একটি বেতার ঘটিত দুর্ঘটনা
অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার মত বরাত বুঝি আর হয় না। মোটর চাপাপড়া গেল অথচ অ্যামবুলেন্স আসার জন্য তর সইতে হলো না–যাতে চাপা পড়লাম তাতেই চেপে হাসপাতালে চলে গেলাম। এর চেয়ে মজা কি আছে?
ভাগ্যের যোগযোগ বুঝি একেই বলে। অবিশ্যি, ক্কচিৎ এরূপ ঘটে থাকে-সকলের বরাত তো আর সমান হয় না। অবিশ্যি এর চেয়েও–অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার চেয়েও, আরো বড়ো সৌভাগ্য জীবনে আছে। তা হচ্ছে রেডিয়োয় গল্প পড়তে পাওয়া।
দুর্ভাগ্যের মত সৌভাগ্যরাও কখনো একলা আসে না। রেডিয়োর গল্প আর অ্যামবুলেন্স চাপ–এই দুটো পড়াই একযোগে আমার জীবনে এসেছিল। সেই কাহিনীই বলছি।
কোন পূণ্যবলে রেডিয়োয় গল্পপাঠের ভাগ্যলাভ হয় আমি জানিনে, পারতপক্ষে তেমন কোনো পুণ্য আমি করিনি। অন্তত আমার সজ্ঞানে তো নয়, হঠাৎ রেডিও অফিসের এক আমন্ত্রণ পেয়ে চমকাতে হলো। আমন্ত্রণ এবং চুক্তিপত্র একসঙ্গে গাঁথা দক্ষিণা পর্যন্ত বাঁধা–শুধু আমার সই করে স্বীকার করে নেওয়ার অপেক্ষা কেবল। এমন কি রেডিয়োর কর্তারা আমার পঠীতব্য গল্পের নামটা পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছেন। সর্বমন্ততাম! এই নাম দিয়ে, এই শিরোনামার সঙ্গে খাপ খাইয়ে গল্পটা আমায় লিখতে হবে।
তা, আমার মত একজন লিখিয়ের পক্ষে এ আর এমন শক্ত কি? আগে গল্প লিখে পরে নাম বসাই, এ না হয়, আগেই নাম ফেঁদে তারপরে গল্পটা লিখলাম। ছেলে আগে না ছেলের নাম আগে, ঘোড়া আগে না ঘোড়ার লাগাম আগে, কারো কাছে সেটা সমস্যারূপে দেখা দিলেও একজন লেখকের কাছে সেটা কোনো প্রশ্নই নয়। লাগামটাই যদি আগে পাওয়া গেল, তার সঙ্গে ধরে বেঁধে একটা ঘোড়াকে বাগিয়ে আনতে আর কতক্ষণ?
প্রথমেই মনে হলো, সব আগে সৌভাগ্যের কথাটা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাইকে জানিয়ে ঈর্ষান্বিত করাটা দরকার। বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বন্ধু বান্ধব, চেনা আধচেনা, চিনি-চিনি সন্দেহজনক যাকেই পথে পেলাম, পাকড়ে দাঁড় করিয়ে এটা-সেটা একথা সেকথার পর এই রোমাঞ্চকর কথাটা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করলাম না। অবশেষে পই পই করে বলে দিলাম–শুনো কিন্তু! এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার–সাড়ে পাঁচটায়–শুনে বলবে আমায় কেমন হলো!
শুনব বইকি! তুমি গল্প বলবে আমরা শুনবো না, তাও কি হয়? রেডিও কেনা তবে আর কেন? তবে কিনা, রেডিয়োটা কদিন থেকে আমাদের বিকল হয়ে রয়েছে–কে বিগড়ে দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। গিন্নির সন্দেহ অবশ্যি আমাকেই-যাক, এর মধ্যে ওটা সারিয়ে ফেলব ’খন! তুমি গল্প পড়ছ, সেটা শুনতে হবে তো। একজনের আপ্যায়িত করা জবাব পেলাম।
আরো কজন তো আমরা কথা বিশ্বাস করতে পারেন নাঃ বলো কি? আরে, শেষটায় তুমিও! তোমাকেও ওরা গল্প পড়তে দিলে? দিনকে দিন কি হচ্ছে কোম্পানীর! আর কিছু বোধহয় পাচ্ছে না ওরা নইলে শেষে তোমাকেও–ছিঃ ছিঃ ছিঃ! অধঃপাতের আর বাকি কি রইলো হে? নাঃ, এইবার দেখবে অল ইন্ডিয়া রেডিও উঠে যাবে, আর বিলম্ব নেই!
বন্ধুবরের মন্তব্য শুনে বেশ দমে গেলাম, তথাপি আমতা আমতা করে বললাম–রেড়িয়োর আর দোষ কি দাদা? খোদার দান। খোদা যখন দ্যান ছাপ্পর ছুঁড়ে দিয়ে থাকেন, জানো তো? এটাও তেমনি আকাশ ছুঁড়ে পাওয়া–হঠাৎ এই আকাশবাণীলাভ।
আচ্ছা শুনবখন। তুমি যখন এত করে বলছ। অ্যাসপিরিন, স্মেলিং সলট–এসব হাতের কাছে রেখেই শুনতে হবে। তোমার গল্প পড়লে তো সত্যি বলছি, কিছু মনে কোরো না আমার মাথা ধরে যায়–শুনলে কি ফল হবে কে জানে! মুখ বিকৃত করে বন্ধুটি জানিয়ে গেলেন।
তবু আমি নাছোড়বান্দা। পথেঘাটে যাদের পাওয়া গেল না তাদের বাড়ি ধাওয়া করে সুখবরটা দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য উক্ত শুক্রবারে সেই মুহূর্তে সকলেই শশব্যস্ত! কারো ছেলের বিয়ে, কারো মেয়ের পাকা দেখা, কারো আবার কিসের যেন এনগেজমেন্ট, কাউকে খুব জরুরি দরকারে কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে! এমনি কত কি কাণ্ডে সেই দয়াখো দেখি। আমি গল্প বলব কেউ শুনবে না। আমার জানাশোনারা শুনতে পাবে না এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? আমার গল্প পড়ার দিনটিতেই যে সবার এত গোলমাল আর জরুরি কাজ এসে জুটবে তা কে জানত।
আর তা ছাড়া, রেডিয়োর সময়টাতেই তারা কেন যে এত ভেজাল জোটায় আমি তো ভেবে পাই না। পূর্ব্বজন্মের তপস্যার পুণ্যফলে রেডিয়োকে যদি ঘরে আনতে পেরেছিস–তাই নিয়েই দিনরাত মশগুল থাক–তা না। অন্তত প্রোগ্রামের ঘণ্টায় যে কখনো কক্ষচ্যুত হতে নেই একথাও কি তোদের বলে দিতে হবে? আর সব তালে ঠিক আছিস কেবল রেডিয়োর ব্যাপারেই তোরা আনরেডি–সব তোদের উল্টোপাল্টা!
সত্যি, আমার ভারী রাগ হতে লাগল। অবিশ্যি, ওদের কেউই আমাকে আশ্বাস দিতে কসুর করল না যে যত ঝামেলাই থাক যেমন করে হোক, আমার গল্পটার সময়ে অন্তত ওরা কান খাড়া রাখবে–যত কাজই থাক না, এটাও তো একটা কাজের মধ্যে। বন্ধুর প্রতি কর্তব্য তো। এমন কি কলকাতার বর্হিগামী সেই বান্ধবটিও ভরসা দিয়ে গেলেন যে ট্রেন ফেল করার আগের মিনিট পর্যন্ত কোনো চুল-ছাঁটা সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে যতটা পারা যায় আমার গল্পটা শুনে তবেই তিনি রওনা দেবেন।
সবাইকে ফলাও করে জানিয়ে ফিরে এসে গল্পটা ফলাতে লাগা গেল! সর্বমত্যন্তম-এর সঙ্গে যুতমত, মজবুতমতো একটা কাহিনীকে জুড়ে দেয়াই এখন কাজ।
কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল কাজটা মোটেই সহজ নয়। গল্প তো কতই লিখেছি, কিন্তু এ ধরনের গল্প কখনো লিখিনি। ছোট্ট একটুখানি বীজ থেকে বড় বড় মহীরূহ গজিয়ে ওঠে। লোকে বলে থাকে, আমি নিজের চোখে কখনো দেখিনি বটে, তবে লোকের কথায় অবিশ্বাস করতে চাইনে। তবুও, একথা আমি বলব যে গাছের বেলা তা হয়ত সত্যি হলেও, একটুখানি বীজের থেকে একটা গল্পকে টেনে বার করে আনা দারুণ দুঃসাধ্য ব্যাপার!
বলব কি ভাই, যতই প্লট ফাদি আর যত গল্পই বাঁধি, আর যত রকম করেই ছকতে যাই, কিছুতেই ওই সর্বমত্যন্তম-এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। একটা গল্প লিখতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে একশটা গল্প এসে গেল, মনের গল্পের একশা, আর মনের মত তার প্রত্যেকটাই কিন্তু নামের মত একটাও না।
ভাবতে ভাবতে সাত রাত্রি ঘুম নেই; এমন কি, দিনেও দু চোখে ঘুম আসে না। চোখের কোণে কালি পড়ে গেল আর মাথার চুল সাদা হতে শুরু করল। অর্ধেক চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম–আর কামড়ে কামড়ে ফাউন্টেনের আধখানা পেটে চলে গেল। কত গল্পই এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এল আর গেল কিন্তু কোনটাই এই নামের সঙ্গে খাটল না। •
তখন আমি নিজেই খাটলাম–আমাকেই খাঁটিয়ে নিতে হলো শেষটায়।
শুয়ে শুয়ে আমার খাতার শুভ্র অঙ্কে–আমার অনাগত গল্পে আষ্টেপৃষ্ঠে–ললাটে কত কি যে আঁকলাম! কাকের সঙ্গে বক জুড়ে দিয়ে, বাঘের সাথে কুমীরের কোলাকুলি বাধিয়ে, হনুমানের সঙ্গে জাম্বুবানকে জর্জরিত করে, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার!
সব জড়িয়ে এক ইলাহী কাণ্ড! কি যে ওই সব ছবি, তার কিছু বুঝবার যো নেই, অথচ বুঝতে গেলে অনেক কিছুই বোঝা যায়। গুহা মানুষেরা একদা যে সব ছবি আঁকতো, এবং মানুষের মনের গুহায়, মনশ্চক্ষুর অগোচরে এখনো যে সব ছবি অনুক্ষণ অঙ্কিত হচ্ছে, সেই সব অন্তরের অন্তরালের ব্যাপার! মানুষ পাগল হয়ে গেলে যে সব ছবি আঁকে অথবা আঁকবার পরেই পাগল হয়ে যায়। সর্বমত্যন্তম—ড্যাশ–উইদিন ইনভার্টেড কমার শিরোনামার ঠিক নিচে থেকে সরু করে, গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় আমার নাম স্বাক্ষরের ওপর অবধি কেবল ওইসব ছবি–ওই পাগলকরা ছবি সব! পাতার দুধারে মার্জিনেও তার বাদ নেই–মার্জনা নেই কোনোখানে।
তোমরা হাসছো? তা হাসতে পারো! কিন্তু ছবিগুলো মোটেই হাসবার নয়– দেখলেই টের পেতে। ওই সব ছবির গর্ভে যে নিদারুণ আর্ট নিহিত রইলো আমার আশা, সমদারের সাহায্যে (রাচির বাইরেও তারা থাকবেন নিশ্চয়!) একদিন তার তত্ত্ব উদঘাটিত হবে হবেই চিরদিন কিছু তা ছলনা করে, নিগূঢ় হয়ে থাকবে না। আমার গল্পের জন্য, এমন কি, আমার কোনো লেখার জন্য কখনো কোনো প্রশংসা না পেলেও, ওই সব ছবির খ্যাতি আমার আছেই– ওদের জন্য একদিন না একদিন বাহবা আমি পাবই। ওরাই। ওরাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে–আজকে না হলে আগামীকালে মানুষের দুঃস্বপ্নের মধ্যে অন্ততঃ–এ বিশ্বাস আমার অটল।
অবশেষে সর্বমত্যন্তম-এর পরে ড্যাশের জায়গায় শুধু গর্হিতম কথাটি বসিয়ে রচনা মেষ করে, আমার গল্পের সেই চিত্ররূপ নিয়ে নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রেডিয়ো স্টেশনের দিকে দৌড়ালাম।
ভেবে দেখলে সমস্ত ব্যাপারটাই গর্হিত ছাড়া কি? আগাগোড়া ভাল করে ভেবে দেখা যায় যদি, আমার পক্ষে রেডিয়োর গল্প পড়তে পাওয়া, এবং যে দক্ষিণায় গল্প বেচে থাকি, সেই গল্প পড়তে গিয়ে তার তিনগুণ দাক্ষিণ্যলাভের সুযোগ পাওয়া দস্তুরমত গহিত বলেই মনে হতে থাকে! এবং যে গল্প আমি চিত্রাকারে, মিকি মাউসের সৃষ্টি কর্তাকে লজ্জা দিয়ে, পৃষ্ঠায় পর পৃষ্ঠা ধরে কেঁদেছি তার দিকে তাকালে–না, না এর সমস্তটাই অত্যন্তম–অতিশয় অত্যন্তম–এবং কেবল অত্যন্তম–এবং কেবল অত্যন্তম নয়, অত্যন্তম গর্হিতম!
তারপর? তারপর সেই গল্প নিয়ে হন্যে হয়ে যাবার মুখে আমার দু-নম্বর বরাত এসে দেখা দিল। অ্যামবুলেন্সে চাপা পড়লাম।
হাসপাতালে গিয়েও, হাত পা ব্যয় না করে, নিজে বাজে খরচ না হয়ে, অটুট অবস্থায় বেরিয়ে আসাটা তিন নম্বর বরাত বলতে হয়। কিন্তু সশরীরে সর্বাঙ্গীণরূপে লোকালয়ে ফিরে এসে ভাগ্যের ত্র্যহস্পর্শেয়র কথাটা যে ঘটা করে যাকে তাকে বলবো, বলে একটু আরাম পাবো তার যো কি! যার দেখা পাই, যাকেই বলতে যাই কথাটা, আমারি সুত্রপাতের আগের সে মুক্তকন্ট হয়ে ওঠে।
চমৎকার! খাসা! কী গল্পই না পড়লে সেদিন! যেমন লেখায় তেমনি পড়ায়-লেখাপড়ায় যে তুমি এমন ওস্তাদ তার পরিচয় তো ইস্কুলে কোনোদিন দাওনি হে! সব্যসাচি যদি কাউকে বলতে হয় তো সে তোমায়! আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছ, মাইরি!
আমি কম অবাক হইনি। প্রতিবাদ করতে যাব, কিন্তু হাঁ করবার আগেই আরেকজন হাঁ হাঁ করে এসে পড়েছে :
তোমার গল্প অনেক পড়েছি! ঠিক পড়িনি বটে, তবে শুনতে হয়েছে। বাড়ির ছেলেমেয়েরাই গাড়ে পড়ে শুনিয়ে দিয়েছে। শোনাতে তারা ছাড়ে না–তা সে শোনাও পড়াই মতই! কিন্তু যা পড়া সেদিন তুমি পড়লে তার কাছে সে সব কিছু লাগে না। আমার ছেলেমেয়েদের পড়াও না। হ্যাঁ, সে পড়া বটে একখান! আহা, এখনো এই কানে–এইখানে লেগে রয়েছে হে!
তাঁর মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন আরেকজন! গল্প শুনে তো হেসে আর বাঁচিনে ভায়! আশ্চর্য গল্পই পড়লে বটে! বাড়ি সুদ্ধ সবাই আমার দুধের ছেলেটা পর্যন্ত উত্তর্ণ হয়েছিল, কখন তুমি গল্প পড়বে! আর যখন তুমি আরম্ভ করলে সেই শুকুরবার না কোনবারে–বিকেরের দিকেই না?–আমরা তো শুনবামাত্র ধরতে পেরেছি–এমন টক-মিষ্ট-ঝাল-ঝাল-নোনতা গলা আর কার হবে? আমার কোলের মেয়েটা পর্যন্ত ধরতে পেরেছে যে আমাদের রামদার গলা!
রামদা-টা গলা থেকে তুলতে না তুলতেই অপর এক ব্যক্তির কাছে শুনতে হলো : বাহাদুর, বাহাদুর! তুমি বাহাদুর! রেডিয়োর গল্প পড়ার চানস পাওয়া সহজ নয়, কোন ফিকিরে কি করে জোগাড় করলে তুমিই জানো! তারপরে সেই গল্প মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রগরানো–সে কি চাটটিখানি? আমার তো ভাবতেই পা কাঁপে, মাথা ঘুরতে থাকে! কি করে পারলে বলো তো? আর পারে বলে পারা–অমন নিখুঁত ভাবে পারা–যা একমাত্র কেবল হাঁসেরাই পারে। আবার বলি, তুমি বাহাদুর!! তারাই আমায় তাক লাগিয়ে দিল। রেডিয়োর স্বর্গে যাবার পথে উপসর্গে আটকে অ্যাম্বুলেন্স চেপে আধুনিক পাতালে যাওয়ার অমন গালভরা খবরটা ফাঁস করার আর ফাঁক পেলাম না।