অশ্বত্থামা হতঃ ইতি
পাশের বাড়ি বেরিবেরি হওয়ার পর থেকেই মন খারাপ যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক যে ছিল, তা নয়, সম্পর্ক হবার আশঙ্কাও ছিল না, কিন্তু বেরিবেরির সঙ্গে সম্পর্ক হতে কতক্ষণ? যে বেপরোয়ো ব্যরাম কোনদেশ থেকে এসে এতদূর পর্যন্ত এগুতে পেরেছে, তার পক্ষে আর একটু কষ্ট স্বীকার করা এমন কি কঠিন!
কদিন থেকে শরীরটাও খারাপ বোধ করতে লাগলাম। মনের মধ্যে স্বগতোক্তি শুরু হয়ে গেল–ভাল করছ না হে, অশ্বিনী! সময় থাকতে ডাক্তার-টাক্তার দেখাও।
মনের পরামর্শ মানতে হোলো। ডাক্তারের কাছেই গেলাম। বিখ্যাত গজেন ডাক্তারের কাছে। আমাদের পাড়ায় ডাক্তার এবং টাক্তার বলতে একমাত্র তাঁকেই বোঝায়।
তিনি নানারকমের পরীক্ষা করলেন, পালসের বীট গুণলেন, ব্লাডপেসার নিলেন, স্টেথিসকোপ বসালেন, অবশেষে নিছক আঙুলের সাহায্যে বুকের নানাস্থান বাজাতে শুরু করে দিলেন। বাজনা শেষ হলে বললেন–আর কিছু না, আপনার হার্ট ডায়ালেট করেছে।
বলেন কি গজেনবাবু?–আমার পিলে পর্যন্ত চমকে যায়।
তিনি দারুন গম্ভীর হয়ে গেলেন–কখনো বেরিবেরি হয়েছিল কি?
হুঁ হয়েছিল। পাশের বাড়িতে। ভয়ে ভয়ে বলতে হোলো। ডাক্তারের কাছে ব্যারাম লুকিয়ে লাভ নেই!
ঠিকই ধরেছি। বেরিবেরির আফটার–এফক্ট-ই এই।
তা হলে কি হবে? আমি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লাম–তা হলে কি আমি আর বাঁচবো না?
একটু শক্ত বটে। সঙ্গীন কেস। এরকম অবস্থায় যে-কোন মুহূর্তে হার্টফেল করা সম্ভব।
অ্যাঁ! বলেন কি গজেনবাবু! না, আপনার কোনো কথা শুনব না। আমাকে বাঁচাতেই হবে আপনাকে।–করুণ কণ্ঠে বলি–তা যে করেই পারেন আমি না বেঁচে থাকলে আমাকে দেখবে কে? আমাকে দেখবার আর কেউ থাকবে না যে। কেউ আমার নেই।
পাঁচটাকা ভিজিট দিয়ে ফেললাম।–আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখা যাক–গজেন ডাক্তার বললেন–একটা ভিজিটালিসের মিক্সচার দিচ্ছি, আপনাকে। নিয়মিত খাবেন, সারলে ওতেই সারবে।
আমি আর পাঁচটাকা ওঁর হাতে গুঁজে দিলাম–তবে তাই কয়েক বোতল বানিয়ে দিন আমায়, আমি হরদম খাবো।
না, হরদম নয়। দিনে তিনবার। আর, কোথাও চেঞ্জে যান। চলে যান–পশ্চিম টশ্চিম। গেলে ভালো হয়। সেখানে গিয়ে আর কিছু নয়, একদম কমপ্লিট রেস্ট।
প্রাণের জন্য মরীয়া হতে বেশী দেরী লাগে না মানুষের। বললাম–আচ্ছা, তাই যাচ্ছি না হয়। ডালটনগঞ্জে আমার বাড়ি, সেখানেই যাবো।
কমপ্লিট রেস্ট, বুঝেছেন তো? হাঁটা-চলা, কি ঘোরাফেরা, কি দৌড়ঝাঁপ, কি কোনো পরিশ্রমের কাজ একদম না! করেছেন কি মরেছেন–যাকে বলে হার্টফেল–দেখতে শুনতে দেবে না–সঙ্গে সঙ্গে খমত। বুঝেছেন তো অশ্বিনীবাবু?
অশ্বিনীবাবু হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, ডাক্তার দেখাবার আগে বুঝেছেন এবং পরে বুঝেছেন–যেদিনই পাশের বাড়িতে বেরিবেরির সূত্রপাত হয়েছে, সেদিনই তিনি জেনেছেন তার জীবন সংশয়। তবু গজনবাবুকে আশ্বান্ত করি–নিশ্চয়! পরিশ্রম না করার জন্যই পরিশ্রম, তাই করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এখন থেকে অলস হবার জন্যই আমার নিরলস চেষ্টা থাকবে। এই বলে আমি, ওরফে অশ্বিনীবাবু, বিদায় নিলাম।
মামারা থাকেন ডালটনগঞ্জে। সেখানে তাঁদের ক্ষেত-খামার। মোটা বেতনের সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমিটমি কিনে চাষবাস নিয়ে পড়েছেন। বেকার-সমস্যা সমাধানের মতলব ছোটবেলা থেকেই মামাদের মনে ছিল, কিন্তু চাকরির জন্য তা করতে পারছিলেন না। চাকরি করলে আর মানুষ বেকার থাকে, কি করে? সমস্যাই নেই তো সমাধান করবেন কিসের? অনেকদিন মনোকষ্টে থেকে অবশেষে তারা চাকরিই ছাড়লেন।
তারপরেই এই চাষাবাস। কলকাতার বাজারে তাদের তরকারি চালান আসে। সরকারী-গর্বে অনেককে গর্বিত দেখেছি, কিন্তু তরকারির গর্ব কেবল আমার মামাদের! একচেটে ব্যবসা, অনেকদিন থেকেই শোনা ছিল, দেখার বাসনাও ছিল; এবার এই রোগের অপূর্ব্ব সুযোগ ডালটনগঞ্জে গেলাম, মামার বাড়ির যাওয়া হোলো, চেঞ্জেও যাওয়া হোলো এবং চাই কি, তাঁদের সাম্রাজ্য চোখেও দেখতে পারি, চোখেও দেখতে পারি হয়তো বা।
মামারা আমাকে দেখে খুশী হয়ে ওঠেন।বেশ বেশ, এসেছে যখন, তখন থাকো কিছুদিন। বড়মামা বলেন।
থাকবই তো পায়ের ধুলো নিতে নিতে বলি–চেঞ্জের জন্যই তো এলাম।
মেজমামা বলেন–এসেছ ভালই করেছ, এতদিনে পটলের একটা ব্যবস্থা হোলো।
ছোটমামা সায় দেন–হ্যাঁ, একটা দুর্ভাবনাই ছিল যাক, তা ভালোই হয়েছে।
তিন মামাই যুগপৎ ঘাড় নাড়তে থাকেন।
বুঝলাম, মামাতো ভাইদের কারো গুরুভার আমায় বহন করতে হবে। হয়তো তাদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। তা বেশ তো, ছেলেপড়ানো এমন কিছু শক্ত কাজ নয় যে, হার্টফেল হয়ে যাবে। গুরুতর পরিশ্রম কিছু না করলেই হোলো; টিউশনির যেগুলো শ্রমসাধ্য অংশ–পড়া নেওয়া, ভুল করলে শোধরাবার চেষ্টা করা, কিছুতেই ভুল শোধরালে শেষে পাখাপেটা করা এবং মাস ফুরোলে প্রাণপণে বেতন বাগানন, এখন থেকেই এগুলো বাদ দিতে সর্তক থাকলাম। হা, সাবধানেই থাকবো, রীতিমতই, যাতে কান মোলর কষ্ট স্বীকারটুকুও না করতে হয়, বরঞ্চ প্রশ্রয়ই দেব পটলকে–যদি পড়াশুনায় ফাঁকি দিতে থাকে, কিংবা কাঠফাটা রোদ–জেগে উঠলেই ওর যদি ডাণ্ডাগুলিখেলার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, ভেগে পড়তে চায়, আমার উৎসাহই থাকবে ওর তরফে। ভ্রাতৃপ্রীতি আমার যতই থাক, প্রাণের চেয়ে পটল কিছু আমার আপনার নয়, তা মামাতো পটলই কি, আর মাসতুতো পটলই কি!
মামাতো ভাইদের সঙ্গে মোলাকাত হতে দেরী হোলো না। তিনটে ডানপিটে বাচ্চা-মাথা পিছু একটি করে গুণে দেখালাম।–এর মধ্যে কোনটি পটল, বাজিয়ে দেখতে হয়। আলাপ শুরু করা গেল–তোমার নাম কি খোকা?
রা, ঠনাঠন।
অ্যাঁ। সে আবার কি? পরিচয়ের সূত্রপাতেই পিলে চমকে যায় আমার। দ্বিতীয় জনের। অযাচিত জবাব আসে–হামার নাম ভটরিদাস হো!
আমার তো দম আটকাবার যোগাড়! বাঙ্গালীর ছেলের এ সব আবার কি নাম! এমন বিধঘুঁটে এরকম বদ নাম কেন বাঙ্গারীর?
বড়মামা পরিষ্কার করে দেন–যে দেশে থাকতে হবে, সেই দেশের দস্তর মানতে হবে না? তা নইলে বড় হয়ে এরা এখানকার দশজনের সাথে মিলে মিশে খাবে কিসে, মানিয়ে চলবেই বা কি করে?
মেজমামা বলেন–এ সব বাবা, ডালটনী নাম। সে দেশের যা দস্তুর!
ছোটমামা বলেন–এখানকার সবাই বাঙালীকে বড় ভয় করে। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি যুদ্ধ করতে আসিনি তো! তাই এদের পক্ষে ভয়ঙ্কর বাঙ্গালী নাম সব বাদ দিয়ে এদেশী সাদাসিদে নাম রাখা।
তৃতীয়টিকে প্রশ্ন করতে আমার ভয় করে–তুমিই তবে পটল?
ছেলেটির দিক থেকে একটা ঝটকা আসে–আঃ! হামার নাম গিধৌড় বা!
হার্টফেলের একটা ভয়ানক ধাক্কা ভয়ানকভাবে কেটে যায়। পকেট থেকে বের করে চটকরে এক, দাগ ভিজিটালিস খেয়ে নিই–পটল তবে কার নাম?
তিনজনেই ঘাড় নাড়ে–জানহি না তো!
তুমহারা নাম কেয়া জী? জিগ্যেস করে ওদের একজন।
আমার নাম? আমার নাম? আমতা আমতা করে বলি–আমার নাম শিব্রাম ঠনাটন!
যস্মিন দেশে যদাচারঃ। ডালটনগঞ্জের ডালভাঙ্গা কায়দায় আমার নামটার একটা হিন্দি সংস্করণ বার করতে হয়।
ভটরিদাস এগিয়ে এসে আমার হাতের শিশিটা হস্তগত করে–সিরপ হ্যায় কেয়া?
তিনটি বোতল ওদের তিনজনের হাতে দিই মেজমামা একটি লেবেলের উপর দৃক পাত করে বলেন–সিরপ নেহি! ভিজটলিস্ হ্যায়। খাও মৎ-তাৰু উপর রাখ দেও।
ভটরিদাস রাম ঠনঠনকে বুঝিয়ে দেয়–সমঝা কুছ? ইসসে হি ডিজ লনঠন বনতি। এহি দুবাই সে।
বড়মামা বলেন–শিবু সেই কাল বিকেলে গাড়িতে উঠেছে, ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়? কিছু খেয়েদেয়ে নাও আগে।
এ্যাম্বক ওঝার ডাক পড়ল। ছোটমামা আমার বিস্মিত দৃষ্টির জবাব দেন–তোমার দাদামশায়ের সঙ্গে মামীরা সব তীর্থে গেছেন কিনা, তাই দিনকত-র জন্য এই মহারাজ!কে কাজ চালানোর মত রাখা হয়েছে।
তেইশটা চাপাটি আর কুছ তরকারি নিয়ে মহারাজের আবির্ভাব হয়। তিনটি পাচাটি বা চপেটাঘাত সহ্য করতেই প্রাণ যায় যায়, তারপর কিছুতেই আর টানতে পারি না। মামারা হাসতে থাকেন। অগত্যা লজ্জায় পড়ে আর আড়াইটা কোনো রকমে গলাধঃকরণ করি। টানে টুনে পাঠাইল গলায় তলায়, ঠেলে ঠুলে।
মামা ভয়ানক হাসেন–তোমার যে দেখি পাখির খোরাক হে!
আমি বলি–খেতে পারতাম। কিন্তু পরিশ্রম করা আমার ডাক্তারের নিষেধ কিনা।
আঁচিয়ে এসে লক্ষ্য করি, আমার ভুক্তাবশেষ সেই সাড়ে সাতটা চাপাটি ফ্রম রাম ঠনঠন টু গিধৌর চক্ষের পলকে নিঃশেষ করে এনেছে। এই দৃশ্য দেখাও কম শ্রমসাধ্য নয়, তৎক্ষণাৎ চার দাগ ভিজিটালিস খেতে হয়।
বড়মামা বলেন–চলো একটু বেড়িয়ে আসা যাক। নতুন দেশে এসেছ জায়গাটা দেখবে না? বলে আমাকে টেনে নিয়ে চলতে থাকেন।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরুতে হয়। ডাক্তারের মতে বিশ্রাম দরকার–একেবারে কমপ্লিট রেসট। কিন্তু মামারা রেসট কাকে বলে জানেন না, আলস্য ওঁদের দুচক্ষের বিষ। নিজেরা অলস তো থাকবেনই না, অন্য কাউকে থাকতেও দেবেন না।
সারা ডালটনগঞ্জটা ঘুরলাম, অনেক দ্রষ্টব্য জায়গা দেখা গেল, যা দেখবার কোনো প্রয়োজনই আমার ছিল না কোনদিন। পুরো সাড়ে তিন ঘণ্টায় পাক্কা এগারো মাইল ঘোরা হোলো। প্রতি পদক্ষেপেই মনে হয়, এই বুঝি হার্টফেল করল। কিন্তু কোন রকমে আত্মসংবরণ করে ফেলি। কি করে যে করি, আমি নিজেই বুঝতে পারি না।
বাড়ি ফিরে এবার বিয়াল্লিশটা চাপাটির সম্মুখীন হতে হয়। পাখির খোরাক বলে আমাকেই সব থেকে কম দেওয়া হয়েছে। পরে খাব জানিয়ে এক ফাঁকে ওগুলো ছাদে ফেলে দিয়ে আসি, একটু পরে গিয়ে দেখি,তার চিহ্নমাত্রও নেই। পাখির খোরাক তাহলে সত্যিই!
খাবার পর শোবার আয়োজন করছি বড়মামা বলেন–আমাদের ক্ষেতখামার দেখবে চলো।
ছোটমামা বলেন–দিবানিদ্রা খারাপ। ভার খারাপ! ওতে শরীর ভেঙে পড়ে।
আমি বলি–আজ আর না, কাল দেখব।
তবে চল, দেহাতে দিয়ে আখের রস খাওয়া যাক, আখের খেত দেখেছ কখনও?
আখের রসের লালসা ছিল, জিজ্ঞাসা করলুম–খুব বেশি দূরে নয় তো?
আরে, দূর কীসের? কাছেই তো–দু-কদম মোটে।
কদবে কদম হয় জানি নে, পাক্কা চোদ্দ মাইল হাঁটা হোলো, চোখে ফুল দেখছি! তবু শুনি–এই কাছেই। এসে পড়লাম বলে।
প্রাণের আশা ছেড়েই দিয়েছি, মামার পাল্লায় পড়লে প্রাণ প্রায়ই থাকে না-রামায়ণ-মহাভারতে তার প্রমাণ আছে।
আরো দু-মাইল পরে দেহাত। আখের রস খেয়ে দেহ কাত করলাম। আমার অবস্থা দেখে মামাদের করুণা হোলো বোধ হয়, দেহাতি রাস্তা ধরে এক্কা যাচ্ছিল একটা, সেটাকে ভাড়া করে ফেললেন।
এক্কায় কখনও চড়িনি; কিন্তু চাপবার পর মনে হলো, এর চেয়ে হেঁটে ফেরাই ছিল ভালো। এক্কার এমনি দাপট যে, মুহূর্তের আমি আকাশে উদ্ধৃত হতে লাগলাম এ যাত্রার এতক্ষণে টিকে থাকলেও এ-ধাক্কার এবার গেলাম নির্ঘাত, সজ্ঞানে এক্কা-প্রাপ্তি অর দেরি নেই–টের পেলাম বেশ।
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল–এক্কায় যতক্ষণ এসেছি, তার দুই তৃতীয়াংশ সময় আকাশে আকাশেই ছিলাম, একথা বলতে পারি; কিন্তু সেই আকাশের ধাক্কাতেই সাসা গায়ে দারুণ ব্যাথা! হাড়পাজরা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে ঝরঝরে হয়ে গেয়ে বোধ হতে লাগল। তেত্রিশটা চাপাটির মধ্যে সওয়া তিনখানা আত্মসাৎ করে শুয়ে পড়লাম। কোথায় রামলীলা হচ্ছিল, মামারা দেখতে গেলেন। আমায় সঙ্গে যেতে সাধলেন, বার বার অভয় দিলেন যে এক কদমের বেশি হবে না, আমি কিন্তু ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম। ডালটনী ভাষায় এক কদম মানে যে একুশ মাইল, তা আমি ভাল রকমই বুঝেছি।
আলাদা বিছানা ছিলনা, একটিমাত্র বড় বিছানা পাতা,তাতেই ছেলেদের সঙ্গে শুতে হোলো। খানিকক্ষণেই বুঝতে পারলাম যে হ্যাঁ, সৌরজগতেই বাস করছি বটে– আমার আশেপাশে তিনটি ছেলে যেন তিন টি গ্রহ! তাদের কক্ষ পরিবর্তনের কামাই নেই। এই যেখানে একজনের মাথা দেখি, একটু পরেই দেখি, সেখানে তার পা; কানিক বাদে মাথা বা পার কোনটাই দেখতে পাই না। তার পরেই অকস্মাৎ তার কোনো একটার সঙ্গে আমার দারুণ সংঘর্ষ লাগে। চটকা ভেঙে যায়, আহত স্থানের শুশ্রূষা করতে থাকি কিন্তু ওদের–কারুর নিদ্রার বিন্দুমাত্রও ব্যত্যয় ঘটে না। ঘুমের ঘোরে যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরছে ওরা–আমিও যদি ওদের সঙ্গে ঘুরতে পারতাম, তাহোলে বেধ হয় তাল বজায় থাকত, ঠোকাঠুকি বাধার সম্ভাবনাও কমতো কিছুটা। কিন্তু মুশকিল এই ঘুরতে গেলে আমার ঘুমনো হয় না, আর ঘুমিয়ে পড়লে ঘোরার কথা একদম ভুলে যাই।
ছেলেগুলোর দেখছি পা দিয়েও বক্সিং করার বেশ অভ্যেস আছে এবং সব সময়ে নট-টু-হিট বিলো-দি-বেল্ট-এর নিয়ম মেনে চলে বলেও মনে হয় না। নাক এবং দাঁত খুব সতর্কভাবে রক্ষা করছি–ওদের ধাক্কায় কখন যে দেহচ্যুত হয়, কেবলি এই ভয়। ঘুমানোর দফা তো রফা!
ভাবছি, আর চৌকিদারিতে কাজ নেই, মাটির নেমে সটান জমিদার হয়ে পড়ি। প্রাণ হাতে নিয়ে এমন করে ঘুমনো যায় না। পোয় না আমার। এদিকে দুটো তত বাজে। নিচে নেমে শোবার উদ্যোগে আছি, এমন সময়ে নেপথ্যে মামাদের শোরগোল শোনা গেল রামলীলা দেখে আড়াইটা বাজিয়ে ফিরছেন এখন। অগত্যা মাটি থেকে পুনরায় প্রমোশন নিতে হেলো বিছানায়।
মামারা আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন, অর্থাৎ তাদের ধারণা যে, জাগালেন। তারপর ঝাড়া দু ঘণ্টা রামলীলার গল্প চলল। হনুমানের লম্পঝম্প তিন মামাকেই ভারী খুশি করেছে সে সমস্তই আমাকে শুনতে হোলো। ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে আসছিল কেবল হুঁ হাঁ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক মামা প্রশ্ন করে বসলেন–হনুমানের বাবা কে জানো তো শিব্রাম?
ঘুমের ঝোঁকে ইতিহাসটা ঠিক মনে আসছিল না। হনুমান পুরাল হলে মামাদের নাম করে দিতাম, সিঙ্গুলার অবস্থায় কার নাম করি? সঙ্কোচের সহিত বললাম–জাম্বুমান নয়তো?
বড়মামা বললেন–পাগল!
মেজমামা বললেন–যা আমরা নিঃশ্বাস টানছি, তাই।
ও! এতক্ষণে বুঝেছি!–হঠাৎ আমার বুদ্ধি খুলে যায়, বলে ফেলি চট করে–ও! যতো সব রোগের জীবাণু!
বড়মামা আবার বলেন–পাগলা!
উহুঁহুঁ!–মেজমামাও আমায় দমিয়ে দেন, বলেন–না ও সব নয়। জীবাণুটিবাণু না।
জীবাণুটিবাণুও না? তা হোলে কি তবে? আমার তো ধরণা এই সব প্রাণীরাই আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে যাতায়াত করে।–আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি।
ছোটমামা বলেন–পবনদেব।
সাক্ষাৎ পবনদেবকে নিঃশ্বাসে টানছি এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়েছি, কিংবা হয়তো ঘুমাইনি। বড়মামা আমাকে টেনে তুললেন–ওঠো, ওঠো; চারটে বেজে গেছে, ভোর হয়ে এল। মুখ হাত ধুয়ে নাও, চলো বেরিয়ে পড়ি। আমরা সকলেই প্রাতঃভ্রমণ করি রোজ। তুমিও বেড়াবে আমাদের সঙ্গে।
মেজমামা বললেন–বিশেষ করে চেঞ্জে এসেছে যখন! হাওয়া বদলাতেই এসেছো তো?
ছোটমামাও সায় দেয়–ডালটনগঞ্জের হাওয়াই হোলো আসল! হাওয়া খেতে এসে হাওয়াই যদি না খেলে, তবে আর খেলে কি?
চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে মামাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। সাড়ে সাত মাইল হাঁটবার পর বড়মামা দুধারে যতদুর যাক, বাহু বিস্তার করলেন–এই সব-সবই আমাদের জমি।
যতদুর চোখ যায়, জমি! কেবল জমিই চোখে পড়ে। মেজমামা বলেন–এবার যা আলু ফলেছিল তা যদি দেখতে! পটলও খুব হবে এবার।
ছোটমামা ঘাড় নাড়েন–আমার সব নিজেরাই করি তো! জন-মজুরের সাহায্য নিই না। স্বাবলম্বনের মত আর কী আছে? গতবারে আমরা তিন ভায়ে তুলে কুলিয়ে উঠতে পরলাম না, প্রায় আড়াই কী লক্ষ পটল এঁচোড়েই পেকে গেল। বিলকুল বরবাদ। পাকা পটল তো চালান যায় না, কে কিনবে?
বড়মামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন–তবুও তো প্রত্যেকে দশলাখ করে তুলেছিলাম।
মেজমামা আশ্বাস দেন–যাক, এবার আর নষ্ট যাবার ভয় নেই, ভাগনেটা এসে পড়েছে, বাড়তির ভাগটা ওই তুলতে পারবে।
ছোটমামা বলেন–কিন্তু এবার পটল ফলেছেও দেড়া।
তা ও পারবে। জোয়ান ছেলে– উঠে পড়ে লাগলে ও আমাদের ডবল তুলতে পারে। পারবে? বড়মামা আমার পিঠ চাপড়ান।
পৃষ্ঠপোষকতার ধাক্কা সামলে ক্ষীণস্বরে বলি–পটলের সিজনটা কবে?
আর কি, দিন সাতেক পরেই পটল তোলার পালা শুরু হবে। ছোটমামার কাছে ভরসা পাই।
চোদ্দ মাইল হেঁটে টলতে টলতে বাড়ি ফিরি। ফিরেই ভিজিটালিসের অন্বেষণে গিয়ে দেখি, তিন বোতলই ফাঁক। গিধৌড়কে জিজ্ঞাসা করি–ক্যা হুয়া।
গিধৌয় জবাব দেয়–উ দোনো খা ডালা।
ভটরি দাস প্রতিবাদে করে–নেহি জি, উ ভি খায়া! আপকো ভিজটালিস উভি খাইস।
কেবল খাইস নয়, আমাকেও খেয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি এই দারুণ পরিশ্রমের পর এখন কি করে হার্টফেলের হাত থেকে বাঁচি। আত্মরক্ষা করি আপনার?
গজেন ডাক্তারকে চিঠি লিখতে বসলাম কাল এসে অবধি আদ্যোপান্ত সব হতিহাস সবিশেষ অবশেষে জানাই–
ভিজিটালিস নেই, ভালই হয়েছে, আমার আর বাঁচাবার সাধও নেই। বাঁচতে গেলে আমায় পটল তুলতে হবে। এক-আধটা নয়, সাড়ে তিনলাখ পটল তার বেশিও হতে পারে। তুলতে হবে আমাকে। পত্রপাঠ এমন একটা ওষুধ চট করে, পাঠাবেন, যাতে এই পটল-তোলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাই এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার হার্টফেল করে। এ পর্যন্ত যা দারুণ খাটুনি গেছে, তাতেও যখন এই ডায়ালেটেড হার্ট আমার ফেল করেনি, তখন ওর ভরসা আমি ছেড়েই দিয়েছি। ওর ওপর নির্ভর করে বসে থাকা যায় না। সাড়ে তিনলক্ষ পটল তোলা আমার সাধ্য নয়, তার চেয়ে আমি একবার একটিমাত্র পটল তুলতে চাই-পটলের জিন আসার ঢের আগেই। যখন মরবারও আশা নেই, বাঁচাবারও ভরসা নাস্তি–তখন এ জীবন রেখে লাভ? ইতি মরণাপন্ন (কিংবা জীবনাপন্ন) বিনীত–ইত্যাদি।
এক সপ্তাহ গেল, দুসপ্তাহ কেটে গেল, তবু ডাক্তারের কোনো জবাব নেই, ওষুধ পাঠাবার নাম নেই। কাল সকাল থেকে পটল-পর্ব শুরু হবে ভেবে এখন থেকেই আমার স্বকম্প আরম্ভ হয়েছে। এঁটে রেখেছি মামারা রাত্রে রামলীলা দেখতে গেলেই সেই সুযোগে কলকাতার গাড়িতে সটকান দেব।
কলকাতায় ফিরেই গজেন ডাক্তারের কাছে ছুটি। গিয়ে দেখি কম্পাউন্ডার দুজন গালে হাত দিয়ে বসে আছে, রোগীপত্তর কিছু নেই। জিজ্ঞাসা করলাম–গজেনবাবু আসেননি আজ? কোথায় তিনি?
দু-তিনবার প্রশ্নের পর অঙ্গুলি নির্দেশ জবাব পাই।
ও! এই বাড়ির তেতলায় গেছেন! রোগী দেখতে বুঝি?
উত্তর আসে–না, রোগী দেখতে নয়, আরো উপরে।
আলো উপরে? আরে উপরে রকম? বাড়ির ছাদে নাকি? আমি অবাক হয়ে যাই।–ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন বুঝি?
আজ্ঞে না, তারও উপরে।
ছাদের ও উপরে? তবে কি এরোপ্লেনের সাহায্যে তিনি আকাশেই উড়ছেন এখন? ডাক্তার মানুষের এ আবার কি ব্যারাম! বিস্ময়ের আতিশয্যে প্রায় ব্যাকুল হয়ে উঠি; এমন সময়ে হোট কম্পাউন্ডারটি গুরুগম্ভীরভাবে, অথচ সংক্ষেপে জানান–তিনি মারা গেছেন।
মারা গেছেন! সেকি রকম!!!–দশদিনের মধ্যে তৃতীয়বার আমার পিলে চমকায়। হার্টফেল ফেল হয়।
বুড়ো কম্পাউন্ডারটি বলেন–কি আর বলবো মশায়! এক চিঠি–এক সর্বনাশে চিঠি–ডালটনগঞ্জ থেকে–অশ্বিনীর না ভরণীর কার এলো যেন–তাই পড়তে পড়তে ডাক্তারবাবুর চোখ উল্টে গেল। বার তিনেক শুধু বললে–কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ!!…তার পরে আর কিছুই বললেন না, তার হার্টফেল হোলো।
নিজের পাড়ায় যতটা অপরিচিত থাকা যায়! এই জন্যেই গজেন ডাক্তারের কাছে আমি অশ্বিনীরূপ ধারণ করেছিলাম। আজ সেই ছদ্মনামের মুখোস আর খুললাম না, নিজের কোনো পরিচয় না দিয়েই বাড়ি ফিরলাম। একবার ভাবলাম, বলি যে, সেই সঙ্কট মুহূর্তে ডাক্তারবাবুকে এক ডোজ ভিজিটালিস দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখন আর বলে কি লাভ!