পরভৃৎ
কুল্লে দেড়খানা ঘর। এক চিলতে বারান্দা, ধুলো বাঁচাতে টিনের আড়াল দেওয়া। রাস্তার একেবারে ওপরে তো! একফালি রান্নাঘর। দেয়াল থেকে আস্তর খসছে দিনভর রাতভর, সে নতুন চুন করালেও খসে। মিস্তিরি বলে নোনা ধরেছে কি না বাবু, গঙ্গার এতো কাছে! তা ছাড়াও বাড়ি যে করেছিল সেই কনট্রাকটর বাজে মাল দিয়েছিল। ইঁট বদলালে তবে যদি কিছু হয়। যা অসম্ভব সুতরাং তা অসম্ভবই। সারা দিন রাত যখন তখনই গেল গেল রব।
‘ওগো শীগগীরই এসো।’
‘কি ব্যাপার? কি হল?’
‘ভাতের হাঁড়িতে পড়ে গেল।’
‘ভাতের হাঁড়িতে পড়ে গেল, বাঃ চমৎকার, আমি তবে না খেয়ে আপিস যাই!’
কাঁচুমাচু মুখ এবার আস্তে আস্তে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ‘কবে থেকে যে বলছি ওপরটা ফেঁপেছে ভেঙে দাও, ভেঙে দিয়ে যাও, শুনেছো?’
‘এরকম যখন এখন-তখন অবস্থা হয়ে আছে তখন রান্নাগুলো ঢাকা দিয়ে করতে পারো তো!’
‘ফ্যান উথলোচ্ছে, ঢাকা দেবো? তুমিই রান্নাটা করো তা হলে।’
‘হ্যাঁ ওইটেই বাকি আছে।’
এক খাবলা তেল মাথায় চড়িয়ে গামছা কাঁধে বাবু তারাপদ সেন মহাশয় লম্বা লম্বা পায়ে বাথরুমের গোঁসা ঘরের দিকে চলে যেতে থাকেন। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভাতের হাঁড়ি থেকে লম্বা লম্বা চুনের শক্ত ফালি তুলে ফেলতে থাকেন মিসেস রমলা সেন। হাঁড়ি নামিয়ে টাটকা গরম জল বসান, গরম জল ভাতে ফেলে এবার ফ্যান গালতে থাকেন, ‘যা বালি ভেসে ভেসে বেরিয়ে যা, যা বাবা চুন এতে করে জল ঢেলেছি বেরিয়ে যা।’
পিঁড়ি পেতে তারাপদবাবু বসলে ধবধবে ভাত ধরে দিয়ে, মাছের ঝোল সাঁৎলাতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন গিন্নি।
তারাপদবাবু বলেন, “বাঃ ভাতগুলো আজ বেশ চুনকাম হয়েছে। ফর্সা কাচা ভাত খাবার কপাল আজ আমার। খেয়ে দেয়ে মাঝ-আপিসে মেডিক্যাল কলেজ হয়ে নিমতলা।’
সাঁৎলানো ঝোলে জিরে-ফোড়নের সুগন্ধ ভাসছে। বাটি পাতের পাশে বসিয়ে দিয়ে মিসেস বললেন, ‘অ্যামবুলেন্সটা বাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে বোলো। তোমাকে যদি যেতে হয় তো আমাকেও হবে।’
এই সমস্ত নিত্য-নৈমিত্তিক নাটকের অনেকটাই মঞ্জু জানে না। তার ভোরের কলেজ। ফিরতে বেশির ভাগ দিনই এগার সাড়ে এগার। তার অনেক আগেই বাপ খেয়ে দেয়ে পগার পার। খেতে বসে মা-মেয়ে, বেলা একটা। মঞ্জু বলে, ‘মা, আমার ভাত আলাদা কেন?’
‘গোপালের মা চাইল কিনা, খানিকটা দিয়ে দিয়েছি, একটু কম পড়ে গেছে তাই।’
‘গোপালের মা চাইল? কোন দিন তো চায় না? কই দেখি, ওই তো হাঁড়িতে যথেষ্ট ভাত!’
‘ওটা রাতের জন্যে রেখে দিয়েছি। তুই যে বাসমতী ভালোবাসিস!’
‘একবার বলছো গোপালের মা চাইল, একবার বলছো রাতের জন্যে রেখে দিয়েছো। আবার বলছ, আমি বাসমতী ভালোবাসি। কোনটা সত্যি গো মা!’
‘সবগুলো সত্যি!’ মা ঝংকার দিয়ে ওঠে, ‘নে এখন খা তো!’
নিজের পাত থেকে এক খাবলা মায়ের পাতে তুলে দিয়ে মঞ্জু বলে, ‘তা হলে দুজনে মিলেমিশে খাই।’
হাঁ-হাঁ করে নিজের পাত ঢাকে রমলা-মা। আসলে সেই যে সেন মহাশয় টুকে দিয়ে গেছেন আপিস হয়ে মেডিক্যাল কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ হয়ে নিমতলা! চুনপড়া ভাত কিছুতেই মেয়েকে ধরে দিতে পারেনি। যদি কিছু হয়! নিজেদের বেলায় ঝুঁকি নেওয়া যায়। নিতে হচ্ছে। ছোট সংসার, দুজনেরই হিসেব-বাতিক পরিচ্ছন্নতা-বাতিক। তাই চলছে। এটা নেই সেটা নেই প্রকট হচ্ছে না, নইলে কি যে হত বলা যায় না। কিন্তু মেয়ে একমাত্র মেয়ে, তার বেলা হিসেব শিথিল, পরিচ্ছন্নতার বাতিক আরও কড়া। মঞ্জু বুঝতে পারে কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। কিন্তু কিসের গোলমাল ধরতে পারে না। তার মাথায় এখন সলিড জোমেট্রি ঘুরছে। সে কোনমতে খেয়ে উঠে পড়ে।
মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তার এখন হেঁশেল তোলা, কাপড় মেলা ঘর-গুছোনো হাজারো কাজ বাকি। সব করে সে একটু নিশ্চিন্তে জিরোতে চায়। মঞ্জু এখন খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম করুক, ঘুমিয়ে নিক, নইলে চোখের তলায় কালি পড়বে। মুখ চুপসে যাবে। তার চেয়ে তার মা বেশি বিউটি-কনশাস। এই বেসম মাখ, মুখে সাবান দিসনি, এই ঝামা দিয়ে পা ঘসে ফেল। এই চুল আঁচড়া, একশো বার গুনে গুনে চিরুনি চালাবি। হপ্তায় দুবার করে মাথা ঘষ। রিঠের জল করে রেখেছি। কেশুত, মহাভৃঙ্গরাজ, আমলা দিয়ে তেল করা আছে। মাখ্।
—‘উঃ, এতো তুমি জানলে কোথায় মা?’
—‘একটু চোখ কান মেলে থাকলে তুইও জানতে পারতিস!’
—‘তা নিজে করো না।’
নিজের মাথার পাতলা চুলের বিনুনিটাকে দু-একবার চাপড়ে রমলা-মা বলে, ‘ধুর!’ আড়চোখে মেয়ের পিঠ ভর্তি ঢেউখেলানো কেশ কলাপের দিকে চায়, মসৃণ কাঞ্চনবর্ণ মুখশ্রীর দিকে চায়, ফোটা ফুলের মতো আঙুলের গোছার দিকে চায়, চোখ দিয়ে স্নেহ গর্ব গলতে থাকে, মনে মনে বলে—‘আমার কি ওই রকম!’
মেয়ে যখন বাড়ি থাকে না, কোচিঙে যায় কি কোনও বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যায়, স্বামী-স্ত্রীতে গোপন সভা বসে অনেক সময়। রমলা বলে, ‘সত্যি, ও ওরকম হল কি করে বলো তো!’
রোগা বুক ফুলিয়ে তারাপদ বলে, ‘হুঁ হুঁ বাবা। এ শর্মার যৌবনের চেহারাটা ভুলে যাচ্ছো!’
মুখ বেঁকিয়ে রমলা বলে, ‘আহা হা হা, কী চেহারা, কী চেহারা। দিদিরা সব বললে রাজপুত্তুর বর এসেছে! দেখে আয়। তা চুপি চুপি বারান্দা দিয়ে দেখি, খ্যাংরা কাঠির মাথায় আলুর দম।’
—‘আর রংটা? রংটা?’ হাঁ হাঁ করে ওঠেন তারাপদ।
—‘এখন কেউ বলবে? এখানে কালো ছোপ, ওখানে কালো ছোপ।’
—‘আহা ছিল তো!’
—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, রঙ যেন ছিল, কিন্তু সরস্বতীর মতো অমন মুখশ্রী!’
—‘সরস্বতী নয়, সরস্বতী নয়, মেরিলিন মনরো!’
—‘নিজের মেয়ের সঙ্গে ওই সব মুখপুড়ি হতচ্ছাড়িদের তুলনা করতে লজ্জা করে না?’
—‘ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট। যে দেখে সেই বলে, চোখ দুটো অবিকল মেরিলিন মনরোর মতো, ইয়ংরা বলছে, কুচোরা বলেছে, আমি বললেই দোষ হয়ে গেল?’
—জ্বলজ্বলে চোখে সেনমহাশয় বলতে থাকেন—‘মেরিলিনের মতো চোখ বলেই তো আর ও মেরিলিন হয়ে যাচ্ছে না? ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে পাস করতে যাচ্ছে। এম. এ. পড়বে, এম. বি. এ. পড়বে। বিজনেস এগজিকিউটিভ হয়ে ঢুকবে ইয়াব্বড় কোম্পানিতে, তখন এই বাড়ির ইট শুধু পাল্টে ফেলব। দোতলা তুলব। ম্যাগাজিন দেখে ঘর সাজাবো। তুমি গোলাপি রঙের হাউস কোট পরে এ-ঘর ও-ঘর করবে।’
—‘আহা হা হা, গোলাপি রঙের হাউস কোট পরে এ-ঘর ও-ঘর করবে! অল্প বয়সে পর্যন্ত কোনদিন যে কালো বলে গোলাপি লাল পরতে দিলে না? এখন মাথায় টাক, হাতে পায়ে শির জেগেছে, এখন গোলাপি হাউস-কোট। তুমি পরো গে যাও!’
বলেই রমলা স্বামীকে গোলাপি হাউস-কোট পরা কল্পনা করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
স্বামী-স্ত্রী মিলে দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্ত তৈরি করেছে। কেন্দ্র হল মঞ্জু। মঞ্জুকে ঘিরে দুজনে পাক খাচ্ছে। ভাত- রুটি, মাছ-মাংস, ফল দুধ, সুষম খাদ্য, ব্যায়াম গান, রূপচর্চা, পোশাক-পরিচ্ছদ—মা। বই খাতা, রাত হলে কোচিং থেকে গানের ক্লাস থেকে, বন্ধুর বাড়ির নিমন্ত্রণ থেকে নিয়ে আসা, অনেক সময়ে দিয়ে আসা, কেনা-কাটি, ছোটাছুটি, ডাক্তার-বদ্যি-বাবা। ছোট বৃত্ত বড় বৃত্ত কেন্দ্রবিন্দুটিকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। পাক খাচ্ছে মহা আনন্দে। ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। সবটাই যেন ভারি আনন্দের। সৃষ্টির আনন্দ, তৈরি করার আনন্দ। আরও আনন্দ এই জন্য যে পরিশ্রমের ফলাফলটা হাতে হাতে পাওয়া যায়। মায়ের যত্নে মঞ্জু আপাদমস্তক সুছন্দ, সুচারু, সু-স্বাস্থ্যবতী। গালে তার লালের আভা। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, পরিষ্কার। বন্ধুর বাড়ি বিয়ের নিমন্ত্রণে যাবার সময়ে মা তার একখানা বিয়ের সময়কার সাদা টিসু বেনারসী বার করে দেয়, মাথায় সাদা চন্দ্রমল্লিকা, গলায় ঝুটো মুক্তোর লম্বা হার। মার মার কাট কাট পড়ে যায়। মঞ্জু বাড়ি ফিরে এসে বিরক্ত মুখে বলে—‘মা প্লীজ, তুমি আর আমাকে এতো সাজিও না।’
মা বলে, ‘এর থেকে কম সাজ আর কিসে হয় আমি তো জানি না খুকু!’
সত্যিই! মেয়ে মালাটা তুলে পরখ করে, শাড়ির আঁচলটা ঘুরিয়ে দেখে, তারপর হেসে ফেলে। তারপর বলে—‘মা তোমার রুচিটা দারুণ, এতো আর্টিস্টিক এতো আধুনিক! সায়ন্তনীর মা তো কলেজের প্রোফেসর, উনি বলছিলেন সাদা পরেছিস কেন! অথচ…’
—‘বল, থামলি কেন?’
মঞ্জু লজ্জা পেয়ে যায়। মা জোর করে, ‘বলই না কি বলবি।’
—‘কী আর বলব, সব চোখ আমার দিকে, কনেকে কেউ দেখছে না। সবাই আমাকে। আসলে তোমার পছন্দটা…।’
রমলা বলে, ‘তোকে কিন্তু আমরা পছন্দ করে আনিনি খুকু।’
—‘ধ্যার, কি যে বলো!’
—‘না রে, সত্যিই একেক সময় সন্দেহ হয়, হাসপাতালে বদল হয়ে আসিসনি তো!’
মঞ্জু মাকে জড়িয়ে ধরে, চোখ ভর্তি জল। —‘মা, এমন করে বললে আমার কেমন ভয় করে, কষ্ট হয় মা!’
মা মেয়ের গালে চুমো খেয়ে বলে—‘তা না। কখনোই না। তোর চলাফেরার আড়ালে তোর বাবা আর ঠাকুমা উঁকি মারেন। তোর দিদিমার হাতগুলো ছিল এমনি আ-ফোটা পদ্মের মতো। খুকু, আমার মাসী তাঁকে তুই দেখিসনি, তোর চুলগুলো যেন সেই কনে মাসীমার মতো। তুই ঘুরিস ফিরিস, তোর চোখের চাওয়ার ঠোঁটের ভঙ্গিতে নাকের আদলে যেন আমার অনেক দিনের অনেক ভালো লাগা মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আসলে খুকু, তুই ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। ভগবান আমার সেই ইচ্ছেকে সম্মান দিয়েছেন। সাধারণত, তো তা দ্যান না!’
বাবা বাইরে থেকে ব্যস্ত হয়ে বলে—‘কই, তোমাদের হল? মঞ্জু তোর নোটসগুলো জেরক্স করে এনেছি, আর এই নে তোর মাইক্রো-টিপ পেন।’
মা বলল—‘ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স?’
—‘এনেছি গো এনেছি!’
—‘এনে থাকলে তোমরা খাও। মা খাও, বাবা খাও।’ মঞ্জু খুব রাগ রাগ মুখে বলে। —‘আমার আর ভিটামিনের দরকার নেই।’
মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে তারাপদবাবু বুঝতে পারেন সত্যিই মেয়ে ঠিকই বলেছে। কোনও প্রসাধন ছাড়াই যার গাল ঠোঁট এমন টুকটুক করে, চোখ যার অমন পরিষ্কার জলের মতো স্বচ্ছ, অমন সতেজ চলাফেরা, ভিটামিন তার আপাতত না হলেও চলবে।
বরং রমলা! কালো ঠিকই। কিন্তু শ্রীময়ী ছিল তো! মোটাসোটা হয়েছে ঠিকই। শরীরে কোনও রোগবালাইও নেই। কিন্তু শ্ৰীটা যেন একদম চলে যাচ্ছে। ভিটামিন কয়েক শিশি খেলে কী…।
সুদক্ষিণার মা এসেছেন। সুদক্ষিণা মঞ্জুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। অ্যামবাসাডরটা গলি জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুদক্ষিণা নামল, সুদক্ষিণার মা নামলেন, সুগন্ধে ঘর ভরে গেল। সুদক্ষিণার মা সুজাতা একহাতে সুদক্ষিণাকে মঞ্জুর দিকে ঠেলে দিয়ে আরেক হাতে রমলাকে বেড়ে ধরলেন।
—‘কি দিদি, বোন কি দিদির বাড়ি আসবে না?’
—‘ওমা, সে কি, সে কি। নিশ্চয়ই আসবেন। আসুন। আসুন।’
—‘আপনার চোখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে আপনি একেবারে অবাক হয়ে গেছেন।’
তা তো রমলা যেতেই পারেন। কলেজে ঢুকে অবধি শুনছেন সুদক্ষিণা, সুদক্ষিণা। —সুদক্ষিণার মাও শুনছেন। আজ নেমন্তন্ন, কাল ডে স্পেন্ড করতে যাবে, মানে সারাদিন থাকবে, খাবে, পড়াশুনো করবে, গলির মোড়ে ছেড়ে দিয়ে যাবে সুদক্ষিণাদের গাড়ি। কিন্তু দুজনকেই এই প্রথম দেখলেন।
—‘চা খাবেন তো?’
—‘নিশ্চয়ই। টা-ও খাব, যদি দ্যান।’
সুন্দর করে চা করে দিলো রমলা। কৌটো থেকে কুচো নিমকি। খাওয়া-দাওয়া, অনেক সুখদুঃখের গল্প হল।
সুজাতা বললেন—‘সুখবরটা দিই তা হলে আপনাকে।’
—‘কিসের সুখবর? মেয়ের বিয়ে নাকি?’
—‘ঠিক ধরেছেন দিদি, তবে আমার মেয়ে নয়, আপনার।’
—‘আমার মেয়ের? বিয়ে? খুকু বিয়ে করেছে?’
—‘স্স্স্, কী থেকে কী ভেবে ফেলছেন, মেয়ে আপনার তেমন নয়।’
যাক তবু ভালো, রমলার এমন বুক ঢিপ ঢিপ করছে যে মনে হচ্ছে ঘড়ির আওয়াজের মতো সে শব্দও সবাই শুনতে পাচ্ছে।
—‘আরে বাবা, আপনার মেয়ে বিয়ে করেনি। করবেও না। আপনি দেবেন। একটা খুব ভালো সম্বন্ধ আছে।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রমলা বললো—‘আমরা এখন মেয়ের বিয়ে দোব না ভাই। ও পড়াশোনা করছে, গান শিখছে, করুক, শিখুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। তারপরে ভাবা যাবে। ভালো সম্বন্ধ তো ওর কথা ফোটার বয়স থেকেই আসছে!’
—‘তা তো আসবেই। মেয়ে আপনার যা সুন্দরী। কিন্তু এখানে তো দিদি না করতে পারছেন না।’
সুজাতা হাত ব্যাগ খুললেন। একটা অ্যালবাম খুলে রমলার সামনে মেলে ধরলেন, পাতায় পাতায় ছবি।
‘এই যে দেখছেন এইটি পাত্র। [রমলা: ভালো চেহারা]। আমার দাদার একমাত্র ছেলে। [রমলা: বাঃ বেশ ভালো]। প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পাওয়া ছেলে। জীবনে কোনদিন সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেনি। [রমলা: তা আমার কি]! রঙিন ছবি, চেহারা, রঙ, স্বাস্থ্য সবই ভালো করে দেখে নিন। [রমলা: দেখার দরকার নেই] আপনার অমন সুন্দর মেয়ে, যার তার সঙ্গে তো মানাবে না। [মানাবে না-ই তো] এম আই টি থেকে ডক্টরেট করে ফিরে এসেছে, এখন ব্যাঙ্গালোরে পোস্টেড। [সর্বনাশা] দেশে থাকতে চায় [বাঃ] বাবা, মানে আমার দাদা চার পুরুষে ডাক্তার। কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ মণীশ রায়ের নাম শুনেছেন তো! রমলা: ‘শুনিনি, না, না শুনেছি শুনেছি মনে হচ্ছে! দাদার মেয়ে বড়, বিয়ে হয়ে গেছে কানাডায় থাকে। [রমলা: থাকুক গে না।] বউদিও ডাক্তার। [বেশ, বেশ]—কি হল আপনি যে কিছুই বলছেন না! আমি একদফা কাগজপত্র দিয়ে যাচ্ছি, আপনারা খোঁজখবর করুন।’
কাগজপত্রের সুদৃশ্য ফাইল বার করে সামনে রাখলেন সুজাতা, ‘আমার ভাইপো বলে বলছি না, অমন চরিত্রবান, সোবার ছেলে এ যুগে চট করে পাবেন না।’
—‘না, না, সে কথা নয়’, রমলা তাড়াতাড়ি বলল—‘আপনার ভাইপো, ভাইয়ের ফ্যামিলি সবই খুব ভালো। কিন্তু আমরা তো এখন ওকে পড়াবো। বিয়ে পরে। নিজের পায়ে দাঁড়াক। রোজগারপাতি করুক।’
সুজাতা হেসে বললেন—‘কী পড়াবেন ওকে? বি. এসসি? এম. এসসি? পি-এইচ ডি করবে? বাইরে যাবে?—ওঁরা সব করাবেন। ও থাকবে বাড়ির মেয়ের মতো। যতদূর খুশি পড়বে, যত ইচ্ছে গান শিখবে বড় বড় ওস্তাদ রেখে, বাইরে যেতে ইচ্ছে হলে যাবে। যা ইচ্ছে। ওঁরা নিজেরাই আসবেন। এসে আপনাকে বলবেন সব। আসল কথা, দীপঙ্করের বিয়েতে মঞ্জুকে দেখে আমার দাদা বউদির এবং ভাইপো তীর্থঙ্করেরও অসম্ভব পছন্দ হয়ে গেছে। ও যদি চাকরি করতে চায় করবে, কোনও ব্যাপারেই কোনও বাধা নেই।’
সুজাতারা চলে গেলে রমলা মঞ্জুকে ডাকলেন—‘তুই জানতিস খুকু?’
মঞ্জু ভারী মুখে বলল—‘একদম না। প্রতি বিয়েবাড়িতেই তো কোথায় থাকো, কী পড়ো, ঠিকানা কী আর বাবা কি করেন প্রশ্নের তোড় আসেই মা। সুদক্ষিণারা এই মতলব নিয়ে—এসেছে আমি ঘুণাক্ষরেও জানি না। আমি এখন পড়ব।’
—‘ওঁরা খুব ভালোভাবে পড়াবেন, বলছেন।’
তারাপদ রাত্রে এসে সব শুনে চিন্তিত হয়ে বললেন—‘এমনি একটা রাজসিক সম্বন্ধ, তুমি অমনি না করে দিলে?’
—‘না করে দিলেই শুনছে কে?’
মঞ্জু বলল—‘বাবা আমি এখন বিয়ে করব না। পড়ব, চাকরি করব।’
—‘ওরা তো বলেছেন পড়া, চাকরি করা যা তোর ইচ্ছে তা-ই করতে পারিস।’
—‘চাকরি মানে, আমি—’, মঞ্জু বাবার মুখের ওপর বলতে পারল না। চাকরি সে করবে বাবা-মাকে সুখে রাখবার জন্যে। মা-বাবারও মনের না-বলা আশা, তারও মনের না-বলা সংকল্প, সে বাবা-মার ছেলের কাজ করবে।
পরে যখন ডক্টর মণীশ রায় তাঁর স্ত্রী ডক্টর বিজয়া রায়কে নিয়ে এলেন, এবং একটু পরে ভিন্ন একটি বিদেশি গাড়িতে তাঁদের ছেলে তীর্থঙ্কর রায় এসে পৌঁছলো, সেন মহাশয় দম্পতি তাঁদের ভদ্রতায়, কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মঞ্জুর সঙ্গে তীর্থঙ্করের বেশ আলাপ হয়ে গেল। বাঙ্গালোরে পড়াশোনার যে কত সুবিধে সেই নিয়ে মঞ্জুর সঙ্গে রীতিমতো আড্ডাই জমে গেল তীর্থঙ্করের। ডাক্তার দম্পতি চেয়ে চেয়ে রমলার মটরশুঁটির কচুরি খেলেন। ভূয়সী তারিফ করে। বললেন—‘আপনাদের মতো সরল, সৎ, আন্তরিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হলে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করব।’
তারাপদবাবু আস্তে আস্তে বললেন—‘সবই ঠিক ডক্টর রায়। কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য আমরা যে এখন একেবারেই প্রস্তুত নই।’
ডক্টর বিজয়া রায় বললেন—‘মেয়ের বিয়ের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে কেন আপনাকে বিশেষ ভাবে? এই যুগে? শুনুন দাদা, বিয়ে হবে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে। আপনারা তিনজন আর আমরা তিনজন। তারপর আপনাদের বাড়িতে এসে রমলাদির হাতের মাছের ঝোল ভাত খাবো। দু-এক দিন পর কোনও হল ভাড়া করে কিংবা গ্র্যান্ডে কিংবা তাজবেঙ্গলে রিসেপশন দেওয়া হবে। জয়েন্ট। আপনাদের পক্ষের সবাইকে বলবেন। আমাদের সবাইকে বলা হবে। আর কনের বিয়ের সাজ, এঁদের ফ্যামিলির নিয়ম এঁরাই দ্যান। প্রপিতামহীর আমল থেকে। আমাকেও সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সুজাতাকে জিজ্ঞেস করবেন। সেই সেকালের আমলের ভারী ভারী গয়না ওসব মঞ্জুকে পরাতেই হবে। শাড়িটারই ওজন কী? তা মঞ্জু লম্বা আছে পারবে। আমার যা কষ্ট হয়েছিল! যেমনি রোগা ছিলুম তখন। হাইট তো দেখছেনই!’ বলে বিজয় রায় হাসতে লাগলেন।
আশ্বিন মাসে বিয়ে হল। রেজিস্ট্রির তো কোনও লগ্ন নেই। বেয়াই বেয়ানকে তাজবেঙ্গলে নিয়ে যাওয়া আসার জন্য আলাদা গাড়ি মোতায়েন রইল। রেজিস্ট্রির জন্য একটি হালকা বেনারসী শাড়ি আর সামান্য কখানা সোনার গয়না যা এতদিন মেয়ের জন্য তুলে রেখে দিয়েছিলেন, তীর্থঙ্করকে একটি ধুতি পাঞ্জাবি, কোলাপুরি চটি ও সোনার আংটি বোতাম দিলেন রমলা আর তারাপদ, আর কোনও কিছুর দরকারই হল না।
তাজবেঙ্গলে সবাই মিলে ভূরিভোজ করে বেরিয়ে গেলে তারাপদবাবু বললেন—ডক্টর রায়, আমার শেয়ারটা কিন্তু নিতেই হবে।
ডক্টর রায় হেসে চুপিচুপি বললেন—‘দাদা আপনি সৎ স্বাভাবিক মানুষ, আপনার কি কৃষ্ণবর্ণের টাকা আছে?’
—‘মানে?’
—‘আমি ডাক্তার, আমাকে সাদা-কালো দুরকম টাকারই ব্যবস্থা রাখতে হয়। সরকারের ইচ্ছেয়। তাজবেঙ্গলের পার্টি পুরোটা কালো টাকায় হয়ে গেল। আপনার তো কালো নেই, কোত্থেকে দেবেন? আপনার শুভ পবিত্র অর্থ আমি নেবোই বা কেন?’
নতুন শীত পড়েছে। বিকেলগুলো বড় মলিন, বড় বিষন্ন হয়। আলো জ্বাললেও যেন আলো হয় না। তারাপদ বাড়ি আসতে চিঁড়েগুলো ভেজে ফেলল রমলা। কড়াইশুঁটি, বাদামভাজা দিয়ে মিশিয়ে একটা বড় বাড়িতে রাখল। দুজনের হাতে দু কাপ চা। চুপচাপ, চিঁড়েভাজা চিবোবার কুড়র কুড়ুর শব্দ। সন্ধে ঘন হয়ে আসছে। ঘরে ফেরা পাখির ডাকে কান পাতা দায়। মঞ্জু আর তীর্থঙ্কর গত সপ্তাহে বাঙ্গালোর চলে গেছে। তারাপদ অস্ফুটে একবার বললেন—‘কোথা থেকে ম্যাজিকের মতো কী হয়ে গেল বলো তো?’
রমলা ঘরের ভেতর দিকে তাকালেন, আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে চাইলেন। বারান্দা, ছোট ঘর, কোথাও নেই। সে কোথাও নেই। কোকিল উড়ে গেছে। কাক আর কাকিনী তাদের ভাঙাচোরা বাসায় ফাটা ডিমের টুকরো মাঝখানে নিয়ে মুখোমুখি বসে থাকে।