বক্কেশ্বরের লক্ষ্যভেদ
আমাদের বকু শরীরের ঈশ্বরলাভের পর ভারী কে সমস্যায় পড়ে গেল। আর কিছু না– নিজের নামকরণের সমস্যার।
এ জন্মে ঈশ্বরলাভ হলে এইখানেই ফ্যাসাদ! অকস্মাৎ নাম থেকে নামান্তরে যাবার হাঙ্গামা। এজন্মে না পেলে এসব মুশকিল নেই, নাম বদলাতে হয় না, যথাসময়ে কলেবর বদলে ফেললেই চলে যায়। কিন্তু দেহরক্ষা না করে ঈশ্বরলাভ ভারী গোলমেলে ব্যাপার।
বকুল বরাতে এই গোলোযোগ ছিল–সশরীরে স্বর্গীয় হবার সঙ্কট। মরে যাবার পর যারা স্বর্গীয় হয়, বা স্বভাবতঃই ঈশ্বর পায়–তারা বিনা সাধ্যসাধনাতেই পেয়ে যায়; এইজন্য তাদের নামের আগে একটা চন্দ্রবিন্দু যোগ করে দিলেই চলে। যেমন চিত্তরঞ্জন–আশু মুখুজ্যে ইত্যাদি। স্বৰ্গত র নামের আগে অনুস্বর ও বিসর্গের পরবর্তী চিহ্নটি দিয়ে লেখা দস্তুর ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তিমে, বিসর্গের শেষে স্বর্গের চূড়ান্ত ব্যঞ্জনার যেটি সংক্ষেপ। সংক্ষিপ্ত স্বর্গীয় সংস্করণ। তবে উচ্চারণের সময়ে তোমরা যা খুশি পড়তে পারো ও স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন কিংবা চন্দ্রবিন্দু চিত্তরঞ্জন বা ঈশ্বর চিত্তরঞ্জন। চিত্তরঞ্জন আপত্তি করতে আসবেন না।
বকুর বেলা আমাদের সে সুবিধে নেই। চন্দ্রবিন্দুযযাগে বকুর নিজেরও আপত্তি হতে পারে, তার মা বাবার তো বটেই এবং পাড়াপড়শীরাই কি ছেড়ে কথা কইবে? শ্রদ্ধের নেমন্তন্ন না ডেকে হঠাৎ নাম-ডাকে ঈশ্বর হয়ে যাওয়া–ফাঁকতালে একটা বাহাদুরি বরদাস্ত করতে তারা রাজী হবে না। সবাই কি হাসি মুখে যুগপৎ, পরের লাভ ও নিজের ক্ষতি স্বীকার করতে পারে? উঁহ।
ঈশ্বর সে তো মুঠোর মধ্যে?–এরকম সন্দেহ যার মনে ঘৃণাক্ষরেও জেগেছে সে-ই পিতৃদত্ত নাম পালটে নতুন নামে উত্তীর্ণ হয়। ব্যাঙাচি বড় হলেই তার ল্যাজ খসে যায়, ওরফে, ব্যাঙাচির ল্যাজ খসে সে বড় হয়। এতএব পৈতৃক নাম খসে গেলেই বুঝতে হবে যে লোকটা কিছু যদি হাতাতে পেরে থাকে তো সেই কিছু আর কিছু না, খোদ ঈশ্বর।
এখন, আমাদের বকুও ঈশ্বরকে বাগিয়ে ফেলেছে। তারপরেই এই নতুন নামকরণের নিদারুণ সমস্যা।
আনন্দ যোগ করে একটা উপায় অবশ্যি ছিল; কিন্তু কেউ কি তার কিছু বাকি রেখেছে আর? বিবেকানন্দ থেকে আরম্ভ করে আড়ম্বরান্দ, বিড়ম্বনানন্দ পর্যন্ত যা কিছু ভালমন্দ এবং ভালমন্দের অতীত আনন্দদায়ক নাম ছিল, সবাই বকুর বেদখলে। এই কারণে বকু ভারী নিরানন্দ কদিন থেকে। দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর হাতানো যত সোজা, ঐশ্বরিক নাম হাতড়ানো ততটা সহজ নয়।
অনেক নামাবলী টানা-ছেঁড়ার পর একট আইডিয়া ধাক্কা মারে আমার মাথায়; আচ্ছা ব্যাকরণ মতে একটা নাম রাখলে হয় না?
ব্যাকরণের নাম–কি রকম নাম–কি রকম শুনি আবার? বকু একটু আশ্চর্যই হয়। কিন্তু নিমজ্জমান লোকের কুটোটিকেও বাদ দিলে চলে না এবং কুটোটি এগিয়ে পরের উপকার করতে, ঈশ্বর যে পায় নি, সেও কদাচই পরানুখ হয়।
সোৎসাহে আমি অগ্রসহ হইঃ এই যেমন এই ধর না কেন, বকু ছিল ঈশ্বর–
সে বাধা দেয়ঃ বারে! আমি আবার ঈশ্বর ছিলাম কবে?
ছিলে কি ছিলে না তুমিই জানো! আমার জানা থাকার কথা নয়। ব্যাকরণের ব্যবস্থাটাই বলছি আমি কেবল। বেশ, তাহলে এই ভাবেই ধরো–বকু হলো ঈশ্বর–তো হয়? হতে পারে তো?
বাঃ! আমি হবো কেন? সে আপত্তি করে, আমি তো কেবল ঈশ্বরকে পেলাম!
বেশ, তাই সই। তবে এই রকম হবে–বকু পেল ঈশ্বর ইতি বক্কেশ্বর। কেমন, হলো এবার?
ততটা মনঃপুত হয় না বকুর। কিন্তু অনেক টানা–হ্যাঁচড়ার পর কষ্টেসৃষ্টে এই একটা বেরিয়েছে, এটাও খোয়ালে, অগত্যা বিনামা হয়েই থাকতে হবে যে বকুকে, কিংবা নেহাত কোনো বদনামই না বইতে হয় শেষটায় একথা স্পষ্টাস্পষ্টিই আমি ওকে জানিয়ে দিই।
ব্যাকরণের সূত্রটা কি শোনা যাক তো?
যাবে বলে একেবারে দীর্ঘসূত্র। আমি ব্যাখ্যার দ্বারা বোঝাই। সন্ধিও বলতে পারো। সমানও বলা যায়। সমাস হলে হবে দ্বন্দ্ব সমাস–বকুশ্চ ঈশ্বররশ্চ–
আর বলতে হয় না। নামের মহিমায় বকু বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিলি বকু প্রগলভ হয়ে ওঠে, বাঃ বেশ নাম! নামের মতো নাম। বক্কেশ্বর! বকু ছিল–নাঃ, ছিল কি? ছিল কেন? এ তো অতীতের কথা নয়–বকু হলো—হ্যাঁ–হওয়া আর পাওয়া একই। হলেই পায়, পেলেই হয়–বকু হলো ঈশ্বর। আবার ব্যাকরণসিদ্ধও বটে? কটা সিদ্ধপুরুষের আছে এমন নাম। বকুশ্চ ঈশ্বরশ্চ–যেন দিল্লীশ্বরো বা জদীশ্বরো বা! খাসা!
সেই থেকে দ্বন্দ্ব সমাসে ঈশ্বরের সঙ্গে ওর সন্ধি স্থাপিত হয়েছে এবং মার্বেলের ট্যাবলেট পড়েছে বাড়ির সদরে : স্বামী বক্কেশ্বর পরমহংস।
ঈশ্বরের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে জড়িত হবার ঢের আগে থেকেই বুকু বেচারা আমাদের ঈশ্বরে জর্জরিত। ছোট বেলা থেকেই ওর ঈশ্বর–উপার্জনের দুরভিসন্ধি। সদ্য প্রকাশিত ওর নিজের কথামৃতে রয়েছে: বরাবরই আমার ঝোঁক ছিল, এই পরম বর্বরের দিকে বাড়িই বলল আর জুড়িগাড়িই বলো কিংবা জারিজুরিই বলো এ সবই পেতে হবে বর্বর হয়ে। বর্বরতা ব্যতিরেকে এসব লভ্য হবার নয়। নায়মাত্মা বলহীনের লভ্য। বল আর বর্বরতা এক; দয়াখো ভূতপূর্ব্ব ইংরেজ আর বর্তমান জাপানকে, দয়াখো অভূতপূর্ব্ব হিটলার, মুসোলিনী আর চেঙ্গীজ খাকে। এইসব বর্বর শক্তির মূলে আছেন সেই বর্বর শক্তিমান মহাবীর। হিটলাটের হিট-এর যোগান এই কেন্দ্র থেকেই। মুসোলিনীর মুষল ইনিই। প্রচুর অর্থ বা প্রচুর অর্থ যাই যাই করতে চাও না কেন, খোদ ভগবানের কাছ থেকেই তার ফন্দি ফিকির জেনে নিতে হবে। এই রহস্য হচ্ছে উত্তম রহস্য–উপনিষদের রহস্যমুত্তমম। তার কাছ থেকেই জানতে হবে সুকৌশলে। কায়দা করে। সহজে জানান দেবার পাত্র তিনি নন–যোগবলেই তাঁকে টের পাবে। যোগঃকর্মসুকৌশলম। এবং তার ফলেই হবে বলযোগ। অচিরাৎ এবং নির্ঘাৎ।
এই কথামৃত পড়ার পর থেকেই আমার ধারণা বলবৎ হয়েছে, যে বৈধ বা অবৈধ যে কোনো উপায়ে হোক, ঈশ্বরকে আত্মসাৎ না করে ও ছাড়বে না। আর তার পরেই ওর কেল্লা ফতে–বাড়িই কি আর দাড়িই কি, জুড়িই কি, আর ভুঁড়িই কি–সবই ওর হাতের আওতায়। তখন ওকে কে পায়!
হ্যাঁ, যা বলছিলুম…ছোটবেলার থেকেই ওর এই ভাগবৎ দৌর্বল্যের কথা। সেই কালেই একদিন ওর বাড়িতে গিয়ে যে-দুর্ঘটনা দেখেছিলাম তাতেই আমার আন্দাজ হয়েছিল যে ঈশ্বর না পেয়ে ওর নিস্তার নেই। বকু তখন স্কুলের ছাত্র, সেকেন্ড ক্লাসে এবং হাফপ্যান্টে। যদি পড়ার কথা ধরো, বইয়ের চেয়ে প্যান্টেই ছিল ওর বেশি মনোযোগ–প্যান্টই ছিল ওর একমাত্র পাঠ্য। এবং অদ্বিতীয়। প্রায় সময়েই পড়া না, প্যান্ট পরা নিয়েই ওকে বিব্রত দেখেছি।
এমনি একদিন গেছি ওদের বাড়ি, ক্লাস পরীক্ষার ফলাফলের বৃত্তান্ত নিয়ে, গিয়ে দেখি বকু এবং বকুর বাবা মুখোমুখি বসে–আর বুক দিচ্ছে বাবাকে ধর্মোপদেশ। কথাগুলো ঠিক ধরতে পারলাম না, তবে এটুকু বুঝলাম যে বড় বড় বাণী গড় গড় করে বকে যাচ্ছে বকু–বোধহয় মুখস্থ কোনো বই থেকে–আর হাঁ করে শুনছেন ওর বাবা।
আমাকে দেখে বকু সহসা থেকে যায়–কিরে কি খবর?
পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে–আমি ইতস্তত করি, বল–বলবো কি?
বল না কি হয়েছে?
ফেল গেছিস তুই! বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক পালি–সব সাবজেকটেই। বলে ফেলি আমি।
সামলাতে একটু সময় লাগে বকুর, ওর বাবার হাঁটা, কেবল আরো একটু বড়ো হয়। বকু বলে যাক, সংস্কৃতি যে পাস করেছি এই ঢের। ওতেও তো ফেল যেতে পারতুম। তবু ভাল।
সংস্কৃত তোর ছিল না, তুই পালি নিয়েছিলিস তো!
আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে বকু যেন কেমন হয়ে গেল হঠাৎ!—ও–তাই নাকি! এই বাঙনিষ্পত্তি করেই তার চোখ ঠেলে কপালে উঠল, নাক গেল বেঁকে, মুখ গেল সাদা ফ্যাকাসে মেরে।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে ওকে ধরতে গেলাম। ওর বাবা আমাকে ইঙ্গিতে নিরস্ত করলেন–তারপর আস্তে আস্তে ওর চোখ বুজে এল, ঘাড় হোল সোজা, সারা দেহ কাঠ হয়ে অনেকটা ধ্যানী বুদ্ধের মতো হয়ে গেল বুক।
আমি যেন সার্কাস দেখছি তখন, কিন্তু ঠিক উপভোগ করতে পারছি না, এমন সময়ে ওর বাবা বললেন-ভয় পেয়ো না, ভয়ের কিছু নেই। ওর সমাধি হয়েছে!
সমাধি? সমাধি কি? মরে গেলেই তো সমাধি হয়! আমি এবার সত্যিই ভয় পাই, যাকে বলে কবর দেওয়া! তাহলে বকু কি আর বাঁচবে না? আমার কণ্ঠস্বর কাঁদো কাঁদো।
না-না মরবে কেন। বেঁচেই আছে, জলজ্যান্ত বেঁচে আছে।
ও, বুঝেছি! আমি মাথা নাড়ি–জীবন্ত সমাধি! এরকম হয় বটে। অনেক সময়ে সমুদ্রে জাহাজ ডুবে গেলে এরকমটা হয়ে যায় নাকি!
বকুর বাবা ঘাড় নাড়েন–উঁহু, সে সমাধিও নয়। তাতে তো লোক মারা যায়, প্রায় সব লোকই মারা যায় জলে ডুবই মারা যায়। কিন্তু এ সমাধিতে মরবার কিছু নেই, খাবি খায় না পর্যন্ত।
তারপর একটু থেকে তিনি অনুযোগ করেন, এরকম ওর মাঝে মাঝে হয়। প্রায়ই হয়।
তবে বুঝি কোন শক্ত ব্যায়রাম? সভয়ে জিজ্ঞাসা করি।
ব্যায়রাম! হ্যাঁ, ব্যায়রামই বটে! অমায়িক মৃদু মধুর হাস্য ওর বাবার। কেবল ঈশ্বরজনিত মহাপুরুষদেরই হয় এই ব্যায়রাম।
আমি এর ওষুধ জানি। বলি ওর বাবাকে। আমার পিসতুতো ভায়ের এই রকম হতো। ঠিক হুবহু। তারপর পাঁচু ঠাকুরের মাদুলি পরে ভাল হয়ে গেল। আপনি যদি ওকে মাদুলি আনিয়ে দ্যান, ও সেরে যাবে।
পাগল। এ পেঁচোয় পাওয়া নয় যে সারবে। এ হচ্ছে ভগবানে পাওয়া– এ সারে না। তাঁর কণ্ঠস্বর আশাপ্রদ কি হতাশাব্যঞ্জক ঠিক ধরতে পারি না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, আর একবার ভগবানের হাতে পড়লে, মানে ভগবানের হাতে কারু কি পরিত্রাণ আছে? তাঁর কাছ থেকে কি পালিয়ে বাঁচতে পারে কেউ?
এই অভিযোগের আমি আর কি জবাব দেব? তবু তাঁকে আশ্বাস দিতে চেষ্টা করি, যদি বলেন, এখনকার মতো আমি বকুকে ভাল করে দিতে পারি?
তিনি শুধু সবিস্ময়ে আমার দিকে, কিছু বলেন না।
আপনাদের বাড়িতে নস্যি নেয় কেউ? এক টিপ ওর নাকে দিলেই এক্ষুণি–
খোকা, তুমি নেহাৎ ছেলেমানুষ! সমাধির ব্যাপার বোঝ তোমার সাধ্য নয়। এ যে পরমহংসদেবের মতো! সমাধি সারানো নস্যির কর্ম না–তা পরিমলই দাও কি কড়া মুকুথলই দাও।
নস্যির কর্ম নয়–তাহলে-তাহলে-তাহলে তো ভারী মুশকিল! বেচারার দৈহিক বিপর্যয় দেখে দুঃখ হয় আমার। অজ্ঞান মানুষকে জ্ঞান দেবার ইচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক। এই ইচ্ছার বশে যারা ডুবন্ত অবস্থায় জল খেয়ে বা আত্মহত্যার আকাঙ্ক্ষায় আত্মহারা হয়ে আফিং গিলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাদের অভিরুচির তোয়াক্কা বা অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই তাদের ঠ্যাং ধরে প্রবল প্রতাপে আমরা ঘুরিয়ে তাকি, দুমদাম দুদ্দাড় পিঠে কিলাচড় সাঁটিয়ে যাই তাদের দেহে লাগবে কি মনে ব্যথা পাবি মিছুমাত্রও একথা ভাবিনে, তাদের আবার ধাতস্থ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাতেই আমাদের আনন্দ।
তাহলে তো সত্যিই ভারী মুশকিল! একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলি কথাটা, অবশ্যি আরো একটা উপায় আছে সমাধি সারাবার। যদি বলেন–যদি বলেন আপনি–তবে র্যাক চড়ে–
মনে হলো বকু চমকে উঠলো। চড়ের উঠলো। চড়ের কথায় নড়েচড়ে বসলো যেন। কিন্তু সেদিকে দেখব কি, আমার চড়ের গুণই বা কি দেখাব, তার আগেই ওর বাবার চাড় দেখা গেল। ওর বাবা করছেন কি, আমার কথা শুনেই না হাতের কাছে ছিল এক ভাঙা ছাতা, তাই নিয়ে এমন এক তাড়া করলেন আমায়, যে তিন লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে সটান ছাতে উঠে পাশের বাড়িতে টপকে পড়ি বেচারা বকুকে সমাধির গর্ভে অসহায় ফেলে রেখে পালিয়ে আসি প্রাণ নিয়ে। বকুর আগে আমাকে নিজেকে বাঁচতে হয়।
পরের দিন ইস্কুলে এসে বকুর কি না বকুনি আমায়।
আমার সমাধি তুই কি বুঝিস রে হতভাগা? বোকা গাধা কোথাকার। জানিস শ্রীরামকৃষ্ণের, শ্রীচৈতন্যের সমাধি হতো? শ্রীবকুরও তাই হয়। তুই তার জানবি কি মুখ? চড় দিয়ে উনি সমাধি সারাচ্ছেন! আহাম্মোক! সমাধি হলে কানের কাছে রাম নাম কৃষ্ণ নাম করতে হয় তাহলেই হয় তাহলেই জ্ঞান ফিরে আসে। সবাই জানে একথা, আর উনি কিনা–
বকুর আফশোস আর ফোঁস ফোঁস সমান তালে চলে। বাধা দিয়ে বলতে যাই–রাম নামের মহিমা আমারও জানা আছে। আমাকে আর তোর শেখাতে হবে না। কিন্তু মারের চোটেও ভূত পালায় নাকি? তোকে পোঁচা ভূতে পেয়েছিলো তাই আর–
সেই মুহর্তে মাষ্টারমসাই আসেন ক্লাসে–বিতণ্ডা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পর মুহূর্তেই, বকুর কি বরাত জানি না, সেই পুরাতন দুর্লক্ষণের পুনরাবৃত্তি। মাষ্টারমশাই পড়া নিয়ে কী প্রশ্ন করেছেন, বুকু পারেনি; অমনি হুকুম হয়ে গেছে বেঞ্চির উপর নীল ডাউনের। আর নীল ডাউন হবার সঙ্গে সঙ্গেই বকুর সমাধি।
ব্যাপার দেখে ভড়কে গিয়ে মাষ্টারমশাই তো জল আনতে ছুটে বেরিয়েছেন। ক্লাসসুদ্ধ সবাই গেছে হকচকিয়ে; কী করতে হবে ভেবে পাচ্ছে না কেউ। ভারী বিভ্রাট!
আমি ওর কানে কাছাকাছি গিয়ে রাম না, মার–কোনটা যে লাগাবো ঠিক করতে না পেরে বলেই ফেলি হঠাৎ–চাঁটাও কসে য়্যাক চড়!
যেই না এই বলা, অমনি বকু সমাধি আর নীল ডাউন ফেলে রেখে এক সেকেন্ডে স্ট্যান্ড আপ অন দি বেঞ্চি।
তারপর–তার পরদিনই বকু ইস্কুলে ইস্তফা দিল।
এসব তো বেশ কিছুদিন আগের কথা। ইতিমধ্যে বকু বয়সে বেড়ে এবং বুদ্ধিতে পেকে যে ঈশ্বরকে নিয়ে বাল্যকালে তার নিতান্তই খুচরো কারবার ছিল তাকেই এখন বেশ বড় রকমের আদমানী রপ্তানীর ব্যাপারে ফলাও রকমে ফাঁদতে চায়। আর সেই জন্যেই ওকে জাঁকালো রকমের নাম নিতে হচ্ছে, শ্রীমৎ বক্কেশ্বর পরমহংস। যে কোনো ব্যবসাতেই নামটাই হচ্ছে আসল। সেইটাই–গুড-উইল কিনা।
বকু থেকে বক্কেশ্বর হবার পর, অনেকদিন আর যাওয়া হয়নি ওর কাছে। ভাবলাম যাই একবার। ঈশ্বরই লাভ করেছে বেচারা, কিন্তু ঈশ্বরকে ভাঙিয়ে আরো কতদূর কী লাভ কোনো সুরাহা করতে পারলো কিনা দেখে আসা যাক। পুরো টাকাটা পেয়ে কোনোই সুখ নেই–যদি না মোলো আনায়ও চৌষট্টি পয়সায়–এবং কত আধলায় কে জানে–তার বহুল ও বহুবিস্তৃত হবার সম্ভাবনা থাকে। যে টাকাকে আনায় আনা যায় না, তা নিতান্তই অচল টাকা। তাকে পাওয়াও যায় না, না পাওয়াও তাই–একেবারেই বদলাভ বলতে গেলে।
বকুই আমাকে বলেছিল একথা। যে ঈশ্বর ব্যাঙ্কে বাড়েন না, তিনি নিতান্তই বক্কেশ্বর। বক্কেশ্বর। বকেশ্বরের তাকে আদৌ কোন দরকার নেই। অকেজো জিনিসের ঝামেলা কে সইবে বাপু??
গিয়ে দেখি বেশ ভীড় ওর বৈঠকে। ঘর জুড়ে শতরঞ্জি পাতা, ভক্ত শিষ্য পরিবেষ্টিত বকু মাঝখানে সমাসীন। নির্লিপ্ত, নির্বিকার প্রশান্ত ওর মুখচ্ছবি– কেমন যেন ভিজেবেড়াল ভাব।
আমিও গিয়ে বসি একপাশে, ও দেখতে পায় না, কিংবা দেখেও দেখে না, কে জানে!
ভক্তদের একজন প্রশ্ন করেছে, প্রভু, ব্ৰহ্ম কি? ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধই বা কি?
প্রথমে বকুর মৃদু হাস্য-তারপরে বকুর সুমধুর কণ্ঠ। ব্ৰহ্ম! ব্রাহ্মকে দেখা স্বয়ং ব্রহ্মারও অসাধ্য। আর ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ বলছ? সে হচ্ছে ডিমের সম্বন্ধ! এই জন্যেই জগৎকে ব্রহ্মাণ্ড বলে থাকে। আমাদের জন্যে ব্রহ্মের কোনোই হাপিত্যেশ নেই; আমরা বাঁচি কি মরি, খাই কি না খাই, খাবি খাই কি খাবার খাই তা নিয়ে ব্রহ্মের মোটেই মাথা ব্যাথা করে না। মাথাই নেই তো–মাথা ব্যাথা! ব্রহ্মণ সে এক চীজ। এই প্রত্যয় যার হয়েছে তাকেই বলা যায় ব্রহ্মালু। ব্রহ্মের আলু প্রত্যয় আর কি? খুব কমলোকেরই এই প্রত্যয় আসে জীবনে। যাদের হয় তাঁদেরই বলা হয় সিদ্ধ মহাপুরুষ। অর্থাৎ কিনা–
ভিড়ের ভেতর থেকে আমি ফোড়ন কাটি, আলুসেদ্ধর মহাপুরুষ।
ক্ষণেকের জন্য বকুর খাইফোঁটা বন্ধ হয়, ভক্তরাও চঞ্চল হয়ে ওঠে।
কিন্তু ভক্তির স্রোত কতক্ষণই বা রুদ্ধ থাকে! আরেক জনের প্রশ্ন হয়–দেখুন, আপনি ভগবানকে মাতৃভাবে সাধনা করতে বলেছেন। কিন্তু মার কাছে যা চাই তাই পাই, কিন্তু ভগবানের কাছে চেয়ে পাই না কেন বলুন তো?
ভারী মুশকিলের কথাই। এই নিদারুণ সমস্যার বকু কি সমাধান করে, জানবার আমারও বাসনা হয়।
বকুর আবার মৃদু হাস্য–তবে এবার হাসির পরিধি সিকি ইঞ্চি সংক্ষিপ্ত।
আমরা কি ভগবানের কাছে চাই পাগলা? সত্যি সত্যিই কি তাঁকে মা বলে ভাবতে পারি? আমাদের প্রার্থনা তো রাম শ্যাম যদু মধুর কাছেই। তাদের কাছে চেয়ে-চিন্তে আমাদের পাওয়া- গণ্ডা না পেলে তখন গিয়ে ভগবানকেই গাল পাড়ি।
কিন্তু রাম শ্যাম যদু মধুর মধ্যেও কি সেই ভগবান– সেই মা নেই কি? তবে তাদের আচরণ ঠিক মাতৃবৎ হয় না কেন মশাই?
তার কারণ, সেই মা যখন সীমার মধ্যে আসেন তখন সে মাসীমা হয়ে পড়েন। মার চেয়ে মাসীর দরদ কি বেশি হয় কখনন? মাসীর যদি বা কদাচ দেবার ইচ্ছাই হয় সে নিতান্তই যৎকিঞ্চিৎ, কখনো বা হয়ই না, কখনো যদি বা হলো, দিলেন আবার ঠিক উল্টোটাই। তাই এত হা-হুতাশ।
বকু তাক লাগিয়ে দেয় আমায়। এই সব মুরুব্বির মতো আর মোরব্বার মতো বোলচাল–যেমন মিষ্টি তেমনি গুরুপাক। অ্যাতো তত্ত্ব পেলো কোথায়। তবে কি সত্যিই ভগবান পেয়েছে নাকি? সন্দিগ্ধ হতে হয়। এ যে স্বয়ং পরমহংসদেবের মতোই প্রাঞ্জল ভাষায় প্রাণ জল করা কথা সব। আমার নাস্তিক হৃদয়েও ভক্তির ছায়াপাত হতে থাকে।
এমন সময়ে জনৈক ভক্ত এক ছড়া পাকা মর্তমান নিয়ে এসে হাজির। দণ্ডবৎ হয়ে বকুর শ্রীচরণে কলার ছড়াটা নিবেদন করে দেন তিনি।
বকু হাত তুলে আশীর্বাদ জানায়–জয়স্ত।
তারপর একটা কলা ছাড়িয়া মুখের কাছে তোলে নিজের মুখের কাছে। কাকে যেন অনুনয় করে–মা খাও!
আমি চারিদিকে তাকাই, বকুর মাকে দেখতে পাই না কোথাও। তিনি হয়তো তখন তেতলায় বসে। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পান দোক্তাই চিবুচ্ছেন হয়ত। সেখান থেকে কি শুনতে পাবেন বকুর ডাক? তাছাড়া হাজার অনুনয় বিনয়েও, তিনি কি আসতে চাইবেন এই দঙ্গলে? সাধের দোক্তা ফেলে খেতে চাইবেন এই কলা?
বকুর পুনরায় সকাতর অনুরোধ–খাও না মা?
তাহলে বোধহয় দরজার আড়ালেই অপেক্ষা করছেন উনি। এতক্ষণ হয়তো নেপথ্যেই বিরাজ করছিলেন।
আমি মার আগমনের প্রতীক্ষা করি, বকু কিন্তু করে না, কলাটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে, সুচারুরূপে বিচিয়ে ফ্যালে একদম।
দ্বিতীয় কলাটিও ঐভাবে মুখের কাছাকাছি আনে। আবার বকুর বেদনামথিত আহ্বান–মা! মাগো! খাও না মা! আরেকটা কলা খাও!
আমি অবাক হইয়া এবার। পাশের একটি ভক্তকে জিজ্ঞেস করি–মহাপ্রভুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এমন করছেন কেন?
শুনে তিনি তো চোখ পাকান, আরেকজন ঘুসি পাকায়। অবশেষে পেছনের একটি সদাশয় ভদ্রলোক আমাকে সব বুঝিয়ে দেন; তখন আমি জানতে পারি যে, ভগবানের সঙ্গে আমাদের চিরদিনের আদা ও কাঁচকলার সম্পর্ক চেষ্টা করে হলে গিয়ে, আত্মীয়বোধে তার সঙ্গে বাতচিত করা আধুনিক ভাগবৎ সাধনারই একটা প্রত্যঙ্গ। তারপর আর বুঝতে দেরী হয় না আমার। অর্থাৎ ভগবানকে মা-মাসী বলে একটা সম্পর্ক পাতিয়ে আমাদের ধর্ম মা যেমন–ভুলিয়ে ভালিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বাগিয়ে নেবার ফন্দি। ভগবানের সঙ্গে এহেন চালাকি আমার ভাল লাগে না। চালাকির দ্বারা একে চালাকি করা ছাড়া কি বলব? কিন্তু চালাকির দ্বারা কি কোনো বড় কাজ হয়?
তৃতীয় কলার প্রাদুর্ভাবেই আমি প্রতিবাদ করি–উঁহু, মা বেচারীকে অত কলা খাওয়ানো কি ঠিক হবে? সর্দি হতে পারে মার। তার চেয়ে বরং এখানকার বাবাজীদের মধ্যে বিতরণ করলে কি হয় না?
বকুর কদলী সেবন কিন্তু বাধা পায় না। চিবুতে চিবুতেই সে বসে, হ্যাঃ, মার আবার সর্দি হয় নাকি? তিনি হলেন আদ্যশক্তি। সর্বশক্তীময়ী! সর্দি হলেই হলো। আর যদি হয়ই, মা কি আমার আদা-চা খেতে জানেন না?
সাধ্য-সাধনের লোকে চেঁকি গেলে, কলা তো কি ছার! সমস্ত ছড়াটাই বকুর মাতৃগর্ভে গেল! মার বিকল্পে বকুর অন্তরালে দেখতে না দেখতে হাওয়া!
তারপর একে একে মা আঁচাও মা মুখ মোছ–ইত্যাদি হয়ে যাবার পর একটি পান মাতৃজাতির মুখে দিয়ে বকুর দ্বিতীয় কিস্তি কথামৃত শুরু হয়। মাঝে একবার একটা সমাধির ধাক্কাও সামলাতে হয় বেচারা বকুকে।
অবশেষে অনেক বেলায়, ভক্তদের সবার অন্তর্ধানের পর, থাকি কেবল বকু আর আমি।
এই যে শিব্রাম যে! অনেকদিন পরে কি মনে করে? ভারিক্কী চালে বকু বলে।
এলাম তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমায় যাব বলে! মডার্ন টাইমস হচ্ছে মেট্রোয় চার্লি চ্যাপলিনের। চল, দেখে আসা যাক আর হেসে আসা যাক খানিক।
আমার কত কাজ, কি করে যাই বল! বকুর মুখ ভার।
আচ্ছা মাকে একবার জিজ্ঞেস করেই নাও না বাপু। তিনি তো এখনো দেখেননি ছবিটা। কিংবা যদি দেখেও থাকেন তো দেখেছেন সেই ফিল্ম তোলার সময় হলিউডে। তারপর সটান চলে এসেছে কলকাতায়, এই প্রথম শো।
আঃ, কী যা তা বকছ! মার এখন সময় কই?
তবে মাকে নাই নিয়ে গেলে, তোমাকে নিয়ে গেলেই হবে। মার কি মাসীমার কি যারই হোক, অনুমতিটা নিয়ে নাও চটপট।
ভাই শিব্রাম, বকুর দ্বিতীয় দফার দীর্ঘনিঃশ্বাস : ঈশ্বর ছাড়া কি কোনো কাম্য আছে আমার জীবনে? না, আর কোনো চিন্তা? না, কিছু দ্রষ্টব্য? না। এখন ঈশ্বরই আমার একমাত্র লক্ষ্য।
তা বেশ তো। লক্ষ্য তাই থাক না, কিন্তু সিনেমাটা উপলক্ষ্য হতে বাধা কি? চার্লি চ্যাপলিন–
তা হয় না ভাই শিব্রাম বকু বাধা দিয়ে বলে–তুমি নিতান্ত মূঢ়মতি! মহৎ গূঢ় রহস্য কি বুঝবে! লক্ষ্য মাত্রই ভেদ করার জিনিস তা তো মানো? কথায় বলে লক্ষ্যভেদ। ঈশ্বর যদি জীবনের লক্ষ্য হয় তাহলে ঈশ্বাকেও ভেদ করতে হবে বৈ কি। ঈশ্বরকে ফাঁক না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
আমার কি রকম একটা ধারণা ছিল যে, ঈশ্বর লক্ষ্য হতে পারে কিন্তু ভেদ্য নন, কিংবা ভেদ্য হতে পারেন কিন্তু লক্ষ্য নন অথবা ও দুয়ের কিছুই তিনি নন সমস্ত ভেদাভেদের বিলকুল অতীত তিনি। সেই কথাই পরিষ্কাররূপে প্রমাণ করতে যাচ্ছি কিন্তু পাড়তে না পাড়তেই সে আমাকে বাগড়া দেয়–বাঃ, ভেদ করা যায় না কে বলল? ঈশ্বরকে ভেদ করেই তো আমরা এলাম। এলো এই বিশ্ব চরাচর! নইলে এলাম কোত্থেকে? ঈশ্বরকে ছিন্নভিন্ন ছত্রাকার করেই তো আমরা এসেছি ধাবমান পলাকতক বিধাতার ছত্রভঙ্গ আমরা! যা একবার ভেদ হয়েছে তা আবার ভেদ হবে! বার বার ভেদ হবে। তবে হ্যাঁ, দুর্ভেদ্য বটে।
এই বলে সে অর্জুনের লক্ষ্যভেদের উদাহরণ ঠেলে নিয়ে আসে আমার সামনে, আমার কিন্তু ওরফে ধনঞ্জয় য়ের, অধিকতর মুখরোচক দৃষ্টান্তে প্রহারের দুরভিসন্ধিই জাগতে থাকে মাথায়।
নিজেকে সামলে নিয়ে কোনরকমে–না, এতখানি বরদাস্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার পিত্ত প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, একটা নিষ্কাম রাগ, নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে ধরে অহেতুক পেটাবার সদিচ্ছা আমার পেটের মধ্যে প্রধুমিত হয়। না,বকু এতটা বাড়ে তাহলে বকুকেই আমার জীবনের লক্ষ্য করে বসব কোনদিন! ধরে ঠ্যাঙাব, বা একেবারে ভেদ করেই ফেলব ওকে জরাসন্ধের মত সরাসরি। জরাসন্ধকে কে ফাঁক করেছিল? অর্জ্জুন, না, ধনঞ্জয়–কে? সে যেই হোক, য়্যাডভাইস বা একজাম্পলের পরোয়া নেই আমার ওকেও আমি দেখে নেব, হুবহু, তা যাই থাক কপালে, মানে বুকর কপালে! আর বলতে কি, বকুকে আমার ততটা দুর্ভেদ্য বলে মনে হয় না আদপেই।
চটেমটেই চলে আসি–সেদিনকার মতো ওকে মার্জনা করে দিয়ে।
আসবার সময় সে রহস্যময় হাসি হেসে বলে–জানতে পাবে, ক্ৰমশঃই জানতে পাবে। অচিরেই প্রকাশ হবে সব। ভগবান যখন ফাটেন, বোমার মতোই ফাটেন! যেমনি অবাক করা তাঁর কাণ্ড তেমনি কান ফাটানো তার আওয়াজ! না দেখার, না শোনার মত কি! কতজনকে যে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যান তার পাত্তাই পাওয়া যায় না। ভগবানের মুখে যে পড়েছে তার কি আর রক্ষে আছে ভাই?
দিনকতক পরে যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি সঞ্চয় করে আবার যাই বকুর কাছে। দৃঢ়সংকল্প হয়েই যাই, এবার বলা নেই কওয়া নেই, সোজা গিয়েই ওকে চাটাতে শুরু করে দেব, তা যাই থাক বরাতে–ভক্তবৃন্দই এসে বাধা দিক কি মাঝখানে পড়ন। কারুর কথা শুনছি না!
কিন্তু যাবার মুখে দোরগোড়াতেই প্রথম ধাক্কা। দেখি বকুর সাইনবোর্ড বদলেছে, শ্রীমৎ বক্কেশ্বর পরমহংসের বিনিময়ে স্রেফ স্বামী বক্কানন্দ! আমার মনে আঘাত লাগে, ভাল হোক মন্দ হোক বকু আমার বন্ধুই–বিনা হাফপ্যান্ট এবং হাফপ্যান্টের সময় থেকেই। ধনরত্ন কিছুই ওকে দিতে পারিনি, কেবল মান–মাত্র দান করেছিলাম, তাও অভিমান বশে সে প্রত্যাখ্যান করল।
অভিমানবশে কি ক্রোধভরে, কে জানে। আমি ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে অনুযোগের সুর তুলতেই ও বলে, আর ভাই, বোলো না! পাড়ার চ্যাঙড়াদের জ্বালায় পাল্টাতে হোলে! পরমহংসের জায়গায় কেবল পরমবক বসিয়ে দিয়ে যায়। চক দিয়ে, কালি দিয়ে, উড পেন্সিল নিয়েই–যা পায় তাই। কাঁহাতক আর ধোয়া মোছা করি? আর যদি দিনরাত কেবল নিজের নাম দিয়েই পাগল হব, ভগবানকে তাহলে ডাকব কখনও কাল আবার আলকাতরা দিয়ে লিখে গেছে–সে লেখা কি ছাই সহজে ওঠে? ভারী খিটকাল গেছে কাল; তারপরই ভাবলাম ধুত্তোর নাম। নাম নিয়ে কি ধুয়ে খাবো? রোজ রোজ নাম ধুয়ে খেতে হবে? বদলে ফেললুম নাম। তা বক্কানন্দ! এমন মন্দই বা কি হয়েছে?
শ্রীমৎ বক্কেশ্বর পরম্বক? আমি বলি, তাই বা এমনকি খারাপ হতো? ছেলেরা তো তোমার ভালই করছিল। বক্কানন্দের চেয়ে ভালই ছিল বরং।
বারে! তুমিও আবার বক বক করছ! বক যে একটা গালাগাল! বকু বলে– দারুণ গলাগাল যে! হংসমধ্যে বাকো কথা, পড়নি বইয়ে?
ধার্মিক মানুষদের তো বকের সঙ্গেই তুলনা করে। বলে বক ধার্মিক। বক কি যা তা? বকের পক্ষে আমি দাঁড়াই–হাঁসের চেয়েও বক ভাল এমন কি প্যাঁচার চেয়েও।
তোমার কাছে ভাল হতে পারে বকু এবার চলে, আমার কাছে নয়। তোমার ইচ্ছা হয়, বকের মাদুলি বানিয়ে গলায় বোলাওগে। আমি কিন্তু বক দেখলেই মুছে ফেলব, মেরেই বসব একেবারে! কেউ যদি একবার আমাকে বক দেখায়। যদি হাতের নাগালে পাই কাউকে। বকু গজরাতে থাকে।
তা যাকগে। আমি ওকে ঠাণ্ডা করি, ব্যাকরণ থেকে বের করা ছিল কিনা নামটা, তাই বলছিলাম–!
বাঃ, এতেও তো ব্যাকরণ বজায় আছে। বিলক্ষণ! বকু ছিল আনন্দ কিংবা বন্ধু পেল আনন্দ অথবা বকুর হল আনন্দ ইতি বক্কানন্দ! এমন কি মন্দ!
কিন্তু এই যে নামের গোড়ায় স্বামী বসিয়েছ! স্বামী কেন আবার?
বাঃ তাও জানে না? স্বামী বসাতে হয় যে। বিয়ে না করলেও বসানো যায়। আমার বোকামিতে বকুর বিস্ময় ধরে না–তার ওপরে আমি তো বিয়েও করতে যাচ্ছি শিগগির।
আমি আকাশ থেকে পড়ি–বল কি? বিয়ে? এই এত বয়সে?
অবাক হচ্ছ যে! বিয়ে কি করতে নেই? বকু বলে, দুদিন বাদে বক্কানও লোপ পাবে আমার। থাকবে কেবল স্বামী। শুধুই স্বামী।
হ্যাঁ।
তোমাকে লক্ষ্যভেদের কথা বলেছিলাম না? সে লক্ষ্যভেদে হয়ে গেছে আমার অ্যাদ্দিনে।
হ্যাঁ বলো কি? ঈশ্বরকে ফাঁক করেছো তাহলে?
একেবারে চৌচির–এই দয়াখো। ব্যাঙ্কের একটা পাস বই বের করে আমাকে দেখায়, তাতে বকুর নামে লক্ষ টাকা জমা। পুনরায় আমার পিলে চমকায়–অ্যাঁ! এত টাকা বাগালে কোত্থেকে?
ভক্তদের কাছ থেকে প্রণামী পাওয়া সব। ধারও আছে কিছু কিছু–তাও বেশ মোটারকমের। তবে ধর্তব্য নয়। ফেরত দেবার কোনো কথা নেই।
ভক্তদের ফাঁকি দেবে? বেচারাদের?
ভক্তিতে মানুষকে কানা করে! গুরুর কাজ হচ্ছে চক্ষুদান করা। এইজন্যে গুরুকে বলেছে জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া। সেই গুরুতর কাজটাই করছি আমি কেবল!
বারে আমার ভাই বক্কানন্দ! বলে আমি তারিফ করি–বাহবা কি বাহবা! গদাম—গদাম–গুম!
শেষের কথাগুলো বলে আমার দক্ষিণহস্ত…ওর প্রশস্ত পিঠে–বেশির ভাগ অব্যয় শব্দ সব হাতের অপব্যয় থেকেই আসে তা!
আমার তারিফের তাল সামলাতে ওর সময় লাগে। এটা অনুরোগের বহর, না কি, অনেকদিনের রাগের ঝাল…ও ঠিক বুঝতে পারে না। আমিও না।
পুনাবৃত্তির সূত্রপাতেই ও পিছিয়ে যায়। আমি চললুম ব্যাঙ্কে। য়্যাদ্দিন শুধু সমাধিই করেছি। এবার সমাধা করি!
আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। লক্ষ টাকা ভেদ করা কি চারটি খানি? দুর্ভেদ্য রহস্যের মতোই বকুকে বোধ হতে লাগল আমার।
ব্যাঙাচির ল্যাজ খসে সে ব্যাঙ হয়, আর বড়ো হলে তার ব্যাঙ্ক হয় তারপরে যখন ঠ্যাংটাও খসে যায় তখন থাকে শুধু ব্যা।
তা, ভক্তদের কাছে অপদস্থ হলেও বকুর আর কোনো তুয়াক্কা নেই। সে আবার বিয়ে করতে যাচ্ছে। নতুন ব্যা–কারনে।
ভক্তরা ওর পীঠস্থানে যদি পাদ্যর্ঘ দেয় তাতেই বা কি যায় আসে ওর এখন?