করুণা তোমার
‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ‘ছোটরানী আছাড় খাইয়া পড়িলেন’-এর মতো দৃশ্যটা। পাপু মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছে। উপুড় পিঠটা নিথর। কাঁধের তলায় পিঠের ওপর দুদিকে দুটো ত্রিভুজ। একটু একটু উঠছে নামছে। ছোট চুল। বব-ছাঁট ছিল। একটু বড় হয়ে গেছে। তাই আগাগুলো মেঝেতে লুটোচ্ছে।
পাপুর বাবা ঘরে ঢুকেই অবাক।
—‘একি? পাপুর কী হলো?’ কোথাও কোনও জবাব নেই।
পাপুর বাবার পুনরুক্তি—‘বলি, হলোটা কী?’
পাপুর মা অর্থাৎ শ্রীলা উল বুনছিল। উলের থলি টেবিলের ওপর রেখে গম্ভীরভাবে বলল—‘তুমি কি চা পান করবে?’
হতভম্ব সুরজিৎ অর্থাৎ শ্রীলার স্বামী ওরফে পাপুর বাবা বলল—‘চা তো আমি রোজই এ সময়ে পান করে থাকি। হঠাৎ প্রশ্ন? প্রশ্নের জবাব এড়াতেই প্রতি-প্রশ্ন নাকি?’
—‘বোঝ তো বেশ। বুদ্ধি ভালোই। আরেকটু বাড়লে যেটা বুঝেছ সেটা মুখে বলে বোকা-বুদ্ধির পরিচয় দিতে না।’
—‘বুদ্ধিও বুঝি। বোকাও বুঝি। বোকা বুদ্ধিটা কী?’—সুরজিৎ তরল গলায় প্রশ্ন করছে। যদিও চোখ দুটো অনড় পিঠটার ওপর স্থির। মেয়ে সুরজিতের প্রাণ।
ঘরে ঢুকে পড়েছে পাপুর পিঠোপিঠি দাদা পিন্টু।
—‘বাবা জানো, আসলে…’ পেছন থেকে তার মুখের ওপর হাত চাপা দিয়েছে শ্রীলা।
চা খাওয়া শেষ। চা এর সঙ্গে টা। পিন্টু খেলতে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে চায়ের বাসন ঠুনঠুন করে ধুচ্ছে বোধ হয় চুনী। শ্রীলা বলল—‘চুনী, যা ঘুরে আয়। বেশি দেরি করবি না। ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যে তোর আড্ডা শেষ হওয়া চাই।’
কাচের চুড়ির আওয়াজ। চুনী বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিন মুখে খই ফোটে। আজকে দিদির মেজাজ খারাপ। আবহাওয়া থমথমে। চুনী তাই চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
শ্রীলা বলল—‘মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিচ্ছো না।’
—‘যা বাব্বা, আমি আবার কখন শিক্ষা দিলুম, ওসব তো তুমি আর তোমার কনভেন্টের মিসের এক্তিয়ার।’
—‘না, ইয়ার্কি নয়। পুজোর কেনাকাটা করতে গিয়ে সেদিন পাপুর স্কাই ব্লু রঙের চাইনিজ সিল্কের চুড়িদার সেটটা কিনেছিলুম মনে আছে? সাদা স্যাশের মতো আছে।’
—‘তোমরা যে কেনাকাটা করতে গিয়ে কী কেনো, কত কেনো আর কতরকম কেনো…’
—‘আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। দয়া করে পুরোটা শোনো। চুনী সেটা দেখতে পেয়ে গেছে। ধরল ওকেও পুজোয় ঠিক ওই রকমই কিনে দিতে হবে। ওর খুব পছন্দ। ঠিক ওই রঙ, ওই ডিজাইন। এসব জিনিস তো ডুপ্লিকেট হয় না। দামও অনেক। আজকে ঠিক ওই জিনিসটাই দোকানে ঝুলছে দেখে কী মনে হল কিনে ফেললুম। মেয়েটা তো বরাবর পুরনো, রং জ্বলা জিনিস নিয়েই তুষ্ট আছে। বড় মুখ করে বলল। তা সেই থেকেই তোমার কন্যে অমনি পেছন উল্টে শুয়ে আছে।’
—‘কেন?’ সুরজিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
—‘কেন বুঝতে পারছো না তো! যাক, তোমার সম্পর্কে ভাবনা ছিল সেটা অন্তত ঘুচলো। বুঝতে পারছে না? তোমার কন্যা চুনীর সঙ্গে একরকম জিনিস পরবে না।’
—‘ও হো হো। তা পাল্টে দিলেই তো হয়। চাইছে না যখন।’
—‘বাঃ চমৎকার। মেয়ের জেদ বজায় থাকবে! হৃদয়বৃত্তি কোনদিন ডেভেলপ করবে না এমন করলে। দয়া করে একটু তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করো।’
সুরজিৎ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল—‘তা হলে একটু টাইম দাও। তলিয়ে বুঝি।’
শ্রীলা রাগ করে সামনে থেকে উঠে গেল।
পাপুটার সঙ্গে চুনীটার যে কী রেষারেষি! অনেক লোক বদলে বদলে অবশেষে এই মেয়েটাকে পেয়েছে সে। বছর পনেরর মেয়ে, পাপুর থেকে সামান্য ছোটই। দেখতে তো ছোট্টখাট্ট। একটু খরখরি। কিন্তু বেশ কাজের। অন্ততপক্ষে কথা বললে শোনে। বেশ চটপটে। মুখে হাসি লেগেই আছে। কথাও আছে সাতকাহন। একটু বড় হয়ে গেলেই এরা যেমনি সেয়ানা হয়ে যায়, তেমনি হয় বদমাশ। চুনী এসে শ্রীলার মনে শান্তি এনেছে। যেমন যেমন শেখায়, তেমন তেমন করে মেয়েটা। নিমেষে বুঝে ফেলে। ঘষর ঘষর বাটনা বাটছে, খচাখচ আনাজ কুটছে, ফটাফট জামা-কাপড় কেচে ফেলছে। কিন্তু কী যে নজর মেয়েটার! পাপুর সঙ্গে সব কিছুতেই ওর পাল্লা দেওয়া চাই। ঠোঁটে রং, নেল পালিশ, জরিঅলা জুতো, চকচকে ঝলমলে জামা—এসব নিয়ে গোড়ায় গোড়ায় খুশি ছিল। এখন আর এ সব মনে ধরে না। পাপুর ফেলে-দেওয়া প্লীটেড স্কার্ট, জাম্পার, দর্জি দিয়ে তৈরি করানো সালোয়ার কামিজ এই সব মোটামুটি পায় ও। এইগুলো পরে পরে ওর রুচি ঘুরে যেতে শুরু করেছে। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পাপুর হেয়ার-ব্যান্ড মাথায় দিয়ে দেখছিল একদিন। পাপুর সেই থেকে ওর ওপর রাগ। শ্ৰীলা পরদিনই ওকে একটা হেয়ার-ব্যান্ড কিনে দিয়েছে। কিন্তু ও ঠিকই বুঝেছে দিদির জিনিসটার মহিমা আলাদা। মুখ গোঁজ করে থাকে। কথায় কথায় পাপুর সঙ্গে ওর লেগে যায়।
—‘দুধে কেন সর রে?’ পাপু দুধে মুখ দিয়েই মুখ বিকৃত করে ফেলল।
—‘মা তোমাকে কতবার, বলেছি তুমি নিজে ছেঁকে দেবে। এরকম করলে আমি দুধ খাবো না।’
শ্রীলা চেঁচাল—‘চুনী, দুধ ছাঁকিসনি? এত করে বলি যে…’
চুনীর খ্যানখেনে সরু গলা শোনা যাবে—‘ছাঁকলুম তো। কতবার ছাঁকব? আধ ঘণ্টা আগে দুধ ঠিক করে রেখে এসেছি। আবার পড়লে কি করবো? দুধ আর ছাঁকনি নিয়েই সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তা হলে…’ খরখরি বলেই যাবে, বলেই যাবে।
—‘ও কিন্তু ঠিকই বলেছে পাপু, গরম দুধ আলগা থাকলে সর পড়বেই, যখন দেয়, তখন খেয়ে নিলেই পারিস।’
—‘ও যখন যা দেবে দয়া করে, ওর হাত থেকে সব নিয়ে নিয়ে খেতে হবে নাকি তক্ষুনি তক্ষুনি!’
পাপু ভীষণ রেগে যায়—‘তুমি, তুমিই ওকে আশকারা দিয়ে দিয়ে এমনি করেছে।’
প্রায় কেঁদে ফেলে মেয়ে—‘আমার একটা কথা থাকবে না। নিজের পছন্দমতো জিনিস কক্ষনো পাবো না। খারাপ হলে বলতেও পাবো না, যাও আমি খাবোই না।’
সাধাসাধি করেও মেয়েকে আর খাওয়াতে পারে না শ্রীলা। মহা জ্বালা হয়েছে তার। কোন দিকে যাবে? পাপুর নালিশও ঠিক, পাপুর দিক থেকে। আবার চুনীর সাফাইও কতকটা ঠিকই তো।
পাপু পিন্টু কেউই খাবার দিলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে খায় না। ডেকে ডেকে মুখ ব্যথা হয়ে যায়। কাজের একটা শৃঙ্খলা আছে তো!
সুরজিৎ ডাকল—‘পাপ্পু, আপ্পু উঠে পড়ো।’
কাঁধটায় একটু ঝাঁকানি দিল মেয়ে। ওর গড়ন একটু দোহারা। সামান্য এদিক ওদিক হলেই মোটা হয়ে যাবার ধাত। বাবা আপ্পু বলে ডাকলে ক্ষেপে যায়। খুব একটা সত্যি সত্যি নয় অবশ্য। সুরজিৎ নিচু হয়ে চুলের ঝুঁটি ধরল—‘উঠে পড়।’
হঠাৎ একটা ঝটকা দিয়ে উঠে বসল পাপু। —‘না বাবা, ইয়ার্কি নয়। মা কী বলতে চায়! একটা কাজের মেয়ে আর আমি এক মায়ের কাছে? আমাকে মা যা দেবে ওকেও ঠিক তাই দেবে! পুজোর সময়ে ও আর আমি একরকম পরে ঠাকুর দেখতে যাবো!’
সুরজিৎ হেসে ফেলল—‘বলিস কি রে! একে দাদা তোর ভাগে ভাগ বসিয়ে রেখেছে। আবার আরেক শংকরা?’
শ্রীলা বলল—‘তুমি চুপ করো তো। দাদা ভাগ বসিয়েছে আবার কী? ওকি একবারও বলেছে সে কথা? তুমি তো দেখছি আরও জটিলতা, হিংসেহিংসি সৃষ্টি করছো।’
পাপু মুখ তুলে বলল—‘হ্যাঁ আমি বাচ্চা কি না, বাবা বলল আর অমনি দাদাকে হিংসে করতে শুরু করে দিলাম।’
সুরজিৎ বলল—‘আরে আমিও তো তাই-ই বলতে যাচ্ছিলুম। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করতে চললি, তুই কি একটা বাচ্চা? বেবি!’
—‘বেবি হলে এগুলো মনে হত না বাবা। মা লোকজন নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে। মার সঙ্গে তো আর কিছু করবে না। তোমার সঙ্গেও না। মা মাথায় চাপাচ্ছে। আমাদের মাথায় উঠে নাচবে। তোমরা ফল ভোগও করবে না, বুঝবেও না।’
শ্রীলার ভীষণ রাগ হয়ে যায়, সেই সঙ্গে হতাশা। কাজের লোক তো দূরস্থান। অন্য কেউই সে কখনও ছেলে-মেয়ের সমান হতে পারে না, তা কী করে ওকে বোঝাবে! সে বলল—‘একটা, মাত্র একটা পোশাক তোমার মতো দিলেই, তোমার মনে হয়, ও আর তুমি আমার কাছে এক? চমৎকার!’
—‘তুমি অন্ধ মা, তুমি বুঝবে না। যেভাবে সব সময়ে ওর হয়ে ওকালতি করো। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি। তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না।’
পিন্টু এসে ঢুকল। হাতে ঝুলছে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট। বলল—‘এখনও তোমাদের সেই এক নীলজামা প্রসঙ্গ চলছে? আরে বাবা এটা বুঝছিস না কেন, তোর মতো জামা পরলেই কি চুনী তুই হয়ে যাবে? চুনী চুনীই থাকবে।’
সুরজিৎ যেন হালে পানি পেল, বলল—‘রাইট। দুজনে এক রকম জামা পরে বেরোলেও, কখনও দুজনকে একরকম দেখাবে না রে পাপু।’
পাপু গম্ভীর হয়ে বলল—‘ঠিক আছে।’
সপ্তমীর দিনে চুনী সেজেগুজে নীল রঙের চুড়িদার পরে একগাল হেসে শ্রীলাকে প্রণাম করল, বলল—‘পাপু দিদি, তুমি এই জামাটা কবে পরবে?’
পিন্টু বলল—‘আরে এ চুনী, তু যে শাঁকচুন্নি বন গিয়া রে!’
চুনী বেশ কথার পিঠে কথা শিখেছে বলল—‘আমার শাঁকচুন্নিই ভালো বাবা, কটা ভূত হয়ে কাজ নেই।’
পাপু নীল পোশাকটা আর কোনদিনই পরল না। অথচ খুব পছন্দ করে নিজে উদ্যোগী হয়ে কিনেছিল জিনিসটা।
জটিলতা এখানেই থেমে থাকল না। একদিন ওর বাতিল করে দেওয়া স্কার্ট-ব্লাউজ পরে চুনী পেছন ফিরে কি করছিল ঘরে, সুরজিৎ তাকে পাপু বলে ডেকে ফ্যালে। সেই থেকে পাপু আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। ইদানীং ওর পুরনো জামা-কাপড়গুলোর শ্রীলা হদিস পাচ্ছে না। নিজের মেয়ের বয়সী কাজের মেয়ে থাকলে জামা-কাপড়ের খাতে খরচটা কমে। লোক রাখবার সময়ে এ হিসেবটাও মনে মনে করে নিতে হয়। জামা-কাপড়ের খরচ কি কম? দিন কে দিন বেড়েই যাচ্ছে, বেড়েই যাচ্ছে। একদিন পাপুর অনুপস্থিতিতে তার আলমারিটা ভালো করে খুঁজে দেখল, তাকের পেছনের দিকে পুরনো তোয়ালে মোড়া বাতিল জামা-কাপড় গুছনো রয়েছে। কাউকে দেবে? না নিজেই কিছু ভেবে রেখে দিয়েছে? মেয়েকে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল—‘হ্যাঁরে তোর কালো স্কার্টটা তো আর পরিস না, কোথায় গেল রে?’
পাপু উদাস গলায় বলল—‘কি জানি?’
অথচ একটু আগেই শ্রীলা দেখেছে কালো স্কার্ট তোয়ালে-মোড়া সযত্নে রাখা রয়েছে। নিজেই রেখে দিয়েছে, অথচ অনায়াসে বলে দিল ‘কী জানি!’ মেয়েকে কিছু বলতে আর সাহস পায় না শ্রীলা। আসল কথা ওগুলোও চুনীকে দিতে দেবে না। এইভাবে নীরবে ওগুলো সরিয়ে রেখে সে কথাই ও জানাতে চাইছে। এখন শ্রীলা কী করে?
অগত্যা আর বছরখানেকের মধ্যে শ্রীলা চুনীকে শাড়ি ধরায়। পাপুকে পারবে না। পাপু এখনও অনেক বয়স পর্যন্ত অনেক রকম পোশাক পরবে। চুনী তো আরও ক্ষয়া চেহারার মেয়ে, স্বাস্থ্য অনেক ভালো হলেও পাপুর কাঠামো সে পাবে কোথায়? অনায়াসেই আরও ক’ বছর চালিয়ে দিতে পারা যেত। চুনীর খুব পছন্দ হচ্ছে না ব্যাপারটা, বোঝাই যাচ্ছে। ফ্রক স্কার্টে বয়সটা বেশ ঢেকে রাখা যায়। সব মেয়েই বাচ্চা থাকতে চায়। শ্রীলাদের ঘরের মেয়েও। চুনীদের ঘরের মেয়েও। শ্রীলা নিজের একটা লাল শাড়ি বাছে। লাল রংটা আজকাল আর পরছে না সে। শাড়িটা দিব্যি নতুন।
—‘চুনী, চুনী, দ্যাখ দিকি, এই শাড়িটা পছন্দ হয় কিনা।’
লাল টাঙ্গাইল শাড়ি, জরিপাড়। এই অসম্ভব প্রাপ্তিতে খুশিতে ঝলমল করতে থাকে চুনী।
—‘এটা আমার, মা?’
—‘হ্যাঁ রে তোর, বেশ লম্বা হয়ে গেছিস, শাড়ি ধরে ফ্যাল এবার।’
চুনী আমতা আমতা করতে থাকে—‘মাঝে মাঝে পরব মা। সব সময়ে পরলে কাজের অসুবিধে হবে না?’
—‘যেগুলো আছে সেগুলো পরতে থাক। এরপর যখন দরকার হবে শাড়িই দেবো।’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার গলায় শ্রীলা বলে। আরেকটা পরিত্যক্ত ছাপা শাড়ি এনে চুনীকে গছায়, সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক সমস্ত। ব্লাউজগুলো একটু ঢলঢল করে, ছুঁচ-সুতো দিয়ে তাকে মেরে ছোট করে নেয় চুনী। কখনও শ্রীলা নিজেই করে দেয়। এইভাবে একরকম হঠাৎই চুনীর ফ্রক-স্কার্ট থেকে শাড়িতে উত্তরণ ঘটে যায়। পাপুর সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলবার কোনও উপায়ই থাকে না। একজন জীনস টিশার্ট, অন্যজন শাড়ি। একজন লম্বা স্কার্ট, অন্যজন শাড়ি। একজন কাফতান, অন্যজন শাড়ি। শাড়ি এবং শাড়ি এবং শাড়ি।
প্রথম প্রথম কাঠিতে জড়ানো কাপড়ের মতো দেখাতে শাড়ি-পরিহিত চুনীকে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর শ্রীলা সুরজিতের সংসারে থেকে তার কালো রঙে চাকচিক্য এসেছে, চুলে ঔজ্জ্বল্য। এখন শাড়ির আড়ালে হঠাৎ-ই যেন তার শরীর ভরে উঠতে থাকে। পরিচ্ছন্ন পাট পাট করে ধোপদুরস্ত, রঙ-মিলোনো শাড়ি ব্লাউজ পরে চুনী যখন ঘোরে ফেরে দোকানের শো-কেসের কালো মডেল পুতুলের কথা মনে পড়ে যায় শ্রীলার। কিন্তু খুব শীগগিরই শ্রীলা অস্বস্তির সঙ্গে আবিষ্কার করে চুনী শুধু তার চোখেই নয়, পাড়ার রিকশঅলা, বহুতলের কেয়ারটেকার, দারোয়ান, চায়ের দোকানের ছেলে, পাড়ার কিছু অকালকুষ্মণ্ড—এদের চোখেও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। চুনীর বিকেলের ছুটির সময় ক্রমশই বাড়ছে। অন্যান্য বাইরের কাজ, যেমন দুধ আনা, বাজার করা, মিষ্টির দোকান ইত্যাদিতেও সে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে। এবং সময়-টময় নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছে তখন সারা শরীরে বেশ একটা হিল্লোল নিয়ে ফিরছে। চোখে মুখে যেন খুশি আর ধরে রাখতে পারছে না।
একদিন পিন্টু এসে বলল—‘মা, চুনীটা কি ওস্তাদ হয়েছে জানো, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা কুলি-কাবাডি লোকের সঙ্গে যাচ্ছে তাই ইয়ার্কি দিচ্ছিল। আমি দেখেও ফেলেছি, শুনেও ফেলেছি।’
শ্ৰীলা গৃহ-সমস্যার সব কথা সুরজিৎকে বলে না। এটা বলল—‘দিনকাল ভালো না। এভাবে চললে বিপদে পড়তে কতক্ষণ?’
সুরজিৎ গম্ভীরমুখে বলল—‘আরও আদর করে শাড়ি পরাও!’
—‘কেন, কত দুঃখে শাড়ি ধরিয়েছি জানো না নাকি?’ শ্রীলা রাগ করে বলে। সুরজিৎ হেসে বলল—‘যে কারণেই পরিয়ে থাকো, তোমার হাত থেকে তাস এখন বেরিয়ে গেছে। এবার ট্রাম্পড হবার জন্য প্রস্তুত থাকো।’
সত্যিই চুনীকে সামলানো এবার দায় হয়ে উঠল। যখন-তখন খিল খিল খিল, চুনী কাজ করছে না তো, ঘরে-দোরে নদী বইছে, এত ঢেউ। চুড়ির রিনিঠিনি, বাহারি টিপের রং-চং, চটির ফটাস ফটাস। মাথায় টপ নট। ক্লিপ দিয়ে দু পাশ থেকে চুল তুলে মাথার পেছন দিকে আটকানো, বাকি চুল ছাড়া পেছনে, চুনী কিছুই শিখতে বাকি রাখেনি। লাল শাড়ি পরে এইভাবে ঢেউ কাটতে কাটতে চুনী সুরজিৎকে, পিন্টুকে জলখাবার দেয়। শ্ৰীলার চোখ করকর করে। নানা ছুতোয় ধমকায় সে মেয়েটাকে।
পিন্টু বলে—‘কি রে চুনী, আজ যে দেখছি টিকায়াম আগুনম।’
চুনী দারুণ চালাক। ঠিক ধরতে পারে, বলে—‘বাজে বকো না দাদা। যতই অং বং চং বলো ফিলিমের আসল হিরোইনরা রেখা শ্রীদেবী সব কালো, কুচকুচে কালো।’
সুরজিৎ বলে—‘তাই নাকি রে?’
শ্রীলা প্রসঙ্গ থামাতে এক ধমক দেয়—‘তুমি চুপ করো তো। চুনী চুপচাপ কাজ কর। যত্ত বাজে কথা।’
চুনী দাঁত বার করে বলল—‘হি, আমি সত্যি জানি মা, সব্বাই তো আর পাপুদিদির মতো গোরে গোরে নয়।’
—‘তুই থামবি?’ শ্রীলা আবার বলল।
পাপু শেষ লুচিটা কোনমতে মুখে পুরে উঠে গেল।
চুনীকে সোজাসুজি ধমকানোটা আর এড়ানো যাচ্ছে না। হেমন্তের সন্ধে। রবিবার। শ্রীলা ছাড়া কেউ বাড়ি নেই। চুনী আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরল।
শ্রীলা গম্ভীর মুখে বলল—‘চুনী শোন। চটিটা ছেড়ে এসে এ ঘরে শোন।’
চুনী আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল।
—‘যত রাজ্যের ছেলের সঙ্গে অত বাজে বকবক করিস কেন রে? সিঁড়ির মোড়ে দাঁড়িয়ে লিফটম্যান জালাল। নিচে দারোয়ান বাহাদুর, রাস্তায় হরেক রকমের ছোকরা তাদের সঙ্গে তোর অত কলকলানি কিসের? বিপদে পড়তে চাস না কী?’
চুনী আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে বলল—‘দিদিও তো করে। দিদির তো অত ছেলে-বন্ধু, তারা বাড়িতে এসে যখন গল্প করে দিদিও তো হেসে হেসে ইয়ার্কি দেয়। তখন তো কিছু বলো না। তা ছাড়া আমি তো শুধু রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করি, দিদি যে সিনেমায় যায়, পিকনিকে যায়, সেগুলো বুঝি কিছু না।’
হাসবে না কাঁদবে শ্রীলা ভেবে পায় না। বলল—‘ওরা তো সব দিদির কলেজের, ক্লাবের বন্ধু, মেয়ে-বন্ধুদের সঙ্গে ওদের কোনও তফাত-ই নেই। তোর কি তাই? তুই যেটা করিস সেটা ভালো দেখায় না তো বটেই, তুই একদিন মহা বিপদে পড়বি। কী বিপদ, কেন বিপদ কিছু কিছু বোঝবার বয়স তোর হয়েছে চুনী।’
চুনী গোঁয়ারের মতো বলল—‘সব্বাই মোটেই দিদির কলেজের বন্ধু নয়, দিদি তো একজন লম্বা গোঁফ দাড়িঅলা ছেলের সঙ্গেও একা একা ঘোরে। সিনেমা যায়। ইস্টিশানে একদিন ট্রেন থেকে নামল।’
—‘তুই কোত্থেকে দেখলি?’
—‘আমি জানি।’
শ্রীলা স্তম্ভিত।
সেদিন সুরজিৎ ফিরলে তাকে সব খুলে বলে শ্রীলা দৃঢ়কণ্ঠে দাবি জানাল—‘মেয়ের বিয়ে দিতে হবে।’
সুরজিৎ বলল—‘ক্ষেপেছো? সবে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে, পার্ট ওয়ান এসে গেল। এখনই বিয়ে? তুমিই না বলতে মেয়ে তোমার ছেলের সমান সমান। পড়বে, যতদূর ইচ্ছে, ডক্টরেট করবে, চাকরি করবে।’
—‘সে আমার ভাগ্য আর আমার মেয়ের ভাগ্য। কপালে যদি না থাকে আমি কি করবো বলো, আমার দিক থেকে তো চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।’
সুরজিৎ বলল—‘তুমি এখনই অত হতাশ, অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ছো কেন? সে ছেলেটি কে, কার সঙ্গে মিশছে, ব্যাপারটা আদৌ সত্যি কিনা এসব জানো, জানতে চাও। চুনী কি না কি বলল, তুমিও অমনি বিশ্বাস করে বসলে? তা ছাড়া সত্যিই যদি সিরিয়াস কিছু হয় মেয়েকে টেনে এনে বিয়ে দিতে পারবে? না সেটা উচিত হবে? তুমি কোনকালে আছো বলো তো?’
শ্রীলা গম্ভীরভাবে বলল—‘তুমি ঠিকই বলেছে। কিন্তু আমি মা। আমাকে সব সময়ে আগামী কালে থাকলে চলে না। তুমি যত সহজে ‘জানো, জানতে চাও’ বললে আমি তা পারবো না। উপদেশটা তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। এটা আমার চ্যালেঞ্জ। বাবারা সব সময়ে কথায় বাতায় সুপার ফার্স্ট। কাজে-কম্মে মান্ধাতার যুগে। আমি অন্তত এ বিষয়ে এটা চলতে দিতে রাজি নই।’
সুরজিৎ বলল—‘ঠিক আছে। চ্যালেঞ্জটা আমি গ্রহণ করলাম।’
সুরজিৎ চ্যালেঞ্জ নেবার দিন সাতেকের মাথায় শ্রীলা জানল—‘গোঁফ-দাড়িঅলা লম্বা একটি বন্ধু সত্যিই পাপুর হয়েছে। ছেলেটি হোস্টেলে থাকে। এম-ই করছে। য়ুনিভার্সিটির চত্বরেই আলাপ। পাপুর গ্রুপের সঙ্গেও ওর ভালোই চেনা। তবে হ্যাঁ, পাপু দু-এক দিন ওর সঙ্গে কয়েকটা খুব ভালো ভালো বিদেশি ছবি দেখতে এসপ্লানেড পাড়ায় গিয়েছিল। বালিগঞ্জ স্টেশনে একবার ওরা কয়েকজন বন্ধুকে ট্রেনে তুলে দিচ্ছিল, নিজেরা কোথাও যায়নি। পাপু জানতে চেয়েছে কোথা থেকে সুরজিৎ এত কথা জানতে পারল। সে তো লুকিয়ে কিছু করেনি। অন্যান্য বন্ধুদের মতোই জয়ও একদিন এ বাড়িতে আসতোই। ইন ফ্যাক্ট জয় পরের রবিবার নিজেই আসতে চেয়েছে।
ছেলেটি—জয়দীপ—যেদিন বাড়িতে এলো সুরজিৎ, শ্রীলা তো বটেই পিন্টু শুন্ধু মুগ্ধ হয়ে গেল। সোজা স্বাস্থ্যবান চেহারা, দাড়ি গোঁফে দারুণ ইনটেলেকচুয়াল দেখায়। অথচ কোনও কৃত্রিমতা, কোনও দম্ভ নেই। এঞ্জিনিয়ার হলে কি হবে, কবিতা এবং ফিলম সম্পর্কে দারুণ আগ্রহ, শুধু পাশ্চাত্ত্য সংগীত সম্পর্কে কথা বলেই সে পিন্টুকে কাত করে দিল। খাবার সময়ে খুব সহজভাবে জয় জানাল সে শিগগিরই এম আই টিতে ডক্টরেট করতে চলে যাবে। বাবা মার ইচ্ছে বিয়ে করে যায়। বউকেও শিগগিরই নিয়ে যেতে পারবে। পাপুর সঙ্গে বিয়ে হলে সে খুব আনন্দিত হবে। শ্ৰীলা সুরজিৎ উভয়েই অবাক। এত তাড়াতাড়ি, এভাবে যে এমন প্রস্তাব কেউ করে ফেলতে পারে তারা ভাবতেই পারেনি। পাপুটারও মুখ লাল হয়ে গেছে। সে বোধ হয় এত সব ভাবেনি।
সুরজিৎ বলল—‘সে কি! তোমার বাড়ি, বাবা-মা?’
জয় হাসল, বলল—‘বাবার বর্ধমানে নার্সিং হোম আছে। ডাক্তার। মাও সেসব সামলান। ওঁরা নিশ্চয়ই শিগগিরই এসে দেখা করবেন। তবে বিয়ের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। পাপুর পার্ট ওয়ানের পরই বিয়েটা হতে পারে। ডিসেম্বর নাগাদ আমি চলে যাবো। পাপু পার্ট টু-টা দিক। তারপর আমি এসে নিয়ে যাবো। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স ওখানেই করবে। অসুবিধে কি? স্টুডেন্টস ভিসায় বরঞ্চ এটাই যাবার সুবিধে। আমি আমার বায়োডেটা কাল পরশুর মধ্যেই দিয়ে যাবো।’
জুলাই মাসের এক আশ্চর্য সুন্দর বৃষ্টি-ধোয়া অকালবসন্তের হাওয়া-বওয়া দিনে মাত্র উনিশ বছর বয়সে পাপুর বিয়ে হয়ে গেল। এবং জুলাই মাসেরই এক উপর্ঝুরস্ত বাদল দিনে চুনী এসে শ্রীলাকে জানাল, সে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ সে বিয়ে করছে। বর রাজ-মিস্ত্রি। সনাতন মিস্ত্রির নাম এ দিকে কে না জানে, ঢালাই বাবদই হাজার হাজার টাকা কামায়। তাকে আর চাকরি করতে দেবে না বর। বারুইপুরে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। কোনও ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা নেই। খালি এক শাশুড়ি।
শ্ৰীলা অবাক হয়ে বলল—‘কবে হবে বিয়ে? কোথায়?’
চুনী সলজ্জে জানাল—‘বিয়ে হয়ে গেছে গত পরশু। কালীঘাটে। চুলের ভেতরে সিঁদুর সে লুকিয়ে রেখেছিল।
শ্ৰীলা বলল—‘আগে বললেই পারতিস। তোর বাবা-মা নেই। আমরাই দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতে পারতুম। একটু খোঁজ-খবর নিতে পারতুম।’
চুনী সলজ্জ নতমুখে নখ খুঁটতে খুঁটতে জানাল—‘তারও দিদির মতোই হুট বলতেই বিয়ে হয়ে গেল।’
শ্রীলা মনে মনে খুব খানিকটা হাসল। কে জানে, দিদির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতেই বিয়েটা ও হুট করে করে ফেলল কি না! কিছুই অসম্ভব নয়। সে পাপুর উপহারের শাড়ি থেকে বেছে একটা রঙচঙে ভালো সিল্কের শাড়ি চুনীকে দিল। নিজের একটা হালকা রুপোর সেট ছিল, সেটাও দিয়ে দিল। বলল—‘এতদিন চাকরি করে যা পয়সা জমালি সব পোস্ট অফিসে তোলা আছে। এই নে পাস বই। সাত বছরে এগার হাজারের মতো জমেছে। সাবধানে রাখিস চুনী। এই এখন তোর সর্বস্ব।’
চুনী শ্ৰীলাকে প্রণাম করে ছলছল চোখে বাড়ি ছাড়ল।—‘বাবার সঙ্গে, দাদার সঙ্গে দেখা হল না মা। পরে এসে নিশ্চয়ই দেখা করে যাবো।’
আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর শেষ হয়ে গেল। প্রত্যেক মাসে, প্রত্যেকবার যখন পাপু আসে, শ্রীলা অবাক হয়ে দেখে, সে প্রতিদিন আরও সুন্দর, আরও শ্রীময়ী হয়ে উঠছে। বরাবরের গোলগাল ভাবটার ভেতর থেকে কে যেন বাটালি দিয়ে কেটে বার করে আনছে ধারাল চেহারা। গেঁয়ার, জেদী, রাগী ভাবটা কোমল ঝলমলে লাবণ্যে কবে মিলিয়ে গেল। সে যে আপাদমস্তক জয়দীপ নামে মানুষটার বিস্ময় দিয়ে মোড়া, এখনও বুঝতে পারছে না একটা অপরিমিত আনন্দের ভাণ্ডার তার সামনে কেমন করে খুলে গেল, এ বিস্ময় কেমন করে তার নিজের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল—এ কথা শ্রীলা-সুরজিৎ বুঝতে পারে। নিজেদের মধ্যে সুখের হাসি হাসে। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ডিসেম্বরে জয়দীপ চলে গেল। এপ্রিলে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে পাপুও যাবে। এ কটা মাস প্রধানত মায়ের কাছেই থাকছে সে। একদিন নিজের পুরনো আলমারি গোছাতে গোছাতে পাপু একটা প্যাকেট হাতে বলল—‘মা, একদম নতুন একটা চুড়িদার-কামিজ রয়েছে, দ্যাখো, কি সুন্দর পাউডার ব্লু রংটা।’
শ্রীলা মুখ ডুবিয়ে ডাঁই জামায় বোতাম বসাচ্ছিল। মুখ না তুলেই বলল—‘যা হঠাৎ তোর বিয়ের ঠিক হয়ে গেল, এখনও কত ওরকম নতুন ড্রেস পড়ে রয়েছে দ্যাখ। স্কার্ট-টার্ট নিয়ে যা না ক’টা। বিদেশে পরতে পারবি। নতুন নতুন জিনিসগুলো নষ্ট হবে, খুব গায়ে লাগে রে!’
পাপু বলল—‘না মা, এটা একদম নতুন। কি সুন্দর চওড়া সাদা স্যাশ!’
শ্রীলা এইবার ফিরে দেখল। চিনতে পারলো। তিন-চার বছর আগের পুজোয় কিনে দেওয়া সেই চায়না-সিল্কের পোশাক যা পাপু কোনদিন স্পর্শ করেনি। কেন পরেনি সেটা ও বেমালুম ভুলে গেছে। সে হেসে বলল—‘পর না পাপু, আজই পর।’
—‘পরব?’ চুল দুলিয়ে পাপু বলল—‘আজ বিকেলে একটু লাইব্রেরি যাবো মা, তখন পরব, হ্যাঁ?’
সন্ধে পার হয়ে গেছে। এসব পাড়ায় শাঁখ বাজে না। কিন্তু ধূপ জ্বলে। শ্রীলা ঘরে ঘরে চন্দন-ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। ধূপের অনুষঙ্গে শাঁখের আওয়াজও কেমন মনে এসে যায়, মনের মধ্যে বসে—স্বৰ্গত পূর্বনারীরা শাঁখ বাজান। অমঙ্গল অশুভ দূর হয়ে যাক এই প্রার্থনা বুকে নিয়ে মধ্য কলকাতায় ভীরু কিশোরী সন্ধের শাঁখ। সে সময়ে চারপাশ ঘিরে বাবা-মা-ঠাকুমা-দাদা-দিদিরা থাকা সত্ত্বেও সন্ধের মুখটাতে পৃথিবীটাকে কেমন একটা নাম-না-জানা অপরিচিত রহস্যের জায়গা, দুঃখের জায়গা বলে মনে হত। সেই বিষাদের অনুষঙ্গও ধূপের গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে মনে আসে। এই সময়কার নির্জনতাটুকু শ্ৰীলা খুব রোম্যান্টিকভাবে উপভোগ করে।
বেল বাজল। ছেলে গেছে দীঘা। সুরজিৎ আজ অফিস-ফেরত পাইকপাড়ায় যাবে। তার বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই খুব অসুস্থ। আসতে দেরি হওয়ার কথা। তবে নিশ্চয় পাপুই। দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে কিন্তু সে পাপুকে দেখতে পেলো না। আধা-অন্ধকারে ল্যান্ডিংটাতে পুঁটলি হাতে করে যেন চুনী দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে দিয়ে শ্রীলা থমকে দাঁড়াল—চুনীই তো!
—‘কি রে চুনী?’
চুনী হঠাৎ ল্যান্ডিংটার ওপরই বসে পড়ল। হাঁউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলল—‘মা আমায় তোমার কাছে আবার কাজ করতে দাও মা। তোমার কাছে আমায় ঠাঁই দাও মা!’
আলোটা জ্বেলে দিল শ্রীলা। পেছনে পাপু এসে দাঁড়িয়েছে। হালকা নীল চুড়িদারে তাকে বড় পরিচ্ছন্ন, উজ্জ্বল, শান্ত, সুস্থিত লাগছে। কিন্তু শ্রীলা তাকে দেখছে না। দেখছে চুনীকে। চুনীর সেই কালীঘাটের কালীর মতো চকচকে কালো কোথায় গেল? আপাদমস্তক খসখস করছে। এই ক’মাসে সে অমন হাড়-জিরজিরেই বা হল কী করে? পরনের শাড়ি ব্লাউজ দুটোই চিট ময়লা। চুলে জট, যেন হাওড়া-শেয়ালদার সারাদিন ধরে বেগুন-ঢেঁড়স-বেচা শহরতলির ফেরিওয়ালী। কিংবা সোজাসুজি ভিখারিণী। কোলে একটা পেট ফুলো, ন্যাংটাপুটো বাচ্চা ধরিয়ে দিলে মানাত।
শ্রীলা বলল—‘কাজ করবি তো বেশ কথা। কাঁদছিস কেন? সনাতনের কী খবর?’
—‘ও মিনসের নাম করো না মা’, এ ক’মাসে চুনীর মুখের ভাষারও অনেক অবনতি ঘটেছে, ‘ঠগ, জোচ্চোর, আমার জমানো টাকাগুলো তুইয়ে বুইয়ে নিয়ে নিয়েছে, শাউড়িতে আর ওতে মিলে মেরে মেরে আমায় উচ্ছন্ন করে দিয়েছে মাগো! এই দ্যাখো।’ ছেঁড়া ব্লাউজের ভেতর থেকে কালশিটের দাগ দেখায় চুনী, বলে, ‘তারপর পরশুদিন কোত্থেকে ছেলেপুলে সুদ্ধ একটা বউকে নিয়ে এসে বললে—“এই আমার আসল বউ। তুই দূর হয়ে যা”—চুনী আবার হাঁউমাউ করে উঠল।
শ্রীলা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল—কাঁদিসনি চুনী। ওরা ওইরকমই হয়। তুই তো আমাদের কথা শুনিসনি। ঘরে আয়। কাপড় দিচ্ছি, সাবান দিচ্ছি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নে। সে আবার এসে গোলমাল করবে না তো?’
—‘ইস, গোলমাল করলেই হল? নিজেই তো বলল, “কালীঘাটের বিয়ে আবার বিয়ে!” এই বাড়িতে তোমার কাছে থাকতে পেলে আমি আর কোথাও কখনো যাবো না মা!’
শ্রীলার এত দুঃখেও হাসি পেলো। তার শাশুড়ি একবার বলেছিলেন, ‘পেটের খিদে মিটে গেলে, গায়ে-গতরে একটু শাঁস-জল লাগলেই এদের অন্য খিদে চাগাড় দিয়ে উঠবেই। তখন মিষ্টি কথাই বলো আর টাকাই দাও। কিছু দিয়েই বশ মানাতে পারবে না।’
চুনী পুঁটলি খুলে বলল—‘তোমার দেওয়া সিল্কের শাড়িখানা খালি আনতে পেরেছি মা, গয়নাগুলো সুদ্ধ গা থেকে খুবলে খুবলে নিয়েছে।’
‘ঠিক আছে। তুই এই কাপড়খানা পর।’ শ্রীলা নিজের ঘরে গিয়ে আলনা থেকে তার ঘরে পরার একখানা শাড়ি আর ব্লাউজ তক্ষুনি এনে দিল।
—‘যা বাথরুমে যা চুনী। এরকম নোংরা হয়ে থাকিসনি। দেখতে পারছি না।’
চুনী বাথরুমে ঢুকে গেল। শ্রীলা হালকা মনে পাপুর ঘরে ঢুকল।
—‘ভালোই হল, বুঝলি পাপু। এতদিন ধরে লোক খালি আসছে আর যাচ্ছে। একটাও ভালো…’
থমকে গেল শ্রীলা। পাপু বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে। নীল চুড়িদার পরনে। তার পিঠের দুটো তিনকোণা হাড় জামার মধ্যে দিয়ে উঠছে নামছে। ঝুঁটি বাঁধা চুল পিঠ থেকে কাঁধের ওপর জাপানি পাখার মতো ছড়িয়ে গেছে। ছবিটা কেমন পরিচিত লাগল শ্রীলার। সে ঝুঁকে পড়ে পাপুর পিঠে হাত রাখল। হঠাৎ কী হল?
সে নরম গলায় বলল—‘পাপু! জয়ের জন্য মন কেমন করছে? আর ক’মাস পরেই তো দেখা হবে, কাঁদছিস কেন?’
পাপু তেমনি উপুড় হয়ে ভাঙা ভাঙা বোজাগলায় বলল—‘মা; চুনীর কী কষ্ট…মা! কেন এমনি হবে?’
শ্রীলা ঝুঁকে ছিল। সোজা হয়ে গেল। খাটের মাথার দিকে শুভ্র দেওয়াল। সেখানে কি কোনও লিখন? অনন্ত-কারুণিক কোনও আশিস-দৃষ্টি? নিদাগ দেয়ালের সেই অলক্ষ্য চাহনির দিকে শ্রীলা তাকিয়ে রইল পরম আনন্দে, বিষাদে। কৃতজ্ঞতায়। পাপু কাঁদছে। নিজের জন্য নয়। চুনীর জন্য।