে জানালেন, শুধু স্টেশন কেন? দরকার হলে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতেও রাজি আছেন। তবে তাতে করে কনের পিঁড়িটা হয়ত আর ধরা হয়ে উঠবে না। নাজমা তাঁর হাসির তাপাঙ্ক এই সময়েই ঝটিতি কমিয়ে ফেলেছিলেন। যেসব বাদশাজাদারা মোগলাই আমলে কেল্লার প্রাচীর থেকে রুমাল ছুড়ে ছুড়ে নর্মসঙ্গিনী যোগাড় করত, কয়েক জেনারেশন পর এখন তারাই সুকান্তদা, প্রশান্তদা, রফিকদা, জলিলদা হয়ে পকেটের রুমাল মোচড়াতে মোচড়াতে আনাচে কানাচে সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এ বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
এর পরেই লিলি সাজতে বসে গিয়েছিল, এবং সাজতে বসলে যুবতী তো যুবতী, প্রৌঢ়াদেরই হুঁশ থাকে না। মেকাপ, গ্লীমার, আই-শ্যাডো, ব্লাশ-অন, লিপস্টিক, লিপগ্লসের অরণ্যে বিলকুল গায়েব। লিলি মায়ের একমাত্র মেয়ে। তিনি ব্যস্ত। সবারই দেখা গেল কাছাখোলা অবস্থা। নাজমা দু-তিনবার সবার অলক্ষ্যে টুক করে কেটে পড়বার চেষ্টা করে ছিলেন। প্রত্যেকবারই কারো না কারো চোখে পড়ে গ্রেপ্তার হয়ে ফিরে এসেছেন। খাওয়াই হল সাড়ে ছটায়। কনের ঘরে আলাদা করে যেটুকু রান্না হয়েছে তুলে আনা, এবং সারাক্ষণ লিলির মাসিমা জোড়হস্ত। ‘বড্ড দেরি করিয়ে দিলুম, দরকার হলে সুকান্ত আপনাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেবে, ভাববেন না।’
লিলি বলল, ‘ভাবনা? নাজমাদির? ভয়-ভাবনা কাকে বলে জানলে নাজমাদিকে আর শক্তি সেন্টারের সেক্রেটারি হতে হত না মাসি। তোমাদের মতো কেবলু পার্টি না কি?’
নাজমা মৃদু হেসে সায় দিয়েছিলেন, ‘ভয়ের কথা হচ্ছে না, কিন্তু সুবিধে-অসুবিধেও তো আছে?’
—‘তেমন তেমন বুঝলে না-হয় থেকেই যান না? না কি গরিবের বাড়ি থাকতে খুব কষ্ট হবে?’
থেকে-টেকে যেতে নাজমার খুব আপত্তি। চেনেন না, শোনেন না, বিয়েবাড়ির পাঁচ-মিশালি ভিড়, তার ওপর নিশ্চয়ই সারাটা রাত বর-কনেকে নিয়ে যত রকমের নাক-কান-কাটা ইডিয়টিক রসিকতা চলবে। এর মধ্যে রাত কাটাবার কথা চিন্তাই করতে পারেন না। সংক্ষেপে বললে ‘বাবাকে বলা নেই।’
‘তুমিও বাবাকে বলার ভয়ে ঘাবড়াবে নাজমাদি?’ ভ্রূ ভঙ্গি করে বলেছিল লিলি। স্বাধীনতা আর খামখেয়াল যে এক বস্তু নয় হাজার চেষ্টাতেও সেকথা এদের এখনও বোঝানো গেল না। না-ফেরার হলে অবশ্যই তিনি আলিসাহেবকে বলে বেরোন।
এখন প্ল্যাটফর্মের টিমটিমে আলোর ওধারে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জাফরির দিকে তাকিয়ে মনে হল থেকে যাওয়াই বোধহয় উচিত ছিল। কতবার কত অজানা, অপরিচিত জায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে। বিহারের ভাঙ্গি পল্লীতে, পিলখানার দরিদ্র মুসলমান পাড়ায়। আনাজের খোসা, পেঁয়াজ-রসুনের তীব্র গন্ধ, শূয়োরের নাদি, পেচ্ছাপ-পায়খানার মধ্যে। সমাজসেবিকার আবার স্থান-কালের বিচার। আসল কথা, মন নিজের অজ্ঞাতেই কাজ আর সামাজিকতার মাঝখানে একটা দেয়াল তুলে দেয়।
সাতটা পঁয়তাল্লিশের ট্রেন। কোনও মানে হয়? যত সময় যায় লোক্যালের সংখ্যা ততই কমিয়ে দেয় এরা। ছটা পঞ্চান্নর পর এই সাতটা পঁয়তাল্লিশ। মাঝখানে কিচ্ছু নেই। লিলির সুকান্তদা অবশ্য ট্রেনে তুলে দিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বরফের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেছে। দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখতে পেয়ে তৎপর হলেন নাজমা। লেডিজ কামরাটা পরক্ষণেই সামনে দিয়ে শটাশট চলে গেল। এক্কেবারে ফাঁকা। এখন অবশ্য আর বিচারের সময় নেই। সামনে যেটা পেলেন সেটাতেই উঠে পড়লেন নাজমা। মন্দ ভিড় নয়। তবে জায়গা হল দুই ভদ্রলোকের মাঝখানে, একধারে সরে গিয়ে মহিলাকে পাশটা ছেড়ে দেবার ভদ্রতাও যাঁদের নেই।
জ্ঞান হয়ে থেকে আজ অবধি যা দেখলেন তাতে করে নাজমা বুঝে গেছেন এই পুরুষ জাতটার মতো পাজির পাঝাড়া আর নেই। আইন-শৃঙ্খলা এবং গুটিকয় সামাজিক বাধ্য-বাধকতার চাপে পড়ে আনরুলি আদিম থাবা চারটি কোনমতে গুটিয়ে-সুটিয়ে রেখেছে। সুযোগ পেলেই সুযোগ নেবে। দু পাশে শীতসন্ধ্যার আলকাতরা অন্ধকার চিরে পাগলের মতো ছুটে চলেছে ট্রেনটা। সাত থেকে বত্রিশ এই দীর্ঘ সময় নাজমাও এই রকম একটা নিকষ অন্ধকার চিরে প্রাণপণে ছুটে চলেছেন। কত শত ডিসট্যান্ট সিগন্যালের রক্তচক্ষু হুঁশিয়ারি, নাজমা ভ্রূক্ষেপও করছেন না। কোনও উটকো জায়গায় থেমে অমূল্য জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করতে চান না তিনি। তাঁর লক্ষ্য পরিপূর্ণ মুক্তি। সেই মুক্তি যার প্রথম ধাপ স্বাধীনতা এবং যা কোনক্রমেই কারো উপহার দেবার জিনিস নয়। পরিপূর্ণ আত্মনির্ভরতা কাকে বলে নাজমা প্রায় জেনে ফেলেছেন এবং সম্ভব হলে এই আত্মনির্ভরতার শিক্ষা তিনি অন্তত তাঁর নাগালের মধ্যে যেসব মেয়ে আছে তাদের দিয়ে যেতে চান। তা, সে চৈতন্য থাকলে তো! তিনি নিজে মাত্র সাড়ে আট বছর বয়সে পাড়ার মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন নানীর প্রেরণায়। মাদার মেরিয়নের কাছে স্বাধীনতার শিক্ষায় হাতেখড়ি তাঁর। মুর্শিদাবাদের চাষী-গ্রামের নবাবগৃহের লোহার পর্দা ছিঁড়ে মাকে নিয়ে বাবার কাছে তাঁর কর্মস্থলে চলে আসবার যুদ্ধটা তো প্রায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শামিল! কারণ, সাড়ে দশ বছরের নাতনি দুর্দান্ত তেজী রাগী দাদু নওশের সাহেবের হাত কামড়ে ধরেছিলেন। হঠাৎ হেসে ফেলে রাগী মানুষটি বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা যা। দেখি তোর দৌড় কোন মসজিদ পর্যন্ত। বাপের নিকাহ্ ঠেকাতে পারিস তো যা।’
তা ঠেকিয়েছিলেন নাজমা। মা যা পারেননি, মেয়ে তা পেরেছিল। তাই-ই মনে হয় নিজেদের উদ্যোগ, নিজেদের চৈতন্য দরকার। তা নয়ত অবলাবান্ধব তো মন্দ এলেন না গেলেন না। তা সত্ত্বেও এই বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বউ-পোড়ানো এবং খোমেইনি! বাইরের চেহারাটা বদলানো ছাড়া আর কিই বা হয়েছে? বোরখা খসলেই যদি ভেতরের পর্দা খসত! তা ছাড়া এখন তো ক্রীতদাসীদের হাতে-পায়ে আর একখানা বাড়তি শেকল। রোজগার করতে বেরোচ্ছ তো কি? তোমার সংসারের খুঁটিনাটি কি মিঞা-বাবু দেখবেন? লেখাপড়া শিখেছ? বহোত আচ্ছা! ছেলেমেয়েদের শেখাও। ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ার পবিত্র দায়িত্ব নিতেই তো তোমার জন্ম, তোমার শিক্ষা-দীক্ষা। গৃহকর্ম তুমি করবে না তো কি পুরুষরা করবে? ছিঃ! পৌরুষ থাকবে তা হলে? বেরোচ্ছই যখন বাজারটা কম-সম টাকায় বুদ্ধি করে কিনে আনো। ইলেকট্রিকের বিল? ওতো অফিসের পথেই পড়ে। কেরোসিনের লাইন, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, ডাক্তার, তাই বা বাদ যায় কেন? ইত্যবসরে তোমার গর্দানে আরামকেদারা পেতে খাটাখাটনিতে ক্লান্ত পয়গম্বরগুলি একটু বাড়তি নিদ্রা দিয়ে নিন। নারী-স্বাধীনতা। হুঃ!
আরেক দল আছেন যাঁরা ব্রা ছিঁড়ে, লিভিং টুগেদারের নব্য ইজমে দীক্ষিত হয়ে শার্ট পেন্টুলুন পরে উইমেনস লিবে শামিল হয়েছেন। জীনস নাজমাকেও পরতে হয়, কিন্তু সেটা নিতান্তই কাজের পোশাক। রাজদ্বারে, উৎসবে, গোরস্থানে সর্বত্র ব্লু জীনস আর টাইট ভেস্ট পরে চুলছাঁটা। যেসব মহিলা লিবের পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা হল সত্যিকারের প্রবলেম এই নারী-স্বাধীনতা যুগের। শক্তি সেন্টারের সেমিনার সিম্পোজিয়ামগুলোতে এসব নিয়ে খুব দক্ষ এবং শৃঙ্খলাসম্মত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন নাজমা। মুক্তির সংজ্ঞা কি? সমান অধিকার বলতে কি বোঝায়? নারীর অস্তিত্বের বায়োলজিক্যাল তাৎপর্য ছাড়া আর কোনও স্বতন্ত্র মূল্য আছে কি না। সে কি সত্যিই দ্বিতীয় লিঙ্গ? দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এই পৃথিবী গ্রহে?
এই ধরনের সিমপোজিয়ামে সিরাজ সব সময় উপস্থিত থাকে। টাকাকড়ির জোরে একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার তো হয়েছে! নারী-মুক্তি না হলে যেন আর ঘুম হচ্ছে না! সিগারের মতন আবার মুখে ঝোলে বক্র হাসি। বোদ্ধার মত আবার মন্তব্যও করা চাই ‘উইমেন নীড প্রোটেকশন নাজমা, অ্যান্ড দে নীড ম্যানস লাভ।’ জনান্তিকে মুখ ঝামটা দ্যান নাজমা ‘হোয়াট ডু ইউ মীন? এই সেন্টারে আমি প্রতিটি মেয়েকে জুডো, কারাটে, লাঠিখেলা, ছোরা খেলা শেখাচ্ছি, তা জানো? আর ওই লভ বস্তুটা কি? অন হুইচ উইমেন আর সাপোজড্ টু থ্রাইভ? কত পার্সেন্ট ওর সেক্স? কত পার্সেন্ট ব্লাস্টেড ওয়ান সাইডেড, সোশ্যাল কনট্রাক্ট? আর কত পার্সেন্ট নির্ভেজাল, নির্লজ্জ সুবিধেবাদ?’ সিরাজ তখনও হাসে, বলে ‘আই ক্যান ডেমনস্ট্রেট, ইফ ইউ অ্যালাউ নাজমা, বস্তুটা ঠিক কি এক্সপ্লেন করতে তো পারব না। মুরুক্ষু সুরুক্ষু মানুষ!’
ঘড়ির কাঁটায় চোখ পাতলেন নাজমা। মোটে সাড়ে আট। অনেকগুলো স্টেশন পেরিয়ে গেছে। কামরার ভিড় এখন পাতলা। দুপাশে দুই কলাগাছের মতো অভদ্র ভদ্রলোকদ্বয় কখন নেমে গেছেন। জানলার ধারে সরে গিয়ে কাচটা তুলে দিলেন নাজমা। দু-একটা জলের ফোঁটা কনুয়ের ওপর পড়তে গা শিরশির করে উঠল। কনুইটা সরিয়ে নিলেও কাচটা বন্ধ করলেন না তিনি। বাইরের হাওয়া এসে ভেতরের ঘাম-দুর্গন্ধ-অলা বাতাস শুদ্ধ করে দিয়ে যাক। হাওয়ার ঝাপটায় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর, নাকের ওপর সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ভারী মনোরম একটা অনুভূতি। আপাতত দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত পার হচ্ছে ট্রেনটা। অন্ধকারেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। ঝোপঝাড়ের গায়ে গায়ে থোকা থোকা জোনাকি আটকে আছে। আঁকাবাঁকা খেজুরগাছগুলো কোমরভাঙা বৃদ্ধার মতো নিরাসক্ত দৃষ্টিতে অপস্রিয়মাণ ট্রেনটাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। প্রকৃতির সঙ্গে সব সময়েই একটা একাত্মতা অনুভব করেন নাজমা। প্রকৃতি কি শুধুই প্রসবিত্রী? গভীর, বিরাট, সুন্দর, রহস্যময়, অনন্ত শক্তির রোমহর্ষকারী খেলার পটভূমি এই প্রকৃতি স্বরূপত কি? নারীই বা স্বরূপত কি? কোন বিশেষ প্রয়োজনে সে ভিন্ন হল? শুধু জৈব প্রয়োজন? কে জানে! মন সায় দেয় না যেন। কিন্তু সে যা-ই হোক না কেন। রুচিবোধ, সৌন্দর্যবোধ পরিমিতিবোধ এগুলো যে নারীনামক রহস্যময় আধারের শাশ্বত আধেয় এতে বোধহয় কোনও সন্দেহ নেই।
সেন্টারে এক মহিলা আসেন তাঁর পশ্চাদ্দেশ বেখাপ্পা রকমের বিপুল। সেক্রেটারি হিসেবে তাঁকে বলা ভালো মনে করেছিলেন নাজমা, ‘মিসেস বিশ্বাস, আপনি কিন্তু শাড়ি পরলেই বুদ্ধিমতীর কাজ করবেন।’
‘কেন?’
‘শাড়িই আপনার ফিগারে বেশি মানাবে।’
‘ও। কিন্তু এই ফিগারের ছেলেরা কি অফিস যাবার সময় পেন্টুলুন পরে না?’
‘অবশ্যই পরে। কিন্তু আপনার বিশেষ সুবিধে এই যে আপনার বিকল্প রয়েছে।’
‘বিকল্পটা গ্রহণ করব কেন? আর একটু সুন্দর দেখাবার জন্য?’ যাতে চারপাশের পুরুষগুলো একটু বেশি ডিগ্রিতে চোখের আরাম পায়? যদিও প্যান্টেই আমি কাজের সময় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি?’
অকাট্য যুক্তি। এর উত্তরে নাজমা কিছু বলতে পারেননি। বলতে পারেননি—‘নারী মুক্তি মানে নারীত্ব বিসর্জন দেওয়া নয়।’ বলতে পারেননি—‘মিসেস বিশ্বাস, আপনি শোভন হন শুধু পুরুষের চোখের আরামের জন্য নয়, আমাদের, মানে মেয়েদেরও চোখের কথা ভেবে। মেয়েরা সুন্দর হয় শুধু সুন্দর হবার জন্যই।’
আসলে সমস্ত ব্যাপারটা খুব জটিল। এই ধরনের ভুল প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক। কঠিন, খুবই কঠিন সমস্যাটা। একদিকে উপযোগবাদ আর একদিকে সাম্যবাদ। দুয়ে মিলে সৌন্দর্যবোধের মাথা খেয়েছে।
কামরার মধ্যে চোখ ফেরালেন নাজমা। কেমন একটা অসোয়াস্তি। কিসের? যেন বাইরের প্রকৃতি সমেত নাজমার ভাবনার জগৎ আর এই কামরার ভেতরটা দুটো পৃথক গ্রহ এবং এই গ্রহ অতি বিপজ্জনক বিষ বাষ্পে ভরা। কেন এমন মনে হচ্ছে বোঝবার জন্য শিক্ষিত শিকারী কুকুরীর মতো নাক উঁচু করে কামরার বাতাস ফুসফুসে টেনে নিলেন নাজমা। তারপরেই বুঝতে পারলেন। দু-এক বেঞ্চি দূরে, সামনের দিকে, তাঁর ঠিক কোণাকুনি একটা লোক বসে। রুক্ষ, রূঢ় চেহারা, ছড়ানো চোয়াল, গালের ওপর বাসি দাড়ি এবং দু-চারটে মাংসের ডুমকি উঠে আছে। চেক-চেক একটা সস্তার শার্ট এবং টেরিকটের আধ ময়লা প্যান্ট পরনে। গায়ের ওপর একটা পাটকিলে রঙের চাদর ফেলা। লোকটা তীক্ষ্ণ, চোরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। খোলা ছুরির মতো দৃষ্টিটা তাঁকে বিঁধছে। দৃষ্টিটা অনুসরণ করে নিজের ডান হাতের অনামিকায় পৌঁছলেন নাজমা। এইটাই ওর চাঁদমারি মনে হচ্ছে। নাজমার ডান হাতের অনামিকায় সাড়ে আট রতির অতি নিপুণ কাটিং-এর একটি হীরে, হোয়াইট-গোল্ডের ওপর সেট করা। ‘এই হীরের এখনকার বাজারে কত দাম হতে পারে আন্দাজ নেই নাজমার। বুড়ি নানী নুরাতুন বেগমের মৃত্যুশয্যায় আদরের নাতনির আঙুলে স্থানান্তরিত হয়েছিল এই ফ্যামিলি এয়ারলুম। সে আজ নয় নয় করে দশ বচ্ছর তো হবেই। নানীর অনেক দুঃখের সাথী, ব্যথার ব্যথী ছিলেন তরুণী নাজমা। সৈয়দ বংশের মেয়ে, সৈয়দ বংশে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু নানার তিন বিবি। সতীন এবং সতীন পুত্রকন্যাদের বিষ কণ্ঠে ধারণ করে দেহে-মনে বড় কম জ্বালা ছিল না নানীর। এ আংটি নাকি আর্জুমন্দ বানু বেগমের, কোন মীনাবাজারে যুবরাজ খুর্রামের গোপন প্রণয়োপহার। স্বামীর প্রেমের ধাক্কায় অবশ্য বছর বছর সন্তানধারণ করে স্রেফ রক্তশূন্যতা রোগেই মারা গেলেন তিনি সারা হিন্দুস্থানের অধিশ্বরী হয়ে। অবশ্যই তাজমহল নামক বিশ্ববিশ্রুত স্থাপত্যের উপলক্ষ গড়ে দিতে। নানীর নির্বন্ধে কখনও আংটি হাত থেকে না খোলবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নাজমা। তখনও দিনকাল এতো খারাপ ছিল না। হাত বাড়িয়ে বাসের জানলা দিয়ে হার-ছিনতাই, কি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিনদুপুরে কান থেকে দুল খুলে নেওয়া এ ধরনের অরাজকতা এ রকম ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। অনায়াসেই প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন তিনি। আসলে ইতিহাসের টান নয়। এ আংটি তাঁর নানীর ভালোবাসার প্রতীক। এ অঙ্গুরী তাঁর লড়াইয়েরও প্রতীক। মায়ের লড়াই, দিদিমার লড়াই, মমতাজের লড়াই। অনেক বদখত জায়গায় কর্মসূত্রে যেতে হয়েছে, আংটিটা কখনও হাত থেকে খোলেননি নাজমা। আজও একজন বলেছিলেন—‘ট্রেনে যাচ্ছো, ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে যাবে, আংটিটা খুলে অন্তত ব্যাগে নিয়ে নিও নাজমা।’ নাজমা কান দেননি। অদূরের কোণে বসা লোকটার লোভাতুর দৃষ্টি এখন সেই আংটির ওপর চক্রধর সাপের মতো ছোবল মারছে।
কড়ে আঙুলের চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে আংটিটাকে ঘোরাতে লাগলেন নাজমা। মুঠোর মধ্যে এখন হীরেটা। হাতের পাতায় চাপ লাগছে। হাতটা মুঠো করে পঞ্চোর মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে নিলেন। যেন এমনিই করছেন শীত করছে বলে। পঞ্চোটাকে গুটিয়ে-সুটিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। লোকটার দিকে একবারও তাকালেন না। যেন লক্ষ্যই করেননি। কিন্তু লক্ষ্য না করলেও বুঝলেন লোকটা মারাত্মক রকম উত্তেজিত হয়ে আছে। পা দুটো বেগে দোলাচ্ছে। হাঁটুতে হাঁটু লেগে যাচ্ছে। হাতগুলো কোথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার হাঁটুর ওপর, তারপর বুক-পকেটে, তারপর মুখে বুলিয়ে নিল, কাঁধের চাদরটা ঠিকঠাক করে নিল। বিড়িতে ঘনঘন ফুঁ দিচ্ছে। খালি ওস্তাদ তীরন্দাজের মত দৃষ্টি লক্ষ্যে স্থির। লোকটা বোধহয় কোন কারখানার শ্রমিক-ট্রমিক হবে। প্রচণ্ড পেশল চেহারা। দাগী গুণ্ডা বদমাস বোধহয় নয়। নাজমা নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করলেন। কামরায় এখন সবশুদ্ধ পাঁচজন লোক। এক বুড়ি, চালের পুঁটলি কোলে তাঁর পাশে বসে ঢুলছে। ওই লোকটা, তিনি, আর দুটি গ্রাম্য লোক পেছনের দিকের বেঞ্চে বসে বিড়ি খেতে খেতে গল্প করছে। ওরা নেমে যাবে না তো? একবার মনে হল ওদিককার লোক দুটির কাছে গিয়ে সাহায্য চান। কিন্তু ও লোক দুটিই কি স্বাভাবিক? সাহায্য চাইতে গেলে অপমান করে বসতে পারে। দ্বিগুণ বিপদে পড়তে হতে পারে। কানের পাথর দুটো আজকালকার বাজার-চলতি আমেরিকান ডায়মন্ড। এই রকম অতিকায় একটা হীরে পরে প্রকাশ্য রাস্তায় এখন লোকে চলাফেরাও করে না। এটাকেও ঝুটো ধরে নিতে আপত্তি কি? সেইরকম একটা হেলাফেলার ভাব দেখিয়ে ধাপ্পা দেওয়া যায় না?… এখনও কি তাকিয়ে আছে লোকটা? মতলব আঁটছে মনে মনে? না, তবে হার্ডন্ড্ ক্রিমিন্যাল নয়, হলে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ত। লোহাপেটা শরীর, অস্ত্রশস্ত্রও ওদের কাছে থাকে, আজকাল ট্রেন-ডাকাতি হলে সহযাত্রীরা বাধা দেয় না। …আসলে লোভের জিনিস চোখের সামনে দেখে ভেতরের লালসা গর্জে উঠেছে। স্বভাব-ক্রিমিন্যালের ধরন-ধারণ নয়। আড়চোখে একবার চাইলেন নাজমা। চেয়েই শিউরে উঠলেন। লোকটার দৃষ্টি এখন খানিকটা পিছলে গেছে। লোভ আর রিরংসার কি বিকট চেহারা! হঠাৎ বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে বরফজল নামছে। ও কি শুধু হীরেটাই চায়?
রাত নটা। শাঁখ বাজিয়ে ট্রেনটা একটা শূন্য প্ল্যাটফর্মের বুড়ি ছুঁল। পাশের বৃদ্ধা পুঁটলি-কোলে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওদিক থেকে একটা লোক শশব্যস্তে বিড়িটা পায়ে মাড়িয়ে নেমে গেল। এখন আততায়ী আর তিনি ছাড়া শুধু একটি নিম্নশ্রেণীর লোক। নতুন কোনও যাত্রী উঠল না। সেই সময় মাথায় খেলল চিন্তাটা। যেন অন্যমনস্ক ছিলেন স্টেশনের নাম খেয়াল করেননি, এই স্টেশনেই নামবার কথা এই রকম একটা ভাব করে তীরের মত ছুটে গিয়ে নেমে পড়লেন নাজমা। তিন চারটে কামরা বাদ দিয়ে উঠে পড়লেন। এটাতে এখনও বেশ কয়েকজন রয়েছে। জানলার ধারে বসে কাচ নামিয়ে দিলেন। যাক। বিপদের সময় বুদ্ধি হারালে চলে? বুদ্ধিনাশই বেশির ভাগ সময় প্রাণনাশের কারণ হয়ে থাকে। সেন্টারের মেয়েদের শারীর শিক্ষার ক্লাসে তিনি বহুবার জীবনধারণে উপস্থিতবুদ্ধির ভূমিকার কথা বলেছেন! নাজমা হঠাৎ জমে গেলেন। লোকটাও উঠে এসেছে। ওদিককার জানলার ধারে বসে খুব নিশ্চিন্তে একটা বিড়ি ধরাচ্ছে। দেশলাইয়ের কাঠিটা জ্বেলে মুখ নিচু করে বিড়ি ধরাবার মুহূর্তে চট করে একবার দেখে নিল এদিকে। দেশলাইয়ের আগুনের লাল আভায় নাকের পাশের ডুমকিগুলো দেখাচ্ছে রাক্ষসের দাঁতের মতো। না, কোনও ভুল নেই। উদ্দেশ্য স্পষ্ট।
প্রত্যেক স্টেশনে দুজন তিনজন করে লোক নেমে যাচ্ছে। সিমলাগড়… পাণ্ডুয়া… মগরা। কি করবেন নাজমা? নেমে পড়বেন? সন্দেহ নেই লোকটাও নেমে পড়বে এবং হাওড়ার জনাকীর্ণ প্ল্যাটফর্মে যে সুবিধে পেত না, মফঃস্বল শহরের শীত-বৃষ্টির ঝিমধরা রাস্তাঘাটে ওর সে সুবিধে হয়ে যাবে। নাজমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আর একটা মাত্র লোক। সেই লোকটা আরও দুটো বেঞ্চি এগিয়ে এলো। শ্রীরামপুর। শেষ লোকটি টুপ করে খসে গেল। ট্রেন এখনও থেমে রয়েছে। নাজমা বুঝলেন নেমে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। হাওড়া আর মাত্র কয়েকটা স্টপ। একটু সাহস করে কাটিয়ে দিতে পারলেই ফাঁড়াটা কেটে যায়।
চলতে আরম্ভ করেছে ট্রেন। লোকটা আরও দুটো বেঞ্চি এগিয়ে এলো। অপাঙ্গে তাঁকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। ট্রেনের আলো অর্ধেক নেই। কামরার ছাদটা বসন্তে ক্ষত-বিক্ষত মুখের মতো ভয়াবহ দেখাচ্ছে। যে কটা আলো আছে এই বিপুল ভয়ার্ত অন্ধকারে তারা বুড়োটে ঘোলাটে চোখে চেয়ে আছে। বাহাত্তুরে-ধরা নির্লিপ্ত নিঃসাড় চোখ। কণ্টকিত হয়ে নাজমা দেখলেন লোকটা প্রত্যেক বেঞ্চে লাফিয়ে লাফিয়ে বসছে। ডাইনে-বাঁয়ে সর্বত্র। কি এক রহস্যজনক ইন্দ্রজালে অ্যামিবার বাইনারি ফিশনের মতো দু ভাগ হল, চার, তারপর আট, ষোল, বত্রিশ। বিস্ফারিত চোখে নাজমা দেখলেন কামরাময় ছড়িয়ে পড়ছে লোকটার চেক-শার্ট, ঘেমো টেরিকটের প্যান্ট, পাটকিলে চাদর, থ্যাবড়া আঙুলের মাথায় জ্বলন্ত বিড়ি। জোড়া জোড়া শ্যেনচক্ষু তাঁর দিকে নির্মম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখ ভরা ব্রন, মাংসের ডুমো কামরাময় ছড়াচ্ছে, গড়াচ্ছে। এ বেঞ্চি থেকে ও বেঞ্চি, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ঘৃণ্য, পিচ্ছিল পোকার মতো উঠে আসছে সর্বাঙ্গে। লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। কি ভয়ঙ্কর! রুক্ষ, রূঢ় মুখে বাসি দাড়ি, কণ্ঠমণিটা উঠছে, নামছে। গরিলার মতো রোমশ ভয়াল হাত উদ্যত হল। ভয়ে জমে যাওয়া দু হাত সমস্ত শক্তি দিয়ে শূন্যে ছুঁড়লেন নাজমা। স্বপ্নে-ছোঁড়া হাতের মতো তাতে বিন্দুমাত্র জোর ছিল না। এতদিন ধরে যা শিখেছেন, শিখিয়েছেন আত্মরক্ষার সেই-সব করণকৌশল সব স্বপ্নলব্ধ জ্ঞান, স্বপ্নেই মিলিয়ে গেছে। কামরার দুটো আলোর একটা হঠাৎ নিভে গেল। কোন্ স্টেশনের কাছ দিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটা? গাড়ি যেন মন্থর হয়ে এলো? বিপুল ভয়ে জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে নাজমা আবছা দেখলেন চলন্ত কামরায় যেন জাদুমন্ত্রে লাফিয়ে উঠল সিরাজ। কালাকাল ভুল হয়ে গেল নাজমার। ধোঁয়াটে মস্তিষ্কে এলোমেলো চিন্তাগুলো ভেসে গেল… সিরাজ কি তবে ছায়ার মতো তাঁর পিছু নিয়েছিল? এভাবেই কি ও…? এ কি শুধু আজই? না, অনেককাল থেকে? অনেক কাল… কতকাল? ওর সেই পেট থিয়োরি… উইমেন নীড প্রোটেকশন… অ্যান্ড… দে…।
সংবিত ফিরে আসবার পরও সিরাজের শক্তিশালী মুঠোর মধ্যে থরথর করে কাঁপছিলেন নাজমা আর বলছিলেন —‘সভ্যতা যতদিন জঙ্গল, মানুষ ততদিন জানোয়ার। সর্বাত্মক মুক্তি কোথাও নেই। কি ইজ্জৎ কি জহরত, কোনটাই নিজের চেষ্টায় রক্ষা করতে পারিনি, স্বীকার করছি সিরাজ। তোমার লাখ টাকার দেন মোহর আমার চাই না। দুটি স্বাধীনতার নিঃশর্ত মিলনে যে বিবাহ শুধু সেই বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার জীবনভর সংগ্রামের মান বাঁচাও।’ বলছিলেন বটে নাজমা, কিন্তু তাঁর ঠোঁটই বোধহয় শুধু নড়ছিল, কথা ফুটছিল না। কারণ সিরাজ এই সময়ে ব্যস্ত হয়ে বলল—‘শুনছেন, শুনছেন, এতো ঘাবড়ে গেলে চলবে কেন দিদি? চেয়ে দেখুন, বদমাশটা নেমে গেছে। মেয়েদের ওপর যারা হামলা করে সে পুরুষগুলো কিন্তু আসলে এক নম্বরের কাওয়ার্ড। প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকটাকে আপনার ওপর ঝুঁকে পড়তে দেখেই…’
আশ্চর্য হয়ে নাজমা তাকিয়ে দেখলেন একমুখ সুসজ্জিত গোঁফদাড়ি এবং চেহারার আদল সিরাজের মতো হলেও ছেলেটি আদৌ সিরাজ নয়। খুব ছেলেমানুষ। খুব সম্ভব কলেজে-টলেজে পড়ে। এবং শরীরচর্চা করে।
গল্পটা নাজমা চৌধুরীদের।