নরখাদকের কবলে
শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছ, এটা ভীষণ অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। যথার্থই তাই, সত্যিই ভারি রোমাঞ্চকর ঘটনা–নিতান্তই একবার আমি এক ভয়ঙ্কর নরখাদকের পাল্লায় পড়েছিলাম।
আফ্রিকার জঙ্গলে কি কোনো অজ্ঞাত উপদ্বীপের উপকূলে নয়–এই বাংলাদেশের বুকেই, একদিন ট্রেনে যেতে যেতে। সেই অভাবনীয় সাক্ষাতের কথা স্মরণ করলে এখনো আমার হৃঙ্কম্প হয়।
বছর আটেক আগের কথা, সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছি–মামার বাড়ি যাচ্ছি বেড়াতে। রাণাঘাট পর্যন্ত যাব, তাই ফুর্তি করে যাবার মতলবে বাবার কাছে যা টাকা পেলাম তাই দিয়ে একখানা সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কিনে ফেললাম। বহুকাল থেকেই লোভ ছিল ফাস্ট-সেকেন্ড ক্লাসে চাপবার, এতদিনে তার সুযোগ পাওয়া গেল। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু–কথাটা প্রায় ভুলে গেছলাম। ভুলে ভালই করেছিলাম বোধ করি, নইলে এই অদ্ভুত কাহিনী শোনার সুযোগ পেতে না তোমরা।
সমস্তক কামরাটায় একা আমি, ভাবলাম আর কেউ আসবে না তাহলে বেশ আরামে যাওয়া যাবে একলা এই পথটুকু। কিন্তু গাড়ি ছাড়বার পূর্ব্ব-মুহূর্তেই একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে উঠলেন। একমাথা পাকা চুলই তাঁর বার্ধক্যের একমাত্র প্রমাণ, তা না হলে শরীরের বাঁধুনি, চলা-ফেরার উদ্যম, বেশ-বাসের ফিটফাট কায়দা থেকে ঠিক তার বয়স কত অনুমান করা কঠিন।
গাড়িতে আমরা দুজন, বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও অল্পক্ষণেই আমাদের আলাপ জমে উঠল। ভদ্রলোক বেশ মিশুক, প্রথম কথা পাড়লেন তিনিই। এ-কথায় সে-কথায় আমরা দমদম এসে পৌঁছলাম। হঠাৎ একটা তারস্বর আমাদের কানে এল–অজিত, এই অজিত, নেমে পড় চট করে। গাড়ি ছেড়ে দিল যে!
সহসা ভদ্রলোকের সারা মুখ চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তুরিত দৃষ্টিতে সমস্ত প্ল্যাটফর্মটা একবার তিনি দেখে নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–নাঃ, সে অজিতের কাছ দিয়েও যায় না!
কিছু বুঝতে না পেরে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। ভদ্রলোক বললেন–অজিত নামটা শুনে একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল আমার। কিছু নাঃ এ–অজিত সে–অজিতের কড়ে আঙুলের যোগ্যও নয়–এমনি খাসা ছিল সে–অজিত! অমন মিষ্টি মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। শুনবে তুমি তার কথা?
আমি ঘাড় নাড়তে তিনি বললেন–গল্পের মাঝ পথে বাধা দিয়ে না কিন্তু। গল্প বলছি বটে, কিন্তু এর প্রত্যেকটা বর্ণ সত্য। শোনো তবে।–
জিভ দিয়ে ঠোঁটটা একবার চেটে নিয়ে তিনি শুরু করলেন; বছর পঞ্চাশ কি তার বেশিই হবে, তখন উত্তর–বর্মায় যাওয়া খুব বিপদের ছিল। চারিধারে জঙ্গল আর পাহাড়। জঙ্গল কেটে তখন সবে নতুন রেললাইন খুলেছে সেই অঞ্চলে অনেকখানি জায়গা জুড়ে মাঝে মাঝে এমন ধ্বসে যেত যে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যেত একেবারে। তার ওপরে পাহাড়ে-ঝড়, অরণ্য-দাবানল হলে তো কথাই না। রেঙ্গুন থেকে সাহায্য এসে পৌঁছতে লাগত অনেকদিন–এর মধ্যে যাত্রীদের যে কি দুরবস্থা হতো তা কেবল কল্পনাই যেতে পারে।
তখনকার উত্তর-বর্মা ছিল এখনকার চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা, রীতিমত বরফ পড়ত–সময়ে সময়ে চারিধারে সাদা বরফের স্তূপ জমে যেত। এখন তো মগের মুলুকের প্রকৃতি অনেক নম্র হয়ে এসেছে, তার ব্যবহারও এখন ঢের ভদ্র। সেই সময়কার ব্রহ্মদেশের মেজাজ ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে।
সেই সময় একবার এক ভয়ানক বিপাকে আমি পড়েছিলাম–আমি এবং আরও আঠারো জন। আমরা উত্তর-বর্মায় যাচ্ছিলাম-আমরা উনিশনই ছিলাম সমস্ত গাড়ির যাত্রী। উনিশজনই বাঙালি প্রথম রেললাইন খুলেছিল, কিন্তু দুর্ঘটনার ভয়ে সেখানকার অধিবাসীরা কেউ রেলগাড়ি চাপত না। ভয় ভাঙাবার জন্যে রেল কোম্পানি প্রথম প্রথম বিনা-টিকিটে গাড়ি চাপবার লোভ দেখাতেন। বিনা পয়সার লোভে নয় অ্যাডভেঞ্চারের লোভে রেঙ্গুনের উনিশজন বাঙালি আমরা তো বেরিয়ে পড়লাম।
সহযাত্রী মোটে এই কজন–কাজেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ-পরিচয় হতে দেরি হলো না। কোনখানে যে সেই ভয়াবহ পাহাড়ের ঝড় নামল, আমার ঠিক মনে পড়ে না এখন, তবে রেলপথের প্রায় প্রান্ত সীমায় এসে পড়েছি। ওঃ সে কী ঝড় সেই দুর্দান্ত ঝড় ঠেলে একটু একটু করে এগুচ্ছিল আমাদের গাড়ি–অবশেষে একেবারেই থেমে গেল। সামনের রেললাইন ছোট বড় পাথরের টুকরোয় ছেয়ে গেছে –সেই সব চাঙর না সরিয়ে গাড়ি চালানোই অসম্ভব। এতএব পিছননা ছাড়া উপায় ছিল না।
অনেকক্ষণ ধরে এক মাইল আমরা পিছোলাম। এত আস্তে গাড়ি চলছিল, চলছিল আর থামছিল যে মানুষ হেঁটে গেলে তার চেয়ে বেশি যায়। কিছু পিছিয়েই কি রেহাই আছে? একটু পরেই জানা গেল যে পেছনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ধ্বস নেমেছে। ঘণ্টাখানেক আগে যে রেলপথ কাঁপিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটেছে, এখন কোথাও তার চিহ্নই নেই।
অতএব আবার এগুতে হলো। যেখানে যেখানে পাথরের টুকরো জমেছে, আমার সব নেমে লাইল পরিষ্কার করব ঠিক হলো। তা ছাড়া আর কি উপায় বলো? কিন্তু সেদিকেও ছিল অদৃষ্টের পরিহাস। কিছুদুর এগিয়েই ঝড়ের প্রবল ঝাঁপটায় ট্রেন ডিরেলড হয়ে গেল। লাইন থেকে পাথর তোল আরেক কথা। পাঁচ দশজন মিলে অনেক ধরাধরি করলে এক-আধটা পাথরের চাঙড় যে না সরানো যায় তা নয়, কিন্তু সবাই মিলে বহুৎ ধ্বস্তাধস্তি করলেও গাড়িকে লাইনে তোলা দূরে থাক এক ইঞ্চিত নড়ানো যায় না। এমন কি আমরা ঊনিশজন মিলেও যদি কোমর বেঁধে লাগি, তাহলেও তার একটা কামরাও লাইনে তুলতে পারব কিনা সন্দেহ! তারপরে ঐ লম্বা চওড়া ইঞ্জিন-ওকে তুলতে হলেই তো চক্ষুস্থির! ওটা কত মণ কে জানে। আমরা ইঞ্জিনের দিকে একবার দৃকপাত করে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম।
পেছনের অবস্থা তো দেখেই আসা গেল, সামনেও যদি তাই ঘটে থাকে, তাহলেই তো চক্ষুস্থির! কেন না যেদিক থেকেই হোক, রেলপথ তৈরি করে সাহায্য এসে পৌঁছিতে কদিন লাগবে কে জানে। চারিধারে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল, একশো মাইলের ভেতরে মানুষের বাসভূমি আছে কিনা সন্দেহ! ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গের যা খাবার-দাবার তা তো এক নিঃশ্বাসেই নিঃশেষ হবে তারপর? যদি আরো দুদিন এইভাবে থাকতে হয়? আরো দু-সপ্তাহ? কিম্বা আরো দু-মাস? ভাবতেও বুকের রক্ত জমে যায়।
পরের কথা তো পরে–এখন কি করে রক্ষা পাই? যে প্রবল, গাড়ি সমেত উড়িয়ে না নিয়ে যায় তো বাঁচি। মাঝে মাঝে যা এক-একটা ঝাঁপটা দিচ্ছিল, উড়িয়ে না নিক, গাড়িকে কাত কিম্বা চিতপাৎ করার পক্ষে তাই যথেষ্ট। নিজের নিজের রুচিমত দুর্গানাম, রামনাম কিম্বা ত্রৈলঙ্গস্বামীর নাম জপতে শুরু করলাম আমরা।
সে-রাত তো কাটল কোনোরকমে, ঝড়ও থেমে গেল ভোরের দিকটায়। কিন্তু ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে খিদেও জোর হয়ে উঠল। বর্মার হাওয়ায় খুব খিদে হয় শুনেছিলাম, প্রথম দিনেই সেটা টের পাওয়া গেল। খিদের বিশেষ অপরাধ ছিল না যে হাওয়াটা কাল আমাদের ওপর দিয়ে গেছে।
কিন্তু নাঃ, কারু টিফিন ক্যারিয়ারে কিছু নেই, যার যা কিছু কাল রাত্রের চেটে-পুটে সাবাড় করেছে। কেবল অ্যালুমিনিয়াম প্লেটগুলো পড়ে রয়েছে, আমাদের উদরের মত শোচনীয় অবস্থা–একদম ফাঁকা। সমস্ত দিন যে কি অস্বান্তিতে কাটল কি বলব! রাত্রে কষ্টকল্পিত নিদ্রার মধ্যে তবু কিছু শান্তির সন্ধান পাওয়া গেল–বড় বড় ভোজের স্বপ্ন দেখলাম।
দ্বিতীয় দিন যা অবস্থা দাঁড়াল, তার আর কর্তব্য নয়। সমস্ত সময় গল্প গুজব করে, বাজে বকে, উচ্চাঙ্গের গবেষণার ভান করে, খিদের তাড়নাটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করলাম! গোঁফে চাড়া দিয়ে খিদের চড়াটা দমিয়ে দিতে চাইলাম,–তারপর এল তৃতীয় দিন।
সেদিন আর কথা বলারই উৎসাহ নেই কারো রেলগাড়ির চারদিকে ঘুরে, আনাচ-কানাচ লক্ষ্য করে, অসম্ভব আহার্যের অস্তিত্ব পরিকল্পনায় সেদিনটা কাটল। চতুর্থ দিন আমাদের নড়া-চড়ার স্পৃহা লোপ পেল–সবাই এক-এক কোণে বসে দারুণভাবে মাথা ঘামাতে লাগলাম।
তারপর পঞ্চম দিন। নাঃ, এবার প্রকাশ করতেই হবে কথাটা-আর চেপে রাখা চলে না। কাল সকাল থেকেই কথাটা আমাদের মনে উঁকি মারছিল, বিকেল নাগাদ কায়েম হয়ে বসেছিল এখন প্রত্যেকের জিভের গোড়ায় এসে অপেক্ষা করছে সেই মারাত্মক কথাটা–বোমার মত এই ফাটল বলে। বিবর্ণ রোগা, বিশ্রী বিশ্বনাথবাবু উঠে দাঁড়ালেন, বক্তৃতার কায়দায় শুরু করলেন–সমবেত ভদ্রমহোদয়গণ–
কি কথা যে আসছে আমরা সকলেই তা অনুমান করতে পারলাম। উনিশজোড়া চোখের ক্ষুধিত দৃষ্টি এক মুহূর্তে যেন বদলে গেল, অপূর্ব্ব সম্ভাবনার প্রত্যাশায় সবাই উদগ্রীব হয়ে নড়ে-চড়ে বসলাম।
বিশ্বনাথবাবু বলে চারজন–ভদ্রমহোদয়গণ, আর বিলম্ব করা চলে না। অহেতুক লজ্জা, সঙ্কোচ বা সৌজন্যের অবকাশ নেই। সময় খুব সংক্ষিপ্ত–আমাদের মধ্যে কোন ভাগ্যবান ব্যক্তি আজ বাকি সকলের খাদ্য জোগাবেন, এখন আমাদের তা স্থির করতে হবে।
শৈলেশবাবু উঠে বললেন, আমি ভোলানাথবাবুকে মনোনীত করলাম।
ভোলানাথবাবু বললেন, কিন্তু আমার পছন্দ অমৃতবাবুকেই।
অমৃতবাবু উঠলেন–অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে তিনি লজ্জিত কি মর্মাহত বোঝা গেল না, নিজের সুস্পষ্ট দেহকেই আজ সবচেয়ে বড় শত্রু বলে তার বিবেচনা হলো। আমতা আমতা করে তিনি বললেন, বিশ্বনাথবাবু আমাদের মধ্যে প্রবীণ এবং শ্রদ্ধেয়, তা ছাড়া তিনি একজন বড় বক্তাও বটেন। আমার মতে প্রাথমিক সম্মানটা তাকেই দেওয়া উচিত, অতএব তার সপক্ষে আমি নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করছি।
কমল দত্ত বললেন, যদি কারুর আপত্তি না থাকে তাহলে অমৃতবাবুর অভিলাষ গ্রাহ্য করা হবে।
সুধাংশুবাবু আপত্তি করাতে অমৃতবাবুর পদত্যাগ অগ্রাহ্য হলো, এই একই কারণে ভোলানাথবাবুর রেজিগনেশনও গৃহীত হলো না।
শঙ্করবাবু বললেন, ভোলানাথবাবু এবং অমৃতবাবু–এঁদের মধ্যে কার আবেদন গ্রাহ্য করা হবে, অতঃপর ভোটের দ্বারা তা স্থির করা যাক।
আমি এই সুযোগ গ্রহণ করলাম–ভোটাভুটির ব্যাপারে একজন চেয়ারম্যান দরকার, নইলে ভোট গুনবে কে? অতএব আমি নিজেকে চেয়ারম্যান মনোনীত করলাম।
ওদের মধ্যে আমিই দূরদর্শী, সাহায্য এসে না পৌঁছানো তক নিত্যকার ভোটায়নের জন্যে চেয়ারম্যানকেই কষ্ট করে টিকে থাকতে হবে, শেষ পর্যন্ত, এটা আমি সূত্রপাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। অমৃতবাবুর দিকেই সকলের দৃষ্টি নিবন্ধ থাকতে, আমি সকলের বিনা অসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়ে গেলাম।
অতঃপর প্রভাসবাবু বললেন, আজকের দুপুরবেলার জন্যে দুজনের কাকে বেছে নেওয়া হবে, সেটা এবার সভাপতিমশাই ব্যালটের দ্বারা স্থির করুন।
নাদুবাবু বললেন–আমার মত ভোলানাথবাবু নির্বাচনের গৌরব লাভের অযোগ্য। যদিও তিনি কচি এবং কাঁচা, সেইসঙ্গে তিনি অত্যন্ত রোগা ও সিঁড়িঙ্গে। অমৃতবাবুর পরিধিকে এই দুঃসময়ে, আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না!
শৈলেশবাবু বললেন, অমৃতবাবুর মধ্যে কি আছে? কেবল মোটা হাড় আর ছিবড়ে। তাছাড়া পাকা মাংস আমার অপছন্দ, অত চর্বিও আমার ধাতে সয় না। সেই তুলনায় ভোলানাথবাবু হচ্ছে ভালুকের কাছে পাঠা। ভালুকের ওজন বেশি হতে পারে–কিন্তু ভোজনের বেলায় পাঠাতেই আমাদের রুচি।
নাদুবাবু বাধা দিয়ে বললেন, অমৃতবাবুর রীতমত মানহানি হয়েছে, তাকে ভালুক বলা হয়েছে–অমৃতবাবুর ভয়ানক রেগে যাওয়া উচিত আর প্রতিবাদ করা উচিত–
অমৃতবাবু বললেন, শৈলেশবাবু ঠিকই বলেছেন, এত বড় খাঁটি কথা কেউ বলেনি আমার সম্বন্ধে। আমি যথার্থই একটা ভালুক।
অমৃতবাবুর মত কূটতার্কিক যে এত সহজে পরের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন, আশা করতে পারিনি। বুঝতে পারলাম, তার আত্মগ্লানির মূলে রয়েছে stuggle for existence। যাক, ব্যালট নেওয়া হলো। কেবল ভোলানাথবাবুর নিজের ছাড়া আর সকলের ভোট তার সপক্ষে গেল। অমৃতবাবুর বেলাও তাই, একমাত্র অমৃতবাবু স্বয়ং নিজের বিপক্ষে ভোট দিলেন।
অগত্যা দুজনের নাম একসঙ্গে দুবারব্যালটে দেওয়া হলো–আবার দু জনেই সমান সমান ভোট পেলেন। অর্ধেক লোক পরিপুষ্টতার পক্ষপাতী, বাকি অর্ধেকের মত হচ্ছে, যৌবনে দাও রাজটীকা।
এরূপ ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান সভাপতির ওপর নির্ভর করে; আমার ভোটটা অমৃতবাবুর তরফে দিয়ে অশোভন নির্বাচন প্রতিযোগিতার অবসান করলাম। বাহুল্য, এতদিনের একাদশীর পর অমৃতে আমার বিশেষ আরুচি ছিল না।
ভোলানাথবাবু পরাজয়ে তাঁর বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ অসন্তোষ দেখা গেল, তারা নতুন ব্যালট দাবি করে বসলেন। কিন্তু রান্নাবান্না যোগাড়ের জন্য মহাসমারোহে সভাভঙ্গ হয়ে যাওয়ায়, ভোলানাথবাবুকে বাধ্য হয়ে স্থগিত রাখতে হলো। তাঁর পৃষ্ঠপোষকরা নোটিশ দিয়ে রাখলেন, পরদিনের নির্বাচনে তারা পুনরায় ভোলানাথবাবুর নাম তুলবেন। কালও যদি যোগ্যতম ব্যক্তির অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে তাঁরা সবাই একযোগে হাঙ্গার স্ট্রাইক করবেন বলে শাসালেন।
কয়েক মুহূর্তেই কি পরিবর্তন। পাঁচদিন নিরাহারের পর চমৎকার ভোজের প্রত্যাশায় প্রত্যেকের জিভই তখন লালায়িত হয়ে উঠেছে। এক ঘন্টায় মধ্যে আমরা যেমন আশ্চর্য রকম বদলে গেলাম–কিছুক্ষণ আগে আমরা ছিলাম আশাহীন, ভাষাহীন, খিদের তাড়নায় উন্মাদ–অর্ধমৃত; আর তখন আমাদের মনে আশা, চোখে দীপ্তি, অন্তরে এই কথাটা তুলতে যদি চলে তো তুলবেন না, ভালবাসা–এমন প্রগাঢ় প্রেম, যা মানুষের প্রতি মানুষ কদাচই অনুভব করে! এমন একটা অপূর্ব্ব পুলক, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অর্ধ-মুমূর্ষুতা থেকে একেবারে নতুন জীবন। শপথ করে বলতে পারি তেমন অনির্বচনীয় অনুভূমির আস্বাদ জীবনে আমি পাইনি।
অমৃতকে আমি আন্তরিক পছন্দ করেছিলাম। সত্যিই ভাল লেগেছিল ওকে আমার। স্কুল মাংসল বপু, যদিও কিছু অতিরিক্ত রোমশ (শৈলেশবাবু ভালুক বলে বেশি ভুল করেননি), তবু ওঁকে দেখলেই চিত্ত আশ্বস্ত হয়, মন কেমন খুশি হয়ে ওঠে। ভোলানাথও মন্দ নন অবশ্য; যদিও একটু রোগা, তবু উঁচুদরের জিনিস তাতে সন্দেহ নেই। তবে পুষ্টিকারিতা এবং উপকারিতার দিক থেকে বিবেচনা করলে অমৃতর দাবি সর্ব প্রথম। অবশ্য ভোলানাথের উৎকৃষ্টতার সপক্ষেও অনেক কিছু বলবার আছে, তা আমি অস্বীকার করবার চেষ্টা করব না। তবু মধ্যাহ্নভোজনের পাতায় পড়বার যোগ্যতা ওঁর ছিল না, বড়-জোর বিকেলের জলখাবার হিসেবে ওঁকে ধরা যেতে পারে।
দীর্ঘ উপবাসের পর প্রথম দিনের আহারটা একটু গুরুতরই হয়ে গেল। অমৃত এতটা গুরুপাক হবে আমরা ভাবিনি–বাইরে থাকতে যিনি আমাদের হৃদয়ে এতটা আবেগ সঞ্চার করেছিলেন, ভিতরে গিয়ে যথেষ্টই বেগ দিলেন। সমস্ত দিন আমরা অমৃতের সেঁকুর তুললাম। সকলেরই পেট (এবং সঙ্গে মন খারাপ থাকায়, পরদিন লঘু পথ্যের ব্যবস্থাই সঙ্গত স্থির হলো–অতএব কচি ও কাঁচা ভোলানাথবাবুকে জলযোগ করেই সেদিন নিরস্ত হলাম। তারপর দিন আমরা অজিতকে নির্বাচিত করলাম। ওরকম সুস্বাদু কিছু আর কখনো আমরা খাইনি জীবনে। সত্যিই ভারী উপাদেয়, তার বউকে পরে চিঠি লিখে আমি সে-কথা জানিয়েছি। এক মুখে তার প্রশংসা করে শেষ করা যায় না–চিরদিন ওকে আমার মনে থাকবে। দেখতেও যেমন সুশ্রী, তেমনি মার্জিত রুচি, তেমনি চারটে ভাষায় ওর দখল ছিল। বাংলা তো বলতে পারতই। তা ছাড়া ইংরাজি, হিন্দি এবং উড়েতেও অনর্গল তার খই ফুটত। হিন্দি একটু ভুলই বলত, তা বলুকগে; তেমনি এক-আধটুকু ফ্রেঞ্চ আর জামার্নও ওর জানা ছিল, তাতেই ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছল। ক্যারিকেচার করতেও জানত, সুর ভাঁজতেও পারত,–বেশ মজলিসী ওস্তাদ লোক এক কথায় অমন সরেশ জিনিশ আর কখনো ভদ্রলোকের পাতে পড়েনি। খুব বেশি ছিবড়েও ছিল না, খুব চর্বিও নয় ওর ঝোলটাও ভারি খাসা হয়েছিল। এখনো যেন সে আমার জিভে লেগে রয়েছে।
তার পরদিন বিশ্বনাথবাবুকে আমরা আত্মসাৎ করলাম–বুড়োটা যেমন ভূতের মত কালো তেমনি ফাঁকিবাজ, কিছু তার গায়ে রাখেনি, যাকে বলে আমড়া-আঁটি আর চামড়া। পাতে বসেই আমি ঘোষণা করতে বাধ্য হলাম, বন্ধুগণ, আপনাদের যা খুশি করতে পারেন, আবার নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমি হাত গুটোলাম। শৈলেশবাবু আমার পথে এলেন, বললেন–আমারো ঐ মত। ততক্ষণ আমিও অপেক্ষা করব।
অজিতকে সেবা করার পর থেকে আমাদের অন্তর যে আত্মপ্রসাদের ফাল্গুধারা আগোচরে বইছিল, তাকে ক্ষুণ্ণ করতে ইচ্ছে ছিল না। কাজেই আবার ভোট নেওয়া শুরু হলো-এবার সৌভাগ্যক্রমে শৈলেশবাবুই নির্বাচিত হলেন। তার এবং আমাদের উভয়েররই সৌভাগ্য বলতে হবে; কেন না, কেবল রসিক লোক বলেই তাকে জানতাম সরস লোক বলেও জানলাম তাঁকে। তোমাদের বিশ্বকবির ভাষায় বলতে গেলে, তার যে-পরিচয় আমাদের কাছে অজ্ঞাত ছিল; সেই নতুন পরিচয়ে তিনি আমাদের অন্তলঙ্গ হলেন।
তারপর? তারপর–একে একে ব্যোমকেশ, নিরঞ্জন, কেদারনাথ, গঙ্গাগোবিন্দ– গঙ্গগোবিন্দ নির্বাচনে খুব গোলমাল হয়েছিল, কেন না ও ছিল যেমন রোগা তেমনি বেঁটে তারপর নিতাই থোকদার-থোকদারের এক পা ছিল কাঠের সেটা থোখ ক্ষতি, সুস্বাদুতার দিক থেকে সে মন্দ ছিল না, নেহাত–অবশেষে এক ব্যাটা ভাগ্যবৎ, সঙ্গী হিসাবে সে মোটেই বাঞ্ছনীয় ছিল না, খাদ্য হিসেবেও তাই। তবে রিলিফ এসে পৌঁছবার আগে যে তাকে খতম করতে পারা গেছল এইটাই সুখের বিষয়। নিতান্তই একটা আপদ–চুকানো দায় কার কি।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আমি ভদ্রলোকের কাহিনী, শুনছিলাম, এতক্ষণে আমার বাক্যস্ফুর্তি হলো–তাহলে রিলিফ এসেছিল শেষে?
হ্যাঁ, কবির ভাষায়, একদাসুপ্রভাতে, সুন্দর সূর্যালোকে, নির্বাচনও সদ্য শেষ হয়েছে, আরও রিলিফ ট্রেনও এসে পৌঁছেছিল, তা নইলে আজ আমাকে দেখবার সৌভাগ্য হত না তোমার।…এই যে বারাকপুর এসে পড়ল, এখানেই নামব। বারাকপুরেই আমি থাকি গঙ্গার ধারে, যদি কখনো সুবিধে হয়, দু একদিনের জন্যে বেড়াতে এসো আমার ওখানে। ভারী খুশি হব তাহলে। তোমাকে দেখে আমার কেমন বাৎসল্য–ভাব জাগছে। বেশ বাল লাগল তোমাকে, এমন কি অজিতকে যথটা ভাল লেগেছিল, প্রায় ততখানিই, একথা বললে মিথ্যা বলা হয় না। তুমিও খাসা ছেলে,–আচ্ছা আসি তাহলে।
ভদ্রলোক বিদায় হলেন। এমন বিমূঢ়, বিভ্রান্ত আর বিপর্যস্ত আমি কখনো হইনি। বৃদ্ধ চলে যাবার পর আমার আত্মাপুরুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তাঁর কণ্ঠস্বর মৃদু- মধুর, চালচলন অত্যন্ত ভদ্র–কিন্তু হলে কি হবে, যখনই তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন, আমার হাড়-পাঁজরা পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। কি রকম যেন ক্ষুধিত দৃষ্টি তাঁর চোখে–বাবাঃ। তারপর তার বিদায়-বাণীতে যখন জানালেন যে তার মারাত্মক স্নেহ-দৃষ্টি লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছে, এমন কি তাঁর মতে আমি অজিতের চেয়ে কোনো অংশেই ন্যূন নই,–তেমনি খাসা বোধকরি তেমনি উপাদেয়–তখন আমার বুকের কাঁপুনি পর্যন্ত বন্ধ হবার মত হয়েছিল।
তিনি যাবার আগে মাত্র একটি প্রশ্ন তাঁকে করতে পেরেছিলাম–শেষ পর্যন্ত আপনাকেও ওরা নির্বাচন করেছিল? আপনি তো সভাপতি ছিলেন, তবে কি করে এটা হল?
শেষ পর্যন্ত আমিই বাকি ছিলাম কিনা। আগের দিন ভ্যাগাবণ্ডটার পালা গেছল; আমি একাই সমস্তটা ওকে সাবাড় করেছিলাম। বলব কি, পাহাড়ের যেমন আমার খিদে হতো, তেমনি হজম করবার ক্ষমতাও খুব বেড়ে গেছল। হতভাগা লোফারটা শেষ পর্যন্ত টিকেই ছিল, তার কারণ অখাদ্য লোক বলে তাকে খাদ্য করতে সবার আপত্তি ছিল। কিন্তু খাবার জিনিসে অত গোঁড়ামি নেই আমার–উদয়ের ব্যাপারে আমি খুব উদার। তাছাড়া এতদিনেও নির্বাচিত হবার সুযোগ না পেয়ে নিশ্চয়ই অত্যন্ত মনোক্ষোভ জেগেছিল ওর; আমার আত্মমর্যাদা লাভ করে সে যে কৃতার্থ হয়েছে এতে আমার সন্দেহ নেই।
হ্যাঁ, তুমি কি জানতে চাচ্ছিলে কি করে আমার পালা হলো? পরদিন আবার নির্বাচনের সময় এল। কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায়, আমি যথারীতি নির্বাচিত হয়ে গেলাম বিনা বাধায়। তারপর কারু আপত্তি না থাকায়, আমি তৎক্ষণাৎ সেই সম্মানার্য পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আপত্তি করবার কেউ ছিল না তখন। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছিল ট্রেনটা–দুরূহ কর্তব্যের দায় থেকে রেহাই পেলাম আমি–নিজেকে আর গলাধঃকরণ করতে হলো না আমায়!