বিজ্ঞাপনে কাজ দেয়
টুসিকে নিয়ে আবার মুশকিল হয়েছে ঘনশ্যামবাবুর। রবিবার দিন আফিসের তাড়া নেই, তাই একটু দেরি করে ওঠেন তিনি। সেদিনও সাতটা বাজিয়ে উঠেছেন; উঠে দেখেন টুসির কোন পাত্তা নেই। যা সন্দেহ করেছিলেন তাই, পকেট হাতড়ে দেখলেন ট্রামের মান্থলিখানাও হাওয়া।
ছুটির দিনে ভোরে উঠেই হাওয়া খেতে বেরিয়েছে টুসি।
ফিরল বারোটা বাজিয়ে–প্রায় একটার কাছাকাছি।
ছিলি কোথায় এতক্ষণ? আমার মান্থলি নিয়ে বেরিয়েছিস? কতদিন বলেছি এটা বে-আইন; তাছাড়া মান্থলির মধ্যে আমার…
বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে গেছলাম। সাড়ে দশটার শো-এ সিনেমা দেখে ফিরছি… জানালো টুসিঃ বুঝলে দাদু, ছবিটায় কি মারামারি কাটাকাটি… উঃ, কি মারামারি যে কী বলব।
বুঝেছি। কিন্তু মান্থলির খাপের ভেতর দুশো কত টাকা ছিল না?
দুশো সাত টাকা ছিল যেন। কিন্তু এখন আর তা নেই। আমরা বন্ধু মিলে সিনেমা দেখলাম? আর এতক্ষণ অব্দি না কিছু খেয়ে থাকা যায়? রেস্তোরাঁয় খেতেও হলো। বেশি খাই নি দাদু, একখানা করে মোগলাই পরোটা আর প্লেট করে কষা কারি।
কেতাত্থ করেছে! এখন দাওতো আমার মান্থলি আর দুশো টাকা!
পকেটে হাত দিয়ে টুসি আঁতকে ওঠে–ওমা, কোথায় গেল মান্থলিটা। এ পকেট ও পকেট হাতড়ায়। প্যান্টের পকেট পর্যন্ত।
নাঃ, হাফ প্যান্টের পকেটেও তো নেই। নিশ্চয় পড়ে গেছে কোথাও। ট্রামেই পড়েছে নিশ্চয়।
দুখানা একশো টাকার নোট ছিল যে রে। আর খুচরো সাত টাকা।
সাত টাকা আর নেই, বলেছি তো।
দুশো টাকাই রয়েছে যেন। রাগে উথলাতে থাকেন ঘনশ্যাম,–পড়ে গেছে না হাতি! বন্ধুদের কেউ হাতিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়। যা সব বন্ধু! নয় তো কেউ পকেট মেরেছে নির্ঘাত।
আমার বন্ধুরা তেমন নয়–টুসির প্রতিবাদ–তারাও আমায় খাওয়ায়, সিনেমা দেখায়, তাই আমিও তাদের দেখালুম। আর আমার পকেট মারবে এমন কেউ জন্মায় নি এই কলকাতায়।
তুই নিজেই ত পকেটমার। আমার পকেট সাফ করাই তো তোর কাজ। বদ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে দিনকে দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছিস। তোকে আমি ত্যজ্যপুত্র করব।
ত্যজ্যপুত্র কি করে হবে দাদু? আমি তো তোমার পুত্র নই।
ত্যজ্যনাতি করে দেব তোকে।
ত্যজ্যনাতিও হয় না দাদু। শুনি নি কোনকালে।
হয় না, হবে। হলেই দেখতে পাবি। আমার সব বিষয়-আশয় থেকে বঞ্চিত করব তোকে।
বিষয়-আশয় আমার চাইনে দাদু। ও নিয়ে আমি কি করব? বলে টুসি। সত্যি, দাদুর বিষয়ের কোন আশায় সে করে না, সে বিষয়ে তার উৎসাহই নেই, কেবল দাদুর পকেটই তার লক্ষ্যস্থল। সেই সম্বল বজায় থাকলেই ঢের।
আমি তোর অনেক অত্যাচার সয়েছি, কিন্তু আর না। আজই আমি খবর-কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি যে তোর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই…এখুনি আমি চললাম কাগজের আপিসে।
খবরের কাগজে যাচ্ছোই যখন দাদু, তখন ঐ সঙ্গে মান্থলিটার জন্যেও একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দাও না–এই বলে যে যদি কোন সদাশয় ভদ্রলোক আমার মান্থলি টিকিটটি খুঁজিয়া পান তাহা হইলে দয়া করিয়া…।
দয়া করিয়া! সে আমি বুঝবো। তোমাকে আর উপদেশ দিয়ে আমার মাথা কিনতে হবে না।
কেন, পাওনি একবার খুঁজে? সেই যেবার হারিয়ে গেছলাম, রাত দুপুরে তোমার কলিকের ওষুধ কিনতে গিয়ে, খবর-কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাওনি আমায় তুমি? বিজ্ঞাপন দিতে না দিতেই তো পেয়ে গেছলে আমাকে। বিজ্ঞাপনে কাজ হয় দাদু।
সে কথা কানে না তুলে ঘনশ্যাম বেরিয়ে পড়েন। তা এখানে কি করতে শুনি? শুধান বটকেষ্ট।
একটা বিজ্ঞাপন দিতে এসেছি ভাই। বোলা না আর। বখা ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নাতিটা আমার গোল্লায় গেছে। বিজ্ঞাপন দিয়ে ভাবছি ওকে ত্যজ্যপুত্র করে দেব। ত্যজ্যপুত্র বা ত্যজ্যনাতি যাই বলো!
ও বাবা।এ যে দেখছি নাতিবৃহৎ ব্যাপার। বটকেষ্ট অবাক হলো–পুঁচকে একটা নাতিকে নিয়ে একটা বৃহৎ কান্ড বাধিয়েছে দেখছি।
নইলে ছেলেটা মানুষ হবে না। বাপ-মা-মরা ছেলে-অসৎ সঙ্গে মিশে অধঃপাতে যেতে বসেছে। ঐ বিজ্ঞাপনটা দিলে ভাবছি ও শুধরোবে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবস্থা করে দেওঘর কি কনখল, গুরুকুলে কি রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে কোনো আশ্রমে পাঠিয়ে দেব ওকে সেখান থেকে সৎসঙ্গে যদি ছেলেটা মানুষ হয় কোনোদিন। আমার কাছে আদরে মানুষ হয়েছে। কিন্তু দেখছি, ঠিকই বলে থাকে সবাই, আদর দিয়ে ছেলের মাথা খাওয়া হয় কেবল। আমি আর টুসির মুখ দেখব না ঠিক করেছি।
To see ro not to see? কিন্তু ও যাবে আশ্রমে?
না গিয়ে উপায় কি? ছাপার অক্ষরে যখন দেখবে ওর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তারপর আশ্রম থেকে ওকে নিতে এসেছে….ভাল কথা, তুমি এখানে কেহ হে?
একটা কুকুর হারানোর বিজ্ঞাপন দিতে ভাই। অ্যালসেসিয়ান কি কোন নামী জাতের কুকুর নয়, এমনি দেশী কুকুর কিন্তু দেখতে ভাল। আর ভারী প্রভুভক্ত। ভারী মায়া পড়ে গেছে কুকুরটির ওপর আমার। কেউ খুঁজে দিতে পারলে নগদ পাঁচশো টাকা পুরস্কার দেবার বিজ্ঞাপন।
দিয়েছ বিজ্ঞাপন।
দশটার সময় এসে দিয়ে গেছি…
দিয়েছ তো! তা এখন আবার এই বেলা দুটোর সময় কি? তোমার বিজ্ঞাপন তো ছেপে বেরুবে কাল সকালের কাগজে।
তা তো জানি, তবে বিজ্ঞাপনটার খবর নিতে এসেছিলাম।
ও, তার প্রুফ দেখতে চাও বুঝি?
কিন্তু এসে দেখছি, যে কর্মচারিটির কাছে বিজ্ঞপনটা দিয়েছিলাম সে লোকটা নেই। বিজ্ঞাপন বিভাগে সকাল দশটায় সাতটা লোক দেখেছিলাম এখন তাদের একটাও দেখছিনে। কী যেন জরুরি কাজে বেরিয়ে গেছেন সবাই।
বিভাগে তা হলে আছে কে এখন?
কেবল বেয়ারা। সে তো কোন খবর দিতে পারে না। অপেক্ষা করছি তাই তো।
তা হলে তো আমাকেও অপেক্ষা করতে হবে দেখছি।
কিন্তু কাঁহাতক অপেক্ষা করা যায়? অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা আবার সেই বিজ্ঞাপন-বিভাগে গিয়ে হানা দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন বেয়ারাকে কর্তারা সব কি জরুবী কাজে বেরিয়েছেন জানতে পারি কি?
কুকুর খুঁজতে বেরিয়েছেন সবাই।
কুকুর।
হ্যাঁ, আমিও বেরুতাম, কিন্তু আপিস ফাঁকা রেখে যাই কি করে? কুকুরটার জন্য নগদ পাঁচশো টাকার বকশিস আছে মশাই।
কিন্তু কুকুর তো… বলতে গিয়ে বাধা পান বটকেষ্ট। ঘেউ ঘেউ করতে করতে বিজ্ঞাপন বিভাগের এক কর্মচারী এসে উপস্থিত। যার হাতে, বটকেষ্টবাবু বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন, তিনিই। তার ঘেউল্কারই বাধা দিল।
তিনি নন, তার সঙ্গীটিই ঘেউ ঘেউ করছিল।
এই নিন মশাই আপনার কুকুর। খুঁজে খুঁজে হয়রান। বলেন ভদ্রলোক–এবার পুরস্কারটা বার করুন তো দেখি।
সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিভাগের আরেকজন এসে হাজির আর একটা কুকুর নিয়ে। আবার আনকোরা ঘেউ ঘেউ।
তারপর আরোও একজন। তিনিও একটাকে খুঁজে এনেছেন।
সাতজন এলেন একে একে–সাতটা কুকুর সাথে নিয়ে।
বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্তা সাতটা কুকুর লম্বা দড়ায় বেঁধে এনেছেন। যেমন ঢেউ এর পর ঢেউ আসে, তেমনি ঘেউ-র পর ঘেউ ঘেউ আসতে লাগল।
দারুণ হৈ চৈ পড়ে গেল সারা আফিসে। সবারই দাবি নগদ পুরক্ষারের।
নিন আপনার কুকুর–বেছে নিন এর ভেতরে থেকে। আর দিয়ে দিন পুরস্কারের টাকাটা। আমার বাঁটোয়ারা করে নেব সবাই।
কিন্তু আমি তো কুকুর নিতে আসি নি। আমি সেই বিজ্ঞাপনটার সম্পর্কেই বলতে এসেছিলাম।
বলুন তা হলে।
বিজ্ঞাপনটা আমি আর দিতে চাই না। ওটা আমি ফেরত চাই। বিজ্ঞাপন দিতে না দিতেই কুকুরটা আবার ফিরে এসেছে–নিজের থেকেই কখন এসে গেছে।
বিজ্ঞাপনে কাজ হয়, বলছিল টুসি। মনে পড়ে ঘনশ্যামের।
ফিরে এলে চলবে কেন। এসব কুকুর এখন কে নেবে তাহলে? বিজ্ঞাপন বিভাগের ভদ্রলোকেরা প্রশ্ন তোলেন–আর আমাদের প্রাপ্য পুরক্ষারেই বা কী হবে? কুকুর তো আমরা এনেছি এখন নেওয়া না নেওয়া আপনার মর্জি। সব এরা দেশী কুকুর, নেড়ি কুত্তা–যেমনটি আপনি চেয়েছিলেন।
কিন্তু এদের তো আমি চাই না…বোঝাতে যান বটকেষ্টবাবু–আমার নিজেরটিকেই চাই।
দারুণ ঘেউ ঘেউ শুনে এর মধ্যে আফিসের বড়কর্তা বেরিয়ে এসেছেন।
এখানে এত হট্টগোল কিসের? এসেই তিনি তম্বি করেন।
ইনি…এঁর কুকুর সব…নিয়ে যেতে বলছি এঁকে। ইনি নিচ্ছেন না কিছুতেই।
নিয়ে যান আপনার কুকুরদের। হুকুম দেন বড় কর্তা–দারোয়ান, ইন লোককো নিকাল দেও।–
দারোয়ানরা এসে দড়িসমেত কুকুরগুলো বটকেষ্ট জড়িয়ে দেয়–নিয়ে যান আপনার কুকুর মশাই। আপনি আমাদের চাকরি খাবেন দেখছি।
কুকুরের দলবলসহ বটকেষ্টকে তারা গলির মোড় অবধি পার করে দিয়ে আসে। তারপর, সদলবলে বটকেষ্ট চলে গেলে আসেন আরেক ভদ্রলোক।
হারানো—প্রাপ্তি–নিরুদ্দেশ বিভাগে আমি একটা বিজ্ঞাপন দিতে এসেছি।
দিন, বিজ্ঞাপন-বিভাগ থেকে তাঁকে বলা হয়–কিন্তু আমরা কুকুর- হারানো কোনো বিজ্ঞাপন নেব না। কুকুরের বিজ্ঞাপন একদম নেওয়া হয় না।
না না, কুকুর নয়। হারানোর বিজ্ঞাপনও না। আমি একটা ট্রামের মান্থলি টিকিট খুঁজে পেয়েছি। আজ বেলা সাড়ে বারোটার সময় ট্রামের মধ্যেই পড়েছিল মান্থলিটা।
বিশদ বিবরণ দিন। বিজ্ঞাপন-বিভাগের কর্মচারী কপি লিখে নিতে তৈরি হন।
মান্থলিটার খাপে G-H G-H মার্কা মারা…
জি-এইচ জি-এইচ? লাফিয়ে ওঠেন ঘনশ্যাম–ও তো আমার মান্থলি। আমার নাম ঘনশ্যাম ঘাই। তারই আদ্যাক্ষর জি-এইচ জি-এইচ।
তাই নাকি? বলুন তো আর কি ছিল সেই মান্থলির ভেতরে?
একশো টাকার দু-খানা নোট-মোট দুশো টাকা। কিছু খুচররাও থাকতে পারে। নোটের নম্বর দিতে পারি তবে তার জন্যে দয়া করে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে হবে একবার। আমার নোটবুকে টোকা আছে নম্বর।
তার দরকার নেই–এই নিন আপনার মান্থলি আর টাকাটা। বিজ্ঞাপন দেওয়ার খরচটা আমার বেঁচে গেল মশাই, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকেও। আমিও ঐ মান্থলির জন্যই বিজ্ঞাপন দিতে এসেছিলাম। আমার নাতি বলছিল যে বিজ্ঞাপন দিলে নাকি কাজ হয়। তা, দেখছি ব্যাপারটা সত্যি!
ভারী বুদ্ধিমান তো আপনার নাতি!
সে কথা বলতে। অমন ছেলে আর হয় না। তিনি গালভরা হাসি হাসেন– এমন কি বিজ্ঞাপন না দিয়েও কেবল দিতে এলেই কাজ হয় তাও দেখলাম।