স্বচ্ছ শেষ স্তবক

স্বচ্ছ শেষ স্তবক

তৈমুরের মৃত্যুর পর তার তৈরি মানুষের কাটা মাথার স্তুপ দিয়ে তৈরি পিরামিডের দিকে কেউ ফিরেও তাকালো না। কেউ সেটা যত্ন নেওয়ার চিন্তা ও করলো না। কেউ আসলো একটি বারও।

তখন পর্যন্ত প্রায় দশ লক্ষ কর্তিত মস্তক দিয়ে তৈরি নয়টি পিরামিডের স্তুপ ছিলো। সেগুলো কয়েক বছরের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রথমত খুলির নরম অংশগুলোতে পচন ধরে। তারপর এর বাইরে রাসায়নিক যে আস্তরণ দেওয়া হয়েছিলো তাতে ক্ষয় ধরে। এর পর যে সুতো দিয়ে খুলিগুলো একটার সাথে আরেকটাকে বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো সেই সুতোগুলোও ঢিলে হয়ে আসে। এভাবে খুলির পিরামিডটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এছাড়া শীতকালীন ঝড়, বন্য পশুর আক্রমণে এক সময়ে এই পিরামিডের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু খুলির এ পিরামিড নিয়ে এক ধরনের ভীতিকর আতঙ্ক মানুষের মধ্যে ঠিকই থেকে যায়।

এরপরেও মূল পিরামিডের বিস্ময় নিয়ে নানা ধরনের কাহিনী চক্রাকারে বেড়েই যাচ্ছিলো।

তবে ভবিষ্যতে কী ঘটবে কিংবা অতীতে আসলে কী ঘটেছিলো এ নিয়ে কেউই তেমন সঠিক ধারণা করতে পারলো না। অবশেষে মানুষ ধরে নিলে সময়ের আবর্তে পিরামিড নিয়ে এ রহস্যের জাল ক্রমশঃই বুনতে থাকবে আর বড় হতে থাকবে। তার ডালপালা গজাবে। চারদিকে ছড়াবে।

এক সকালে খুব সুন্দর পরিপাটি চুলের এক পর্যটক পিরামিডগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে এলো।

সে নানা দিক থেকে পিরামিডের ছবি তুলছিলো। হঠাৎ করেই তার মাথায় একটা চিন্তা এলো। সে ভাবলো ঐতিহাসিক এ স্মৃতিস্তম্ভটা সবার কাছে আরো স্বচ্ছ হওয়া বিশেষ দরকার।

এর ভেতর কী আছে।

কী রহস্য মতো যুগ যুগ ধরে এর ভেতরে আর বাইরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

পিরামিডের ভেতরের সব কিছু যেমন পাথরের কফিন, মমি, গোলকধাঁধার বারান্দা, গোপন কুঠুরি, রহস্যময় ঘর, সব কিছুই স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার।

সে ছবি তুলছিলো আর বাইরের পৃথিবীতে গুটিগুটি করে সময় এগুচ্ছিলো। যতোই দিন শেষ হচ্ছিলো পিরামিডটা ততোই অস্পষ্ট আর কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসছিলো। ভেতরে ভেতরে সেই পর্যটক ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছে।

একটা একটা করে মুহূর্ত পার হচ্ছে আর সে ভাবছে হয়তো যে কোনো সময় অদৃশ্য ভীতিকর কোনো কিছুর সামনে সে পড়ে যাবে। অথবা ছবি তোলার সময় সে কোনো প্রেতাত্মার ছবি তুলবে।

এক সকালে পর্যটক পিরামিডের ছবি তুলতে চাইলো। সে ছবি তুললো অনেকগুলো। তারপর ছবিগুলো দেখলো। সে সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করলো।

ছবিগুলোতে পিরামিডটাকে আসলেই স্বচ্ছ কাচের মতো লাগছিলো। তবে একটা অংশ খুব রহস্যময় মনে হলো। ছবিতে দেখা গেলো পিরামিডের উত্তর পূর্ব দিকের ঢালু জায়গাটিতে নবম সারিতে একটা অংশ একটু ত্রুটি যুক্ত।

সে ঐ ছবিটাকে আরো বেশ কয়েকবার ভালোভাবে পরিষ্কার করলো। অবশেষে সে বুঝতে পারলো চার হাজার বছর আগের তৈরি পিরামিডের এই ছবিটির ত্রুটি যুক্ত এ অংশটি আসলে ছবি তোলার জন্য হয় নি।

বরং পিরামিডের এ অংশটিতে এমন এক রক্ত ঝরানো চিহ্ন আছে যাকে শতবার পানি কিংবা এসিড দিয়ে ধৌত করলেও এই রক্তের দাগ কিছুতেই পরিষ্কার হবে না।

ঘাম আর রক্ত ঝরানো এই চিহ্ন কিছুতেই মোছা যাবে না। আর তা কখনো পরিষ্কার হবে না।

তিরানা, প্যারিস, ১৯৮৮-১৯৯২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *