পদ্ম কলি
সুদর্শন সরকার এ জায়গা সে জায়গা নানান জায়গায় আধাসরকারি কর্ম করে যখন অবসর নিলেন ঠিক তখনই, বলা নেই, কওয়া নেই, তাঁর পাকা আমের মতো টুকটুকে মা জননীটি টুক করে বোঁটা থেকে খসে পড়লেন। সুদর্শন বড্ড মাতৃভক্ত ছিলেন। প্রচলিত ধরনে নয়। বৃদ্ধা জননী ও প্রৌঢ় কনিষ্ঠ পুত্রের মধ্যে একটা ছ্যাবলামির স্রোত বইত সব সময়ে। যেমন, সুদর্শন বলতেন—‘এই যে মিসেস সরকার এইবার বেলাবেলি কেটে পড়ন দেখি, আপনার কোলেরটিও ষাট ছুঁতে চলল। এরপর আর কাছা গলায় দিয়ে, খালি পায়ে প্যাঁকাটির পাকের হবিষ্যি সহ্য হবে না।’
জননী বললেন—‘আ মর মুখপোড়া, মুখের আগল নেই। তুই-ই বা কেন এক পা ওদিকের বয়স পজ্জন্ত দামড়া রইলি। আমায় বুঝিয়ে বল। তুই সনকার নখীন্দর। তোকে তোর বেউলো জুটিয়ে দিতে পারলে, এ জন্মের মতো আমার গঙ্গার চানের সাধ মিটে যাবে।’
তবে তুমি তোমার পুত্তুরের মুয়ে আগুন দিতে বসে থাকো। আমি চললুম। বলে সুদর্শন তাঁর ছোট সুটকেসটি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। যেতে হবে সেই মুর্শিদাবাদ। জেলা, গঞ্জ, গ্রাম, টাউন চষে বেড়ানোই তাঁর কাজ। কলীগরা, অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সীরাও ফ্যামিলি নিয়ে নানান অসুবিধের কথা বলে বদলির দায়গুলো অপত্নীক সুদর্শন সরকারের ঘাড়ে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত। সুদর্শন ছাতুবাবুর ঘাটের দিকে চললেন। হরঠাকুরের সঙ্গে দেখা করা দরকার। হরঠাকুর বাড়ির বাঁধা পুরোহিত। লক্ষ্মীপুজো, সত্যনারায়ণ ইত্যাদি বাড়ির যাবতীয় পুজো করেন। রাম-সীতার মন্দিরের চাতালে তাঁকে পাওয়া যাবে।
দূর থেকে সুদর্শনকে আসতে দেখেই হরঠাকুর তাঁর গাঁজা খাওয়া দমকা গলায় বললেন—‘ঠিক আছে ছোটবাবু। চিন্তা নাই।’
‘আমি তা হলে নিশ্চিন্তে যাই?’ সুদর্শন হেঁকে বললেন।
ব্যাপারটা আর কিছুই না। সুদর্শনের অশীতিপর জননী নিত্য গঙ্গাস্নান করেন। সুদর্শন যতদিন বাড়ি থাকেন, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাঁকে ডুব দিইয়ে আনা তাঁর নিত্য-কর্ম। কিন্তু তিনি না থাকলে? তখন যাতে মায়ের বিপদ-আপদ না হয় তাই নানান জায়গায় তিনি লোক ফিট করে দিয়ে যান। গঙ্গার ঘাটে হরঠাকুর, তো হরিসভায় পঙ্কজিনী দাস। বৈঠকখানা ঘরে শোয় পাড়ার পরোপকারী যুবক পান্তু গুছাইত আর সত্যেন মণ্ডল। এদিকে রান্নাঘর সামলাতে কমলি তো আছেই। স্বপাকে ছাড়া জননী খাবেন না। অথচ চোখে দ্যাখেন না। কমলি জলে চাল ফেলে দিয়ে সময়মতো বলে—‘কই গো ঠাকুমা। এই নাও। ন্যাতাটা বেড়ে ধরো। ডাঁড়াও ডাঁড়াও, পুড়ে মরবে যে! ব্যস, তোমার স্বপাক হয়ে গেল।’ বৃদ্ধার নিদন্ত মুখে ভর-ভর্তি হাসি উথলে ওঠে। বলেন—‘যাক, এতখানিটা বয়েস পজ্জন্ত যখন পর-পরালির হাতে-পাতে খেতে হল না, তো আর হবেও না, কি বল!’ কমলি বলে—‘হ্যাঁ গো ঠাকুমা, স্বগ্গ তোমার বাঁধা।’
সে যাই হোক সুদর্শন সরকারের গল্পের সঙ্গে এসবের আর কতটুকু সম্পর্ক! অবসর নিয়ে সুদর্শন চেপে বসলেন, মাতৃসেবা করবেন। একে মায়ের কোল পোঁছা, তার ওপর চাকরির সুবাদে মাতৃসঙ্গ—আশ মিটিয়ে করাও হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাঁর কপাল খারাপ। এক সকালে মা-জননী উঠছেন না দেখে ডাকতে গিয়ে দেখেন মশারির মধ্যে পাকা আমটি খসে রয়েছে। পাতা নেই, বোঁটা নেই। শুকিয়েও উঠেছে এরই মধ্যে। আর, এর পরেই তাঁকে ধরল তাঁর সারা জীবনের সবচেয়ে বড় অসুখ—হেপাটাইটিস-বি। এমনি অসুখ যে ঝাড়া তিনটি মাস নার্সিং হোমের যত্নে থেকে সুদর্শন যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তাঁর বয়সের মেদমাংস সব ঝরে গিয়ে বয়সকালের সোজা সাপটা আড়াটি বেরিয়ে পড়েছে। ডাক্তার বললেন—‘চেঞ্জে যান। এখানে আর একদণ্ড নয়। জীবপালিনী গঙ্গা এখন বিষপালিনী হয়ে উঠেছেন।’
সুতরাং মা-গঙ্গার আওতা ছাড়িয়ে সুদর্শন চললেন শালমউলের দেশে। শাল, মউল, ইউক্যালিপটাস, শিশু, শিরীষ। লাল-মাটির ভাপে গাছের রোগহর বাতাসে, ইঁদারার জলে যদি স্বাস্থ্য ফেরে।
রিকশাঅলা গাড়ি ছুটিয়েছে শনশন করে। সুদর্শন বলেন—‘আস্তে চল্ বাবা, অত হটর হটর করবার কিছু নেই। দাঁড়া দাঁড়া বাহান্ন বিঘে আরম্ভ হয়ে গেল বলছিস? ইঁদারাতলা ছিল যে একটা রাস্তার মোড়ে! অ্যায়, এই তো! এইবার একটু বাঁদিকে ঘেঁষে চল দেখি। “শুভময়ী কুটির” বলে একটা বাড়ি চোখে পড়ে কিনা দেখি।
‘শুভময়ী কুটির যাবেন? মায়ের হোটেল? তা আগে বলেননি কেন বাবু?’
‘হোটেল?’ সুদর্শন যেন ভূত দেখলেন।
‘মায়ের হোটেলই বলি কিনা আমরা।’ ঠাকুরদের হোটেলের মত নয়। ওই যাঁরা বাড়ির মতন থাকতে চান, দু-চার জন তাঁরাই মায়ের হোটেলে কাটিয়ে যান বাবু।’
‘হোটেল দেখে কে?’
‘বা! মা নিজে রয়েছেন। তেনাদের মেনেজারবাবু নিতাইপদ রয়েছেন। বুধন রিকশাঅলা-ও পরিবার নিয়ে বাগানেই থাকে; সবাই দেখে।’
সুদর্শন আর কিছু বললেন না। তিনি ঘরের মত একটি হোটেলেরই সন্ধান করছিলেন। হেপাটাইটিস-বি’র পরে সাধারণ হোটেলের রান্না খেতে হলে তাঁকে এ জগতের পাততাড়ি গুটোতে হবে।
‘বোর্টার এসেছে গো!’ টিং টিং করে বেল মেরে জানান দিল রিকশাঅলা। ভেতর থেকে খোঁচা খোঁচা দাড়িঅলা হাফ পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা নিতাইপদ মেনেজার বেরিয়ে এলো।
সুদর্শন ঘরটি একটেরে পেয়েছেন। নেটের মশারি খাটিয়ে রাত্রে শোন। মশারির বাইরে রাশি রাশি রঙবেরঙের পোকা আর মথ ঘোরে, ভোরবেলা জানলার ঠিক বাইরে পেঁপে গাছের সারির মধ্যে থেকে গুব গুব গাব গুব করে হলদে ন্যাজের পাখি ডাকে। আধ-ঘুমন্ত সুদর্শনের ভোরের ঘুমে বড় খেদ হয় বড় হয়ে ইস্তক মায়ের সঙ্গ, মায়ের সেবাটি করা হল না। এদিকে নাগাড়ে চাকরি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমেছে কার ভোগে লাগবে? দূর করো অমন চাকরি!
মেনেজার নিতাইপদর খড়মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে কাঁচা সকালে। শুভময়ী কুটিরের ইঁদারার জলে মনে হয় হেপাটাইটিস-বি’র ধন্বন্তরী ওষুধ আছে। সুতরাং দিন কে দিন সুদর্শন সরকারের খিদে বাড়ে।
পুকুরের টাটকা মাছের ঝোল, কিংবা দিশি মুরগীর সুরুয়া দিয়ে ভাত বেড়ে দ্যান শুভময়ী কুটিরের সুধা। ভাতের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বিকেলবেলা বেড়াতে বেড়াতে লালচে মাঠে সূর্যাস্তের কাছাকাছি চলে যান। দেখতে দেখতে যান একটার পর একটা বাড়ি কেমন যত্নের অভাবে, মানুষজনের অভাবে অসহায়ের মতো ভেঙে পড়ছে। দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরেন যখন সন্ধে। সকালে চা খান না। সন্ধেবেলা পাতলা সুগন্ধি এক কাপ চা একখানা বিস্কুটের সঙ্গে খান। তারপর কুটিরের বারান্দায়, বাগানশুদ্ধু ভুরভুরে অন্ধকার নিয়ে বসে থাকেন, বসেই থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সামনেটা তারার মাঠ হয়ে যাচ্ছে।
এই সময়ে কোন কোনদিন শুভময়ী কুটিরের সুধা পেছন দিকে একটি বেতের চেয়ার নিয়ে এসে বসে থাকেন। মধ্যবয়সী মহিলা, খুব শান্ত সৌম্য চেহারা, মাজা রঙ, ধনেখালির ডুরে শাড়ির আঁচলটি গায়ে জড়ানো থাকে। সুধা চুপচাপ মানুষ। কিন্তু সুদর্শন খুব চুপ করে থাকবার লোক নন। সুধার সঙ্গে কথা জমাতে না পারলে নিতাইপদ আছে, সে সিঁড়ির গোড়ায় থেবড়ে বসে, চুলের মধ্যে জোনাকি পোকা ঢুকে যায়। বুধন রিকশাঅলার সঙ্গেও একেক সময়ে জোর আড্ডা জমে যায়। তা ছাড়াও আছেন মোড়ের বাড়ির বয়োবৃদ্ধ শান্তিবাবু। কখনও তিনি আসেন, কখনও সুদর্শন নিজেই যান।
চুপচাপ হলেও সুধাময়ী খুব সহজ আমুদে মানুষ। কথা যখন বলেন, দূরত্ব রেখে বলেন না। একদিন বললেন—‘মা-টিকে তো বলছেন খেয়ে বসে আছেন, এখন করবেনটা কি শুনি?’
সুদর্শন বললেন—‘তাই তো দেবী, ভেবেছিলুম ভ্রমণ করে করে কাটিয়ে দেবো। দেখবার জায়গা তো পৃথিবীতে কিছু কম নেই। কিন্তু যা রোগে ধরল চট করে কোথাও যেতে সাহস পাচ্ছি না। বাড়িতে আছে এক কমলি ঠানদি, ক’টা দিন দেশে জুড়োতে গেছে। সরকার-মা তো জ্বালিয়েছেন কম না! তা সেই কমলির হেপাজতেই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে দেখছি।’
‘তা যাঁর হেপাজতে কাটাতে হলে ভালো লাগত সে মানুষটিকে ঘরে আনলেন না কেন?’ সুধা মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
‘সে এক ভারি মজার গল্প। শোনেন তো বলি’—সুদর্শন নড়েচড়ে বসলেন।
সুধা এতদিনে অতিথির স্বভাব টের পেয়ে গেছেন। বড় গল্প একখানা শোনবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসলেন।
‘কর্মব্যপদেশে নানান দেশে ঘুরেছি জানেন তো?’ জমিয়ে আরম্ভ করলেন সুদর্শন। ‘সেবার বদলি হলুম এক নিঝঝুম জায়গায়। না আছে বাসস্থান, না আছে একটা কথা বলবার লোক। শেষ কালে অফিসের এক সহকর্মী আমার জন্য একটা পেয়িং গেস্ট থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। ভদ্রলোক বিপত্নীক। পাঁচ মেয়ে আর একটি বাড়ি, কুল্যে এই তাঁর সম্বল। আমাদের অফিসেই কলম পেষেন। বাড়িতে নাকি জায়গা প্রচুর। থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। আমাকে হাত জোড় করে বললেন—“আপনি যা ধর্মত মনে হয় দেবেন খাই-খরচ বাবদ। থাকার জন্য খরচা করতে পারবেন না।” বাড়িটি সত্যি বড় সুন্দর। পাখিডাকা গাছ-গাছালি-ভরা ছায়া-অলা বাংলো বাড়ি। আমার ঘরটি একেবারে দাওয়ার পাশে। ইচ্ছে করলে দাওয়ায় বসে পড়ালেখা করতে পারি, ইচ্ছে করলে বাগানে নেমে যেতে পারি। খালি বাথরুম যেতে হলে অন্দরের উঠোন পেরিয়ে যেতে হয়। সে-ও আলাদা, আমার একার বাথরুম। চালের ওপর কুমড়োলতা তোলা আছে। সকালবেলা তা থেকে বৃষ্টির জলের মতো দানা দানা শিশির পড়ে।’
সুধা হেসে বললেন—‘আপনি কি কবিতা লেখেন নাকি? টপটপ করে শিশির পড়ে তো সেই জলেই চান করে নিতেন না কেন? অমন দানা দানা কুমড়োলতার জল!’
সুদর্শন বললেন—‘হাসছেন? আরে বাবা চিরকালই কি এমন বুড়ো-হাবড়া রসকষহীন ছিলুম? তারপর শুনুন। ভদ্রলোকের পাঁচটি মেয়ে যেন পাঁচটি রত্ন। মুক্তো, চুনী, হীরে, পান্না, প্রবাল। আমার বালিশ, বিছানা, পর্দা, তোয়ালে, জামা কাপড়, সব সময়ে ধবধব করছে। সে তাদের কারো হাতের কাজ। সকাল-বিকেল চা এনে দিত। অমন রঙ আর গন্ধ সারা জীবন আর কখনও পেলুম না। কে করেছে, কেমন করে করেছে জিজ্ঞেস করলে মুখ টিপে খালি হাসত। রান্নার আর কি বলব তুলনা হয় না। সত্যি অন্ন-ব্যঞ্জনের অমন স্বাদ, সাধারণ শাকের ঘন্ট, মাছের মুড়োর কালিয়া কি শুক্তো যেন অমৃত। আর কী বর্ণ? আহা! মনে করলেও দশ-বিশ বছর বয়স কমে যায়।’
সুধা হেসে বললেন—‘বুঝেছি, বুঝেছি ওইসব রঙ খানিকটা ছিল আপনার চোখেও নইলে…’
‘সত্যি বলছি সুধাদেবী’, সুদর্শন হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘আমার বয়সটা তখন রঙ দেখবার বয়স হতে পারে। কিন্তু অমন জিনিস, তেল-ঝাল-মশলার বাড়াবাড়ি নেই, পুষ্টিকর, অথচ অতি সুখাদ্য আমি তারপর জীবনে আর খাইনি। তা সে যাই হোক, আমি বলতুম পঞ্চকন্যে। ছোটটি নেহাতই ছোট। বছর ষোল-সতের, তাকে পড়া দেখিয়ে দিতুম, কবিতা-টবিতা পড়লে আর চারজনও এসে বসত, তাদের বাবাও ঘুরঘুর করতেন। ভদ্রলোক ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন। ক্রমশ দেখলুম ওইই নির্জন অরণ্যবাস পঞ্চকন্যের কল্যাণে গানে-গল্পে-যত্নে কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে আমি টেরই পাচ্ছি না। খুব কষে মন দিয়ে আদিবাসী কল্যাণ করতে লাগলুম।
‘তারপর একদিন প্রাতঃকালে ঘুম ভাঙলো মৃদু মধুর গন্ধে। গন্ধটি অপরিচিত। চোখ খুলে দেখি আমার তক্তপোশের পাশে যে ছোট টেবিলটাতে সকালে চা খেতুম, রাত্রে পড়ার বইটা মুড়ে রেখে শুয়ে পড়তুম, সেই টেবিলের ওপর সরু একটি বেলে পাথরের গ্লাসে একটি আধফোঁটা পদ্ম কলি। ওপর দিকটা সাদা, তলার দিকটা গোলাপী, মৃণালের ওপর হেলে আছে। চমৎকার। ভাবলুম, বাঃ, ভারি সুন্দর তো! এখানে চারদিকে অনেক ফুল, তবে বেশির ভাগই রঙিন মৌসুমী ফুল, পদ্ম কার বাগানে কোন পুকুরে ফোটে কে জানে, তারপর কাজে-কর্মে ভুলে গেছি।’
সুধা বললেন—‘অত ভালো লাগল জিনিসটা। অথচ ভুলে গেলেন! আচ্ছা তো!’
‘আরে মশাই শুনুনই না, এ হল গিয়ে ভুলে থাকা, সত্যি সত্যি ভোলা নয়। রাত্তিরে শোবার সময়ে মশারিতে ঢুকেই প্রথম কথা মনে হল আহা কাল সকালেও যদি চোখ মেলে অমনি একটি পদ্ম কলি পাই! খুব ভোরে তখনও চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে, হুট করে ঘুমটা ভেঙে গেল, মশারির জালির মধ্যে থেকে দেখলুম আরে! পঞ্চকন্যের মেজকন্যে ঢুকছে যে! হাতে সেই পদ্ম কলি! এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে ভীরুর মতো ঢুকল। কলিটিরই মতো লতিয়ে, তারপর আমার টেবিলে সরু বেলে পাথরের গ্লাসে ফুলটি নামিয়ে রেখে এক রকম দৌড়ে চলে গেল।
‘ভালো রে ভালো!’ সারাদিন ধরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেজকন্যের মুখখানা মনে পড়তে লাগল। রঙটি সুগৌর, হতে পারে মুখে একটু ভুটিয়া-ভুটিয়া ভাব আছে, কিন্তু আহা কী শোভা কুচকুচে কালো চুলের ঢালে। কাঠামোটি চওড়া, মোটা নয়, দোহারা। আর কী কোমল! সারা দিন স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দিলুম। ভাবছি ক’দিন যাক তারপর মেজকন্যের পিতাঠাকুরের কাছে প্রস্তাব রাখবো। ওমা! দু-চার দিন পরই দেখি ভোরবেলা আবার আমার ঘরে ছায়া ঘুরঘুর করছে। এ কী? এ যে ছোট কন্যে। সেই ষোল-সতের বছরের সদ্য কিশোরী। মুখে কাঁচা আমের আভা। এখনও ভালো করে শাড়ি পরতে শেখেনি, ঠোঁট দুটি ছোট্ট একটি পাহাড়ি গোলাপের মতো, আচ্ছা পাকা পক্বান্ন তো! টুক করে পদ্মকলিশুদ্ধু গেলাসটি নামিয়ে রেখে সে ছুট্টে বাইরে চলে গেল। এমনি করে ভোরবেলা জেগে জেগে পঞ্চকন্যের পাঁচটিকে একদিন একে, একদিন ওকে পদ্মফুল রেখে যেতে দেখলুম। সে কী মধুর ব্রীড়া! কী অপরূপ ভঙ্গি। পাঁচটি কন্যেকেই এইভাবে আমার দুয়ারে প্রণয়প্রার্থী দেখে আমি মহাধন্দে পড়ে গেলুম সুধাদেবী। তাই বদলির সুযোগ পাওয়ামাত্র মনে মহাদুঃখু নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলুম। মনের খেদে আর বিয়ে করাই হল না। বিবাহের কথা হলেই সেই পাঁচটি মেয়ের ফুটফুটে মুখ মনে পড়ত। একজন নয়, দু’জন নয়, পাঁচ-পাঁচজন কুমারীর হৃদয়, সে কি সোজা কথা! বলুন!’
সুধা হেসে বললেন—‘আপনি আশ্চর্য লোক তো! খুব অহঙ্কারীও দেখছি! আপনার একবারও মনে হল না ব্যাপারটা একটু খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার!’
সুদর্শন বললেন—‘এখন বয়সে এমনি হয়েছি। হেপাটাইটিসটাও ধরে গেল। নইলে তখনকার সুদর্শন সরকার একটু বাড়াবাড়ি রকমের সুদর্শনই ছিল যে দেবী!’
সুধা বললেন—‘তাই তো বলছি আপনি বড্ড অহঙ্কারী। গুমোরে চোখে দেখেও দ্যাখেন না। আপনার মনে হওয়া উচিত ছিল, মেয়েগুলির নানান বয়স, পরস্পরে ভাব, মনের মিলও খুব, তারা একসঙ্গে সবাই এক পাত্রে মজতে না-ও পারে।’
‘কি বলতে চাইছেন আপনি!’ সুদর্শন চমকে উঠলেন।
‘বলতে আর কি চাইবো? আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তো বলব পাঁচজনের মধ্যে একজনই আপনাকে পদ্মকলি নিবেদন করত, বোনেদের হাত দিয়ে নিশ্চয়ই সে-ই পাঠাত ফুলটা। আর আপনার সেবা-যত্ন, আদর-আপ্যায়নের পেছনে পাঁচজনের আড়ালে একজনের হাতই যে খুব বেশি করে থাকা সম্ভব, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিও আপনার ঘটে ছিল না। আসলে আপনি নিজেই পাঁচজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন।’
সুদর্শন বললেন—‘তুমি ঠিক বলছো? সেই পাঁচজনের মধ্যে একজন, একদম একা একজন একমাত্র? সে কি তবে তুমিই?’
সুধা হাসতে লাগলেন। সুদর্শন উৎসুক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন—‘আর চারজন কোথায় গেল? কি হল তাদের? কও দেখি।’
সুধা বললেন—‘মেজ মায়া থাকে দিল্লি, তার বর সেখানে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট সার্ভিসে আছে, রূপা রয়েছে কলকাতায়। বর মস্ত কনট্র্যাক্টর, একটার পর একটা বহুতল বাড়ি তুলছে, গীতু থাকে মিডল ইস্টে, বছরে একবার করে আসে, কত জিনিস যে নিয়ে আসে! আপনি যে মাখমের মতো নরম চাদরে শুচ্ছেন, পালকের বালিশে মাথা দিচ্ছেন, হাল্কা নাইলনের কম্বল গায়ে দিচ্ছেন, সব ওর আনা।’
‘আর…ছোটটি? স্নেহ?’
সুধা আঁচলে মুখ ঢেকে ফেললেন।
‘কি হল? থামলে কেন? বলো?’
‘স্নেহ আমাদের বুক খালি করে দিয়ে চলে গেছে। তার সব গান, সব কথা নিয়ে।’ সুধা ধরাগলায় বললেন।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সুদর্শন আপন মনে বললেন—‘মায়াময়ী, রূপময়ী, গীতময়ী, স্নেহময়ী আর…সুধাময়ী?’ ঝুঁকে বসলেন তিনি—‘তুমি? তুমিই তা হলে আমার মতো একা একা রয়ে গেলে? আমার জন্যে?’
মাসখানেকের মাথায় সুদর্শন বউ নিয়ে হাওড়ায় দেখাতে চললেন। এতদিনে লখীন্দরের বেহুলা জুটল। ‘সবই হল—বুড়ো মায়ের সাধটুকু শুধু মেটানো হল না’—এই বলে পাঁচজনে অনুযোগ করলে সুদর্শন জীবনে এই প্রথম মুখ কাঁচুমাচু করে ‘জানালেন—‘তিনি তো বেশি দেরি করেননি। সনকাদেবীর একটু তর না সইলে তিনি আর কী করতে পারেন!’