আমার বাঘ শিকার
মুখের দ্বারা বাঘ মারা কঠিন নয়। অনেকে বড় বড় কেঁদো বাঘকে কাঁদো কাঁদো মুখে আধমরা করে ঐ দ্বারপথে এনে ফেলেন। কিন্তু মুখের দ্বারা ছাড়াও বাঘ মারা যায়। আমিই মেরেছি।
মহারাজ বললেন, বাঘ-শিকারে যাচ্ছি। যাবে আমাদের সঙ্গে?
না বলতে পারলাম না। এতদিন ধরে তাঁর অতিথি হয়ে নানাবিধ চর্বচোষ্য খেয়ে অবশেষে বাঘের খাদ্য হবার সময়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলে না। কেমন যেন চক্ষুলজ্জায় বাধে।
হয়তো বাগে পেয়ে বাঘই আমায় শিকার করে বসবে। তবু মহারাজ!র আমন্ত্রণ কি করে অস্বীকার করি? বুক কেঁপে উঠলেও হাসি হাসি মুখ করে বললাম, চলুন যাওয়া যাক। ক্ষতি কি?
মহারাজ!র রাজ্য জঙ্গলের জন্যে এবং জঙ্গল বাঘের জন্যে বিখ্যাত। এর পরে তিনি কোথাকার মহারাজ, তা বোধ হয় না বললেও চলে। বলতে অবশ্য কোন বাধা ছিল না, আমার পক্ষে তো নয়ই, কেন না রাজামহারাজ!র সঙ্গেও আমার দহরম-মহরম আছে–সেটা বেফাঁস হয়ে গেলে আমার বাজারদর হয়ত একটু বাড়তোই। কিন্তু মুশকিল এই, টের পেলে মহারাজ হয়তো আমার বিরুদ্ধে মানহানির দাবি আনতে পারেন–এবং টের পাওয়া হয়তো অসম্ভব ছিল ন। মহারাজ না পড়ন, মহারাজকুমারেরা যে আমার লেখা পড়েন না, এমন কথা হলফ করে বলা কঠিন। তাছাড়া আমি যে পাড়ায় থাকি, যে গুড়াপাড়ায়, কোন মহারাজ!র সঙ্গে আমার খাতির আছে ধরা পড়লে তারা সবাই মিলে আমাকে একঘরে করে দেবে। অতএব সব দিক ভেবে স্থান, কাল, পাত্র চেপে যাওয়াই ভাল।
এবার আসল গল্পে আসা যাক।
শিকার যাত্রা তত বেরোল। হাতির উপরে হাওদা চড়ানো, তার উপরে বন্দুক হাতে শিকারীরা ডজনখানেক চড়াও হাতি চার পায়ে মশ মশ করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে। সব আগের হাতিতে চলেছেন রাজ্যের সেনাপতি। তারপর পাত্র-মিত্র-মন্ত্রীদের হাতি; মাঝখানে প্রকাণ্ড এক দাতালো হাতিতে মশগুল হয়ে স্বয়ং মহারাজ!; তার পরের হাতিটাতেই একমাত্র আমি এবং আমার পরেও ডানহাতি, বাঁহাতি আরো গোটা কয়েক হাতি; তাতে অপাত্ৰ অমিত্ররা! হাতিতে হাতিতে যাকে বলে ধূল পরিমাণ! এত ধূলো উড়ল যে দৃষ্টি অন্ধ, পথঘাট অন্ধকার–তার পরিমাণ করা যায় না।
জঙ্গল ভেঙ্গে চলেছি। বাধা রাস্তা পেরিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ–এখন আর মশ মশ নয়, মড় মড় করে চলেছি। এই ‘মর্মর-ধ্বনি কেন জাগিল রে।’ ভেবে না পেয়ে হতচকিত শেয়াল, খরগোশ, কাঠবেড়ালির দল এধারে ওধারে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিয়েছে, শাখায় শাখায় পাখিদের কিচির-মিচির আর কারো পরোয়া না করে চলেছি। হাতিরা কারো খাতির করে না।
চলেছি তো কতক্ষণ ধরে। কিন্তু কোন বাঘের ধড় দূরে থাক, একটা ল্যাজও চোখে পড়ে না। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর কিসের শোরগোল শোনা গেল। কোত্থেকে একদল বুনো জংলী লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। তারা বনের মধ্যে ঢুকে কি করছিল কে জানে! মহারাজ! হয়তো বাঘের বিরুদ্ধে তাদের গুপ্তচর লাগিয়ে থাকবেন। তারা বাঘের খবর নিয়ে এসেছে মনে হতেই আমার গায়ে ঘাম দেখা দিল।
কিন্তু তারা বাঘের কোন উচ্চবাচ্য করে হাত-তী-হাত-তী বলে চেঁচাতে লাগল।
হাত-তী তো কি? হাতি যে তা তো দেখতেই পাচ্ছ–হাতি কি কখনো দেখনি না কি? ও নিয়ে অমন হৈ চৈ করবার কি আছে? হাতির কানের কাছে ওই চেঁচামিচি আর চোখের সামনে ওরকম লম্ফঝম্ফ আমার ভাল লাগে না। হাতিরা বন্য ব্যবহারে চটে গিয়ে ক্ষেপে যায় যদি? হাতি বলে কি মানুষ নয়? হাতিরও তো মানমর্যাদা আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে!
মহারাজকে কথাটা আমি বললাম। তিনি জানালেন যে, আমাদের হাতির বিষয়ে উল্লেখ করছেন, একপাল বুনো হাতি একদিকেই তাড়া করে আসছে, সেই কথাই ওরা তারস্বরে জানাচ্ছে। এবং কথাটা খুব ভয়ের কথা। তারা এসে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। হাতি এবং হাওদা সমেত সবাইকে আমাদের দলে পিষে মাড়িয়ে একেবারে ময়দা বানিয়ে দেবে।
তৎক্ষণাৎ হাতিদের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হল। কথায় বলে হস্তিযূথ, কিন্তু তাদের ঘোরানো ফেরানোর এত বেজুত যে বলা যায় না। যাই হোক কোন রকমে তো হাতির পাল ঘুরল, তারপরে এলো পালাবার পালা।
আমার পাশ দিয়ে হাতি চালিয়ে যাবার সময় মহারাজ! বলে গেলেন, খবরদার! হাতি থেকে একচুল যেন নড় না। যত বড় বিপদই আসুক, হাতির পিঠে লেপটে থাকবে। দরকার হলে দাঁতে কামড়ে, বুঝেছ?
বুঝতে বিলম্ব হয় না। দূরাগত বুনোদে বজ্রনাদী বৃংহণধ্বনি শোনা যাচ্ছিল-সেই ধ্বনি হন হন করতে এগিয়ে আসছে। আরো-আরো কাছে, আরো আরো কাছিয়ে। ডালে ডালে বাঁদররা কিচমিচিয়ে উঠেছে। আমার সারা দেহ কাটা দিয়ে উঠতে লাগল। ঘেমে নেয়ে গেলাম।
এদিক আমাদের দলের আর আর হাতিরা বেশ এগিয়ে গেছে। আমার হাতিটা কিন্তু চলতে পারে না। পদে পদে তার যেন কিসের বাধা! মহারাজের হাতি এত দূর এগিয়ে গেছে যে, তার লেজ পর্যন্ত দেখা যায় না। আর সব হাতিরাও যেন ছুটতে লেগেছে। কিন্তু আমার হাতিটার হল কি। সে যেন নিজের বিপুল বপুকে টেনে নিয়ে কোনরকমে চলেছে।
আমাদের দলের অগ্রণী হাতিরা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর এধারে বুনো হাতির পাল পেল্লায় ডাক ছাড়তে এগিয়ে আসছে ক্রমশই তার আওয়াজ জোরাল হতে থাকে। আমার মাহুতটাও হয়েছে বাচছা। কিন্তু বাচ্ছা হলেও সেই তখন আমাদের একমাত্র ভরসা।
জিজ্ঞাসা করলাম–কি হে। তোমার হাতি চলছে না কেন? জোরসে চালাও। দেখছ কি?
জোরে আর কি চালাব হুজুর? তিনি পায়ে হাতি আর কত জোরে চলবে বলুন? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে বললে।
তিন পা। তিন পা কেন? হাতিদের তো চার পা থাকে বলেই জানি। অবশ্য, এখন পিঠে বসে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু চার পা দেখেই উঠেছিলাম বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য, ভাল করে ঠিক খেয়াল করিনি।
এর একটা পা কাঠের যে। পেছনের পাটা। খানায় পড়ে পা ভেঙে গেছল। রাজাসাহেব হাতিটাকে মারতে রাজি হলেন না, সাহেব ডাক্তার এসে পা কেটে বাদ দিয়ে কাঠের পা জুড়ে দিয়ে গেল। এমন রঙ বার্নিশ যে ধরবার কিছু জো নেই। ইট্রাপ দিয়ে বাঁধা কি না।
শুনে মুগ্ধ হলাম। ডাক্তার সাহেব কেবল হাতির পা-ই নয়, আমার গলাও সেইসঙ্গে কেটে রেখে গেছেন। আবার মহারাজেরও এমন মহিমা, কেবল বেছে বেছে খোঁড়া হাতিই নয়, দুগ্ধপোষ্য একটা খুদে মাহুতের হাতে অসহায় আমায় সমর্পণ করে সরে পড়লেন।
কাঠের হাতি নিয়ে বাচ্চা ছেলে তুমি কি করে চালাবে?–আমি অবাক হয়ে যাই।
বার্লি আমার নাম–সে সগর্বে জানাল–আর আমি হাতি চালাতে জানব না?
বার্লি? ভারি অদ্ভুত নাম তো।–আমার বিস্ময় লাগে।
আমি সাবুর ভাই। সাবু আমেরিকায় গেছে ছবি তুলতে।
তোমার বার্লিনে যাওয়া উচিত ছিল।–না বলে আমি পারলাম না।–গেলে ভাল করতে।
শোনা মাত্রই নিজের ভুল শোধরাতেই কি না কে জানে, তৎক্ষণাৎ সে হাতির ঘাড় থেকে নেমে পড়ল। নেমেই বার্লিনের উদ্দেশ্যেই কি না কে বলবে দে ছুট। দেখতে দেখতে আর তার দেখা নেই। জঙ্গলের আড়ালে হাওয়া।
আমি আর আমার হাতি, কেবল এই দুটি প্রাণী পেছনে পড়ে রইলাম। আর পেছন থেকে তেড়ে আসছে পাগলা হাতির পাল। তেপায়া হাতির পিঠে নিরুপায় এক হস্তিমুখ।
কিন্তু ভাববার সময় ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাজ পড়ার মতো আওয়াজ চার ধার থেকে আমাদের ছেয়ে ফেলল। গাছপালার মড়মড়ানির সঙ্গে চোখ ধাঁধানো ধুলোর ঝড়। তার ঝাঁপটায় আমাদের দম আটকে গেল একেবারে।
মহারাজ!র উপদেশ মতো আমি এক চুল নড়িনি, হাতির পিঠে লেপটে সেটে রইলাম। হাতির পাল যেমন প্রলয় নাচন নাচতে নাচতে এসেছিল তেমনি হাঁক-ডাক ছাড়তে ছাড়তে নিজের ধান্দায় চলে গেল।
তারা উধাও হলে আমি হাতির পিঠ থেকে নামলাম। নামলাম না বলে খসে পড়লাম। বলাই ঠিক। হাতে পায়ে যা খিল ধরেছিল। নীচে নেমে একটু হাত-পা খেলিয়ে নিচ্ছি, ও-মা, আমার কয়েক গজ দূরে এক কি দৃশ্য! লম্বা চওড়া বেঁটে খাটো গোটা পাঁচেক বাঘ একেবারে কাত হয়ে শুয়ে! কর্তা গিন্নী, কাচ্চা-বাচ্চা সমেত পুরো একটি ব্যাঘ্র-পরিবার হাতির তাড়নায় হয়তো বা তাদের পদচারণায়, কে জানে, হতচৈতনয় হয়ে পড়ে আছে।
কাছাকাছি কোনও জলাশয় থাকলে কাপড় ভিজিয়ে এনে ওদের চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে পারলে হয়তো বা জ্ঞান ফেরানো যায়। কিন্তু এই বিভুয়ে কোথায় জলের আজ্ঞা, আমার জানা নেই। তাছাড়া, বাঘের চৈতনয়সম্পাদক করা আমার অবশ্য কর্তব্যের অন্তর্গত কি না, সে বিষয়েও আমার একটু সংশয় ছিল।
আমি করলাম কি, প্রবীণ বনস্পতিদের ঘাড় বেয়ে যেসব ঝুরি নেমেছিল তারই গোটাকতক টেনে ছিঁড়ে এনে বাঘগুলোকে একে একে সব পিছমোড়া করে বাঁধলাম। হাত মুখ বেঁধে-ছেনে সবাইকে পুটলি বানিয়ে ফেলা হল–তখনো ব্যাটারা অজ্ঞান।
হাতিটা এতক্ষণ নিস্পৃহভাবে আমার কার্য্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। এবার উৎসাহ পেয়ে এগিয়ে এসে তার লম্বা শুঁড় দিয়ে এক একটাকে তুলে ধরে নিজের পিঠের উপর চালান দিতে লাগল। সবাই উঠে গেলে পর সব শেষে ওর ল্যাজ ধরে আমিও উঠলাম। তখনো বাঘগুলো অচেতন। সেই অবস্থাতেই হাওদার সঙ্গে শক্ত করে আর এক প্রস্থ ওদের বেঁধে ফেলা হল।
পাঁচ-পাঁচটা আস্ত বাঘ–একটাও মরা নয়, সবাই জলজ্যান্ত। নাকে হাত দিয়ে দেখলাম নিঃশ্বাস পড়েছে বেশ। এতগুলো জ্যান্ত বাঘ একাধারে দেখলে কার না আনন্দ হয়? একদিনের এক চোটে এক সঙ্গে এতগুলো শিকার নিজের ল্যাজে বেঁধে নিয়ে ফেরা–এ কি কম কথা?
গজেন্দ্রগমনে তারপর তো আমার রাজধানীতে ফিরলাম। বাচ্ছা মাহুত বার্লি ব্যগ্র হয়ে আমাদের প্রতীক্ষা করছিল। এখন অতগুলো বাঘ আর বাঘান্তক আমাকে দেখে বারংবার সে নিজের চোখ মুছতে লাগল। এরকম দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।
খবর পেয়ে মহারাজ! ছুটে এলেন। বাঘদের হাওদা থেকে নামানো হলো। ততক্ষণে তাদের জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু হাত পা বাঁধা–বন্দী নেহাৎ! নইলে, পারলে পরে, তারাও বার্লির মতো একবার চোখ কচলে ভাল করে দেখবার চেষ্টা করতো।
এতগুলো বাঘকে আমি একা স্বহস্তে শিকার করেছি, এটা বিশ্বাস করা বাঘদের পক্ষেও যেমন কঠিন, মহারাজ!র পক্ষেও তেমনি কঠোর! কিন্তু চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে দেখলে অবিশ্বাস করবার কিছু ছিল না।
কেবল বার্লি একবার ঘাড় নাড়বার চেষ্টা করেছিল–এতগুলো বাঘকে আপনি একলা হাতিয়ার নেই, কুছ নেই–বৃহৎ তাজ্জব কি বাত…!
আরে হাতিয়ার নেই, তো কি, হাত তো ছিল? বাধা দিয়ে বলতে হলো আমায়! আর, তোমার হাতির পা-ই তো ছিল হে! তাই কি কম হাতিয়ার? বাঘগুলোকে সামনে পাবামাত্রই, বন্দুক নেই টক নেই করি কি, হাতির কাঠের পা-খানাই খুলে নিলাম। খুলে নিয়ে দু-হাতে তাই দিয়েই এলোপাথাড়ি বসাতে লাগলাম। ঘা কতক দিতেই সব ঠাণ্ডা! হাতির পদাঘাত–সে কি কম নাকি? অবশ্য তোমাদের হাতিকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। বলবামাত্র পেছনের পা দান করতে সে পেছ পা হয়নি। আমিও আবার কাজ সেরে তেমনি করেই তার ইস্ট্রাপ লাগিয়ে দিয়েছি। ভাগ্যিস, তুমি হাতিটার কেঠো পায়ের কথা বলেছিলে আমায়।
অম্লান বদনে এত কথা হাতির দিকে চোখ তুলে তাকাতে আমার লজ্জা করছিল। হাতিরা ভারি সত্যবাদী হয়ে থাকে। এবং নিরামিষাশী তো বটেই তাদের মতো সাধুপুরুষ দেখা যায় না প্রায়। ওর পদচ্যুতি ঘটিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি এই মিথ্যা কথায় কেবল বিরক্তি নয়, ও যেন রীতিমত অপমান বোধ রকছিল। এমন বিষ-নজরে তাকাচ্ছিল আমার দিকে যে-কি বলব! বলা বাহুল্য, তারপর আমি আর ওর ত্রিসীমানায় যাইনি।
হাতিরা সহজে ভোলে না।