ভালুকের স্বর্গলাভ
গল্প কেমন লিখি জানিনে, কিন্তু শিকারী হিসেবে যে নেহাৎ কম যাই না, এই বইয়ের আমার ভালুক শিকার, এই তোমরা তার পরিচয় পেয়েছে। আমার মাসতুতো বড়দাদাও যে কত বড় শিকারী, তাও তোমাদের আর অজানা নেই। এবার আমার মামাত ছোট ভাইয়ের একটা শিকার-কাহিনী তোমাদের বলব। পড়লেই বুঝতে পারবে, ইনিও নিতান্ত কম যান না। হবে না কেন, আমারই ছোট ভাই।
গল্পটা, যতদূর সম্ভব, তার নিজের ভাষাতেই বলবার চেষ্টা করা গেলঃ
ভালুকদের ওপর আমার বরাবর ঝোঁক, ছোটবেলা থেকেই। দাদুর ভালুক শিকারের গল্পটা শুনে অবধি, ভালুকদের ওপর আমার ছোটবেলার টানটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। সর্বদাই মনে হয়, কোন ফাঁকে একটা ভালুক শিকার করি। কিন্তু শিকারের জন্য এয়ারগান পাওয়া সোজা হতে পারে (আমাদের দেবুই একটা আছে)–কিন্তু ভালুক যোগাড় করাই শক্ত। অবশ্য রাস্তায় প্রায়ই ভালুকওয়ালাদের দেখা পাওয়া যায় সেসব নিঃসন্ধিগ্ধ নৃত্যপটু ভালুকদের শিকার করাও অনেকটা সহজ, কিন্তু তাতে ভালুকদের আপত্তি না থাকলেও তাদের গার্জেনদের রাজি করানো যাবে কি না সন্দেহ।
কিন্তু চমৎকার সুযোগ মিলে গেল হঠাৎ। আমাদের পাহাড়ে দেশে সার্কাস–টার্কাস বড় একটা আসে না। সার্কাস দেখতে হলে আমরা কলকাতায় যাই বড়দিনে দাদার ওখানে। যাই হোক, এবার একটা সার্কাস এসে পড়েছে আমাদের অঞ্চলে। শুনলাম, অনেকগুলো ভালুকও এনেছে তারা। ভারী আনন্দ হল।
দেবুকে গিয়ে বললাম, এই, তোর বন্দুকটা দিবি দিন কতোর জন্যে?
কি করবি?
ভালুক শিকারের চেষ্টা দেখব।
আমার এটা তো এয়ার-গান, এতে কি ভালুক মরে? কেন অমল, তোর তো সেজকাকারই ভাল বন্দুক রয়েছে।
দুর, সেটা বেজায় ভারী। তোলাই দায়, ছোঁড়া তো পরের কথা। তাছাড়া আমি একটা গল্পে পড়েছি, ভারি বন্দুক ভালুক-শিকারের পক্ষে বড় সুবিধের নয়।
ও, তোর সেই দাদার গল্পটা? কিন্তু আমি যে এটা দিয়ে কাকমারি।
এট হল গিয়ে দেবুর স্রেফ গুল। বললে কাক মারি, কিন্তু আসলে ওই ও মাছি তাড়ায়। এয়ার গান থাকে ওর পড়ার টেবিলে, সেখানে কাকা একটাও নেই, কিন্তু যত রাজ্যের মাছি।
বেশ, আমি তোকে একটা জিনিস দেব, তাতে মারা না যাক কাক ধরা পড়বে।–দেবু উৎসুকচোখে তাকায়–আমার ক্যামেরাটা দেব তোকে ওর বদলে। কাকের ছবি ধরা আর কাক ধরা একই ব্যাপার নয় কি?
দেবু সে কথা মেনে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহিত হয়ে উঠে। আমার জাইস, আইকনের সঙ্গে ওর বন্দুকটা বিনিময় করে আমরা দুজনেই বেরিয়ে পড়ি সার্কাসের তাঁবুর উদ্দেশ্যে–ভালুক মারার মত্সব নিয়ে আমি, আর ভালুক ধরার উৎসাহ নিয়ে দেবু।
বাজারের কাছ দিয়ে যাবার দেবু এক গাদা কালো জাম কেনে। আমার দিকে, বোধ করি তার স্মরণশক্তির পরিচয় দেবার জন্যই, গর্বভরে তাকায়–জানিস, ভালুকেরা জাম খেতে ভাল বাসে?
হুঁ, জানি; কিন্তু যাকে শিকার করতে যাচ্ছি তাকে জাম খাওয়ানো আমি পছন্দ করি না–সাবাড়ের আগে খাবারের ব্যবস্থা একটা নিষ্ঠুর ব্যবহার নয় কি? আমার মতে ওটা দস্তুরমত অত্যাচার-ভালুকের প্রতি এবং নিজের পকেটের প্রতি। দেবুকে জবাব দিই, ভালুকের সঙ্গে ভাব করা তো মলব নেই আমার।
সার্কাসের তাঁবুর পেছন দিকটায় জানোয়ারের মিনেজারী–হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, ভালুক, জেব্রা–একটা উটও দেখলাম। খোটায় বাঁধা হাতি শুঁড় তুলে অপরিচিত লোককেও সেলাম ঠুকছে, জেব্রা এবং উটও কম দর্শক আকর্ষণ করেনি। কতকগুলো ছোঁড়া বাঘের খাঁচার দিকে গিয়ে ভিড়েছে, ওদের আফিং খাইয়ে রাখা হয় কিনা এই হলো ওদের আলোচ্য বিষয়। দেখা গেল, বাঘেরা মনোযোগ দিয়ে সেই গবেষণা শুনছে এবং মাঝে মাঝে হাই তুলে ওদের কথা সমর্থন করছে।
মোটের উপর সমস্তটা জড়িয়ে বেশ উপভোেদ্য ব্যাপার। কিন্তু এ সমস্ত থেকে কাঠোরভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে ভালুকের খাঁচার দিকে আমার অগ্রসর হলাম।
পথে-ঘাটে সর্বদাই যাদের দেখা মেলে স্বভাবতঃই তাদের মর্যাদা কম; বেচারা ভালুকদের বরাতে তাই একটিও -য়্যাডমায়ারার- জোটেনি।
একটি বড় খাঁচার একধারে দুটো মোটাসোটা ভালুক–আর তার পাশেই পার্টিশান-করা অন্য ধারে একটা বেঁচে ভালুক। পার্টিশানের মাঝখানের দরজাটা বাইরে থেকে লাগানো। এতক্ষণ অবধি কোনো সমঝদার না পেয়ে মোটা ভালুক দুটো যেন মুষড়ে পড়েছিল, আমাদের দুজনকে যেতে দেখে নড়ে-চড়ে বসল। কিন্তু বেঁটে ভালুকটার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। বুঝলাম নিতান্ত উজবুক বলেই ওটাকে আলাদা করে রেখেছে।
দেবু পকেট থেকে একমুঠো জাম বার করল–তাই না দেখে বেঁটে ভালুকটার লম্ফঝম্ফ দেখে কে? কিন্তু আমরা প্রথমে দিলাম মোটা ভালুকদের, তারা দু-একটা চাখলো মাত্র, তারপর আর ছুঁলোও না। এই ভালুক দুটোর টেস্ট উঁচুদরের বলতে হবে, কেননা আমরাও রাস্তায় চেখে দেখেছি জামগুলো একেবারে অখাদ্য, এমন বিশ্রী জঘন্য জাম প্রায় দেখা যায় না।
কিন্তু বেঁটে ভালুকটা তা-ই অম্লানবদনে সবগুলো খেলো; খেয়ে আবার হাত বাড়ায়! দেবু দুপকেট উলটিয়ে জানায় যে হোপলেস আর আগ্রহের নিবৃত্তি হয় না। বুঝলাম ব্যাটার বুদ্ধিশক্তি একটু কম।
দেবু আমার কাছে আবেদন করে,–এই অমল, দে না তোর একটা চকোলেট একে।
আমি অগত্যা বিরক্তিভরে একটা চকোলেট ছুঁড়ে দিই–ভারি হ্যাংলা তো।
দেবু মাথা নেড়ে জানায়, ছেলেমানুষ কিনা। বড় হলে শুধরে যাবে।
কিন্তু ভালুকটা চকোলেট স্পর্শও করে না, জামের জন্য দেবুর জামার নাগাল পাবার চেষ্টা করে। আমি এয়ার-গানের সাহায্যে চকোলেটটা সন্তর্পণে বাগিয়ে এনে বদন ব্যাদান করতেই দেবু বাধা দেয়, খাস নে, সেপটিক হবে।
বাধ্য হলে চকোলেটটা মোটা ভালুকদের দান করতে হয়। যথার্থই ওদের টেস্ট উঁচুদরের। ওদের একজন ওটা সযত্নে কুড়িয়ে নেয়, নিয়ে সুকৌশলে রূপোলী কাগজের মোড়ক খুলে ফেলে চকোলেটটা বার করে, তারপর সমান দুভাগ করে দুজনে মুখে পুরে দেয়। ভালুকদের মধ্যে এরূপ সভ্যতা আর সাধুতা আমি কোনদিন আশা করিনি। একদম অবাক হয়ে যাই। এ রকম ন্যায়পরায়ণ আদর্শ ভালকুকে মারাটা সঙ্গত হবে কিনা এয়ার গান হাতে ভাবতে থাকি।
দেবু চমৎকৃত হয়–দেখছিস কি রকম শিক্ষিত ভালুক। তারপর একটু থেমে যোগ করে–শিক্ষিত প্রাণীদের শিকার করা কি উচিত? অবশেষে আমার মতামত না পেয়েই আপন মনে ঘাড় নাড়তে থাকে–একেই তো আমাদের দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম,….এই ভালুকটি গেলে স্থান কি আর পূর্ণ হবে?
ওর সহৃদয়তার প্রশ্রয় না দিয়ে গম্ভীরভাবেই জবাব দিই–না, এখন আর শিকার করবো না। সার্কাস দেখবার আগে এদের খতম করা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না।
আড়াইটার শোরর টিকিট কেটে আমি আর দেবু ঢুকে পড়ি; আমার হাতে দেবুর এয়ার-গান, আর দেবুর হাতে আমার ক্যামেরা। স্থিরসংকল্প হয়েই ঢুকেছি, সার্কসের পরেই অব্যর্থ শিকার; কেননা অনেকে ভেবে দেখলাম, সাকার্স-এর সঙ্গে কারকাসই হচ্ছে একমাত্র মিল এবং খুব ভাল মিল। শিকারী জগতে ভয়ানক পিছিয়ে রয়েছি, অন্ততঃ আমার পিসতুতো দাদা এবং তার মাসতুততা বড়দার চেয়ে ত বটেই,–সেই অপবাদ আজ দূর করতে হবে।
প্রথমেই সেই মোটা ভালুক দুটোকে এরিনায় এনে হাজির করেছে। বেঁটেটাকে ওদের সঙ্গে দেবু একটু ক্ষুণ্ণ হলো,–সেই বাচ্চাটাকে আনবে না?
ওটা আস্ত জানোয়ারই আছে, এখনো মানুষ হয়ে ওঠেনি কিনা।
দেবু চুপ করে থাকে, বোধ করি ওর প্রাণের ভালুককে অমানুষ বলাতে মনে মনে দুঃখিত হয়। খানিক বাদে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, হতভাগার জন্যে জাম এনেছিলাম।
আমি ওর দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকাই–য়্যা? তোরও বুঝি ভালুক শিকারের মতলব? একরাশ ওই বিদঘুঁটে জাম খেয়ে কেউ বাঁচে কখনও? পেটে গেছে কি নির্ঘাৎ ধনুষ্টাংকার। তুই বুঝি জাম খাইয়ে কাজ সারতে চাস? দেবু উত্তর দেয় না। আমি আশ্বাস দিই–তা বেশ ত, এয়ার গানে ঐ জাম পুরে ছুঁড়লে নেহাৎ মন্দ হবে না। জাম খাওয়ানো–কে জাম খাওয়ানো, কাম ফতে–কে কাম ফতে।
দেবু সান্তনা পায় কিনা ও-ই জানে। দেখি ওর দুপকেট জামে ভর্তি। ইতিমধ্যে সেই মোটা ভালুক দুটো বাইসাকেলে চেপে এমন অদ্ভুত কসরৎ দেখাতে থাকে যা নিজের চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না। ভালুকের ভাষা আলাদা না হলে এবং আলাপের সুবিধা থাকলে ওদের কাছ থেকে দুএকটা সাইকেলের প্যাঁচ শিখে নিলে নেহাৎ মন্দ হত না। সেটা সম্ভব কিনা মনে মনে চিন্তা করছি এমন সময়ে দেবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে–আমার সেজ মামা কি বলে জানিস অমল?
দেবুর সেজ মামা কি বলে জানবার আগ্রহ না থাকলেও জিজ্ঞাসা করি। বলে, যে সার্কাসে মানুষে ভালুকের খোলস গায়ে দিয়ে সেজে থাকে। সাইকেলের খেলা দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে।
আমি প্রতিবাদ করি–পাগল। আমি কখনো কোনো মানুষকে এমন অদ্ভুত সাইকেল চালাতে দেখিনি, এ কেবল ভালুকের পক্ষেই সম্ভব।
দেবু ঘাড় নাড়ে–তা বটে।
আমি জোর দিয়ে বলি–নিশ্চয়ই তাই। শিক্ষালাভের ফলে কত কি হয় বইতে পড়িসনি? এ তো কিছুই না, আমি যদি ভালুকটাকে তারের ওপর সাইকেল চালাতে দেখি তাহলেও আশ্চর্য হব না।
এমন কি এখুনি যদি ওরা স্পষ্ট বাংলায় কথা কইতে শুরু করে দেয় তাহলেও না।
দেবু সায় দেয়–হু, তা বটে
কায়দা-কসরৎ দেখিয়ে ভালুকেরা চলে গেল। একটু পরে যখন হাতি চার পায়ে একটা পিপের পিঠে দাঁড়াবার দুশ্চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে–আমি দেবুকে অপেক্ষা করতে বলে, অলক্ষ্যে ওদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম এখন হাতির কসরতের ওপরেই সকলের যারপরনাই মনোযোগ, ভালুক শিকারের এই হচ্ছে সুযোগ।
সার্কাসের পেছন দিকে, একেবারে তাঁবুর শেষ প্রান্তে ভালুকের আস্তানা। দূর থেকে মনে হলো ভালুক দুটো যেন নিজেদের বাহাদুরির গল্প ফেঁদেছে। বেশ স্পষ্ট দেখলাম ধেড়ে-মোটাটা পিঠ চাপড়ে ছোট ভাইকে সাবাস দিচ্ছে। ওরা কী ভাষায় কথোপকথন করে জানবার কৌতূহল ছিল কিন্তু আমাকে দেখতে পাবামাত্র যেন একদম বোবা মেরে গেল।
আমি বললাম–কি হে ভায়ারা। বেশ তা আজ্ঞা চলছিল, থামলে কেন?
আমার কথা শুনে এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। তার মানে–এই ছেলেটা কি বলছে হ্যাঁ? নিশ্চয়ই আমাদের বুলি ওদের বোধগম্য নয়। উঁহু, স্বদেশী ভালুক না; তবে কি উত্তর মেরুর? যাকে, পোলার বেয়ার বলে, তাই নাকি এরা? পোলার বেয়ার মারতে পারলে বড়দার চেয়ে বড় কীর্তি রাখতে পারব ভেবে মনে ভারি ফুর্তি হল। এয়ার-গানটা বাগিয়ে ধরলাম।
প্রথমে বাচ্চা থেকেই শুরু করা যাক, কিন্তু খাঁচার পাখি শিকার করে আরাম নেই। বেঁটে ভালুকটার খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। বিপদ এবং মুক্তি এক কথা বিপন্মুক্তির সম্মুখীন হয়ে ও যেন প্রথমটা ভ্যাবাচকা খেয়ে গেল। কেননা অনেক ইতস্তত করে তবে সে খাঁচায় নীচে পা বাড়ালো।
এমন একটা অঘটন ঘটল। অকস্মাৎ দৈববাণী হলো–পালাও পালাও, মারাত্মক ভালুক।
চারিদিকে তাকালাম, কেউ কোথাও নেই, সার্কাসের লোকজন সার্কাস নিয়ে ব্যস্ত। তবে এ কার কণ্ঠধ্বনি? নিজের স্বৰ্গতোক্তি বলেও সন্দেহ করবার কারণ ছিল না। ভাল করে চেয়ে দেখি, ওমা, সেই মোটা ভালুকদেরই একজন হাত নাড়ছে আর ওই কথা বলছে।
আগেই আঁচ করা ছিল, তাই আর আশ্চর্য হলাম না। বাংলাভাষাও যে এরা আয়ত্ত করেছে, এই ধরণের একটা সন্দেহ আমার গোড়া থেকেই ছিল। শিক্ষিত ভালুকের পক্ষে একটা বিদেশী ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করা এমন আর বেশি কথা কি? ইতিমধ্যে সেই বেঁটে ভালুকটা দেখি আমার বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে এসে পড়েছে।
মোটা ভালুকটা আবার আওয়াজ ছেড়েছে–ওহে দেখছ না। ভালুক যে।
ভালুক যে, তা অনেকক্ষণ আগেই দেখেছি। ভালুক আমি খুব চিনি। চিনি এবং নিজেকেও চেনাতে জানি–আমি এবং আমার দাদা দুজনেই। কিন্তু এই মোটা ভালুকটার আহাম্মকি দেখ! একটু শিক্ষা পেটে পড়েছে কি আর অহঙ্কারের সীমা নেই অমনি নিজের জাত ভুলতে শুরু করেছেন। কোন কোন বাঙালি যেমন দুপাতা ইংরেজি পড়েই নিজেকে আর বাঙালি জ্ঞান করে না, একেবারে খাস ইংরেজ ভেবে বসে, ওরও তাই দশা হয়েছে। নিজেও যে উনি একটি নাথিং বাট ভাল্লুক, তা ওঁর খেয়াল নেই।
ভারি রাগ হয়ে গেল আমার। চেঁচিয়ে বললাম–ও তো ভালুক, আর তুমি কি? তুমি যে আস্ত একটা জাম্ববান।
ওকে একটু লজ্জা দেবার চেষ্টা করলাম, এ রকম না দিলে চলে না। শিক্ষিত লোককেও অনেক সময় শিক্ষা দেবার দরকার হয়। আমার অত্যুক্তি শুনে বোধ করি ভালুকটার আত্মগ্লানি হলো, কেননা সে আর উচ্চবাচ্য করল না। বেঁটেটা আর এক পা এগুতেই আমি,এয়ার-গান ছুঁড়লাম, ছররাট ওর পেটে গিয়ে গিয়ে লাগল। ও থমকে দাঁড়িয়ে পেটটা একবার চুলকে নিল, কিন্তু মোটেই দমল না; ধীরে পদে অগ্রসর হতে লাগল–বন্দুকের মুখেই।
দুঃসাহসী বটে! বাধ্য হয়ে এবার আমাকেই পশ্চাৎপদ হতে হলো। আবার, আবার সেই কামান গর্জ্জন। কিন্তু ও একটু করে গা চুলকোয় আর এগিয়ে আসে। গ্রাহ্যই করে না, যেন অনেক কালের গুলি খাবার অভ্যাস!
বুঝলাম খুব শক্ত শিকারের পাল্লায় পড়া গেছে, আমার বড়দার বরাতে যা জুটেছিল, ইনি মোটেই তেমন সন্তোষজনক হবেন না। হঠাৎ উনি একটা উদ্ভুত গর্জ্জন করলেন; ওটা বাংলায় কোনো
অব্যয় শব্দ কিংবা কোন অপভাষা কিনা মনে মনে এইরূপ আলোচনা করছি এবং যখন প্রায় সিদ্ধান্ত করে ফেলেছি যে ওই গর্জনের ভাষাটা বাংলা নয় বরং গ্রীক হলেও হতে পারে, সেই সময়ে ভালুকটা অভদ্রের মত দৌড়ে এসে অকস্মাৎ আমকে এক দারুণ চপেটাঘাত করল।
স-বন্দুক আমি বিশ হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। জানোয়ারদের খাবার জন্য কি শোবার জন্য জানি না বিচালির গাদি স্থূপাকার করা ছিল, তার ওপরে পড়েছিলাম বলেই বাঁচোয়া। এক মুহূর্তর চিন্তাতেই বুঝলাম গতিক সুবিধের নয়। যে পালায় সেই কীর্তি রাখে এবং রাখতে পারে কেবল সেই বেঁচে যায়, এমন কথা নাকি শাস্ত্রে বলে। আজ যদি শাস্ত্রবাক্য রক্ষা করি, তাহলে কাল ফিরে এসে শিকার আবার করলেও করতে পারি। অতএব–
চড়-টা আমার পালানোর পক্ষে সাহায্যই করল, না হেঁটে, না হটে এবং না লাফিয়ে বিশ হাত এগিয়ে পড়া কম কথা নয়! উঠেই উদার পৃথিবীর দিকে চোচা দৌড় দিলাম। ভালুক বাবাজীবনও অমনি পিছু নিলেন–যেমন ওদের দুস্বভাব। অনুকরণ আর অনুসরণ করতে যে ওরা ভারি মজবুত, দাদার গল্প পড়েই তা আমার জানা ছিল।
পাহাড়ের যে দিকটায় আলোয়ার ভয়ে দিনেও লোকে পথ হাঁটে না, প্রাণভয়ে সেইদিকেই ছুটলাম। মাঝখানে একটা জায়গা এমন স্যাঁৎসেতে, সেখান দিয়ে যেতে কি রকম একটা গ্যাসে যেন দম আটকে আসে; জায়গাটা পেরিয়ে উঁচু একটা পাথরের ঢিবিতে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
দৌড়তে দৌড়তে ভালুকটা সেই স্যাঁৎসেতে জায়গাটায় এসে পিছলে পড়ল। মিনিটখানেক পরে উঠতে গিয়ে আবার মুখ থুবড়ে গেল। হঠাৎ কি হলো ভালুকটার? বার বার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই যেন আর দাঁড়াতে পারে না।
আমিও সেই উঁচু ঢিবিটার ওপরে দাঁড়িয়ে–অনেকক্ষণ কেটে গেল। হঠাৎ দেখি ভালুকটা উঁচু হয়েছে, উঠেই দাঁড়িয়েছে, কিন্তু মাথার দিকে নয় লেজের দিকে! অবাক কাণ্ড! মাথার নীচের দিকে, লেজ ওপরের দিকে এ অবাক কি রে! এটা কি এখানেই সার্কাস শুরু করল নাকি!
আরো খানিকক্ষণ কাটল! ভালুকটা আরো একটু উঁচু হল। ভাল করে চোখ রগড়ে দেখি–ও দাদা, এ যে একেবারে মাটি ছেড়ে উঠে পড়েছে। দাঁড়িয়েই আছে বলতে হবে, যদিও তার মাথাই নীচে আর পা ওপরের দিকে। ভালুকটা দুহাত মাটি আঁকড়াবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে, কিন্তু তার আকাশে পদাঘাত করাই সার–কেননা পৃথিবী আর তার মধ্যে তখন দুহাত ফারাক। মাটির নাগাল পাওয়া মুশকিল!
খানিক বাদে ভালুকটা উড়তে শুরু করল। ভালুক উঁড়ছে এ কখনও কল্পনা করতে পার? কিন্তু আমার স্বচক্ষে দেখা। আমার হাত থেকে এয়ার গান খসে পড়ল। উড়তে উড়তে ভালুকটা এবার আমার মাথার কাছাকাছি পর্যন্ত এল–আমি বসে পড়ে আত্মরক্ষা করলাম। ও যে রকম হাত বাড়িয়েছিল,–ঠিক ডুবন্ত লোক যেভাবে কুটো ধরতে যায়,–আর একটু হলেই আমায় ধরে ফেলেছিল আর কি! ওর চোখে এক অসহায় সপ্রশ্ন ভাবটা যেন, হায়, আমার একি হলো। আমাকে ধরতে ওকে সাহায্য না করায়, ও যে আমার ওপর খুব বিরক্ত আর মর্মাহত হয়েছে, তা ওর মুখভাব দেখলেই বোঝা যায়।
লক্ষ্য করে দেখলাম ওর পেটটা ভয়ানক কেঁপে উঠেছে–চারটে জয়ঢাক এক করলে যা হয়। ঠিক যেন একটা রক্তমাংসের বেলুন। ভালুকটা ক্রমশঃই ওপরের দিকে যেতে লাগল–লেজ সর্বাগ্রে। দেখতে দেখতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে অবশেষে বিন্দুমাত্রে পরিণত হলো, তারপর পলকে শূন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অমল ভ্রাতাজীবনের শিকার কাহিনী পাঠে বিজ্ঞানবিদ পাঠক হয়ত এই ব্যাখ্যা দেবেন যে বেচারা ভালুক সে স্যাঁতসেতে জায়গায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সেখানটায় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাদুর্ভাব ছিল; সেই উদরস্থ করার ফলেই বাবাজী বেলুনে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমার বিশ্বাস ওই ভালুকটা ছিল অতিরিক্ত পুণ্যাত্মা–কেননা সশরীরে স্বর্গারোহণের সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়। এভাবে মহাপ্রস্থানের পথে যাবার এ্যাকসিডেন্ড এ পর্যন্ত চারজনের মোটে হয়েছে, এই ভালুক–নন্দনকে ধরে; যাদের মধ্যে কেবল একজন মাত্র দুর্বিপাক কাটিয়ে কোন গতিকে স্বস্থানে ফিরতে পেরেছেন। প্রথম গেছলেন স্বয়ং যুধিষ্ঠির, দ্বিতীয়–তাঁরই সমভিব্যাহারি জনৈক কুকর শাবক, তৃতীয় আমার বন্ধু শ্ৰীযুক্ত প্রবোধকুমার সান্যাল, আর চতুর্থ–?
চতুর্থ এদের কারো চেয়েই কোন অংশে নূন্য নয়।