শিবরাম চকরবরতির মত কথা বলার বিপদ

শিবরাম চকরবরতির মত কথা বলার বিপদ

আর কিছু না, বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেছি খালি : চা খাও আর না খাও, আমাকে তো চাখাও।

অমনি দোকানের ও-কোণ থেকে কে যেন তার কান খাড়া করল, ছোট্ট একটি ছেলে, আমি লক্ষ্য করলাম।

দূর। এই অবেলায় এখন চা খায়? শুদু একগ্লাস জল–আর কিছু না। বন্ধুর জবাব এল :–আর-আর না হয় ওই সঙ্গে একখানা বিস্কুট। ভাগভাগি অবিশ্যি।

ভারী যে নিরাসক্তি। না বাপু, আধখানা বিস্কুটে আমার লোভ নেই, আর নীরেও আমার আসক্তি নেই তুমি জানো আমার। চা-ই চাই।

কান-খাড়া করা ছেলেটি এবার বলে উঠল?

অ্যাঁ, কি বললেন?

তোমাকে তো কিছু বলিনি ভাই।আমি বললাম : আমি বকচি এই-এই পাশের আমার পাশের কি বলব একে? এই পার্শ্ববর্তীকে।

আপনি শিবরাম চকরবতির মতো কথা বললেন না?

অ্যাঁ? কার মতো কথা বল্লাম? আমার বেশ চমক লাগে।

শিব্রাম চকরবরতির মতো।

এবার আমি হকচকিয়েই গেছি। বা রে। আমি আবার কার মতো কথা বলতে যাব? আমি কি বলতে কি আমি নিজেই কি উক্ত অভদ্রলোক সেই শিব্রাম চকরবরতি নাই?

ওই রকম মিলিয়ে-মিলিয়ে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ল্যাজামুড়ো এক করে কথা বলা খারাপ। ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। বুঝলেন মশাই?

তুমি কি–ঐ কি নাম বললে–সেই ভদ্রলোককে কখনো দেখে?

না দেখিনি, দেখবার আমার বাসনাও নেই। ঐ ভদ্রলোক আমাকে যা বিপদে ফেলেছিলেন একবার।

অ্যাঁ, বলো কি? তোমাকে তিনি বিপদে ফেলেছিলেন? আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ওকে পর্যবেক্ষণ করি কই, আমার তো তা মনে পড়ছে না।

উনি কি আর ফেলেছিলেন? ওঁর মতো কথা বলতে গিয়ে আমি নিজেই ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম। ছেলেটি বললঃ হাড় কখানা আস্ত নিয়ে যে নিজের আস্তানায় ফিরতে পেরেছি এই ঢের।

ও বুঝেচি। সেই তারা, সেই সব বিচ্ছিরি লোক, শিব্রাম চকরবরতির লেখা যারা একদম পছন্দ করে না, তারাই বুঝি? তারা তোমার কথা শুনে, তোমাকেই শিব্রাম চকরবরতি ভেবে, সবাই মিলে, ধরে বেঁধে এক চোট বেধড়ক

উঁহুহু। ছেলেটি বাধা দেয়। তারা কেন মারবে? তারা কারা? তারা কোথাথেকে এল? না, তারা নয়। সেই জন্যেই তো বারন করচি, শিব্রাম চকরবরতির মতো কথা কক্ষনো বলবেন না। ওই ধরনের কথা বলার বদভ্যাস ছাড়ুন, জন্মেম মতো ছেড়ে দিন তা নাহলে আপনাকেও হয়তো কোনদিন আমার মতো বিপদে পড়তে হবে।

বন্ধুর উদ্দেশ্যে বললাম–তাহলে চা থাক। খোকার গল্পটাই শোনা যাক। বলো তো ভাই, কান্ডটা। ওই বিষয়ে বলতে কি, সব চেয়ে বেশি আমারই আগে সাবধান হওয়া দরকার।

এবং আমার বন্ধু যিনি এতক্ষণ চায়ের বিপক্ষে ছিলেন চাউর করলেন?

না, চা আসুক। এবং তুমিও এসো এই টেবিলে। ওহে, তিন কাপ চা, আর আর তিন ডজন, বিস্কুট। চা খাই আর না খাই, তোমাদের তো কি বলে গিয়ে চা পান করাতে দোষ নেই?

খুব সামলে নিয়েছেন। ছেলেটি আমাদের টেবিলে এসে বসল : বলতে পারতেন যে ঐটেই দস্তুর। সঙ্গে বলতে পারতেন আরো। কিন্তু খুব বাঁচিয়ে নিয়েছেন। শিব্রাম চকরবরতি এখানে থাকলে, ঐ দোষের জন্যে, দস্যুকেও নিয়াসতেন বিনা দোষেই। ঐটেই ওঁর মস্ত দোষ। টেনে হিঁচড়ে কেমন করে যে তিনি এনে ফেলেন।

কি করে যে এত পারেন ভদ্রলোক, আমি আশ্চর্য হই। আশ্চর্য হয়ে আমি বলি।

যেমন করে মুর্গিতে পাড়ে, তেমনি আর কি। বন্ধুবরের অনুযোগ? এমন কি শক্ত?

শক্ত? কিছু না। ছেলেটি বলে আমরা সবাই পারি। আমাদের ক্লাসের পেত্যেক ছেলে। আমাদের বাড়িতে দাদারা, দিদিরা, এমন কি বৌদি পর্যন্ত। ওতো এনতার পারা যায়, ঐ উনি যা বললেন একেবারে মুর্গির মতোন। আস্ত ঘোড়ার ডিম। পেড়ে দিলেই হলো–পারতে কি। তবে লেখকের মধ্যে ঐ একজনই শুধু পারেন কিন্তু পাঠকের হাজার হাজার। পাঠকের মধ্যে এক আমিই যা ঠেকে শিখেচি, আমি আর পারব না। ছেলেটি নিজের অক্ষমতা জ্ঞাপন করে।

এরপর, আসল গল্পটা যতদূর সম্ভব ছেলেটির নিজের ভাষায় বলার চেষ্টা করা যাক ।

গরমের ছুটিটা কোথায় কাটানো যায়! ভাবলুম, অনেক দিন তো যাইনি, কাকার ওখানেই যাই ছেলেটি শুরু করল বলতেঃ আসানসোলে গিয়ে সোলে শান দিয়ে আসি। কলকাতার বাইরে ফাঁকাও হবে, আর আরাম করে থাকাও হবে। একেবারে আমের আশা যে ছিল না তাও না, তবে না মশাই, আমার আমাশা ছিল না। তবে, কাকার বাগানে ঢুকে আম জাম যে বাগানো যাবো সে আশা খুবই ছিল।

ছেলেটি অম্লানবদনে অকাতরে বলে যাচ্ছিল, আর আমার চোখ ক্রমশই বড়ো থেকে আরো হতে হতে, ছানাবড়া কি, লেডিকেনি পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেল। অবশেষে আমি আর থাকতে পারলাম না।

থামো, থামো। তুমি বলছ কি? তুমি কি বলছ, তুমি শিব্রাম চকরবরতি নও? তুমি নিজেই নও? ঠিক বলছ? ঠিক জানো? আমার গুরুতর সন্দেহ হচ্ছে, তুমিই শিব্রাম চকরবরতি?

আমি? না, আমি না ছেলেটি ম্লান একটুখানি হাসল।

বলো, নির্ভয়ে বলো, কোন ভয় নেই। লোকটার ওপর রাগ আছে, কিন্তু আমরা তোমাকে ধরে ঠ্যাঙাব না। আমার বন্ধুটি অভয় দিয়ে বলেন:–না, এমন সামনে পেয়ে বাগে পেলেও না।

কী যে বলেন। শিব্রাম চকরবরতি লোকটি কি এতই ছোট হবে? এই বলে ছেলেটি আত্মরক্ষার খাতিরেই কিনা বলা যায় না, অদূরবর্তী আয়নায় প্রতিফলিত নিজের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল : চেয়ে দেখুন তো। আর শিব্রাম চকরবরতির নাকি গোঁফ-দাড়ি একদম থাকবে না?

সে একটা কথা বটে। আমি ঘাড় নাড়ি ও শিব্রাম চকরবরতি লোকটা এত ছোট না হওয়াই উচিত। এতদিনে তো সাবালক হবার কথা। তবে কিনা, ছোট লোকের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তা ছাড়া–আমি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠিঃ তুমি ঠিক ছদ্মবেশে আসো নি তো? মানে কিনা–ভদ্র ভাষার বলতে হলে আপনি ছদ্মবেশে আসেন নি তো শিব্রাম বাবু?

ছেলেটি মুখ ভার করে ভাবতে লাগল, বোধহয় তারা ধরা পড়ে যাওয়া ছদ্মবেশের কথাই সে ভাবতে লাগল। আমিও ভাবতে থাকি, ঐ শিব্রাম হতভাগাটাকে অনুকরণীয় বলেই আমার ধারণা ছিল। একটু অহঙ্কারও না ছিল তা নয়। অনুকরণীয় মানে, অনুকরণের অযোগ্য। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ওর সম্বন্ধে আমার, অনেকের মতো আমারও একটা ভুল ধারণাই এতদিন থেকে গেছে। অত্যন্ত সহজেই যে-কেউ ওকে-মানে, ঐ শিব্রামটাকে টেক্কার পর টেক্কা মেরে বেটর যেতে পারে। তবে আর কষ্ট করে ওর লেখাপড়া কেন? ছছাঃ। অন্ততঃ আমি তো আর পড়ছিনে; ওর আজে-বাজে যতো বই, আজ থেকে সব তালা দিলাম, তালাবন্ধ থাকল বাক্সে।

আপনি বলছেন আমিই সেই? ছেলেটি আরো একটু ম্লান হাসল। ছদ্মবেশে এসেছি বলে আপনাদের মনে হচ্ছে? বেশ, তাহলে আমার নাক কান টেনে টেনে দেখুন। দেখতে পারেন টানাটানি করে। মুখোস হলে তো খুলে আসবে?

ছেলেটি তার মুখ বাড়িয়ে দিল। আমার, হাত সুড় সুড় করলেও আত্মসম্বরণ করে বললাম : আচ্ছা, পরে পরীক্ষা করে দেখবখন। এখন তোমার গল্প তো শেষ কর।

আরম্ভ করল ছেলেটি?

গেছি তো কাকার বাড়ি। নিরাপদে পৌঁছেচি। কাকা তখন বেদানা খাচ্ছিলেন; কোন জ্বরজারি হয়নি, এমনই সুস্থ শরীরে বেদনা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করছেন, দেখেই বুঝতে পারলাম।

আমি যেতেই বলেন, এইযে, এইযে। মন্টু যে। খবর কি? আছিস কেমন?

খবর ভাল। সামার ভেকেশন আমার কিনা। ভাবলুব, আসানসোল এসে সোলে একটু

কাকাবাবু বাধা দিয়ে বলেন : বেশ বেশ। এসেছিস, বেশ করেছিস। যখন পারবি তখনই আসবি। কাকা-কাকীর বাড়ি সবাই আসে। আসে না কে?

ডাকাডাকি না করেই তো আসে। ঐ সঙ্গে এইটুকুও যদি যোগ করতেন কাকাবাবু, ভারী খুশি হতাম। কিন্তু কাকাবাবু ওর বেশি আর এগুলেন না অধিক ভলা বাহুল্য মাত্র ভেবে চেপে গেলেন। একেবারে। বোধহয় শিব্রাম চকরবরতির বই ওঁর তেমন পড়াটড়া ছিল না।

পায়ের ধূলো নিতে না নিতেই তিনি গলে পড়লেন : এই নে। বেদানা খা।

বেদানার অনুরোধে বেশ দমে গেলাম। ও-জিনিষ অসুখবিসুখে খেতেই যা বিচ্ছিরি, তার ওপর সুস্থ শরীরে খেতেহলেই তো গেছি। বেদানাটা হাতে নিয়ে বললাম : কাকাবাবু। বেদানা দিলেন বটে, কিন্তু বলতে কি, একটু বেদনাও দিলেন।

কাকা আমার কথাটায় কানই দিলেন না।

নে নে, খেয়ে ফ্যাল। খেলে গায়ে জোর হয়। ভাল শরীরে খেলেই আরো জোর বাড়ে। নে, ছাড়িয়ে খা। কাকা বেদানা দিলে খেতে হয়।

মনে মনে আমি বলি, কাকস্য পরিবেদনা। এবং প্রাণপনে বেদনা দূর করি, এক একটাকে পাকড়ে, গলা ধরে দূর করে দিই একেবারে গালের ভেতরে। তারপর আমার গলার তলায়।

তুমি গলাধঃকরণ করে। বুঝতে পেরেছি। আমি বলি।

ঠিক বলেচেন! চমৎকার বলেছেন, কিন্তু ছেলেটি উসকে উঠেই তক্ষুনি আবার নিবু নিবু হয়ে আসে, কেমন যেন মুষড়ে পড়ে। তারপরে শুনুন।

এমন সময়ে কাকীমা এসে পড়লেন। এসেই কাকার কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন।

কী, সকাল বেলায় ছেলেটাকে ধরে ধরে বেদানা খাওয়াচ্ছ? ওসব ওদের কখনো ভাল লাগে? রোচে কখনো? মন্টু, আয় চপ খাওয়াব তোকে, ভাল এঁচোড়ের চপ, আমার নিজের তৈরি রান্নাঘরে আয়।

পিতৃব্যস্নেহ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে হাঁফ রান্নাঘরে গিয়ে উঠলাম। কাকীমা ছোট্ট একটু পিড়ি দিলেন বসতে : বোস।

না, এই ভূঁয়েই বসি। আমি বললাম : পিড়ি দিয়ে কেন আর পীড়িত করছেন কাকীমা?

অ্যাঁ, কি বললি? কাকীমা কান খাড়া করলেন।

পিঁড়ি তো নয়, পীড়ানের যন্ত্র। আমার পুনরুক্তি হলোর যন্ত্রণাও বলতে পারেন। আরো ভাল করে বললাম আবার : না, কাকীমা, আমি প্রপীড়িত হতে চাইনে।

কাকীমা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না।

এসব আবার কেমন কথা? কাকীমা হাঁ করে রইলেন : যন্ত্র আবার যন্ত্রণা কীসব যা তা বকচিস আবোল তাবোল? কাকীমার দুই চোখ বিস্ময়ে চোখা হয়ে উঠল।

চপ দিন, তাহলে চুপ করব। বললাম আমি। কাকীমা একটু ইতস্ততঃ করে চপের প্লেটটা এগিয়ে দিলেন।

কামড়াতে গিয়ে দেখি দাঁত বসে না। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র বাইরে এ আবার কি জিনিস রে বাবা?

কাকীমা, এ কি বানিয়েছেন? এ কি চপ? এর চাপ তো আমি সইতে পারছি না। আমি জানাইঃ এচোড়গুলো আগে কিমা করে নেন নি কেন কাকীমা? এ যে চোরেরাও অখাদ্য হয়েছে। এই চাপের আঘাত না করে আমাকে চপেটাঘাত করলেও পারতেন। আমি হাসিমুখে খেতাম।

ফাকীমার চোখ কপালে উঠে যায়, বহুক্ষণ তার মুখে কথা সরে না। তারপর তাঁর সমস্ত মুখ কেমন একটা আশঙ্কার আবছায়ায় ভরে ওঠে। তিনি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করেন : ঢোকবার আগে তুই এ-বাড়ির ছাঁচতলাটায় দাঁড়িয়ে ছিলি না? তুই-ই তো? আমি ওপর থেকে দেখলুম যেন?

হ্যাঁ, ভাবছিলুম, আপনাদের নতুন দারোয়ান বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা! আমাকে দ্যাখেনি তো আগে। আমি কৈফিয়ত দিই : নাম লিখে পাঠাতে হবে ভেবে কাগজ পেনসিল খুঁজছিলাম, কিন্তু দরকার হলো না। সে একটু কাত হতেই আমি তার পেছন দিক দিয়ে সাঁত করে গলে পড়েছি।

ছাঁচতলাতে তুইই দাঁড়িয়েছিলি! কাকীমার সমস্ত মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসে; তাই তো বলি! কেন আমার এমন সর্বনাশ হলো।

কাকীমা পা টিপে টিপে পেছোতে থাকেন : চুপ করে বসে থাকো। নড়ড়া না যেন। আমি আসচি এক্ষুনি।

কাকীমার এই অদ্ভুত বিহেভিয়ার আমি যতই ভাবছি ততই মনে মনে হেভিয়ার হচ্ছি। ওরকম ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার মানে? আমিও কি একটা এঁচোড়ের চপ না কি?

একটু পরে কে যেন দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে। আবার কে একজন, একটু গলা বাড়িয়েই সরে যায়। আমার কাকতুত ভাইবোন সব, বুঝতে পারি। কাকার আর সব পরিবেদনা, কাকীমার অন্যান্য অনাসৃষ্টি। ইকোয়ালি অখাদ্য। এক একটি পাকা এঁচোড়ের চপ! কেন বাপু, অমন উঁকিঝুঁকি মরামারি কেন? আমি যদি এমনই দ্রষ্টব্য, সামনাসামনি এসে কি আমাকে দেখা যায় না?

ওদের সবার হাবভাব আমার ভারী খারাপ লাগে। কেমন কেমন ঠেকে যেন। আশপাশ থেকে চাপা গলা কানে আসে, চারধার থেকে ফিস ফিস গুজ গুজ শুনি, আর আমার দু-হাত নিসপিস করতে থাকে। ইচ্ছে করে, হাতের নাগাল না পাই, কসে এক ঘা–এই চপ ছুঁড়েই লাগাই না কেন এক একটাকে?

ভাবতে ভাবতে যেমন না দরজা তাক করে একটা চপ নিক্ষেপ করেছি ওই নেপথ্যের দিকেই–অমনি হুটপাট বেধে গেছে। হুড়মুড়, দুড়দুড়, হৈ-হৈ, দুদ্দাড়–রৈ রৈ কাণ্ড!

বাবা রে! মা রে! ধরলে রে! গেছি রে! কি ভূত রে বাবা! খেয়ে ফেললে রে! ভারী হৈ চৈ পড়ে গেল হঠাৎ।

আমি বিরক্ত হই। ভারী অসভ্য তো এরা! খেয়ে ফেললাম কখন? ও-চপ তো খেয়েই আমি ফেলেচি, এঁটো, তো নয়, তবে কেন?

অবশেষে কাকীমা এলেন। সঙ্গে সঙ্গে এল সনাতন। সনাতন এ-বাড়ির পুরাতন চাকর। সনাতন–কাল থেকে ওকে দেখছি।

দুজনেই সসঙ্কোচে ঢুকল।

সনাতন একেবারে আমার অদূরে এসে দাঁড়াল। কীরকম চোখ পাকিয়ে কটমট করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, যেন চিনতেই পারছে না আমায়।

পুরানো চাল যেমন ভাতে বাড়ে, পুরানো চাকর তেমনি চালে বাড়বে, এ আর আর বিচিত্র কি? তবু আমি একটু অবাক হলাম।

কাকীমা একি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

কাকীমা কি রকম একটা সন্ত্রস্ত ভাবে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন, বেশি আর এগোননি। তিনি কোন জবাব দিলেন না। তার পেছনে, চোখ বড়ো বড়ো করে বাড়ির যত ছেলেমেয়েরা, ঝি চাকর যত!

সনাতন বিড়বিড় করে কী সব বকে, আর সরষে ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমায় লাগায়। আমার সারা গায়ে।

আমার ভারি বিচ্ছিরি লাগে। এবং লাগেও মন্দ না বলি : সনাতন, এসব কি হচ্ছে? তোমাদের সব মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কী বিড়বিড় করচ? তোমার ঐ কটাক্ষ আমার একেবারেই ভাল লাগছে না।

সনাতন তবুও বিড় বিড় করে।

কথং বিড়বিড়য়সি সনাতনং? আমি সংস্কৃত করে বলি : সনাতন, তোমার এ বিড়ম্বনা কেন?

আপনি কে? সনাতন এতক্ষণ পরে একটা কথা বলে।

আমি–আমি তোমাদের মন্টু। আমাকে চিনতে পারছ না, সনাতন? আমি অবাক হয়ে যাই।

মন্টু না হাতি! সনাতন বলে? বলুন আপনি কে? আপনি কি আমাদের বেলগাছের বাবা? দয়া করে এসেছেন পায়ের ধূলো দিতে, আজ্ঞে?

ওসব রসিকতা রাখো। কারো বাবা-টাবা আমি নই, তা বেলগাছেরই কি আর তালগাছেরই কি! ওসব গেছো ছেলেদের আমি ধার ধারিনে।

তবে কে তুমি? তুমি কি তাহলে আমাদের গোরস্থানের মামদো? সনাতন একটু সভয়েই এবার বলে।

বলছি না, আমি মন্টু? ন্যাকামি হচ্ছে কিনা? কদ্দিন কতো চকোলেট খাইয়ে তোমায় মানুষ করলাম! আমার রাগ হয়ে যায়।

মন্টু না ঘন্টা। আমাকে আর শেখাতে হবে না। আমার কাছে চালাকি? ভুত চরিয়ে চরিয়ে আমার জীবন গেল। হাড় ভেঙ্গে সুরকি বানিয়ে দেব। বল, কোন ভূত আমাদের মন্টুর ঘাড়ে চেপেছিস? বল আগে?

বোধ হয় কোন রামভূত! আমি আর না বলে পারি না। আধাগল্পের মাঝখানেই বাধা দিয়ে। বলি। স্বনামধন্য আমার নিজের প্রতিই কেমন যেন একটু কটাক্ষ হয়, কিন্তু না পারা যায় না।

সনাতনও ঠিক ঐ কথাই বলল। বলল, গিন্নীমা, এ হচ্ছে কোন রামভূত! সহজে এ ছাড়বে না। রাম নামেও না। সরষে-পোড়া নয়, এর অন্য ওষুধ আছে।

এই বলে–

ছেলেটি আরো বিস্তরিত করেঃ সনাতন করল কি, জলভর্তি বড় একটা পেতলের ঘড়া এনে হাজির করল আমার সামনে। বলল বুঝেছি, তুই কে? অ্যাশশ্যাওড়ার শাকচুন্নী। টের পেয়েছি ঢের আগেই তোল তোল এই ঘড়া দাঁতে করে।

ভাবুন দিকি, কী ব্যাপার! ঘড়া দেখেই তো আমার চোখ ছানাবড়া। আমাকে ওরা যে কী ঠাউরেছে তাও আর আমার বুঝতে বাকী নেই। ওদের কাছে আমি এখন কিম্ভুতকিমাকার! আমার প্রতি ওদের কারু যে মায়া দয়া হবে না তাও বেশ বুঝতে পেরেছি। আমার ভূত না ছাড়িয়ে ওরা ছাড়বে না।

তবু একবার কাকীমাকে ডাকি শেষ ডাকা ডেকে দেখি : কাকীমা, এসব তোমাদের কি হচ্ছে? আমাকে তোমরা পেয়েছ কি? এসব কি বাড়াবাড়ি? আমার একদম ভাল লাগছে না।

কাকীমা চোখের জল মুছে চুপ করে থাকেন।

তখন সনাতনকে নিয়েই শেষ চেষ্টা করতে হয়। তাকেই বলি : বাপু, তোমার এই সনাতনপদ্ধতি অতিশয় খারাপ। কি চাও বলো তো? চকোলেট না চারটে পয়সা? তাই দেব, ছেড়ে দাও আমায়।

শাকচুন্নী ঠাকুরন, আর নাকে কান্না কেঁদনি! ভাল চান তো যা বলি তাই করুন দিকি এখন। এই বলে সতাতন ঘড়াটাকে মন্ত্র পড়ায়।

আমার মাথা ঘুরে যায়! জলভরা ঐ বড় ঘড়া-এক মণের কম হবে না। দুহাতেই কোনদিন তুলতে পারিনি, আর তাই কিনা, মুষ্টিমেয় এই কটা দাঁতে আমায় তুলতে হবে?

জাতও গেল, দাঁতও গেল, প্রাণও যায় যায়!

ধমক লাগায় সনাতন :–ভাল চাস তো ন্যাকাপনা রাখ! তোল দাঁতে করে। নইলে দেখেছিস—

বলতে না বলতে সনাতন—

ছেলেটি থেমে যায়। মুখ চোখ তার লাল হয়ে ওঠে। চকচকে চোখ ছলছল করতে থাকে।

আমার বন্ধুটি উৎসাহ দেয় ও বলো বলো–জমেছে বেশ।

আমি কিছু বলতে পারি না। মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকি। সব দায়, সমস্ত অপরাধ যেন আমার আমারই কেবল! এই কেবলি আমার মনে হতে থাকে।

বলতে না বলতে সনাতন ঘা কতক আমাকে লীগয়ে দেয়! এই সনাতন, যাকে আমি চকোলেট খাইয়েছি, ছোটবেলায় কত না ওর পিঠে চেপেছি, কতই না ওকে পিটেছি, আর সেই কিনা….

ছেলেটির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। আমার এক চোখ দিয়ে জল গড়ায়। আমার বন্ধু রুমালে নাক মোছেন।

জগতের এই নিয়ম। বর্ষণমুখর চোখটা মুছে ফেলে আমি দার্শনিক হবার চেষ্টা করি। তুমি কেঁদ না, কেঁদ না তোমরা সনাতন রীতিই এই! আজ তুমি যার পিঠে চাপছ, কাল তোমার পৃষ্ঠপোষক! উপায় কি? এই বলে আমার যথাসাধ্য ওদের সান্ত্বনা দিই।

ছেলেটি ম্লান একটুখানি হেসে আবার শুরু করে : বেশ বোঝা যায়, সনাতন আমার হাতে যত না মার খেয়েছে এর আগে, এখন বাগে পেয়ে সে সবের শোধ তুলে নিচ্ছে। এই সুযোগে এক ছুতো করে বেশ একচোট হাতের সুখ করে নিচ্ছে। সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে, বেশ বুঝতে পারি।

কি করি? কাঁহাতক মার খাব? প্রাণের দায়ে ঘড়াকে মুখে তুলতে যাই। কিন্তু পারব কেন? একটু আগে আমি যে চপেই দাঁত বসাতে পারিনি, কিন্তু সে তো এর চেয়ে ঢের নরম ছিল। আর এর চেয়ে হালকা তো বটেই!

সনাতন কিন্তু ঘড়ার চেয়েও কড়া। সে ধা করে তার ওপরেই—

ছেলেটি আর বলতে পারে না।

বলতে হবে না। আবার ঘা কতক! বুঝতে পেরেছি। আমার বন্ধুটি ভগ্নকণ্ঠে বলেন, এবং রুমালে নিজের চোখ মুছতে ভুল করে তার পাশের আরেক জনের মুখ মুছিয়ে দেন।

আমার অপর চোখটি দিয়ে এবার জল গড়াতে থাকে।

তখন আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। এই ধাক্কায় মূচ্ছিত হয়ে গেলে কেমন হয়? তাহলে হয়তো এ-যাত্রা বেঁচে যেতেও পারি। রোজার হাত থেকে ডাক্তারের খর্পরে পড়ব, হয়ত ইনকেজসনই লাগাবে, তেঁতো ওষুধ গেলাবে, কিন্তু সেও ঢের ভাল এর চেয়ে।

ব্যস, অমনি আমি পতন ও মূৰ্ছা–একেবারে নট নড়ন চড়ন, নট কিছু!

এই বলে এতক্ষণ পরে ছেলেটি একটু হাসল, এবার আত্মপ্রসাদের হাসি!

মূছার মধ্যেই আমি শুনতে থাকি, চোখ বুজেই শুনতে পাই, সনাতন বলছে–গিন্নীমা, আমার মনে হয় ভূত নয়। ভূত হলে আলবৎ দাঁতে করে তুলতো। এর চেয়ে ভারী ভারী ঘড়া অক্লেশে তুলে ফেলে। আমার নিজের চোখেই দেখা! আমার মনে হয় মন্টুবাবুর মাথা বিগড়ে গেছে। বা বড় বড় চুল, এ গরমে, তাই হবে। আপনি কাচিটা আমায় দিন ত! চুলগুলো কদম ছাঁট করে মাথায় ঠাণ্ডা গোবর লাগালে দু-এক দিনেই থোকাবাবু শুধরে উঠবেন। শিবঃ রচনাসমগ্র-১২-ক

এই কথা যেই না আমার যাওয়া, আমি তো আর আমাতে নেই। অ্যাঁ, আমার এমন সাধের একচোখ–ঢাকা চুল–শিব্রাম চকরবরতির দেখাদেখি কত করে বাড়িয়েছি–

আমি বাধা দিয়ে বলি :–তবে যে তুমি বললে, শিব্রাম চকরবরতিকে কখনো দেখনি?

ঠিক স্বচক্ষে দেখিনি। তবে আজকাল ওঁর যত বইয়ে ওঁর চেহারার সে সব কার্টুন বেরয় তাই দেখেই আন্দাজ করে রেখেছিলাম। আপনিও তো মশাই প্রায় তার মত করেই চুল রেখেচেন দেখ যাচ্ছে। আমার প্রতি কটাক্ষ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে ছেলেটিঃ কত কষ্ট করে কত বকুনি সয়ে, কত সমাদরে বাড়ানো এই চুল, তাই যদি গেল, তাহলে আর আমার থাকল কি!

সনাতনের গিন্নীমা কাঁচি আনতে গেছেন, আর আমি এদিকে চোখ টিপে টিপে চেয়ে দেখলাম, সনাতন ঘড়াটা সরাচ্ছে, সেই সুযোগে আমি না, একলাফে তিড়িং করে না উঠে, চৌকাঠ পেরিয়ে, কাকাতুত রাক্কোসদের এক ধাক্কায় কক্ষচ্যুত না করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে একেবারে সেই সদরে!

দারোয়ান হতভাগা, দ্বারে যার ওয়ান হয়ে সব সময়ে থাকবার কথা, সে ব্যাটা তখন জিরো হয়ে পড়েছিল। ইংরিজি ওয়ান-এর বদলে, বাংলা ১ বনে গিয়ে পা গুটিয়ে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে জিবরাচ্ছিল, আমি না সেই ফাঁকে…

ধর ধর ধর ধর! সোরগোল উঠল চারদিকে।

আর ধর! এই ধুরন্ধর ততক্ষণে–ছেলেটি থেমে গেল। গল্পটাকে সুচারুরূপে শেষ করার জন্য, কপাল কুঁচকে, যুৎসই একটা কথা খুঁজতে লাগল মনে হয়।

পালিয়ে এসেচ। বুঝতে পেরেছি, আর বলতে হবে না। আমার বন্ধুটিই পালা শেষ করেন।

পালানো হচ্ছে একটা লম্বা ড্যাশ-ওর কোথাও ফুলস্টপ নেই।

তোমার নামটি কি? আমি জিগ্যেস করি? মন্টু তো বলেছ। কিন্তু ভাল নামটি কি তোমার?

ধ্রুবেশ।

বাঃ বেশ! বলতে গিয়ে আমার বলা হয় না। গলায় আটকায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *