প্রমিতার সঙ্গে
(১)
আমি প্রমিতাকে বিয়ে করেছি। আশ্চর্য! বিয়ে করে ফেলেছি আমি, প্রমিতাকে। এইমাত্র রেজিস্ট্রি অফিস থেকে আসছি। অনুষ্ঠান করে বিয়ে-থা প্রমিতা পছন্দ করে না। আমিও না। মাথায় টোপর, গলায় মালা, কপালে চন্দন-টন্দন পরে বর সাজলে কিরকম বর্বর দেখাবে কল্পনা করতেও আমাদের হাসি পায়। যাই হোক, আনুষ্ঠানিক বিয়ে আর পুরুত-নাপিত-এয়ো না হলেও রিসেপশন হবে। গ্রেট ইস্টার্ন বা রিৎজের মতো কায়দার জায়গায় না হলেও সোমনাথ হলে হবে। আমার বন্ধুবান্ধব, প্রমিতার বন্ধুবান্ধব, আমাদের কমন ফ্রেন্ডস্, আমার আত্মীয়স্বজন, প্রমিতার আত্মীয়স্বজন—সব্বাই আসবে। জাঁকজমক কিছু কম হবে না। খালি প্রমিতা বলে দিয়েছে ও কনে-টনে সেজে ডেকোরেটরের সাজানো সিংহাসনে পটের পুতুলটি হয়ে বসতে-টসতে পারবে না। আমার দেওয়া শকিং পিংক রঙের বালুচরীটি পরে ও আমার পাশে পাশে ঘুরবে। হল থেকে দালান, দালান থেকে প্যাসেজ, প্যাসেজ থেকে আবার হলে। আমি আর প্রমি। প্রমি আর আমি। সবাই দেখতে পাবে। কিছুদিন আগেও যারা অবিশ্বাস করেছিল তারাও দেখতে পাবে ভালো করেই, এবং আশা করি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে ব্যাপারটা। জানি না, ঠিক বলতে পারি না, তবে ছোট্ট একটু কাঁটা তাদের অনেকেরই বুকের মধ্যে বোধ হয় হুলের মতো ফুটবে। জ্বালা-জ্বালা করবে সেখানটায়। তো আমি কি করতে পারি! আমি তো বরাবরই বলে এসেছি আমি প্রমিতাকে বিয়ে করব। প্রমিতা আমাকে বিয়ে করবে।
দুজনে গাড়িতে উঠলাম। আমার মা-বাবা নেই। দিদি আর জামাইবাবু। প্রমিতারও মা-বাবা নেই। দাদা-বৌদিদি। এই ক’জন মিলে কোয়ালিটিতে গিয়ে সামান্য একটু সেলিব্রেট করা গেল। তারপর আবার গাড়ি। এবার আমরা আমাদের নতুন কেনা সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে যাবো। সেখানে গত ছ মাস ধরে সব দেখেশুনে কেনা-কাটা হয়েছে প্রমিতা বলে গেছে। আমি কিনে কিনে গেছি। আমি বলে বলে গেছি, প্রমিতা কিনে কিনে গেছে। আলমারি, সুটকেস, খাবার টেবিল, সোফা-কৌচ, বাসন-পত্র, গ্যাস-স্টোভ, ফ্রিজ, বইয়ের আলমারি, র্যাক, কালীঘাটের পট, দক্ষিণ ভারতের নটরাজ, পেপার ম্যাশের বুদ্ধ। সব আমার সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে কেনা। আমি বরাবর অল্প খরচে, হিসেবী মানুষ। বন্ধুরা বলে কৃপণ। এখন তারা দেখুক আমি কি করেছি, কি কিনেছি প্রমিতার জন্যে। কোথাও কিপটেমি করেছি কি না। আর দু-চার দিন পর যে রিসেপশন দেওয়া হবে, যেখানে মোগ্লাই বিরিয়ানি থেকে ভায়া স্মোক্ৰ্ড হিলসা, চিকেন বাটার মসালা, কাশ্মীরী গ্ৰীল্ড্ মাট্ন, ফিশ তন্দুরি হয়ে পেস্তা চকোলেট আইসক্রিমে মসৃণভাবে পৌঁছে যাবার আয়োজন হয়েছে, সেখানেই বা কোনও কিপটেমি দেখানো হয়েছে কিনা। আরে বাবা! খরচ করো বললেই কি করা যায়। ওদের মতো প্যাকেট প্যাকেট সিগ্রেট উড়িয়ে, বোতল বোতল হুইস্কি গড়িয়ে, যখন-তখন ট্যাকসি, যখন-তখন হোটেল-বার-রেস্তোরাঁ! ছিঃ। সত্যিকার খরচ করবার সময় আসতে দাও, নিশ্চয় করব, নির্দ্বিধায় করব, যেমন এখন!
পেশায় আমি গবেষক। আর প্রমিতা? প্রমিতারও একটা পেশা আছে। অবশ্য সেটাকে পেশা না বলে নেশা বলাই ভালো। প্রমিতার আগে লেখার বাতিক ছিল। সেই বাতিকের ফলেই আজ ও লেখিকা। নবতম, বিস্ময়কর, সাড়া-জাগানো লেখিকা। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে আমাদের দেশের সমস্ত পুরনো কনভেনশন ভেঙে যুবতী প্রমিতা, রাতারাতি অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেলো, বিশেষ করে বারাঙ্গনাদের নিয়ে লেখা ওর দুর্ধর্ষ উপন্যাস ‘নগরীর নটী’র জন্যে।
পুরস্কার বিতরণী সভার অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম প্রমিতা ইলেকট্রিক ব্লু শাড়ি গায়ে জড়িয়ে স্মার্টলি এগিয়ে গেল। গোল্ড ফ্রেমের চশমায় বিদ্যুৎ ঝলকালো। তীক্ষ্ণ নাক, তীক্ষ্ণ চিবুক, চোখের কোণা থেকেও যেন তীক্ষ্ণতা বর্শার ছোট ছোট ফলার মতো চতুর্দিকে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। প্রতিটি স্টেপে জিনিয়াসের স্বাক্ষর। যেভাবে পায়ে পায়ে স্টেজে এগিয়ে গেল, হাই-পাওয়ার চশমা, সামান্য হোঁচট খেয়ে যেভাবে সামলে নিলো, রাজ্যপালের হাত থেকে নম্র, সম্ভ্রান্ত, তীক্ষ্ণ হাসি হেসে পুরস্কারটা নিলো, মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বাও করল। অদ্ভুত। এরকম আমি আর দেখিনি। কেউ দেখেছে বলেও জানি না।
সেই প্রমিতাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলেছি। সুখের বাসায়, ভালোবাসায়। আমি অবশ্য সংস্কৃত জানি না। তবু ওই শ্লোকটা শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। আমি অতশত জানি না। কিন্তু প্রমিতা সব জানে। ওর বইয়ের ফরমাশ মেটাতে মেটাতে আমি পাগল হয়ে গেছি। পাগল মানে অবশ্য মোটেই পাগল নয়, মাতাল-মাতাল পাগল, সুধায় মাতাল, আনন্দে পাগল। কতো যে ডিক্শনারী, এনসাইক্লোপিডিয়া, পুরাণ, কাব্য সংকলন, উপন্যাস, ছোট গল্প সংগ্রহ, কতো যে দর্শন, শাস্ত্র সমালোচনাগ্রন্থ ওর সংগ্রহে ছিল এবং যোগাড় করল তার সীমাসংখ্যা নেই। সে এক এলাহি ব্যাপার। প্রমিতা বলেছে, আমিও নাকি ওর একখণ্ড চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি ও আমার কাছ থেকে বুঝে নেবে। নিচ্ছেও। ফিজিক্স অ্যাসট্রোনমি, অ্যানাটমি। ব্ল্যাকহোলের বৃত্তান্ত শুনে সেদিন বলছিল, ‘কাঞ্চন আমার নতুন, সম্ভবত সব চেয়ে অ্যামবিশাস উপন্যাস হবে তোমার এই কৃষ্ণ গহ্বরের ওপর। নাম দিচ্ছি “অ্যান্ড্রোমিডা।” একটা পুরো গ্যালাক্সি জোড়া বিশাল সভ্যতার ধ্বংসের শেষ দিন। অদ্ভুত! কি কল্পনাশক্তি! কি দুর্ধর্ষ দৃষ্টি। বাপরে বাপ। ছাপোষা বিজ্ঞানের মাস্টার আমি। কাজই বা কি আমার অত কথায়। বললেই হল স্ত্রৈণ, নিজের স্ত্রীর ঢাক নিজেই পেটাচ্ছে। বললেই হল! চিনি তো সব্বাইকেই।
গাড়িটা থামতে দুজনে নামলাম। প্রথমে আমি, দরজা খুলে একপাশে দাঁড়ালাম, তারপর রক্তাম্বরা প্রমিতা। বাকি চারজন আগেই নেমে গেছেন, বলে গেছেন—‘আমাদের যাবার দরকার নেই। আমাদের কাজ আগেই সেরে রেখেছি।’
দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। দোতলার ফ্ল্যাট, দক্ষিণ খোলা। সামনে ডিনার-টেবিলের ওপর একটি ভারি সুন্দর আধারে একটি ভারি সুন্দর বাতি জ্বলছে। সাদায়-মেরুনে-হলুদে-গোলাপিতে ঢেউ তোলা তোলা একটি ফুট দেড়েক ভেনাস। শোবার ঘরের দরজা খুলতেই রাশি রাশি দস্যি ছেলের মতো আমাদের গায়ে, মুখে, মাথায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ফুলের গন্ধ। দেখলাম বিছানা ভর্তি খালি ফুল, ফুল আর ফুল। রজনীগন্ধা, বকুল, গন্ধরাজ, যুঁই, চাঁপা, বেল। আমাদের সবুজ শয্যা একেবারে বাগান হয়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলের ফুলদানে আবার মস্ত বড় একটা কেতকী। মরি! মরি! কী গন্ধই ছড়াচ্ছে!
প্রমিতা দরজায় পা দিয়েই স্থির হয়ে গিয়েছিল। চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। বলল—‘কাঞ্চন দেখো, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!’
আমি বললাম, ‘সত্যিই! নিশ্চয় যখন আমরা নীচে গাড়িতে ওয়েট করছিলাম তখনই কোন ফাঁকে দিদি আর বউদিদি এই কাণ্ড করেছেন! কিন্তু কী সুন্দর কাণ্ড!’
প্রমিতা আমার দিকে অলৌকিক দৃষ্টিতে চাইল। ওর হাতে একটা মস্ত ব্যাগ। চট করে তার ভেতর থেকে একটা মোটা ডায়েরি আর একটা পাতলা কলম বার হয়ে এলো। খাটের রাশি রাশি ছড়ানো ফুলের পাপড়ির ওপর আরো একটি ফুল খুব সম্ভব ম্যাগনোলিয়ার (যদিও আমি এ ফুল দেখিনি) মতো বসে পড়ে বলল, ‘কাঞ্চন, অদ্ভুত একটা প্লট মাথায় এসে গেল হঠাৎ। মাল্টি-কালার্ড ভেনাস দ্যাখো অর্ধেক পুড়ে গলে আছে, হাত আগেই গেছে, আজ ওর মাথাও গেল, তবু ও আছে, ও থাকবে। ঘরে ঢুকতেই দ্যাখো ফুলের গন্ধ কিভাবে আমাদের আক্রমণ করল। তোমার ওই মন্তব্যটা—কি সুন্দর কাণ্ড—রেমিনিসেন্ট অফ দা রামায়ণ! সমস্তই অদ্ভুত! লিখে ফেলি হাঁ?’
মিষ্টি হাসল প্রমিতা। হাসলে ওর ঠোঁটের কোণাদুটো কিরকম মোচড় খেয়ে ওপর দিকে বেঁকে যায়। কোনও লেখিকা যে এরকম হাসি হাসতে পারে তাও আমি এই প্রথম দেখলাম। কিন্তু আজকে আমি স্বামী, আমি প্রভু। ডায়েরির ওপর হাত চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, ‘কিন্তু প্রমি, আজ আমাদের বাসর-কাম-ফুলশয্যার রাত। জীবনে কোনদিন আর ফিরে আসবে না। আজকের প্লটটা না-হয় দু-চার লাইনে সিনপ্সিস করে রাখো। পরে হবে।’
প্রমিতা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘য়ু আর রাইট দেয়ার কাঞ্চন, অ্যাজ য়ু অলওয়েজ আর। আমি একটা সিনপ্সিসই করে রাখি বরং।’
নতুন বালিশ বুকে নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল প্রমিতা। শন শন করে চলতে থাকল কলম। পিঁপড়ের মতো খুদে-খুদে অক্ষর ঝরঝর করে বেরিয়ে আসতে লাগল জাপানি পাইলটের সূচীমুখ দিয়ে। প্রমিতার লাল-লাল ঠোঁট দুটো মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। বোধহয় গল্পের পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে ও-ও সংলাপ বলছে, বলে বলে বলাচ্ছে তাদের।
লিখতে লিখতে প্রমিতার পা থেকে লাল-শাড়ি উঠে গেল খানিকটা। লালের পাশে আরও ফর্সা দেখাচ্ছে গোল গোল পায়ের গোছ। কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়ল। মণিবন্ধে মোটা সোনার বালা, কাঁপছে। সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলঙ্কার সত্যিই বলা মুশকিল। বাইরে খালপাড় থেকে হুতোমপ্যাঁচা ডাকতে লাগল। কম্পিত, স্বেদাক্ত, রোমাঞ্চিত কলেবরে প্রায় সমস্ত রাত প্রমিতার সিনপ্সিস শেষ হওয়ার প্রতীক্ষায় বসে রইলাম। ঠিক ভোরের পাখি ডাকার মুহুর্তে ঘুমে রক্তাভ চোখ মেলে অনেক দূরের পথিকের মতো আমার দিকে চাইল প্রমিতা। তারপর তার হাত নুয়ে পড়ল, কলম খসে পড়ল আঙুল থেকে, ডায়েরির পাতা ভোরের হাওয়ায় ফরফর করে উড়তে লাগল। বালিশের ওপর কাত হয়ে কত্তকালের ঘুম ঘুমোতে লাগল বেচারি প্রমিতা।
রিসেপশনে আমায় অভিনন্দন জানাল অনেকেই। ওকে তো কেউ জানাল না! বউকে কংগ্র্যাচুলেট করাটা কি শিষ্টাচারসম্মত নয়? ঠিক মনে না করলেও আমার সামান্য খারাপ লাগল। জিনিয়াস না হতে পারি, কিন্তু নিজ মুখেই বলছি, আর কে-ই বা বলছে, থার্মোডাইনামিক্স্-এর সেকেন্ড ল’-এর ওপর আমার থিসিস কিন্তু খুব প্রশংসা পেয়েছিল। গাইড হিসেবেও আমার দুর্দান্ত সুনাম। উচ্চারণে একটু বাঙাল টান আছে বলে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথম প্রথম আড়ালে একটু হাসাহাসি করে। আমি ওসব পাত্তা দিই না। তার পরেই স্যার, স্যার, স্যার। আমার দেওয়া একটা স্কীমের ওপর এখন একটা ফুল ব্যাচ রিসার্চ করছে। জিনিয়াস নই, কিন্তু আমি পরিশ্রমী, সৎ, উদার, কর্তব্যপরায়ণ, নেশা করি না, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করি, সচ্চরিত্র। চেহারা? আমি ফর্সা নই, কালো, জেট ব্ল্যাক। প্রমিতা বলে পুরুষমানুষ ফর্সা হলেই তার অর্ধেক চার্ম নষ্ট। ওর উপন্যাসের হিরোরা সব কালো, সাইড-হিরোরা কেউ কেউ ফর্সা। পুষ্ট, সযত্নলালিত একজোড়া মিলিটারি গোঁফ আছে আমার। মাথার চুল ক্লোজ-ক্রপ। আমি পুরোপুরি একটি হী-ম্যান। তবে? প্রমিতাকে কংগ্র্যাচুলেট করতে এদের বাধা কোথায়?
খেয়ে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। এই বাজারে সব চেয়ে দামী কেটারারের সব চেয়ে দামী মেনু। ধন্য ধন্য করবে এ আর বেশি কথা কি? এ আমার উপছে-পড়া আনন্দের প্রকাশ। পঞ্চাশ টাকা প্লেট না ষাট টাকা এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
পেস্তা-আইসক্রিম মুখে নিয়ে আমার দিকে চুপিচুপি একবার চাইল প্রমিতা। ওর স্পেশ্যাল ফেভারিট। মুখে দিলেই গলে যায়। ও বলে ফুলের সৌরভের মতন দেহ-মন সব একসঙ্গে ভরে দেয়। এখন ওর চোখে-মুখে সেই স্নিগ্ধ সুগন্ধের আবেশ। আইসক্রিমের মতো একটা নিতান্ত জৈব খাদ্যবস্তু মানুষের জিহ্বা অর্থাৎ একটি কর্মেন্দ্রিয়র আশ্রয়কে স্পর্শ এবং তুষ্ট করবার পর কি করে যে আত্মায় প্রবেশ করতে পারে তা এক প্রমিতাকে দেখেই বুঝেছি। ও বলে সাহিত্যের মধ্যে যেমন কবিতা, খাদ্যের মধ্যে তেমন আইসক্রিম।
আমাদের সংক্ষিপ্ত সংসারে রান্না-বান্নার জন্য ষণ্ডা-গণ্ডা চেহারার একটি মহিলা কর্মী রেখে দিয়েছি। নাম শিবু। অন্যান্য ফাই-ফরমাস খাটবার জন্য আছে একটা হিন্দুস্তানী বাচ্চা। নাম মুন্না। ইনস্টিট্যুট থেকে ফিরতে প্রথম দিন শিবু বললে, ‘কি জলখাবার দেবো গো বাবু?’
—‘কেন বউদিদি নেই?’
—‘ছিলেন তো সারা দুপুর। বিকেলের দিকে একটা ফোন এলো। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন। কিছু তো বলে গেলেন না!’
আমি বললাম, ‘যা হয় করো!’
তা শিবু যত্ন, করেই দিলে। চিঁড়ে-ভাজা, তার সঙ্গে কুচো কুচো আলুভাজা, বাদামভাজা, মরিচগুঁড়ো, সঙ্গে কফি। খেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, শিবু আবার এসে দাঁড়াল—‘রাত্তিরে কি হবে গো বাবু?’
—‘যাচ্চলে, আমি তার কি জানি?’
—‘বউদি তো কিছু বলে গেলেন না!’
—‘তোমার যা প্রাণ চায় করো।’
—‘আপনি কী খান রাত্তিরে?’
আমি? ভাবতে লাগলাম তাই তো কী খাই? কী খাই রাত্তিরে? খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তো কোনদিন মাথা ঘামাইনি! মেসের ঠাকুর ব্যাটা যেদিন যা ছাই-পাঁশ ধরে দিত, তাই-ই খেয়ে এসেছি। ভেবেচিন্তে বললাম, ‘রুটি বানাও। বেগুনভাজা বানাও। আর কি? সকালের মাছ আর আছে?’
—‘না তো বাবু, সে তো সকালেই সব খেয়ে নিলেন!’
—‘তা হলে?’ ‘আলু-ফালুর চচ্চড়ি বানাও তা হলে?’
শিবু ওই একদিনই জিজ্ঞেস করেছিল। তাইতেই আমার দৌড়, প্রমিতার দৌড় বুঝে ফেলেছে। আর জিজ্ঞেস করে না। নিজেই বাজার করে, নিজেই রান্না করে, নিজেই দেয় থোয়, মুন্নাটাকেও কাজে লাগায়।
কিন্তু প্রমিতার সেদিন ফিরতে রাত প্রায় নটা হল। ভীষণ উত্তেজিত। পাবলিশার ফোন করেছিল। অমুক ফিলম-ডিরেক্টর ডেকেছে। ‘নগরীর নটী’ ছবি হবে। সেই সব কথাবার্তা আলোচনা হতে হতেই এতো রাত।
ফিলম ডিরেক্টর শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘এর পর এসব জায়গায় একলা একলা একদম যেও না প্রমি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেও।’
প্রমিতা হাসল। সেই ঠোঁটের কানা-তোলা অদ্ভুত হাসি।
—‘নিশ্চয়ই! কিন্তু এরকম বিনা নোটিসে তলব এলে? তখন?’ বলতে বলতে প্রমিতা আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। রাত্রে কিছু খেলো না। ফিলম ডিরেক্টর অনেক খাইয়েছে। খিদে নেই। একাই খেলাম। আমি খেলাম, শিবু খেলো, মুন্না খেলো। মুন্না প্রমিতার ভাগটাও খেয়ে নিল। ব্যাটার পেট ইল্যাসটিকের মতো, বাড়ালেই বাড়ে।
রবিবার। বেড়াতে যাবো ঠিক করি। সারা সপ্তাহ খালি কাজ আর কাজ আর কাজ। শনিবারেও তো রেহাই নেই আমার। এক দঙ্গল ছেলের সঙ্গে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে হয় ল্যাবরেটরিতে। ট্রামে বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাড়ি ফেরা। খোলা হাওয়ার সাধ্য কি আমাদের ছোঁয়। ভিকটোরিয়া মেমোরিয়্যালের বাগানটি বেশ। ঘুরে ঘুরে বেড়াই। কতো পুরনো স্মৃতি। বেশি পুরনোও তো নয়। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে জলের ধারে বসি। জলের মধ্যে প্রমিতার ছায়া, ভাঙছে চুরছে আধুনিক ভাস্কর্যের মতো। পাশে আমার ছায়া, কাঁপছে। অন্ধকার ঘন হয়। বেশ সুগন্ধি অন্ধকার। আমি ওর ডান হাতটা মুঠোর মধ্যে তুলে নিই। প্রমিতা শিউরে ওঠে।
—‘কি হলো?’
—প্রমিতার দুই ভ্রূর মাঝে খুব ছোট্ট একটা রেখা উঠেই মিলিয়ে যায়।
—‘কিছু না। কনসেনট্রেশানটা নষ্ট হয়ে গেল।’
খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। তারপর দুজনে আবার বেড়াতে থাকি। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। উত্তর থেকে পুবে, পুব থেকে পশ্চিমে। প্রমিতা খুব অস্থির। ছটফট করতে করতে বেড়াচ্ছে। আমি ওর অবস্থাটা ঠিকই বুঝি। খুব দুঃখিত গলায় বলি—‘আয়্যাম সরি প্রমি।’ ও আবার ভয়ানক শিউরে ওঠে—‘কাঞ্চন, ওই তোমার বড্ড দোষ, বড্ড অসময়ে কথা বলো। চিন্তাটাকে সবে গুছিয়ে এনেছিলুম। দিলে তো সব এলোমেলো করে!’
প্রমিতা ঘোরে ফেরে ওর মাথার মধ্যে পুষ্পবৃষ্টির মতো ধ্বনি বৃষ্টি হয়, শব্দ-বৃষ্টি হয়। আইডিয়া-বৃষ্টি হয়। এক হিসেবে অসম্ভব টেনশন বেচারির।
দিন যায়। রাত হয়। ভোর আসে। কাজ করি। বাড়ি ফিরি। দুটি মুখ দেখি এসে। নতুন কাটানো শিলের মতো শিবুর মুখখানা, নোড়ার মতো লম্বা মুন্নার মাথাটা। শিবু রাঁধে, মুন্না বাড়ে। খাই-দাই। মাঝরাতে ঘুম ভাঙে। হাত বাড়াই। পাশে প্রমি। হাতটা আস্তে নামিয়ে দেয় ও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসে—‘আজ সারাদিন ধরে পড়েছি, কাঞ্চন, মাথা টনটন, সারা বিকেল গল্পের জট ছাড়িয়েছি, সারা সন্ধে লিখেছি, হাত কনকন! কি ঘুম পাচ্ছে। কি ঘুম! কি ঘুম! ঘুমের মধ্যে অসহায়ের মতো তলিয়ে যেতে থাকে প্রমিতা।
(২)
বছর ঘুরে গেছে। আবার এসেছে সেই দিন। সেই বৈশাখী পূর্ণিমা। সকাল থেকে ছুটোছুটি করে বাজার করেছি। বাগদা-চিংড়ি, মুরগী, খুঁজে পেতে ভেড়ির ভেটকি। অসময়ের ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, কাজুবাদাম, কিসমিস। আর মস্ত বড় স্ল্যাব চকোলেট আইসক্রিম। কিনে আগে থেকে ফ্রিজে ভরে রেখেছি। দশ জনে খেতে পারে এতো বড়। কি জানি হয়ত প্রমিতা মাছ-টাছ সরিয়ে রেখে দেবে, মুরগী ছোঁবে না, পোলাও ঠেলে দেবে। বলবে—‘আজ আমায় আইসক্রিম দাও। সুদ্ধু আইসক্রিম।’ তাই অনেকটা কিনেছি। সারাদিন ধরে একটু একটু করে যত খুশি খাক না প্রমিতা।
আজ কাউকে ডাকিনি। কাউকে না। আমাদের দুজনের ছোট্ট সংসারে বড্ড ভিড়। আমার বন্ধুবান্ধব, প্রমিতার বন্ধুবান্ধব, প্রায় রোজ। পাবলিশার, উঠতি লেখক, পড়তি লেখক, গুণমুগ্ধ, আজকাল আবার ফিলমের হিরো-হিরোইনরাও কিছু কিছু আসতে লেগেছে। একটা সন্ধেও দুজনে একা হতে পাই না। হয় ওরা আসে, নয় আমাদের যেতে হয়। আজকে তাই কাউকে বলিনি। স্বার্থপরতা? না। একালষেঁড়েমি? না। আজকের দিনটা শুধু আমাদের। গভীর গোপন বিজন নীরব। আজ আর কেউ না।
শিবু এক্সপার্ট লোক। রান্না সেরে ফেলেছে। তার আজ খুব আনন্দ। বউদিদি হাত লাগিয়েছে। দাদাবাবু বাজার করেছে। চড়ুইভাতি হচ্ছে যেন। মুন্নাটা আহ্লাদে চরকির মতো পাক খাচ্ছে। ভালো ভালো রান্নার খোশবাই ছেড়েছে। পেট ভরে রাজকীয় খাদ্যাখাদ্য খাবে, ব্যাটা যেন হাওয়ায় উড়ছে।
একটা। বেল বাজল। দরজা খুলে দিতে আমিই এগোলাম। প্রথমে ঢুকলেন ‘নগরীর নটী’র প্রোডিউসার মিঃ বনশিলাল বাজোরিয়া। পেছনে অদ্ভুত চেহারার এক যুবক। বিরাট লম্বা। আমার থেকে অন্তত দেড় হাত উঁচু। মাথার ওপর যেন বোম্বাই সামোসা শোভা পাচ্ছে। ঠোঁট দুটোতে কি লিপস্টিক লাগিয়েছে? আঙুলগুলো কি রে বাবা। যেন রসে টুপটুপ করছে। আমার মুখ হাঁ। বনশিলাল আমার ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘বোম্বে থেকে সাজ্জাদ আজাদীকেই নিয়ে আসলুম। বুঝলেন কি না মিঃ মুকার্জী। ও ওরূপকুমার-টুমারকে দিয়ে ‘নোগোরের নটী’র হিরো হোবে না।’
ওরা ভেতরে ঢুকল। কিন্তু বাইরে ও কিসের গোলমাল? পেছনে ও কি? দেখি পিলপিল পিলপিল করে কাতারে কাতারে আসছে মানুষ। পাড়া-বেপাড়া দূরপাড়া যেখানে যত ছেলে-মেয়ে, যুবা-যুবী, এমনকি প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া ছিল, কোথা থেকে টের পেয়েছে জানি না, সব বিনা অনুমতিতে, বিনা দ্বিধায়, গর্জন করতে করতে আমার সাতশ পঞ্চাশ বর্গফুটের ছোট্ট ফ্ল্যাটটায় ঢুকে পড়তে লাগল। সাজ্জাদ আজাদী! সাজ্জাদ আজাদী! সাজ্জাদ! সাজ্জাদ! শেষকালে শুধু হাজার হাজার ভিমরুলের গর্জনের মতো একটা সজ্জ্জ্জ্ আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। প্রতি মিনিটে সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ওরা ঢুকে পড়ছে আমার প্যাসেজে, ডাইনিং স্পেসে, শোবার ঘরে, বারান্দায়, পড়ার ঘরে। ঠেলাঠেলি করছে, মারামারি করছে, খিস্তি করছে। প্রথমে হাতজোড় করে বাইরে যেতে বললাম। তারপর বেগতিক দেখে হাত পা চালালাম। মুন্না, শিবু, আমি আর বনশিলাল। কিল, চড়, ঘুষি, লাথি। সাজ্জাদ বাথরুমে ঢুকে পড়ল, প্রমিতা স্টোরে। বনশিলাল ঘুষি চালাতে চালাতে চেঁচাতে লাগলেন—‘হাপনার তো একটা বোন্দুক ভি আছে মিঃ মুকার্জী, লিয়ে আসুন, লিয়ে আসুন জলদি।’ একটা লিকলিকে রোগা মেয়ে হঠাৎ মেঝের ওপর সটান শুয়ে পড়ে খুব সরু গলায় চিৎকার করতে লাগল—‘আমার ওপর দিয়ে একবার হেঁটে যাক সাজ্জাদ, মাত্র একবার, যেমন ‘রাত কি চিঁড়িয়া’য় অঞ্জ্নার ওপর দিয়ে হেঁটেছিল…’ সাজ্জাদ হাঁটল না। কিন্তু আরও অনেকে হাঁটল, দৌড়োলো। তারপর? ফোন, হাসপাতাল, থানা, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, দমকল…।
সব শেষ করে ঝামেলা চুকিয়ে যখন বনশিলাল, প্রমিতা আর সাজ্জাদ নামে ফিলম স্টারটিকে নিয়ে খেতে বসতে পারলাম তখন রাত্তির দশটা। ঠেলাঠেলি আর মারামারিতে আমার ঠোঁটটা কেটে ফুলে উঠেছে। সারা ফ্ল্যাটে ভাঙা ফার্নিচার আর কাচের টুকরো ছড়ানো। কাদায় কাদা। শোবার ঘরে বিছানার ওপর পর্যন্ত রাশি রাশি কাদামাখা পায়ের ছাপ। শিবু আর মুন্না মিলে যতদূর সম্ভব পরিষ্কার করেছে। আমরাও হাত লাগিয়েছি। বিবাহবার্ষিকীর খাদ্যাখাদ্যগুলোর সদ্ব্যবহারই হল। আইসক্রিমটা ভাগ্যিস বেশি করে এনেছিলাম। মিঃ বাজোরিয়া আবার ভেজিটেরিয়ান তো! তিনিই খেলেন বেশি। বাইরে পুলিশভ্যান অপেক্ষা করছিল। ওদের এসকর্ট করে নিয়ে গেল।
এখন রাত বারোটা। পড়ার ঘরে ডিভানের ওপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রমিতা। বাড়ি নিঝ্ঝুম। সারাদিনের হল্লার পর যেন অস্বাভাবিক লাগছে এই নীরবতা। বাড়িটা যেন হানাবাড়ি। আমি একটা চেয়ারে একা বসে আছি। ভূতের মতো। সিগারেট ধরালাম। নেশা নেই। খাই না সাধারণত। এটা বনশিলাল ফেলে গেছেন। এক্সপার্ট স্মোকারদের মতো ধোঁয়া ছাড়ছি, ধোঁয়া গিলছি। গলাটা বেশ গরম গরম, তেতো-তেতো লাগছে। ধোঁয়ার রিং ছুঁড়ে যাচ্ছি ওপর দিকে। নীল নীল রিং। একটার পর একটা। একটার পর একটা। স্প্রিং-এর মতো পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে রিংগুলো। আহ্ কি আরাম। নিচের ঠোঁটটা সবরি কলার মতো ফুলে উঠেছে। গা-গতর ব্যথা। মদ্যজাতীয় কিছু একটা পেলে হত। সাজ্জাদ একটা চ্যাপটা বোতল ফেলে গেছে। হিপ পকেটে ছিল। সে কি বস্তু জানি না। একটু বরফজল মিশিয়ে খেলাম কয়েক ঢোঁক। শিবু ঘুমোচ্ছে। মুন্না ঘুমোচ্ছে। প্রমিতা ঘুমোচ্ছে। খালি আমিই প্যাঁট-প্যাঁট করে জেগে আছি। চোখে ঘুম, মাথায় ঘুম নেই। বোতলটার অর্ধেকও শেষ করতে পারলাম না। কড়া জিনিস। ভালোও। বোধহয় জার্মান-টার্মান হবে। এবার মাথাটা হালকা হয়ে আসছে। চিন্তা করতে পারছি পরিষ্কার, আলমারির ভেতর থেকে কিছু টাকা বার করলাম। ওভারনাইট ব্যাগটা। শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, রুমাল। দু-একখানা বই আর ফাইল। ব্যাগের ভেতর সব ঠেসে ঠেসে পুরলাম। চাবির থলোটা টেবিলের ওপর রাখলাম প্রমিতার সামনে। চিঠি-চাপাটি কিছু লিখব না কি? নাহ্। দরকার নেই। বেচারি প্রমি! হয়ত আমার অনুপস্থিতি টেরই পাবে না। আজ যা তুলকালাম হল তারপর কাল থেকে ওর একটা উপন্যাস শুরু করাই সম্ভব। বেচারি! কিন্তু আমিই বা কি করি! কিই বা করার আছে আমার! ছাপোষা বিজ্ঞানের মাস্টার বই তো নই!
এইবার আমি আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছি। বাড়ি ঘর দোর, কিছু কিছু অভগ্ন আসবাব, বাসন-কোশন, টাকাকড়ি, শিবু, মুন্না, পাবলিশার, বনশিলাল, সাজ্জাদ সব রইল। আশা করি অসুবিধে হবে না বেচারির। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এসেছি। কারো ঘুম না ভেঙে যায়। দরজাটা আস্তে টেনে দিয়েছি। ভোর হয়ে এসেছে। ফুরফুর করে ভারি সুন্দর একটা গা-জুড়োনো হাওয়া দিচ্ছে। আ-হ্!