পথিকবন্ধু
গাঢ় নীল আকাশ। মেঘলেশহীন। কালোর নানান শেড দিয়ে আঁকা একখানা অতিকায় বোল্ডার। তিনটি বাজ গাছ পেছনে। সারি সারি দাঁড়িয়ে তিনজন। হলুদ-কালো সিল্কের শাড়ি পরে একটু ঘাড় বেঁকিয়ে হাসছে মা। পাশে বাবা। অর্ধেকটাই মায়ের পেছনে ঢাকা পড়ে গেছে। সদ্য-কেনা জমকালো স্লিপ-ওভারটা কি চমৎকার এসেছে! বাবার মুখে হোল্ডারে সাদা কাঠি। ঠোঁট চাপা। চোখ দুটো চশমার আড়ালে হাসি-চকচক। বাবা একেবারে পার্ফেক্ট টি. ডি. এইচ। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম। বাবার হাত ধরে তার স্বাভাবিক ভীষণ আহ্লাদী ভঙ্গিতে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে এণা। নীল জিনস, ভীষণ চওড়া ফ্যাশনেবল্ বেল্ট, মাস্কাট থেকে সেজজেঠুমণি এনে দিয়েছিল। বেল্টের সামনের কারুকাজগুলো পর্যন্ত নিখুঁত উঠেছে। সরু সরু ঝকমকে দাঁত বার করে গলে গিয়ে হাসছে এণা। ভীষণ ভী-ষণ খুশি। কানের দু পাশ থেকে ঝুলে থাকা খোলা চুলের মধ্যে দিয়ে জাফরির মতো দেখা যাচ্ছে লাল টপটার নকশা।
ডান হাতে ছবিটা নিয়ে তারিফের ভঙ্গিতে হাতটা সামনে প্রসারিত করল বাবা।
—‘বাঃ, চমৎকার তুলেছে তো ছোকরা! একেবারে প্রোফেশন্যাল হাত। আমাদেরগুলো অত ভালো হয়নি। রঙিন বলেই উতরে গেছে।’
মা বলল—‘তোমার হাতে ছবি এসেছে এই ঢের! মনে নেই বিয়ের পর তিলাইয়ায় কি কীর্তি করেছিলে? নতুন নতুন শাড়িগুলো পরে কত রকম পোজ দিয়ে ছবি তুললুম। সব ব্ল্যাঙ্ক! জানিস এণু, কোনটাতে আবার ঝুমকো-পরা, আধ-খাবলা গালসুন্ধু একটা কান, কোনটাতে ভেলভেট জর্জেটপরা ধড়! উঃ, তোমার জন্যে আমার সবচেয়ে রোম্যান্টিক সময়টার কোন দলিল রইল না।’
—‘আহাহা! তুমি এখন তার চেয়েও কত রোম্যান্টিক হয়ে উঠেছো নিজেই জানো’না, দুঃখু করছো কেন!’
বাবা-মার কথা শুনতে শুনতে কুলকুল করে হাসছিল এণা।
তারপরেই হঠাৎ এণার বুকের মধ্যে জমাট পাথর। বাবা মেলে ধরেছে সেই ছবিটা। গ্র্যানাইটের উটের পিঠ উঁচু হয়ে রয়েছে। নীল আকাশের ক্যানভাসে মস্ত দেওদার সহিস পাশে নিয়ে একটি বলবান সাদা ঘোড়া। লাগাম হাতে, বিশাল সানগ্লাস চোখে বিশুদ্ধ কিশোরী হাসি হাসছে এণাক্ষী।
‘এক্সেলঁ’ বাবা বলল—‘আগেরটার নাম যদি দাও “থ্রি ইন ওয়ান” তো এটার নাম হওয়া উচিত “দা উইনার্স।”
এই দুটোই ওদের রোলিফ্লেক্সে তুলে দিয়েছিল ও।
বাবার চেম্বারে যাবার সময় হল। মায়ের ফোন এসেছে। নতুন অ্যালবামটা এণার কোলের ওপর ফেলে দিল মা—‘নে, সাজিয়ে ফ্যাল, পেছনে তারিখ-টারিখগুলো যেন দিতে ভুলিস না এণু।’
ছবি এবং অ্যালবাম কোলে ডিভানের ওপর বসেই থাকে, বসেই থাকে এণা। বিস্বাদ সব। কেন ও জানে না। কি একটা মূল্যবান জিনিস যেন হারিয়ে গেছে, মা-বাবা যেন হঠাৎ ওকে না বলে কয়ে কোথায় চলে গেছে। কবে আসবে জানে না। অন্যান্যবার বেড়াতে গিয়ে যেসব ছবি তোলা হয় সেগুলো নিয়ে হুলুস্থূল বাধিয়ে দেয় সে। বন্ধুদের দেখাতে হবে, শমীদি রাজাদা মৌ তুলতুল…কার কোনটা পছন্দ কপি করাও, দফায় দফায়। আরেকবার তাসের মতো ছবিগুলো সাজিয়ে ফেলল সে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। না, একটাতেও নেই। একটাতেও ওর একটা প্রোফাইল পর্যন্ত নেই। হারিয়ে গেল? পুরোপুরিই হারিয়ে গেল তা হলে? প্রথম দিকের গুলোতে তো থাকবেই না। কিন্তু গানহিলের ওপর সেই ঝড়ো সন্ধ্যায়? গাইডদের মধ্যে পেশাদার ফটোগ্রাফার ছিল, তাকেই তো তুলতে বলা হয়েছিল! তা হলে কেন…। ওরা বলছিল—‘শীগগিরই ঘরে ঢুকুন। বাতাসে উল্টে ফেলে দেবে…’। ও বলছিল—‘একটু, আর একটুখানি দাঁড়িয়ে যাই, শুনতে পাবো মেঘ বলছে দত্ত দয়ধ্বম্, দাম্যত, দাও, দয়া করো, দমন করো। একজন ইংরেজ কবি শুনতে পেলেন আর আমরা মেঘের দেশের মানুষ হয়ে দৈববাণী শুনবো না?’ কেম্পটিতে বোল্ডারে বোল্ডারে লাফ দেবার সময়ে বাবা তোলেনি? কাঠের রিকশায় ওরা যাচ্ছে, পাশে বড় বড় পা ফেলতে ফেলতে ও, ‘চল চল রে নওজোয়ান’, গান গাইছে আবার, বাবার ফরমাশ অবশ্য। রিকশায় ওঠার কথা বলতে বলল—‘এই বাইসেপ্স্ আর এই ছাতি নিয়ে আমি উঠব ওই দুবলা বৈজলালের কাঁধে? শেম! শেম!’ একেবারে খেয়াল হয়নি কারো যে ওর ছবি থাকছে না একটাতেও? অথচ এণাদের রোলিফ্লেক্সে, তা ছাড়া নিজের ভীষণ দামী কি যেন জার্মান ক্যামেরায় কত্ত ছবি তুলল ও। বারবার মনে মনে ও-ও বলে এণা যেন কেমন লজ্জা পেলো। ‘ও’ তো মা-রা বাবাদের বলে। শুধরে নিয়ে মনে মনে সে বলল—শফিদা। শফি।
এ ক’মাসে অন্তত ছখানা চিঠি সবসুদ্ধু জে. এন. ইউতে পাঠিয়েছে এণা। একটারও জবাব আসেনি। খুবই আশ্চর্য। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় পাঠালে কি চিঠি যথাস্থানে বিলি হয় না? এই তো ওর মামাতো দিদি নবনীতা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে এসে উঠেছে সম্প্রতি। ‘গার্লস হোস্টেল’ বলে আন্দাজে একটা চিঠি ছেড়ে দিয়েছিল সে। দেরি হলেও পেয়ে গেছে তো ঠিক! কে জানে! জে. এন. ইউ তো বিশাল ব্যাপার হোস্টেলের নাম-ঠিকানা, রুম নম্বর-টম্বরগুলো কেন যে জেনে নেওয়া হলো না! কিন্তু ও? ও-ও তো লিখতে পারে। ওর কাছে রয়েছে এণাক্ষীদের বাড়ির ঠিকানা ডিরেকশন সব। বাবা-মা কতবার করে আসতে বলেছে ওকে। খুবই আশ্চর্য! মা-বাবাকে বলতে আজকাল কেমন বাধোবাধো ঠেকে। বন্ধুদেরও! কেন এণা জানে না। কেন যে এণার জগতে প্রাইভেসি বলে বিচ্ছিরি অচেনা একটা ব্যাপার ঢুকল! কিছুদিন আগেও এটা ছিল না।
কিন্তু মুখ শুকনো দেখলেই এখনও মা জিজ্ঞেস করবে—‘কি হয়েছে রে এণু?’ মাকে এড়ানো মুশকিল। ‘কি আবার হবে, কিচ্ছু না।’ মাকে কেন যেন বলা যায় না প্রথম বাহারি চিঠিগুলোর জবাব না পেয়ে রাগ করে শেষে একটা অন্তর্দেশীয় পত্র ছেড়েছিল সে, প্রেরকের জায়গায় নাম-ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল নিজের। ফেরত এসেছে সেটা। কথাটা কাউকে বলতে পারেনি সে। অন্তরা, লায়লী, পিউ, কাউকে না। এমনিতেই তো ওরা খেপায়—‘কোথায় গেল রে তোর বয়-ফ্রেন্ড? উবে গেল না কি? সাবলিমেশন?’ শুনলেও রাগ ধরে। আর ওই এক হয়েছে বয়-ফ্রেন্ড বয়-ফ্রেন্ড! ও তো শফিদা। অন্তরার সেই সম্রাট রায়ের মতো নাকি! ডিস্কো নাচে। কি রকম গাড়ি-বারান্দা-অলা-চুল! কি বিচ্ছিরি তাকায়! অন্তরার আড়ালে আবার ওর সঙ্গে কি রকম গদগদ গলায় কথা কয়! বয়-ফ্রেন্ড! দূর। কিন্তু কোথায় যেন একটা অপমানবোধ জমে। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি পনের বছরের জীবনে এমনটা আর কখনও হয়নি যে! ইস্স্স্! ওকি আবারও ঘুরতে চলে গেল? ঘোরাই তো ওর হবি। বলেছিল—‘পারলে পেঙ্গুইন আর নীল তিমিদের সঙ্গেও মোলাকাত করে আসবো আইসবার্গের পিঠে চড়ে।’ জে. এন. ইউ কি ছেড়ে দিল? কেমন একটু খেয়ালিও যেন ও। আবার ও? এণাক্ষী জিভ কাটল। শফিয়ুজ্জামান। শফি।
বিছানার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে তেত্রিশখানা মুসৌরি। যেন পোস্টার-কালারে আঁকা। অফ সীজনের কি সুন্দর নিরিবিলি হোটেলটা! কি সস্তায় পুরো একটা স্যুইট! ঘরের সামনে চওড়া গোল বারান্দা। খাদের ওপর ঝুলে আছে। গোল গোল ঝুড়ি চেয়ারে নরম কুশনে পিঠ দিয়ে বসলেই কাচের ওপারে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অদ্ভুত আলো-আঁধারি। বড় বড় মেঘের ছায়া বিশাল হয়ে বিছিয়ে রয়েছে তলায়। ইচ্ছে করে ছুট্টে গিয়ে ওই মেঘের ছাতার তলায় দাঁড়াতে। পাক খুলতে খুলতে চকচকে রাস্তাটা নেমে গেছে কত দূর। গোছ গোছা গ্রামের গাছপালা ঘরবাড়ির মধ্যে থেকে একটা একবগ্গা পাহাড়ি নদীর মতো মনে হয় রাস্তাটাকে। রাত্তিরে অনেক নিচে অর্ধবৃত্তাকার আলোর নকশা। শফি বলত—‘কালো চোলিতে জরির বুটির মতো চমকাচ্ছে দেখো দুন ভ্যালি। ঊর্বশী মেনকা কোই হবে, নাইট-ড্রেস পরেছে কালো, দারুণ না? বম্বের কুইন্স নেকলেসটা এবার গলায় ঝুলিয়ে দিলেই হয়।’
গত বছর দার্জিলিঙে এণাদের একদম ভালো লাগেনি। ঠিক ম্যালের ওপর একটা ভীষণ পশ হোটেল ছিল সেটা। দোতলায় রাস্তার ওপর ঘর। সারা দিনরাত আশপাশের রেস্তোরাঁ থেকে ঝমাঝ্ঝম্ বাজনা। আনারস আর খোয়া ক্ষীর দিয়ে কি সাঙ্ঘাতিক মাংস রান্না করত একটা! খেয়ে সব্বার পেট খারাপ। বাবা বলেছিল—‘কান-মাথা-পেট আপসেট করবার জন্যে এক্সট্রা পয়সা দিতে হয় জানা ছিল না আমার।’ ম্যালের ওপর কি অসংখ্য মানুষের ভিড়। রোগা রোগা ঘোড়ার পিঠে মোটা-মোটা মহিলা। বেনারসী। হাই-হিল। গড়িয়াহাটের মোড়ের সঙ্গে কোনও তফাত নেই। তার ওপর আবার তখন মে’র শেষ। সারাক্ষণ মেঘ, সারাক্ষণ বৃষ্টি, কুয়াশা আড়াল করে রইল গোটা হিমালয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘের আড়ালেই ছুটি কাটালেন। একদিন রেঞ্জের বাঁ দিকটা একটু উঁকি দিয়েছিল, তাইতে মন আরও খারাপ। ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, ঘিঞ্জি, নোংরা, গোলমাল, একদম বাজে!
এপ্রিলের শেষ। বাবা বলল, ‘যাবি নাকি? একটু স্কুল কামাই হবে।’ কি আর করা যাবে। স্কুল কামাই না করলে কি আর দেখা যেতো স্নো পীকস? লালটিব্বার দূরবীনে চোখ লাগিয়ে সারি-সারি সাদা টুপি পাহাড়ের ছবি? ওসব মে জুন এমন কি অক্টোবরেও না কি দেখতে পাওয়া যায় না। কি ঝলমলে আবহাওয়া! সব সময়ে যেন হালকা হলুদ রঙের একটা চুন্নি দুলছে চোখের সামনে। মিষ্টি-মিষ্টি আইস-ক্রিম-ঠাণ্ডা রোদ। চুপচাপ চারদিক। রাসবিহারীর ঠিক মাঝ মধ্যিখানে এণাদের বাড়িটা। ঢং ঢঙে ট্রাম, শাঁ শাঁ বাস, ধড়ফড় করতে করতে লরি-ট্রাক-টেম্পো সবই চলছে। মা বলে, ‘বাবা রে বাবা! ঝালাপালা করে দিল কান!’
এখানে মে-জুন মাসে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব থেকে দারুণ গরমের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে কিছু কিছু লোক ছুটে আসে ঠিকই। কিন্তু এখনও সে ছুট পুরোপুরি আরম্ভ হয়নি। শহর একরকম ফাঁকাই। চওড়া, কালো রাস্তাগুলো সারাদিন পড়ে পড়ে অতিকায় ময়ালের মতো রোদ পোহায়। গাছের মধ্যে থেকে কি-সব পাহাড়ি পাখি অদ্ভুত স্বরে ডাকতে থাকে। নির্জনতা যেন আরও বেড়ে যায় তাতে। উৎরাই ভাঙতে ভাঙতে গ্র্যানাইটের দেয়ালে চার পাপড়ির হলদে গোলাপ। মা বাবা খালি বলছিল—‘তুই যা দুরন্ত, ছটফটে, ঠিক দেড় দিন পরেই বলবি, “বোরড হয়ে গেলুম”।’ জাঠতুত দিদি মীনাক্ষীকে অনেক সাধাসাধি করেছিল আসতে। হায়ার সেকেন্ডারি ফাইন্যাল ইয়ার। সায়েন্স নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। স্কুল কামাই করতে সাহস পেল না। সারা বছর রোগীর ভিড় ঠেলতে হয় যে মানুষটাকে, সারা বছর শব্দ দূষণে ভুগছেন যে মহিলা তাঁদের কাছে নির্জনতা আশীর্বাদ এবং নিরাময় মনে হতে পারে। কিন্তু এণা!
সারাদিন বাবা মা হোটেলের ঢাকা বারান্দায় দূরের দিকে চেয়ে যেন সংসার-টংসার ত্যাগ করে বুদ্ধদেব হয়ে গেছে একেবারে। কোলের ওপর রোদের রিবন। আধঘণ্টাটাক এই কাচের কৌটোর মধ্যে খুশি মনে ঘোরে এণা। পাহাড়ের ঢালে বেওয়ারিশ গরু চরছে এবং ল্যাজের ঝাপটায় মাছি তাড়াচ্ছে এই ছ হাজার ফুট উঁচু শৈল-শহরেও। পাকদণ্ডী বেয়ে গিরগিটির মতো উঠে গেল দুটো গাড়োয়ালি বাচ্চা। বড়টা আবার ছোটটাকে পিঠে নিয়েছে। নিচে বাস রাস্তায় বাস এবং ল্যান্ডরোভার কটা লুকোচুরি খেলছে। খেলনার গাড়ির খেলা। বারান্দার এদিক ওদিক থেকে সমস্ত দৃশ্যটাই বারবার দেখা হয়ে গেল। চারদিকে শুধু বাজ আর বাজ। স্থানীয় লোকেরা মিষ্টি করে বলে বাঞ্জ। বুনো এপ্রিকটে কাঁচা ফল ঝুলছে। দেওদারগুলোর প্রসারিত ডানা থেকে ঘন শ্যাওলার মত কি একটা পর্দা দুলছে। ব্যাস। আর পারে না এণা।
—বেরোও না বাবা একটু! কতক্ষণ তো বসে বসে কুমীরের মতো রোদ খেলে।’
—‘দাঁড়া দাঁড়া, তোর মা কবিতা-টবিতা লিখবে নাকি ভাবছে আমি যদি মিল-টিল সাপ্লাই দিতে পারি…।’
মা বলে, ‘কবিতা আর আমার এ জন্মে হবে না। তা বলে এই রোদ্দুরে হটর হটর করে ঘোরা আমার কম্মো না। আমি একটু বিশ্রাম করছি, বুঝলি? যেতে হয় বাবাকে নিয়ে যা।’
বাবা তখন মৌজ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে। পাজামার ওপর এলিয়ে আছে গায়ের চাদর। কি কুঁড়ে! কি কুঁড়ে! জেঠু বলে তামসিক। সেই তামসিকতার চূড়ান্ত। কবিতা না আরও কিছু। এণার কথা যেন শুনতেই পাচ্ছে না।
—‘তা হলে তোমরা থাকো। আমিই একটু রাইড দিয়ে আসি।’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই যা’, মা বলল, ‘বেশি দূর যাসনি যেন।’
—‘সাবধানে চড়বে, এখানকার ঘোড়াগুলো অশ্বই, তর নয় কিন্তু’, বাবা হেঁকে উঠল। ততক্ষণে এণা পায়ে কেড্স্ এঁটে চুল দোলাতে দোলাতে ছুট। অপেক্ষা করলে যদি বাবা-মার মত বদলে যায়!
সবে স্কুলবাসের খবরদারি থেকে রেহাই পেয়েছে এণা। এখন খাবার টেবিলে বসে বাসের হর্ন শোনে নিশ্চিন্ত মনে। পাশের বাড়ির পুঁচকিগুলোর ফার্স্ট ট্রিপ। ও এখন হেলতে দুলতে পিউয়ের সঙ্গে একা একা রাস্তা পার হয়। ট্রামে ওঠে, হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কুলে চলে যায়। এক-একদিন বাবা হাসপাতালে যায় ওর স্কুলের সময়ে। সেদিন গাড়িতে উঠতে হয়। পেছনের সীটে বসে ফিসফিস করে গুলতানি করে ও আর পিউ: সুনীতা লাস্ট বেঞ্চে বসে জিওগ্রাফির মিসের কার্টুন আঁকে, শিরীন ওর বয়-ফ্রেন্ডকে দিয়ে সমস্ত হোম-টাস্ক করায়…এই সব। দুজনে দুজনকে খোঁচা মারে আর ফিসফিস করে হাসে, বাবা যেন শুনতে না পায়।
এই প্রথম একা একা মুসৌরির রাস্তায় এণা। বেশ মুরুব্বি চালে দরাদরি করছে—‘এই, ঠিকসে বাতাও তো কেত্না লেগা?’
—‘দশ রূপেয়াসে কুলরি ঘুমাকে লায়েগা। চড়িয়ে না—মেমসাব।’
মেমসাব! আবার চড়িয়ে! ঘোড়াঅলাটা এণারই মতন অবশ্য। সাদা ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বীরদর্পে কুলরির দিকে চলে যাচ্ছে এণা। মা নেই, বাবা নেই, কেউ নেই, কেউ নেই। ঝাঁক ঝাঁক ঘোড়া। উজ্জ্বল বাদামি, সাদা, কালো, দু রঙের মিশেল। পায়ের তলায় পাথুরে জমিতে খটাখট। গান হিল থেকে কুলরি অবধি সারা ম্যাল রোড জুড়ে, রাস্তার ধারে ধারে ভুটিয়াদের পসরা। রঙিন গরম জামা আর পাথরের মালা-টালায় ঝলমল করছে রাস্তা। আকাশ থেকে আলো, পায়ের নিচে আলো, রঙ, নকশা। শূন্যের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে এণা। ঘোড়ার বাঁকা পিঠের বেয়াড়া দুলুনিটা না থাকলে তো স্রেফ পরীর দেশের রাস্তা। ঘোড়াঅলাটা বলেছিল—‘আপ তো বহোৎ অচ্ছী চড়নেবালী হ্যাঁয়। ঔর পাঁচ রূপেয়া দিজিয়ে না, ক্যামেলস ব্যাক ভি ঘুমায় গা।’
পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর প্রাণী হল ঘোড়া। আগে আগে এণার ধারণা ছিল কুকুরই মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই যে এখন ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে স্পিৎজ খোকাটা! সাদা সাদা ঝুলঝুলে লোমের মধ্যে গুলগুলে চোখ, বাড়িতে কারো ঢোকবার জো নেই, সরু গলায় প্রাণপণে চেঁচাবে অমনি কৌ কৌ কৌ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ধমক খেলেই জুজু। হয় এক লাফে এণার কোলে উঠে ফ্রকের কলার চিবোতে থাকবে, নয়তো সোজা খাটের তলায়। পারমিতাদের ডবারম্যানটা অবশ্য আরেকটু মান্যগণ্য। অ্যালসেশিয়ানদের ধরনধারণও অনেক দেখা গেছে। কিন্তু কুকুরেরা আসলে হল চাকরের জাত। বড় জোর পুঁচকে বাচ্চু। কিন্তু ঘোড়া? সওয়ার বইলে কি হবে! আকাশের দিকে মুখ তুলে, কেশর ঝেড়ে যখন হ্রেষাধ্বনি করে? কি দারুণ ম্যানলি। ক্যামেলস ব্যাকে ঢুকে কি বেকায়দাই না ফেলে দিয়েছিল এণাকে। খানা খন্দে ভরা নির্জন রাস্তা। পাইন আর দেওদারে কালো হয়ে আছে, সকাল বলে মনে হয় না। কিছুটা যায়, আর খাদের ধারে গিয়ে আগাছা খেতে শুরু করে। খাওয়াটাও উপলক্ষ। যেন কিছু খুঁজছে। মালকিনকে যেন জানিয়েও দিচ্ছে তোমার মর্জিমাফিক আমি চলব মনেও করো না।
মেয়ে গেছে বহুক্ষণ। কমলেশবাবু বললেন, ‘মেয়েটাকে একলা পাঠাতে তুমি যেরকম ব্যস্ত হয়ে পড়লে…’
সুস্মিতা বললেন, ‘বা রে তুমি যেন পড়োনি! কবিতা ভাবছ, শুধু অশ্ব, তর তম নয়, কত কি জপালে! সব দোষ আমার এখন, না!’
‘দোষ কার জানি না। তবে ইটস এভিডেন্ট বাই নাউ যে কাজটা ভালো হয়নি। নির্জন অচেনা শহরের রাস্তায় একটা বিপদ হতে কতক্ষণ? আর বিপদ কি আজকাল এক রকম?’
শিউরে উঠে দাঁড়ালেন সুস্মিতা। কমলেশবাবু অনেকক্ষণ থেকেই কাচের ওপর চোখ পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। উৎরাইয়ে নামছেন দুজন। গান্ধী চৌকের দিকে। ঘোড়াঅলা, রিকশাঅলারা অনেকেই খুব চেনা হয়ে গিয়েছিল। রিকশাঅলা বৈজলাল বললে, ‘ডরিয়ে মৎ সাব। বেবি আ যায়গী’ বলল বটে, কিন্তু কার ঘোড়ায় এণা চাপল, কোন দিকে গেল, কিছুই বলতে পারল না। মোড়ের মাথায় দুজনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে। ভাবনার ব্যারোমিটারে পারার অবস্থা বিপজ্জনক।
সুস্মিতা বললেন, ‘চলো, বৈজলালকে নিয়ে খুঁজতে বেরোই।’
‘কোন দিকে যাবে? তিন দিকে তিনটে রাস্তা বেরিয়ে গেছে।’
‘তা বলে তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না।’
‘ছোটাছুটিটা তুমিই করো তা হলে, আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ছি না।’
‘হুয়া ক্যা?’ বৈজলাল, কমলেশবাবু এবং প্রায় সাশ্রুনেত্র সুস্মিতার সামনে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে, স্পাইকঅলা ট্রেকিং শ্যূ পরে দুদিকে দু পা সটান, টেরিউলের চেক-চেক ট্রাউজার্সের পকেটে হাত, বয়স বেশি না হলেও বোঝা যায় বেশ অভিজ্ঞ সে। যে কোনও পরিস্থিতির প্রভু। কমলেশ-সুস্মিতা দুজনেই বেশ ভরসা পেয়ে গেছেন। খুব সম্ভব পাঞ্জাবি-টাঞ্জাবি হবে, পাশ কাটিয়ে চলে গেল না তো! ওঁদের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই সামান্য টান-অলা উচ্চারণে বলল, ‘আহা! দিস গার্ল! সফেদ ঘোড়ার পিঠে একেই আমি ঘুমতে দেখেছি ক্যামেলস ব্যাকে। সোচছিলাম কি লোক্যাল মেয়ে, নইলে বারণ করতাম। দাঁড়ান, আমি দেখছি। ঘাবড়াইয়ে মৎ।’
কমলেশ আর সুস্মিতা তখন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছেন না। দুজনে দুজনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।
এণার ঘোড়া খাদের বিপজ্জনক ঢালে। নাক বাড়িয়ে নিচে কি খুঁজছে সেই জানে। পিঠ থেকে নামানো ঘাড় পর্যন্ত একটা বিচ্ছিরি বাঁক। হড়কে হড়কে নেমে আসছে এণা। রাশ আঁকড়ে প্রাণপণে শুয়ে পড়েছে ঘোড়ার পিঠে। ছোকরা ঘোড়াঅলাটা সমানে হ্যাট হ্যাট করে চলেছে। এণা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। খালি নিচে খাদ, পাহাড়ি কুঁড়ে ঘর। ওরই একটার চালে সে ঝপাং করে পড়বে। তারপর গড়াতে গড়াতে গড়াতে… শেষ। হাত-পা-ভাঙা দ হয়ে বেঁচে না থাকাই তো ভালো! মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। আছাড়ি-পিছাড়ি করে কাঁদছে। বাবা? পাথর। সামনে একটা শক্ত থাবা দেখতে পেলো এণা। ঘোড়ার মুখের কাছে লাগামটা ধরেছে। তারপর এক ঝটকায় তার সাদা ঘোড়া ঘুরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে ডাক দিয়ে উঠল। এণা দেখল বাদামি ঘোড়ার পিঠে চেক-চেক ট্রাউজার্স চকোলেট উইন্ডচীটার, সবল কাঁধ, দেবদূত?
‘আপনার মা-বাবা কান্নাকাটি লাগিয়েছেন। জলদি চলুন।’
ঘোড়াঅলাটাকে সাঙ্ঘাতিক ধমক।
এই প্রথম এণাকে কেউ আপনি বলল।
কি রাগারাগি! বকাবকি! এণার সঙ্গে মা-র। ঘোড়াঅলা ছেলেটার সঙ্গে বাবার। উদ্ধারকর্তা হেসে বলল, ‘বকাঝকা করে ফায়দা কি অ্যান্টিজী? ঘুমতে গেলে এরকম কিছু কিছু হবেই, নেই হোনেসে ঘুমবার চার্ম থোড়াই আছে। জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার…ইয়ে এক বাত হ্যায় না?’
সুস্মিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি খুব বাংলা বলতে পারো তো! কিছু মনে করো না… পাঞ্জাবি… না!’
‘উহুঁ। গুজরাটি মুসলিম। মাদার ল্যাঙ্গোয়েজ সাপোজড টু বি উর্দু। জানি না। পশ্চিমবঙ্গে মানুষ। স্কুলে সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ বাংলা ছিল। বাংলা বলতে আমার কিছু অসুবিধা নেই।’
মা বলল, ‘পশ্চিমবঙ্গে দু-তিন পুরুষ কাটিয়েও তো অবাঙালিরা ভালো বাংলা বলতে পারে না। তোমাকে উৎসাহী বলতে হবে।’
‘বললাম না, সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ বাংলা ছিল। আমি তো রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র সবই অরিজিন্যালে পড়েছি। যতো ভালো পড়ি, তত ভালো বলি না। আরও অনেক প্রোবাদ-সুভাষিত জানি অ্যান্টিজী। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, নাচ নেই জানে তো উঠানকাই গলতি হ্যায়, ঠিক কি না?’
মিটি-মিটি হেসে সুস্মিতা বললেন, ‘কলকাতার কোথায় থাকো তোমরা?’
‘থাকি না, থাকতাম। ওয়েলিংটন। এখনও আস্তানা আছে সেখানে। লেবার-প্রোবলেমের জন্য বাবাও ব্যবসা গুটিয়ে দিল্লি গেলেন। আমাকেও ওখানে জে. এন. য়ুতে ঢুকতে হলো।’
‘কিসের ব্যবসা তোমাদের?’
‘আমাদের কি? বাবার। কেমিক্যালসের। ক্যা চীজ মুঝে মালুম নেই, আন্টিজী। ইন্টারেস্ট নেই। ডক্টরেট করবো। বাইরে যাবো। ব্যবসা ছোট ভাই দেখতে হয় দেখবে। ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস নিয়ে পড়ছি।’
—‘ঠিক নাম যেন বললে তোমার?’
‘সৈয়দ শফিয়ুজ্জামান। শফি বলবেন।’
হোটেলে ফিরতে ফিরতে বাবা বলেছিলো, ‘বেশ ছেলেটি।’
মা বলেছিল, ‘বাংলা সম্পর্কে মমতা আছে এরকম অবাঙালিদের ওপর তোমার বরাবরের দুর্বলতা।’
উঠে দাঁড়াল এণা। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। ভেতরে যেন ফিউজটা জ্বলে গেছে। সব অন্ধকার। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। স্বর্ণদি বলল, ‘আঙুরগুলান খাইতে ভুলছস এণু? বরফে রাখি? খাস। বকা খাইবি নইলে…’
ক্যাশমিলনের এই মেরুন কার্ডিগ্যানটার জন্য পঁচানব্বুই প্রায় দিয়েই দিয়েছিল মা। শফি বলল, করছেন এ কি? সোয়েটারবালী, সোচা সব নাদান, ক্যা?’
আশাতীত কম দামে ভালো ভালো জিনিস কিনেছিল ওরা। শফি বলেছিল, ‘চোখে লাগলে কিনে নিন, আন্টিজী। অন্য হিল স্টেশনে এরকম ফ্যাশনেবল্ জিনিস পাচ্ছেন না।’ কোন কোন সময় আবার বলত, ‘দিয়েই দিন যা চায়। আফট্রল পভার্টিলাইনের নিচে তো। জ্বালানির জন্যে তামাম পাইনবন সাফ করে দিলে। এৎনা ডিফরেস্টেশন হোনে সে ক্যা হোগা ফিউচার মে, মালুম?’
—‘আপনি বুঝি মার্কেট রিসার্চ করেন? স্ট্যাটিসটিক্স্ নেন ঘুরে ঘুরে?’ ওর দরাদরির বহর দেখে এণা বলেছিল।
—‘তা বলতে পারেন। ডালহৌসি বাদ সব হিল স্টেশন ঘোরা কিনা। ভুটিয়ালোগদের হালচাল সব জানা। আপনার মতন তো এক মাদার নেই আমার যে প্যার সে বানিয়ে দেবেন, নিজের দেখভাল নিজেরই করতে হয়, নিজে নিজেই কিনে নিতে হয় কিনা সব!’
বাবা বলল—‘এণুকে তুমি আপনি বলছ? হাসালে! এখনও রোজ রাত্তিতে আমার কোলে বসে পুরো এক গ্লাস দুধ খেয়ে তবে শুতে যায়। শী ইজ ফোর্টিন, গোয়িং অন ফিফটিন।’
—‘ভালো হচ্ছে না কিন্তু বাবা,’ এণা প্রতিবাদ করল লজ্জায়, রাগে।
সুস্মিতা বললেন—‘এই শুরু হল। দুজনে যত ভাব তত ঝগড়া। না শফি। এণা মোটেই অমন করে না। তবে বড্ড ভূতের ভয় কিনা! তাই মাঝ রাত্তিতে হঠাৎ লম্ফ মেরে মা-বাবার মধ্যিখানে সেঁটে যায়। যদি ভূতে হাত বাড়ায়।’
এণার খুব রাগ হচ্ছিল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল—‘তোমরা যা খুশি বলতে থাকো, আমিও যা খুশি করতে থাকি। ওই কা ফল না কি যেন বিক্রি করছে লোকটা, ওইগুলো আমি খাচ্ছিই খাচ্ছি।’
শফি খুব হাসছিল। ডানদিকে একটা গজদাঁত। হাসলে দেখা যায়।
কমলেশবাবু মোটেই করিৎকর্মা নন সুস্মিতার মতে, সুস্মিতা ভীষণ খরচে কমলেশবাবুর মতে, বাবা-মা সঙ্গী হিসেবে একেবারে হোপলেস, এণার মতে। এণা ইজ টু মাচ বাবা-মার মতে। বাবা বলেছিল—‘একলা একলা তোমাদের এই ইমপেচ্যুয়াস ইমপিরিয়াল মেজাজের পেয়ারকে সামলানো একটা সুপারহিউম্যান টাস্ক। যা দেখবে তাই কিনতে হবে! আর কি শেমলেস দরাদরি। একশ টাকার জিনিসটাকে বেমালুম বলে দিলে পাঁচ টাকা! আমার পক্ষে যাই বলো মোস্ট হিউমিলিয়েটিং এক্সপিরিয়েন্স!’
বাবারই সবচেয়ে বেশি জিনিস কেনা হয়েছিল কিন্তু। মা রাগ করে বলেছিল—‘ঠিক আছে। শুধু শুধুই যখন কিনছি তখন বিলিয়ে দোব। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন তো কম হয় না। তোমার বন্ধুরা—পরিতোষ ভৌমিক, অসীমাংশু চট্টোপাধ্যায় সব পরবে এখন…’
তেগবাহাদুরের একটা আলাদা, একক ছবি নিয়েছে এণা। এই যে।
ওদের প্রিয় সাদা ঘোড়াটার নাম তেগবাহাদুর। কেন কে জানে? বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরে এসে বসেছে এণা। তেগবাহাদুরের ছবিটা ব্রততীর কাকাকে দিতে হবে, অয়েলে একটা এঁকে দিতে বলবে। ওর এই ডিভানের ঠিক পায়ের দিকে থাকবে। ওর প্রিয় ভঙ্গিই ছিল কেশর ঝেড়ে আকাশের দিকে মুখখানাকে তোলা। ছুঁচলো মুখটা দিয়ে যেন আকাশটাকেই বিদ্ধ করবে ও। শফি বলত—‘করবে না কেন? ও তো আসলে পিকাসোর ঘোড়া। ঘোড়াদের ভগবানের কাছে দিনরাত প্রে করছে—“ও লর্ড, পরের জন্মে যেন এসব সওয়ার ঔর সইস লোগ ঘোড়া হয়, আর আমি যেন মানুষ হই, এ জন্মে ওরা আমার পিঠে চড়ল তো সে জন্মে হম ভি ওদের ওপর চড়ে যাবো। শোধ বোধ!’
ব্রেকফাস্টের পর ও রোজ এণাকে তেগবাহাদুরের পিঠে চড়তে নিয়ে যাবেই। প্রথম দিনের সেই অভিজ্ঞতার পর এণা ভয় পেত। শফি বলত—‘ঝান্সী কী রাণী বনবার এমন চান্স কভী মিলবে না। ডরবে না একদম। ঠিক পেরে যাবে। মঞ্জিলকে লিয়ে দো গম চলু তো মঞ্জিল সামনে আ জায়ে। তোমার মঞ্জিল মুন ভি হোতে পারে।’ সত্যিই! পিয়ালি শুটিং ক্লাবে যায়, রত্না পাল ক্রিকেট খেলে, স্বাতী মিত্র রোয়িং করে কত প্রাইজ এনেছে, এণার মা বাবা ওকে খেলাধুলো কিচ্ছু করতে দেবে না। কেন? ক’দিনেই মন্দ শেখেনি কিন্তু। জকিদের ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়েও পড়ত মাঝে মাঝে মাঝে। তখনই ও বলত—‘দা মোস্ট বিউটিফুল অ্যানিমল ইন দা ওয়ার্ল্ড। হোয়াট গ্রেস! পোয়েটিক! হিরোইক!’
ময়দানে মাউন্টেড পুলিশগুলোকে দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায় এখন। কি ভাগ্যবান লোকগুলো! দাবা খেলার সময়েও ওই ঘোড়ার চালেই বেশির ভাগ ওকে মাত করত শফি, বলত—‘দেখছো তো, ঘোড়াদের সঙ্গে আমার কি পার্ফেক্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং! অ্যান্ড দেয়ার আর মোর থিংস ইন হর্সেস দ্যান আর ড্রেম্ট্ অফ ইন ইয়োর বুকস অন চেস!’
এই ছবিটা কেম্পটির পথে, বাবা তুলেছে। কত নিচে ফলস। ওপর থেকে মানুষগুলোকে ছোট নাইলনের ডলের মতো দেখাচ্ছে। দুটো রুপোলি ধারায় নেমে গেছে প্রপাত।
শাড়ি ভিজে যাবে বলে মা নামল না কিছুতেই। বাবা তো কুঁড়ের বেহদ্দ। অন্তত দশ হাত দূরে ক্যামেরা কাঁধে দাঁড়িয়ে। বোল্ডারগুলোর ওপর নাচতে নাচতে এগিয়ে যাচ্ছিল এণা। ধা ধিনা, না তি না, তেরে কেটে ধুন, কৎ, তে, ধাগে…।
—‘কি মজা না? আপনি আগে কটা ফলস দেখেছেন?’
—‘কতো! হুড্রু, উস্রি, ভিক্টোরিয়া, নর্মদা ফলস, যোগ এখনও বাদ আছে কেদার যেতে কতো ঝর্না, ফলস, র্যাপিডস, ক্যাটার্যাক্টস!’
—‘উস্রি আমিও দেখেছি, ছোটবেলায়। এটা একদম অন্যরকম, না?’
—‘নেচারে তো কভী ডুপ্লিকেট পাবে না। অর্ডারি চীজ নেই তো! মানুষ ভি ডুপ্লিকেট হয় না। আমরা সব অলগ্ অলগ্ ফলস আছি।’
—‘উরি বাবা! কবি না ফিলসফার?’
—‘স্ট্যান্ড ক্লোজ টু দা সাবলাইম, অ্যান্ড ইউ আর বাউন্ড টু বি বোথ।’
—‘আচ্ছা আচ্ছা। তা আপনি কি রকমের ফলস সাব?’
—‘আমি? অফ কোর্স নায়াগ্রার মতো! দুর্দান্ত আওয়াজ। টপ স্পিডে ঝরে যাচ্ছি। লেকেন উইনটার আনে দো। থেমে যাবো অচানক। ঝটসে জিরো ডিগ্রির নিচে যাবে টেম্পারেচার। বাস। অ্যাবসল্যুট সাইলেন্স।’
—‘ভীষণ অহঙ্কারী তো দেখছি।’
সুস্মিতা বললেন, —‘কি এতো বলাবলি করছে গো ওরা? অত কিসের হাসি?’
কমলেশ মুখ থেকে সিগারেটটা না সরিয়েই জবাব দেন, ‘যাই বলুক না কেন? তাতে তোমার কি?’
—‘আমার কি? বেশ বলছ তো! আমার মেয়ে নয়?’
—‘তুমিও একদিন পঞ্চদশী ছিলে। মুগ্ধ যুবকদের সঙ্গে অনেক অর্থহীন প্রলাপ বকেছ। অনেক অর্থহীন হাসি হেসেছো। ও কিছু না!’
—‘প্রলাপ বকেছি? হায় রে! আমাদের বাগবাজারের বাড়ির বারান্দায় সাবেকি চিকটা এখনো ঝোলানো আছে, ভুলে গেছো বুঝি?’
—‘তা। পাশের বাড়ির ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে পারোনি বলে এখন হিংসেয় মেয়ের ওপর টিকটিকিগিরি করছ, এই তো!’
সুস্মিতা রাগ করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। মিটিমিটি হাসতে হাসতে কমলেশবাবু ক্যামেরা তুলে নিয়েছিলেন। তেরো নম্বর ছবিতে মায়ের রাগত প্রোফাইল। কেন রাগত এণা জানে না।
নামার সময়ে ওরা স্বচ্ছন্দে নেমে গিয়েছিল। ওঠার সময়েই হল বিপদ। বিশেষ করে সুস্মিতার। বাবা-মা ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে। ওরা দুজন টকাটক এ পাথরে ও পাথরে পা রেখে উঠে যাচ্ছে। কি সুন্দর মিহি রোদের দিন। পরিশ্রমে ছোট্ট ছোট্ট দানার মতো ঘাম ফুটছে কপালে।
—‘অত জোরে দৌড়য় না’ শফি বলেছিল, ‘হঠাৎ লেগে যেতে পারে। আনন্যাচারাল ব্রিদিং হতে লাগছে তো!’
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিল এণা—‘আনন্যাচারাল ব্রিদিং না হাতি। আমি আরও জোরে দৌড়তে পারি। নিজে আর পারছেন না তাই বলুন।’
—‘আমি পারছি না। হাউ ডেয়ার য়ু! জানো কতবার ট্রেকিং-এ গেছি! ফালুট, সান্দাকফু, রূপকুণ্ড, পাহাড়ে চড়ার কতকগুলো নিয়ম আছে বেবি, সেগুলো ফলো করতে হয়।’
নববিবাহিত দম্পতি এসেছে প্রচুর। বোধহয় হনিমুনে। অস্বস্তিকর দৃশ্য চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে। অস্বস্তি কাটাতে শফি বলেছিল—‘দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলি। ওই উঁচু পাথরটার ওপর ডান পাটা তুলে দাঁড়াও তো!’
—‘বাঘের মৃতদেহের ওপর পা রেখে শিকারীরা যেমন দাঁড়ায়? তা আমার রাইফেল কই?’
—‘বাঃ, আচ্ছা বলেছ তো! অরিজিন্যালিটি হ্যায়। লেকেন অরিজিন্যালিটি ইজ সিম্পলি এ পেয়ার অফ ফ্রেশ আইজ।’
কোথা থেকে একটা গাছের ডাল যোগাড় করে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল—‘এই নাও, এবার আর ছবিটাতে তাল কাটছে না। দিস মাস্ট বি এ পিস অফ মিউজিক।’
—‘পাঠাতে মনে থাকবে তো? ঠিকানা দিয়েছি কিন্তু কাল। আর কলকাতায় গেলেই আগে আমাদের বাড়ি।’
—‘জরুর। তবে ছবিগুলোই আসল হেডেক কিনা। মেয়েরা ছবি বিষয়ে বেদম লোভী আছে।’
—‘সত্যি বলছি। শুধু ছবিগুলোর জন্যে মোটেই নয়। একলা একলা বাড়িতে বোরড লাগে আমার। দারুণ দারুণ বিদেশি ইনডোর গেম আছে। ভালো সঙ্গী না হলে খেলা হয়? মজার মজার বন্ধু আছে। আলাপ করিয়ে দোব। রুম্পাদের রুফ গার্ডেনে মুনলাইট পিকনিক করা যাবে।’
—‘শুধু ফটোগুলোর জন্যে নয়, ঠিক? তিন সত্যি লাগাও!’
—‘বাবা বাবা! করলুম তিন সত্যি। তিন সত্যিও জানেন? কি ভীষণ সুপারস্টিশাস! গাঁইয়া একেবারে।’
—‘ও, আমার বেলা সুপারস্টিশাস! কাল তা হলে—এক শালিক দেখে অমনি কালো মুখ হল কেন?’
—‘মোটেই না।’
—‘মোটেই হ্যাঁ।’
—‘আজ্ঞে না। আমি আসলে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। মুসৌরিতে শালিক দেখে অবাক হবো না! মনে হচ্ছিল ওটা আমাদের পার্কের শালিকটাই। রোজ যেটা রাধাচূড়ার ডালে রসে কটর কটর করে!’
—‘হতেই পারে। দোস্ত তো! তোমার ট্রেনটার সাথ্ সাথ্ উড়েছে বেচারা।’
ছবিগুলো একমনে দেখছে এণা। কখনও চলে যাচ্ছে মিউনিসিপ্যাল গার্ডেন, কখনও গান হিল। বিদ্যুৎবর্ষী আকাশের তলায়, দেওদার বীথিকার পথে পথে বহু দূর। পায়ের তলায় ঘোড়ার নালে শব্দ উঠছে। ফুলকি বেরোচ্ছে। ছোটাও। ঘোড়া ছোটাও। জোরে আরো জোরে! কী বিস্ময়কর বাঁক নিয়ে পথ নেমে গেছে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ইনস্টিট্যুটের দিকে। রঙবেরঙের মোমের ফুলের মতো বিরাট বিরাট গ্ল্যাডিওলাস ফুটে আছে ঝাড়ে ঝাড়ে। আলো হয়ে আছে কাচঘর। রবারের বোট ভাসছে লেকের জলে। সবুজ দোপাট্টা উড়ছে বোটবিহারিণীর। শফি বলেছিল—ওদের নিয়ে গোমুখ যাবে। পথ যেমনি দুর্গম। তেমনি সুন্দর। ওয়াইন্ড বিউটি। জ্যোৎস্নারাতে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার যা দেখায় না!
আসবার আগের দিন ঠিক সাড়ে সাতটায় হাজির। সেই চেক চেক গরম প্যান্ট। চকোলেট উইন্ডচীটার। তখনও প্রচণ্ড শীতের কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে হোটেল। এণা বলেছিল—‘বেডটির লোভটাও বুঝি ছাড়তে পারলেন না? বাবা! বাবা! অ্যাত্তো সকালে কেউ কাউকে ঘুম থেকে তোলে? তুললে পাপ হয়।’
বাবা বলল—‘ঘুমো না তুই কত ঘুমোবি। তবে মনে রাখিস, আগামীকাল এরকম সময় আমরা দেরাদুনগামী বাসে চড়বার জন্যে রেডি হচ্ছি। শেষবারের মতো যা দেখবার দেখে নে।’
হোটেল থেকে বেরিয়েই মা বলল—‘আমাদের একটা ফ্যামিলি গ্রুপ তুলে দাও তো শফি! ও একটাতেও থাকছে না।’
রাস্তার বাঁকে সেই ছবি। মা-বাবার বুকের কাছে হারের লকেটের মতো দুলছে এণা। ঝকঝকে হাসি। তারপরই বাবার ক্যামেরাটা নিয়ে দুজনে ক্যামেলস ব্যাক। বাবা-মা রেস্তোরাঁর সামনে কালভার্টের ওপর বসে রইল। তেগবাহাদুরের পিঠে ওরা দুজন। সেই প্রথম দিনকার স্পটটাতে এসে রোলিফ্লেক্স তুলে নিল শফি। পেছনে আকাশ, দেওদার, নীল, কালচে সবুজ।
—‘প্রথম দেখা যেখানে, শেষ দেখাও সেখানেই হোক, কি বলো এণা! লাস্ট রাইড টুগেদার…’
এণার মনটা হঠাৎ বড্ড বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
—‘কেন? আজ তো সারাদিনই আমাদের সঙ্গে থাকবার কথা। বেশ তো!’
—‘সহী বাত। কিন্তু তোমার সঙ্গে এই শেষ দেখা, ঠিক কিনা?’ ‘তোমার’ শব্দটার ওপর অস্বাভাবিক জোর। চোখে চোখ। এণা চুপ। ‘তোমার’ শব্দটা ঘিরে তৈরি হচ্ছে অজানা, নিবিড় একটা অদ্ভুত গোপন অনুভূতির অবয়ব। সানগ্লাসের কুয়াশার আড়ালে এই প্রথম আরেক রকম শিশির জমছে।
—‘ভালো করে হাসো! বাঃ!’—ক্লিক।
এখন সেই ছবিটাই দেখছে এণা। দেরাদুনের মামার কাছে পড়েছিল। কয়েকটা ফিল্ম বাদ ছিল, সেগুলো মামাই তুলল, তারপর বলল—‘আমি ওয়াশ-টোয়াশ করে পাঠিয়ে দোব কমলেশদা।’ বাবাও যেমন, বলল—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে!’ এত কুঁড়ে মামা যে ছবি পাঠাতে যুগ কাবার করে দিলে। অক্টোবরের আকাশ আজ তেমনি মুসৌরি নীল, রোদ্দুরে মাঝ দুপুরের মুসৌরি ওম, তেমনি পাহাড়ি সবুজই বুঝি ফলে আছে রাসবিহারীর গাছগাছালিতে। বিকেল তিনটের নির্জনতায় চিঁউ চিঁউ করে কি একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে ক্রমাগত, সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা জোড়া ট্রাফিক সত্ত্বেও ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রোশ ক্রোশ মন-কেমন-করা নির্জনতা। এণার বুকের মাঝখানটায় সেই গোপন বালির বিন্দুটাকে ঘিরে ঘিরে কেমন একটা অব্যক্ত কান্না শরীর নেয়। শুক্তির মধ্যে মুক্তো। অন্যমনস্কভাবে একটা ঢোঁক গিলে ঘুঙুরের ব্যাগটা তুলে নেয় এণাক্ষী। আনমনেই পার হয় রাস্তা। নাচের স্কুল আছে। অন্তরা, লায়লী, কে, সাবিত্রী, উষা,… ধা… ক্রেধা…ধিনতা কৎ, ধিনা নানাধা, ধিনা নানাধা, ধিনা। ভীষণ ভিড় বাসটায়। আনমনে বাসে উঠল, টিকিট কাটল। রোববারেও এতো ভিড়। হাজরার মোড়। হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠল এণা। স্টপে তিন-চারটি ছেলে খুব হাত-মুখ নেড়ে কথা বলছে। ওদের মধ্যে শফি না?—‘শফিদা! শফিদা! এই শফি।’
ও দেখতে পাচ্ছে না কেন? শুনতে পাচ্ছে না কেন? এতো ভিড় টের পাচ্ছে না তো এণা! মাঝখানে তো কেউ নেই! একবার যেন তাকাল এদিকে! চোখাচোখি হয়েও হল না। কে হবে ও ছাড়া! পাকা পেয়ারার মতো মুখের রং! সোনালি সোনালি গোঁফ! একগাল কোঁকড়া দাড়ি, চওড়া কাঁধের ওপর সেই অশান্ত চুল। বাসটাতে উঠেও উঠল না যে! এণা নামতে চাইল, পারল না। সামনে জমাট মানুষের দেয়াল। যা ছেড়ে দিল। ঠিক সেই সময়ে চোখে চোখ পড়ল।
—‘কি হল রে? ছেড়ে দিলি যে বাসটা? আচ্ছা আহাম্মক তো!’ শ্যামলের কথার কোনও জবাব দিল না কল্যাণ। সে শুনেছে। মাইল মাইল জনজঙ্গলের নির্জনতার মধ্যে থেকে শরবিদ্ধ পক্ষিশাবকের চড়া সুরের আর্ত ডাক—‘শফিদা! শফিদা! এই শফি।’ হৃদয়জোড়া বিভ্রান্তির মধ্যে দেখতেও পেয়েছে। দেখতে পেয়েছে একটি অপাপবিদ্ধ কিশোরী মুখে স্তম্ভিত বিস্ময়। অভিমান? আশাভঙ্গ। অপমানে নীল মুখখানা।
কিন্তু কি করবে সে? পথের আলাপ ঘরে টেনে আনার কোন উপায় নেই যে তার। কি করবে সে একটিমাত্র ঈশ্বরদত্ত দীন পরিচয়ের মধ্যে আটকে থাকতে যদি না চায় মন? প্রবাসে তাই তো সে সব সময়ে অজ্ঞাতনামা, গরঠিকানা। কখনও বাঙালি ক্রিশ্চান অ্যালফ্রেড বিকাশ মণ্ডল—মুখে শেকসপীয়র, এলিয়ট, হুইটম্যানের ফুলঝুরি, কখনও অমলজ্যোতি সিংহরায় রাঢ় বঙ্গের জমিদারবংশের শেষ কুলপ্রদীপ, প্রাচীন জলসাঘরের স্মৃতি কাফি ঠুংরি, বাগেশ্রী তারানার টুকরা হয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। কখনও এমনি গুজরাতি মুসলিম সৈয়দ শফিয়ুজ্জমান। প্রতারক? শহরতলির স্টুডিওতে তালা ঝুলিয়ে যখন সে একা একা বেরিয়ে পড়ে তখন তো গৃহত্যাগী বৈরাগীর মতোই ফেলে দিয়ে যায় এখানকার পরিচয়। সন্ন্যাসীরা অন্য নাম নেন না? সেও তো একরকম পরিচয় বদলের নেশা! এক পরিচয়ে যে বড় ক্লান্তি! পথের ঝুলি বেদিয়ার আলখাল্লা আবার পথেই নামিয়ে দিয়ে আসে মফঃস্বলের ফটোগ্রাফার কল্যাণময় বিশ্বাস। ঘনিষ্ঠতা, বিশেষত কলকাতার লোকের সঙ্গে, সাধারণত এড়িয়ে চলে সে। এবার বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল। উৎরাই ভাঙতে ভাঙতে গ্র্যানাইটের দেয়ালে ফুটে ছিল হলুদ গোলাপ। চার পাপড়ির ছোট্ট ফুল! ছেঁড়েনি ছোঁয়নি। শুধু চোখ মেলে চেয়ে দেখেছে। অ্যালবামের পাতায় বন্দী হয়ে থাক দু পাথরে দুই পা, পাহাড়ি গাছের ডাল হাতে পঞ্চদশী সেই ভ্রমণসঙ্গিনী। স্রোতের পাথর কি চার দেয়ালের মধ্যে কুড়িয়ে আনতে আছে? জলের তলায় জেগে জেগে ওরা দূর আকাশের স্বপ্ন দেখে। জাগরস্বপ্ন ভাঙাতে নেই।