আত্মজন
॥ ১॥
বাড়িতে আদ্যিকালের দেয়ালঘড়িখানায় ট্যাং ট্যাট্যাং ট্যাং করতে করতে বেলা তিনটেও বাজল, ডাক্তারবাবুরাও সব একত্তরে যেন সাঁট করে রুগীর ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মুখগুলোয় সব থম ধরেছে। কেউ কারও পানে চাইতে পারছেন না সোজাসুজি। মোটা টাকার ফি গ্যাঁটস্থ হয়েছে, সারাদিন এলাহি খাওয়া-দাওয়া, কিন্তু সুরাহা কিচ্ছুটি হল না। তা ছাড়াও, মানুষগুলির বিদ্যে-সিদ্যে সব যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। বড়বাবুও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন। শুধু মেজবাবু এখনও ভেতরে। মুখময় খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি, পালঙ্কের ইদিক-উদিক দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ঘুরে ঘুরে মরছেন।
শহর থেকে গলা-কাটা-দাম-দিয়ে-আনা ডাক্তারগুলি সব যে যার গাড়ি করে হুস্ করে গেল। বাড়ির বদ্যি গুহ ডাক্তারই শুধু জালে আটকা পড়ে ধাড়ি কাতলার মতো খাবি খাচ্ছেন। বড়বাবু তাঁর কনুইয়ের কাছটা ক্যাঁক করে ধরে আছেন। কোনমতেই ছাড়ছেন না। নজর মাটির পানে রেখে গুহ বদ্যি মাথাটা নাড়লেন, ডাইনে-বাঁয়ে। বড়বাবু বললেন—‘সে কি?’ কথার ভাবে মনে হল অত বড় মানুষটি এক্ষুনি ভ্যাঁ করে ফেলবেন। গুহ নিচু গলায় বললেন—‘ব্যাপার তো ভুতুড়ে কিনা বড়বাবু! রক্তে চিনি নেই কো, হার্ট প্রেশার সব ঠিক ঠাক, ইনফেকশন নেই। আঘাত-টাঘাত কিছু না। খামোখা মানুষটার এমনিধারা অবস্থা যাকে কিনা আমাদের শাস্তরে বলে ‘কোমা’। আপনি তো দেখতেই পেলেন বড়বাবু ওনারা সব বলছেন হাসপাতালে নিলেও সুবিধে বিশেষ কিছু হবে বলে মনে হয় না। আর, হাসপাতালের ব্যবস্থা তো এখানেই সব করেছি—গ্যাসকে গ্যাস! স্যালাইন কে স্যালাইন। চব্বিশ ঘণ্টা নার্স মোতায়েন। ত্রুটি তো কিচ্ছুটি রাখেননি বড়বাবু!’
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। মেজমণিকে শহরের বড় ডাক্তারেও জবাব দিয়ে গেছে। কবরেজ, হাকিম, হোমিওপ্যাথিক, জড়িবুটি সব রকমই হচ্ছিল। এখন শেষমেষ ভারি শহরের ভারি ডাক্তার, বুকের ছবি, পেটের ছবি, হ্যান একজামিন, ত্যান একজামিন, এক কাঁড়ি করে টাকা খর্চা, তা তেনারাও সব যে যার মতো মাথা নেড়ে নেড়ে জবাব দিয়ে গেলেন।
ছোট গ্রাম। গঞ্জর কাছেই। টাউন-শহরও দূর-দূরান্তে। তা সেই গাঁয়ের যে যেখানে আছে আজ এতোগুলিন দিন একবার করে অন্তত বড় বাড়িতে হাজরে দিয়ে আসছে। জমিদার-বাড়ি নয়, হাকিম না হুকুম না, তবু বড় বাড়ি বড় বাড়িই। গাঁয়ের ছেলে ছোকরার, ঝি-বউয়ের বিয়ে-বউভাতে ওই বড় বাড়ির উঠোনেই শামিয়ানা পড়ে, পালা-গান, যাত্রা, অষ্টপ্রহর সব ওইখানেই।
কিছুর মধ্যে কিছু না বড়বাড়ির মেজমণি অজ্ঞান হয়ে আছেন আজ মাস ফুরুতে চলল। অমন লম্বা চওড়া জগদ্ধাত্রীর মতো শরীরটি ছোট্ট হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। সোনাহেন বর্ণ কালি-ঢালা। চোখ-মুখ সব যেন গর্তে ঢুকে আছে।
ঘটনাটা যে রোববার ঘটল, তখন দুপুরবেলা। সিরাজুলের মা অন্দরে বসা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণখানা সে ইতিমধ্যেই যেখানে পেরেছে চাউর করে ফেলেছে। বাড়িটিতে মানুষ তো আর কম নয়! শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে ষেটের বাছা এই এতগুলি। সব যে যার তালে। বড়মণি পুজোর ঘরে। বেরোতেই কোন না একটা দুটো বেজে যাবে। তিরিশ রকম ঠাকুর-দেবতাকে ফুল-জল দেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! বড় ভক্তিমানী মানুষটি বড়মণি। এতটি বেলা পর্যন্ত সুদ্ধু এক ঘটি চা খেয়ে ঠাকুর দেবতাদের সব জল-পান দিচ্ছেন। ছোটমণি তখন টেবিল ঢাকায় ফুল কাটছেন ফুট ফুট। সূঁচ ঢুকছে, সূঁচ বেরুচ্ছে, আর কত রঙবেরঙের কারুকাজ—দোপাটি ফুল, বেড়ালছানা, শিবলিঙ্গ জড়িয়ে কালসাপ—সব সিলসিল সিলসিল করতে করতে ঢাকার ওপর আঁকা হয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু তখন আড্ডাঘরে, তাস পিটছেন, ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে গুলতান খুব জমেছে। ওদিকে বড়বাবুতে মেজবাবুতে তক্কো চলেছে। ইনি বলছেন সাংখ্য হলেন গিয়ে আদি সংখ্যার আখ্যান-বাখ্যান, সাংখাই সবচেয়ে বড়, উনি বলছেন বেদান্ত হচ্ছেন সব বিদ্যের অন্ত বাপধন! কে বড় কে ছোট এখন আপনি বোঝ।
পেল্লাই ভাতের হাঁড়িখানি নামিয়ে মেজমণি বললেন—‘আর একটু সবুর কর সিরাজুলের মা, বেলাবেলি দুধটুকু জ্বাল দিয়ে নিই। একরাশ কচুর ডাঁটা কাটতে আমার সৈরভীর দুধটুকু জ্বাল দেওয়া হয়নিকো এখনও।’
‘বসতেই তো এয়েচি তোমার ঠেঁয়ে’—সিরাজুলের মা গাছের আম-জাম কোঁচড়ে নিয়ে অপেক্ষা করে। দুধ জ্বাল দিয়ে, উনুনে রাশ রাশ কয়লা ঢাললেন মেজমণি। উনুন দুখানা কী! রাই খাই না রাবণ খাই। কয়লা দিয়ে-টিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে দাওয়ায় এসে বসলেন মেজমণি। মেজমণিও বসলেন সিরাজুলের মা-ও নিষ্পলকে দেখতে থাকল। দুগ্গা ঠাকুরের মতো এই টানা টানা চোখ, ভুরু কান ছুঁয়েছে, এই থাক দোয়া দোয়া চুল! এতক্ষণ হাতখোঁপা করে বেঁধে রেখেছিলেন রসুইঘরে ছিলেন বলে, এখন খুলে দিতেই শাঁত্ করে পিঠময় ছড়িয়ে দাওয়ার ওপর বিলি কাটতে লাগল। কি রাশ! বাব্বাঃ! ডিবিসি বাঁধের বন্যের মতন।
হাত দিয়ে চুলের গোড়ার কাছটি খেলাতে খেলাতে মেজমণি বললেন—‘আম ক’খানি তুই নিয়ে যা দিকিনি। তোর সিরাজুল খাবে। বচ্ছরকার জিনিস। একটি তো মোটে তোর গাছ, তা থেকে বিকোবি, বিলোবি, তবে আর খাবি কি বাছা। চাল তোর থলিতে আমি ভরে দিয়েছি। দেখিস কাগজের ঠোঙায় মুড়ে আলাদা করে একটুখানি কামিনী দিলুম, পায়েস করে মায়ে-পোয়ে খাস।’
বেশ গপ্প করছিল সিরাজুলের মা গেজেটবুড়ি, গাঁয়ের গপ্প, গঞ্জর গপ্প, টাউন-শহর থেকে যা-যা তথ্য-সংবাদ কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনতে পেরেছে তা-ও। গপ্প করছিল আর ভেবে মরছিল—‘এই মানুষের আবার অংখার! লোকে দেখেই বা কি আর বলেই বা কি! পাড়া বেড়াবে কি মানুষটা, মরবার সময়টুকু থাকলে তো!’
হঠাৎ মেজমণি কেমন অস্থির হয়ে বললেন—‘মা, শরীরটা আমার কেমন আনচান করছে, আমি একটুক ঘরে যাই।’
যেতে যেতেই মেজমণি টলতে লাগলেন, সিরাজুলের মা না ধরলে বোধ করি পড়েই যেতেন। পালঙ্কে কোনমতে কাত করে দিয়ে সিরাজুলের মা অন্দরের অন্য দিকে ছুটল—‘ও বড়মণি গো, ও ছোটমণি গো দেখে যাও তোমাদের মেজমণি কেমন করতেছে!’ বড়মণি ঠাকুরঘরে, শুনতে পেল না। ছোটমণি সিলোতে সিলোতে সুতোটুকু দাঁত দিয়ে কাটছিল, তা দাঁতের সুতো দাঁতেই রয়ে গেল, ছোটমণি দৌড়ে এসে বললে—‘মেজদি-ই-ই।’ আর মেজদি; মেজদি তখন ঘোরে কি বেঘোরে।
বড়বাবু এলো ধমধম করে, মেজবাবু এলো কাছা কোঁচা সামলাতে সামলাতে, ছোটবাবু এলো বাঁটা তাসক’টা হাতে ধরে, শেষকালে গুহবদ্যি এলো তার চামড়ার থসথসে ব্যাগটি নিয়ে, গলায় ইস্টেথো ঝুলিয়ে। ক্রমে গাঁ গঞ্জের মানুষগুলি আড়ালে-আবডালে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বড় বাড়ির পেল্লাই বার-উঠোনে, ভেতরবাড়ির দরদালানে, দোলমঞ্চের ফাটা ফোটা থামগুলির আশেপাশে ভেঙে পড়ল। কি হয়েছে গো মেজমণির? কি হল হঠাৎ মেজমণির? আগে তো কখনও কিছু শুনিনিকো বাতিকের ব্যামো আছে বলে? কি হয়েছে না কি হয়েছে! সেই যে মেজমণি চোখ বুজেছেন আজ নিয়ে পুরো সাতাশটি দিন কাবার হয়ে গেল, মানুষের আর চোখ মেলবার নামটি নেই।
জমিদারি কবেই উঠে গেছে। তারও আগে থেকে গেছে বড়বাড়ির ঝাড়বাতি, বোলবোলাও, লোক-লস্কর। বলতে লাগে না, পাঁচিলের গায়ে বড় বড় বট অশত্থ, ডুমুরের বাড়বাড়ন্ত দেখলে কথাটি আপনি বোঝে যে জন বুঝদার। যে ক’ বিঘে ধান-জমি, পুকুর, বাগান, গোধন আছে, তল্লাটের সব মানুষ জানে তা দিয়ে বড়বাড়ির জলখাবার টুকুনিও হয় কি না হয়। বড়বাবু দেবভক্ত সাত্ত্বিক মানুষ, জীবনে কখনও রোজগারের টাকা ছুঁয়ে দেখেননি। ভাত পাতে তেতো থেকে মিষ্টান্ন অব্দি কুটি কুটি সব রকম না পেলে রোচে না। ক্ষীর কদ্দূর ঘন হল ঢালা-উপুড় করে দেখতে হয় রোজ। কোঁচা লুটুবে একহাত। ঝাড়া বাহান্ন ইঞ্চি, কল্কাপাড়ের দিশি কাপড় নিবারণের কুঁচিয়ে দেওয়া নইলে বড়বাবু পরেন না। মেজকর্তার তক্কো বাতিক। যেখানেই চাকরি করতে যান তক্কো করে সেসব খুইয়ে-টুইয়ে দু’দিন পরেই বাড়ি এসে বসেন। আপিসে লোক রাখে কাজের জন্যে, খামোখা তক্কো করলে তারা শুনবে কেন বাপু? ছোট কত্তার অতসব ভাববার চিন্তোবার সময় নেই। ছেলেবেলা থেকেই নানান শখ। তাসের শখ, যাত্রা-থিয়েটারের শখ, মেডেলের শখ। কিছুর মধ্যে কিছু না ছোট কত্তা হঠাৎ মেডেল হেঁকে বসেন। তালদিঘি, পাড়ুইপুর, কন্নাট এই তিনখানা গ্রাম যে সবচেয়ে আগে বড় বেড় দিয়ে আসতে পারবে সে সোনার মেডেল পাবে। ছোট কত্তার মুখ থেকে কথা বেরুনো আর রামচন্দ্রের ধনুক থেকে তীর বেরুনো মোটের ওপর একই কথা। ওরে এই বাজারে সোনার মেডেল কোথায় পাবো রে? পাত দিয়ে মুড়ে দিতে হলেও হাজার দু-হাজারের ধাক্কা! ওরে অমন হাঁকা হাঁকলি কেন? আর কেন! ছোট কত্তা মাথায় নতুন গামছা চাপিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। ভাত খাবে না, ঘুমোবে না, কথা কও তার জবাব দেবে না। চোখের জলে নাকের জলে হয়ে সদর-অন্দর সদর-অন্দর করতে করতে অবশেষে ছোটমণি রসুইঘরে গিয়ে দড়াম করে আছড়ায়—‘অ মেজদি, কি হবে গো, মানুষটা যে শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হতে চলেছে।’
মেজমণি হেসে বলে—‘আচ্ছা সে আমি দেখছি’খন।’ মেজমণি দেখচি বলল তো হিল্লে হয়ে গেল। আর ভাবনা নেই, চিন্তা নেই। এখন যে যার ঘরে বসে শিবের মাথায় বিল্ব-চন্দনই দাও, কি কাঁথাই সিলোও, তাসই পেটো কি বিদ্যের জাহাজ ভাসিয়ে তক্কাতক্কিই করো। যা করো বাপু নিশ্চিন্দে করো গে! মেজমণি বলে দিয়েছে—‘সে আমি দেখছি’খন।’
বড়বাড়ির এই হল গিয়ে বৃত্তান্ত। ননদিনীরা আসেন, যান। শহর-বাজারের মস্ত মস্ত সব জামাই। গো-গাড়ি, সাইকেল রিকশা, কি জগঝম্প মটর গাড়ির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এসে পড়েন। তখন বড়বাড়িতে যেন রসুনচৌকি বসে। জামাই শালা ভাজ ননদাই নিয়ে সে বড় আদিখ্যেতার রোশনাই। বড় বউর ঘরে বসে হাত-পা ছড়িয়ে গাল-গল্প করতে করতে বড় ননদ বলেন—‘পানে বেশ করে কেয়ার খয়ের দিয়ে সেজো গো মেজ বউ।’ মেজমণি বলে—‘আচ্ছা!’
মেজননদ বলে—‘ছেলে দুটো আমার কেন যে অমন খ্যাংরা কাঠির জ্ঞাত-গোত্তর বুঝি না ভাই মেজ বউদি।’
মেজমণি বলে—ওষুধ আছে। মেজদি তুমি ঘুম যাও।’
মেজদি গিয়ে ছোটমণির ঘরে এ কেলেচ্ছা ও কেলেচ্ছা করতে করতে ঘুমিয়ে যায়।
সেজননদ বলে—‘তোমার ননদাই বলছে কষে জলসা বসাও গিয়ে একদিন গাঁয়ে। গাইয়ে-বাজিয়ে বাজাবার দায় তাঁর, রাখবার দায় তোমার। উনি সারারাত ঠায় তবলায় বসে থাকবেন।
মেজমণি বলে’ বেশ তো।’
ছোট ননদ বলে—‘পুজোর কাপড়-চোপড়গুলি দেখে শুনে নাও গো বউদিরা। ফুল কাটাটি ছোট বউর, দাঁত দেওয়া মেট্রোপাড়খানা বড় বউর, ছেয়ে-রঙটি নয় মেজ বউদি নিও।’
নিজে নিজেই উল্টে-পাল্টে দেখে ননদ তেমন সরেস হল না এটি। না-ই হোক। অনেক আছে মেজর। অনেক, অনেক।
ছেলে-পিলেরা সারাটা দিন মেজমণির পায়ে বাজছে। মেজমণি না খাওয়ালে ভাতের পাত শুধু ঠোকরাবে। মেজমণি রূপকথা না বললে—দুপুর রাত পর্যন্ত চোখ সব টেনে টেনে খুলে রাখবে, বলবে—‘ঘুম আমাদের পায়নি গো। ঘুম পায় না।’ এমনি বজ্জাত সব।
ছোট কত্তার ছেলের মুখে-ভাত হবে। কত্তারা সব মেজর ঘরে শলা নিতে গেছেন। কোথা থেকে দই আসবে? মেজমণি বললেন—‘অনন্ত ঘোষেরটাই ভালো।’ কোন পুকুরের মাছ উঠবে? মেজমণি বললেন—‘কেন? তেলি পুকুরের! থই থই করছে এখন রুই কাতলায়!’ নেমন্তম্নের লিস্টি মেলাও, গুষ্টি জ্ঞাতি বর্গের কেউ যেন আবার বাদ না যায়। তদারক করো, তদবির করো।
মেজমণি শশব্যস্তে বলেন—‘বড়দি, তোমার পুজো হয়েচে তো ভাতের হাঁড়িটা একটু নামিও, নবাই এয়েচে, মাছের কথাটা ঠিকঠাক করে আসি গে।’
বড়মণি চোখ কপালে তুলে বলেন—‘এই সেদিন যে বুকের ব্যামো ধরা পড়ল রে মেজ, ভুলে গেলি? ওমা! আমি যাবো কোথা।’
মেজমণি বলেন—‘কি সব্বোনাশ, তাই তো! ছোট কোথায় গেলি? ছোটকে ডাকো, নবাই বড্ড ব্যস্ত হচ্চে।’
ছোট ফিসফিস করে বলে—‘খোকার আমার ঘুমটা সবে ধরেছে গো মেজদি! চাঁদের কপালে চাঁদ আহা! নইলে তোমার ভাতের হাঁড়ি কেন গোটা হেঁসেলখানাই নামিয়ে দিয়ে আসতুম গিয়ে।’
গভীর রাত্তিরে সব ঘুমিয়ে-জুমিয়ে পড়লে মেজকত্তা আড়ে আড়ে দেখে মেজমণি গদির তলা থেকে চাবি বার করল, ঘরের কোণে আঁধার বরণ সিন্দুকের চাবি ঘোরাল ঝনাৎ করে, সিন্দুকের ভেতর রুমঝুম, টাকায় মোহরে গাঁদি লেগেছে, সব মেজমণির ইস্ত্রীধন। তা থেকে মেজমণি সংসারের সার খরচ-খর্চা যেটুকু যা দরকার, অন্নপ্রাশনের মোচ্ছবের টাকা গুণে গেঁথে সব তুলে নিল। মেজকত্তা পাশ ফিরে নিশ্চিন্দে ঘুম গেল।
এইভাবে বড়বাড়ির বড় সংসার—তার দৈনন্দিন, তার পাল পার্বণ, তার মোচ্ছব সব চলে। সেই মেজমণি আজ সাতাশটা দিন জ্ঞান নেই, ঘোরের মধ্যে পড়ে। চলে?
কি করবে! বড়কত্তা গোবিন্দ বসাক গদিওয়ালার কাছে কর্জ করে আসেন। মেজ বউ উঠলে পরে শোধ যাবে। মেজকত্তা গদি-টদি হাতড়ে চাবি-টাবি কই কিচ্ছু পায় না। সিন্দুকের ডালা যেমন ভারি হয়ে বসে থাকে তেমনি। দেয়ালের তাক হাতড়ে আলমারির খোপ হাতড়ে অবিশ্যি টাকাকড়ির পুঁজি মন্দ মেলে না। মেজকত্তা সেইগুলি দিয়ে বড়দাদার সঙ্গে শলা করে বড় শহর থেকে ভারি ডাক্তার আনায়। গোটা সংসারের মুখ শুকিয়ে এতটুকু। ছেলে-পিলেগুলি সময়ে আহার না পেয়ে খিদেয় কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে, রসুইঘর ছমছম করছে, কোনমতে দুটি ভাতে-ভাত নামিয়ে বড়মণি ছোটমণি এ-ওর মুখে চায়। কি হবে গো? কি হবে? কত্তাদের মুখে খাবার রুচছে না। বড় মেজর তো হুঁশই নেই। এদিকে তিন তিরিক্ষে তেত্রিশ রকম পরীক্ষার পর বড় শহরের ভারি ডাক্তার কিনা বড় আশায় ছাই দিয়ে জবাব দিয়ে গেল?
তে-তল্লাটে মেজমণির বাপের বাড়ির কেউ নেই। খবর দেবে কাকে? একটি মাত্তর মেয়েকে টাকার পুঁটুলি সুদ্ধ শ্বশুরঘর সই করে দিয়ে বাপ-মা চোখ বুজে নিশ্চিন্দি হয়েছেন। ননদিনীরা সব আসেন। চোখে আঁচল দিয়ে বড়র ঘরে, ছোটর ঘরে থানা দিয়ে বসে থাকেন। যদি কোনও সুখবর হয়। তা বসে থাকাই সার হয়। মন কারুর ভাল নেইকো। মেজকত্তা একবার বলেছিল শহরের নার্সিং-হোমে নিলে কি হয়? বড়কত্তা জবাব দেন—‘বড়বাড়ির ইজ্জতটুকুও তালে বড় শহরে রেখে এসো গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে।’ ছোটকত্তা জবাব দেয়—‘তা ছাড়া ঠাঁই নাড়া করতে তো ডাক্তার মানাই করে গেল মেজদা, কান পেতে শোননিকো?’ মেজকত্তা কাঁচুমাচু মুখে সরে যায়। আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে ঘোরে, ফকির-দরবেশ, সাধু-সন্ত কেউ যদি কিছু সুলুক-সন্ধান দিতে পারে। আশা ছাড়তে পারছে কই?
এমন দিনে ভোর রাতে স্বপন দেখে উঠে বসল মেজকত্তা। ঘুমের ঘোরেই জড়িত গলায় বলল—‘দাদা, সন্নিসি ঠাকুর এয়েচেন, দোলতলায় দাঁড়িয়ে।’ বড়কত্তা কোমরে লুঙ্গি কষতে কষতে আসছিলেন, দোরগোড়া থেকে বললেন—‘আমিও তাই বলছিলুম।’
ওদিক থেকে দৌড়তে দৌড়তে ছোটকত্তা এসে বলল—‘শেষ রাতে মাঠ সারতে গিয়ে দেখি পেল্লায় এক চিমটেধারী ব্রহ্মচারী দাদা—ওই যে দোলতলায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’
সারা বাড়ি দেখতে দেখতে জেগে উঠল। বড়মণি যে বড়মণি ধূলিশয্যায় ছিলেন, বুকে বড় ব্যথা মা। সারা রাত জপ করেছেন মেজমণির জন্যে, এখনও কুঁড়োজালির মধ্যে আঙুল নড়চে, উঠে বসে আঁচল সামলে মুখে চোখে জল দিলেন। ছোটমণি ঘুম ভেঙে খুঁক খুঁক করে কাঁদছিলেন—চোখ মুছে বাইরে এলেন। কপাট খুলে ওঁরাও সব দাঁড়িয়ে গেছেন—ননদিনী, ননদাই। ছেলেপিলেগুলি দলবদ্ধ হয়ে গোঁজ দাঁড়িয়ে সন্নিসিঠাকুর দেখছে।
দোলতলায় প্রায় কার্নিশ সমান উঁচু এক পাহাড়ের মতো সন্ন্যাসী। জটাজুট গোড়ালি ঢেকে লুটুচ্ছে একেবারে। গোঁফসুদ্ধু দাঁড়ি বুক অব্দি নেমে পড়েছে। হাতে ইয়া কমণ্ডলু, চিমটে। কপালে ত্রিপুণ্ড্রক, গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা, একটার পর একটা ভুঁড়ির কাছে দুলছে। ভস্মলিপ্ত। দারুণ, করুণ সুন্দর, ভরাট ভরসা-জাগানো মুখখানি।
সন্নিসির পায়ের তলায় সব এক-একখানা কাটা মাছের মতো শুয়ে পড়লেন। বড়, মেজ, ছোটকর্তা, বড়মণি, ছোটমণি, ননদিনীরা চারজনা। তিনটি ননদাই, একজন এখনও এসে উঠতে পারেননি। ছেলেরা সব খাড়া দাঁড়িয়েছিল। সর্দার ছেলেটি যেমনি বড়দের দেখাদেখি উপুড় হল বাকি ছেলেগুলিও অমনি তার দেখাদেখি সব মাজা ঘটিবাটির মতন উপুড় হয়ে পড়ল।
‘দয়া করো বাবা।’
‘রক্ষা করো।’
‘বিপদভঞ্জন মধুসূদন, রাখো ঠাকুর রাখো।’
শেষরাত্তিরে ঝিমঝিম করে আঁধার বৃষ্টি হচ্ছে, জনপ্রাণীর সাড়া নেই, শব্দগুলি ভারি-ভর্তি হয়ে যেন রাতের চাতালে বিঁড়ে-পেতে সব মাটির কলস, পেতলের কলস যে যার ঠাঁই বসে গেল। জল চলকাতে লাগল বেশ কিছুক্ষণ। গমগম করছে শেষ রাত্তিরের বড়বাড়ি মেজবউটির জন্য প্রার্থনায়—দয়া করো বাবা, রক্ষা করো, বিপদভঞ্জন মধুসূদন হে, রাখো ঠাকুর, রাখো।’
রেশটুকু যেন ধূপের ধোঁয়া, মিলিয়ে গেল ক্রমে। সন্নিসি বললেন—‘কিসের দয়া? কার রক্ষা? কাকে রাখবেন, ঠাকুর?’
গলা নয়কো মৃদঙ্গ। ভাষা নয়কো সুর।
মেজমণির ঘরে দীপ জ্বলছে, সেদিকে তাকিয়ে সন্নিসি বললেন—‘শিখাটি ক্ষীণ। কিন্তু আলোটি তো দেখছি দিব্যি পরিষ্কার। তোরা এতগুলি প্রাণী তার জন্যে আহার নিদ্রা ছেড়েচিস আর আলোটি নিভে যাবে? তা-ও কি হয়? আধারখানি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করো গে যাও বাছারা। আর হোমের যোগাড় দেখো গে। শুদ্ধ কাপড় অত চাই না মা। শুদ্ধ মনে করো, এখুনি। মহাপ্রাণী কি বলেন, দেখছি।’
ভাণ্ডার থেকে মাসের জমা গব্যঘৃত বার করে দিলেন বড়মণি। চন্দন কাঠ নিয়ে এলেন ছোটকত্তা, দিঘির মাটি নতুন সরায় করে এনে হাজির করলেন মেজকর্তা। ছেলেরা সব নদীর পাড় থেকে হোমের বালি বের করল। বড়কর্তা দোলতলায় গিয়ে আসন করে বসলেন, দেব-দ্বিজে শুদ্ধা ভক্তি কত্তার। যজ্ঞস্থলে নাম করবেন। সন্নিসি বললেন—‘আর কিছু চাই না। কাউকে চাই না। নির্জন ঘরে একলা হোম করব বাবারা। না হলে আদেশ পাওয়া শক্ত।’
তা—তাই হল। ঠাকুরঘরে ঠাঁই করে দেওয়া হল। ঘরের দরজায় কড়া পাহারা, বন্ধ ঘরে তিন প্রহর নির্জনে হোম করলেন সন্ন্যাসী। দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে সারাটা সকাল হু হু করে চন্দনের গন্ধ, গব্যঘৃতের গন্ধ। দুগ্ধ, মধু…সন্ন্যাসী হোম করছেন। হোম করছেন। গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে শব্দ আসছে—আহুতি দেবার চড়বড় শব্দ, অং বং মন্ত্র পড়ার শব্দ। তারপর সব চুপ। সারা দুপুর, সারা বিকেল নিঃশব্দ রইল হোমঘর, ঠাকুরঘর।
॥২॥
সন্ধ্যা আসন্ন হইলে সশব্দে দরজা খুলিয়া গেল। কবাটবক্ষ বিরাট সন্ন্যাসী হোমগৃহের চৌকাঠে দাঁড়াইয়া উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিলেন—‘উপায় মিলিয়াছে। বধূমাতার প্রিয়জন যে স্থানে এতগুলি, সে স্থানে তাঁহার প্রাণরক্ষা এমন কঠিন কর্ম কিছু না। স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া, পবিত্র ও পরিতুষ্ট হইয়া একে একে এ ঘরে আইস, রক্ষার উপায় আমি করিয়া দিই।’
প্রথম প্রবেশ করিলেন বড়বাবু। গরদের ধূতি ও পিরান পরনে, দিনান্তে মার্জনার ফলে গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল রক্তাভ, যুক্ত করে জোড়াসনে বসিয়া বড়বাবু ভক্তিভরে বলিলেন—‘আদেশ করুন প্রভু।’
সন্ন্যাসী বলিলেন—‘বৎস বধূমাতার রক্ষার একমাত্র উপায় কিঞ্চিৎ প্রতিদান। দান সাতিশয় পুণ্য কর্ম ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সংসারী ব্যক্তি বিশেষত রমণীর অন্তরাত্মার গঠন বড় বিচিত্র। ডান হস্ত দান করিল, বামহস্ত জানিতে পারিল না এই শাস্ত্রোক্ত বিধান উহাদের ক্ষেত্রে খাটে না। উহারা স্বীকৃতি চায়। অবিশ্রান্ত দান করিয়া করিয়া মাতার মহাপ্রাণী বড় ক্লান্ত দেখিতেছি। অঞ্জলি পাতিয়া করুণ নয়নে চাহিয়া আছেন। আমি যাহা বলি তাহা যদি উহাকে সমর্পণ করিতে পারো তো রক্ষা হইবে, অন্যথায়…’
বড়কর্তা বলিলেন—‘আমি ত্রিদিবশরণ দেবশর্মা বলিতেছি প্রভু। ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী ব্যতীত জল পান করি না, ত্রিলোকে এমন দেব-দেবী নাই যিনি আমার হস্তের তুলসী-চন্দন নিত্যসেবা করেন না। মোক্ষ ব্যতীত আমার নিজের জন্য দ্বিতীয় প্রার্থনা নাই। আদেশ করিতে আজ্ঞা হয়, মেজবধূমাতাকে আমার অদেয় কিছুই নাই।’
সন্ন্যাসী শান্তকণ্ঠে বলিলেন—‘বাস। এই অহঙ্কারটুকু ওই নির্বাপিত হোমকুণ্ডে আহুতি দিয়া চলিয়া যাও। দেবতায় তোমার ভক্তির অহঙ্কার। সাত্ত্বিক জীবনযাপনের অহঙ্কার। এই মাত্র। ভাবিয়া-চিন্তিয়া দিবে, ঘর মন্ত্রসিদ্ধ। দিলাম বলিলেই দেওয়া হইবে না। দান পূর্ণ হইলে হোমকুণ্ড আবার জ্বলিবে।’
বলিয়া সন্ন্যাসী একমনে মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। দণ্ডকাল পরে চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন সম্মুখের আসন শূন্য। হোমকুণ্ড জ্বলে নাই।
ধীরে ধীরে প্রবেশ করিলেন বড়বধূ। লাল পাড় শুদ্ধ বস্ত্রের প্রান্ত কণ্ঠে জড়াইয়া অবগুণ্ঠনবতী ভক্তি ভরে প্রণাম করিলে সন্ন্যাসী বলিলেন—‘অধিক সময় লইব না মা, দক্ষিণ হস্তে কোষা হইতে বিল্বপত্র তুলিয়া বাম হস্তের মুষ্টিতে স্থাপন করো। ঈর্ষার বিষে মেজবধূর দেহ নীলবর্ণ হইয়াছে। কেহ জানিবে না মা, তোমার এই গোপন ঈর্ষাটুকু হোমকুণ্ডে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যাও, তাহা হইলেই উনি আরাম হইবেন। বিল্বপত্রে ঈর্ষা আকর্ষণ করো। দেখিও মা, মন্ত্রসিদ্ধ ঘর, দিব বলিলেই দেওয়া না-ও হইতে পারে।’
সন্ন্যাসী জানিতেও পারিলেন না, কখন বড়বধূ নির্গত হইয়া গিয়াছেন। আসনে মেজকর্তা, যজ্ঞকুণ্ডে সামান্যতম ধূমও আর নাই। মেজকর্তা গদ্গদ কণ্ঠে বলিলেন—‘আদেশ করুন প্রভো।’
সন্ন্যাসী মৃদুস্বরে কহিলেন—দারাপুত্র পরিবারসম্পন্ন গৃহস্থ মানুষের কোনও দায়িত্ব অস্বীকার করিলে চলে না বৎস। আচমন করিয়া বসো। উদাসীনতা হোমকুণ্ডে বিসর্জন দিয়া একটি কাষ্ঠখণ্ড দায়িত্ব স্বীকারের প্রতীক স্বরূপ যজ্ঞকুণ্ড হইতে তুলিয়া লইয়া পীড়িতা পত্নীর বক্ষে স্থাপন করো গে। উনি রক্ষা পাইবেন।’
মেজকর্তা কিছুক্ষণ প্রাণপণে কাষ্ঠখণ্ড তুলিবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে শুষ্ক মুখে, ঘর্মাক্ত কলেবরে বাহির হইয়া গেলেন। মনে হইল এইবার সন্ন্যাসীর ধৈর্যচ্যুতি হইতেছে। মুখমণ্ডলে প্রশান্ত শিবভাব অন্তর্হিত হইয়াছে, ধীরে ধীরে যেন চক্ষে, গণ্ডদ্বয়ে, ওষ্ঠাধরে রুদ্রভাব প্রকাশ পাইতেছে। সেই মেঘগম্ভীর মুখমণ্ডল দেখিয়া ভয়ে ছোটকর্তা ও ছোটবধূর প্রাণ উড়িয়া গেল। সন্ন্যাসীর আদেশে তাঁহারা একত্রে প্রবেশ করিয়াছিলেন। বজ্রকণ্ঠে সন্ন্যাসী বলিলেন—‘স্বার্থপরতা ত্যাগ করিতে পারিবে?’ মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় দুলিতে দুলিতে দম্পতি বলিল—‘না।’ দীপ্ত চক্ষে সন্ন্যাসী বলিলেন—‘তবে দূর হইয়া যাও।’
আসন ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হোমঘরের কপাট খুলিয়া দাঁড়াইলেন। যেন মূর্তিধারী কালভৈরব। দীপ্ত চক্ষু, কণ্ঠে বজ্র—বলিলেন—‘আর তিন দণ্ড কালমাত্র বাকি আছে ইহার মধ্যে মাতার প্রাণ রক্ষা করিতে হইলে তোরা কেউ শীঘ্র কিছু দে।’ ননদিনীদের কাহাকেও বলিলেন—’লোভ দে’, কাহাকেও বলিলেন—‘মিথ্যায় মুগ্ধ হইয়া আছিস, মোহটুকু দে,’ কাহাকেও বলিলেন—‘একদেশদর্শিত বিসর্জন দে’ সন্ন্যাসীর মন্ত্রের ক্রিয়ায় সকলে সত্যবদ্ধ। কেহই প্রার্থিত বস্তু দিতে পারিল না।
অবশেষে সন্ন্যাসী বালক-বালিকাদিগের প্রতি চাহিয়া মৃদু, কোমল কণ্ঠে বলিলেন—‘ওঁ তৎসৎ। বৎস, তোরা শুচি, নিষ্কলঙ্ক, অকপট তোরাই তাঁহার শেষ আশ্রয়। বল, বাছারা মেজমাতাকে ভালোবাসিস?’
‘হ্যাঁ।’ সমবেত কণ্ঠে উত্তর আসিল।
‘কেন?’
‘মেজমণি পুতুল কিনিয়া দেয়, লাটিম কিনিয়া দেয়?’
‘বল কিনিয়া দেয়’, ‘মেজমণি খাবার করে’, ‘গল্প বলে।’
‘যদি তিনি আর কিছু কিনিয়া না দেন, আহার্য প্রস্তুত না করেন, যদি রূপকথা আর না বলিতে পারেন?’
বালক-বালিকার দল মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল। সন্ন্যাসী খড়মের শব্দ তুলিয়া বাহির হইয়া গেলেন। প্রথমে দরদালান, তাহার পর বাহির প্রাঙ্গণ, তাহার পর বিরাট মানুষটিকে আর দেখা গেল না।
॥৩॥
হোমঘরে চন্দন কাঠ, গব্যঘৃত, ধুনো গুগগুলের গন্ধ কেমন তীব্র কটু হয়ে উঠেছে। বড়বাবু রোষকষায়িত লোচনে বললেন—‘ভণ্ডামিগুলো টান মেরে ফেলে দে। নিবারণ, বিশু কে কোথায় আছিস।’
সিরাজুলের মা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এসে বলল—‘সব্বোনাশ হয়ে গেল গো। মেজমণিমা আমার আর নেই যে গো! টিমটিম করে পিদ্দিমটি জ্বলছিল, আগলে-বাগলে রেখেছিনু, তা মাকে আর ধরে রাখা গেলনি।’
—মেজমণির ঘরে দীপ জ্বলেনি। বড়কর্তা বললেন—‘মেজ, চাবি দে।’
মেজ বললেন—‘চাবি নেই।’
ছোটকর্তা বললে—‘ইয়ার্কি মেরো না দাদা। চাবিটা দিয়ে ফেলো। চাবি হলে সব হবে।’
বড়মণি বললেন—‘চাবি হলে সব হবে?’
ছোটমণি বললেন—‘সব হবে।’
ননদিনীরা বললেন—‘হবে, হবে, সব হবে।’
গদীর তলায় হাত দিয়ে মেজকর্তা অবাক হয়ে দেখলেন—ওমা এই তো চাবি। শেষ-সম্বলটুকু দাদার হাতে তুলে দিতে দিতে মেজকর্তা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
চাবি একবার ঘোরাতেই সিন্দুকের ডালা ফাঁক হয়ে গেল। অভ্যন্তর শূন্য। মেজমণি স্ত্রীধন মেজমণির দেহান্তের সঙ্গে অন্তর্ধান করেছে।