হরগোবিন্দের যোগফল
কঞ্জিভেরম থেকে ঘুরে এসে আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দ মজুমদার কেবল তাল ঠুকতে লাগলেন–বলং বলং যোগবলম। বলযোগ কিছু হবে না, যদি কিছু হয় তো যোগবলে।
আমাদের সন্দেহ হলো, ভদ্রলোক বোধহয়, শ্রীঅরবিন্দর আশ্রমে গেছলেন এবং সেখান থেকে মাথা খারাপ করে রাঁচী না হয়েই বাড়ি ফিরেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম–কঞ্জিভেরমটা কোথায় দাদা?
কঞ্জিভেরম কোথায় জানিসনে? কোথাকার ভেড়া। জিওগ্রাফি অপশনাল ছিল না বুঝি? কঞ্জিভোরম হলো পণ্ডিচেরমের কাছাকাছিই।
পণ্ডিচেরম। সে আবার কোথায়? বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই।
তিনি ততোধিক অবাক হন–কেন? আমাদের অরবিন্দর আস্তানা। পণ্ডিচেরম-এর বাংলা করলেই হবে পণ্ডিচারী। আসলে ওটা তেলেগু ভাষা কিনা। একটু থেমে আবার বলেন, তেমনি কঞ্জিভেরমের বাংলা হোলো কঞ্চি ভারী, মানে বাঁশের চেয়েও।
ওঃ, বোঝা গেছে। পণ্ডিচেরী না গিয়েই তুমি পিণ্ডচারী, মানে কিনা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েচ? তাই বলল এতক্ষণ।
তোরা বুঝবিনে। এসব বুঝতে হলে ভাগবৎ মাথা চাই রে, মানুষের মাথার কর্ম নয়। যোগবল দরকার। তিনি হতাশভাবে মাথা নাড়েন।
আমি তার চেয়ে বেশি মাথা নাড়ি–যা বলেছ দাদা। আমাদেরই মগেরম, অর্থাৎ মুণ্ডুর কিনা, কপালের গেরো।
বাড়ির চিলকোঠায় বসে দাদার যোগাভ্যাসের বহর চলে, পাড়ার চা খানায় বসে আমরা তার আঁচ পাই। একদিন খবর যা এল তা যেমন অদ্ভুত তেমনি অভূতপূর্ব্ব। দাদা নাকি যোগবলে মাধ্যকর্ষণকেও টেক্কা মেরেছেন—আসন–পিঁড়ি অবস্থায় নাকি আড়াই আঙুল মাটি ছাড়িয়ে উঠেছেন।
আমরা সন্দেহ প্রকাশ করি, এ কখনো হতে পারে? উঁহু। অসম্ভব।
কিন্তু সংবাদদাতা শপথ করে বলে (তার বিশ্বস্ত সূত্রকে টেনে হেঁড়ে যায় না) যে তা নিজের চোখে দেখা দাদার তলা থেকে পিঁড়ি টেনে নেওয়া হলো কিন্তু দাদা যেমনকার তেমনি বসে থাকলেন যেখানকার সেখানে–যেন তথৈবচ।
আমি প্রশ্ন করি, চোখ বুজে বসে ছিলেন কি?
উত্তর আসে–আলবাৎ। যোগে যে চোখ বুজতে হয়।
আমি বলি, তবেই হয়েছে। চোখ বুজে ছিলেন বলেই পিঁড়ি সরাতে দেখতে পান নি, নইলে ধূপ করে মাটিতে বসে পড়তেন।
ভরত চাটুজ্যে যোগ দেয়–নিশ্চয়ই। হাত পা গুটিয়ে আকাশে বসে থাকা কি কম কষ্ট রে দাদা। অমনি করে মাটিতে বসে থাকতেই হাতে পায়ে খিল ধরে যায়।
তার পরদিন খবর এল, আজ আর আড়াই আঙুল নয় প্রায় ইঞ্চি আড়াই। তার পরদিন আধ হাত, তারপর ক্রমশঃ এক হাত, দেড় হাত, পৌনে দুই–অবশেষে যেদিন আড়াই হাতের খবর এল সেদিন আর আমি স্থির থাকতে পারলাম না, পৃথিবীর নবম আশ্চৰ্য্য (কেননা, অষ্টম আশ্চর্য অনেকগুলো ইতিমধে ঘোষিত হয়ে গেছে) হরগোবিন্দ মজুমদার দর্শনে উদ্ধশ্বাস হলাম।
কিন্তু গিয়েই জানলাম তার একটু আগেই তিনি নেমে পড়েছেন–ভারি হতাশ হলাম। কি করব? কান থাকলেই শোনা সম্ভব কিন্তু দেখার আলাদা ভাগ্য থাকা চাই। ভূত, ভগবান, রাঁচীর পাগলা গারদ। বিলেত—জায়গা–এসব অনেক কিছুই আছে বলে শোনা যায়, কিন্তু কেবল ভাগ্য থাকলেই দর্শন মেলে। আমার চক্ষু ভাগ্য নেই করব কি?
উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রতা, ইত্যাদি আবেদনে আড়াই হাত আত্মোন্নতির জন্য হরগোবিন্দকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করব কিনা ভাবছি, এমন সময়ে দাদা আমার ইতস্ততঃ–চিন্তায় অকস্মাৎ বাধা দিলেন–তোরা আর আমাকে হরগোবিন্দবাবু বলিসনে।
তবে কি বলব?
হরগোবিন্দ মজুমদারও না
তবে?
তিনি আরম্ভ করেন–যেমন শ্রীভগবান, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র।
আমি যোগ করি–শ্রীমদ্ভাগবৎ, শ্রীহনুমান—
উঁহু, হনুমান, বাদ। যেমন শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবুদ্ধ, শ্রীচৈতনয়, শ্রীরামকৃষ্ণ—
আমি থাকতে পারি না, বলে ফেলি–শ্রীত্রৈলঙ্গস্বামী, শ্রীঅরবিন্দ–
হু এবার ঠিক বলেছিস। তেমনি আজ থেকে আমি, তোরা মনে করে রাখিস, আজ থেকে আমি শ্রীহরগোবিন্দ।
আমি সমস্ত ব্যাপারটা হৃদয়মঙ্গ করবার চেষ্টা করি, সত্যি তাইত, হবে ব্যাঙচি বড় হয়ে ব্যাঙ হলে তার ল্যাজ নোটিশ না দিয়েই খসে যায় তেমনি–যে মানুষ আড়াই হাত মাটি ছাড়িয়েছে সে তো আর সাধারণ মানুষ নয়, তারও ল্যাজামুড়ো যে বিনা বাক্যব্যয়ে লোপ পাবে সে আর আশ্চর্য কি।
আমি সবিনয়ে বলি–এতটাই যখন ত্যাগস্বীকার করলেন দাদা, তখন নামের মধ্যে থেকে ওই বদখৎ গোকথাটাও ছেটে দিন। ওকে ভারি ছন্দপাত হচ্ছে। নইলে শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে শ্রীহরিবিন্দ বেশ মিলে যায়।
দাদাকে কিঞ্চিৎ চিন্তান্বিত দেখি–ব্যাকরণে লুপ্ত অ-কার হয় জানি। কিন্তু গো-কার কি লুপ্ত হবার? তাঁর বিচলিত দৃষ্টি আমার ওপর বিন্যাস্ত হয়।
আমি জোর করে দিই–একেবারে লুপ্ত না হোক ওকে গুপ্ত রাখাও যায় তো? চেষ্টা করলে না হয় কি।
দাদা অমায়িক হাস্য করেন–পাগল। যোগদৃষ্টি থাকলে দেখতে পেতিস যে গুরু–মাত্রের মধ্যেই গরু প্রচ্ছন্ন রয়েছেন, গরুর জন্যে যেমন শস্য, গুরুর জন্যে তেমনি শিষ্য–আদ্যস্বরের ইতর বিশেষ কেবল। আসলে উভয়েরই হলো গিয়ে খাদ্যখাদক সম্বন্ধ। সুতরাং গো-কথাটায় আপত্তি করবার এমন কি আছে? তারপর দম নেবার জন্য একটু থামেন, তা ছাড়া গো-শব্দে নানার্থ। অভিধান খুলে দ্যাখ।
আমি কি একটা বলতে যাচ্ছিলাম, উনি বাধা দেন–এ নিয়ে মাথ ঘামাতে হবে না তোকে। তোর যখন ভাগবৎ মাথা নয়, তখন ও-মাথা আর ঘামাসনে। তুই বরং ভরতকে ততক্ষণ ডেকে আন। ওকে আমার দরকার।
ভরতচন্দ্র আসতেই দাদা সুরু করেন–বৎস, তোমার লেখা-টেখা আছে নাকি? এই করকম যেন কানে এসেছিল।
লিখি বটে এক-আধটু, সে-কিন্তু কিছু হয় না।
আরে সাহিত্য না হোক কথা-শিল্প তো হয়? তা হলেই হোলো। কথা-শিল্প আর কাঁথা-শিল্প এই দুটোই তো আমাদের জাতীয় সম্পদ, বলতে গেলে-আর কি আছে? সহসা আত্ম-প্রসাদের ভারে দাদা কাতর হয়ে পড়েন, ভরত, তোমাকেই আমার বাহন করব, বুঝলে? তুমিই আমার মহিমা প্রচার করবে জগতে। কিন্তু দেখো শ্রীভ কথিত যেন সাত খণ্ডের কম না হয়। (আমার দিকে দৃকপাৎ করে) তোদের কেনা চাই কিন্তু।
আমি দাদাকে উৎসাহ দিই–কিনব বইকি। আমরা না কিনলে কে কিনবে?
দাদা কিন্তু খিঁচিয়ে ওঠেন–কে কিনবে। দুনিয়া শুষ্টু কিনবে। আর কেউ না কিনুক রোমা রোলী কিনবে একখানি। (তারপর একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে) ওই লোকটাই কেবল চিনল আমাদের,–আর কেউ চিনল না রে।
এমনি চলছিল–এমন সময়ে দাদার যোগচর্চার মাঝখানে এক শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটল। দাদা যোগবলে আড়াই হাত ওঠেন, পৌনে তিন হাত ওঠেন তিন হাত ওঠেন এমনি ক্রমশঃ চলে, হঠাৎ একদিন আকস্মিক সিদ্ধিলাভ করে একবোরে সাড়ে সাত হাত ঠেলে উঠেছেন। ফলে চিলকোঠার ছাদে দারুণভাবে মাথা ঠুকে গেছে দাদার। ঘরখানা, দুর্ভাগ্যক্রমে, সাড়ে পাঁচ হাতের বেশি উঁচু ছিল না।
কলিশনের আওয়াজ পেয়ে বাড়িশুদ্ধ লোক ওঘরে গিয়ে দ্যাখে, দাদা কড়িকাঠে লেগে রয়েছেন। মানে, মাথাটা সাঁটা, উনি অবলীলাক্রমে ঝুলছেন চোখ বোজা, গা এলানো। ওটা যোগ-সমাধি কি অজ্ঞান-অবস্থা, ঠিক বোঝা গেল না–দেখলে মনে হয়, যেমন কড়িকাঠকে বালিশ করে আকাশের ওপর আরাম করেছেন।
ভগবৎ মাথা বলেই রক্ষা, ছাতু হয়নি। অন্য কেউ হলে ঐ ধাক্কায় আপাদমস্তক চিড়ে চ্যাপটা হয়ে একাকার হয়ে যেত। যাই হোক দাদাকে তা বলে তো কড়িকাঠেই বরাবর রেখে দেওয়া যায় না,–কিন্তু নামানোই বা যায় কি করে?
বাড়িশুদ্ধ সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কি করবে, ঘরের ছাদ সাধারণতঃ হাতের নাগালের মধ্যে নয়–বেশির ভাগ ছাদ এমনি বে-কায়দায় তৈরি। অবশেষে একজন বুদ্ধি দিল, দাদার পায়ে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে, কূপ থেকে যেমন জলের বালতি তোলে, তেমনি করে টেনে নামানো যাক। অগত্যা তাই হলো।
আমি যখন দাদার সান্নিধ্যে গেলাম–যেমন শোনা তেমনি ছোটা, কিন্তু ততক্ষণ দাদার পঙ্কোদ্ধার হয়ে গেছে–তখন দাদার মাথা আর বাড়ির ছাদে নেই, নিতান্তই তুলোর বালিশে। হায় হায়, এমন চমকপ্রদ দৃশ্যটাও আমার চোখ ছাড়া হোলো, চক্ষুর আগোচরে একেবারেই মাঠে (মানে, কড়িকাঠে) মারা গেল–এমনি দুরদৃষ্ট। হায় হায়।
চারিদিকের সহানুভবদের বাঁচিয়ে, বিছানার একপাশে সন্তর্পণে বসলাম। মাথার জলপটিটা ভিজিয়ে দিয়ে দাদা বললেন–ভায়া। এইজন্যই মুনি ঋষিরা বাড়ি ঘর ছেড়ে, বনে-বাদড়ে যোগসাধনা করতেন। কেননা ফাঁকা জায়গায় তো মাথায় মার নেই। যত ইচ্ছে উঠে যাও, গোলোক, ব্রক্ষ্মলোক, চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, যদ্দুর খুশি চলে যাও, কোনো বাধা নেই–আকাশে এনতার ফাঁকা। এই কথাই তো এতক্ষণ বোঝাচ্ছিলুম ভরতচন্দ্রকে।
ভরতচন্দ্র বাধিতভাবে ঘাড় নেড়ে নিজের বোধশক্তির পরিচয় দেন।
আর এ কথাও বল বাবা ভরতকে, যে কদাপি লেখার চর্চা ছেড়ো না। ওটাও খুব বড় সাধনা। কালি-কলম-মন লেখে তিন জন–এটা কি একটা কম যোগ হলো? আর যখন চাটুজ্যে হয়ে জন্মেছ তখণ আশা আছে তোমার।
আশান্বিত ভরত জিজ্ঞাসান্বিত হয়–প্রভু, পরিষ্কার করে বলুন। আমরা মুখ-সুখ মানুষ–
প্রভু পরিষ্কার করেন–চাটুজ্যে হলেই লেখক হতে হবে, যেমন বঙ্কিম চাটুজ্যে, শরৎ চাটুজ্যে! আর লেখক হলেই নোবেল প্রাইজ।
কিন্তু আমার লেখা যে নোবেল প্রাইজওলাদের লেখার দুহাজার মাইলের মধ্যে দিয়ে যায় না, গুরুদেব! তেমন লিখতে না পারি, তেমন-তেমন লেখা বুঝতে তো পারি।
পারো সত্যি? গুরুদেব যেন সাহসা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, কিন্তু পরক্ষণেই কণ্ঠ সংযত করে নেন–বাংলাদেশে কারই বা যায়? আর বিবেচনা করে দেখলে, তাদের লেখাও তো তোমাদের লেখার দু হাজার মাইলের মধ্যে আসে না। তবে?
আমি ভয়ে ভয়ে বলি–তফাণ্টা অতখানিই বটে, কিন্তু আগিয়ে কে, আর পিছিয়ে কে, সেই হোলো গে সমস্যা।
দাদা অভয় দেন–বৎস ভরত, ঘাবড়ে যেয়ো না। তুমি, নারাণ ভটজাচ আর মেরী করেলী হলে এক গোত্র। পাবে, আলাবাৎ পাবে, নোবেল প্রাইজ পেতেই হবে তোমাকে। বিলেতে যাবার উদযুগ কর তুমি। আমি শুনেছি, এদশে থেকে এক-আধ ছত্র লিখতে জানা কেউ বিলেতে গেছে কি অমনি তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নোবেল প্রাইজ গছিয়ে দিয়েছে। প্রায় কালিঘাটে পাঁঠা বলি দেওয়ার মত আর কি!
ভরতচন্দ্র উৎসাহ পায় কিন তার মুখ দেখে ঠাহর হয় না। আমি কানে কানে বলি–আরে নাই বা পেলে নোবেল প্রাইজ! এই সুযোগে বিলেতে দেখতে পাবে, অনেক সাহেব মেম দর্শন হবে, সেইটাই কি কম লাভ? বরং এই ফাঁকে এক কাজ করো, বন্ধু-বান্ধন, ভক্ত-টক্তদের মধ্যে বিলেত যাবার নামে চাঁদার খাতা খুলে ফেল, বোকা ঠকিয়ে যা দুপাঁচ টাকা আসে। তারপর নাই বা গেলে বিলেত! তোমার আঙুল দিয়ে জল গলে না জানি, নইলে এই আইডিয়াটা দেবার জন্য টাকা বখরা চাইতাম।
ভরতের মুখ একটু উজ্জ্বল হয় এবার।
তার বিলেত যাবার দিনে জাহাজঘাটে সে কী ভীড়! নোবেল-তলার যাত্রী দেখতে ছেলে বুড়ো সবাই যেন ভেঙে পড়েছে। চিড়িয়াখানার শ্বেতহস্তী দেখতেও এরকম ভীড় হয়নি কোনোদিন। স্বয়ং শ্রীহরগোবিন্দ যখন বলেছেন, তখন নোবেল প্রাইজ না হয়ে আর যায় না। যোগবাক্য কি মিথ্যে হবার? লেখার জোরে যদি না-ই হয়–যোগবল ত একটা আছে, কি না হয় তাতে? ভরতচন্দ্র জাহাজে উঠতে গিয়ে পুলকের আতিশয্যে এক কুকুরের ঘাড়ে গিয়ে পড়েন।
কিম্বা হয়ত কুকুরই তাঁর ঘাড়ে পড়েছিল, কেননা কুকরের হয়ে কুকুরের মালিক মার্জনা চান—I am sorry Babul
ভারতচন্দ্র জবাব দেন–But I am glad-very glad। আমার হাত টিপে ফিস ফিস্ করেন–দেখছিস, সাহেবের কুকুর এসে ঘাড়ে পড়েছে। সাদা চামড়ার লোক কামড়ে না দিয়ে আপ্যায়িত করেছে–এ কি কম কথা রে? নোবেলপ্রাইজ তো মেরেই দিয়েছি। কি বলিস?
আমি আর কি বলব! হয়ত কিছু বলতে যাই এমন সময় অকুস্থলে শ্রীশ্রীহরগোবিন্দর অভ্যুদয় হয়।
আশীর্বাদের প্রত্যাশায় ভরতচন্দ্র ঘাড় হেঁট করেন। কিন্তু দাদার মুখ থেকে যা বেরোয়, তা ঠিক আর্শীবাণীর মত শোনায় না–
বৎস, ফিরে চল, ফিরে চল আপন ঘরে। নোবেল প্রাইজ তোমার জন্য নয়।
শরতের আকাশে (কিম্বা ভারতের?) যেন বিনামেঘে বজ্রাঘাত! আমরা স্তম্ভিত, হতভম্ব, মুহ্যমান হয়ে পড়ি। এত আয়োজন, প্রয়োজন–সব পণ্ড তা হলে?
বস প্রথমে যোগবলে যা বলেছিলাম, তা ঠিক নয়। তাছাড়া সেদিন আমার ভাগবৎ মাথার অবস্থা ভালো ছিল না–ভাগবৎ যোগের সঙ্গে কড়িকাঠ যোগ ঘটেছিল কিনা! আজ সকালে আবার নতুন করে যোগ করলাম, সেই যোগফলই তোমাকে জানাচ্ছি।
ফুঁ দিয়ে বাতি নিবিয়ে দিলে ঘরের চেহারা যেমন হয়, ভরতচন্দ্রের মুখখানি ঠিক তেমনি হয়ে গেল (উপমাটা বাজারে–চলতি চতুর্থ শ্রেণীর উপন্যাস থেকে চুরি করা সেই মুখভাবেরা হুবহুব বর্ণনা দেবার জন্যই, অবশ্য!)
হরগোবিন্দ বাণীবর্ষণ চলতে থাকে;–বৎস, সব যোগের চেয়ে বড় যোগ কি, জানো? রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ, মনোযোগ, অধোদয়যোগ সব যোগের সেরা হচ্ছে। যোগাযোগ। এই যোগাযোগ ঘটলেই, তার চেয়েও বড়ো, বলতে গেলে শ্রেষ্ঠতম যে যোগের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, তা হচ্ছে অর্থযোগ। এবং তা না ঘটলেই বুঝতে পারছ যাকে বলে অনর্থযোগ। রবীন্দ্রনাথের বেলা এই যোগাযোগ ছিল, তাই তার নোবেল প্রাইজ জুটেছে; তোমার বেলা তা নেই। কি করে আমি এই যোগফলে এলাম, তোমরাও তা কষে দেখতে পারো। রবীন্দ্রনাথ + পাকা দাড়ি + টাকার থলি + নোবেল প্রাইজ। কিন্তু তোমার পাকা দাড়িও নেই, টাকাকড়িও নেই–বস বরতচন্দ্র, সে যোগাযোগ তোমার কই?
ভরতচন্দ্রের করুণ কণ্ঠ শোনা যায়–কিছু টাকা আমিও যোগাড় করেছি। আর দাড়ির কথা যদি বলেণ, না হয় আমি পরচুলার মত একটা পরদাড়ি লাগিয়ে নেব।
শ্রীহরগোবিন্দ প্রস্তাবটা পর্যালোচনা করেন, কিন্তু পরক্ষণেই দারুণ সংশয়ে তার মুখ-চোখ ছেয়ে যায়–কিন্তু তারা যদি প্রাইজ দেবার আগে টেনে দ্যাখে, তখন?
সেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা আমার মনেও সাড়া তোলে। সত্যিই তো, তখন? ভরতচন্দ্রও বারবার শিউরে ওঠেন।
নাঃ, সে কথাই নয়! ভরতচন্দ্র, তুমি মর্মাহত হয়ো না। যেমন half a loaf is better than no loaf, তেমনি half a বেল is detter than নোবেল। তোমার জন্য আমি প্রাইজ এনেছি, তা নোবেলের চেয়ে বিশেষ কম যায় না। বিবেচনা করে দেখলে অনেকাংশে ভালোই বরং। বৎস, এই নাও।
বলে কাগজে-মোড়া একটা প্যাকেট ভরতচন্দ্রের হাতে দিয়ে, মুহূর্তে বিলম্ব না করে ভিড়ের মধ্যে তিনি অন্তর্হিত হন। আমরা প্যাকেট খুলতে থাকি, মোড়কের পর মোড়ক খুলেই চলি, কিন্তু মোড়া আর ফুরোয় না। অবশেষে আভ্যন্তরীণ বস্তুটি আত্মপ্রকাশ করে।
আর কিছু না, একটা কদবেল।