পৌত্তলিক

পৌত্তলিক

গাড়ি থেকে নেমে শুভব্রত টাইয়ের গিঁটটা আলগা করে নিল। এই এক গেরো। দেশটা গ্রীষ্মপ্রধান। কণ্ঠ বন্ধনী-পরা সাহেবরা বিদায়ও নিয়েছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর। কিন্তু এই ভাদুরে গুমোটেও সিনিয়র এগজিকিউটিভকে সেই সাহেবদের বেঁধে দেওয়া নেংটিটি গলায় বাঁধতেই হবে। একেই বোধহয় বলে গলায় গামছা বেঁধে ধরে আনা। এদিকে সামনে লম্বা দুটো ঝুমঝুমি সাপ। একটি আপ একটি ডাউন, মাঝে মধ্যে আরও কিছু-কিছু ঢুকে পড়েছে। থেকে থেকেই হর্নের প্যাঁ পোঁ এবং বিষাক্ত নিশ্বাস। পেছন দিকে সেই ঝুমঝুমি সাপ বোধহয় কোনও বহুপুচ্ছ—পৌরাণিক সরীসৃপে পরিণত হয়েছে। স্ট্র্যান্ড রোড। কলকাতা শহরের বিখ্যাত জ্যাম। ফল-ফুলুরির জ্যামের থেকে এই জ্যাম এখানে অনেক সস্তায় মেলে। একেই অনেকে বাসে-ট্রামে ‘জাম্প’ বলে থাকেন। ‘জাম্প’ই বটে। রামভক্ত বজরংবলীর মতো একখানা জগঝম্প লাফ না দিলে এই জ্যাম থেকে উদ্ধার পাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তারই মতো বহু অভাগা গাড়ি-ট্যাকসি-বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন চোখে সরীসৃপের খাঁজ খোঁদল পরীক্ষা করছে, যদি কোনও ফোকর দিয়ে কোনও ফিকিরে বেরিয়ে যাওয়া যায়। ঘাড় আর গলার মধ্যে ঘাম আর ময়লা জমে কুটকুট করছে। রুমাল চালিয়ে বেশ খানিকটা হিউম্যান কাদা মুছে ফেলে দাগী রুমালটার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুভব্রত।

শফার বলল—‘একটু হাওয়া খেয়ে উঠে পড়ুন সার। এখান থেকে নিউ আলিপুর তো আর হেঁটে যেতে পারবেন না! যখন জাম ছাড়বে, তখন যাবেন।’

না, হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। বছর কুড়ি আগে হলে দুর্গা বলে নেমে পড়া যেত। কিন্তু এখন আর হয় না। তা ছাড়া লাগেজ রয়েছে। সামান্য হলেও লাগেজ। এবং অফিসের কিছু জরুরি কাগজ-পত্তর। দিল্লি থেকে অনেক যত্নে সঙ্গে করে বয়ে আনা। লাস্ট মিনিটে পি. এ. গদাধর ‘রাজধানী’র টিকিটটি হাতে ধরিয়ে দিল। আকাশের টিকিট মেলেনি। ট্রেন-জার্নির সময়টুকু বাদে ঠিক দু’দিন হাতে। তারই মধ্যে নিজেদের অফিসের ব্রাঞ্চ, মার্কিন এমব্যাসি, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর। আগস্ট মাসের গরমে এই প্রাণান্তকর ছুটোছুটির পর স্ট্র্যান্ড রোডে কালো জাম। ড্রাইভার-কর্তৃক হেঁটে নিউ-আলিপুর যাবার প্রচ্ছন্ন পরামর্শ। স্বভাবটা আদৌ রাগী না হলেও শুভব্রতর গায়ের মধ্যে নানান জায়গায় কেমন চিড়বিড় করতে লাগল। একেই বোধ হয় বলে গায়ের ঝাল! আচ্ছা একখানা জীবন! সেই ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকে ফার্স্ট হতে হতে আসছে। প্রতি বছর ফার্স্ট প্রতি বছর দুশ্চিন্তা—পরের বছরও হবে তো! ক্লাস-টিচার প্রোগ্রেস রিপোর্টটা হাতে তুলে দিয়ে চিৎকার করে বলতেন ‘আসছে বছর…’। ছেলেরা সমস্বরে স্লোগান দিত ‘আবার হবে।’ সেই ‘আবার হবে’ এম-টেক অবধি গড়ালো। গড়াবার মূল্যস্বরূপ গেল রাতের ঘুম, দিনের শান্তি। বন্ধু-বান্ধব যখন হই-হই করে আড্ডা মারছে, সিনেমা দেখছে, ফার্স্ট বয় তখন আসছে বছরের জন্যে মুখ গুঁজে টেবিলে। রাত-আলো ভোরের আলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে। শেষ ডিগ্রিটার পরে দম ফেলতে না ফেলতেই পাঁচ হাজারি মনসবদার। তারপরেই গুরুজনরা উলু-উলু করে গলায় লটকে দিলেন একটি সালঙ্কারা ঢুলুঢুলু চোখ সলজ্জ নায়িকা। নায়িকা খোলসা করে কিছুই বলেন না, খালি আভাসে ইঙ্গিতে জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে চলেন। একমাত্র ছেলেটাকে কোনমতেই দার্জিলিং সেন্ট পলের কমে দেওয়া গেল না। মেয়েটাও মুসৌরি। বিয়ের পরে কাশ্মীরে হনিমুন ছিল। ডাল লেকে নারী জলের শোভা দেখতে দেখতে কণ্ঠলগ্না হচ্ছেন, অঙ্গে নিত্য নতুন কাশ্মীরি শাল, আর তুমি ভাবছো ট্রাভলার্স চেকগুলো তো ফুরিয়ে এলো? আর কলকাতার ফেরার পর দিনই সাইট দেখতে মধ্যপ্রদেশে পাড়ি দিতে হবে।

শুভব্রত সরকার একটা সাঙ্ঘাতিক সুখী মানুষ। বন্ধুদের ভাষায় ‘লাকি গাই’, সুন্দরী শান্ত স্বভাবা স্ত্রী। দুটি ছেলে মেয়ে পৃথিবীর যেখানে যা বিদ্যে আছে সব আয়ত্ত করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। একটি বাবা, একটি মা। এখনও চোখ কান হাত-পা বজায় আছে। নিচের তলায় বিশ্বাসী কাজের লোকসহ বাস করছেন। আলাদাকে আলাদাও হল আবার যৌথকে যৌথও। রবিবার-রবিবার খাবার টেবিলে সবাই একত্র। অফিস-অতিথি না থাকলে। সকালে লাফ মেরে মেরে অফিস বেরোবার সময়ে দুর্গা নামও রোজ শোনা হচ্ছে মায়ের মুখে। খবরের কাগজের আবডাল থেকে বাবার ‘সাবধানে চোলো’, যেন শুভব্রত চলে! সে যে সদা সর্বদাই চালিত হচ্ছে, বাবা কি জেনেও জানেন না! সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চেন-রিঅ্যাকশন। একটা নিউট্রন গিয়ে আরেকটা নিউট্রনকে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে, সে আবার আরেকটাকে, এইভাবে চলল। জনগণের মঙ্গল হচ্ছে। বাড়ি হচ্ছে, গাড়ি হচ্ছে, শাড়ি, রকমারি পোশাক, বিউটি পার্লার এয়ারকুলার, অ্যাক্রিলিক পেন্ট, ভি সি আর সব হচ্ছে। তোমার কি হচ্ছে? তুমি মানুষটি আসলে আর মানুষ নেই। নিজেই জানো না। জাপানি রোবটে পরিণত হয়েছে। তোমার সুখ বলতে চায়ের রঙটা ঠিক হয়েছে কিনা, শান্তি বলতে ভেড়া গুনতে গুনতে রাত আড়াইটেয় ঘুম এলো কিনা, আহ্লাদ বলতে এক পাত্র মদিরার কৃত্রিম স্নায়বিক উত্তেজনা।

মাসকয়েক আগে স্কুলের বন্ধু নিখিলেশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে-ও এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে ছুটোছুটির মাঝখানে। বলল, ‘চল না—একটু কফি হাউসে বসা যাক।’ মাস্টারমশাইদের স্ট্রাইকে লাগাতার ছুটি। তোমার আর কি শালা। এদিকে আমি শুভব্রত সরকার আসলে আমার ওপর-অলাদের বাজার সরকার। ‘সময় নেই’ শুনে নিখিলেশ বলল—‘খাসা আছিস সত্যি।’ বলতে বলতে সিগারেটের প্যাকেটে আঙুল ঠুকতে ঠুকতে মহা-আনন্দে কফি হাউসের দিকে চলে গেল। সময় না থাকাটা যে কি করে খাসা থাকার লক্ষণ হতে পারে শুভব্রতর মাথায় আদৌ আসে না। সিগারেটের প্যাকেটে টোকা দিতে দিতে কফি হাউসের দিকে চলে যাওয়াটা, যেতে পারাটা বরং তার কাছে ঈর্ষণীয় সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে মনে হয়।

—‘আরে, শুভ না?’ সামনে দাঁড়িয়ে কালো দাড়ি-অলা ফর্সা রং হাফ-পাঞ্জাবি পরা এক হৃষ্টপুষ্ট সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক যাঁকে শুভব্রত কস্মিনকালেও দেখেনি। আপাদমস্তক দেখে নিয়ে অগত্যা সে আমতা আমতা করল, ‘আপনাকে তো ঠিক…

হাসিমুখে ভদ্রলোক নিজের দাড়িটা চেপে ধরে উজ্জ্বল চোখে শুভব্রতর দিকে চেয়ে রইলেন।

—‘আরে তাই বল, চিত্ত? জব্বর দাড়ি রেখেছিস তো?’ শুভব্রত এগিয়ে গিয়ে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখল।

—‘দাড়িতে মুখের চেহারা কিভাবে পাল্টে দেয় দ্যাখ, সাধে কি আর ক্রিমিন্যালরা দাড়ি রাখে? তা তুই এখানে কোত্থেকে?’

—‘গঙ্গায় চান করে ফিরছি!’ ইঙ্গিতে চিত্ত হাতের পুঁটলিটা দেখাল।

—‘গঙ্গাচ্চান, এই সন্ধেবেলায়?’ শুভব্রতর মুখ হাঁ।

চিত্ত হেসে বলল—‘মুখটা বুজিয়ে ফেল, আরশুলো ঢুকে যাবে, তুই জ্যামে পড়ে গেছিস মনে হচ্ছে!’

গাড়িটার দিকে হাত দেখিয়ে শুভব্রত বলল—‘তাই তো দেখা যাচ্ছে!’

—‘নটা সাড়ে নটার আগে এ জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না রে। কোত্থেকে আসছিস?’

—‘আরে দিল্লি থেকে। গাড়ি স্টেশনে নিতে গিয়েছিল, তারপর এই।’

—‘বলিস কি? তুই ট্রেন-জার্নি করে এসে এইভাবে যাঁতাকলে পড়ে আছিস? আয়, আয়, আমার সঙ্গে আয়। তোর কি নিজের গাড়ি না কোম্পানির?’

—‘ওই হলো।’ শুভব্রত বলল।

—‘ছেড়ে দে। চলে যেতে বল সময় মতো। তোর লাগেজও যাক। তুই আমার বাড়িতে একটু বিশ্রাম-টিশ্রাম করে যাবি এখন।’

—‘কোথায় তোর বাড়ি?’

—‘আরে এই তো কাছেই, হ্যারিসন রোড ধরে যাবো, চিৎপুরের কাছে। একটা রিকশা নিয়ে নেবো এখন, আয় তো!’

শুভব্রত এক মুহূর্ত চিন্তা করল। প্রচণ্ড রকম ডায়াবিটিক শরীর। ঝিমঝিম করছে এখন। প্রেশারও আছে। সত্যি-সত্যিই পারা যাচ্ছে না।

ড্রাইভার মদন পাশে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিল। শুভব্রত ফিরে দাঁড়িয়ে বলল—‘কি মদন? আমি তা হলে চলেই যাই! তুমি লাগেজ পৌঁছে দিও।’

মদন বলল—‘ঠিক আছে সার। ঠিকানাটা বলে দিন। জ্যাম ছাড়লে আমি একবার ট্রাই করতেও পারি।’

—‘তার আর দরকার হবে না। শুধু শুধু আবার একগাদা ঘুরতে হবে তোমায়। তুমি চলে যেও।’

দরকারি কাগজের ব্রিফকেসটা শুধু হাতে তুলে নিয়ে শুভব্রত বলল—‘চল।’

চিত্তর মুখটা মনে হল যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুর হাত থেকে ব্রিফকেসটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে সে স্ট্র্যান্ড রোড পার হয়ে একটা রিকশা ধরল। রিকশাঅলা দেখা গেল ওকে চেনে। রাস্তা পার হতে না হতেই ঠুনঠুন করতে করতে এগিয়ে এলো। মুখে কৃত কৃতার্থের হাসি। জ্যামের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে কেটে যেতে কোনও আপত্তিই নেই।

রিকশায় উঠতে উঠতে শুভব্রত বলল—‘মানুষের কাঁধে চড়তে আমার কেমন ইয়ে লাগে রে চিত্ত!’

চিত্ত হেসে ফেলে বলল—‘মানুষের কাঁধে তো মানুষই চড়ছে রে বাবা, যন্ত্র তো আর চড়েনি! নে, তোদের এই পুতুপুতু ভাবটা ছাড় তো। যে সিসটেমে আছে ওরা এই করেই তো ওদের খেতে হবে। তুই না চড়লে আরেক জন চড়বে। তোর চেয়েও মোটা। ওর আরও কষ্ট হবে তখন। তা ছাড়া একটা গরিব মানুষের সম্মানের রোজগারে তোর অবদানটুকু থাকবে না!’

—‘সবই জানি, তবু…’

—‘সবই যদি জানিস তো আর দ্বিধা করিসনি। কেমন সুন্দর ফুরফুরিয়ে হাওয়া দিচ্ছে দেখ তো! রিকশায় উঠলে যেমন হাওয়া পাওয়া যায় অন্য কোনও যানে তেমন যায়? আর দ্যাখ দৌড়োনোর কায়দাটা। লোকনৃত্য করছে না রিকশা চালাচ্ছে বোঝা দায়! সাক্ষাৎ নটরাজ মহাদেবের শিষ্য সব।’ চিত্ত সামান্য একটু ঝুঁকে বসল।

রিকশাঅলা চলছে। রেলগাড়ির ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো তার কনুই দুটো তালে তালে সামনে পেছনে সামনে পেছনে সরছে। ঘাম চকচক করছে। ফুলে ফুলে উঠছে পেশিগুলো।

চিত্ত বলল—‘দেখেছিস? দেখেছিস? অপূর্ব না? ভাস্করদের সাবজেক্ট রে। আমাদের মেঠো চোখ আর কি দেখছে!’

শুভব্রত হেসে বলল—‘তুই এখনও তেমনি পাগলা আছিস চিত্ত। আঁকিস-টাঁকিস আজকাল?’

চিত্ত কিছু বলল না। হাসিমুখে চুপ করে রইল।

কতকগুলো জিনিস মানুষ কখনই ভোলে না। কেমন করে কে জানে ঠিক স্মৃতিতে থেকে যায়। চিত্তর পাশাপাশি চলতে চলতে সেই কথাগুলো এখন এমন জীবন্তভাবে মনে পড়ল শুভব্রতর যেন গঙ্গার পুলের তলা দিয়ে পঁচিশ বছরের জল গড়িয়ে যায়নি।

চিত্তটা অঙ্কর খাতায় সব সময়ে একটা কাঁটালি চাঁপা ফুল রেখে দিত। খানিকটা করে অঙ্ক কষবে আর ফুলের গন্ধ শুঁকবে। জিজ্ঞেস করলে বলত—‘বুদ্ধির গোড়ায় ফুলের গন্ধ দিচ্ছি। আঁকগুলো কিরকম সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে দ্যাখ না।’

সত্যিই! জিওমেট্রিতে এঁটে উঠতে পারত না বলেই চিত্তটা শুভব্রতর থেকে কম নম্বর পেতে অঙ্কে। আঁকার সুযোগ পেলেই ও নানারকম কারিকুরি করবে। করবেই। ডায়াগ্রামের চারপাশে শেড দেবে। কোথাও গাঢ়, কোথাও হালকা। তলার লেখাগুলো সব বাহারি। প্রত্যেকবার অঙ্কের মাস্টারমশাই ওর কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেবেন বেঞ্চে। তবুও ও করবেই। তা ছাড়া যা দেখবে তাই আঁকবে। ক্লাসঘরের জানলার পাটে বসে একটা দাঁড়কাক বিশ্রী স্বরে ক্ব ক্ব করত। তাকে সুদ্ধু এঁকে ফেলল ঠোঁটের ভেতরকার লাল সমেত। তার সেই ঘাড় বাঁকানো ভঙ্গিতে একচোখো তাকানো দেখে ক্লাসসুদ্ধু ছেলের কি হাসি!

চিত্ত বলল—‘নাম। দে ব্রিফকেসটা আমার হাতে দে তো।’ তড়াক করে অনায়াসে নেমেছে ও। শুভব্রতর একটু কষ্ট হয়। প্রথমত অনভ্যাস, দ্বিতীয়ত ভুঁড়িটা ঘনত্বে, বেড়ে বেশ, তৃতীয়ত হাঁটুতে আজকাল একটা খচখচে ব্যথা হচ্ছে।

সরু গলির মধ্যে হলেও চিত্তর বাড়িটা দেখা গেল খুব প্রশস্ত এবং পরিচ্ছন্ন। এসব অঞ্চলের রাস্তাঘাট যে রকম একটা ঘিনঘিনে নোংরা হয় সেরকম নয় মোটেই। বেশ বড় উঠোন তার চার দিক ঘিরে রোয়াক। উঠোনময় প্রচুর টবে ফুলগাছ। প্রত্যেকটা টব চকচক করছে। শুভব্রত চিত্তর বাড়িতে ঢুকেই যেন একটা ডুব দিল। দু হাতে জল সরিয়ে সরিয়ে, জল সরিয়ে সরিয়ে ঝপাৎ করে ডুব। সময়ের লহরীমালার অভ্যন্তরে কোথাও বুঝি মানুষের জীবনের পুরনো সময় টিকে থাকে। আসলে ওরা দুজনেই এক গ্রামের ছেলে। শহরতলির গ্রাম। শুভব্রতদের ছেলেবেলায় সে সব গ্রাম খুব এঁচড়ে পক্ব হয়ে ওঠেনি। সারা গ্রীষ্ম রোদ্দুরের গন্ধ, জ্বলন্ত আকাশের গন্ধ ঠাণ্ডা জলের গন্ধ আর ফুলের গন্ধে টইটম্বুর হয়ে থাকত সেই শহরতলির গ্রাম। সিনেমার পোস্টার, ফিলমি গানের ঘেয়ো কুকুর তখনও তার সর্বাঙ্গ চাটেনি। সেইসব ফুলের গন্ধ চিত্ত তার উঠোনে কোন আশ্চর্য জাদুতে জিইয়ে রেখেছে। শুভব্রত মেশিন পার্টস চিনেছে চিরকাল, ফুল-টুল অত চেনেনি, বিশেষত দেশি ফুল। কিন্তু ফুলের গন্ধ তার সমস্ত চেতনা ছেয়ে আছে।

—‘জুতোটা এখানে খোল শুভ, দাঁড়া একটা টুল এনে দিই’…চিত্তর গলার স্বরে সে চমকে উঠল।

রোয়াকের এক কোণে জুতো আর মোজা খুলে ঘরে ঢুকল শুভ। এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার চমকে উঠল। চিত্তর ঘরের দেয়ালে দেয়ালে কুলুঙ্গি খুপরি, কাঠের তাক, এবং সর্বত্র পুতুল। ঘরটা ধূপের ধোঁয়ায় আবছায়া, বাইরের ফুলের গন্ধ এখানে চার দেয়ালের মধ্যে আরও প্রবল। ফুলদানিতে, গেলাসে, বোতলে, রেকাবিতে সর্বত্র ফুল। একটা নিচু তক্তপোশে তাকে বসিয়ে চিত্ত বলল—‘দাঁড়া আসছি। সিগারেট খাসনি ভাই প্লীজ।’

সিগারেট খাওয়ার অবশ্য কোনও প্রশ্নই নেই। ডায়াবিটিসের সঙ্গে হাই প্রেশার। ডাক্তার একদম ত্যাগ করতে বলেছেন। তবে ধীরে। এখন দুবেলায় দুটো এসে দাঁড়িয়েছে। খাওয়ার পর একটা করে ধরায়। ওই ধরানোই। কিং সাইজ সিগারেট আঙুলের ফাঁকেই ছাইয়ের স্তম্ভ হতে থাকে। দু-একটা টান দেয় কি না দেয়। ঘরে ঢুকল চিত্ত এক হাতে থালায় প্রচুর খাবার, আরেক হাতে চা। বলল—‘ওই টুলটা টেনে নে না ভাই!’

শুভব্রত বলল—‘খিদে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এত খাবোই বা কি করে আর জোগাড়ই বা করলি কোথা থেকে? তুই একা দোকা তা-ই তো এখনও বুঝতে পারলুম না রে!’

চিত্ত হেসে বলল—‘খিদে পেয়েছে, খেয়ে নিবি, ফুরিয়ে গেল। মেয়েদের মতো তা না না না করিসনি তো! এই সব লুচি, আলুরদম, ঘুগনি, সব আমার দিদির হাতে করা, দোকানের নয় একটাও। তা ছাড়া স-ব ঠাকুরের ভোগ। খা।’

—‘ঠাকুরের ভোগ? কী ব্যাপার বল তো?’

চিত্ত হাতটাকে ঘরের চারদিকে ঘুরিয়ে এনে বলল—‘এই তো সব ঠাকুর। আমরা যা কিছু খাই, খাওয়াই স-বই দেবতার ভোগ রে শুভ, আলু-টালু কিছুই খেতে দ্বিধা করিসনি।’

শুভব্রত বলল—‘বলিস কি? আমি এক্ষুণি ভাবছিলুম এতো পুতুল তুই জোগাড় করলি কোত্থেকে! এসব শখ তো মেয়েদের থাকে বলেই জানতুম।’

চিত্ত রহস্যের হাসি হেসে বলল—‘পুতুলই বটে! মিথ্যে কিছু বলিসনি। আর শখের কথা বলছিস! দু-চারটে আমার কিংবা দিদির কেনা। বাস।’

—‘বাকিগুলো? সব গিফ্‌ট?’

চিত্ত বল, ‘ধর যদি রাস্তায় একটা ছোট্ট অনাথ ছেলে এসে তোকে আশ্রয়ের জন্যে ধরে, আর ধর তোর সংসার বলতেও কিছু নেই, অভাব বলতেও কিছু নেই। তুই কী করবি শুভ?’

—‘কি আর করব, ভাগিয়ে দোব।’ চিত্তর কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন মনে হচ্ছিল শুভব্রতর।

—‘কিন্তু তার পরেও যদি দেখিস ছেলেটা ঠিক তোর বাড়ি চিনে চিনে এসে হাজির হয়েছে আর জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত নিখুঁত ভাবে সেরে ফেলে শুধু তোর একটু মায়া-মমতার আশা করে রয়েছে, তবে?’

—‘তা হলে তাকে রাখা যায় বটে। ছোট ছেলে, সুতরাং কর্পোরেশন স্কুলে লেখাপড়ার একটা ব্যবস্থাও করে দেওয়া যায়।’

চিত্ত অন্যমনস্ক ভাবে বলল—‘ঠিক। আমিও ঠিক তাই-ই করেছিলুম রে। মাইনে তো নিলই না। স্কুলেও গেল না। যাবার কোনও দরকারও ছিল না।’

‘ব্যাপারখানা কী খুলে বল তো।’ শুভব্রত লুচিতে কামড় দিয়ে বলল, তারপরেই বলে উঠল—‘তোর দিদির রান্না বললি না! এটা কি প্রিপেয়ারেশন রে? অদ্ভুত ভালো খেতে তো!’

চিত্ত বলল—‘ভোগ অমনিই খেতে হয় রে শুভ। দিদির বাহাদুরি সামান্যই।’

আনমনার মতো হেঁটে হেঁটে চিত্ত ঘরের মাঝখানে একটা কুলুঙ্গির দিকে চলে গেল। কুলুঙ্গিতে একটা কৃষ্ণমূর্তি, নীলচে রঙ, হাতে বাঁশি। একলা মূর্তি। রাখালবেশী বালক কৃষ্ণ।

‘চমৎকার না?’ চিত্ত বলল, ‘এরকম মূর্তি কখনও দেখেছিস?’

শুভ বলল—‘পুতুলটা খুবই সুন্দর, সত্যিই। কৃষ্ণনগরের নাকি রে?’

—‘ঠিকই ধরেছিস।’ চিত্ত বলল, ‘বছর দশেক আগেকার কথা, কেষ্টনগর বেড়াতে গেছি। ঘূর্ণিতে গিয়ে অনেক কিছুর মধ্যে এই মূর্তিটা খুব পছন্দ হয়ে গেল। সঙ্গে ছিলেন তেজেশবাবু আমার এক সহকর্মী। তখন পাকপাড়ার একটা স্কুলে কাজ করতুম। ভদ্রলোক ফিজিক্সের লোক, বললেন—কিনছেন তো অন্য জিনিস কিনুন, পুরনো সংস্কারের ওই সব ভূতগুলোকে আর কিনবেন না চিত্তবাবু। বরং ওই টিকটিকি জোড়া কিনুন। আসলের থেকে তফাত করতে পারবেন? আমি বললুম, আমার ঘরের দেয়ালে টিকটিকির অভাব নেই তেজেশদা। এ পুতুলটা আমার চমৎকার লাগছে। তা আমার গরজ দেখে লোকটা একটা সৃষ্টিছাড়া দাম হেঁকে বসল। রাগ করে চলে এলুম। কলকাতায় ফিরে ভিড়ের মধ্যে দেখি একটা বছর দশ বারোর ছেলে আমার পেছু ধরেছে—বাবু তোমার মোটটা আমায় দাও না। যত বলি মোট কোথায় যে দেবো? থাকার মধ্যে তো খালি একটা ব্যাগ বা ঝোলা যা বলিস। “ওইটেই নোব।” ভাবলুম বোধহয় খুব অভাব, পয়সাটা পেলে ওর উপকার হয়। দিলুম ব্যাগটা। নে বাবা, ব’। সেদিনও এমনি জ্যাম। সারাটা পথ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি। পয়সা দিতে গেলুম নিল না। বললে, “দুটি দুধ-ভাত দেবে?” দিদি খেতে দিল ভালো করেই। নিঃসন্তান বিধবা। বাচ্চা ছেলে-মেয়ের ওপর একটু অতিরিক্ত মমতাই। তা সেই থেকে ছেলেটা দিদির মন ভিজিয়ে বাড়িতে থেকে গেল। পায়ের কাছে চকচকে জুতো। হাতের কাছে জামা। দিদি কলঘরে থাকতে থাকতেই অর্ধেক রান্না সেরে ফেলে। এদিকে একদম ভদ্রলোকের ছেলের মতো কথাবার্তা টানটোন। দিদিতে আমাতে ঠিক করলুম ছেলেটাকে মানুষ করব। সব ব্যবস্থা করে ফেলে বললুম—কি রে কেষ্টা, তোর তো খুব মাথা। স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসি চল। কি বলল জানিস?—‘ক’দিন পরেই তো বুড়ো হবে, তার পরেই পট করে মরে যাবো। তোমার ইস্কুল শেখাতে পারবে কি করে বুড়ো-টুড়ো না হয়ে যতদিন ইচ্ছে বেঁচে থাকা যায়? নইলে লেখাপড়া শিখে সেগুলো কাজে লাগাতে না লাগাতেই তো মরে যাবো!’ পাকা পাকা কথা শুনে আমরা ভাইবোন তো হাঁ।

‘পর দিন সকাল থেকেই ছেলেটাকে আর খুঁজে পেলুম না। দিদির সন্দেহ হয়নি। আমার তো পাপ মন। তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেতে দেখছি কিছু হারিয়েছে কিনা। যে ঝোলা নিয়ে কেষ্টনগর গিয়েছিলুম সেই ঝোলার ভেতরে দেখি সেই কেষ্টনগরের কৃষ্ণমূর্তি। কি বলব শুভ—এই দ্যাখ আমার গায়ে এখনও কাঁটা দিচ্ছে।’

শুভব্রতর একবার মনে হল গলা ফাটিয়ে হেসে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণে চিত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ও থেমে গেল। তন্ময় দৃষ্টিতে সে কৃষ্ণ মূর্তিটার দিকে চেয়ে রয়েছে।

শুভ বলল—‘ছেলেটা নিশ্চয় পড়ার ভয়ে পালিয়েছে। হয়ত ঘূর্ণি থেকে মূর্তিটা সরিয়ে তোর পেছু নিয়েছিল, অনাথ-টনাথ হবে। তা সেই থেকেই কি তুই ঠাকুরের মূর্তি জোগাড় করে চলেছিস?’

চিত্ত বলল—‘না রে শুভ, একটা মূর্তিও আমি জোগাড় করিনি।’

—‘তবে? এই যে তোর দুর্গা, কালী, নটরাজ, সরস্বতী, লক্ষ্মী—এটা কি?’

—‘গঙ্গা। মকরবাহিনী, দেখছিস না?’

—‘এসব তুই জোগাড় করিসনি?’

—‘তুই হরিদ্বারে গেছিস?’

—‘একবার গিয়েছিলুম বটে’, শুভব্রত বলল।

—‘তুই গিয়ে কি দেখেছিলি জানি না, আমি তো গঙ্গার ঘোলা জল আর গুচ্ছের কুষ্ঠরুগী দেখে দারুণ হতাশ। গঙ্গার ধারেই একটা ধর্মশালায় উঠেছি, দাদা-বউদির হোটেলে দু বেলা ভাত খাই। আর কনখলে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে গিয়ে বসে থাকি। কি রে বোর হচ্ছিস না তো?’ চিত্ত হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল।

শুভব্রত তখন প্লেটের খাবারের একেবারে শেষাংশটুকু আনমনে চাটছে। কতদিন খেতে বসে আঙুল চাটা, থালা-চাঁছা হয় না। এ-ও ছেলেবেলার এক লুপ্ত স্মৃতি। লুব্ধতার স্মৃতি। যে লুব্ধতা এখন অসভ্যতার নামান্তর। সে বলল—‘তুই বলে যা চিত্ত। আমি ঠিক শুনে যাচ্ছি।’

চিত্ত বলল—‘একদিন ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছি। দারুণ ফর্সা একজন গাড়োয়ালি যোগিনী মতো গঙ্গার ধারে বসে জপ করছে দেখি, ব্রিজটার ঠিক মুখে, আমাকে দেখে বলল—“এ বেটা উধর মাৎ যাও। ইধর যাকে গঙ্গাজীকি মন্দির মে পূজা চড়াও!” গলায় যেন খানিকটা আদেশের সুর। সত্যি দিন তিন-চার হয়ে গেল এসেছি। গঙ্গামন্দিরের দিকে যাই-ই নি। মহিলা ঝুলি থেকে বার করে ওই মূর্তিটা দিলে, ভালো লাগল মূর্তিটা, দাম জিজ্ঞেস করলুম, বললে—“মন্দির সে ওয়াপস আ যাও, পৈসা লে লুঙ্গী।” তো ঠিক আছে। গঙ্গামন্দিরে গিয়ে পুজো চড়াব কি মূর্তি দেখে আমি অবাক, অবিকল সেই যোগিনী, ফেরবার পথে মহিলাকে আর দেখতে পাইনি। যে ক’দিন ছিলুম হরিদ্বার চষে ফেলেছি। একদম বাতাসে মিলিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা।’

শুভব্রত হেসে বলল—‘তুই কি সিদ্ধি-টিদ্ধি খাস না কি বল তো? বরাবরই তুই ছিটে পাগলা। কিন্তু এসব রোগ তো তার ছিল না?’

চিত্ত হাসিমুখে বলল—‘নাই বা শুনলি এসব গুলগপ্পো। ছেলেবেলাকার মতো আড্ডা মারি আয়।’ .

শুভব্রত নিজের মনের ভেতর খানিক হাতড়ে বলল—‘প্রোফেশন্যাল টক করে করে ব্রেনের ভেতরটা কি রকম ইয়ে হয়ে গেছে রে চিত্ত। তুই শুরু কর। তুই আজকাল করছিসটা কি? সেই পাকপাড়ার স্কুল?’

—‘ছেলেবেলায় যা করতুম তাই। পাকপাড়ার ইস্কুলেও তাই। এখানেও তাই।’

—‘অর্থাৎ?’

—‘অর্থাৎ আঁক কষছি।’

—‘মাস্টারি-ই?’

—‘না রে, এক ব্যবসাদারের গদিতে হিসেব-নিকেশ করি।’

—‘বড়বাজারি নাকি রে?’

—‘হ্যাঁ; কেন বল তো?’

—‘ওরা তো সাবর্ডিনেটদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। শুনেছি চাকরবাকরের মতো দেখে! মনে করিসনি কিছু।’

—‘না, মনে করব কেন? তুই তো ঠিকই বলেছিস। করত। আমার মনিবও করত। এখন আর করে না। আমার সঙ্গে তো নয়ই। অন্য কোনও কর্মচারীর সঙ্গেও না।’

—‘আগে করত। এখন করে না?’ শুভব্রত অবাক হয়ে বলল। একটু থেকে ও আবার বলল, ‘খুব ঝেড়ে দিয়েছিলি বুঝি? বেশ করেছিস। এই তো চাই। চিত্ত তোর গায়ের জোরও তো কম ছিল না রে, তেঁতুলবাগানের কুস্তির কথা মনে আছে? সেই গোবরবাবুর ফটো সামনে রেখে একলব্যের মতো…?’

চিত্ত হাসতে হাসতে বলল—‘তুই তো কিছুই ভুলিসনি দেখছি।’

শুভব্রত বলল—‘এত যে আমার মনে আছে তাই-ই জানতুম না। ওঃ সে একখানা সিন করেছিলি তুই, এক-একজন আসছে আর বলছিস—“উঠাকে পটাক দেগা!” বাপ্‌স্‌ রে। কতজনকে কাত করেছিলি বল তো?’

—‘জনা চার-পাঁচ হবে। ও কিছু নয়। আসলে ওগুলো ছিল কাপুরুষ। না হলে নিরীহ মাস্টারমশাইকে অপমান করে?’

—‘কি করেছিল বল তো?’

—‘দূর দূর ওসব ছাড়।’

—‘তা তোর মনিবকেও কি ওই রকম পটকে দিয়েছিলি নাকি!’

—‘দূর দূর তাও কখনও কেউ করে?’ চিত্ত হাত নেড়ে বন্ধুর কথা একদম উড়িয়ে দিল।

এই সময়ে বাইরে থেকে একটা হাঁক শোনা গেল ‘বাবুজী! চিত্তরঞ্জন ভাইয়া!’

চিত্ত তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল। শুভব্রত দেখল রোয়াকের ওপর উঠে আসছেন ফিনফিনে মিলের ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি পরা দুধে ঘিয়ে অতিরিক্ত পুষ্ট ধবধবে ফর্সা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। পেছনে একটি চাকরশ্রেণীর লোক। তার হাতে খুঞ্চিপোষ ঢাকা মস্ত থালা। উঠতে উঠতে ভদ্রলোক বললেন—‘কেতোবার বলিয়েছি চিতজী হামাকে আপনি শিউরতনভাই বলবেন, তো হামি এতো পাপতাপ করিয়েসে যে একঠো বাত রাখতে পারলেন না।’

চিত্ত বলল—‘আগরওয়ালজী আপনি তো বয়সেও আমার থেকে বড়। এতদিনের অভ্যাস কি করে ছাড়ি বলুন তো?’

—‘হাঁ উমর, উমর। কেতো উমর হামার? চিত্‌জী পিছলে পিছলের সোব জনম হিসাব করেন, জরুর দেখবেন আপনি হামার থেকে বোরো আছেন।’

শিউরতনবাবু জুতো খুলে উঠলেন। সঙ্গের লোকটি খালি পায়ে এসেছিল, চিত্ত বালতি থেকে মগে করে তার পায়ে জল ঢেলে দিতে লাগল। শুভব্রতর দিকে লাজুক দৃষ্টিতে চেয়ে শিউরতনবাবু বললেন—‘দেখছেন তো। এ চিতজী বিলকুল পাগলা আদমি আছেন। নোকর উকর কুচ্ছু মানবেন না।’

ঘরের মধ্যে ঢুকে লোকটির হাত থেকে বিশাল থালাটি নিজের হাতে নিয়ে নিলেন শিউরতনবাবু। বাঁ দিকে একটি তাকের সামনে চলে গেলেন, খুঞ্চিপোশের ঢাকা খুলতেই এক শতাব্দী আগেকার গাওয়া ঘি-এর গন্ধে ঘর ম ম করে উঠল। আড়চোখে চেয়ে শুভব্রত দেখল থালাটি রুপোর, তার ওপর পুরি, কচুরি, লাড্ডু, রাবড়ি; এবং আরও নানারকম বস্তু বাটিতে বাটিতে সাজানো। তাকে গণেশের একটি ছোট্ট মূর্তি। এক বিঘৎ মতো। মাটির ওপর শিউরতনের লোক বোধহয় গঙ্গাজলের আছড়া দিল, তিনি থালা নামিয়ে রেখে ধূপ জ্বালিয়ে দিলেন। চিত্ত ইশারা করল। শুভব্রত তার সঙ্গে বাইরে চলে এল। কিছুক্ষণ পর শিউরতনও বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দশ মিনিট চোখ বুজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর হঠাৎ জয় রামজী, জয় বজরংবলী, জয় গণেশজী বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। পেছন পেছন চিত্ত ও শুভব্রত।

হুমড়ি খেয়ে থালাটায় কী দেখছেন শিউরতন। হঠাৎ আবার ‘জয় বজরংবলী’ বলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন।

—‘কী হল?’ শুভব্রত নিজের অজান্তেই বলে উঠেছে।

—‘গণেশজী কী কিরপা মিল গয়া।’

চিত্ত প্রশান্তমুখে বলল, ‘ঠাকুর দৃষ্টিভোগ করেন আগরওয়ালজী। আপনাকে আমি আজও বোঝাতে পারলুম না।’

—‘আরে চিতজী। দৃষ্টিভোগ তো জরুর করেন। কিরপা কি লিয়ে কচৌড়ি, মিঠাই, খান ভি কভি কভি। দেখিয়ে লিন লাড্ডু সে, জিলাবি সে কুছু কুছু সেবা করিয়েসেন।’

শ্যেন দৃষ্টি মেলেও লাড্ডু বা জিলাবির মধ্যে কোনও বৈলক্ষণ্য দেখতে পেল না শুভব্রত। শিউরতনের মতে লাড্ডুর ওপর বড় বড় বাদামের টুকরো ছিল ন’টি তিনি স্পষ্ট দেখেছেন এখন আট টুকরো আছে।

ততক্ষণে শিউরতনের লোকটি ভেতর থেকে একটি থালা নিয়ে এসেছে। শিউরতন তার ওপর তুলে দিচ্ছেন কচুরি, লাড্ডু মতিচুর রাবড়ি।

চিত্ত অধৈর্য হয়ে বলল—‘শিউরতনজী আপনাকে কতবার বলেছি প্রসাদ কণিকামাত্রই যথেষ্ট, কেন আপনি এইভাবে…’

হঠাৎ শিউরতন হুড়মুড়িয়ে চিত্তর পায়ে পড়ে গেলেন। গদগদ স্বরে বললেন—‘বজরংবলীর কিরপা মিলল, গণেশজীর কিরপা মিলল চিতজী আপনার কিরপা মিলল না এখনও।’

—‘করছেন কি করছেন কি ভাইয়া, ইস উঠুন।’

সত্যি-সত্যি সজল চোখে উঠে দাঁড়ালেন শিউরতন। —‘বাস আপ নে মুঝে ভাই বোলা, তো কিরপা আধা মিলই গয়া।’

ভদ্রলোক নোকরের হাতে থালাটি তুলে দিয়ে যেমন এসেছিলেন তেমনিই ফিরে গেলেন।

শুভব্রত বলল—‘কি ব্যাপার রে, চিত্ত? এ যে দেখি রীতিমতো নাটক?’

চিত্ত নিশ্বাস ফেলে বলল—‘উনিই আমার মনিব, তোরা যাকে বলিস বস্। নানারকম ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেটস-এর এজেন্সি, তা ছাড়াও কাপড়ের দোকান, উলের স্টকিস্ট। আমি ওঁর গ্যাজেটস্-এর দোকানে বসি।’

—‘বসিস, ভালো করিস। তো আজকের নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু খুলেই বল না বাবা।’

অনিচ্ছুক স্বরে চিত্ত বলল—‘তা হলে তো আবার গল্প বলতে হয়।’

—‘বল বল, গল্পই বল, খুব দর বাড়াচ্ছিস চিতে!’

পুরনো নাম শুনে চিত্ত হেসে ফেলল বলল—‘ব্যাপার কিছুই না। যা হয় আর কি! লোকটা প্রতিদিন ক্যাশ মেলাবার সময়ে এসে ঝামেলা করত।’

—‘এ বাঙালি বাবু সোব মালে পক্কা-ক্যাশ মেমো দিবে তো হমার খাতা মিলবে কি করে? বুরবক কঁহাকা!’ রোজ রোজ।

আমি হিসেবের কারচুপিতে রাজি নই। এদিকে আমার মতো ভালো অ্যাকাউন্টসও ওখানে কেউ জানে না, বিশ্বাসীও না সবাই। একদিন এসে কি করল জানিস? দোকানের সামনের ঝাঁপ পড়ে গেছে, পেছন দিক দিয়ে বেরোচ্ছি দুজনে। শেয়ালের মতো হেসে বললে—‘চিত্তরঞ্জনবাবু, কয়েদখানার ভেতরটা দেখিয়েছেন?’

আমি বললুম, ‘মানে?’

—‘মানে আপনি তো কুছু কুছু করে আমার বহুৎ রূপেয়া সরিয়েছেন, কয়েদঘর দেখতে হোবে না? সোচুন, সোচে লিন খাতা ঠিক করবেন কি শ্বশুরাল যাবেন।’

আমি বললুম—‘আজই আপনার চাকরি আমি ছেড়ে দিচ্ছি।’

—‘আসানি কি বাত ক্যা বাবু? লাখো রূপেয়া মারকে ভাগ যানা এত্‌না আসান?’ বলে লোকটা চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে চেয়ে রইল।

টলতে টলতে বাড়ি চলে এলুম। খেলুম না, দেলুম না। পর দিন জ্বর এসে গেল। অনেক রাতে দিদি মাথা ধুইয়ে দিতে দিতে বলছে শুনলুম—‘শিউরতনের গণেশ মূর্তিটা নিয়ে এসেছিস বেশ করেছিস। হনুমানটাকেও আনলি না কেন?’ মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা তারই মধ্যে আমি উঠে বসেছি—‘শিউরতনের গণেশ মূর্তি? আমি আনব কেন? কি যাতা বলছ?’

সামনেই তাকের ওপর বসানো গণেশ ওই যে যেটিকে পুজো করে গেলেন শিউরতনজী। ওঁর গ্যাজেটের দোকানে ছিল গণেশ মূর্তি, আর কাপড়ের দোকানে হনুমানজী। গণেশটিকে দেখতে গিয়ে হনুমানজীকেও পেলুম। কৃষ্ণমূর্তিটির পেছনে লুকিয়ে ঝুকিয়ে বসে আছেন।

আমার যন্ত্রণা তো আরও বেড়ে গেল। সকালেই হয়ত চুরির দায়ে শিউরতন আমাকে অ্যারেস্ট করাবে। দিদি বলল—‘মূর্তিদুটো তা হলে লুকিয়ে ফেলি।’ আমি বললুম—‘না, যেমন আছে, তেমন থাক।’

পরদিন বিকেল নাগাদ ঠিক একটা ঝড়ো কাকের মতো শিউরতন আমার বাড়ি পৌঁছলো।

—‘চিত্তরঞ্জনবাবু হমার গণেশজী. চোলে গেলো, ইনকম ট্যাকসের ধরপাকড় হচ্ছে বহুত্‌। ডাকু ক্লথ স্টোর্সমে আগ লগাকে ভাগ গিয়া। লেকেন দেওতা তারা লেয়নি। কেন লেবে? মিট্টি কি মুরত, উসমে হ্যায় ক্যা, উন লোগোঁকে লিয়ে?’

—আমি বললুম—‘শিউরতনবাবু আপনার দুই মূর্তিই আমার ঘরে, বজরংবলীও। আমি কিন্তু নিয়ে আসিনি। ওই দেখুন।’

খুব হম্বি তম্বি করে মূর্তি নিয়ে চলে গেল। পরদিন আমার জ্বর আরও বেড়েছে, দিদি ভীষণ ব্যস্ত, ঘোরের মধ্যে শুনছি ডাক্তার বলছেন—‘শক ফিভার মনে হচ্ছে, জ্বরটা ভালো ঠেকছে না। ডঃ ধরকে কনসাল্ট করুন।’…

এমন সময়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল শিউরতন। আমার অবস্থা দেখে চমকে গেল। খুব নরম সুরে দিদিকে বলছে শুনি—‘বহেনজী আপ ঘাবড়াইয়ে মৎ ডাগদারবাবুকে হমি গাড়ি ভেজকে ডেকে আনছি। হমারা মূরত ফির কিসনে চোরি কিয়া। বহুত গলত হো গয়া মেরা। যে আদমী, দুসরা খাতা বনাতে হমার পসিনা ছুটিয়ে দিল সে চোরি করবে?’ বলতে বলতেই শিউরতন দিয়েছে এক দারুণ লাফ। লম্ফ যাকে বলে,

—‘ওই তো হামার মূরত!’ ঠিক যেখানে আগের দিন গণেশের মূর্তিটি ছিল সেখানে গোলাপি পেটের ওপর সাদা শুঁড়টি গুটিয়ে ভদ্রলোক বসে আছেন। কৃষ্ণমূর্তির পেছনে বীরবাহাদুর হনুমান এক হাতে গদা এক পা তুলে পাশ ফিরে দণ্ডায়মান। ফ্যাল ফ্যাল করে সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিউরতন আমার দিদির পায়ে পড়ে গেল, তারপর আমার পায়ে।

সেই থেকে ও কারো সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করে না। মূর্তিদুটি আর নিয়ে যায়নি। ফি সপ্তাহে তিন দিন করে পুজো করে যায় এখানে। তা ছাড়া ডেইলি ভোগ পাঠায়। আমাকে রোজ ধরছে ওকে দীক্ষা দেবার জন্যে। কিছুতেই বোঝাতে পারি না আমি কিছুই জানি না। একজন সাধারণ মানুষ। ওর ধারণা আমি ছদ্মবেশী মহাপুরুষ-টুরুষ হবো।’

শুভব্রত হাসতে হাসতে বলল—‘আমারও তো তাই ধারণা রে। শাস্ত্রের তেত্রিশ কোটি দেবতা নিজের থেকে যেচে তোর কাছে এসে পড়ছে। বিপদে-টিপদে পড়লে একটু দেখিস বাবা।’

চিত্ত বলল—‘ঠাট্টা করছিস? ঠাট্টা করারই কথা। কেন যে এমন হয় আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। কত পুণ্যবান মানুষ আছে জগতে। ছেলেবেলা থেকে মূর্তি দেখতে, গড়তে ভালোবাসতুম। এইটুকুই শুধু…’

ঘরের মধ্যে একটি মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন। চিত্তর মতো দশাসই নয়। হঠাৎ দেখলে চিত্তর থেকে বয়সে ছোট বলে মনে হয়। সাদা ধবধবে বুজ পাড় একটা শাড়ি পরনে। চিত্ত বলল—‘দিদি রে শুভ, আমার দিদি।’ ‘আমার দিদি’ কথাগুলোর মধ্যে কি যেন ছিল। শুভ উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মহিলার হাতে দুটো থালা, হাসিমুখে বললেন—‘প্রসাদ খেয়ে নাও।’

শুভব্রত শিউরে উঠে বলল—‘এইমাত্র অত খাওয়ালেন, আবার প্রসাদ?’

‘একজন সিদ্ধিদাতা গণেশ, আরেকজন ভক্তি এবং শক্তিদাতা শ্রীহনুমান। এঁদের প্রসাদে কখনও না করতে আছে!’ দিদি দুজনের দিকে দুটো পাথরের থালা এগিয়ে ধরলেন। ভদ্রমহিলা ছোটখাটো হলে কি হবে, বেশ একটা ব্যক্তিত্ব আছে।

বাবা বললেন—‘আমরা বুড়ো হয়েছি খোকা, আমাদের অবস্থাটার কথা একটু বিবেচনা করো।’ গলা বেশ গম্ভীর। মা মাথায় কাপড় টেনে বললো—‘কে এসে বলল বন্ধু, অমনি তুই চলে গেলি! রাত দশটা বেজে গেল। আমরা কেউই এখনও কিছু মুখে দিইনি।’

বয়োবৃদ্ধ বাবা-মাদের ভালোবাসার এই একমাত্র প্রকাশ। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের বাড়ি-ফেরা না-ফেরার সময় নিয়ে অযথা চিন্তা করা। তাঁদের দুশ্চিন্তা হবে বলে তুমি নিয়মমতো বাড়ি ফেরার রুটিন ভঙ্গ করতে পারবে না। রুটিন পালন করতে করতে তোমার জীবনের রস মূল থেকে শুকিয়ে গেলেও না।

রাত-আলোর সবুজ আলোয় বিছানার ওপর পাশ ফিরে কনুইয়ে ভর দিয়ে অনুশীলা বলল ‘হ্যাঁ গো, দিল্লির চটি আর সালোয়ার-সেট এনেছো?’ ওপাশ ফিরতে ফিরতে শুভব্রত বলল—‘হুঁ।’ অনুশীলা সবুজ-আলোয় স্বপ্নের মৎস্যকন্যা।

—‘আর কার্ডিগ্যান? ওখানে তো ডিসকাউন্ট দেয়।’

—‘হ্যাঁ হ্যাঁ’—শুভব্রতর গলায় বিরক্তি।

—‘রাগ করছো কেন বাবা? ওখানে কত সস্তায় চমৎকার চমৎকার পাওয়া যায়। তোমারই খরচ কমাচ্ছি।’

খরচ কমানোর জন্য খরচ বাড়াবার এই এক চিরকালীন ধান্দা এদের। শুভব্রত বলল—‘চাবিও জানো। সুটকেসের সঠিক অবস্থানও জানো। আমাকে একটু ঘুমোতে দিলে হত না? দুটো বড়ি গিলেছি।’

অনুশীলা সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল। বাঁচা গেল। চিত্তটা কি গাঁজা খায়, না সোজাসুজি লোক ঠকায়? কৃষ্ণনগরের বাজার থেকে পছন্দসই কৃষ্ণমূর্তিটা নির্ঘাত হাত সাফাই করেছিল যদি না পুরো গল্পটাই গাঁজা হয়। হনুমান আর গণেশের মূর্তিদুটো সেও শিউরতনকে জব্দ করবার জন্যে নিজের বশংবদ কাউকে দিয়ে সরিয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহই অবশ্য নেই। করেছে বেশ করেছে। এন্ডস অলওয়েজ শুড জাস্টিফাই মীন্‌স্‌। শিউরতন লোকটা তো চিরকালের মতো জব্দ হয়ে গেছে! বাস। কিন্তু গল্পের পেছনের আসল গল্পটা বন্ধুর কাছে চেপে যাওয়াটা কি উচিত হল চিতেটার? তা ছাড়া ওই সব গঙ্গা-ফঙ্গা। সেইজন্যেই সন্দেহ হয় চিত্তটা হয় গেঁজেল নয় গুলবাজ। চেহারাটা বেশ সৌম্য-সৌম্য বাগিয়েছে কিন্তু। যেন খুউব শান্তিতে আছে ঘর ভর্তি ওই সব পুতুল-ফুতুল নিয়ে।

‘দারুণ হয়েছে গো শালটা। সেমি পশমিনা, না আসল?’ ও ঘর থেকে অনুশীলার গান গান গলার আদুরে চিৎকার ভেসে এলো।

চিত্তর দিদির ব্যাপারটা কিন্তু হেভি গোলমেলে। নিজের দিদি নয়, মাসতুতো। চোরে চোরে মাসতুতো একেবারে। নিঃসন্তান, বালবিধবা। এই সব মহিলারা সাঙ্ঘাতিক হয়। সেক্স-স্টার্ভড্‌ হিস্টিরিক। চিতেটাকে হিপনটাইজ করে রেখেছে কিনা কে জানে? পয়সাকড়ি আছে মহিলার। খালি আপনজন কেউ নেই। চিত্তই একমাত্র আপন। মহিলা যদি ঘোরে ডালে ডালে তো চিতে ঘোরে পাতায় পাতায়। দুজনের মধ্যে রিলেশন ফিলেশন…ওষুধ ঘুমের ঘোর নামছে। একটা ফিনফিনে পাতলা মসলিন কেউ তার চেতনার ওপর টুপ করে ফেলে দিল। তলিয়ে যাচ্ছে এবার। কবোষ্ণ একটা সমুদ্রের মধ্যে মিছরির দানার মতো গলে যাচ্ছে যে সে কি সত্যিই কেউ? কোথাও যাচ্ছিল? তারপর যেতে যেতে…আদৌ কি সে আর কোথাও যেতে পারবে? কে যেন সুখী সুখী মাজা-মাজা চর্চিত গলায় বলে উঠল—‘তুমি ছিলে কর্মবীর। আজকের এই দিনটিতে গত বছর মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। তোমায় আমরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করি বাবাই, মোনালিসা, অনুশীলা বাবা ও মা।’ চমকে খানিকটা ভেসে উঠল সে। মোনালিসার গলা না? সে তা হলে মরে গেছে? সত্যিই তা হলে…বাবা মা সবাই তার শ্রাদ্ধ করছে? কথাটা শ্রাদ্ধ না শ্রদ্ধা? কাকে? কারা? আপাদমস্তক ঘেমে পুরোপুরি জেগে উঠল সে। ঢং ঢং করে কোথাও রাত দুটো বাজল। খলবলে পায়ে খাট থেকে হুমড়ি খেয়ে নামল, টেবিলে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে জ্বল খেয়ে নিল। পুরো আধ বোতল খেয়ে থামল। বুকের মধ্যে জল আটকেছে। ব্যথা। আস্তে আস্তে সেটা নেমে গেল। জানলার ধারে গিয়ে ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে দিল। ধরাল না। আকাশটা ঝকমকে কালো। কালীপুজোর রাতে টুনি বালবের মতো তারাগুলো জ্বলছে, নিবছে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল তার আকাশে তমিস্রা, তবু জীবনের ঘুড়িখানা মাঝ আকাশ বরাবর টানটান হয়ে উড়ছে। এখান থেকে বেশ লাগছে। সে, একমাত্র সে-ই জানে বড্ড টান। যে কোনও মুহূর্তে ভো কাট্টা হয়ে যেতে পারে। তা যাক। কিন্তু তারপর? হঠাৎ সে টের পেল দিকচিহ্নহীন মহাকাশের মধ্যে এক ফোঁটা বস্তুবিন্দু তার ওই ঘুড়িখানা গোঁত্তা খাচ্ছে। তার বড্ড বিপদ এবং সে চিত্তর সঙ্গে তার আকাশ বদল করতে চায়। এখন, দমবন্ধকরা গ্রীষ্মের নিদ্রাহীন মাঝরাতে তন্ন তন্ন করে আকাশময় সে আসলে খুঁজছে কোনও মিষ্টিমুখের রাখাল পুতুল, যার বাঁশির আওয়াজে ভয় ভোলা যায়, কিংবা কোনও গৌরকান্তি যোগিনী মূর্তি যে তার বহতা জটাভার মেলে তাকে চমকে দিয়ে বলে উঠবে—‘উধর মৎ-যাও বেটা, ম্যয় য়হাঁ হুঁ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *