ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি
আর কিছু না, একটু মোটা হতে শুরু করেছিলাম, অমনি মামা আমার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বললেন–সর্বনাশ! তোর খুড়তুতো দাদামশাই–কী সর্বনাশ!
কথাটা শেষ করবার দরকার হয় না। আমার মাতুলের খুড়ো আর জ্যেঠা স্থূলকায়তায় সর্বনাশের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। নামের উল্লেখেই আমি বুঝতে পেরে যাই।
খুড়তুতো দাদামশায়ের বুকে এত চর্বি জমে ছিল যে হঠাৎ হার্টফেল হয়েই তাঁকে মারা যেতে হল, ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন হয়নি। জ্যেঠতুতো দাদামশাইয়ের বেলা ডাক্তার এসেছিলেন কিন্তু ইনজেকশন করতে গিয়ে মাংসের স্তর ভেদ করে শিরা খুঁজে না পেয়ে, গোটা তিনেক উঁচ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গচ্ছিত রেখে, রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় ভিজিট না নিয়েই রেগে প্রস্থান করেছিলেন। রেগে এবং বেগে।
যে বংশের দাদামশায়দের এরূপ মর্মভেদী ইতিহাস, সে বংশের নাতিদের মোটা হওয়ার মতো। ভয়াবহ আর কী হতে পারে? কাজেই আমার নাতিবৃহৎ হওয়ার লক্ষণ দেখে বড়মামা বিচলিত হয়ে পড়েন।
প্রতিবাদের সুরে বলি কি করব! আমি কি ইচ্ছে করে হচ্ছি?
উঁহু, আর কোনো অসুখে ভয় খাই না। কিন্তু মোটা হওয়া–বাপস! অমন মারাত্মক ব্যাধি আর নেই। সব ব্যায়রামে পার আছে, চিকিচ্ছে চলে; কিন্তু ও রোগের চিকিচ্ছেই নেই। ডাক্তার কবরেজ হার মেনে যায়। হুঁ!
অগত্যা আমাকে চেঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, রোগা হবার জন্য। লোকে মোটা হবার জন্যেই চেঞ্জে যায়, আমার বেলায় উল্টো উৎপত্তি। গৌহাটিতে বড় মামার জানা একজন ভালো ডাক্তার থাকেন; তার কাছেই যেতে হয়। তিনিই আমায় রোগা-রোগা করে আরোগ্য করার ভার নেন–।
প্রথমেই তার প্রশ্ন হয়–ব্যায়াম-ট্যায়াম কর?
আজ্ঞে দুবেলা হাঁটি। দুমাইল, দেড় মাইল, এমনকি আধ মাইল পর্যন্ত–যেদিন যতটা পারি। রাস্তায় বেরলেই হাঁটতে হয়!
হা! হাঁটা আবার একটা ব্যায়াম নাকি! ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস আছে?
না তো! সসংকোচে কই।
ঘোড়ায় চড়াই হল গিয়ে ব্যায়াম। পুরুষ মানুষের ব্যায়াম। ব্যায়ামের মত ব্যায়াম। একটা ঘোড়া কিনে ফেলে চড়তে শেখো–দুদিনে শুকিয়ে তোমার হাড়গোড় বেরিয়ে পড়বে।
ডাক্তারের কথা শুনে আমার রোমাঞ্চ হয়। গোরু থেকে ঘোড়ার পার্থক্য সহজেই আমি বুঝতে পারতাম, যদিও রচনা লিখতে বসে আমার এসেতে ঘোড়া-গরু এক হয়ে এসে মিলে যেত, সেই একতার থেকে ওদের আলাদা করা ইস্কুলের পণ্ডিতের পক্ষে কষ্টকর ছিল। চতুম্পদের দিক থেকে উভয়ে প্রায় এক জাতীয় হলেও বিপদের দিক থেকে বিবেচনা করলে ঘোড়ার স্থান কিছু উঁচু হবে বলতে হয়।
যাইহোক, ডাক্তার ভদ্রলোক গৌহাটির লোক হলেও গৌ গাবৌ গাবঃ না করে, গোড়াতেই গোরাকে বাতিল করে ঘোড়াকেই তিনি প্রথম আসন দিতে চাইলেন–অবশ্য আমার নিচেই। আমিও, ঘোড়র উপরেই চড়ব, এই সংকল্প করে ফেললাম। বাস্তবিক, ঘোড়ায় চড়া সে কী দৃশ্য! সার্কাসে তো দেখেইছি, রাস্তাতেও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে যায় বই কি!
আম্বালায় থাকতে ছোটবেলায় দেখেছি পাঞ্জাবিদের ঘোড়ায় চড়া। এখনও মনে পড়ে, সেই পাগড়ী উড়ছে, পারপেন্ডিকুলার থেকে ইষৎ সামনে ঝুঁকে সওয়ারের কেমন সহজ আর খাতির নাদার ভাব আর তার দাড়িও উড়ছে সেই সঙ্গে! যেন দুনিয়ার কোনো কিছুর কেয়ারমাত্র নেই! তাবৎ পথচারীকে শশব্যস্ত করে শহরের বুকের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে যাওয়া। পরমুহূর্তে তুমি দেখবে কেবল ধুলোর ঝড়, তাছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না।
হ্যাঁ ঘোড়ায় আমায় চড়তে হবেই! ঠিক তেমনি করেই। তা না হলে বেঁচে থেকে লাভ নেই, মোটা হয়ে তো নেই-ই।
আশ্চর্য যোগাযোগ। ডাক্তারের প্রেসকৃপশনের পর বিকেলের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছি, দেখি সদর রাস্তায় নীলাম ডেকে ঘোড়া বিক্রি হচ্ছে। বেশ নাদুস-নুদুস কালো কালো একটি ঘোড়া–পছন্দ করে সহচর করবার মতই।
বাইশ টাকা! বাইশ টাকায় যাচ্ছে–এক, দুই–
তেইশ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আমি হাঁকলাম।
চব্বিশ টাকা। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন যেন আমার কথারই জবাব দিল।
চব্বিশ টাকা। নীলামওয়ালা ডাকতে থাকে, ঘোড়া, জিন, লাগাম মায় চাবুক–সব সমতে মাত্র চব্বিশে যায়। গেল গেল–এক দুই–
বলে ফেলি একবারে সাতাশ।
আটাশ! ভিড়ের ভেতর থেকে আবার কোন হতভাগার ঝগড়া।
আমার পাশে একজন লোক আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়–আমি ঘোড়া চিনি, সে বলে, অদ্ভুত ঘোড়া মশাই! এত সস্তায় যাচ্ছে, আশ্চর্য! এর জিনের দামই তো আঠাশ টাকা!
বলেন কি! আমার চোখ বড় হয়ে ওঠে, তা হলে আরো উঠতে পারি–কী বলেন?
নিশ্চয়! ভাবছেন বুঝি দিশী ঘোড়া? মোটে তা নয়, আসল ভুটানী টাট্টু–যাকে বলে!
ভুটানী বলতে কি বোঝায় তার কোন পরিচয়ই আমার জানা ছিল না, কিন্তু ভদ্রলোকের কথায় ভঙ্গিতে এটা বেশ বুঝতে পারলাম যে এ যেন একটা জানোয়ারের মালিক না হতে পারলে ভূভারতে জীবনধারণই বৃথা!
আকুতোভয়ে ডাকছাড়ি–তেত্রিশ।
চৌৎ-আমার পাশের এক ব্যক্তি ডাকার উদ্যম করে। উৎসবের পুত্রপাতেই ওকে আমি দমিয়ে দিই–সাইত্রিশ! তারপর আমি হন্যে হয়ে উঠিপর পর ডেকে যাই–উনচল্লিশ, তেতাল্লিশ, সাতচল্লিশ, ঊনপঞ্চাশ।
পর পর এতগুলো ডাক আমি একাই ডেকে যাই! ঊনপঞ্চাশে গিয়ে ক্ষান্ত হই।
উনপঞ্চাশ-উনপঞ্চাশ! এমন খাসা খোঁড়া মাত্র ঊনপঞ্চাশে যায়! গেল—গেল–চলে গেল। এক-দুই–
তারপর আর কেউ ডাকে না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিরস্ত হয়ে পড়েছে তখন। এক দুই তিন।
নগদ ঊনপঞ্চাশ টাকা গুনে ঘোড়া দখল করে পুলকিত চিত্তে বাড়ি ফিরি। সেই পার্শ্ববতী অশ্ব সমঝদার ভদ্রলোক আমার এক উপকার করেন। একটা ভাড়াটে আস্তাবলে ঘোড়া রাখবার ব্যবস্থা করে দেন। তারাই ঘোড়ার খোরপোশের, সেবা শুশ্রূষার যাবতীয় ভার নেবে। সময়ে-অসময়ে এক চড়া ছাড়া কোনো হাঙ্গামাই আমাকে পোহাতে হবে না। অবশ্য এই অশ্ব সেবার জন্য কিছু দক্ষিণা দিতে হবে ওদের।
ভদ্রলোককে সন্দেশের দোকানে নেমন্তন্ন করে ফেলি তক্ষুণি।
পরের দিন প্রাতঃকালে আমার অশ্বারোহনের পালা। ভাড়াটে সহিসরা ঘোড়াটাকে নিয়ে আসে। জনকতক ধরছে ওর মুখের দিকে, আর জনকতক ওর লেজের দিকটায়। মুখের দিকের যারা, তারা লাগাম, ঘোড়ায় কান, ঘাড়ের চুল অনেক কিছুর সুযোগ পেয়েছে কিন্তু লেজের দিকে লেজটাই কেবল সম্বল। ও ছাড়া আর ধর্তব্য কিছু ছিল না। আমি বিস্মিতই হইয়া কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করি না, পাছে আমায় আনড়ি ভাবে। ঘোড়া আনার এই নিয়ম হবে হয়তো, কে জানে।
সেই ডাক্তার ভদ্রলোক বাড়ির সামনে দিয়ে সেই সময় যাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে থামেন। এই যে। একটা ঘোড়া বাগিয়েছে দেখছি। বেশ বেশ। কিনলে বুঝি? কতয়? উনপঞ্চাশে? বেশ সন্তাই তো। খাসা-বাঃ।
ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে নিজের প্রেসকৃপশনকেই বড় করেন–হ্যাঁ, হাঁটা ছাড়ো। হ্যাঁ-টা ছাড়ো। হাঁটা ব্যায়াম নাকি আবার। মানুষে হাঁটে? ঘোড়ায় চড়তে শেখো। অমন ব্যায়াম আর হয় না। দুদিনে চেহারা ফিরে যাবে। এত কাহিল হয়ে পড়বে যে তোমার মামারাই তোমাকে চিনতে পারবেন না। হুম।
তাঁর ‘রুগী’ দেখার তাগাদা, অপেক্ষা করার অবসর নেই। ঘাড় নেড়ে আমাকে উৎসাহ দিয়েই তিনি চলে যান। দর্শকদের মধ্যে তাঁকে গণনা না করেই আমার অভিনব ব্যয়ামপর্ব শুরু হয়।
সহিসরা বশে কষে তাকে ধরে থাকে, আমি আস্তে আস্তে তার পিঠের উপর বসি; বেশ যুত করেই বসি; শ্ৰীযুত হয়ে।
কিন্তু যেমনি না তাদের ছেড়ে দেওয়া, ঘোড়াটা চারটে পা একসঙ্গে জড়ো করে, পিঠটা দুমড়ে ব্যাখারির মতন বেঁকিয়ে আনে। এবং করে কি, হঠাৎ পিঠটা একটু নামিয়েই না, ওপরের দিকে এক দারুণ ঝাড়া দেয়–ধনুকে টঙ্কার দেওয়ার মতই। আর তার সেই এক ঝাড়াতেই আমি একেবারে স্বর্গে-ঘোড়ার পিঠ ছাড়িয়ে প্রায় চার পাঁচ হাত উঁচুতে আকাশের বায়ুস্তরে বিরাজমান।
শূন্যমার্গে চলাচল আমার ন্যায় স্কুল জীবের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে নামতে হয়, ঐ ঘোড়ার পিঠেই আবার। সেই মুহূর্তেই আবার যথাস্থানে আমি প্রেরিত হই, কিন্তু আমার অধঃপতন। এবার জিনের মাথায়। আবার আকস্মিক উন্নতি, এবার নেমে আসি ঘোড়ার উপর। আবার আমাকে উপরে ছুঁড়ে দেয়; এবার যেখানে নামি সেখানে ঘোড়ার চিহ্নমাত্র নেই। অশ্ববর আমার আড়াই হাত পেছনে দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তখন, আমাকে লুফে নেবার জন্যই কিনা কে জানে।
ঘোড়ার মতলব মনে মনে টের পেতেই, তার ধরবার আগেই আমি শুয়ে পড়ি। জানোয়ারটা ততক্ষণে আমাকে উন্মুক্ত গৌহাটির পথ ধরে টেলিগ্রামের মতো দ্রুত ছুটে চলেছে।
আস্তে আস্তে উঠে বসি আমি। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি, ঘোড়ায় চড়ার বিলাসিতা পোষাল না আমার। একটা হাত কপালে রাখি, আর একটা তলপেটে। মানুষের হাতের সংখ্যা যে প্রয়োজনের পক্ষে পর্যাপ্ত নয় এ কথা এর আগে এমন করে আমার ধারণাই হয়নি কখনও। করাণ তখনও অরো কয়েকটা হাতের বিলক্ষণ অভা বোধ করি। ঘাড়ে পিঠে কোমরে, পাঁজরায় এবং শরীরের আরো নানা স্থানে হাত বুলোবার দরকার ছিল আমার।
কেবল যে বেহাতই হয়েছি তাই নয়, বিপদ আরো;–উঠতে গিয়েই সেটা টের পাই। দাঁড়াবার এবং দাঁড়িয়ে থাকার পক্ষে দুটো পা-ও মোটেই যথষ্টে নয়, বুঝি তখন। সহিসরা ধরে বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়, কিন্তু যেমনি না ছাড়ে অমনি আমি সটান। তখন সবাই মিলে, সহানুভূতিপরবশ হয়ে ধরাধরি করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারেও আমার নিজের হাত পা নিজের কোন-ই কাজে লাগে না, লাগে না, এক ওদের হ্যাঁন্ডেল হওয়া ছাড়া….নিজের চ্যাংদোলায় নিজে চেপে আসি।
তারপর প্রায় এক মাস শয্যাশায়ী। সবাই বলে ডাক্তার দেখাতে কিন্তু ডাক্তার ডাকার সাহস হয় না আমার। মামার বন্ধু-তিনিই তো? এই অবস্থাতেই আবার ঘোড়র চড়ার ব্যবস্থা দিয়ে বসবে কিনা কে জানে। অশ্বচিকিৎসা ছাড়া আর কিছু তো জানা নেইকো তার। সেই পলাতক ভূটানী টাটুকে যদি খুঁজে না-ও আর পাওয়া যায়, একটা নেপালী গাঁট্টার যোগাড় করে আনতে কতক্ষণ? ডাক্তার? নাঃ। মাতৃপুরুষানুক্রমে সে আমাদের ধাতে সয় না।
বিছানা ছেড়ে যেদিন প্রথম বেরুতে পারলাম সেদিন হোটেলের বড় আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে গেলাম। অ্যাঁ এতটা কাহিল হয়ে পড়েছি নাকি? নিজেকে দেখে চেনাই যায় না যে; মুখের দিকে তাকাতেই ইচ্ছা করে না।–বিকৃতবদনে বাইরে বেরিয়ে আসি।
রাস্তায় পা দিতেই আস্তাবলের বড় সহিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ।–হুজুর আপনার কাছে আমাদের কিছু পাওনা আছে।
পাওনা? আবার আমাকে চমকাতে হয়–কিসের পাওনা?
আজ্ঞে, সেই ঘোড়ার দরুন।
কেন, তার দাম তো চুকিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ, চাবুকের দরুন ক-আনা পাবে বটে তোমরা। তা চাবুক তো আমার কাজেই লাগেনি, ব্যবহারই করতে হয়নি আমায়। ও ক-আনাও কি দিতেই হবে নেহাৎ?
আজ্ঞে কেবল ক-আনা নয় তো হুজুর। বাহাত্তর টাকা সাড়ে বারো আনা মোট পাওনা যে। এই দেখুন বিল।
বাহাত্তর টাকা সাড়ে বারো আনা? আমার চোখ কপালে ওঠে। কেন, আমার অপরাধ?
আজ্ঞে আপনার ঘোড়ায় খেয়েছে এই এক মাসে সাড়ে বাইশ টাকার ছোলা সোয়া পাঁচ টাকার ঘাস—
আমি বাধা দিয়ে বলি– কেন, সে তো পালিয়ে গেছে গো।
আপনার ঘোড়া? মোটেই না। খাবার সময়েই ফিরে এসেছিল, আর তার পর থেকে আস্তাবলে ঠিক রয়েছে। সেই ছোট সহিসকে হুকুম দেয়–নিয়ে আয়তো ভূটানী টাট্ট হুজুরের সামনে।
বলতে বলতে সহিসটা ঘোড়াকে এনে হাজির করে। ঘোড়াটা যে ভাল খেয়েছে দেয়েছে তার আর ভুল নেই, বেশ একটু মোটাসোটাই হয়েছে বলে আমার বোধ হোলো।
আমরা তো তবু ওকে কম খেতে দিয়েছি, দিতে পারলে ওর ডবল, আট ডবল খেতে পারত। কিন্তু সাহস করে খাওয়াতে পারিনি, হুজুর বেঁচে উঠবেন কিনা ঠিক ছিল না তো। এর আগের–সহিসটা হঠাৎ থেমে যায়, আর কিছু বলতে চায় না।
পরবর্তী বাক্যটি প্রকাশ করার জন্য আমি পীড়াপীড়ি লাগাই। ছোট সহিসটা বলে ফেলে-ওকে চেপে এর আগে আর কেউ বাঁচেনি হুজুর।
বড় সহিসটা বলে–এই তো ঘাস আর ছোলাতেই গেল সওয়া পাঁচ আর সাড়ে বাইশ। একুনে সাতাশ টাকা বারো আনা। ভুট্টা খেয়েছে মোট দশ টাকার। ভুটানী টাট্ট কিনা, ভুট্টা ছাড়া ওদের চলে না। এই গেল সাঁইত্রিশ টাকা বারো আনা দেখুন না বিল।
এর ওপর আবার বজরা–ছোট সহিসটি বলতে যায়।
থাম তুই। বলে বড় সহিসটা তাকে বাধা দেওয়ায় আমাকে আর বজরাঘাতটা সইতে হয় না।
বিল এনেছ, আমার ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। মনে বলি।–খাল বিল এক হয়ে যাক আমার।
এবার ছোট সহিসটা শুরু করে–তারপর ঘোড়ায় বাড়ি ভাড়া বাবদে গেল দশ টাকা–
ঘোড়ার জন্যে আবার একটা বাড়ি? আমি অবাক হয়ে যাই।
আজ্ঞে একটা গোটা বাড়ি নিয়ে একটা ঘোড়া করবেই বা কি? ওদের তো খাবার ঘর কি শোবার ঘর, বৈঠকখানা কি পায়খানা আলাদা লাগে না। এক জায়গাতেই ওদের সব কাজ–কিন্তু হুজুর, ঐ জায়গটার ভাড়াই হচ্ছে মাসে দশ টাকা
আমার কথা বেরোয় না। সহিসটা সরু মোলায়েম করে বলে, তারপ হুজুরেরা ঘোড়ার খিদম খেটেছি, আমাদের মজুরি আছে। আমরাই দশ পনের টাকা কি না আশা করি হুজুরের কাছে?
হুজুরের অবস্থা তখন মজুরের চেয়েও কাহিল। তবু মনে মনে হিসাব করে অঙ্ক খাড়া করি–তা হলেও সব মিলিয়ে বাষট্টি বারো আনা হয়। আর দশ টাকা দুপয়সা কিসের জন্যে?
ছোট সহিসটা চটপট বলে–আজ্ঞে ও দুপায়সা আমাকে দিবেন। খৈনির জন্যে।
ঘোড়ায় খৈনি খায়? আশ্চর্য তো!
আজ্ঞে ঘোড়ায় খায়নি। আমিই খাবার জন্য বলছিলাম, ওটার মুখের কছেই। কিন্তু যেমনি না ফটফটিয়েছি অমনি হারমীটা হেঁছে দিয়েছে–বিলকুল খৈনিটাই বরবাদ।
তখনই পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ওকে দিয়ে দিই। যতটা পাতলা হওয়া যায়। দেনা আর শত্ৰু কখনও বাড়াতে নেই।
বড় সহিস বলে–আর বাকি দশ টাকার হিসাব চান? জানোয়ার এমন পাজী আর বলব কি হুজুর! একদিন বাড়ির মালিকের পাকিটের মধ্যে নাক ডুবিয়ে একখানা দশ টাকার নোট বেমালুম মেরে দিয়েছে। একদম হজম।
অ্যাঁ, বল কি?–আমি বিচলিত হই–একেবারে খেয়ে ফেলল নোটখানা? কড়কড়ে দশ-দশটা টাকা?
এক্কেবারে। আমরা আশা করলাম পরে বেরুবে, কিন্তু না, পরে অনেক আস্ত ছোলা পেলাম, সেগুলো ঘুগনিওয়ালাদের দিয়েছি, কিন্তু নোট বিলকুল গায়েব। এ টাকাটাও ঘোড়ার খোরাকীর মধ্যে ধরে নেবেন হুজুর।
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি। দশ-দশটা টাকা ঘোড়ার নস্যি হয়ে গেল ভাবতেই আমার মাথা ঘুরতে থাকে।
সহিসটা আশ্বাস দেয়–চাবুকের দামটা তো ধরা হয়নি হুজুর, যদি মর্জি করেন তা হলে ওটার কয় আনা জুরে পুরো তেয়াত্তর টাকাই দিয়ে দিবেন। আর আমাদের দুজনকে ওই দুটো টাকা, বিনয়ের বাড়াবাড়িতে জড়ীভূত হয়ে বলে সে–আপনাদের মতো আমীর লোকের কাছেই তো আমাদের বকসিসের আশা-প্রত্যাশা হুজুর!
প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে সহিস বিদায় করি। মামার দেওয়া যা উপসংহার থাকে তার থেকে হোটেলের দেনা চুকিয়ে, হয়তো মালগাড়িতে বামার হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। যাই হোক, ঘোড়াকে আর আস্তাবলে ফিরিয়ে নিতে দিই না। সামনেই একটা খুঁটোয় বেঁধে রাখতে বলি, রাস্তাই আমার ঘোড়ার আস্তানা এখন থেকে। সেই উপকারী ভদ্রলোককে ডেকে দিতে বলি, সহিসদের, যিনি কেবল ঘোড়া চিনিয়েই নিরস্ত হননি, আস্তাবলও দেখিয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোককে ঘোড়াটা উপহার দিয়ে তাঁর উপকারের ঋণ পরিশোধ করব।
অভিলাষ প্রকাশ করতেই বড় সহিত বলে–ওকে কি দেবেন হুজুর! ওঁর ভগ্নীপতিরই তো ঘোড়া।
আমার দম ফেলতে দেরি হয়। সেই নীলামওয়ালা ওর ভগ্নীপতি? সে ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ছোটটা যোগ দেয়–আর ওনারই তো আস্তাবল হুজুর!
আমি আর কিছু বলি না, কেবল এই সংকল্প স্থির কির, যদি আমি গৌহাটিতে থাকতে থাকতেই সেই উপকারী ভদ্রলোকটি মারা যান, তাহলে আমার যাবতীয় কাজকর্ম গল্পের বই পড়া, বায়স্কোপ দেখা, চপকাটলেট খাওয়া এবং আর যা কিছু সব স্থগিত রেখে ওঁর শবযাত্রায় যোগ দেব। সব আমোদ-প্রমোদ ফেলে প্রথমে ঐ কাজ। সেদিনকার অ্যামিউজমেন্ট ঐ।
সহিসরা চলে যায়। আমি ঘোড়র দিকে তাকাই আর মাথা ঘামাই–কি গতি করব ওর? কিংবা ও-ই আমার কি গতি করে? এমন সময়ে ডাক্তারের আবির্ভাব হয় সেই পথে। আমাকে দেখে এক গাল হাসি নিয়ে তিনি এগিয়ে আসেন–এই যে! বেশ জীর্ণশীর্ণ হয়ে এসেছ দেখছি! একমাসেই দেখলে তো? তখনই বলেছিলাম! গোড়ায় চড়ার মতন ব্যায়াম আর হয় না। পায়ে হেঁটে কি এত হালকা হতে পারতে? আরও মুটিয়ে যেতে বরং। যাক, খুশি হলাম তোমার চেহারা দেখে! বাড়ি ফিরে মামাকে বোলো, মোটা রকম ভিজিট পাঠিয়ে দিতে আমায়।
মামা কেন, আমিই দিয়ে যাচ্ছি! সবিনয়ে আমি বলি, এই ঘোড়াটাই আপনার ভিজিট।
খুশি হলাম, আরো খুশি হলাম। ডাক্তারবাবু সত্যিই পুলকিত হয়ে ওঠেন, তা হোলে এবার থেকে আমার রুগী দেখার সুবিধেই হল।
ডাক্তারবাবু লাফিয়ে চাপেন ঘোড়ার পিঠে, ওঠার কায়দা দেখেই বুঝতে পারি এককালে ওই বদঅভ্যাস দস্তুরমতই ছিল ওঁর। পর মুহূর্তের তাকে আর দেখতে পাইনা। বিকালে হোটেলের সামনে আস্তে আস্তে পায়চারি করছি, তখন দেখি, মুহ্যমানের মতো তিনি ফিরছেন, হেঁটেই আসছেন সটান।
আপনার ঘোড় কি হল? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি। আমার দিকে বিরক্তিপূর্ণ দৃকপাত করেন তিনি।–এই হেঁটেই ফিরলাম। কতটুকুই রা পথ! চার মাইল তো মোটে। ঘোড়ায় চড়া ভালো ব্যায়াম বটে, কিন্তু বেশি ব্যায়াম কি ভালো? অতিরিক্ত ব্যায়ামে অপকারই করে, মাঝে মাঝে হাঁটতেও হয় ভাই! বলে তিনি আর দাঁড়ান না।
খানিক বাদে ডাক্তাবাবুর চাকর এসে বলে–গিন্নীমা আপনার ঘোড়া ফিরিয়ে দিলেন।
কিন্তু ঘোড়া কই? ঘোড়াকে তোমার সঙ্গে দেখছি না তো?
ঘোড়া যে কোথায় তা চাকর জানে না, ডাক্তারবাবুও জানেন না, তবে তার কাছ থেকে যা জানা গেছে তাই জেনেই কর্তার অজ্ঞাতসারেই গিন্নী এই মোটা ভিজিট প্রত্যার্পণ করতে দ্বিধা করছেন না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গিন্নীপক্ষ যা জেনেছেন আমি তা কর্মবাচ্যের কাছ থেকে জানাবার চেষ্টা করি। যা পঙ্কোদ্ধার হয় সংক্ষেপে তা এই–অশ্বপৃষ্ঠে যত সহজে ডাক্তারবাবু উঠতে পেরেছিলেন নামটা ঠিক ততখানি সহজসাধ্য হয়নি, এবং যথাস্থানে তো নয়ই। দুচার মাইলের কথাই নয়, পাক্কা নয়, পাক্কা পনের মাইল গিয়ে ঘোড়াটা তাকে নামিয়ে দিয়েছে বললেও ভুল বলা হয়, ধরাশায়ী করে পালিয়েছে। কোথায় গেছে বলা কঠিন, এতক্ষণে একশ মাইল, দেড়শ মাইল কি এক হাজার মাইল চলে যাওয়া অসম্ভব না। কর্তা বলেণ একশ, গিন্নীর মতে দেড়শ, এক হাজার হচ্ছে চাকরের ধারণায়।
আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি, ততক্ষণাৎ গাড়ি ধরে বাড়ি ফেরার জন্যে। খাবার সময় তো প্রায় হয়ে এল, যে-এক হাজার মাইল সে এক নিঃশ্বাসে গেছে, খিদের ঝোঁকে তা পেরিয়ে আসতেই বা তার কতক্ষণ? ঘাড় থেকে না নামিয়ে গৌহটিতে বাস করা বিপজ্জনক।